রাজকন্যের সন্ধানে – ১৫

অভীক দত্ত

“ওই মেয়েটা তোমার বিবি?”

ড্যানিয়েলের জ্ঞান ফিরতে প্রথম এই প্রশ্নটাই শুনল সে।

মাথায় অসহ্য ব্যথা করছে। কিডন্যাপিঙের সময় মাথায় কিছু একটা দিয়ে জোরে মারা হয়েছিল। চোখ খুলে দেখল একটা বেশ বড় ঘর। তাকে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। ঘরের এক কোণে কয়েকটা বাচ্চা মেঝেতে শুয়ে আছে।

তাকে যে প্রশ্নটা করেছে, তার বয়স মেরেকেটে আঠেরো হবে। অত্যন্ত সুপুরুষ এক যুবক, নীল চোখ। কৌতূহলী গলায় তাকে প্রশ্নটা করেছে ছেলেটা।

ড্যানিয়েল মাথা নাড়ল।

ছেলেটা বলল, “তোমাদের দেশে মেয়েরা এভাবে পরপুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়?”

ড্যানিয়েল কাতর গলায় বলল, “জল”।

ছেলেটা যত্ন করে তাকে জল খাইয়ে দিল। ড্যানিয়েল বলল, “এটা কোথায়?”

ছেলেটা বলল, “বলা যাবে না। হুজুর বলতে বারণ করেছে”।

ড্যানিয়েল বলল, “তোমার নাম কী?”

ছেলেটা বলল, “আরিফ”।

ড্যানিয়েল বলল, “তোমার অর্গানাইজেশন?”

আরিফ বলল, “আমরা মুজাহিদিন। তুমি জানো এটা আমার প্রথম কাজ ছিল? কী মজা পেয়েছি”।

ছেলেটা সরল। কথাটা বলে এত খুশি হল যেন সে বিরাট কোন কাজ করে ফেলেছে। ঝরঝরে ইংরেজি বলছে। ড্যানিয়েল বলল, “আমার মাথা থেকে কি খুব ব্লিডিং হচ্ছে?”

আরিফ বলল, “হয়েছিল। দাওয়াই দিয়েছেন হুজুর। সেরে যাবে”।

ড্যানিয়েল ঘরের চারপাশে দেখতে চেষ্টা করল। কোন একটা জায়গা থেকে আজানের শব্দ আসছে। এটা কি কোন মসজিদ? সে দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করল। এনা ঠিক আছে তো? থাকা উচিত। এরা তাকে তুলে নিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস এনাকে নিয়ে বেরোয় নি সে।

সে দ্রুত স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল, “শোন আরিফ”।

আরিফ আগ্রহী গলায় বলল, “বলুন”।

ড্যানিয়েল বলল, “তোমার হুজুরকে ডাকো। আমি কথা বলতে চাই। বল ভীষণ জরুরি”।

আরিফ বলল, “ঠিক আছে। আমি দেখছি”।

আরিফ বেরিয়ে গেল।

ঘরটায় কোথাও কোন জানলা নেই। জানলা থাকলে বাইরেটা দেখে খানিকটা ধারণা করা যেতে পারে।

মিনিট পাঁচেক পর দশ বারোজনের একটা দল এল। তাদের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক মানুষটার চোখে সুরমা, বড় দাড়ি, দাড়িতে মেহেন্দি করা। তার সামনে এসে বসল।

ড্যানিয়েল বলল, “আমাকে তুলে আনার কোন মানে হয় না”।

মৌলানা তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “মানে হয় নাকি সেটা আমি আপনি ঠিক করার কেউ না। আল্লাহপাক ঠিক করে দেন”।

ড্যানিয়েল বলল, “কী করবেন আমাকে নিয়ে?”

মৌলানা হাসল, “সেটাও উনিই ঠিক করবেন। আমরা কী করি? আমরা জেহাদ করি। ওর দেখানো পথে”।

ড্যানিয়েল বলল, “উনি এভাবে মারতে বলেন নিরীহ মানুষকে?”

মৌলানার চোখ জ্বলে উঠল এবার, “আফগানিস্তানে তালিবান দমনের নামে বোম ফেলে ফেলে শিশু হত্যা করেছে তোমাদের দেশ, ইরাকে, সিরিয়ায়, গোটা পৃথিবীতে কত গরীব মুসলমান মারা গেছে। নিউটনের থার্ড ল, নাথিং এলস”।

ড্যানিয়েল বলল, “আপনি নিউটনও জানেন?”

মৌলানা হাসল, “কেন জানব না? সব কি তোমাদের পশ্চিমী দেশের মানুষেরাই জানে?”

ড্যানিয়েল বলল, “দেখুন, আপনাকে একটা কথা বলি। আমাদের দেশের সরকার যেমন ইরাক, সিরিয়া কিংবা আফগানিস্তানে অ্যাটাক করে, একইভাবে আমাদের দেশে এমন প্রচুর মানুষ আছে, যারা এই সব কিছুর প্রতিবাদ করে। যারা যুদ্ধ চায় না। আমি জার্নালিস্ট, আপনি আপনাদের কথা আমার মাধ্যমে গোটা পৃথিবীকে বলত পারবেন, সেটা না করে এভাবে কেন আটকে রেখেছেন?”

মৌলানা বলল, “আমাদের পবিত্র মাটিতে তোমাদের ঢুকতে দেব না বলে। ও হ্যাঁ, সি আই এ আমাদের দুজনকে আটকে রেখেছে। আমরা যোগাযোগ করেছি। তাদের ফেরত না পেলে তোমাকে আর দেশে ফিরতে হবে না ইনশাল্লাহ”।

মৌলানা জোরে হেসে উঠল। সঙ্গে বাকিরাও।

ড্যানিয়েল বলল, “শুনুন মিস্টার, আমি যেদিন সি এন এন জয়েন করেছিলাম, সেদিন থেকেই জানি এভাবেও মরতে হতে পারে। ওসব ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। বরং এটুকু জানবেন, আমার কিছু হলে অ্যাবটাবাদে যেভাবে লাদেনকে কুকুরের মত মারা হয়েছিল, সি আই এ আপনাদের তার থেকেও খারাপ অবস্থা করতে পারে”।

মৌলানা উঠ ড্যানিয়েলের মুখে থুতু দিল। বাকিদের বলল, “এটাকে এত মারো, যেন না মরে বেঁচে থাকে। জিন্দা লাশ বানিয়ে দাও”।

১৬

দাসুতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।

একটা ছোট বাড়িতে আশ্রয় নিল তারা।

মাটির বাড়ি। মেঝেতে কার্পেট পেতে দেওয়া হয়েছে। যত রাত হচ্ছে, শীত জাঁকিয়ে পড়ছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে সৈকত বসে আছে। বাকিরা নামাজ পড়ে নিল।

কাওয়া চা দেওয়া হল তাদের। সৈকত চা খেয়ে বলল, “পাড়ার দোকানের চা বড় মিস করছি। তোমরা কেউ ইন্ডিয়া গেলে আমাদের পাড়ায় নিয়ে যাব”।

খালেদ বলল, “আমি দিল্লি গেছি একবার। দিল্লি খুব ভাল জায়গা না। খুব কস্টলি”।

সৈকত বলল, “এর পর গেলে কলকাতায় এসো। আমি ঘুরিয়ে দেখাবো। যেমন সস্তা জায়গা, তেমন ঘুরে মজা”।

হামিদ বলল, “যদি বেঁচে ফিরি, তবেই”।

সৈকত বলল, “কেন বেঁচে ফিরব না? জীবনে আছেটা কী মিয়াঁ? অত ভয় পেলে চলে?”

হামিদ তার মোবাইল বের করে সৈকতের হাতে দিল, “গ্যালারিতে যাও। গিলগিটে কীভাবে পাকিস্তানি আর্মি চেক পোস্ট বসিয়েছে, দেখো”।

সৈকত হামিদের ফোন নিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি দেখে হামিদকে ফোন ফেরত দিয়ে বলল, “গিলগিটে পৌঁছে টেনশন নেব। এখন টেনশন নিতে যাব কেন? এক্সিট রুট কী হবে? চিফ বলেছিলেন এক্সিট রুট ইফতিকার মিয়াঁ ঠিক করবে”।

ইফতিকার বলল, “আপনাদের দুজনকে শ্রীনগর পৌঁছনোর দায়িত্ব আমার। বর্ডার পার করিয়ে দেব”।

সৈকত চোখ ছোট করল, “কীভাবে? এতো ছেলের হাতের মোয়া না।”

ইফতিকার বলল, “তখন দেখা যাবে”।

হামিদ নিজের মোবাইল ঘাঁটছিল। সৈকত দেখল এক বাচ্চার ছবি। বলল, “তোমার ছেলে?”

হামিদ বলল, “ছিল। এখন কোথায় আছে, জানি না”।

ইফতিকার হামিদের কাঁধে হাত রাখল।

খালেদ মেঝেতে শুয়েছিল। অনেকটা পথ গাড়ি চালিয়ে সে ক্লান্ত। বলল, “হামিদ যখন ইসলামাবাদে ছিল, ওর ফ্যামিলি গিলগিটেই ছিল। লস্করের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা লাগে। ওদের গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল ওরা। হামিদের ফ্যামিলির কেউ আর বেঁচে নেই এখন”।

সৈকত বলল, “ওহ, আই অ্যাম সো সরি”।

খালেদ বলল, “আর ইফতিকার মিয়াঁর ঘটনাটা শুনলে কী বলতে তুমি?”

ইফতিকার রেগে গেলেন, “আহ, খালেদ!”

খালেদ চুপ করে গেল।

থমথমে আবহাওয়া হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ইফতিকার উঠে বাইরে চলে গেলেন।

খালেদ দরজাটা দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “পাকিস্তানী আর্মি ওর বিবিকে তুলে নিয়ে গেছিল। পরের দিন নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া গেছিল”।

সৈকত বলল, “তা সত্ত্বেও গিলগিট সেভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে নি। এটা তো একটা ঘটনা না। আরও অসংখ্য ঘটনা আছে। আমি যতবার গিলগিটে গেছি, প্রতিবার কোথাও না কোথাও শিয়া মসজিদ ভাঙার ঘটনা আছে”।

হামিদ বলল, “গিলগিটে বাল্টিস্তানে শুধু পাক আর্মি অ্যাক্টিভ না। তার সঙ্গে লস্কর আছে, হিজবুল আছে। গিলগিটে আর কত মানুষ আছে? কে এদের আর্মস দেবে? এরা আর উপায় না দেখে ইরানে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের।”

খালেদ বলল, “আজ যতটা আরামে এলাম, কাল এতটা আরাম থাকবে না। রাস্তার হাল ভীষণ খারাপ সামনে”।

সৈকত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ইফতিকার ঘরে ঢুকে বলল, “ওই জার্নালিস্টকে নিয়ে পাকিস্তান গভর্নমেন্টের উপর চাপ তৈরী করছে মার্কিনীরা। ইলিয়াস ফোন করেছিল”।

হামিদ বলল, “কার কাজ জানা গেল কিছু?”

ইফতিকার বলল, “লস্কর। ওরা এখন খুব অ্যাক্টিভ হয়েছে এদিকে। তার পবিত্র গিলগিটে মার্কিনীরা আসুক, মৌলানা নিশ্চয়ই চাইবে না”।

হামিদ বলল, “মৌলানা মানুষ না। পাক্কা শয়তানের বাচ্চা একটা। কোন দিন যদি হাতের কাছে পেতাম, বন্দুকের সবক’টা কার্তুজ ওর ভিতরে ভরে দিতাম। শেষ করে দিল আমাদের সব কিছু”।

রাগে হামিদের মুখ লাল হয়ে গেল।

ইফতিকার বলল, “খালেদ একবার পারমিটটা আমাকে দাও তো”।

খালেদ বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ইফতিকারকে দিল।

ইফতিকার কাগজটা বের করে দেখে সৈকতকে বলল, “ঠিক আছে। এটার সঙ্গে হয়ত আমাদের চারজনের পরিচয়পত্রও দেখবে ওরা। আপনি আপনার পরিচয় মুখস্ত করে নিন”।

সৈকত ঘাড় নাড়ল, “একদম চিন্তা নেই। কিন্তু এ পারমিট কী করে জোগাড় করলেন?”

খালেদ ফিক ফিক করে হাসতে লাগল।

সৈকত বুঝল না। বলল, “জাল নয়ত?”

খালেদ আবার হাসতে শুরু করল।

১৭

ফাজিয়া তার ঘরে চুপ করে শুয়েছিল। জানলা খোলা। শীতল হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে।

তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই।

তার মন একেবারেই ঠিক নেই।

ঘরের দরজা খুলে তার খালা ঢুকল। বলল, “আজমত সাব এসেছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আর তুমি জানলা বন্ধ কর নি কেন?”

ফাজিয়া বলল, “আমার আজমত সাবের সঙ্গে দেখা করার কোন ইচ্ছা নেই। ওঁকে চলে যেতে বল”।

খালা জানলা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “আজমত সাব সব সামলাচ্ছেন এখন। তোমার বাবার মৃত্যুর পরে উনিই তো দেখছেন। ওর কথা না শুনলে হয়, বল?”

ফাজিয়া তেতো মুখে খালার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে হিজাব পরে বাইরের ঘরে গেল।

আজমত বসে আছে। তার বাবার মৃত্যুর পর গিলগিট বাল্টিস্তানের শিয়াদের নেতা হয়েছে আজমত।

তাকে দেখে দাঁত বের করল, “সব সালামত তো বেটী?”

ফাজিয়া বলল, “জি”।

আজমত বলল, “আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। কিন্তু মা ভেবে দেখো, ইয়াসির সাবের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমরা শিয়ারা কিছুদিন অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবো। গোটা দেশে শিয়াদের উপর অনেক অত্যাচার হচ্ছে। গিলগিটে এখন শান্তির পরিবেশ। একমাত্র তুমিই পারো এই উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে”।

ফাজিয়া বলল, “আমি তো শান্তি চাই না”।

আজমত চমকে উঠল, “মানে?”

ফাজিয়া বলল, “আমি কোন দিন শান্তি চাই না। একে শান্তি বলে না। কবরস্থানে যেমন শুধু মৃত মানুষ ছাড়া আর কেউ থাকে না, গিলগিটেও তেমন শিয়ারা এখন মৃত প্রজাতি হয়ে গেছে। তাদের মতের অমতে পাকিস্তানী আর্মি বাড়ি থেকে তাদের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, ছেলেদের মুজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি করে দেচ্ছে। এই শান্তি আমি চাই নি, আব্বুও চায় নি। আপনার লজ্জা করে না চাচা? আয়নায় মুখ দেখেন কী করে নিজের? ছেলেকে তো তেহরানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মেয়েকেও। আর আমাকে জোর করে এই সমঝোতার বিয়ে করতে বলছেন। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় আমার আব্বুকে খুনের পেছনে আপনারও হাত ছিল কিনা”।

আজমত রেগে গেল, “তুমি এগুলো কী বলছো?”

ফাজিয়া শান্ত গলায় বলল, “আমি ভেবে চিন্তে বলছি। একটা কথাও বাড়িয়ে বলছি না”।

আজমত থমথমে মুখে উঠে দাঁড়াল, “তাহলে তো আমার এখানে থাকার কোন প্রয়োজন খুঁজে পাচ্ছি না আমি”।

ফাজিয়া বলল, “আপনাকে আমি দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসি নি চাচা”।

আজমত বেরোতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা জিপ এসে দাঁড়াল। আজমত ফ্যাকাসে গলায় বলল, “ইয়াসির সাব এসেছেন”।

ফাজিয়া বলল, “ভাল তো। যান, পোষা কুকুরের মত পা চাটুন”।

আজমত রেগে গেলেও কিছু বলল না, ইয়াসির ড্রইং রুমে ঢুকে ফাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “বসতে পারি”?

আজমত বলল, “বসুন জনাব। আপনারই তো বাড়ি”।

ইয়াসির চেয়ারে বসে ফাজিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “দেশ বিদেশের মিডিয়া আসবে এই বিয়ে কভার করতে। চ্যানেলে চ্যানেলে দেখানো হবে। এক ঐতিহাসিক বিয়ে হবে”।

আজমত তেলতেলে গলায় বলল, “হুজুর সব আপনাদের মেহেরবানি”।

ইয়াসির বলল, “আজ সন্ধ্যেয় একটা ইন্টারভিউ নেওয়া হবে বেগমের। আশা করব উনি যেন গিলগিটের শান্তির পক্ষে সওয়াল করেন। আর্মি এবং এখানকার অধিবাসীরা ঐক্যের যে শপথ নিচ্ছে, তা প্রচার করেন”।

আজমত বলল, “নিশ্চয়ই জনাব। তাই হবে”।

ফাজিয়া শক্ত হয়ে বসে ছিল।

ইয়াসির বলল, “বেগমের কি কিছু লাগবে? দামী পাথর কিংবা কসমেটিক্স? আমি তাহলে ইসলামাবাদ থেকে আনার ব্যবস্থা করব”।

ফাজিয়া ঘাড় নেড়ে না করে দিল।

আজমত বলল, “জনাব, আমাদের বিটিয়া লজ্জা পাচ্ছে। আপনার যা আনার, তা তো আপনি আনবেনই”।

ইয়াসির ঘাড় নাড়ল, “বেশক। ঠিক আছে, আমি উঠি এখন। কোন দরকার পড়লে খবর দেবেন। চলে আসব”।

ফাজিয়া মাথা নাড়ল।

ইয়াসির বেরিয়ে গেল। তার সঙ্গে আজমত লেজ নাড়াতে নাড়াতে বেরোল।

ফাজিয়া ঘরে এসে হিজাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খাটে শুয়ে কাঁদতে লাগল।

তার কিচ্ছু ভাল লাগছিল না।

১৮

ইসলামাবাদ।

পাক বিদেশমন্ত্রী আবু সাইদের সাংবাদিক সম্মেলন ভিড়ে গিজগিজ করছে।

আবু সাইদ সম্মেলন কক্ষে ঢুকে গম্ভীর মুখে বসে বললেন, “গতকাল রাওয়ালপিন্ডির র্যাডিসন থেকে সি এন এনের সাংবাদিককে কিডন্যাপিং এর তদন্ত আমরা শুরু করেছি। খুব শীঘ্রই ড্যানিয়েল মুক্তি পাবে ইনশাল্লাহ”।

প্রশ্নবাণ ছুটে আসতে শুরু করল।

“কারা এই কিডন্যাপিঙে যুক্ত স্যার?”

“লস্কর যদি রাওয়ালপিন্ডি থেকে অপারেট করতে পারে, তাহলে তারা সেটা পাকিস্তান সরকারের মদত ছাড়া কী করে করছে?”

“গিলগিটে কর্নেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিদেশী সাংবাদিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?”

আবু সাইদ বললেন, “দেখুন, আপনারা ভুল করছেন। ড্যানিয়েলকে যে লস্করই কিডন্যাপ করেছে, সে সম্পর্কে কোন সলিড এভিডেন্স নেই। লস্কর একবারও দায় স্বীকার করে নি। কোন বিবৃতিও দেয় নি। স্থানীয় কোন গুন্ডাবাহিনী মুক্তিপণের লোভেও করতে পারে। আমরা সব রকম পরিস্থিতি বিবেচনা না করে কিছু বলতে পারি না”।

“স্যার, লস্কর ছাড়া পাকিস্তানে এই মুহূর্তে একশো পঁয়ত্রিশটা মুজাহিদিন বাহিনী অপারেট করছে। এদের সম্পর্কে পাকিস্তানী গভর্নমেন্ট কী স্টেপ নিয়েছে?”

আবু সাইদ রেগে গিয়ে বললেন, “যা পারছেন, বলে দিলেই হল? একশো পঁয়ত্রিশটা মুজাহিদিন বাহিনীর নাম দিতে পারবেন?”

“হ্যাঁ পারব স্যার। বলব?”

আবু সাইদ বললেন, “বলতে হবে না। মনগড়া কাহিনী পাকিস্তানকে ডিফেম করার জন্য বলে গেলেই হয় না। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পাকিস্তানকে শান্তির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শিয়া কিংবা সুন্নী, কোন সম্প্রদায়ই পাকিস্তানে নিরাপত্তাহীন নয়। গিলগিটে কর্নেলের বিয়েটা তারই প্রমাণ দেয়”।

“স্যার, এই বিয়েতে শিয়া কন্যার কি মত আছে, না জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে?”

আবু সাইদ বললেন, “আমি এই নিয়ে কোন কথা বলব না। আমার অন্য মিটিং আছে। এখানেই প্রেস কনফারেন্স শেষ করা হল”।

একগাদা প্রশ্নের মধ্যে থেকেই কনফারেন্স রুম ছেড়ে বেরোলেন আবু সাইদ। তার পেছন পেছন তার সেক্রেটারি জাহির ছুটছিল। আবু সাইদ রাগী গলায় বললেন, “মৌলানার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফোন করেছিলেন প্রাইম মিনিস্টারকে। সরাসরি হুমকি দিয়েছেন, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ড্যানিয়েলকে খুঁজে না বের করতে পারলে পাকিস্তানে ওদের সেনা নামবে”।

জাহির বলল, “স্যার মৌলানাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না”।

আবু সাইদ বললেন, “মৌলানাকে না পাওয়া গেলে ওদের সেকেন্ড কম্যান্ড ইন চিফকে খবর পাঠাও। দে নিড টু ফ্রি ড্যানিয়েল অ্যাট এনি কস্ট। এ কি ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি?”

জাহির বলল, “সেকেন্ড কম্যান্ড ইন চিফ রাশিদ সম্ভবত গিলগিটেই গেছে”।

আবু সাইদ থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, “মানে? এ কি বিয়েতে অ্যাটেন্ড করবে নাকি? ইয়ার্কি হচ্ছে?”

জাহির বলল, “জনাব, আর্মি জানিয়েছে এই বিয়েতে সব রকম ভাবে লস্করের ইনভলভমেন্ট আটকে দেওয়া হয়েছে। তবু কিছু তো লুপ হোলস থেকেই যায়”।

আবু সাইদ রাগী চোখে জাহিরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন, “গাড়ি বের কর। প্রাইম মিনিস্টারের গালি খেয়ে আসি”।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানে পৌঁছলেন আবু। প্রধানমন্ত্রী উচ্চ পর্যায়ের মিটিং করছিলেন। সে মিটিং বন্ধ করে আলাদা ঘরে আবু সাইদের সঙ্গে মিটিং এ বসলেন।

চিন্তিত গলায় বললেন, “কী আপডেট? কোন খবর পাওয়া গেল?”

আবু সাইদ বললেন, “লস্কর ই তৈবা জনাব। এটুকুই জানা গেছে। বাকি কিছুই জানা যায় নি”।

প্রধানমন্ত্রী দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললেন, “ইয়া আল্লা। এবার আমরা কী করব? সি আই এ কাবুল কান্দাহারে বসে আছে শুধু উপরওয়ালার একটা নির্দেশের অপেক্ষায়। ওদের স্যাটেলাইট আমাদের প্রতিটা গতিবিধি নজরে রাখছে। কী করার আছে সাইদ?”

সাইদ ম্লান হেসে বললেন, “জনাব আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাই। আর্মি চিফ নিজে বলেছিলেন গিলগিটের বিয়েতে লস্করের কেউ থাকবে না। এখন শুনতে পাচ্ছি সেখানেও ওদের লোক থাকবে। ইন্ডিয়া তো ছেড়ে দিন, গোটা ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া আমাদের ছিঁড়ে খাবে”।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, “উই নিড টু টেক স্টেপ। নাও। চিফকে জানিয়ে দাও, ওদের হাতে বারো ঘন্টা সময় আছে। হয় লস্করকে বলে এই সব অসভ্যতা বন্ধ করুক, নয়ত আমার কোন উপায় থাকবে না সি আই এ কে গ্রীণ সিগন্যাল দেওয়া ছাড়া। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু হিয়ার”।

সাইদ বললেন, “ওকে স্যার”।

প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত মুখে বসে রইলেন।

১৯

ইসলামাবাদ সেক্টর সেভেন।

ভোর রাত।

ইলিয়াসকে হোটেল থেকে পুল কার নামিয়ে দিয়ে গেল।

ইলিয়াস গাড়ি থেকে নামতেই একটা জিপ এসে দাঁড়াল। ইলিয়াস দেখে বুঝল আই এস আই এর লোক। সে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল।

গাড়ি থেকে একজন তার দিকে রিভলভার তাক করে বলল, “উঠে এসো”।

ইলিয়াস চুপচাপ গাড়িতে উঠে পড়ল।

কেউ কোন কথা বলছে না। ইলিয়াস চুপ করে রইল।

কিছুক্ষণ পর শহর ছাড়িয়ে একটা পোড়ো বাড়িতে এসে গাড়িটা দাঁড়াল।

একজন তার পিঠে রিভলভারের খোঁচা মেরে বলল, “চল”।

ইলিয়াস গাড়ি থেকে নামল। তাকে পোড়ো বাড়িতে ঢুকিয়ে একটা চেয়ারে বসানো হল। ঘরে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে।

খানিকক্ষণ পর একজন লোক এল। প্রফেসরের মত তার চেহারা। নীল চোখ। দেখে মনে হবে না আই এস আইতে আছে। মনে হতে পারে এখনই কবিতা লিখতে বসে যাবে।

লোকটা ইলিয়াসের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, “আমি আলি। আপনি ইলিয়াস। ভাল আছেন আপনি?”

ইলিয়াস বলল, “জি জনাব। নাইট ডিউটি করে খানিকটা ক্লান্ত”।

আলি বলল, “র্যাডিসনের চিফ শেফ আপনি। আমি একবার বউকে নিয়ে র্যাডিসনে খেয়েছিলাম। রান্না বেশ ভাল। আপনার লিডারশিপ কোয়ালিটি ইজ গুড। মানতে হবে”।

ইলিয়াস বলল, “র্যাডিসনে হাই কোয়ালিটি মেইন্টেন করা হয় জনাব। বিভিন্ন বিদেশী গেস্ট আসে। আমাদের দেশের যাতে কোন রকম নাম খারাপ না হয়, তার চেষ্টা থাকে সব সময়”।

আলি মাথা নাড়ল, “গুড। তো ইলিয়াস, আপনি আমাকে বলুন, সি এন এনের জার্নালিস্ট ড্যানিয়েলের অপহরণ যেদিন হল, সেদিন আপনি ছুটি নিয়েছিলেন কেন?”

ইলিয়াস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে ভেবেছিল তাকে সৈকতের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে।

ইলিয়াস বলল, “জি জনাব আমার শরীরটা খারাপ ছিল সেদিন”।

আলি বলল, “ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?”

ইলিয়াস বলল, “না জনাব। প্যারাসিটামল খেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যদি তারপরেও জ্বর না কমে, তাহলে হাসপাতালে যাব”।

আলি বলল, “আর কোথাও যান নি?”

ইলিয়াস বলল, “না জনাব”।

আলি বলল, “আপনার স্টাফেদের মধ্যে কাউকে সন্দেহ হয়, যারা লস্কর বা কোন টেররিস্ট অরগানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে?”

ইলিয়াস ঘাড় নাড়ল, “না জনাব। আমার সেটা মনে হয় না। র্যাডিসনের স্টাফ বেশ ভাল। তাছাড়া আমাদের সময় কোথায়? সর্বক্ষণ দৌড়ের মধ্যে থাকতে হয়”।

আলি মাথা নাড়ল, “তা ঠিক। আপনার স্পেশালিটি কী?”

ইলিয়াস বলল, “মুঘলাই হুজুর”।

আলি বলল, “আমাদের অফিসারদের পার্টিতে আপনাকে ডাকা হলে ম্যানেজ করে আসতে পারবেন?”

ইলিয়াস ঘাড় নাড়ল, “নিশ্চয়ই জনাব। একবার ডাকলেই চলে আসব”।

আলি কয়েক সেকেন্ড ইলিয়াসের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল, “ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে লাস্ট মানডে আপনি কেন গেছিলেন?”

ইলিয়াসের এবার বুক খানিকটা কাঁপল। তবু যতটা সম্ভব স্বাভাবিক মুখ করে বলল, “হাইকমিশনে একটা ডেলিগেশন টিম আসছে ইন্ডিয়া থেকে। তারা একটা ছোট পার্টি অ্যারেঞ্জ করতে চায়। সেই ব্যাপারেই আমি গেছিলাম”।

আলি বলল, “আপনার হোটেল ম্যানেজমেন্ট জানাচ্ছে তারা এই ব্যাপারে কিছু জানতেন না। আপনি নিজে থেকেই গেছিলেন? কাকে চেনেন ওখানে?”

ইলিয়াস বলল, “জি জনাব আমার ভাই কাজ করত ওখানে। ওর সূত্রে আলাপ হয়েছিল”।

আলি বলল, “আপনার ভাই এখন কোথায়?”

ইলিয়াস বলল, “তেহেরানে থাকে জনাব। ভাইয়ের কার্পেটের ব্যবসা”।

আলি বলল, “ইন্ডিয়ান এমব্য্যাসিতেঁ আপনার ভাই কী করত?”

ইলিয়াস বলল, “সেটা ভাল করে জানি না। তবে ওই কেনা বেচার সূত্রেই যেত মনে হয়। হাইকমিশনারের স্ত্রীর কাশ্মীরি কার্পেট খুব পছন্দ ছিল। সেসব ব্যাপার কিছু ছিল। অতো জিজ্ঞেস করি নি কোন কালে”।

আলি বলল, “ঠিক আছে। আপনি আমার নাম্বার রাখুন। দুটো কাজ করবেন। এক, আপনার ভাই এলে আমাকে ফোন করতে বলবেন। দুই, র্যাডিসনে কোন রকম কোন ক্লু থাকলে আমাকে জানাবেন। ক্লিয়ার?”

ইলিয়াস বলল, “ক্লিয়ার স্যার”।

আলি বলল, “আপনাকে ওরা নামিয়ে দিয়ে আসবে। ভাল থাকুন। খুদা হাফিজ”।

ইলিয়াস বলল, “খুদা হাফিজ জনাব”।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন