রাজকন্যের সন্ধানে – ৫

অভীক দত্ত

খানিকটা গিয়ে জাভিদই তাদের গাড়িটাকে বাঁ দিকে দাঁড় করিয়ে দিল।

আর্মির গাড়িটা তাদের পাত্তাও না দিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল।

সৈকত জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, “বাঁচা গেল মাইরি”।

জাভিদ বলল, “আপনাকে আরেকবার বলে রাখছি, এখানের পুলিশ বা আর্মি, যেই আমাদের গাড়ি দাঁড় করাক, আপনি কোন কথা বলবেন না। যা বলার আমি বলব”।

সৈকত বলল, “ঠিক আছে”।

জাভিদ গাড়ি স্টার্ট দিল।

অন্ধকার নেমে এসেছে। সৈকত বলল, “ইরানে কত বছর আছো তুমি?”

জাভিদ বলল, “বারো বছর”।

সৈকত বলল, “তার আগে কোথায় ছিলে?”

জাভিদ বলল, “কাশ্মীর”।

সৈকত বলল, “উহু, তেহেরান আর কাশ্মীরের মাঝে। দিল্লিতে ছিলে তুমি। তাই না?”

জাভিদ সামান্য চমকে গিয়ে বলল, “আপনি কী করে বুঝলেন?”

সৈকত বলল, “তোমার গায়ে পুরনো দিল্লির গন্ধ লেগে আছে। আমি গন্ধ পাই। কুকুর স্বভাব আমার”।

জাভিদ বলল, “অসম্ভব। এরকম হতেই পারে না। মানুষের মধ্যে এরকম কিছু হয় নাকি?”

সৈকত বলল, “তোমার কী ধারণা আমাকে এমনি এমনি এত বড় মিশনে চিফ সিলেক্ট করেছেন? নিশ্চয়ই কিছু আছে। তাই না?”

জাভিদ বলল, “আপনি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছেন”।

সৈকত জোরে হেসে উঠে বলল, “তা ঠিক, আন্দাজেই বটে। আসলে চাঁদনী চকের সেফ হাউজে কিছুদিন আমিও তো ছিলাম। কেন জানি মনে হল, তুমিও ছিলে ওদিকেই”।

জাভিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল এবার, “পারমিন্দর আছে এখনো ওখানে?”

সৈকত বলল, “নাহ। চিফ এখন ওর পোস্টিং কানাডাতে করে দিয়েছে। পাকিস্তান এমব্যাসির সামনে ঘুর ঘুর করা ছাড়া ওর কোন কাজ নেই”।

জাভিদ বলল, “ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারত। আমারও তো বয়স হচ্ছে”।

সৈকত বলল, “আমি চলে আসব। এই মিশন থেকে যদি বেঁচে ফিরি, তাহলে আমিই তেহরানে থেকে যাব না হয়! খারাপ হয় ব্যাপারটা?”

জাভিদ বলল, “আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন। তাছাড়া বয়সেও ছোট। গিলগিটে গিয়ে আপনি কী করবেন, আল্লাই জানে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। বেশি বকবক করলে আমার কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়ে যাবে। এ রাস্তা বেশ দুর্গম”।

সৈকত তৎক্ষণাৎ হাই তুলে গাড়ির সিটে শুয়ে পড়ল।

তার ঘুম ভাঙল যখন, তখন ভোর হয়েছে। গাড়ি দাঁড় করানো। জাভিদ গাড়ি থেকে নেমে চোখে মুখে জল দিচ্ছে।

সৈকত বলল, “জাভিদ মিয়াঁ, এসে গেলাম নাকি?”

জাভিদ বলল, “আর খানিকটা গিয়ে জাহেদান এয়ারপোর্ট। ওখানে একটা হোটেলে আপনি দু ঘন্টা থাকবেন। তারপর আপনাকে নিয়ে বর্ডারের দিকে রওনা দেব”।

সৈকত বিস্মিত গলায় বলল, “যাহ শালা, জাহেদানে এয়ারপোর্ট আছে? তাহলে আমাকে এতটা রাস্তা গাড়িতে করে নিয়ে এলে কেন?”

জাভিদ বলল, “আমার কাছে যা ইন্সট্রাকশন আছে, সেটা মেনে চলেছি। আলাদা করে কিছু বলা হয় নি। আপনি ওখানে পৌছে কাউকে ফোন করার হলে করে নেবেন। ইসলামাবাদে ইলিয়াসের বাড়ি পৌঁছনোর আগে কাউকে ফোন করবেন না। মনে থাকবে?”

সৈকত বলল, “যাহ, আমাকে পাথরের কাছে দাঁড় করাবে না?”

জাভিদ বলল, “চেপে বসে থাকুন। হোটেলে গিয়ে যা করার করবেন”।

সৈকত কাঁধ ঝাঁকাল।

খানিকক্ষণ পরে একটা তিনতলা হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয় জাভিদ বলল, “চলুন”।

সৈকত গাড়ি থেকে নামল।

জাভিদ সন্তর্পণে চারদিকে দেখে নিয়ে তাকে নিয়ে হোটেলের ভিতর প্রবেশ করল। রিসেপশনিস্টের সঙ্গে গুজগুজ করে একটা চাবি নিয়ে সৈকতকে দোতলার একটা রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “রুমে ফোন আছে। ফোন করলে করুন। আমি দু ঘন্টা পরে আসছি। ব্রেক ফাস্ট পাঠিয়ে দেব। খেয়ে নেবেন। কোয়েটায় ঢুকে কখন কী খাবেন, তা তো জানা নেই, তাই পেট ভরে খেয়ে নেবেন”।

সৈকত বলল, “ঠিক হ্যায়”।

জাভিদ বেরিয়ে গেল।

সৈকত দরজা বন্ধ করে জয় ত্তারা বলে বিছানায় ঝাঁপ দিল।

আবার চোখ বন্ধ হয়ে গেল ঘুমে।

ঘুম ভাঙল কলিং বেলের শব্দে। উঠে দরজা খুলে দেখল জাভিদ বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে, “আপনার তো মরার মত ঘুম। সেই কখন থেকে ডাকছি। হোটেলের ছেলেটা ব্রেকফাস্ট নিয়েও ঘুরে গেছে। আপনি রেডি? ফোন টোন করেছেন?”

সৈকত চোখ মুছতে মুছতে বলল, “ও। ফোন করার ছিল না? বাদ দাও। কাকে আর ফোন করব? কে বা আছে আমার? চল বাড়ি যাই”।

জাভিদ বলল, “বাড়ি না। আপনি পাকিস্তান যাবেন”।

সৈকত বলল, “ওই একই হল। যা বাড়ি, তাই পাকিস্তান। চল ভাই। শুভারম্ভ করি”।

পাক অধিকৃত কাশ্মীর। গিলগিট। লস্কর ট্রেনিং ক্যাম্প।

দুপুর বারোটা। যদিও বারোটা বেজেছে, তবে মাঝে মাঝেই তীব্র শীতল হাওয়া দিচ্ছে। আকাশে তেমন রোদ নেই।

একশোটা ছেলেকে একসঙ্গে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। ছেলেগুলোর বয়স বারো থেকে ষোলোর মধ্যে। শীতের মধ্যে সবাই জোব্বা পরে ট্রেনিং করছে।

প্রত্যেকের হাতে অত্যাধুনিক বন্দুক। দশটা চাঁদমারি বানানো হয়েছে। দশটা দলে দশজন করে ছেলেকে রাখা হয়েছে। এক একজন এসে সুশৃঙ্খলভাবে চাঁদমারিতে নিশানা করছে। এই ছেলেদের মুখে শৈশব, কৈশোরের কোন লেশমাত্র নেই। যেন একশোটা রোবোট।

লস্কর কমান্ডার বিলাবল খান কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোন ভুল করলে জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।

ট্রেনিং ক্যাম্পের পাশে পাকিস্তান আর্মির একটা জিপ এসে দাঁড়াল। লেফটেনান্ট কর্নেল ইয়াসির হুসেন জিপ থেকে নেমে ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

বিলাবল খান কড়া ভাষায় ছেলেগুলোকে ট্রেনিং চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ইয়াসির হুসেনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

ইয়াসির বলল, “সিক্সটিন্থ ফাইনাল?”

বিলাবল বলল, “ফাইনাল কিনা আপনি বলবেন জনাব। আমরা তো সব সময় তৈরী”।

ইয়াসির ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “সিক্সটিন্থে ওদের মুজফফরাবাদে পাঠিয়ে দেবেন। শ্রীনগরে ইন্ডিয়ান আর্মির কড়া পাহাড়া থাকে। আমরা ওদিকটা অ্যাভয়েড করব। ম্যাপ ট্রেনিং করিয়েছেন?”

বিলাবল ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে হাসল। ইয়াসির বলল, “কী হল? আমার সময়ের দাম আছে। হাসছেন কেন?”

বিলাবল দঙ্গলের মধ্যে থেকে একটা ছেলেকে চেঁচিয়ে ডাকল, “আসিফ”।

ছেলেটা ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিলাবলের সামনে এসে হাজির হল।

বিলাবল বলল, “অমৃতসর থেকে দিল্লি কীভাবে যেতে হয়?”

ছেলেটা গড়গড় করে বলে গেল।

বিলাবল ইয়াসিরের দিকে তাকাল।

ইয়াসির সন্দিগ্ধ চোখে বিলাবলকে বলল, “শুধু এই জানে? বাকিরা?”

বিলাবল বলল, “ঠিক আছে। আপনি যে কোন একজনকে ডাকুন”।

ইয়াসির তীক্ষ্ণ চোখে দঙ্গলের মধ্যে থেকে একজন অপেক্ষাকৃত ছোট ছেলেকে ডাকল। ছেলেটার উচ্চতা চারফুট দশ এগারো হবে। চোখের মণি নীল রঙের। শরীরের থেকে হাতের বন্দুকের ওজন বেশি।

ছেলেটা এসে দাঁড়ালে ইয়াসির বলল, “কী নাম তোর?”

ছেলেটা বলল, “সোবাহান আলি”।

ইয়াসির বলল, “ফাইন। তো সোবাহান আলি, ভুবনেশ্বর থেকে গুয়াহাটির রুটটা বল দেখি। কী করে যেতে হয়”?

সোবাহান আগের ছেলেটার মতই সুন্দর করে বলে গেল।

এবার ইয়াসিরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল।

বিলাবল বলল, “এবার খুশি তো জনাব?”

ইয়াসির বলল, “হ্যাঁ। দশটা করে ছেলে এক একটা ব্যাচে ইন্ডিয়ার একেকটা শহরে ছড়িয়ে পড়বে। এই ক্যাম্পের সব ক’টা ছেলেকে আমার ইন্ডিয়ার কোণায় কোণায় চাই খান”।

বিলাবল বলল, “আপনি যেমন চাইবেন, তেমনই হবে জনাব। কিন্তু আমার উপহারটা?

ইয়াসির ভ্রূ কুঁচকাল, “কীসের উপহার?”

বিলাবল বলল, “শুনলাম আপনি গিলগিট নেতা সুলেমানের মেয়ের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হচ্ছেন। আমার সেখানে নিমন্ত্রণ নেই জনাব?”

ইয়াসির বলল, “জারনালিস্ট থাকবে। ওই কী সব আমেরিকান জারনালিস্টও থাকবে। ওখানে তোমাকে চিনতে পারলে সমস্যা হবে”।

বিলাবলের চোখ জ্বলে উঠল, “যারা আমাদের ধর্মের লোকেদের খুঁজে খুঁজে মেরে ফেলছে, তাদের আপনি দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছেন?”

ইয়াসির বলল, “আমি করছি না। সরকার করছে। ট্রাডিশনাল বিয়ে হবে, গোটা পৃথিবী দেখবে আমরা কীভাবে জঙ্গীদের হাতে মৃত শিয়া নেতার মেয়েকে পুনর্জীবন দিই। আশা করি ব্যাপারটার গুরুত্ব এবার তুমি বুঝেছো”।

বিলাবল গোঁয়ারের মত বলল, “ঠিক আছে, আমি ছদ্মবেশে থাকব। তবু থাকবো”।

ইয়াসির বলল, “ঠিক আছে। তা বলে কোন রকম আর্মস নিয়ে এসো না। বাইরের বিশ্বকে আমাদের দেখাতে হবে আমরা এই ভূমিতে শান্তি আনার চেষ্টা করছি। অনুষ্ঠানের দশদিন আগে গিলগিটের প্রতিটা বাড়িতে গিয়ে আমরা নেমন্তন্ন করে আসব। তাদের মুখে যেন দুঃখের কোন চিহ্ন না থাকে। পাকিস্তানী আর্মি যে কাশ্মীরের ইন্ডিয়ান আর্মির থেকে অনেক বেশি মানবিক, তা আমাদের দেখাতেই হবে”।

বিলাবল বলল, “বিলকুল জনাব। তা হবু স্ত্রীর সঙ্গে আপনার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?”

ইয়াসির বিরক্ত গলায় বলল, “সেটা জেনে তুমি কী করবে? আমার বিবির ব্যাপারে তুমি জানবে কেন?”

বিলাবল বলল, “গুস্তাখি মাফ জনাব”।

ইয়াসির বলল, “যাও, ওদের ট্রেইন করাও। সব ব্যাপারে জানার চেষ্টা করবে না। আবু সাইদ কালকেও তোমার ব্যাপারে আমার কাছে খোঁজ নিচ্ছিল। আমি বলেছি তুমি এখানে ভাল কাজ করছো। আশা করি নিজের গুড উইল নষ্ট করবে না”।

আবু সাইদের নাম শুনে বিলাবলের মুখ এমন হল যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল।

সে গুটিয়ে গেল।

ইয়াসির আর বিলাবলকে পাত্তা না দিয়ে নিজের জিপের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

অ্যাবটাবাদ, পাকিস্তান।

রাত আটটা।

মৌলানা বরকতউল্লাহ তার ঘরে বসে ক্রিকেট দেখছিল। আফগানিস্তান বনাম আয়ারল্যান্ড। মৌলানা আফগানিস্তানের লোক।

কাবুলে আমেরিকা বোমা বর্ষণ শুরু করায় পেশোয়ার হয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। আগে ট্রেনিং দেখত, পরে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অপারেশন সামলায়।

দরজায় তিনটে নক পড়ল।

বরকত বলল, “এসো”।

একজন উনিশ বছরের ছেলে প্রবেশ করে বরকতকে সেলাম করল। বলল, “আমাকে ডেকেছিলেন হুজুর?”

মৌলানা বলল, “হাফিজকেও নিয়ে এসো”।

ছেলেটা বেরিয়ে গিয়ে আরেকটা ছেলেকে ডেকে নিয়ে এল।

দুজনে ঘরে ঢুকে মৌলানার অনুমতি নিয়ে মৌলানার পায়ের কাছে বসল।

মৌলানা বলল, “শুনলাম গিলগিটে বিভিন্ন দেশের জার্নালিস্ট আসছে?”

হাফিজ একটা ট্যাব নিয়ে এসেছিল। উঠে মৌলানার হাতে ট্যাবটা দিয়ে বলল, “এরা সবাই আসবে”।

মৌলানা সোয়াইপ করে একটার পর একটা ছবি দেখে হাফিজকে ট্যাব ফেরত দিয়ে বলল, “গিলগিটের রাস্তা তো খুব দুর্গম, তাই না হাফিজ?”

হাফিজ মাথা নাড়ল, “জি হুজুর”।

মৌলানা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। ধরল ফোনটা, “কে?”

“হুজুর আমি বিলাবল বলছি”।

বিলাবলের নাম শুনে মৌলানার মুখে হাসি ফুটল, “বল। আমাদের শেররা তৈরী হয়েছে?”

“বিলকুল হুজুর। একশোটা বাঘ তৈরী করেছি। এবার আর্মি চিফের সঙ্গে কথা বলে ওদের কাশ্মীরে ঢোকানোর অপেক্ষা শুধু”।

“বহুত খুব। ইয়াসির হুসেন তার বিয়েতে দাওয়াৎ দিয়েছে?”

ও প্রান্তে খানিকটা নীরবতা।

মৌলানা বলল, “তওবা তওবা। দেশ বিদেশের কাফেরদের দাওয়াত দিল আর তার দেশের জন্য যারা জীবন দিয়ে দিচ্ছে, তাদেরই বলল না?”

বিলাবল বলল, “বলে নি হুজুর। থাকলেও ছদ্মবেশে থাকতে হবে। মিডিয়া জানলে নাকি বিশ্বের সামনে পাকিস্তানের নাক কাটা যাবে”।

“গেলে যাবে”, মৌলানা চিৎকার করে উঠল, “যে দেশে বাইরে থেকে আমেরিকান সেনা এসে আমাদের লোকেদের মেরে চলে যায়, সেই আর্মির কাছে আমাদের শিখতে হবে কার সঙ্গে কী ব্যবহার করতে হবে? কাপুরুষ না-মর্দের দল যত। আমাকে বল তুমি, তোমার প্ল্যান কী। বল”।

বিলাবল বলল, “ইয়াসির বলল পাকিস্তান সরকার চায় না ওই দিন কোন রকম ঝামেলা হোক। সব রকম নিরাপত্তা দিতে হবে বাইরে থেকে আসা অতিথিদের”।

মৌলানা বলল, “নিরাপত্তা? নিজেদের মানুষেরা যখন আমেরিকার বোমের আঘাতে মুড়ি মুড়কির মত মরে যায়, তখন কোথায় থাকে এদের আতিথেয়তা? পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকেও আমেরিকান সিকিউরিটিরা ওদেশে ঢোকার আগে জামা প্যান্ট খুলে সার্চ করবে। আর আমাদের লোকেরা আতিথেয়তা দেখাচ্ছে? লজ্জা!”

বিলাবল বলল, “জনাব আমার হাত পা বাঁধা। আমি কিছু করতে পারবো না। গিলগিটের ট্রেনিং ক্যাম্পে এখনো অনেক আর্মস দরকার, ইয়াসির হুসেন কথা দিয়েছে আর্মসের ব্যবস্থা ওই করে দেবে। এখানকার গভর্নর সাহেবও আসবে। গিলগিটে ওদের কিছু করা সম্ভব না”।

মৌলানা বলল, “ঠিক আছে, ওরা গিলগিটে দাওয়াত খেয়ে ওখান থেকে সহি সালামাত বেরোলেই তো পাকিস্তান সরকারের নাক ঠিক থাকবে, তাই তো?”

বিলাবল বলল, “জি হুজুর, ওরা ওদের দেশ পর্যন্ত সহি সালামাত গেলে তবেই পাকিস্তান সরকারের নাক ঠিক থাকবে”।

মৌলানা বলল, “ওসামা বিন লাদেনকে যেদিন এই শহরে আমেরিকান সেনা কুকুরের মত খুন করেছিল, সেদিন পাকিস্তান সরকারের নাক ঠিক ছিল? হ্যাঁ কি না?”

বিলাবল বলল, “হুজুর ইয়াসির হুসেন বলছে…”

মৌলানা চেঁচিয়ে উঠল, “আমি যা জিজ্ঞেস করছি, তার জবাব দাও বিলাবল। ওসামা বিন লাদেনকে অ্যাবটাবাদে যেদিন আমেরিকান সেনা কুকুরের মত খুন করেছিল, সেদিন পাকিস্তান সরকারের নাক ঠিক ছিল? হ্যাঁ কি না?”

বিলাবল থতমত খেয়ে বলল, “না হুজুর”।

মৌলানা বলল, “তাহলে এর পরে কী হবে, সেটা আমরা ঠিক করব”।

বিলাবল ও প্রান্তে বলল, “কাজটা ঠিক হবে হুজুর?”

মৌলানা ফোন কেটে দিল।

ধুলো বালির মধ্যে দুটো চেক পোস্ট। মাঝে বেশ উঁচু দেওয়াল।

পাথুরে মুখে টহল দেওয়া সৈন্যের দল।

ঝা চকচকে চওড়া রাস্তায় একটার পর ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।

জাহেদান চেক পোস্টের এক কিলোমিটার আগে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল জাভিদ। সৈকতকে বলল, “আপনার যা জিনিসপত্র আছে, এই গাড়িতে রেখে যান। এই ব্যাগটা আপনার জন্য, এখানে এক লাখ পাকিস্তানী রূপী আছে। পঞ্চাশ হাজার রূপী পাকিস্তানী চেকপোস্টেই যাবে, বাকিটা কাছে রাখবেন। পথে লাগবে”।

একটা ছোট ব্যাগ দিল জাভিদ।

ব্যাগটা নিয়ে সৈকত বলল, “তাহলে এখানেই বিদায়, জাভিদ মিয়াঁ?”

জাভিদ বলল, “আমাদের সবার আশা আপনার উপরে। আশা করি আপনি সফল হবেন। আরেকটা কথা, আপনার কাছে যথেষ্ট পাকিস্তানী রূপী থাকলেও আপনি কোন ভাবেই এরোপ্লেনে ইসলামাবাদ যাবেন না, আশা করি কেন সেটা বলে দিতে হবে না। আপনার পাকিস্তানী পাসপোর্ট আছে, তেহরানে ব্যবসা করতে গেছিলেন। এটাই পাকিস্তানী চেকপোস্টে বলবেন, ঠিক আছে?”

সৈকত বলল, “দেখা যাক। আপাতত ইরান থেকে বের করার ব্যবস্থা তো কর মিয়াঁ”।

জাভিদ গাড়ি স্টার্ট দিল, “ইরান থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা আমার হাতে, আপাতত পাকিস্তান বর্ডারে বেফাঁস কিছু বলবেন না”।

সৈকত হাতের পাসপোর্টটা দেখতে দেখতে বলল, “এত উঁচু দেওয়াল বানিয়েছে কেন ইরান?”

জাভিদ হাসল, “ও দেশ থেকে টেরোরিস্টরা মাঝে মাঝেই গুলি চালায়। পাকিস্তানের থেকে আর কী এক্সপেক্ট করা যায়?”

সৈকত বলল, “পাকিস্তানের উপর তোমার খুব রাগ, তাই না? সবাই কিন্তু খারাপ না মিয়াঁ”।

জাভিদ গম্ভীর হল, “যে দেশ আমার বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু দিতে পারে না, সে দেশের ওপর রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। ইন্ডিয়াতেও অনেক মানুষ আছে যাদের বেঁচে থাকার অধিকার আপনাদের সরকার দিতে পারে না। মাঝখান থেকে বলি হয় আমাদের মত মানুষেরা। চলুন”।

গাড়ি দাঁড় করাল জাভিদ। গাড়ি থেকে নেমে দুজনে হাঁটতে শুরু করল। পাথুরে মাটি। হাঁটার জন্য মোটেও ভাল নয়। দেশের এ প্রান্ত কঠোর নিরাপত্তায় রাখা হয়। ইরানের সেনা সংখ্যার প্রাচুর্য চোখে পড়ার মত। পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারীরা কোন ভাবেই যেন এ দেশে ঢুকে পড়তে না পারে, তার জন্য যথেষ্ট কঠোর ইরানের সেনাবাহিনী।

সৈকত হাঁটতে হাঁটতে ফুরফুরে মেজাজে গান গাইতে শুরু করল।

জাভিদ বলল, “আপনি টেনশন কমাতে গান করেন?”

সৈকত বলল, “কীসের টেনশন? আবার পাকিস্তানে যাচ্ছি, ভাবতেই আমার আনন্দ হচ্ছে। আহা, কত কাবাব, কত ভাল ভাল খাবার খাব আবার”।

জাভিদ বলল, “গুলিও খুব সুখাদ্য”।

সৈকত বলল, “ওসবে ভয় পাই না। কাল সকালেই আমি কোয়েটায় পৌঁছে যাব। আহা আফসার ভাইয়ের বিরিয়ানি! আহা!”

জাভিদ কঠিন গলায় বলল, “আপনাকে বার বার বলা হয়েছে এবারে আপনি কোন চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা করবেন না”।

সৈকত বলল, “তাও ঠিক”।

ইরান চেকপোস্টে পৌঁছে জাভিদ সৈকতকে অফিসের বাইরে দাঁড় করিয়ে ভিতরে গেল। কিছুক্ষণ পর বাইরে বেরিয়ে বলল, “কপাল ভাল, তেরোদিন পরে বর্ডার খুলেছে আজকে। এমদাদ আলি স্যার আছেন চেক পোস্টে। আমার পরিচিত। এখানে আপনার কোন অসুবিধা হবে না”।

সৈকত জাভিদকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আবার দেখা হবে”।

জাভিদ প্রতি আলিঙ্গন করল না। শুধু বলল, “যদি দুজনের কেউ বেঁচে থাকি, তবেই”।

সৈকত বলল, “উইল মিট ইন হেল দেন। আলভিদা বন্ধু”।

জাভিদ বলল, “আলভিদা”।

সৈকত ইরানের কাস্টমস অফিসে প্রবেশ করল।

জাভিদ চুপ করে একজন অফিসার এগিয়ে এসে বললেন, “রুবায়াত পাশা?”

সৈকত মাথা নাড়ল।

অফিসার হাত বাড়ালেন, “আলি। জাভিদ আপনার কথা বলেছেন। আসুন”।

একটা ঘরে নিয়ে তাকে বসানো হল। বেশ কয়েকটা ফর্ম ফিল আপ করিয়ে ইরানের সিলমোহর পড়ল তার পাসপোর্টে।

ইরানের গেট খুলল তার জন্য। একমাত্র সে ছাড়া আর কেউ এই সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করল না। তুলনায় ও দেশ থেকে ইরানে ঢোকার লাইন বেশ বেশি।

দেওয়াল আর নো ম্যান্স ল্যান্ড পেরিয়ে সৈকত যখন পাকিস্তানের গেটের দিকে এগোতে শুরু করল, হালকা বালি ঝড় হচ্ছে। বালোচ প্রদেশে আগেও এসেছে সৈকত। তার কোন কিছুই অচেনা লাগছিল না।

পাকিস্তানের গেট পেরোতে তার দিকে তাকিয়ে একজন পাকিস্তানী সেনা বলল, “ভাল দেশেই তো ছিলে? আবার পাকিস্তান এলে কেন? কোন পাগল কুকুরে কামড়েছিল?”

সৈকত মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল, “নিজের দেশ মহান, ফিরতে তো হবেই মিয়াঁ”।

সেনা বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিল। বোঝাই যাচ্ছিল এই ঝামেলার প্রদেশে কাজ করতে তার মোটেও ভাল লাগছে না। একে ইরানের সেনার চাপ থাকে, তার উপর পাকিস্তানের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের প্রবল চাপ।

পাসপোর্ট চেক, কাগজপত্র মিলিয়ে দেখা ইত্যাদি মিলিয়ে একঘন্টার বেশি সময় লাগল না সৈকতের। পঞ্চাশ হাজার পাকিস্তানী রূপী ম্যজিকের মত কাজ করল।

চেকপোস্টের অফিস থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে পা রেখে সৈকত আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দ্য মিশন স্টার্টস নাও”।

জাহেদান সীমান্তে কোয়েটার বাস পেয়ে গেল সৈকত।

চওড়া রাজপথ। বাসে বসে হেলান দিল সে। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে। কোয়েটায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেশ বড় বেস আছে। সে এর আগে দুবার কোয়েটায় ছিল।

বাস ছাড়লে সৈকত চোখ বুজল। রাত হয়েছে।

হঠাৎ করে চোখ খুলে গেল তার। সেই দিনগুলো হানা দিয়েছে আবার!

বাবা কাশ্মীর গেল, আর ফিরল না। মৃতদেহটুকুও পুরো শরীরে ফেরে নি। পুঞ্চে ডিউটি ছিল। চারজনের বাহিনী জিপে টহল দিতে বেরিয়েছিল। বোম মেরে জিপটাই উড়িয়ে দিয়েছিল লস্কর।

যখনই মনে পড়ে, একটা অসহ্য রাগ ভর করে আসে মাথায়।

বাড়ি ফিরতে পারে না সে। বাবার ঘরে যেতে পারে না। গেলেই দু চোখ জলে ভরে আসে।

#

সেনাবাহিনীর এলাকা শেষ হতেই বাস দাঁড় করিয়ে দিল একদল লোক। কন্ডাকটার তার আগে বলে দিয়েছিল সতর্ক থাকতে।

স্থানীয় জঙ্গী সংগঠনের লোকজন। মূলত তোলাবাজ। বাসে উঠে সবার থেকে টাকা নিয়ে নেমে গেল। বালোচ প্রদেশের নিত্ত নৈমিত্তিক ঘটনা। পুলিশ কিছু বলে না, বা বলার জায়গাতেও নেই। অলিখিত লোকাল ট্যাক্স। দিতেই হবে।

আইনের শাসন নেই বললেই চলে।

বাস ছাড়লে কন্ডাকটার আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানাল আজ তোলাবাজদের মুড ভাল ছিল বলে কাউকে বাস থেকে নামায় নি। আগের দিনই দুজনকে নিয়ে আর বাসে উঠতে দেয় নি। তাদের সঙ্গে কী হয়েছে সহজেই অনুমেয়।

জীবনের দাম এখানে একবারেই নেই। আফগান সীমান্ত বেশি দূর নয়। তালিবানদের একটা অংশ আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে নক কুন্ডি সহ বেশ কয়েকটা জায়গায় থাকে। কয়েকটা গোষ্ঠী আবার পেশোয়ারের দিকেও থাকে। এদের মধ্যে অস্ত্রের সরবরাহ বন্ধ নেই, ফলে দু চারটে লাশ পড়ে গেলে কেউ অবাক হয় না।

সৈকতের পাশে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসে ঝিমোচ্ছিলেন। সৈকত বলল, “কোথায় যাবেন মিয়াঁ?”

ভদ্রলোক বললেন, “কোয়েটা যাব, যদি এই বাস সহি সালামাত পৌঁছতে পারে। আপনি?”

সৈকত বলল, “আমিও কোয়েটা যাব। আপনি এখানে কী করতে এসেছিলেন?”

ভদ্রলোক জানালেন ট্রাকের ব্যবসা করেন। সীমান্ত বন্ধ ছিল বলে ঝামেলায় পড়েছিলেন। এখন সীমান্ত খুলে যাওয়ায় ফিরে যাচ্ছেন। ব্যবসার হাল একেবারেই খারাপ। ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করেন। এখানকার তোলাবাজদের টাকা দিতে দিতে ব্যবসা মাথায় উঠেছে। ট্রাকের ব্যবসা আছে, অথচ গাড়িতে না এসে বাসে করে যাচ্ছেন কেন জানতে চাওয়ায় ভদ্রলোক হেসে জানালেন তার মাথা খারাপ হয় নি। নিজস্ব গাড়িতে এলে দুষ্কৃতিরা গাড়ি থেকে নামিয়ে গাড়ি কেড়ে নেয়।

লুঠপাঠ তো করেই সেটা আলাদা কথা। ভদ্রলোকের ব্যবসা থেকে মন উঠে গেছে। ঠিক করেছেন বাকি জীবনটা মক্কায় গিয়ে কাটিয়ে দেবেন। ভদ্রলোকের বক বক শুনতে শুনতে ঘুম চলে এল সৈকতের।

ঘুম যখন ভাঙল, তখন রাত তিনটে। একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। পেট্রোল পাম্পের সঙ্গে লাগোয়া হোটেলও আছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাকে বললেন, “চল হে, কিছু খেয়ে আসি”।

বাসে একজনও মহিলা নেই। এসব জায়গায় মেয়েদের রাতে বাস জার্নি করার কথা কেউ ভাবতেই পারে না।

সৈকত দশ বারোটা রুটি খেয়ে নিল একবারে।

ভদ্রলোক তার খাওয়া দেখে বললেন, “তোমার খুব খিদে পেয়েছিল বেটা, তাই না?”

সৈকত মাথা নেড়ে বলল, “খুব। খিদে পেলে আমার মাথা কাজ করে না”।

ভদ্রলোক বললেন, “কোয়েটায় আমাদের বাড়ি এসো। আমার বিবির রান্না খাওয়াব। হজরত মহল্লা, মনে থাকবে?”

সৈকত বলল, “জি চাচা, কেন মনে থাকবে না, চাচি বিরিয়ানি বানাতে পারেন?

ভদ্রলোক বললেন, “সব পারেন, তোমার জন্য বিরিয়ানিই বানাতে বলব। খেয়ে বোল কেমন হয়েছে”।

বাসে উঠেও ভদ্রলোক তার স্ত্রীর রান্নার সুখ্যাতি করে যেতে লাগলেন। সৈকতকে দাওয়াত আসছে শুক্রবার দাওয়াতও দিয়ে দিলেন।

পথের পরিচয় কখন যে মানুষকে আপন করে নেয়, তারা নিজেরাই বুঝতে পারে না।

এক বাঙালি, আর এক কোয়েটাবাসী অদৃশ্য আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে গেল সেই পথেরই সৌজন্যে।

ভোর ছ’টায় বাস কোয়েটা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছল। ভদ্রলোক আল্লাহকে বার বার শুক্রিয়া জানালেন এই রাস্তায় বাঁচিয়ে ফেরানোর জন্য, সৈকত চাচাজানকে জড়িয়ে ধরে অটো ধরে কোয়েটা স্টেশনে দৌড়ল।

বিরামহীন রাস্তা।

থামার উপায় নেই…

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন