মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
“সবকিছুই আছে এখানে,” মেরি ব্যাংক সার্টিফিকেট আর ফ্রাঁ নোটগুলো টেবিলে রেখে বললো। “আমি বলেছিলাম না এটাই হবে।”
“একটুর জন্যে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেতো।”
“কি?”
“তারা জুরিখের যে লোকটাকে জোহান নামে ডাকতো সে মরে গেছে। আমি তাকে খুন করেছি।”
“জেসন, কি হয়েছে?”
তাকে সব খুলে বললো। “তারা পন্ত নোয়েফে গিয়েছিলো,” বললো সে। “আমার অনুমান ছিলো ব্যাকআপ গাড়িটা ট্রাফিক জ্যামে আটকা প’ড়ে যাবে, তারা কুরিয়ারের ওয়্যারলেসে বলবে একটু দেরি করতে। আমি একেবারে নিশ্চিত।”
“ওহ্ ইশ্বর, তারা দেখি সব জায়গায় আছে!”
“কিন্তু তারা জানে না আমি কোথায় আছি,” বর্ন বললো। আয়নায় নিজের সোনালী চুল আর চশমাটা দেখে নিলো সে। “এই মুহূর্তে তারা আমাকে যে জায়গায় খুঁজতে চাইবে না সেটা হলো সেন অনরের ফ্যাশন হাউজে।”
“লো ক্লাসিক?” মেরি জানতে চাইলো।
“ঠিক। তুমি কি ফোন করেছিলে?”
“হ্যা। কিন্তু ওখানে যাওয়াটা তো এখন একেবারে পাগলের কাজ হবে!”
“কেন?” আয়নার দিকে থেকে ঘুরে বললো জেসন। “এটা একটু ভাবো। বিশ মিনিট আগে তাদের ফাঁদটা ভেঙে পড়েছে। তারা এখন অন্ধকারে আছে। নিজেদেরকে দোষারোপ করছে। অথবা তার চেয়েও খারাপ কিছু। এখন তারা আমাকে নয়, নিজেদেরকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত আছে। কেউ নিজের গলায় বুলেট বিদ্ধ করতে চায় না। তবে তারা খুব জলদিই আবার এক হয়ে পুণরায় কাজে নেমে পড়বে। কার্লোস সেটাই করাবে। কিন্তু এখন, কি হয়েছে, কিভাবে হয়েছে, সেটা নিয়েই ভাবছে তারা। এ মুহূর্তে তারা এই একটা জায়গাতেই আমাকে খুঁজতে যাবে না।”
“কেউ তোমাকে চিনে ফেলবে।”
“কে? এটা করতে তারা জুরিখ থেকে এক লোককে এখানে নিয়ে এসেছিলো। সে মারা গেছে। আমি দেখতে কী রকম সেটা তারা জানে না।”
“কুরিয়ার। তারা তাকে সঙ্গে নিয়ে নেবে। সে তো তোমাকে দেখেছে।”
“এখন থেকে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা সে পুলিশ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।”
“দামাকোর্ত কিংবা উকিল লোকটি?”
“আমার ধারণা তারা নরম্যান্ডি কিংবা মার্সেই’র পথে আছে, অথবা তাদের ভাগ্য যদি ভালো হয়, তারা দেশের বাইরে চলে গেছে।”
“ধরো তাদেরকে তারা ধরে ফেলেছে?”
“ধরো তারা করেছে? তোমার ধারণা কার্লোস কোত্থেকে মেসেজ পায় সেটা সে জানিয়ে দেবে? না।”
“জেসন, আমি খুব ভয় পাচ্ছি।”
“আমিও। তবে সেটা আমাকে চিনে ফেলবে সেজন্যে নয়।” বর্ন আয়নার সামনে ফিরে গেলো। “আমি চেহারাটা বদলে ফেলতে পারি, তবে সেটা আমি করবো না।”
“তুমি আমাকে বলেছিলে, পোর্ত নোয়ে’র ডাক্তারও এ কথা বলেছে।”
“আমার চোখের রঙ কি?” আয়নার আরো কাছে গিয়ে জানতে চাইলো সে। “কি?”
“আমার দিকে না তাকিয়ে বলো। আমার চোখের রঙ কি? তোমারটা বাদামী, তাতে সবুজ রঙের ফুটকি আছে। আমারটা কি?”
“নিল…নিলচে। অথবা এক রকম ধূসর, আসলে…” মেরি থেমে গেলো। “আসলে আমি ঠিক বলতে পারছি না।”
“এটা একেবারে প্রাকৃতিক। আসলে এগুলো পিঙ্গল বর্ণের, তবে সব সময় নয়। আমি যখন নিল রঙের শার্ট পড়ি লক্ষ্য করেছি আমার চোখগুলো নিলচে হয়ে যায়। বাদামী জ্যাকেট পড়লে হয় ধূসর। আর আমি যখন নগ্ন থাকি সেগুলো অদ্ভুতভাবেই বর্নহীন হয়ে পড়ে।”
“এটা কোনো অদ্ভুত কিছু না। আমি নিশ্চিত, লক্ষ লক্ষ লোকের এমনটি হয়।* “আমিও নিশ্চিত। কিন্তু তাদের মধ্যে যাদের চোখের শক্তি স্বাভাবিক আছে, তারা কতোজন কনট্যাক্ট লেন্স পরে?
“কনট্যাক্ট—”
“সেটাই আমি বলতে চাচ্ছি,” জেসন কথার মাঝে বললো। “কিছু কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করা হয় চোখের রঙ বদলে ফেলার জন্যে। চোখ যদি পিঙ্গল বর্ণের হয়ে থাকে তবে সেটা খুবই কার্যকরী হয়। ওয়াশবার্ন যখন আমাকে প্রথম পরীক্ষা ক’রে দেখেছিলো তখন দীর্ঘদিন কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করার চিহ্ন ছিলো আমার চোখে। এটাও একটা কু, তাই না?”
“তুমি যেমনটি চাও তেমনটিই ভাবো,” মেরি বললো। “যদি এটা সত্যি হয়ে থাকে তো।”
“কেন হবে না?”
“কারণ ঐ ডাক্তার তোমার মতোই সারাক্ষণ মাতাল থাকে। আর মাতালেরা এরকম নিশ্চিত ক’রে কিছু বলতে পারে না।
“সে কিন্তু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি একজন বহুরূপী। স্থিতিস্থাপক আকার দেয়ার উপযোগী ক’রে ডিজাইন করা হয়েছে আমাকে। আমি খুঁজে বের করতে চাই কার জন্যে সেটা করা হয়েছে। হয়তো আমি জানতে পারবো। তোমাকে ধন্যবাদ, আমার কাছে একটা ঠিকানা আছে। ওখানের কেউ হয়তো সত্যটা জানে। কেবল একজন লোক। কেবল তাকেই দরকার আমার। একজনের সাথে আমার মুখোমুখি হতেই হবে, প্রয়োজনে তাকে…”
“আমি তোমাকে থামাতে পারবো না, তবে ঈশ্বরের দোহাই লাগে, সাবধানে থেকো। তারা যদি তোমাকে চিনতে পারে তবে তোমাকে খুন ক’রে ফেলবে।”
“ওখানে তারা সেটা করবে না; এটা তাদের ব্যবসাকে নষ্ট ক’রে দেবে। এটা প্যারিস।”
“আমার মনে হয় না এটা খুব মজার কোনো বিষয়, জেসন।”
“আমারও তাই মনে হয়। আমি এটা খুব গুরুতরভাবেই হিসেব করছি।”
“তুমি করবেটা কি? মানে কিভাবে করবে?”
“ওখানে গেলে আমি সেটা ভালো করেই জানবো। আমি দামাকোর্তের সাথে
যা করেছি ঠিক তাই করবো। বাইরে অপেক্ষা করবো, যেই হোক না কেন অনুসরণ করবো। আমি কাছেই থাকবো। কিছু বাদ দেবো না। সতর্ক থাকবো।”
“তুমি কি আমাকে ফোন করবে?”
“চেষ্টা করবো।”
“আমি অপেক্ষায় থেকে থেকে হয়তো পাগল হয়ে যাবো।”
“অপেক্ষা কোরো না। তুমি কি বন্ডগুলো অন্য কোথাও ডিপোজিট করতে পারবে?”
“ব্যাংকগুলো তো বন্ধ হয়ে গেছে।”
“একটা বড় হোটেল ব্যবহার করো যাদের ভল্ট আছে।”
“তাহলে তো একটা ঘর ভাড়া নিতে হবে।
“নিয়ে নাও। মরিসে অথবা জর্জ শিঙ্ক-এ। ডেস্কে অ্যাটাশি কেস্টা রেখে এখানে ফিরে এসো।”
মেরি মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“তারপর অটোয়াতে ফোন করবে। খোঁজ নিয়ে দ্যাখো ওখানে কি হয়েছে।”
“ঠিক আছে।”
টেবিল থেকে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ নিয়ে নিলো বর্ন। “একটা ঘুষ খুব সহজেই কাজ আদায় ক’রে দেবে,” বললো সে। “মনে করছি না সেরকম কিছু করতে হবে। তবে হতেও তো পারে।”
“তা পারে,” মেরি বললো। “তুমি কি তোমার নিজের বলা কথাগুলো শুনেছো? তুমি এইমাত্র সাবলীলভাবে দুটো হোটেলের নাম বললে।”
“শুনেছি,” সে তার দিকে সরাসরি তাকালো। “আমি এখানে এর আগেও ছিলাম। অনেকবার। আমি ওখানেও ছিলাম। সেইসব হোটেলে নয় অবশ্য। কাছাকাছি কোথাও। যাতে খুব সহজে আমাকে খুঁজে না পাওয়া যায়।” কয়েক মুহূর্তের নিরবতা নেমে এলো।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, জেসন।”
“আমিও,” বললো বর্ন।
“আমার কাছে আবার ফিরে এসো। যাই ঘটুক না কেন, আমার কাছে ফিরে আসবে।”
.
বাতিগুলো মৃদু আর অতিনাটকীয়। গাঢ় বাদামী রঙের সিলিং থেকে স্পটলাইটগুলো ঝুলছে। মহামূল্যবান সব পোশাক পরা ম্যানেকিনগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে ক্রেতাদের সুবিধার্থে। পাশেই হাউজের অফিস আর অন্য সব ঘরগুলো। জায়গাটা প্যারিসের সবচাইতে দামি এলাকায় অবস্থিত। একটা সুইচবোর্ডের সামনে মধ্য বয়সী এক লোক ব’সে আছে। সে কন্সোলটা অপারেটিং করছে। হেডফোনের মাউথপিস দিয়ে কথা বলছে লোকটা।
ক্লার্কদের বেশির ভাগই মহিলা। দীর্ঘাঙ্গী আর ছিমছাম গড়নের। সাবেক ফ্যাশন মডেলদেরই কেউ হবে হয়তো। যে কয়জন পুরুষকে দেখা গেলো তারা ও ছিমছাম গড়নের। হালকা রোমান্টিক গান ভেসে আসছে। জেসন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। ম্যানেকিনগুলো ভালো ক’রে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো যেনো তাকে একজন ক্রেতা ব’লে মনে করে সবাই। সে কি এখানে কার্লোসের মেসেঞ্জারকে খুঁজে পাবে? অফিসে ঢোকার খোলা দরজাটার দিকে তাকালো সে। নারী-পুরুষ আসছে যাচ্ছে। একে অন্যের সাথে আড্ডা মারছে। তাদের মধ্যে কোনো তাড়া নেই। তাদের চোখেমুখে ফাঁদ কিংবা খুনির কোনো লেশমাত্রও নেই। মনে হচ্ছে না তারা কার্লোসের হয়ে প্যারিসে কাজ করে।
সে যা ভেবেছিলো জায়গাটা একেবারেই তার বিপরীত। তারপরও সে কিছু একটা প্রত্যাশা করছে। তাকে কেউ বিশেষভাবে লক্ষ্যও করছে না। চারপাশে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
তারপরও, এই এখানেই, কোনো এক জায়গায় একটা প্রাইভেট ফোন রয়েছে, কেউ একজন সেটা দিয়ে কেবল কার্লোসের পক্ষ হয়ে কথাই বলে না, বরং তিনজন খুনিকে শিকার করার ব্যবস্থা করার মতো ক্ষমতাও রাখে। একজন মহিলা…
সে মহিলাকে দেখতে পেলো। এটাই সেই মহিলা হবে। কার্পেট মোড়ানো একটা সিঁড়ি দিয়ে লম্বা আর বয়স্ক এক মহিলা নেমে আসছে। তার মুখে কড়া মেকআপ। একেবারে মুখোশ পরে আছে যেনো। সে থেমে এক চিকনা লোককে কিছু একটা করার নির্দেশ দিলো।
মহিলার চোখে একটু প্রশান্তির ছায়াও রয়েছে। বর্নের দেখা এই চোখ জোড়া সবচাইতে সতর্ক। না, সবচাইতে নয়, কেবল জুরিখের গোল্ডরিম চশমা পরা লোকটাকে বাদ দিলে।
তার মন বলছে মহিলাই তার টার্গেট। কেবল তার কাছে পৌঁছানোটাই বাকি। প্রথম চালটা খুব অল্প, আবার খুব বেশি প্রকটও হবে না। মহিলাকে তার কাছে আসতেই হবে, এরকম কিছু একটা করতে হবে তাকে।
একটা পোশাক হাতে নিয়ে সেটার সেলাইগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো সে, তারপর বোতামঘর, কলার সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। এক পর্যায়ে কাপড়টা ফেলে দিলেও মহিলার কোনো দৃষ্টি কাড়তে পারলো না। মহিলা তার পাশে থাকা এক সেলস্ ক্লার্কের দিকে আসতেই জেসন সৌজন্যবশত তার দিকে চেয়ে হাসলো। ত্রিশ সেকেন্ড পরে তিনটা ম্যানিকেনের পেছনে দাঁড়িয়ে পোশাকগুলো দেখতে লাগলো সে। এগুলো এখানকার সবচাইতে দামি ডিজাইনের পোশাক।
কাপড়গুলো দেখে ভুরু তুলে মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক একটা ভঙ্গী করলো সে। দু’হাত বুকের কাছে ভাঁজ ক’রে আরেকটা ম্যানিকের দিকে বর্ন। সম্ভাব্য বড় একজন ক্রেতা কিন্তু মনস্থির করতে পারছে না। আর এরকম একজন ক্রেতা যে মূল্যের দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না তার দরকার একটু সাহায্যের। সেই সাহায্যটা আসতে হবে এ বিষয়ে সবচাইতে ভালো জানা লোকের কাছ থেকে। অভিজাত মহিলাটি তাকে দেখতে পেয়ে নিজের চুলটা হাত দিয়ে একটু সরিয়ে আস্তে আস্তে তার কাছে এগিয়ে এলো।
“দেখতে পাচ্ছি আপনি ভালো আইটেমগুলোর দিকেই নজর দিচ্ছেন, মঁসিয়ে,” ইংরেজিতে বললো মহিলা। তার অভিজ্ঞ চোখ বলছে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। “আমারও বিশ্বাস, তাই,” জেসন বললো। “আপনাদের কালেকশানগুলো খুব ভালো বলেই মনে হচ্ছে। তবে একটু খোঁজ করার দরকার রয়েছে। তাই না?”
“আমাদের সব ডিজাইনই এক্সকুসিভ।”
“সেলা ভা সাঁ দায়ার, মাদাম।”
“আহ্, ভু পারলেজ ফ্রাঁসোয়া?”
“উন পু। পাসাবলি।”
“আপনি একজন আমেরিকান?”
“আমি অবশ্য ওখানে খুব একটা থাকি না,” বললো বর্ন। “আপনি বললেন এইসব শুধু আপনাদের জন্যেই বানানো হয়?”
“হ্যা। আমাদের সাথে ডিজাইনারের চুক্তি আছে। আমি নিশ্চিত আপনি তার নাম শুনেছেন। রেনে বারগোঁয়া।”
জেসন ভুরু তুললো। “হ্যা। খুবই পরিচিত। তবে সে এখনও কোনো অসাধারণ কিছু করে নি, করেছে কি?”
“করবে, মঁসিয়ে। এটা অবধারিত। প্রতি সিজনেই তার সুনাম বাড়ছে। কয়েক বছর আগে সেন লরেনের পক্ষে কাজ করতো, তারপর গিভেনচি’তে। লোকে বলে ওখানে সে কেবল প্যাটার্নই কাঁটতো। বুঝেছেন তো, আমি কি বললাম।”
“না বোঝার তো কিছু নেই।”
“ঐসব বেড়ালগুলো তাকে কিভাবে দমিয়ে রাখতো, ভাবতে পারেন? কি অসম্মানজনক ব্যাপার! সে মেয়েদেরকে খুব পছন্দ করে, সম্মান করে; তাদের সাথে রঙ্গতামাশা করে। ভু কম্প্রেন্স?”
“জো ভু কম্প্রেন্স পারফেইমেন্ত।”
“সে খুব শীঘ্রই বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠবে, আর তারা তার জামার কোণাগুলোও ছুঁতে পারবে না। এইসব জিনিসকে একজন উদীয়মান মাস্টারের কাজ হিসেবে বিবেচনা করুন, মঁসিয়ে।”
“আপনি দেখছি মানুষ পটাতে খুব দক্ষ। আমি এই তিনটি পোশাক নিচ্ছি। আমার ধারণা এগুলো বারো সাইজের হবে।”
“চৌদ্দ, মঁসিয়ে। তবে ফিট হবে।”
“আমি নিশ্চিন্ত, আপনাদের এখানে ভালো দর্জি আছে।”
“অবশ্যই আছে।”
“আমার সময় বাঁচাতে, আমার জন্যে আরো কিছু আইটেম বেছে রাখবেন, এরকম লাইনের কিছু পোশাক। একটু আলাদা ছাপা, আলাদা কাট, বুঝেছেন কি?”
“খুব ভালো জ্ঞান আছে দেখছি, মঁসিয়ে।
“ধন্যবাদ। বাহামা থেকে আমি দীর্ঘ ফ্লাইটে এসেছি, খুবই ক্লান্ত।”
“তাহলে কি একটু বসবেন?”
“সত্যি বলতে কি, আমি একটু ড্রিংক করতে চাচ্ছিলাম।”
“সে ব্যবস্থা করা যাবে। পেমেন্টটা কিভাবে হবে…মঁসিয়ে?”
“নগদে,” জেসন বললো। “চেক আর একাউন্ট হলো জঙ্গলের প্রাণী, তাই না?”
“আপনি খুবই বুদ্ধিমান,” একটু হেসে বললো মহিলা। “ড্রিংকটা আমার অফিসে করছেন না কেন? জায়গাটা খুবই প্রাইভেট আর নিরিবিলি। আপনি সেখানে আরাম করতে পারেন, সেই ফাঁকে আমি আপনার পছন্দের আইটেমগুলো নিয়ে আসবো।”
“দারুণ।”
“মূল্যের রেঞ্জটা কেমন হবে, মঁসিয়ে?”
“লে মেইলিয়ে, মাদাম।”
“অবশ্যই,” শুকনো সাদা হাতটা বাড়িয়ে বললো। “আমি জ্যাকুলিন লাভিয়া। লো ক্লাসিকের ম্যানেজিং পার্টনার।”
“আপনাকে ধন্যবাদ,” বর্ন নিজের নাম না বলেই হাতটা মেলালো। এখন টাকাই হলো তার আসল পরিচয়। “আপনার অফিসটা কোথায়? আমারটা তো হাজার মাইল দূরে।
“আসুন, মঁসিয়ে।” সিঁড়ি দিয়ে তারা দু’জন উঠে গেলো।
তার পাশের মহিলাটি যে মারাত্মক কোনো মেসেঞ্জার সে ব্যাপারে জেসন অনেকটা নিশ্চিত। কয়েক ঘণ্টা আগে একটা বন্দুক-যুদ্ধ হয়ে গেছে, সেটা হয়েছে অদৃশ্য এক লোকের আদেশে। আর এই মহিলার মতো কেউই সেইসব অর্ডার বহন ক’রে থাকে। তবে মহিলাকে দেখে এরকম কিছু মনে করার কোনো কারণই নেই। এখন পর্যন্ত সে লো ক্লাসিকে কোনো প্রাইভেট নাম্বার খুঁজে পায় নি। হিসাবের একটি অংশ পাওয়া যাচ্ছে না…তবে আরেকটা জিনিস বিব্রতকরভাবেই নিশ্চিত।
সেটা তার নিজের ব্যাপারে। সে একজন বহুরূপী। চালাকিটাতে কাজ হয়েছে। সে এখন শত্রুপক্ষের ক্যাম্পে। কোনো সন্দেহ নেই যে, তাকে কেউ চিনতে পারে নি। পুরো ব্যাপারটিই দেজাভু টাইপের। এরকম কাজ সে এর আগেও করেছে। সে এমন একজন লোক যে অচেনা এক জঙ্গলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তারপরও, কোনো না কোনোভাবে সে জানে তার পথটা কোথায়, আর কোথায় ফাঁদ পাতা আছে, অথবা কিভাবে এড়ানো যায় সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। বহুরূপী খুবই অভিজ্ঞ একজন। বর্ন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো। নিচের ডান দিকে মধ্যবয়সী অপারেটর মাউথ পিসে নিচু কণ্ঠে কথা বলছে। মাথা দোলাচ্ছে সে যেনো ওপাশে যে আছে তাকে সব ঠিক আছে বলে আশ্বস্ত করছে,।
সিঁড়ির সপ্তম ধাপে এসে বর্ন থেমে গেলো। এটা অনৈচ্ছিকভাবেই হলো। লোকটার মাথার পেছন দিক, গালের হাড়ের গঠন, মাথার পাতলা ধূসর চুল— যেভাবে সেগুলো কানের দু’পাশে আলতোভাবে পড়ে আছে। সে এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছে! কোথাও। অতীতে। বিস্মৃত এক অতীতে। তবে এখন অন্ধকারের মধ্যে…আলোর ঝলকানির সাথে স্মরণ করছে। বিস্ফোরণ, কুয়াশা, ঝড়ো বাতাস। সেটা কি? কোথায় সেটা? তার চোখে কেন যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এলো? ধূসর চুলের লোকটা চেয়ার ঘোরাতে শুরু করছে। তাদের মধ্যে চোখাচোখি হবার আগেই জেসন তার মুখটা সরিয়ে ফেললো।
“মঁসিয়ে দেখছি আমাদের অনন্য সাধারণ সুইচ-বোর্ডের দিকে চেয়ে আছেন, “ মাদাম লাভিয়া বললো। “এটা আমরা আমাদের সেন অনরের অন্য দোকানগুলো থেকে লো ক্লাসিককে আলাদা করার তাগিদেই বসিয়েছি।”
“কিভাবে?”
“যখন কোনো ক্লায়েন্ট লো ক্লাসিকে ফোন করে তখন কোনো মাথা মোটা মহিলা সেটার জবাব দেয় না, তার বদলে একজন সংস্কৃতিবান ভদ্রলোক, যার নখদর্পনে আমাদের সব তথ্য রয়েছে, সে জবাব দেয়।”
“চমৎকার ব্যবস্থা।”
“অন্যেরাও তাই বলে।”
তারা জ্যাকুলিন লাভিয়ার সুবিশাল অফিসে ঢুকলো। একগাঁদা এক্সিকিউটিভ এখানে কাজ করে। দেয়ালে জলরঙের ছবি টাঙানো। কিছু কিছু খুবই সাহসী, একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। দেয়ালে মডেলদের অসংখ্য ছবিও আছে, সুন্দর আর যৌন আবেদনময়। বাতাসে একটা বন্য সুগন্ধী টের পেলো বর্ন। এই জায়গাটা এক বয়স্ক আর ক্ষিপ্র বাঘিনীর অভয়ারণ্য। যারা তার জায়গাটা, অবস্থানটার জন্যে হুমকী হিসেবে আবির্ভূত হয় সে তাদেরকে নিমেষে পরাভূত করে। তারপরেও মহিলা বেশ নিয়মনিষ্ঠ। সবকিছু বিবেচনা করে এটা বোঝা যায়, সে হলো কার্লোসের একজন লিয়াজো।
সুইচবোর্ডের লোকটা কে? তাকে সে কোথায় দেখেছে?
তাকে এক সারি মদের বোতল থেকে বেছে নিতে বলা হলে সে ব্র্যান্ডি বেছে নিলো।
“বসুন মঁসিয়ে। আমি রেনেকে আপনার সাহায্যে নিয়োজিত করবো, যদি তাকে খুঁজে পাই।”
“আপনার মহানুভবতা, তবে আমি নিশ্চিত আপনি যা পছন্দ করবেন সেটা খুবই ভালো হবে। এটা আপনার অফিস। সব জায়গায় রুচির ছাপ দেখতে পাচ্ছি। আমি বেশ আরাম বোধ করছি এখানে।”
“আপনিও খুব মহানুভব।”
“কেবল যখন এটার দরকার পড়ে,” বললো জেসন। এখনও সে দাঁড়িয়ে আছে। “আসলে আমি ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই। এসব ছবি আমি দেখেছি। বাহামাতে এসব ছবি যায়।”
“হ্যা, তা যায়,” লাভিয়া একমত পোষণ করলো। “খুব বেশি দেরি হবে না আমার মঁসিয়ে।”
আপনি সেটা করবেনও না, ভাবলো জেসন। লো ক্লাসিকের পার্টনার ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। মাদাম লাভিয়া একজন ক্লান্ত ধনাঢ্য ব্যক্তিকে ভালোমতো চিন্তা করার জন্যে খুব বেশি সময় দেবে না। সে খুব জলদি একগাদা পোশাক নিয়ে ফিরে আসবে। সেজন্যে এই ঘরে যদি কার্লোস সংক্রান্ত কোনো কিছু থেকে থাকে তবে সেটা খুব দ্রুত খুঁজতে হবে। আর সেটা ডেস্কের আশেপাশে অথবা ডেস্কেই থাকার কথা।
জেসন ছবি দেখা বাদ দিয়ে ডেস্কটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। রিসিপ্ট, বিল আর চিঠিপত্রের সাথে একটা এ্যাড্রেস বুক আছে। চারটা নাম আছে প্ৰথম পৃষ্ঠায়। নামগুলো, কোম্পানিগুলোর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার মুখস্ত করতে পারলে ভালোই হোতো, সে আপন মনে বললো। তাই যখন করতে যাবে ঠিক এমন সময় তার চোখ গেলো টেলিফোনটার নিচে একটা ইনডেক্সের দিকে। ফোনের নিচে থাকার কারণে অল্প একটু অংশই দেখা যাচ্ছে। আর সেখানে আরো একটা জিনিসও আছে—শুকনো, সহজে চোখে পড়ে না। ট্রান্সপারেন্ট টেপের একটা টুকরো। ইনডেক্সে কার্ডটার প্রান্ত ছুঁয়ে সেটাকে আঁটকে রেখেছে। টেপটা অপেক্ষাকৃত নতুন, সাম্প্রতিক সময়ে লাগানো হয়েছে।
বর্ন টেলিফোনটা সরাতে সেটা বেজে উঠলে আবারো ওটা ডেস্কে রেখে দিলো। এরপরই এক লোক ঘর ঢুকলে একটু সরে গেলো সে। লোকটা আচমকা থেমে বর্নের দিকে চেয়ে রইলো। তার চোখেমুখে সতর্কতা থাকলেও কিছুই বললো না। দ্বিতীয়বার ফোনটা বেজে উঠলে লোকটা এগিয়ে এসে ফোনটা তুলে নিলো।
“আলো?” লোকটা মাথা নিচু ক’রে চুপচাপ শুনে গেলো। মধ্যবয়সী, পেশীবহুল একজন। সূর্যের আলোয় তামাটে চামড়া বয়সটাকে বিভ্রান্ত করছে। লোকটা অন্য হাতে ফোনটা নিয়ে রুক্ষভাবে বললো, “পাস ইসি। সে পাস। তেলেফোনজে প্লাস তাদ…” ফোনটা রেখে সে জেসনের দিকে চেয়ে রইলো। “অউ এস্ত জ্যাকুলিন?”
“আস্তে বলুন, প্লিজ,” বর্ন ইংরেজিতে মিথ্যেটা বললো। “আমার ফ্রেঞ্চ খুব একটা ভালো না।”
“দুঃখিত,” তামাটে বর্ণের লোকটা জবাব দিলো। “আমি মাদাম লাভিয়াকে খুঁজছি।”
“মালিক?”
“হ্যা। সে কোথায়?”
“আমার টাকার শ্রাদ্ধ করছে,” জেসন হেসে গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে ধরলো।
“ওহ্? আপনি কে, মঁসিয়ে?”
“আপনি কে?”
লোকটা বর্নকে খুঁটিয়ে দেখলো।
“রেনে বারগোয়াঁ।”
“ওহ্, ঈশ্বর!” জেসন উচ্ছ্বাসে বললো। “সে তো আপনাকেই খুঁজছে। আপনি তো অসাধারণ, মি: বারগোঁয়া। সে বলেছে আপনার কাজগুলোকে আমি যেনো উদীয়মান একজন মাস্টারের কাজ হিসেবে দেখি।” বর্ন আবারো হাসলো। “আপনার জন্যেই তো আমি বাহামাতে ফোন ক’রে প্রচুর টাকা চেয়ে পাঠিয়েছি।”
“আপনার দয়া, মঁসিয়ে। আমার ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি আবারো।”
“আপনি বরং ফোনের জবাব দিন। আমাকে নিয়ে ভাববেন না।”
“ক্রেতা, সরবরাহকারী, সব হাউকাউ মার্কা গর্দভ। আমি কার সাথে কথা বলছি, মঁসিয়ে?”
“বৃগস্,” কোত্থেকে এ নামটি সে পেলো সে সম্পর্কে জেসনের কোনো ধারণাই নেই। বেশ অবাকই হলো সে। “চার্লস্ বৃগস্।”
“আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আনন্দিত হলাম,” বারগোঁয়া তার হাতটা বাড়িয়ে দিলো। “আপনি বলছেন জ্যাকুলিন আমাকে খুঁজছে?”
“মনে হচ্ছে আমার প্রয়োজনেই।”
“তাকে খুঁজে বের করি তাহলে।” ডিজাইনার খুব দ্রুত চলে গেলো।
জেসন ডেস্কের কাছে গিয়ে দরজার দিকে চোখ রাখলো। তার হাত টেলিফোনটার উপর। ফোনটা সরিয়ে ইনডেক্সটা দেখলো সে। দুটো ফোন নাম্বার আছে সেখানে। প্রথমটি দেখেই চেনা যাচ্ছে, জুরিখের এক্সচেঞ্জ নাম্বার, দ্বিতীয়টি অবধারিতভাবেই প্যারিসের।
তার ধারণাই ঠিক। নাম্বার দুটোর দিকে তাকালো সে। ওগুলো মুখস্ত ক’রে ফোনটা আবার আগের জায়গায় রেখে ডেস্ক থেকে সরে দাঁড়ালো।
ডেস্ক থেকে সরতেই মাদাম লাভিয়া ঘরে ঢুকলো হুড়মুড় ক’রে। তার হাতে আধডজন পোশাক। “সিঁড়িতে রেনের সাথে দেখা হয়েছে। সেও আমার পছন্দগুলো বেশ পছন্দ করেছে। সে আরো জানালো, আপনার নাম বৃগস্, মঁসিয়ে।”
“আমি সেটা নিজেই আপনাকে বলতাম,” বর্ন বললো একটু হেসে। “তবে আমার মনে হয় না আপনি আমার নামটা জানতে চেয়েছিলেন।”
“ক্ষমা করবেন, মঁসিয়ে। এখানে আমি আপনার জন্যে খাদ্য নিয়ে এসেছি!” সে পোশাকগুলো আলাদা আলাদা ক’রে কয়েকটা চেয়ারের উপর রাখলো। “আমি সত্যি বিশ্বাস করি এগুলো আমাদের দেয়া রেনের সবচাইতে সেরা কাজ।”
“তার দেয়া? তাহলে সে এখানে কাজ করে না?”
“কথার কথা আর কি। তার স্টুডিওটা করিডোরের শেষপ্রান্তে অবস্থিত। তবে সেটা একটা পবিত্র জায়গা। আমি নিজেও ওখানে ঢুকলে কাঁপতে শুরু করি।”
“এগুলো অসম্ভব সুন্দর,” একটার পর একটা কাপড় দেখতে দেখতে বর্ন বললো। “তবে আমি আমার ডার্লিংকে ঘাবড়ে দিতে চাই না।” তিনটি পোশাক দেখিয়ে সে বললো। “আমি এগুলো নিচ্ছি।”
“চমৎকার পছন্দ, মঁসিয়ে বৃগস্!”
“বাক্সে ক’রে দেবেন কি।”
“অবশ্যই। সে নির্ঘাত ভাগ্যবতী এক মেয়ে।”
“বলতে পারেন একজন ভালো সঙ্গী, তবে বাচ্চা মানুষ। বখে যাওয়া এক বাচ্চা। আমি খুব বেশি বিদেশে থাকি, তাকে খুব একটা সময় দিতে পারি না। তাই আমার মনে হয় আমার উচিত হবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই একটা কারণে আমি তাকে কেইপ ফেরেতে পাঠিয়েছি।” সে হেসে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করলো। “লা ফ্যাকচার, সিল ভু প্লেইত?”
“আমি একটা মেয়েকে এসব দিয়ে দিচ্ছি,” মাদাম লাভিয়া টেলিফোনের পাশে ইন্টারকমটার বোতাম চাপলো। “আরেকটু ব্র্যান্ডি নেবেন, মঁসিয়ে?” বললো সে।
“মাখসি বুঁয়ো,” বর্ন তার গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলে গ্লাসটা নিয়ে বারের দিকে গেলো। জেসন জানে তার যে পরিকল্পনা সেটার সময় এখনও হয় নি। তবে খুব জলদিই আসবে—এখন নয়। এবার ম্যানেজিং পার্টনারের সাথে ভাব জমালো সে। “বারগোঁয়া,” সে বললো। “আপনি বলছেন তার সাথে আপনাদের চুক্তি আছে?”
মাদাম লাভিয়া ঘুরে তাকালো। “ওহ্ হ্যা। আমরা খুব ঘনিষ্ঠ, একটা পরিবারের মতো আর কি।”
বর্ন তার ব্র্যান্ডিটা নিয়ে মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ডেস্কের সামনের একটা চেয়ারে ব’সে পড়লো। “এটা খুবই ভালো একটি ব্যবস্থা,” সে উদ্দেশ্যহীনভাবেই বললো।
লম্বা, ছিপছিপে যে মেয়েটির সাথে সে অফিসে ঢোকার সময় প্রথম কথা বলেছিলো, সেই ক্লার্ক মেয়েটি হাতে একটি সেলস্ বুক নিয়ে ঢুকলে লাভিয়া মেয়েটিকে কিছু নির্দেশ দিয়ে দিলো। তারপর সেলস্ বুকটা হাতে নিয়ে জেসনের দিকে বাড়িয়ে বললো, “ভইসি লা ফ্যাকচার, মঁসিয়ে।”
বর্ন মাথা ঝাঁকালো, জানালো খাতিয়ে দেখার দরকার নেই। “কমবুয়ো?” জিজ্ঞেস করলো সে।
“ভিঙ্গত্-মিলে, সোঁয়াতে ফ্রাঁ, মঁসিয়ে,” লাভিয়া জানালো। জেসনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করলো সে।
কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। জেসন পাঁচ হাজার ফ্রাঁ’র নোটগুলো বের ক’রে তাকে দিলে টাকা আর পোশাক নিয়ে উত্তেজক ভঙ্গীতে হেটে ঘর থেকে চলে গেলো মেয়েটা।
“আপনার ভাংতি টাকাগুলো নিয়ে আসার সময় সবগুলো পোশাক প্যাকেজ ক’রে নিয়ে আসবে।” লাভিয়া তার নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। “এখান থেকে আপনি ফেরেতে যাচ্ছেন। খুবই চমৎকার জায়গা।”
টাকা পরিশোধ করা হয়ে গেছে। সময় এসে গেছে এখন। “ঐ কিন্ডার গার্টেনে ফিরে যাবার আগে প্যারিসে শেষ রাতটা কাটাবো,” জেসন বললো, গ্লাসটা তুলে টোস্ট করলো ঠাট্টাচ্ছলে।
“হ্যা। আপনি বলেছেন আপনার বান্ধবীর বয়স খুবই কম।”
“বলতে গেলে একেবারে বাচ্চা, তবে মেয়েটা সঙ্গী হিসেবে ভালো। কিন্তু আমি একটু পরিণত বয়সের মেয়েই বেশি পছন্দ করি।”
“আপনি অবশ্যই তাকে খুব পছন্দ করেন,” লাভিয়া পাল্টা বললো নিজের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে। “আপনি তার জন্যে দারুণ সুন্দর আর দামি জিনিস কিনে দিচ্ছেন।”
“সে যা করেছে সে তুলনায় এটা একেবারেই নগন্য।”
“সত্যি!”
“সে আমার স্ত্রী, সত্যি বলতে কি তৃতীয় স্ত্রী। তবে বাহামাতে আমি এটা গোপন রেখেছি। এখানে হোক আর ওখানে হোক, আমার জীবনটা একেবারেই নিয়মের মধ্যে চলে।”
“আমিও তাই মনে করি।”
“কয়েক মিনিট আগে বাহামা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার একটা চিন্তা মাথায় এসেছে। এজন্যেই আমি বারগোঁয়ার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম।”
“সেটা কি?”
“আপনি হয়তো ভাববেন আমি খুব তাড়াহুড়া করছি। তবে আপনাকে আশ্বস্ত করছি, আমি তা করছি না। আসলে আমার যখন কোনো কিছু মনে আসে আমি সেটা প্রকাশ করি। যেহেতু বারগোঁয়া আপনার খুব দামি একটি রত্না, তাই আপনি কি বাহামাতে কোনো শাখা খোলার কথা ভেবেছেন?”
“বাহামায়?”
“এবং দক্ষিণ দিকে। মানে ক্যারিবিয়ানে।”
“মঁসিয়ে, এটাই আমরা চালাতে হিমশিম খাই। বাইরে কোনো কিছু পরিচালনা করাটা অনেক ঝামেলার হবে।”
“আপনি যেমনটি ভাবছেন তেমনটি হবে না। স্থানীয় লোকেরাই সব করবে, আপনারা কেবল তদারকি করবেন আর পার্সেন্টিজ পাবেন।”
“তাতেও তো বেশ টাকা লাগবে, মঁসিয়ে বৃগস্।”
“শুরুতে কিছু টাকা লাগবে। সেটাকে আপনি প্রবেশ ফি বলতে পারেন। টাকাটা বেশি হলেও অসম্ভব কিছু না। তাছাড়া ওখানে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে। ভালো ব্যবস্থাপনা করে তারা।”
“আপনি তাদের চেনেন?”
“খুব চিনি। আমার মনে হয় আইডিয়াটার মূল্য আছে। আপনার লেবেলটারও মূল্য আছে—লো ক্লাসিক, প্যারিস, গ্র্যান্ড বাহামা… কানিল বে, এরকম আর কি।” বর্ন বাকি ব্র্যান্ডিটুকু পান ক’রে ফেললো। “হয়তো আপনি ভাবছেন আমি পাগল। মাঝে মাঝে আমি আমার পছন্দের জিনিসের জন্যে ডলার বিনিয়োগ করি। ঝুঁকি নেই।”
“ঝুঁকি?” জ্যাকুলিন লাভিয়া আলতো ক’রে চুলে হাত দিয়ে বললো।
“আমি কেবল আইডিয়া দেই না, সেগুলো বাস্তবায়ন করতেও সাহায্য করি।”
“কে বলেছে?”
“তুমি সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো না।”
“আমি জিজ্ঞেস করছি!”
“আমার কথা শোনো। গত চব্বিশ ঘণ্টায় আমি বাড়িতে নেই। বারো ঘণ্টা ধরে আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। বুঝতে চেষ্টা করো—আমি তোমাকে ফিরে আসার কথা বলছি না। এটা তোমার গভর্নমেন্টের আদেশ।”
“আদেশ? কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই?”
“তাই। তারা চায় তুমি এসব থেকে দূরে থাকো। তারা তাকে সম্পূর্ণ একা ক’রে ফেলতে চায়।”
“দুঃখিত, এ্যালান—এটা হবে না। গুডবাই,” সে ফোনটা রেখে দিয়ে নিজের হাতটার কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা করলো। ওহ্, ঈশ্বর, সে তাকে খুবই ভালোবাসে… আর তারা তাকে খুন করার চেষ্টা করছে। জেসন, আমার জেসন। তারা সবাই তোমাকে খুন করতে চায়। কিন্তু কেন?
.
সুইচবোর্ডের মধ্যবয়সী লোকটি লাল ক্লিপটাতে আঘাত করলে লাইনগুলো আর ব্লক হয়ে থাকলো না। সব ইনকামিং কলকে বিজি সিগনাল দিচ্ছিলো সেটা।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। খুব বেশি আগে নয়, যখন অন্যেরা তার জন্যে সুইচবোর্ডের সামনে ব’সে থাকতো তার সায়গনের কোম্পানি আর মেকং অফিসের কমিউনিকেশন রুমে। আর এখন, এখানে সে ব’সে আছে অন্য একজনের জন্যে।
সিঁড়িতে হাসাহাসির শব্দ শুনে সেদিকে তাকালো সে। জ্যাকুলিন বেশ তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই বেশ ধনী একজনের সাথে। জ্যাকুলিন সুরক্ষিত স্বর্নখনি থেকেও সোনা তুলে নিয়ে আসতে পারে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তার সঙ্গের লোকটাকে সে দেখতে পায় নি। সে জ্যাকুলিনের অন্য পাশে আছে, তার মুখটা অদ্ভুতভাবেই অন্য দিকে ঘোরানো।
তারপর এক মুহূর্তের জন্যে দেখতে পেলো সেই মুখটা। তাদের চোখাচোখি হলো। খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট। ধূসর চুলের সুইচবোর্ড অপারেটরের নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। বিশ্বাস আর বিশ্বাসের দোলাচালে দুলতে লাগলো সে। যে মুখটা দেখলো সেটা অনেক বছর ধরেই দেখে নি।
হায় ঈশ্বর—সে এখানে!
সুইচবোর্ড থেকে লোকটা অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ালে মাউথপিসটা কান থেকে খুলে ফেলতেই সেটা মাটিতে পড়ে গেলো। প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে এসে জ্যাকুলিন লাভিয়ার সাথে ভূতটাকে ভালো ক’রে দেখার জন্যে তাকালো সে। এই ভূতটা একজন খুনি—পাক্কা খুনি। তারা তাকে বলেছিলো এটা ঘটবে, তবে সে একটুও বিশ্বাস করে নি। এখন করছে। সে-ই তো!
তাদের দু’জনকেই পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে সে। তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে থামাতে হবে। মহিলাকে থামাতে হবে! কিন্তু দৌড়ে চিৎকার ক’রে এটা করতে গেলে মহিলা মারা যাবে। মাথায় একটা বুলেট বিদ্ধ হবে সে।
দরজার কাছে পৌঁছাতেই জেসন দরজা খুলে লাভিয়াকে বের হতে দিলো। তারা এখন রাস্তায়। ধূসর চুলের লোকটা সামনের একটা জানালার কাছে দৌড়ে চলে এলো। বাইরের রাস্তায় একটা ট্যাক্সি থামালো জেসন। দরজাটা খুলে দিচ্ছে সে। জ্যাকুলিনকে ঢুকতে ইশারা করছে। হায় ঈশ্বর। জ্যাকুলিন চলে যাচ্ছে!
মধ্যবয়সী ধূসর চুলের লোকটা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো। তার গন্তব্য এখন স্টুডিও।
“রেনে! রেনে!” ভেতরে ঢুকেই চিৎকার ক’রে ডাকতে লাগলো সে।
বারগোঁয়া স্কেচ করছেলো। মুখ তুলে তাকাতেই খুব অবাক হলো সে। “কি হয়েছে?”
“জ্যাকুলিনের সাথে ঐ লোকটা কে? সে এখানে কতোক্ষণ ধ’রে আছে?”
“ওহ্, সম্ভবত আমেরিকান,” ডিজাইনার বললো। “তার নাম বৃগস্। খুবই ধনী লোক। আজকে আমাদের বিক্রির অবস্থাটা বেশ ভালো ক’রে দিয়ে গেছে সে।”
“তারা কোথায় গেলো?”
“আমি জানি না, তারা যেকোনো জায়গায় যেতে পারে।”
“সে ঐ লোকটার সাথে গেছে।”
“আমাদের জ্যাকুলিন, তার রুচি আছে বলতে হবে।”
“তাদেরকে খুঁজে বের করো। জ্যাকুলিনকে ধরতে হবে!”
“কেন?”
“সে জেনে গেছে। সে জ্যাকুলিনকে খুন করবে!”
“কি?”
“আরে ঐ লোকটাই সেই লোকটা! কসম খেয়ে বলছি! ঐ লোকটাই কেইন!”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন