২২. জঙ্গলপীরের কাছে এসে

সমরেশ বসু

পরদিন ফেরবার পথে জঙ্গলপীরের কাছে এসে হঠাৎ লখাইয়ের শ্রীনাথের কথা মনে পড়ে গেল।

তার সঙ্গে দেখা করা মনস্থ করে লখাই জঙ্গলপীরের ভেতর দিয়ে কাঠুরেপাড়ার মধ্যে ঢুকেই শুনতে পেল শ্রীনাথ চিৎকার করে বেসুর গলায় গান ধরেছে :

কত যে ঢলালি ঢলানি কুলকলঙ্কিনী,
তোর বে উপলক্ষ, ঘটক এক লক্ষ লক্ষ
হয়ে রাজার শত্রুপক্ষ বিপক্ষ হাসালি।

 লখাই বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখল দুই বউ সহ তিনজনে এই সকালবেলাতেই তাড়ি খাওয়া শুরু করেছে। লখাইকে দেখে দুই বউ মত্ত হেসে কাপড় সামলাতে গিয়ে আরও বেসামাল হয়ে উঠল। শ্রীনাথ সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, আরে বা বা বা। লখাই এসো, লখাই এসো, বসে পড়ো।

লখাই বলল, আজ সকালবেলাতেই শুরু করেছ?

শ্রীনাথ বুক ফুলিয়ে বলল, আমার খুশি, কারও সাহস থাকে বলে যাক দুকথা, কেরামতিটা দেখি একবার। তারপর হো-হো করে হেসে উঠে বলল, আর কি কাজ আছে বলে? চাল লেই, তাই রামা নেই। গাছ সেই, তাই কাটাও নেই।

গাছ নেই কেন?

কত্তারা বন্ধ করে দিয়েছে।

কেন, খাজনা দিতে না বনের?

কোন শালা বলবে। একপয়সা খাজনা বাকি আছে ছিনাথের? কিন্তু মহাজনে ডেকে নিল চড়া দরে।

কী কথা বলতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল লখাই।

শ্রীনাথ সে কথা ছেড়ে বিড়বিড় করে বকতে লাগল, আর শালী দুটো যে কী? দ্যাখ তো খাই, মাগী দুটো মেয়েমানুষ কি না?

লখাই তাকিয়ে দেখল বেসামাল বউ দুটো হঠাৎ ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছে শ্রীনাথের কথা শুনে। আর মার খাওয়ার ভয়ে পানের মাত্রাও বেড়ে গেল তাদের।

লখাই বলল, মেয়েমানুষই তো।

ঠিক দেখেছিস?

হ্যাঁ গো।

আর আমি? ব্যাটাছেলে কি না?

লখাই তাকিয়ে দেখল, শক্ত শ্রীনাথ খানিকটা দুমড়ে গেছে যেন। হাড়গুলো বেরিয়ে পড়েছে। বলল, সে কথা বলে! তুমি হাজারবার পুরুষ।

তবে মাগীদের ছাওয়াল হয় না কেন, অ্যাঁ?

বউ দুটো যত শুনছে তত গিলছে ঢকঢক করে।

লখাই এসব কথায় শান্তি পেল না। গভীর উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞেস করল, কিন্তু ছিনান্দা, তাড়ি খেয়ে তো পেট ভরবে না। তুমি কী করবে?

ছিনাথ হাত ঝটকা দিয়ে ঠোঁট উটে বলল, আমার একটা তো পেট। কোনওরকমে—

লখাই অবাক হয়ে গেল। একটা পেট কী রকম?

ও দুটোকে তো বিলিয়ে দে যাব।

লখাই তাকিয়ে দেখল, ওদুটোর তাতে ভুক্ষেপ নেই। তারা একনিষ্ঠভাবে পান করে চলেছে। সে বলল, বিলিয়ে দে কোথায় যাবে।

যাব চটকল মটকলে।

চটকল মটকলে? দুনিয়াসুদ্ধ লোক কি ওই এক কথাই ভাবছে? চটকল আর চটকল। হঠাৎ যেন শ্রীনাথের উপর তার মায়া দয়া দূরে থাক রাগ হতে লাগল। সে উঠে পড়ল।

শ্রীনাথ তার হাতটা ধরে ফেলে বলল, একটুখানিক খেয়ে গেলিনি?

না, ছেড়ে দেও।

ছাড়ব না, একটু খা।

তুমি চটকলে গে মরো, ছেরাদ্দে খাব।

তা খাস, এট্যুস খা।

ধ্যাততরি তোর এট্যুস। বলে লখাই লাথি দিয়ে তাড়িপূর্ণ ভাঁড়টা ফেলে বেরিয়ে গেল।

বউ দুটো আঁতকে উঠে সেই তাড়ির উপর পড়ে মরাকান্না জুড়ে দিল।

শ্রীনাথ চিৎকার করে ডাকল, লখাই, লখাই লক্ষ্মীন্দর!..

লখাই ফিরল না।

শ্রীনাথ ক্রন্দনরতা বউ দুটোকে ধমকে উঠল, অ্যাই চুপ কর। কদিন কাঠ না কাটা হাত সুড়সুড় করছে, শেষটায় তোদেরই আমি চেলা করব কেটে।

তারপর নিজের মনেই বলতে লাগলে, এঃ শালা পেটটা এখনও ঢসটস করছে। বলতে বলতে ঘরে গিয়ে কুড়লটা বের করে নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল। বউ দুটো ভয়ে জড়সড় হয়ে বসল।

শ্রীনাথ বলল, ই হারামজাদীরা, চ তো জঙ্গলপীর থানে। ওখানকার জমি আর গাছ তো মাষের নয়, দেবতার। ওখানেই গাছ কাটব আজ।

বউ দুটো আতঙ্কে ড়ুকরে উঠল। হেই সব্বোনাশ, দেবতার থানে গাছ কাটবে?

তা মানূষের থানে না পেলে কী করব?

বলে সে সেই কুটিল দেবদেবীর আস্তানা জঙ্গলপীরের দিকে অগ্রসর হল।

বউ দুটো ভয়ে ভয়ে উঠল। এগুলো, আবার পেছুল। একটা বউ বলল, চল পাইলে যাই।

কোথায়?

তেলেনীপাড়ায়। মেয়েমানুষে কাজ করে সেখেনে।

চল।

বলে তারা গঙ্গার ধারের দিকে দ্রুত চলতে শুরু করল।

জঙ্গলপীর থেকে বউ দুটোকে ছুটতে দেখে প্রথমে ভীষণ রাগ হল শ্রীনাথের। তারপর ভাবল, না আসতে চাওয়ার মারের ভয়ে পালাচ্ছে–যেমন পালায় অন্য সময়ে মারের ভয়ে। তারপর মনে মনে হেসে বলতে লাগল সে, ছেলেপুলে হবে না, সে ভয়ে মাগীরা দেবতার থানে গাছ কাটবে না।

বলে হাসতে হাসতে কুড়লটা রেখে বসে পড়ল, থাক, কাটব না।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আঠারোশো ষাট সালের এক রাত্রি
২. ০২. গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা আসে
৩. ০৩. নারকেল আর কলা
৪. ০৪. কাঞ্চন-লখাইয়ের সম্পর্ক
৫. ০৫. সেনকর্তা ডেকে পাঠালেন লখাইকে
৬. ০৬. কাঞ্চনের মুখ ভার
৭. ০৭. কালীবউ ও মধুকে নিয়ে
৮. ০৮. সেনবাবুদের বাড়িতে উৎসবের কলরোল
৯. ০৯. মুসলমানদের জুম্মাবার
১০. ১০. অনেকের জমিই নীলামে ডাকা হল
১১. ১১. পুঞ্জপুঞ্জ মেঘে-ছাওয়া সকালের আকাশ
১২. ১২. পরিবারিক সভা বসে গেল
১৩. ১৩. পবনের ভিটা-ত্যাগ
১৪. ১৪. জায়গায় জায়গায় রক্ত জমে
১৫. ১৫. লখাই গরুর গাড়ি ছাড়ল
১৬. ১৬. বাসন মাজতে মাজতে
১৭. ১৭. পূর্বের সেই গৌরব
১৮. ১৮. লখাইয়ের ব্যাপারটা
১৯. ১৯. সন্ধ্যাবেলা সেজবাবুর কাছ থেকে চিঠি
২০. ২০. লখাই যখন ফিরে এল বাড়িতে
২১. ২১. কাটুনিবউয়ের অন্তর্ধানের পর
২২. ২২. জঙ্গলপীরের কাছে এসে
২৩. ২৩. একটা গরুর গাড়ি এসে দাঁড়াল
২৪. ২৪. তেলেনীপাড়ার চটকল
২৫. ২৫. একদিন বিকাল বেলা
২৬. ২৬. কাঞ্চনের বাপের বাড়ি থেকে
২৭. ২৭. পবনের আত্মহত্যা
২৮. ২৮. দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল
২৯. ২৯. লখাই দাওয়ায় বসে রয়েছে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন