২৩. একটা গরুর গাড়ি এসে দাঁড়াল

সমরেশ বসু

দুপুরবেলা।

একটা গরুর গাড়ি এসে দাঁড়াল শ্যামের বাড়ির দোরগোড়ায়। বলদের গলায় ঘন্টার শব্দে কালী বাইরে এসে দাঁড়াল। বাড়িতে তখন আর কেউ নেই। কালী ভাল করে উঁকি দিয়ে দেখল কাঞ্চন ছইয়ের ভিতর বসে মিটমিট করে তার দিকে চেয়ে হাসছে। কোলের ভিতর থেকে তার দুটি কোমল কচি কচি হাত মুখের দিকে উখিত হচ্ছে। সে খবর আগেই এসেছিল যে, কাঞ্চনের যমজ ছেলে হয়ে একটি মারা গেছে, অপরটি জীবিত আছে এখনও এবং ভালই আছে। সেও আজ দুমাস আগের কথা।

খুশির বেগে কালী ফিসফিস করে উঠল, হারামজাদী ঠাট করে বসে আছিস কেন, লেমে আয়।

বলে সে ছুটে গিয়ে ছোঁ মেরে তার কোল থেকে শিশুকে তুলে নিয়ে চুমোয় আদরে অতিষ্ঠ করে তুলল। কিন্তু ছেলেটা তাতে বিশেষ অস্বস্তি পেল বলে মনে হল না। সে তার উজ্জ্বল অপলক চোখ দিয়ে সব দেখলে লাগল। কালীর কোলে পা দিয়ে গুতিয়ে ডিঙি মেরে উঠে, কালীর নাক চোখ মুখ সব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের হাঁয়ের মতো গিলে নেওয়ার চেষ্টায় নালে ভরে তুলল। আর এইটুকু ছেলে হাঁ করে মাড়ি দেখিয়ে হাসতে লাগল কেমন খিলখিল করে।

সে হাসি শুনে কালী পাগল হয়ে গেল, ওরে সব্বোনেশে, মোনসার নাতি।

আশেপাশের বাড়ির মেয়ে-বউরা ভিড় করল এসে। ছেলে দেখে যে যার মন্তব্য করতে শুরু করল। কেউ বলল, অবিকল কাঞ্চনের মতো দেখতে হয়েছে। কেউ বলল, কাঞ্চনের রং পেয়েছে কিন্তু হয়েছে বাপের মতোই। কালী বলল, চোখে মুখে একেবারে ওর মা, নাকটা শুধু বাপের পেয়েছে।

কাঞ্চনের রূপ কমেনি কিন্তু কেমন যেন শুকনো ভাব একটু। হয়তো এতখানি পথ আসতে এমন দেখাচ্ছে! তার চোখ ব্যাকুল অস্থির কাকে যেন খুঁজছে সে। থেকে থেকে তার সারা মুখে বিচিত্র গোপন হাসি খেলে যাচ্ছে আর বাইরের দিকে দেখছে কেবলি। তারপর কালীকে বলল, জানো দিদি, তোমার দেওরপুত্রকে মাঝে মাঝে কাঁদিয়ে কান্না শুনতে নাগে। ছোঁড়া শুধু হাসে।

হাসুক, আমি তাই দেখে মরব।

বলতে বলতে তার চোখে হুহু করে জলের ধারা ফেটে বেরুল। শিশুর গালে গাল দিয়ে সে বলে উঠল, এ সমসারে আর কেউ হাসে না, কেউ না। ও হাসুক রাতদিন, হেসে হেসে সবার ঘুম অবধি কেড়ে নিক।

মেয়েদের ভিড় কমে গলে কাঞ্চন জিজ্ঞেস করল, দিদি, ভাসুর কোথায়? মধুকেও দেখিনে?

কালী বলল, ওরা মাঠে গেছে। আর লখাই–

তাকে চুপ করতে শুনে কাঞ্চনউল্কণ্ঠিত চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকাল।

কালী বলল, কাজ নেই, সে তো শুনেছিস। কোনদিন মাঠে যায়, কোনদিন যায় না। এখানে সেখানে ঘোরে, কী যেন ভাবে, নোকজনকে বলে, চটকলের গোরাদের কেউ জমি বিকিয়ো না। নোকে বলে বিকোব না কিন্তু মনে মনে সবাই জানে, চাইলে বিকোতেই লাগবে। আর মুরলীদাসের আখড়া ভেঙে সেখেনে চটকল হয়েছে। আখড়া উঠে গেছে পুবে, পেরায় মাঠের ওপরে। সেখানেও যায়, থাকে কোনও কোনওদিন।

থাকে? আখড়ায়? চমকে উঠল কাঞ্চন। চোখ জ্বলে উঠল, ফুলে উঠল নাকের পাটা। সারা মুখ যেন প্রবল জ্বরের ঘোরে থমথমে হয়ে উঠল। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।

তার চোখের উপর বারবার ভেসে উঠল সরি বোষ্টমির হাসিখুশি মুখ। যে হাসি দেখে লখাইয়ের ধন্দ লাগে। সেই ধন্দের ঘোরে বুঝি আজকাল রাত্রিযাপন করেও আসতে হয়। মিসে। কাঞ্চীবউয়ের শিয়রে তুমি এমনি করে মরণকাটি বয়ে আনছ?

সকল অধ্যায়

১. ০১. আঠারোশো ষাট সালের এক রাত্রি
২. ০২. গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা আসে
৩. ০৩. নারকেল আর কলা
৪. ০৪. কাঞ্চন-লখাইয়ের সম্পর্ক
৫. ০৫. সেনকর্তা ডেকে পাঠালেন লখাইকে
৬. ০৬. কাঞ্চনের মুখ ভার
৭. ০৭. কালীবউ ও মধুকে নিয়ে
৮. ০৮. সেনবাবুদের বাড়িতে উৎসবের কলরোল
৯. ০৯. মুসলমানদের জুম্মাবার
১০. ১০. অনেকের জমিই নীলামে ডাকা হল
১১. ১১. পুঞ্জপুঞ্জ মেঘে-ছাওয়া সকালের আকাশ
১২. ১২. পরিবারিক সভা বসে গেল
১৩. ১৩. পবনের ভিটা-ত্যাগ
১৪. ১৪. জায়গায় জায়গায় রক্ত জমে
১৫. ১৫. লখাই গরুর গাড়ি ছাড়ল
১৬. ১৬. বাসন মাজতে মাজতে
১৭. ১৭. পূর্বের সেই গৌরব
১৮. ১৮. লখাইয়ের ব্যাপারটা
১৯. ১৯. সন্ধ্যাবেলা সেজবাবুর কাছ থেকে চিঠি
২০. ২০. লখাই যখন ফিরে এল বাড়িতে
২১. ২১. কাটুনিবউয়ের অন্তর্ধানের পর
২২. ২২. জঙ্গলপীরের কাছে এসে
২৩. ২৩. একটা গরুর গাড়ি এসে দাঁড়াল
২৪. ২৪. তেলেনীপাড়ার চটকল
২৫. ২৫. একদিন বিকাল বেলা
২৬. ২৬. কাঞ্চনের বাপের বাড়ি থেকে
২৭. ২৭. পবনের আত্মহত্যা
২৮. ২৮. দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল
২৯. ২৯. লখাই দাওয়ায় বসে রয়েছে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন