সৌভিক চক্রবর্তী
অষ্টমীর দুপুরটা ভাদুড়ি মশায়ের গল্প শুনে একেবারে জমজমাট কেটেছে। তাই আজ নবমীর দুপুরটাও নষ্ট করতে চায়নি পল্লব। সবাইকে জপিয়ে নিয়ে হাজির হয়েছে ভাদুড়ি মশায়ের বাড়িতে। ভাদুড়ি মশায়ও খোশমেজাজে আছেন। বললেন, বলুন রাইটার সাহেব, আজ কী শুনতে চান?
একটু ভেবে পল্লব বলল, আজও একটা ঠাকুর দেবতার গল্প হয়ে যাক স্যার।
ভুরু কুঁচকে ভাদুড়ি মশায় বললেন, যদ্দুর জানি দেবদ্বিজে তোমার তো বিশ্বাস নেই। তা হলে কাল থেকে ঠাকুর, দেবতা, ঈশ্বর নিয়ে পড়লে কেন?
পল্লব কিছু বলার আগেই তিতাস ফস করে বলে উঠল, বিশ্বাস আছে স্যার। যথেষ্টই আছে কিন্তু ও ডিনায়ালে ভোগে।
মোটেই না, প্রতিবাদ করে উঠল পল্লব, কোনও ডিনায়াল না। আমার জীবনে ঈশ্বরের অবস্থান এবং উপস্থিতি নিয়ে আমার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। ঠাকুর দেবতা ইত্যাদি নিয়ে আমার ইন্টারেস্ট আছে কিন্তু আমি ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করি না।
তা হলে ঠাকুরের গান শুনে কাঁদিস কেন? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে তিতাস।
একযোগে পল্লবের দিকে নিবদ্ধ বেশ কয়েক জোড়া চোখ। তাকে সবচেয়ে বেশি মাপছে সঞ্জয় আর অমিয়। পল্লব বুঝতে পারল এবার শুরু হবে আওয়াজ দেওয়া। তিতাস একটা সিক্রেট সবার সামনে ফাঁস করে দিয়েছে আর এমন অসভ্য তিতাসটা, মিটিমিটি হাসছে। অমিয় সবে কিছু বলবে বলে মুখটা খুলেছে, পল্লবকে বাঁচিয়ে দিলেন ভাদুড়ি মশায় স্বয়ং। বললেন, ঠাকুর দেবতা বিশ্বাস করি না বলে ভক্তিগীতি শুনে চোখে জল আসতে পারবে না এ কেমন কথা? এ তো অতিসরলীকরণ হয়ে গেল হে ডাক্তারবিবি।
পল্লবের লেগপুল করা যাবে বলে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল অমিয়। বেশির ভাগ সময় পল্লবই সকলের লেগপুল করে। আজ ব্যাটাকে বাগে পাওয়া গেছে। মওকাটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ল সে। ভাদুড়ি স্যারের ওপর তো আর কথা চলে না। তবু একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ করল, কেন স্যার? এটাকে তো হিপোক্রিসি বলে।
একেবারেই বলে না অমিয়। এবার তেড়েফুঁড়ে উঠেছে পল্লব। ভাদুড়ি স্যারের প্রশ্রয় পেয়ে সে এতক্ষণে হালে পানি পেয়েছে। গলা ঝেড়ে বলল, ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করা আধ্যাত্মিকতা দু’টো তো আলাদা জিনিস। আমি ছোটবেলা থেকে একটা অদ্ভুত আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছি। আমাদের বাড়িতে নিত্যপুজো হত। আমার কাকার একটা মন্দির ছিল, সে মন্দির আজও আছে। প্রতি গুরুপূর্ণিমায় বিরাট করে রামকৃষ্ণ দেবের পুজো হত। আমার ঘুম ভাঙত মহেশরঞ্জন সোমের গান শুনে। ‘কে তুমি এলে এবার প্রেমিক উদাসীর ভানে?’ পুজোর আগে আগে আগে প্রতিদিন সৎসঙ্গের লোকেরা ভোরবেলায় গান গাইতে গাইতে প্রভাতফেরী করত। আমি প্রথম যে গানটা শিখেছিলাম সেটা হল, ‘ছাড়ো রে মন ভবের আশা/ অজপা নামে করো রে নেশা।’ তার পর যখন গানের কথার মানে বুঝতে শিখলাম আমি শ্যামাসঙ্গীতের প্রেমে পড়ে গেলাম। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত এবং আরও কত পদকারের পদ পান্নালালের কণ্ঠ বেয়ে আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গেল। ‘তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি/ তবে আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই।’ এমন করে ক’ জন বলতে পারে রে? সত্যি তো, এমন কনফিডেন্স যদি আমার থাকত, যদি ডাকার মতো ডাকতে পারতাম তা হলে কি আমার শিল্পের চূড়ান্ত রূপ আমার কলমে ধরা দিত না? দেয় না কেন? কেন আমি মধ্যমেধার লেখক? কারণ আমার সেই সমর্পণ নেই। আমি ডাকার মতো ডাকতে পারি না। তার পর কলেজে উঠে বৈষ্ণব পদাবলী পড়লাম। কীর্তন শুনলাম। সে তো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করেই লেখা পদ। কিন্তু অমন প্রেম আমি কেন করতে পারি না? কেন ওভাবে ভালোবাসতে পারি না তিতাসকে? আমার এই এত অক্ষমতা আমাকে কুরে কুরে খায়। তাই ওই গানগুলো যখন শুনি আমার কষ্ট হয়। কান্না পায়। কী করব বল?
পল্লব যখন থামল সবাই তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শুধু ভাদুড়ি মশায়ের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। একটু দম নিয়ে পল্লব আবার বলল, আমি নিজে বিশ্বাস না করতে পারি কিন্তু আমি কারও বিশ্বাসে আঘাত করি না। আর আমি এটা মানি বিশ্বাসের একটা ভয়ানক জোর আছে। বিশ্বাস অসাধ্যসাধন করতে পারে। কী স্যার? তাই না?
মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়, একদম ঠিক বলেছ পল্লব। খুব সুন্দর বলেছ। তুমি ঠাকুর দেবতার গল্প শুনতে চেয়েছিলে না? আজ আমি তোমাকে একজন মানুষের গল্প শোনাব। যে বিশ্বাস করে নিজেকে দেবতার উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।
গল্পের গন্ধ পেয়ে সবাই নড়েচড়ে বসল। এক ঢোঁক জল খেয়ে ভাদুড়ি মশায় বললেন, আমার দেশের বাড়ি যে পুব বাংলায় সে তো বলেইছি। আমি যে গ্রামে থাকতাম তার পশ্চিম দিকে ছিল কুসুমপুর গ্রাম। সে গ্রামের আরাধ্য ইদ্রিশঠাকুর।
সবাই একটু থমকে গেল। অপালা বলল, ইদ্রিশঠাকুর? ইনি তো তেত্রিশ কোটির দলে পড়েন বলে মনে হচ্ছে না।
না, ইনি কুসুমপুরের লোকায়ত দেবতা। একেবারে ওদের নিজস্ব। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের পনেরো তারিখে ইদ্রিশঠাকুরের থানে মেলা বসে। চারদিন ধরে মেলা চলে। তা কীভাবে এই ইদ্রিশঠাকুর এলেন তাই নিয়েই গল্প। আমি শুনেছি আমার বাবার কাছে। বাবা শুনেছেন তাঁর বাবার কাছে। এ কাহিনি কোথাও লেখা নেই, আমাদের শ্রুতিতে আছে। স্মৃতিতে আছে। যেমন ভাবে বাবার মুখে শুনেছিলাম, তেমন ভাবেই তোমাদের শোনাচ্ছি।
‘তখন কুসুমপুরের জমিদার নরেন্দ্রপ্রতাপ সিংহরায়। তিনি যেমন খেয়ালি তেমনই একগুঁয়ে। তাঁর ভয়ে প্রজারা থরহরি কম্প। এক বর্ষার দুপুরে তাঁর রাজত্বে হাজির হল ইদ্রিশ। পরনে এক ফালি লাল কাপড়। মাথায় জটা, মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। সে শুধু তার নাম বলল কিন্তু কোথায় থাকত, কীভাবে এখানে এল কিছুই জানা গেল না।
গ্রামের একপাশে বটগাছের তলায় সংসার পাতল ইদ্রিশ। সংসার বলতে একটা মেটে হাঁড়ি, একটা ঝোলা আর একটা বেঁটে লাঠি। সে সারাদিন গাছতলাতেই বসে থাকে আর পাশ দিয়ে কেউ গেলেই চিৎকার করে, মারণ, উচাটন, বশীকরণ, বায়ুবন্ধন করানো লাগে গো কত্তা? দুই বেলা পেটচুক্তি খাওয়া দিলেই হইব। পয়সা দেওন লাগব না ইদ্রিশের। পয়সায় মন্ত্রের গুণ বেবাক নষ্ট হয়। ইদ্রিশের বাণ শত্তুরের চোখ দিয়া গলগল কইরা বাইর হইয়া আসে তাজা রক্ত। পয়সা দেওন লাগব না। পেটচুক্তি খাওয়া।
দিন কয়েকের মধ্যেই পাগল হিসেবে পরিচিত হয়ে গেল ইদ্রিশ। এতদিন গ্রামে কোনও পাগল ছিল না বলে কুসুমপুরের লোকেরা মনমরা হয়ে থাকত। ইদ্রিশ আসায় সেই অভাব ঘুচল। তাই বলে যে ইদ্রিশের খাদ্য সমস্যা মিটল এমন নয়। মানুষ ঢিল মেরে, লাঠিপেটা করে পাগলের খাতিরদারি করে। ইদ্রিশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। চুরি-চামারি করে আর ক’দিন বেঁচে থাকা যায়? ইদ্রিশপাগলা কুসুমপুরের পাট ওঠাবে ভাবছে এমন সময় তার দেখা হয়ে গেল বিভূতির সঙ্গে।
ছোট্ট ছেলে বিভূতি। তার বাবা ভূষণ ভাগচাষি। মা নারকেল পাতা ছেঁচে ঝাঁটা বানায়, ঢেঁকিতে পাড় দেয়, অন্যের বাড়ি ধান সেদ্ধ করে। বিভূতিদের গরিব ঘরেই একবেলা অন্নসংস্থান হয়ে গেল ইদ্রিশের। তবে এর পিছনেও কারণ আছে। কেমন করে যেন ইদ্রিশের ভক্ত হয়ে গেছিল ছোট্ট বিভূতি। রোজ সন্ধ্যায় ইদ্রিশের জন্য কলাপাতায় মুড়ে খাবার পৌঁছে দিত সে। তার পর দু’জনের গল্প হত।
বিভূতি বলত, তোমায় যখন ঢিল মারে তুমি কিছু বলো না কেন?
ইদ্রিশ বলত, ক্ষমা হইল গিয়া পরম ধর্ম। বোঝলা বাপধন? ইদ্রিশ যদি একখান বাণ মারে তা হলে কেউ বাঁচবো না। একবিন্দু বাতাসের লগে সব আকুলিবিকুলি করব।
সত্যি?
সত্য না তো কি মিছা কথা কই? আমার পুষা জিন আছে, জানো?
জিন কী?
তোমরা যারে দত্যি কও হেই বস্তু।
সত্যি?
আবার কয় সত্যি? আমার তিনটা পুষা জিন বুঝলা? দুইটা পুরুষ একটা মাইয়া।
ওদের নাম কী?
পুরুষ দু’টার নাম ফজল আর বদলু। মাইয়াডার নাম লিলি।
ওরা কী করে?
মাইয়াডা বড্ড সাজুনি। দিনরাত গালে রং মাইখ্যা বইস্যা থাহে আর চুল আঁচড়ায়। কাজকামে মন নাই।
ফজলু আর বদলু?
এই দু’টা মহা বদ। বদের বদ। শয়তানের বাচ্চা। খালি ঘুমায়। তবে ওদের বিরাট শক্তি। যদি ওদের জাগাই আমি যা চাই তাই হইব।
যা চাইবে তাই? এখানে রাজপ্রাসাদ বানাতে পারবে।
রাজপ্রাসাদ? এইডা তো সরল কাম। তোমারে একদিন সব শিখাবো।
সত্যি?
সত্য সত্য সত্য।
ইদ্রিশের এই আশ্চর্য ক্ষমতার গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে থাকে ছোট্ট বিভূতি। কল্পনায় দেখতে পায় ফজলু, বদলু আর লিলিকে দিয়ে সে যা খুশি তাই করাচ্ছে। একদিন সেও মারণ, উচাটন, বশীকরণ আর বায়ুবন্ধন শিখে যাবে। ইদ্রিশ কি আর যে সে লোক?
সেবার প্রচণ্ড গরম পড়ল। সেই যে ফাল্গুনের মাঝামাঝি বৃষ্টি হয়েছে তারপর চৈত্র, বৈশাখ পার হয়ে জ্যৈষ্ঠ এসে পড়ল অথচ আকাশে এক টুকরো মেঘের দেখা নেই। খালি চোখে তাকানো যায় না এমন রোদের তাত। আশপাশের সাত-আটটা গ্রামের সব পুকুর, কুয়ো শুকোতে আরম্ভ করল। দেখা দিল প্রবল জলকষ্ট। কাক, কুকুর মরতে লাগল জলের অভাবে। পুকুরগুলোর কাদা সেঁচে তোলা এক আঁজলা ঘোলা জলের জন্য মারপিট লেগে গেল দিকে দিকে। অথচ জমিদারের দিঘি ভর্তি টলটলে জল ব্যবহারের অনুমতি পেল না কুসুমপুরের লোকেরা। তারা জমিদারের সামনে চোখের জলের পুকুর বানিয়ে ফেলল কিন্তু লাভ হল না কিছুই। রোজ তারা তিন মাইল পথ হেঁটে বাগদার খাল থেকে জল আনতে শুরু করল। কিন্তু এতেও শান্তি নেই। জল লুঠ হতে লাগল। বাগদার খাল থেকে কুসুমপুরে আসতে মাঝপথে পড়ে বড় এক মাঠ। সেখানেই লুঠেরারা মুখে গামছা বেঁধে লুকিয়ে থাকে। মেয়ে আর বাচ্চাদের জল নিয়ে ফিরতে দেখলেই কেড়েকুড়ে নেয়।
এমনই একটা অবস্থায় একদিন গভীর রাতে জমিদারের দিঘি থেকে জল চুরি হল। জল চুরির নেপথ্যে ছিল বিভূতির বাপ ভূষণ। তাকে বেঁধে নিয়ে গেল জমিদারের পাইক। পঞ্চাশ ঘা চাবুক মেরে তাকে বেঁধে রাখা হল দেউড়িতে। কঠিন সাজা না দিলে মানুষ ভয় পায় না।
বিভূতি আছাড় খেয়ে পড়ল ইদ্রিশের কাছে, তোমার ফজলু আর বদলুকে জাগাও। আমার বাপকে বাঁচাও।
বিভূতির কান্নায় চোখ ফেটে জল আসে ইদ্রিশের। সে পাথরের মতো বসে থাকে। তার পায়ে ধরে বিভূতি। কিল, চড়, ঘুসি মারে। ইদ্রিশের ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ে। তবু সে কথা বলে না।
বিভূতি উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার করে বলে, তুমি মিথ্যুক। সবাই ঠিক বলে। জিনটিন সব বাজে কথা। তোমার কোনও ক্ষমতা নেই। তুমি পাগলা। পাগলা পাগলার মতো থাকবে।
তারপর এত বড় একটা ঢেলা ছুড়ে মারে ইদ্রিশের কপাল লক্ষ্য করে। আটকানোর চেষ্টাও করে না ইদ্রিশ। সে তখন প্রাণপণে তার জিনেদের জাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জলচোরকে শাস্তি দিয়ে খুশি মনে বাগানে বসেছিলেন সপারিষদ নরেন্দ্রপ্রতাপ। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে প্রণাম করল ইদ্রিশ। নরেন্দ্রপ্রতাপের মেজাজটা আজ ফুরফুরে। তিনি বললেন, কী রে ইদ্রিশ কী চাস?
আমারে সাড়ে তিন হাত জমিন লিখাপড়ি কইরা দেন কত্তা। দাফন করতেও তো সাড়ে তিন হাত জমিন লাগে। আল্লার দুনিয়ায় এইটুক জমিন তো হক্কলের পাওনা। আপনার দুনিয়ায় আমারে এইটুক জমিন লিখাপড়ি কইরা দ্যান কত্তা।
কেন রে, তুই মরবি নাকি?
ইদ্রিশ উত্তর দেয় না। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নরেন্দ্রপ্রতাপের কী খেয়াল চাপে তিনি নায়েবকে ডেকে বলেন, আপনি কাগজপত্র আনুন। তোর ইচ্ছামতো সাড়ে তিন হাত জমি বেছে নে রে ইদ্রিশ।
তার বটগাছের আস্তানার পাশেই জায়গা বাছে ইদ্রিশ। কাগজপত্র বুঝে নিয়ে যাওয়ার সময় একটা কোদাল, গাঁইতি, বালতি আর মোটা দড়ির আবদার করে সে। কাকের মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ে, নিজের হাতে নিজের কবর দেবে ইদ্রিশপাগলা। গাঁয়ের লোক এই মজা দেখতে ছুটে আসে।
এক মনে মাটি কোপাচ্ছে ইদ্রিশ। ঝপ ঝপ কোদাল পড়ছে আর একটু একটু করে গভীর হচ্ছে গর্ত। লোকজন হাঁক দেয়, এই পাগলা, এই বার শুয়ে পড় কবরে।
ইদ্রিশ উত্তর দেয় না। গর্ত গভীর হচ্ছে ক্রমশ। সন্ধে নামে। বটগাছের চারপাশে মানুষের ভিড় দেখে বিরক্ত হয় পাখিরা। তারা চেঁচামেচি শুরু করে। ইদ্রিশের কাজের বিরাম নেই। কে একজন কলাপাতায় করে খাবার রেখে গেছে। ফিরেও তাকায়নি সে। পুরনো বিদ্যা চলকে উঠেছে তার রক্তে। সে শুনতে পাচ্ছে সেই শব্দ। সে বুঝতে পারছে আর ঠিক কতটা।
তিনদিন ধরে ক্রমাগত মাটি কাটছে ইদ্রিশ। এক মুহূর্তের জন্যেও তার হাত চলা থামেনি। তার বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। নিঃশ্বাসের বদলে কেমন একটা সাঁইসাঁই শব্দ হচ্ছে। গর্তের মুখে ভেঙে পড়ছে গাঁয়ের লোক। তারাও হাত লাগিয়েছে ইদ্রিশের সঙ্গে। বালতি বালতি মাটি উঠছে গর্ত থেকে। চারদিনের মাথায় ইদ্রিশ শব্দটা পেল। কল কল করে জল উঠছে গর্তে। তাজা পরিষ্কার কাচের মতো স্বচ্ছ জল। মাটির বুক থেকে উঠে আসছে প্রাণ।
কাদা মাটি মাখা ইদ্রিশকে শোয়ানো হয়েছে বটগাছের নিচে। সে শুনতে পাচ্ছে, আনন্দে কোলাহল করছে গোটা গাঁয়ের লোক। ঘোলাটে চোখে সে কাকে যেন খুঁজছে। বিভূতি এসে তার পাশে বসে। হাপরের মতো শ্বাস টানতে টানতে ফিসফিস করে সে বলে, দেখলা?

কী?
ফজলু আর বদলু কেমন কামটা করলো?
কুয়ো তো তুমি কাটলে।
চাইর দিনে কুয়া কাটা কোনও একা মাইনষের কাম না।
তবে?
কী কইছিলাম তুমারে? ইদ্রিশ যদি ইচ্ছা করে…
গলার স্বর জড়িয়ে আসে ইদ্রিশের। চারদিনের অমানুষিক পরিশ্রমে তার হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তখন। তবু তার মুখে যেন আরামের হাসি। তাকে ঘিরে বিভূতি চিৎকার করছে, তোমরা কেউ বিশ্বাস করতে না কিন্তু সত্যি তিনটে জিন আছে। নয়তো চারদিনে কোনও মানুষ কুয়ো কাটতে পারে? ইদ্রিশ কি যে সে লোক না কি?
গ্রামের লোকজনও সেটাই বিশ্বাস করতে শুরু করে। অস্বাভাবিক কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার করার থেকে অলৌকিকে বিশ্বাস করা অনেক সোজা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জটিল হিসেব সাধারণ মানুষ বোঝে না।’
গল্প শেষ করলেন ভাদুড়ি মশায়। সবাই চুপ করে বসে আছে। তিতাসের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, তা হলে কী বুঝলে ডাক্তারবিবি?
একটা বড় শ্বাস ছেড়ে তিতাস বলল, একটা গান গাই স্যার?
মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়। চোখ বুজে তিতাস গান ধরল, ‘আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছু জানি নে মা/ শুধু যা জেনেছি সেটুক হল এই/ তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি/ তবে আসবি নে তোর তেমন সাধ্য নেই…’
র থেকে অলৌকিকে বিশ্বাস করা অনেক সোজা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জটিল হিসেব সাধারণ মানুষ বোঝে না।’
গল্প শেষ করলেন ভাদুড়ি মশায়। সবাই চুপ করে বসে আছে। তিতাসের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, তা হলে কী বুঝলে ডাক্তারবিবি?
একটা বড় শ্বাস ছেড়ে তিতাস বলল, একটা গান গাই স্যার?
মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়। চোখ বুজে তিতাস গান ধরল, ‘আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছু জানি নে মা/ শুধু যা জেনেছি সেটুক হল এই/ তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি/ তবে আসবি নে তোর তেমন সাধ্য নেই…’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন