সৌভিক চক্রবর্তী
পল্লব বলল, স্যার আপনার কখনও ঈশ্বর দর্শন হয়েছে?
অষ্টমীর দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আড্ডা বসেছে ‘শ্রীরঞ্জনী’ মানে ভাদুড়ি মশায়ের বাড়ির বারান্দায়। পড়ন্ত দুপুরের মিঠে রোদ গা ধুয়ে দিচ্ছে। পুজো উপলক্ষে লম্বা একটা ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছে অপালা। তারই উদ্যোগে এই জমায়েত। অমিয়, মিতুল, দীপক পাল, পল্লব, তিতাস, সবাই আছে। এমনকী অপালার অনুরোধে সঞ্জয় অবধি এসে উপস্থিত হয়েছে। বাংলায় দুর্গাপুজো প্রচলনের গল্প শোনাচ্ছিলেন ভাদুড়ি মশায়। মশায়ের গল্প বলার ধরনটি ভারী চমৎকার। ইতিহাসের কচকচানিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল ওরা। এমন সময় হ্যান্ড গ্রেনেডের মতো দুম করে প্রশ্নটা ছুড়ে বসল পল্লব।
থমকে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। তটস্থ হয়ে উঠল বাকিরা। কথার মাঝপথে বাধা মোটেই পছন্দ করেন না বৃদ্ধ। চাপা গলায় পল্লবকে ধমকে উঠল তিতাস, কথার মাঝে কথা বলিস কেন? আক্কেল নেই তোর? তার পরেই ভাদুড়ি মশায়কে বলল, ওর কথায় কান দেবেন না স্যার। আপনি প্লিজ কন্টিনিউ করুন।
প্রশ্নটা কিন্তু পল্লব মন্দ করেনি, সবাইকে অবাক করে স্মিত হেসে বলে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়।
সবার দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল পল্লব। একে বলে কলার তোলা হাসি। বলল, হ্যাঁ স্যার, আমি অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম আপনাকে প্রশ্নটা করব। আপনার বিবিধ বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এমন কিছু কি কখনও ঘটেনি আপনার জীবনে?
ফের স্মিত হাসলেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, জীবের মধ্যেই তো ঈশ্বরের বাস। সে হিসেবে ঈশ্বর দর্শন তো সব সময়েই হচ্ছে।
দাদু যে বেশ খোশমেজাজে আছে এতক্ষণে বুঝে গেছে অপালা। সে চেপে ধরল, উঁহু। অমন ভাসাভাসা উত্তর দিলে হবে না। বলো না, দেখেছ কি না?
একটু যেন উদাস হয়ে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। চশমাটা খুলে কোলের ওপর রেখে বললেন, সত্যি কথা কী জানো দিদিভাই, ঈশ্বর প্রতি মুহূর্তে আমাদের দেখা দেন। আমাদের তো পাপী চোখ আমরা দেখতে পাই না। তেমন চোখ থাকলে দেখতে পেতাম। আমার জীবনে বেশ কয়েকবার এমন ঘটনা ঘটেছে কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমি সে পরম মঙ্গলময়কে চিনতে পারিনি।
ইতিহাসের চেয়ে এ কাহিনি অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। তিতাসও এ বার আবদারের গলায় বলল, প্লিজ বলুন না স্যার। খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। দুই চোখ দূরগামী। যেন অতীত মন্থন করছেন একাগ্রচিত্তে। এক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন, সে বহুকাল আগের কথা। তখন আমার তেরো-চোদ্দো বছর বয়স হবে। আমাদের আদি বাড়ি কিন্তু ময়মনসিংহে। পঞ্চাশ সালে আমরা এদিকে চলে আসি।
অবাক হয়ে পল্লব বলে উঠল, তাই না কি স্যার? আমাদের দেশের বাড়িও তো ময়মনসিংহে। আমার বাবার জন্ম যদিও এখানেই তবু ঠাকুরদাদার মুখে দেশের বাড়ির গল্প শুনেছি।
কী নাম তোমার ঠাকুরদাদার? যদিও ময়মনসিংহ অনেক বড় জায়গা তবু দেখি চিনতে পারি কি না?
শ্রী রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
একটু ভাবলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর মাথা নেড়ে বললেন, নাহ্। এ নামে কাউকে চেনা লাগছে না। যাই হোক, যা বলছিলাম, তখন মার্চ মাসের মাঝামাঝি। আমাদের ছেলেবেলায় আলাদা করে হেমন্ত আর বসন্তকাল দুটোই বোঝা যেত, বুঝলে? হেমন্তে হিম পড়ত আর বসন্তে নরম রোদের চাদর গায়ে দিয়ে সেজে উঠত চারপাশ। ভারী মন ভালো করা আবহাওয়া। তবে একটা ভয় ছিল। খুব গুটিবসন্ত হত। যাকে বলে স্মল পক্স। তখনও বসন্তের টিকা নেওয়ার মতো সচেতনতা আসেনি গ্রামগঞ্জের লোকের মধ্যে। ফলে গুটিবসন্তে বহু মানুষ মারা পড়ত। আর এ রোগ ছিল তেমন ছোঁয়াচে। কারও বসন্ত হয়েছে জানতে পারলে গ্রামদেশে একঘরে করা হত। সে ভারী কষ্টের। তা সেবার এমনই এক বসন্তকালে মামাবাড়ি থেকে চিঠি এল, ছোটমামার ছেলে হয়েছে। তার দিন কতক আগেই পুকুরপাড়ে পিছলে পড়ে মায়ের গোড়ালিতে চোট লেগেছে। বাবার পক্ষে চাষবাস ফেলে রেখে যাওয়া সম্ভব না। অগত্যা একটা সোনার বাজুবন্ধ পেটকাপড়ে বেঁধে আমি আর আমার থেকে দু’ বছরের ছোট ভাই বীরেন্দ্রনাথ রওনা দিলাম মামাবাড়ির উদ্দেশে। আমাদের গ্রাম থেকে ছ’খানা গ্রাম পেরিয়ে মামাবাড়ি। এমনিতে ও দেশে জল আর জল। অন্য সময় হলে নৌকা বেয়েই চলে যেতাম। কিন্তু সেবার বর্ষা তেমন হয়নি ফলে বৈশাখের দোরগোড়ায় এসে খাল বিলের নাব্যতা গেছে কমে। অনেক জায়গায় তো হাঁটুও ডোবে না। অগত্যা হণ্টন।
তিতাস বলল, অতটা রাস্তা পায়ে হেঁটে?
হাসলেন ভাদুড়ি মশায়, নিজের জখম পা দু’টোর দিকে তাকিয়ে বললেন, এককালে পা দু’খানাই তো যাতায়াতের মাধ্যম ছিল। মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারতাম। সবটা যে সাধ করে তা নয়, কিছুটা বাধ্য হয়েও। কারণ, গোরুর গাড়ি ভাড়া করার পয়সা ছিল না আমাদের। যাই হোক, ভোর থাকতে থাকতে দু’ভাইতে পা চালালাম। ঠিকমতো যেতে পারলে সন্ধে নাগাদ মামাবাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। প্রথম তিনখানা গ্রাম নির্বিঘ্নেই পেরিয়ে গেলাম। দুপুর হতে গাছের নীচে বসে ফলারও সেরে নিলাম দু’জনে। একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের যাত্রা শুরু করব। সামনের গ্রামের নাম তালদি। তালদির পর বড়জাগুলে, তার পর বোষ্টমগোলা পেরোলেই মামাবাড়ির গ্রাম জগন্নাথপুর। খাবার খেয়ে মিঠে হাওয়ায় দু’জনেরই চোখ লেগে গেছিল। ফিরিওলার ডাকে আমার ঘুম ভাঙল। দেখলাম, বীরু তখনও ঘুমোচ্ছে। আমি ডাক দিলাম, বীরু ওঠ। পথ আর বেশি বাকি নেই। গিয়ে একেবারে ঘুম দিবি। বীরু।
চোখ মেলল বীরু আর আমি প্রচণ্ড চমকে উঠলাম। বীরুর চোখ দু’টো রক্তজবার মতো লাল। বললাম, এই বীরু কী হয়েছে তোর?
ঘোর লাগা গলায় বীরু বলল, খুব মাথাব্যথা করছে রে দাদা।
অবাক হয়ে গেলাম আমি। এই তো এতক্ষণ দিব্যি হাঁটছিল। হঠাৎ মাথাব্যথা করছে কেন? গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, বেশ জ্বর। এবার একটু ভয় পেলাম আমি। খুব বেশি পথ না হলেও পথ নেহাত কমও নয়। এই অবস্থায় ও কি হাঁটতে পারবে! বললাম, কী মনে হচ্ছে? হাঁটতে পারবি?
নেতিবাচক মাথা নাড়ল বীরু, পায়ে জোর নেই দাদা। মাথার মাঝখানটা খুব চুলকোচ্ছে। একটু চুলকে দে না রে।
বীরুর মাথায় হাত দিয়ে আমি শিউরে উঠলাম। মাথাভর্তি ছোট ছোট গুটি আর তাদের অভ্যন্তরে টলটল করছে বিভীষিকার মতো তরল। কোন অতর্কিতে যে গুটিবসন্ত ছোবল মেরেছে বীরুকে বুঝতেই পারিনি। দিশাহীন হয়ে সেই গাছতলায় বসে রইলাম আমি আর আমার কোলে নেতিয়ে পড়ল আমার দু’ বছরের ছোট ভাই, মায়ের নয়নের মণি বীরু। রওনা দেওয়ার সময় মা বারবার করে বলেছিলেন, ছোডকারে দেইখ্যা রাইখ্যো। মায়ের কথা বুঝি বা রাখতে পারলাম না আমি। আধ ঘণ্টাও যেতে পারল না, তার আগেই বীরুর সারা গা, মুখ জুড়ে গুটি ফুটে বেরল। এমন ভয়াবহ ভাবে গুটি বেরতে আমি আগে দেখিনি। কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। একে বসন্তের রোগী, তার ওপর ভিনগ্রামের লোক! কেউ সাহায্য করবে না আমাদের। বরং জানতে পারলে দূর দূর করে খেদিয়ে দেবে গ্রামের বাইরে। কিন্তু ভাইটাকে তো এভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিতে পারি না। কিছু একটা বন্দোবস্ত তো করতেই হবে। বীরুকে গাছতলায় শুইয়ে রেখেই আমি উঠে পড়লাম। খুঁজে দেখি যদি কোনও বদ্যিবাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু বিপদের ওপর বিপদ। কয়েক পা এগোতে না এগোতেই আকাশ কালো করে এল। হাওয়া বইতে শুরু করল শনশন করে। তার সঙ্গে মেঘের গুরুগুরু। বুঝলাম, গতিক সুবিধের না। যখন তখন আকাশ ভেঙে নামবে। এই বাদলায় ভিজলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু বীরুকে নিয়ে মাথা গুঁজব কোথায়? এমন সময় চোখে পড়ল, কিছু দূরে একটা ভাঙা মন্দির। মনস্থির করে ফেললাম, বীরুকে মন্দিরের চাতালে শুইয়ে আমি নিজেদের গ্রামের দিকে দৌড় দেব। গ্রামে গিয়ে খবর দিলে তাও একটা ব্যবস্থা হতে পারে।
প্রায় অচেতন বীরুকে ধরে ধরে আমি মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। মনে মনে তখন আমি শুধু ঠাকুরকে ডাকছি। বলছি, হে দয়াময়, সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন তো তুমিই আশ্রয় দাও প্রভু। বীরুকে তোমার পায়ের কাছে রেখে আমি গ্রামে ফিরে যাব। আমি ফিরে না আসা অবধি কেউ যেন ওর ধারেপাশে ঘেঁষতে না পারে। কেউ মানে আমি কী বলতে চাইছি বুঝছ তো প্রভু? বীরু মায়ের বড় আদরের ছেলে। আর মায়ের চোখের জল আমি সইতে পারি না। তোমার শরণ নিলাম আমি। আমায় যেন খালি হাতে ফিরতে না হয়।
মন্দিরের বাইরে একটা ফটক। সেটা পেরিয়ে ভেতরে কিছু দূরে মূল ঠাকুর দালান। বহু দিনের অযত্নে ফটকটা ভেঙে পড়েছে প্রায়। আশপাশে পুরনো পচা পাতার স্তূপ। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই আমি চমকে গেলাম। ভেতরটা একেবারে সাফসুতরো। যেন সদ্য কেউ ঝাঁট দিয়েছে। এক পাশে একটা মাটির চ্যাঙাড়ি, তাতে মুখ ডুবিয়ে এক মনে বিচালি খাচ্ছে একটা গাধা। বুঝলাম, দেখতে পোড়ো মনে হলেও এ মন্দিরে লোক চলাচল আছে। গাধাটা বোধ হয় পূজারির। বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম আমি। লোক থাকা মানেই তো বিপদ। বীরুকে রেখে যেতে গেলে হাজার কৈফিয়ত দিতে হবে। তার পরেও রাখতে দেবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে! বেরিয়ে চলে যাব না কি পূজারিকে অনুরোধ করব, এই সব সাতপাঁচ ভাবছি এমন সময় বিকট শব্দ করে গাধাটা ডেকে উঠল। জোর চমকে উঠলাম আমি। বুঝলাম, আমাদের উপস্থিতি গাধাটা মোটেই পছন্দ করেনি। পা দাপাচ্ছে আর তারস্বরে ডাকছে। এমন করতে থাকলে লোকে তো আমাদের চোর ভাববে। তড়িঘড়ি বীরুকে মন্দিরের চাতালে শুইয়ে আমি এগিয়ে গেলাম গাধাটার দিকে। ব্যাটাকে শান্ত করতে হবে, না হলেই বিপদ। আমায় এগিয়ে আসতে দেখে গাধা তখন তিড়িংবিড়িং লাফাতে শুরু করেছে। খুব রাগ ধরে গেল আমার, সাধে কী গাধা বলে! আমায় দেখে অমন লাফানোর কী আছে! দেখে বুঝিস না, চোর-ডাকাত না ভালো মানুষ? সবে গাধার গায়ে হাত বোলাতে যাব ভাঙা কাঁসরকে লজ্জা দেয় এমন একটা গলা হুঙ্কার দিয়ে উঠল, কে রে পোড়ারমুখো?
চমকে পেছন ফিরে দেখি, এক খুনখুনে বুড়ি। শনের নুড়ির মতো চুল। একটা সাদা থান কোনওরকমে ফেরতা দিয়ে গায়ে জড়ানো। হাতে এক বিশাল ঝাঁটা। বুঝলাম, এই বুড়িই ঝাঁটপাট দিয়ে মন্দিরটা এমন তকতকে করে রেখেছে। হাত জোড় করে কিছু বলতে যাব তার আগেই লাফ দিয়ে তিন পা এগিয়ে এল বুড়ি। বলল, এখানে কী মরতে এয়েচিস? কে ঢুকতে দেচে তোরে? আর উটি কে? অমন মরার মতো পড়ে আচে কেন?
ভাবলাম, মিথ্যে বলে লাভ নেই। যদিও বুড়িকে খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না তবু সত্যিটা শুনলে যদি মন গলে! হাজার হোক মায়ের জাত। বললাম, বুড়িমা, ও আমার ভাই। আমরা জগন্নাথপুর যাচ্ছিলাম। পথে ওর বসন্ত হয়েছে। ভেবেছিলাম, পোড়ো মন্দির, তাই ওকে এখানে শুইয়ে রেখে গ্রামে যাব খবর দিতে…
কথা শেষ করতে দিল না বুড়ি। তার আগেই হাঁইমাই করে উঠল, ও রে আমার নাতজামাই রে! কত আহ্লাদের কতা! একেনে রোগব্যাধি ছোঁয়াছানি করে উনি না কি খপর দিতি যাবেন! বেরো। বেরো এক্কুনি।
হাত জোড় করে বললাম, তাড়িয়ে দেবেন না বুড়িমা। বাইরে মেঘ করেছে। কোথায় ফেলে রাখব বলুন অসুস্থ মানুষটাকে? এখানে ও এক কোণায় পড়ে থাকুক। আমি দৌড়ে যাব। দৌড়ে আসব।
হবে নে, ভীষণ মুখব্যাদান করে উঠল বুড়ি, ভালোয় ভালোয় বলচি, একনও না গেলি কিন্তু কপালে দুক্কু আছে রে ড্যাকরা।
গাধাটাও বুড়ির সাথ তাল মিলিয়ে চ্যা-ভ্যা, চ্যা-ভ্যা করে ডেকে উঠল। যেন সেও বেরিয়ে যেতে বলছে আমাদের। ভারী মাথা গরম হয়ে গেল আমার। বুক চিতিয়ে বুড়িকে বললাম, যাব না। তোমার যা করার করে নাও। ঠাকুরের মন্দিরে আশ্রয় নিতে এসেছি। তুমি তাড়িয়ে দেওয়ার কে হে?
রাগে বুড়ি থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমারও তখন রোখ চেপে গেছে, দেখি বুড়ির কত ক্ষমতা? কিন্তু বুড়ি এর পর যা করল তার জন্য মোটে প্রস্তুত ছিলাম না আমি। এক লাফে বুড়ি আমার কাছে এগিয়ে এল তার পর সটান ঝাঁটাখানা বসিয়ে দিল আমার বুকের ওপর। বুড়ির গায়ে অত জোর আমি কল্পনাও করিনি। ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে আমি ধড়াস করে উলটে পড়লাম। বুক জ্বলে যাচ্ছে তখন। মাথা আগুন গরম। আমি ভাদুড়ি বাড়ির ছেলে, আমায় ঝাঁটার বাড়ি মারা! উঠে বুড়ির হাত থেকে ঝাঁটা কেড়ে নিতে যাব তার আগেই বুড়ি আরও এক ঘা বসিয়ে দিল আমার পায়ের গোছে। সে ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই এবার সোজা মাথায়। চোখে তখন সর্ষেফুল দেখছি আমি। আমায় ছেড়ে বুড়ি এবার বীরুকে পেটাতে শুরু করল। অচেতন মানুষটাকে নির্দয় ভাবে ঝাঁটাপেটা করছে আর চিৎকার করছে, মন্দির নোংরা করবি গুখেগোর দল! মর মর! নিব্বংশ হ।
অমানুষিক ওই প্রহার এবং অভিশাপের সামনে আমি বড়ই ভয় পেয়ে গেলাম। এ ভাবে মারলে অসুস্থ ছেলেটা তো এমনিতেই মরে যাবে। ছুটে গিয়ে দু’ হাতে আড়াল করে ধরলাম বীরুকে। কোনওমতে ওকে টেনে তুলে ছুটে বেরিয়ে এলাম মন্দিরের বাইরে। ইতিমধ্যে আরও কয়েক ঘা আমার পিঠের ওপর পড়েছে। ভেতরে তখনও বুড়ি অবিশ্রান্ত গালাগাল দিচ্ছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে ডেকে চলেছে বিটকেল গাধাটা।
বাইরে বেরোতে না বেরোতেই শুরু হল বাদলা। এমন তার তেজ চারদিক একেবারে সাদা হয়ে গেল। অচেতন বীরুকে টানতে টানতে একটা বড় গাছের নীচে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু জলের যা তোড় ভিজে কাক হয়ে গেলাম দু’জনেই। বীরু মরার মতো পড়ে আছে আর কোলে ওর মাথা নিয়ে আমি অঝোরে কাঁদছি। ভাবছি, এত নিষ্ঠুরও মানুষ হয়! সময়ের হিসেব গুলিয়ে গেছে একেবারে। কতক্ষণ এ বাদলা চলেছে আমার খেয়াল নেই। ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম আমি। ঘোর কাটল বীরুর ডাকে। বীরু ডাকছে, দাদা, এই দাদা।

চমকে ফিরে তাকালাম আমি। দেখলাম, বাদলা থেমে গেছে। মায়ের পুরনো শাড়ির মতো নরম আর জলে ধোয়া হলুদ একটা রোদ উঠেছে। দূরে আকাশের গায়ে রংধনু আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বীরু। আমি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালাম। দু’হাতে ওকে জড়িয়ে আকুল হয়ে বলে উঠলাম, বীরু, তুই কথা বলছিস?
অবাক হয়ে বীরু বলল, ও মা! কথা বলব না কেন? আর তুই এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন শুনি?
তখন আর আমার কথা বলার মতো অবস্থা নেই। আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখছি, বীরুর গায়ে আর একটিও গুটি নেই! কোনও এক আশ্চর্য দৈবী স্পর্শে ও সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হয়ে গেছে! এমনকী ব্যাধিকালীন যন্ত্রণার কথাও ওর মনে নেই! আমি তখন পাগলের মতো ভেবে চলেছি, এ অসম্ভব কী করে সম্ভব হল? আচমকাই এক সম্ভাবনার কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল আমার মাথার মধ্যে আর আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি যা ভাবছি তবে কি তাই? কিন্তু সে যে অবিশ্বাস্য। না না, আমাকে এ রহস্যের কিনারা করতেই হবে। জানতেই হবে কোন জাদুমন্ত্রবলে এ ভাবে ফিরে যেতে বাধ্য হল মারণ বসন্তরোগ? বীরুকে দাঁড়াতে বলে আমি উদভ্রান্তের মতো ছুটলাম। হ্যাঁ, এ পথে কিছুটা গিয়েই তো সেই পোড়ো মন্দির। কিন্তু খানিকটা গিয়েই আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওই তো কানে আসছে শঙ্খ, ঘণ্টার শব্দ। আর একটু এগিয়েই আমার বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা রইল না। মন্দিরটা আমি দেখতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু এ তো মোটেই ভাঙা নয়। রীতিমতো পাকা দালান। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিয়মিত যত্নআত্তি হয়। আমার বুক দুরদুর করতে লাগল। পা কাঁপতে লাগল। একরাশ দ্বিধা আর প্রশ্ন নিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম মন্দিরের ভেতরে। ভেতরে তখন পুজো হচ্ছে। বিগ্রহ এক দেবীর। দেবীর বাহন রাসভ। দেবীর এক হাতে বরাভয় অন্য হাতে সম্মার্জনী। তোমরা আশা করি জানো, রাসভ মানে গাধা আর সম্মার্জনী মানে ঝাঁটা। আমার ভাবনা মিলে গেছে। এ মন্দির মা শীতলার। এ বার আর ঝাঁটাটা চিনতে ভুল হল না আমার। ওই ঝাঁটা দিয়েই মা বীরুর যমকে ওর দেহছাড়া করেছেন। আমার দু’ চোখ তখন জলে ভেসে যাচ্ছে। বসে পড়লাম ধপ করে। কাঁদছি আর মনে মনে বলছি, মা গো, এত কাছে এলে তবু তোমায় চিনতে পারলাম না?
এই অবধি বলে থামলেন ভাদুড়ি মশায়। বারান্দায় তখন নীরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে অপালা বলে উঠল, ওহ মাই গড! দাদু এটা তো ট্রিমেন্ডাস এক্সপিরিয়েন্স।
হাসলেন ভাদুড়ি মশায়। পল্লবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রাইটার সাহেব? গল্পের প্লট হিসেবে মন্দ নয় কী বলো?
পল্লব কিছু বলতে যাবে তার আগেই অপালা বলে উঠল, এক মিনিট। একটু ইন্টারাপ্ট করছি। দাদু, ডোন্ট মাইন্ড, তুমি তো জানোই সব কিছুর একটা লজিক্যাল ব্যাখ্যা না পেলে আমার শান্তি হয় না। সো আই হ্যাভ আ কোয়েশ্চেন।
স্নেহভরা চোখে তাকালেন ভাদুড়ি মশায়, বলো দিদিভাই। বলো।
আচ্ছা, ওই বুড়িমার ঝাঁটাপেটা খেয়ে ছোটদাদুর পক্স সেরে গেল এই অবধি ঠিক আছে। কিন্তু উনি তো তোমাকেও ঝাঁটাপেটা করেছিলেন। সেটা কেন?
একটু সময় নিয়ে ভাদুড়ি মশায় বললেন, ভালো প্রশ্ন করেছ। এ কথাটা আমিও বহুবার ভেবেছি এবং ভেবে তোমার ভাষায় একটা লজিক্যাল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। দেখো, পক্স খুব ছোঁয়াচে। আমি বীরুর সঙ্গে ছিলাম ফলে আমারও পক্স হতেই পারত। মা আগে থেকেই সে আশঙ্কা দূর করেছিলেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা…
সবাই উৎসুক হয়ে তাকাল ভাদুড়ি মশায়ের দিকে। একটু হেসে তিনি বললেন, আমি কখনও স্মল পক্সের টিকা নিইনি আর আজ অবধি আমার একবারও পক্স হয়নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন