অতৃপ্ত আত্মা – তাপস কুমার দে

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

লেখক দীপ প্রকাশনের কর্মরত ক্যাশিয়ার

আজ থেকেপ্রায় বছরকুড়ি আগের দুর্যোগপূর্ণ রাতের একটি ঘটনা। যা আমার স্মৃতিকে আজও নাড়া দেয়। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন থাকায় সেদিন আমি শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে নৈহাটি স্টেশনে আসি। জনবহুল স্টেশন—গিজগিজ করছে লোক। স্টেশনের নাম নৈহাটি। তখন রাত প্রায় আটটা চল্লিশ হবে। ব্যান্ডেল যাব, ঠিক দু—তিন মিনিট আগে নৈহাটি—ব্যান্ডেল লোকালটা বেরিয়ে গেছে। ব্যান্ডেলে যেতে পরবর্তী লোকাল ধরার জন্য এখনও আমাকে দীর্ঘ দেড়ঘণ্টা যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।

ঠিক রাত নটা দশ—পনেরো হবে, গরমকাল—বৈশাখ মাস। দূর থেকে একটা সোঁ…সোঁ… শব্দ শুনতে পাচ্ছি। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কীসের শব্দ। এলোপাথাড়ি দমকা হাওয়ায় আমার মাথার টুপিটা উড়ে লাইনে চলে গেল। আর তুললাম না, বা তোলার সময়ও পেলাম না। হাওয়ার টানে টুপিটা প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে চোখের নিমেষে কোথায় যে উড়ে চলে গেল ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। হাওয়ার দাপটে যে যার শরীর বাঁচাতে ব্যস্ত। দোকানদাররা অর্ধেক করে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিল। আমি একটা দোকানের দেওয়ালে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার রোগাপাতলা চেহারায় দোকানের দেওয়ালে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। স্টেশন চত্বর ঘুটঘুটে অন্ধকার। দোকানদাররা ইমার্জেন্সি লাইট জ্বালাতে ব্যস্ত হল। আমি দোকানের দেওয়ালের গায়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে ঝড়ের ঝাপটা খেতে লাগলাম।

কালবৈশাখীর চরম খামখেয়ালিপনার চল্লিশ—পঞ্চাশ মিনিটের দাপটে ট্রেনলাইনের বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেল। অনেক জায়গায় গাছ উপড়ে গেছে, লাইনে গাছ পড়ে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ।

রাত প্রায় ২টোয় প্লাটফর্ম ফাঁকা শুনশান। যে যেমনভাবে পেরেছে আস্তে আস্তে চলে গেছে। আমার কোনো উপায় নেই, পরিচিতের মধ্যে কেউ ধারে—কাছে থাকে না। কোনো আত্মীয়ের বাড়ি নেই, তাই প্লাটফর্মেরই চেয়ারে বসে আছি। এমন সময় কারেন্ট আসায় প্লাটফর্ম আলো ঝলমল হয়ে উঠল। শুধু দেখলাম এক দম্পতি প্লাটফর্মের শেষের দিকে একটা বেঞ্চে বসে আছে। আমার মতোই তারা বোধহয় হতভাগ্য, তাদের হয়তো কাছেপিঠে কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই, তাই প্লাটফর্মেই বসে ছিল।

প্রায় রাত তিনটে নাগাদ একটা EMU কোচ এল— নৈহাটি—ব্যান্ডেল লোকাল। অবসন্ন হয়ে আমি একমাথা চিন্তা নিয়ে একা ট্রেনে উঠলাম। কম্পার্টমেন্টে আর কেউ নেই। আমি শুধু একা। দেখে শুনে চারদিকে তাকিয়ে এক কোণায় বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ বাদে সেই দম্পতি এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আমার কম্পার্টমেন্টে উঠেই দু—জনে চেয়ারে না বসেই আমায় জিজ্ঞাসা করল ‘দাদা, এটা ব্যান্ডেল যাবার ট্রেন তো…?’ আমিও ঠিক জানি না ট্রেনটা নৈহাটি—ব্যান্ডেল লোকাল কিনা। না জেনেই বলে ফেললাম—’আমি ঠিক জানি না…উঠে বসে আছি…কি ট্রেন করবে এখনও অ্যানাউন্সমেন্ট হয়নি।’

একটা কম্পার্টমেন্টে মোট তিনটি প্রাণী—এদিক ওদিক জানলা দিয়ে তাকাচ্ছি কেউ আমার কম্পার্টমেন্টে উঠছে কিনা।

এই সময় অ্যানাউন্সমেন্ট হল—ব্যান্ডেল—নৈহাটি ফার্স্ট লোকাল রাত তিনটে চল্লিশ মিনিটে দু—নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে। মনে মনে চিন্তা করলাম যাক তা হলে ট্রেনের গেরো কাটল, আর ন—দশ মিনিট বাদেই ছাড়বে।

যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল, সেই দম্পতিটি চেয়ারে বসছে না, গেটের সামনে দু—জনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার সঙ্গে ট্রেনে উঠবার সময় ওই একবারই কথা হয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যেও যতক্ষণ ছিল কথা বলতে শুনিনি।

গরিফা স্টেশন ছেড়ে ট্রেনটা যখন ঠিক হুগলি ব্রিজের মাঝখানে এসেছে তখন হঠাৎ তাকিয়ে দেখি ওই দম্পতির কেউ নেই। একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম বাঁচাও…বাঁচাও। এখন আমি এই কম্পার্টমেন্টে একা। পুরো ট্রেনটিতে বোধহয় জনাদশেক লোক হবে। আমি ভাবছি ওই ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা হঠাৎ কোথায় গেলেন…আমি ভুল দেখছি না তো! এলোপাথাড়ি চিন্তা এল মাথায়। খুব ভয় পেয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তারপর আবার ভাবছি গরিফার স্টেশনে ওরা নেমে যায়নি তো! আমার চোখের ভুলও হতে পারে, ওরা বোধহয় নেমে গেছে আমি ঠিক খেয়াল করিনি। একটু বোধহয় অন্যমনস্ক ছিলাম, চারটে দশ নাগাদ ট্রেন ব্যান্ডেল স্টেশনে এসে থামল। আমি ভীত—সন্ত্রস্ত হয়ে চিন্তা করতে করতে ট্রেন থেকে নামলাম। চারটে পঞ্চাশ মিনিটে আমার ফার্স্ট ট্রেন ব্যান্ডেল থেকে ছাড়বে, এখনও প্রায় আধঘণ্টা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। একটা চায়ের স্টল—এর কাছে এসে এক ভাঁড় চা নিয়ে একটা বেঞ্চে এসে বসলাম। সকালের প্যাসেঞ্জারের লোকজন, তারা সব চা—বিস্কুট খাচ্ছে। তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে গতকাল রাত্রির ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলাম এবং যা দেখেছি তাও বললাম। একজন স্টলঅলা ও দু—একজন প্যাসেঞ্জার একটু মুচকি হেসে বলল, ‘দাদা প্রাণে বেঁচে গেছেন— ওরা মানুষ নয়…অপদেবতা!’

আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে ওরা ওই নৈহাটি লোকাল থেকে হুগলি ব্রিজে গঙ্গায় ঝাঁপ মেরে আত্মহত্যা করেছিল। তাই প্রতিদিন নৈহাটি—ব্যান্ডেল লাস্ট ট্রেনে ওই দম্পতির অশরীরী আত্মা ওই বগিতে মানুষের রূপ ধরে উঠে। এবং হুগলি ব্রিজ এলেই ঝাঁপ মারে ও বাঁচাও…বাঁচাও বলে চিৎকার করে। যারা জানে তারা নৈহাটি—ব্যান্ডেল লাস্ট ট্রেনের ওই কামরায় কেউ ওঠে না। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে এরকমই চলে আসছে বলে অনেকের ধারণা।

অধ্যায় ৮০ / ৮০

সকল অধ্যায়

১. পূজার ভূত – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. সে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. কার্তিক-পুজোর ভূত – হেমেন্দ্র কুমার রায়
৪. ঘাড় বেঁকা পরেশ – মনোজ বসু
৫. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
৬. খুঁটি দেবতা – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৭. রামাই ভূত – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
৮. টিকটিকির ডিম – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. মারাত্মক ঘড়ি – প্রমথনাথ বিশী
১০. পালানো যায় না – বনফুল
১১. গোলদিঘির ভূত! – শিবরাম চক্রবর্তী
১২. রক্তের ফোঁটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
১৩. দিন-দুপুরে – বুদ্ধদেব বসু
১৪. ভূতুড়ে বই – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৫. নিশুতিপুর – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৬. পাশের বাড়ি – লীলা মজুমদার
১৭. চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখা – আশাপূর্ণা দেবী
১৮. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
১৯. তৃষ্ণা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
২০. কুয়াশা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২১. ভূতচরিত – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
২২. পুষ্করা – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
২৩. ডুব – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
২৪. ফ্রিৎস – সত্যজিৎ রায়
২৫. অমলা – বিমল কর
২৬. শতাব্দীর ওপার থেকে – সমরেশ বসু
২৭. বাচ্চা ভূতের খপ্পরে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৮. সাতভূতুড়ে – মহাশ্বেতা দেবী
২৯. চাবি – আশা দেবী
৩০. লোকটা কে – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩১. মোতিবিবির দরগা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩২. ভয়ের দুপুর – আলোক সরকার
৩৩. ধোঁয়া – শোভন সোম
৩৪. চোখ – আনন্দ বাগচী
৩৫. জানলার ওপাশে – অশেষ চট্টোপাধ্যায়
৩৬. ক্ষতিপূরণ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৭. কার হাত? – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৮. পুনার সেই হোটেলে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কুকুর-বাংলো – অজেয় রায়
৪০. ভূত-অদ্ভুত – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪১. মুখ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৪২. চাঁপাফুলের গন্ধ – সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৩. আলো নিভে গেলে বুঝবে – অনীশ দেব
৪৪. দরজা খুলে গিয়েছিল – পার্থ চট্টোপাধ্যায়
৪৫. এ কী আজব গল্প – শৈলেন ঘোষ
৪৬. বিলাপী আত্মা – মঞ্জিল সেন
৪৭. ঘণ্টা – অদ্রীশ বর্ধন
৪৮. নিশীথ দাসের ভেলকি – বাণীব্রত চক্রবর্তী
৪৯. মোচার ঘণ্ট – বাণী বসু
৫০. পণ্ডিত ভূতের পাহারায় – শেখর বসু
৫১. কেপ মে’-র সেই বাড়ি – শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
৫২. মায়ামাধুরী – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৫৩. নিমন্ত্রণ – মনোজ সেন
৫৪. অদ্ভুত এক হাওয়া – বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
৫৫. ঘোড়ামারায় একটি রাত – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫৬. ভূত ও মানুষ – অমর মিত্র
৫৭. অলীক প্রেমিক – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৮. একমুঠো ছাই – হর্ষ দত্ত
৫৯. এ পরবাসে – মধুময় পাল
৬০. রসগোল্লার গাছ – শ্যামলকান্তি দাশ
৬১. ভূতের গল্প – পৌলোমী সেনগুপ্ত
৬২. পাতালরেলের টিকিট – রতনতনু ঘাটী
৬৩. ও করকমলেষু – তিলোত্তমা মজুমদার
৬৪. হ্যাঁ-ভূত, না-ভূত – চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
৬৫. ছায়ামুখ – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬৬. ভূতের কাছারি – রূপক চট্টরাজ
৬৭. দেখা হবে মাঝরাতে – শুভমানস ঘোষ
৬৮. এসো গো গোপনে – প্রচেত গুপ্ত
৬৯. গাঁ-এর নাম ছমছমপুর – গৌর বৈরাগী
৭০. ডবল রোল – উল্লাস মল্লিক
৭১. সেই ছবি – সিজার বাগচী
৭২. দিনেমার বাংলোর নর্তকী – সসীমকুমার বাড়ৈ
৭৩. ভূতুড়ে বিজ্ঞাপন – কল্যাণ মৈত্র
৭৪. দাদামশায়ের বন্ধু – হিমানীশ গোস্বামী
৭৫. আলো-আঁধারির গল্প – সুবর্ণ বসু
৭৬. ভূতবাবার মেলায় – জয়দীপ চক্রবর্তী
৭৭. বিদিশার প্রেমিক – সুস্মেলী দত্ত
৭৮. জোছনার আড়ালে – অমিতকুমার বিশ্বাস
৭৯. ওপাশে – অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
৮০. অতৃপ্ত আত্মা – তাপস কুমার দে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন