পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৩

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪

আজ ক্ষণে ক্ষণে রৌদ্র উঁকি মারছে, কিন্তু সে যেন তার গারদের গরাদের ভিতর থেকে। তার সংকোচ এখনো ঘুচল না। বাদল-রাজের কালো-উর্দি-পরা মেঘগুলো দিকে দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।

আচ্ছন্ন সূর্যের আলোয় আমার চৈতন্যের স্রোতস্বিনীতে যেন ভাঁটা পড়ে গেছে। জোয়ার আসবে রৌদ্রের সঙ্গে সঙ্গে।

পশ্চিমে, বিশেষত আমেরিকায় দেখেছি, বাপমায়ের সঙ্গে অধিকাংশ বয়স্ক ছেলে-মেয়ের নাড়ীর টান ঘুচে গেছে। আমাদের দেশে শেষ পর্যন্তই সেটা থাকে। তেমনিই দেখেছি, সূর্যের সঙ্গে মানুষের প্রাণের যোগ সে-দেশে তেমন যেন অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করে না। সেই বিরলরৌদ্রের দেশে তারা ঘরে সূর্যের আলো ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে যখন পর্দা, কখনো বা অর্ধেক কখনো বা সম্পূর্ণ নামিয়ে দেয় তখন সেটাকে আমি ঔদ্ধত্য বলে মনে করি।

প্রাণের যোগ নয় তো কী। সূর্যের আলোর ধারা তো আমাদের নাড়ীতে নাড়ীতে বইছে। আমাদের প্রাণমন, আমাদের রূপরস, সবই তো উৎসরূপে রয়েছে ওই মহাজ্যোতিষ্কের মধ্যে। সৌরজগতের সমস্ত ভাবীকাল একদিন তো পরিকীর্ণ হয়ে ছিল ওরই বহ্নিবাষ্পের মধ্যে। আমার দেহের কোষে কোষে ওই তেজই তো শরীরী, আমার ভাবনার তরঙ্গে তরঙ্গে ওই আলোই তো প্রবহমান। বাহিরে ওই আলোরই বর্ণচ্ছটায় মেঘে মেঘে পত্রে পুষ্পে পৃথিবীর রূপ বিচিত্র; অন্তরে ওই তেজই মানসভাব ধারণ করে আমাদের চিন্তায় ভাবনায় বেদনায় রাগে অনুরাগে রঞ্জিত। সেই এক জ্যোতিরই এত রঙ, এত রূপ, এত ভাব, এত রস। ওই যে-জ্যোতি আঙুরের গুচ্ছে গুচ্ছে এক-এক চুমুক মদ হয়ে সঞ্চিত সেই জ্যোতিই তো আমার গানে গানে সুর হয়ে পুঞ্জিত হল। এখনই আমার চিত্ত হতে এই যে চিন্তা ভাষার ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সে কি সেই জ্যোতিরই একটি চঞ্চল চিন্ময়স্বরূপ নয় যে-জ্যোতি বনস্পতির শাখায় শাখায় স্তব্ধ ওঙ্কারধ্বনির মতো সংহত হয়ে আছে।

হে সূর্য, তোমারই তেজের উৎসের কাছে পৃথিবীর অন্তর্গূঢ় প্রার্থনা ঘাস হয়ে, গাছ হয়ে আকাশে উঠছে, বলছে, জয় হোক! বলছে, অপাবৃণু, ঢাকা খুলে দাও! এই ঢাকা-খোলাই তার প্রাণের লীলা, এই ঢাকা-খোলাই তার ফুলফলের বিকাশ। অপাবৃণু, এই প্রার্থনারই নির্ঝরধারা আদিম জীবাণু থেকে যাত্রা করে আজ মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত, প্রাণের ঘাট পেরিয়ে চিত্তের ঘাটে পাড়ি দিয়ে চলল। আমি তোমার দিকে বাহু তুলে বলছি, হে পূষন্‌, হে পরিপূর্ণ, অপাবৃণু, তোমার হিরন্ময় পাত্রের আবরণ খোলো, আমার মধ্যে যে গুহাহিত সত্য তোমার মধ্যে তার অবারিত জ্যোতিঃস্বরূপ দেখে নিই। আমার পরিচয় আলোকে আলোকে উদ্‌ঘাটিত হোক।

সকল অধ্যায়

১. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০১
২. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০২
৩. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৩
৪. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৪
৫. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৫
৬. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৬
৭. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৭
৮. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৮
৯. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ০৯
১০. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১০
১১. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১১
১২. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১২
১৩. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৩
১৪. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৪
১৫. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৫
১৬. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৬
১৭. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৭
১৮. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৮
১৯. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ১৯
২০. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২০
২১. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২১
২২. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২২
২৩. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২৩
২৪. পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি – ২৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন