তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো – ২০

মৌরি মরিয়ম

বাবার ঘর থেকে ফিরে বিছানায় শুতেই ঘাড়ে লম্বা কিছুর খোঁচা লাগল কলরবের। ওঠে তাকাতেই দেখতে পেল একটা কাজল। হাতে উঠিয়ে ভাবলো নিহিনেরই হবে। ভুলে হয়তো ফেলে গেছে। বালিশ সরিয়ে ভালো করে খুঁজে একটা লিপস্টিক আরও কিছু একটা পেল, যার নামও জানে না ও। ভালোই হলো এই ছুঁতোয় কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে। তৎক্ষণাৎ কল করল নিহিনকে।

“হ্যালো”

“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

“নাহ, এত তাড়াতাড়ি ঘুমাই না তো, বলো।”

“তাড়াতাড়ি না ঘুমানোই ভালো।”

“মানে?”

“না কিছু না, শোনো তুমি বোধহয় কিছু কসমেটিকস ফেলে গেছ। কাজল, লিপস্টিক আর কি যেন একটা।”

“ওমা তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। তোমার লাগলে আমি কাল দিয়ে যেতে পারি। কাল তো আমার

অফ ডে।”

“না অসুবিধা নেই, পরে দেখা হলে নিয়ে এসো। আমার কাছে এক্সট্রা আছে। তাছাড়া আমার কাল ক্লাস আছে।”

“ও।”

মিইয়ে গেল কলরব, ভেবেছিল এই ছুঁতোয় কালও দেখা করতে পারবে। নিহিন বলল,

“কি হলো চুপ করে আছ যে?”

“না ভাবছিলাম।”

“কী ভাবছিলে?”

“ওই তো তুমি কত বদলে গেছ সেটাই ভাবছিলাম।”

“কী বদল আবার চোখে পড়লো?”

“তুমি যে বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পার আবার এক হাতের ধাক্কায় একটা ছেলের বুকের পাঁজর ভেঙে ফেলতে পার তা সত্যিই জানা ছিল না। ভালো জোর তোমার হাতে।”

“ব্যথা পেয়েছো নাকি?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। তুমি টাচ করলেই বুকে ব্যথা লাগে, আর ওই কিলার চাহনি দিয়ে তাকালেও লাগে।”

“যাহ, তোমার সাথে ইদানীং কথাই বলা যায় না।”

“কেন?”

না বোঝার ভান করল কলরব। নিহিন বলল,

“জানি না।”

কলরব হাসল। নিহিন কথা এড়াল,

“কল্প কোথায়?”

“পাশেই, ঘুমাচ্ছে।”

“আংকেল?”

“সেও ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“তুমি জেগে আছ কেন?”

“ঘুম আসছে না, আজ আর আমার ঘুম আসবে না। আজকের প্রাপ্তি অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে।”

মিটিমিটি হাসল নিহিন। পরে বলল,

“ঘোড়ার ডিমের প্রাপ্তি, আমার রান্না তো তোমার ভালোই লাগেনি।”

“প্রাপ্তি বলতে রান্নাকে বোঝাইনি, অন্য প্রাপ্তির কথা বলেছি। কিন্তু কী করে বুঝলে যে রান্না ভালো লাগেনি?”

“সবাই খেয়ে বলেছে রান্না ভালো হয়েছে, কিন্তু তুমি বলেছ সব ভালো হয়েছে, শুধু ইলিশ পোলাওটা ভালো হয়নি। অথচ ওটা তোমার পছন্দ বলে খুব যত্নে রেঁধেছি।”

“তা বলিনি, আজকেও মজা হয়েছে তবে আগের বারের সাথে তুলনা করা বোকামি। অবশ্য কল্প হয়তো আসল মজাটা পেয়েছে।”

“ধ্যাত, তুমি যে কী বলো।”

ইংগিত বুঝতে পেরে লজ্জা পেল নিহিন। কলরব বলল,

“তোমার এই লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।’ “আজকেই তো দেখলে, আবার?”

“সারাজীবন দেখলেও কি আশ মিটবে?”

নিহিন কিছু বলল না, শুধু হাসল। কলরব আবার বলল,

“ও ভালো কথা, তুমি এখন আর নূপুর পরো না?”

“পরি না তা নয়, আবার খুব একটা পরাও হয় না।”

“ও। না পরার পিছনে কোনো বিশেষ কারণ আছে?”

“না তো, কেন?”

“না এমনি।”

নিহিন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল,

“আচ্ছা শোনো?”

“হুম, বলো। শুনছি তো।”

“এভাবে না, সিরিয়াসলি শুনতে হবে। কারণ কথাটা খুব সিরিয়াস।”

কলরব ঢং করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“হুম, আমি সিরিয়াস! তুমি বলো।”

তারপর কলরব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিহিন বলল,

“তোমাকে বলেছিলাম আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে কেন? আমি সেদিন বলিনি, সামনাসামনি বলতে পারবো না তাই।”

“ও।”

এখন বলতে চাচ্ছি।”

“তাহলে বলো।”

“আমি তখন কলেজে ভর্তি হয়েছি মাত্র। ১৬ বছর বয়স। তখন একদিন ছেলে পক্ষের আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল। আমি পাত্রপক্ষের সামনে যেতে চাইনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি তা নয়। মোহনা আপুকেও তো অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিল। তাই একটা ভয় ছিল। তোমার ওপর তো তখন প্রচণ্ড রাগ। যাই হোক মা বলল, দেখতে আসলেই কারো বিয়ে হয়ে যায় না, কিন্তু আমার জীবনে এমনটাই হলো। দেখতে এসেই বিয়ে হয়ে গেল। চিনি না, জানি না একটা লোককে বিয়ে করতে হলো।”

কলরব কোনোরকমে গলা দিয়ে কথা বের করল,

“লোক মানে? অনেক বড় ছিল তোমার থেকে? তুমি তো তখন বাচ্চা ছিলে।”

হাসল নিহিন,

“আমার দ্বিগুণ বয়স ছিল।”

কলরব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল কিন্তু বোধহয় পারল না।

শুধু বলল,

“আচ্ছা সেদিন বলেছিল সংসার ভেঙে গেছে।”

“কীরকম ভেঙেছে? ডিভোর্স হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

কলরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। অনুমান তাহলে ঠিক।

“তোমার বাবা রাজি হলো ডিভোর্সে?”

“বাবা নিজেই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেছেন। আমার জীবন বাঁচাতে তার সেটা করতে হয়েছে।”

“কী বলছ!”

“আমার জীবনে অনেক বড় ঝড় গিয়েছে যা তুমি ভাবতেই পারছো না। আজ তোমাকে সব বলব।”

“নিহিন শোনো..”

“বলো..”

“তুমি আমাকে সব বলতে চাচ্ছ কেন? আমার সাথে শেয়ার করে মন হালকা করার জন্য, নাকি আমাকে জানানোর জন্য?”

“শেয়ার করার জন্য না, কোনো সুখকর স্মৃতি তো না যে শেয়ার করব। এরকম বিচ্ছিরি ঘটনা শেয়ার করার কোনো মানে হয় না। আমি শুধু চাই তুমি আমার সবকিছু সম্পর্কে অবগত থাকো, সেজন্যই বলতে চাচ্ছি।”

“কোনো দরকার নেই, যদি শেয়ার করার জন্য বলতে তাহলে শুনতাম। কিন্তু যেহেতু জানানোর জন্য বলতে চাচ্ছ তাই আমি শুনতে চাই না। আমি তোমাকে জানি। তোমার অতীতে কী ঘটে গিয়েছে তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই।”

“কিন্তু সব জানা দরকার তোমার।”

“বললাম তো তোমাকে জানি। তাছাড়া অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আমার পছন্দ না। কারণ অতীত কোনো ফিক্সড ডিপোজিট না যে তোমাকে প্রফিট দেবে। আর তুমি এত লাফাচ্ছ কেন বলার জন্য? আমি কি আমার এক্সদের নিয়ে কিছু বলেছি তোমাকে?”

“এক্সদের? অনেকগুলো ছিল নাকি?”

হেসে জিজ্ঞেস করল নিহিন। কলরব বলল,

“অনেক মজা পাচ্ছ মনে হয়।”

“পাব না? তুমি যেভাবে অকারণে রেগে যাচ্ছ।”

“অকারণে রেগে যাচ্ছি না, করণেই রেগে যাচ্ছি। আমি শুনবো না তাও তুমি বলবে কেন?”

নিহিন মজা করে বলল,

“আরে বুঝতে পারছো না? আমি আমার অতীত বললেই তো তোমার সেই এক্সদের ব্যাপারে অনায়াসে জিজ্ঞেস করতে পারব।”

“জিজ্ঞেস করতে হবে না, আমার দুটো গার্লফ্রেন্ড ছিল, দুইটাই তোমার বাবা ফিরিয়ে দেওয়ার পরে এবং কল্প আসার আগে। একসাথে নয়, একটার পর একটা। দুটোই করেছি তোমাকে ভুলে নতুন করে শুরু করার জন্য। তাই নতুন প্রেম করেছি। প্রথমজন ছিল অফিসে।”

নিহিন কলরবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“এই দাঁড়াও, আমি আগে বলব, তারপরে তোমারটা শুনবো।”

“চুপ! একটা কথা বলবে না, যা বলছি চুপচাপ শুনবে।”

কলরব এমন একটা ধমক দিয়ে বলল কথাগুলো যে নিহিনের বিশ্বাসই হলো না এটা কলরব। নিহিন কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল,

“আচ্ছা বলো।”

“ওই মেয়েকে শুধু তোমার নাম ধরে ডাকতাম, আর তা নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া করত। তাই মিউচুয়াল ব্রেকাপ করেছি। তার পরেরটা আমার এক কাজিনের ফ্রেন্ড। দুটোর একটাও আমি প্রপোজ করিনি, ওরাই করেছে আর আমি এক্সেপ্ট করেছি। যাই হোক, ওদের মধ্যে আমি শুধু তোমাকে দেখতে পেতাম। আর তোমাকে যেভাবে ফিল করতাম সেভাবে ওদের করতে পারিনি। তোমার মুখে একটু হাসি ফোটাবার জন্য যেমন অনেক কিছু করতাম তার কিছুই আমি ওদের জন্য করতে পারিনি। তোমাকে দেখলেই বুকের মধ্যে যে উথাল-পাথাল একটা ব্যাপার হতো এমনকি এখনো হয় সেটা কখনো হয়নি ওদের জন্য। তোমার কারণে অকারণে লজ্জা পাওয়া, খুব উৎসাহে রান্না করে আমাকে এটা ওটা খাওয়ানো, আগ্রহ নিয়ে আমার বকবকানি শোনার ধৈর্য আর আমার মুখ দেখে সব বুঝে ফেলার ক্ষমতা কিছুই পাইনি ওদের মধ্যে।”

কলরব যাতে টের না পায় তাই নিহিন মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে, এত ভালোবাসা পাওয়া থেকে ১০ টা বছর বঞ্চিত হয়েছে ও! কলরব বলেই যাচ্ছে,

“এগুলো আজকাল বিলুপ্ত প্রায়, হ্যাঁ বুঝতে না পারতেই পারে কিন্তু চেষ্টা তো থাকতে হবে। যাই হোক, ওদের দোষ না, দোষ আমারই ভালোবাসা হয়নি ওদের জন্য। সেটা ওরাও বুঝতো, এসব নিয়ে ঝগড়া করত। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমি, প্রথম প্রেমটা ১ মাস আর পরেরটা ১৫/১৬ দিন টিকেছে। পরে বুঝলাম আমি আর কোনো মেয়ের সাথেই থাকতে পারব না। তার পর থেকে একাই থেকেছি, বিয়ে করব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কল্পকে নিয়ে এসেছি। শেষ আমার এক্সদের কাহিনি, খুশি?”

নিহিন প্রসঙ্গ পালটাতে চাইল, কান্না থামিয়ে গলাটা স্বাভাবিক করে বলল,

“কল্পকে কোথায় পেয়েছ?”

“কিনে এনেছি।”

“সেকি! কোত্থেকে?”

“ঢাকা মেডিকেলে বাচ্চা কিনতে পাওয়া যায়, বৈধভাবে ১০ হাজার আর অবৈধভাবে ১ লাখ টাকা। দুই ক্ষেত্রেই নার্সদের সাথে যোগাযোগ করতে হয় গোপনে।”

আঁতকে উঠল নিহিন।

“ওমা, কী শুনছি আমি? তার মানে পরের বাচ্চা নার্সরা চুরি করে বিক্রি করে?”

“না, যারা অনেক গরিব এবং অলরেডি অনেকগুলো বাচ্চা আছে তারা নিজেরাই বিক্রি করে দিয়ে যায়। তাতে তারা টাকা পায়। অনেক হারামি পুরুষ আছে যারা নিজের বাচ্চাকে অস্বীকার করে, সেসব বাচ্চার মায়েরা বাচ্চা জন্ম দিয়ে রেখে চলে যায়।”

“এটা কীভাবে সম্ভব, একটা মা এটা কখনো পারে না।”

“বাচ্চা পালার মতো টাকা না থাকলে কী করবে তারা? আর সে বাচ্চা নিয়ে গেলে তো তার স্বামী তাকে ঘরেই ঢুকতে দেবে না।”

“সেরকম হলে বাচ্চা না নিলেই হয়।”

“সবাই কি ইচ্ছে করে নেয়? আরও কত ধরনের ঘটনা ঘটে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

“যেমন?”

“অনেক নেশাখোর বাবা আছে যারা মা ঘুমিয়ে থাকলে বাচ্চাকে নিয়ে এসে বিক্রি করে টাকা নিয়ে নেশা করে।”

“উফ, এমন বাবাদের খুন করে ফেলা উচিত।”

“কিন্তু ওইসব মায়েরা তারপরেও সেই স্বামী নিয়ে সংসার করে এবং আবারও ওর বাচ্চার মা হয়। কারণ ওর যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।”

“আর শুনতে চাই না প্লিজ।”

“এটুকু শুনেই একথা বলছো? এর চেয়েও মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে ওখানে।”

“তুমি এসব জানলে কী করে?”

“আমার এক বন্ধু ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। ওই যে তোমাদের পাশের বাসায় যখন থাকতাম ও আমার পাশের রুমটাতেই থাকত।

“তার মানে এসব কথা ডাক্তাররাও জানে?”

“হুম জানে তো।”

“এটা তো এক ধরনের দুর্নীতি। কেউ প্রতিবাদ করে না?”

“কে প্রতিবাদ করবে? কার কাছে করবে? যারা ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না তারা চোখ বন্ধ করে থাকে কারণ তাদের কথা শোনার কেউ নেই। তাছাড়া সবগুলো তো আর দুর্নীতি না। গরিব বাবা-মা দুজন স্বইচ্ছায় যখন এটা করে তখন তুমি ওদের দোষ দেবে?”

“অবশ্যই দেবো। কারণ ওরা লোভী। টাকার লোভে ওরা নিজের বাচ্চা বিক্রি করে দিচ্ছে। আরে এটা কি ফসল নাকি যে চাষ করব আর বিক্রি করব?”

কলরব হেসে বলল,

“বাহ! ভালো কথা শিখেছো তো।”

“তো কী? ভুলে যাচ্ছ কেন যে আমি একজন টিচার।”

“উহু লেকচারার।”

“ওই হলো।”

“না হলো না, পার্থক্য আছে।”

যাই হোক, সেকথা আমি ভুলিনি। কিন্তু আমার কাছে তুমি আজও সেই বাচ্চা মেয়েটিই আছ। তা না হলে ওভাবে বাচ্চাদের মতো আমার বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে না। তাও আবার কী? আমার দুঃখের জন্য!”

“উফ তুমি ট্র্যাক চেঞ্জ করছো। আমরা বাচ্চা বিক্রির প্রতিবাদ নিয়ে কথা বলছিলাম।”

“তুমি বা এত প্রতিবাদের কথা বলছো কেন? এসব বন্ধ হলে আমাদের মত এতিম বাবারা সারাজীবনেও বাবা হতে পারবে না।”

“এতিম বাবা মানে?”

“মানে বউ ছাড়া যারা বাবা হতে চায়।”

“উফ আমি সিরিয়াস, আর তুমি মজা করছো?”

“আচ্ছা সরি বাবা, আর মজা করব না। শোনো বলছি, মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করবে, কল্পকে আমি কিনতে গেলে ওর বাবা মা বলেছিল, বাচ্চা নিয়ে ওরা বাসায় গেলে ওদের বাসা থেকে নিয়ে আসতে তাতে নার্সরা জড়িত থাকবে না। নার্সরা জড়িত থাকলে ওরা ৫ হাজার পাবে। ওদের প্রস্তাব আমার পছন্দ হয়নি কারণ নার্সরা ছাড়া ব্যাপারটা বৈধ হতো না। অনেক ঝামেলা আছে, ওগুলো ওরা সামলায়। তাই আমি অনায়াসে অন্য কোনো বাচ্চা নিয়ে আসতে পারতাম কিন্তু আমি অন্য বাচ্চা নিতে চাইনি। তাই আমি ওদের বলেছি আলাদাভাবে পুরো ১০ হাজারই দিব ওদের কিন্তু নার্সরা জড়িত থাকবে। যাই হোক, আসল কথায় আসি। তুমি ভাবছো ওরা লোভে পড়ে বাচ্চাকে বিক্রি করছে। এটা কি ভেবেছ ওদের কাছে থাকলে কল্পর এখন কী অবস্থা হতো? হয়তো রাস্তায় রাস্তায় ফুল, পানি না হলে পেপার বিক্রি করত। ওর বড় আরো পাঁচটা ভাই বোন ছিল তারাও এসব কাজই করত তখন। আর এখন কল্প শহরের সেরা একটা স্কুলে পড়ছে, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। মা ছাড়া আজ পর্যন্ত যা চেয়েছে তাই পেয়েছে ও। কত আদরে বড় হচ্ছে। এই জীবনটা ভালো না, ওটা? ওর বাবা মাও ওর এই ভালো থাকার কথাটা চিন্তা করেছে।”

“হুম, আচ্ছা ওরা যদি কখনো কল্পকে ফেরত চায়?”

“কীভাবে? না ওরা আমাকে চেনে, না আমি ওদের চিনি। আর পেপারসে স্পষ্ট করে লেখা আছে ওরা সব অধিকার ত্যাগ করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছে। আর কখনো ফেরত চাওয়া দূরের কথা কখনো যোগাযোগও করতে পারবে না আমার সাথে। আর করবেও না ওরা। ওরা এসবে অভ্যস্ত।”

“আমি ভাবতেও পারছি না।”

“তোমার ভাবা লাগবেও না। জাস্ট ফরগেট ইট। কল্প আমার নিজের ছেলে।”

“হুম, আচ্ছা তুমি তখন এটা কেন বললে যে তুমি অন্য বাচ্চা নিতে চাওনি।”

“কারণ কল্পকে যখন দেখেছি তখন ও হাসছিল। ছোট্ট বাচ্চা তাও ওর গালের টোলটা আমার চোখে পড়েছিল।”

“তোমার গালেও টোল আছে, এই মিলের জন্য?”

“হ্যাঁ। আমার ছেলে যে হবে তার যদি আমার সাথে কোনো মিল থাকে তাহলে ভালো হয় না? যদিও আমি কালো তাই কালো বাচ্চা খুঁজেছিলাম প্রথমে। কিন্তু কল্প ফরসা হয়ে গেল।”

“তুমি অতটাও কালো না।”

“আমি জানি ম্যাডাম।”

“আচ্ছা তুমি কি ওর পাশে শুয়ে এসব বলছো?”

“পাগল? আমি সেই কখন বারান্দায় চলে এসেছি।”

“ভালো করেছ।”

“হুম”

“আচ্ছা তোমার সব কথা তো শুনলাম, এবার আমার কথাগুলোও শোনো প্লিজ।”

“কোন কথা?”

“ডিভোর্স কেন হলো।”

“আমার শোনার দরকার নেই বলেছি তো। ডিভোর্স হয়েছে কি না সেটা জানার দরকার ছিল জেনেছি।”

“আসলে তুমি ভয় পাচ্ছ।”

“হ্যাঁ পাচ্ছি, তোমাকে কেউ কষ্ট দিয়েছে সেকথা সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেননি।”

“আমারও তো দোষ থাকতে পারে।”

“দোষ গুণ মিলেই মানুষ, প্রত্যেকে। ক্ষমতাবানরা গুণগুলো বের করে নিতে জানে। আর অক্ষমরা দোষগুলো বের করে নিতে জানে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে বললাম না, কিন্তু অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হুম, বলো।”

“তুমি তখন বললে, অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তুমি পছন্দ করো না। কিন্তু আমিও তো তোমার অতীত!”

কলরব হাসল। নিহিন বলল,

“হাসির কী আছে? বলো।”

“তুমি বুঝবে না।”

এমন সময় ফজরের আজানের আওয়াজ ভেসে এলো। কলরব অবাক হয়ে বলল,

“আজান দিয়ে দিয়েছে, এখন কী হবে ক্লাসে যাবে কী করে?”

“সমস্যা নাই, এমনিতেও ঘুম হয় না রাতে। অভ্যাস আছে, তাছাড়া ক্লাস ১২ টায়। ১০ টা পর্যন্ত ঘুমাতে পারব অনায়াসে।”

“আচ্ছা তাহলে ঘুমিয়ে পড়।”

“তুমিও ঘুমাও।”

“আচ্ছা”

বলেই হেসে ফেলল কলরব। নিহিন বলল,

“কী হলো? শুধু শুধু আসছ কেন?”

“শুধু শুধু হাসছি না। একটা কথা ভেবে হাসছি।”

“কী?”

“বললে তুমি লজ্জা পাবো কিন্তু সেটা আমার সমস্যা না, মারতেও পার সেটাই আমার সমস্যা।”

নিহিন আর কিছু বলল না, ছেলেটার মাথায় সবসময় দুষ্টুমি ঘুরতে থাকে। কথা না বলাই ভালো।

২১

ভোর হয়ে যাওয়ায় আর বিভিন্ন রকম চিন্তায় ঠিকমতো ঘুম আর হলো না কলরবের, ঘুম ভাঙল বেলা ১১ টায়। ঘুম থেকে ওঠে ও সাব্বিরকে কল করল,

“সাব্বির, আজ ফ্রি আছিস?”

“ক্যান ভাই? কোনো কাজ আছে?”

“আছে, সেজন্যই জিজ্ঞেস করছি।”

“কালকে যদি বলতে, আজকে রাতে আম্মুর সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”

“মেয়ে দেখতে যাবি নাকি?”

“ইউ আর গ্রেট ভাই, না বলতেই সব বুঝে যাও।”

“সবার ক্ষেত্রে বুঝি না। কিন্তু মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস কোথায়?”

“আমি নিজেও জানি না, কোনো ইন্টারেস্ট নাই, শুধু আম্মুকে খুশি করার জন্য সাথে যাওয়া। আর কইয়ো না ভাই, গার্লফ্রেন্ডটা ভাইজ্ঞা যাওয়ার পর থেকে আম্মু জ্বালাইয়া মারতাছে, আগে ওর পড়াশুনার ছুতা দিয়া পিছাইয়া রাখছি, এখন কই যামু!”

“আগে ভাষা ঠিক কর, নাহলে অফিসেও ভুলে বলে ফেলবি।”

“আচ্ছা সরি। কিন্তু ভাই আম্মুর সাথে আমি রাত ৮ টার দিকে যাব। তার আগে তোমাকে টাইম দিতে পারি।”

“না এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই, হাতে অনেক সময় আছে।”

“আসলে ভাই এলাকায়ই আছি, রাতের আগে কোনো কাজও নাই তাই তোমার বাসায় আসতে চাচ্ছি। নিহিনের কালকের রান্নার কিছু অবশিষ্টাংশ যদি পাওয়া যায় সে লোভে।”

কলরব হেসে বলল,

“চলে আয়। সবই আছে তবে ফ্রিজে রাখা বাসি, গরম করার কষ্টটা আমিই করতে পারব।”

“আসতেছি ভাই।”

কলরব ওর কাপড় ইস্ত্রি করছে। আর কল্প বিছানায় বসে চিপস খাচ্ছে আর ওর সাথে গল্প করছে। হঠাৎ বলে উঠল,

“আচ্ছা পাপ্পা, মিষ্টি যে স্কুলে পড়েছে ওটাতে আমাকে এডমিট করে দেবে?”

চমকে উঠল কলরব। হঠাৎ ওর কথা!

“কেন তোর স্কুল কী দোষ করল?”

“না আমার স্কুলটাও ভালো। কিন্তু কোনো রান্না শিখায় না, মিষ্টির স্কুলে পড়লে তো ওর মতো মজার রান্না শিখতে পারব।”

কলরব শব্দ করে হেসে ফেলল,

“রান্না কোনো স্কুলেই শেখায় না, বোকা। ও রান্না শিখেছে ওর মায়ের কাছ থেকে।”

“ও।”

সাব্বির ঘরে ঢুকতেই লাফ দিয়ে কোলে চড়ল কল্প,

“চাচ্চু!”

সাব্বির ওকে কোলে নিয়ে আদর করল। কলরব বলল,

“কল্প এখন দাদাভাইয়ের সাথে গিয়ে খেল। আমারা এখানে কাজ করব এখন।”

“ওকে পাপ্পা।”

কল্প ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতেই সাব্বির বলল,

“নিজে ইস্ত্রি করছো?”

“বুয়া আসেনি, আর আমিও বসেই ছিলাম তাই।”

“ও।”

সাব্বিরের চোখ পড়ল দেয়ালে নিহিনের ছবিটার দিকে।

“এই ছবিটা যে কতবার দেখেছি, অথচ একবারও বুঝিনি এটা নিহিনের ছবি।”

“অথচ কল্প নিহিনকে দেখেই বলেছে ওর মায়ের সাথে অনেক মিল। তাহলে বোঝ তুই কত আহাম্মক।”

“ভাই ও তো ছবিটা ডেইলি দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, তাই নিহিনকে দেখেই মিল পেয়েছে। আমি তো এত ভালো করে দেখিনি। কখনো ভাবিওনি এরকম হতে পারে। তাছাড়া নিহিন তো ছবির মত নেই, অনেক পরিবর্তন এসেছে।”

“হুম, বুঝেছি। এখন কাজের কথায় আসি। ও তুই আগে খেয়ে নে।”

“না, দুপুরে খাবো। তুমি কাজের কথাটা বলো।”

“আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।

“কোথায় যেতে হবে?”

“মার্কেটে।”

“মার্কেটে! আমাকে নিয়ে? কী জন্য?”

“আসলে তোকে নিয়ে না, তিথিকে নিয়ে যাব। যেহেতু তিথির সাথে আমার পরিচয় নেই তাই তুই ওকে নিয়ে আসবি এবং পরিচয় করিয়ে দিবি। এই হলো তোর কাজ।”

“কিন্তু তিথি কেন?”

“নিহিনের জন্য একটা জিনিস কিনব, তাই তিথিকে লাগবে।”

“নিহিনকে কি সারপ্রাইজ দিতে চাও?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে ভুলেও তিথিকে নিয়ো না।”

“কেন?”

“তাহলে তোমার সারপ্রাইজ আর সারপ্রাইজ থাকবে না। ও নগদে বলে দেবে নিহিনকে।”

“নিষেধ করলে বলবে কেন?”

“ইচ্ছে করে বলবে না তো। যেমন ধরো আমি বা নিহিন যদি ওকে কিছু বলে কাউকে বলতে নিষেধ করি, ওর পেটে বোমা মারলেও কথা বের হবে না। কিন্তু কেউ যদি আমাকে বা নিহিনকে কিছু বলতে নিষেধ করে ওইটা ও আগে বলে দেবে। এসব ব্যাপার ও গোপন রাখতে পারে না।’ “বললে তো সারপ্রাইজ নষ্ট হবে, সেটা জেনেও কেন বলবে?”

“এই কেনর কোনো উত্তর নাই ভাই।”

“তাহলে তো সমস্যা।”

“এজন্যই বলছি ওকে ইনভলভ করারই দরকার নাই। কী জিনিস কিনতে চাও?”

“নূপুর।”

“নূপুর! এটার জন্য ওকে লাগে! কত নূপুর কিনছি! তুমি যাইয়ো আমাকে নিয়ে, আমি পছন্দ করে দেবো। নিহিনের পছন্দ হবে।”

“বেশি বুঝিস তুই, আমি কি একটা নূপুর নিজে পছন্দ করে কিনতে পারি না? তিথিকে লাগবে অন্য কারণে।”

“কী কারণ?”

“নিহিনকে আমি একটা নূপুর দিয়েছিলাম।”

“ওর জন্মদিনে, ওটা দিয়ে প্রপোজ করেছিলে।”

“বলেছে তোকে?”

“হুম, দেখিয়েছেও।”

“বাহ, তাহলে তো আর তিথিকে দরকার নেই। তোর ওই নূপুরটা ডিজাইন মনে আছে?”

“না। অনেকবছর আগে দেখেছিলাম।”

অসহায় মুখে বলল সাব্বির। কলরব বলল,

“তাহলে তো তিথিকেই লাগবে।”

“কী করতে চাচ্ছ বলো তো। ওইটার ডিজাইন কেন লাগবে?”

“ওই ডিজাইনেই বানাব।”

“কেন? অন্য একটা সুন্দর দেখে দিলেই হয়।”

“তুই বুঝবি না।”

“আচ্ছা, কিন্তু তিথির কি ওই ডিজাইন মনে আছে?”

“থাকতে পারে। মেয়েদের এসব মনে থাকে, না থাকলে কোনো ছুঁতোয় দেখে আসবে বা একটা ছবি তুলে নিয়ে আসবে। তারপর বানাতে দেবো। আর ওকে ভালোভাবে পটাতে হবে যাতে ও নিহিনকে কিছু না বলে।”

“সামনের সপ্তাহে যেতে হবে তাহলে। ওর শুক্র শনি বন্ধ আছে, তবে শনিবার হলেই ভালো। শুক্রবার প্রায়ই নিহিন তোমার সাথে বা তিথির সাথে দেখা করতে চাইতে পারে। শনিবার তো নিহিনের ভার্সিটি থাকে তাই ওইদিন যাওয়াই ভালো।”

“আচ্ছা তাহলে আগামি শনিবারে যাচ্ছি।”

“পারও তুমি ভাই। লাভ কী এসব করে? ও তো এমনিতেই তোমাকে ভালবাসে।”

“শোন এসব করতে হয়। আমি যেমন ওর মধ্যেকার অতুলনীয় কিছু কাজের জন্য ভুলতে পারিনি ওকে, এখনো ভালোবাসি। তেমনি ও আমার এ ধরনের কিছু মূল্যহীন কাজের জন্যই আমাকে এতটা ভালোবাসে। আমাদের ভালোবাসার মানুষেরা তো আমাদের ভালোবাসবেই, কিন্তু তার গভীরতা আমাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে। মনের মধ্যে যতটুকু খুঁড়বি ভালোবাসা ততটুকু গভীরই হবে। বেশি খুঁড়লে বেশি, কম খুঁড়লে কম।”

“খোঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারটা বেশি কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল ভাই, মনে হচ্ছে বুঝেছি আবার বুঝি নাই।”

“না বোঝার কী আছে? পুকুর যত খোঁড়ে তত গভীর হয় না? ওই রকম মন যত খোঁড়ে ভালোবাসা তত গভীর হয়।”

“ভাই মন কি মাটি যে খোঁড়া যাবে? বুঝিনাই ঠিক। যদি একটা উদাহরণ দিতা?”

“মন মাটির চেয়েও নরম। মন খোঁড়া মাটি খোঁড়ার চেয়েও সহজ। এই ধর, আমি একটা নূপুর গিফট করব ওকে। সেক্ষেত্রে আমি চেষ্টা করছি আগেরটার মতো একটা দিতে। কেন? কারণ একই রকম দেখে ও খুশি হবে, সেই মিষ্টি স্মৃতিগুলো মনে পড়বে। আর আমি যে ওর ভালোলাগার কথা ভেবে ইচ্ছে করে এটা করেছি সেটা ভেবে ওর আরো ভালো লাগবে, কারণ তখনই ও বুঝবে ওকে আমি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। এটাই খোঁড়াখুঁড়ি, যত এরকম করব ততই ওর মনে আমার জন্য ভালোবাসার গভীরতা খোঁড়া হবে। আবার ধর ওর দিক থেকে যদি বলি, তাহলে ওই বাচ্চা মেয়েটা যে রাতদুপুরে আমার সাথে দেখা করতে ছাদে আসত। সেটা খুব রিস্কের কাজ আমি ছিল, তাও আসত। মাঝে মাঝেই আমার জন্য এটা ওটা রান্না করত, খেতে ভালোবাসি বলে। আমার এখনো মনে আছে, শুধু বলতাম যে অমুক জিনিসটা খেতে ইচ্ছে করছে, মা কাছে থাকলে বললেই বানিয়ে দিত। ও সেদিন না পারলেও দুদিনের মধ্যে সেটা রেঁধে খাওয়াতো আমাকে। প্ৰথমে কিন্তু রাঁধতে জানত না, আমাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যই রান্না শিখল। এগুলো করে করে আমার মনে এত বেশি খুঁড়ে ফেলেছিল যে আমার ভালোবাসার গভীরতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাই অন্য কারো কথা ভাবতে পারিনি আমি, আজও একা।”

“আজও একা কোথায়? পেয়েই তো গেছ তোমার পরিকে।”

“নারে অনেক সমস্যা, অনেক বাধা। যদি সব অতিক্রম করতে পারি তবেই পাব।”

“তুমি পারবা, ভাই। তোমাদের মতো কাপল খুব কম আছে ভাই যে দুজন দুজনের জন্য এসব করে আর তা অপরজন বুঝতে পারে। তোমরা ভাগ্যবান।”

“এতই ভাগ্যবান যে আজ ১০ টা বছর ধরে দূরে।”

“ইনশাআল্লাহ এবার দূরত্ব ঘুচবে সারাজীবনের জন্য। কিন্তু ভাই তুমি তো চিন্তায় ফেলে দিলে। তোমার মতো করে কখনো ভাবিনি। তাছাড়া এরকম তো অনেক কিছু আমার গার্লফ্রেন্ডও করেছিল আমার জন্য। কিন্তু খেয়াল করিনি। আমি সবসময় ভাবতাম এত ঝামেলা করার কী আছে। আমার গার্লফ্রেন্ড তো আমাকে ভালোবাসেই!”

“খেয়াল করতে হয়, ভালোবাসার মানুষের প্রত্যেকটা কাজে, প্রত্যেকটা অনুভূতি, প্রত্যেকটা কথা, প্রত্যেকটা ইংগিত খেয়াল করতে হয়। না করলে তার কাছ থেকেও আশা করবি কীভাবে? তোর কাছ থেকে একটা মেয়ে যখন প্রচণ্ড ভালোবাসা পাবে তখনই সে তোকে পাগলের মত ভালোবাসতে শুরু করবে। অবহেলা করলে ওই খোঁড়াখুঁড়িটা সে একদিন বন্ধ করে দেবে। যদি সে খুঁড়তেই থাকে আর তুই ভরতেই থাকিস তাহলে গভীর হবে কী করে?”

“চিন্তায় ফেলে দিলা ভাই। কিন্তু এখন আর চিন্তা করে কী হবে? ওতো চলেই গেছে, বিয়েও হয়ে গেছে এখন।”

“তাতে কী? বউ হয়ে যে আসবে তার খোঁড়াখুঁড়িতে নজর দিস। আর ভালো হয় সে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করার আগে যদি তুই শুরু করিস, যত যাই হোক তুই একটা পুরুষ মানুষ।”

“হ ভাই, ভালো কথা কইছো। তোমার মতো বিয়া না কইরা তো থাকতে পারমু না, বিয়া যখন করতেই হইব, তখন বউয়ের লগে ভালোবাসা জমানোই ভালো।”

“আগে ভাষা ঠিক কর তো। বিরক্ত লাগে এসব শুনলে।”

“সরি ভাই, আবেগে চলে আসছে।”

২২

বিছানার ওপর পা ভাঁজ করে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে নিহিন। তিথি সামনেই বসে আছে। তিথি বলল,

“তুই অযথাই এত চিন্তা করছিস।”

“নারে, অযথা না। ও তো ডিরেক্ট কিছুই বলেনি এখনো। তাই আমি কোনো আশাও রাখছি না।”

“সরাসরি বলার কী আছে? সে যে তোকে ভালোবাসে সেটা তো বুঝিয়েছে। এমনকি তুই বলতে চাওয়া সত্তেও তোর ডিভোর্স কেন হয়েছে সেটা শুনতে চায়নি।”

“না, ও সরাসরি বলার মতন ছেলে। কিন্তু তবু কিছু বলছে না বলে তোদের মতো এত আশা করতে পারছি না।”

“মানুষতো বদলায় হয়, হয়তো ভাইয়াও বদলেছে। অনেকগুলো দিন পার হয়ে গিয়েছে তো।”

“সেরকম হলে তো আরো চিন্তার বিষয়।”

“উফ, সবসময় অত নেগেটিভ কেন ভাবছিস?”

“রেডি থাকছি। যাতে নেগেটিভ কিছু হলে সামলাতে পারি।”

হঠাৎ তিথির চোখ গেল নিহিনের পায়ের নূপুরটার দিকে। ও বলল,

“এটা ভাইয়ার দেয়া সেই নূপুরটা না?”

“হ্যাঁ”

“বাহ, সুন্দর লাগছে তো। এটা না কালো হয়ে গিয়েছিল?”

“হ্যাঁ ওয়াশ করিয়ে নিয়ে এসেছি।”

“ওয়াও, তোরা কি ভালোবাসিস রে একজন আরেকজনকে!”

“হঠাৎ একথা কেন?”

তিথি ঘাবড়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“না, মানে একজন দেওয়ালে তোমার ছবি ঝুলিয়ে রাখে। আর তুমি এতদিন পর আবার তার দেওয়া নূপুর পরে বসে আছ। তাই বললাম।”

“এটা পরলে ভালো লাগে। মনে হয় ও সঙ্গে আছে।”

তিথি কী ভেবে হাসল কে জানে। নিহিন জিজ্ঞেস করল,

“হাসছিস কেন?”

তিথি বলল,

“এমনি।”

“অসহ্য লাগে তোদের এই এমনি ন্যাকামি।”

“মানে?”

“ও সারাক্ষণ শয়তানি হাসি দিতে থাকে, জিজ্ঞেস করলে বলে এমনি। এখন তো তুইও এটা করছিস।”

“নারে দোস্ত, বিশ্বাস কর তোকে এত খুশি দেখে আমার যে কি ভালো লাগছে বলে বোঝাতে পারব না। যাই হোক, খুব সুন্দর লাগছে নূপুরটা পরে। একটা ছবি তুলি?”

“কীসের ছবি তুলবি?”

“তোর পায়ের।”

“পায়ের ছবি দিয়ে কী হবে?”

“কিছুই হবে না, সুন্দর লাগছে তাই বলেছি। যাহ লাগবে না, হুহ।”

“আচ্ছা তোল।”

হেসে বলল নিহিন। তারপর খুব সুন্দর করে নিহিনের নূপুরসহ পায়ের একটা ছবি তুলে নিল তিথি। তারপর বলল,

“আবার দেখা করছিস কবে?”

“শুক্রবার।”

“তার মানে তো পরশুই।”

“হুম।”

“কোথায়? আবার বাসায়?”

“না, মুভি দেখবো তারপর নদীতে ঘুরতে যাব।”

“নদী মানে তো আশুলিয়া। ওইযে ছাউনিওয়ালা নৌকাগুলো! পর্দা দেওয়া থাকে, আর খালি দোলে। ওখানে যাবি? তার চেয়ে আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়। শাশুড়ি আম্মা বাপের বাড়ি গেছে।”

“ছি।”

লজ্জায় লাল হয়ে গেল নিহিন। তিথি খুব মজা পাচ্ছে। তাই আবার বলল, “ছি এর কী আছে? আমার বাসাটা ওই নৌকার চেয়ে ভালো না?”

“আমরা নৌকায় করে নদীতে ঘুরতে যাব।

“দোল খাওয়ারাও ঘুরতেই যায়।”

বলেই হাসল তিথি। নিহিন বলল,

“ছি তুই খুব জঘন্য হয়ে গেছিস। আমরা কোনো পর্দা বা ছাউনি দেওয়া নৌকায় ঘুরতে যাব না। খোলা নৌকায় যাব।”

“তার মানে খোলা নৌকায়! লজ্জা শরম কি দেশ থেকে উঠে গেল নাকি?”

এবার নিহিন মারতে গেল তিথিকে। আর তিথি মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিহিনকে জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগল।

ফোনটা এলো পরদিন সকালে। নিহিন অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে এমন সময়। নাম্বারটা নিহিনের অচেনা। ধরে বলল,

“হ্যালো।”

“মিষ্টি!”

“কল্প! আমার বাবুটা কেমন আছে?”

“খুব ভালো। তুমি কেমন আছ মিষ্টি?”

“আমার কল্প ফোন করেছে, আমি ভালো না থেকে পারি?”

“হিহিহি, মিষ্টি দাদাভাই তোমার সাথে খুব ইম্পরট্যান্ট কথা বলবে। তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে, কথাই বলতে দিচ্ছে না আমাকে। ওর সাথে কথা বলো তো। তুমি বাসায় আসলে আমি এত্ত কথা বলব।

নিহিন হেসে বলল,

“ওকে, দাদাভাইকে দাও।”

“টাটা।”

“টাটা।”

এরপর শওকত সাহেবের ভারী কন্ঠ পাওয়া গেল, “হ্যালো।”

“আসসালামুওয়ালাইকুম আংকেল। কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুমআসসালাম। মা ছাড়া ছেলেরা যেমন থাকে তেমনই আছি

মা। তুমি ভালো আছ তো?”

নিহিন লজ্জা পেয়ে গেল একথায়। শুধু বলল,

“জ্বি আংকেল।”

“কলরবের জন্মদিনের কথা কি তোমার মনে আছে মা?”

“জ্বি আংকেল। মনে কেন থাকবে না, মনে আছে। সামনের মঙ্গলবারই তো।”

মনে হলো খুশি হয়েছেন উনি। বললেন,

“বাহ, কোন প্ল্যান আছে তোমার?”

কলরবের জন্য কেনা কালো রঙের গিটারের দিকে তাকালো নিহিন। “জ্বি আংকেল, আমি ওকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছি। কিন্তু কীভাবে সেটা এখনো ঠিক করিনি। এমন হতে পারে ওকে না জানিয়ে সকালে ওর অফিসের ওখানে চলে যাব। কিংবা অন্যকিছু এখনো ঠিক করতে পারিনি। তবে গিফট কিনে ফেলেছি।”

“আচ্ছা কিন্তু জন্মদিনে ও সবসময় ছুটি নেয়, অফিসে যাবে না। তার চেয়ে আমার মনে হয় তুমি যদি সকাল সকাল আমাদের বাসায় চলে আসো তাহলে সারপ্রাইজ দিতে সুবিধা হবে।”

“ও ঠিক আছে, ও কখন ওঠে ঘুম থেকে?”

“তুমি এসে ঘুম থেকে ওঠাতে চাচ্ছ?”

একথায় আবার লজ্জা পেয়ে গেল নিহিন। বলল,

“জ্বি আংকেল, গেলে ও ঘুম থেকে ওঠার আগেই যাব।”

“অফিস থাকলে ও ভোরে ওঠে, কল্পকে স্কুলে দিয়ে তারপর যায় তো। কিন্তু ছুটির দিনে ১০ টার আগে কখনো ওঠে না। তার আগে আসতে পারবে তো?”

“জ্বি আংকেল, তাহলে আমি চেষ্টা করব ৯ টার মধ্যে আসার।”

“ঠিক আছে মা। আর আমরা তো সবসময় ওকে রাত্রেই কোনো না কোনো সারপ্রাইজ দেই এবারও তাই করব, নাহলে আবার সন্দেহ করবে।

হাসল নিহিন,

“ঠিক আছে আংকেল।”

“কী করছো মা এখন?”

“রেডি হচ্ছি, অফিসে যাব।”

“আচ্ছা ঠিক আছে মা, আমি তাহলে রাখছি।”

২৩

শুক্রবার শুরু হলো ওদের গন্তব্যহীন যাত্রা। কলরব জিজ্ঞেস করল,

“আগে কোথায় যাবে?”

“তোমার ইচ্ছা।”

“জানতাম তুমি এটাই বলবে। আচ্ছা, চল আগে মুভি দেখে আসি।”

“ঠিক আছে।”

এরপর কলরব নিহিনকে একটা ছোট্ট ব্যাগ দিলো। নিহিন বলল, “কী এটা?”

“তোমার সেই সাজুগুজু! আমার বাসায় ফেলে এসেছিলে।”

“ও।”

হাসল নিহিন, তারপর নিজের অজান্তেই ব্যাগটা খুলল। দেখে বলল, “এগুলো তো আমার না।”

“এগুলোই তোমার।”

“আরে বাবা, আমারগুলো তো ব্যবহৃত। এগুলো তো নতুন।”

“হুম ওগুলো আমি রেখে দিয়েছি। ওই ব্রান্ডের ওই জিনিসগুলোই আছে এখানে।”

“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কেন?”

“তোমার ওই ছোটবেলার ছবিটা ছাড়া আর তো কিছু নেই আমার কাছে, থাকুক না কিছু জিনিস স্মৃতি হিসেবে!”

নিহিনের বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠল। স্মৃতি হিসেবে রাখতে চাচ্ছে কেন? তাহলে কি যা ভেবেছিল তাই! আবার ভাবল, ধ্যাত হতেই পারেনা। কলরব তো ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে।”

নিহিন মনোযোগ দিয়ে মুভি দেখছে আর কলরবের দেওয়া চকোলেট খাচ্ছে। আর কলরব দেখছে নিহিনকে। খেতে খেতে একটুখানি চকোলেট ঠোঁটে লেগে গেল নিহিনের, ও খেয়াল করল না। সিনেপ্লেক্সের আধো আলোতে অসাধারণ লাগছে নিহিনকে। নিহিনের মুখটা এমন যে একবার তাকালেই ভালো লাগে, আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে করে। তবে ওর সৌন্দর্য শতগুণ বেড়ে যায় হাসলে আর হাজারগুণ বেড়ে যায় লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলে।

কলরব আঙুল দিয়ে চকলেটটুকু নিহিনের ঠোঁট থেকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের মুখে দিলো। কলরব নিহিনের ঠোঁটে হাত দিতেই ও চমকে উঠেছিল। তারপর কলরবের এ কাণ্ড দেখে লজ্জায় আর মুখ উঠাতে পারল না। কলরব বুঝল, তবু না বোঝার ভান করে ফিসফিসিয়ে বলল,

“কী হলো?”

“কিছু না।”

বলেই আধ খাওয়া চকোলেটটা এগিয়ে দিলো কলরবের দিকে। কলরব হাতে নিয়েই খাওয়া শুরু করল। নিহিনকে এত লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে কলরব মুভিতে মন দিলো।

কিছুক্ষণ পর দুজনেই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। একই সাথে দুজন দুজনার দিকে ফেরাতে নিহিনের ঠোঁট ধাক্কা খেল কলরবের বাহুতে। ফলে নিহিনের ঠোঁট থেকে চকোলেট মাখা লাল লিপস্টিক লেগে গেল কলরবের কালো টি শার্টের হাতায়। নিহিন গলা নিচু করে বলল,

“ইশ, সরি খেয়াল করিনি। কী হবে?”

“কিছুই হবে না। ঠিকাছে।”

“কালোর ওপর লাল একদম স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।”

কলরব হেসে বলল,

“সমস্যা নেই তো, ছেলেদের কাপড়ে এবং গায়েও লিপস্টিকের দাগ সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার।”

“যাহ, তুমি না!”

“কী?”

“অসভ্য।”

“আমি কোথায় অসভ্যতা করলাম? তুমিই তো অসভ্যতা করলে!”

নিহিন অবাক হলো,

“আমি! আমি কী করেছি?”

“চুমু খেলে আমার হাতে।”

“ইশ! যাহ। মুখে কিছু আটকায় না।”

লজ্জায় চুপসে গেল নিহিন। আর কলরব হাসতে লাগল।

২৪

“এম্মা এ তো দেখি একদম বাচ্চা ছেলে!”

কলরবকে দেখেই একথা বলল তিথি। হকচকিয়ে গেল কলরব। এ মেয়ে বলছে কী? সাব্বির বলল,

“তিথি তোর কী জ্ঞানবুদ্ধি কখনো হবে না?”

“এম্মা এখানে জ্ঞানবুদ্ধির কী আছে? তুই ছোট ভাই হতে পারিস, আমি তো আধি ঘরওয়ালি। কি ভাইয়া ঠিক বলেছি তো?

কলরব হেসে বলল,

“সাব্বির তুই থাম তো, হ্যাঁ আধি ঘরওয়ালি কী যেন বলছিলে?”

“বলছিলাম যে, আপনাকে দেখে চমকে গেলাম, মনেই হচ্ছেনা আপনি আমাদের থেকে অত বড়। আমাদের বয়সী বলেই মনে হচ্ছে।”

“সেটা হওয়া কি ভালো না? নিজের প্রিয় বান্ধবীর জন্য নিশ্চয়ই কোনো বুড়োকে পছন্দ করবে না?”

“সেটা তো অবশ্যই না, নিহিনের ভাষ্যমতে আপনি কালো এবং ওর চেয়ে ৭/৮ বছরের বড়। তো সে হিসেবে আমি ভেবেছি একটা কালো, ভুঁড়িওয়ালা টাক লোককে দেখতে পাব। অথচ আপনি এত্ত কিউট এন্ড হ্যান্ডসাম যাকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ছাড়া আর কিছু বলা যাচ্ছে না। আমি বিয়েটা না করে ফেললে আপনার সাথে লাইন মারতাম নির্ঘাত।”

একথা বলেই তিথি একটা চোখ মারল কলরবকে। কলরবের তো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। বিস্ময় কাটলে কলরব হো হো করে হেসে উঠল সাব্বির খুব বিরক্ত হচ্ছে। তিথির সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। কলরব বলল,

“আচ্ছা তোমার বান্ধবী তোমাকে বলেছে আমার মাথায় টাক আছে? আর ভুঁড়ি!”

“না তা নয়, আসলে কালো আর অনেক বড় বলেছে, তাই তামিল সিনেমার ভিলেনদের সাথে বাকিটা মিলিয়ে নিয়েছিলাম।”

আবার হাসল কলরব।

“যাক ভালোই হলো, বউটা আমার খুব শান্ত, আরেকটা চঞ্চল বউ পাওয়া গেল। সাব্বির চল আমরা আগাই।”

এরপর তিথিকে জিজ্ঞেস করল,

“তুমি নাকি নূপুরের ছবি তুলে এনেছ?”

তিথি মোবাইলের ছবিটা বের করে দেখালো। ছবিতে নিহিনের পা টা দেখে কলরবের মনটা একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেল। ব্যাপারটা তিথি ধরে ফেলল।

“কি ব্যাপার পা দেখেই চিনে ফেলেছেন?”

“আমার জিনিস, আমি চিনব না?”

“শুধু যে চিনেছেন তা তো নয়। চোখ দুটো একদম নেচে উঠেছে।” হেসে ফেলল কলরব। দোকানে ঢুকতেই দোকানদার বলল,

“স্যার কী দেখাব?”

“কিছু দেখব না, অর্ডার দেবো। একটা নূপুর।”

“ওহ, সরি স্যার, আমরা রূপার জিনিসের অর্ডার নেই না। এখানে সুন্দর ডিজাইনের রেডিমেট বানানো আছে। এগুলো দেখতে পারেন।”

“না না, আমি আমি স্বর্ণের বানাবো। আর ডিজাইন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।”

চমকে উঠল তিথি।

“আপনি পাগল হয়েছেন? মুসলমানের স্বর্ণের নূপুর পরতে হয় না।”

“কেন?”

“সেটা জানি না।, সবাই বলে তাই।”

“এরকম কোনো কুরআনে আছে? হাদিসে আছে?”

“জানি না।”

“তাহলে আর কী, এখন তো বানাই। পাপ হলে তোমার বান্ধবীকে

বোলো ভেঙে অন্যকিছু বানিয়ে নিতে।”

“কেন লাগবে? আপনার কি টাকা পয়সা বেশি হয়েছে?”

কলরব হেসে বলল,

“একটু স্পেশাল তাই। এখন তো বুঝতে পারবে না। পরে বুঝবে।”

সাব্বির বলল,

“তোমার ভাই টাকা বেশি হইছে, রূপা দিয়ে বানাইলেই তো হয়।”

“তুই কি তোর বউকে বিয়েতে রূপার গয়না দিবি? নাহয় দিলি, তারপরেও কি একটুও স্বর্ণ থাকবে না?”

“তা থাকবে। কিন্তু তুমি কি এটা বিয়ের জন্য বানাচ্ছ?”

“ধরে নে, ওইরকম কিছু।”

খেয়ে দেয়ে, ঘুরে ফিরে ভালোই কিছু সময় কাটাল ওরা। যাওয়ার সময় তিথি বলল,

“ভাইয়া, এই প্রথম কিছু লুকিয়েছি নিহিনের কাছ থেকে।”

“সেটা তো তোমার বান্ধবীর খুশির জন্যই। সারপ্রাইজ পেতে কার না ভালো লাগে বলো।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এখন যে কষ্টটা পাচ্ছে তার জন্যই খারাপ লাগছে।”

“কেন? কষ্ট পাচ্ছে কেন?”

“আপনি যে ওকে ভালোবাসেন সেটা ও খুব ভালোভাবেই জানে, কিন্তু সরাসরি কিছু বলেননি তাই টেনশনে মরছে। আর এদিকে আপনি বিয়ের প্ল্যানিং করছেন, বউ বউ করছেন। আমাকে কিছু বলতেও নিষেধ করছেন, কিন্তু ভাইয়া মেয়েটা ওদিকে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।”

হাসল কলরব। তিথি অবাক হয়ে বলল,

“আপনি হাসছেন?”

“ওকে টেনশন করতে দাও। সময় এলেই আমি যা বলার বলব। যাতে সবকিছু খুব সুন্দরভাবে হয় সে ব্যবস্থাই করছি। আর তোমার বান্ধবী অনেক কষ্টই তো পেয়েছে, সুখটা নাহয় একবারে বেশি করে পাক। তাছাড়া গতকালই ওর সাথে দেখা হয়েছে, ও ভালোই আছে।”

এমন সময় সাব্বির তিথিকে বলল,

“তুই দরদ দেখাইয়া বলে দিয়া সব ব্লান্ডার করে দিস না দোস্ত প্লিজ।”

“আহ বললে তো কবেই বলে দিতাম। আমি কিছু বলেছি?”

“নিহিনের ফিলিংসের কথা ভাইয়াকে বলার কী দরকার ছিল? তুই এসে বলে দিবি সেজন্য কি নিহিন তোকে বলেছে? কোনো কথা এ মেয়েটার পেটে থাকে না।”

“এম্মা, আমি নিহিনের কোনো প্ল্যান..”

থেমে গেল তিথি। কলরব বলল,

“নিহিনের কীসের প্ল্যান?”

“না কিছু না, আমি গেলাম ভাইয়া।”

এই বলেই দৌড়ে পালালো তিথি। কলরব সাব্বিরকে বলল,

“আই থিংক নিহিন কোন প্ল্যান করছে, যেটা তিথিকে বলেছে, আর তিথি সেটা মুখ ফসকে বলে ফেলছিল। মনে পড়তেই আবার গিলে ফেলল কথাটা। তাই না?”

“আমি কি জানি, আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছো?”

“তুই হলি মিচকা শয়তান। সবার সব জানিস কিন্তু কিছু বলিস না।”

“সেটাই কি ভালো না? একজনের কথা আরেকজনের কাছে বলার মানে কী? যত্তসব! তিথি তোমাকে যেটুকু বলেছে তার জন্য আমার গা জ্বলছে।”

“জ্বলাজ্বলির কিছু নেই, আমার জন্মদিন আর নিহিন কিছু প্ল্যান করবে না এটা তো হতেই পারে না, কী প্ল্যান তা অবশ্য জানি না। কিন্তু কিছু তো একটা। তোরা না বললেও আমি বুঝি। নিহিনকে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে বল?

সাব্বির অবাক হওয়ার ভান করল,

“তোমার জন্মদিন নাকি?”

হেসে ফেলল কলরব। সাব্বির আবার বলল,

“শোনো নিহিনের অত টাইম নাই ওকে? মঙ্গলবার ওর অফিস আছে।”

কলরব হো হো করে হেসে দিলো। তারপর বলল,

“ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট। একটু আগেই আমার জন্মদিন শুনে অবাক হলি। এখনই আবার বলছিস মঙ্গলবার ওর অফিস আছে। সামনে আমার জন্মদিন এটা জানিস না কিন্তু মঙ্গলবার আমার জন্মদিন এটা জানিস। হাস্যকর!”

“আচ্ছা ভাই, তাড়াতাড়ি চলো। আমার আবার কাজ আছে।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন