বীরকন্যা কল্পনা : সংগ্রামের সতত সাহসী প্রেরণা – প্রসিত বিকাশ খীসা

অভিশপ্ত কালো রাতের ভয়াল অন্ধকারের সেই দিনটির ঘটনা আজো আমাদেরকে ঝাঁকুনি দিয়ে তোলে। জাগ্রত বিবেককে নাড়া দিয়ে করে তোলে অস্থির, বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ। প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে না পারার অক্ষমতা মনে পড়লে যন্ত্রণা বিক্ষুব্ধ প্রতিটি দেশপ্রেমিক সংগ্রামী তরুণ হয়ে উঠে লড়াই সংগ্রামের স্পৃহায় আরো বেশী নির্ভীক, মৃত্যুভয়হীন দুর্দান্ত সাহসী লড়াকু সৈনিক।

‘৯৬ এর ১১ই জুন দিবাগত রাতে আমাদের প্রিয় বোন, নারী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়ী প্রতিশ্রুতিশীল নেতৃত্ব কল্পনা চাকমা চিহ্নিত অপরাধী লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে কতিপয় দুষ্কৃতিকারী আনসার-ভিডিপি’দের হাতে অপহৃত হয়েছেন। সেই অবধি তার কোন হদিশ নেই। আজ এক একটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো।

তদন্ত কমিটি করেই সরকারের সব দায় দায়িত্ব যেন শেষ হয়েছে এমন ভাবসাব। অনুসন্ধান বা উদ্ধার তৎপরতার কোন খবর দেশবাসীর জানা নেই। চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার সাধারণ কাজটুকু আজ পর্যন্ত সরকার করেনি।

প্রশ্ন জাগে, এ কোন মুল্লুকে বাস করছি আমরা? দেশে সরকার কিংবা আইন শৃংখলা বলে আসলে কোন কিছু আছে কিনা সেই সন্দেহ জাগে।

সরকারের মন্ত্রী আমলারা কথায় কথায় আইন শৃংখলা, সন্ত্রাস প্রতিরোধ, প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বুলি কপচিয়ে বক্তব্য বিবৃতি দেয়। কিন্তু তা কি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ রেখেই হচ্ছে, সেই জবাব কেউ দেন না। দিতে পারেনও না। না হলে, কল্পনার ব্যাপারে এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও কি কারণে মৌনব্রত পালন করছে সরকার? অপহরণের সাথে সরকারের রাঘব বোয়ালদের কেউ কেউ ধরা পড়ে যাবে এই ভয়ে কি নির্লিপ্ততা? কেন চিহ্নিত অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? তাহলে কি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বহির্ভূত? সেনা কর্তৃত্বের খেয়াল খুশীর কাছে বন্ধক দেয়া আইন শৃংখলাহীন অঞ্চল?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বজন হারানোর মর্মবেদনা বুঝাতে যাওয়ার দরকার নেই। বরং সেটা করতে গেলে এক ধরনের ফাজলামোই হবে। “১৫ই আগস্টের” কথা স্মৃতিচারণ করলেই তার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায়। কথা বলতে পারেন না। আবেগে ভাষা হারিয়ে ফেলেন। স্বজন হারানো শোক কত গভীর তা বুঝানো যায় না। কল্পনার অপহরণে তার বিধবা মা ও আত্মীয় স্বজনদের কথা কি হাসিনা একটি বারও ভেবে দেখেন?

নিজ বাড়ীতে মা-ভাই বোনদের মাঝ থেকে মধ্যরাত্রে ঘুমন্ত কল্পনাকে অপহরণ করা হয়েছে। সেখানে রাস্তা ঘাটের নিরাপত্তার কথাতো বাদ। অপরাধী অপহরণকারী চিহ্নিত দুষ্কৃতিকারীদের সনাক্ত করার পরেও আইনানুগ কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষ করেও রিপোর্ট প্রকাশ করছে না, কিংবা পারছে না। অপরাধী দম্ভ ভরে ঘোরাফেরা করছে। হুমকি দিচ্ছে। কল্পনার বিধবা মা আর ভাইয়েরা অজানা আশংকায় রয়েছে ত্রস্ত। এরপরেও কি বলা যায় দেশে আইন শৃংখলা আছে?

শেখ হাসিনা আজ প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতাসীন দল। আর তাই ২১ বছর পরে মুজিব হত্যার বিচার হতে পারছে। ইনডেমনিটি বিল বাতিল সম্ভব হয়েছে। শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হচ্ছে।

অপহৃত কল্পনা চাকমার তো কেউ নেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তার নিকট কেউ ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে (শেখ হাসিনার মতো স্বজন হারানো ব্যথা নিয়ে) অপহরণের বিচার করবে সেটা দূর কোন কষ্ট কল্পনার চাইতেও অধিক কল্পনা মাত্ৰ।

তাই কল্পনার অপহরণে সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রী, এম.পি. আমলা কার কি আসে যায়? কল্পনাতো তাদের কেউ নয়। শুধু কল্পনাই বা কেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণই তো সরকারের কেউ নন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিতে না পারার মনের খেদ তো বোধহয় এখনো যায়নি আওয়ামী লীগের। কল্পনার মায়ের মতো আরো কতো দুঃখিনী পাহাড়ি মায়ের মেয়ে ছেলে পথে ঘাটে লাঞ্ছিত হচ্ছে। অত্যাচারিত হচ্ছে- সে খবর তো সরকারের জানার দরকার নেই। তার তো দরকার শুধু মৌসুমে ভোট। সময়ে সময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েই খালাস কিছু স্থানীয় হুজুগপ্রিয় অস্থিরমতি অপরিণামদর্শী ভাড়া করেই কাজ শেষ। জুম্মো দিয়ে জুম্মোদের ব্যতিব্যস্ত রাখতে পারলেই সরকারের লাভ। অপহৃত কল্পনার বিধবা মাকে সান্তনা দেবার মানবিক দায়িত্বটুকু সরকারের পদস্থ কিংবা দলের কেউ পালন করেনি। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করণে তাদের তো মেলা কাজ! এ ধরণের সরকার কল্পনাদের রক্ষার জন্য নয়। অপহরণ, অত্যাচারের বিচার তো আরো দূরের ব্যাপার। তদন্ত রিপোর্ট? সে তো শুধুমাত্র লোকের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবার জন্য “খালি পাতিল উনুনে চড়িয়ে দেয়া”।

কল্পনার কেউ নেই সরকারের মন্ত্রী সভায়। প্রশাসনের উর্ধ্ব অধঃ কোন মহলে কোথাও নেই তার কেউ।

কিন্তু, কল্পনার আছে শত সহস্র অকুতোভয় সংগ্রামী সহযোদ্ধা-ভাই-বন্ধু। আছে মানবতাবাদী অনেক হিতাকাঙ্খী, দরদী বন্ধু। যারা তার খোঁজ নিতে গিয়েছিল অখ্যাত নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামে। তাকে উদ্ধারের মিটিং মিছিলে কাঁপিয়ে তুলেছে রাজপথ। বীরত্বের সাথে আত্মাহুতি দিয়েছে রূপনের মতো এক নিষ্পাপ স্কুলের কিশোর। গুম হয়েছে সমর, সুকেশ, মনোতোষের মতো সম্ভাবনাময়ী সংগ্রামী বন্ধু। যারা আর কোনদিন ফিরে আসবে না আমাদের মাঝে। হারিয়ে গেছে তারা চিরদিনের জন্য। তাদের স্মৃতি আমাদের হৃদয়ের মানসপটে থাকবে চির অম্লান। তাদের দেশপ্রেম, সাহসিকতা, বীরত্ব আমাদেরকে করবে উজ্জ্বীবিত। লড়াই সংগ্রামে যোগাবে সাহস ও শক্তি।

কল্পনাকে উদ্ধার করতে শহীদ রূপন, সমর, সুকেশ ও মনোতোষের সাহসী আত্মা বলিদান আমাদের মনে করিয়ে দেয় লংকা যুদ্ধের কাহিনী, ট্রয় নগরীর যুদ্ধের কথা। রাক্ষসদের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কায় হয়েছিল, কূল, গৌরব ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই। হেলেনকেও উদ্ধার করতে যুদ্ধ হয়েছিল ট্রয় নগরীতে। তা করতে হয়েছিল শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন ও মর্যাদা রক্ষার্থে।

সতী সাধ্বী অসামান্য রূপই ছিল যেন সীতার অপরাধ। রাক্ষস রাজা রাবণ তাকে করেছিল অপহরণ। আলোক সামান্য সুন্দরী হেলেনকেও অপহরণের কারণে বীরত্ব, গৌরব ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে যুদ্ধ করতে হয়েছিল ট্রয় নগরীতে।

কল্পনার সংগ্রামী চেতনা, সাহস ও তেজস্বীতায় ভীত সন্ত্রস্ত কাপুরুষেরা তার প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে রাতের অন্ধকারে তাকে অপহরণ করেছিল। কিন্তু অপহৃত হয়ে কল্পনা আর নিছক একজন কল্পনা হয়ে নেই। সে পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত সাহসী তরুণদের কাছে মানবাধিকার, বিবেক, মর্যাদা, সম্মান ও ইজ্জত রক্ষার লড়াইয়ে এক অফুরন্ত প্রেরণা।

লংকার বন্দীদশা হতে সীতা আর ট্রয় নগরী হতে হেলেনকে উদ্ধার করতে যে লড়াই হয়েছিল, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামেও কল্পনার মতো শত সহস্র বোনকে লৌহ নিগঢ়ের বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের জন্য হবে আপোষহীন লড়াই সংগ্রাম। তার মধ্য দিয়েই অর্জিত হবে অধিকারহারা মানুষের অধিকার, মর্যাদা, সম্মান, স্বীকৃতি ও অস্তিত্বের নিশ্চয়তা। চেতনার অগ্নি মশাল ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। অপহরণ করে দেশপ্রেমিক সংগ্রামীদের দাবিয়ে রাখা যায় না। ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়া যায় না। এক কল্পনা অপহৃত, কিন্তু আরো শত হাজারো চেতনাদীপ্ত সাহসী সংগ্রামী বোন কল্পনার চেতনায় মৃত্যু ভয়হীন লড়াকু যোদ্ধা এলাকায় এলাকায় জন্ম নিচ্ছে। অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে চলবে নিরন্তর সংগ্রাম। পূর্ণস্বায়ত্তশাসন অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দুঃখিনী পাহাড়ি মায়ের দামাল ছেলেরা ঘরে ফিরবে না। সেই লড়াই সংগ্রামে কল্পনা হবে এক সতত সাহসী প্রেরণা।

স্বাধিকার : বুলেটিন নং—সাত, ২০ আগস্ট ‘৯৭

সকল অধ্যায়

১. কল্পনা চাকমার ডায়েরি
২. কল্পনা চাকমার লেখা
৩. কল্পনা চাকমার চিঠিপত্র
৪. কল্পনা চাকমার ছবি
৫. কল্পনা চাকমা অপহরণের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ
৬. কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদে স্মারকলিপি ও প্রচারপত্রসমূহ
৭. কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার অনুসন্ধান
৮. কল্পনা চাকমা, তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো? – এ.এন. রাশেদা
৯. FOCUS : A Month After Abduction, Kalpana Chakma Yet to be Rescued – Morshed Ali Khan
১০. অপহৃত কল্পনা চাকমা – শাহীন আখতার
১১. আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে – সামিও শীশ
১২. কল্পনা চাকমার ডায়েরি থেকে – এফ.এম.এ. সালাম
১৩. টক অফ দি টাউন কল্পনা চাকমা – আবেদ খান
১৪. কল্পনা চাকমাকে খুঁজে বের করতেই হবে!! – ফরিদা আখতার
১৫. বাঘাইছড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি : কল্পনা ত্রিপুরায় একথা বিশ্বাস করে না চাকমারা – মনির হোসেন
১৬. শোকার্ত পাহাড়ী জনপদ : কল্পনা চাকমার সন্ধান মেলেনি এক বছরেও – বিপ্লব রহমান
১৭. অপহৃত কল্পনা ও আজকের অবস্থা – মুক্তি নারায়ন
১৮. অনুভব – প্রণয় খীসা ঝিমিত
১৯. বীরকন্যা কল্পনা : সংগ্রামের সতত সাহসী প্রেরণা – প্রসিত বিকাশ খীসা
২০. কল্পনা অশান্ত পাবর্ত্য চট্টগ্রামের প্রতীক – মি. প্রদীপন খীসা
২১. কল্পনা চাকমা ও পাথর-মা’র গল্প – সঞ্জীব দ্রং
২২. কেন ফিরে আসছে না কল্পনা চাকমা? – আবেদ খান
২৩. কল্পনাকে মনে পড়ে ওর চিন্তাকে মনে পড়ে – জোবাইদা নাসরীন কনা
২৪. কল্পনা চাকমার স্মৃতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – কবিতা চাকমা
২৫. WHERE IS KALPANA CHAKMA? A four-year-old Question with No Answers – Meghna Guhathakurta
২৬. কল্পনা – প্রিসিলা রাজ
২৭. কল্পনা চাকমা অপহরণ : পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার ও নারী অধিকার লংঘন – এডভোকেট খালেদা খাতুন
২৮. আমার স্মৃতিতে কল্পনা চাকমা – প্রদীপন খীসা
২৯. এই নিশ্চুপতাটি আমাদের জাত্যাভিমানের একটা স্মারক হয়ে উঠল – মানস চৌধুরী
৩০. কল্পনা চাকমা অপহরণ প্রসঙ্গে অধিপতি জাতির আমরা – সায়দিয়া গুলরুখ
৩১. ঐ পাহাড়ে জুলুম চলে – রবীন আহসান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন