কল্পনা অশান্ত পাবর্ত্য চট্টগ্রামের প্রতীক – মি. প্রদীপন খীসা

বৃহত্তর পার্বত্য চট্রগ্রাম হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা। তার নিজ বাড়ী রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামে। জন্মের মাসে তার বাবা মারা যান। নিজ চোখে বাবাকে দেখেনি। প্রতিকূল ও বৈরী পরিবেশে নিজ গ্রামে কল্পনা বড় হয়। কল্পনাকে নিয়ে তার বিধবা মায়ের শত হাজারো স্বপ্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত কন্যা হারানোর শোক নিয়ে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিলেন তার মা বাঁধুনী চাকমা।

১৯৯৬ সালের ১২ই জুন গভীর রাতে নিজ বাড়ী হতে কল্পনা চাকমা অপহৃত হন। তাকে অপহরণ করে কজইছড়ি ক্যাম্প কমান্ডার ঈস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেনেন্ট ফেরদৌস। তাকে সহযোগীতা করে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্লাটুন কমাণ্ডার নূরুল হক, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য সালেহ আহম্মদসহ আরো ক’জন সেনা সদস্য।

সেইদিন কল্পনার দু’ভাইকেও গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করে। কালীচরণ চাকমা (৩২) ও লাল বিহারী চাকমা ক্ষুদিরাম (২৬)-কে লে. ফেরদৌস গুলি করতে নির্দেশ দেয়। গুলি করার আগেই তারা পালাতে সক্ষম হয়। পালানোর সময় তাদেরকে ৩০৩ রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে তারা অক্ষত অবস্থায় পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু কল্পনা চাকমা পালাতে পারেনি। সেই থেকে কল্পনা আজো নিখোঁজ।

কল্পনা চাকমাকে উদ্ধার ও অপহরণের প্রতিবাদে বাঘাইছড়ি থানাসহ দেশের সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে। পত্র পত্রিকায় ব্যাপক লেখালিখি হয়। একই ভাবে দেশের বাইরে ও দেশে অনেক নিন্দার ঝড় উঠে তারপরও সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব। তাই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন যৌথভাবে গোটা বাঘাইছড়ি থানায় অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেয়। ২৭শে জুন ১৯৯৬ সালে এই অবরোধ কর্মসূচী সফল করতে সকলেই মন প্রাণ দিয়ে পিকেটিং এ লেগে যায়। সেই দিনই সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতে সেটেলার বাঙালীরা কুপিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের তিন জন সক্রিয় কর্মীকে। তারা হলো ১. মনোতোষ চাকমা (১৮) গ্রাম-বঙলতলী ২. সুকেশ চাকমা (১৭) গ্রাম-খরেঙ্গাতলী ও ৩. সমর বিজয় চাকমা (২০) গ্রাম খরেঙ্গাতলী। আর বাঘাইছড়ি থানা-পুলিশ পিন্টু চাকমা (১৬) রূপন কে গুলি করে হত্যা করে। মনোতোষ সুকেশ সমর বিজয় ও পিন্টু চাকমার লাশ গুম করে। আজ রূপকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দাড়িয়ে আছে তাদের স্মরণে তৈরী স্মৃতিস্তম্ব। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করা হয়।

নেত্রী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ, মনোতোষ, সুকেশ, সমরবিজয় ও পিন্টু চাকমা (রূপন) কে নির্মমভাবে খুন এবং তাদের লাশ গুম করা হয়। এই সব ঘটনাবলী অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনী পুলিশ এবং বহিরাগত সেটেলার বাঙালীদের নৃশংসতা পৈশাচিকতা, নির্মমতা, বর্বরতা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক।

নেত্রী কল্পনা অপহৃত হবার পর তারই উত্তরসূরী হিসেবে ভূমিকা রাখে জীতা চাকমা, জ্যোৎস্না চাকমা, সুমিতা চাকমা, লিপি চাকমা, রুপ্তা তালুকদার, রেনিবন চাকমা সহ আরো অনেকে। তারা আজ প্রায় সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা বজায় থাকলে তারা হয়ত এখনো সক্রিয় হয়ে কাজ করত। এখন জনসংহতি সমিতি আত্মসমর্পণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, হত্যা, গুম ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্তু লারমা স্বৈরাচারী এরশাদের ভূমিকা নিয়েছে। এরশাদ, খালেদা, শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রাক্কালে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়। সে সময় দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তার আগে বি. এন. পি. রাষ্ট্র ক্ষমতায়। থাকাকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হয় লোগং নান্যাচরের মত লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। ৯৬ সালের নির্বাচনের পর দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন আওয়ামী লীগ সরকার। এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি এখনো রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তার এই সরকারের আমলে চলছে একের পর এক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে নয় দেশের সর্বত্র। উদিচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর বর্তমান সরকার অপহৃত কল্পনা ঘটনার তদন্তের রির্পোট প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হন পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও পুলিশেরা নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধ করতে। তার প্রমাণ কল্পনার উত্তরসুরী লিপি চাকমার ১৯৯৬ সালের ১৩ নভেঃ লেখা চিঠি।

বাঘাইছড়ি

সহযোদ্ধা প্রদীপন দা,

চিঠি খানি চলতি মাসের ৫ তারিখ পেয়েছি কিন্তু সে সময়ে শারীরিক ভাবে অসুস্থ এবং তার পরপরই ১০ নভেঃ। প্রাপ্তি স্বীকার করতে দেরী হলো বলে দুঃখিত।

সংগ্রামী শুভেচ্ছা থাকলো। শুনেছি সেখানে ১০ ই নভেঃ সুন্দর ভাবে পালন করা হয়েছে। আমাদের এখানেও মোটামুটি দু’স্থানে জাঁকজমক ভাবে পালন করেছি। একটা রূপকারী অন্যটি বাঘাইছড়ি হাইস্কুল মাঠে। আমি রূপকারীতে অংশগ্রহণ করেছি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে পাহাড়ি গান নিয়ে কিন্তু তার ফাঁকে চলছিল কাজী নজরুলে বিদ্রোহী কবিতা পাঠ।

উদ্বোধনী সংগীতে আমাকে কাঁদতে হয়েছে। আমি সহজে কাঁদি না। কিন্তু গানটি শুনতে শুনতে মনে হলো কোন আপন জনকে হারিয়েছি। সম্পূর্ণ জাতির পিতার উদ্দেশ্যে। এক এক করে মনে পড়তে লাগলো কল্পনা, মনতোষ, রূপন, পিন্টু ও সুকেশ কে।

আমদের অবস্থা তেমন ভালো না। শুনবে অবশ্যই গত ৯ ই নভেঃ আমদের অন্যতম কর্মী তরুণকে লঞ্চ থেকে চিদিরা কুকুররা তুলে নিয়েছে। যখন শুনি তখন থেকে কেমন যেন লাগতেছে। কলেজে যাচ্ছি তার খবর পাওয়ার জন্য কিন্তু কোন খবর পাচ্ছি না। প্রতিবাদ মিছিল করার ও কোন পরিবেশ দেখতেছিনা। এক এক করে একটার পরে একটা হচ্ছে।

সব কিছু মেনে নিয়ে চলতে হচ্ছে। জানি এগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ইস্পাতের মতো শক্ত হতে হবে। নিজেকে একদিকে হতে হবে কঠিন এবং নিষ্ঠুর।

আমাদের এলাকাটা বেশ বড় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাও কঠিন। একটা কিছু হলে খবর পেতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। আমি তো যত পারি খবর গুলো পাঠানোর চেষ্টা করি।

আমদের জুম্মরা এ রকম কেন? কয়েকদিন হতে না হতে সবকিছু ভুলে যাই বলে মনে হয়। শত্রু পক্ষতো সুযোগের অপেক্ষায় আছে। কখনো বসে নেই, সুযোগ পেলে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু আমরা কেউ সহজে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চায় না। সময়ের সাথে তাল মেলানোর প্রস্তুত রাখি না কেন? বর্তমানে এই কঠিন সময়ে মোকবেলা করার প্রস্তুত থাকার। কঠিন সংগ্রামের প্রয়োজন হলে কঠিন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা। আমাদের নারী সমাজের বেশী ভাগের সেই মানসিকতা নেই বলে মনে হয়। আমাদের নারী সমাজকে হতে হবে আরও কঠিন ও নিষ্ঠুর। হতে পারবো কি?

কয়েকদিন বাদে আমার প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। প্রসিতদার চিঠি খানি পেয়েছিলাম। কিছুটা ব্যস্ত আছি। তার চিঠির প্রতিউত্তর দিতে সময়ের প্রয়োজন আছে। ভালো হোক সব কিছু। সংগ্রামী শুভেচ্ছা।

লিপি
১৩-১১-৯৬ইং

বিঃ দ্রঃ টেলিফোন নম্বর খাগড়াছড়িটা পাঠাবে কি? কেননা গত বারেরটা খুঁজেও পাইনি। লিখতে ভুলে গেছি। কল্পনাদি গ্রামের লোকেরা এখন ধর্ম দিয়ে দেওয়ার কথা তুলতেছে বলে শুনলাম, তার জন্য কি করা যায়। আমার যোগাযোগের ঠিকানা-

বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটি, পোষ্ট কোড-৪৫৯০।

অপ্রকাশিত লেখা ১৯৯৮

সকল অধ্যায়

১. কল্পনা চাকমার ডায়েরি
২. কল্পনা চাকমার লেখা
৩. কল্পনা চাকমার চিঠিপত্র
৪. কল্পনা চাকমার ছবি
৫. কল্পনা চাকমা অপহরণের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ
৬. কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদে স্মারকলিপি ও প্রচারপত্রসমূহ
৭. কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার অনুসন্ধান
৮. কল্পনা চাকমা, তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো? – এ.এন. রাশেদা
৯. FOCUS : A Month After Abduction, Kalpana Chakma Yet to be Rescued – Morshed Ali Khan
১০. অপহৃত কল্পনা চাকমা – শাহীন আখতার
১১. আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে – সামিও শীশ
১২. কল্পনা চাকমার ডায়েরি থেকে – এফ.এম.এ. সালাম
১৩. টক অফ দি টাউন কল্পনা চাকমা – আবেদ খান
১৪. কল্পনা চাকমাকে খুঁজে বের করতেই হবে!! – ফরিদা আখতার
১৫. বাঘাইছড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি : কল্পনা ত্রিপুরায় একথা বিশ্বাস করে না চাকমারা – মনির হোসেন
১৬. শোকার্ত পাহাড়ী জনপদ : কল্পনা চাকমার সন্ধান মেলেনি এক বছরেও – বিপ্লব রহমান
১৭. অপহৃত কল্পনা ও আজকের অবস্থা – মুক্তি নারায়ন
১৮. অনুভব – প্রণয় খীসা ঝিমিত
১৯. বীরকন্যা কল্পনা : সংগ্রামের সতত সাহসী প্রেরণা – প্রসিত বিকাশ খীসা
২০. কল্পনা অশান্ত পাবর্ত্য চট্টগ্রামের প্রতীক – মি. প্রদীপন খীসা
২১. কল্পনা চাকমা ও পাথর-মা’র গল্প – সঞ্জীব দ্রং
২২. কেন ফিরে আসছে না কল্পনা চাকমা? – আবেদ খান
২৩. কল্পনাকে মনে পড়ে ওর চিন্তাকে মনে পড়ে – জোবাইদা নাসরীন কনা
২৪. কল্পনা চাকমার স্মৃতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – কবিতা চাকমা
২৫. WHERE IS KALPANA CHAKMA? A four-year-old Question with No Answers – Meghna Guhathakurta
২৬. কল্পনা – প্রিসিলা রাজ
২৭. কল্পনা চাকমা অপহরণ : পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার ও নারী অধিকার লংঘন – এডভোকেট খালেদা খাতুন
২৮. আমার স্মৃতিতে কল্পনা চাকমা – প্রদীপন খীসা
২৯. এই নিশ্চুপতাটি আমাদের জাত্যাভিমানের একটা স্মারক হয়ে উঠল – মানস চৌধুরী
৩০. কল্পনা চাকমা অপহরণ প্রসঙ্গে অধিপতি জাতির আমরা – সায়দিয়া গুলরুখ
৩১. ঐ পাহাড়ে জুলুম চলে – রবীন আহসান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন