টাকের ওপর সটান খাড়া শরীর

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

টাকের ওপর সটান খাড়া শরীর

কাটিহারে আমরা ছিলাম তিন-চার বছর। কিন্তু ওই সময়েই আমি যত বিচিত্র ও বিশেষ মানুষকে দেখেছি, তেমনটা আর কোথাও দেখিনি। পূর্ণিয়ার দাতাবাবা, আমেরিকান সন্ন্যাসী, তন্ত্রসাধক, যুদ্ধফেরত বাঙালি সোলজার এবং এই রকম বহু। আমার বাবা একাধারে অতীব সুপুরুষ, টেনিস এবং ক্রিকেট খেলোয়াড়, এক জন ভাল গায়ক এবং দক্ষ অফিসার। সেই সুবাদে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই গানের আসর বসত। তাতে নরেন্দ্রনাথ চন্দ্র নামে এক জন আসতেন, ওস্তাদি গানে যিনি ছিলেন খুবই দড়। তিনিই এক বার বিখ্যাত গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদারকে আমাদের বাড়িতে এনে হাজির করেছিলেন। তখন অবশ্য তিনি ততটা বিখ্যাত হননি। দিন দুই আমাদের বাড়িতে গানের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। বেশির ভাগই রাগপ্রধান, ঠুংরি আর গজল। আর সেই আসরে এসে এক জন মানুষ মাঝে মাঝে শ্যামাসংগীত গাইতেন। তিনি ছিলেন ডিটিএস সাহেব সুধীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই শিবু বন্দ্যোপাধ্যায়।

শিবুকাকুকে সবাই জানত মাথাপাগলা লোক। খুব ফরসা, সামান্য মেদযুক্ত চেহারা, মাথাজোড়া টাক। শিবুকাকুর বয়স যে খুব বেশি ছিল তা নয়। বড়জোর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। তাঁর সম্পর্কে কাটিহারে অনেক রটনা ছিল। তিনি কালীসাধক, মারণ উচাটন বশীকরণ জানেন, সাধনায় বসে তিনি মাটি থেকে তিন-চার হাত শূন্যে ভেসে থাকতে পারেন— এই রকম নানাবিধ কথা। এমনিতে মানুষটা ভারী হাসিখুশি, ধুতি আর শার্ট ছিল তাঁর মার্কামারা পোশাক। প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন। আমার মায়ের হাতের লুচি-তরকারি বা পরোটা খেতেন যত্ন করে। আমাদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতেও নেমে পড়তেন।

ডিটিএস তখন একটি বিশেষ রাশভারী পদ। তখনকার ব্রিটিশ আমলে ওই পদে সাহেবসুবোই বেশি থাকত। বাঙালি বা ভারতীয় কম। সুতরাং সুধীরবাবুর বেশ খাতির ছিল। কিন্তু শিবুকাকাকে নিয়ে তাঁর একটু সমস্যা ছিল। অমন এক জন মান্যগণ্য মানুষের ভাই কিনা যত্রতত্র টো-টো করে ঘুরে বেড়ান। খালাসি, খানসামা, বাদামওলা, ধোপা, নাপিত, মুচি, এমনকী ভিখিরিদের সঙ্গেও তাঁর অগাধ মেলামেশা। শিবুকাকা চাকরি করতেন না, সুতরাং রোজগার নেই। কালীসাধনা করা ছাড়া অন্য কোনও উচ্চাশাও তাঁর ছিল না। বিয়ে করার কথায় আঁতকে উঠতেন।

শিবুকাকা সম্পর্কে দু’ধরনের রটনা ছিল। গরিবগুরবো, সাধারণ মানুষেরা বলত শিবুকাকু এক জন মস্ত সাধু। তিনি মড়া বাঁচাতে পারেন। আর বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষেরা মনে করত, শিবুকাকু এক জন ভণ্ড। তবে তাঁকে অগ্রাহ্য বড় কেউ একটা করত না।

শিবুকাকু গানটান বিশেষ শেখেননি। কিন্তু যখন তিনি শ্যামাসংগীত গাইতেন, তখন কিন্তু অনেকের চোখে জল আসত।

আমরা ছোটরা অবশ্য শিবুকাকুকে খুবই পছন্দ করতাম। আমাদের সঙ্গে তিনি আমাদের বয়সি হয়েই যেন মিশতেন। আবদার করলে মেটাতেন, লজেন্স দিতেন। আমাদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে পোড়া ভুট্টা, বাদামভাজা বা বুড়ির মাথার পাকা চুল খেতেন। আর শোনাতেন ভূতপ্রেত বা রাক্ষস-খোক্কসের গল্প। আমরা সম্মোহিত হয়ে যেতাম।

মহিলাদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার মতো বয়স তখন আমাদের নয়। আমাদের কাছে তখন ওই বয়সি মেয়েরা ছিঁচকাঁদুনে, নালশেকুটি, ঝগড়ুটে ছাড়া কিছু নয়। তাই যখন শুনলাম, কালীসাধক হওয়ার আগে শিবুকাকু একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন, এবং প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কালীসাধনার পথ ধরেন, তখন ভারী রাগ হয়েছিল। এহ্ মা, একটা মেয়ের জন্য? দূর! একটা মেয়ের জন্য কেউ ফিদা হয়ে যায় নাকি?

তখন অবশ্য প্রেম বলতে মাখামাখি তো নয়ই, এমনকী বাক্যালাপও হত না। বড়জোর চোখাচোখি। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় যে মহিলার জন্য চিরকুমার ছিলেন, তার সঙ্গেও তাঁর মাত্র কয়েক দিনের চোখাচোখির সম্পর্ক ছিল মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। মনে মনে প্রেম যে উচ্চারিত প্রেমের চেয়ে বহু গুণ শক্তিশালী তা এখন একটু একটু বুঝতে পারি।

একটা জিনিস লক্ষ করতাম। শিবুকাকু যখন বড়দের আসরে বসতেন, তখন তাঁকে লক্ষ করে নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা করা হত, টিটকিরি দেওয়া হত। কিন্তু কখনও শিবুকাকুকে উত্তেজিত হতে বা রেগে যেতে দেখিনি। মুখে সর্বদাই সেই সহজ এবং সরল একটা হাসি। সেটা প্রতিবাদ না অনুমোদন, তা-ও বোঝা যেত না।

এক দিন ছুটির সকালে আমাদের বাংলো বাড়িতে কয়েক জন এসেছেন। শিবুকাকুও উপস্থিত। এবং যথারীতি হাসি-মশকরাও হচ্ছে। কে যেন বললেন, ও হে শিবু, তুমি তো দারুণ শীর্ষাসন করতে পারো। দেখাও তো বাপু!

শিবুকাকু হাসিমুখেই বললেন, দেখবেন?

তার পরই অবিশ্বাস্য সেই কাণ্ড! বারান্দার মেঝের ওপর শিবুকাকু উবু হয়ে বসে হাতের ভর দিয়ে শীর্ষাসন করলেন, কিন্তু হাতের সাপোর্ট ছাড়া। দুটি হাত বুকে জড়ো করা, শুধু টাকের ওপর শরীরটা সটান খাড়া হয়ে আছে। পা ওপরে, মাথা নীচে, চোখ বোজা। তা-ও এক মিনিট, দু-মিনিট নয়, ওই রকম নিরালম্ব হয়ে তিনি স্থির হয়ে রইলেন। সময়ের হিসেব ছিল না। চেঁচামেচি হল। তাঁকে নামানো হল। দেখা গেল বাহ্যজ্ঞান নেই।

আজ অবধি ওই আশ্চর্য শীর্ষাসন আমি কখনও দেখিনি। এর পর থেকে শিবুকাকুকে সবাই সমঝে চলত।

সকল অধ্যায়

১. লাহিড়িকাকু
২. বেণুদা
৩. প্রিয় পপি
৪. তারা ছিল বর-বউ
৫. শিবেশ্বর মহাপাত্র
৬. অজু
৭. ধ্রুবদা
৮. গোবিন্দর গল্প
৯. জগুদা
১০. খোকাকাকু টি টি
১১. মনোহরপুকুরের সেই বাড়ি
১২. সতীশবাবু
১৩. প্রাণটুক লইয়া আছি রে বাবা
১৪. এক অসহনীয় সৎ মানুষ
১৫. সাংঘাতিক সাইকেলবাজ
১৬. বাহান্ন দিন টানা শিয়রে
১৭. খালি হাতে বাঘ মেরেছিলেন
১৮. এ তো আচিমিৎকার জিনিস!
১৯. আনন্দই ছিল তাঁর ঈশ্বর
২০. ‘বুঝলা, হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেতাজি’
২১. গোলাপ হাতে পড়াতে এলেন
২২. তাঁর বিষাদ লোককে টানত
২৩. পশ্চাদ্দেশে দিল এক কামড়
২৪. সবাই 007 নয়, কেউ 000
২৫. টুপটুপাটুম মানে কী
২৬. আমার বমা, তোদের কী!
২৭. আমি কি মনিষ্যির মতো মনিষ্যি
২৮. টাকের ওপর সটান খাড়া শরীর
২৯. পায়ে আশি টাকার জুতো!
৩০. অঙ্ক ক্লাসের চার্লি চ্যাপলিন
৩১. পাগল মা-ই যেন তার মেয়ে
৩২. ‘কবীন্দ্র রবীন্দ্র… বুঝলেন কিনা’
৩৩. শনিবারে কালো কুকুরকে লুচি
৩৪. সৎ, গরিব, ব্রাহ্মণ: হাঁড়িতে মা ভবানী
৩৫. মিষ্টি বলতে মুড়ি + চিনি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন