গোলাপ হাতে পড়াতে এলেন

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

গোলাপ হাতে পড়াতে এলেন

ধর্মদাস মাস্টারমশাই ছিলেন রেলের টালিক্লার্ক। ছোটখাটো, কিন্তু ভারী সুন্দর চেহারা, সামান্য একটু মেয়েলি ভাব ছিল তাঁর মুখশ্রীতে। বড় বড় চোখ। প্রথম দিন এলেন হাতে একটা গোলাপ নিয়ে। মুখে মিষ্টি হাসি। যেন স্বপ্নে মাখানো মুখচোখ। আমাকে আর দিদিকে প্রাইভেট পড়াতেন। দোমোহানিতে রেলের অনেক অফিস-টফিস ছিল, সঙ্গে রেলশহর। মাস্টারমশাইয়ের তখন নিতান্তই ছোকরা বয়স। বিয়ে করেননি। বোধহয় কোনও মেসবাড়িতে থাকতেন। আর দু’বেলাই ভাত খেতে আসতেন আমাদের বাড়িতে।

আমি আর দিদি দুজনেই তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। ধর্মদাস মাস্টারমশাই খুব খেটে আমাদের পড়াতেন। তাঁর পড়ানোর ভঙ্গিও ছিল চমৎকার। রাগারাগি নেই, গায়ে হাত তুলতেন না, বার বার বুঝিয়ে দিতেন।

সেই চল্লিশের দশকে দোমোহানিতে মানুষের প্রমোদের উপকরণ বড় একটা ছিল না। রেলওয়ে ইনস্টিটিউটের একটা গুদামের মতো হলঘরে সিনেমা দেখানো হত। সেখানেই হত মাঝে মাঝে পালে-পার্বণে নাটকাভিনয়। রেলের বাবুরাই রাজা-উজির সাজতেন। কত নাটকই যে হত, সব নাম আজ আর মনে নেই। তবে খুব জনপ্রিয় ছিল সিরাজউদ্দৌল্লা, কেদার রাজা, দুই পুরুষ, কঙ্কাবতীর ঘাট, টিপু সুলতান।

নাটকে মহিলা চরিত্রে এবং বিশেষ করে নায়িকার ভূমিকায় ধর্মদাস মাস্টারমশাই ছিলেন বাঁধা। আর মেয়ে সাজলে তাঁকে পুরুষ বলে চেনে কার সাধ্য! মহিলার ভূমিকায় এত ভাল অভিনয়ও করতেন যে, যারা তাঁকে চিনত না, তারা ভাবত সত্যিই বুঝি কোনও সুন্দরী মহিলাকেই মঞ্চে নামানো হয়েছে। আর তেমনই রপ্ত ছিল তাঁর মেয়েলি রংঢং।

মাস্টারমশাইয়ের এই মেয়ে সাজার ব্যাপারটাকে আমি বিশেষ ভাল চোখে দেখতাম না। মাঝে মাঝে বলেই ফেলতাম, মাস্টারমশাই, আপনি কেন মেয়ে সাজেন? লজ্জা করে না?

দূর! অভিনয় তো আর সত্যি নয়।

মনে আছে এক বার বোধহয় কঙ্কাবতীর ঘাট-এ মাস্টারমশাইয়ের অভিনয় দেখে আমার মা তাঁকে সোনার মেডেল দিয়েছিলেন।

এর পর আমরা যথারীতি বদলি হয়ে যাই। নানা জায়গায় ঘুরে শেষে আলিপুরদুয়ার জংশনে বাবা পোস্টিং পাওয়ার পর ফের ধর্মদাস মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি তখন বুকিং ক্লার্ক। কিছু দিন আগে বিয়ে করেছেন। বউকে নিয়ে মাঝে মাঝে আমাদের বাংলোয় এসে মা-বাবাকে প্রণাম করে যেতেন। আমার বাবা তাঁর ওপরওয়ালা, এবং খানিকটা ভাগ্য-নিয়ন্তাও।

তখন আমরা উঁচু ক্লাসে পড়ি এব‌ং আমাদের পড়াতে আসেন প্রভাস চক্রবর্তী নামে এক জন বেশ শিক্ষিত মানুষ। ধর্মদাস মাস্টারমশাই আমাদের আর পড়াতে পারতেন না।

হঠাৎ শুনলাম, ধর্মদাস মাস্টারমশাইয়ের প্লুরিসি হয়েছে। ছুটি নিয়ে তিনি দেশে চলে গেলেন সস্ত্রীক। শোনা গেল তিনি গুরুতর অসুস্থ। মাস চারেক তাঁর কোনও পাত্তাই ছিল না। এক দিন সকালে এক জন মোটাসোটা ভদ্রলোক যখন হাঁফাতে হাঁফাতে আমাদের বাড়িতে এলেন, তখন তাঁকে ধর্মদাস মাস্টারমশাই বলে চেনে কার সাধ্য! সেই ছিপছিপে চেহারা, কমনীয় মুখশ্রী উধাও। মোটা হয়ে কেমন ঢ্যাপসা হয়ে গেছে চেহারা!

এর পর মাস্টারমশাইয়ের দুটো ছেলে হল। তিনি আরও সংসারী হলেন, সঞ্চয়ী হলেন, ভিতুও হয়ে গেলেন। বাবা তাঁর বস বলে খাতির করতেন, সে অন্য কথা। কিন্তু আমি বা দিদি তো তাঁর ছাত্র এবং ছাত্রী। তবু তিনি আমাদের অনাবশ্যক খাতির করা শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে গেলে বউদিও আমাদের বড্ড বেশি খাতির, যত্ন, সমীহ করতে থাকেন। কিন্তু মানুষটি ছিলেন ভারী ভাল। তাই মাঝে মাঝে যেতাম তাঁদের কোয়ার্টার্সে।

হঠাৎ মাস্টারমশাইকে টাংলা নামে একটা জায়গায় বদলি করা হল। তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে মায়ের কাছে বিস্তর কান্নাকাটি করলেন, মাসিমা, টাংলাতে গেলে আমি ছেলেপিলে নিয়ে বেঘোরে মারা পড়ব। মা বাবাকে সন্তর্পণে বলেওছিলেন, কিন্তু বদলি রদ হয়নি।

মাস্টারমশাই চোখের জল মুছতে মুছতে টাংলায় গেলেন। যত দূর মনে হয়, টাংলাতে গিয়ে তাঁর রোজগার বেড়ে যায় এবং সেখানে তিনি দিব্যি ছিলেন। বছর দুই বাদে ফের ঘন ঘন তিনি পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতে থাকেন আমার মায়ের কাছে। লিখতেন, মাসিমা, শুনিতেছি আমাকে টাংলা হইতে অন্যত্র বদলি করা হইবে। তাহা হইলে ছেলেপিলে নিয়ে আমি বেঘোরে মারা পড়িব। মেসোমশাইকে বলিয়া দয়া করিয়া আমার বদলি আটকাইবেন।

এ রকম ভাবে যত বার বদলি হতেন, তত বার চিঠি লিখতেন। এবং তাঁর প্রিয় গৎ ছিল ‘ছেলেপিলে নিয়ে বেঘোরে মারা পড়ব।’ কিন্তু কোনও বারই নতুন জায়গায় গিয়ে তিনি মারা পড়েননি। বরং বহাল তবিয়তেই ছিলেন।

স্থূলকায়, হাঁসফাঁস করা, ভিতু, উদ্বিগ্ন মাস্টারমশাইকে দেখে বিশ্বাসই হত না যে, এক দিন এক জন ছিপছিপে তরুণ সুদর্শন লাজুক যুবক হাতে একটি গোলাপ নিয়ে আমাদের ভাইবোনকে পড়াতে আসতেন এবং ইনিই তিনি।

সকল অধ্যায়

১. লাহিড়িকাকু
২. বেণুদা
৩. প্রিয় পপি
৪. তারা ছিল বর-বউ
৫. শিবেশ্বর মহাপাত্র
৬. অজু
৭. ধ্রুবদা
৮. গোবিন্দর গল্প
৯. জগুদা
১০. খোকাকাকু টি টি
১১. মনোহরপুকুরের সেই বাড়ি
১২. সতীশবাবু
১৩. প্রাণটুক লইয়া আছি রে বাবা
১৪. এক অসহনীয় সৎ মানুষ
১৫. সাংঘাতিক সাইকেলবাজ
১৬. বাহান্ন দিন টানা শিয়রে
১৭. খালি হাতে বাঘ মেরেছিলেন
১৮. এ তো আচিমিৎকার জিনিস!
১৯. আনন্দই ছিল তাঁর ঈশ্বর
২০. ‘বুঝলা, হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেতাজি’
২১. গোলাপ হাতে পড়াতে এলেন
২২. তাঁর বিষাদ লোককে টানত
২৩. পশ্চাদ্দেশে দিল এক কামড়
২৪. সবাই 007 নয়, কেউ 000
২৫. টুপটুপাটুম মানে কী
২৬. আমার বমা, তোদের কী!
২৭. আমি কি মনিষ্যির মতো মনিষ্যি
২৮. টাকের ওপর সটান খাড়া শরীর
২৯. পায়ে আশি টাকার জুতো!
৩০. অঙ্ক ক্লাসের চার্লি চ্যাপলিন
৩১. পাগল মা-ই যেন তার মেয়ে
৩২. ‘কবীন্দ্র রবীন্দ্র… বুঝলেন কিনা’
৩৩. শনিবারে কালো কুকুরকে লুচি
৩৪. সৎ, গরিব, ব্রাহ্মণ: হাঁড়িতে মা ভবানী
৩৫. মিষ্টি বলতে মুড়ি + চিনি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন