২২. আফ্রিকার মতো দেশ

হুমায়ূন আহমেদ

কভার নেবার জন্য আফ্রিকার মতো দেশ হয় না। ঘন বনের দেশ। পুরো এক ডিভিশন সৈন্য ছোট্ট বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পারে। বিমান থেকে তাদের খোঁজা অসম্ভব। জায়গায়-জায়গায় খানাখন্দ গিরিখাত। আদর্শ কভার।

ফকনারের দল এয়ারপোর্টের উত্তরের বনে ঢুকে পড়ল। দলের কাউকেই তেমন চিন্তিত মনে হল না। অনেকেই পছন্দসই জায়গা বেছে ঘুমুবার আয়োজন করছে। দুজনের একটা দল তাস নিয়ে বসেছে। আলো ভালো মতো ফোটে নি। তাস দেখা যাচ্ছে না। তাতে খেলায় অসুবিধা হচ্ছে না। তাই স্টেকের খেলা। দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে টাকার হিসাব রাখা হচ্ছে। সকলের ইন্দ্ৰিয় তাসে কেন্দ্ৰীভূত।

এরকম পরিস্থিতিতে যে-জাতীয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাধারণত থাকে, তার কিছুই নেই। সবই কেমন যেন আলগা ধরনের। সবার মধ্যে কেমন টিলালা ভাব। যেন আফ্রিকার বনে তারা সাপ্তাহিক বনভোজনে এসেছে। কারোর চেহারায় উদ্বেগের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। শুধু বেন ওয়াটসনকে খানিকটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

সে বিশাল এক পিপুল গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসেছে। নিশো আছে তার পাশে। নিশোর হতভম্ব ভাব এখনো কাটে নি। এখন পর্যন্ত তিনি একটি কথাও বলেন নি। কফি দেওয়া হয়েছিল। খান নি, ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর শরীর খুবই খারাপ লাগছে। কিছুক্ষণ আগে বমি করেছেন। যেভাবে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন, তাতে মনে হচ্ছে মৃত্যু আসন্ন। এখনি হয়তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে, কয়েক বার হেঁচকি তুলে সবরকম সমস্যার সমাধান করে দেবেন। এ নিয়েও বেন ওয়াটসনের মাথাব্যথা নেই। সে একটা লম্বা ঘাস দাঁত দিয়ে কাটছে এবং কিছুক্ষণ পরপর কাটা ঘাসের টুকরো থু করে দূরে-দূরে ফেলছে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তার মূল প্রচেষ্টা ঘাসের টুকরোটা কত দূরে ফেলা যায়।

নিশো একটা কাতর শব্দ করলেন।

বেন বিরক্ত মুখে বলল, কোঁ-কে করবে না। কোঁ-কে শব্দটা আমার খুবই অপছন্দ।

নিশো বললেন, আনন্দের কোনো শব্দ করতে পারলে খুশি হতাম। তা পারছি না।

যখন পারছ না, তখন চুপ করে থাক।

নিশো হেসে ফেললেন।

বেন কড়া গলায় বলল, হাসছ কেন?

মানুষের হাসি শুনে কেউ বিরক্ত হয় না, তুমি হচ্ছ কেন?

বেন উঠে চলে গেল। নিশো কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন। অসম্ভব সাহসী একদল মানুষের সঙ্গে তিনি আছেন। সাহস একটি দুর্লভ জিনিস। সেই দুর্লভ জিনিস এদের আছে। কিন্তু সাহসের সঙ্গে আদর্শের চমৎকার মিলটি এদের হয় নি। যে-কারণে তাদের এই সাহস অর্থহীন। থাকাও যা, না থাকাও।

তিনি জানেন, এরা ভাড়াটে সৈন্য। টাকা যার এরা তার। টাকার বিনিময়ে তাকে উদ্ধার করেছে। টাকার বিনিময়ে বিনা দ্বিধায় ডোফার হাতে তুলে দেবে। অবশ্যি তার জন্যে তিনি যে খুব দুঃখিত তা নয়। যার যা চরিত্র, সে তাই করবে। জীবনের শেষ সময়টা তিনি বিনা ঝামেলায় কাটাতে চেয়েছিলেন, তা সম্ভব হচ্ছে না। কষ্ট এই কারণেই। তিনি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন, ডোফার সঙ্গে যদি দেখা হয়, তা হলে তিনি কী বলবেন। বলার মতো তেমন কোনো কথা কি সে-সময় খুঁজে পাওয়া যাবে? তার একটি প্রিয় লাইন হচ্ছে—ম্মাঝে-মাঝে জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের ক্ষমতা অনেক বেশি হয়। এই লাইনটি বলা যায়। তবে না-বলাই ভালো। এই কথাগুলিতে একধরনের অহঙ্কার প্রকাশ পায়। জীবনের শেষভাগে এসে তিনি অহঙ্কারী সাজতে চান না। কারণ তিনি অহঙ্কারী নন। এটাও বোধহয় ঠিক হল না। তিনি অহঙ্কারী। মানুষ হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ, এই অহঙ্কার তাঁর আছে।

কয়েকটা মাছি তাঁকে বিরক্ত করছে। এটাও বেশ মজার ব্যাপার। মাছিগুলি অন্য কাউকে বিরক্ত করছে না। বারবার উড়ে এসে তাঁর মুখে বসছে। কীটপতঙ্গরা মানুষের মৃত্যুর খবর আগে টের পায়। এরাও হয়তো পেয়ে গেছে। নয়ত বেছে-বেছে তাঁর মুখের ওপরই ভভ করবে কেন?

নিশো দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। পানির পিপাসা হচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই, যাকে পানির কথা বলা যায়। চেচিয়ে কাউকে ডাকার মত জোর তাঁর ফুসফুসে নেই। তিনি মড়ার মতো পড়ে রইলেন। তাঁর মুখের ওপর মাছি ভভ করছে। কী কুৎসিত দৃশ্য। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কুৎসিত দৃশ্যের পাশাপাশি একটি চমৎকার দৃশ্যও তাঁর চোখে পড়ল পিপুল গাছের মোটা শিকড়ে একটি পাহাড়ী পাখি। ঝকঝকে সোনালি পাখা। চন্দনের দানার মতো লাল টকটকে ঠোঁট। কী নাম এই পাখির, কে জানে। পাখিটা তাঁকে কৌতূহলী চোখে দেখছে। আহ্, বেঁচে থাকার মধ্যে কত রকম আনন্দ। কত অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত।

সম্রাট নিশো।

তিনি পাখির ওপর থেকে দৃষ্টি না-ফিরিয়েই বললেন, আমি শুনছি।

আপনি কেমন বোধ করছেন?

এই মুহূর্তে, চমৎকার বোধ করছি।

শুনলাম কিছুই খান নি।

ইচ্ছা করছে না।

দয়া করে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।

নিশো তাকালেন।

আমার নাম ফকনার।

তুমি এই দলের প্রধান?

হ্যাঁ। আমি জানতে এসেছি আপনার কিছু লাগবে কি না।

কাগজ এবং কলম দিতে পার? পাখিটা দেখার পর চমৎকার একটা ভাব এসেছে। চেষ্টা করব ভাবটা ধরে রাখতে পারি কি না।

কবিতা লিখবেন?

আবেগ ধরে রাখবার জন্যে কবিতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।

আপনার কি মনে হচ্ছে না, কাব্যচর্চার জন্যে সময়টা উপযোগী নয়?

না, তা মনে হচ্ছে না।

কাগজ-কলমের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলে দুঃখিত। আমি অন্য একটি ব্যাপার জানতে এসেছি।

কি ব্যাপার?

এ-দেশের লোকজন কি আপনাকে ভালবাসে?

মনে হয় বাসে।

কি করে বললেন?

আমি ওদের ভালবাসি। ভালবাসা এমন একটি ব্যাপার যে, যাকে ভালবাসা হয় তাকে তা ফেরত দিতে হয়। এখানে বাকি রাখা চলে না। তুমি যখনি কাউকে ভালবাসবে তখনি তা ফেরত দিতে হবে। এবং মজার ব্যাপার কি, জান? অনেক বেশি পরিমাণে ফেরত আসে। তা-ই নিয়ম।

কার নিয়ম?

প্রকৃতির নিয়ম।

নিশো দেখলেন, ফকনার চলে যাচ্ছে। তিনি তাকালেন পাখিটির দিকে। আশ্চর্য, পাখিটা এখনো আছে, উড়ে যায় নি। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, এই আয়, কাছে আয়। পাখিটা তখন উড়ে গেল। এই ব্যাপারটাও তাঁর বেশ মজা লাগল। যতক্ষণ পাখিটাকে কাছে আসতে বলেন নি, ততক্ষণ সে কাছেই ছিল। যেই কাছে ডেকেছেন অমনি উড়ে গেছে।

সম্রাট নিশো।

কে?

আমার নাম জনাথন—মিঃ ফকনার আপনার জন্যে কাগজ এবং কলম পাঠিয়েছেন।

ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।

সকল অধ্যায়

১. ০১. জুলিয়াস নিশো
২. ০২. কিছু কিছু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ আছে
৩. ০৩. অল্পবয়সী মেয়েরা সহজেই হতাশ হয়
৪. ০৪. ফকনার ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছিল
৫. ০৫. জুলিয়াস নিশোর ঘুম ভাঙল
৬. ০৬. জেনারেল সিমসন
৭. ০৭. এন্ড্রু জনাথন
৮. ০৮. বেন ওয়াটসনকে ডেকে তোলা হল
৯. ০৯. টিলার ওপর চমৎকার বাংলো
১০. ১০. গামাল হাসিম লোকটি স্বল্পভাষী
১১. ১১. পঞ্চাশ জনকে রিক্রুট করার দায়িত্ব
১২. ১২. সত্তর জন সদস্যের চুক্তিপত্রে সই
১৩. ১৩. ট্রেনিং ক্যাম্প
১৪. ১৪. জুলিয়াস নিশোর শরীর খুব খারাপ
১৫. ১৫. ট্রেনিংয়ের ধরন পাল্টেছে
১৬. ১৬. মোরান্ডা
১৭. ১৭. মেসঘরে ঢুকে সবাই অবাক হল
১৮. ১৮. ইঞ্জিনের হুম-হুম গর্জন
১৯. ১৯. চারদিকে অন্ধকার
২০. ২০. মাওয়া জেগে উঠল
২১. ২১. এয়ারপোর্টে সবাই অপেক্ষা করছে
২২. ২২. আফ্রিকার মতো দেশ
২৩. ২৩. ফকনার দাঁড়িয়ে আছে
২৪. ২৪. জেনারেল ডোফা বিস্মিত
২৫. ২৫. রবিনসন এগিয়ে গেল ফকনারের দিকে
২৬. ২৬. এক ঘন্টা একুশ মিনিটের মাথায়
২৭. ২৭. উসসি নদীতে ডোফা
২৮. ২৮. কবরের শোকগাঁথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন