ফুটপাথের এই হানাদাররা কারা?

গৌরকিশোর ঘোষ (রূপদর্শী)

কলকাতা শহরের ফুটপাথ দখলদাররা যে কারা এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ দেখা দিয়েছে। এদের উৎপত্তি, বংশপরিচয় এবং ফুটপাথ দখলের কৌশল প্রভৃতি বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্প্রতি কিছুকাল যাবৎ ব্যাপক গবেষণা শুরু হলেও ইতিহাসবেত্তারা আজও যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছেন।

জাতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদের প্রাণপুরুষ ড: পদ্মবিভূষণ এক একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাকে জানান, প্রাচীন পুঁথিপত্রে কিম্বা সাহেবদের রচনায় এই ফুটপাথ হানাদারদের কোনও রেফারেন্স না থাকায় আমাদের গবেষকরা এক পাও অগ্রসর হতে পারছেন না। আমাদের মুশকিলটা হয়েছে এইখানে।

ড: পদ্মবিভূষণ সারাজীবন ইতিহাস চর্চায় ব্যাপৃত থেকে প্রচুর শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকারী হয়েছেন। জনৈক প্রকাশকের ভাগিনেয়র সহযোগিতায় রচিত তাঁর ‘ইতিহাস কুসুম’, ‘অমর ভারত’, ‘জাগে নব ভারতের জনতা’ ইত্যাদি বইগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বিদ্যালয়ের অবশ্য পাঠ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে।

ড: পদ্মবিভূষণ বললেন, ‘বেদ বা পুরাণের কোথাও ‘হকার’ শব্দটার উল্লেখ নেই। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে আর্য ঋষিরা অথবা পুরাণকারেরা হকারের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। বাল্মীকির রামায়ণে আমরা অযোধ্যা এবং লঙ্কার যে বিবরণ পাই তা থেকে এই কথাই ধরে নিতে পারি যে ওই দুটি নগরী তৎকালের সব থেকে আধুনিক নগরী ছিল। মহাভারতেও আমরা হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ প্রভৃতি আধুনিক নগরীর উল্লেখ পাই। কিন্তু ওই সব নগরী সম্পর্কে যে সকল বিবরণ পাই তার মধ্যেও আমরা হকার বা হকার জাতীয় কোনও হানাদারের উল্লেখ পাইনি। বৌদ্ধযুগের ধর্মগ্রন্থ বা জাতকগুলো সম্পর্কে সাহেবদের যত লেখা বেরিয়েছে আমরা তন্ন তন্ন করে তা উল্টে দেখেছি। কোথাও হকারের উল্লেখ পাইনি।’

‘আচ্ছা মহেন জো দোড়ো কি হরপ্পায় যে-সকল নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তার থেকেও কি এই হানাদার হকারদের কোনও পরিচয় বের করা সম্ভব হয়নি?’

ড: পদ্মবিভূষণ বললেন, ‘পাওয়া গেলে কি আমরা এই রকম অসহায় হয়ে বসে পড়তাম। মহেন জো দোড়ো হরাপ্পার কথা কী বলছেন আমরা এই হানাদার হকারদের অরিজিন বের করার জন্য প্রত্নপ্রস্তর নব্যপ্রস্তর যুগের গুহাচিত্রগুলোও অনুসন্ধানের বাইরে রাখিনি। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। তাই আমরা এখন ‘প্রাক বৈদিক যুগে হকাররা কি সত্যিই ছিল?’

‘গবেষণার এই স্তরে এসে পৌঁচেছি। এবং প্রশ্নটা উঠিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকিনি।’

‘উত্তরটাও বের করে ফেলেছেন বুঝি।’ ড: পদ্মবিভূষণ বললেন, ‘না না। উত্তরটা পস্টারিটির জন্য তুলে রেখে আমরা ইতিহাসের যুগে নেমে এসেছি। তবে আপনাকে এইটুকু বলতে পারি, প্লিজ ডোন্ট কোট মি, ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা হয়েছে, এই হানাদার হকাররা ককেশিয়া বা ওরই সন্নিহিত অঞ্চল থেকে আগত যাযাবর আর্য অথবা আর্যদের সমপর্যায়ের কোনও সংকর জাতিরই এক শাখা। তবে এই বিষয়ে আমি ডেফিনিট যে ওরা ঘোড়ার ব্যবহার জানত না।’

‘কী করে জানলেন যে ওরা ককেশিয়া বা তৎসন্নিহিত অঞ্চলের থেকে আগত?’

মৃদু মৃদু হেসে ড: পদ্মবিভূষণ বললেন, ‘ইতিহাস কচলে চুল পাকিয়ে ফেললাম আর এটা বুঝতে পারব না? অন্য কোনওখানে সূত্র না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পর্যটকদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলাম। মেগাস্থিনিস, উয়াং চুয়াং ওরফে হিউয়েন সাং, ফা হিয়েন, অলবেরুনী, ইবন বতুতা, মারকোপোলো, নিকিতিন, রামনাথ বিশ্বাস কাউকেই বাদ দিইনি, জানেন? তবুও যা চাইছিলাম তা তাদের মধ্যে পেলাম না। ওঁদের বৃত্তান্ত হকার কথারই কোনও উল্লেখ নেই। যখন প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছি তখন হঠাৎ নজরে পড়ল অজ্ঞাত এক প্রতিবেদকের বিবরণ। উক্ত প্রতিবেদক বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদের কোনও এক সময়ে হকার কবলিত কলকাতা নগরী ভ্রমণ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘আছে অল্প কিছু বাঙালী, অল্প কিছু জীবনসংগ্রামে পথে বসা ঘরের ছেলে। কিন্তু কজন তারা? কোণঠাসা হতে হতে উত্তরে আর দক্ষিণে সামান্য জায়গায় ঠেকেছে এসে। বসেছিল কিছু বাঙালী চৌরঙ্গি এলাকারও। কিন্তু বাঙালীর রাজধানী এই কলকাতার মাঝখানে বাঙালী? মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে বাঙালী, ছেলেদের ওই বহিরাগত দখলদাররা।’

‘উঃ কী ভিভিড বিবরণ! চোখে জল এসে যায় বীর বাঙালীদের পরাজয়ের এই করুণ বিবরণ শুনলে।’

‘কিন্তু আমার চোখে ভাসে ওই দুর্ধর্ষ বহিরাগত দখলদারদের চেহারা।’ ড: পদ্মবিভূষণ বললেন, ‘ইন্দো এরিয়ান হানাদারদের প্রকৃতির সঙ্গে এই হানাদার হকারদের অদ্ভুত মিল। তাই না?’

‘এখন তাই মনে হচ্ছে বটে। তবে ওদের যে ঘোড়া ছিল না, বুঝলেন কি করে?’

‘প্রতিবেদক এতসব কথা সরলভাবে বলেছেন, ঘোড়া দেখলে তার বর্ণনাও নিশ্চয়ই দিতেন। আর এরা যে ইন্দো এরিয়ান উক্ত প্রতিবেদকের আরও একটা মন্তব্য পড়লে তা বোঝা যায়। তিনি জনৈক বিশেষজ্ঞের কথা তুলে বলেছেন, কলকাতাকে ওরা সারা ভারতের পাবলিক ইউরিনালে পরিণত করেছে। সাহেব ঐতিহাসিকদের মতে এটা হচ্ছে টিপিক্যাল ইনডো এরিয়ান হ্যাবিট।’

অতঃপর ড: পদ্মবিভূষণ জানান, তবে এই হানাদার হকারেরা যে সকলেই ককেশিয়া অঞ্চল থেকে এসেছে এ তত্ত্ব সকলে মানেন না। অনেকের মতেই কলকাতার ফুটপাথের উপর আক্রমণ একবারে হয়নি। খেপে খেপে হয়েছে। ককেশিয়া বা তৎসন্নিহিত অঞ্চলের লোকেরা হয়তো প্রথমে হানা দিয়েছিল। পরে এই সুবর্ণপ্রসবিনী ফুটপাথের কথা ছড়িয়ে পড়ার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম এবং পূর্ব দিক থেকেও অবিশ্রান্ত ঢেউএর মতো হানাদাররা কলকাতার ফুটপাথের দখল নেবার জন্য একে একে ছুটে আসতে থাকে। এবং বঙ্গভানু প্রথম মানু রায়ের শাসনকালেই হানাদার হকারদের আগ্রাসন চরমে ওঠে। তখন কলকাতার প্রায় সকল প্রধান ফুটপাথই হানাদার হকারদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। চৌরঙ্গি, শ্যামবাজার ও শিয়ালদহের যুদ্ধে বঙ্গভানু হকারদের গেরিলা কৌশলের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে যে অলিখিত শান্তি চুক্তি করেন, বা মেট্রো বাজার চুক্তির নামে বিখ্যাত হয়ে আছে, তদনুসারে হকারেরা কলকাতার ফুটপাথ ভোগদখলের অবাধ অধিকার লাভ করে এবং অধিকৃত অঞ্চলের ফুটপাথে স্থায়ী বসতি নির্মাণ করে। কলকাতার চতুর্দিকে অদ্যাবধি এইসব বিজয়-সৌধ হকারদের শক্তি সামর্থ্যের পরিচয় দিচ্ছে।

৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪

অধ্যায় ৩৩ / ৩৩

সকল অধ্যায়

১. অতিথি-যোজনামন্ত্রী, স্বাগতম
২. খাদ্যমন্ত্রীর নব আবিষ্কার
৩. চুয়াত্তরের সুসমাচার
৪. পোড়া বাড়ির রহস্য
৫. অত্যাশ্চর্য ভাসমান রাজপথ
৬. রেডার যন্ত্রের ঝড়ের সংকেত
৭. রেল-ডাকাতি নিরোধের অব্যর্থ উপায়
৮. আপেক্ষিক মোরচাবাদ : নয়া বিজ্ঞান
৯. মুখ্যমন্ত্রী তলিয়ে দেখবেন
১০. খাদ্যমন্ত্রীর দুঃসাহসিক অভিযান
১১. শিশুবোধক জৌন শিক্ষা, সহজ পাঠ
১২. পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে আসুন
১৩. গণমৃত্যু উদ্যাপনের দুর্লভ সুযোগ
১৪. কলকাতার নৌবহ খাল প্রসঙ্গ
১৫. পঞ্চম যোজনা এখন ছুটিতে আছেন
১৬. বহিরাগত বিতাড়ন আইন
১৭. লণ্ঠন ও হাত-পাখা মন্ত্রীর আশা
১৮. কমরেড দামোদরের মর্মবেদনা
১৯. রেলগাড়ি চালু রাখার মিশ্র পদ্ধতি
২০. ভারত মন্ত্রশক্তিতে শক্তিমান হল
২১. অসার খলু সংসারে
২২. মন্ত্রিগণের নিদারুণ অগ্নিপরীক্ষা
২৩. পি ডি এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন
২৪. কাদাংচু কমিশনের নেপথ্য-চিত্র
২৫. লুমবিনির ওঁরা কী বলেছিলেন?
২৬. প্রোফেসার পাংচু’স্ ওয়ানডার ইনক্
২৭. বি আর মোহান্ত সংরক্ষণের প্রস্তাব
২৮. মিলনের পালা : নিকসন-মাও পদ্ধতি
২৯. কীভাবে আমরা লাভ করতে পারি
৩০. প্রেসিডেনট নিকসনের মারাত্মক ভুল
৩১. নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প
৩২. মুক্ত কারার গুপ্ত জ্ঞান
৩৩. ফুটপাথের এই হানাদাররা কারা?

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন