নবনীতা দেবসেন
জীবনটা হঠাৎ আরও একটা মোড় ঘুরে গেল।
এই পৃথিবীতে এসেছি তো কম দিন হোলো না—ষাট পার হয়ে গেছে, পৌত্রের মুখ দেখেছি, এখন তো চলে গেলেই হয়। আমি প্রস্তুত।
বীরুবাবুর প্রতিক্রিয়াটা খুব অদ্ভুত।
এত বছর ধরে আমি আছি কি নেই সেই নিয়ে ওঁর মাথাব্যথা ছিল না। আমারও দিব্যি অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল এই না—থাকার মতো করে থাকা। ছোট্ট শৌণককে নিয়েই আমার পৃথিবী সম্পূর্ণ ছিল। বীরুবাবুকে তো প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু ছোট্ট শৌণক বড়ো হয়ে গেল। তার নিজস্ব জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেল। তবু ‘মা’ তার কাছে সবার আগে। আমার সেটুকুই যথেষ্ট। বীরুবাবু থাকুন তাঁর দিদিদের কোলের খোকাটি হয়ে। কখনো কখনো এমনও মনে হয় যেন আমি শৌণককে কোলে করেই জন্মেছিলাম। যেন, ও যখন ছিল না, আমিও তখন ছিলাম না।
.
মার রোগটা ধরা পড়েনি। যখন জানা গেল তখন শেষ। সর্বাঙ্গে, অস্থিতে মজ্জায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্যানসার। অথচ সময়মতো খেয়াল করলে অপারেশন করলে দীর্ঘায়ু হতেও পারতেন।
মার অত যন্ত্রণা চোখে দেখেছি আমরা। কোনো রিলিফ দিতে পারিনি, পেথিড্রিনও বেশিদিন চালাতে হয়নি—মা চলে গেলেন। আমরা তখনই দুপুরে ভাত খেতে যাব যাব করছি। দিদি ঘরে ছিল। মা খুব হঠাৎ চলে গেলেন—অসুখ—বিসুখ, তোলপাড়, সবই দু’মাসের মধ্যে শেষ।
.
সেই থেকে সাবধান হয়েছি। নিয়মিত মেডিক্যাল চেক আপ করাই। শুধু এইবারই দু’বছর হয়ে গেছে, চেক আপটা সময়মতো করানো হয়নি। চেক আপ—এই ধরা পড়লো। আমি নিজে নিজে কিন্তু টেরও পাইনি। ওই অনুধানের দু’বছরের মাঝখানেই কর্কট রোগ এসে রাজ্যপাট বিছিয়েছে আমার বাঁদিকের বুকে।
মার কাছ থেকে প্রাণ পেয়েছি—মার কাছ থেকেই পেয়েছি জীবনভোর যন্ত্রণা, অপমান—সেই মায়ের কাছ থেকেই বুঝি এলো চরমতম আঘাতও, মৃত্যুবীজ।
মায়ের যে—বয়েসে অসুখটা হয়েছিল, আমারও ঠিক সেই বয়েসেই ধরলো—কিন্তু মায়ের বেলায় সেটা ছিল শেষ মুহূর্ত, আমার বেলায় তা নয়। আমার বাঁচার পথ আছে। ডাক্তাররা বলছেন অসুখ কেবল একটি স্তনের একটি অংশেই বন্দী আপাতত; সেই অঞ্চলেই বিষবীজটুকু বেঁধে রেখে, অপারেশনে স্তনবিয়োগ করে ফেললে, বাকি শরীরটা নিরোগ হয়ে উঠবে। আমিই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছি। বীরুবাবু তো সেটা ঠিকঠাক পেরে ওঠেন না। ওঁর দিদিদের সঙ্গে আগে পরামর্শ করতে যান। শৌণককেই সামনে রেখে আমি কথা বলি। অনেক সময়েই ডাক্তাররা রুগিকে সোজাসুজি সত্যিকথা বলতে চান না, কিন্তু ছেলেকে সব ঠিকঠাক বলেন। শৌণক জানে তার মায়ের বিষয়ে পরামর্শ করার ব্যক্তি আমিই—বীরুবাবুর যা কিছু ব্যক্তিত্ব কোর্টে। ঘরে তিনি শুধু তিন দিদির কোলের কচি ভাইটি। ছেলের বাবা হওয়া তাঁর ত্রিশ বছরেও অভ্যেস হল না। আর আমাদের মা তো মা ছিলেন না আমাদের! আমি তাই মনেপ্রাণে শৌণকের মা হতে চেয়েছি, মা হতে চেষ্টা করেছি।
.
মা—কে কি লোভী হওয়া সাজে?
ছোড়দিটা লোভী, ছোড়দিটা বোকা। মা তো বোকা নন। ছোড়দি ফাঁদে পড়বে সেটা আর আশ্চর্য কী? বয়স কত ছিল ওর? আর সামনের লোভটা কত প্রবল ছিল?
কিন্তু মায়ের কী হয়েছিল?
হ্যাঁ, বাবা চলে গিয়েছেন নিরুদ্দেশ যাত্রায়। নিরুদ্দেশ? বেশ। তাই।
কিন্তু মা তো সমুদ্রে ভেসে যাননি।
মায়ের চাকরি ছিল। বসতবাড়ি ছিল। মোটামুটি চালিয়ে নেবার মতো সঙ্গতি ছিল মায়ের। তবুও মিত্তিরবাড়ির কত্তামশায়ের ফাঁদে পা দিলেন আমার মা। তখনো অল্পবয়সী মা।
ওই, একটু একসঙ্গে সময় কাটানো, একটু কাকাবাবুকে সান্নিধ্য দেওয়া, সন্ধ্যাবেলা ইশকুল থেকে ফিরে ও—বাড়িতে চলে যেতেন মা। কাকাবাবুর দেখাশুনো, তাঁর সংসারের খবরদারি, তাঁকে একটু মনোযোগ দেওয়া। ওই পর্যন্তই। দরজা বন্ধ হোতো না। জ্যোৎস্নারাতে দুজনে ছাদে বসে থাকতেন। টানা বারান্দায় বসে গঙ্গায় সূর্যাস্তের ছায়া দেখতেন। প্রতিদানে কী পেতেন মা? আমাদের পড়াশুনো, খাওয়া—দাওয়া সব আপনা—আপনি হয়ে যেত।—সকালবেলাই এ—বাড়ির ব্যবস্থা সেরে ইশকুলে বেরুতেন মা। বাকিটা করতো দিদি। দিদিই ছিল আমাদের মা।
কাকাবাবুর কি বউ ছিল না?
ছিল। কিন্তু সে—বউ থেকেও নেই। মিত্তিরকাকিমা দেখতে নাকি এককালে রীতিমতো সুন্দর ছিলেন। অরুর মুখখানা তার মায়ের মতো। কিন্তু আমাদের দেখা মিত্তিরকাকিমা তো ছিলেন শুচিবাইগ্রস্ত উন্মাদিনী—তাঁর হাত—পা ঘায়ে—রসে রক্তাক্ত হয়ে থাকত—সর্বদা ভিজে গামছা পরনে, শীর্ণ হাতে হয় ঝাঁটা, নয় ন্যাতা—লাল টকটকে চোখে এলোমেলো দৃষ্টি, ভিজে চুলে জটপাকানো ঝুঁটি—কাকিমা কক্ষনো রান্নাঘরে ঢুকতেন না, কোনো মেয়েমানুষকেই ঢুকতে দিতেন না রান্নাঘরে। বামুনঠাকুর রান্না করত। ঝি কুটনোকোটা, বাটনাবাটা, সব সারত দালানে। আমার মারও ঐ দালান পর্যন্ত গতি ছিল। কাকিমা সমস্ত দিন—রাত্তির ঠাকুরঘরেই পড়ে থাকতেন, আর ঠাকুরদালান ধোয়া—মোছা করতেন,—অত বড় ঠাকুরদালান দিনে কতবার যে ধুতেন—মুছতেন—জল তুলে দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেত রঘুবীর।
কাকিমার ওই কাঠির মতো শরীরে অমন দানবিক পরিশ্রমের শক্তি আসতো কীভাবে?
কাকাবাবুর দ্বিতীয় পক্ষ তিনি।
বয়েসে অনেক ছোটো, অরুর জন্ম দিয়েই তিনি প্রথমে সূতিকা পাগল হয়ে যান, তারপরে তো এই। প্রথম পক্ষের দুটি মেয়েই শ্বশুরবাড়িতে। তাদের বিয়ের সময়ে আমরা ছোট। ওরা দুজনে ইন্দোরে আর দিল্লিতে থাকে, কালেভদ্রে বাপের বাড়িতে আসে কি আসেই না। কাকাবাবুর চরিত্রদোষের কথা ওদের শ্বশুরবাড়িও জানে নিশ্চয়।
.
ছোড়দিটা বড় বোকা।
হাজার হোক মা ইশকুলের দিদিমণি—অনেকদূর গেলেও খানিকটা আড়াল রেখে চলতেন। কিছুটা বাঁচিয়ে চলতেন নিজেকে। কাকাবাবুর সেটা ঠিক পছন্দ ছিল না। তাঁর খাঁই অনেক বেশি। বোকা, সদ্য বড় হওয়া ছোড়দিটা ধরা দিল তাঁর সর্বগ্রাসী হাঁ—য়ের মধ্যে। মা যেটা এড়িয়ে চলেছেন।
লোকভয় মিত্তিরবাড়ির কর্তামশায়ের ছিল না, টাকার গুণে সকলকেই তিনি মৌনব্রত ধরিয়ে ছাড়তে পারেন। সেই অতি বৃদ্ধ লম্পট এখনও সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে—আর আমার ছোড়দি তাঁর রাজ্যের প্রধান বশংবদ প্রজা। সময়মতো দিদি পালিয়ে বেঁচেছে, ছোড়দিকে বাঁচানোর শক্তি তো মায়ের ছিল না।
কোন জোরে আটকাবেন তাকে?
প্রথম প্রথম আমাদের তিন বোনকে তিনিই তো টেনেছেন ও—বাড়ির দিকে—আমার প্রতি অরুর পাগলামিকে খুব অদ্ভুতভাবে প্রশ্রয় দিতেন আমার মা, এবং আরও বেশি করে, অরুর বাবা। কী ছিল তাঁদের উল্লাস এতে, তা তাঁরাই জানেন—কিন্তু তাঁদের আগ্রহ যত বাড়তো, আমার উৎসাহ ততই কমতো। আমি জোর করে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি ও—বাড়ির সংশ্রব থেকে।
অরুর পাগলামিকে আমার ভয় করেছে। হ্যাঁ, ভালো লাগতো, ভয়ও করতো—ও তো ওই কাকাবাবুরই ছেলে!
ছোড়দি যখন প্রথম কাকাবাবুর পাল্লায় পড়লো, মা তখন বাধা দেননি। হয়তো ভাবতে পারেননি কাকাবাবুর অধঃপাত কত গভীর। যখন বুঝলেন, তখন আর সময় নেই। কাকাবাবুর সংসারে তখন এ—বাড়ি থেকে সাপ্লাই দুই সেবিকা—একজন তাঁর সংসারকে সামাল দেয়, আর একজন স্বয়ং কাকাবাবুকে। মা—র শক্তির চাবিকাঠি হস্তান্তর হয়ে গেছে কখন। এই অবনমন মা—র সহ্য হয়নি—মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ছোড়দি মা—র জায়গাটা অধিকার করতে পেরে অহংকারে টলোমলো। আমার মায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা ছিল না। কষ্ট হোতো, রাগ হোতো শুধু বোকা ছোড়দিটার জন্যে।
.
মনস্থির করতে পারছি না। রাজি হব? মা রাজি হয়েছিলেন শেষটায়—কিন্তু ততদিনে মা—র যেভাবে মেটাস্টেসিস হয়ে গিয়েছিল, অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে পড়েছিল রোগ—তাতে অপারেশন করলেও লাভ হোতো না। ডাক্তারদেরই মতের মিল হচ্ছিল না। কেউ বলছিলেন, খবর্দার না! অপারেশন করলেই হু—হু গতিতে ছড়িয়ে পড়বে রোগ—দেখতে দেখতে বাজিয়ে দেবে আয়ু শেষের ঘণ্টি। কাটলেই বাড়বে। স্তন বাদ দিয়ে রোগ কন্ট্রোল করার সময় আর নেই। আবার কেউ বলছিলেন স্তনটি বাদ দিলেই কিছুকালের মতো অন্তত বাড়বে মায়ের আয়ু। মা বাঁচতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিয়েছিলেন—কিন্তু অপারেশন হয়নি।
মা—র ছিল সৌন্দর্যের অহংকার। মা—র রূপই ছিল মা—র গুণ। আমি ভেবেছিলাম স্তন বিষয়ে এত বয়েসেও মা—র এত মোহ কেন? মায়ের স্তন তো তার পুণ্যকর্ম সুষ্ঠুভাবেই সেরেছে তবে ওর জন্যে কেন অত মায়া মায়ের? আমার মনে এইরকমই প্রশ্ন উঠেছিল। মা যেহেতু মা—মা ছিলেন না একটুও,—মা আমাদের মা হতে পারেননি কোনোদিনই, তাই আমি মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছি শৌণকের মা হতে। আমিও যে এই সুন্দর পৃথিবীতে এসেছিলাম, কিছু তো প্রমাণ রেখে যাব তার? শৌণক আমার সেই প্রমাণ। একদিন এই গ্রহে আমার বেঁচে থাকার প্রমাণ। আমি চলে গেলেও শৌণক থাকবে। আমার মায়ের এরকম কিছু মনে হোতো কি না জানি না। অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলেন, অথচ কিছুতেই কেমো নেবেন না। চুল পড়ে যাবে। জোর—জবরদস্তি কেমোথেরাপি করা হোলো তাঁর। পড়েও গেল চুল। বিছানায়—বালিশে—স্নানঘরে—চিরুনিতে—মা—র কোঁকড়া সুন্দর রেশমী চুল ঝরে ঝরে পড়তে থাকল। এক সময়ে শুরু হোলো অসহনীয় যন্ত্রণা। মা—র রোগজীর্ণ স্তন আর বাদ দেওয়া হোলো না। রেডিয়েশনে আর কেমোতে তাঁকে বেশিদিন আটকানো গেল না। শীর্ণ, জীর্ণ, রুগণ মা, অসুন্দর হয়ে যাওয়া, কর্কট দংশনে নিপীড়িত মা স্তনচ্ছেদনে শেষ পর্যন্ত রাজি যখন হলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন ডাক্তাররা রাজি হলেন না। এত শরীরবিলাসিনী মা—ও তো রাজি হয়েছিলেন শেষপর্যন্ত। আজ জীবনের এই বাঁকে থমকে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি হয়তো মাকে বুঝতে পারছি কিছুটা।
.
আজ মনে হচ্ছে—ছোড়দিকে বলা দরকার—দিদিকেও—যে মা—র আপত্তিটা হয়তো রূপ নষ্ট হবার উদ্বেগের জন্য ছিল না। এতদিনে আমার মনে হচ্ছে প্রসঙ্গটা অন্য—প্রসঙ্গটা নারীত্বের। প্রসঙ্গটা আমিত্বের। মা—র কাছে মা—র নারীত্বটাই ছিল মা—র আমি। ‘রূপ—যৌবন’ বলে তাঁকে হয়তো ছোটো করে দেখছিলাম আমরা তখন। ভালোবাসি না বলে, মা—কে বেনিফিট অফ ডাউট না দিয়ে সমালোচনার চোখেই দেখেছি—সেই মৃত্যুমুখী মাকেও। এখন ভেবে খারাপ লাগছে।
.
কোনওদিনই মায়ের মনের মধ্যে ঢুকতে পারিনি আমরা।
ঢুকতে চেষ্টা করিনি।
শেষদিন পর্যন্ত, চুল উঠে যাওয়া সিঁথিতে মা সিঁদুর পরতে চেষ্টা করেছেন।
যে স্বামীর খোঁজ পাননি অনন্তকাল,—তার জন্যেই কি? নাকি মা—র কাছে তাঁর ‘আমি’টি ছিল সিঁদুর—পরা, সালঙ্কারা, সুকেশিনী, সুস্তনী একটি সধবা নারী। তাঁর পরনের শাড়ির পাড়ে, কপালের টিপের রঙে, ব্লাউজের পূর্ণতায় যে অক্ষত নারীত্ব, সেইখানে কিছু একটুও এদিক—ওদিক হলেই হয়তো মা—র অস্তিত্বের সমস্যা হোতো। তখন মা হয়তো নিজেই আর নিজের নাগাল পেতেন না। সম্পূর্ণ বাইরে থেকেই নিজের দিকে তাকালে যা হয়। বহিরঙ্গের ‘আমি—ই’ ছিল তাঁর চেনা একমাত্র ‘আমি’। মা—র কথা আগে কখনও এত ভাবিনি। এমনকি মা—র অসুস্থতার সময়েও বোধহয় না। কেবল ভাবছি আমাতে আর মা—তে কত তফাত। আকাশ—পাতালের ক্লিশেটা এখানে দিব্যি খাটে। ডাক্তারকে বলে দিয়েছি অপারেশনে আমার অনুমতি আছে। বিলম্ব চাই না! আমি ভেবে দেখেছি! আমার নারীত্ব কি আমার স্তনাগ্রে বিধৃত?
আজ্ঞে না।
আমি যতদিন বাঁচব, আমার নারীত্ব আমার ভিতরে উথলে উঠবে। শৌণকের প্রতি স্নেহে। মাতৃস্নেহে। মা তো ‘মা’ হয়ে উঠতে পারেননি। মায়ের মতো ‘প্রেমিকা’ হয়ে জীবনের মানে খুঁজতে যাইনি আমি। ওটা ফাঁদ।
মা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। ‘প্রেমিকা’ হলেও কি শুধু নারীত্ব অনুভব করা যায়? মা তো ছোড়দিকে সাম্রাজ্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঢের বেশি সুন্দরী ছিলেন মা—ছোড়দি তো সাধারণ। তবুও। সে কি শুধুই যৌবনের কারণে? নাকি নারীত্বের অন্য আরও কিছু ছোড়দির কাছে পেয়েছিলেন ভদ্রলোক যা মা দিতে পারেননি? এসব কথা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে—ও নিয়ে বরং আর ভাববো না। থাক ও জীবন। ভাবতে ভাবতে ষাট বছর পার হয়ে গেল।
.
মা স্তন বাদ দিতে বাধা দিলেন যখন, তার দশ বছর আগেই মায়ের ঋতুবিরতি ঘটে গিয়েছিল। আমার তো মনে হয়, ঋতুবিরতি একটা ভয়ংকর সময়। সে ঘোষণা করে—নারীত্বের শেষ সীমানা পার হয়ে এলে তুমি, এইবারে তোমার মা হওয়ার বেলা ফুরুলো। এবার তোমার দিদিমা, ঠাকুমা হবার কাল। অবশ্য সেই বা মন্দ কী? ঐ সময়ে আমার তো মনে হয়েছিল এই তো শৌণকের কোলে এসে গিয়েছেন নাতিবাবু—আমার খেলাধুলোর সঙ্গী—দায়—দায়িত্বের ভার অন্যের। মোটেই মন্দ নয়। ঋতুর কাল তো কোনো কাজেই লাগছিল না আমাদের? না বীরুবাবুর, না আমার। সর্বক্ষণ মনের মধ্যে একটা মন্থনের ঘর্ঘর শব্দ। মায়ের জীবন। মায়ের বাঁচা। মায়ের মরা।
.
মৃত্যুভয় আমার নেই। আমি প্রস্তুত। কিন্তু এটা একদমই ভাবতে পারিনি। পড়েছিলাম যে ক্যানসার একটা প্রজন্ম বাদ দিয়ে দিয়ে রক্তে ছড়ায়। মায়ের ক্যানসার যখন ধরা পড়ে, আমি যথাসাধ্য খোঁজ করেছি, পড়াশুনো করেছি, রোগটার বিষয়ে জেনেছি। এখন জানার সুবিধে অনেক। মায়ের কথা ভেবেই তো আমি শৌণককে সিগারেট ছাড়িয়ে ছিলাম। ওর জন্যেই ভাবনা ছিল, তৃতীয় প্রজন্ম তো সেই। অথচ সব হিসেব গুবলেট করে দিয়ে আমারই হোলো মায়ের ব্যাধি। মারণ ব্যাধি। করাল মারণ ব্যাধি। না, যা অবধারিত, তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। মৃত্যুকে আমার ভয় করে না। ওটা তো অবধারিত। ভয় যন্ত্রণাকে। মায়ের সেই যন্ত্রণা তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি।
এই অসুখের জন্য আমি সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। কেন যেন ধারণা হয়েছিল, এ যাত্রায় আমরা বেঁচে গেছি—মায়ের ওপরেই নেমেছে কৃপাণ। কিন্তু তা তো হোলো না। মা কি অলক্ষ্যে মুখ টিপে হাসছেন?
.
ডাক্তাররা অবশ্য বলছেন অপারেশনের পরে আমার দীর্ঘায়ু হতে বাধা নেই। আয়ু নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনো। ‘মোহন মরণ’ আমাকে কোনোদিনই টানেনি বটে কিন্তু অনেক বছর ধরেই জীবনও তো কৈ টানে না? তাই খুব সহজেই বলতে পারছি আমি প্রস্তুত। বেঁচে থাকার মোহ অঞ্জন চোখ থেকে কখন যে মুছে গিয়েছে টেরও পানি। দীর্ঘায়ুর লোভ নেই আমার।
সব গোলমাল করে দিয়েছে অরু এসে উপস্থিত হয়ে। ছোট্ট থেকে অরু হয়ে গিয়েছিল আমার self appointed guardian, যদিও সে আমার চেয়ে ছোট—কিন্তু পুরুষবিহীন পরিবারে সে নিজেকে জাহির করবার চেষ্টা করত জরুরি পুরুষ অস্তিত্ব হিসেব। আমি তাতে বাদ সাধতাম, কেন না আমার ব্যক্তিত্ব একবিন্দু পুরুষ—নির্ভর ছিল না। ছোড়দির মতো ললিত লবঙ্গলতা ছিলাম না আমি। ছোড়দিটার মনে মনে বরং গার্জেন—টার্জেনের একটা প্রয়োজন ছিল। যেজন্যে মিত্তির কাকাবাবু ওকে হাত করে ফেললেন অত সহজে। সেই ছিল শনির রন্ধ্র। এবারে অরুকে খবর দিয়েছে ছোড়দিই।
.
খুব মনে পড়ছে সেইসব দিনগুলোর কথা—যখন আমরা বড় হচ্ছিলাম। দিদি তখনই বড়, দিদি তখন শাড়ি। আমি আর ছোড়দি নিচু ক্লাসে—কি জানি কেন আমি কোনোদিনই ছোড়দিকে আমার চেয়ে বড়ো বলে মানতে চাইনি। দুজনে একক্লাসে পড়েছি, একসঙ্গে কলেজে ঢুকেছি। সেই ছোড়দি এখন বৃদ্ধ মিত্তির কাকাবাবুর সর্বজনসম্মত রক্ষিতা। মায়ের এবং কাকিমার মৃত্যুর পরেও কেন ওরা বিয়েটা করলো না, আজও জানি না।
.
যেদিন জানা গেল বাঁদিকের ব্রেস্টটা বাদ দিয়ে দিতেই হবে—কোনো চয়েস নেই—সেদিন থেকে বীরুবাবুর চেহারা বদলে গেল হঠাৎ। অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। এমনকি চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়াও বন্ধ করে দিলেন। তাঁর যেন এ বিষয়ে আর হাত—পা নড়া দূরে থাক, জিবটুকুও নড়ছিল না। চিকিৎসার বন্দোবস্ত এতদিন যা কিছু সব আমি নিজেই করেছি—শৌণকের সঙ্গে। যা কিছু পরামর্শ, দিদি—সুব্রতদার সঙ্গে, ফোনে। খবর শুনেই চলে এসেছিল ওরা শান্তিনিকেতন থেকে। রিটায়ার করে চেন্নাই থেকে চলে এসে শান্তিনিকেতনে বাড়ি করে রয়েছে দিদি। ছেলেটা শিকাগোয়। মেয়ে আছে কাছাকাছিই, দুর্গাপুরে। সুব্রতদা অনেক সাহায্য করেছেন ডাক্তার—বদ্যি ধরাকরার ব্যাপারে। বীরুবাবুকে কখনো ধরতাইয়ের মধ্যেই আনিনি আমরা। ব্যস্ত মানুষ। প্রতি মিনিটে টাকা। তাঁকে ডিস্টার্ব করে কেউ? কোর্ট—কাছারি, চেম্বার আর দিদিদের বাড়ি। এই নিয়েই তাঁকে আস্তে আস্তে বার্ধক্য গ্রাস করে ফেলেছে। তিনি টেরও পাননি।
প্রথমটা প্রবল ধাক্কায় ভেঙে পড়লেও দিদিদের সহায়তায় অচিরেই ঠিক হয়ে গেলেন বীরুবাবু। পুত্রকে নির্দেশ দিলেন—টাকার মায়া কোরো না, মায়ের চিকিৎসা ঠিকমতো হোক। শ্রেষ্ঠ ডাক্তারদের দেখাও। সেই সময়েই অরু দেশে এলো।
একটা সময় ছিল, যখন ‘টার্মিনাল ডিজিজ’ কথাটা শুনলেই গা কেঁপে উঠতো। মায়ের বেলাতেও কেঁপেছিলাম। কিন্তু একদিন এই শব্দটা হঠাৎ ঘরের ছেলের সহজ পোশাক পরে জীবনে চলে এলো। সত্যি সত্যিই গা কেঁপে ওঠেনি আমার। প্রান্তিক অসুখ। বেশ তো? প্রান্তের দিকে তো চলেছি। আর কতকাল থাকবো? কষ্ট না পেয়ে চটপট চলে যাওয়া তো ভালোই। মন্দ কি? নাতিবাবু? সে তো দু’দিন পরে বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে—তার ভরসায় কি বাঁচা যায়? যাবার সময় হয়েছে বলে ধরেই নিয়ে এগোচ্ছি—চিকিৎসা যা যা সম্ভব, নিশ্চয় করাবো, মার মতন দেরি তো হয়ে যায়নি আমার। দিদি—সুব্রতদা ব্যাপারটা বোঝে ভালো। ওরা ভরসা দিল—অপারেশনের পর সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ম্যাসটেকটমি এখন জলভাত—এ তো সুমিত্রাদির মতো ব্রেন টিউমার নয়। অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্ম কারুকার্য নেই এতে। আর বুক? দিদি বলল, আজকাল তো আর্টিফিশিয়াল লিম্বসের মতো আর্টিফিশিয়াল ব্রেস্টও তৈরি হয়। বুকের সেলাই শুকোলেই তোকে পরিয়ে দেবে—ব্রা’র ভিতরে ভরে নিয়ে পরবি। কোনো কষ্টই নেই। কোনোই অসুবিধে হবে না। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না বাইরে থেকে—as usual দেখাবে। দিদিটা কেন যে এত করে সান্ত্বনা দিচ্ছিল আমাকে! আমার তো মন তৈরি হয়েই গিয়েছে। বেচারী ভাবছে স্তন বাদ পড়লে হয়তো আমার ডিপ্রেশন হবে। অল্প বয়েস হলে নিশ্চয় হোতো। কিন্তু স্তনের কাজ তো স্তন করেছে। দু’বছরের বেশি দিন ধরে দুধ খেয়েছে শৌণক—কিছুতেই দুধের নেশা ছাড়ানো যাচ্ছিল না ওর! অনেকদিনই অকেজো হয়ে স্তন দুটি ঘুমিয়ে আছে পাশাপাশি, আমার বুকের ওপরে। একটি রইল, কি গেল, তাতে কী বা এসে যায়? দিদি বুঝতেই পারছে না এ নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই, মায়ের মতন। আমার স্তনই যে আমি নই, তা আমি বিলক্ষণ জানি। আর তাছাড়া এক আমি ছাড়া আর কারুর তো ঘটনাটাতে ব্যক্তিগত ইন্টারেস্ট নেই? সতীলক্ষ্মী হবার ফল!
.
মৃত্যুর একেবারে সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছিলাম যেদিন—জানি না অপারেশনের পরের বায়োপসি কী বলবে—হাড়ে—মজ্জায় সংক্রমণ ছড়িয়ে গেছে কি না। তাহলে তো চিকিৎসা নিষ্প্রয়োজন। মা—র মতোই দিন গুনতে শুরু করতে হবে। ভিতরে ভিতরে অন্তর্জলি যাত্রা তো শুরু হয়েই গিয়েছে।
শৌণক শক্ত ছিল সেদিন।
ছোড়দি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। দিদি আসেনি। সুব্রতদা দূরে দূরে ডাক্তারদের পিছু পিছু ঘুরছিলেন। বীরুবাবু আসেননি নার্সিংহোমে। সেদিন প্রচণ্ড জরুরি কেস ছিল তাঁর, বিড়লাদের কেস। আমিও বললাম, এসে কী হবে? শৌণকই তো আছে। সুব্রতদাও থাকবেন। তুমি কোর্টের পরে খবর নিও। আসলে তো আমি জানি বীরুবাবুর ভয় করছে—তাঁর শৌর্যবীর্য সবই আদালতে! প্রকৃতপক্ষে বেজায় ভীরু প্রকৃতির মানুষ। ব্যক্তিগত সংকটের মুহূর্তে ওঁর মনের জোর থাকে না। আমার শাশুড়ির মৃত্যুর সময়ে দেখেছিলাম এইরকম অজুহাত দিয়ে সরে থাকা।
শৌণক ভাগ্যিস ওর বাপের মতো হয়নি?
কিন্তু হাসপাতালে কারুকেই দরকার ছিল না। ডাক্তারদের সঙ্গে সর্বক্ষণই অরু ছিল। অরু একাই এক সহস্র।
অনেক অনেক বছর পার হয়ে, অসুখের কাঁটাতারের বেড়ার এধারে দাঁড়িয়ে, অরুর সঙ্গে আবার দেখা হোলো। কিন্তু এ অন্য অরু। অন্য চোখ, অন্য স্বর। অরু বদলে গেছে। খুব কেজো কথা, অল্প কথা। চাউনি বদলে গেছে। চোখ শান্ত। সুদূর। এরকমই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু ভালো লাগছে না কেন?
.
‘প্রান্তিক অসুখ’ শব্দটার অনেক উপকারিতা আছে।—আমার গোটা জীবনে, এত বছরের আয়ুষ্কালে, এতটা মনোযোগ পাইনি আমি কোনোদিন। ভাগ্যিস কালব্যাধিতে ধরেছিল! নইলে তো জানাই হোতো না, আমাকে ওরা চায়। ব্রেস্ট বাদ দেওয়ার ব্যাপারটা যত সোজা ভেবেছিলাম, তত সোজা নয় মনে হচ্ছে। মন—মেজাজ তেরিয়া হয়ে আছে। বুক—আছে—না—বুক—নেই এটা এতকাল আমার কাছে কোনও ব্যাপার ছিল না। কোনও প্রশ্ন ওঠেনি ওগুলির অস্তিত্ব—অনস্তিত্ব বিষয়ে। কিন্তু আজ সেই প্রসঙ্গ উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে আরও অনেকগুলো প্রশ্ন।
.
স্তনোদগমের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই বোতামের মতো ছোট্ট দুটি কঠিন বিন্দু। ক্রমশ বৃত্ত হয়ে উঠছে—ব্যথা—কী ব্যথা—জামা পরতে গেলেও লেগে যায়—ছোড়দি, তোরও কি লাগে? লাগে। আমাদের তাহলে এটা ফোড়া না? দিদি বলল, না না, ফোড়া কেন হবে, বোকা মেয়ে! ওইভাবেই তো বুক ওঠে। ব্যথা হয়। ভয় নেই, পরে চলে যাবে আপনিই।
বুক ওঠে। যেমন বীজ থেকে চারাগাছ ওঠে। বুক ফুটে ওঠে। যেমন কুঁড়ি থেকে ফুল। স্তনবৃন্তে স্তনপুষ্প প্রস্ফুটিত হয়। সেই নিয়ে কত কবিতা, কত ভাস্কর্য, আর সহস্র অশ্লীলতা। বালিকাকে যুবতী করে সে, নারীকে মা। বুকই বলে দেয় তুমি এখন কোন কামরায়। কৈশোরে? যৌবনে? প্রৌঢ়ত্বে? না জরায়? প্রত্যেক ঋতুর অবস্থানের আলাদা রূপ আছে তার। নিসর্গ নিয়মে। খালিগায়ে বেনিয়ান পরে ঘোরা বন্ধ হয়ে গেল। এবার ফ্রক পরবে বেনিয়ানের ওপরে। তার পরে চাই টাইট শেমিজ। ফ্রকের নীচে। তারও পরে এল ব্রা। ব্লাউজের নীচে পরবার বড়দের জন্য ছোট জামা। ব্রা পরা মানেই পুরোপুরি বড় হয়ে যাওয়া। ব্রা পরা মানেই এবার তুমি প্রস্তুত। ব্রা পরা মানে খুকী, এবার তুমি যুবতী। পুরুষের জন্য প্রস্তুতি নাও। কিন্তু তুমি কতকাল ধরে যুবতী থাকবে ভাবছো?
এখন হয়তো ভাবলে হাসি পাবে। কিন্তু তখন ব্যাপারটা হাসির ছিল না। আমাদের তখন কত হবে? ত্রিশ—বত্রিশ? মিতিল হঠাৎ একদিন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, রূপু, তোর ব্রেস্ট কি স্যাগ করতে শুরু করেছে? তখন বেশ কিছুদিন মা হয়ে গেছি, শৌণক বহুদিন দুধ ছেড়েও দিয়েছে। তাই বলে স্যাগ করা? হেসে ফেলে আমি বলি, দূর! ওসব কে জানতে যাচ্ছে? আর জানবই বা কেমন করে? তুইও যেমন!
মিতিলটা পাগলি। সে লেখক হবে ঠিক করে ফেলেছিল ক্লাস টেনেই।
”পাগলামি নয়। উপায় আছে।”
কোন একটা ইংরেজি ম্যাগাজিনে পড়েছে মিতিল। বুকের নীচে একটা পেনসিল ধরতে হয়। যদি ছেড়ে দিলেই পেনসিলটা পড়ে যায়, তবে জানবে সব ঠিকঠাক। যদি একটু আটকে থেকে তারপরে পড়ে, তাহলে বুঝবে স্যাগিং শুরু হয়েছে। আর যদি থেকেই যায়, বুকের তলায় আটকে,—তবে জানবে কেস ক্লোজড! কিছু করার নেই। প্রকৃতিমায়ের নিজস্ব বন্দোবস্ত। দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন ফুরোলে স্তনেরও কাজ শেষ।
আমরা দুজনেই একা—একা বাথরুমে ঢুকে পেনসিল ধরার পরীক্ষাটা করলাম—দুরু দুরু বক্ষে। আঃ, কি রিলিফ!
যাক! এখনও যায়নি তবে যৌবন! টুক করে পেনসিল পড়ে গেছে!
.
পুরো ব্রেস্ট বাদ না দিলেই চলছিল না। এতটা বয়েসে হয়তো কেউ সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু নারী—শরীর তো। একটি স্তন বাদ দিয়ে দিলে মনে মনেও একটা ভাঙচুর হয়ই। হয়তো দেখা যাবে না বাইরে থেকে। নতুন কৃত্রিম প্রত্যঙ্গের কল্যাণে আগের মতোই সম্পূর্ণ দেখাবে আমাকে। কিন্তু আমি তো জানি, আমি এখন অসম্পূর্ণ। আমার অঙ্গহানি হয়েছে। আমি বিকলাঙ্গদের দলে ভর্তি হয়েছি। যেমন—তেমন কিছু নয়, একেবারে স্তনচ্ছেদন। শব্দটা ভাবতেই শিউরে ওঠে শরীর। তাই তো ঘটেছে আমার। ম্যাসটেকটমির বাংলা তো তাই—ই। স্তনচ্ছেদন। খুব মন খারাপ হতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম কিছু মনে হয়নি। স্তন নিয়ে ভাবিইনি মোটে। কিন্তু অরুকে দেখলেই কেন জানি না ব্যাপারটা খেয়াল হতে লাগলো।
অরু এখন অন্য।
অরুর চোখে এখন ঔদাস্য।
তবু আমার লজ্জা করছে। মন খারাপ করছে। নদীর ধারের উড়িয়ে নেওয়া বাতাসের মতো সেই আবেগ—পাগল ছেলেটাকে খুঁজছি আমি ওর মধ্যে। আমি নিশ্চিত জানি, এই স্মার্ট, সুদর্শন, পশ্চিমাস্য পুরুষটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমার চেনা অরু। নিবিড় আত্মবিশ্বাস আর উষ্ণ ব্যবহার দিয়ে হাসপাতালে সকলের সম্ভ্রম আদায় করেছে অরু—আমার ভিতরেও একটা অস্থির উথাল—পাথাল চলছে। এই কি অরু? আমার সেই অরু? আমার জন্যে পাগল ছিল যে, সেই ছেলেটা?
অরুর আচার—ব্যবহারে পূর্বে কিছুই প্রকাশ পায় না। কেবল সৌজন্য, আর রুগির প্রতি চিকিৎসকের উদ্বেগ, যত্ন—এর বাইরে কিছুই যেন খুঁজে পাই না ওর মধ্যে। অথচ আমার সমস্ত প্রাণে, সমস্ত অস্তিত্বে মোচড় দিয়ে অন্তঃস্তল থেকে উদগত হয়ে আসছে আশ্চর্য যে অনুভব—তার নামই প্রেম।
বীরুবাবুর প্রতি আমার প্রাণে যে বস্তুটি আছে তার কোনো নাম নেই। মমতা? কৃতজ্ঞতা? কিছু নয়, কিছু নয়। তবে? ভদ্রতা। হ্যাঁ—বস্তুটার নাম সৌজন্য। সংসারে একত্র বসবাস করতে হলে যে সামাজিক সৌজন্যটুকু থাকা প্রয়োজন—শুধু সেটুকুই।
আমার স্তন আছে, কি স্তন নেই, তাতে বীরুবাবুর কিছুই এল—গেল না।
আমার স্তন আছে, কি স্তন নেই, তাতে অরুরও কি কিছু আসে—যায় না?
ভাবতে ভাবতেই একদিন সকালে খুব ডাক্তারি স্বাভাবিকতার সঙ্গে অরু এসে বললো, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবেন এই ভদ্রমহিলা—ইনি আর্টিফিশিয়াল ব্রেস্ট তৈরি করে দেবেন তোমার জন্য। লজ্জার কিছু নেই—ইউ নীড ইট। নইলে শরীরের ব্যালান্স থাকে না। তুমি তো এক্ষুনি বলবে, দরকার নেই, এই বেশ—আমি তাই বলে রাখছি, এটা not for beauty alone—but to maintain the balance of your physique.
মেয়েটা তো মাপজোক নিয়ে চলে গেল। আমার খুবই মন খারাপ লাগতে লাগলো তারপর।
অরু আবার এলো। হঠাৎ। একটা চেয়ার টেনে বসলো কাছে।
কী? মেজাজ খারাপ? চোখের দৃষ্টি কমে গেলে চশমা পরতে হয়। হয় তো? একটা চোখে পাওয়ার লাগলেও, দু’চোখেই চশমা পরে লোকে। প্রশ্নটা ব্যালান্সের। এটাও তাই। তাছাড়া ইউ’ল ফিল বেটার। মোর ন্যাচারাল।
আমি কি পরবো না বলেছি?
তবে এত মন—মেজাজ খারাপ কেন?
অঙ্গহানি হলে কি মেজাজ ভালো থাকার কথা?
গোটা প্রাণহানির চেয়ে তো কিঞ্চিৎ অঙ্গহানি ভালো?
তা বলে একেবারে একটা অঙ্গ কেটে বাদ দিয়ে—
পায়ের অ্যাম্পুটেশন এর চেয়ে ঢের বেশি খারাপ। একটা স্তন থাকলো, কি গেল, তাতে জীবনের এই ধাপে পৌঁছে তোমার আর কী এসে যায় রূপুদি? টু টেল ইউ দ্য ট্রুথ, ম্যাসটেকটমি না করালেই বুঝি স্তন সুরক্ষিত থাকে? স্তন কখনো চিরস্থায়ী হয়? দেখো রূপুদি, প্রকৃতিদেবীর কতগুলো বস্তাপচা ধারণা আছে—তিনি ভাবেন সন্তান পালনের বয়েস পেরিয়ে এলেই স্তন দিয়ে আর কাজ নেই কারুর। তিনি তখন ওটা ফেরত নিয়ে নেন।
নাউ কাম অন রূপুদি, ডোন্ট গেট ডিপ্রেসড—লিসন টু দিস—ম্যাসটেকটমি অর নট, ইউ আর স্টিল দ্য মোস্ট বিউটিফুল উওম্যান আনডার দ্য সান।
খুব গম্ভীর মুখে, খুব গম্ভীর গলায় অরু কথাগুলো বললো।
আর আমার মনে হোলো, অনেক বছর পার হয়ে গঙ্গায় আবার বান ডেকেছে—ষাঁড়াষাঁড়ির বান—আমাদের উঠোন ভাসিয়ে, দালান ভাসিয়ে, শোবার ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে জল।
আচ্ছা স্তনের উদয়, আর স্তনের অস্তগমন—এইতেই কি নারী—শরীরে যৌবনের আসা—যাওয়া মাপা হয়? একটা পেনসিলই কি হতে পারে যৌবনের মাপকাঠি? একদিন তো সত্যিই মনে হয়েছিল, যদি বুকের তলায় পেনসিল থেকে যেত, তাহলে আর বেঁচে কী হবে? কিন্তু যখন ঢল নামলো তখন আর পেনসিলের কথাটা মনেও পড়েনি।
কিন্তু স্তনের ওঠা—পড়ায় যদি যৌবনের ওঠা—পড়া বাঁধা থাকে, তাহলে শরীর কেন জেগে থাকে স্তন—নম্রতার অনেক, অনেক পরেও? কেন থাকে জেগে? এমনকি স্তনচ্ছেদের পরেও!
বীরুবাবুর স্ত্রীর অবশ্য এসব প্রসঙ্গ ভাবতেই নেই। বীরুবাবু এবং তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত সজ্জন। তাঁদের সেক্সের মতো হীনকর্মে মতিগতি নেই। বীরুবাবুর দিদিরা জানতে পারলে কী মনে করবেন? ছি! এই বয়েসেও?
কী সুন্দর সকাল। সকালের একটা ম্যাজিক আছে। নার্সিংহোমে যেদিন সকালবেলায় নার্স পর্দা টেনে সরিয়ে দিল, আমি কাচের জানলার বাইরে দেখলাম অনেকগুলো সবুজ গাছের মাথা। আমার খবর নেবার জন্যে জানলার কাছে ভিড় করেছে—পিছনের নীল আকাশে সূর্য তখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন—ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন একটা সকাল। আমার অপারেশনের পরদিন। হঠাৎ ভীষণ ভালো লেগে গেল। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা মনে পড়লো, অরুর পছন্দসই সেই লাইনটা, ”কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়। কেমন করে বলি!” সেটা ছিল চিল্কার সকাল, এটা নার্সিংহোমে। কিন্তু এটা আরও জরুরি। আমি আবার একটা সুন্দর সকাল পেলাম। তার মানে, এবারকার মতো আরও অনেক সকাল নিয়ে জীবন আমার কাছে ফিরে এল।
.
সকালবেলাতেই অরু এসেছিল। গম্ভীর গলাতে বলেছিল, তিনমাস এখন চিকিৎসা চলবে—বাড়ি গিয়েও হুড়দস্যিপনা চলবে না।
যেন এই বয়েসেও সেই ছোটবেলার মতো গাছে চড়বো, গঙ্গায় ঝাঁপাবো। আমি ওর দিকে চেয়েই বুঝতে পারছি, অরু আমার এই ষাট বছরের শরীরটাকে দেখতে পাচ্ছে না—ওর চোখ দেখছে সেই ছোট্ট, দুষ্টু মেয়েটাকে, যে ওর খেলার সাথী, ওর বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গী। অরু যখন কাছে আসে, তখন ওর সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়েটাও চলে আসে আমার কাছে, সেই জেদী, দুষ্টু, একগুঁয়ে মেয়েটা। মা যাকে মারত। মেরে মেরেও সামলাতে পারত না। মেয়েটা মুখে কিছু বলত না। কাজে করত। ওর কাজই বলত—তুমি যা খুশি করতে পারো, আমি বুঝি পারি না?
ছোড়দিও যখন যা খুশি তাই করা শুরু করলো, মা বাধা দিল না তো। মা মারলো না তো। অবশ্য মারের বয়েস ছিল না তখন ছোড়দির। কিন্তু ততদিনে মা—র সঙ্গে কথাবার্তা বলাও প্রায় বন্ধ করে ফেলেছি আমি। মা নিজে থেকে কথা না কইলে, নিজে ডেকে কথা বলি না। আর মা কিছু বললে, এককথায়, দু’কথায় জবাব দিই। মা—র সঙ্গে বাক্যালাপ যতদূর কমিয়ে আনা যায় তাই করে ফেলেছি ইশকুলে পড়ার সময়েই। বাড়িতে আমার কথা বলার, প্রাণ খোলার জায়গা ছিল অরু। সব কথা অরুর সঙ্গে। কিন্তু প্রেমের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না।
মা—র প্রেম দেখেছি। একরকম। তারপর ছোড়দির প্রেম। আরেক রকম।
হ্যাঁ, দিদির প্রেমও দেখেছি। সুব্রতদার সঙ্গে। কিন্তু সে তো বিয়ের পরের প্রেম। বিয়ের আগের প্রেমটা দিদি এতটাই গোপনে সেরেছিল, আমরা কেউ কিছুই জানতে পারিনি।
বিয়ে নেই, প্রেম আছে, এ বস্তু আমি সইতে পারি না। আর অরু যখনই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, আমি ‘না’ বলেছি, কেননা, আমাকে ও দিদি বলে, ছোট্ট থেকে ওকে আমরা ভাইফোঁটা দিয়েছি, ওসব কথা ভাবলেও মহাপাপ। আর, তাছাড়া আমি তো ওর প্রেমেও পড়িনি যে সমাজসংস্কার সব ভেঙে ফেলতে হবে। কিন্তু সেসব কথা শুনবে কে, বুঝবেই বা কে! অরু কোনো কথা শুনতোই না।
.
রক্ত সম্পর্কে পাপ হয়, হৃদয়ের সম্পর্কে পাপ নেই। (জানি। তবু—সংস্কার বড্ড শক্ত জিনিস অরু।)
রূপুদি, তুই তো আমার বন্ধু, আমার ‘বউ’ তো তুই—তুই আবার আমার দিদি হতে যাবি কোন দুঃখে? তোকে ছোট্ট বেলা থেকে ‘বউ’ বলেছি না? রূপু সোনা, রূপসা, রূপসী এগুলো কার নাম? রূপুদিও তেমনি, আর একটা নাম। যেমন বুড়ুমার নাম বুড়ুমা। তা বলে কি পাড়াসুদ্ধুর মা নাকি সে বেচারা? ওই দিদিপনা ভুলে যাও—দু’আড়াই বছরে কিচ্ছু হয় না—জানো, সত্যজিতের বউ বিজয়া রায় তো বড়?
দিদিও তো ছিলেন তিনি সত্যজিতের। আপন মামাতো, না পিসতুতো, কী যেন একটা দিদি। শুনেছিলুম যেন?
ওই তো একই হলো, মোটকথা একটু বড়। একটু দিদি, আর অনেকখানি বউ।—সারাজীবন জুড়ে বউ। জীবনসঙ্গিনী। রূপুদি, তু ই—ই আমার জীবনসঙ্গিনী।—এটা ঈশ্বরনির্দিষ্ট ব্যবস্থা। তুই কিছুতেই বুঝতে পারিস না—বুঝেও মানতে পারিস না।
বাল্যপ্রেমে অভিশাপ আছে। পড়িসনি?
গুড! গুড! তাহলে তো মানছিস। আমাদেরটা বাল্যপ্রেম?
আমাদের আবার বাল্যপ্রেম?
আমাদের আবার কী? তোরটা বল। প্রেমটা তো তোর একারই।
কিন্তু যেদিন ছোড়দি বললো, রূপু, অরু এসেছে, ডেনে আনি? আমার বুকের ভেতরে রক্ত ছলকে উঠলো—পর্দার বাইরে থেকে অরুর ভারী গলা এল—আসবো?
কবে আবার আমার পর্দার বাইরে থেকে ”আসবো?” বলে ঘরে এসেছে অরু? এই ভারী—গলাতে অরুকে হঠাৎ অন্যরকম লাগলো।
ঘরে ঢুকেই আমার দিকে তাকালো। এক হাত পর্দায়, অন্য হাত পকেটে। চোখে মোটা কাছিমখোলের ফ্রেমের চশমা, খুব ফরসা রং হয়ে গেছে অরুর, একমাথা ঘনকালো চুলে এখন নুনমরিচের রং। অচেনা কোনো বিলেত—ফেরত ডাক্তারের মতোই সম্ভ্রান্ত, সুদূর দেখাচ্ছে তাকে,—চকচকে পালিশ করা জুতো থেকে লাল টাই, পোশাকেও কোনো পুরোনো দিনের চেনা পর্যন্ত চিহ্ন নেই। সেই সরু গোঁফটা একটু মোটা হয়েছে। সেই রোগা অরুও বেশ ভারিক্কি। অরু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আগের মতো নয়। অন্য হাসি। দূরের জনের হাসি। অপ্রস্তুত। লাজুকমতো। অরুর মতো নয়।
কেমন আছো? বলে আরেকটু হাসলো অরু। এবারে আরেকটু স্বাভাবিক। ও যদি বলতো, কেমন আছেন রূপসাদি? সেটাও মানাতো ওই অপ্রস্তুত হাসির সঙ্গে। ওই লাল টাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু না। ততটা নয়।
এগিয়ে এসে আমার হাতটা হাতে তুলে নিল। একটু কাঁপলো কি ওর হাত? না আমারই? নরম, গরম, ঠিক আগের অরুর হাত।
তুই—ই কেমন আছিস বল, বিলেতে?
গ্রেট। তুমি তো ভালোই বাধিয়ে বসেছো।
তোকে কে খবর দিল?
বাবা ফোন করেছিল। তারপর ছোড়দি। অ্যানড ডক্টর সুমন্ত্র সেনগুপ্ত। Three pronged attack!
তুই শুধু আমার জন্যেই এলি? আমেরিকা থেকে? সত্যি?
নয় তো কী? সত্যি রূপুদি, তোর বুদ্ধিসুদ্ধি আর হোলো না।
এতে বুদ্ধিসুদ্ধির কী আছে?
কিছু না। আগে বল তোর ভয় করছে না তো রে?
অপারেশন হবে বলে? না,—মম—নাঃ।
আমি চলে এলাম তোকে মনোবল সাপ্লাই করতে। নাথিং টু ওয়ারি অ্যাবাউট—ম্যাসটেকটমি তেমন জটিল অপারেশন নয়—এ তো ব্রেন—সার্জারি হচ্ছে না। সুপারফাইন কোনো কীর্তিকলাপ নেই—কম্পারেটিভলি সিম্পল সার্জারি—সূক্ষ্ম কোনো কারুকার্য নেই এতে। একদম মন খারাপ করিস না—তোকে যেমন সুন্দরী তেমনি সুন্দরীই দেখাবে। ইউ ওন্ট মিস এনিথিং অ্যাট অল—ছেলেরা যেমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো, তেমনিই তাকিয়ে থাকবে তোর দিকে—
চুপ কর। পাজি ছেলে! জানিস, আমি ঠাকুমা হয়েছি?
জানব না কেন? আই হ্যাভ মেট হিম জাস্ট নাউ, ইওর নাতিবাবু।
ওর নাম ভুতো। আমাদের সেই কালো কুকুরটার মতো।
দূর! ভুতো একটা নাম হোলো? বাচ্চার জন্যে?
বীরুবাবু দিয়েছেন। আমি আদর করে ডাকি ভুতুম।
যাক ভুতুম is far better than ভুতো!
হেসে উঠলো, ছেলেবেলার অরু।
সহজ হয়ে উঠলো বাতাস। রাজলক্ষ্মী ঢুকলো ভুতুমকে নিয়ে। অল্পক্ষণের মধ্যেই অরু ভুতুমকে কোলে নিয়ে লোফালুফি শুরু করে দিল। লাল টাই, চকচকে পালিশ করা জুতো, কাছিম ফ্রেমের চশমা—সব মুছে গেল। মালকোঁচা মারা ধুতির সঙ্গে নীল শার্ট পরা আঠারো বছরের তেধেড়েঙ্গে লম্বা ছেলেটাকে দেখা গেল আবার। ব্যাকব্রাশ করা একমাথা চুল থেকে থেকেই চোখের ওপরে এসে পড়ছে। চুলগুলোর এখন নুনমরিচ রং।
.
কত চওড়া হয়েছে অরুর কব্জি। গালের সেই ফুলকোলুচি নেই আর, তার বদলে একটা ভরাট ভাব এসেছে মুখে। ওর দৈর্ঘ্যটা মোটাসোটা হয়ে কমে যায়নি, বরং বেশি ওজনদার দেখাচ্ছে। সেই লম্বা লিকলিকে তলতা বাঁশের ডগায় আলুর দম চেহারাটার ভেতরে যে এই সুপুরুষ ব্যক্তিটি লুকিয়ে ছিল তা কে জানতো চল্লিশ বছর আগে?—অরু অন্য একটা চোখে আমার চোখের ভিতরে তাকালো। আমার বুকের মধ্যে হঠাৎ ধড়াস করে একটা অনেকদিনের বন্ধ জানলা খুলে গেল।
আমার সঙ্গেও তাহলে এরকম খেলা করে এখনও? চোখ বুজে হাত পাতি।
ঈশ্বরের দিকে বাড়িয়ে দিই সেই হাত।
দেরি হয়ে গিয়েছে।
এখন কি আর অঞ্জলি পূরণের দিন আছে?
.
অপারেশনের দিন স্থির হোলো।
অরু আমার পাশে পাশে।
অরু ছোড়দি—শৌণকেরও পাশে পাশে।
অরু ডক্টর সুমন্ত্র সেনগুপ্তেরও পাশে পাশে।
অরু যে কী পারে, কতটা পারে, সেটা যত দেখছি, ওর প্রতি সম্ভ্রমে, ভালোবাসায়, বুকটা উপচে উঠছে।
মিত্তির কাকাবাবুর প্রতি এতদিনের তীব্র বিতৃষ্ণা কিঞ্চিৎ কমেছে, তাঁরই আগ্রহে তো অরুকে আনা হয়েছে কলকাতায়। উনি না বললে ছোড়দি, শৌণকের হয়তো মনেই হত না ওকে যোগাযোগ করার কথা। যোগাযোগ তো রাখেনি সে। দেশে আসে না। শুধু মিত্তির কাকাবাবুর সঙ্গেই ফোনে কথা হয়। এই পর্যন্ত। শেষবার এসেছিল যেবার মিত্তির কাকিমা মারা গেলেন। অদ্ভুত একটা দেখাশোনা হয়েছিল আমাদের। শৌণক তখন স্কুলে পড়ছে, মিত্তির কাকিমার শ্রাদ্ধে আমি একাই শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছি। বীরুবাবু আসেননি। শৌণকও না। আপিস—ইশকুলের দিন।
অরু এসেছিল নিউইয়র্ক থেকে। তখনও রিসার্চ ফেলো। তখনও রোগা, তখনও ফুলকো গাল, তখন চশমা সোনালি ফ্রেমের। শ্রাদ্ধের দিন দেখা হোলো। ধুতি—পাঞ্জাবি। চুলভর্তি মাথা, কামায়নি। কাকাবাবু পুরুতকে চুলের দাম চুকিয়ে দিয়েছেন। উপোস—ক্লান্ত চোখমুখ।
অরু আমার হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে গেল। ঠিক যেমন টানাটানি করত যখন আমরা ছোটো। যেন অরু বিলেতে যায়নি। যেন আমার বিয়ে হয়ে যায়নি। যেন আমি মা হইনি। যেন কিছুই বদলায়নি। যেন সবই ঠিক যেমন ছিল তেমনি। অরু যেমনটি তেমনি ছিল। কিন্তু আমি তো তেমনটি ছিলাম না।
.
কি আশ্চর্য—অরু, আমার বিয়ে হয়ে গেছে—আমি ছেলের মা, এখনো তুই আমাকে এত চাপ দিচ্ছিস কেন অরু, আমি বুঝতে পারছি—না!— তোকে কতবার বলতে হবে যে, ভালো লাগা, ভালোবাসা আর প্রেমে পড়া এক নয়? তোকে তো আমরা সবাই ভালোবাসি, তোর প্রশংসা শুনলে আমার গর্ব হয়, নিন্দে শুনলে রাগ হয়—ক’দিন না দেখতে পেলে ভাবনা হয়, দেখা হলে আনন্দ হয়, তোর অসুখ—বিসুখ করলে মন খারাপ হয়, তোর রেজাল্ট ভালো হলে—
হয়েছে হয়েছে। রূপুদি, আর বোর করিস না, প্লিজ। লম্বা লিস্টি দিতে শুরু করেছে কী হলে কী হয়। তপনদার সে গল্পটার মতো, সেই যে, কী খেলে কী হয়! ধুৎ!
কোন গল্পটা আবার? সেই যে এক গ্রামের ইশকুলের মাস্টারমশাই মর্যাল সায়েন্সের প্রশ্ন করেন। সেই গ্রামে পুরুষরা ভীষণ মদ খেয়ে কেলোর কীর্তি করে। ফলে মাস্টারমশায়ের প্রশ্ন প্রতিবারেই হয়—মদ খাইলে কী হয়?
ছেলেরা লেখে, মদ খাইলে মাতাল হয়।
পর পর দু’বছর এটা চললো। হেডমাস্টার তাকে ডেকে পাঠালেন। মাস্টারমশাই, এক প্রশ্ন বারবার দেবেন না। এবারে প্রশ্নটা বদল করুন।
ঠিক আছে স্যার।
সেবারে মর্যাল সায়েন্সের প্রশ্ন এল—কী খাইলে মাতাল হয়?
ছেলেরা লিখলো, মদ খাইলে মাতাল হয়।
হেডমাস্টার আবার ডেকে পাঠালেন।
ও মাস্টারমশাই, ছেলেরা যে একই উত্তর দিচ্ছে!
তা তো দেবেই। এই প্রশ্নের তো এটাই উত্তর। অন্য কিছু লিখবে কেমন করে?
না না, এ চলবে না, প্লিজ, আপনি কোয়েশ্চেন বদল করুন।
অনেক ভেবে—চিন্তে স্যার প্রশ্ন দিলেন ছেলেদের—কী খাইলে কী হয়?
ছেলেরা আবার লিখলো, মদ খাইলে মাতাল হয়।
হেডমাস্টারমশাই আর ডেকে পাঠালেন না নিশ্চয়ই সেই স্যারকে? এবার তিনি নিজেই মদ খাইয়া বেহুঁশ হইয়া ঈদৃশ শিক্ষকদের মুখচ্ছবি ভুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এই তো?
সত্যি, পারিসও, তুই জোগাড় করতে!
আমি না, আমি না, তপনদা। তাঁর জোগাড় করা গল্প। তাঁর অজস্র এরকম গল্প আছে। সে সবই তুই শুনতে পাবি—চল তো আমার সঙ্গে।
পাগলামিটা এখনো গেল না? বরকে ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে আমি ছুটবো তোর পিছু পিছু?
আমার পিছু পিছু কেন? প্রেমের পিছনে ছুটবি। ডোন্ট টেল মি, প্রবীরবাবু তোর প্রেমিক। হি মে বি ইওর হাজব্যান্ড বাট নট ইওর লাভার। ইউ নীড লাভ। অ্যান্ড হিয়ার আই অ্যাম। নিজেকে আর কত ঠকাবি তুই? চল চল। নিজের সংসার করবি চল, বরের সংসার ফেলে দে—
বাঃ! ফেলে দে! বরের সংসার ফেলে দে? ছেলেটাও ফেলে দেব? কী কথা!
না না, ছেলেটাকে তো সঙ্গে নিয়ে যাবো আমরা!—তোর ছেলে তো আমারও ছেলে! উই আর ওয়ান! রূপুদি, এখন আমরা ছেলেমানুষ নই—তুই একজন ফুলগ্রোন উওম্যান—তোর জীবনটা তোর হাতেই থাকা উচিত।
আর আমি এখন ফুল পে—তে পুরোদমে স্যালারিড চাকুরে—তোর কোনোদিন অর্থাভাব হবে না—খুব যত্নে মানুষ করবো তোর ছেলেকে; ঠিক স্বপ্নের মধ্যে বাঁচবো আমরা—
কী করব? আমি কী করব শুনি, সেখানে?
কেন, যা করিস এখানে, তাই করবি। গান গাইবি—
আমার কাজের জায়গাটা তো একটা বনের ধারে, একটা হট স্প্রিং আছে কাছাকাছি—ঝিরঝিরে একটা ছোট নদী আমাদের বাড়িটার পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে, তাতে রাজহাঁসেরা ভেসে বেড়াচ্ছে—
সেই নদীটাই আবার খানিক দূরে গিয়ে ইয়া লম্বা—চওড়া, তখন তাতে জাহাজের মতো সব স্টিমার ভাসে। আমাদের কটেজটা শাদা ধবধবে, তার লাল টুকটুকে টালির চাল, জানলা—দরজাগুলোর রং আকাশী—নীল। একটা সুন্দর ছবির মতো চৌকো বাগানের মাঝখানে কটেজটা বসে আছে। শাদা সেই ধবধবে কাঠের ফেন্স দিয়ে ঘেরা—সেই কাঠের বেড়াতে ছোট্টো কাঠের দরজা। তার পাশে একটা থামের ওপর একখানা খুদে ডলস হাউস বসানো—সেটা হচ্ছে আমাদের লেটার বক্স। তাতে লেখা থাকবে—কী লেখা থাকবে বল তো? এবার তোর পালা। তুই বল বাড়িটাতে নেমপ্লেটটা কেমন?
যাঃ, আমার বাড়ি নাকি? আমি কিছু জানি না। তোর বাড়ি তুই জানিস।
তোরও বাড়ি যে—শোন, আরেকটু কাছে এসে বোস—না হলে কী করে বলব? এমনি করে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে—
ফের বজ্জাতি? ছোড়দিকে ডাকি?—
ডাক না, ডাক? সেই ছোটবেলার মতো—ছোড়দি তো এসে আমাকে ধমক দিয়েই উলটে যাবে—ধুর—শোন সেই শাদা গেটটাতে খুব অল্প একটু হাত ছোঁওয়াবি তুই, আলতো করে, অমনি গেটটা খুলে যাবে, সামনে সবুজ ঘাসের মধ্যে মেরুন রঙের সরু সুরকি বিছানো রাস্তা বাড়ি অবধি গেছে। দু’পাশে মরসুমি ফুলের বাগান। পিছনে ফলের বাগিচা, আর দুটি পাশে সবজি ক্ষেত। ভরভর্তি সব!
যাবি না রূপুদি, ঐ বাড়িটাতে? বেড়াটার ধার দিয়ে, না না, বাড়ির বাগানের মধ্যে দিয়েই—ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে একটা পাহাড়ি ঝোরার হালকা জলের ধারা—তাতে অজস্র গোল গোল রঙিন নুড়ি, ‘উপল’ বলে যাকে—তার ওপর দিয়ে বইছে তো, তাই কুলু কুলু ধ্বনি উঠছে জলে। আর, আর, তাতে ছোট্ট ছোট্ট রঙিন মাছ—আপনমনে খেলে বেড়াচ্ছে। ফুলের বাগানে ভ্রমরের গুন গুন—
ওরে বাবা। তাহলে আমি নেই! ভোমরার কামড় একবার খেয়েছি—
আরে? এ তো বিলিতি ভ্রমর। ওরা কি আমাদের মতো দংশন করতে জানে? আমাদের ভ্রমররা—এমনি করে—এই—এমনি করে—
ওঃ ছাড়! ছাড় বলছি অরু—ভালো হবে না কিন্তু—উঃ—
ছাড়িব না, ছাড়িব না! তোকে আমি ছাড়ব না। তোকে আমি ধরে নিয়ে যাবই! ওই বাড়িটা তোর জন্যে বসে আছে যুগ যুগ ধরে—আর, রূপু সোনা কই, রূপু সোনা কই, বলছে—প্লিজ রূপু, তোর জন্যে পাসপোর্টের ফর্ম এনেছি—কিচ্ছু না, শুধু ফর্মটা ভর্তি করে দে। আট কপি ছবি, আর যা যা লাগবে, সব আমি জোগাড় করে দেব তোকে—
রূপু সোনা, এই নকল জীবনটা থেকে তুই বেরিয়ে পড়, পালিয়ে যাই চল—আমরা দুজনে খুব সুন্দর একটা জীবন তৈরি করে নেবো—তুই যেটা চাস—
অরু! এক মিনিট তোর বক্তিয়ারি বন্ধ করবি?
এই কথাগুলোকে তুমি বক্তিয়ারি বললে? রূপুদি! তুমি আর কত ঠকাবে নিজেকে? আমি তোমাকে ছুঁলেই তোমার মন বুঝতে পারি—তোমার শরীর তো মিথ্যে কথা বলে না, ভাঁওতা দেয় না তোমার মতো? রূপুদি, আমাদের তো একটা সম্পর্ক আছে? না নেই? সেই বিষ্টির দুপুরটা থেকে যার শুরু, সেসব কি মিথ্যেমিথ্যি? না। সে সবই সত্যি। রূপুদি, তুই স্বপ্ন দেখিসনি। সবই হয়েছিল। সত্যি সত্যি ঘটেছিল। তুই কেন নিজেকে ঠকিয়ে ”কিচ্ছু হয়নি” বলতে চাস? এতে কার কী উপকার হচ্ছে?
দ্যাখ অরু, তোর ঐ ধারণাটা কিন্তু…
ধারণা নয় রূপু, ওটাকে বলে স্মৃতি। তোমার যা ঘটেছে তাকে কিন্তু বিস্মৃতি বলে না, স্মৃতিভ্রংশও বলে না, রূপুদি, এখন তুমি যেটা করছো, সেটাকে বলে,—সেটা হচ্ছে, সেটার নাম তঞ্চকতা। আমি বুঝতে পারি না, তুই কেন সম্পর্কটা এভাবে অস্বীকার করে চলেছিস বছরের পর বছর ধরে? আমরা যা করেছি, তাতে কোনো পাপ নেই—কোনো পাপ ছিল না রে, রূপুদি—ফুল ফুটলে ভ্রমর আসে। তাতে পাপ নেই। আর আমার সঙ্গে তোর যেটা, সেটা তো প্রেম। প্রেমে সবটাই শুধু পুণ্য—বুঝলি বোকা মেয়ে,—শুধুই পুণ্য—তুই মিছিমিছি একটা অস্বীকৃতির জাল পেতে নিজেই নিজেকে ফাঁদে ফেলেছিস—আমি তোর হাত ধরে টেনে বের করে আনতে চাইছি—সেটাও করতে দিবি না? রূপুদি, প্লিজ, লুক অ্যাট মি, প্লিজ ফেস দ্য ট্রুথ—উই আর লাভার্স, ইয়েস, লাভার্স, দেয়ার ইজ নাথিং রং ইন ইট—প্রেমে পাপ নেই—বিলিভ মি রূপু সোনা—
.
আমিও বোধহয় অরুর কথার মায়ায় সেদিন ধরা দিয়েছিলাম—হঠাৎ মনে হোলো, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ—মুহূর্তে ছিটকে সরে গিয়ে আমি ফোঁস করে উঠি—
ছিঃ! কী হচ্ছে কী, অরু? আড়ালে আমাকে একা পেয়ে কাকাবাবুর লাইনে যাচ্ছিস? ছাড়, কেউ দেখবে—
নিমেষেই ওর মুখখানা শাদা, ফ্যাকাশে, রক্তহীন!
শিউরে উঠে আমাকে ছেড়ে দিল।
ঘন করে জড়িয়ে ধরেছিল। চুমুটা খেতে শুরু করেছিল। সবে ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট—
সিঁড়িতে কেউ ছিল না। আমার মনের ভুল।
হ্যাঁ, শিউরে উঠেছিল অরু। ভয়ের নয়, অন্য একরকমের শিহরন। কী যেন একটা ছিল সেদিন ওর মর্মাহত চোখের চাউনিতে—যাতে আমার নিজেরই হঠাৎ প্রবল লজ্জা করলো নিজের কথাগুলোর জন্যে।
অরু কিছুই বললো না।
নিঃশব্দে নীচে নেমে গেল।
সেদিন রাত্রে অরু আমাকে একটা চিঠি লিখে ছোড়দির হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। উত্তর দিইনি!
বছরখানেক পরে খবর এল অরু বিয়ে করেছে। একটি পাকিস্তানি মেয়েকে। তার পরিবারে মেয়েটি নিপীড়িত ছিল, Battered Women’s Home থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। অরু ওখানে চিকিৎসার জন্যে যেত। বউকে দেশে আনেনি। একটি মেয়ে হয়েছিল ওদের। বউ তারপরে মারা গিয়েছে পাকিস্তানে বেড়াতে গিয়ে। মেয়েটি মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছে।
অরু বউকেও কখনও দেশে আনেনি—মেয়েকেও না। কাকাবাবু ডেকেছিলেন, তাও আসেনি। টেলিফোনেই বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। কাকাবাবুর তাতে কোনো ক্ষোভ—দুঃখ আছে কি না জানা যায়নি। কিন্তু আমার অসুখে তিনিই অরুকে খবরটা দিলেন। বললেন—রূপুর অসুখ শুনলে অরু ছুটে চলে আসবেই। দেখো তোমরা। কাকাবাবু তাঁর ছেলেকে হয়তো চেনেন, কিন্তু রাজ্যিসুদ্ধু লোকের অবাক না হয়ে উপায় কী—এত বছর পরে অরুর এভাবে হঠাৎ দেশে ফিরে আসায়?
অরুকে দেখে কে বলবে এই আমাদের সেই অরু? দিদি বললো আদর করে। আদুরে গলা শুনেই অরুও দিদির কাছে ছোট একটা বেড়ালছানার মতো বসলো গিয়ে।
এককাপ চা হবে দিদিভাই?
ছোড়দি ওকে দু’জোড়া পাজামা—পাঞ্জাবি এনে দিয়েছে। সেগুলো পরলে আমি ওর মধ্যে ছোটবেলার ছেলেটার আদল পাই।
আর বুকের ভেতরে অস্থির লাগে। কেন না এই অরু সেই অরু নয়। এ খুব ভদ্র, বেশ শান্ত, ধীর—স্থির। এই অরুর মধ্যে আমার চেয়ে ছোটো সেই পাগলা প্রেমিকটাকে খুঁজে পাই না। ইনি হচ্ছেন ডক্টর অরিন্দম মিত্র। এঁকে ব্যাংককের ইন্টারন্যাশনাল Oncologists’ Congress—এ সভাপতিত্ব করতে যেতে হয়। এঁকে আমার চেয়ে ছোটো মনে করবার কোনো সুযোগ নেই। নার্সিংহোম একপায়ে খাড়া হয়ে যায়, ইনি ঢুকলে। এ আমাকে ‘রূপুদি’, ‘তুমি’ বলে। আমার বুকের ভেতরে একটা কষ্ট গোল হয়ে পাক খেতে থাকে। বীরুবাবুর স্ত্রী ঠিক যা চেয়েছিলেন তাই তো হয়েছে। অরুর প্রেম নিবেদন বন্ধ করতেই তো চেয়েছিলাম। এখন কেন তবে এমন লাগছে? বাঁদিকের বুকে এখনও ব্যান্ডেজ—শিল্পীর কারুকৃতি যোগ করা হয়নি। ষাটোর্ধ্ব, একস্তনী অতি কিম্ভুত এক মহিলার হাস্যকর বুকের ভেতরে একটা হলদে প্রজাপতি ফুরফুর করে উড়ছে।
.
ওপরের বোতাম দুটো খোলা। অরু অন্যমনে একটা কাগজ পড়ছে। পাঞ্জাবির ফাঁকে বুকের কোঁকড়া শাদা—কালো চুল উঁকি দিচ্ছে। অরুর বুকে এত চুল ছিল নাকি? কত কি দেখা হয়নি। অরুর হাতের কব্জি পর্যন্ত লোম হোলো আবার কবে? অরু যে এত সুন্দর খেয়ালই করিনি এতকাল। আমার ষাট পেরিয়েছে। এখন জীবনের একটা বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি—নিজের দু’দিকে দুটো লম্বা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। শুধু ভোর হচ্ছে, না সন্ধ্যা নামছে, সেইটে ঠিক বুঝতে পারছি না এক্ষুনি।
এই অত্যন্ত ভদ্র সভ্য মার্জিত সংযত অরুকে আমি যেন ঠিক সইতে পারছি না। আমার মনকেমন করছে। একে তো আমি চিনি না।
আমার রূপুর জন্যে মনকেমন করছে। আমার অরুর জন্যে মনকেমন করছে।
এই যে বীরুবাবুর বউ, একে কি আমি চিনি? আমি কি অরুর কাছে গিয়ে বলব, অরু, শোন, প্লিজ, ওরকম করিস না অরু, আগের মতো আমাকে আদর কর?
কিছুই যে হলো না পাওয়া, সেই সব, সেই সব।
.
আবার যদি ইচ্ছা করো, আবার আসি ফিরে। অরু রে, একবার ভালো করে তাকা আমার দিকে।—”এসেছি বাসবদত্তা” করে আসতে তোকে কে বলেছিল? কে তোর মহত্ত্ব চেয়েছে? অরু, আমি এখনও সেই রূপুই আছি রে—বিশ্বাস কর। যখন ডেকেছিলি তখন বুঝতে পারিনি, তখন টের পাইনি বুকের ভেতরে কী আছে। এখন বুঝেছি। কিন্তু যাবার রাস্তা সব বন্ধ। আমার দিকে সাড়া ছিল না বলে তুই ঝগড়া করতিস, যুদ্ধ করতিস। এখন তুই নিঃসাড় ভদ্রতার তুহিনস্তূপ হয়ে গেছিস। একদিনও ঠিক করে কথা বলিসনি আমার সঙ্গে। রুগি দেখতে এসেছিল সাতসাগর পেরিয়ে, রুগি দেখা সেরেই ফিরে যাবি। অরু, আমি যদি মন ঠিক করে ফেলি, যদি বলি, আমি এখন যাব তোর কাছে—তুই কি আমাকে নিবি?
তোর মনে আছে অরু, তুই বলতিস, একবার যদি তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারি, তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারে নিয়ে ফেলতে পারি যদি তোমাকে, দেখবে পৃথিবীতে কোনও দুঃখ নেই, কোনও অপমান নেই, কেবল ভালোবাসা আছে, কেবল বিশ্বাস আছে, কেবল রূপু আর অরু আছে—সেইসব কথাগুলো আমি কিছুই ভুলিনি রে, অরু। তুই—ই কি ভুলে গেলি?
.
তোকে বোঝাতে পারব না অরু, আমার এই অস্থির উজান বাইবার কষ্ট। ভাঁটার টান লেগেছে—একদিকে স্বামী—পুত্র—নাতি—বউমা মান—সম্ভ্রম—ভরা সংসার, আরেক দিকে তুই। না, তুই আর আমি। হোলো না। আরেক দিকে আমি।
শুধু আমিই।
এই টানাপোড়েনে তুই নেই। এর দায় সম্পূর্ণ আমারই। গভীরভাবে ভেবে দেখেছি আমার জীবন এখন যেখানে এসে ঠেকেছে,—এবার আমি ছুটি নিতেই পারি। প্রায় চল্লিশ বছরের টানা সার্ভিস,—এবারে রিটায়ারমেন্ট ডিউ হয়েছে। বীরুবাবু তাঁর ক্লাব—কাছারি—দিদিদের নিয়ে দিব্যি সুখে আছেন, সুখেই থাকবেন। কিন্তু আমি? আমিও তো থাকবো সুখে? এই যে আমি রয়েছি—সুখে রয়েছি কি? সুখ কী?
.
শৌণকের বউটি খুব চমৎকার মানুষ। ওদের কোলে অরিত্রবাবু এসে গেছেন। ওদের পরিবারটি প্রস্তুত। বীরুবাবুর ঘর ভর্তি থাকবে। (অরিত্রই সুখ, ঠিক, কিন্তু অরিত্র আমার নয়!)
এবার আমি নিজেরই জন্যে বাকি দিনগুলো একটু বাঁচলে কার কী ক্ষতি? মনেপ্রাণে সংসারী না হয়েও তো সংসার—সংসার খেলা অনেকদিন হোলো। এবার সত্যি সত্যি ঘর বাঁধতে চাওয়া কি অন্যায়? নিজের ঘর। ভালোবাসার জমিতে। এবারে শুধু বাঁচা। নিজের জন্যে নিজের বাঁচা। এই আমিটা শুধু তোরই জন্যে অরু।
অরু—সেই বিকেলটা মনে আছে? সেই ছাদের আলসেয়—? যেবার তোর মা—র শ্রাদ্ধে এসেছিলি? আমাকে তুই একটা চিঠি লিখেছিলি সেবারে। মনে আছে সেই চিঠি? এই যে সেই চিঠি। আমার সেই চাবি—দেওয়া দেরাজেই ছিল। ফর্মটর্মসুদ্ধু। পড়বি? সেই ফর্ম এতদিনে তামাদি হয়ে গেছে, কিন্তু চিঠিটাও কি?
.
রূপুদি, সোনার রূপাই,
অযথা ওই কথাটা বলে আমাকে অপমান করলে কেন? তুমি কি জানো না আমি কে, আমি কেমন, আমি তোমার কে হই? তোমারই বিয়ে করে ফেলা উচিত হয়নি। অপেক্ষা করার ভরসা নিয়েই আমি বাইরে গিয়েছিলুম। তুমি কিসের ভয়ে অমন দৌড়ে একা বিয়ে করে ফেললে? আমার জীবনটাও শূন্য করে দিলে, নিজের জীবনটাও। আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি, রূপু, আমি দিন গুনছি। তোমার স্বামী আমার কেউ হয় না। তুমি আমার বউ। তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমাকেই ভালোবাসো। আজন্ম ভালোবেসেছো। তুমি আর কারুকেই ভালোবাসোনি। ওই মিথ্যের বোঝা আর মাথায় করে বয়ে বেড়িও না, ছুঁড়ে ফেলে দাও। আমার কাছে চলে এসো। তোমার সন্তান তোমারই অঙ্গ। তাকে নিয়ে আমার কাছে চলে এসো।
রূপুদি, আমার কথাগুলো শোন, মন দিয়ে শোন। একটা ফর্ম দিচ্ছি এই সঙ্গে। পাসপোর্টের ফর্ম। আমার বাবার কাছে নিয়ে যাস, সব ভর্তি করে দেবে। গ্যারান্টার নিজেই হবে। তোর পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে, তখন বাড়ির লোক জানতে পারবে। বাপের বাড়ির ঠিকানা দিতে পারিস, পার্মানেন্ট রেসিডেন্স। তাহলে ঝামেলা হবে না। থানাটাও বাবা সামলে দেবে। পাসপোর্টটা তৈরি করে রাখ। যে কোনোদিন তোকে টিকিট পাঠিয়ে দেবো। আর ‘না’ বলিস না—আরও দেরি করিস না। একটা খোকা হয়েছে, ঠিক আছে, ওকে নিয়েই চলে আয়। আমরা তিনজনে খুব আনন্দে থাকবো—
বিশ্বাস করো তুমি আমাকেই ভালোবাসো। একেই বলে প্রেম, রূপুদি। প্রেম খুব মূল্যবান সম্পর্ক।
না, আমার বাবার সঙ্গে যে সম্পর্কগুলো তুমি দেখেছো সেগুলো প্রেম নয়। সেগুলো সেক্স। আমার বাবা অন্য কিছু জানেন না। তোমার মা, ছোড়দি, কেউ জানেনি প্রেম কাকে বলে। বাবা ইজ ইনকেপেবল অফ এনিথিং এলস। শুধু সেক্স জানে বাবা। আমার সঙ্গে আমার বাবাকে তুলনা করে ঠিক করোনি, রূপুদি।
আমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক, তোমার আর আমার, তাকেই বলে প্রেম। বিশ্বাস করো, এটাই প্রেম। খুব দুঃখের কথা তোমাকে এভাবে বোঝাতে হচ্ছে। তুমি যে প্রবলভাবে সত্য—অসত্য, স্মৃতি—বিস্মৃতি, প্রেম—অপ্রেম সবকিছু গোল পাকিয়ে গুবলেট করে বসে আছো। একবার বলেছিলাম তোর বিস্মৃতিটা বিস্মৃতি নয়, অস্বীকৃতি। তঞ্চকতা।—মনে আছে? আবার বলছি সেই কথা।
রূপুদি—তুমি হয়কে নয় করছো, ঘটেছে—কে ঘটেনি করছো। আছে—কে নেই করছো। কোরো না রূপুদি, প্লিজ, আত্মপ্রবঞ্চনাও কিন্তু পাপ। মহাপাপ। আত্মহত্যারই সমতুল্য তো। তুমি সত্যকে অস্বীকার করছো, স্মৃতিকে ধ্বংস করছো। তুই ভেবেছিস—’নেই—নেই’ করতে করতে সাপের বিষও নষ্ট হয়ে যায়,—এ তো কেবল সামান্য ব্যাপার, অরুর প্রেম! আজ্ঞে না, বিষের কথা জানি না, কিন্তু অমৃতকে ‘নেই—নেই’ করে ‘নেই’ করে দেওয়া যায় না। সে তো থাকবেই এবং ফিরে ফিরে আসবেও।
আমি তোমার পায়ে পড়ছি, রূপুদি, wake up—face the reality—denial মস্ত বড় রোগ একটা। সুস্থ জীবনে বাঁচতে দেয় না মানুষকে, সত্যের মুখোমুখি হতে দেয় না আমাদের। তুমি প্রচণ্ডভাবে denial—এ ভুগছো, রূপুদি। প্লিজ! এই কিছু—নেই—কিছু—হয়নিটা ছেড়ে দে তুই, আমাকে জড়িয়ে ধর। এই যে, এই যে আমি তোকে জড়িয়ে ধরেছি, এই যে আমি তোকে আদর করছি, তোর ভালো লাগছে না? বল, সত্যি কথা বল, ভালো লাগছে না? রূপুদিদি, সোনামণি, আমি তোকে বিয়ে করে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে নিয়ে যাবো ছোট্ট একটা স্কটিশ শহরে। সেখানে শীতে যেমন ঠাণ্ডা, গ্রীষ্মে তেমনই আরাম। আমরা দুজনে পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে চলে যাবো হেমন্তের রঙিন পাতাঝরা বনের পথে—তুই শাড়ি পরে, জুতো—মোজা পরে মোটা সোয়েটারের ওপর শাল জড়িয়ে নিবি ভালো করে, তেমন ঠাণ্ডা পড়লে কোট পরে নিবি। আমরা বেড়াবো নদীর তীরে—হাত ধরাধরি করে। না, হাত না, কোমর জড়াজড়ি করে।—নদীতেও চাঁদ ভাসবে, আকাশেও চাঁদ হাসবে—আর আমার কোলের মধ্যে, বুকের মধ্যে তুই—রূপু, রূপু সোনা,—একটা চুমু দে আমাকে?
সেই রাত্রিবেলায় ছাদে যেরকম—তুই বললি, অরু, প্লিজ—সেদিনকার কথাটা ভুলে যা তুই, প্লিজ অরু, আর ঐ দুপুরবেলাটা, বিষ্টির মধ্যে, সেটাও কি ভুলে যেতে বলছিস? তুই ভুলতে পারবি?
রূপুদি তুই না বলিস, তুই আমার বড়ো? তো এই বুঝি বড়োর মতো কাজ হচ্ছে? এ তো ভিতুর একশেষ, ছোট্ট একটা খুকুর মতো কাজ হচ্ছে!—ঝেড়ে ফেলে দে। কে কী বলবে—মাকে দেখিসনি? ছোড়দিকে দেখিসনি? আমার পিতাকে দেখিসনি? ওরা কদাচ ভেবেছিল, কে কী বলবে? কে কী ভাববে?
না। ভাবেনি। কেউ কিছু বলেওনি। লোকে মেনে নিয়েছে। তুই যত ভয় পাবি লোকে তত তোকে ভয় দেখাবে। ভিতুকেই ভয় দেখাই আমরা, সাহসীকে কেউ কিছু বলতেই সাহস পায় না।—শোন রূপুদি, তুই চল আমার সঙ্গে, দেখি কে কী বলে?
.
.
আজ তোর পুরোনো চিঠি তোকে ফিরিয়ে দিলাম নতুন জবাবসমেত। সেদিন আমি যেতে পারিনি। ফর্ম ফিল আপ করিনি পাসপোর্টের। কিন্তু এখন তো পারি?
এখন যদি যাই? নিষ্পত্র বৃক্ষের মতো? ছায়াটুকুও দেবার শক্তি নেই যার? তুই কি এখনও আমাকে নিবি? জানি না, আর ক’বছর এই পৃথিবীর আদর আমার ভাগ্যে আছে। এবার বোধ হচ্ছে তোর কথাই ঠিক। আমি এতকাল ভুল জীবন যাপন করেছি। এবার ঠিক করে নিতে দে।
পূর্ণ যৌবন যাকে দেবার ছিল,—শূন্য হাতে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে আমার লজ্জা করছে না। যখন শরীর ছিল, যৌবন ছিল, তখন মনে প্রেম ছিল না। এখন শরীর না—ই বা থাকুক, প্রেম তো এসেছে। বেশ জানান দিয়েই, মহা সমারোহে। তোরই দেওয়া এই প্রেম। তোর দিকেই মুখ ফিরিয়ে আছে। তুই একে তুলে নে, অরু। এতদিন তো তুই বলেছিস, এসো—এবার আমি বলছি—এসো। এতদিনে আমার প্রাণের ভিতরে প্রতিধ্বনি উঠলো। এতদিনে আমার বুকের গহনে পৌঁছোলো তোর স্বর। শেষ মুহূর্তে হলেও তো ভ্রম সংশোধনের সুযোগ থাকে মানুষের? অনেক যুদ্ধ করেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি। এটা আমার স্থির সিদ্ধান্ত। রূপসা।
.
মিতিলের কথা আমি বিশ্বাস করিনি এত বছর। মিতিল সমানেই বলেছে, ভুল করেছিস। মিতিলের মতে, অনেক আগেই অরুর সঙ্গে আমার বিলেতে চলে যাওয়ার কথা। এতদিনে সংসার সম্পূর্ণ হয়ে যেত। বীরুবাবুর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক বা নিঃসম্পর্ক সেটা মিতিলকে যারপরনাই বিরক্ত করে। মিতিল অধ্যাপক, মিতিল দর্শন পড়ায়—সে যেভাবে জীবনটাকে দেখেছে আমি তো সেভাবে দেখিনি।
বীরুবাবুর সঙ্গে আমার গাঁটছড়াই বাঁধা হোলো, মনের মিল আর হোলো না।
মিতিল বলে, তার কারণ অরু। বীরুবাবু নন। মনে মনে তুই অরুর প্রতি একান্তভাবে অনুরক্ত। কেমন করে অন্য মানুষকে ভালোবাসবি? তোরই মহা অপরাধ হয়েছে বীরুবাবুকে বিয়ে করা। তোর ক্ষমা নেই। বুঝলি? দু’দুটো মানুষকে কষ্ট দিচ্ছিস কেবল নিজের মতিগতি নিজে বুঝিস না বলে। মিতিল চটে যায়। মিতিল চায় আমাকে মনের ডাক্তার দেখাতে। তার ধারণা মা, ছোড়দি ইত্যাদির জীবনযাপন নিজের বাড়িতে দেখে আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়ে আর প্রেমে পড়তে সাহস পাচ্ছি না। না। ইন ফ্যাক্ট, মিতিলের মতে আমি আবাল্য আপাদমস্তক অরুর প্রেমে পড়ে রয়েছি, কিন্তু সেটা নিজের কাছেই নিজে স্বীকার করতে রাজি নই, অরুর কাছে তো নয়ই। মিতিলের ধারণা আমার হয়তো ভয় করে, একবার স্বীকার করে নিলেই সম্পর্কটা ওই ছোড়দিদের মতো ঘোলাটে, অপরিচ্ছন্ন, অপবিত্র হয়ে যাবে। তাই ঐ আমার এক গোঁ—No. I am not in love. Not with you, not with anyone else either. স্বামীর জন্যই যে সেবারে আমি অরুকে ফিরিয়ে দিয়েছি তাও নয়। সেটা মেনে নিচ্ছে মিতিল। তবে আমি অরুর কাছে চলে যাচ্ছি না কীসের জন্য? মিতিল বলেছে, বুকের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে উত্তর খোঁজ। উত্তর পাবি।
.
অসুখে পড়লুম। কোথা থেকে দৈবশক্তির মতো উড়ে এসে পড়লো অরু (সিনেমাতেই শুধু এমনটি দেখা যায়)। বললে বিশ্বাস করবে না কেউ, সত্যি সত্যিই গল্পের মতন। আমার হয়েছে ক্যানসার আর অরু হয়েছে ক্যানসার স্পেশালিস্ট। অরিন্দম মিত্র বললে সবাই একডাকে চেনে Oncologist মহলে। ঈশ্বরের ইচ্ছে না থাকলে কেনই বা হবে এই আশ্চর্য যোগাযোগ? মিতিল বলে, এগুলো সবই পূর্বনির্ধারিত। এতেও তুই বুঝতে পারছিস না যে বীরুবাবু নন, অরুবাবুই তোর জীবনসঙ্গী—ঈশ্বরের সেটাই ইচ্ছে।
মিতিল একদিন বলেছিল—আচ্ছা রূপু, তুই কি অমিয়কুমার হাটির কথা জানিস?
ডাক্তার তো? জানি। ভালো ডাক্তার। কেন?
হ্যাঁ। ডক্টর অমিয়কুমার হাটির বিয়ের খবরটা জানিস কি?
বিয়ে? না বাপু! তাঁর ব্যক্তিগত ইনফর্মেশন আমার কাছে নেই। কেন রে? শুনেছি খুব ভালো ডাক্তার, এইটুকু।
তাঁরও একজন বাল্যসখী ছিল, কিন্তু যৌবনেই অবস্থার চাপে দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, কেউই আর বিয়ে করেননি। নানা দায়িত্বে জড়িয়ে গিয়ে যোগাযোগ হারিয়ে গিয়েছিল তাঁদের।
তো?
হঠাৎ একদিন, তিনি তখন বোধহয় শেষ পঞ্চাশের ঘরে, ডক্টর হাটি তাঁর বাল্য প্রেমিকার উদ্দেশে একটি স্মৃতিমেদুর কবিতা লিখলেন। সেটি ‘নবকল্লোলে’ পাঠিয়ে দিলেন। ছাপাও হোলো।
তারপর?
তারপর সেই কবিতা গিয়ে পড়বি তো পড় এক্কেবারে সেই মহিলার হাতে।
অ্যাঁ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তারপর?
তিনিও তখনও অবিবাহিতা, দায়িত্বগুলি সব পালন করা শেষ হয়েছে ততদিনে। কলকাতার বিখ্যাত এক সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। কবিতাটি পড়েই তিনি সোজা চলে গেলেন ‘নবকল্লোল’ অফিসে, কবির খোঁজে।
তারপর?
তারপর আর কি? আমি তোকে যা বলছি, ডক্টর হাটিও মহিলাকে সেই কথাটিই বললেন, ইটস নেভার টু লেট।
তা—র—পর?
তুই যা ভাবছিস, অবিকল তাই হয়েছে। তাঁরা দুজনে এখন সুখে ঘর—সংসার করছেন।
বেশ তো। গুড নিউজ। কিন্তু আমাকে তুই এই কাহিনী কেন শোনাচ্ছিস?
কেন না তোমার বর্তমান পরিস্থিতিতে এই উদাহরণ খুব ইউজফুল হতে পারে। তোমার প্রেমবিহ্বলতা শিশুতেও বুঝতে পারবে।
তাহলে অরু কেন বুঝছে না?
কে বলেছে বুঝছে না? অভিমান বলে জগতে একটি বস্তু আছে। ওকে তুই কতকাল টাঙিয়ে রাখবি? ডু সামথিং।
ও কে, তাহলে কোন লেসনটা নেব আমি তোর গল্প থেকে? দুটো পসিবিলিটি দেখতে পাচ্ছি। প্রথমটা অ্যাকটিভ। অর্থাৎ অরুর নামে প্রেমের কবিতা লিখে নবকল্লোলে পাঠাবো। যদি ছাপা হয়, তবে সেই পত্রিকার কপি ডি—এইচ—এল এক্সপ্রেসে নিউইয়র্কে স্লোন কেটারিং হসপিটালে প্রেরণ করবো।
সেকেন্ডটা প্যাসিভ। অর্থাৎ প্রতি সংখ্যার নবকল্লোল খুলেই অরুর একটা প্রেমপত্র খুঁজবো? খুঁজেই চলবো। তুই কোনটা করতে বলছিস? সেইটে করবো।
ইয়ার্কি মারছিস? নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে? জীবন তো একটাই। সংস্কার থাকা ভালো—কিন্তু কুসংস্কার আঁকড়ে থাকা ভালো কি? যাকে কোনোদিন আপনজন করলি না—তারই সঙ্গে সমস্ত জীবন প্রতারণার মধ্যে বেঁচে থাকবি? লোকলজ্জাই বড়ো হোলো? জীবন নয়?
মিতিলের কথাটার গভীর তাৎপর্য আজ প্রকাশ হয়েছে, সামনে যখন শুধু একমুঠো সকাল বাকি। এবারে আমিই চিঠি লিখতে বসেছি অরুকে। লিখতে হবে, অরু আমি এসেছি। হাতে একমুঠো ভোর, আর একমুঠো সন্ধে নিয়ে আমি তোর কাছে এসেছি অরু। এতদিনে।
চিঠিটার জবাব আসেনি। অরু ব্যাংককে গিয়েছিল, ফিরে আসার পর থেকে আমাদের মধ্যে আর আগের মতো দূরত্বটা নেই। কিছু একটা সরে গেছে বুঝতে পারছি। অনেকটা সহজ হয়েছে ও। চোখের ভাষায় ছোটবেলার বার্তা ফিরেছে। জীবন তো আমার স্বাভাবিক নয়, ইতিমধ্যে মাঝে মাঝেই নার্সিংহোমে যাত্রা করতে হয়েছে কেমো নিতে। ক্লান্তি আমার প্রতি রোমকূপে। চার নম্বর কেমোথেরাপির পরে পরিশ্রান্ত দেহে বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়েছি। অরু এসেছে। ব্যাংকক থেকে কি সুন্দর থাই সিল্কের চাদর এনেছে, ছোড়দির জন্য, আমার জন্য। নাতির জন্যে চকোলেট। বীরুবাবু আর শৌণকের জন্যে স্কচের বোতল। আমার জন্য একটা এক্সটা চন্দনকাঠের পাখা!
আরে? এটা নিশ্চয় ইনডিয়ারই তৈরি! একবার দেশের বাইরে গেছে, আরেকবার দেশে ফেরত এলো! বৃত্ত কমপ্লিট।
আমার সেই চিঠিটার মতন?
আমি কী বলব ভেবে পাই না।
ছোড়দি এলো চা নিয়ে।
অরু হঠাৎ বললো—ছোড়দি, রূপুকেও সঙ্গে করে নিউইয়র্ক নিয়ে গেলে কেমন হয়? ওখানে চিকিৎসা কন্টিনিউ করলে আয়ু নিদেনপক্ষে বিশ বছর বাড়বে বলে মনে হয় আমার।
ছোড়দি চমকে উঠলো।
নিউইয়র্ক? তোর সঙ্গে? বীরুবাবু কি যেতে দেবেন? শৌণকের সঙ্গে কথা বলে দ্যাখ।
যেতে দেওয়াদেয়ির কী আছে? রূপুদি কি অপ্রাপ্তবয়স্কা খুকি? গেলে যাবে, নিজের ইচ্ছেয়। চিকিৎসার জন্য তার যেখানে যাওয়া দরকার মনে হবে সেখানেই যাবে।
ছোড়দি উত্তর দেয় না।
অরুই বলে, রূপুদির পাসপোর্ট ফর্মটা প্রায় সবটাই ভর্তি করে রেখে দিয়ে যাচ্ছি, তুই ওকে দিয়ে সইটা করিয়ে, জমা দিয়ে দিস পাসপোর্ট অফিসে।
আমাকে তো বিদেশ যাবার কথা কিছুই বলিসনি তুই! কি আশ্চর্য। শুধু বম্বে যাবার কথাই তো বলছিস।
আরে এক্ষুনি তো নয়? আগে পাসপোর্টটা তৈরি হয়ে যাক। ততদিন বেশ করে বিশ্রাম করে নে। অত লম্বা ট্রিপ! শরীরে ঐ ট্রিপ সইবার মতো শক্তি হোক। আমি তোকে ঠিক এমনি চিলের মতো ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবো।
হঠাৎ সেই ছোটবেলার অরুই নুয়ে পড়ে খুব সাবধানে তার বলিষ্ঠ দুই হাতে তুলে নিল আমার হালকা, কেমোর জন্যে দুর্বল শরীরটাকে। তারপর ইজিচেয়ারে শুইয়ে দিয়ে বলল, জোলো হাওয়ায় একদম না—। ছোড়দি, জানলাটা বন্ধ করে দে। মোটে হুড়যুদ্ধি নয়, এক্কেবারে চুপ, শান্ত হয়ে থাকবি কটা দিন। এরপরে তোর রেডিয়েশনটা হয়ে যাক। কেমন থাকিস সেটা অবজার্ভ করে, ব্লাড টেস্টের রেজাল্টগুলো পর পর দেখে এর পরের কেমোথেরাপির কোর্সটা দেওয়া হোক।—এখন নিউইয়র্ক চলে যাচ্ছি। ততদিনে আবার আমার ফেরত আসার সময় হয়ে যাবে। আমি এসে ঠিক করবো তোকে কবে নিয়ে যাবো। ততদিনে ওজনটা একটু বাড়িয়ে নে। এখন তো দেখছি টেবিলফ্যান চালালেই উড়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাবি।
ছোড়দি কিছুই বললো না। আমিও চুপ।
আমার পাশে মোড়াটা টেনে এনে ঘেঁষটে বসলো পুরোনো অরু। ছোড়দি এক পলক দেখে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে অরু বলতে লাগলো, যেন মনেমনেই—
.
আবার আমার ডাল কাঁপছে
সমস্ত ডাল কাঁপছে আমার
কিন্তু বলো বসন্ত দিন
তার সঙ্গে তলিয়ে যাবার
উপায় আমার কই?
উপায় আছে রূপুদি, উপায় সবসময়েই থাকে, শুধু হাতটা বাড়াতে হয়।
আমার একটা সরু হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিয়ে অরু আস্তে গলায় উচ্চারণ করতে থাকে।
.
বাড়িটি থাকবে নদীর কিনারে চৌকো
থাকবে শ্যাওলা রাঙানো একটি নৌকো
বাড়ি ফিরে এসে আলতো ডাকবো, ‘বউ কই?’
তখন সাড়া দিবি তো, রূপুদি?
.
সময় হঠাৎ স্তব্ধ। বুকের মধ্যে শত—শত হলুদ প্রজাপতির ওড়াওড়ি—চোখে ভেসে উঠলো সেই কবেকার, জন্ম—জন্মান্তর আগেকার চেনা বাংলোটা—শাদা কটেজ, লাল টালির ছাদ, নীল রং করা জানালা দরজা—বাড়িটা বাগানের ঠিক মাঝখানে বসানো—চারিদিকে সবুজ, ধবধবে শাদা কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা, লাল সুরকির পথ, শাদা গেট, ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে ছোট নদী, রাজহাঁস ভেসে যাচ্ছে, কিছু শাদা, কিছু কালো, লাল—নীল মাছ খেলা করছে, আর তার পাশেই এখন দেখছি খোঁটাতে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা আছে ছোটো একটা নৌকো, তার গা—টা শ্যাওলায় রঙিন, ঢেউয়ের দোলায় দুলছে, দুলছে….. আমি চোখ বুজে ফেলি।
সেই বাড়িটার ওপাশে একটা হালকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন একটি সুদর্শন সন্ন্যাসী পুরুষ—পথ চিনে বাড়ি—ফেরার উপায়—হারিয়ে—ফেলা একজন খুব চেনা মানুষ—এইখানেই যেন তাঁর সঙ্গে দেখা হবার কথা ছিলই আমাদের—এই স্বপ্নের রাজ্যে। আমি তাঁকে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না।
.
উপসংহার
মিতিল? হ্যালো? হ্যালো, মিতিল?
কে রে? রূপু? কলকাতায়? নাকি বম্বে থেকেই?
কোথা থেকে বলে মনে হচ্ছে?
মমম্—কলকাতায়।
হোলো না। নেক্সট? থ্রি চান্সেস।
তার মানেই বম্বেতে। তো? কী বলল টাটার ডাক্তাররা? ঠিকঠাক তো?
এবারেও হোলো না। বম্বে না। বাট এভ্রিথিং ইজ ও কে। ডাক্তাররা বলল ছ’মাস বাদে নেক্সট চেক আপ।
বা, বা। গ্রেট! তা বম্বেতে নয় তো কোথায়? ও, বুঝেছি, লোনাভালাতে ইন্দুর কাছে গেছিস নিশ্চয়।
এটাও মিস। থ্রি চান্সেস। তৃতীয়টা?
জ্বালাসনি বাপু। কলকাতাতে নয়, বম্বেতে নয়, লোনাভালাতে নয়—তবে কি বাপের বাড়িতে? উত্তরপাড়ায়।
এটাও মিস করলি। আচ্ছা, তোকে ভালোবেসে আরো একটা চান্স দিচ্ছি না হয়—
থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না, বলেই দে কোথায় আছিস, কোন সেই মিস্টিরিয়াস লোকেশন, শুনি? লাওস? টিম্বাকটু? প্যারিস? নিউইয়র্ক? আমিও এবার ফাজিল হবো।
রাইট! নিউইয়র্ক!
ইয়ার্কি মারিস না রূপু, সত্যি কথা বল। উই আর সিনিয়র সিটিজেনস—খেয়াল আছে? ছুকরিপনা মানায় না। বুঝলি?
কিন্তু, ছুকরিপনাই তো করছি রে!
মানে?
মানে যা বলছি তাই। উই আর ইন নিউইয়র্ক। অরু আর আমি। ফলোইং ইওর অ্যাডভাইস।
ওহ নো!
ওহ ইয়েস। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? ঐ যে রোজ কতো কি ঘটে যাহা তাহা, এমন কেন সত্যি হয় না, আহা? একদম তাই! স্বপ্নটাই হঠাৎ সত্যি হয়ে গেছে।
কবে গেলি? কখন গেলি? কিছুই তো জানালি না? আশ্চর্য!
বম্বে থেকেই চলে এসেছি যে। পাসপোর্ট ভিসা অরু কলকাতায় সব রেডি করে ফেলেছিল। আমি তখনও মনস্থির করতে পারিনি। একবার কলকাতা থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ে, মনে হোলো, আর ফিরবো না। এবার নিজের জন্যে বাঁচবো, যেটুকু আয়ু বাকি আছে। অরুকে কিছুই তো দিইনি। অরু তো বিয়ে করতে চাইছে। এই ছেষট্টি বছর বয়েসে এরকম পাগলামি কেউ শুনেছে?
রিঅ্যালি? ওহ রূপু! আয়্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ! দা—রু—ণ খবর! ডক্টর হাটির মতোই ফ্যানটাস্টিক। কনগ্র্যাচুলেশনস, বোথ অফ ইউ। আমি বলেছিলাম না, ইটস নেভার টুউ লেট!
মিতিল!
বল? ডাক্তার দেখানো হোলো, নিউইয়র্কে?
হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে তো আগে? এই তো এলাম।
শৌণকদের কী বললি?
কী আবার বলব? শৌণকই তো বম্বেতে নিয়ে এসেছিল আমাকে। ও—ই আমাদের প্লেনে তুলে দিয়ে গেল। হি ইজ হ্যাপি ফর মি।
দ্যাটস গ্রেট! কী ভালোই যে লাগলো এটা শুনে! হোয়াট অ্যাবাউট বীরুবাবু?
হোয়াট অ্যাবাউট হিম?
কী বলছেন? ননদরাই বা কী বলছেন?
জানি না। জানতে চাইও না। আমি ওঁকে সব জানিয়েই এসেছি। হি হ্যাড নো অবজেকশন। শুধু বলছিলেন শৌণককেও সঙ্গে নিতে। কিন্তু তার তো প্রয়োজন নেই। শৌণকের ছুটিও নেই। অপারেশনের জন্য প্রচুর ছুটি নষ্ট হয়ে গেছে তার।
তাছাড়া ও এখন যাবেই বা কেন? তোদের দুজনের মাঝখানে, কাবাবমে হাড্ডির মতো? ওর কি নিজস্ব বুদ্ধিসুদ্ধি নেই নাকি? ও কি বীরুবাবু?
তুই বড্ড যা তা বলিস কিন্তু মিতিল।
যা তা নয়। যেটা যা, তাই বলি। ভাবছি বীরুবাবু এবারে দিদিদের বুদ্ধিতে কেস—টেস না ঠুকে দেন। তোর মেজো ননদাই অ্যাডভোকেট না?
কিসের কেস করবেন? ‘ডেজারশন’? স্বামীকে পরিত্যাগের নালিশ আনবে? আনুক না। আমি ডিভোর্স চাইবো। ‘ডেজারশন’ কি শুধু একরকমই? তার অনেক রকমফের আছে রে। এক সংসারে বাস করেও ‘ডেজারশন’ খুবই পসিবল। তুই তো জানিস সবই, মিতিল, এতগুলো বছরের লম্বা গল্প, কে কাকে ডেজার্ট করেছে।
সে তো হোলো। কিন্তু অ্যাডালটারি কেস যদি আনে? শুনেছি খুব খতরনাক কেস। লক্ষ লক্ষ টাকা খসিয়ে দিতে পারে। তুই লড়তে পারবি ওঁর সঙ্গে?
লড়াইয়ের প্রশ্ন ওঠে কেন? অ্যাডালটারি প্রুভ করা অত্যন্ত কঠিন—হাতেনাতে ধরতে হয়। বিছানার মধ্যেকার ফটো চাই! না, বীরুবাবু কেসটেস করবেন না, মিতিল, বৃথা ভাবনা করিস না। হি অ্যান্ড হিজ থ্রি সিস্টারস আর হ্যাপি। ওরা দিব্যি থাকবে। রুগণ বউটা চলে গেছে, বাঁচা গেছে। Outsider হয়েই পঁয়তিরিশ বছর কেটে গেল।
ওখানে অরুর বাড়িটা কোথায়? শহরে, না সাবার্বে? নিউইয়র্ক সিটিতেই থাকিস নাকি?
না, না, বাইরে। খুব সুন্দর একটা গ্রামে। অরুর বাড়িটা একটা সবুজ টিলার ওপরে—গেট পর্যন্ত অবশ্য গাড়ি উঠে আসে—কি সুন্দর ঝিরিঝিরি একটা ঝরনার মতন নদী এঁকেবেঁকে নেমে গেছে নীচের সবুজ উপত্যকায়।
অ্যাতো বড়ো নীল আকাশটা—চারিপাশে উঁচু উঁচু গাছের হালকা জঙ্গল—জঙ্গল নয় বনভূমি। কি যে সুন্দর। দেশের জঙ্গলের মতো আগাছায়, কাঁটাঝোপে ভর্তি নয়। খরগোশে আর কাঠবেড়ালিতে ভর্তি। ইশকুলের বাচ্চারা বনে গিয়ে খেলা করে। কুল পাড়তে যায়। দেখা যায় বাড়ি থেকে।
ওখানে বসেই তো আদ্ধেক অসুখ সেরে যাচ্ছে তোর—বাতাসে নিশ্চয়ই পলিউশান অনেক কম ওখানে। টিলার ওপরে যখন—
শুধু বাতাসেই নয়। জলে নয়। শব্দে নয়। দূষণই নেই কোথাও। শান্ত, চুপচাপ পাড়াটা। পাখির ডাক আর মাঝে মাঝে পোষা কুকুরদের ডাক—দূষণহীন জীবনযাপন।
একেবারেই রূপকথার দিনযাপন!
ঠিক তাই!
অরু কোথায়?
একটু বেরিয়েছে।
.
তারপর?
অরিন্দম ও রূপসা এখনও নিউইয়র্কে। তাঁরা রোজ বনভূমিতে হাঁটতে যান, ঝিরিঝিরি ঝোরাটার ধারে বসে পিকনিক বাস্কেট থেকে চা—পেস্ট্রিজ খান। রূপসা গান ধরেন—”এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ”… বনভূমি রোমাঞ্চিত হয়।
অরিন্দম কবিতা বলেন—
”অন্ধকারে আর রেখো না ভয়
আমার হাতে রাখো তোমার মুখ—”
.
রূপসা রোমাঞ্চিত হন।
বীরুবাবু ভালো আছেন।
রূপসা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অসুবিধে হচ্ছে না তো? ফিরে যাবো কি? বীরুবাবু বলেছেন, না না, ওখানেই চিকিৎসা চলুক। আমরা দিব্যি আছি।
ইতিমধ্যে মিতিল একটা কনফারেন্সে শিকাগো এসেছিল, ওদের কাছে ঘুরে গেছে, চট করে স্বচক্ষে পরিদর্শন সেরে নিয়েছে।
শৌণক তার বউ—বাচ্চা নিয়ে সামনের জুলাইয়ে বঙ্গসম্মেলনে যাচ্ছে নিউইয়র্কে।
ওখানে গঙ্গা নেই, কিন্তু অতলান্তিকের সৈকত আছে। অরু ঘুরিয়ে এনেছে এক উইক—এন্ডে রূপুকে সাগর সৈকতে। অরুর বিশাল বাগানে সাঁতার পুকুর আছে, নীল চৌকো আয়নার মতো জল। সামনের চেক আপটার পরে অরুর ইচ্ছে রূপুকে সাঁতার কাটতে নামাবে—গঙ্গা নাইবা থাকলো। বয়েসটাও তো ষোলো নেই।
.
অন্ত্যটীকা : একটি ইতিবাচক প্রেমকাহিনী
এই নিতান্তই অবাস্তব রূপকথাটির মুখ্য পাত্রপাত্রী দুজনেই কিন্তু বাস্তব। অন্য চরিত্রগুলি কল্পিত।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন