একটি ইতিবাচক প্রেমকাহিনী – প্রথম পর্ব

নবনীতা দেবসেন

ছোড়দি বললেই তো হলো না? আমি যাব না।

কেন রে, কেন যাবি না? অরু বলে গেছে…

বলুক গে। তুমি যাও।

তোকে ঠিক টেনে নিয়ে যাবে। দেখিস।

তুমি দেখো। আমি যাব না।

আচ্ছা মেয়ে তো? কেন যাবি না বলবি তো?

রূপু চুপ করে থাকে। দুই আঙুলে মোটা বইটার পাতাগুলোয় ফর ফর শব্দ করে বাজায়।

রাখ বইটা। নষ্ট হয়ে যাবে!

বই রেখে দেয় রূপু। কলমটা নিয়ে পুট পুট করতে থাকে।

তোর কী হয়েছে বল তো? ভারি ছটফটে হয়ে যাচ্ছিস দিনকে দিন—এক মুহূর্ত চঞ্চল না হয়ে স্থির থাকতে পারিস না?

রূপু কলম রেখে দেয়।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়।

গঙ্গার ওপরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

যা, যা, তৈরি হয়ে নে। ঐ নতুন গঙ্গাজলী ডুরেটা পর, পাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে লাল ব্লাউজ দিয়ে পরলে সুন্দর লাগবে—

আমি যাচ্ছি না।

.

.

শোন অরু—জাস্ট লিসন টু মি। পাগলামিরও একটা সীমা আছে। প্রেম করবার আগে ভেবে দেখবি নিজের বয়েসটা কত। দাড়ি—গোঁফ গজায়নি, ছেলে বিয়ে করতে অস্থির! ভ্যাট! একদম বিরক্ত করবি না বললুম। বুদ্ধিভ্রংশ আর কাকে বলে?

বুদ্ধিভ্রংশ তোরই হয়েছে রূপুদি। বয়েস দিয়ে কী হবে? প্রেম কি বয়েস মানে? তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো না রে—মরে যাবো। সত্যি সত্যি মরে যাবো।

তবে তাই যা। মরেই যা। সত্যি সত্যি মরে যা—নইলে তুই আমাকেই মেরে ফেলবি। যে জ্বালাতন শুরু করেছিস, এবার তোর একটু—আধটু মরে—টরে যাওয়াই ভালো। তোর পক্ষেও, আমার পক্ষেও। ওঃ!

ভালো তো? তাহলে মরি? মরি তাহলে? তুই বললে আমি এক্ষুনি মরে যেতে পারি—

অরু স্টুপিড দু—হাত তুলে ঝাঁপ দেবার ভঙ্গিতে পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি জানি ও সাঁতার জানে না। ভরা গঙ্গায় জোয়ারের স্রোত বয়ে যাচ্ছে—অরুটা ভিতুর ডিম, জলে এত ভয় যে নদীর ধারে বাস করেও সাঁতার শেখেনি। উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে ঝাঁপ দেবার ভঙ্গিতে। কি জানি বাবা, কোন পাগলামি ওকে পেয়েছে—হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিই আমি অরুকে।

এটা কোন পাগলামি হচ্ছিল, পাজি ছেলে? আমাকেই ঝাঁপাতে হোতো তোকে তুলতে। তোকে কি মরতে বলা হচ্ছিল? বলা হচ্ছিল বাঁচতে—এই অন্যায়, অনুচিত, অবিবেচক প্রেম থেকে বাঁচতে। তোর চেয়ে আমি তিন বছরের বড়, আমি তোর দিদি হই—তুই আমাকে রূপুদি ডাকিস—কেমন করে আমাকে প্রেম নিবেদন করছিস তুই? লজ্জা করে না?

ওমা, লজ্জা করবে কেন? প্রেমই তো নিবেদন করছি, সবচেয়ে দামি বস্তু, পৃথিবীতে সবচেয়ে মহার্ঘ বস্তু, নিবেদন করতে লজ্জা করবে কেন?

আহা ন্যাকা! জানেন না যেন কেন। তোর মুখে ”প্রেম” শুনলেই রাগে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে অরু!

তোমার প্রেম শুনলে রাগ হয়? আশ্চর্য তো! তোমাকে ডাক্তার দেখানো আশু প্রয়োজন। জগতে আর—সকলের খুব আহ্লাদ হয় প্রেম শব্দ শুনলে। সখি কেবা শুনাইল প্রেম নাম? কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ! এই রকমই তো হবার কথা তোর রূপুদি! তোর আর আমার! ছোট্ট থেকে তুই আমার প্রাণের কথা জানিস—তবু কিছুতেই বিশ্বাস করছিস না এটা সত্যি সত্যি প্রেম?

প্রেম সহ্য হচ্ছে না? বলিস কি রূপুদি? তবে কী সহ্য হবে তোর? প্রেম অসহ্য হয় এমন কথা জন্মে শুনিনি। কেন, আমার কী নেই, যা তোর আদর্শ প্রেমিকের মধ্যে দেখতে চাস? আমায় বল তুই।

শোন অরু, মন দিয়ে। কেরিয়ার তৈরি করার সময় এটা। প্রেমের সময় পড়ে আছে। আর তুই নিজের বয়েসটা একবার ভেবে দেখিস।

আরে! আজগুবি কথার কি শেষ নেই? আমি কি কেরিয়ার বাদ দিয়ে প্রেম করতে চাইছি? আমি ডাক্তারি পাশ করে লন্ডনে যাই, FRCS—টা পাস করি। ততদিন তুই মন দিয়ে কেরিয়ার তৈরি কর না। কে বারণ করেছে? তাতে প্রেম না করার কী আছে? তুমি ভাত খাবে বলে কাপড় পরবে না?

মেলা বাজে বকিস না তো। সোজা কথাটা শোন, অরু। আমি তোর প্রেমে পড়িনি। পড়বও না কোনোদিন। সিম্পল কথাটা তুই বুঝতে পারছিস না কেন? নাকি বুঝতে চাইছিস না? স্টুপিড তো নোস। তবে? তোকে আমার একদম বাচ্চা মনে হয়। প্রেমিক বলে ভাবতেই পারব না—

রূপুদি, তুই তো আমাকে জানিস। এত সহজে আমি হাল ছাড়ি না। আমার তোকে ছাড়া চলবে না। আমি মরে যাব। রূপুদি, তোকে না পেলে ঠিক মরে যাব আমি। কাল তোকে যে কবিতাটা লিখে দিয়েছি ঠিক তেমনি।

আবার সেই মরে যাওয়া? আর শোন, কবিতা—টবিতা আমাকে দিবি না একদম। কবিতা আমি পড়ি না। তুই বড্ড বোর করিস, জানিস সেটা?

শোনো রূপু, আমি বিলেত থেকে মস্ত ডাক্তার হয়ে ফিরে আসব। এসে তোমাকে নিয়ে চলে যাব। যাবই। নাথিং উইল স্টপ মি দেন। এখন আমার কোনও জোর নেই, অর্থবল নেই, বিদ্যার বলও নেই, নিজেই ছাত্র, বাবার টাকায় নির্ভরশীল—কিন্তু যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবো সেদিনই এসে তোকে নিয়ে যাবো। তুই রেডি থাকবি কিন্তু—এই তোকে ছুঁয়ে বলছি,—কথা দিচ্ছি—তোর এই জেদ আমি ভাঙবই। নইলে—

কি মুশকিল! এত উত্তেজিত হবার কী আছে? তোর বয়েস হোক, ঠিক প্রেমিকা পাবি। নাকি বড়দের সঙ্গেই প্রেম করতে ইচ্ছে? তুই ছোড়দিকে বল না? ওর ওসব খুব আসে—টাসে। ও রোমান্টিক আছে। প্রেম—ট্রেম আমার লাইন নয়। নো স্যার! নট মি।

রূপুদি….!!

অরিন্দমের মুখে কথা যোগায় না আর।

.

.

ছোড়দি, তুই আজও গিয়েছিলি, নারে?

কোথায়?

জানিস না? কোথায় যাবার কথা বলছি?

না তো?

সত্যি জানিস না? ছোড়দি, তুই মিথ্যেবাদী হয়ে গেছিস। তোকে আমার ঘেন্না করে।

রূপু, মুখ সামলে…!!

ছোড়দি মুখ থেকেও কথা বের হয় না বেশি রেগে গেলে। অরুর মতোই। ওদের দুজনের জমতো ভালো। কিন্তু বিধি উলটপুরাণ লিখে রেখেছেন। কেবল ছোড়দির রেগে গেলে চোখে জল এসে যায়,—অরুর সেটা আসে না। কী দেখেই যে অরুটা আমার প্রেমে পড়লো? ছোড়দির প্রেমে পড়তে যাচ্ছিলো, সেটাই তো বেশ হচ্ছিলো। শুধু—

ছোড়দি, তুই ও—বাড়িতে গিয়েছিলি কাল সন্ধেবেলাতে?

কে বললো?

কেউ বলেনি। আমি জানি।

কেমন করে জানিস?

হাত গুনে।

বাজে বকিস না—

তোকে দেখেই আমি বুঝতে পারি। তুই যে অন্যরকম দেখতে হয়ে ফিরিস।

ছোড়দি এবারে আর কিছু বললো না। বলতে পারল না। চোখ তুলে রূপুর দিকে তাকালো। তাকিয়েই রইল। রূপুর ভিতর পর্যন্ত দেখে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো। বাইরে রূপুর চোখ খোলা, কিন্তু মনের ভিতর দিয়ে সে খিল এঁটে রেখেছে। চোখের ফাঁকে মনের কথা গলবে না। ছোড়দি এক্সরে আইজ দিয়েও দেখতে পেল না। রূপু ছোড়দির মতো সরল নয়। সে গোপনীয়তা রাখতে পারে। ছোড়দি এত বড় একটা গোপন কাজে লিপ্ত, ও মুখে কিছুই বলে না—বাইরেও সতর্কতা অবলম্বন করে যথেষ্ট—কেউ যাতে কিছু জানতে না পারে—অথচ ওর দুটো ভাসা ভাসা কটা রঙের চোখে সব কথা বলা হয়ে যায়—ও কোথায়, কার কাছে গিয়েছিল, কিসের জন্য গিয়েছিল, গিয়ে ওর কেমন লেগেছে। যেদিন খুব ভালো লাগে, সেদিন একরকম। যেদিন তত ভালো লাগে না সেদিন চোখটা অন্যরকম।

ছোড়দি, তুই এটা চালাস না।

কোনটা?

যেটা চালাচ্ছিস। অরুদের বাড়িতে।

ছোড়দি চুপ।

কাজটা ভালো না। তোরই ক্ষতি হবে শেষটা।

ছোড়দি চুপ।

আমি বুঝি না তুই এটা করতে পারলি কেমন করে? দোষটা যদিও আমি তোকে দিই না। দোষ ওঁরই। তবু তুই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছিস না কেন? মরিব শেষ পর্যন্ত।

ছোড়দি চুপ করেই উঠে গেল। উঠে গিয়ে পশ্চিমের বারান্দায় দাঁড়ালো। গঙ্গা এখন অন্ধকার। গঙ্গা এখন কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না। শুধু শুনবে। ছোড়দি কি এখন গঙ্গাকে বলবে ওর সমস্যার কথা? আমি যেমন বলি?

আমার অস্থির অস্থির লাগছে।

ছোড়দি মানুষটা সহজ—সরল, দেখতেও খুব সাদাসিধে। সেইজন্যেই বুড়ো বজ্জাতটার খপ্পরে গিয়ে পড়েছে। আমি হলে কোনওদিনই পড়তুম না। সেও সাহস করত না।

.

.

রূপুদি তুই ‘হ্যাঁ’ বলে দে। আমার বন্ধুদের সবাইকে বলে দিয়েছি আমি এনগেজড—আমার প্রেমিকা থার্ড ইয়ারে পড়ছে—রূপুদি, তোর সঙ্গে সবাই আলাপ করতে চায়—তুই না এলে হবেই না।

কি পাগলামো করিস অরু? আমি যাবো তোদের হোস্টেলের ফেয়ারওয়েল পার্টিতে? ওরকম কেউ যায় কখনও? দূর—

যাবে না কেন, খুব যায়। বাড়ি থেকে গেস্টস আসে তো, তুই যাবি আমার গেস্ট হয়ে। স্পেশ্যাল গেস্ট। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি, রূপু আসবে। আমার প্রেমিকা—

কাকাবাবুকে নিয়ে যা।

বাবা? তুই কি আমাকে ঠাট্টা করছিস? না অপমান করছিস?

অপমানের কী আছে? অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে তো দেখি কাকাবাবুর বেশ পছন্দই!

সেকথা তোর মুখ থেকে শুনতে চাই না রূপুদি।

তাহলে কার মুখ থেকে শুনতে চাস? ছোড়দিকে বলব? তোকে বুঝিয়ে বলতে?

অরু হঠাৎ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। আস্তে করে বললো, ঠিক আছে, রূপু। যথেষ্ট হয়েছে। বেচারাকে আর এর মধ্যে টানিস না।

আমি—ই টানছি বটে। আমি মনে মনে হাসি। ছোড়দির ব্যাপারটা তাহলে সত্যিই ও জানে না? আশ্চর্য তো? একা আমিই কেবল জানি?

.

রূপু, অরন্দিম তোমাকে এইটা দিয়েছে—

কাকাবাবুর হাত থেকে খামটা নিতে নিতে আমি মুখ নিচু করে ফেলি।

এই একটা অদ্ভুত জিনিস শুরু করেছে অরু ইদানীং। কাকাবাবু যখন সকালে হাঁটতে বের হন আমার জানলাতে থেমে, আমাকে অরুর চিঠি দিয়ে যান। বেড়িয়ে ফেরার সময়ে আবার আমার জানলায় টোকা মেরে কাকাবাবু চিঠির জবাবটা চেয়ে নিয়ে যান। জবাব দেবার কী আছে? ওই খামটার মধ্যেই ভরে দিই একছত্র, কি দু’ছত্র ঠাট্টা—তামাশা।

অরুর চিঠি কাউকে দেখানো যায় না। পড়ে আবার লুকিয়ে রাখতে হয়। অত সুন্দর চিঠি তো ছিঁড়েও ফেলা যায় না। যদিও প্রত্যেকটিতে নির্দেশ দেওয়া থাকে—”পড়ার পরেই ছিঁড়ে ফেলিস”—আমি ছিঁড়ি না। আমার চাবি দেওয়া দেরাজ আছে। তিন বোনের তিনটে দেরাজ। বড়দি বিয়ে হয়ে চলে গেছে, কিন্তু তারও দেরাজ আছে। চাবি নিয়ে গেছে সঙ্গে। ছোড়দি এই চিঠি চালাচালির ব্যাপারটা নিশ্চয়ই জানে—কিন্তু উল্লেখ করেনি কোনওদিন। বাড়ির আর কেউ জানে না। ”বাড়ির আর কেউ” মানে তো মা। মা ছোড়দির খবরটাও রাখেন না। মা বড় আশ্চর্য মানুষ। তিনটে মেয়ের তো জন্ম দিয়েছেন—আমরা যে এত বড়টা হয়েছি কেমন করে কে জানে? মা তো আমাদের দিকে চেয়েও দেখেননি। ভাগ্যিস দিদিটা ছিল। ছোটবেলায় দিদি আমাদের মায়ের মতন যত্ন করত—যদিও ছোড়দিতে দিদিতে মাত্র চার বছরের তফাত। দিদি কেমন করে যেন বুঝে ফেলেছিল ওকেই বোনদের দেখতে হবে, নইলে তাদের দেখাশুনোর লোক নেই। দিদিকে কে বড় করেছিল? বোধহয় ঠাকুমা। তখনও তো ঠাকুমা ছিলেন। ঠাকুমা চলে গেছেন, ছোড়দি আমাদের সেই থেকেই গার্জেন।

মা আছেন। মা—র থাকা—না—থাকার সঙ্গে আমাদের বড় হওয়ার বিশেষ যোগ নেই। বাবার থাকা—না—থাকাটা বরং খুব জরুরি ব্যাপার। আমাদের বাবা না থাকায় প্রায়ই নানা ধরনের মুশকিলে পড়তে হোতো। বাবা যদি মারা যেতেন সে একরকম এস্পার—ওস্পার হিল্লে হয়ে যেতো। কিন্তু এ তো অন্য জাতের—বাবারা উধাও হয়ে গেলে সংসারে কারুরই সুখ থাকে না। সিঁথেয় সিঁদুর পরে, লালপাড় ডুরে শাড়ি পরে মা স্কুলে যান। শাঁখা লোহা পলা বালা সবই আছে হাতে, কপালে বড়ো করে সিঁদুরটিপও। বাবা বেঁচে আছেন, মার নিশ্চিত ধারণা। বেঁচে আছেন, কিন্তু সংসারে ফিরতে চাইছেন না। দিদির বিয়ের পরে মা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন—বাবার ছবি দিয়ে—”তোমার মনার বিয়ে হয়ে গেল, এসে আশীর্বাদ করে যাও।” কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি সে—চিঠির।

বাবার অবর্তমানে কাকাবাবুই আমাদের দেখভাল করতে শুরু করলেন আপনা থেকেই। একে প্রতিবেশী, তায় বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড এবং অত পশার জমানো ডাক্তার। আমাদের সংসারে কাকাবাবুর হস্তক্ষেপে কারুর কিছু বলার ছিল না—আমাদের একজন পুরুষ অভিভাবক দরকার ছিল।

ঠিক আঠারো বছরে দিদি সুব্রতদাকে বিয়ে করে কলকাতায় চলে গেল। কাকাবাবুকে কিছু বললো না, মাকেও কিছু বললো না, রেজিস্ট্রি করে বিয়ে। সুব্রতদা কলকাতায় চাকরি করে। দিদির হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরুনো বাকি।

একদিন সকালে উঠে মা দেখলেন দিদি নেই—মাকে চিঠি লিখে গেছে। বলে গেছে, তিন—চারদিন বাদেই ফিরবে। মা কাকাবাবুর কাছে ছুটলেন। কাকাবাবু বললেন, থানা—পুলিশ না করতে। তিন—চারদিন দ্যাখো। দিদি ফিরলো চারদিন বাদে সুব্রতদার সঙ্গে। সিঁদুর পরে। মিষ্টি নিয়ে। ঝলমল করতে করতে। কাকাবাবুর কথামতো মা অশান্তি না করে ওদের মেনে নিলেন। দিদিকে সুব্রতদার মা—বাবা আদর করেই ঘরে তুলেছেন, কানে, গলায় নতুন গয়না পরে এসেছে দিদি। পরনে নতুন বালুচরী। মায়ের জন্য প্রণামী ঢাকাই শাড়ি এনেছে সুব্রতদা। আমাদের দুই বোনের সিল্কের ছাপা শাড়ি। দিদি ফিরে গেল, কলেজে ভর্তি হোলো কলকাতায়। দিদির জীবন দিদি নিজের হাতে গড়ে নিল। সময় থাকতে থাকতে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছে দিদি। ছোড়দিটা পারলো না।

.

.

রূপুদি, তুই আমাকে কথা দে, প্লিজ রূপুদি! আমি ফিরে এসেই তোকে বিয়ে করব। ততদিনে তুই এম. এসসি. পাস করে যাবি—রিসার্চ করবি তখন—আমাকে শুধু দুটো বছর সময় দে, দেখবি তোর জন্যে কী রকম একটা জীবন এনে দিয়েছি—পড়াশুনোতে ডিস্টার্বেন্স হয়েছে বলতে পারবি না—ফিরে এসেই বিয়ে! তারপর তোকে নিয়ে আবার ফিরে যাবো—তুই ওখানে রিসার্চ কন্টিনিউ করবি, আর আমি—

এইসব হিসেবগুলো কি ফেল—করাগুলো ধরে নিয়ে? নাকি—

আরে? ফেল করতে যাবি কেন? তুই কখনও ফেল করবার মেয়ে? কী যে বলিস!

আমার ফেল করবার কথা তো বলিনি? ফেল তো তুই করবি। FRCS পরীক্ষায় নাকি আগে দু’বার ফেল করতে হয়, তারপর তিনবারের বার পাস। নিয়ম।

তোমাকে বলেছে। বুদ্ধু কোথাকার। আমি জীবনে কোনও পরীক্ষায় ফেল করিনি—বিলেতেও করব না—ফার্স্ট চান্সেই পাস করব। তুই দেখে নিস, করি কি না? আমার জেদও কিন্তু কম নয়, রূপুদি—তুই তো জানিস। আমার সঙ্গে মিছিমিছি লড়ে তুই—ই ফেল করে যাবি—যতই বাধা দিতে চেষ্টা কর, আমার তোকে বিয়ে করাটা কিছুতেই তুই আটকাতে পারবি না—

থাম থাম ঢের হয়েছে পাগলামো—

জানি, আমার নিজের কোনও জোর নেই, তাই জন্যে তো? বাবার পয়সায় খাই—পরি, বাবার পয়সায় বিলেত যাচ্ছি, তাই তো? একবার FRCS হয়ে ফিরি, তুই দেখবি—

.

ছোড়দি, তোর কি শরীর ঠিক নেই?

কে বললো?

ফের কে বললো? বলবে আবার কে? তোর চেহারা বলছে। কী হয়েছে তোর?

কিছু না।

সেই পেট ব্যথাটা আবার? বেরালগান খাবি?

ছোড়দি মাথা নাড়লো। খাবে না।

.

আমরা দুই বোন এক ঘরে পাশাপাশি শুই। আমাদের পড়ার টেবিলও একটা, দুটি চেয়ার। আমার সঙ্গে ছোড়দির বয়েসের তফাৎ দু’বছরের—কিন্তু প্রায় যমজের মতো বেড়ে উঠছি। আগে একরকমের ফ্রক হোতো, এখন একজোড়া শাড়ি হয়, তবে আমাদের রুচি এখন বদলাচ্ছে, আমি চড়া রং পছন্দ করি, ছোড়দি হালকা রং ভালোবাসে। আমি গ্রীষ্মে স্লিভলেস ব্লাউজ পরতে চাই, ছোড়দিটা কিছুতেই বগলকাটা জামা পরবে না। আর ছোড়দির জীবনেই এমন একটা গোপন কামরা তৈরি হয়ে গেল, যেটাতে আমাকেও ডেকে নিতে পারে না ও। না পারুক, আমি তো ঢুকে পড়েছি—ঢুকে পড়ে অবশ্য কোনো উপকার করতে পারিনি ওর। ছোড়দি যে জালে জড়িয়েছে তা থেকে ওকে মুক্ত করার সুযোগ ও দিচ্ছে না আমাকে। দিদি আর আমি ছাড়া ওর যে আর জগতে কেউ নেই, সেটাও তো বুঝতে পারে না ছোড়দি। দিদিকে তো কিছুই বলে না ; যদিও দিদিই একমাত্র আমাদের আশ্রয়ের ঠাঁই—দিদি আর সুব্রতদা। আমাদের স্বজন বলতে শুধু ওরাই।

মা? মা কি কখনও কারুরই স্বজন হতে পারবেন কোনোদিন? এখনও পর্যন্ত মা একদম একা, ফাঁকা, নিজেকে ঘিরেই, নিজেকে নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা। আর কাকাবাবু। কাকাবাবু? কি জানি—

ছোড়দি কথা শুনছে না।

.

.

ছোড়দি, তোর পেট ব্যথা হয়নি, তবে হয়েছেটা কী? আমার কাছে লুকোস না, খুলে বল—

খুলে বলাবলির কী আছে? লুকোচ্ছি নাকি আমি কিছু?

ছোড়দি হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলো—যেটা ওর স্বভাববিরুদ্ধ।

চুপ করে শুয়েছিল, মুখ—চোখে কালি, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সুস্থ নেই।

এবার উঠে পড়লো, আঙুলে চুলগুলো জড়িয়ে সেই মস্ত হাত—খোঁপাটা বাঁধলো, শাড়ির আঁচল, কুঁচি সব ঠিকঠাক গুছোলো, হাত কপালে ছুঁইয়ে দেখে নিল টিপ পরা আছে কি না—তারপরে বাথরুমে গেল। দরজা বন্ধ হোলো।

এত সেজেগুজে বাথরুমে?

বমিটমি করছে না তো? সেই ধ্রুপদী সমস্যাটি সৃষ্টি হয়নি তো?

ছোড়দি? বমি করছিস নাকি? ছোড়দি?

উত্তর এল না।

কান পেতে থাকি। বমির শব্দ শুনতে পাবো। বমি নয়, একটু পরে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ টের পাই, খুব চাপা, খুব অসহায়।

ছোড়দি, দরজা খোল।

উত্তর নেই।

ছোড়দি, আমাকে বল তোর কী হয়েছে। আমাকে বলতেই হবে তোর কী হয়েছে।

উত্তর নেই।

দরজায় টোকা দিতে দিতে ক্রমশ জোরে ধাক্কা দিতে থাকি আমি—

ছোড়দি, দরজা খোল, আমি তাহলে যাচ্ছি কাকাবাবুকে ডেকে আনতে—

খবর্দার না।

এতক্ষণে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল একটা।

বেরোও তবে তুমি। আর কেঁদো না। আমার সহ্য হচ্ছে না আর—আমার কথাটাও তো ভাববি ছোড়দি?

এ কথায় কাজ হোলো।

ছোড়দিটা নিখাদ ভালোমানুষ। আমার মতো চালুপার্টি নয়। আমাকে কষ্ট দেওয়াটা ওর উদ্দেশ্য নয়—এবারে বেরুবে নিশ্চয়।

কিন্তু কেন কান্না? এত কান্না কেন? লোকটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে আমার।

.

.

অরু এসে নিজে তোকে ডেকে গেল, তুই গেলি না? এত জেদ? এত বড় তোর আস্পদ্দা? সোনা আর আমি ঘুরে এলাম। দারুণ খাওয়ালো। একমাত্র ছেলে বিলেতে পড়তে যাচ্ছে, মা—বাবার কি মন মানে? আহাহা! খাওয়াবেই তো।

আহাহা!

ভেংচি কাটলি আমাকে তুই?

ভেংচি? ছিছি—ভেংচি কাটবো কেন, সমবেদনা জানাচ্ছি।

সব্বাই এসেছিল, তুই গেলি না কেন?

তোমার তা দিয়ে কী দরকার মা? আমার ইচ্ছে করেনি আমি যাইনি, ঠিক আছে?

.

বিলেতের চিঠি এসেছে বুঝি?

কেন বলো তো?

তোর হাতে নীল চিঠিটা কার?

তোমার তা দিয়ে কী দরকার?

অরু প্রথম পরীক্ষায় খুব ভালো করেছে—

তাই নাকি? আমি ভেবেছিলাম ফেল করবে।

কী যে তোর কথার ছিরি! আমি বুঝতে পারি না কেমন করে তুই এরকম কাঠখোট্টা হলি।

তোমার কাছ থেকে অন্তত নয়।

তা তা নয়ই। আমি সভ্যভব্য মানুষ।

সে আর বলতে!

রূপা, তোমার সঙ্গে কথা বলা যায় না।

বোলো না। কে বলেছে আমার সঙ্গে কথা কইতে? তোমার আর কোনো কাজ নেই? খাতা দেখা শেষ?

ভাগ্যিস সোনাটা তোর মতন নয়? সোনাও যদি তোর মতন খিটখিটে হোতো আমি গলায় দড়ি দিতুম।

সে চয়েস তোমার এমনিতেও রয়েছে।

তার মানে?

তার মানে কিছু নয়।

তুই খারাপ কিছু বলছিলি আমাকে।

না।

মনা ফোন করেছিল?

করেছিল।

কিছু বলল?

বলল।

কী বলল সেটা বলবি তো? আশ্চর্য! খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সব বের করতে হবে।—নিজে থেকেই খবরটা দিবি তো? কী বলল তোকে মনা? আসছে কবে?

শুক্রবার।

ছোটকু—পুটকুকে আনছে?

আনবে নিশ্চয়ই।

সব কথা দু’ অক্ষরে?

দু’ অক্ষরে নয়, দুটো শব্দে।

আচ্ছা রূপু? লেখাপড়ার ভালো হলে কি এতদূর অভদ্র হতে হয়? মায়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলে কেউ?

কেউ কেউ বলে, দেখতেই পাচ্ছো।

বড্ড দেমাক হয়েছে তোর। ঠাকুর তোর দেমাক ভেঙে দেবেন। জেনে রাখবি তাঁর নাম দর্পহারী। হে ঠাকুর, তুমি দেখো—

বাঃ! বাঃ! এরকম মা বলেই তো তোমার এরকম মেয়ে। যে মা বলে ”ঠাকুর যেন তোর গর্ব হরণ করেন—” সেই মায়ের সঙ্গে মেয়ে কেমনভাবে কথা বলবে? নাঃ, আমি আর পারছি না মা, excuse me, আমি উঠলুম।

সোনা কোথায় জানিস? এখনও এল না

জানি, তুমিও জানো, মা। জানো না? তবে আর ভাবনা কিসের? এসে যাবে ঠিক।

.

অরুর চিঠির নাকি উত্তর দিস না তুই?

কাকাবাবু বললেন বুঝি?

যেই বলুক। দিস? কি দিস না? সেটা বল।

মাঝে মাঝে দিই।

অর্থাৎ মাঝে মাঝে দিস না।

একদম ঠিক।

কেন দিস না?

দ্যাটস মাই প্রবলেম, নট ইওরস।

রূপু, তুই আমাকে সবসময়ে এভাবে স্নাবিং দিয়ে কথা বলিস কেন রে—?

তোমাকে আমার সবকিছু নিয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে কেন?

কেননা আমি তোর মা। আমার একটা রাইট আছে তোর কাছে কৈফিয়ত চাইবার—

আছে কি?

নেই?

না।

না?

না। নিজে নিজে ভেবে দেখো, কেন নেই। ভাবলেই বুঝতে পারবে। কঠিন নয়।

কই? মনা—সোনা তো তোর মত নয় রূপু—? আমি তো তোদের তিনজনেরই মা—ওরা তো আমাকে কথায়—কথায় এত অপমান করে না—

ওরা অন্যভাবে ভাবে। আমি সেভাবে ভাবি না। আমরা তিনজন তিনটে আলাদা আলাদা মানুষ, আমাদের চিন্তাধারা এক নয়। তুমি একজন স্কুল—টিচার, এটুকু বুঝতে পারছো না?

মা চুপ করে রইলেন।

একটু অন্যমনস্ক হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে গামছাটা পাকাতে লাগলেন। মা—র মুখখানা খুব লাবণ্যময়, নরম। মুখের চারিদিকে ঘিরে ঝিরিঝিরি উড়ছে গুঁড়ো গুঁড়ো কোঁকড়া চুল—এখনও স্নান হয়নি, আজ রবিবার, আজ স্কুল নেই। হালকা একটা শাদা—গোলাপি প্রিন্টেড শাড়ি চটকে—মটকে পরে আছেন। মাকে দিদির বড় বোন মনে হচ্ছে। আমার খুব মায়া হোলো হঠাৎ।

চান করতে যাচ্ছো?

মা—র অন্যমনস্কতা কাটলো।

হ্যাঁ, যাচ্ছিলুম। শ্যাম্পুটা তোদের বাথরুমে?

বোধহয়। ছোড়দি বোধহয় এনেছিল। দেখছি।

বাথরুম থেকে শ্যাম্পু নিয়ে এসে দেখি মা সেই একইভাবে চুপচাপ বসে আছেন, গামছাটা পাকাচ্ছেন।

এই যে। শ্যাম্পু।

মা হাত বাড়িয়ে বোতলটা নেন। উঠে পড়েন মোড়া থেকে। কোনও কথা না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।

মাঝে মাঝে মায়ের জন্য মায়া হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, মানুষটা হয়তো ততটা খারাপ না।

মাঝে মাঝে মনে হয়, মা—ও হয়তো পরিস্থিতির শিকার।

ছোড়দিরই মতন।

মা কি নিষ্ঠুর?

নাকি নির্বোধ?

না বোধহীন?

আজ আমাদের জীবনটা যেরকম হয়েছে, সেটা মায়ের জন্যই। বাবার জন্য নয়।

হঠাৎ হঠাৎ বুকের মধ্যে পাক দিয়ে দিয়ে ব্যথা করে আমার।

বুঝি না কার জন্য।

.

অরুর ফাইনালের FRCS রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে—শুনেছিস? স্ট্যান্ড করেছে বলে মনে হচ্ছে। সোনার মেডেল পাবে বোধহয়।

ইস দারুণ খবর!

তোমাকে অরু একটা পার্সেল পাঠিয়েছে। তোমার জন্মদিনের উপহার বোধহয়।

আপনাদের ঠিকানায়?

আমাদেরও কিছু জিনিস পাঠিয়েছে তার সঙ্গে, ওর এক বন্ধুর হাতে—সে দেশে এসেছে—

অরু ফিরে এল না কেন?

ও একটা চাকরি পেয়ে গেছে কিনা? ক’দিন চাকরিটা করবে বলছে, একটু টাকা জমিয়ে দেশে চলে আসবে—

অরু চাকরি করছে? বিলেতে? বাঃ—

এই তো এ মাসেই ধরেছে কাজটা, ইস্ট লন্ডনের একটা হাসপাতালে—একটু রোজগারপাতিও হবে, এক্সপিরিয়েন্সও হবে—আমিও বললুম কাজটা করাই ভালো—

আমাকে কিছু লেখেনি তো অরু?

তোকে বলে কী লাভ? তুই কি ওর চিঠিগুলোর জবাব দিস?

হঠাৎ মা বকে ওঠেন।

কাকাবাবু একটু অবাক হন বোধহয়।

দাও না উত্তর? অরুর চিঠির?

মাঝে মাঝে দেওয়া হয় না। লজ্জিতই হই।

এবারে চিঠি দিও। এত সুন্দর গিফট পাঠালো। পেয়েই ওকে জানিও।

কী ”এত সুন্দর গিফট?” আপনি জানেন?

নাঃ, ওই ছেলেটি জানে তো, ও বলছিল। গিফট প্যাক করা আছে, তাই আমি র‍্যাপিং খুলিনি। বিলিতি র‍্যাপিং পেপারগুলো পর্যন্ত এত আর্টিস্টিক হয়। ছিঁড়তে মায়া লাগে।

কাকাবাবু একবার মা’র দিকে, একবার ছোড়দির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মা আর ছোড়দিও হেসে কাকাবাবুকে মদত দেন। কাকাবাবুর হাসিটায় বেশ একটা টান আছে।

রঙিন কাগজে প্যাক করা উপহার বেরুলো এবার। কী আছে? কী আছে?

একবাক্স সুইৎজারল্যান্ডের রুমাল—সুইস কটনের ওপর লেস আর এমব্রয়ডারির কাজ। হালকা হালকা রং—নীল, হলুদ, গোলাপি, সবুজ, মভ, শাদা—ছয় রঙের বারোটা। আর আছে একটি রুমাল রাখবার থলি—গোলাপি স্যাটিনের ওপরে শাদা লেস আর আকাশ—নীল আর শাদা রং দিয়ে এমব্রয়ডারি।

হৃদয়াকৃতি থলিটি সত্যি খুব সুন্দর। হঠাৎ খেয়াল হোলো, তার ওপরে নাম লেখা আছে। RUPA! আর একবাক্স সুইৎজারল্যান্ডের চকোলেট। সেই থলিতে ভরা।

চকোলেটের বাক্সটা খুলে আমি সকলকে ভাগ করে দিই।

ই—স। কি ভালো দেখতে বাক্সটা! মা চেঁচিয়ে ওঠেন। মা—র যেমন স্বভাব। বাক্স দেখেই মুগ্ধ। ভিতরটা দেখতেই পান না। ছোড়দির জন্যও অরু গিফট পাঠিয়েছে। সুন্দর একটি ছোট্ট প্লেট, ফুলকাটা—পোর্সিলেনের একটা পুতুল আঁটা আছে তাতে।

সত্যি, অরুটা পারেও বাবা! সক্কলের জন্যে নামে নামে উপহার! উঃ! মা বলেন ছদ্ম কোপে!

মা মনে মনে দুঃখ পাচ্ছেন, কেন তাঁর জন্যেও অরু কিছু পাঠাল না। কি ভাগ্য সে—কথাটা সর্বসমক্ষে বললেন না।

মা বড্ড লোভী। ছোট জিনিস নিয়েই মা সুখী থাকেন। লোকটা তার পূর্ণ সুযোগ নেয়। লোকটাকে আমি সহ্য করতে পারি না।

ঐ চকোলেটটা সকলেরই জন্যে, নিশ্চয়ই একা রূপুর জন্যে নয়। ওটা তোমার আমার সবার।

লোকটাও দেখছি মাকে চেনে। মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মা নিজে ওর জালে জড়িয়েছেন আপাদমস্তক। ছোড়দিও নিস্তার পেল না।

আমাকেই শুধু রেয়াত করেছে লোকটা। বোধহয় অরুর জন্যে। অথচ আমি ওর চেয়ে আড়াই বছরের বড়। অরুটা যে কেন এমন করছে? ও বোঝে না যে আমি ওর প্রেমে পড়ব না। আমি প্রেমেই পড়ব না। কোনওদিন না।

.

ছোড়দি তুই অত কাঁদছিলি কেন রে সেদিন? কী হয়েছিল? আমাকে বল—

ছোড়দি বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো।

কী বলব?

কী হয়েছিল বল।

বিনুনি বাঁধার আঙুলগুলো স্থাণু হয়ে যায়। চুলবাঁধা স্থগিত রেখে ছোড়দি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমাকে না বললে তুই কাকে বলবি ছোড়দি? এত বড় ব্যাপারটা ঘটছে, তুই ভাবছিস কেউ কিছু টের পাচ্ছে না? কাকিমা কিছু বলেন না, কাকিমা আর কী বলবেন, ওঁর তো এসব সহ্য হয়ে গেছে। এই তো প্রথমবার দেখছেন না।

ছোড়দি বিস্ফারিত নেত্রে আমার কথা গিলতে থাকে।

কাকিমা ঐ ঠাকুরঘরেই একদিন মুখ গুঁজে মরে পড়ে থাকবেন, দেখিস। ওই ঘরই ওঁর একমাত্র আশ্রয়!

কাকিমা না হয় সইতে পারছেন, তাঁর স্বামীর স্বভাব—চরিত্র তাঁর জানা, কিন্তু মা? মা কেমন করে সহ্য করছেন?

কাকিমাকে তবু বুঝতে পারি। বেচারা এই বয়সে বিদ্রোহ দেখাতে চলে যাবেন কোথায়? শুচিবাই আর ঠাকুরঘর নিয়ে পড়ে আছেন। জীবন্মৃত মানুষ। কিন্তু মা—র তো চাকরি আছে। নিজস্ব সংসার আছে। আমরাও আছি। তবে কেন? ছোড়দিই বা কেমন করে, সবকিছু জেনেশুনেও—?

লোকটা কি জাদু জানে?

একটা ছবি টাঙানো আছে আমাদের বসার ঘরের দেওয়ালে।

বাবার ছবি।

কিন্তু সেই সুপুরুষ বাবার ছবিতে আমরা কেউ কখনো ফুলচন্দন দিই না, ধূপদীপ জ্বালাই না।

মা—র ধারণা তাতে বাবার অমঙ্গল হবে।

বাবা তো বেঁচে আছেন।

লুকিয়ে আছেন।

চম্বলের খাদে, তরাইয়ের জঙ্গলে, হিমালয়ের শিখরে—

বাবা হাঁটছেন—

বাবা পালাচ্ছেন—

একদিন ফিরবেন। মা—র শাঁখা—সিঁদুরের টানে। নিরাপদে।

.

কিন্তু কেন এই পলায়ন?

কেন এই লুকিয়ে থাকা?

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে—কী তাঁর অপরাধ।

মা বলেন,—জানি না তো? বোধহয় আপিসেরই কিছু গোলমাল, অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন তো?

তো? তো কী? চোরও ছিলেন কি?

মাকে প্রশ্নটা করিনি।

.

দিদি, তুই জানিস, বাবার কী হয়েছিল? বাবা কি ‘ফেরার’? সুব্রতদাকে কী বলেছিস?

দিদি একটুও ঘাবড়াল না।

যা জানি, যা সত্যি বলে জানি, তাই বলেছি। বলেছি, বাবা বাড়ি থেকে চলে গিয়েছেন। কেন গিয়েছেন তা আমরা কেউ জানি না।

সুব্রতদা মেনে নিল?

মানবে না? তো কী করবে?

মা যে বলেন, অফিসের কোনো গোলমাল থেকে হয়তো পালিয়েছিলেন—ক্যাশবাবু ছিলেন। তুই সেটা বলিসনি?

আমি আট বছর বয়েস পর্যন্ত বাবাকে দেখেছি। বাবা চুরি—জোচ্চুরি করে ভেগে পড়বার মতো মানুষ ছিলেন না। মা যাই বলুক।

তাহলে লুকিয়ে আছে কেন? তোর বিয়ের নোটিস পড়েও ফিরলো না কেন?

পড়েননি হয়তো।

ফোন করে না কেন? চিঠি দেয় না কেন? সম্পর্ক তুলে দিয়েছে কেন নিজের পরিবারের সঙ্গে? দিদি, তুই বিশ্বাস করিস, বাবা বেঁচে আছে?

দিদি মাথা নাড়লো। না।

বিশ্বাস করে না।

তবুও আমি বলি, তোর কি মনে হয় বাবা ফিরবেন?

ধুর!

মানে, বাবা মারা গেছেন বলেই তোর বিশ্বাস?

আমাকে এরকম জেরা কচ্চিস কেন রে রূপু? তোর হোলো কী?

আমার আজকাল মাকে খুব খারাপ লাগে।

দিদি চট করে পর্দার দিকে তাকায়—কেউ শুনলো না তো? তারপর আমার পিঠে হাত রেখে আদর করে বললো—

ওসব বলতে নেই রে রূপু। অন্য কথা ভাব। তোর পড়াশুনোর কী খবর?

মা কেবল নিজেকে সধবা রাখবেন বলে বাবার মৃত্যুটা স্বীকার করতে চান না।

থাক না ওসব কথা!

আর কতকাল থাকবে রে? একটা তো closure চাই? বাবা মারা গেছেন এটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, লোকেরা পিতৃহীন হয়। কিন্তু বাবা হারিয়ে গেছেন? এ কখনো হয় নাকি? ব্যাপারটা সহ্য করা কঠিন।

কিন্তু বাবারা চলেও যায়। প্রায়ই তো দেখি—দেখি না? স্বামী—পরিত্যক্ত সব মেয়ে—

হ্যাঁ, দিদির কথাও ঠিক, স্বামী—পরিত্যক্তা মেয়েদের দেখি বইকি, মাথায় সিঁদুর, কোলে—কাঁখে বাচ্চা, পথেঘাটে, বস্তিতে এদের দেখি। গরিবঘরে দারিদ্র্যের চাপে এসব হয়—মধ্যবিত্ত ঘরে হয় নাকি?

ক’জনকে চিনি আমরা, যার বাবার কোনও খোঁজ নেই? বিচ্ছেদ এক, আর নিপাত্তা হওয়া আরেক। মিলিটারিতে ছাড়া, নিখোঁজ সুস্থ মস্তিষ্ক। অ্যাডাল্ট কিন্তু খুব রেয়ার।—মুখে বলি, বাবার মৃত্যুটা স্বীকার করে নিলেই পারতেন মা—আমাদের অনেক সুবিধে হোতো।

দিদির কোলে টুকলু। দিদি টুকলুর মাথায় চুমু খেয়ে বলে,—

ধ্যাৎ! বাবার মৃত্যুকামনা করতে হয় না।

মৃত্যুকামনা আবার কী? মৃত মানুষের মৃত্যুকামনা করা যায়?

না, তা বলছি না, আসলে—

তবে কী বলছিস, কার সঙ্গে ভদ্রতা করছিস? মরা মানুষকে মরা বলায় দোষ নেই রে দিদি—মরা মানুষকে জ্যান্ত বলাতেই দোষ। আমাদের জীবনে একটা বড় হাঁ—করা গর্ত রয়ে গেল, যা মৃত্যুসংবাদে বুজে যেত।

উল্টোদিকটাও ভাব—বাবা যদি কোনোদিন, সত্যি সত্যিই—

দিদি রে, ইউ আর আ ড্রিমার! মা কিন্তু তা না! মা এক্কেবারে ডাউন টু আর্থ, টোটালি সেলফ সেন্টারড—আর মার চরিত্রে কোনো স্ক্রুপলস নেই। মা সবকিছু পারে।

বা, বা, কী চমৎকার কথাবার্তা—তোর হোলো কী রূপু?

বললাম তো, মাকে একদম ভালো লাগছে না—ইন ফ্যাক্ট আই থিংক আই হেট হার।

নতুন করে এই ভাবোদয় কী কারণে? মা তো এরকমই।

ছোড়দির কথাটা ভাবিস?

মানে?

শ্বশুরবাড়িতে থাকিস বলে কিছুই কি খোঁজ রাখিস না তুই?

সোনা ক্লাসে যায় না?

আঃ, ক্লাসে যাবে না কেন।

তবে? মা ওর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন?

দিদি, তুই কি সত্যি সত্যি কিছু জানিস না? তাহলে থাক। এসব না জানাই ভালো। পালিয়ে বেঁচেছিস।

প্রেম করছে নাকি? আবার? কি এনথু মেয়েটার! এবারে কার সঙ্গে?

যাক গে যাক ছেড়ে দাও।

এতদূরে বসে বসে এই যে তোকে একের পর এক চিঠি লিখি, তুই কি কিছুতেই আমার মনটা বুঝতে চাইবি না রূপু? আমার পরীক্ষা শেষ হলেই ফিরব বলেছিলুম। পরীক্ষা শেষ হোলো, রেজাল্ট অতি উত্তম হোলো। এবার ভাবছি আরেকটা ডিগ্রি করে ফেললে কেমন হয়? তেমন কিছু স্ট্রেনুয়াস নয়। যাওয়া—আসায় অনেক খরচ, কী দরকার ফিরে, যেতে—আসতে জাহাজে সময়ও অনেক লাগে—তাই ডিগ্রিদুটো বগলে নিয়েই দেশে ফিরব। তোকে বিয়েটা করে নিয়ে আবার ফিরে আসব, এখানে কিছুদিন চাকরি করার প্ল্যান করছি। এই যে এখন পরীক্ষার পরের ক’মাস হাসপাতালে চাকরি করছি—অনেক ধরনের কাজ শিখছি, অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরছে, ডাক্তারিতে এইটে খুব জরুরি। অভিজ্ঞতা। আর অবশ্যই আরও দুটি বস্তু চাই—বিবেক এবং মমতা। Sorry, বেশি বিবেকানন্দ টাইপের হয়ে যাচ্ছে? তুই বলবি, সবচেয়ে আগে চাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে পারদর্শিতা। সেটা তো বলা বাহুল্য। কিন্তু পারদর্শিতা is not enough, বুঝলি? Conscience না হলে ঐ পারঙ্গমতা কোনও কাজে লাগে না। আর যতই Conscience থাক, এবং পটুত্ব থাকুক, ডাক্তারিতে চাই মানুষের প্রতি দরদ।—আমি বিদেশে না এলে অনেক কিছুই জানতে পারতুম না রে, রূপু। (চিঠিতে তোকে দিদি বলব না।) দেশে বসে বসে বিদেশ বিষয়ে কত কীই তো ভাবি আমরা।

বাই দি ওয়ে, তোর মনে আছে তো, তুই যে বলেছিলি তিনবারের বার FRCS পাশ করব,—আর আমি বলেছিলুম, বাজি! ফার্স্ট চান্সেই বেরিয়ে যাব—কার কথা ফললো? যেটা বাজিতে ধরা হয়নি, সেটা ঐ সোনার মেডেলটা! তোকেই দেব, হারের মধ্যে লকেট পরবি, আর লজ্জায় মরবি।

রূপু রে, তোর জন্যে ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ বেশি মন কেমন করে।

এখানে বাঙালিরা খুব গানবাজনা করে। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় এক বন্ধুর বাড়িতে ডিনার ছিল, এই আমরা যারা পাস করলুম, একটু খাওয়া—দাওয়া, হইচই আর কি, তখন ওই গানটা গাওয়া হোলো—বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলে—শুনেই আমার কার জন্যে মন কেমন করে উঠলো বল তো? এই গানটা তোর জন্যে লেখা, তোর আর আমার জন্যে। তোকে কতবার শুনিয়েছি বল তো? ছোড়দি কি গানটান গাইছে? ওর খবর কী? পরীক্ষার পরে সাতদিন সুইৎজারল্যান্ডে ঘুরে এলুম—জেনিভা, জুরিখ, লুসার্ন, ইন্টারলাকেন—তোর জন্যে চকোলেট, আর রুমাল পাঠালুম। আরেকটাও উপহার এনেছি তোর জন্যে। সেটা হাতে করে নিয়ে যাব। এখন বলব না কী জিনিস! বিয়ের সময়ে তোকে দেব।

রূপু, আমাকে একটা লিস্ট পাঠাবি, বুঝলি? কী কী চাস। মনে মনে ভেবে ভেবে রোজ একটু একটু করে লিখে রাখবি। আমি তো জানি না মেয়েদের কী কী লাগতে পারে। তোর জন্যে দোকানসুদ্ধ উজাড় করে সবকিছুই নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে—হীরেমুক্তোর গয়না, কাচের বাসন, রেডিও, রেকর্ড—প্লেয়ার, এখন হাই—ফাই বলে একটা নতুন হাইফিডেলিটি রেকর্ড—প্লেয়ার বেরিয়েছে (গ্রুনডিগ টেপরেকর্ডার একটা কিনে ফেলেছি তোর জন্যে, আর একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা আমার জন্যে)—কত কিছুই যে আধুনিক যন্ত্রপাতি বেরিয়েছে জীবন সম্ভোগ করবার জন্যে। এখানে তো টেলিভিশনও আছে—কিন্তু ঈশ্বর জানেন দেশে টেলিভিশন আসতে আসতে এখনও কত বছর লাগবে!

রূপু, ছেলেবেলায় বিলেত বলতে আমরা কী যেন ভাবতুম—এসে অবধি একটা অন্য বিলেত পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে। তোকে তো সবই লিখেছি। সব বিস্ময়, সব বিষাদই তোকে জানিয়েছি। আমি তো জানাই—কিন্তু তোর কাছ থেকে চিঠি এতই কম আসে, আমার মনপ্রাণ সদা সর্বদা তৃষিত হয়ে থাকে। আমার জন্যে তোর মন কেমন করে না, রূপু?

তোর মতন গুছিয়ে বাংলা লিখতে পারি না বলে তোকে বোঝাতে পারি না তুই আমার কাছে কী! যতদিন না তোকে সঙ্গে করে এদেশে নিয়ে আসতে পারছি, এখানকার সব দৃশ্য, সব শব্দ, সব স্বাদ তোর সঙ্গে ভাগ করে না নিতে পারছি ততদিন আমার এই বিলেতে আসাটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আমার আধখানা এখানে এসেছে আর আধখানা তোর ঘরের সামনে, ওই পেয়ারাগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আছে। তুই সকাল—সন্ধেয় আধোফোটা আলোয় আর আধোফোটা অন্ধকারে যদি তাকাস, আমাকে দেখতে পাবি। রাত্তিরে পাবি না। তখন আমি হাসপাতালে ব্যস্ত খুব, কাজকম্মো নিয়ে ডুবে থাকি। বাড়ির কথা মনেই থাকে না তখন। আর তাছাড়া আমি তো ভূত নই, জীবন্ত মানুষকে অমন রাতের অন্ধকারে দেখতে পাওয়া যায় না। শুধু ঐ দিবা—নিশির মিটিং—পয়েন্টে (‘মিলনলগ্নে’ কথাটা বড্ড বেশি ন্যাকা ন্যাকা) স্বপ্নেরা সত্যি হয়ে দেখা দেয়। অর্থাৎ দিবাস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। তুই মন দিয়ে আমাকে দেখতে চাইলেই দেখবি পেয়ারাগাছের আলো—ছায়ার মধ্যে অরু দাঁড়িয়ে আছে। তোর জন্যে। হাতে কী থাকবে বল তো? পাকা তেঁতুল? না বকুলফুল? তোর কাছে তো দুই—ই সমান আদরণীয়।

ওহো, আদরের প্রসঙ্গে মনে পড়লো, কতদিন আদর করা হয়নি তোকে। ভুলেই গিয়েছি কেমন করে আদর করতুম, তোর সঙ্গে যুদ্ধু করতে করতে।

আচ্ছা সত্যি করে বল তো রূপু—কেন তুই অমন গায়ের জোরে বাধা দিস আমাকে? কেন চিঠির পর চিঠি লিখলেও চুপচাপ বসে থাকিস?

তুই কি ভাবিস এ থেকে আমি ধরে নেব যে তোর মুখের কথাগুলোই ঠিক, আমাকে তুই ভালোবাসিস না। দু’বছরটা এতই কি তফাত রে? জীবনে একদিনও তোর মুখ থেকে কথাটা বের করতে পারিনি আজ পর্যন্ত—যে তুই আমাকে ভালোবাসিস—নাই বা বললি, না হয় তুই তোর হাড়কেপ্পন স্বভাবটাই প্রেমের ক্ষেত্রেও চালু রাখলি। তা বলে আমি কি নির্বোধ? যে তোর মুখের কথাতেই বিশ্বাস করব? তোর মিথ্যেবাদী জিব যাই বলুক, চোখ দু’খানা তো মিথ্যে বলতে পারে না?

তাই আমি জানি, রূপু আমার। রূপু আমার জন্যে বসে আছে। রূপু, তুই আমার জন্যে বসে থাকিস কিন্তু। কাকীর কিংবা আমার পিতৃদেবের কোনও প্ররোচনায় কান দিয়ে ফেলিস না যেন? ওদের বিশ্বাস নেই। আজ ভালো ভালো কথা বলছে, কালই দেখবি উলটো গাইছে। ওদের ভরসা মানেই পদ্মপাতায় জল।

ছোড়দির খবর বহুদিন পাই না। কী করছে সে এখন? দিদির খবর কী? দিদিরা কি এখন মাদ্রাজে ট্রান্সফার হয়ে গেল? মানে সুব্রতদা কি মাদ্রাজে ট্রান্সফার নিলেন? দিদি তাহলে কাজ করবে কোথায়? নাকি করবে না? না, ওখানে গিয়ে কাজ খুঁজবে? মেয়েদের এই এক ঠেলা, সত্যি। বরের ট্রান্সফার হোলো, তো ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বরের সঙ্গে যাও। কেউ বরকে কেন বলে না, রেঁধে বেড়ে খেতে, নিজের কাজ নিয়ে, স্বস্থানে সুস্থির হয়ে মেয়েরা চেপে বসে থাকে না কেন, বুঝি না। অবশ্য স্কুলের অঙ্কের টিচার সর্বত্রই কাজ করতে পারে। দিদি যদি বাংলার দিদিমণি হোতো, কাকীর মতো, তাহলে মুশকিলে পড়ত। দিদি আসে—টাসে?

আমার মায়ের কথা মাঝে মাঝে একেবারেই যে মনে পড়ে না তা নয়। ঐ মহিলাকে আমার ভালো করে চেনাই হোলো না। কেবল ঠাকুরঘর, আর ছোঁয়ান্যাপা করেই জীবনটা একা—একা কাটিয়ে দিলেন। নিজের স্বামী, নিজের সন্তান, এদেরও যে ছোঁওয়া অপবিত্র হতে পারে—সেটা এই উন্মাদ মহিলাকে না দেখলে বুঝতুম না! সারা জীবন ভিজে গামছা পরে, অর্ধনগ্ন হয়ে, হাতে—পায়ে হাজা নিয়ে হপ্তায় চারদিন উপোস করে কেমন করে যে আস্ত একটা মানুষ বেঁচে থাকতে পারে—নিজের ছেলের খাওয়া হোলো কি না, (স্বামীর কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি) সেটাও যাঁর দেখবার সময় হয় না ঠাকুরঘরের দেবদেবীর সংসার নিয়ে ব্যস্ততায়—

তুমি কিন্তু ওরকম হবে না।

আমার রূপু, তুই খবরদার ওদের মতো হবি না। তোর মায়ের মতোও নয়, আমার মায়ের মতোও নয়। বইতে লেখে, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।—আমি দেশেই জানতুম প্রথমটা সত্য নয়। দ্বিতীয়টাও সত্য কি না সন্দেহ হোতো মাঝে মাঝে। জন্মভূমি যে জননীর চেয়ে ঢের বেশি নির্ভরযোগ্য, ঢের বেশি জোরের জায়গা—এখানে এসে মর্মে মর্মে টের পাই সেটা। কাজ ফুরোলেই দেশে ফিরে যাব। তোর কাছেই ফিরে যাব। তুমি অপেক্ষা করে আছো তো রূপুদি?

.

রূপুদি!

তুমি নাকি চুল কেটে ফেলেছ? ঘাড় পর্যন্ত নয়, একেবারে ছোটো, বয়জ কাট? রূপুদি! তোমার অত সুন্দর, অমন সিল্কের মতো চুলগুলো তুমি কেমন করে কেটে ফেললে? আমি ফিরে আসছি সেটা বুঝি তোর মনে নেই? আমার যে মনে কষ্ট হবে, বুক ভেঙে যাবে তোর বয়জ কাট চুল দেখে, সেটা একবারও মনে হোলো না তোর? বুঝেছি চুলটা কেটে ফেলবার আগে আমার মুখখানা তোর চোখে ভেসে ওঠেনি—তুই কি সত্যি সত্যিই তাহলে আমাকে ভালোবাসিস না—আমি কি সত্যি সত্যি ভুল ভেবে বসে আছি সারা জীবন? আমার জীবনে তুই—ই প্রথম মেয়ে—আমার জীবনে তুই শেষ মেয়ে।—রূপুদি, তুই সেই দিনটাকে যতই অস্বীকার কর, আমি তো ভুলতে পারি না! মেঘ জমলে, বৃষ্টি পড়লেই আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। সেই দিনটাতে তুই আমাকে ভালোবেসেছিলি, সেই দিন থেকে আমি বড়ো হয়ে গেলুম।

.

এই দেশটা সবসময়েই মেঘলা রে রূপু, সবসময়ে বৃষ্টি—বৃষ্টি, সবসময়ে মনকেমন, সবসময়ে তোর কথা। শীত করলেও তোকে মনে পড়ে, আর যেদিন রোদ্দুর ওঠে, হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে দেশসুদ্ধ লোক আহ্লাদে মেতে ওঠে, আমার আবার সেই তোরই জন্যে কান্না পায়। ভাগ্যিস এত পড়াশুনোর চাপ, ভাবনার সময় পাই না, মনকেমনকে প্রশ্রয় দিতে পারি না। যেই একটু ফাঁক পাই, অমনি সেই ফাঁকটুকু দিয়ে তুই ঢুকে পড়িস। রূপুদি, আমার রূপু সোনা, (ছোড়দি নয়!)—আমাকে তুমি গ্রহণ করবে তো, আমি কিন্তু তোমার জন্যে, শুধুই তোমার জন্যে জন্ম নিয়েছিলুম। ভুলে যেয়ো না, আমার জীবনে তুমি ছাড়া ভালোবাসার কোনো আধার নেই। রূপু, তোমার ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের খবরে আমি ভীষণ গর্বিত হয়েছি। তুমি ফেলোশিপ নিয়ে কলকাতায় রিসার্চ করছো, মেয়েদের হস্টেলে একা—একা থাকছো, আমি এখান থেকে মনে মনে সব দেখতে পাই—তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ কুঁচকে ঘড়ি দেখছো, স্নান করছো, চন্দন সাবান মেখে (তোমার জন্যে এখান থেকে খুব সুন্দর সুগন্ধী সাবান নিয়ে যাব, তোমার প্রিয় মলয় চন্দনের চেয়েও সুন্দর), শাড়ি পরছো, সবুজপাড় হলুদ শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ (নাকি সেই কালোপাড়, বেগুনি শাড়িতে কালো ডুরে, কালো ব্লাউজ?) লম্বা বিনুনিটা বাঁদিকে বুকের ওপরে দুলছে, কাঁধে ঝোলা, হাতে ঘড়ি, পায়ে অল্প হিলতোলা চটি—কপালে ছোট্টো কালো টিপ—তুমি অচেনা ট্রামস্টপে দাঁড়িয়ে আছো। রূপুদি, আমি তোকে সবসময়ে দেখতে পাই—তুই কী করছিস সব জানতে পারি, তুই আমাকে ফাঁকি দিবি কেমন করে?

সেই বৃষ্টির দুপুরে তোর খোলা নরম চুলের মেঘের মধ্যে আমাকে তুই ঢেকে নিয়েছিলি—আমি আর মাটির পৃথিবীতে ছিলুম না—তোর চুলের সেই মিষ্টি গন্ধ আমার মুখে—বুকে আজও জড়িয়ে আছে। রূপু, তুই জানিস না তোর চুলগুলো আমার কাছে কী! ওই মেঘের মতো একরাশ চুল, চুল খুলে দাঁড়ালে তোকে মা সরস্বতীর মতো দেখাতো—সেই চুল কেটে—কুটে সর্বনাশ করে ফেললি তুই? তোর মায়া হোলো না রে?

জানিস রূপুদি আমার কেমন ভয়—ভয় করছে। আমি তো ভীষণ মায়ায় জড়ানো মানুষ—তোর এত মায়া কম এতদিন তো সেটা টের পাইনি?

কেমন লাগছে কলকাতায় বাস? তুই কলকাতায় গেলি, দিদিরাও মাদ্রাজ চলে গেল—ভেরি ব্যাড টাইমিং। দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারতিস।

ছোড়দি কেমন আছে? ও কি শুধু গানের স্কুলের চাকরিটাই করছে? না বালিকা বিদ্যালয়েও গানের দিদিমণি হতে পেরেছে? কাকিমা একটু চেষ্টা করলেই ওটা হয়ে যেত। ছোড়দির বিয়ে—থার কিছু হোলো? কাকিমাও তো ক্ষেপী—বিয়ে—টিয়ের কথা হয়তো ভাববেই না। পাছে বাড়ি খালি হয়ে যায়? রূপু, তুই ছোটো বটে, কিন্তু তোরই একটু জোর করার শক্তি আছে—ছোড়দির একটা বিয়ের চেষ্টা কর। আমাদের বিয়ের আগেই যদি ছোড়দিটার একটা বিয়ে হয়ে যেত, সব দিক দিয়ে ভালো হোতো। আমার যে—বন্ধুটার হাতে তোদের গিফট পাঠালুম সেবারে, সেই প্রবীরবাবু খুব ভালো মানুষ। বাবাকে বলছি ছোড়দির সঙ্গে প্রবীরের সম্বন্ধ করুক। দেখতে প্রবীর উত্তমকুমারের মতো না বটে (সবাই তো অরিন্দম হয় না) কিন্তু অত্যন্ত সৎ ছেলে। ছোড়দিকে খুব যত্নে রাখবেন। একটা দেখাশুনোর বন্দোবস্ত করাচ্ছি। দাঁড়া, বাবাকে লিখছি। প্রবীর তো ইনারটেম্পল থেকে বার—অ্যাট—ল করে দেশেই প্র্যাকটিস শুরু করবেন। সুপাত্র বলতে যা বোঝায় একদম তাই। ওঁর বাবা সরকারি চাকরি থেকে সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। (অরিন্দমের মতো ভালো না হলেও) প্রবীর সত্যিকারের গুডবয় রে, গুডি গুডি বয়। ছোড়দি বর্তে যাবে! এত কেন ভাবছি ছোড়দির বিয়ের জন্যে? পুরো সেলফিশ কারণে। ছোড়দি আইবুড়ো থাকলে তোর মা হয়তো আমাদের বিয়েটা দেরিতে করতে বলবেন। দুটো বিয়ে এক—সঙ্গেই হয়ে যেতে পারে এক্ষেত্রে। আমি বাবাকে লিখছি। তুইও কাকিমাকে বল।

.

রূপু, চুল তো জীবন্ত বস্তু, তার বৃদ্ধি আছে। তুমি আর চুল কাটবে না। স্বপ্নও জীবন্ত বস্তু, তারও বৃদ্ধি আছে—তুমি স্বপ্ন ছাঁটাই করবে না! এই আমার আদেশ—আমার অনুনয়ও বলতে পারিস—রূপুর চুলে আর কাঁচি ঠেকানো চলবে না, চলবে না—আমি ফিরে যেন দেখি মা সরস্বতী এয়ারপোর্টে এসেছেন। এই তিনটে বছরে কতো তফাত হয়ে গেছে, এখন প্লেনে করে ফেরবার কথা ভাবতেই পারা যায়। আর এবারে তো বাবার টাকাতে টিকিট নয়। আমার নিজের উপার্জনে।

রূপু, আমি আর মাস ছয়েকের মধ্যেই দেশে ফিরতে চাই—ছ’মাসও অনেক দীর্ঘকাল বলে মনে হচ্ছে।

এ চিঠির জবাব প্লিজ দিস। জানিস না তুই, আমি কেমন করে চিঠির বাক্স খুলি। রোজই ভাবি আজকে তোর চিঠি আসবে। কলকাতা থেকে মাত্র দুটোই চিঠি দিয়েছিস—তোর খবর বাবার চিঠিতেই পাই।

তোর কি সত্যি সত্যি আমার কথা মনে পড়ে না? তুই কি সত্যি সত্যি আমাকে miss করিস না, রূপু? মাঝে মাঝে আমার কেমন ভয় করে। প্লিজ বল, এই ভয়টা আমার মিথ্যে। ‘দেশ’ বলতে আমার কাছে শুধু তুই—বাবাকে তো জানিসই।

বিয়ের সময়ে তুই একটা সুতী লালশাড়ি পরবি, বুঝলি? নো বেনারসী। আমিও সুতী পাঞ্জাবি পরবো—নো গরদ বিজনেস (এখানে যেন কতদিন সুতোর কাপড়ের সঙ্গে যোগ নেই বলে মনে হয়।)—নো টোপর বাঁদরামি। সুন্দর, সুশ্রী, ভদ্র, রেজিস্ট্রেশন বিয়ে করব আমরা, কিন্তু ধুমধাম করে।

.

আমি প্রায়ই মনে মনে প্ল্যান করি, জানিস? আমাদের বিয়েটা মনে হবে। সানাই, নিশ্চয়ই। নো লেস দ্যান ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান উইল ডু! তুই বলবি খানসাহেব আমাদের বিয়েতে কেন সানাই বাজাতে রাজি হবেন? হবেন, হবেন, বাবা সব পারে।

তোদের বাড়িতে এ ব্যাপারটা নেই, তোরা জানিস না। কৃষ্ণধন গুপ্ত মশাই তো আমাদের বাড়িতে আছেন! ডাক্তার আর উকিল হবার তো এটাই সুবিধে এবং অসুবিধে। উপার্জন এবং ট্যাক্স হাত ধরে চলে আসে, তখনই খোঁজ পড়ে কৃষ্ণধনবাবুর। নইলে রোজগার বৃথা!

.

রূপুদি, তোর কলকাতার হোস্টেলের ঘরে তোর একটা ছবি তুলে পাঠাবি? আমি তোকে তোর পারিপার্শ্বিকে সবসময়ে কল্পনা করতে চেষ্টা করি। এখানে ছায়া ঘনাইছে—দিনের বেলায় বাতি জ্বেলে চিঠিটা শেষ করতে হোলো। বাজে বিশ্রী দেশ—তবু তোকে একবার নিয়ে আসবো—এখানে কিছুদিন থেকে না গেলে তোর অনেক কিছুই জানা হবে না। বইয়ের পাতায় সেসব নেই।

.

মাঝে মাঝে তোকেই আমার মনে হয় বুঝি অনেক ছোট। রূপুদি, দ্যাখ, দুটো বছর একদমই কিস্যু না। তুই চিরকাল ওই দু’বছরের ডাণ্ডা উঁচিয়ে আমাকে দূরে দূরে রাখলি। সেই বিষ্টির দুপুরটাকে তুই তোর মন থেকে, স্মৃতি থেকে রবার দিয়ে ঘষে ঘষে যতই তুলে দিচ্ছিস, আমি কিন্তু ততই ওটাকে সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে তুলে রাখছি চোখের সামনে। না। ভুল হোলো। ওটা তো গাছের মতো, জ্যান্ত। বড় হবে। ঐ দুপুরটা অনেক লম্বা হবে। লম্বা হতে হতে আমাদের দুজনের দিন, রাত্রি, মাস, বছর, পুরো জীবনটা ছেয়ে ফেলবে। আমাদের জীবন। তোর সঙ্গে আমার। রূপুদি, তোর ওই খোলাচুলের সিল্কের মতন স্পর্শটা আজও আমার মুখে জড়িয়ে রয়েছে। আর রূপুদি সোনা, কী সুন্দর গন্ধ তোর গায়ে রে। সাবান নয়, পাউডার নয়, সেন্ট নয়, কিচ্ছু নয়, তোরই গন্ধ ওটা। তবে তো আমার কথা বিশ্বাস করিস না, আমি এখানেও গন্ধটা পাই, আমার মন কেমন করতে থাকে। সেটা আজকের, কালকের, কি পরশুর কিছু নয় রে রূপুদি, গতজন্মের চেনা গন্ধ। গতজন্মে বিশ্বাস করিস তুই? আমি করি। আমি জানি, তুই আর আমি গতজন্মের জুড়ি—ঐ যেন মাইকেলের ভাষায় ”কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষচূড়ে”, তোকে নিয়ে আমার মনুমেন্টের চুড়োয় উঠে ঠিক অমনি করে চুমু খেতে ইচ্ছে করে রে—

আমাদের বাগানে শীতের শেষ হলেই একটা ছোট্ট পাখি আসে। তার বুকটা পুরো লাল। লালে টুকটুক করছে, নইলে চড়ুই পাখি টাইপেরই চেহারা। সেই পাখিটা এলেই বোঝা যায় বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আমাদের দেশে যেমন কোকিল (শুধু কোকিলকে দেখা যায় না, তার গান শুনেই বোঝা যায় বসন্ত এলো। রশ্মি দৃশ্যমান।) আমার মনে মনেও তেমনি তুই আছিস আনন্দের দূত হয়ে—। তোর সঙ্গে দেখা হওয়া মানেই সুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ। কবে যে সেই দিনটা আসবে? ছ’মাস বড্ড বেশি সময়!

.

আমার রূপুদি! যা শুনেছি তাই কি ঠিক? তুই তো চিঠির জবাব দিলি না। প্রবীরবাবু চিঠি লিখেছেন। সোনা রূপুদি! এটা তুই কী করলি? ছ’মাস ধৈর্য ধরল না তোর? তুই আমার কথাটা ভাবলি না? সত্যি সত্যি না? প্রবীরবাবুর দিদিরা ছোড়দির বদলে তোকে পছন্দ করে ফেললেন আর তুইও অমনি বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি? এক্ষুনি ওই বাড়ি ছেড়ে বেরুনো কি এতই জরুরি ছিল যে অন্ধের মতো ঝাঁপ দিলি? এতদিন সহ্য করলি, আর ছ’টা মাস—? সম্বন্ধ—করা বিয়ে নাকি কোনোদিনও করবি না তুই? সারাজীবন বসে থাকবি তোর প্রেমিক রাজপুত্তুরের পথ চেয়ে? আমি যে তোর সেই স্বপ্ন, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম প্রেমিক রাজপুত্র, যে চুমু খেয়েই তোকে রাজকন্যে বানিয়ে দিতে পারে—সেটা কি এতদিনেও বুঝিসনি তুই? বিয়েটা করেই ফেললি? রূপুদি, এ বিয়ে ভেঙে দে। আমি তোকে হাতজোড় করে বলছি, তোর পায়ে ধরে বলছি, শ্রীচরণেষু রূপু সোনা, প্লিজ, এত বড় সর্বনাশ কন্টিনিউ করিস না—আমাদের দুটো জীবনই ধ্বংস হয়ে যাবে—প্রবীরবাবুকেও তুই কোনওদিন ভালোবাসতে পারবি না, কেন না তুই ভালোবাসিস আমাকে। শুধু আমাকে। আর আমার রূপু শুধু আমারই।

তুই যাকেই বিয়ে কর না কেন, রূপুদি, আমার দুটো হাত তোকে ঘিরে থাকবে সর্বক্ষণ, তাকে জড়িয়ে থাকবে, তোকে ছাড়বে না। কোনোদিন না। প্রবীরবাবুর হবি না তুই। তুই কেবল আমার। এটা তুইও জানিস।

ভাবের ঘরে চুরি করলে কি সুখ—শান্তি হয় রে?

.

আমি আর দেশে ফিরছি না। আমার ‘দেশ’ তো তুই।

আমি স্লান কেটারিংয়ে একটা রিসার্চের চান্স পেয়েছিলাম, সেটা নিয়ে নিচ্ছি। আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। এই বাড়ি, এই নদী, এ দিয়ে আমি কী করব? বিয়ের সময়ে তোকে দেবো বলে জেনিভা থেকে এই সোনার ওমেগা ঘড়িটা কিনেছিলাম—বিশুদার হাতে পাঠাচ্ছি। তুই হাতে পরিস।

আমি হাল ছাড়ব না কিন্তু। জানি এই সময়ে এ—কথা বলতে নেই—বলতে হয় তুমি সুখে থাকো। সুখ—দুঃখের কথা জানি না, রূপু, আমি কিন্তু তোর জন্যে অপেক্ষা করে থাকব। তুই যতই বলিস আমার প্রেমে তুই পড়িসনি, আমি বলছি, সেটা denial—এর ঘোরে বলা। তোর counselling দরকার—তুই জানিস না তুই নিজে কী চাস, কাকে চাস। তাই এই সর্বনাশটা করে ফেললি।

পারলে এখনও বেরিয়ে আয়—ওই বিয়েটা সত্য নয়, ওটা অবাস্তব। বিশ্বাস কর you have made a mistake—আর সারাজীবনই সময় থাকে ভ্রম সংশোধনের। তুমি আমারই—আমি মনেপ্রাণে জানি। তোমার শরীর মিথ্যে কথা বলেনি। মন মিথ্যে বলছে। শুনিস না ওর মিথ্যে কথা। নিজের কাছ থেকে ছুটে পালাচ্ছিস কোথায়? রূপুদি, ইটস নেভার টুড লেট টু চেঞ্জ ইওর লাইফ।

আমাদের একসঙ্গে বাঁচার দিনগুলো সামনে পড়ে আছে—তুই প্রবীরবাবুকে সব কথা বলে দিয়ে, বেরিয়ে আয়। মিথ্যে দিয়ে বাঁধা থাকিস না।

.

রূপুদি, ফেস দ্য ট্রুথ।

উই আর লাভার্স।

তুই যাকেই বিয়ে কর না কেন, তুই আমারই বউ।

অধ্যায় ২ / ২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন