১৭. সন্ত্রাসবাদী বৈমানিক

সুধীন্দ্রনাথ রাহা

আফ্রিকায়, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় রোমাঞ্চকর অনেক অনেক অ্যাডভেঞ্চারে অংশগ্রহণ করেছি প্রথম জীবনে। কিন্তু সব সেরা অ্যাডভেঞ্চার আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল এই লন্ডনেরই বুকের উপরে। ‘আটিলায়’ যেদিন উঠলাম, কঙ্গোর সিংহ আর আরব মরুর বেদুইনকে মনে হল টিনের খেলনা।

সন্ধ্যা বেলায় বার্নেট এসে উপস্থিত হল আমার ফ্ল্যাটে। সে খুব যে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তা নয়, তবে কয়েক বছর আগে আমার জীবনটা ও রক্ষা করেছিল কোনো এক সংকটে। আর তারপর থেকেই লেপটে আছে আমার সঙ্গে, এ তরফ থেকে তেমন কোনো উৎসাহ না-পেয়েও।

উৎসাহ আমার থাকবার কথা নয়। কারণ ও হল সন্ত্রাসবাদী, আর আমি হচ্ছি ধনী মানুষ, পার্লামেন্ট-সদস্য, রক্ষণশীল সমাজের অন্যতম সুবর্ণস্তম্ভ। কিন্তু কৃতজ্ঞতা বলে একটা জিনিস আছে পৃথিবীতে। তা ছাড়া, কথাবার্তায় সন্ত্রাসের বিশেষ আভাস নেই বার্নেটের। তর্ক করে, কিন্তু তর্কে হারলে রেগে যায় না। শুধু মুচকি হেসে বলে, ‘আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না, তা ঠিক। তবে হার্টম্যান বা সোয়ার্জ, ওদের দেখা যদি কোনোদিন পাও, সব কিছুই তারা জলবৎ তরল করে দেবে, দেখো।’

এই আর এক ধাপ্পা। হার্টম্যান আর সোয়ার্জ! বিশ বছর আগে যারা আটলান্টিকে ডুবে মরেছে। ছোট্ট ইয়ট। গরিবের ছেলে হার্টম্যান ইয়টের মালিক কী করে হল, ভগবানই জানেন; কিন্তু হয়েছিল তা ঠিক। সম্ভবত কেড়ে-কুড়ে নিয়েছিল কারও, অন্তত পুলিশ তাই বলে। সেই ইয়ট ডুবি হয়ে—

মানে, আপনা থেকে ডোবেনি। ওরাই ডুবিয়ে দিয়েছিল, পুলিশ জাহাজের বেড়াজাল কেটে বেরুবার পথ না-পেয়ে। যাহোক, পুলিশ এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। আজ বিশ বছর ধরে তারা তারস্বরে ঘোষণা করে আসছে যে টেররিস্ট ক্যাপ্টেন হার্টম্যান আর তার জার্মান সহকারী সোয়ার্জ, এরা মরেছে, মরেছে। তারা বেঁচে ফিরে আসবে, এমন কোনো আশঙ্কা নেই।

অথচ বার্নেট যখন-তখনই বলে—

বিশ্বাস? না, বার্নেটের কথা আমি বিশ্বাস করি না, যদিও বিশ্বাস করতে পারলে হত ভালো। আমার নিজের ভালো, এমন কথা বলছি না। ভালো হত হার্টম্যানেরই বুড়ি মায়ের পক্ষে। বুড়িটা অনেক দিন থেকে আমার চেনা। কী উপলক্ষ্যে, তা আর শুনে কাজ নেই কারও। খানিকটা জড়িয়ে পড়েছি ওর ব্যাপারে। এটা ওটা সাহায্য করতে হয়েছে মাঝে মাঝে। বড়ো ভালো মানুষ ওই বুড়ি। একমাত্র সন্তান জলে ডুবে মরল। আজ বিশ বছরেও সে শোক ও ভুলতে পারেনি। দেখা হলেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয় ছেলের কথা তুলে। তাই বলছিলাম—

বার্নেটের কথা বিশ্বাস করতে পারলে হত ভালো। বুড়িকে বলতে পারতাম, ‘মাসি, তুমি কেঁদো না, ছেলে তোমার মরেনি।’

নাঃ, বিশ্বাস করতে পারি না, আশ্বাস দিতেও পারি না।

যাহোক, যা বলছিলাম—

সেদিন সন্ধ্যায় বার্নেট এসে এমন একটা ভঙ্গি দেখাল যেন একটা মহাযুদ্ধ জয় করে এসেছে, ‘ওহে, আজ রাত দশটা নাগাদ কেনসিংটন বাগানে যেতে পারবে একবার? চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসবে।’

‘কী বিবাদ চক্ষু-কর্ণের?’ বার্নেট যে হার্টম্যানদের কথা বলছে, তা আমি বুঝতেই পারিনি।

‘হার্টম্যানরা বেঁচে আছে, তা তো বিশ্বাসই করতে চাও না কিনা!’ বুকে তাল ঠোকে বার্নেট কথার জবাব দিতে গিয়ে।

খানিকটা তর্কাতর্কি এর পরেও না-হল, তা নয়। কিন্তু বুড়ি মিসেস হার্টম্যানকে আশ্বাস দিতে পারব— এ প্রলোভন আমার পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হল না। আমি রাত দশটায় কেনসিংটন গার্ডেনে গিয়ে হাজির হলাম।

কোন দিক দিয়ে কোথায় যেতে হয়, বার্নেট বলেই দিয়েছিল। সেই অনুযায়ী প্রথমেই যেখানটায় গিয়ে হাজির হলাম, সেটা হল দক্ষিণ দিকের উঁচু রেলিং। ওটা পেরুতে হবে, কথা আছে। ওপাশে মোতায়েন থাকবে বার্নেট।

রেলিং বেয়ে উঠতে শুরু করেছি, এমন সময় একটা টর্চ এসে পড়ল আমার উপরে। হকচকিয়ে গেলাম দস্তুরমতো। এদিকেই নেমে আসব, না ওদিকেই টপকে যাব, চট করে ঠিক করতেই পারলাম না যেন। কেলেঙ্কারিই হয়ে যেত তক্ষুনি। অর্থাৎ আমি, পার্লামেন্ট সদস্য স্ট্যানলি ধরা পড়ে যেতাম টিকটিকি পুলিশের হাতে, টেররিস্টদের গুপ্তচর হিসেবে। সে বিপর্যয় থেকে বাঁচাল বার্নেট। রেলিংয়ের ওপিঠ থেকে তার গলা শোনা গেল, ত্বরিত, শানিত। ‘লাফিয়ে চলে এসো, লাফিয়ে চলে এসো, ধরা পড়লে সর্বনাশ হবে যে!’

আমি দিলাম লাফ। অন্ধকারের ভিতরে লাফিয়ে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তা জেনে শুনেও, দিলাম লাফ।

বার্নেট হাত বাড়িয়েই ছিল। লুফে নিল আমাকে। তারপর দে দৌড়।

‘গেরো দেখো, টিকটিকিগুলো ঠিক জুটেছে এসে!’ বার্নেটের গজগজানি টের পেলাম সেই ধাবমান অবস্থাতেই।

কিন্তু ধাবনচাতুর্যে ওপক্ষও কিছু কম যায় না। টিকটিকিরা ইতিমধ্যে রেলিং টপকেছে। আবারও তাদের টর্চের আলো পড়ছে আমাদের পিঠে এবং আশেপাশে। বেশ মনে পড়ে, ওই দৌড়োতে দৌড়োতেই তারিফ করছিলাম মনে মনে, লন্ডনের পুলিশ সত্যিই দুনিয়ার সেরা পুলিশ। অন্য শহরে হলে এতক্ষণ গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেত আমাদের পিঠ। এদের সংযম এবং মাত্রাজ্ঞান অপূর্ব।

না, গুলি ওরা করেনি, করতে হল আমাদের। আমি না। আমি কোথায় পাব রিভলবার? হল কী, দৌড়ঝাঁপ অনভ্যাসে দাঁড়িয়েছে, সেই আফ্রিকা ছেড়ে আসার পর থেকেই। পড়ে গেলাম কীসে যেন পা বেঁধে। বার্নেট আমাকে ধরে তুলল। বাহাদুরি দিতে হয় তাকে যে, এ সময়েও পালিয়ে নিজের একার প্রাণ বাঁচাবার কল্পনা তার মাথায় আসেনি।

কিন্তু ধরে তুলতে সময় লাগে তো। সেইটুকু সময়ের মধ্যেই টিকটিকিরা এসে গিয়েছে, লাফিয়ে পড়েছে আমারই উপরে। কোনো আঘাত পেয়ে নয়, স্রেফ আতঙ্কেই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম তক্ষুনি। আতঙ্ক— ওই যে বলছিলাম, কেলেঙ্কারির আতঙ্ক! আমি ধনকুবের স্ট্যানলি। অভিজাত সমাজের সিংহপুরুষ, আগামী দিনের অন্যতম কনিষ্ঠ মন্ত্রী।

আমি শেষকালে সত্যি সত্যি ধরা পড়লাম টেররিস্টের সহযোগী বলে?

জ্ঞান হারালাম, কিন্তু হারাতে হারাতেও শুনতে পেলাম পর পর গুলির আওয়াজ। জ্ঞান হারালাম। সে জ্ঞান ফিরল যখন, তখন আমি আটিলায় কেবিনে, মাটি-মায়ের বুক ছেড়ে দশ হাজার ফুট উপরে হাওয়ায় ভাসছি। বার্নেট গেলাসে ব্র্যান্ডি ঢালছে আমায় খাওয়াবার জন্য।

প্রথম প্রশ্ন আমার, ‘গুলি তুমিই চালিয়েছিলে?’

‘আমি ছাড়া আর কে? উদাসীনভাবে জবাব দিল বার্নেট, ‘দেখলাম, তা নইলে তোমায় বাঁচাতে পারতাম না ওদের হাত থেকে।’ আঙুল দিয়ে সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমারই কোটের দিকে, তার সমুখ দিকটা লালে লাল। মনে হল, আবারও বুঝি মূর্ছা যাব। নিজের অধঃপতন দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি। নিজেরই যেন বিশ্বাস হয় না যে, দুই বছর আগেও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিংহ-শিকার করেছি কঙ্গোর অরণ্যে। নগরজীবনের অবসাদক প্রভাব আর কী! মনকে বোঝালাম ব্র্যান্ডি গিলতে গিলতে।

বার্নেট নিজে কোনো কথাই বলতে নারাজ, ‘আমার মুখ থেকে হঠাৎ আর রা বেরুচ্ছে না বন্ধু! আবার যদি মাটির বুকে তোমাতে আমাতে দেখা হয় কোনোদিন, তবেই— কিন্তু তার বোধ হয় আর ভরসা নেই।’

‘ওই যে মুখে কুলুপ এঁটে দিল, ব্যস! শেষপর্যন্ত জেনেছিলাম, আটিলাতে কথা কয় শুধু একজন। সে হল হার্টম্যান, ক্যাপ্টেন। অন্যসব মুখ বুজে কাজ করে। আমায় হার্টম্যানের কাছে পৌঁছে দিল বার্নেট।

ওর মাকে দেখেছি। সেই মায়ের এই ছেলে? সে বুড়ি ভরাট যৌবনেও যে পাঁচ ফুটের চেয়ে এক ইঞ্চি ডাগর ছিল না, তা আমি হলপ করে বলতে পারি। আর এ? সাড়ে ছ-ফুট তো হেসে খেলে। সেই আন্দাজে পুরুষ্টু কলেবর। মোটের মাথায়, দৈত্যাকার মানুষ একটা!

কিন্তু কী অমায়িক। আমায় কেবিনে ঢুকতে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে এল, করমর্দন করল গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে। তারপর আগে আমায় আসনে বসিয়ে পরে নিজের চেয়ারে ফিরে গেল, ‘আমার মায়ের অসময়ের বন্ধু আপনি। কী করে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব, তা জানি নে।’

যথাসাধ্য মোলায়েম করেই উত্তর দিলাম, ‘কৃতজ্ঞতার কথা ছেড়ে দিন। কিন্তু আমি শুনেছিলাম, আপনার মা-ও তাই শুনেছেন যে, আপনি বেঁচে নেই। বেঁচেই যদি আছেন, তবে মাকে তা জানতে দেননি কেন? তাঁর অশ্রুর বিরাম নেই।’

‘জানতে দিলেও বিরাম থাকত না।’ জবাব এল বিষণ্ণকণ্ঠে, ‘বরং শোকের সঙ্গে তাতে যোগ হত যন্ত্রণা। দুশ্চিন্তার যন্ত্রণা! সারা পৃথিবীর পুলিশ যাকে বিপজ্জনক ব্যক্তি বলে মনে করে, তার মায়ের মনে শান্তি কী করে আসবে, বলুন তো! তার চেয়ে, এই যে তিনি আমায় মৃত বলে জানেন, সেই তো ভালো। মৃতেরা তো পুলিশের এক্তিয়ারের বাইরে।’

এ কথার উত্তর হঠাৎ আমার মুখে জোগাল না। হার্টম্যানও উত্তরের আশায় বসে রইল না। নিজের মনেই বলে চলল, ‘বার্নেট আপনাকে ডেকেছিল, আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে বলে। মাটিতে নেমেই আমি দেখা করতাম আপনার সঙ্গে! কিন্তু বাদ সাধল ওই ডিটেকটিভরা! তারা মাঝখানে এসে পড়ার দরুন তারাও মরল, আপনাকেও ঝামেলা পোয়াতে হল অনেক।’

‘ওদের মেরে না-ফেললেও হত বোধ হয়।’ আমার মন্তব্যটা দুর্বল শোনাল আমার নিজেরই কানে।

‘কী করে হত! মেরে না-ফেললে আপনাকে ওরা নিয়ে যেত। হাজত, আদালত, বিচার, জেল, জীবনটাই মাটি হয়ে যেত না আপনার? ডেকে এনে তারপর আপনাকে এমন সর্বনাশের মুখে ফেলে দিই কী করে?’

একটু থেমে, তারপর একটু হেসে সে আবার বলল, ‘আর মরতো তো ওরা বটেই! দু-দিন পরেই না-মরে আজই মরে থাকে যদি, কী এমন লোকসান তাতে?’

‘মরতো ওরা বটেই?’ আমি একথার মানে বুঝতে না-পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন মরতো?’

‘যেজন্য সবাই মরবে। প্রথমে এই লন্ডনের সবাই, তারপর ধনিকতন্ত্রের ধ্বজাধারী সব দেশের মানুষই। আমরা সন্ত্রাসবাদী, তা তো জানেন! আমাদের যুদ্ধ চলছে এই অসাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ও ব্যবস্থা আমরা উলটে দিতে যাচ্ছি দুই-একদিনের ভিতরই। সেইজন্যই একবার দেখা করতে চেয়েছিলাম আপনার সঙ্গে।’

‘সেইজন্যই?’ ওর কোন কথাটা আমাকে বেশি অবাক করল, তা আমি বুঝতেই পারছি না। দুই-এক দিনের ভিতর সমাজব্যবস্থা উলটে দেওয়ার পরিকল্পনাটাই বেশি হতবুদ্ধিকর, না তার সঙ্গে আমার মতো নির্বিরোধ লোককে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টাটাই বেশি দুর্বোধ্য।

‘সেই জন্যই।’ জোর দিয়ে বলে উঠল হার্টম্যান, ‘পৃথিবীর একটা বৃহৎ অংশকে ধ্বংস করে ফেলতে যাচ্ছি আমি। সেই ধ্বংসের কবল থেকে আমার মাকে আমি রক্ষা করতে চাই। আর বিশ্বাস করতে পারেন, রক্ষা করতে চাই আপনাকেও। কারণ পৃথিবীতে আমার মায়ের একমাত্র উপকারী বন্ধু আপনিই। আপনাকে ডেকে এনে শুধু ওই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম, কোনো অছিলা করে আমার মাকে লন্ডন থেকে সরিয়ে দিন এক্ষুনি। আপনি নিজেও সরে যান, আপনার নিজের প্রিয়জনদের নিয়ে— এই কথা।’

হার্টম্যান কি উন্মাদ হয়ে গিয়েছে? কথাবার্তা শুনে তো সেরকমই মনে হয় যেন!

যাহোক, মনের চিন্তা মুখে প্রকাশ করা বুদ্ধির কাজ হবে না! একটু যেন দিশেহারার মতো ভাব দেখিয়ে বললাম, ‘পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে তাহলে এখন করা যায় কী?’

‘করার জিনিস একটাই আছে, আপনাকে নামিয়ে দেওয়া। কিন্তু আমার বিমানকে আমি এখন নামাতে পারি না, অন্তত ইংল্যান্ডের মাটিতে তো নয়ই! দুটো ডিটেকটিভ মারা পড়েছে, সারা ইংল্যান্ড এখন সজাগ। কেনসিংটন গার্ডেনের ত্রিশ ফুট উপরেই আমার বিমান ছিল সেই ঘটনার সময়, হয়তো কেউ দেখেও থাকবে। এখন নেমে-পড়া আমার পক্ষে নিরাপদ হবে না। অবশ্য আটিলা এমন ধাতুতে তৈরি যে হাইড্রোজেন বোম ছাড়া অন্য কোনোকিছুর আঘাতে তার তিলমাত্র ক্ষতি হবে না, তবু—’

‘আটিলাকে যদি আপনি না নামাতে চান’ মনের বিরক্তি চাপবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে আমি বললাম, ‘প্যারাসুট দিয়েই আমায় নামিয়ে দিন না-হয়।’

খুব উৎসাহের সঙ্গে হার্টম্যান বলে উঠল, ‘ওই কথাটাই বলতে চাইছিলাম আমি। বলতে সংকোচ হচ্ছিল একটু। অমন দুঃসাহসের কাজ করতে বলা, যে লোক পেশায় বৈমানিক নয়, বিবেকে বাধছিল আমার।’

‘পেশায় বৈমানিক নই বটে, কিন্তু সিংহ-শিকার করেছি, বেদুইনদের সাথে বন্দুকবাজি করেছি মরুভূমির বালিতে দাঁড়িয়ে।’ জবাব দিলাম নিরুত্তাপ কণ্ঠে।

তাই হল। প্যারাসুট দিয়েই হার্টম্যান আমাকে নামিয়ে দিল সমুদ্রকূলের এক নিভৃত প্রান্তরে। হাতে দিল একখানা চিঠি তার মায়ের নামে। দিতে ইচ্ছা ছিল না তার। সে বলছিল, তার জীবিত থাকার ব্যাপারটা পূর্ববৎ গোপনই থাকুক তার মায়ের কাছে, বুড়িকে স্থান ত্যাগে প্ররোচনা দেওয়ার দায়িত্বটা আমার উপরেই থাকুক। আমি রাজি হইনি তাতে, কারণ বুড়ির উপরে ততখানি প্রভাব আমার কাছে বলে আমি নিজেই ভাবতে পারিনি। প্রকৃতপক্ষে তার উপরে আমার এমন কী জোর আছে? সাহায্য মাঝে মধ্যে করেছি বটে, কিন্তু তা এমন কিছু নয় যে, আমার প্রত্যেকটা কথাকেই বাইবেলের বাণীর মতো শিরোধার্য করে নিতে সে নীতিগতভাবে বাধ্য থাকবে।

কথাটা বুঝিয়ে বলার পরে হার্টম্যান চিঠি লিখল মাকে।

আমি চিঠি নিয়ে প্রথমেই কিন্তু হার্টম্যানের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না। আমার নিজের প্রিয়জনও তো কেউ কেউ আছে। একটা ঘোরতর বিপদকে আসন্ন বলে জেনেছি যখন, আমার প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাদেরই নিরাপদ করবার দিকে সচেষ্ট হওয়া। আমি তাদেরই খোঁজে খোঁজে পুরে একটা দিন খরচ করে ফেললাম।

তারপর যখন বুড়ি মিসেস হার্টম্যানের কাছে পৌঁছোলাম, তার কাছে কথাটা তোলাই তো কঠিন হল! যে ছেলেকে আজ বিশ বছর যাবৎ সে মৃত বলে জেনেছে, হঠাৎ তার চিঠি পেলে কীরকম চ্যাঁচামেচি করে উঠবে সে, কে তা আগে থেকে বলতে পারে?

যাহোক, পৌঁছোলামও মিসেস হার্টম্যানের কাছে, কোনোপ্রকারে তার কাছে কথাটা প্রকাশ করেও ফেললাম! তারপর যা হতে থাকল—

সেসব বিবরণ থাকুক! ঘণ্টা খানেক তো বুড়ি নিছক পাগলের মতোই আচরণ করেছিল! তারপর সে কিন্তু পাথর বনে গেল একেবারে। আমার কেবলই হতে লাগল গভীর আপশোস, তার মায়ের বর্তমান প্রতিক্রিয়াটা হার্টম্যানকে ডেকে এনে দেখাবার উপায় নেই বলে।

‘ধ্বংস করবে? আমার সোনার ইংল্যান্ডকে? এইজন্যই কি তাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছিলাম?’

কথা তো নয়, শাঁইনি সাপের হিসহিসানি যেন। আরও ঘণ্টা খানেক বাদে আমি যখন বুড়ির বাড়ি থেকে বেরুলাম, তখন দ্বিতীয় একখানা চিঠি আমার পকেটে, এ চিঠি হার্টম্যানকে লিখেছে তার মা। বুড়ি চিঠি দিয়েছে আমার হাতে, কিন্তু আমি তা হার্টম্যানের কাছে পৌঁছে দেব কেমন করে? আর তো বার্নেট এসে আমায় ডেকে নিয়ে যাবে না আটিলায় চড়ে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য!

ফিরে এলাম নিজের ফ্ল্যাটে। বারো-তলায় ফ্ল্যাট আমার, উপরে রয়েছে আরও ছ-টা তলা। সকালে প্রাতরাশ সেরেই ছাদে গিয়ে উঠলাম। উদ্দেশ্য আকাশটা একবার পর্যবেক্ষণ করা, যদি আটিলাকে কোনোদিকে দেখতে পাই! দেখে অবশ্য লাভ হবে না কিছু, আর দেখার আশাও তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না আমার।

কিন্তু, যা আশা করিনি তাই হল।

রাস্তায় দেখতে পেলাম বিরাট জনতা। তারা জমায়েত হয়েছে কোনো একজন বৈদেশিক প্রেসিডেন্টের শুভাগমন উপলক্ষ্যে। তোরণ গড়া হয়েছে রংবেরঙের, জয়ধ্বনি উঠছে মাননীয় অতিথির নামে, টাওয়ার থেকে তোপধ্বনি হচ্ছে মুহুর্মুহু।

এমন সময়ে কোথা থেকে বিদ্যুতের গতিতে ধেয়ে এল আটিলা, ভাসতে লাগল ঠিক জনতার মাথার উপরে। নীচে থেকে হাজার কণ্ঠে উঠল উল্লাসের ধ্বনি। লোকে ভেবেছে, ওই বিমানখানাও বুঝি উৎসবে অংশ নেবে কোনো-না-কোনো রকম।

অংশ অবশ্য নিল আটিলা, তবে উৎসবে নয়, ধ্বংসে। হঠাৎ বোমা বৃষ্টি শুরু হল জনতার মাথার উপরে। বিস্ফোরণের কর্ণবিদারী আওয়াজ, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ, হতাহত মানুষের মিলিত আর্তনাদ, আনন্দমুখর লন্ডনকে মুহূর্তে পরিণত করে দিল রক্তপিছল রণক্ষেত্রে। আমি তাড়াতাড়ি একটা মিনারের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম।

কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই প্রতিরক্ষা বাহিনী তৎপর হয়ে উঠল। বিমানবিধ্বংসী কামান চলে এল রাজপথে, পার্কে, ঘোড়দৌড়ের মাঠে। অতিথি প্রেসিডেন্টকে বিমান বহরের মহড়া দেখাবার আয়োজনও করা হয়েছিল। সেইসব বিমান ধেয়ে এল আটিলাকে লক্ষ করে, ঘিরে ফেলল তার চারপাশে। আটিলাও ডানা ঝাড়া দিয়ে সাঁ সাঁ শব্দে উঠে গেল উপরে।

উপরে— উপরে— কত উপরে, তা আর ঠাহরই হয় না চোখে। শুধু আটিলা নয়, অনুসন্ধানকারী সামরিক বিমানেরাও মেঘের রাজ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। দৃষ্টির বাইরে কোথাও চলেছে তুমুল লড়াই! দূরশ্রুত বজ্রনাদের মতোই কানে আসে বোমা আর কামানের গর্জন।

কতক্ষণ? পাঁচ মিনিটের বেশি নয়। তারপরই উত্তর আকাশে একখানা, পুবের আকাশে আর একখানা বিমান ভেঙেচুরে জ্বলতে জ্বলতে পড়ে গেল মাটিতে। আরও কয়েকখানা দেখা গেল টলতে টলতে ঘুরপাক খেতে খেতে পালিয়ে যাচ্ছে দূরে দূরান্তরে, দুর্জয় শত্রুর আক্রমণের সমুখ থেকে।

গুরু গুরু আওয়াজ একটা, আকাশ-পৃথিবীর ভয়ার্ত বুকের স্পন্দন যেন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়। নেমে এল আটিলা মেঘলোক থেকে। নেমে এল একেবারে রাজপথের দু-শো ফুট উপরের আকাশে। ওপাশে সেন্টপলের গির্জা। বোমা ছুড়ল তারই দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা রক্তপতাকা উড়িয়ে দিল আটিলার আরোহীরা। তাতে সাদা সাদা বড়ো হরফে লেখা, ‘ফিরে এল সন্ত্রাসবাদী হার্টম্যান!’

সেন্ট পলের চূড়া ভেঙে পড়েছে প্রলয় বোমার আঘাতে। এবারে আটিলার লক্ষ্য টাওয়ারের চূড়া। এদিকে মাটি থেকে বিমানবিধ্বংসী কামান গর্জাচ্ছে অবিরাম, আকাশে আকাশে উড়ছে নানা জাতীয় ক্ষেপনাস্ত্র। কিন্তু কী আশ্চর্য! আটিলার দেহে প্রতিহত হয়ে প্রত্যেকটা অস্ত্র মাটির ঢেলার মতো গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। কী ধাতুতে তৈরি ওটা, কে জানে!

আগুন! আগুন! ওয়েস্ট-এন্ড-এর মাথার উপর ভাসছে আটিলা, তার ট্যাঙ্ক থেকে প্রপাতের মতো ঝরছে জ্বলন্ত পেট্রোলিয়াম, তরল আগুনবন্যা। জ্বলে গেল লন্ডন! ধ্বংস হল ইংরেজের সাধের রাজধানী! সে দৃশ্য আর দেখতে পারি না চোখে। আমি কাঁপতে কাঁপতে নেমে এলাম নিজের ঘরে।

দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়ে আছে বার্নেট।

‘ক্যাপ্টেন জানতে চান, তাঁর মা নিরাপদ দূরত্বে চলে গিয়েছেন তো? আমি প্যারাসুটে নেমেছি। আজ নয়, কাল। এ প্রলয় আরম্ভ হওয়ার আগে। টিকটিকির চোখে ধুলো দিতে এবার বেশ বেগ পেতে হয়েছে।’

আমি নিঃশব্দে চিঠিখানা বার করে বার্নেটের হাতে দিলাম। হার্টম্যানের মায়ের চিঠি। যে চিঠিতে মিসেস হার্টম্যান শাসিয়েছেন, ‘ইংল্যান্ডের উপরে একটা বোমা যদি তুমি নিক্ষেপ করো, সেই মুহর্তেই আমি আত্মহত্যা করব!’

বার্নেট চলে গেল। সারাদিন আটিলার তাণ্ডব চলল লন্ডনের আকাশে। লন্ডনের অর্ধেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। সামরিক কর্ত,পক্ষ হাইড্রোজেন বোমা নিক্ষেপের কথা চিন্তা করছেন।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, চুপি চুপি আর একবার উঠলাম ছাদে। কী আশ্চর্য! আটিলা আমার অতি নিকটে যে! হার্টম্যানকে স্পষ্ট দেখলাম। তার হাতে একখানা চিঠি। বার্নেটকেও দেখলাম হার্টম্যানের সমুখে।

আর তারপরই—

হঠাৎ পকেট থেকে রিভলবার বার করে হার্টম্যান নিজের মাথায় গুলি করল। সঙ্গেসঙ্গে সে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। মায়ের মৃত্যু ঘটিয়েছে সে, তারই অনুতাপের প্রতিক্রিয়া হয়তো।

পরদিন সকালে আটিলাকে আর কোথাও দেখা গেল না, সারা ইউরোপের কুত্রাপি না। আটলান্টিকের মাঝামাঝি এক জায়গায় সোয়ার্জ ডুবিয়ে দিয়েছে বিমানখানাকে— এইরকম একটা খবর কানে এল কয়েক দিন পরে।

সকল অধ্যায়

১. ১. আলফা সেন্টৌরির পথে
২. ২. লতার নাম হাঁউ-মাঁউ-খাঁ
৩. ৩. দশ লাইট-ইয়ার দূরত্বে
৪. ৪. মহাকাশের পালকওয়ালা মানুষ
৫. ৫. নক্ষত্র? না, ক্ষেপণাস্ত্র
৬. ৬. মঙ্গলের প্লেগ
৭. ৭. জীবন-মৃত্যুর লটারি
৮. ৮. পৃথিবী যখন ধ্বংস হল
৯. ৯. জীবন-মৃতের জাদুঘর
১০. ১০. এগিয়ে চলো অসম্ভবের মুখে
১১. ১১. এম-১
১২. ১২. কালচক্রের সওয়ার
১৩. ১৩. পাগলা গ্রহ
১৪. ১৪. রোবট বন্ধুর মৃত্যু
১৫. ১৫. অস্য দগ্ধোদরস্যার্থে
১৬. ১৬. ক্লোরোফাগ
১৭. ১৭. সন্ত্রাসবাদী বৈমানিক
১৮. ১৮. কত রহস্য ওই অসীমে!
১৯. ১৯. মহাবিমানের উল্লম্ফন
২০. ২০. জীবন কোথায় নেই?
২১. ২১. আঙুল যাদের ছ-টা
২২. ২২. আজি হতে শতবর্ষ পরে
২৩. ২৩. ফিরে চলো গুহামানবের যুগে
২৪. ২৪. ধূমকেতুর উদরে
২৫. ২৫. হাসপাতালের ‘টি’ ওয়ার্ড
২৬. ২৬. দেহান্তরী
২৭. ২৭. অ্যাপিনের গবেষণা
২৮. ২৮. মঙ্গলের পথে সেকেলে কাপ্তেন
২৯. ২৯. ত্রিমূর্তি
৩০. ৩০. এক ঘুমে এক-শো বছর
৩১. ১. ভৌতিক কুকুর
৩২. ২. মোড়ের দোকান
৩৩. ৩. রাক্ষসীর পূজা
৩৪. ৪. অশরীরী স্নেহ
৩৫. ৫. অশরীরী ঈগল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন