২৯. ত্রিমূর্তি

সুধীন্দ্রনাথ রাহা

কাপ্তেন অবাক। টেলিভিশনে দরাজ গালাগালি দেওয়ার পরে ডানা কী বলে আবার অফিসে এল আজ?

দানা লি। বাপ ছিল ওলন্দাজ, মস্ত লোক। এ অঞ্চলটা দখল করার সময় সে ছিল অন্যতম সেনানায়ক। তারপর সেই হয় রেসিডেন্ট। বলতে গেলে রাজাই।

হ্যাঁ, বাপ ছিল শ্বেতাঙ্গ, মা তা নয়। তার বাড়ি এই বালি দ্বীপেই। গায়ের রং বাদামি। কিন্তু রূপ—

তার রূপ যে কী অসামান্য ছিল, তা আজকের এই তরুণী ডানাকে দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এরও রং বাদামি, চোখে-মুখে বালিনিজ আভিজাত্যের ছাপ, তার উপরে কী যে একটা অনির্বচনীয় জৌলুস! রৌদ্রঝলমল তরোয়াল যেন একখানা।

এই জৌলুসের উৎস আবার ডবল। যৌবনসুষমা তো বটেই, তার উপরে আবার বুদ্ধির দীপ্তি। বাপ তাকে শিক্ষা দিয়েছিল ইউরোপীয় ধাঁচে। সে-শিক্ষা ষোলো আনা সার্থক হয়েছে ডানার ক্ষেত্রে। টেলিভিশনে ওকে দেখবার জন্য, ওর কথা শুনবার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক উন্মুখ হয়ে আছে।

কাপ্তেন রবিন উইনবুম অবাক হতে পারেন, কিন্তু অভদ্র হতে পারেন না। ইঙ্গিতে চেয়ার দেখিয়ে দিয়েছেন। ডানা বসেছে, পায়ের উপরে পা তুলে দিয়ে নীরবে প্রতীক্ষা করছে। কাপ্তেন কীভাবে তাকে অভ্যর্থনা করেন, তাই দেখবার জন্য।

কাপ্তেনের কথা কইতে দেরি হল। তার কারণ অন্য কিছু নয়। তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল ডানার চুলের দিকে। নীলচে কালো কেশপাশে ইলেকট্রিকের আলো খেলছে। যেন মেঘের কোলে সৌদামিনী।

যাহোক, অবশেষে তিনি কথা কইলেন— ‘খুব যে খুশি হয়েছি, তা বললে সত্যের অপলাপ হবে মিস লি! আপনার চাবুকের ঘা থেকে এখনও রক্ত ঝরছে আমার সর্বাঙ্গে। কিন্তু সে-কথা থাকুক, কেন এ শুভাগমন, সেইটেই বলে ফেলুন সোজাসুজি।’

‘সমালোচনাটাকে ব্যক্তিগত বলে ধরে নিয়েছেন কেন? সরকারি কাজে গাফিলতি দেখলে দু-কথা বলতেই হয়। আপনি যখন বিভাগীয় কর্তা, খানিকটা দোষ আপনার মাথায় এসে পড়বে ঠিকই। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন, আক্রমণের লক্ষ আপনি নন।’

‘খুব যে সান্ত্বনা পেলাম, তা অবশ্য নয়’— বললেন উইনবুম— ‘তবু ধন্যবাদ। কিন্তু আগমনের উদ্দেশ্যটা—?’

‘বলি এইবার। ইন্টারস্টেলার মানে আন্তর্নক্ষত্র বার্তাবিনিময় সংস্থা এদের নাম কখনো শুনেছেন নাকি?’

মাথা নাড়লেন উইনবুম— ‘বেসরকারি গোয়েন্দা অফিট-টফিস হবে। নাম শুনে তাই তো মনে হয়। কিন্তু নক্ষত্রলোকে গোয়েন্দাগিরি ব্যাপারটা তো সোজা নয়।’

‘আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু চিঠি যা লিখেছে আমাকে, তা আনাড়ি গোয়েন্দার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। খানিকটা শোনাতে চাই আপনাকে সেই চিঠির।’

পকেট থেকে একখানা কাগজ বার করে ডানা পড়তে লাগল—

‘টেলিভিশন টিপ্পনীকার হিসাবে নাম আছে আপনার। শ্রোতাও আপনার অনেক, দায়িত্বও সেই অনুপাতে প্রচুর। কাজেই সংবাদের উৎসগুলি আপনার খুবই যাতে নির্ভরযোগ্য হয়, তা দেখতে হবে আপনাকে। আমাদের সঙ্গে প্রাথমিক কিছু কারবার আপনি করে দেখুন, এই আমাদের অনুরোধ। এর দরুন খরচা আপনার হবে না। আমরা শুধু এইটিই প্রমাণ করতে চাই প্রথমে যে সংবাদের জোগানদার হিসেবে পৃথিবীতে আমরাই শ্রেষ্ঠ। নমুনাস্বরূপ তিনটি ভবিষ্যদবাণী আমরা আপনাকে শোনাচ্ছি। ”হারকিউলিস” ও ”থ্রি-গোস্ট” এলাকার মহাকাশে অদূর ভবিষ্যতে যেসব ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তারই সম্পর্কে। এসব ভবিষ্যদবাণী যদি শতকরা এক-শো ভাগ সত্য বলে প্রমাণ হয়, তবে যেন আপনি আমাদের সঙ্গে বৈষয়িক সূত্রে আবদ্ধ হন, এইটুকুই আমরা চাই। লক্ষ করুন, শতকরা নিরানব্বুই ভাগেরও কথা আমরা বলছি না, পুরোপুরি এক-শো ভাগ যদি কোনো দিক দিয়ে হেরফের হয়, আমাদের আবেদন সরাসরি নাকচ করে দেবেন।

ওই দুটো এলাকার কথাই আমরা বলছি আপাতত, হারকিউলিস আর থ্রি-গোস্ট দরদস্তুরের কথা পরে।’

‘হুঁ-উ-উম’—টেনে টেনে বললেন, উইনবুম— ‘লোকগুলোর আর কিছু না থাকুক, আত্মবিশ্বাসটা টনটনেই আছে। পাশাপাশি দুটো নামও মিলিয়েছে ভালো। সৌরমণ্ডলদের ভিতর থ্রি-গোস্ট হচ্ছে একেবারে বালখিল্য, আর হারকিউলিস হচ্ছে, মানে এত বড়ো যে গোটা নক্ষত্রজগৎটাকেই প্রায় ভরে ফেলা যায় তার ভিতরে। ওরা হয়তো এই কথাই বোঝাতে চায় আপনাকে যে সংবাদ সংগ্রহের সূত্র গভর্নমেন্টের চাইতে ওদের কম নয়। আজকাল তো আর আস্ফালন করতে কম যায় না কেউ!’

‘স্রেফ আস্ফালন কিনা, সে-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে ওদের ভবিষ্যদবাণী অন্তত একটা শুনে নিলে ভালো হয় না?’ —বলল ডানা, তারপর উইনবুমের অনুমতির অপেক্ষা না করেই হাতের কাগজখানা থেকে পড়তে শুরু করল— ‘২০৯০ সালের নববর্ষ দিবসে রাত্রি ৩টা ১৬ মিনিট ১০ সেকেন্ডর সময় আন্তর্নক্ষত্র বিমান ব্রিন্ডিসি আক্রান্ত হবে চারখানি শত্রুবিমানের দ্বারা থ্রি-গোস্ট এলাকার সন্নিকটেই—’

উইনবুম চেয়ারে খাড়া হয়ে উঠে বসলেন, ছিলাকাটা ধনুকের মতো তিরবেগে হাত বাড়িয়ে বললেন— ‘দেখি দেখি, চিঠিখানা দেখি—’

ধীরে সুস্থে স্কার্ট পালিশ করতে করতে ডানা বলল— ‘এই যে দিচ্ছি, আগে শুনে নিন আর একটু— চারখানি শত্রুবিমান, আগাপাশতলা রণসজ্জা তাদের, মাথায় হ্যামারস্মিথ-২-এর বিশেষ ধরনের আলো। ব্রিন্ডিসির অবস্থান সেসময়ে থাকবে— সাংকেতিক সংখ্যা ৮৮এ-থিটা-৮৮ আলেফ-ডি-পার্সি—’

‘ব্যাস, ব্যাস’— হুংকার দিয়ে উঠলেন উইনবুম— ‘আর না পড়লেও চলবে। যেটুকু শুনেছি, তাইতেই আপনাকে গারদে পাঠাতে আমি বাধ্য, তাতে আপনার টেলিভিশন কোম্পানি যতই চেঁচাক। এই আন্তর্নক্ষত্র সংস্থার কথা কিছুই জানি নে আমি। যে চিঠির খানিকটা বয়ান আমাকে পড়ে শোনালেন আপনি। সেটা আসল না জাল, তা নিয়েও কথা কইতে চাই নে আমি। কিন্তু যে বিষয়বস্তুটি আপনি শোনালেন, তা এই মুহূর্তে আমার এবং অন্য জনাচারেক মাত্র লোকেরই জানা থাকবার কথা। অন্য কেউ তা জেনে থাকলে, তার স্থান ইয়াংক্ষপের অন্ধকূপে।’

ডানার ভাবগতিকে বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ পায়নি এতক্ষণ, সর্বশক্তিমান ব্যুরোচিফের এত দাপাদাপি সত্ত্বেও। এইবার সে নীলচে-কালো কেশপাশে হাত বুলোতে বুলোতে বিশ্রম্ভালাপের সুরে বলল— ‘ব্রিন্ডিসি তাহলে সত্যিই ওই সাংকেতিক সংখ্যায় ওই নির্দিষ্ট সময়ে যাচ্ছে। একটা অতি গোপনীয় নবাবিষ্কারের কথাও বলছে ওই আন্তর্নক্ষত্র সংস্থা, তার যন্ত্রপাতিও থাকবে ব্রিন্ডিসিতে?’

‘আমাকে আপনি বাধ্যই করবেন দেখছি, আপনাকে জেলে পুরতে—’ দাঁতে দাঁত ঘষছেন উইনবুম— ‘নাকি, একটা বাজে গল্প ফেঁদে আমাকে ধোঁকা দিতে এসেছেন? বলতে চান যে আমার অফিসটা বিশ্বাসঘাতকে গিজগিজ করছে?’

‘বিশ্বাসঘাতকে গিজগিজ?’ —ডানা উপরে-নীচে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছে— ‘তা হতেও পারে, না-ও হতে পারে। আন্তর্নক্ষত্র সংস্থা ইয়ে করে থাকতে পারে, থ্রি-গোস্ট এলাকা থেকেই খবর সংগ্রহ করে থাকতে পারে।’

‘অসম্ভব!’ উইনবুম জোর দিয়ে বলে উঠল— ‘অ-স-ম্ভ-ব!’

‘কেন? অসম্ভব কীসে?’

‘কারণ, এই যে নবাবিষ্কারের ব্যাপারটা, ওটা থ্রি-গোস্ট এলাকায়, আমারই চরদের কাছে পৌঁছোয়নি এখনও— না থ্রি-গোস্টে, না হ্যামারস্মিথ-২-তে। কথাটা বুঝে দেখুন একবার। চিঠি যাবে তো বিমানে? না গিয়ে উপায় নেই। ইথারতরঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতি যার, সেই আলট্রাওয়েভে খবর পাঠালেও আমার থ্রি-গোস্টের এজেন্ট সেটা পাবে তিন-শো-চব্বিশ বছর পরে। আর বিমানে পাঠালে, দুই মাসও লাগবে না।’

‘তা ঠিক’— উদারভাবে স্বীকার করে নিল ডানা।

‘তবেই দেখুন’— তাকে বুঝিয়ে চলেছেন উইনবুম— ‘এই আবিষ্কারের যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্রিন্ডিসি এখান থেকে যাত্রা করেছে মাত্র পাঁচটি দিন আগে। বিমানের কোনো লোক বিমানে বসে যদি সেসব দেখে শুনে থাকে, সে এখন পর্যন্ত থ্রি-গোস্টে সেখবর পাঠাবার সময় পায়নি। ব্রিন্ডিসির চেয়ে দ্রুতগামী বাহন তো তার নেই! কারোই নেই!’

ডানা এবার উদাসীন— ‘তাহলে তো অনিবার্যভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে আপনার অফিসেই বিশ্বাসঘাতক আছে—’

হিংস্র শোনালো উইনবুমের প্রশ্ন— ‘কিন্তু আপনার ওই যে পত্র, ওর লেখকটি কে?’

‘সই করেছে কে এক শেলবি স্টিভেন্স।’

উইনবুম আভ্যন্তরীণ ফোনে ডায়াল ঘুরিয়ে দিলেন— ‘মার্গারেট! কারবারিদের তালিকায় দেখ তো, আন্তর্নক্ষত্র বার্তাবিনিময় সংস্থা কেউ আছে কিনা। থাকে যদি, তার মালিক কে?’

‘বাদ বাকি ভবিষ্যদবাণী শুনবার জন্য আপনার আগ্রহ নেই বোধ হয়?’ —জিজ্ঞাসা করল ডানা।

‘তা আর নেই?’ উইনবুম বললেন— ‘শুনব সব, কিন্তু তার আগে জানতে চাই, ওই অভাগা সংস্থা, ওরা যোগাযোগের কোন প্রণালী অবলম্বন করে কাজ চালায়, তা কিছু বলেছে কিনা চিঠিতে।’

‘বলছে বই কী! কী এক ডিরাক প্রেরক।’

উইনবুমের মুখ থেকে যা বেরুল, তাকে বলা যায় নির্ভেজাল নৈরাশ্যের আওয়াজ।

আবার আভ্যন্তরীণ ফোনে ডাকলেন মার্গারেটকে— ‘ডক্টর ওয়াল্ডকে পাঠিয়ে দাও তো!’

ওদিক থেকে রিসেপশনিস্ট মার্গারেট যা বলল— তাতে মুখ বিকৃত হয়ে গেল উইনবুমের— ‘ল্যাবরেটরিতে ফিরলেই এখানে পাঠাবে। দুই ঘণ্টার জন্যে টেকো বুড়োর কোথায় কী দরকার পড়ল এই সময় বল তো!’

আবার মার্গারেট কিছু বলল হয়তো। এবার উইনবুম প্রশ্ন করলেন— ‘তখন যে খবরটা নিতে বলেছিলাম— আন্তর্নক্ষত্র—’

তারপরই কান পেতে রইলেন কয়েক সেকেন্ড, তারপরই ছেড়ে দিলেন এই কথা বলে— ‘ওয়াল্ড এলেই পাঠিয়ে দিতে চাও—’

ডানার দিকে তাকিয়ে এইবার বললেন উইনবুম— ‘এই ওয়াল্ডই হচ্ছেন আমাদের নতুন আবিষ্কারের জনক। আর যে ডিরাক প্রেরকের কথা আপনি বলছিলেন এইমাত্র, সেই ডিরাকই হচ্ছে ওয়াল্ডের নবাবিষ্কার। যার কার্যকারিতা হাতে-কলমে পরীক্ষা নেবার জন্যই ব্রিন্ডিসি রওনা হয়ে গিয়েছে থ্রি-গোস্ট এলাকার মহাশূন্যে!’

‘খুব আশ্চর্য তো!’

ডানার কথার সুরে নিছক বিস্ময়— ‘যে ডিরাকের কার্যকারিতা সম্পর্কে তার আবিষ্কর্তাই এখনও নিঃসংশয় হতে পারেননি, সেই ডিরাকেরই সাহায্যে ভবিষ্যদবাণী করছে— আন্তর্নক্ষত্র সংস্থার শেলবি স্টিভেন্স?’

‘হ্যাঁ, ওই শেলবি স্টিভেন্স!’ —চিবিয়ে চিবিয়ে উইনবুম বললেন— ‘ওর নাম পাওয়া গিয়েছে আমাদের খাতায়। আন্তর্নক্ষত্র বার্তা-বিনিময় সংস্থা আসলে একটি মাত্র লোকের কোম্পানি, সেই একটি মাত্র লোকই হল আপনার শেলবি স্টিভেন্স।’

‘আশ্চর্য!’ —ডানা আগের কথারই আবৃত্তি করল আবার।

‘মাত্র একটি লোক’ —ডানার মন্তব্যে মনোযোগ না দিয়েই উইনবুম বলছেন— ‘মাত্র এক বছর আগে আমাদের দপ্তরে নাম উঠেছে ওর। আফিস রিকো সিটিতে। আপনি চিঠি পেয়েছেন রিকো সিটি থেকেই তো?’

মাথা নাড়ল ডানা, সায় দেওয়ারই মাথানাড়া।

হঠাৎ সোজা হয়ে বসে ডানার দিকে চোখা নজরে তাকালেন উইনবুম, ‘আপনার এখন করণীয় কী, জানেন তো? করণীয়, মানে যা না করলে আপনাকে আমি অন্ধকূপে আটক করতে বাধ্য হব?’

‘বলুন’ —উদাসীন উক্তি ডানার।

‘শেলবি স্টিভেন্সের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করা এবং টেলিভিশনের প্রোগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো দিকে মন না দেওয়া—’

ডানা উঠে দাঁড়াল— ‘তাহলে নমস্কার—’

ডক্টর ওয়াল্ড এসে উইনবুমের ঘরে ঢুকলেন প্রায় দুই ঘণ্টা পরে! কী মস্ত মাথা লোকটির! আর সেই মাথা জোড়া কী বিরাট টাক! মুখখানা সে অনুপাতে পাতলা বলতে হবে, গায়ের রং প্রায় কালো। তার কারণ, কয়েক পুরুষ ধরে ওরা বাসিন্দা ছিলেন পূর্ব আফ্রিকার, আমেরিকায় পাড়ি দেওয়া, মাত্র এই বছর কুড়ি আগের ঘটনা, ওয়াল্ড তখন প্রথম যৌবনে পা দিয়েছেন সবে।

ঘরে ঢুকেই ওয়াল্ড বললেন— ‘হ্যাঁ গো চিফ! মার্গারেটের মেজাজ অমন কড়া কেন? এই মারে তো এই মারে অবস্থা! আমায় কিনা তম্বি করে— ”আপনি ছিলেন কোথায়? আমরা খুঁজে খুঁজে হাল্লাক!”

‘মার্গারেটের কথা ছেড়ে দিন’ —মোলায়েম সুরে কথা কইছেন চিফ, ডিরাকের আবিষ্কারককে কোনো অবস্থাতেই রাগানো চলে না— ‘মার্গারেটকে নিয়ে কাজ করাই মুশকিল, কিন্তু সত্যিই আপনি ছিলেন কোথায়? ডানা লি-র সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দেওয়া দরকার ছিল খুব। সে একখানা চিঠি নাকি পেয়েছে, চিঠির কথা বিশ্বাস করি আর না-করি, এটা স্বীকার করতেই হচ্ছে যে ডিরাক প্রেরকের কথা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। কে এক শেলবি স্টিভেন্স—’

‘ডিরাকের কথা জানাজানি?’ —রাগে ফেটে পড়লেন টেকো ওয়াল্ড, ‘তাহলে আপনার ওই মার্গারেট ছাড়া অন্য কেউ এর জন্য দায়ী নয়! আমি সেই কবে থেকে পই পই করে বলছি কিনা যে এ জিনিস জানাজানি হয়ে গেলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে? আপনার বা আমার সর্বনাশের কথা আমি বলছি না। বলছি সমগ্র পৃথিবীর কথা, মানব জাতির কথা। ডিরাকের রহস্য যদি হ্যামারস্মিথ-২ জানতে পারে, বা আরস্কিনেরা জানতে পারে, কী হবে বলুন তো?’

‘হবে এই যে— পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস করে দেবার জন্য ওই শত্রুরা যুগ যুগ ধরে যে ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা এইবারে সার্থক হবে তাদের। হাজার আলোকবর্ষ তফাতে কোথায় কী ঘটছে, তা যদি ঘটনার সঙ্গেসঙ্গে মহাশূন্যের সর্বত্র একসাথে জানাজানি হয়ে যায়— তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।’

উইনবুমকে হঠাৎ থেমে যেতে হল। বিব্রত, হতবাক হয়ে। ডিরাকের আবিষ্কারক মনস্তাপে কপাল চাপড়াচ্ছেন। মাথায় চুল নেই, থাকলে এতক্ষণ ছিঁড়ে উপড়ে ফেলতেন সব। কালো মুখখানা লাল হয়ে উঠেছে উত্তেজনায়, থেমে থেমে জড়িয়ে জড়িয়ে বলছেন— ‘আমি কোথায় ল্যাবরেটরিতে বসে ডিরাকের রিসিভারটা নিখুঁত করবার চেষ্টা করছি—’

‘ল্যাবরেটরি? মার্গারেট যে বলল আপনি ল্যাবরেটরিতে নেই?’ বাধা দিতে বাধ্য হলেন উইনবুম।

‘মার্গারেট যা জানে, তাই বলেছে, তার দোষ কী? আমি তার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম, আর পাঁচ মিনিট পরেই ফিরে এলাম গুপ্তদ্বার দিয়ে। ল্যাবরেটরিতে একটা গোপন ঘর আমি বানিয়ে নিয়েছি, তা আপনাকেও জানতে দিইনি। সেইখানে বসেই আমার সবচেয়ে দামি গবেষণাগুলি আমি করি। যখন সেখানে থাকি, মার্গারেট জানে— আমি বেরিয়ে গিয়েছি—’

গড়গড় করে এই কথাগুলি বলে নিয়ে অবশেষে ওয়াল্ড জিজ্ঞাসা করলেন— কী করে জানাজানি হল? জানাজানি যে হয়েছেই, তার কী প্রমাণই বা পেয়েছেন আপনি?’

উইনবুম তখন সব ব্যাপার খুলে বললেন ওয়াল্ডকে? শুনতে শুনতে ক্রমাগত মাথা চাপড়াতে থাকলেন বেচারি আবিষ্কারক।

সেইদিনই রিকো সিটিতে হানা দিলেন উইনবুম। শেলবি স্টিভেন্সের ছোট্ট অফিসে। রিসেপশনিস্ট এক জন না অছে, তা নয়। কিন্তু তার কাজ অল্প, আর সে কাজের সঙ্গে খাতাপত্র চিঠিচাপাটির কোনো সংশ্রব নেই। লোকজন এলে তাদের খাতির করা, আর স্টিভেন্সের অনুপস্থিতিতে ফোনটা ধরা, ব্যাস, এই পর্যন্ত।

আর সব কাজই একা হাতে করেন শেলবি স্টিভেন্স।

যাকে বলে থুত্থুড়ে বুড়ো। শনের নুড়ি চুল দাড়ি, দুটোই অতিরিক্ত লম্বা। মুখে অমায়িক হাসি, রং ধবধবে সাদা। এ লোক ডিরাক নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, থ্রি-গোস্টে ব্রিন্ডিসির উপর শত্রুবিমানের সুনিশ্চিত হামলার সম্বন্ধে ভবিষ্যদবাণী করছে। একথা উইনবুম কদাচ বিশ্বাস করতে পারতেন না। ডানার কাছে আগে থাকতে সব খবর না পেলে।

‘কী করে ডিরাকের রহস্য জানলেন আপনি?’ —রুক্ষ প্রশ্ন উইনবুমের।

‘তা কি বলতে পারি আপনাকে?’ —মধুর হাসি হেসে বৃদ্ধ জবাব দিলেন— ‘ব্যবসার রহস্য কেউ প্রকাশ করে?’

‘গুপ্তচরবৃত্তির মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়ে থাকি আমরা’ —হুংকার করে ওঠেন উইনবুম।

‘বড়ো বড়ো উকিলের পরামর্শ নিয়েছি মশাই’ —মুখের হাসি অম্লান শেলবির, ‘সবাই একবাক্যে বলেছে— আমার কেশাগ্র আপনি স্পর্শ করতে পারেন না। আমি আপনার ব্যুরো থেকে খবর বার করেছি। এর প্রমাণ কী? আমার এজেন্ট আছে মহাশূন্যের সর্বত্র। তারা অকুস্থল থেকে খবর পাঠাচ্ছে।’

‘ঘটনা ঘটার মুহূর্তেই?’

‘ঘটনা ঘটার মুহূর্তেই। ডিরাকের কী পরিমাণ কাজ দেবে, তার পরীক্ষা নেবার জন্য আপনি তো ব্রিন্ডিসিকে এই সবে পাঁচ দিন আগে পাঠালেন। আমার সে পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে এক বছর আগে।’

‘তাহলে বলুন আপনিই ডিরাকেই আবিষ্কর্তা? ওয়াল্ড নন?’—শাণিত বিদ্রূপ উইনবুমের কথায়।

‘দু-জনেই! দু-জনেই! দু-জন বিজ্ঞানী পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে একই আবিষ্কার করে বসল, এমনটা আগেও কি হয়নি?’

একটুখানি চুপ করে থেকে উইনবুম বললেন— ‘আপনি যদি সারাজীবন অন্ধকূপে বাস করতে না চান, তাহলে আপনাকে আমার ব্যুরোর শামিল হতে হবে। কী চান আপনি পারিশ্রমিক?’

‘প্রথম কথা অন্ধকূপে আমাকে নিক্ষেপ করার মতো আইন পৃথিবীতে নেই। আর আপনি যতই শক্তিমান হোন, আইন লঙ্ঘনের সাহস নেই আপনার। তাহলে আসছে ওই পারিশ্রমিকের কথা। ওর একটা হিসেব আমার করাই আছে। আপনি ব্যুরোর খরচা বাবদ পৃথিবীর রাষ্ট্রসংঘের কাছ থেকে যা অর্থ পেয়ে থাকেন, ওইটে সব দিয়ে দিলেই আপনি পাবেন আমার সহযোগিতা।’

বলতে বলতেই এক এক টানে শেলবি স্টিভেন্স মাথা থেকে সাদা চুল এবং মুখ থেকে সাদা দাড়ি খুলে ফেললেন। স্তম্ভিত উইনবুম বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন সাদা চুলের নীচ থেকে বেরিয়ে পড়ছে নীলচে-কালো ববছাঁট চকচকে চুল। আর সাদা দাড়ির নীচে থেকে আত্মপ্রকাশ করছে ডানা লি-র বাদামি রং মসৃণ মুখকান্তি।

‘কিছু মনে করবেন না চিফ। আবিষ্কারককে বিদায় করবেন তুচ্ছ একটি মিলিয়ন ডলার দিয়ে, আর তারপর ডিরাকের মুনাফা বাবাদ আপনি আর আপনার কেরানিরা এজেন্টরা লুটতে থাকবেন মাস মাস পাঁচ মিলিয়ন, এটা আমার কাছে ন্যায্য মনে হয়নি। তাই আপনাকে প্যাঁচে ফেলতে হল খানিকটা।’

এতক্ষণে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠেছেন উইনবুম, তিনি তিরিক্ষে মেজাজে বলে উঠলেন—’আবিষ্কারক! আবিষ্কারক কী বলছেন মিস লী? আবিষ্কারক তো ডক্টর ওয়াল্ড!’

‘আমিও! আমিও! এক জন মিলিয়ন পাবেন, আর এক জন কিছুই পাবেন না। এই কি ন্যায় বিচার? বিশেষ, ওয়াল্ডের পরীক্ষানিরীক্ষা যেখানে শেষ হয়নি এখনও, অথচ আমার হয়ে গিয়েছে।’

‘আমি ওয়াল্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে আপনাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাব।’ এই বলে দীর্ঘপদক্ষেপে উইনবুম বেরিয়ে গেলেন শেলবি স্টিভেন্সের আফিস থেকে।

ডানা ফোনে ডাকল রিসেপশনিস্টকে— ‘আমি বেরুচ্ছি। যতক্ষণ না ফিরি, তুমি থাকবে অফিসে।’

তারপর দেরাজ থেকে একটা রবারের টুপি সে বার করল, পরে ফেলল মাথায়।

মাথাজোড়া টাক দেখা দিল এক সেকেন্ডের ভিতর। মুখে একটা কালো রং মাখানো, নাকটা মোটা আর চোয়ালটা উঁচু করে তাতে একটা আঁচিল লাগিয়ে নিতে লাগল এক মিনিট। তারপর পোশাক বদলানো পাঁচ মিনিট আরও।

তারপর— শেলবি স্টিভেন্সের পিছনের দরজা দিয়ে যে ভদ্রলোক সন্তর্পণে বেরিয়ে গেলেন, তিনি ডক্টর ওয়াল্ড।

সকল অধ্যায়

১. ১. আলফা সেন্টৌরির পথে
২. ২. লতার নাম হাঁউ-মাঁউ-খাঁ
৩. ৩. দশ লাইট-ইয়ার দূরত্বে
৪. ৪. মহাকাশের পালকওয়ালা মানুষ
৫. ৫. নক্ষত্র? না, ক্ষেপণাস্ত্র
৬. ৬. মঙ্গলের প্লেগ
৭. ৭. জীবন-মৃত্যুর লটারি
৮. ৮. পৃথিবী যখন ধ্বংস হল
৯. ৯. জীবন-মৃতের জাদুঘর
১০. ১০. এগিয়ে চলো অসম্ভবের মুখে
১১. ১১. এম-১
১২. ১২. কালচক্রের সওয়ার
১৩. ১৩. পাগলা গ্রহ
১৪. ১৪. রোবট বন্ধুর মৃত্যু
১৫. ১৫. অস্য দগ্ধোদরস্যার্থে
১৬. ১৬. ক্লোরোফাগ
১৭. ১৭. সন্ত্রাসবাদী বৈমানিক
১৮. ১৮. কত রহস্য ওই অসীমে!
১৯. ১৯. মহাবিমানের উল্লম্ফন
২০. ২০. জীবন কোথায় নেই?
২১. ২১. আঙুল যাদের ছ-টা
২২. ২২. আজি হতে শতবর্ষ পরে
২৩. ২৩. ফিরে চলো গুহামানবের যুগে
২৪. ২৪. ধূমকেতুর উদরে
২৫. ২৫. হাসপাতালের ‘টি’ ওয়ার্ড
২৬. ২৬. দেহান্তরী
২৭. ২৭. অ্যাপিনের গবেষণা
২৮. ২৮. মঙ্গলের পথে সেকেলে কাপ্তেন
২৯. ২৯. ত্রিমূর্তি
৩০. ৩০. এক ঘুমে এক-শো বছর
৩১. ১. ভৌতিক কুকুর
৩২. ২. মোড়ের দোকান
৩৩. ৩. রাক্ষসীর পূজা
৩৪. ৪. অশরীরী স্নেহ
৩৫. ৫. অশরীরী ঈগল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন