অর্পিতা সরকার
তিথি হঠাৎই আবিষ্কার করল অফিসে ও একা বসে আছে৷ ল্যাপটপে মুখ ডুবিয়ে ছিল বলেই হয়তো শূন্যতাটা অনুভব করেনি৷ এখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, সব ক-টা টেবিল ফাঁকা৷ এমনকী কাজ অন্ত প্রাণ প্রাণেশদার টেবিলও ফাঁকা৷ এত বড়ো হলঘরে কখনো একা বসে থাকেনি তিথি৷ তাই আচমকাই একটা শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরতে আসছে৷ এই অসতর্ক মুহূর্তটাকে কোনোরকম প্রশ্রয় দিতে ও রাজি নয়৷ তিথি জানে একটু প্রশ্রয় পেলেই একাকিত্ব থেকে দুঃখ-বিলাসিতা সবাই জোট বেঁধে ওর ঘাড়ে এসে চাপবে৷ তাই তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ বন্ধ করে, ব্যাগ গুছিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলল তিথি৷ গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সুকুমার৷ ওকে দেখেই সচকিত হয়ে বলল, ‘আজ এত দেরি হল যে ম্যাডাম? আমি গেট বন্ধ করব বলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি৷ সোনালি ম্যাডাম জানিয়ে গেল, আপনি একটা কাজে আছেন৷
তিথি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ এতটা দেরি হবে, আমিও বুঝতে পারিনি৷’
তিথির এটা নিজের অফিস৷ বিশাল কিছু বড়ো অফিস নয়৷ গোটা পনেরোজন কর্মী নিয়েই ওর অফিস৷
তিথি ওর আই টেনের সিটে বসে সিট বেল্টটা বাঁধতে বাঁধতেই মাধবীলতা গাছটার দিকে তাকাল৷ ডালপালা আড়াল করে ঝাঁপিয়ে ফুল এসেছে গাছটাতে৷ ওদের অফিসের গেটটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে লতানো ফুলগুলো৷ নিজের সংসারে অন্যের উপস্থিতি একেবারেই মেনে নেবে না বলেই গেটের পাশের ঝাউ গাছ দুটোকেও খুব বেশি বাড়তে না দিয়ে ওদের মাথাতেও নিজের আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে৷ কেন যে এভাবে নিজের অধিকার চাইতে পারে না তিথি কোথাও, কে জানে! আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল মুখটা কেমন গোমড়া করে রেখেছে৷ ঠিক যেন অভিমানী ছোট্ট মেয়েটি৷ বাবার ওপরে রাগ করে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে দোর দিয়েছে৷ একপ্রস্থ কেঁদে নিলে মন্দ হয় না, কিন্তু অভিমানী মন কাঁদতেও নারাজ, তাই গাল ফুলিয়ে বসে রয়েছে৷ তিথি গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার আগে আরেকবার সাইনবোর্ডের দিকে তাকাল, ‘চুপি চুপি’ লেখাটা এল.ই.ডি. আলো পড়ে ঝকঝক করছে৷ এ নামটার পুরো ক্রেডিট অবশ্য স্নেহাংশুর৷ ও-ই প্রথম বলেছিল, ‘আচ্ছা তিথি, ছোটোবেলায় তোর কোন বই পড়তে সব থেকে বেশি আগ্রহ ছিল?’
তিথি না ভেবেই উত্তর দিয়েছিল, ‘বড়োদের বই৷ মানে যেগুলো পড়তে বাড়িতে নিষেধ করত সেগুলো৷’
‘স্নেহাংশু সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলেছিল, ‘তার মানে তুই একটা কথা মেনে নিচ্ছিস তো, গোপন জিনিসের প্রতি আমাদের আগ্রহ অদম্য৷ মানে চুপি চুপি করার একটা আলাদা থ্রিল আছে৷ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি টান সবাই অনুভব করি৷ তাই তোর এই অফিসের নাম দে ‘‘চুপি চুপি’’৷ নামটা মানুষকে টানবেই৷ এরপর তো তোর কাজ তোকে ফেমাস করবে৷ মানে কতটা গোপনীয়তা বজায় রেখে তুই মানুষের মনের ট্রিটমেন্ট করতে পারছিস সেটার ওপরে তোর অফিসের সুনাম ছড়াবে৷ স্টাফ নিয়োগ করার সময় একটা জিনিস মাথায় রাখবি, যেন পেট-পাতলা না হয়৷ তাহলেই গেলি৷’
তিথি স্নেহাংশুর হাতটা ধরে বলেছিল, ‘প্লিজ ইন্টারভিউয়ের সময় তুই একটু থাকবি৷’ তিথি জানে স্নেহাংশু বেশি দিন এক জায়গায় থাকার ছেলে নয়৷ নিরুদ্দেশ হওয়াটাই ওর নেশা৷ ফোন সুইচড অফ করে কোথায় যে ঘুরে বেড়ায়, কেউ জানে না৷ ওর ফোনের সুইচড অন হয় শুধু ওর মর্জিতে৷ স্নেহাংশুর মা মারা যাবার পর থেকেই ও এমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে৷ বাবার বিশাল ব্যাবসা, কিন্তু সেদিকে ওর মন নেই৷ ও ঘুরে বেড়ায় আপনমনে৷ কখনো দেখা যায় ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়ে ঘুরছে স্নেহাংশু, কখনো আবার ফুটপাতের টি-শার্ট পরে বিন্দাস৷ অদ্ভুত এক ভবঘুরে জীবন কাটল ছেলেটা আটাশ বছর পর্যন্ত৷ ফিজিকস নিয়ে পড়াশোনা করেছে, তুখোড় রেজাল্ট৷ কিন্তু ও যে ঠিক কী চায়, নিজেই বোধহয় জানে না৷ প্রায় বছর তিনেক পরে তিথিদের বাড়িতে এসে হাজির৷ এতে অবশ্য তিথি আশ্চর্য নয়৷ ও জানে, এমন ঝড়ের মতোই ও আসে৷ তিথির গোছানো ভাবনাচিন্তাগুলোকে নিমেষে ভুল প্রমাণিত করে দেয় যুক্তি দিয়ে৷ তারপর বিধ্বস্ত এলোমেলো তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে ওর ঘেমো বুকে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘এত কনফিডেন্স কম নিয়ে এগোবি কী করে? আমি এসে কয়েকটা যুক্তি দিলাম আর তোর ভাবনাগুলো সব ঘেঁটে গেল? দুটো যুক্তি সাজাতে পারলি না নিজের কাজের সপক্ষে? দেখ, আমি আবার তোর ঘেঁটে-যাওয়া ভাবনাকে সাজিয়ে দিচ্ছি৷’ স্নেহাংশু নিজের দেওয়া যুক্তিগুলোকেই নিষ্ঠুরভাবে কাটতে কাটতে এগিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দেয় তিথিই ঠিক, ও ভুল৷ ঠিক যেন ম্যাজিশিয়ান৷
ওর পুরুষালি বুকে ঘেমো গন্ধে হাঁসফাঁস করে ওঠে তিথি৷ তবুও থাকতে চায় আরও কিছুক্ষণ৷ কিন্তু স্নেহাংশু ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘সোজা সিল্ক রুট থেকে আসছি, মাত্র সাত দিন স্নান করিনি৷ ঘামের গন্ধটা বড্ড কটু লাগছে তা-ই না রে? দাঁড়া, ফ্রেশ হয়ে আসি৷’ সোজা ঢুকে যায় তিথির বাথরুমে৷ তিথি অপলক তাকিয়ে থাকে বোহেমিয়ান স্নেহাংশুর দিকে৷ বুকের ভিতরটা শিরশির করে ওঠে৷ এই অনুভূতি স্নেহাংশু ওকে এখনও মনে রেখেছে বলে নাকি আবার ভুলে চলে যাবে বলে বুঝতে পারে না তিথি৷
আজকের কেসটাতে স্নেহাংশুকে ওর বড্ড প্রয়োজন৷ কেন কে জানে মনে হচ্ছে, এই ঊর্মিলা মেয়েটাকে স্নেহাংশুই বাঁচাতে পারত৷
মেঘের গুরুগুরু ডাক শোনা যাচ্ছে৷ গাড়ির অল্প স্পিড বাড়াল তিথি৷ নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে আরও মিনিট দশেক৷ ‘চুপি চুপি’ খোলার পরেই নিজের বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল তিথিকে৷ বাবা আর দাদা দুজনেই বলেছিল, ‘যদি কোনো কোম্পানিতে চাকরি করে তাহলে ঠিক আছে কিন্তু এসব আজব কারখানা খোলার দরকার নেই৷’ তিথি নিজের সিদ্ধান্তে স্থির ছিল৷ তাই দাদা একদিন স্পষ্ট বলেছিল, ‘এ বাড়িতে বসে এসব আজব কাজকর্ম করা যাবে না৷’ বাবারও একই মত বুঝেছিল৷ একমাত্র মা নিজের জমানো বেশ কিছু টাকা আর গয়না দিয়ে বলেছিল, ‘মেয়েদের এসব করতে নেই— এই ভাবনাটাকে ভেঙে দিস৷’ মায়ের টাকাতেই ফ্ল্যাটটা বুক করেছিল তিথি৷ এক কামরার ছোটো ফ্ল্যাট৷
বাবার কথায় বাড়িতে একদিন পুলিশ আসবে৷ মানসিক রোগীর কাউন্সেলিং করা অত সহজ কাজ নয়৷ কে সুইসাইড করবে আর তখন ফাঁসবে তিথি৷ এতদিনের অর্জিত সব সম্মান শেষ হবে তিথির জন্য৷ সুতরাং তনয় বোসের মেয়ের পরিচয়ে এ বাড়িতে থেকে এসব আজগুবি কাজ নাকি করা যাবে না৷
ফোনটা বাজছে তিথির৷ গাড়িটা পার্ক করেই রিসিভ করবে, না হলে কল ব্যাক করবে না হয়৷ নিজের নির্দিষ্ট পার্কিং-এ পার্ক করার ফাঁকেই ফোনটা কেটে গেল৷
কল ব্যাক করতেই অত্যন্ত পরিচিত গলাটা শুনতে পেল তিথি৷ ‘কী রে, তোর চুপি চুপির অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি তো, তোর গার্ড বলল, তুই বেরিয়ে গেছিস৷’
এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না তিথি৷ স্নেহাংশু? ঠিক ওকেই যে দরকার ওর এই কঠিন সময়ে৷ তিথি বলল, ‘নম্বর বদলেছিস? এটা নতুন নম্বর?’
স্নেহাংশু বলল, ‘দেশটা চোরে ভরে গেছে মাইরি৷ আজব ভিখারি চোর মাইরি৷ না হলে আমার সাত জন্মের পুরোনো ফোনটাও চুরি করে নেয়? শালা গজব সব চোর৷’
‘তিথি বলল, ‘অ্যাড্রেস লেখ৷ আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়৷ বাড়িতে আর থাকি না আমি৷’
স্নেহাংশু হেসে বলল, ‘আহা আমার তিথি হল সাবালিকা৷ মাত্র আটাশেই? ভাবা যায় না বস৷ জাস্ট ভাবা যায় না৷’
তিথি ফ্রেশ হয়ে ঘরের পোশাক পরতে পরতেই ভাবল, এখুনি ঢুকবে উড়নদত্যিটা৷ রাতের খাবার বেশিই করা আছে তিথির৷ সবিতা কম রান্না করতে পারে না বলে রোজই বকা খায়৷ আজ কাজে লেগে যাবে৷ সোফায় বসার আগেই গেট থেকে ফোন এল৷ গেটে হ্যাঁ বলতেই স্নেহাংশুকে ছেড়ে দিল৷ দরজাটা খুলেই রাখল তিথি৷ ঝড়ের গতিকে শুধু শুধু বেল বাজিয়ে আটকে রাখার দরকার নেই৷ ঝড়ের গতিতেই ঢুকল স্নেহাংশু৷ পিঠ থেকে বড়ো সাইজের রুকস্যাক ব্যাগটা ধপ করে নামিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে, এটা তোর নিজের ফ্ল্যাট? মানে এখানে যদি আমি দিন সাতেক থাকি, কেউ কিছু বলবে না?’ তিথি প্রায় বছর আড়াই পরে দেখছে স্নেহাংশুকে৷ এতটুকু বদলায়নি৷ এমনভাবে কথা বলছে যেন গতকালই কথা হয়েছে ওর সঙ্গে৷
তিথি বলল, ‘তোর যতদিন ইচ্ছে থাক৷ কিন্তু তুই কি জানিস, আমি গত আট দিন ধরে শুধু তোকেই ভেবেছি৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘তুই বলতে চাইছিস টেলিপ্যাথি কথাটা আসলে সত্যি? কেন খুঁজেছিস, পরে শুনছি৷ আপাতত লাখ চারেক টাকা তোর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতে চাই৷’
‘তিথি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কার টাকা?’
ওয়াশরুমে যেতে যেতে স্নেহাংশু বলল, ‘চোরাই টাকা৷’
তিথি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কী হেঁয়ালি করছিস বল তো?’
স্নেহাংশু বলল, ‘শোন, এ হল সিতাংশু রায়ের অহংকারের টাকা৷ তাই ছেলে হিসাবে আমারও প্রাপ্য বলে আমাকেও পাঠিয়েছে, বুঝলি? কিন্তু এত টাকা আমার অ্যাকাউন্টে থাকলে কেমন একটা অদ্ভুত ফিলিং হয় মাইরি৷ নিজেকে ফালতু বড়োলোক মনে হয়৷ শোন, তুই নিজস্ব ফ্ল্যাট কিনেছিস, নিশ্চয়ই ই.এম.আই. টানছিস৷ এটা দিয়ে শোধ করে দে কিছুটা৷ কারণ আমি যখন ফিরব তখন এই ফ্ল্যাটেই ডেরা গাড়ব বস৷’
তিথি বলল, ‘তুই আমার এখানে থাকবি বলে তোকে আমার ব্যাঙ্ক লোন শোধ করতে হবে না পাগল৷’
ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে স্নেহাংশু বলল, ‘নিলে নে, এত তেল দিতে পারব না৷ না নিলে বিলোনোর লোক খুঁজতে হবে৷ অযথা এসব টাকাপয়সার চক্করে আমি পড়ব না৷ তারপর আমার এই বন্ধনহীন জীবনটা ওই ব্যাটা ক-টা টাকা দিয়ে বেঁধে দেবার যে চক্রান্ত চলছে তাতে পড়ে যাবে৷’
তিথি আলতো গলায় বলল, ‘বেশ দিস৷ আপাতত খেতে বোস৷’
স্নেহাংশু খেতে বসেই বলল, ‘বল, কেন আমায় স্মরণ করছিলিস?’
তিথি বলল, ‘আমার চুপি চুপিতে একটা কেস এসেছে, কেসটা খুব সেনসেটিভ আর বেশ জটিল৷ মেয়েটার নাম ঊর্মিলা৷ মেয়েটা কোনো ডক্টরের কাছে যাবে না৷ অথচ নিজের সব সমস্যা জানে৷’
স্নেহাংশু চিকেনের লেগ পিসটা আয়েশ করে খেতে খেতে বলল, ‘হ্যাঁ রে, এখানে চিকেন এখন কত করে চলছে রে?’
তিথি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুই শুনছিস না, তা-ই না?’
স্নেহাংশু চৈতন্যদেবের মতো নিষ্পাপ মুখ করে বলল, ‘যদি ডক্টরের কাছেই যাবে তাহলে তোর এখানে আসবে কেন? তুই সাইকোলজি নিয়ে পড়েছিস বলে? আরে পাগলা, এরা ডক্টরকে বিশ্বাস করে না৷ এরা ভাবে, ওষুধ দিয়ে এদের পাগল করে দেবে৷ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না৷ তুই বেশি জ্ঞান দিবি তো তোকেও কাঁচা কলা দেখিয়ে চলে যাবে৷ এসব ছেলে-মেয়ের বয়েই গেছে৷ বাপ-মায়ের অঢেল আছে আমার মতো৷ তাই মোটা ফিজ দিতে এদের আটকাবে না৷ শুধু একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে বস, রাজকুমার বা রাজকুমারীর ইগো যেন হার্ট না করে৷’
তিথি বলল, ‘নাম ঊর্মিলা৷’
স্নেহাংশু ফোড়ন কাটল ‘মাতন্ডকর? মাইরি ফিগারটা কিন্তু ভালো ছিল৷’
তিথি ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘বয়েস মাত্র বাইশ৷ ব্রেকআপ হয়েছে সদ্য৷ নিজেই ব্রেকআপ করেছে৷ ছেলেটা এতদিন সিঙ্গল ছিল ব্রেকআপের পর৷ কিন্তু কয়েকদিন হল ঊর্মিলা জানতে পেরেছে, ওর এক্স-লাভার নির্বাণ আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়েছে৷ ব্যাস ওর প্রবলেম শুরু এখান থেকেই৷ এখন ও নিজের সব কাজ ছেড়ে নির্বাণকে ফলো করছে৷ রীতিমতো অ্যাসিড অ্যাটাক করবে বলেও ভেবে রেখেছে৷ ওর মনে হচ্ছে এটা অন্যায়৷ ব্রেকআপের পর নির্বাণ যার সঙ্গে ইচ্ছে রিলেশনশিপ চালাতেই পারে, তাতে ওর ইন্টারফেয়ার করার কিছুই নেই৷ তবুও ও কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না৷ ওর আরেকটা মন সর্বক্ষণ ক্ষতি করতে চাইছে নির্বাণের৷ এই অসুস্থ মনটার ট্রিটমেন্ট করতে চায় ও৷ প্লিজ হেল্প কর৷ না হলে মেয়েটা একটা ক্রাইম করবে আর ছেলেটাও বাঁচবে না৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘মেয়েটার একটা প্রেমিক জুটিয়ে দিতে পারলি না? এত বড়ো কলকাতা শহরে কি প্রেমিক ভাড়া পাওয়া যাবে না? ঊর্মিলার জন্য একজন প্রেমিক ভাড়া করে দে, দেখ, এসব ক্রাইম করার ইচ্ছে চলে যাবে মেয়েটার৷ প্রেমিককে কিন্তু বেশ কেয়ারিং হতে হবে৷ মানে আগের প্রেমিককে জাস্ট ভুলিয়ে দিতে হবে৷’
তিথি জল খেয়ে বলল, ‘আচমকা এমন প্রেমিক পাব কোথায়? যদিও ঊর্মিলার প্রচুর টাকা৷ ও খরচ করতেও প্রস্তুত৷ প্রেমিক ভাড়া করাই যায়৷’
স্নেহাংশু বলল,‘হ্যাঁ রে, তুই কি আর স্মোক করিস না? ছেড়ে দিয়েছিস?’
তিথি বলল, ‘আজকাল আর স্মোক করি না রে৷ হেলথের কথা ভেবেই৷’
স্নেহাংশু সিগারেটটা তিথির ঠোঁটে ঠেকিয়ে বলল, ‘জোরে টান দেখি৷’ তিথি জোরে টানতেই দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে কেশে উঠল৷ মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে স্নেহাংশু বলল, ‘দেখ, এবারে তোর বুদ্ধি খুলবে৷ বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে দিলাম৷ হ্যাঁ রে তিথি, আজকাল রোদে ঘুরে ঘুরে আমি কি একেবারেই হতকুচ্ছিত হয়ে গেছি? না মানে চোখের সামনে আমার মতো হ্যান্ডু ছেলে থাকতেও তুই প্রেমিক ভাড়া করার আগে আমার কথাটা একবারও ভাবলি না, এটাতেই ভীষণ আপসেট হলাম৷ শোন, ঊর্মিলার প্রেমিক হিসাবে আমি প্রক্সি দিলে চলবে? আপাতত কিছুদিন কলকাতাতেই থাকব ঠিক করেছি৷’
‘তিথি একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘তুই? মানে এটা আমার চুপি চুপির একটা কেস মাত্র৷ না সলভ করতে পারলে ছেড়ে দেব৷ তা-ই বলে এমন একটা ক্রিমিনাল মাইন্ডেড মেয়ের চক্করে তোকে জড়াতে চাই না রে৷ দু-দিন পরে যদি ঊর্মিলা বোঝে এটা গটআপ কেস, অথবা তোদের সম্পর্কটা ব্রেকআপের পরে যদি ও আগের প্রেমিকের মতোই তোর প্রতিও হিংস্র হয়ে ওঠে তখন?’
স্নেহাংশু সোফায় লম্বা হয়ে আরাম করে বসে বলল, ‘নিজের প্রতি যদি এটুকু বিশ্বাসই না থাকে তাহলে আর তোর পরামর্শদাতা হয়ে কলার তুলি কেন? কেসটা তুই আমার ওপরে ছেড়ে দে৷’
তিথি বলল, ‘কিন্তু ঊর্মিলার সেকেন্ড ব্রেকআপের পরে যদি ও আরও অ্যাডামেন্ট হয়ে যায় তাহলে? তখন সামলাতে পারবি?’
স্নেহাংশু হেসে বলল, ‘তুই না আমার বেস্টি, বন্ধুর প্রেম শুরুর আগেই ব্রেকআপ ব্রেকআপ বলে অশুভ গাইছিস কেন? হতেও তো পারে তোর ঊর্মিলা মাতন্ডকর আমার মতো উড়নচণ্ডীকে সংসারের জাঁতাকলে বেঁধে ফেলল?’
তিথি অপলক তাকিয়ে রইল স্নেহাংশুর দিকে৷ কী অবলীলায় বলছে স্নেহাংশু ঊর্মিলার সঙ্গে বিয়ের কথা! ও কি বোঝেই না তিথি ওর অপেক্ষায় থাকে? হয়তো বোঝে না৷ স্নেহাংশু বলল, ‘আরে কী দেখছিস হাঁ করে? চিনিস তো আমায়? একটু ভরসা কর প্লিজ৷’
তিথির ইচ্ছা করছিল বলতে, ‘প্লিজ তুই একলা থাক কিন্তু অন্য কারো হোস না৷’ কিন্তু স্নেহাংশুর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা এমনই যে সবকিছু শেয়ার করা গেলেও ‘ভালোবাসি’টা বলা যায় না৷ হয়তো ওর ‘ভালোবাসি’ শুনে হা হা করে অট্টহাসি হাসবে, নয়তো ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলবে, ‘প্লিজ নুন-তেলের হিসেব কষতে বসাস না আমায়’, অথবা বলবে, ‘দশটা-পাঁচটা জীবনে চাইছিস আমায়? তাহলে চললাম আমি৷’
তিথি স্নেহাংশুকে হারাতে পারবে না এভাবে৷ তাই বলা হয়ে ওঠেনি— ভালোবাসি৷ স্নেহাংশু তো শুধুই পাহাড়, জঙ্গল, ঝরনা, সমুদ্রের প্রেমে হাবুডুবু খায়৷ তিথিকে নিয়ে ভাবার মতো সময় কোথায় ওর কাছে?
স্নেহাংশু উদাস গলায় বলল, ‘জানতে চাইলি না তো কেন এখন কিছুদিন কলকাতায় থাকব? কেন ফিরতে চাইছি না পাহাড়ে?’
তিথি বলল, ‘সে তো তোর ইচ্ছে, যেটার মালিক শুধু তুই নিজে৷ ওখানে ঢোকার অধিকার কি আমার আছে?’
স্নেহাংশু আচমকা তিথির হাত ধরে বলল, ‘অধিকার কেউ কাউকে দেয় না পাগলি, অধিকার কেড়ে নিতে হয়৷ তুই আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বলেই না এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তোর কাছে এলাম৷ এটুকুও যদি না বুঝিস তাহলে আর কী করব?’
তিথি স্নেহাংশুর হাতের উত্তাপটুকু অনুভব করে বলল, ‘বুঝলাম, তোর জীবনে আমি এক টুকরো জায়গা নিয়ে হলেও আছি৷ এবারে বল, কেন কলকাতায় বেশি দিন থাকতে চাইছিস?’
স্নেহাংশু অবসন্ন গলায় বলল, ‘ভালোবাসা বড্ড নিষ্ঠুর জানিস তো৷ আমার মতো পাষাণকেও কাঁদিয়ে ছাড়ল৷’
তিথি দেখল লিভিং রুমের ঘড়ির কাঁটাটা ছুটছে৷ কিন্তু ও জানে, আজ যদি বলে, স্নেহাংশু কাল সকালে বলিস, আজ অনেক রাত হল তাহলে ওর আর শোনাই হবে না৷ কারণ কাল ভোরে ও সম্পূর্ণ অন্য মুডের স্নেহাংশুকে পাবে৷ আজ মধ্যরাতের স্নেহাংশু অন্যরকম রহস্যময়৷ তাই তিথি ভ্রূ-তে কোনোরকম ভাঁজ বা বিরক্তি না প্রকাশ করেই বলল, ‘ভালোবাসার তুই কী বুঝিস রে? তুই কবে কাকে মন দিলি? চিরটা কাল তো উড়েই গেলি৷ কলেজের সেই মীনাক্ষীকে মনে আছে তোর স্নেহাংশু? তোর জন্য পাগল ছিল?’
স্নেহাংশুর চোখে তখন সমুদ্রের গভীরতা৷ তাই তিথির এসব হালকা কথায় কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দিয়ে বলল, ‘ভালোবেসেছিলাম জানিস হৃষীকেশের ওখানে একটা মেয়েকে৷ মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল৷ ওর প্রেমিক ওকে প্রেগন্যান্ট করে দিয়ে পালিয়েছিল৷ নরেন্দ্রনগর একটা পাহাড়ি ছোটো জনপদ বলতে পারিস৷ পাহাড়ি মেয়ে বিয়ের আগেই প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে বলে বাড়ি থেকেও তাড়িয়ে দিয়েছিল৷ মেয়েটা কী সৎ জানিস? কিছুতেই প্রেমিকের নাম বলেনি৷ তবে সবাই সন্দেহ করেছিল বরুণ নামের একটা ছেলেকে৷ কারণ ঝোরায় জল নিতে গিয়ে এই ছেলেটার সঙ্গে লোকজন রুনঝিকে গল্প করতে দেখেছিল৷ রুনঝি অবশ্য বরুণকে দোষী করেনি৷ তাই খারাপ মেয়ে বলে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিল৷ গঙ্গোত্রী যাবার রাস্তায় একটা চটিতে মেয়েটা সকলকে শরবত করে খাওয়াচ্ছিল৷ প্রতি গ্লাস দশ টাকা৷ বিশ্বাস কর, মেয়েটার চোখে অদ্ভুত একটা মায়া ছিল৷ আমি দু-গ্লাস শরবত খাওয়ার পরেও যখন ওখানেই বসে রইলাম, তখন রুনঝি ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আর কিছু লাগবে?’
‘আমি ওকে বললাম, কী নাম তোমার? স্বামী কী করে? মেয়েটা যে প্রেগন্যান্ট সেটা বোঝা যাচ্ছিল৷ রুনঝি কোনো কপটতার আশ্রয় না নিয়ে সরল গলায় বলেছিল, আমার বিয়ে হয়নি৷ এ আমার ভালোবাসার ফসল৷ সে বিয়ে করতে চায়নি তাই করিনি৷ একে সবাই নষ্ট করতে বলেছিল, কিন্তু আমি মা হতে চাই তাই একে জন্ম দেব৷ ওই সহজ সরল সত্যের পর থেকেই গোটা পুরুষজাতির ওপরে কেমন একটা করুণা জাগল জানিস৷ মনে হল, রুনঝি বোধহয় পুরুষদের ঘৃণা করে৷ কারণ ওর এমন অসহায় অবস্থার জন্য কোনো এক পুরুষ দায়ী৷ সে নপুংসক নয় ঠিকই কিন্তু পুরুষ নয়৷
‘আমি রুনঝিকে বললাম, আমি যদি এই সন্তানের বাবা হতে চাই, তুমি মেনে নেবে?’
তিথি নিজের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা অজানা অনুভূতির আনাগোনা টের পেল৷ স্নেহাংশু কোন এক পাহাড়ি মেয়ের সন্তানের বাবা হতে চেয়েছিল? অচেনা একটি মেয়ের অবৈধ সন্তানের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল এই উড়নচণ্ডী ছেলেটা! এ স্নেহাংশুকে তো তিথি চেনেই না৷ অবশ্য আদৌ কি এই মানুষটাকে ও চেনে? যেটুকু ধরা দেয় সেটুকুই তো মাত্র চেনা হয়৷ বাকিটা রহস্যময় চাদরে ঢাকা৷ স্নেহাংশুর মর্জির বাইরে সে চাদর তোলার ক্ষমতা কারোর নেই৷
স্নেহাংশু আনমনে বলে চলেছে৷ চারিদিকে মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা৷ একমাত্র বিরামহীনভাবে ছুটে চলেছে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা৷ টিক টিক টিক করে বুঝিয়ে দিচ্ছে তিথি আর স্নেহাংশুর মুহূর্ত যাপনের একান্ত সময়টুকুকে৷ ‘জানিস তিথি, পাহাড়ি মেয়েরা কলকাতার মেয়েদের মতো শিক্ষিত নয় ঠিকই কিন্তু স্বনির্ভর হবার কী ভীষণ বাসনা৷ রুনঝি তখন আট মাস ক্যারি করছে তবুও চার কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে ওর শরবতের ব্যাবসাটা চালিয়ে যাচ্ছিল৷ আমি বলেছিলাম, এত পরিশ্রম না করতে কিন্তু ও শোনেনি৷ বলত, নিজের পকেটে নিজের রোজগারের টাকা থাকুক৷’
তিথি বলল, ‘তারপর রুনঝিকে বিয়ে করলি?’
স্নেহাংশু বলল, ‘আমি তো করতে চেয়েছিলাম রে৷ মন থেকে ওকে ভালো বেসেছিলাম৷ কিন্তু ও বলেছিল, নিজের আর নিজের সন্তানের দায়িত্ব ও নিজেই নিতে পারবে৷ তারপরেও আমি ওর ঘরের কাছেই একটা ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করলাম৷ রুনঝির সকাল হওয়া, বিকেল নামা, সন্ধের বাড়ি ফেরা দেখব বলে৷ রুনঝিও বুঝত, আমি ওর জন্যই রয়ে গেছি ওখানে৷ তারপর একদিন সময়ের আগেই রুনঝিকে ভরতি করা হল হেলথ সেন্টারে৷ যাওয়ার সময় আমায় বলল, যদি আমি না ফিরি তাহলে আমার সন্তানকে বরুণের কাছে পৌঁছে দিয়ো না৷ তুমি মানুষ কোরো ওকে৷ আমি কথা দিলাম, ওর সন্তানকে দেখব৷ ও সন্তান কোলে ফিরলে ওকেও বিয়ে করব৷ সেদিন মধ্যরাতে শ্বাসকষ্টে মারা গেল রুনঝি৷ মৃতা রুনঝির গর্ভ থেকে মৃত একটি পুত্রসন্তান বেরোল৷ আমি ফিরে এলাম কলকাতা৷ পাহাড় আমায় নিঃস্ব করে কেড়ে নিল জীবনের প্রথম ভালোবাসা৷ তাই পাহাড়কে আপাতত ব্রাত্য করেছি আমি৷ কখনো যদি ক্ষমা করতে পারি তবে ফিরব৷ আসলে কী জানিস, পাহাড়ের ওই বন্ধুর রাস্তার জন্যই রুনঝিকে কোনোভাবেই শহরের হসপিটালে আনতে পারিনি৷ পাহাড়ের ওই কঠিন জীবনযাত্রার জন্যই মেয়েটাকে শেষ দিন পর্যন্ত এত খাটতে হল৷ তাই পাহাড়কে আপাতত আমি ত্যাগ করলাম৷’
তিথি নরম গলায় বলল, ‘ঘুমিয়ে পড় এবার৷ রাত দুটো বাজে৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘তুই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়, আমি সোফায় শুয়ে পড়ছি৷’
তিথি হেসে বলল, ‘উহুঁ, তুই আমার অতিথি, তুই বিছানায় গিয়ে ঘুমো৷’
স্নেহাংশু হেসে বলল, ‘এসেই মালিককে যারা বেঘর করে, মালিক সেই অতিথিকে বেশি দিন বাড়িতে চায় না৷ তুই নিজের রুমে যা৷ আমায় এখন কদিন এই সোফাতেই শুতে হবে৷ কারণ আপাতত তুই তাড়িয়ে দিলে বিপদে পড়ব৷’
তিথি হেসে বলল, ‘তোকে তাড়াব এমন সাহস কোথায় রে?’
স্নেহাংশু বলল, ‘তাহলে চল, দুজনেই বেড শেয়ার করি৷ আমায় বিশ্বাস করিস তো? ঘুমের ঘোরেও তোর থেকে এক হাত দূরে থাকব৷’
তিথি হেসে বলল, ‘নিজেকে করি না৷ তুই বড্ড সুপুরুষ কিনা৷’
স্নেহাংশু তিথির মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল, ‘পাবলিককে হালকা করে চেটে দেওয়ার স্বভাবটা এখনও বজায় আছে দেখে ভারী তৃপ্তি পেলাম৷ যা যা, ঘুমিয়ে পড়৷ কাল তোর ঊর্মিলা মাতন্ডকরের সঙ্গে মুলাকাত করব৷’
তিথি বুঝল ও সোফাতেই শোবে৷ তাই ঘুম-জড়ানো চোখ নিয়ে নিজের বেডরুমে ঢোকার সময় বলল, ‘কিছু দরকার হলে ডাকিস৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘পাহাড়ি রাস্তার ধারে চটির মধ্যে কম্বল পেতে শোয়া অভ্যেস৷ এমন সুন্দর গদিওয়ালা সোফা কাম বেডে শুয়ে তো আমি স্বর্গের স্বপ্ন দেখব বস, ডাকাডাকির প্রশ্ন নেই৷ সকালে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিস, বুঝলি তো৷ মায়া করলে কিন্তু দুপুর অবধি ঘুমিয়েই যাব৷’
তিথি দেখল, সেই স্কুল-কলেজের ছেলেটা৷ বদল বলতে চাপ দাড়ি আর মাথায় ঝাঁকড়া চুল৷ আর গায়ের রঙে মেঠো বাদামি একটা পালিশ পড়েছে মাত্র৷ বাকি ভাবভঙ্গি সেই একই আছে৷ একগুঁয়ে, একরোখা, ইমোশনাল, আচমকা অনেক কথা বলে ফেলে আবার নিশ্চুপ, চোখ দুটোতে সেই স্বপ্নের ভিড় রয়েছে আজও৷
তিথির ঠোঁটে হাসির রেখা৷ ওর স্বপ্নের পুরুষ ওরই ফ্ল্যাটে ঘুমোচ্ছে৷ তবুও তাকে জড়িয়ে ধরে বলার অধিকার নেই, তুই আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ৷ একমাত্র তোর বুকের গন্ধে আমি আজও মাতাল হই৷ বয়েস, ম্যাচিয়োরিটি, পজিশন বদলালেও এ অনুভূতি আজও বদলায়নি৷ না-দেখা রুনঝির প্রতি একটু ঈর্ষা বোধ করল কি তিথি? কিন্তু তিথি তো জানে, স্নেহাংশুকে ভালোবাসলে কিছু পাবার প্রত্যাশা রাখলে চলবে না৷ ঝড়ের কাছে মানুষ কি কিছু চায়? ঝড়কে ভালোবাসলে ধ্বংসের ভয় না পেয়েই বাসতে হবে৷
স্নেহাংশুর গভীর নিশ্বাসের শব্দ আসছে ঘরে৷ ছেলেটা শারীরিক আর মানসিকভাবে বড্ড ক্লান্ত৷
বেশ দেরি করেই ঘুম ভাঙল তিথির৷ তাও সিতাংশু রায়ের ফোনের আওয়াজে৷ বেশ গম্ভীর গলায় আঙ্কল বলল, ‘টুবুন কি তোমার ওখানে আছে তিথি? নাকি কোনো হোটেলে উঠেছে? রুবির কাছের ওই ফ্ল্যাটে যে যায়নি সেটা ওই ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার জানাল৷ কলকাতায় ফিরেও এ বাড়িতে থাকবে না বলেই বাইপাসের ধারে ওর জন্য ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছিলাম৷ সেখানে তো আমার ছায়া নেই, তাও যে কেন সেখানে না গিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরে, জানি না৷ প্রতিবারই তো কলকাতা ফিরলে তোমার ওখানে যায়, তুমিই কল করে জানাও আমায়, স্নেহাংশু ফিরেছে৷ এবারে তোমার কল এল না বলেই দুশ্চিন্তায় পড়লাম৷’
তিথি আঙ্কলকে মাঝপথে থামিয়ে বলল, ‘আসলে আঙ্কল কাল বেশ রাতেই স্নেহাংশু আচমকা এসেছে আমার ফ্ল্যাটে৷ আমার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে জানলে রাতেই চলে যেত৷ ও আছে বলেই কল করা হয়নি৷ টেক্সট করে দেওয়া উচিত ছিল আমার আঙ্কল, সো সরি৷’
সিতাংশু রায় গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এবারে একটু নিশ্চিন্ত হলাম৷’
একটু আমতা আমতা করে তিথি বলল, ‘আঙ্কল, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড একটা কথা জানার ছিল৷ কথাটা একটু পার্সোনাল৷’
আঙ্কল বলল, ‘নিশ্চয়ই বলো৷ সেই ছোট্ট থেকে তোমায় চিনি, টুবুনের বেস্ট ফ্রেন্ড হিসাবে৷ পার্সোনাল সম্পর্কে পার্সোনাল কথা না-হবার তো কিছু নেই৷ নিদ্বিধায় বলতে পারো৷’
তিথি বলল, ‘আপনি কি ওকে চার লাখ টাকা দিয়েছেন? আসলে ও সেটা আমায় দিতে চাইছে৷’
আঙ্কল একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার টাকা নয়, ওটা ওর নিজের তৈরি অর্গানিক ফার্মের প্রোডাক্ট বিক্রির লভ্যাংশ৷ চার নয়, ছয় দিয়েছিলাম৷ দুই হয়তো ইতিমধ্যেই কাউকে দিয়েছে৷ দেখো তিথি, এই অর্গানিক ফার্মের আইডিয়া ওর, এমপ্লয়িদের ও নিয়োগ করেছে, ইন ফ্যাক্ট যত দূরে থাকুক এর সব খোঁজখবর ও রাখে৷ নিত্যনতুন প্রজেক্ট লঞ্চ করার বুদ্ধিও ওর, তারপরেও এই ফার্ম থেকে লভ্যাংশের টাকা দিতে চাইলে বলে, অহংকার দেখাচ্ছ? যা-ই হোক, যদি তোমায় দিতে চায়, নাও, কারণ প্রয়োজনে তোমার কাছে হাত পাতলেও আমার কাছে তো পাতবে না৷ মাঝে মাঝে ফোন করে একটু খোঁজ দিয়ো বুবলার৷’
তিথি জানে স্নেহাংশুকে ওর মা বুবলা বলেই ডাকত৷ মায়ের মৃত্যুর পরে কেউ যেন ওকে বুবলা বলে না ডাকে এমনই একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে ও৷ তাই আঙ্কল বুবলা ডেকেই স্নেহাংশু বলে সংশোধন করে নিলেন৷
কেন যে ছেলেটার মাথায় এমন বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হল কে জানে, যে কারণে নিজের বাড়ি, বাবা, আত্মীয়দের প্রায় পরিত্যাগ করে দিল৷ যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে, তিথির সঙ্গে সিতাংশু রায়ের যোগাযোগ আছে তাহলে তিথিকেও ত্যাগ করে দেবে পিসি, মাসিদের মতোই৷ কারণ স্নেহাংশুর ধারণা বাবার কাজ কাজ করে ব্যস্ততাই মায়ের মৃত্যুর কারণ৷ মায়ের হাতে গোছা গোছা টাকা ধরিয়ে দিলেও স্বামীর কর্তব্য করেনি৷ মায়ের প্যানক্রিয়াসের রোগটা নাকি বাবার অবহেলার ফসল৷ বাবার ওপরে অভিমানেই নাকি মা ঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া করত না৷ এমন অনেক যুক্তি সাজানো আছে স্নেহাংশুর ওর বাবার বিরুদ্ধে৷ মা-কে অসম্ভব ভালোবাসত স্নেহাংশু৷ তাই তার মৃত্যুটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না৷ সেই কারণেই অত বড়ো বাড়ির ছেলে হয়ে ওই বাড়িতেই ঢোকে না খুব প্রয়োজনে না পড়লে৷ সেই থেকেই বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা খারাপ হতে হতে সরু সুতোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে৷ স্নেহাংশু চায় ওই সুতোটা একটানে ছিঁড়ে দিতে৷ নিজের আধার কার্ড থেকে সিতাংশু রায়ের নামটা হটিয়ে দেবে বলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে বলেছিল, শালা ভারতীয়রা এইজন্যই সাবালক হয় না৷ পঁচিশ বছরের ছেলের আইডেন্টিটি কার্ডে বাবার নাম মাস্ট৷ তিথি গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘তুই জানিস এটাই নিয়ম৷ সব সময় এসব চিরাচরিত নিয়ম ভাঙতে তোর এত আগ্রহ কেন?’
স্নেহাংশু বলেছিল, ‘পারলাম কই? আমায় সর্বত্র সেই ছোটো থেকে ওই সিতাংশু রায়ের নামটাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে৷ কেন রে, আমি একটা মানুষ এই পরিচয় কি যথেষ্ট নয়? বাবার নাম সর্বত্র জুড়তেই হবে কেন? আর যদি জুড়তেই হয় তাহলে নয় মাস যে গর্ভে ধারণ করল, কেয়ার অফ-এ তার নাম থাকুক৷’
বাবার ওপরে এই একরোখা রাগ এতগুলো দিন পাহাড়ে, বনে, জঙ্গলে কাটিয়েও কমেনি৷ তবে ইদানীং কলকাতায় ফিরলে এক ঘণ্টার জন্যও বাবার সঙ্গে দেখা করে আসে এটুকুই যা পরিবর্তন হয়েছে ওর৷
তিথি নেহাতই মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হয়ে উঠেছিল৷ ছোটো থেকেই জানত, আজকে পেন চাইলে বাবা দিন তিনেক পরে ঠিক এনে দেবে৷ কিন্তু স্নেহাংশুদের বাড়িতে প্রতিবার গিয়ে দেখত, ওর ঘরে নতুন নতুন হরেকরকম জিনিস৷ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জিনিস কিনে দেওয়াটাই ছিল আঙ্কলের আদরের টেকনিক৷ কোন জিনিসে হাত দিয়ে মিনিট দুয়েক ঘাঁটাঘাঁটি করলেই ও বলত, ‘নিয়ে যা তিথি৷ আমার অনেক আছে৷’
তিথি সংকুচিত হয়েই জিনিসটা রেখে দিয়ে বলত, ‘ধুর আমি তো দেখছিলাম জাস্ট৷’
বাড়ি ফিরে নিজের স্কুল ব্যাগ থেকে আবিষ্কার করত স্নেহাংশুর বাড়িতে পছন্দ হওয়া পেনসিল বক্সটা৷
স্নেহাংশু এরকমই৷ পার্থিব কোনো কিছুর প্রতিই ওর কোনো আকর্ষণ ছিল না৷ ওর আকর্ষণ ছিল একমাত্র আকাশের প্রতি৷ একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত৷ মহাকাশ নিয়ে প্রচুর বই পড়ত৷ স্নেহাংশু বলত, ‘জানিস তিথি, আকাশের অনেক রহস্য আছে৷ একদিন তোকে সব বলব৷’ সেই কবে থেকে স্নেহাংশুর এসব ভাবুক ভাবুক কথা শোনার একমাত্র শ্রোতা ছিল তিথি৷ স্নেহাংশু বলত, ‘এ পৃথিবীতে একমাত্র তুই আর মা দুজনে আমায় চিনিস৷’ তিথির ভিতরে ভিতরে বেশ গর্ব হত, স্নেহাংশুকে চেনার গর্ব, ওকে নিজের ভাবার গর্ব৷ সেই স্কুল লাইফ থেকে চেনে ওকে তিথি তারপরও বুঝতে পারেনি ও আচমকা একজন অপরিচিত অন্তঃসত্ত্বা পাহাড়ি মেয়ের প্রেমে পড়ে যাবে৷ কেন কে জানে বার বার মনে হচ্ছে স্নেহাংশুকে ওর এখনও অনেক চেনার বাকি৷
কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলতে গিয়ে দেখল, স্নেহাংশু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ সামনের লেকটার স্থির জলের দিকে তাকিয়ে আছে ও৷ দরজা খুলতেই সবিতা বিরক্ত মুখে বলল, ‘এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছিলে নাকি? দুবার বেল বাজিয়ে চলে গেলাম৷’
আড়মোড়া ভেঙে তিথি বলল, ‘ফোন করোনি কেন?’
সবিতা নিজস্ব ঢঙে হেসে বলল, ‘ফোন আনতে ভুলে গেছি যে৷’ তিথির কাছে এটা কোনো নতুন কথা নয়৷ সবিতার একখানা ফোন আছে বটে কিন্তু সে যে কোথায় পড়ে থাকে তার ঠিক নেই৷ বেশির ভাগই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ফোনটি নিতে সবিতা ভুলে যায়৷
সোফার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেউ এসেছিল?’
তিথি হালকা স্বরে বলল, ‘আমার বন্ধু৷ কদিন এখানেই থাকবে৷’ সবিতার ভ্রু-তে একটা হালকা তির্যক রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল৷ কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর ভয়ংকর রোগটা সবিতার নেই৷ ওকে যেটুকু বলা হয় সেটার পরে আর তেমন প্রশ্ন ধেয়ে আসেনি কখনো তিথির দিকে৷ তাই সবিতাকে বেশ ভালো লাগে তিথির৷ আসলে অনেক পোশাকে-আশাকে আধুনিক মানুষকেও দেখেছে, ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়তে চায় অনায়াসে৷ তারপর চলে একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্নের র্যাপিড ফায়ার রাউন্ড৷
সবিতা সেদিক থেকে ভীষণ নিরাপদ৷ তিথি বলল, ‘কড়া করে চা করো তো দু-কাপ৷ ঘুমকে বিদায় করে অফিস ছুটতে হবে৷’ সবিতা আড়চোখে স্নেহাংশুর দিকে তাকাল৷
স্নেহাংশু বলল, ‘আচ্ছা, আপনি চিকেনে বড়ো এলাচের ব্যবহার কোথা থেকে শিখলেন? আমার মা করত৷ সাধারণত বাঙালি বাড়িতে গরমমশলা বলতে ছোটো এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়, বড়ো এলাচের যে অদ্ভুত পাগল-করা একটা গন্ধ আছে, লোকজন ভুলে যায়৷’
সবিতা খুশি হয়ে বলল, ‘এটা আমায় এক ঠাকুমা শিখিয়েছিল৷ তখন আমি বারুইপুরের ওদিকের এক মিত্র বাড়িতে রান্না করতাম৷ আমার বয়েস তখন মাত্র সতেরো৷ কিছুই রাঁধতে জানি না৷ ওই ঠাকুমা আমায় হাতে ধরে সব শিখিয়েছিল৷’
স্নেহাংশু উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওই ঠাকুমার নাম কি নয়নতারা মিত্র ছিল?’
সবিতা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কী করে জানলে?’
স্নেহাংশু এক হাত দিয়ে নিজের মাথা ভরতি চুলের মুঠিটা খামচে ধরে বলল, ‘আরে ওটা আমার দিদা৷ আমার দিদা ছিলেন রান্নায় দ্রৌপদী৷ তাই তো ভাবছি, রান্নার টেস্টটা এত চেনা কেন লাগল!’
সবিতা আর স্নেহাংশু চা খেতে খেতে ওর দিদার গল্প জুড়েছিল৷
স্নেহাংশুর বয়েস যখন দশ তখনই ওর দিদা মারা যান৷ দিদার রান্নার স্বাদটা ধরে রেখেছিল ওর মা৷
তিথির কানের কাছে এসে সবিতা বলল, ‘আহা গো বড়ো ভালো ছেলে৷ মা-মরা ছেলে৷ দু-দিন থাকতে বলো না এখানে, দু-রকম রেঁধে খাওয়াতে পারব৷’
তিথি মনে মনে হাসল৷ এটাই স্নেহাংশুর ম্যাজিক৷ সবিতাদির মতো ফাঁকিবাজ রাঁধুনিও ওর জন্য ভালো-মন্দ রাঁধতে চাইছে৷ তিথি বলল, ‘তুমি ওর দিদার বাড়ির লোক, বেশি আপন৷ তুমিই বলো না হয়৷ ছোটোবেলায় যখন মামাবাড়ি যেত, তুমিই হয়তো দেখেছ৷’
সবিতা বলল, ‘হ্যাঁ দেখেছি তো৷ যদিও আমি ওই বাড়িতে কাজ করেছিলাম মাত্র দু-বছর৷ তখনই ওকে আর ওর মা-কে দেখেছিলাম৷ দু-দিনের জন্য মামাবাড়ি আসত, যাওয়ার সময় খুব কান্নাকাটি করত ছেলেটা৷ এটুকুই যা মনে আছে৷’
ওর দিদা বলত, ‘আবার স্কুল ছুটি পড়লে আসবি৷’
তিথি হেসে বলল, ‘স্নেহাংশু কাঁদত শুনেই মজা পেলাম৷’
তিথি বাথরুমে ঢুকবে বলে এগোচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই ওর ফোনটা বেজে উঠল৷ অনির্বাণ ফোন করেছে৷ ছেলেটা ওর চুপি চুপিতে আছে বহুদিন ধরে৷ কাজেও খুব দক্ষ৷ বিশেষ করে কাস্টমারের সঙ্গে রিলেশনশিপটা ভালো ম্যানেজ করে৷ তিথি অফিস পৌঁছোতে দেরি করলে বা ছুটিতে থাকলে অনির্বাণই সবটা সামলে নেয়৷ তাই অনির্বাণের ওপরে বেশ ভরসা করে তিথি৷ ফোনটা রিসিভ করতেই ও প্রান্তে অনির্বাণ একটু উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ম্যাডাম পুলিশ এসেছে৷ ঊর্মিলার খোঁজে৷ ঊর্মিলাকে নাকি কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ চুপি চুপির হেলথ প্রেসক্রিপশনটা ওর বাড়িতে পেয়েই এখানে এসেছে৷ আপনি কখন ঢুকছেন, ম্যাডাম? আপনার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাইছেন৷’
স্নেহাংশুর দিকে তাকাতেই ও বলল, ‘সবিতাদি, খাবার প্যাক করো৷ আমরা বেরোব৷ চল তিথি, রেডি হয়ে নে— ফাস্ট৷ গাড়িতে যেতে যেতে ডিটেলস শুনছি৷’
স্নেহাংশু চুপি চুপির অফিসে ঢোকার আগেই বলল, ‘তিথি আমি আর তুই এই কোম্পানির পার্টনার৷ তাই আজ আমি কথা বলব৷ এনিওয়ে, তুই কিডন্যাপ করেছিস ঊর্মিলাকে?’
তিথি বলল, ‘হোয়াট রাবিশ?’
‘তাহলে কপালের ভাঁজে, ঠোঁটের কোণে এত টেনশন কেন জমে আছে তোর? মামারা তো তোকে দেখে মনে করবে তুইই দায়ী৷ বি ক্যাজুয়াল৷ তোর চেম্বারে যে কেউ আসতে পারে৷ তোর লাইসেন্স আছে৷ সে কীভাবে মিসিং হল তার দায় তোর নয়৷ বি স্টেডি৷ কথার মধ্যে যেন টেনশন প্রকাশ না পায়৷ এবারে একটু মনে করে ঊর্মিলার যাবতীয় আপডেট দে৷ কবে প্রথম এল?’
তিথি বলল, ‘প্রথম এসেছিল প্রায় আট মাস মতো আগে৷ তারপর কালকে আসব বলে পুরোপুরি বেপাত্তা, বুঝলি তো৷ আবার এল মাস চারেক আগে৷ তারপর যতবার কাউন্সেলিং করতে আসে ততবারই ওই এক কথা, আমি মেরে দেব এক্সকে৷ নির্বাণ ওকে এখনও ফ্রেন্ড লিস্টে রেখে দিয়েছে নাকি ওদের প্রেমলীলা দেখাবে বলে৷ চব্বিশ ঘণ্টা নির্বাণের স্টোরি দেখছে, হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি চেক করছে৷ সে এক অস্থির পরিস্থিতি৷ আমার কাছে যখন আসে তখন যথেষ্ট শান্ত করে বাড়ি পাঠাই আমি৷ তখন আবার রেগুলার ইউনিভার্সিটি যায়৷ ওর মা নাকি ওকে জোর করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে৷ মেয়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকে ফাটিয়ে দিয়েছে নিজেরই৷ তারপর থেকে বাবা-মা ভয়েই একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে মেয়ের সঙ্গে৷ আর অদ্ভুত কোনো একটা কারণে ঊর্মিলা আমায় বিশ্বাস করে৷ ভাবে, ওর সব সমস্যার সমাধান আছে আমার কাছে৷ মেয়েটা পড়াশোনায় বেশ ভালো, জানিস তো৷ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে৷ রেজাল্ট যথেষ্ট ভালো৷ কিন্তু এভাবে চললে তো নিজের কেরিয়ারটারও সর্বনাশ করবে৷ ইন ফ্যাক্ট ওর কোন একটা সেমিস্টারে রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলেও কাঁদছিল৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘আর ওই নির্বাণ, তার কী খবর রে? সে কী করে?’
তিথি বলল, ‘একই কলেজের৷ এক ইয়ার সিনিয়র ছিল৷ এবারে সম্ভবত নির্বাণের ফাইনাল ইয়ার ছিল৷ বেরিয়ে যাবে কলেজ থেকে৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘এই ঊর্মিলা মেয়েটা কি কখনো সুইসাইড করতে পারে বলে ইন্ডিকেট করেছিল? বা তোর মনে হয়েছিল, মেয়েটা আত্মহত্যা করতে পারে?’
তিথি অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘না সেটা বলেনি৷ তবে বলত, আমি একদিন অনেক দূরে চলে যাব, ম্যাম৷ যেখানে কেউ আমায় চিনবে না৷ কেউ ঠকাবে না—এসব বলত৷ আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোথায় চলে যাবে? বলেছিল কোনো অজানা গ্রামে৷ গ্রামটা যেন সমুদ্রের ধারে হয়৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘ওই নির্বাণ বলে ছেলেটার ফোন নম্বর আছে তোর কাছে?’
তিথি একটু অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘হ্যাঁ আছে অফিসে৷ ঊর্মিলার কেস হিস্ট্রি লেখার সময়েই ওর নিকট লোকজনের ফোন নম্বর নোট করেছিলাম৷ চুপি চুপির এটা সিস্টেম৷ কারণ অনেক সময় পেশেন্টের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এদের আপনজনদের কল করতে হয়৷ যেমন ধর ছোটো থেকে এর স্বভাব কেমন? শান্তিপ্রিয় নাকি প্রতিবাদী চরিত্রের? কারণ নিজে নিজের সম্পর্কে কে আর হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি বলে, বল? হ্যাঁ রে, পুলিশ আবার আমার অফিসের ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে না তো?’
স্নেহাংশু বলল, ‘তুই বেশি করে ব্রাহ্মীশাক খা৷ বুদ্ধি বাড়বে৷ এটা কি বাংলা মদের ঠেক, যে ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে? মানুষের কথা বলার লোক কমছে৷ তাই বাড়ছে একাকিত্ব, ফলস্বরূপ ডিপ্রেশনের মতো ভয়ংকর ব্যাধি এসে ধ্বংস করে দিচ্ছে গোছানো জীবন৷ সেখানে তুই তাদের মনের কথা শুনছিস৷ চেষ্টা করছিস একাকিত্ব দূর করার৷ কোনো মেডিশন প্রেসক্রাইব করছিস না তুই৷ ডায়েট আর এক্সারসাইজের মাধ্যমে রোগ সারানোর চেষ্টা করছিস, কেন তোর অফিসের ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে বল তো? এসব কিছু হবে না৷ তাছাড়া তোর সঙ্গে আমি আছি না? তিথির চোখের বড়ো বড়ো জলের ফোঁটাগুলো আমার কাছে কতটা মূল্যবান সেটা স্কুল থেকে দেখেও বুঝিসনি? তাই তোকে আর তোর চুপি চুপিকে প্রোটেক্ট করার সব দায়িত্ব আমার৷’ তিথি যে এই মুহূর্তে নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছে সেটা শুধু ওর পাশে স্নেহাংশু আছে বলেই৷ কারণ ও জানে, কিছু না কিছু ব্যবস্থা তো ও করবেই৷
চুপি চুপির সামনেই পুলিশের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে৷ নেহাত পজ এলাকা তাই লোকজন এসব ঘুরেও দেখে না৷ কলোনি হলে এই পুলিশ আসা নিয়েই গল্প তৈরি হত মুখে মুখে৷ অফিসের রিসেপশনে বসেই স্টাফদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে একজন মধ্যবয়স্ক অফিসার৷ স্নেহাংশু তিথিকে ইশারা করেই এগিয়ে গিয়ে স্মার্টলি বলল, ‘হ্যালো স্যার৷ আমি স্নেহাংশু৷ চুপি চুপির একজন পার্টনার৷ বলুন, কী জানতে চান৷’ অফিসার স্নেহাংশুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মিস তিথি’… কথা শেষের আগেই স্নেহাংশু বলল, ‘তিথিও আছে৷ তিথি, এদিকে আয়৷’
অফিসার তিথিকেই ডাইরেক্ট প্রশ্ন করল, ‘ম্যাম, আপনাদের এই চুপিচুপির আসল কাজ কী?’
তিথিকে উত্তর না দিতে দিয়ে স্নেহাংশু বলল, ‘আসলে এই চুপি চুপি নামটাও আমার দেওয়া আর প্ল্যানটাও আমারই৷ দেখুন অফিসার, এই জেট যুগে মানুষের সময় কমছে৷ কারো জন্য কারো সময় নেই৷ তাই মনের কোমল অনুভূতিগুলো বা দুঃখগুলো প্রকাশ করার জায়গা নেই৷ যদি বা বিশ্বাস করে কাউকে বলা হচ্ছে সে আবার বিশ্বাসভঙ্গ করে সেসব কথা হাটেবাজারে বিক্রি করে বদনাম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ তাই মানুষের একাকিত্ব বাড়ছে৷ সঙ্গে ডিপ্রেশনের শিকার হচ্ছে মানুষ৷ তারপর আত্মহত্যা৷ হ্যাঁ, আপনি বলতেই পারেন, তার জন্য তো পাস-করা সাইকিয়াট্রিস্ট আছেই৷ কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এইসব মানুষ বোঝেন না যে মনের কোনো রোগ হতে পারে৷ এরা ভাবে সাইকিয়াট্রিস্ট মানে পাগলের ডাক্তার৷ আর আমরা যেহেতু পাগল নই তাই ডক্টরের কাছে কেন যাব? অথচ এদের মনে কিন্তু অসংখ্য প্রশ্ন জমেছে৷ সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ওরা আসে আমাদের চুপি চুপিতে৷ চুপি চুপির প্রথম শর্তই থাকে, ওদের গোপন কথা গোপন থাকবে৷ তৃতীয় ব্যক্তি জানতে পারবে না৷ আশা করি চুপি চুপির কার্যকলাপ সম্পর্কে আপনাকে বোঝাতে পেরেছি৷ বিনা অর্থে নয় ঠিকই, তবে এটা কিন্তু একটা সমাজকল্যাণমূলক কাজ৷ কী স্যার তা-ই তো? বন্ধুহীন এ দুনিয়ায় ডিপ্রেশনে ভোগা এ দুনিয়ায় চুপি চুপি নিঃশব্দে নিজের কাজ করে যাচ্ছে৷ কিছু মানুষর প্রাণ বাঁচাচ্ছে রোজ৷’ তিথি দেখল, পুলিশ অফিসারের চোখে বেশ একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত চাউনি, যেটা পাঁচ মিনিট আগেও ছিল না৷ এটাই হয়তো স্নেহাংশুর ম্যাজিক৷ ও যখন কথা বলে তখন বাকিরা শোনে৷
অফিসার মন দিয়ে সবটা শুনে বললেন, ‘লাইসেন্স তো আছে দেখলাম৷ বাকিটা আমি ইনভেস্টিগেট করে নেব৷ আপাতত আমায় একটু হেল্প করুন তো৷ এই ঊর্মিলা নামের মেয়েটা ঠিক কী সমস্যা নিয়ে এসেছিল আপনাদের কাছে?’
স্নেহাংশু বলল, ‘ওটা আপনাকে তিথি বলতে পারবে৷ ও আসলে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছে৷ হিউম্যান সাইকোলজি ভালো বোঝেও৷ ও-ই ঊর্মিলার কেসটা স্টাডি করছিল৷’
অফিসার পূর্ণেন্দু অধিকারী মোটা চশমার মধ্যে দিয়েই একবার তিথিকে মেপে নিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ এই পেশায় এলেন কেন? শুধু সমাজসেবার লোভে নাকি আর কোনো চাকরিবাকরি জোটেনি?’
স্নেহাংশু ইশারায় শান্ত থাকতে বলছে তিথিকে৷ প্রথম প্রশ্নেই মেজাজ হারাত তিথি, শুধু স্নেহাংশুর ইশারায় নিজেকে সংযত করে বলল, ‘ঠিক যেভাবে ডাক্তার হওয়ার সব গুণ থাকা সত্ত্বেও আপনি পুলিশের চাকরিটা বেছে নিয়েছিলেন তেমনভাবেই মল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জব ছেড়ে নিজেই নিজের ইচ্ছের মালিক হয়ে গেলাম, স্যার৷’
অফিসার বোধহয় তিথির কথার শ্লেষটা বুঝেই অন্য প্রসঙ্গে গেলেন৷
‘ঊর্মিলা আসলে কী সমস্যা নিয়ে এসেছিল? মানে আপনি দেখলাম, প্রেসক্রিপশনে লিখেছেন মেডিটেশন মাস্ট, কেন?’
তিথি সাবধানে বলল, ‘মেয়েটা ডিপ্রেশনে ভুগছে৷ এই বয়সের মেয়েদের যা হয় আর কী! সম্পর্ক, তারপর ব্রেকআপ৷ সেই থেকেই একটা মন-খারাপ কাজ করছিল ওর মধ্যে৷ কিছুতেই লেখাপড়া মন দিতে পারছিল না৷ অথচ যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে৷ বন্ধুবান্ধবদের বলতেও পারছিল না ওর সমস্যাটা কী? তাই এখানে এসেছিল৷ ঊর্মিলা বলেছিল, ‘ও সম্পর্ক, ভাঙাগড়া এসব ভুলে কেরিয়ারে মন দিতে চায়৷ সেই কারণেই আসত এখানে৷’
অফিসার বললেন, ‘হুঁ বুঝলাম৷ তারপর আপনি এমন মোটিভেট করলেন যে সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল নাকি? তার মনে হল এ জীবন নশ্বর, কেরিয়ার গোল্লায় যাক, আমি পথে পথে ঘুরে পরিব্রাজক হয়ে যাই৷ তা-ই তো ম্যাডাম?’
স্নেহাংশু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অফিসার ওকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার কথা শুনে নিয়েছি৷ আপাতত আপনি শুনুন, আমি কী জানতে চাইছি৷ বলুন মিস তিথি, আপনি তাকে কীভাবে মোটিভেট করতেন?’
তিথি বলল, ‘বন্ধুর মতো করে বোঝাতাম এসব ব্রেকআপ, সম্পর্কের ওঠা-পড়া এগুলো পার্ট অফ লাইফ৷ আমরা যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু প্রাণের বন্ধু তৈরি হত৷ হাত ধরে হাঁটতাম৷ একসঙ্গে টিফিন খেতাম৷ সে স্কুলে না এলে আমারও পেটে ব্যথা করছে বলে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যেতাম৷ একরাতে কত গল্প জমে যেত৷ পরেরদিন মর্নিং স্কুলে গিয়ে তাকে বলতে হবে বলে৷
‘তারপর হাই স্কুলে গিয়ে আরও কত বন্ধু হল৷ রুচি যার সঙ্গে মিলল তার বন্ধুতালিকায় প্রাধান্য পেল৷ প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুরা সকলে হয়তো সেই তালিকাভুক্ত হল না৷ কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে আমার বন্ধু পালটাতে শুরু করল৷ পিছনদিকে তাকালে মনে হয় না, যাকে ছাড়া একদিন চলবে না মনে হচ্ছিল তারা কবেই নিরুদ্দেশ হয়েছে৷ না শুধু বন্ধুতালিকা থেকে নয়, মন থেকেও৷ তাহলে একটা জিনিস তো পরিষ্কার, কোনো সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয়৷ একমাত্র অপশন নেই বলে বাবা-মা-দাদু-ঠাম্মারাই চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে যায় জীবনের সঙ্গে৷ বাকি প্রেম থেকে বিয়ে অপশন যেখানেই আছে সেখানে উনিশ-বিশ হলেই মানুষ নতুন বন্ধু খুঁজে নেয়৷ তাই প্রেমে ব্রেকআপ মানে জীবন শেষ হতেই পারে না৷ ভেবে দেখো, সেই প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুটা যে তোমার স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ ছিল একদিন, আজ তার মুখ ঝাপসা৷
‘অথচ তুমি যে তার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছ এমন নয়৷ কারণ তুমি ভুলে গেছ৷ তোমার মন অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ ঠিক সেইভাবেই নিজেকে অন্য কাজে ব্যস্ত করে ফেললে এই বর্তমানের ব্রেকআপের শূন্যতাটাও কেটে যাবে৷ হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে নিজের গোছানো কেরিয়ারে, গোছানো সংসারে আজকের এই পাগলামিটা মনে পড়ে তোমার নিজেরই হাসি পাবে৷ তাই এখন এই মন খারাপের সময়টুকু শান্ত হয়ে কাটিয়ে দিতে পারলেই জীবন তোমাকে আবার জিতিয়ে দেবে৷’
অফিসার সবটা শুনে বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘ম্যাডাম, আমার ছেলে ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, পড়াশোনায় অমনোযোগী৷ কম্পিউটার গেমের প্রতি খুব আকর্ষণ৷ ওকে যদি আপনি একটু মোটিভেট করতেন খুব উপকার হত৷ না মানে কথাটা তো আমি ভেবে দেখিনি কখনো৷ সত্যিই তো কত কত সম্পর্ক ভেঙেছে, জুড়েছে, জীবন তো থেমে যায় না৷ থ্যাংক ইউ ম্যাডাম৷ আপনি কাজ চালিয়ে যান৷ ঊর্মিলা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করলেই আমাকে ইনফর্ম করবেন প্লিজ৷’
পুলিশ অফিসার বেরিয়ে যেতেই স্নেহাংশু এসে সকলের সামনেই তিথিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ব্রিলিয়ান্ট ইয়ার৷ আমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছিলাম রুনঝির জন্য৷ আজ এই মুহূর্তে বেশ হালকা লাগছে নিজেকে৷ তুই বিশ্বাস করবি কি না জানি না তিথি কিন্তু তুই যখন বোঝাচ্ছিলিস অফিসারকে তখন তোর মুখে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস কাজ করছিল৷ তোর ঠোঁটের দৃঢ়তা বলে দিচ্ছিল, তুই কোনো অন্যায় কাজ করিসনি৷ এটাই তো তোর শক্তি৷ তিথি, তুই আমার সেই ছোটোবেলার একমাত্র বন্ধু যে আমার সমস্ত বেয়াদপ সহ্য করেও সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রেখেছিস৷ আজ বুঝলাম, কেন বেঁচে আছে সম্পর্কটা, তুই জীবনকে অন্যরকম চোখে দেখিস৷ গড়পড়তা ভাবনায় মাপিস না দৈনন্দিন জীবনটাকে৷’ তিথি স্নেহাংশুর এত প্রশংসাবাক্য শুনেও স্থির হয়ে বসে ছিল৷ চুপি চুপিতে এই প্রথম পুলিশ এল৷ সত্যি বলতে কী পুলিশের কাছে তিথি মিথ্যে বলল৷ ঊর্মিলা নির্বাণকে ভুলতে ওর কাছে আসেনি৷ এসেছিল ওর মাথায় চব্বিশ ঘণ্টা নির্বাণকে খুন করার যে অভিসন্ধি চলছে সেটা যাতে ওর মাথা থেকে বেরিয়ে যায় সেটার উপায় খুঁজতে৷ কিন্তু খুন, অ্যাসিড অ্যাটাক এসব শুনলে পুলিশ চুপি চুপির বাইরেই চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা বসিয়ে দেবে তাই বাধ্য হয়েই মিথ্যে বলতে হল ওকে৷ কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়?
স্নেহাংশু ওর চোখের সামনে তুড়ি দিয়ে বলল, ‘কী হল রে, কোথায় হারিয়ে গেলি?’
তিথি কিছু বলার আগেই সোনালি বলল, ‘তিথিদি, বাইরে তিনজন ভিজিটর আছেন৷ দুজনের আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল৷ একজন আননোন৷ তাকে অনির্বাণ বোঝানোর চেষ্টা করছে যে এভাবে বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে ম্যাম কথা বলেন না৷ কিন্তু মেয়েটি নাছোড়৷ বলছে খুব আর্জেন্ট৷’
সোনালি একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েই বলল,‘তিথিদি, মেয়েটা বোরখা পরে আছে৷ মুখ দেখতে পাচ্ছি না৷ কী করব?’
স্নেহাংশু বলল, ‘পাঠিয়ে দিন, আমিও রুমে থাকছি তিথির সঙ্গে৷ ওকেই আগে পাঠান৷’
তিথি বাধা দিয়ে বলল, ‘স্নেহাংশু, এটা চুপি চুপির নিয়ম নয় রে৷ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আমরা কথা বলি না৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘একদিন নিয়ম ব্রেক কর-না৷ বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে বিষয়টা৷’
তিথি সোনালিকে বলল, ‘অনির্বাণকে বলো বাকি দুজনকে ট্রিট করতে, আমি একে সামলে নিচ্ছি৷ পাঠিয়ে দাও৷ কী নাম বলল?’
সোনালি বলল, ‘দিলসাথ বেগম বলল৷’
সোনালি বেরিয়ে যেতেই স্নেহাংশু বলল, ‘শোন, আমি ওই পরদার আড়ালে থাকব৷ জাস্ট শুনব, তোর পেশেন্ট আমায় দেখতে পাবে না, চিন্তা করিস না৷ কিন্তু আজ তোকে একা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি না৷ বোরখা পরে আপাদমস্তক ঢেকে কে এল? পুলিশের লোক নয় তো? ডাউট যখন হয়েছে তখন আমি লুকিয়ে থাকছি৷’
বোরখা পরে আপাদমস্তক ঢেকে একটা মেয়ে ত্রস্ত পায়ে ঢুকল তিথির চেম্বারে৷ মেয়েটা যে ভীত সেটা ওর চলনভঙ্গিমাই বলে দিচ্ছে৷ তিথি বলল, ‘বলুন কী সমস্যা? আপনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেননি কেন?’
মেয়েটা এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘দরজাটা লক আছে তো ম্যাম?’
তিথি বলতে যাচ্ছিল, হ্যাঁ আছে৷ কিন্তু গলাটা ভীষণ চেনা লাগল ওর৷ চমকে উঠে বলল, ‘ঊর্মিলা তুমি?’
বোরখাটা খুলতেই বেরিয়ে এল তিথির পরিচিত মুখ৷
বিস্মিত হয়ে তিথি বলল, ‘তোমার খোঁজে পুলিশ এসেছিল৷ তুমি কোথায় ছিলে? আর এভাবে বোরখা পরে আসার কারণ কী?’
ঊর্মিলা ভীত গলায় বলল, ‘আমি নির্বাণকে কিডন্যাপ করে রেখেছি৷ ও এখন আমার জিম্মায়৷ মারিনি এখনও৷ তাই দু-দিন বাড়িতে ফিরতে পারিনি৷ আমাদের সল্ট লেকের দিকে একটা ছোটো ফ্ল্যাট আছে৷ এমনিই বাবা কিনে রেখেছিল৷ সেভাবে যাতায়াত হয় না৷ ওখানেই ওকে আটকে রেখেছি৷ আমি অন্য ঘরে পাহারায় ছিলাম৷ বুঝতে পারিনি বাবা পুলিশে খবর দিয়ে দেবে৷’
তিথি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, ‘তো নির্বাণকে আটকে রেখে লাভ? না মানে তুমি তো আর ওর কাছে ফিরে যাবে না তাহলে?’
ঊর্মিলা বলল, ‘না আমি ফিরব না ঠিকই, কিন্তু ওকে অন্য প্রেম করতে আমি দেব না৷ গত পরশু ওর লাভারের বার্থডে ছিল৷ যাতে ও না পৌঁছোতে পারে তাই আটকে রাখা৷’
তিথি বলল, ‘তোমার কী মনে হয়, একদিন জন্মদিনের পার্টিতে না পৌঁছোলে ওদের ব্রেকআপ হয়ে যাবে? এমন শিশুসুলভ ভাবনা নিয়ে তুমি প্ল্যান বানাও? আরে ও বেরিয়েই তোমার নামে থানায় কমপ্লেইন করবে৷ তোমায় পুলিশ অ্যারেস্ট করবে৷ আর যদি তুমি ওকে খুন করে দাও তাহলেও ওর বাড়ির লোকজন তোমাকেই সন্দেহ করবে, কারণ তোমাদের রিলেশনশিপটা ভেঙে গেছে৷ আর ও যে দু-দিন নিখোঁজ সে দুদিন তুমিও বেপাত্তা৷ তাই এত সহজ একটা অঙ্ক মেলাতে ব্যোমকেশ বা কিরীটীর দরকার নেই, কলকাতা পুলিশের কনস্টেবলই যথেষ্ট৷ এনিওয়ে, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?’
ঊর্মিলার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ৷ তিথি বেশ বুঝতে পারছে, ঊর্মিলা দ্বন্দ্বে পড়েছে৷ মাথা নিচু করে কিছু যেন ভাবছে৷ তিথি ওকে ভাবার সময় দিল৷ ঊর্মিলা বলল, ‘সে যদি জেল খাটতে হয়, খাটব না হয়, কিন্তু নির্বাণের মতো বেইমানকে ছাড়ব না কিছুতেই৷’
তিথি বলল, ‘বললে না তো আমার কাছে কী করতে এসেছ? ডিসিশন যখন নিয়েই নিয়েছ, তখন আমার কাছে কী করতে এসেছ?’
ঊর্মিলা বিভ্রান্তের মতো বলল, ‘আমি আপনাকে আমার প্ল্যানটা জানাতে এলাম৷ ভাবলাম, যদি আপনি কোনো গাইড করেন৷’
তিথি বলল, ‘আমি তো তোমাকে বলেছিলাম, এসব খুনোখুনির ভাবনা ছেড়ে পড়াশোনা করো৷ আবার প্রেম আসবে জীবনে, তাই এত উদবিগ্ন হবার কিচ্ছু নেই৷’
ঊর্মিলা বলল, ‘আমিও তো চেয়েছিলাম নির্বাণকে দেখাতে যে ও ছাড়াও আমার বন্ধু আছে৷ কিন্তু হল কই? আর কারো সঙ্গে তো ওয়েভলেংথ ম্যাচ করল না৷’
তিথিকে চমকে দিয়ে স্নেহাংশু ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আই অ্যাম ইমপ্রেসড, মিস ঊর্মিলা৷ একটা মেয়ে ভালোবাসায় এতটা অ্যাগ্রেসিভ হতে পারে দেখেই আমি চমকে গেছি৷’
ঊর্মিলা কিছু বলার আগেই তিথি বলল, ‘আমার বন্ধু৷ চুপি চুপির আরেক পার্টনার৷
স্নেহাংশু ঊর্মিলার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আপাতত আপনার প্রেমিকের ভূমিকায় প্রক্সি দিতে পারি৷ নির্বাণকে জ্বালানো গেল, বেঁচেও থাকল, আবার কমপ্লেক্সে থাকল, কী বলেন, আইডিয়াটা কেমন?’
ঊর্মিলা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সত্যিই আপনি আমায় হেল্প করবেন? বিশ্বাস করুন, আমি কাউকে খুন করতে চাই না৷ নির্বাণকেও না৷ গতকাল রাতে নির্বাণ যখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল তখন বার বার মনে হয়েছিল, ওকে খুন করে দেওয়াই যায়, কিন্তু তারপরেও আটকে গেছি৷ আমি ওকে শাস্তি দিতে চাই, শারীরিক নয়— মানসিক৷ যেমন আমি পাচ্ছি প্রতিনিয়ত৷ একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়েছে মাত্র কয়েকদিন আগে, সেটার সব ভুলে অন্য একজনকে এভাবে কাছে টেনে নেওয়াটা জাস্ট মেনে নেওয়া যায় না৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘আমাদের প্রথম কাজ নির্বাণকে ছেড়ে দেওয়া৷ থানা-পুলিশ হবার আগেই৷ চলো, যেতে যেতে বলছি, কী করতে হবে৷’
তিথি আলতো করে ঊর্মিলার কান বাঁচিয়ে বলল, ‘এর থেকে কী পুলিশে খবর দেওয়া বেশি সহজ ছিল না কী রে?’
স্নেহাংশু বলল, ‘আগে নির্বাণকে উদ্ধার করি৷ তারপর ভাবব৷’
তিথির মনটা কু গাইছে৷ ঊর্মিলা যে এতটা ডেসপারেট হতে পারে, কল্পনার বাইরে ছিল তিথির৷ ঊর্মিলার যত রাগই হোক মেয়েটা আসলে ভিতু৷ তাই তিথির কাছে বার বার ছুটে আসত যখনই ওই খুনের চিন্তা ওর মাথায় আসত৷ সেই মেয়ে যে এভাবে নির্বাণকে কিডন্যাপ করবে সেটা কল্পনার বাইরে! আচমকা কেন এমন করল সেটাই ভেবে চলেছে তিথি৷ ঊর্মিলার সঙ্গে স্নেহাংশু কী সব আলোচনায় মত্ত৷ স্নেহাংশুর এ বিষয়ে জড়িয়ে যাওয়াটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না তিথির৷ ঊর্মিলা মেয়েটাকে যতটা সহজ, ইনোসেন্ট মনে হয়েছিল তেমন নয়৷ রীতিমতো ক্রিমিনাল মাইন্ডেড মেয়ে৷ তিথির ইচ্ছে পুলিশকে নক করে ঊর্মিলাকে হ্যান্ডওভার করা৷ তারপর পুলিশ যা ভালো বুঝবে, করবে৷ কারণ এই মেয়েকে শেলটার দেওয়া মানে চুপি চুপির বিপদ৷ কেন যে স্নেহাংশু নিজের ঘাড়ে এই দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে! স্নেহাংশুর এই অ্যাডভেঞ্চারের মানসিকতাই বিপদে ফেলবে তিথিকে৷ তিথি বলল, ‘ঊর্মিলা, তুমি একটু বোসো৷ আমি স্নেহাংশুর সঙ্গে আলাদাভাবে একটু কথা বলতে চাই৷’
ঊর্মিলা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘ম্যাম, আমিও তা-ই চাই৷ আপনি ওঁকে বোঝান নির্বাণকে জাস্ট মেরে দেওয়া বেটার অপশন৷ ও থাকলেই আমার মাথার প্রেশার বাড়বে৷ আমি কনসেনট্রেইট করতে পারছি না কিছুতে৷ কিন্তু নির্বাণহীন পৃথিবী কল্পনা করে দেখুন কত শান্তি৷ ওঁনাকে বোঝান এসব ফলস প্রেমিকের চক্করে না গিয়ে মার্ডারের প্ল্যান দিতে৷’
তিথি চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল৷ চোখের সামনে একজন ক্রিমিনাল বসে আছে আর ও চুপ করে আছে— এটা যেন বেশি অসহ্য৷ স্নেহাংশু ইশারা করে বলল, ‘আচ্ছা ঊর্মিলা, নির্বাণ তোমার ডাকে এলো? না মানে তোমাদর তো ব্রেকআপ হয়ে গেছে৷ তারপর প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে এক ডাকে চলে এল? ছেলেটা মনে হচ্ছে, তোমায় এখনও ভালোবাসে৷’
ঊর্মিলা বলল, ‘ভুল ভুল৷ ও আমায় জাস্ট ঘৃণা করে৷ ও মনে করে, আমার মতো স্বার্থপর মেয়ে খুব কম আছে এ রাজ্যে৷ জানতাম, নিজের ফোন থেকে ফোন করলে ধরবে না৷ তাই একটা নতুন সিম কার্ড নিলাম৷ নতুন নম্বর৷ রিসিভ করল৷ আমার গলা পেয়েই যাতে কেটে না দেয় তাই বললাম, তোর দেওয়া গিফটগুলো ফেরত দিতে চাই৷ তুই এসে নিয়ে যাবি নাকি তোর প্রেজেন্ট গার্লফ্রেন্ডের কাছে পাঠিয়ে দেব? ওই পিঙ্ক বিকিনিটাও পাঠিয়ে দেব যেটা তুই আমায় গিফট করেছিলিস৷ ইভন আমাদের ঘনিষ্ঠ ছবিগুলোও পাঠিয়ে দিতে পারি৷ আসলে তোর কোনো জিনিসই আমি নিজের কাছে রাখতে চাইছি না রে৷ কেমন একটা গা-গোলানো ব্যাপার হচ্ছে এগুলো দেখলে৷’
‘নির্বাণ শক্ত গলায় বলেছিল, কোথায় যেতে হবে? বেশিক্ষণ সময় নিবি না৷ রেডি করে রাখ, আমি নিয়ে আসছি৷ আর হ্যাঁ, তোর দেওয়া গিফটগুলোও আমি ফেরত দিয়ে আসব৷ আমি অ্যাড্রেসটা বলেছিলাম, ও ফোন কেটে দিয়েছিল৷ তাই ওসব ভালোবাসা নেই, যাতে বর্তমান সম্পর্কটা ভেস্তে না যায় সেই কারণেই এসেছিল৷’ তিথি বলল, ‘তারপর?’
ঊর্মিলা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘তারপর আর কী? ফ্ল্যাটের একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে লক করে দিয়েছি৷ ও অবশ্য বলছিল, কী করতে চাস তুই? আমি বললাম, একদিন ওয়েট কর, বুঝতে পারবি৷ খাবারদাবার দিয়েছি জানালা দিয়ে৷’
স্নেহাংশু খুব ক্যাজুয়ালি বলল, ‘চলো ঊর্মিলা, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ পুলিশ খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলে আমাদের প্ল্যান দি এন্ড হয়ে যাবে৷ নির্বাণকে জ্বালাতে হবে তো৷ তিথি, আমরা চললাম রে৷’
স্নেহাংশুরা বেরিয়ে যেতেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক হন্তদন্ত হয়ে চুপি চুপির রিসেপশনে ঢুকল৷ নিজের রুম থেকেই সিসিটিভি-তে পুরোটা লক্ষ রাখে তিথি৷ সোনালি এসে বলল, ‘ম্যাডাম, ওই ঊর্মিলা মেয়েটার বাবা এসেছে, বলছে আর্জেন্ট দরকার৷’ তিথি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, এই ঊর্মিলার কেসটা হাতে নেওয়া কতটা বোকামি হয়েছে৷ মেয়েটা বড়োলাকের বখে-যাওয়া মেয়ে৷ তার মধ্যে বেশ সিরিয়াস সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে৷ ওষুধ ছাড়া শুধু এক্সারসাইজ, ডায়েট আর কাউন্সেলিং-এ ঠিক হওয়ার কেস নয়৷ এখন এই মেয়ে যে আর কী কী ঘটাবে কে জানে! স্নেহাংশু আবার এর প্রেমিকের প্রক্সি দিতে গিয়ে না কোনো বিপদে পড়ে৷ আজ পুলিশ এসেছে, ঊর্মিলার বাবাও হাজির৷ অযথা চুপি চুপির দিকে আঙুল উঠছে এই মেয়েটার জন্যই৷
সোনালি ঊর্মিলার বাবাকে তিথির চেম্বার অবধি এগিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল৷ ভদ্রলোকের মুখে রীতিমতো ভয়ের ছাপ৷ চোখ দুটোকে ঘিরে রেখেছে অজানা আতঙ্ক৷ তিথি বলল, ‘বসুন৷ বলুন, কী জানতে চান৷’
ভদ্রলোক হাত জোড় করে বললেন, ‘আমি অতনু পাঁজা৷ আমার মেয়ে ঊর্মিলা যে আপনার কাছে কাউন্সেলিং-এর জন্য আসত সেটা আমি গতকালকেই জানতে পারি৷ আসলে ওর ড্রয়ারে আপনার করে দেওয়া প্রেসক্রিপশন পেয়েই যোগাযোগ করতে এলাম৷ পুলিশেও জানিয়েছি, ম্যাডাম৷ ঊর্মিলা আমার একমাত্র সন্তান৷ খুবই শান্ত মেয়ে ছিল৷ পড়াশোনায় মনোযোগী৷ খুব সুন্দর কবিতা বলে ও৷ সত্যি বলতে বাবা হিসাবে গর্ব করতাম ওকে নিয়ে৷ এই দুটো বছরে কী যে ঘটে গেল, মেয়েটা জাস্ট পালটে গেল৷’
তিথি পরিষ্কার বলল, ‘আপনি জানতেন, আপনার মেয়ে একটা সম্পর্কে ছিল বেশ কিছুদিন ধরে? জানতেন?’
অতনুবাবু মাথা নিচু করে বললেন, ‘হ্যাঁ জানতাম৷ নির্বাণের সঙ্গে বিয়ে দেব না বলাতেই বোধহয় এতটা ফেরোশাস হয়ে গেল মেয়েটা৷ আমার মেয়ে তো আমি জানি, ও যাকে বিশ্বাস করে তাকে সবটুকু দিয়েই বিশ্বাস করে৷ তাই নির্বাণকে ও সত্যিই ভালোবাসত৷ কিন্তু ম্যাডাম, এ বিয়ে দেওয়া কোনোদিন আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ সেটা ঊর্মি জেনেই ব্রেকআপ করেছে৷ আর ওই ব্রেকআপের পর থেকেই মেয়েটা যেন অদ্ভুতভাবে পালটে গেছে৷’ ঊর্মিলা এতদিন আসছে তিথির চেম্বারে, কোনোদিন জানায়নি তো ওদের সম্পর্কটা ওর বাবা মানতে চাননি বলেই ভেঙে গেছে৷ কেন মানতে চাননি অতনুবাবু সেটাও তো ধোঁয়াশা তিথির কাছে৷ এই ব্যাপারে তো কোনো ক্লু ছিল না ওর কাছে৷
তিথি কড়া গলায় বলল, ‘শুনুন, আপনার ওই না-মানার জন্য আজ আপনার মেয়ে একটা ক্রিমিনালে পরিণত হয়েছে৷ সে এখন নির্বাণকে খুন করতে চায়৷’
অতনুবাবু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আমি ভাবতে পারিনি, ঊর্মিলা এতটা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে৷’
তিথি বলল, ‘তো মেয়ের প্রেমে আপনার আপত্তি কেন? কাস্ট সমস্যা? নাকি এন. আর. আই. ছাড়া মেয়ের বিয়ে দেবেন না?’
অতনুবাবু মাথা নিচু করে বললেন, ‘ম্যাডাম, আমি ওরকম টিপিক্যাল বাবা নই৷ আমার যা আছে সব আমার মেয়ের৷ তাই অর্থকষ্ট ওর জীবনে হবে না৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন, এ বিয়ে দেওয়া যায় না৷ ঊর্মিলা অতনু পাঁজার মেয়ে জানলে নির্বাণের বাড়ি থেকেও বিয়ে দেবে না আমি শিয়োর৷ তাই নির্বাণের পরিচয় ঊর্মির কাছ থেকে জানার পরেই ওকে এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছিলাম৷’
তিথি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কারণটা যদি বলতে চান তো বলুন, না হলে আপনাকে এই মুহূর্তে আমি আর কোনো সাহায্য করতে পারছি না৷ পুলিশ তো খুঁজছে আপনার মেয়েকে, চুপি চুপির অ্যাড্রেস তো আপনিই দিয়েছিলেন পুলিশকে, পুলিশ এসে খোঁজ করে গেছে এখানে৷ আর নতুন করে কী করব বলুন৷ আপনার মেয়ের জন্যই আমার স্বপ্নের চুপিচুপির সামনে আজ পুলিশের গাড়ি দাঁড়াল৷ প্লিজ এবারে আমায় ছাড়ুন৷ পুলিশ নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে ঊর্মিলাকে৷’ ভিতরে ভিতরে স্নেহাংশুর ওপরেও বেশ রাগ হচ্ছিল তিথির৷ কী দরকার ছিল মিথ্যে অভিনয় করতে যাওয়ার! এবারে যদি আবার কোনো বিপদে পড়ে স্নেহাংশু তখন তো তিথিকেই ছুটতে হবে৷ কারণ স্নেহাংশুর বিপদে তো ও চুপ করে বসে থাকতে পারবে না৷ ঊর্মিলা আর ওর বাবা দুজনের ওপরেই বিজবিজে রাগটা মুখের শিরায় প্রকটিত হচ্ছে৷ সামনের আয়নায় চোখ যেতেই তিথি দেখল ওর চোয়ালটা বেশ শক্ত হয়ে রয়েছে৷ সাধারণত নিজে যতই বিরক্ত হয়ে থাকুক, চুপি চুপিতে আসা ভিজিটরদের সামনে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেনি৷ আজ ঊর্মিলার বাবার এই ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলা কথার কারণেই নিজের মেজাজ ধরে রাখতে অক্ষম হয়েছে ও৷
অতনুবাবু বললেন, ‘নির্বাণের মা বিদ্যাবতীর সঙ্গেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল৷ না, লাভ ম্যারেজ নয়৷ যাকে বলে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ৷ দুই বাড়ি থেকেই কথাবার্তা বলে বিয়ে ঠিক হয়৷ বিদ্যাবতীকে আমি দেখতেও গিয়েছিলাম বড়দা আর বড়োবউদির সঙ্গে৷ অপছন্দের কোনো কারণ ছিল না৷ শিক্ষিতা, সুন্দরী, সম্ভ্রান্ত রুচির মেয়ে৷ আশীর্বাদ হয়ে গেল যথারীতি৷
‘বিয়ের রাতে ঘটল আসল বিপত্তি৷ আমি বর হিসাবে হাজির হলাম বিদ্যাবতীদের বাড়িতে৷ আমায় বরণ করে নিয়ে যাওয়া হল বিবাহবাসরে৷ বিদ্যাবতীর বাবা-মা-কাকা-জেঠুর খুবই পছন্দ হয়েছিল আমায়৷ তাঁরা আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি রাখেননি৷ হঠাৎই বাড়ির মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেল৷ শোনা গেল, বিদ্যাবতী পালিয়েছে৷ চিঠি লিখে রেখে গেছে, রজতকে ভালোবাসতাম, তোমাদের জানিয়েছিলাম, কিন্তু তোমরা ভালো পাত্রের লোভে রজতকে অস্বীকার করলে৷ তাই চললাম রজতের সঙ্গেই৷’
‘বরপক্ষ চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে ফিরে এল৷ আমার পরিবারের সম্মান মাটিতে লুটিয়ে গেল৷ আমার মা বউমার জন্য গয়না বানিয়ে রেখেছিল, কিন্তু এ ঘটনায় মায়ের হার্ট অ্যাটাক হল৷ মা-কে বাঁচানো গেল না৷ আমার বাবা নির্বাণের দাদুর নামে ফ্রড কেস অবধি করেছিল৷
‘এ ঘটনার প্রায় বছর দুয়েক পরে আমি বিয়ে করি ঊর্মিলার মা মানে সুস্মিতাকে৷ কিন্তু আমাদের বাড়ির প্রতিটা মানুষ আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য আজও বিদ্যাবতীকেই দায়ী করে৷ এবারে আপনি বলুন ম্যাডাম, নির্বাণের সঙ্গে কি বিয়ে দেওয়া যায়? ভাগ্যের কী অদ্ভুত পরিহাস৷ কলকাতা শহরে এত ছেলে থাকতে ঊর্মিলার প্রেম হল বিদ্যাবতী আর রজতের ছেলের সঙ্গে! সুস্মিতা আমার জীবনে আসার পর এসব পুরোনো কথা ভুলেই গিয়েছিলাম৷ তারপর ঊর্মিলা হল, আমরা পরিপূর্ণ হয়ে গেলাম৷ আমার বাবা বলতেন, মা নাকি ঊর্মিলার মধ্যে দিয়ে ফিরে এল৷
‘বিদ্যাবতীর কথা ঊর্মিলার সামনে আলোচনা করা হয়নি কোনোদিন৷ ঊর্মি সবই এসে বলত আমাকে৷ ওর বন্ধুদের কথা, ক্লাস বাঙ্ক করে মুভি দেখতে যাওয়ার কথাও এসে গল্প করত আমায়৷ একদিন হঠাৎই ফোনে নির্বাণের ছবি দেখিয়ে বলল, দেখো তো কেমন লাগছে তোমার হবু জামাইকে? নির্বাণের বেশ কতকগুলো ছবির মধ্যেই একটাতে দেখলাম, বিদ্যাবতী পায়েস খাওয়াচ্ছে ছেলেকে৷ চমকে উঠে বলেছিলাম, কে এই মহিলা? ঊর্মি বলেছিল, নির্বাণের মা৷
‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল৷ আমি জানি আমার মেয়ে খুব জেদি৷ ছোটো থেকে যা চেয়েছে সেটাই দিয়ে এসেছি৷ তাই হয়তো একতরফা পাওয়ার বদ অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷ বিদ্যাবতীর ছেলে আমার বাড়ির জামাই হতে পারে না৷ আমার বোন, ভাইরা কেউ মেনে নেবে না৷ আমিও মানি আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য বিদ্যাবতীই দায়ী৷ ও যদি আগেই জানিয়ে দিত যে ও বিয়েটা করতে পারবে না তাহলে আমি অকালে মা-কে হারাতাম না৷ তাই প্রাণ থাকতে নির্বাণকে মেনে নিতে পারব না৷ সবটা শোনার পর ক্যাজুয়ালি ঊর্মিলা বলেছিল, এমনিতেও ওর সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হচ্ছে, তার ওপরে ওদের ফ্যামিলি আমার বাবাকে অপমান করেছিল, তাই ব্রেকআপ করতে আর দ্বিতীয়বার ভাবব না৷ নির্বাণের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিল ঊর্মি৷ কিন্তু মেয়েটা আমার পালটে যাচ্ছিল৷ নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল৷ আমার সঙ্গেও আর সেভাবে কথা বলত না৷ কিছু বলতে গেলেই বলত, প্লিজ আমায় নিজের মতো থাকতে দাও৷
‘হঠাৎই একদিন বলল, পাপা, নির্বাণকে কিছু শাস্তি দিলে হয় না? ওর মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, তুই নিজে সফল হয়ে দেখা, ওটাই নির্বাণকে শাস্তি দেওয়া হবে৷ ঊর্মি সেদিন কথা বলেনি৷
‘এভাবেই চলছিল৷ কিন্তু তারপর হঠাৎ এভাবে বেপাত্তা হয়ে গেল মেয়েটা৷ থানায় ডায়েরি করলাম৷ থানা থেকেই একজন পুলিশ ঊর্মির ঘর সার্চ করতে গিয়েছিল৷ সে-ই ওর ড্রয়ারে চুপি চুপির অ্যাড্রেসটা পেয়েছিল৷ তখনই আমি জানলাম, ও নিজের মনের চিকিৎসা করাতে আপনার কাছে আসত৷ ম্যাডাম, ঊর্মি কি আমাদের সম্পর্কে কিছু বলত আপনাকে? মানে বাবা-মায়ের ওপরে আক্রোশ আছে কি না বুঝতে পেরেছিলেন?’
তিথি বলল, ‘দেখুন, ঊর্মিলা জীবন সম্পর্কেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ তবে হ্যাঁ, কখনো সুইসাইড করবে এমন কথা বলেনি৷ বরং নির্বাণকে শেষ করে দিতে মন চায়—এটাই বলত৷ নিজের অসুস্থ মনটাকে সারিয়ে তুলতে চাইত৷
তিথি ভাবল, অতনুবাবুকে বলে দেওয়া উচিত ওঁর মেয়ে ওঁর সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে নির্বাণকে আটকে রেখেছে৷ কিন্তু অতনুবাবু যদি ওখানে গিয়ে পৌঁছোন তাহলে ঊর্মিলা বুঝে যাবে, এ তথ্য অতনুবাবু চুপি চুপি থেকেই পেয়েছে৷ তখন যদি আবার রেগে গিয়ে স্নেহাংশুর কোনো ক্ষতি করে৷ তার থেকে চুপ থাকাই ভালো আপাতত, যতক্ষণ পর্যন্ত না স্নেহাংশু গ্রিন সিগনাল দেয়৷ এটুকু অপেক্ষা তিথিকে করতেই হবে৷
অতনুবাবু ভাঙা গলায় বললেন, ‘ম্যাডাম, একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট ছিল৷ মেয়েটা যদি আপনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে, প্লিজ জানাবেন৷ ওর মা খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করেছে৷ আমারও সেই অবস্থা৷ তাই এটা আমার একান্ত অনুরোধ৷’ কথা শেষ করে নিজের কার্ড আর দুটো পাঁচশোর নোট টেবিলে রেখে বললেন, ‘এই কার্ডে আমার নম্বর আছে৷’
তিথি বলল, ‘টাকা কেন দিচ্ছেন?’
অতনুবাবু বললেন, ‘বাইরে আপনার আরও কয়েকজন পেশেন্ট বসে আছেন৷ তার মধ্যেই আপনি প্রায় আধ ঘণ্টা সময় দিলেন আমায়, সময়ের দাম অনেক, ম্যাডাম৷ এটা আপনার ফিজ৷’
তিথি কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক যেমন এসেছিলেন তেমনই চলে গেলেন ঝড়ের গতিতে৷
তিথি ঘন ঘন ফোনের দিকে তাকাচ্ছিল, যদি স্নেহাংশুর কোনো মেসেজ আসে৷ কিন্তু প্রতীক্ষা ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে ওর৷
গাড়িতে উঠেই ঊর্মি বলল, ‘আচ্ছা, আপনি হঠাৎ আমার প্রেমিক সাজতে রাজি কেন হলেন? আপনি তো আমাকে চেনেনই না৷’
স্নেহাংশু স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বলল, ‘এই গাড়িটা কার? তোমার?’
ঊর্মি হেসে বলল, ‘না আমার নয়৷ ভাড়া করেছি৷ নিজের গাড়ি নিয়ে কিডন্যাপ করতে গেলে ধরা পড়ে যাব না?’
স্নেহাংশু হেসে বলল, ‘তোমার উত্তর এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, ঊর্মিলা৷ এই ছন্নছাড়া, লাগামছাড়া, সাহসী জীবন আমায় বড্ড আকর্ষণ করে৷ তোমার নিজের গাড়ি থাকতেও তুমি এই খাটালাটাতে ঘুরে বেড়াচ্ছ দিব্যি৷ নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসেও বেশ ফুরফুরে রয়েছ, ঠিক এই জীবনটাই আমি কাটাই৷ সত্যি বলতে কী এ জীবনের সঙ্গী হতে কেউ চায় না৷ এমন একজনকে পেয়ে নেমে পড়লাম আরেকটা অ্যাডভেঞ্চারে৷ আমিও তোমার মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে৷ আমার বাবারও হিসেবহীন টাকা৷ সঙ্গে বংশমর্যাদা আর অর্থের অহংকার৷ তাই নিজেকে সরিয়ে এনেছি ওই রাজপ্রাসাদ থেকে৷ তোমাকে পছন্দ হওয়ার আরেকটা কারণও আছে, ঊর্মিলা৷ যদি অভয় দাও তো বলি?’
ঊর্মিলা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বলুন নির্ভয়ে৷’
‘তুমি খুব ডেসপারেট৷ যা বলো, জীবনের রিস্ক নিয়ে করে দেখাও, এটাও আমার পছন্দের কারণ৷ নির্বাণকে কিডন্যাপ করাটা অবশ্যই অন্যায়, সবাই তোমার দোষই দেখবে৷ কিন্তু এই অদ্ভুত টাইপের সাহসী বেপরোয়া স্বভাবটা আমার খুব পছন্দের৷ আসলে মনের ওপরে তো জোর চলে না৷ তাই তুমি জানতে চেয়ো না, কেন আমার পছন্দটা এমন সৃষ্টিছাড়া৷’
ঊর্মিলা আলতো গলায় বলল, ‘কদিন থাকবেন আপনি আমার সঙ্গে?’
স্নেহাংশু ডানদিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে বলল, ‘তুমি যতদিন রাখবে৷ যেদিন চলে যেতে বলবে, বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যাব৷ আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী৷ চরমভাবে বিশ্বাসী৷ তোমার আজীবন আমায় ভালো না লাগতেই পারে৷ যেমন ছোটোবেলায় আমার কয়েতবেল পছন্দের খাবার ছিল৷ এখন গন্ধটাই সহ্য হয় না৷ তেমনই আজ তোমার আমাকে ভালো লাগবে বলে, আগামীকাল অপছন্দ হলেও জগদ্দল পাথরের মতো তোমার ঘাড়ে বসে থাকব এমন ধারণায় আমি বিশ্বাসী নই৷ তাই যতদিন চাইবে ততদিন থাকব৷’
ঊর্মিলা বলল, ‘ধরুন উলটোটা হল৷ আমি আজীবন চাইলাম, কিন্তু আপনি থাকতে নারাজ, তখন?’
স্নেহাংশু হো হো করে হেসে বলল, ‘তখন রাতের অন্ধকারে সব ছেড়ে পালাব, কারণ বাঁধনে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে৷ তাই আমি বিয়েতে বিশ্বাসী নই৷ বললাম না, একটু উদ্ভট ভাবনাচিন্তা নিয়েই বাঁচি আমি৷ তাই তো তোমায় পছন্দ হল৷ এনিওয়ে, গুগল ম্যাপ বলছে, আমরা পৌঁছে গেছি৷ নির্বাণের সামনে আমায় যেন আপনি বোলো না ঊর্মিলা, এটা খেয়াল রেখো৷’
ঊর্মিদের সল্ট লেকের ফ্ল্যাটটা চারতলায়৷ ঊর্মি বলল, ‘এসো স্নেহাংশু৷ এখানের সিকিউরিটির আবার কৌতূহল একটু বেশি৷ ও তোমার দিকে বার দুয়েক তাকালেও তুমি তাকিয়ো না৷ বি ক্যাজুয়াল৷’
ফ্ল্যাটের চাবি বের করে ঊর্মিলা বলল, ‘আসলে এই ফ্ল্যাটটা বাবা আমায় আঠারো বছরের জন্মদিনে গিফট করেছিল৷ ব্যবহার বিশেষ হয় না৷ মাঝে মাঝে লোক ডেকে পরিষ্কার করা হয়৷ নির্বাণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন বার তিনেক এসেছিলাম একান্তে সময় কাটাতে৷ এ ব্যাপারে আগ্রহটা অবশ্য নির্বাণেরই বেশি ছিল৷’ স্নেহাংশু ফ্ল্যাটে ঢুকেই বুঝল, ঊর্মিলা শুধু অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে নয়, বেশ প্যাম্পার্ড চাইল্ড৷ দুর্দান্ত ইন্টিরিয়র করে সাজানো রয়েছে ফ্ল্যাটটা৷
ঊর্মিলা ঢুকেই বলল, ‘ফ্রুট জুস বা কোল্ড ড্রিংক খাবে?’
স্নেহাংশু হেসে বলল, ‘ওসব পরে হবে৷ আগে চলো, তোমার নির্বাণকে দেখি৷ আমার থেকে হ্যান্ডু হলে একটু জেলাস ফিল করব অবশ্যই৷’
ঊর্মিলা স্নেহাংশুর পিঠে ছোট্ট কিল মেরে বলল, ‘আই লাইক ইট ডিয়ার৷’
বেডরুমের দরজার লকটা খুলতেই নির্বাণকে দেখতে পেল স্নেহাংশু৷ ছেলেটার চোখে রীতিমতো আতঙ্ক৷ মুখে দু-দিনের না-কামানো দাড়ি৷ মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো অবিন্যস্ত৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দু-দিন স্নান অবধি জোটেনি৷ ঊর্মিলার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল নির্বাণ৷ ঊর্মিলা কিছু বলার আগেই স্নেহাংশু বলল, ‘হে ডার্লিং, তোমার চয়েস এত মিডিয়োকার ছিল, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না৷ তুমি ভাবলে কী করে, আঙ্কল এই ছেলেটিকে তোমার হাজবেন্ড হিসাবে অ্যাকসেপ্ট করবে? ঊর্মি, যা-ই বলো, এক্স হলেও আরেকটু ভালো চয়েস আশা করেছিলাম কিন্তু৷’
ঊর্মিলার ঠোঁটে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি৷ স্নেহাংশুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি ফিরলে নির্বাণের সঙ্গে পরিচয় করাব বলেই ওকে এখানে এনেছিলাম৷ কিন্তু তোমার ফ্লাইট লেট ছিল বলে বেচারাকে দু-দিন আটকে রাখতে হল৷ স্নেহাংশু, আমি তোমার কাছে সব দিক দিয়ে সৎ থাকতে চাই৷ কারণ তোমার ভালোবাসাটা এতটাই অনেস্ট যে আমি আমার পাস্টটুকু তোমার কাছে ক্লিয়ার না করে পারলাম না৷’
নির্বাণ রাগী গলায় বলল, ‘শুধু এই আদিখ্যেতা দেখাবি বলে আমায় অকারণ আটকে রেখেছিলিস?’
ঊর্মি কিছু বলার আগেই স্নেহাংশু বলল, ‘উহুঁ, এটাকে আদিখ্যেতা বলতে নেই৷ এটাকে বলে সততা, বিশ্বাস৷ প্রেমে যেটা থাকা ভীষণ জরুরি৷ এনিওয়ে ঊর্মি, এবারে আমাদের মধ্যে এই হাড্ডি কী করবে? একে বিদায় দাও৷ দুটো জুস নিয়ে এসো, আমি আর নির্বাণ খেতে খেতে একটু কথা বলি৷’ নির্বাণের চোখ দুটো একটু উজ্জ্বল হল, সম্ভবত ছাড়া পাবার আশায়৷
স্নেহাংশু ইশারা করতেই অরেঞ্জ জুস নিয়ে এল ঊর্মিলা৷ নির্বাণের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্নেহাংশু বলল, ‘কিছু মনে কোরো না নির্বাণ, তুমি তো জানো ঊর্মি একটু মুডি৷ আসলে আমার আর ওর বাবার দুজনের প্যাম্পারের ফসল এটা৷ তোমাকে এভাবে আটকে রাখায় আমি বিশেষ দুঃখিত৷ ঊর্মির হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি৷ তবে আমি চাই না, এসব নিয়ে তুমি থানা-পুলিশে যাও৷ কারণ ঊর্মি বেশি রেগে গেলে ওকে আমি সামলাতে পারি না৷ তাই এখান থেকে বেরিয়ে তুমি নিশ্চন্তে তোমার জীবনে ফিরে যাও৷ আমি কথা দিচ্ছি, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না৷’
নির্বাণ বিরক্তির গলায় বলল, ‘আমি ফালতু ঝামেলা পছন্দ করি না বলেই থানায় যাব না, ভাববেন না ওকে ভয় পেয়ে যাব না! ওর ক্ষমতা আমার জানা আছে৷ আমার সঙ্গে রিলেশনে ছিল৷ আমি যদি চাকরি না পাই, তাই চট করে আমার হাতটা ছেড়ে আপনার হাতটা ধরে নিল৷ যা পজেসিভ ও সম্পর্ক নিয়ে, দেখুন, দমবন্ধ না হয়ে যায়৷ সবই মেনে নিয়েছিলাম ভালোবাসার খাতিরে৷ কিন্তু অযথা আমার পরিবারকে অশ্রাব্য কথা বলে ব্রেকআপ করল, এখন আবার আপনার সঙ্গে পরিচয় করাবে বলে আমায় আটকে রাখল, ওর মেন্টাল ট্রিটমেন্ট করা দরকার স্নেহাংশু৷ ভেবে দেখবেন৷ এবারে কি আমি যেতে পারি?’
স্নেহাংশু গলা তুলে ডাকল, ‘ঊর্মি, নির্বাণকে তাহলে ছেড়ে দিলাম৷ এবারে আমরা আমাদের কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে চাই, প্লিজ৷’
নির্বাণ হঠাৎই স্নেহাংশুর হাতটা ধরে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্নেহাংশুদা, আমাকে মুক্তি দেবার জন্য৷’
ঊর্মি দরজার সামনে এসে টায়ার্ড গলায় বলল, ‘তুই এখনও বসে বসে স্নেহাংশুর মাথা চাটছিস? যা ভাগ৷ বাই দ্য ওয়ে, হিংসা করছিস তো? স্নেহাংশুকে দেখে? কর কর৷ ঊর্মিলার বয়ফ্রেন্ডকে দেখে লোকজন ঈর্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক৷ ভুলভাল চয়েস করলে অবশ্য নয়৷ যা ভাগ এখান থেকে৷’
নির্বাণ প্রায় ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল, স্নেহাংশু বলল, ‘ঊর্মি, ওর ফোনটা ওকে ফেরত দিয়ে দাও৷ আর দেখো, ওর কোনো ছোটো জিনিসও যেন এ ফ্ল্যাটে না পড়ে থাকে৷’ ঊর্মির ঠোঁটে হাসির রেখা৷
স্নেহাংশু সেদিকে তাকিয়ে রইল অপলক৷ মেয়েটা বোকা, ইনোসেন্ট, সঙ্গে ভীষণ ডেসপারেট৷ একটা ডেডলি কম্বিনেশন৷ এরা যদি কোনো কাজে বাধা পায় তাহলে সব শেষ করে দিতে দুবার ভাবে না৷
নির্বাণ বেরিয়ে যেতেই ঊর্মি বলল, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে? নাকি ফিরে যাবে?’
স্নেহাংশু জানে, তিথি টেনশন করছে৷ চুপি চুপিতে ফেরা দরকার৷ কিন্তু ঊর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল, ও কী চাইছে৷ মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ক্লান্ত৷ দিন দুয়েক ঘুমোয়নি৷ স্নেহাংশু বলল, ‘তুমি আগে বাড়ি ফেরো ঊর্মি৷ লাঞ্চ আমরা কাল করব৷ তোমার বাবা থানায় যাচ্ছেন বার বার, তোমার বাড়ি ফেরাটা জরুরি৷’
ঊর্মি স্নেহাংশুর কাছে ওর গা ঘেঁষে বসে বলল, ‘আচ্ছা, আমি কি খুব খারাপ? নির্বাণ বলেছিল, কেউ নাকি আমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না৷ কী মনে হল তোমার আমায় দেখে? আমি কি পাগল? প্লিজ স্নেহাংশু, সত্যিটা বলো৷’ স্নেহাংশু দেখল, কথা বলতে বলতেই সোফার কুশনে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে ঊর্মি৷
ওর হাতটা নিজের কাঁধ থেকে আলতো করে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল স্নেহাংশু৷ পাশের ঘরে ঢুকেই তিথিকে কল করল স্নেহাংশু৷ তিথি রিসিভ করেই বলল, ‘নির্বাণ কোথায়? নির্বাণের বাড়ি থেকে থানায় মিসিং ডায়েরি করেছে৷ এইমাত্র ঊর্মিলার বাবা কল করেছিল৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘চিন্তা করিস না, নির্বাণ এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গেছে৷ থানা-পুলিশ করবে না কথা দিয়ে তো গেল, কিন্তু ঊর্মি ওকে যেভাবে ফালতু টর্চার করেছে তাতে থানায় রিপোর্ট করতে গেলেও অবাক হব না৷’
তিথি ঊর্মিলার বাবার বলা কথাগুলো বলল৷ সবটা শুনে স্নেহাংশু বলল, ‘তার মানে এটা শুধু ব্রেকআপ নয়৷ এর পিছনে অন্য গল্প আছে৷ তাই ঊর্মিলার এতটা আক্রোশ নির্বাণের প্রতি৷’
তিথি বলল, ‘মেয়েটা কী করছে রে?’
স্নেহাংশু বলল, ‘একটা কাজ কর, ওর বাবাকে কল করে বল, ও সল্ট লেকের বাড়িতে আছে৷ কিন্তু দেখিস, ওর বাবা যেন আবার বলে না দেয়, তোর কাছ থেকে খবরটা পেয়েছে৷ এ মেয়ে ইচ্ছে হলে সব করতে পারে৷’
তিথি উদগ্রীব হয়ে বলল, ‘তুই এখনও ওর কাছেই আছিস? ফিরে আয় এবারে৷ আমাদের কাজ তো কমপ্লিট৷ নির্বাণকে বাঁচিয়ে দেওয়া গেছে৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘তিথি, ঊর্মিলা আমায় ভরসা করেছে৷ ওকে এভাবে রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? মেয়েটা কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ রয়েছে৷’
তিথি বলল, ‘ওর বাবাকে বলেছি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে৷ এরপর আর চুপি চুপির কোনো দায় রইল না, স্নেহাংশু৷ প্লিজ তুই চলে আয়৷ আমার টেনশন হচ্ছে রে৷’
স্নেহাংশু কিছু বলার আগেই দেখল ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশে৷ ফিসফিস করে বলল, ‘আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড প্লাস প্রেমিকা দুশ্চিন্তা করছে তো? আপনি এবারে আসুন৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘তিথি আমার প্রেমিকা নয় কিন্তু৷ ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷’
ঊর্মিলা বলল, ‘আপনি কি জানেন, মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব জোরালো হয়৷ তিথি ম্যামের চোখে আমি আপনার জন্য উদবেগ দেখেছি৷ আপনারা একে অপরের ইশারায় সাড়া দিচ্ছিলেন৷ এগুলো শুধু বন্ধুত্ব নয়৷ তিথি আপনাকে ভালোবাসে৷ এনিওয়ে, আমার-আপনার প্রয়োজনও মিটে গেছে৷ আপনি আসুন৷ নির্বাণকে খুন হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচালেন, আমাকেও বাঁচালেন খুনির অপবাদ থেকে৷ আমি কৃতজ্ঞ৷ এবারে আপনি আসুন৷ আরেকটা কথা, ভালোবাসা শব্দটাকে আমি খুব বিশ্বাস করি৷ শব্দটা আমার কাছে বড়ো পবিত্র৷ আচমকা ফেক প্রেমিক সেজে ওই শব্দটা নিয়ে খেলা করবেন না৷’ স্নেহাংশু কিছু বলার আগেই এক ধাক্কায় ওকে বাইরে বের করে দিয়ে দরজা লক করে দিল ঊর্মিলা৷ স্নেহাংশু বেশ কয়েকবার ডাকল, বেল বাজাল৷ কোনো সাড়াশব্দ নেই৷
ওপরের লবি থেকেই দেখতে পেল পুলিশ আসছে, সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক৷ সম্ভবত ঊর্মিলার বাবা৷ স্নেহাংশু চুপচাপ লিফটে উঠে গেল৷
দরজায় যতক্ষণ কান দিয়ে ছিল ততক্ষণ কোনো আওয়াজ ভিতরে পায়নি৷ ভয় করছিল, মেয়েটা কিছু করে বসবে না তো!
এতক্ষণে ভয়-ভয় করছে স্নেহাংশুর৷ সিসিটিভি থেকে সিকিউরিটি বলে দেবে, ও এসেছিল ঊর্মিলার সঙ্গে৷ এখন যদি ঊর্মিলা কিছু করে বসে তাহলে তো দোষী সাব্যস্ত হবে স্নেহাংশু৷ চুপি চুপির দায়িত্বে আছে, জানিয়েছিল পুলিশকে, তাই তিথির ওপরেও এফেক্ট পড়বে৷
তিথি ফোন করছে দেখে রিসিভ করল৷ ওর গলা শুনেই তিথি বলল, ‘সব ঠিক আছে তো? আমি পুলিশে জানিয়েছি আর ওর বাবাকেও জানিয়েছি৷ দেখ, পুলিশ এসেছিল আমার কাছে৷ আমি আমার দিক থেকে ঠিক থাকলাম৷ তা ছাড়া এখন তো আর নির্বাণের প্রাণসংকট নেই৷ তাই ভাবলাম, চুপি চুপির দায়িত্ব ছিল ঊর্মিলার খবর পেলে পুলিশকে জানানো, সেটাও ফুলফিল করে দিলাম৷ আমাদের আর দায় থাকল না৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘তিথি, ঊর্মিলা কি সুইসাইড করতে পারে? আমায় ঠেলে বাইরে বের করে দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা লক করে দিল৷ পুলিশ এসেছে৷ আমি পাঁচতলার লবিতে দাঁড়িয়ে আছি৷ মেইন গেটের দিকে তাকিয়ে আছি কাচের মধ্যে দিয়ে৷ ঊর্মিলাকে হেঁটে বেরোতে দেখলেই ফিরে যাব৷ ও যদি আত্মহত্যা করে, পুরো কেস খাব আমি৷ কারণ এই ফ্ল্যাটে আমিই এসেছিলাম ওর সঙ্গে৷’
তিথি আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘আমি আসব?’
স্নেহাংশু বলল, ‘বিপদে ফেললাম তোকে তা-ই না? উপকার করতে গিয়ে তোকে আর চুপি চুপিকে বিপদে ফেললাম আমি৷ রুনঝিও হয়তো বেঁচে থাকত, যদি না আমি ওর পাশে দাঁড়াতে যেতাম৷ এতদিন পর্যন্ত নাস্তিক ছিলাম৷ ভাগ্যে বিশ্বাস করতাম না৷ এখন তো মনে হচ্ছে, মা-কেও হারিয়েছি আমি আমার ভাগ্যের কারণেই৷’
তিথি বলল, ‘তুই শান্ত হয়ে দাঁড়া, প্লিজ৷ ঊর্মিলা নিজেকে ভীষণ ভালোবাসে৷ আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা যদি ঠিক হয় তাহলে ঊর্মিলা আত্মহত্যা করবে না৷’
স্নেহাংশু লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তিথি, ঊর্মিলাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পুলিশ আর এক ভদ্রলোক, সম্ভবত ওটাই ঊর্মির বাবা৷’
তিথি বলল, ‘বাড়ি চলে যাচ্ছি, এদিকটা সোনালিদি আর অনির্বাণ সামলে নেবে৷ তুইও চুপি চুপিতে ঢুকিস না এখন, সোজা বাড়ি আয়৷’
লাঞ্চ করতে বসেই তিথি বলল, ‘এত অন্যমনস্ক লাগছে কেন রে তোকে? মন দিয়ে খাওয়াটা শেষ কর৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘ঊর্মিলা বলল, তুই নাকি আমাকে ভালোবাসিস৷ আমি যেন ভালোবাসা শব্দটা নিয়ে ছেলেখেলা না করি৷ তিথি, তুই আমায় ভালোবাসিস?’
তিথি একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তুই তো সেই ছোটো থেকে চিনিস আমায়৷ স্টাডি করেছিস তো আমায়৷ কী মনে হয় তোর?’
স্নেহাংশু বলল, ‘বুঝিনি৷ তবে ঊর্মিলা আমায় বিশ্বাস করেছিল জানিস, কিছুক্ষণের জন্য হলেও৷’
তিথি বলল, ‘এত আপশোসের কী আছে রে? তোরও যদি ওর প্রতি সফট কর্নার তৈরি হয় তাহলে যা, গিয়ে সিরিয়াসলি প্রোপোজ কর৷ অযথা মন-খারাপ কেন করছিস?’
স্নেহাংশু বলল, ‘না ঠিক মন-খারাপ নয়, আসলে গিল্টি ফিলিং হচ্ছে একটা৷ মেয়েটার বয়েস তো বেশি নয়, এখনও বড্ড ইমোশনাল৷’
তিথি বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘টায়ার্ড লাগছে, একটু রেস্ট নেব আমি৷’
তিথি ঘরের দিকে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই অনির্বাণ কল করে বলল, ‘ম্যাডাম, পুলিশ এসেছে৷ ঊর্মিলা সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে৷ এই মিনিট দশেক আগে৷’
তিথি আঁতকে উঠে বলল, ‘সে কী! বেঁচে আছে তো?’
অনির্বাণ বলল, ‘মারা গেছে, ম্যাম৷ পুলিশ খবর পেয়েছে, আজকে ঊর্মিলা এখানে এসেছিল৷ ও যে গাড়িটা করে ঘুরছিল সেই ড্রাইভার সব বলেছে পুলিশকে৷ আপনি একবার আসুন, ম্যাম৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘ভুলটা আমার রে তিথি৷ ঊর্মিলার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী৷ মেয়েটাকে আরেকটু স্টেবল করা উচিত ছিল আমার৷ বিধ্বস্ত অবস্থায় চলে আসা ভুল হল৷ কিন্তু ও বাড়ি ফিরে গেল তো, তারপর কখন কী করল বল তো?’
তিথি বলল, ‘আমি আর ভাবতে পারছি না রে৷ পুলিশ এসে গেছে চুপি চুপিতে৷ সব শেষ হয়ে গেল৷ রেপুটেশন বাদ দে, আমায় অ্যারেস্ট করবে পুলিশ ভুল ইনফর্মেশন দেওয়ার জন্য৷ ঊর্মিলাকে আড়াল করার জন্য কেসটা খেলাম৷ স্নেহাংশু, তুই বাড়িতেই থাক প্লিজ৷ কাল পাহাড়ে চলে যাস৷ চুপি চুপির কোনো পেপারে তোর নাম নেই, আমি সামলে নেব৷ তুই এসব ঝামেলায় আর জড়াবি না, স্নেহাংশু৷’
স্নেহাংশু অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘ভালোবাসিস তিথি আমাকে? বেঁধে রাখতে পারবি আমায়? আমার পাগলামিগুলোর সঙ্গ দিবি? আমায় মায়ের মতো প্রশ্রয় দিবি?’
তিথি রেডি হতে হতে বলল, ‘কী মনে হয় তোর, ভালো না বাসলে আড়াই বছর পরে তুই যখন হঠাৎ উদয় হোস তখন তোকে টেনে নিতাম নিজের কাছে? পরে কথা হবে, চললাম৷’
পুলিশ অফিসার বেশ কড়া গলায় বলল, ‘আপনি জানতেন, ঊর্মিলা নির্বাণকে কিডন্যাপ করে রেখেছিল?’
তিথি শান্ত গলায় বলল, ‘জানতাম না, ঊর্মিলা হঠাৎ এসে জানিয়েছিল৷ সঙ্গে এটাও বলেছিল, পুলিশে খবর দিলে ও নির্বাণকে খুন করে দেবে৷ তাই আমি আগে নির্বাণকে রেসকিউ করার চেষ্টা করি৷ নির্বাণকে ঊর্মিলার হাত থেকে ছাড়িয়েই আপনাকে কল করেছিলাম, জানিয়েছিলাম, ঊর্মিলা কোথায় আছে৷ আপনারা ওকে বাড়িও পৌঁছে দিয়েছিলেন৷ তারপর ও কেন আত্মহত্যা করল অফিসার, এর উত্তর তো আপনি দেবেন৷’
অফিসার বলল, ‘দেখুন, আপনার বিজনেস পার্টনার ঊর্মিলার সঙ্গে ওর সল্ট লেকের বাড়িতে গিয়েছিল৷ সিকিউরিটি আর গাড়ির ড্রাইভার দুজনেই বলেছিল, একটি ছেলে ছিল ওর সঙ্গে৷ সিসিটিভি ফুটেজে আপনার পার্টনারকে আমরা শনাক্তও করেছি৷’
তিথি বলল, ‘আমি কখন অস্বীকার করলাম, অফিসার? আপনি নির্বাণকে ডেকে পাঠান৷ তাকে কীভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে স্নেহাংশু, সে নিজেই বলুক৷’
পুলিশ অফিসার বললেন, ‘তিনি এখন কোথায়? কিছু ইনফর্মেশন জানার ছিল৷ ঊর্মিলা গলায় ফাঁস লাগিয়েছে নিজের ঘরে৷ কিন্তু একটা নোট লিখে রেখে গেছে৷ সে ব্যাপারে একটু আলোকপাত করতে পারেন?’
তিথি বারণ করা সত্ত্বেও স্নেহাংশু এসে হাজির হয়েছে অফিসে৷ এসেই উদ্ভ্রান্তের মতো পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অফিসার, তিথি এক্ষেত্রে নির্দোষ৷ আমিই ঊর্মিলার সঙ্গে গিয়েছিলাম, কারণ নির্বাণকে উদ্ধার করাটা জরুরি ছিল৷ তাই এ ব্যাপারে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলুন৷’
পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আপনি থানায় আসুন, নির্বাণকেও ডাকা হয়েছে৷’
তিথি অপলক তাকিয়ে আছে স্নেহাংশুর দিকে৷ পুলিশের গাড়িতে গিয়ে উঠল চুপচাপ৷ এই ছেলেটা নাকি কারো দায়িত্ব নিতে পারবে না বলে পালিয়ে বেড়ায় সম্পর্ক থেকে৷ এই ছেলেটা নাকি বিয়ে, ভালোবাসা, সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়৷ উড়নচণ্ডী বলেই পরিচিত ছেলেটা আজ চুপি চুপি আর তিথিকে বাঁচাতে নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিয়ে নিচ্ছে অবলীলায়৷
পুলিশের গাড়িটা বেরোনোর পরেই অনির্বাণ বলল, ‘ম্যাডাম, একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে কথা বলেছি৷ আপনি চাইলে ওঁকে নিয়ে থানায় যেতে পারি আমরা৷’ তিথির মাথাটা কাজ করছে না এই মুহূর্তে৷ ঝাপসা চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছেলেটার ছবি, যে স্কুলে ওর টিফিন পড়ে গিয়েছিল বলে ঝুঁটিতে হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘আমার টিফিনটা খেয়ে নে৷ আমি তো সুপারম্যান, তাই খিদে পায় না৷’
যে ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় কলেজের তিনটে ছেলে যারা তিথিকে ইভটিজিং করেছিল তাদের সঙ্গে মারপিট করে নিজের নাক ফাটিয়ে স্কুলে এসে বলেছিল, ‘সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলাম৷’ আজও একইভাবে ছেলেটা তিথির ঝামেলা নিজের কাঁধে চাপিয়ে চলে গেল৷ এর কতদিন স্নেহাংশুর ওপরে ভরসা করে জীবন চালাবে তিথি? কোনো বিপদে পড়লেই স্নেহাংশু এসে বাঁচাবে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে ও? অনির্বাণ আবারও ডাকল, ‘ম্যাডাম, অ্যাডভোকেট বিপ্লব মাহাতোকে কন্ট্যাক্ট করব?’
তিথি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘ইমিডিয়েট করো৷ স্নেহাংশুর যেন কোনো বিপদ না হয়৷’
সোনালি বলল, ‘ম্যাম, ঊর্মিলার সুইসাইড নোটে কী লেখা আছে সেটা কিন্তু অফিসার বললেন না৷ আর চুপি চুপিতে একজন পেশেন্ট আসতেন বলেই তাঁর সুইসাইডের ঘটনায় আমাদের অফিস জড়িয়ে যাবে এটাই বা কোন যুক্তি? আর নির্বাণকে যে আমরা বাঁচালাম তার কোনো দাম নেই?’
তিথি বলল, ‘সুইসাইড নোটে কি আমাদের কারো নাম দিয়ে গেছে নাকি? আগে থানায় যাই৷’
অনির্বাণ আর তিথি যখন থানার সামনে তখনই অ্যাডভোকেট বিপ্লব মাহাতো এসে হাজির হলেন৷
থানায় ঢুকেই দেখল, নির্বাণ আর স্নেহাংশু বসে আছে৷ বিপ্লববাবুই এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘জেরা কি শেষ হয়েছে, অফিসার? এটা তো একটা আত্মহত্যার কেস৷ মেয়েটি তার নিজের বাড়িতে, বাবা-মা উপস্থিত থাকাকালীন সুইসাইড করেছে৷ আমি তো বুঝতে পারলাম না, এখানে স্নেহাংশুবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের কী প্রয়োজন?’
অফিসার হেসে বললেন, ‘আমি ওঁকে অ্যারেস্ট করিনি, তাই অ্যাডভোকেটের তো দরকার ছিল না৷ জাস্ট জিজ্ঞাসাবাদ করলাম৷ বোঝার চেষ্টা করছিলাম, মেয়েটা ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ছিল কি না৷ আসলে এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের অনেক কমপ্লেক্স থাকে৷ সবটা শুনে বুঝলাম, মেয়েটির মানসিক স্থিরতা ছিল না৷ এনিওয়ে, আপনারা আসতে পারেন৷ কোনো প্রয়োজনে ডাকলে একটু হেল্প করবেন৷’
নির্বাণ বাইরে বেরোতেই ওর বাবা-মা বলল, ‘তুই তো কখনো বলিসনি অতনু পাঁজার মেয়ে তোর বন্ধু ছিল?’
নির্বাণ একটু অবাক হয়েই বলল, ‘এতে বলার কী ছিল? ঊর্মিলার বাবার নাম জেনে তোমরা কী করতে? তা ছাড়া আমি ঊর্মিলাকে ভালোবাসতাম৷ ও-ই ব্রেকআপ করেছিল৷ এনিওয়ে আমার টায়ার্ড লাগছে৷ বাড়ি চলো৷’
স্নেহাংশুকেও ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ৷ কিন্তু ওর যেন যাবার তাড়া নেই৷ মুখ-চোখে ক্লান্তি৷ বিধ্বস্ত চেহারা৷ তিথি বলল, ‘চল, বাড়ি যাই৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘একবার ঊর্মিলাদের বাড়ি যাবি তিথি? ওর বাবার কাছে ক্ষমা চাইব৷ মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না৷’
তিথি কড়া গলায় বলল, ‘না, এখন বাড়ি চল৷’
তিথির ফ্ল্যাটের ব্যালকনিটা বেশ ছোটো৷ কিন্তু সামনেই একটা পার্ক থাকায় বেশ খানিকটা সবুজ এখনও রয়ে গেছে৷ স্নেহাংশু অন্ধকারেও সেদিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তিথি দু-কাপ চা নিয়ে এসে বলল, ‘চা-টা খেয়ে নে, ফ্রেশ লাগবে৷’
স্নেহাংশু বিজবিজ করে বলল, ‘ভালোবাসা শব্দটাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু শব্দটাই আমার বিশ্বাস ভেঙে দিল দ্বিতীয়বারের জন্য৷ কেন ঊর্মিলা এটা লিখে রেখে গেছে, জানিস ওর সুইসাইড নোটে? দ্বিতীয়বার কে ভাঙল বল তো তিথি? আমি৷ আমাকে ওইটুকু সময়ে মেয়েটা বিশ্বাস করেছিল৷ আমার নিখুঁত অভিনয়টা মেয়েটা সত্যি ভেবেছিল, জানিস৷’
তিথি স্নেহাংশুর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘বাদ দে-না প্লিজ৷ চল, আমরা শুরু করি৷ বিয়ে করবি আমায়? বাঁধা পড়বি আমার কাছে?’
স্নেহাংশু দূরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর কেউ বিশ্বাস করবে আমায়?’
রাতে খাওয়ার টেবিলও চুপটি করে বসে ছিল স্নেহাংশু৷ তিথি বার দুয়েক বলল, ‘কী রে, খেয়ে নে৷’ স্নেহাংশু বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে, এই মুহূর্তে তিথির কিছুই করার নেই, ওর পাশে থাকা ছাড়া৷ সময় লাগবে ওর স্বাভাবিক হতে৷ তাই স্নেহাংশুর বিছানা করে দিয়ে নিজে ঘুমোতে গেল৷
আগের দিনের ধকলের জন্যই একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙল তিথির৷ সবিতার বেলের আওয়াজে৷ সবিতা ঢুকেই বলতে শুরু করল, ‘বাপ রে ঘুম, কতবার বেল বাজালাম, জানো?’ তিথি দেখলো, সোফাতে স্নেহাংশু নেই৷ এত সকালে গেল কোথায়? চলে গেল নাকি না জানিয়ে? কিছু বিশ্বাস নেই ওকে, তিথি জানে স্নেহাংশুর মনের অবস্থা এই মুহূর্তে ভালো নিই৷ তাই আবারও নিরুদ্দেশ হতে সময় নেবে না ও৷
ফোন করে দেখল, ‘নট রিচেবল’ বলছে৷ তিথি নিশ্চিত হল আবার স্নেহাংশু চলে গেল অজানা কোনো গ্রামে৷
নিজের মনেই হাসল এক টুকরো৷ ওর বোধহয় ঘর বাঁধা আর হল না স্নেহাংশুর সঙ্গে৷ অবাধ্য চোখ দুটো অকারণেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে৷
চুপি চুপিতে যেতে হবে৷ আর কাজের এনার্জি নেই তিথির৷ অফিসটা কি বন্ধ করে দেবে? ঊর্মিলার ঘটনাটা বড্ড তিক্ততা ছড়িয়ে দিল চুপি চুপির আনাচকানাচে৷ মেয়েটার মুখটা মনে পড়ছে বার বার৷ তিথি ব্যর্থ হল প্রথমবার৷ এতদিন পর্যন্ত যারাই চুপি চুপিতে এসেছে, প্রত্যেকে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠেছে৷ একমাত্র ঊর্মিলার এমন ভয়ানক পরিণতি হল৷
সবিতাদি স্নেহাংশুর কথা জিজ্ঞাসা করছিল, তিথি হ্যাঁ, হুঁ করে দায়সারা উত্তর দিল৷
অবসন্ন পায়ে চুপি চুপির গেটটা পেরোল তিথি৷ আজ আর গাড়ি নিয়ে আসেনি৷ উবের বুক করে নিয়েছিল৷ কে জানে কেন একটু নার্ভাস লাগছে, তাই আর স্টিয়ারিং-এ হাত রাখেনি আজ৷ ওকে দেখেই একমুখ হেসে ‘মর্নিং’ বলল সিকিউরিটি৷ অফিসটা বন্ধ করে দিলে এদেরও চাকরিটা যাবে৷ তিথি বেশ জোরেই দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে ভারী কাচের পাল্লাটা ঠেলে ঢুকল অফিসে৷ ওকে দেখেই মীনা বলে রিসেপশনিস্টটা বলল, ‘ম্যাম, ভিতরে একজন পেশেন্ট আছেন৷ স্যার ওঁর কাউন্সেলিং করছেন অনেকক্ষণ ধরেই৷’
অনির্বাণ ছেলেটা ভাগ্যিস ছিল, তাই কালকের ঝড়ের পরেও আজ চুপি চুপি সচল আছে৷
নক করতেই ভিতর থেকে আওয়াজ এল, ‘কাম ইন৷’
তিথির রুমটা কেউ লাল গোলাপ আর জুঁই দিয়ে সাজিয়েছে নিজের হাতে যত্ন করে৷ ঢুকতেই একমুঠো ফুলের গন্ধ এসে ঝাপটা দিল ওর নাকে৷
চেয়ারে ফর্ম্যাল জামা-প্যান্ট পরে বসে আছে স্নেহাংশু৷ সামনে একটি বছর পঁচিশের ছেলে৷ তিথির দিকে তাকিয়ে স্নেহাংশু বলল, ‘বোস, ওর সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দিই৷ ওর নাম সৌগত৷ সৌগত সদ্য চাকরি পেয়েছে৷ এক মাসের মাইনে পেয়েছে মাত্র৷ হঠাৎই ওর বাবা প্রায় আট লক্ষ টাকার ঋণ ওর সামনে ধরে বলছে, এটা নাকি ওকেই শোধ করতে হবে৷ অথচ ধারটা করেছিল ওর বড়দা৷ বাড়ি থেকে ক্রমশ চাপ তৈরি করা হচ্ছে ওর ওপরে৷ ওইজন্যই বেচারা এসেছে আমাদের পরামর্শ নিতে৷’
তিথির ঠোঁটে আলগা হাসির রেখা৷ সৌগত হয়তো ভাবছে, ওর সমস্যা শুনে তিথির হাসি পাচ্ছে কেন? কিন্তু তিথি কী করে বোঝাবে ওকে, আজ প্রথমবার স্নেহাংশু সম্পর্কে ওর ধারণাটা ভুল হল৷ আজ প্রথমবার ওকে একা করে দিয়ে পালাতে পারল না স্নেহাংশু৷ এগুলো যে কতটা পাওয়া ওর কাছে সেটা একমাত্র তিথিই জানে৷
তিথি বলল, ‘সৌগত, তুমি এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছ এই মুহূর্তে যে মানুষটা হাজার নেগেটিভিটির থেকে পজিটিভ দিকটুকু শুষে নিতে পারে৷ তাই ওর সঙ্গে কথা বলো মন খুলে৷’
স্নেহাংশু বলল, ‘আসলে কী জানো সৌগত, আমরা যতই বলি বাবা-মায়ের কাছে সব সন্তান সমান, সব ক্ষেত্রে সেটা ঠিক নয়৷ সন্তানদের মধ্যে যে একটু বেশি ভদ্র, যে মন দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে চায় তাকেই বেশি ইউজ করে নেয় বাবা-মা-ও৷ তাই যে ঋণ তোমার বড়দা করেছে সেটা শোধ করার দায়িত্ব পড়ছে তোমার ওপরে৷ তুমি একটা কাজ করো৷ জীবনে প্রথমবার নিজের স্বভাববিরুদ্ধ একটা কাজ করে ফেলো৷ বাড়িতে গিয়ে বলে ফেলো, আমি পারব না৷ আমার নতুন চাকরি, আমি লোন নিতে পারব না এখুনি৷ একবার কষ্ট করে না বলতে শেখো৷ কেউ দুঃখ পাবে না, সৌগত৷ সবাই তোমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে৷ দু-দিন হয়তো মনোমালিন্য হবে কিন্তু তুমি মুক্তি পাবে৷ দায়িত্ব-কর্তব্য সব পালন করো কিন্তু মাঝে মাঝে অযৌক্তিক বায়নাতে না বলতে হবে৷’
সৌগত স্নেহাংশুর হাতটা ধরে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ৷ আমার মন থেকে দ্বিধা সরিয়ে দেবার জন্য৷ প্রয়োজনে আমি আবার আসব৷’
স্নেহাংশু একটু জল খেয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বল, তোর চেম্বারটা কেমন লাগছে? আরে ফুল না থাকলে বড্ড যান্ত্রিক লাগে৷ মন নিয়ে কাজ করবি, মন ভালো না থাকলে চলে?’
তিথি বলল, ‘তোর জামা-প্যান্ট সব কোথায় রেখেছিস?’
স্নেহাংশু হেসে বলল, ‘কিছু তোর ডাইনিং রুমের বক্সে আর কিছু ওয়াশিং মেশিনে ভরে এসেছি৷ ভয় পেয়ে গিয়েছিলিস? ভেবেছিলিস, আবার পালালাম? উহুঁ৷ ঊর্মিলা আমায় শিখিয়ে গেল কারো বিশ্বাস নিয়ে খেলা করতে নেই৷ তুই বিশ্বাস করেছিস আমায় তাই আর তোর হাত ছেড়ে পালাব না আমি৷ চুপি চুপিকে আমরা দুজনে সাজাব, তিথি৷ বহু মানুষের অব্যক্ত যন্ত্রণার ভার নেব দুজনে৷’
তিথি কথা বলার চেষ্টা করেও পারল না, গলাটা হঠাৎই বুজে আসছে, দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে-যাওয়া ছেলেটাকে নতুন করে চিনে নিচ্ছে তিথি৷
স্নেহাংশু বলল, ‘নেক্সট পেশেন্টকে ডাকি?’
তিথি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল৷ স্নেহাংশু হেসে বলল, ‘সেই স্কুলের ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটাই রয়ে গেলি৷’
‘নেক্সট’ বলে গলা তুলল তিথি৷
সমাপ্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন