অর্পিতা সরকার
‘আপনি কি মা মৃন্ময়ী? আমি এই আশ্রমে এসে থেকে শুনছি, সব মনের যন্ত্রণার ওষুধ নাকি মা মৃন্ময়ীর কাছে আছে৷ তাই খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম৷ আপনার বয়েস তো খুবই কম, মা৷ এত কম বয়সে এমন শিক্ষা আপনি পেলেন কোথায়?’ বছর পঞ্চাশের বেশ সম্ভ্রান্ত মহিলা হাত দুটো জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়ীর সামনে৷ এ আশ্রমে সকালে-বিকেলে এমন অনেক মানুষ আসেন একটু মানসিক শান্তি পেতে৷ মৃন্ময়ীর কাছে এ আর নতুন কিছু নয়৷ ওকে দীক্ষা দিয়েছিলেন এ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং অঘোরনাথজি৷ তিনিই বলেছিলেন, মানুষের পাশে দাঁড়াতে৷ ওদের আশ্রম শ্রীকণ্ঠধামের পরিবেশটা বড়ো সুন্দর৷ সদর দিয়ে ঢুকেই ছোটো একটা জলাশয়৷ তারই ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটা৷ কষ্টিপাথরের বিশাল শিব মন্দির৷ প্রথম যখন এই আশ্রমে এসেছিল মৃন্ময়ী তখন জানত না শ্রীকণ্ঠ শিবের আরেক নাম৷ অঘোরনাথজির মা স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন সন্তান জন্মের পরেই৷ মায়ের স্বপ্নে পাওয়া ইচ্ছেই পূরণ করেছিলেন অঘোরনাথজি৷ ঠিক যেমন শিব ঠাকুরের মূর্তি ওঁর মা স্বপ্নে দেখেছিলেন তেমনই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ ওঁর মা-ও শেষ বয়সে দেখে গিয়েছিলেন এ মন্দির৷ অঘোরনাথ চাটুজ্জে পেশায় ছিলেন সংস্কৃত কলেজের প্রফেসর আর প্যাশনে পুরোহিত৷ দুর্দান্ত সংস্কৃত উচচারণে আর সুকণ্ঠে যখন পুজোর মঞ্চে বসেন তখন সকলে স্তব্ধ হয়ে শোনেন৷ সেই অঘোরনাথের শিষ্যা মৃন্ময়ী৷ তাই পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে বশ করতে শিখেছে খুব সহজেই৷
ওর একমাত্র আনন্দ মহাদেবের সেবা করায়৷ বাকি সব বড়ো তুচ্ছ ওর কাছে৷ এমন প্রশংসায় আর উদবেল হয় না মৃন্ময়ী৷ শ্রীকণ্ঠধামে মানুষ আসেন একটু শান্তির খোঁজে৷ এখানের সন্ধ্যারতি, পুজো দেখলেও যেন শান্তি মেলে মনে৷ শ্রীকণ্ঠধামের অনেক কাজ৷ থ্যালাসেমিয়া শিশুদের জন্য ফ্রি ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প করা, যারা অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারে না তাদের সাহায্য করা, যে সমস্ত গরিব মেধাবী ছেলে-মেয়ে বইয়ের অভাবে পড়াশোনা করতে পারে না তাদেরও সাহায্য করে এ আশ্রম৷ অঘোরনাথজির বাবা ছিলেন বড়ো ব্যবসায়ী৷ বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর সমস্ত অর্থ এ আশ্রমে ঢেলেছেন অঘোরনাথ৷ তাই শ্রীকণ্ঠধামের নিজস্ব সম্পত্তির পরিমাণ কিছু কম নেই৷ এ ছাড়াও ওঁর শিষ্যের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়৷ অনেকে তো বিদেশে কর্মরত৷ তাঁরা স্বেচ্ছায় প্রচুর ডোনেশন করেন৷ সুন্দরবনের বন্যায় শ্রীকণ্ঠধাম দু-হাত তুলে সাহায্য করেছিল৷ সত্তর বছর বয়স্ক একজন মানুষের যে এত প্রাণশক্তি থাকতে পারে, না দেখলে মৃন্ময়ী বিশ্বাসই করত না৷ সন্ধ্যারতির সময় হয়ে গেছে৷ পাকশালায় লুচি ভাজা হচ্ছে৷ লুচি আর নারকেলের নাড়ু এটা হল সন্ধের প্রসাদ৷ সকালে ফল, মিষ্টি আর খিচুড়ি ভোগ দেন রোজ৷ মৃন্ময়ীকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন অঘোরজি, মুখে বলেন ও আমার মানসকন্যা৷ লোকে বলে, অল্প বয়েসে বাকি অঘোরজি বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে৷ কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেই মেয়ে অনেক টাকা দাবি করে ডিভোর্স চেয়েছিল৷ অঘোরজি তার দাবি মিটিয়ে সংসার ত্যাগ করেন৷ তখন শুধু প্রফেসরি আর পুজো এই নিয়েই থাকতেন৷ আর কখনো বিয়ের দিকে যাননি৷ শ্রীকণ্ঠধামের তখনও জন্ম হয়নি৷ মা আর ছেলের সংসার চলছিল টুকটুক করে৷ তারপরেই মা শেষ বয়সে এসে আবদার করেন, স্বপ্নাদেশে পাওয়া মন্দির তাঁকে বানিয়ে দিতেই হবে৷ মায়ের আদেশে তিনি তৈরি করেছিলেন এই ধাম৷ তারপর থেকে এ মন্দির, এ আশ্রমই ওঁর সংসার৷ এমনিতে বেশ সাদাসিধে মানুষ৷ শুধু রেগে যান কেউ কাজে ফাঁকি দিলে আর মিথ্যে বললে৷ উনি বলেন, এ দুটো করলে আমি তাকে আর মানুষের দলে ফেলি না৷ তাই সাবধান, শ্রীকণ্ঠে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলবি না কেউ৷ শ্রীকণ্ঠর কর্মচারীদের উনি ডাকেন ‘বাবার সন্তান’ বলে৷ অপার জ্ঞান সব বিষয়ে৷ প্রচুর বই পড়েন৷ কিন্তু যখন কেউ কথা বলে ওঁর সামনে বসে তখন উনি মনোযোগী শ্রোতা৷ শ্রমণ একবার প্রশ্ন করেছিল, ‘অঘোরজি আপনার সামনে বসে যে কথা বলছিল এতক্ষণ তার বলা সব কথাই তো আপনার জানা৷ তাহলে আপনি মন দিয়ে কী শুনছিলেন?’ অঘোরজি হেসে বলেছিলেন, ‘জানার আর শেখার কি শেষ আছে রে? আমি ওর কথা শুনে বুঝছিলাম ওর কষ্টের গভীরতা কতটা৷ আসলে কী হয় জানিস, কেউ কেউ যন্ত্রণার গল্প করতে ভালোবাসে আর কেউ কেউ যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখতে৷ তাই আগে ভালো শ্রোতা হতে হয়, তারপর ভালো বক্তা৷’
অঘোরজিকে দেখে দেখে নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করেছে মৃন্ময়ী৷ উত্তজনা, রাগকে বশে আনার পদ্ধতিও স্বয়ং অঘোরজি শিখিয়েছিলেন ওকে৷ এমনকী কষ্টকে হাসিতে বদলে ফেলতেও শিখিয়েছিলেন৷ মৃন্ময়ী খুব ভালো ছাত্রীর মতো ওঁর শেখানো শিক্ষাটুকুকে গ্রহণ করেই আজকের মৃন্ময়ী মা হয়ে উঠেছে মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সেই৷ মন্দিরে পুজো দিয়েই ক্ষান্ত থাকে না ভক্তরা, তারা এসে একবার গল্প করে যায় তাদের মৃন্ময়ী মায়ের সঙ্গে৷ তারা বলে, শ্রীকণ্ঠে এসে যেমন শান্তি পাওয়া যায়, মৃন্ময়ী মায়ের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বললেও ততটাই আনন্দ পাওয়া যায়৷
মৃন্ময়ী হেসে বলল, ‘বয়েস তো একটা সংখ্যামাত্র৷ কে কতটা জীবনকে কাছ থেকে চিনেছে সেটাই তো বড়ো কথা৷ জীবন কাউকে সত্তরেও নিজের স্বরূপ বোঝায় না, আবার জীবন কাউকে বাধ্য করে কুড়িতেই জীবনের নগ্নরূপ দেখতে৷ কাউকে রাখে আদরে-সোহাগে, কাউকে ছেড়ে দেয় পাথুরে রাস্তায়৷’
মহিলা হাত জোড় করে বললেন, ‘বড়ো ভালো কথা বলো তো তুমি মা৷ আমার নাম নিরুপমা ভাদুড়ি৷ আমি একজন হাউসওয়াইফ৷ আমার আর সংসার করতে ইচ্ছে করছে না৷ কিছুতেই মন বসাতে পারছি না নিজের সাজানো-গোছানো সংসারে৷ ভালো গান গাইতাম, জানো, কিন্তু যৌথ পরিবারে বিয়ে হবার পরে হারমোনিয়ামে ধুলো জমল৷ সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হত৷ এর লিকার চা, ওর দুধ চা, এর অফিসের টিফিন, ওর স্কুলের সে এক মহাযুদ্ধ যেন৷
‘শাশুড়ি মা আর বড়োজা বলেছিলেন, স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে৷ মন দিয়ে সংসার করতে৷ তবেই নাকি ভালো বউয়ের পুরস্কার পাব৷ প্রথমে বুঝিনি কেন স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে বলেছিল বাড়ির লোকজন৷ আমার স্বামী রেলের বড়ো অফিসার ছিল৷ ভালো ইনকাম করত৷ কিন্তু মেজাজ ছিল সপ্তমে৷ এই ধরো খেতে, বসে মাছ ভাজা করে দিলুম, রান্নাঘরের কড়াই থেকে খাবার পাত এইটুকুতেই বলত, এমন ঠান্ডা মাছভাজা আমি খাই না৷ দিয়েই ভাতের থালা দিত ছুড়ে৷ সে এক দিন ছিল নিপীড়নের৷ সে এক দিন ছিল নিজের পৌরুষ দেখানোর৷ তারপর ছেলে-মেয়েরা হল৷ শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেলেন৷ ভাইয়ে ভাইয়ে পৃথক হল৷ সেই প্রথম আমি একটা সম্পূর্ণ নিজের রান্নাঘর পেলাম৷ সে আমার কী আনন্দ৷ ওই রান্নাঘরে আমায় কেউ কিছু বলবে না, কেউ নির্দেশ দেবে না৷ মনের আনন্দে নিত্যনতুন রান্না করতে শুরু করলাম৷ রোজই কর্তা খেয়ে বলত, ওই হয়েছে কোনোরকম৷ বিশ্বাস করো, ভালো হয়েছে শোনার অপেক্ষায় কান আমার উৎকর্ণ হয়ে থাকত৷ কিন্তু শুনতে পাইনি কোনোদিন৷ ছেলে-মেয়ে দুজনেই বাবাভক্ত হল৷ কারণ ছোটো থেকেই তারা বুঝে গিয়েছিল, মা গুড ফর নাথিং৷ মায়ের কাছে দশ আনা পয়সা থাকে না যেটা মা নিজে স্বাধীনভাবে খরচ করবে৷ সবটুকুই বাবার কাছে হাত পেতে নেয় মা৷ তাই ছেলে-মেয়েও বিশেষ পাত্তা দিত না৷ আমি আমার সংসার, আমার বাড়ি বলে গর্ব করতাম৷ কিন্তু ঝগড়া হলেই আমার কর্তা বলত, থাকতে দিয়েছি, ডান হাত চারবেলা উঠছে আমার কৃপায়, কাজ বলতে তো ওই দুটো দায়সারা রান্না৷ সারাদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো৷ আগে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, জানো যে এই সংসারে কাজ কিছু কম থাকে না৷ তারপর গা-সওয়া হয়ে গেল এসব কথার দহন৷
‘ছেলে-মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যেতাম৷ শুনতাম, ছেলে খুব অবজ্ঞার সঙ্গে বলছে, না, আমার মা কিছুই করে না, জাস্ট হাউসওয়াইফ৷ মেয়ের গলাতেও একই সুরের অনুরণন৷ আগে এত কিছু ভাবতাম না, জানেন৷ সবই যেন কেমন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল৷ কষ্ট হত, হয়তো কাজের ফাঁকে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ত৷ কিন্তু ওই নিজের লোকেদের ওপরে রাগ করে আর যাবই বা কোথায়, ভেবে রয়ে গেলাম এতগুলো বছর৷ স্বামীর সোহাগ, ভালোবাসা কার নাম বুঝলাম না৷ কখনো তার ইচ্ছে হলে বিছানায় শরীরের খিদে মিটিয়েছে৷ আমিও ওটাকেই ভালোবাসা বলে ভেবে নিয়ে খুশি থেকেছি৷’ মৃন্ময়ী নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল ভদ্রমহিলার কথাগুলো৷ কথা বলতে বলতে কখনো ঠোঁটে ফুটে উঠছিল শ্লেষাত্মক হাসির রেখা, কখনো আবার অনেকটা ঘৃণা, কখনো চোখ দুটো হয়ে উঠছিল ঝাপসা, কখনো আবার সেই চোখেই হতাশার রাগ দেখা গেল৷
মৃন্ময়ী বলল, ‘সবই যখন মেনে নিয়ে এত বছর আছেন তখন হঠাৎ হল কী? মানে নতুন কিছু কি?’
মৃন্ময়ীর দিকে কিছুক্ষণ আনমনে তাকিয়ে নিরুপমাদেবী বললেন, ‘নতুন কিছু বলাই যায়৷ ইদানীং আমার স্বামীর শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না৷ মানে আজ অ্যাসিডিটি, কাল বাতের ব্যথা এইসব আর কি৷ ছেলে-মেয়েরাও জীবনে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ তাই এদের সকলের এখন আমাকে চাই৷ এই গুড ফর নাথিং হাউওয়াইফকে এখন এরা একটু বেশিই তেল দিচ্ছে৷ এদিকে সারাজীবন তেল ছাড়া রান্না খেয়ে খেয়ে আমার হজমক্ষমতা কমেছে৷ এখন অতিরিক্ত তৈলাক্ত বস্তু খেলেই চোঁয়া ঢেকুর দিচ্ছে৷ বদহজমের জ্বালায় অতিষ্ঠ লাগছে৷’
মৃন্ময়ী মৃদু হেসে বলল, ‘কিন্তু আপনি তো এই দিনের আশায় এত পরিশ্রম করেছেন সারাটা জীবন, এখন যখন সকলে আপনাকে ভালোবাসছে তখন ক্ষতি কোথায়?’
নিরুপমাদেবী চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘উহুঁ এটা ভালোবাসা নয়, প্রয়োজন৷ কর্তার রক্তের তেজ কমেছে তাই আমায় প্রয়োজন, সন্তানদের বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত আরাম প্রয়োজন, আর এখানেই আমার বড়ো আপত্তি৷ এতদিন প্রয়োজনটা বেশ উলঙ্গ ছিল, এখন সেটাতেই ভালোবাসা নামক মিথ্যে পোশাক পরাতে চেষ্টা করছে সকলে৷ বিশ্বাস করুন, দম বন্ধ লাগছে আমার৷ এ অহেতুক অভিনয় মেনে নিতে পারছি না৷ তাই আমি ডিভোর্স ফাইল করেছি৷ সেটা দেখে আমার কর্তা আর ছেলে-মেয়েরা হেসে কুটোপাটি৷ তারা বলছে, এসব ফালতু মজা করে লোক হাসানোর দরকার কী? আমার মতো অপদার্থ মানুষ যাবে কোথায় এই বয়সে এসে৷ আমি ছিলাম আমার বাবার একমাত্র সন্তান৷ বাবার বাড়ি, সম্পত্তি সব পেয়েছি মায়ের মৃত্যুর পরে৷ তাই যাবার জায়গার অভাব নেই৷ কিন্তু আমি চাই এখানে থাকতে৷ আমি আমার সবটুকু নিঃস্বার্থভাবে দান করতে চাই৷’
মৃন্ময়ী একটু উতলা হয়ে বলল, ‘কিন্তু মা, এই আশ্রমে তো বাবার শিষ্য-শিষ্যারাই শুধু থাকেন৷ যাঁরা মন্দিরের সব কাজকর্ম দেখেন৷ মধ্যাহ্নভোজনে অতিথিরা আসেন কিন্তু রাত্রিবাসের তো ব্যবস্থা নেই৷’
নিরুপমা বললেন, ‘আমি এ আশ্রমের একজন হয়ে থাকতে চাই৷ আরতির সময় যদি আমি গান গাই, তাহলে কি আমায় কাজে বহাল করা হবে?’
মৃন্ময়ী বেশ বুঝতে পারছে, নিরুপমা বড় চঞ্চল হয়ে আছেন৷ তবে বাড়ি ছাড়বেন এটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেটা ওঁর কথাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে৷ মৃন্ময়ী বলল, ‘আপনার এতদিনের সংসার ছেড়ে আসতে কষ্ট হবে না? সবাই তো নিজের লোক ওই বাড়িতে৷’
নিরুপমা হেসে বললেন, ‘ওটাই তো সব থেকে বড়ো দ্বন্দ্ব৷ কারা আমার নিজের লোক? যাদের জন্য গোটা জীবন সমস্ত কিছু করার পরেও বার বার শুনতে হয়েছে, ও তো তেমন কিছুই করে না৷ কোনটা নিজের বাড়ি? যে বাড়ি থেকে বার বার বের করে দেবার হুমকি দেওয়া হয়েছে সেটা? ভয় পেতাম, জানো, যদি সত্যি বের করে দেয় তখন তো ফিরে যেতে হবে বাবার কাছে৷ না, থাকার জায়গার অভাব নেই বাপের বাড়িতে৷ তেরোখানা ঘরের তিনতলা বাড়ি৷ কিন্তু বাবা-মা বলবে, এই বয়েসে এসে সমাজে সম্মান খোয়ালাম নিরু, তোর জন্য৷ লোকে বলবে, মেয়ে সংসার করতে পারল না৷ এখন ও জ্বালা নেই৷ বাবা-মা দেখে গেল, তাদের মেয়ে সুখে আছে৷ স্বর্গে গিয়ে তো আর সম্মান হারানোর ভয় পাবে না বাবা৷ তাই এত বছরে আমার ফুরসত মিলল সংসার ছাড়ার৷ যদি তোমরা ঠাঁই না দাও তাহলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে৷ আমি বৃদ্ধাশ্রমে থাকব না, কারণ আমি কাজ ছাড়া থাকতে পারি না৷’
মৃন্ময়ী বলল, ‘কিন্তু আপনাকে যে একবার অঘোরনাথজির পারমিশন নিতে হবে, মা৷ উনিই তো সিদ্ধান্ত নেবেন, এখানে কে থাকবে আর কে থাকবে না৷’
নিরুপমা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তো অঘোরনাথজির সঙ্গে কথা বলেই তোমার কাছে এলুম গো মা৷ উনি বললেন, ‘মৃন্ময়ী মায়ের আজ্ঞা পেলে তবেই আপনার স্থায়ী ঠিকানা হবে৷’
মৃন্ময়ীর ঠোঁটে নরম হাসি ছড়িয়ে গেল৷ অঘোরজি ওকে কন্যাতুল্য ভালোবাসতেন এতদিন৷ কিন্তু আশ্রমের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পারমিশন দেননি৷ এবারে কি এটাও পেতে চলেছে মৃন্ময়ী? পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করল ও৷ নিদারুণ জোরে চাবুকটা দিয়ে কশাঘাত করল অবাধ্য মনের দুয়ারে৷ ক্ষমতালোভী মনটাকে শাসন করে বলল, শ্রীকণ্ঠে বসে লোভ করার দুঃসাহসকে এখুনি নির্মূল করো৷ আর যেন কখনো না দেখি এমন আগ্রাসী মনোভাব৷ মৃন্ময়ীর উত্তর পাওয়ার জন্য নিরুপমা তাকিয়ে আছেন৷ মৃন্ময়ী নিজেকে সংযত করে বলল, ‘আপনি একটু বসুন, আমি একবার অঘোরজির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসি৷’
রক্তবর্ণ পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন অঘোরজি৷ সামনে বেশ কয়েকজন ভক্ত বসে আছেন৷ তাদেরই কিছু বোঝাচ্ছিলেন সম্ভবত৷ অঘোরজিকে একদিন মৃন্ময়ী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি লাল পোশাক কেন পরেন? আপনি তো শিবের সাধক, কালীর নয়৷’
অঘোরজি বলেছিলেন, ‘আমি শক্তির সাধক৷ লাল রং শক্তির প্রতীক৷ আর মহাদেব কি শক্তিতে কোনো অংশে কম রে?’ চিরাচরিত নিয়মের বাইরে পৃথিবীকে দেখাই যেন ওঁর নেশা৷ মৃন্ময়ী সামনে আসতেই আলোচনা থামিয়ে বললেন, ‘কী রে মা, চোখে এত দ্বন্দ্ব কীসের?’
মৃন্ময়ী হাত জোড় করে বলল, ‘বাবা, নিরুপমা নামের একজন মহিলা আশ্রমবাসী হতে চাইছেন, সে ব্যাপারে একটু কথা ছিল৷’
অঘোরজি হেসে বললেন, ‘এইটুকু সিদ্ধান্ত যে এবারে তোকেই নিতে হবে রে মা৷’ মৃন্ময়ী তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললেন, ‘পরেশনাথকে বল, নিরুপমা সব সত্যি বলছে কি না সেটা খোঁজ নিতে৷ নিরুপমাকে কালকে একবার অফিসে ডাক আধার কার্ড আর ভোটার কার্ড-সহ৷ তারপর না হয় বিবেচনা করিস৷’
‘মৃন্ময়ী বুঝল এত সহজে মানুষকে বিশ্বাস করতে বারণ করলেন অঘোরজি৷ যাচাই করে তবেই আশ্রয় দেওয়ার নির্দেশ দিলেন৷ মৃন্ময়ী এসে একটু সংকুচিত হয়েই বলল, নিরুপমাদেবী, আপনি কাল অফিসে আসুন সকাল এগারোটার মধ্যে৷ আধার কার্ড আর ভোটার কার্ড নিয়ে৷ আমি দেখছি, কী করা যায়৷’
‘নিরুপমাদেবী একগাল হেসে বললেন, ‘জানতাম, সবাই ফেরালেও স্বয়ং মহাদেব আমায় ফেরাবেন না৷’
মৃন্ময়ী অন্যমনস্ক হয়ে নিরুপমাদেবীর চলে যাওয়া দেখছিল৷ এই বয়েসে এসে সংসার ছাড়তে খুব কম জনকে দেখা যায়৷ বেশির ভাগ মানুষ তো জীবনের শেষ ক-টা দিন নিজের বাড়ি, স্বামী-সন্তান নিয়েই থাকতে চান৷ জীবনের প্রতি কতটা বীতশ্রদ্ধ হলে মানুষ এমন সিদ্ধান্ত নেয়! বড়ো গেটের কাছে রাধাচূড়া গাছটা পেরিয়ে যেতে আর দেখা গেল না নিরুপমাদেবীকে৷ মৃন্ময়ীকে চমকে দিয়ে আশ্রমকক্ষের বড়ো ঘড়িটা সশব্দে জানান দিল, সন্ধে ছ-টা বাজে৷ কথায় কথায় বড়ো দেরি হয়ে গেল৷ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল মৃন্ময়ী৷ গরদের লালপেড়ে শাড়ি পরে আরতির প্রদীপ সাজাতে হবে৷ শাড়ি পরে ব্যস্ত পায়ে যাচ্ছিল মন্দিরের দিকে তখনই বিপ্রদাস ডাকলেন৷ বিপ্রদাস মহারাজ অঘোরনাথজির খুব কাছের মানুষ৷ এ মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই উনি আছেন৷ বলতে গেলে অঘোরনাথজির বাম হাত৷ বয়েস ওই পঞ্চান্নর এদিক-ওদিক৷ এখনও আশ্রমের সব ব্যাপারে ওঁর নিখুঁত নজর৷ কোনো নিয়মভঙ্গ হতে দেন না৷ আশ্রমের মেয়েরা বলে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চির দর বেশি৷ অঘোরজি এত কড়া নন যতটা বিপ্রদাস মহারাজ৷ যেহেতু বাবার এত কাছের তাই কেউ ওঁকে অমান্য করতে পারে না৷ বিপ্রদাসের ডাক শুনে এগিয়ে গেল মৃন্ময়ী৷ বিপ্রদাস স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘আশ্রমের কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার মাত্র পাঁচ বছরে জন্মায় না, এটুকু মনে রাখলেই হবে৷ বাকি সব শ্রীকণ্ঠ বুঝে নেবেন৷’
মৃন্ময়ী মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল মন্দিরের দিকে৷ ও জানে, বিপ্রদাস ওকে একেবারেই পছন্দ করে না, তার একমাত্র কারণ ওর প্রতি অঘোরনাথজির অপরিসীম স্নেহ৷ বিপ্রদাস হয়তো ভাবছে, অঘোরজি নিজের পরে এ আশ্রমের দায়িত্ব মৃন্ময়ীকে দিতে চাইছেন, তাই এই শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে চলেন উনি৷ মৃন্ময়ী নিজেকে এ আশ্রমের আশ্রিতা ছাড়া কিছুই ভাবে না, পাঁচ বছর আগেও ভাবত না, আজও ভাবে না৷
‘কী গো অরূপদা, হাতে ঘড়ি নিয়ে ভাবছটা কী? পঞ্চাননতলায় বাবা পঞ্চাননের পুজো উপলক্ষে নাটকের দল এসেছে৷ ঠাকুরের নাটক হবে, শুনে এলাম৷ যাবে নাকি সন্ধেতে? আজকাল তো এই যাত্রা, নাটকের কালচারটাই উঠে গেল৷ আগে কম দেখেছি, বলো? সেই মনে আছে, সেবার তারকেশ্বরে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম তুমি আর আমি৷ ভয়ানক শীত পড়েছিল৷ যাত্রা দেখে ফেরার সময় সাইকেল আর টানতে পারছিলাম না৷ তুমি বলছ, জোরে চালা সুজয় তবে গায়ে গরম ধরবে৷ আর গরম, কনকনে হাওয়াতে সে এক জমে যাওয়ার অবস্থা৷ যত জোরে চালাই তত উত্তুরে হাওয়া যেন জমিয়ে দিতে চাইছিল৷ আরেকবার মনে আছে, সেই গোবন্দপুরে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম৷ নায়িকার নাকি জ্বর এসেছিল৷ তাই একটা ঢ্যাঙামতো ছেলে সেজেছিল দ্রৌপদী৷ অর্জুন দৌপদীর কাঁধে পড়ে৷ পাড়ার লোক ক্লাবের ছেলেদের এই মারে আর সেই মারে৷ তখন মঞ্চে এল কৃষ্ণ৷ আহা কী তার রূপ৷ অমন সুদর্শন পুরুষকে দেখে সবাই মোহিত হল৷’ কথাটা বলেই থমকে গেল সুজয়৷ জিভ কেটে বলল, ‘এই রে৷ যাক গে বলো দেখি, যাবে কি নাটক দেখতে?’
অরূপ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না রে যাব না৷ আর যাত্রা-নাটক দেখতে যাব না৷’
সুজয় বলল, ‘আরে মেয়ে তোমার ভালোই আছে গো৷ দেখো, খারাপ থাকলে খবর তো একটা আসত নাকি?
অরূপ হাতের ঘড়িটা পাশে রেখে বলল, ‘কোনো’ খবরই যে এল না রে৷ ভালো-খারাপ কোনো খবরই যে পেলাম না৷ একবারও ভাবিনি মঞ্চের অমন রূপবান, গুণবান কৃষ্ণ বাস্তবের মাটিতে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে৷ আরে আমি কি গিয়ে মেয়ের বাড়িতে পড়ে থাকব? তাদের ভাত খাব? আমি তো মেয়েটাকে একটু চোখের দেখা দেখেই চলে আসতাম৷ তো রুদ্র বলল কিনা, মেয়ে নাকি আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না৷ রুদ্র বলল, আমি আর আপনার মেয়ে যথেষ্ট ভালো আছি, অযথা বার বার এসে আমাদের বিরক্ত করবেন না৷ মেয়েও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, বাবা, তুমি যাও, আমরা ভালো আছি৷ এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল, এখনও তৃষার বলা ওই কথাগুলো যেন বুকে বাজে৷ চোখ বন্ধ করলেই মেয়েটার মুখ দেখতে পাই আমি৷ বুকের মধ্যে হু হু করে৷ একটামাত্র সম্বল ছিল আমার, সেটাও হারিয়ে গেল৷ হ্যাঁ রে সুজয়, ভগবান যার কাছ থেকে কেড়ে নেয় তার কাছ থেকে কি সব কেড়ে নেয়? এই বুঝি তার বিচার? এইজন্যই আজকাল কোনো মন্দিরে মাথা ঠুকি না৷ জানি, এত বছরে এ কথা তোকে হাজারবার বলেছি, কিন্তু এ ছাড়া আমার বলার যে আর কিছু নেই৷
সুজয় বলল, ‘অরূপদা এমন মন-খারাপ করে বসে থেকো না তো৷ তোমায় একদিন শ্রীকণ্ঠধামে নিয়ে যাব৷ অঘোরনাথজির সঙ্গে কথা বললে নাকি মন ভালো হয়ে যায়৷ আমার ভগ্নীপতি প্রায়ই যায়৷ ওর কাছেই শুনলাম৷ যাবে একবার?’
অরূপ উদাস হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘সে দেখব৷ তুই এখন যা৷’
সুজয় জানে, তৃষার বিয়ের পর থেকেই অরূপদা বড্ড বদলে গেছে৷ দিনরাত মন-খারাপ করে বসে থাকে৷ আগে ওই মানুষটাই কত গল্প করত, বাংলাদেশের গল্প, ও দেশ থেকে এ দেশে চলে আসার গল্প৷ সুজয়ের দাদুও যেহেতু বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছিল তাই ও দেশের প্রতি টান ওরও ছিল৷ তাই অরূপদার চোখ দিয়েই দেখত ওই দেশটাকে৷ অরূপদা বলত, ‘জানিস, তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সবে থেমেছে৷ আমাদের অনেক আত্মীয় ওই দাঙ্গায় মারা গিয়েছিল, কেউ পালিয়ে বেঁচেছিল৷ আমার বাবা-মা আর আমি ভয়ে ভয়ে ছোট্ট কুঁড়েঘরে দিন কাটাতাম৷ বাবা কাজে বেরোতে পারত না তখন৷ একবেলা খেয়ে কোনোমতে দিন চলছিল৷’
সুজয় জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ও দেশে তোমার বাগান-পুকুর ছিল না?’ অরূপদা বলত, ‘তখন আমার মাত্র সাত বছর বয়েস৷ ওই বয়সেই বুঝেছিলাম আমরা বেশ গরিব মানুষ৷ আমার বাবা পদ্মাপাড়ে মাছ ধরতে যেত৷ থাকার মধ্যে বাবার ছিল একটা বড়ো নৌকা৷ আর আমাদের একটা উঠোন ছিল, জানিস৷ উঠোনে মা অনেক ফুলের গাছ লাগিয়েছিল৷ দুর্গাপুজো আসছে, আমি বুঝতাম আমাদের উঠানের শিউলি গাছ দেখে৷ ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, শিউলিতলাটা সাদা হয়ে আছে ফুলে৷ মা-কে গিয়ে বলতাম, মা, পুজো আসছে, নাড়ু কবে বানাবে? মা হেসে বলত, সে হবে’ খন৷ আমার মা কত রকমের বড়ি দিত উঠোন জুড়ে৷ সে বড়ি বিক্রি হত গঞ্জের হাটে৷ না রে সুজয়, আমাদের ও দেশে জমিদারি ছিল না৷’
সুজয় বলেছিল, ‘দাঙ্গা যখন থেমেই গিয়েছিল তখন চলে এলে কেন এ দেশে?
অরূপদা বলেছিল, ‘ওই যে সেবারের বন্যায় আমাদের বাড়িটা গেল ডুবে৷ ওদিকে বাবা পদ্মায় ভেসে গেল৷ মা শেষে আমার হাত ধরে বলেছিল, চল, এই ভয়ংকরী পদ্মার পাড়ে আর থাকব না৷ তোর বাবাকে নিল, ঘরটুকুকে নিল৷ মায়ের মামারা তখন সব নবদ্বীপে এসে বাড়িঘর করেছিল৷ মা-ও আমায় নিয়ে চলে এল এ দেশে৷ মায়ের হাতের দু-গাছা চুড়ি ছিল তাও বর্ডার পার হতে ঘুস দিতে হল৷ মায়ের সেজোমামা আমাদের দায়িত্ব নিল৷ আমায় স্কুলে ভরতি করে দিল৷ মা-কেও একটা সেলাইয়ের কারখানায় কাজে লাগিয়ে দিল৷ কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম, আমার ভাষায় কথা বললে স্কুলের বন্ধুরা বাঙাল বলে রাগায়৷ তারপর নিজের কথাবার্তা এ দেশের মতো করলাম৷ বাড়ি এসে মায়ের কাছে অবশ্য বলতাম, ভাইত খামু৷ না হলে কেমন পেট ভরত না৷
‘ওখানে আমরা দল বেঁধে স্কুলে যেতাম৷ বর্ষায় যখন জল জমত রাস্তায়, আমরা গোল করে হাত ধরে সবাই মিলে ঝাঁপাতাম৷ সে এক দিন ছিল৷ বাংলাদেশের মাটির গন্ধ গায়ে মেখে পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করতাম৷’
সুজয় হেসে বলেছিল, ‘তা এ দেশে খারাপটা কী আছ? পুকুর, গঙ্গা তো এ দেশেও আছে৷ পদ্মা নেই, গঙ্গা আছে৷’
অরূপদা হেসে বলত, ‘সবই তো আছে, শুধু আমার জন্মভিটেটা নেই রে৷ মনের মধ্যে উথালপাথাল করে ওঠে এখনও ভাবলে, বাপ আমার মাঝপদ্মায় গিয়ে হারিয়েই গেল৷ আমার বাপ বাড়ি ঢুকেই আমার হাতে একখানা মাছ ধরিয়ে দিয়ে বলত, মা-কে গিয়ে বল, কড়া করে ভাজতে৷ সন্ধেবেলাতেও আমাদের বাড়ির রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজার ভুরভুরে গন্ধ ছাড়ত৷ পড়তে বসে আমার খিদে পেয়ে যেত৷ আমার বাবার হাত দুটো সব সময় সাদা হয়ে থাকত৷ বাবা বলত, জল বসে থাকে, শুকোনোর সময় পায় না যে৷ মা যখন ভাত করত বাবা গিয়ে মায়ের পাশের পিঁড়িতে বসে নিজের হাত দুটো সেঁকে নিত৷ আমার তখন বয়েস কম, তবুও বুঝতাম, বাবা মা-কে বড়ো ভালোবাসে৷ মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, এবারে পুজোয় নতুন শাড়ি কিনে দেব৷ মা ঘাড় নেড়ে বলত, আর শাড়ি লাগবে না, শুধু তুমি সময়ে বাড়ি ফিরো৷ তখন বুঝিনি, মা আসলে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাত৷ ঝড় উঠলেই হাত জোড় করে বিজবিজ করে ঠাকুরকে কী সব বলত৷ আমি জিজ্ঞাসা করলেই মা বলত, ঠাকুরকে বলি, মানুষটা যেন সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফেরে৷ কিন্তু ঠাকুর কবে আর গরিবের কথা শুনেছে? তাই মায়ের কথাও শুনল না৷ বাবা হারিয়ে গেল৷ তবুও বাংলাদেশ আমার বড়ো প্রিয়৷ সেজোদাদুর ঘড়ির দোকান ছিল৷ তখন বিয়ে থেকে জন্মদিনে উপহার মানেই ঘড়ি দেওয়া ছিল চল৷ আমার কলেজটা পাস হবার আগেই সেজোদাদু অসুস্থ হয়ে গেল৷ মা বলল, আমরা হলাম অপয়া৷ যার সংসারে থাকি তারই ক্ষতি হয়৷ না হলে অমন হাট্টাকাট্টা সেজোদাদু কিনা চার দিনের জ্বরে কাবু হয়ে বিছানায় মিশে গেল৷ আমার মা কত সেবা করল, আমিও কলেজ কামাই করে ডাক্তারের কাছে ছুটতাম কিন্তু কিছুতেই শরীর সারল না৷ সেজোদাদু আমায় বলল, ঘড়ির দোকানটা খুব শখের দোকান৷ তুই দেখিস অরু, ওটা যেন নষ্ট না হয়ে যায়৷ আমি কলেজ পাস করার আগেই সেজোদাদু মারা গেলেন৷ সেজোদাদু যেহেতু অবিবাহিত ছিলেন তাই অন্য ভাইয়েরা জুটে গেল সম্পত্তির গন্ধ পেয়ে৷ মা বলল, আমরা লড়ব না অরু৷ তাড়িয়ে দিলে ঘর ভাড়া করে থাকব৷ আবারও আমাদের মাথার ওপরে ছাদ টলে গেল৷ কিন্তু সেজোদাদু বোধহয় নিজের ভাইদের চিনতেন৷ তাই উইল করে পাকা কাজ করে রেখে গিয়েছিলেন৷ বাড়িটা আমার মায়ের নামে আর দোকানটা আমার নামে করে দিয়েছিলেন৷ আমার আর পড়া হল না৷ পড়াশোনাতেও বিশাল কিছু ভালো ছিলাম না৷ ওই আর পাঁচজনের মতো পাস করে যেতাম৷ বিশাল ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার যে হব না সেটা জানতাম৷ তাই মন দিয়ে দাদুর ঘড়ির দোকানটাতে বসতে শুরু করলাম৷ বসেই বুঝলাম, শুধু ঘড়ি বিক্রি করলে হবে না, অনেক খদ্দের আসে ঘড়ি সারাতে৷ তাই সারাইয়ের কাজটাও শিখে নিতে হবে৷ রতন গড়াইকে গিয়ে ধরলাম, দাদু, এ চত্বরে তুমিই একমাত্র খোঁড়া ঘড়িকে দৌড় করাতে পারো৷ এ বিদ্যে আমায় শিখিয়ে দাও৷ এদিকে রতনদাদুর সঙ্গে সেজোদাদুর মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল আজীবন৷ একমাত্র সেজোদাদুর মৃত্যুশয্যায় এসে রতনদাদুকে কাঁদতে দেখেছিলাম৷ আমি গিয়ে বলেছিলাম, জানি, সেজোদাদুর সঙ্গে তোমার শত্রুতা ছিল, কিন্তু আমি তো কোনো অন্যায় করিনি৷ তাই এ বিদ্যে তোমায় শেখাতেই হবে৷
‘রতনদাদু তখন একটা গল্প শোনাল৷ সেজোদাদু আর রতনদাদু স্কুল থেকে দুই বন্ধু ছিল৷ বাংলাদেশে পাশাপাশি বাড়ি ছিল৷ এর বাড়ির রান্না করা ইলিশ মাছের ওর বাড়িতে ছিল নিত্য যাতায়াত৷ দুজনে একই সঙ্গে স্কুলে যেত, একই সঙ্গে জলে নেমে ঝাঁপাই জুড়ত৷ তারপর যখন দাঙ্গা লাগল বাংলাদেশে তখন দুটো পরিবারই জমিজমা, ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল নবদ্বীপে৷ এখানে এসেও পাশাপাশি বাড়ি করল৷ ভরতি হল একই স্কুলে৷ তখন ওরা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, এক কাঁঠাল-পাকা গরমের দিনে বাড়ি ফিরছিল দুই বন্ধু স্কুল থেকে৷ রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল একটা চেন-কাটা হাতঘড়ি৷ দুজনে ঠুকেঠাকে অনেক চেষ্টা করেও সে ঘড়ি সারাতে পারেনি৷ তখন সেজোদাদু বলেছিল, ঘড়িটা আমি নিয়ে চললাম, রতন৷ আজ সারারাত আমি চেষ্টা করব, কাল সারারাত তুই৷
‘সেজোদাদু পরের দিন হাসতে হাসতে স্কুলে এসে বলেছিল, ঘড়ি এখন ঘোড়া হয়ে দৌড়োচ্ছে৷ তারপর দুই বন্ধু যার বাড়িতে যা পুরোনো ঘড়ি পেত সেসব নিয়ে সারাই করতে বসত৷ অবশেষে বারো ক্লাসের পর লেখাপড়ায় ইতি টেনে দুজনে মিলে একটা ঘড়ির দোকান করল৷ এ চত্বরে প্রথম ঘড়ির দোকান৷ বিক্রি ভালোই হতে শুরু করল৷ ঘড়ি তখন শুধু প্রয়োজন নয়, ফ্যাশন সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ সেজোদাদুকে কেউ যদি এসে বলত, বাংলাদেশে আদি বাড়ি ছিল তাহলেই ঘড়িতে ডিসকাউন্ট দিত বেশি৷ কী করে যেন কথাটা ছড়িয়ে গেল মুখে মুখে৷ তারপর থেকে সবাই এসে বলত, আমাগো দ্যাশের বাড়ি আছিলো চট্টগ্রাম৷
‘ব্যাবসায় লোকসান হবে ভেবেই রতনদাদু সাবধান করেছিল৷ তাতেই সেজোদাদু বলেছিল, তুই একটা বেইমান৷ দেশের মাটির প্রতি, ওখানের লোকের প্রতি তোর কোনো টান নেই৷ পিঠে কাঁটাতারের ঘা শুকিয়ে যেতেই সব ভুলে গেছিস৷ রতনদাদু রেগে গিয়ে বলেছিল, ব্যাবসা পৃথক করবে৷ দোকানটা হয়েছিল সেজোদাদুর বাবার জায়গায়৷ তাই দোকানঘরের মালিকানা সেজোদাদুর থেকে যায়৷ রতনদাদু সামনেই নিজেদের জায়গায় আরেকটা দোকান খুলেছিল৷ সেই থেকে শুরু হল শত্রুতা৷ গাঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্কে যখন রাগ এসে প্রবেশ করে তখন বন্ধুত্ব বদলে গিয়ে শত্রু হয়ে যায়৷ সেজোদাদু আর রতনদাদুও আর কোনোদিন কথা বলত না৷ সেজোদাদু তারপরও পুরো বদলে যায়নি৷ কেউ এসে যদি বলত বাংলাদেশ থেকে এসেছি তাহলে তাকে কম দামে ঘড়ি দিয়ে দিত৷ লাভ কম হত৷ কিন্তু এতে আরেক বিপদ হল৷ এ চত্বরে রটে গেল রতনের দোকানে দাম বেশি৷ তাই সব সময় ভিড় থাকত সেজোদাদুর দোকানে৷’
সুজয় হেসে বলত, ‘এই তাহলে এদের ইতিহাস? কিন্তু অরূপদা, তুমিও তো বাংলাদেশের মানুষ শুনলে ডিসকাউন্ট একটু বেশিই দাও৷’
অরূপ হেসে বলত, ‘সে তো সেজোদাদুর কড়া নির্দেশ ছিল৷ তা ছাড়া সেজোদাদুর খদ্দেরদের যারা ছেলে-মেয়ে তারাও এসে বলতে লাগল, বাবার সঙ্গে আসতাম ছোটোবেলায়৷ আমাদের ভিটে কিন্তু বাংলাদেশ৷ কে জানে কেন আমারও মনে হতে শুরু করল, এ দোকানে ওদের জন্য একটু বেশিই ডিসকাউন্ট দেওয়া উচিত৷
‘রতনদাদু অবশ্য দাদু মারা যাবার পরে আমার সঙ্গে কোনো শত্রুতা করেনি৷ বলেছিল, তোর দাদু তোকে নিয়ে খুব চিন্তা করত৷ অনেকের কাছেই বলতে শুনেছি, অরূপের একটা হিল্লে হয়ে গেলে ওপরে গিয়ে শান্তি পাব৷ দেখুক এখন মহেশ ওপর থেকে, তার নাতিকে শেখানোর ব্যাপারে আমি কার্পণ্য করছি না৷ আজীবন তো গোঁয়ারই রয়ে গেল৷ লোকে যে কত ঠকাল সে তো আর বুঝল না৷ সত্যিই রতনদাদু মন দিয়ে আমায় শিখিয়েছিল ঘড়ি মেরামত করতে৷ প্রথম প্রথম তো মনে হত, এ বড়ো কঠিন কাজ৷ ওইটুকু টুকু সার্কিটের মধ্যে আবার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তারের খেলা৷ একেক মডেলের একেক স্টাইল৷ সব ঘেঁটে যেত৷ রতনদাদু বলত, বেশি চিন্তা করবি না, একটা কথা মাথায় রাখবি, ঠিক তারের সঙ্গে ঠিক তার না ঠেকালে তোর ঘড়ি টিক টিক আওয়াজ তুলবে না কিছুতেই৷ তারপর আস্তে আস্তে শিখে গেলাম সবকিছু৷’
সুজয় জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘অরূপদা, তোমার বিয়েও নাকি এক যাত্রাপালা হয়েছিল শুনেছিলাম মার্কেটে৷ সে গল্পটা একটু বলবে?’
অরূপ হেসে বলছিল, ‘তা যা বলেছিস৷ যাত্রাপালার নাম কী ছিল, জানিস? নাম ছিল বিয়ের আসরে খণ্ডযুদ্ধ৷
‘শর্মিলার সঙ্গে আমার দেখাশোনা তখন কমপ্লিট৷ মা আর মামারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, দোকান যখন সামলে নিয়েছে, অরূপের এবারে একটা বিয়ে দেওয়া দরকার৷ মেয়ে দেখতে খুবই সুন্দরী৷ লেখাপড়া-জানা মেয়ে৷ শর্মিলারা দুই বোন, এক ভাই৷ শর্মিলাই ছোটো৷ তো কোষ্ঠীবিচার করে দুই বাড়ি রাজি হল৷ সমস্যা হল আমার মেজোদিদাকে নিয়ে৷ সে নাকি শর্মিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, শুটকি রাঁধতে পারিস? শর্মিলা নাকি নাক সিঁটিয়ে বলেছিল, না, আমি ওসব খাই না৷ আমাদের বাড়িতে গেল গেল রব উঠল৷ কয় কী মাইয়াডা? বাঙালের মাইয়া শুঁটকি শুইনা মুখ বেঁকায়! এর সঙ্গে বিয়া দেওয়া চলব না— বলে বসল মেজোদিদা৷ খাঁটি বাঙালের পরিবার আমাদের৷
‘আসলে শর্মিলারা বাঙাল ঠিকই কিন্তু ওর দাদুর বাবা এ দেশে এসেছিল৷ তাই ওদের মধ্যে এ দেশীয় ভাব বেশি৷ শর্মিলার বাবার জন্মকর্ম সবই এখানে৷
‘বিকেলে দোকানে বসে আছি চুপচাপ৷ বিয়ে একপ্রকার ভেঙেই গেছে৷ মেয়েটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল৷ তাই একটু মনমরা হয়েই বসে আছি৷ খদ্দের আসছে, ছাড়ছি টুকটাক৷ এমন সময় শর্মিলা এসে বলল, একটা এইচ. এম. টি. ঘড়ি দিন তো৷ আমি ওকে দেখে অবাক৷ এখন থেকে বাসে ওর বাড়ি প্রায় আধ ঘণ্টা৷ ওদের কৃষ্ণনগরে বড়োবাজার থাকতে নবদ্বীপে এসেছে ঘড়ি কিনতে? আমি ঘড়িগুলো পর পর সাজিয়ে দিতেই বলল, উহুঁ, ইন্ডিয়ার ঘড়ি নয়, মেড ইন বাংলাদেশ সেই ঘড়ি দিন৷ আমি হকচকিয়ে বললাম, ওখানের ঘড়ি তো নেই৷ ও বলল, সে কি বাঙালের পোলা হয়ে বাংলাদেশি ঘড়ি রাখেননি? এ তো ভারী অন্যায়৷ ভাগ্যিস আজ এলাম দোকানে৷ আপনি তো দেখছি, ভারতীয় কোম্পানির ঘড়িতে দোকান সাজিয়েছেন৷ আপনাকে তো বিয়ে করা যায় না৷ আর না দাঁড়িয়ে চলে গিয়েছিল যেমন ঝড়ের মতো এসেছিল তেমন৷
‘আমি বাড়ি ফিরে মা-কে বলেছিলাম, বিয়ে করলে শর্মিলাকেই করব, না হলে নয়৷’
সুজয় অবাক চোখে বলেছিল, ‘বলো কী? সাহস তো তোমার কম ছিল না?’
অরূপ নিজের কথার সূত্র ধরেই বলত, ‘মা শুধু বলেছিল, ঝড় উঠবে আবার৷ মেজোদিদা অপমানিত হবে৷ আমি বলেছিলাম, তাহলে আর আমার বিয়ের যোগাযোগ করবে না এ দেশে৷ কী করে যেন মা সবাইকে রাজি করিয়েছিল৷ শর্মিলাকে বিয়ে করে নিয়ে এলাম৷ খুব গুণের মেয়ে ছিল৷ হাতের সেলাই থেকে রান্না সব গর্ব করে বলার মতো৷ এসেই আবদার করল, আমি টিউশনি পড়াব৷ তখনও এত উন্নত হয়নি সমাজ৷ বউমানুষ টিউশনি পড়াবে বিষয়টা কে কীভাবে নেবে, বুঝতে পারছিলাম না৷ আমার মা বলল, নিশ্চয়ই করবে৷ অরুর বাবা মারা যাবার পর পথে পথে ভিক্ষা করতে হয়নি, কারণ আমি সেলাই শিখেছিলাম৷ তুমি লেখাপড়া-জানা মেয়ে, বাড়িতে বসে কেন থাকবে?
‘শাশুড়ি আর বউমার মধ্যে কখনো খুঁটিনাটি ঝগড়া হতে দেখিনি আমি৷ বরং শর্মিলা ছিল মায়ের মেয়ে৷ আমি কিছু দোষ করলে বকা খেতাম কিন্তু মা শর্মিলার কোনো দোষ দেখতে পেত না৷ মা যেদিন মারা গেল সেদিন শর্মিলা বলছিল, আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, অরূপ৷ মাতৃহারা হলাম আমি৷
‘তৃষা তখন এক বছরের৷ তৃষার মুখটা যত বড়ো হচ্ছিল ততই শর্মিলার মতো হচ্ছিল৷ লোকে বলে পিতৃমুখী মেয়ে সুখী৷ কিন্তু তৃষা আমার মতো দেখতে হয়নি৷ সুখী হয়েছে কি না সেটা শুধু সেই জানে৷
‘শর্মিলা বলত, আমি মনেপ্রাণে ভারতীয়৷ এ দেশ আমার জন্মভূমি৷ মোহনবাগানের সাপোর্টার ছিল শর্মিলা৷ আমি বলতাম, তুমি বাঙালদের কলঙ্ক৷ হেসে বলত, বাঙালদের ঐতিহ্য তো তুমি একাই রক্ষা করে চলেছ৷ আর কাউকে দরকার কী? আমি বলতাম, শর্মিলা, তোমার ইচ্ছে করে না বাংলাদেশ দেখতে?
‘ও ঘাড় নেড়ে বলত, না তো৷ আমার কোনো এক পূর্বপুরুষ ও দেশ থেকে চলে এসেছিল৷ আমি ও দেশের জানিটা কী? চোখ মেলে থেকে তো এখানেই আছি৷
‘এই একটা জায়গায় আমি আর শর্মিলা ছিলাম আলাদা৷ আমি বাংলাদেশ অন্ত প্রাণ, এ বাঙাল হয়েও এ দেশীয়৷ তৃষাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল শর্মিলার৷ মেয়েকে এমন মানুষ করবে যেন দশজন চেনে একডাকে৷ সেসব আর হল কই? তৃষা যখন দশ বছরের তখনই তো আচমকা ডেঙ্গি হল শর্মিলার৷ আমাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই চলে গেল৷ বলেছিল, মরার পর একবার তোমার বাংলাদেশ দেখে আসব অরূপ৷ কেমন ছিল তোমার পদ্মার ধার, কেমন ছিল তোমার চট্টগ্রাম৷ কে জানে, শর্মিলা আদৌ মরণের পর আমাদের ও দেশে গিয়েছিল কি না৷’
সুজয় বলল, ‘শোনো অরূপদা, আমি তোমায় এরকম মন খারাপ করে থাকতে দেব না৷ তুমি চলো, সেই আগের মতো আমরা যাত্রা-নাটক দেখে আসি৷ মনটা ভালো লাগবে৷ আরেকদিন চলো, শ্রীকণ্ঠধামে গিয়ে ঘুরে আসি৷ মনটা ভালো লাগবে৷ আগে কত গল্প করতে তুমি, সেসব মনে পড়ে গো৷ এমন চুপ করে থাকলে চলে?’
অরূপ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বেশ, সে যাব৷ এখন কাজে বসি৷ গোটা দশেক ঘড়ি জমেছে, সবগুলোর কাঁটা স্ট্রাইক ডেকেছে৷ ওদের সচল করতে হবে৷’
সুজয় নিজের কাজে গেল৷ অরূপ ঘড়ির কাঁটাগুলোকে চালানোর ব্যবস্থায় লেগে গেল৷
যাত্রা দেখা এই একটাই তো শখ ছিল অরূপের৷ শর্মিলা বলত, ‘কী যে দেখো ওসব রং মেখে ঠাকুর সাজা৷’ অরূপ বলত, ‘মানুষের মধ্যেই তো ঠাকুরের বাস৷’ শর্মিলা চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে তৃষাকে বড়ো করে তুলেছিল অরূপ৷ সবাই বলেছিল আরেকটা বিয়ে করতে৷ অরূপ বলত, শর্মিলা সারাজীবন থাকবে তার সংসার আগলে কোনো চিন্তা নেই৷ তৃষাকে একটু বেশিই আদর দিয়ে ফেলতো অরূপ৷ আসলে মা আর বাবা দুজনের আদর দিতে গিয়েই বেশি হয়ে যেত৷ মেয়েটাও হয়েছিল বড়ো অভিমানী৷ কথায় কথায় ঠোঁট ফোলাত৷
আসলে আজ সকাল থেকেই অরূপের মনটা খারাপ৷ পুরোনো কথারা ভিড় করে আসছে চোখের সামনে৷ মেয়েটার আজ জন্মদিন৷ এই নিয়ে ছ-টা জন্মদিনে মেয়েটাকে চোখের দেখাই দেখতে পেল না অরূপ৷ বিয়ের পর মেয়েরা দূরে থাকে ঠিকই, কিন্তু এমন পর হয়ে যায় সেটা জানত না অরূপ৷ আজ বার বার মেয়েটার ফেলে-যাওয়া দিনগুলো মনে পড়ছে অরূপের৷ গলাটা যেন কানের কাছে ভাসছে৷
‘তুই আবার আমার দোকান থেকে ঘড়ি চুরি করেছিস, তৃষা?’
তৃষা টপের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘এটাকে চুরি বলে না, বাবা৷ নিজেদের জিনিস তাই পরেছি৷ কলেজ থেকে ফিরেও এসেই আবার দোকানে রেখে আসব৷’
অরূপ রাগী গলায় বলল, ‘তুই বোঝস না ক্যান? এগুলা আমাগো নয়৷’
তৃষা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমাকে বলেছি না বাঙাল ভাষায় কথা বলবে না৷ দোকানে যেভাবে কথা বলো, বাড়িতেও বলবে৷ বললাম তো, আজ একটা রেড ড্রেস পরেছি তাই ওর সঙ্গে ম্যাচিং করে রেড ঘড়িটা পরেছি৷ বিকেলে দোকানে পেয়ে যাবে৷’
অরূপ আবারও বোঝানোর ঢঙে বলল, ‘ওরে মা, তুই বুঝিস না কেন, এগুলো দোকানের মাল৷ কাস্টমারকে বিক্রি করে মহাজনকে দাম দিতে হবে৷ লাভটুকু আমার৷ তুই পরার পরে যদি সে ঘড়ি আমি বেচতে না পারি তাহলে কত লোকসান বল তো?
তৃষা দুষ্টু হেসে বলত, ‘উফ বাবা, তুমি কেমন যেন বুড়ো হয়ে যাচ্ছ৷ আরে এ চত্বরে তোমার মতো কালেকশন আর পাবে নাকি কেউ? ওই তো সামনেই চন্দ্রা ওয়াচের অবস্থা দেখো, সারাদিন মাছি তাড়াচ্ছে৷ তাই চিন্তা কোরো না, কলেজ থেকে ফিরেই ঘড়ি চলে যাবে তোমার দোকানের ডিসপ্লেতে৷’
অরূপ জানে এ মেয়ে বড়ো গোঁয়ার৷ কথা শোনার পাত্রী নয়৷ তাই বাধ্য হয়েই ঘড়ির বক্সটা যত্ন করে রেখে দিত৷ দামি ড্রেস, দামি পোশাক, ম্যাচিং জুতো৷ তৃষা যেন কোনো ধনীর মেয়ে৷ এমনভাবেই সাধ্যের বাইরে গিয়ে বড়ো করেছিল অরূপ তৃষাকে৷ শর্মিলা চলে যাবার পরে তৃষার আর অরূপের দুটো পাসপোর্ট বানিয়েছিল অরূপ৷ মনের মধ্যে কোথাও একটা ইচ্ছে ছিল, বাংলাদেশে যাবে৷ একবার গিয়ে নিজের স্কুলটা, বাড়িটা দেখে আসবে৷ দেখে আসবে, ওর স্কুলের সহপাঠীরা এখন কী করছে৷ আত্মীয় তো নেহাত কম নেই, কারো বাড়িতে যদি থাকার জায়গা না জোটে তাহলে না হয় হোটেলে থাকবে৷ তবুও তৃষাকে একবার দেখাবে ওর বাপের জন্মভিটেটা৷ তৃষা মাঝে মাঝেই বলত, ‘বাবা, তোমাদের ওখানে আম গাছের বাগান ছিল? জমিদারি ছিল?’
অরূপ ঘাড় নেড়ে বলত, ‘আমরা এখানে যেমন আছি তার থেকেও গরিব ছিলাম ওখানে, জানিস৷’
তৃষা অবাক হয়ে বলত, ‘তাহলে ছেড়ে আসার জন্য এখনও দুঃখ করো কেন?’
অরূপ মেয়ের লম্বা চুলে বিলি কেটে বলেছিল, তোর একটা নীল রঙের ফ্রক ছিল, মনে আছে? তোর মা রাধাবাজারের একটা দোকান থেকে কিনে দিয়েছিল৷ জামাটা ছিঁড়ে যেতে তুই খুব কেঁদেছিলিস৷’
তৃষা বলেছিল, ‘আমার এখনও মন খারাপ করে ওই জামাটার জন্য৷’
অরূপ বলেছিল, ‘কেন, তোর কাছে তো ওর থেকে অনেক দামি জামা আছে এখন, তাহলে মন খারাপ করে কেন?’
তৃষা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘এবারে বুঝেছি৷ একটা মায়া, টান তা-ই তো?’ তৃষা জানত বাবার জীবনে একটাই শখ একবার অন্তত জন্মস্থানে যাওয়া৷ তৃষাদের কলেজে রীতা নামের একটা মেয়ে ভরতি হয়েছিল, মেয়েটার বাড়ি নাকি বাংলাদেশে৷ এখানে পিসির বাড়িতে থেকে পড়ে৷ তৃষা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কেন রে, তোদের বাংলাদেশে কলেজ নেই৷’
মেয়েটা বলেছিল, ‘আছে তো৷ কিন্তু দুটো ছেলে স্কুল থেকে আমার পিছনে লাগত৷ তার মধ্যে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল৷ সেটা আমার বাবা জানতে পেরে এ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ বলেছে, মুসলমানদের বাড়িতে আমার বিয়ে দেবে না৷ জানিস তৃষা, জাহাঙ্গির খুব ভালো ছেলে৷ আমায় খুব ভালোবাসত৷ কিন্তু বাবা বলে, মেয়েকে কেটে পদ্মায় ভাসিয়ে দেব, তবুও ওই ধর্মে পাঠাব না৷’ তৃষা আবার এসব জাতপাতের বিষয়টা ভালো বোঝে না৷ সুন্দরী বলে ওর পিছনেও কম ছেলে লাইন দেয়নি, কিন্তু ওর নিজের কাউকে পছন্দ হয়নি৷ সিনেমার হিরোদের মতো কাউকে দেখতে নয়৷
একবারই তৃষা যাত্রা দেখতে গিয়েছিল বাবার সঙ্গে৷ বাবা তো যাত্রা হচ্ছে শুনলেই সুজয়কাকুকে বগলদাবা করে ছুটত৷ তৃষা সিনেমার পোকা হলেও ওসব যাত্রা, নাটক ভালো লাগবে না বুঝেই যায়নি৷ হঠাৎই একবার ইচ্ছে হয়েছিল, যাত্রা কেমন হয়, দেখবে৷ নবদ্বীপের কাছেই কালীনগরে যাত্রাপালা এল শীতকালে৷ তৃষা বলেছিল, ‘বাবা, আমিও যাব৷’ ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ’ ছিল যাত্রাপালটার নাম৷ তৃষা দশ মিনিটেই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল৷ ভরা রাজসভায় দ্রৌপদীর কাপড় খোলার দৃশ্য দেখবে বলে তখন দর্শকদের সে কী উত্তেজনা৷ তৃষা অবাক হয়ে ভেবেছিল, শুধু মঞ্চের রাজসভার লোকজন নয়, দর্শকরাও বসে আছে সে দৃশ্য দেখবে বলে৷ মেয়েদের শরীরের এত দাম? আর মেয়েদের সম্মানের এতটুকু মূল্যও নেই লোকজনের কাছে৷ কেন যে ও আসতে গেল বাবার সঙ্গে! ঠিক তখনই কৃষ্ণর প্রবেশ ঘটেছিল৷ অপরূপ সুন্দর দেখতে একটা ছেলে সুন্দর উচচারণে সংস্কৃত বলে চলেছিল৷ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল তৃষা৷ এ যাত্রায় এই একজনকেই ওর ভালো লেগেছিল৷ ঠিক যেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ৷ বাবা হাত জোড় করে প্রণাম করে বলেছিল, ‘বাঁচাও ঠাকুর, দ্রৌপদীকে বাঁচাও৷’ বাবার দু-চোখে জল৷ হাসি পেয়েছিল তৃষার৷ বাবা এত ইমোশনাল কেন হল কে জানে৷ তবে তৃষা একনজরেই কৃষ্ণর প্রেমে পড়েছিল৷ সুপুরুষ যাকে বলে৷ তেমনি তুখোড় অভিনয়৷ তৃষা হাঁ করে দেখছিল কৃষ্ণকে৷ বাবার কানে কানে বলেছিল, ‘চলো-না একবার গ্রিনরুমে গিয়ে কৃষ্ণকে দেখে আসি৷’ বাবা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ‘না যদি বিরক্ত হন৷’ তারপর তৃষাও প্রায়ই যেতে শুরু করল বাবার সঙ্গী হয়ে যাত্রা দেখতে৷ ‘শেষ বিকেলের ফুল’ যাত্রাতে ওই ছেলেটা একজন সৎ ডাক্তার সেজেছিল৷ ডাক্তারের পোশাকে দুর্দান্ত লাগছিল ছেলেটাকে৷ সেদিন তৃষা বাবার পারমিশন না নিয়েই ছুটেছিল গ্রিনরুমের দিকে৷ যাত্রা শেষ হতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা৷ তৃষা সামনে গিয়ে ভয়ে ভয়েই বলেছিল, ‘আপনার অভিনয় আমার খুব ভালো লেগেছে৷ শুধু আপনার জন্যই আমি এসেছিলাম যাত্রা দেখতে৷’ ছেলেটা আন্তরিকভাবে বলেছিল, ‘আমার নাম রুদ্র৷ রুদ্র গড়াই৷ এই আমার ফোন নম্বর, ইচ্ছে হলে কল করতে পারো৷’ তৃষা তখন আবেগে আনন্দে ভাসছিল৷ পরের যাত্রায় রুদ্র সেজেছিল রাম৷ কে জানে কেন মঞ্চের সীতাকে দেখে রীতিমতো হিংসা হচ্ছিল তৃষার৷ কলেজে এত ছেলে ওকে প্রোপোজ করে, কাউকে দেখে কখনো ওর এরকম অনুভূতি হয়নি৷ রুদ্রর বয়েস বছর পঁচিশ, এই বয়সেই কী সুন্দর অভিনয় করে ছেলেটা৷ আর তৃষার এই অপরিচিত অনুভূতির ঠিক কী নাম সেটাও জানে না ও৷
এই আশ্রমে আসার পর মৃন্ময়ী ভেবেছিল এটা ঈশ্বরের স্থান, এখানে অন্তত হিংসা, ঝগড়া এসব থাকবে না৷ কিন্তু আজ সন্ধ্যারতির জন্য আরতি মঞ্চে যাবার আগে কেমন একটা গা-ছমছমে অনুভূতি হল৷ মহাদেবের চরণে নিজেকে নিবেদন করার পর এমন ভয়ের অনুভূতি কখনো হয়নি মৃন্ময়ীর৷ শ্রীকণ্ঠধামে বড়ো শান্তির বাতাস বইত এতদিন৷ এই প্রথম সে বাতাসটা বেশ ভারী লাগল মৃন্ময়ীর৷ কেউ কেউ যেন চাইছে, মৃন্ময়ী এখানে না থাকুক৷ অঘোরজির স্নেহই হয়তো দায়ী৷ বিপ্রদাস থেকে মধুবন কেমন যেন বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ওর দিকে৷ আরতি মঞ্চ থেকে ফেরার পথে তিনজনের ফিসফিস শুনতে পেয়েছে মৃন্ময়ী৷ মানুষগুলোকে অন্ধকারে না দেখতে পেলেও গলাগুলো শুনে ও চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে, ওই গুলঞ্চ গাছের ঝোপের আড়ালে কারা ছিল! বিপ্রদাস বেশ উত্তেজিত হয়েই বলছিল, ‘বেশি বাড়লে মৃন্ময়ী মায়ের আসল রূপটা না হয় ভক্তদের সামনে তুলে ধরব৷ তখন স্বয়ং অঘোরজিও বাঁচাতে পারবে না তার আদরের মানসকন্যাকে৷ অঘোরজির পর এ আশ্রমের দায়িত্ব শুধু আমার৷ এতদিন অনেক ঝড়ঝাপটা সামলেছি৷ আজ দু-দিনের মেহমান এসে শ্রীকণ্ঠধামে ছড়ি ঘোরাবে সেটা তো হতে পারে না৷’
মধুবন বলল, ‘মৃন্ময়ী মায়ের আবার অতীত আছে নাকি বিপ্রদা? কই বলোনি তো কোনোদিন?’
বিপ্রদাস হেসে বলল, ‘গুরুদেব বলেছেন, সবকিছুর সঠিক সময় আছে, সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত৷ যদি সাপ আমায় দংশন করতে না আসে তাহলে আমিও লাঠি নিয়ে তাকে আঘাত করব না৷ এটাই আমার নীতি৷ তবে যদি সাপ ফোঁস করে, আমি সেদিনই তার বিষদন্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই৷’
কথাগুলো শোনার পর থেকেই কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিল৷ নিজের ঘরে বসে আছে মৃন্ময়ী৷ বাইরেটা এখন নিস্তব্ধ৷ ভক্তরা আরতির পরেই ফিরে যায়৷ সন্ধ্যারতির পর অঘোরজি নিজের ঘরে বসে বই পড়েন৷ আবার রাতের খাবার আগে ঘণ্টা বাজে৷ এই সময়টুকু মৃন্ময়ীর একান্ত নিজের৷ এই সময় ওর ভাবনার পাখনায় কোনো লাগাম পরায় না৷ এখন ও মৃন্ময়ী মা নয়, শুধু মৃন্ময়ী৷ অন্যদিন একটু গান শোনে ও৷ কিন্তু আজ মনটা বড্ড বিষণ্ণ হয়ে আছে৷ মৃন্ময়ী বুঝতেই পারেনি আশ্রমের ভিতরের বাতাস এতটা বিষাক্ত হয়ে গেছে৷ ওকে কেন্দ্র করে এতটা হিংসা কবে ডানা মেলল সেটাই তো বুঝতে পারছে না৷ অঘোরজিকে বলাও যাবে না৷ বললেই উনি বিপ্রদাস আর মধুবনকে ডেকে বকাবকি করবেন৷ সেই অপমান বিপ্রদাসের এতটাই লাগবে যে সে মৃন্ময়ীর ক্ষতি করে দেবে৷ তাই চুপ থাকা ছাড়া উপায় নেই৷
আনমনে বসে কত কী ভাবছিল তার ঠিকঠিকানা নেই৷ হঠাৎই নিরুপমাদেবীর বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ আমি এখন সরতে চাইছি, কারণ সংসার এতদিনে আমার গুরুত্ব বুঝেছে৷ এতদিন বুঝতই না, তাই সরে এলেও ওদের মনে তেমন কোনো আলোড়ন হত না৷ আসলে গুরুত্ব না থাকলে হারানোর ভয়ই থাকে না৷ আর হারানোর ভয় না থাকলে হারিয়েই বা লাভ কী? কী আশ্চর্য! ভদ্রমহিলা গোটা জীবন যে মানুষগুলোর মন পাওয়ার চেষ্টা করে গেলেন সেই মানুষগুলোই যখন ওঁকে যোগ্য সম্মান দিতে চাইছে তখন উনি সেই সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে বলছেন, আর চাই না৷ বড়ো মূল্যহীন আজ ওঁর কাছে এসব৷ তবে কি ভালোবাসা না পেতে পেতে ওটাই অভ্যাস হয়ে যায়? তারপর আর পেলেও সেটাকে অত্যাচার মনে হয় হয়তো৷ তাই এই বয়সে নিশ্চিন্ত গৃহকোণ ছেড়ে নিরুপমাদেবী অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াচ্ছেন৷
মৃন্ময়ী নিজের বাঁধা চুলটা আলগা করে একমনে তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে৷ জমাট অন্ধকার হয়ে আছে৷ এত গাছগাছালি এদিকটায় যে আলোর ক্ষমতা নেই এই অন্ধকার দূর করে৷ এ যেন গাছেদের নিজেদের রাজত্ব৷ ইচ্ছে হলে আলোর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেবে৷ মানুষের মনেও কি এমনই চাপ চাপ অন্ধকার জমে থাকে বিশেষ বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে? তখন একমাত্র মনই নির্ধারণ করে, তার ঘরে কার প্রবেশ হবে আর কার জন্য বন্ধ হবে দরজা৷
মৃন্ময়ীর মনেও আজ থেকে বিপ্রদাস আর মধুবনের জন্য দরজা বন্ধ হল৷ এ দরজা বোধহয় আর খুলবে না৷ আজ নিজের কানে ওদের বিদ্বেষের কথা শোনার পর থেকেই মনে হচ্ছে, এই যে নিরুপমাদেবী মৃন্ময়ী মায়ের ভরসায় নিজের সংসার, বাড়ি ছেড়ে চলে আসছেন এখানে, ওঁকে রক্ষা করতে পারবে তো ও৷ অঘোরনাথজির অবর্তমানে ওর নিজেরই ঠিক কী পরিস্থিতি হবে, ও জানে না, তারপর আর কারো দায়িত্ব নেওয়া কি আদৌ ঠিক হবে? ভাবনার মধ্যে কখন তলিয়ে গেছে খেয়াল নেই মৃন্ময়ীর৷ আর ভাবনার নিজস্ব স্বভাবই এলোমেলো পথে তলহীনভাবে মনকে চালনা করা৷ তাই এই মুহূর্তে মৃন্ময়ী ভাবছে, উত্তরের বারান্দায় যে লজ্জাবতী গাছটা বসিয়েছিল, এ আশ্রমে ও না থাকলে কেউ কি ওটাতে জল দেবে? নাকি আগাছা বলে অযত্নে মরেই যাবে? লজ্জাবতী গাছের প্রতি ওর ছোটো থেকেই একটা বিস্ময় কাজ করত৷ ঠিক যেন ফুলশয্যার ঘরের নতুন বউ৷ স্বামীর হাতের স্পর্শে লজ্জা অবনত৷ লজ্জাবতী পাতার প্রতি অমোঘ বিস্ময় থেকেই আশ্রমের উত্তরের বারান্দায় ও একটা লজ্জাবতী গাছ বসিয়েছে৷ হাজার কাজের মধ্যেও ওদের একবার জ্বালাতে ও ছাড়ে না৷ ঠিক সময়মতো ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে লজ্জা পাইয়ে দিয়ে আসে৷
দরজায় ঠক ঠক করে আওয়াজ হল৷ চমকে উঠল মৃন্ময়ী৷ আনমনে থাকলেও আওয়াজটা যে ওরই দরজায় হচ্ছে সেটা বুঝতে দেরি হয়নি ওর৷ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলতেই নয়নতারা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘অঘোরনাথজি কেমন একটা যেন করছেন৷ তাড়াতাড়ি চলো৷’
মৃন্ময়ী ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে দেখল, নিজের কাঠের চেয়ারে বসে আছেন অঘোরজি কিন্তু বড্ড উতলা লাগছে তাঁকে৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম৷ বেশ অস্থির দেখাচ্ছে৷ মৃন্ময়ী গিয়ে পায়ের কাছে বসে বলল, ‘কী হয়েছে, বাবা? এমন অস্থির কেন লাগছে আপনাকে? শরীর খারাপ লাগছে কি? ডাক্তার চক্রবর্তীকে একটা খবর পাঠাবো কি?’
অঘোরনাথজি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না, ডাক্তারকে খবর দিতে হবে না মা৷ তুই আশ্রমের সকলকে তুলসী মঞ্চের সামনে আসতে বল৷ আমি কয়েকটা কথা বলব সকলকে৷’
মৃন্ময়ী মৃদু প্রতিবাদ করে বলল, ‘কিন্তু বাবা, আপনার এখন বিশ্রাম দরকার৷ এখন সকলকে ডেকে কী করতে চাইছেন? আমি আপনার কাজের কৈফিয়ত চাইছি না, শুধু বলছি, কাল সকালে করলে হয় না?’
অঘোরনাথ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘দেরি হয়ে যাবে, মা৷ এখনই কাজটা সমাপ্ত করতে হবে৷ মোহনকে খবর দাও, বলো সবাইকে ডাকতে৷’
শ্রীকণ্ঠ আশ্রমের ভক্তসংখ্যা নেহাত কম নয়৷ দেখতে দেখতে প্রায় দেড়শোজন স্থায়ী বাসিন্দা৷ অঘোরজির কড়া নির্দেশ ছিল, ‘শ্রীকণ্ঠধামে আসার আগের জীবন সম্পর্কে কেউই কিছু জানতে চাইবে না একে অপরের কাছে৷ এ আশ্রমের সকলের একটাই পরিচয় মহাদেবের ভক্ত৷ অতীতে কে কীভাবে কাটিয়েছে সেটা আলোচ্য নয়৷ বর্তমানে কে কতটা সৎভাবে জীবন অতিবাহিত করছ সেটাই বড়ো কথা৷’ সকলে এসে জড়ো হয়েছে তুলসী মঞ্চের পাশের বিশাল বাঁধানো চাতালে৷
অঘোরনাথ যেন ধ্যানে বসেছেন, এমনভাবেই স্থির হয়ে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে৷ আশ্রমের সমস্ত বাসিন্দার মুখেই কৌতূহল উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে৷ মাসিক যে মিটিং হয়, যেখানে সবাই উপস্থিত হয় সেটা সাধারণত সোমবার বিকেলে হয়৷ রাত সাড়ে আটটা নাগাদ এভাবে চটজলদি ডেকে পাঠানোর কারণটা সকলের কাছেই অজানা৷ কিন্তু শ্রীকণ্ঠধামের সমস্ত আশ্রমবাসী অঘোরজিকে বিশ্বাস করেন৷ তাই তাঁর ডাকে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না৷
অঘোরনাথ বললেন, ‘হয়তো সকলের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, কেন আমি সকলকে এভাবে তলব করলাম? আসলে তলব আমি করিনি, করেছেন স্বয়ং শ্রীকণ্ঠ৷ আমি তো দূত মাত্র৷ তাঁর দেওয়া বার্তা তোদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার কাজ৷ ভণিতা না করে শুরু করি৷
‘আজ সন্ধ্যারতির পর থেকে স্বয়ং মহাদেব আমায় জানিয়ে দিলেন, আমার বয়েস বাড়ছে৷ এতদিন পর্যন্ত শরীর আর মন দুটোকেই অবাধ্য হতে দিইনি৷ কড়া শাসনে রেখেছিলাম৷ তারাও বাধ্য সন্তানের মতো আমার কথা শুনত৷ কিন্তু আজ আরতির আসর থেকে ফেরার পর হৃৎপিণ্ডের অযথা মাতামাতি লক্ষ করলাম শরীরে৷ শ্বাসপ্রশ্বাসে একটু যেন বাধা সৃষ্টি হচ্ছে৷ শ্রীকণ্ঠ বুঝিয়ে দিলেন, মন আমার বশে থাকলেও শরীর আর থাকবে না৷ তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামীকাল থেকে এ আশ্রমের সমস্ত ভার তোদের প্রিয় মৃন্ময়ী মায়ের৷ আমার অবর্তমানে তো বটেই, আমার জীবিতকালেও তার হাতে আশ্রমকে দিয়ে যেতে চাই৷’
মৃন্ময়ী হকচকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এ কী বলছেন অঘোরজি? বিপ্রদাস, সুধাময়, সাবিত্রী, কনকলতা এরা সকলে বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় মৃন্ময়ীর থেকে অনেক বড়ো৷ এদের বাদ দিয়ে উনি কেন এত বড়ো দায়িত্বটা মৃন্ময়ীকে দিচ্ছেন সেটাই বুঝতে পারছে না ও৷ মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়েছে ভক্তবৃন্দের মধ্যে৷ অঘোরজি সময় দিলেন সকলকে প্রথম চমকটা সামলাতে৷ তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘আশ্রম পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার দ্বারা আমি বুঝেছি, অপরিচিত যে সমস্ত দর্শনার্থী এ আশ্রমে আসেন তাঁরা তাঁদের দুঃখ লাঘব করার জন্য বার বার বেছে নিয়েছেন মৃন্ময়ীকে৷ মৃন্ময়ী তাই এত কম বয়েসেই সকলের মা হয়ে উঠতে পেরেছে৷ ভক্তরা যার কাছে নিজেদের উজাড় করতে পারে৷ মৃন্ময়ীই পারবে আমার অবর্তমানে এ আশ্রমকে একই সুতোয় বেঁধে রাখতে৷ আগামীকাল থেকে আমি নিজেও মৃন্ময়ী মায়ের নির্দেশেই কাজ করব৷ তোরা সকলকেই তার নির্দেশে চলবি৷’
মৃন্ময়ী আচমকাই অঘোরনাথজির পায়ের কাছে বসে মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে বলল, ‘আপনি এমন অবিচার করবেন না, বাবা৷ আমি আপনার আশ্রয়ে থাকতে চাই, আমায় এত বড়ো দায়িত্ব থেকে রেহাই দিন বাবা৷ আমি পারব না৷ আমি আপনার আদেশ পালন করতে পারি ঠিকই কিন্তু আদেশ দিতে পারব না৷’
অঘোরজি মৃন্ময়ীর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘সব পারবি৷ আমি শিখিয়ে দেব৷’
বিপ্রদাস হঠাৎই বেশ বিরক্তির গলায় বলে উঠল, ‘কিন্তু বাবা, মৃন্ময়ী সেদিনের বাচচা মেয়ে, ও কেমন করে জানবে, আমরা এই আশ্রমের জন্য কত লড়াই করেছি?’
অঘোরনাথ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘স্বাধীন ভারতে তো আমরাও আছি, বিপ্রদাস৷ আমরা কি স্বাধীনতা সংগ্রামী বা বিপ্লবী ছিলাম? আশ্রম গড়ার সময়ের লড়াই জেনে মৃন্ময়ী করবেই বা কী? ও বরং এই আশ্রমকে কীভাবে আরও বড়ো করবে সে বিষয়ে জানুক৷ আমি আশা করব তোরা সবাই মৃন্ময়ীকে শিখিয়ে দিবি, সাহায্য করবি৷’
বিপ্রদাস কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অঘোরজি বললেন, ‘আশা করি, আমার সিদ্ধান্তে তোদের সকলের মত আছে৷’
সবাই বেশ জোর গলায় বলল, ‘আছে বাবা৷ আজ থেকে মৃন্ময়ী মায়ের নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম৷’
মৃন্ময়ী বেশ বুঝতে পারছে, অঘোরজির সামনে কেউ মুখ খুলতে না পারলেও ভিতরে ভিতরে একটা চাপা অসন্তাোষ তৈরি হল আশ্রমের বাতাসে৷ বেশ কয়েকজন মানুষ যে মৃন্ময়ীকে মেনে নেবে না সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে৷ শুধু যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হল, অঘোরনাথ হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন৷ ময়ূরাক্ষীকে একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে৷ খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে৷ আশ্রমের সব খবর ওর নখদর্পণে৷ এ আশ্রমে মৃন্ময়ীর প্রাণের সখী হল, ময়ূরাক্ষী৷ মেয়েটা যেমন সুন্দরী তেমনি গুণী৷ কী সুন্দর গানের গলা৷ কী সুন্দর অভিনয় করে মেয়েটা৷ আশ্রমে যখন নাটকে হয়েছিল তখন মা সারদার অভিনয় করে চমকে দিয়েছিল সবাইকে৷ ওই গান, অভিনয় এসব নিয়েই বিবাদের শুরু শ্বশুরবাড়িতে৷ প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল ময়ূরাক্ষীর৷ দুই বাড়ির মত নিয়ে৷ কিন্তু তারপর শুরু হয়েছিল সমস্যা৷ ময়ূরাক্ষীকে গান গাইতে দেবে না, বাপের বাড়ি যেতে দেবে না৷ এরকম নানা বাধানিষেধ দিয়ে দিয়ে মেয়েটার জীবনটা নরক করে তুলেছিল৷ কিন্তু কীভাবে শ্রীকণ্ঠধামে এসে পৌঁছেছিল সেটুকু খুব সন্তর্পণে আড়াল করে যায় ময়ূরাক্ষী৷ মৃন্ময়ীও জিজ্ঞাসা করেনি, আর নতুন করে রক্তক্ষরণ চায়নি সখীর৷ যেটুকু স্বেচ্ছায় বলেছে সেটুকুই শুনেছে৷ একবার ময়ূরাক্ষী বলেছিল, ‘ওই বাপের সঙ্গে আমি জীবনেও সম্পর্ক রাখব না৷ যখন শ্বশুরবাড়িতে মার খেয়ে বাপের দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম, তখন বাবা বলেছিল, ওটাই তোমার ঘর, মানিয়ে নাও৷ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে না দিলে করবে না, কিন্তু নিজের সংসারটা নষ্ট কোরো না৷ একবারও জানতে চায়নি আমি কেমন আছি৷’
নীরবে শুনেছে মৃন্ময়ী৷ ময়ূরাক্ষীর সিদ্ধান্তকে সম্মান করেই বলেছে, ‘আরেকবার ভেবে দেখিস৷ ভুল করেছিস মনে হয় না তো?’
জীবনে অনেক সিদ্ধান্ত ভুল নিয়েছে অরূপ৷ তার মধ্যে একটা বড়ো ভুল হল রুদ্রর সঙ্গে মেয়ের বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়া৷ আসলে মঞ্চের কৃষ্ণ বা রামবেশধারী মানুষটার সঙ্গে রুদ্রর যে এতটা তফাত সেটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি অরূপ৷ যখন বুঝতে পারল তখন বিয়েটা আটকাতে চেয়েছিল, কিন্তু তখন তৃষা আর রুদ্রর মেলামেশা এ চত্বরের সবাই জেনে গেছে৷ ওদের বিয়ে হবে এটা জানতে আর নবদ্বীপ শহরের কারো জানতে বাদ ছিল না৷ রুদ্র যেদিন প্রথম অরূপদের বাড়িতে এসেছিল সেদিন আনন্দে পাগল-পাগল অবস্থা অরূপের৷ সাধারণত কলেজ থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে তৃষা৷ অরূপের দোকান হয়ে বাড়ি যায়৷ পোশাকের সঙ্গে ম্যাচিং করে নিত্যনতুন ঘড়ি পরাটা তখন ওর নেশায় পরিণত হয়েছিল৷ কলেজে সবাইকে দেখিয়ে এসে অরূপের হাতে দিয়ে বলত, ‘এই নাও এবারে বেচে দিয়ো৷’ অরূপ হাজার বারণ করলেও শুনত না মেয়েটা৷ অরূপও বেশি ধমক দিতে পারত না, মা-মরা মেয়ের চোখে জল দেখতে চাইত না বলেই হয়তো প্রশ্রয় দিত অরূপ৷
সেদিনও তৃষা দোকানে গিয়ে জয়ের কাছে ঘড়িটা দিয়ে বলেছিল, ‘জয়দা, বাবা কোথায় গো?’
জয় অবাক হয়ে বলেছিল, ‘সে কী, তুমি জানো না? তোমাদের বাড়িতে তো যাত্রায় পার্ট করা নায়ক এসেছে গো, তাই অরূপকাকা চলে গেল৷’
তৃষার একটু অবাক লেগেছিল শুনে৷ এর আগে অবশ্য বাবার পরিচিত এক থিয়েটার অভিনেতা এসেছিল বাড়িতে৷ তার বয়েস তো বাবার মতোই৷ প্রতিটা নাটক-থিয়েটারে বাবার রোল করতে করতে মানসকাকু পঁয়তাল্লিশেই যেন একটু বেশি বুড়িয়ে গিয়েছিল৷ তৃষা বলেছিল, ‘তুমি সব সময় বাবার রোল করো কেন, কাকু?’ মানসকাকু হেসে বলেছিল, ‘মা কালী আমায় টাকা দেননি ঠিকই কিন্তু টাক দিয়েছেন, তাই আমি ইউনিভার্সাল বাবা হয়ে গেছি৷’
ভারী মিশুকে মানুষ ছিলেন৷ বাবার সঙ্গে এই নাটক দেখতে গিয়েই পরিচয় হয়েছিল, তার থেকে বন্ধুত্ব৷ মঞ্চের গুরুগম্ভীর মানুষটা মঞ্চ থেকে নামলেই যেন অন্য একটা মানুষ৷ শিশুসুলভ গল্পে ভরিয়ে রাখত৷ হঠাৎই নাটকের দলের সঙ্গে বনিবনা না-হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছিল নাটক৷ আজ এতদিন পরে কি মানসকাকুই এল নাকি? কিন্তু জয়দা যে বলল, যাত্রার হিরো এসেছে৷ মানসকাকুকে হিরো বলা চলে না অন্তত৷ তাড়াতাড়ি পা চালিয়েছিল তৃষা৷ বাড়ি ঢুকে চমকে গিয়েছিল ও৷ রুদ্র বসে আছে বারান্দার চেয়ারে৷ অরূপ সামনে বসে গদগদ হয়ে কিছু একটা বলছে৷ তৃষা এতটাই চমকে গিয়েছিল বিভিন্ন মঞ্চে দেখা কৃষ্ণ বা রামের বেশধারী ছেলেটাকে নিজের বাড়ির বারান্দায় দেখে যে উঠোনেই দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে৷ হঠাৎই রুদ্র বলল, ‘আরে, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো এসো৷ আমি তো তোমার মতামতের অপেক্ষাতেই ওয়েট করছি৷ তোমার বাবা যদিও আগেই না বলে দিয়েছিল, তবুও মনে হল তোমার মুখ থেকে একবার শুনে যাই৷ ফোনে বলতে পারতাম, কিন্তু সব কথা তো ফোনে হয় না৷’ তৃষার বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছিল৷ হৃৎপিণ্ডের ওই লাবডুব আওয়াজটা নিজের কানে শুনতে পাচ্ছিল তৃষা৷ ওর স্বপ্নের পুরুষ ওরই বাড়ির বারান্দায় বসে আছে? নিজেই নিজেকে চিমটি কেটে দেখেছিল, ও স্বপ্ন দেখছে না তো৷ ফোনে বার দুয়েক কথা হয়েছিল রুদ্রর সঙ্গে৷ হেসে বলেছিল, ‘বাড়ির ঠিকানাটা দাও, হঠাৎ একদিন নিমন্ত্রণ খেতে চলে যাব৷’ তৃষা জানত রুদ্র আসবে না৷ এমন কত মেয়ে ফোন করে ওকে৷ পোস্টারে ওর ছবি দেখে তৃষার বন্ধুরা বলেছিল, ধুর, আজকাল আর যাত্রা কেউ দেখে নাকি? গেলে ওই কেষ্ট ঠাকুরের জন্যই যাব৷ কী দেখতে ছেলেটাকে৷ অরূপ তো রুদ্রকে সত্যিকারের ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিল৷ তৃষা হেসে বলছিল, ‘বাবা, উনি আসল কৃষ্ণ নন, শুধু সাজেন আর অভিনয় করেন৷’ অরূপ রাগ করে বলেছিল, ‘ওরে ওঁর ওপরে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ভর করেন তবেই না অমন অভিনয় করেন৷ যা দেখে দু-চোখে জল আসে৷ মনে হয়, বাংলাদেশে গিয়ে মায়ের মুড়ি ভাজার চালায় মায়ের কোলে শুয়ে কেঁদে নিই একটু সেই ছোটোবেলার মতো৷ শোন তৃষা, আমরা হলাম পাপীতাপী মানুষ, ভগবান আমাদের ধার দিয়েও যাবেন না৷ তাই রুদ্রর মধ্যে যখন ঈশ্বর ভর করে তখন ওকে যখনই দেখবি, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবি৷ ‘তৃষা চমকে উঠে বলেছিল, ‘প্রণাম?’ মনে মনে ভেবেছিল, ক্রাশকে কেউ প্রণাম করে নাকি? বাবা কিছুই জানে না৷ তৃষা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে দেখে অরূপ আবারও বলল, ‘দেখ, আজ আমদের বাড়িতে কে এসেছেন৷ একই অঙ্গে যাঁর রাম আর কৃষ্ণর বাস, যে কাঁদলে জগৎ কাঁদে, যে রুখে দাঁড়ালে ব্রহ্মাণ্ড ভয় পায়, যে হাসলে বিশ্ব হাসে সেই কেষ্ট ঠাকুর এসেছে৷ আয়, দাঁড়িয়ে রইলি কেন? এসে প্রণাম কর৷’ তৃষা তখনও চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে রুদ্র বলেছিল, ‘আহা মেসোমশাই, কী যে বলেন, প্রণাম কেন করবে? এসো তৃষা, আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি তোমাদের কাছে৷ তৃষার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই কথাটা মাথায় ঘুরছিল৷ তাই খুঁজে খুঁজে চলেই এলাম৷’
অরূপের চোখে কৌতূহল৷ এমনিতেই মঞ্চের মানুষকে লাইট, সাউন্ড বাদ দিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যায়, তারপর কেষ্ট ঠাকুর বলে কিনা তৃষাকে দেখার পর থেকেই ওর কথা ভেবেছে! রুদ্র বলল, ‘আরে, আপনারা তো দেখছি, দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন৷ ভয়ের কিছু নেই, তৃষা৷ আমি একটা নতুন দলে যোগ দিয়েছি৷ ওরা একটা চরিত্রের জন্য নতুন মেয়ে খুঁজছে৷ অল্পবয়সি, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে চাই৷ কারণ রাধার চরিত্রে তো আর যাকে-তাকে নেওয়া যায় না৷’
তৃষা হকচকিয়ে গিয়েছিল, এমন একটা প্রস্তাবের জন্য ও প্রস্তুত ছিল না৷ অরূপও যে ঘাবড়েছে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল৷ যাত্রা, নাটক, থিয়েটারের পোকা হলেও নিজের মেয়ে এসব করবে, কখনো কল্পনাও করতে পারেনি হয়তো৷ ভাঙা গলায় বলেছিল, ‘ও কি পারবে?’ রুদ্র বলেছিল, ‘এটা কী বলছেন মেসোমশাই, আমরা হলাম পদ্মাপাড়ের লোক৷ আমরা চেষ্টা করলে পারব না এমন কাজ আছে নাকি?’
এরপর তৃষা চা করে দিয়েছে, বেগুনি ভেজে দিয়ে গেছে আর কান পেতে শুনেছে অরূপ আর রুদ্রর গল্প৷ ও দেশ থেকে রুদ্রর দাদু যখন এ দেশে এসেছিল তখন তার হাতে ছিল সর্বসাকুল্যে একশো টাকা৷ রিফিউজি ক্যাম্পে ছিল প্রায় তিন মাস৷ তারপর একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেছিল, দাদুর জামাকাপড়ের পুঁটলিটাতে কেউ একজন প্রস্রাব করে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে৷ সেদিন কাউকে কিছু না বলে দাদু পালিয়ে এসেছিল রিফিউজি ক্যাম্প থেকে৷ ওই একশো টাকায় ক-টা গামছা কিনে বিক্রি করতে শুরু করেছিল৷ দিনে লোকের জমিতে কাজ করত, আর বিকেলে গামছা বিক্রি করত৷ মাত্র উনিশ বছরের ছেলে, গায়ে জোর ছিল খুব৷ দিনরাত এক করে খাটত৷ এখন বনগা অঞ্চলে রুদ্রর দাদুর কাপড়ের দোকান ‘শ্রীময়ী’কে চেনে না লোক নেই৷
তবে হ্যাঁ, রুদ্রর ঠাকুমা কিন্তু খাঁটি ঘটি বাড়ির মেয়ে৷ দাদুর দোকানে কাপড় কিনতে এসেই পরিচয়৷ তারপর বিয়ে৷ তৃষা বার বার দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল, বাংলাদেশের গল্প করায় এতই মশগুল হয়ে ছিল রুদ্র, যে আনমনে চা আর বেগুনি খেয়ে শেষ করে ফেলল তবুও একটা প্রশংসাবাক্য বেরোল না তৃষার উদ্দেশে৷ মন খারাপ করেই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল তৃষা৷
হঠাৎই দেখল কানের কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে রুদ্র বলছে, ‘চায়ে চিনি ছিল না, শুধু একজনের হাতের গুণে চা-টা মিষ্টি হয়ে গিয়েছিল৷ মেসোমশাই রাজি কৃষ্ণর হাতে তোমায় সমর্পণ করতে, তুমি কি রাজি? জানিয়ো৷’ আর দাঁড়ায়নি রুদ্র৷ তৃষা লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল চুপটি করে৷
কখন যে বাবা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে সেটা টেরও পায়নি৷ অরূপ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিল, ‘রুদ্র কী সব বলে গেল রে মা! তুই যাত্রায় পার্ট করবি? তুই ওসব পারবি? লোকে যদি আবার বলে, মেয়েকে অভিনয় করিয়ে টাকা রোজগার করছি, আমি তখন তো আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারব না৷’
তৃষা বলেছিল, ‘বাবা, রুদ্রও তো বড়ো বাড়ির ছেলে, ও তো অভিনয় করছে, হাজার হাজার লোক হাততালি দিচ্ছে, কই, কেউ তো খারাপ বলছে না? এই যে এত বাংলা, হিন্দি সিনেমার নায়িকারা এরাও তো শিক্ষিত, বড়ো বাড়ির৷ অভিনয় করা কি খারাপ?
অরূপ একটু ভেবে বলল, ‘মা রে, আমরা যে নেহাতই মধ্যবিত্ত, তাই আমাদের কাজের সমালোচনা হয় বেশি৷’
তৃষার চোখে তখন ঘোর-লাগা স্বপ্নের আনাগোনা৷ রুদ্রর পাশে ও সাজবে রাধা৷ এমন স্বপ্নও কি সত্যি হয়? ’
তৃষা বলেছিল, ‘একবার করে দেখি-না বাবা, যদি না পারি তো আর করব না৷’ অরূপ নিমরাজি হয়েছিল৷ মেয়ের মনে যাত্রা সম্পর্কে আগ্রহ ও-ই জাগিয়েছিল, এখন আর পিছিয়ে লাভ নেই৷ রুদ্রই মোটর সাইকেলে করে ওকে নিয়ে যেত রিহার্সালে৷ এ চত্বরে সবাই জেনে গিয়েছিল তৃষা আর রুদ্রর সম্পর্কের কথা৷ লোকজন অরূপকে জিজ্ঞাসাও করেছিল, জামাই তবে ঠিক করেই ফেললে অরূপদা? দুটোকে মানিয়েছে বেশ৷ কিন্তু মেয়েকে যাত্রা করতে না নামালেই পারতে৷ ঠিক কী উত্তর দেওয়া উচিত না বুঝে অরূপ বোকার মতো হাসত৷ কখনো বা ঘাড় নেড়ে বলত, ‘না, ওরা একসঙ্গে অভিনয় করে মাত্র৷’ কিন্তু তৃষার ব্যবহারে অরূপ ততদিনে জেনে গেছে, রুদ্রকে তৃষা ভালোবাসে৷ ভালোবাসার মতোই ছেলে অবশ্য রুদ্র৷ ওর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে আপত্তি ছিল না অরূপের৷ যদিও দু-একজন বলতে এসেছিল, এসব লাইনের ছেলেরা ভালো হয় না৷ কিন্তু অরূপ নিজে চোখে দেখেছিল রুদ্রর দায়িত্ববোধ৷ একদিনও রাত হয়ে গেলে তৃষাকে একা ছাড়ত না৷ আর সত্যি বলতে কী কৃষ্ণবেশে রুদ্রর পাশে রাধাবেশে তৃষাকে দেখে সবাই হাত জোড় করে প্রণাম করত দর্শকাসন থেকেই৷ গর্বে কেঁদে ফেলত অরূপ৷ পাড়ার লোকজন বলত, এরা যেন একে অপরের জন্যই তৈরি হয়েছে৷ রুদ্রর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে কোনো দ্বিধা ছিল না অরূপের৷ কিন্তু সমস্যা তৈরি হল রুদ্রর অবাধ্যতায়৷ তৃষা যে অভিনয়ে খুব পারদর্শী ছিল এমন নয়, কিন্তু রুদ্রর শেখানোর জন্যই বেশ উতরে যাচ্ছিল তৃষার অভিনয়টা৷ হঠাৎই যাত্রা দেখতে গিয়ে অরূপ চমকে উঠল৷ তৃষা বেশ্যার সাজে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছুটে গ্রিনরুমে গিয়ে রুদ্রকে প্রশ্ন করেছিল অরূপ, ‘এসব কী রুদ্র? তৃষা কেন এমন পোশাকে?’ রুদ্র খুব বিরক্তির সুরে মেকআপ করতে করতে বলেছিল, ‘আপনার মেয়ের ইচ্ছে ছিল, সামাজিক যাত্রাপালাতেও অভিনয় করবে৷ সামাজিক যাত্রার নায়িকা এখন একজনই— রানু দে৷ সে না থাকলে যাত্রা দেখার লোক আসবে না৷ তৃষার যা অভিনয়ক্ষমতা তাতে নায়িকা তো করতে পারব না৷ ঠাকুর-দেবতার যাত্রাপালার দিন এবারে শেষ হচ্ছে, সামাজিক চাইছে লোকজন৷ আপনার মেয়ের হাতেখড়ি হল এই অভিনয় দিয়ে৷ এতে যদি ভালো পার্ট করতে পারে তাহলে আর চিন্তা নেই৷’ অরূপ অপলক তাকিয়ে ছিল রুদ্রর দিকে৷ যেদিন তৃষাকে অভিনয় করানোর জন্য ওর অনুমতি চাইতে গিয়েছিল সেদিনের ব্যবহারের সঙ্গে ফারাকটুকু মাপছিল৷ কিছুতেই যেন মেলাতে পারছিল না এই ছেলেটাকে৷
তৃষাকে বাড়িতে ফিরে বলেছিল অরূপ, ‘যথেষ্ট হয়েছে যাত্রায় অভিনয় করা, আর দরকার নেই৷’ তৃষা তখন লাইট, সাউন্ড, হাততালি আর কাঁচা পয়সার নেশায় মত্ত৷ রুদ্রর কথাই ওর কাছে তখন ধ্রুবসত্য৷ অরূপ শাসন করতে গেলে বেশ বিরক্ত হয়ে তৃষা বলেছিল, ‘কেন, মঞ্চে অন্যের মেয়ে অভিনয় করলে হাততালি দাও, আর নিজের মেয়ে করলেই মুশকিল৷ তা ছাড়া সবাই জানে ওটা একটা চরিত্র, সত্যি বেশ্যা নয়৷’
অরূপ বলেছিল, ‘তুই মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, বদনাম হলে আর বিয়ে দিতে পারব না৷’
তৃষা হেসে বলেছিল, ‘আমার বিয়ের চিন্তা তোমায় করতে হবে না, আমি বিয়ে করলে রুদ্রকে করব, না হলে নয়৷’
তৃষার চোখে জেদ দেখেছিল অরূপ৷ মেয়ের জেদের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ছিল সে৷ পরের দিনই রুদ্রর বাড়িতে গিয়েছিল অরূপ৷ রুদ্র হেসে বলেছিল, তৃষাকে সে বিয়ে করতে চায় কিন্তু বিয়ের পরে অরূপ যেন ওদের জীবনে ইন্টারফেয়ার না করে৷ অরূপ তখন নিরুপায়৷ মানুষ চিনতে তার ভুল হয়ে গিয়েছিল৷ তৃষার সঙ্গে রুদ্রর বিয়ে দিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল ও৷ বিয়ের মাসখানেক পরেই রুদ্রর ঈশ্বরমূর্তি ভেঙে গিয়েছিল অরূপের সামনে৷ প্রতিমাসে টাকার বায়না আসত রুদ্রর কাছ থেকে৷ ছোটো একটা ঘড়ির দোকান থেকে নিজের খরচ চালিয়ে অত টাকার দাবি মেটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল অরূপের কাছে৷ টাকা দিতে না পারলেই তৃষাকে আর বাপের বাড়ি আসতে দিত না রুদ্র৷ বাজারে ধারদেনা হচ্ছিল অরূপের৷ তৃষাও ততদিনে চিনে গেছে রুদ্রর আসল উদ্দেশ্য৷ কিন্তু ভালোবাসায় অন্ধ তৃষা বাবাকে অস্বীকার করেছিল শেষ পর্যন্ত৷ বলেছিল, ‘প্লিজ বাবা, তুমি আর এ বাড়িতে এসো না, আমরা আমাদের মতো করে ভালো আছি৷’ মেয়ে-জামাইয়ের কাছ থেকে এতটা অপমানিত হয়েছিল অরূপ যে আর ওমুখো হয়নি৷ বাবার প্রাণ কাঁদলেও সে নোনতা জলকে কখনো গাল বেয়ে চিবুক ছুঁতে দেয়নি ও৷ তৃষার ছবিতে হাত বুলিয়ে বলেছে, ‘যদি কোনোদিন নিজে ডাকিস তবেই যাব৷’ না, ডাকেনি তৃষা৷ লুকিয়ে যাত্রা দেখতে গিয়ে দেখেছিল, রুদ্র একাই পার্ট করছে, তৃষা নেই৷ লোকমুখে শুনেছিল, তৃষা নাকি আর যাত্রা করে না৷ একটু হলেও শান্তি পেয়েছিল অরূপ৷ মেয়েকে সবরকম চরিত্রে অভিনয় করতে বাধ্য করেনি বলে৷ আসলে একেবারেই মধ্যবিত্ত মানসিকতার অরূপ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি তৃষার বেশ্যার চরিত্রের অভিনয়টা৷ যাত্রাপালা দেখতে গিয়ে ভক্তের ভগবান রূপে রুদ্রকে আর দেখতে চায়নি অরূপ, তাই তার একমাত্র শখকে বিসর্জন দিয়েছিল নির্দ্বিধায়৷ মঞ্চের দেবতা যে আসলে কেমন মানুষ সেটার সম্যক ধারণা নিয়েই যাত্রা দেখা ছেড়েছিল অরূপ৷ আর সেই থেকেই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসও হারিয়েছিল৷ যে ঈশ্বর তার ভিটেমাটি, বাবা, মা, স্ত্রী-কে কেড়ে নিয়েছিল তাকে রোজ ধূপ দেখাত অরূপ৷ কিন্তু তৃষার কাছ থেকে অপমানিত হবার পরে আর কোনো পিছুটান ছিল না অরূপের৷ সন্ধেতে গঙ্গার ধারে গিয়ে আধ ঘণ্টার জন্য বসে থাকা ছাড়া আর কোনো নেশা তৈরি হয়নি গত পাঁচ-ছয় বছরে৷ কৃষ্ণবেশী রুদ্র কীভাবে যেন ওর ছোট্ট দুনিয়াটাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়ে গেল৷ পদ্মার বিপুল জলরাশি কি এতটা ক্ষতি আদৌ করতে পেরেছিল অরূপের? কে বেশি ক্ষতি করল, রুদ্র না পদ্মা? এই দ্বন্দ্বে রোজ মনটা ভারাক্রান্ত হয়৷
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে মৃন্ময়ীর৷ কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছে না৷ অঘোরনাথজি কেন যে আচমকা এমন সিদ্ধান্ত নিলেন সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছে না মৃন্ময়ী৷ বিপ্রদাস, মধুবনদের হয়তো মারাত্মক লোভ ছিল শ্রীকণ্ঠধামের প্রধানের পদে বসার, কিন্তু মৃন্ময়ীর কোনো ইচ্ছেই নেই এই বিপুল দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার৷ কিন্তু অঘোরনাথজিকে কে বোঝাবে সে কথা? উনি এককথার মানুষ, আজ অবধি কথার নড়চড় হতে দেখেনি মৃন্ময়ী৷ ময়ূরাক্ষী আলতো করে মৃন্ময়ীর মাথায় হাত রেখে বলল, ‘আমি জানি সখী, তুই চিন্তিত৷ এমন একটা পদে তোকে যে অঘোরজি বসিয়ে দেবেন এ আমি যেমন কল্পনা করিনি, আশ্রমের একজন মেম্বারও বোধহয় কল্পনা করেনি৷ সবাই জানত অঘোরজির অবর্তমানে বিপ্রদাস আশ্রম সামলাবে৷ আজ যখন অঘোরজি তোর নাম ঘোষণা করলেন তখন আমি দেখলাম অনেকের মুখেই অবিশ্বাস, দ্বন্দ্বের মাখামাখি৷ কিন্তু বিপ্রদাসের মুখের শিরা-উপশিরায় রাগ-হিংসায় ফুলে উঠেছিল৷’ ময়ূরাক্ষী বলল, ‘সখী, দুশ্চিন্তা করিস না৷ উনি নিশ্চয়ই কিছু বুঝেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ আর আমি যেটুকু খবর পেলাম সনাতনের কাছ থেকে সেটা হল, বিপ্রদাস আর মধুবন তোকে তাড়াতে চাইছে আশ্রম থেকে৷ আজ সন্ধেতে সেই নিয়ে জলঘোলাও করতে গিয়েছিল, সেই খবর পেয়েই তড়িঘড়ি অঘোরজি এই সিদ্ধান্ত নিলেন, মনে হচ্ছে৷ শুনলাম, বিপ্রদাসরা তোর অতীত জীবন নিয়ে ছেঁড়াকাটা করে তোকে তাড়াতে চাইছে৷ শোন সখী, অঘোরজি জ্ঞানী মানুষ, উনি যা ভালো বুঝেছেন, করেছেন, তুই মন দিয়ে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে পালন কর৷ যেন অঘোরনাথজি গর্ব করে বলতে পারেন, তাঁর নির্বাচনে কোনো ভুল ছিল না৷’
মৃন্ময়ী আঁতকে উঠে বলল, ‘কিন্তু আমার অতীত ওরা জানল কোথা থেকে? এরপর আশ্রমের কেউ আমায় আর মৃন্ময়ী মা বলে সম্মান করবে না, ময়ূরাক্ষী৷ সম্মানটুকুর জন্যই তো বাঁচা, সেটুকুও চলে গেলে ভালোবাসাহীন জীবনে থাকব কী নিয়ে? শ্রীকণ্ঠও যদি মুখ ঘুরিয়ে নেন, যাব কোথায়?’
ময়ূরাক্ষী ধীর গলায় বলল, ‘অতীত সবার আছে, সখী৷ বিপ্রদাসের নেই? মধুবনের নেই?’ আমি ওদের অতীত আগেই খুঁজে রেখেছি৷ ওরা যদি আমাদের আবরুহীন করতে চায় তাহলে উলঙ্গ ওরাও হবে৷ তার আগে অবধি বিপ্রদাসের অন্ধকার দিকটা আমি দ্বিতীয় কাউকে বলব না৷’
মৃন্ময়ীর কপালে তবুও আঁকিবুকি কেটে চলেছে দুশ্চিন্তার কালো মেঘেরা৷ কতবার আর আশ্রয়হীন হবে মৃন্ময়ী?
ঈশ্বরের ধামেও যে এত জটিলতা ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে এ চিন্তা কোনো দুঃস্বপ্নেও আসেনি মৃন্ময়ীর৷
ময়ূরাক্ষী চলে গেছে পাশের ঘরে৷ বলে গেল, ‘নিশ্চিন্তে ঘুমো সখী, আমি রইলাম তোর পাহারায়৷’ মেয়েটা তো মৃন্ময়ীর দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ও নয়, তবুও কেন এত টান ওর প্রতি! অঘোরনাথজিও তো ওর কেউ নন তবুও কেন এত ভাবেন ওকে নিয়ে?
এক সংসার ভেঙে গেলে, এক আশ্রয় চলে গেলে ঈশ্বর বুঝি আরেকটা বন্দোবস্ত করেই রাখেন?
আপনজনেরা যখন পর হয়ে যায় তখন বুঝি দূরের মানুষরা আপন করে নেয়? জীবন বড়ো বিচিত্র৷ ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরেই চলেছে৷ প্রতিটা ঘরে একটু করে বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে চলেছে, থামছে কই? শ্রীকণ্ঠধামের ঘরে বছর ছয়েক না হয় বিশ্রাম নিয়ে নিল মৃন্ময়ী, এরপর জীবন যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবে৷ চোখ দুটো জড়িয়ে এসেছিল মৃন্ময়ীর৷ হঠাৎই দরজায় বেশ জোরে জোরে আঘাত পড়ল৷ ধড়ফড় করে উঠে বসল মৃন্ময়ী৷ নাইটল্যাম্পের আলোয় ঝাপসাভাবে দেখল, ঘড়িতে তিনটে বাজে৷ এত রাতে কে এল?
দরজায় কান পাততেই শুনতে পেল সনাতনের গলা৷
দরজাটা ফাঁক করতেই ফিসফিস করে বলল, ‘বেরিয়ে এসো৷’ মৃন্ময়ী কিছু বোঝার আগেই সনাতন হ্যাঁচকা টানে ওকে বাইরে বের করে নিয়ে এলো৷
একটা লম্বা পিলারের আড়ালে দুজনেই লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ কীসের অপেক্ষায় সেটা অবশ্য মৃন্ময়ী নিজেও জানে না৷ সনাতন ইশারায় ওকে চুপ করে দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে বলল শুধু৷ মৃন্ময়ীর ভয় করছিল গতকাল সন্ধে থেকেই৷ এখন সেই ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে৷
কালো চাদরে মুখ ঢেকে দুটো ছায়ামূর্তি এগিয়ে চলল অঘোরনাথজির ঘরের দিকে৷ সনাতন বলল, ‘চলো মৃন্ময়ী৷ বাবা যখন তোমায় দায়িত্ব দিয়েছেন এ আশ্রমের তখন এ আশ্রমের শত্রুদেরও তোমাকেই ধরতে হবে৷’
মৃন্ময়ী বলল, ‘কারা ওরা, আশ্রমের লোক?’
সনাতন বলল, ‘বিপ্রদাস আর মধুবন৷ অঘোরনাথজিকে শেষ করতে যাচ্ছে৷ ওঁর ঘরের দরজা যেহেতু সারারাত খোলা তাই কোনো সমস্যা নেই ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে ওঁকে খুন করে দেওয়া৷’
সনাতন একটা কাটারি মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে বলল, ‘যাও, বাঁচাও তোমার বাবাকে৷’ কাটারি জীবনে আরেকবার ধরেছিল মৃন্ময়ী, নিজেকে বাঁচাতে৷
হাতে কাটারি নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল মৃন্ময়ী৷ অঘোরনাথজির দরজার কাছে পৌঁছোনোর আগেই বিপ্রদাসের সামনে রুখে দাঁড়াল মৃন্ময়ী৷ বিপ্রদাস মৃন্ময়ীর শান্ত রূপ দেখতেই অভ্যস্ত এতদিন৷ এলোথেলো কাপড়, মাথার খোঁপা খুলে একরাশ চুল এলিয়ে পড়েছে পিঠে, ডান হাতে কাটারি—যেন সাক্ষাৎ রণচণ্ডী৷ বিপ্রদাস কোনো কথা না বলে দৌড় লাগাল৷ ধরা পড়ে গিয়ে বেশ ভয় পেয়েছে মধুবন, সেটা ওর চলে যাবার গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল৷ সনাতন ততক্ষণে আশ্রমের সব আলো জ্বেলে ফেলেছে৷ সিকিউরিটিরা ছুটে এসেছে সদর ছেড়ে৷
মৃন্ময়ী ভেজানো দরজা খুলে দেখল, নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন অঘোরনাথজি৷ মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি৷ নাইটল্যাম্পের আলোয় সাবধানে গুটিগুটি পায়ে মৃন্ময়ী এগিয়ে গেল ঘরের ভিতরে৷ ওঁর ঘরে পরা চপ্পলজোড়ায় প্রণাম করে বেরিয়ে এল৷
সনাতন বলল, ‘এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো৷ কাল সকালে বাবা উঠলেই সবকিছুর ফয়সালা হবে৷’ সনাতনের তীক্ষ্ণ নজর এ আশ্রমের প্রতিটা খুঁটিনাটির প্রতি৷ ওর নজর এড়িয়ে কেউ শ্রীকণ্ঠধামের একটা পাতাও ছিঁড়তে পারবে না৷ সনাতন কথা কম বলে, কাজ করে বেশি৷ গায়ে জোরও পালোয়ানদের মতোই৷ অল্প বয়েসে নাকি রাস্তাঘাটে মারামারি করে বেড়াত৷ একবার ওই মারপিট করতে গিয়েই মাথা ফেটেছিল৷ রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, একটা মানুষও এগিয়ে আসেনি ওর সাহায্যের জন্য৷ অচৈতন্য দেহটাকে নিয়ে অঘোরনাথজিই ছুটেছিল হসপিটালে৷ সনাতন বলে, ‘দ্বিতীয় জীবন যখন ফিরে পেয়েছিলাম তখন ঠিক করেছিলাম মানুষরূপী এই ভগবানই আমার জীবনের মালিক৷’ সেই থেকেই নাকি সনাতন অঘোরজির ছায়াসঙ্গী৷
মৃন্ময়ী ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিল, ঘুম ভাঙল লোকজনের চিৎকারে৷
শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে মৃন্ময়ীর৷
‘কী গো অরূপদা, দোকানে বসে ঢুলছ কেন? রাতে ঘুমোওনি নাকি?’
অরূপ বলল, ‘আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে গো সৌগত৷ রাতে চোখে ঘুম নামে না, এদিকে সূর্য উঠলেই যত ঘুম আমার চোখে এসে ভর করে৷ বলো সৌগত, আজ দোকানে কী মনে করে? তোমায় তো এদিকে একেবারেই আসতে দেখি না৷ পাকাপাকি কি কাটোয়াতেই থেকে গেলে? পূর্বস্থলীতে থাকতে তাও হালেকালে দেখা হত, এখন তো আর আসো না এদিকে৷’
সৌগত একটা প্যাকেট সামনে রেখে বলল, ‘ব্যান্ডটা চেঞ্জ করে দাও তো অরূপদা৷ বেশি দামি দিয়ো না৷ ব্যাবসার যা অবস্থা, দামি কিছু কিনতে পারব না৷ আমার ঘড়ি হলে সারাতে আসতাম না, নেহাত মেয়ের ঘড়ি তাই সারাতে এলাম৷ হ্যাঁ গো, কাটোয়াতেই রয়ে গেলাম৷ এখানেও ভাড়াবাড়িতে থাকতাম, ওখানেও তা-ই৷ কাটোয়ায় একটা ছোটো পান-বিড়ির দোকান খুলেছি, বুঝলে৷ মেয়েটা আবার লেখাপড়ায় ভালো, তাই তাকেও তো পড়াতে হচ্ছে৷ খরচ কি আর কম গো— এদিকে আজ একটা কাজে এসেছিলাম, মেয়ে ঘড়িটা দিয়ে রেখেছে আজ এক মাস হল৷ ভাবলাম, যাচ্ছি যখন তখন দেখা করেই যাই অরূপদার সঙ্গে৷ আজকাল আর যাত্রা দেখতে যাও নাকি?’
অরূপ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না আর যাওয়া হয় না৷’
ঘড়িটাতে হাত দিয়েই চমকে উঠল অরূপ৷ কাঁপা গলায় বলল, ‘এ ঘড়ি তুমি কোথায় পেলে, সৌগত?’
সৌগত অরূপের ভাবভঙ্গি দেখে একটু থমকে বলল, ‘কেন বলোতো? একটা ছেলে পুরোনো মাল বিক্রি করে, নতুন কন্ডিশনে, আমাদের বাড়ির পাশেই৷ ওর কাছ থেকে মেয়ে কিনেছিল৷ কেন বলোতো? কোনো গণ্ডগোল?’
অরূপ বলল, ‘কবে কিনেছে ঘড়িটা, বলতে পারব?’
সৌগত একটু ভেবে বলল, ‘তা বছর তিনেক আগেই হবে৷’
অরূপ বলল, ‘শোনো-না, সেই ছেলেটার ফোন নম্বরটা দিতে পারবে আমায়? আর এই ঘড়িটা আমি রাখছি৷ এর বদলে তোমায় নতুন ঘড়ি দিচ্ছি একটা৷
সৌগত বলল, ‘কিন্তু বিষয়টা ঠিক বুঝলাম না তো৷’
অরূপ অসহায় গলায় বলল, ‘এটা আমার মেয়ে তৃষার ঘড়ি৷ মাধ্যমিকের পর ওকে উপহার দিয়েছিলাম৷ দোকান থেকে অনেক ঘড়ি নিয়ে পরলেও এটা ছিল ওর প্রিয় ঘড়ি৷ কখনো হাতছাড়া করত না৷ এই দেখো, ঘড়ির পিছনে লেখা আছে৷ এটা ও-ই লিখিয়েছিল৷ বহুদিন মেয়েটার কোনো খোঁজ পাই না৷’
সৌগত রিকুর ফোন নম্বর দিয়ে নিজে একটা লেডিজ নতুন ঘড়ি নিয়ে চলে গেল৷ ঘড়িটা হাতে নিয়েই তড়িঘড়ি ফোন করল রিকু নামের ছেলেটাকে৷ বার পাঁচেক বেজে গেল ফোনটা, তাও রিসিভ করল না দেখে নিরাশ হল অরূপ৷ বাবার ওপরে যতই অভিমান থাকুক, এ ঘড়িটা তো হাতছাড়া করবে না তৃষা৷ রুদ্ররা বাড়ি পালটানোর পর আর কোনো খোঁজ পায়নি অরূপ তৃষার৷ আর মেয়েও দিব্যি দিয়ে বলেছিল, ‘তুমি আর কখনো আমার বাড়িতে আসবে না৷ আমাদের শান্তিতে সংসার করতে দাও৷’ সমুদ্রসম অভিমান নিয়ে এতগুলো বছর মেয়েটার কোনো খোঁজ না নিয়ে তবে কি ভুল করল অরূপ? প্রিয় ঘড়িটা বেচে দিতে হল কেন ওকে? তৃষা কি তবে ভালো নেই? মেয়ে তো কোনোদিন ভুল করেও একটা খোঁজ নিল না অরূপের, বাবা বেঁচে আছে কি না জানতেও চাইল না৷ কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মেয়েটা৷ এত দামি ঘড়ি কেনার সামর্থ্য অরূপের কোনোওদিনই ছিল না৷ তবুও সামর্থ্যের বাইরে গিয়েই মেয়ের জন্য কিনেছিল ঘড়িটা৷ মহাজনের কাছে এক বছর ধরে অল্প অল্প করে ধার শোধ করেছিল তারপর৷
রংবেরঙের ঘড়ির প্রতি নেশা ছিল মেয়েটার, কিন্তু এই ঘড়িটা ছিল ওর সব থেকে প্রিয়৷ সেটা বিক্রি করে দিল কেন? ঘড়ির কন্ডিশন তো একেবারে ঠিক আছে৷ শুধু বহু ব্যবহারে ব্যান্ডের একটা লক নষ্ট হয়ে গেছে৷
‘কী গো অরূপদা, কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?’ চা হাতে সুজয় দাঁড়িয়ে আছে৷
নিজের গালে হাত দিয়ে দেখল, সত্যিই জলে ভিজে গেছে৷ কখন যেন এত বছরের অবরুদ্ধ অভিমানের দরজাটা খুলে গেছে, টেরও পায়নি ও৷ অভিমানের বরফ গলতে শুরু করেছে সেটাও খেয়াল করেনি অরূপ৷ ঘড়িটা সুজয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তৃষার ঘড়ি৷ একজনকে বিক্রি করে দিয়েছে৷’
কথা শেষ হবার আগেই অরূপের ফোনটা বেজে উঠল, রিসিভ করতেই একটা অল্পবয়েসি ছেলে বলল, ‘বলুন, কে বলছেন?’
অরূপ নিজের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল যেন৷ নিজেকে শান্ত করে বলল, ‘তুমি রিকু তো? সৌগতর কাছ থেকে নম্বরটা পেলাম৷ একটু কথা ছিল আমার৷’
ছেলেটা একটু বিরক্তির গলায় বলল, ‘ব্যাবসার সময় অযথা নষ্ট না করে কী কথা বলুন৷’
অরূপ বলল, ‘তুমি তো পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করো, শুনলাম’৷
কথা শেষ করতে না দিয়েই রিকু বলল, ‘ঠিকই শুনেছেন, শুধু পুরোনো জিনিস নয়, চোরাই জিনিসও বেচতাম৷ এখন ছেড়ে দিয়েছি৷ নিজের ব্যাবসা খুলেছি৷ কাটোয়া স্টেশনের ধারে আমার ফলের দোকান৷ আর ওসব ব্যাবসা করি না৷’
অরূপ দিশাহারার মতো বলল, ‘সৌগতর মেয়ে ঝিলমিল তোমার কাছ থেকে যে ঘড়িটা কিনেছিল ওটা তোমায় কে দিল ভাই? কার কাছ থেকে কিনেছিলে?’
রিকু বেশ খানিকক্ষণ ভাবল, যেন তিন বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে চলেছে৷ তারপর বলল, ‘ওহ বুঝেছি, ওটা আমার শ্রীকণ্ঠধামের এক মহিলা বিক্রি করেছিলেন৷ সরি সরি, বিক্রি করেননি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, কোনো গরিব মেয়েকে যেন দিই৷ সৌগতদার মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো বলে খুব সস্তায় দিয়ে দিয়েছিলাম৷’
অরূপ বলল, ‘শ্রীকণ্ঠধাম? সেটা কোথায়?’
রিকু ঠিকানা বলার আগেই সুজয় বলল, ‘আরে তোমায় তো আমি এখানেই নিয়ে যেতে চাইছিলাম৷ আমার ভগ্নীপতিরা সব যায়৷ বলে, মনে শান্তি আসে৷ ঠিকানা আমি জানি, তুমি যাবে?’
রিকুর ফোনটা রেখে অরূপ বলল, ‘চল, এখুনি যাব৷’
সুজয় বলল, ‘কী ব্যাপার একটু বলবে?’
অরূপের আর তর সইছে না৷ এতদিন মনে করছিল, মেয়ে তার রুদ্রর সঙ্গে সংসার করছে, ছেলে-মেয়ে-স্বামীর যত্ন করতে গিয়ে বাবার খোঁজটুকুও রাখেনি হয়তো৷ অথবা রুদ্র চায়নি তৃষা অরূপের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখুক, তাই সংসার বাঁচাতে হয়তো তৃষা বাবাকে ভুলেছে৷ কিন্তু এই ঘড়িটা ওর হাতে আসার পর থেকে ভাবনা বদলে গেছে অরূপের৷ তৃষা ঘড়িটা বিক্রি করেনি অর্থসংকটে, দান করেছে৷ কিন্তু যে ঘড়িটা তার সব থেকে প্রিয় ছিল সেটা হঠাৎ একটা চোরাই মাল বিক্রি করে এমন ছেলেকে দিয়ে দিল কেন! জয়ের হাতে দোকানের চাবি দিয়ে সুজয়কে বলল, ‘চল, আর দেরি করব না, যেতে যেতে সব বলছি৷’
ময়ূরাক্ষী এসে দরজা ঠুকছে মৃন্ময়ীর৷ মৃন্ময়ী দরজা খুলতেই ভয়ার্ত চোখে বলল, ‘শিগগির বাইরে চল সখী৷ বিপ্রদাস আর মধুবন তোর চরিত্রে কালি ছড়াচ্ছে৷ বলছে, তুই নাকি আগে খারাপ পাড়ায় ব্যাবসা করতিস৷ কী সব প্রমাণও এনেছে, বলছে৷ অঘোরজিও ওদের থামাতে পারছে না৷ বলছে তুই নাকি বেজন্মা, তোর বাবা-মায়ের পরিচয় নেই৷ তুই কী করে এমন পবিত্র আশ্রমের প্রধানা কর্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারিস? এই নিয়ে আশ্রমের ভক্তদের খেপাচ্ছে৷’
মৃন্ময়ী বুঝল, কালকে ওদের হাতেনাতে ধরায় আজকে অন্য ছকে এগোতে শুরু করেছে৷ মৃন্ময়ী ধীরেসুস্থে বাথরুমে গেল৷ নিজেকে গুছিয়ে নিল৷ স্নান সেরে কাচা গরদের শাড়িখানা পরে ধূপ জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘোরাল৷ ভিজে চুলটা চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে ছড়িয়ে দিল পিঠের ওপরে৷ বাইরে যে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে সেটা ঘরে বসেই টের পাচ্ছিল মৃন্ময়ী৷ ওই তো কখানা পরনের কাপড়, গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পরতে কতক্ষণ? আশ্রয় হারিয়ে যাবার ভয়টা আজ আর করছে না৷
বাইরে বেরোতেই দেখল, নিরুপমাদেবী দুটো ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ওকে দেখেই হেসে এগিয়ে এসে বললেন, ‘চলে এলাম সব পিছুটান ছেড়ে৷ মৃন্ময়ী মায়ের দায়িত্বে রয়ে যাব আজ থেকে৷’ মৃন্ময়ী ওঁকে নিজের ঘরে বসিয়ে নাটমন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল৷ লোকজন জড়ো করে ফেলেছে বিপ্রদাস৷ মৃন্ময়ী সামনে আসতেই চিৎকারটা গুঞ্জনে পরিণত হল সাময়িকভাবে৷ মঞ্চের ওপরে উঠে দাঁড়াল মৃন্ময়ী৷ অঘোরজির দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করে বলল, ‘ক্ষমা করবেন বাবা, আপনার কথার অবাধ্য হলাম বলে৷ আজ আমি ছয় বছর আগের অতীতকে সামনে আনছি৷’
বিপ্রদাসের হাতে কয়েকটা ছবি৷ বেশ্যার পোশাকে দেওয়ালে হেলান দিয়ে খদ্দের ডাকছে মৃন্ময়ী৷
ভক্তদের হাতে হাতে ঘুরছে সে ছবি৷ মৃন্ময়ী সেদিকে তাকিয়েই বলল, ‘এগুলো আমার যাত্রাপালার ছবি৷ ভালো করে ব্যাকগ্রাউন্ড দেখো সবাই৷ হ্যাঁ, জীবনের শুরুতে আমি যাত্রাপালায় রাধা, সীতার অভিনয় যেমন করেছি তেমনই বারবনিতার অভিনয়ও করেছি৷ আমার স্বামীই আমায় যাত্রায় অভিনয় করার জন্য রাজি করিয়েছিল৷ আমার স্বামী যাত্রা করত৷ বিয়ের পর কয়েকটা যাত্রা করার পরেই আমার স্বামী বলল, আর তোমাকে অভিনয় করতে হবে না৷ আমি তখন সংসারে মন দিলাম৷ তিন দিন অন্তর সে আমায় বলত, বাবার কাছ থেকে টাকা না আনলে বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না৷ বাবা নিঃশেষ হয়ে আমায় টাকা দিচ্ছিল, আমি তখন বাবার সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করলাম৷ আমার স্বামী রুদ্র বাবার কাছ থেকে আর টাকা পাবে না জেনে পুরোনো বাড়ি ছেড়ে আমায় নিয়ে চলে এল অন্য বাড়ি ভাড়া করে৷ বাবার সঙ্গে সামান্য যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হল৷ রুদ্রদের বাড়ি, সম্পত্তি থাকলেও ওর স্বভাবের জন্য ওর বাবা ওকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিল৷ বিয়ের আগে সেটা আমাদের বলেনি ও৷ আমার বাবার হাজার বারণে আমি কান না দিয়েই বিয়ে করেছিলাম রুদ্রকে৷ তাই বাড়ি ফেরার মুখ আর ছিল না৷ তারপর একদিন রুদ্র রাতে গিয়েছিল যাত্রা করতে, আমি ঘরে ঘুমিয়ে গেছি কখন, জানি না৷ হঠাৎই দেখি, একটা রোমশ হাত আমার গায়ে হাত বুলোচ্ছে৷ ঘরের চাবি রুদ্রর কাছে ছিল৷ ও চাবি না খুলে দিলে কারো পক্ষে ঘরে ঢোকা সম্ভব ছিল না৷ বুঝতে দেরি হল না, রুদ্র টাকার জন্য আমায় ব্যাবসায় নামাতে চায়৷ দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লোকটাকে সজোরে একটা লাথি মেরে অন্ধকারের মধ্যেই ছুটছিলাম৷ হঠাৎই একটা গাড়ির আলো চোখে পড়ে, তারপর আর জ্ঞান ছিল না৷ জ্ঞান ফিরলে দেখলাম, অন্য জায়গায় শুয়ে আছি৷ সামনে একজন গেরুয়া বস্ত্রধারী মানুষ জিজ্ঞাসা করছেন, তুই কে রে মা? ওভাবে মেইন রোডে ছুটছিলিস কেন? কী হয়েছে তোর? আমি শুধু কেঁদেছিলাম ভয়ে৷ উনি আমায় নিয়ে এলেন শ্রীকণ্ঠধামে৷ আমার সঙ্গে ছিল দুটো সোনার কানফুল, হাতের বালা আর একটা ঘড়ি৷ ওই ঘড়িটা আমি রাতে পরে শুতাম৷ মাঝরাতে রেডিয়ামের আলোয় ঘড়ি দেখার নেশা আমার স্কুল লাইফ থেকে৷ অঘোরজি বললেন, এসব পার্থিব জিনিসের মায়া কাটাতে হবে৷ আজ থেকে এটাই তোমার সংসার৷ সোনার গয়না খুললেও ঘড়িটি রেখেই দিলাম৷ বুঝলাম, মায়া কাটাতে সময় লাগে৷ সবকিছুর মায়া কাটাতে আমারও বছর তিনেক লেগেছিল বই কী৷ তবে এখন আমি নির্মোহ৷ এ আসনের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই৷ এবারে আপনারা বলুন আমার দোষ কোথায়? আমি একজনকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে বিয়ে করে সংসার করতে চেয়েছিলাম৷ সে মানুষটা প্রবঞ্চক হলে আমি কী করব? নতুন জীবনে বাঁচতে চাওয়া কি অপরাধ? আমি জানি, বিপ্রদাস রুদ্রর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে, ছবিগুলো ওর কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছে৷ জানি না রুদ্রর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হয়েছিল বিপ্রদাসের৷ অঘোরজি আমার জীবনের সব খুঁটিনাটি জানেন৷ আপনারাও আজ জানলেন৷ এবারে যদি বলেন এ পৃথিবীতে আমার বাঁচার অধিকার নেই, তাহলে আমি চলে যাব বিনা প্রশ্নে৷ না, আমি এ আশ্রমের দায়িত্ব চাইনি৷ অঘোরজি নিজে দিয়েছেন, কেন দিয়েছেন সেটা ওঁর মতো বিচক্ষণ মানুষ বলতে পারবে৷
মধুবন বলল, ‘স্বামীর সঙ্গে না হয় সম্পর্ক নেই, কিন্তু বাবা-মা ? তারা তো থাকবে মৃন্ময়ীর৷ অবৈধ সন্তান তো নয়৷ আর যদি অবৈধ পরিচয়হীন হয় তাহলে তার হাতে শ্রীকণ্ঠ জলগ্রহণ করবে তো? সেটা আপনারা বিচার করুন৷ নিজেদের জাতধর্ম খোয়াবেন নাকি ধর্ম করতে এসে? একজন বেশ্যার তত্ত্বাবধানে যদি এ আশ্রম চলে তবে আশপাশের লোকজন কি আর আসবে এ আশ্রমে?’
মৃন্ময়ী কিছু বলার আগেই দেখল, দুজন মানুষ ভিড় ঠেলে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে৷ মৃন্ময়ী বলল, ‘আমি একবর্ণও মিথ্যে বলিনি, এবারে আপনারা বিচার করুন৷ আমার ব্যাগ গোছানোই আছে, আপনরা বললে এখুনি আশ্রম ছাড়ব৷’
অঘোরজি রুখে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মৃন্ময়ী, এসব কী বলছিস মা?’
মানুষ দুটো দূরে দাঁড়িয়ে যে ওর সব কথা শুনছিল সেটা খেয়াল করেনি মৃন্ময়ী৷ লুকিয়ে পড়তে হবে যাহোক করে৷ বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করছে৷ কত রোগা হয়ে গেছে বাবা৷ একটু যেন বুড়ো৷ ছয় বছর পরে দেখছে বাবাকে৷ সামনের চুলে পাক ধরেছে মনে হচ্ছে৷ বাবা এগিয়ে আসছে৷ খুব কাছে চলে এসেছে মৃন্ময়ীর৷ আর পালানো সম্ভব নয়৷ পাশেই ময়ূরাক্ষী দাঁড়িয়ে ছিল৷ মৃন্ময়ী ফিসফিস করে বলল, ‘ওই আকাশি জামা-পরা মানুষটা আমার বাবা, সখী৷ বুঝতে পারছি না কার কাছে খবর পেয়ে এখানে এসেছে! আমি চাই না আমায় চিনতে পারুক৷ আমি এখন কোথায় লুকোব, ময়ূরাক্ষী? কী করব?’
‘ময়ূরাক্ষী বলল, ‘কী নাম সখী তোমার বাবার?’
মৃন্ময়ী বলল, ‘অরূপ ভট্টাচার্য৷’
ময়ূরাক্ষী হঠাৎই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল৷ মৃন্ময়ী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সখী এমন কিছু করতে পারে৷ ময়ূরাক্ষী নাটমঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শ্রীঅরূপ ভট্টাচার্য, আপনি একবার এদিকে উঠে আসুন৷ সবাই শান্ত হোন৷ সবাই উত্তর পাবেন৷’
অরূপ এগিয়ে এসে বলল, ‘কে বলল ওর পিতৃপরিচয় নেই? আমি ওর বাবা৷ ও আমার একমাত্র সন্তান৷’
সকলে চুপ করল অরূপের কথা শুনে৷ অরূপ কান্না ভেজা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, এগুলো সব ওর যাত্রাপালার ছবি৷’
অঘোরজি স্থির গলায় বললেন, ‘সনাতন, কাল রাতে যা ঘটেছিল সেগুলো আশ্রমের সকলকে জানানো তোর কর্তব্য৷ তুই বল সবাইকে৷’
অঘোরজির কথাটা শেষ হবার আগেই বিপ্রদাস আর মধুবন এসে মৃন্ময়ীর পায়ের কাছে বসে বলল, ‘এবারের মতো ক্ষমা করে দাও মৃন্ময়ী৷ আমরা তোমাকেই মা হিসাবে মানব৷
আশ্রমের ভক্তরা যে যার কাজে চলে গেল৷ মৃন্ময়ী বসে আছে গুলঞ্চ গাছের নীচে৷
অরূপ মেয়ের হাত দুটো ধরে বলছে, ‘আমায় ক্ষমা করিস মা৷ আমি তোর মুখের কথাটাতেই বিশ্বাস করেছিলাম, বুঝিনি তুই বাবাকে বাঁচাতে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস৷ রুদ্রর টাকার লোভ থেকে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলিস৷ কিন্তু তারপরেও তো তুই ফিরতে পারতিস৷ আমি যে তোর অপেক্ষায় দিন কাটাতাম৷’
মৃন্ময়ী বলল, ‘বাবা, আমার শুধু নামটা পালটে দেননি অঘোরনাথজি, আমাকেও পালটে দিয়েছেন৷ আমি আর সংসারী মানুষ নই৷ কোনো আগ্রহ নেই সংসারের প্রতি৷ এই শ্রীকণ্ঠধামই আমার সংসার৷ তাই আর ফিরতে মন চায়নি৷ তা ছাড়া তোমার কথা অমান্য করেই রুদ্রর হাত ধরেছিলাম, যখন বুঝলাম, ভুল করেছি তখন কোন মুখে ফিরব তোমার কাছে?’
অরূপ বলল, ‘আমি তো এই ঘড়িটা না পেলে জানতেই পারতাম না তোর জীবনে এত কিছু ঘটে গেছে!’
‘ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়ী বলল, ‘এইটার মায়া কাটাতে আমার সময় লেগেছিল৷ একদিন বাজারে গিয়েছিলাম ঠাকুরের পোশাক কিনতে৷ দেখি, একটা ছেলে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে৷ বলল, বেচবেন? ভালো দাম দেব? কে জানে, মনটা কেমন হল৷ ছেলেটার হাতে ঘড়িটা খুলে দিয়ে বললাম, এমন কাউকে দিয়ো যার এটা প্রয়োজন৷ সে অবাক হয়ে বলল, পয়সা নেবেন না? আমি বললাম, না৷ আমি শ্রীকণ্ঠধামে থাকি৷ মহাদেব আমার অন্ন জোগান৷ টাকা নিয়ে করব কী? ছেলেটি হয়তো তোমার ঘড়ির দোকানে বেচতে গিয়েছিল৷’
অরূপ সৌগতর ঘটনাটা বলে বলল, ‘না রে মা, সে ছেলে তোর কথা শুনেছে৷
মৃন্ময়ী উঠে পড়ল, বলল, ‘বাবা, এবার আমি আসি৷ আমায় পুজোর জোগাড় করতে হবে৷ অঘোরনাথজি আমায় এ আশ্রমের দায়িত্ব দিয়েছেন৷ আমার এখন অনেক কাজ৷’
সুজয় বলল, ‘তুই তবে এখানের মৃন্ময়ী মা তৃষা?’
মৃন্ময়ী হেসে বলল, ‘হ্যাঁ সুজয়কাকু, এরা আমায় এই নামেই ডাকে৷’
সুজয় বলল, ‘অরূপদা, আমার ভগ্নীপতিরা সবাই মৃন্ময়ী মা বলতে অস্থির৷ বলে, ওঁর কাছে দু-দণ্ড বসলেও মনে শান্তি মেলে৷’
অরূপের এসব কথা মাথায় ঢুকছিল না৷ আকুল হয়ে বলল, ‘তৃষা, তোর প্রতিটা জন্মদিনে আমি তোর জন্য একটা করে নতুন ঘড়ি কিনে রেখেছি, মা৷ ছ-টা নতুন ঘড়ি৷ সব রঙের৷ তুই পরবি না মামণি? চল, বাড়ি চল৷’ অরূপ জানে, রংবেরঙের ঘড়ি তৃষার খুব পছন্দের৷ মৃন্ময়ী নরম হাসল৷ অরূপ আবার বলল, ‘তোর ঘরে মিকি মাউসের ছবি-আঁকা চাদর পেতে রেখেছি, তৃষা৷ চল, বাড়ি চল মা৷ আর কখনো বকব না তোকে৷’
মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াল৷ শান্ত গলায় বলল, ‘বাবা, আমি এখন আর শুধু তোমার মেয়ে নই৷ আমি শ্রীকণ্ঠধামের সকলের মা৷ এ দায়িত্ব ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না৷ আমার দ্বিতীয় জীবন যিনি দান করেছেন তিনি এ বিশাল দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পণ করেছেন৷ এ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়া মানে ওঁকে হারিয়ে দেওয়া৷ এটা আমি করতে পারব না৷ তোমার সঙ্গে এ জন্মেই দেখা হল, শ্রীকণ্ঠ দেখা করিয়ে দিলেন নাটকীয়ভাবেই৷ এটুকুই আমার প্রাপ্তি৷’ মৃন্ময়ী ধীরপায়ে এগিয়ে গেল৷ প্রতিটা পদক্ষেপ দৃঢ়, অবিচল৷
অরূপ অপলক তাকিয়ে দেখল, এই মেয়েটা তার তৃষার মতো দেখতে বটে কিন্তু স্বভাবে তৃষা নয়৷ এ যেন অন্য কোনো পরিপূর্ণ নারী৷
মৃন্ময়ী একটু এগোতেই বহু মানুষ এসে তাকে ঘিরে ধরেছে৷ কেউ প্রণাম করছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে হাত জোড় করে৷ বিভিন্ন বয়সের মানুষের চোখে-মুখে অপার বিশ্বাস তাদের মৃন্ময়ী মায়ের প্রতি৷
সুজয় অরূপের পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘অরূপদা, ও এখন আর শুধু তোমার মেয়ে নয় গো, এদের সকলের মা৷ চলো, বাড়ি চলো৷ আমরা না হয় মৃন্ময়ী মায়ের কাছে আসব মাঝে মাঝে৷’ অরূপ তবুও দাঁড়িয়ে আছে৷ এতদিন পরে মেয়েকে কাছে পেয়েও যে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না সেটা কল্পনার বাইরে ছিল অরূপের৷ রিকুর কাছ থেকে তৃষার ঠিকানা পাওয়ার পর থেকেই মনটা আনন্দে নাচছিল৷ নিশ্চিন্ত ছিল, মেয়ের অভিমান এতদিনে ভেঙে যাবে৷ তৃষা যে এমন একটা জীবনে প্রবেশ করতে পারে এ যেন ধারণারও অতীত ছিল৷ এ কোন তৃষাকে দেখল অরূপ৷ সুজয়কে বলল, ‘আরেকটু বসি রে সুজয়৷ এলাম যখন, আরেকটু দেখি মেয়েটাকে৷’
ঢং ঢং করে ঘণ্টাধ্বনি হল৷ মন্দিরে পুজোর সময় হয়েছে৷ অরূপরাও গিয়ে দাঁড়াল পুজো দেখবে বলে৷ চওড়া লালপাড় গরদের শাড়ি, কোমর অবধি খোলা চুল, কপালে চন্দনের টিপ৷ হাতে পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা৷ অঘোরনাথজি পুজোয় বসলেন৷
‘‘ওম৷ ত্র্যম্বকম যজমহে
সুগন্ধিম পুষ্টী-বর্ধনম
উর্ভারুকমিব বন্ধনন
মৃত্যুর মুখশিয়া মমৃতত’’
মৃন্ময়ী বলল, ‘মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র হল ঋগবেদে পাওয়া ভগবান শিবের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র৷ সকলে উচচারণ করুন৷’
অরূপ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিল মৃন্ময়ীমাকে৷ তখনই এক ভদ্রমহিলা পাশে বসে বললেন, ‘আপনি বুঝি মৃন্ময়ীর বাবা? আমি নিরুপমা৷ আপনার মেয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ৷ আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছে ও৷ আপনি ধন্য৷’
মৃন্ময়ী তখন পুজোয় মগ্ন৷ অরূপ বলল, ‘চল সুজয়৷ আমি বোধহয় কোনোদিনই ওকে আর ছুঁতে পাব না৷’
‘‘করপুর গৌরম করুণাবতারম সংসার সারাম
ভুজগেন্দ্র হারাম৷
সদা বসন্তম হৃদয়বৃন্দে
ভাবম ভবানি সহিতম নমামি’’
মৃন্ময়ী বলছে— ‘আমি ভবানীকে প্রণাম করি এবং সেই সঙ্গে ভগবান শিবকেও প্রণাম করি যিনি কর্পূরের মতো শ্বেত, যিনি করুণাময় অবতার, যিনি জগতের সার, যিনি একটি বৃহৎ সাপের মালা পরিধান করেন এবং যিনি সর্বদা পদ্মের মতো হৃদয়ে বাস করেন৷’
সমাপ্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন