পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী

পাঁচকড়ি দে

পূর্ব্ববর্ণিত ব্যাপার সমাধা করিয়া, বাড়ী আসিতে অধিক রাত্রি হওয়ায়, দেওয়ান গোবিন্দরাম অন্তঃপুরে না যাইয়া বৈঠকখানায় শয়ন করিয়াছিলেন। নিরতিশয় পরিশ্রমের পর অধিক রাত্রিতে শয়ন করিয়াছিলেন বলিয়া অদ্য বেলা সাতটার সময় তাঁহার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। তিনি ‘দুর্গা দুর্গা’ বলিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। তাঁহার শরীর স্বচ্ছন্দ ও মন প্রফুল্ল হইয়াছে—তিনি প্রফুল্লমনে গান করিতে লাগিলেন। যাঁহার অন্তঃকরণ নিৰ্ম্মল, যাঁহার চিন্তা বিশুদ্ধ, যাঁহার হৃদয় প্রশস্ত, তিনি যদি গান না করিবেন, তবে গান করিবে কে? গান করিবে কি রত্নাপাখী–না গান করিবে মহাপাতকী রাঘব সেন?

তিনি গান করিতে করিতে অন্তঃপুরে গমন করিলেন। যে মনোমোহিনী, সুখময়ী-প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে, তাঁহার হৃদয় কবিকল্পিত নন্দনকাননের সমতুল্য হইয়াছিল, যে মূৰ্ত্তি ধ্যান করিয়া তিনি প্রবাসেও অতুল সুখে কালাতিপাত করিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার সেই চিত্তাধিষ্ঠাত্রী দেবতা—তাঁহার সেই একমাত্র চিন্তা—সেই প্রাণাধিকা বনিতা বিনোদিনীর মোহিনীমূর্ত্তি বাড়ীতে আসিয়া, এখন পৰ্য্যন্ত নয়ন ভরিয়া দেখিতে পান নাই—এখন পর্যন্ত তাঁহার কোকিল-নিন্দন স্বরসুধায় শ্রবণ যুগল পরিতৃপ্ত করিতে পারেন নাই—এখন পর্য্যন্ত তাঁহার সেই বিমলকমলতুল্য কপোলযুগল চুম্বন করিয়া বিরহ-সন্তপ্ত হৃদয় সুশীতল করিতে পারেন নাই। বিনোদিনীকে দেখিবার নিমিত্ত তাঁহার অন্তঃকরণ অস্থির হইয়া উঠিল।

তিনি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, পুরীর নিম্নতলে কেহই নাই, কেবল একজন দাসী গৃহকার্য্য করিতেছে; দ্বিতলে উঠিলেন, সেখানেও কেহ নাই, তাঁহার শয়নমন্দির কুলুপ-বদ্ধ রহিয়াছে। দাসীকে জিজ্ঞাসিলে, সে উত্তর করিল, “ঠাকুর ঘরে।”

তিনি দ্রুতপদে ত্রিতলে উঠিলেন। দেখিলেন, ছাদে বিনোদিনী অবনতবদনে বসিয়া তাম্রটাট, তাম্রকুণ্ড, পঞ্চপাত্র, পঞ্চপ্রদীপ প্রভৃতি তৈজসরাশি পরিষ্কৃত করিতেছেন। তাঁহার সীমন্তের উভয়পার্শ্বস্থ কৃষ্ণবর্ণ কুঞ্চিত কুন্তলদাম বিলম্বিত হইয়া মৃদুল পবনে মন্দ মন্দ সঞ্চালিত হইতেছে এবং ললাট ও নাসিকা বিন্দু বিন্দু স্বেদাভিষিক্ত ও কপোলযুগল ঈষৎ রক্তাভ হওয়ায়, বদনমণ্ডলের অপূর্ব্ব শোভা সম্পাদিত হইয়াছে।

দেওয়ান, বিনোদিনীর এই অপূর্ব্ব অমানুষী-মূৰ্ত্তি দেখিতে দেখিতে বিমোহিতচিত্তে তাঁহার নিকটে আসিয়া বসিলেন, এবং তাঁহার সুকোমল করকমল নিজ করতলে গ্রহণ করিয়া সস্নেহবচনে বলিলেন, “তুমি করছ কি? এত রৌদ্রে বসতে হয়? সে কি, তুমি কাঁদছ কেন? “

বিনোদিনী কোন উত্তর না করিয়া অধিকতর আবেগসহকারে কাঁদিতে লাগিলেন।

দেও। কি হয়েছে বিনোদ, বল না, কাঁদ কেন?

বিনো। না কাঁদিনি।

এই সময় দাসী আসিয়া বলিল, “এই যে দেখা পেয়েছেন, হেঁ গা বাবু, তুমি কেমন গা। জান, উনি কেমন ভয়-তরাসে—কাল সমস্ত রাত্রে একবার কি বাড়ীতে আসতে নাই। কাল যে করে রাত পুইয়েছে, তা আমি জানি, আর উনি জানেন। সমস্ত রাত্রি কি একবার চোখে-পাতায় করেছেন, না করতে দিয়েছেন—যেই তন্দ্রা আসে, অমনি বলেন, ‘ও ঝি ঘুমুলি গা, আমার বড় ভয় করছে।’ এমন ভয়-তরাসে মেয়ে, বাবু কখনও দেখিনি। আর তুমিও বাবু বিদেশ থেকে এসেছ, দুদিন বাড়ীতে থাক, দুদিন ঘরকন্না দেখ। বাহিরের আমোদ-আহ্লাদ কোন্ ফুরিয়ে গেছে।

দেও। আ-মর্! তুই বলছিস্ কি রে?

দাসী। বাবু, তোমার নিমক খাই, তাই বলি; না হলে আমার বলবার দরকার কি? বাবু, হক্কথা বললে বন্ধু বিগড়ায়, তুমি যে গহনাগুলি সেই মাগীকে দিয়েছ, সেগুলি এঁকে দিলে তোমারই থাকত। সে কি কম গহনাটা গা! মাগীকে যেন রাস গাছ সাজিয়েছ।

দেও। আরে তুই মেলা কি এত বলছিস্, পাগল হয়েছিস্ না কি?

দা। বাবু, আমি পাগল হই নাই, তুমিই পাগল হয়েছ। না হলে এমন সোনার পিয়তিমেকে ফেলে, একটা লক্ষ্মীছাড়া মাগীকে নিয়ে ভাস।

দেও। তুই যে আমায় জ্বালাতন করে তুললি, আমি কাকে নিয়ে ভেসেছি রে?

দা। কা’কে নিয়ে ভেসেছ, তাকি আপনি জান না? কাকে কাল সন্ধ্যাবেলা সাজিয়ে-গুজিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে বাবু? আমি কি তা’ দেখিনি?

দেওয়ান ঈষদ্ধাস্য করিয়া বলিলেন, “তাই হোক, তুই কোথা থেকে দেখলি?”

দা। আমি যেখান থেকেই দেখি না কেন, কাজটা কি তোমার ভাল হয়েছে, বাবু?

দেও। যে গহনাগুলি তার গায়ে দেখেছিস, সেগুলি সব আমি বিনোদের জন্য এনেছি। সেই গহনার জন্যই পথে আমার এত বিপদ ঘটেছিল।

দেওয়ান এই কথা বলিয়া ছাদের ধারে গিয়া ভীম সদারকে ডাকিয়া গহনার বাক্স আনিতে বলিলেন। দাসী কিয়ৎকাল নীরবে থাকিয়া বলিল, “আচ্ছা বাবু, এঁর জন্যই যদি গহনাগুলি এনেছিলে, তবে তা’কে সেগুলি পরালে কেন?”

দেও। সে কে? সে কি মেয়ে মানুষ?

এই সময় ভীম সর্দ্দার বাক্স লইয়া আসিল।

দাসী। হেঁরে ভীমে, এই গহনাগুলি কাল কে পরেছিল, তুই ঠিক কথা বলত।

ভীম। কেন? চিনিবাস ঠাকুর।

দাসী। হেঁ, চিনিবাস ঠাকুর! তাকে ত ডাকাতে মেরে ফেলেছে। তার মা মাগী রাতদিন কেঁদে কেঁদে মরছে।

ভীম। না গো না, তিনি কাল সকাল বেলা এসেছেন।

বিনোদিনী অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “আহা, মায়ের বাছা! মার কাছে এসেছে, বেশ হয়েছে। বামুন ঠাকুর এসেছে কি?”

দেও। না, সে যে কোথা ভেসে গেছে, তার আর ঠিকানা হল না, শ্রীনিবাসও অনেক কষ্টে বেঁচে এসেছে।

ভীম। বামুন ঠাকুরও এসেছেন।

দেও। অ্যাঁ, কখন এলেন?

ভীম। আপনি অন্দরে আসবার একটু পরেই তিনি এলেন।

এই সময়ে বহির্বাটীতে মহা কোলাহল উপস্থিত হইল, পরক্ষণেই বিস্ফারিতনেত্রে কম্পান্বিত কলেবর দেওয়ানের ভগিনীপতি হরজীবন কুমার তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

দেও। কি কুমারজী, কি হয়েছে, এত গোলযোগ কিসের?

হর। এত কাণ্ডও করতে পার! কি সর্ব্বনাশ করলে বল দেখি।

দেও। হয়েছে কি?

হর। তোমার নামে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা এসেছে, দেউড়িতে দারোগা, জমাদার এসে মহা হাঙ্গামা করছে, দেশের লোক ভেঙ্গে পড়েছে, তুমি করেছ কি?

দেও। আমি ডাকাত মেরেছি, আর ডাকাত ধরেছি।

এই কথা বলিয়া তিনি প্রাসাদ-শিখর হইতে অবতরণ করিয়া বহির্বাটীতে গমন করিলেন।

সকল অধ্যায়

১. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পাখীর বাগান
২. প্রথম পরিচ্ছেদ – গঙ্গা-হৃদয়ে
৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্ন্যাসীর আশ্রম
৫. পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ঘোষেদের বাটী
৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পরামর্শ
৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – দেউলপোতা
৮. অষ্টম পরিচ্ছেদ – রাঘব সেনের বাটী
৯. নবম পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী
১০. দশম পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর
১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গঙ্গাবক্ষে
১৩. ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – পূজাবাটী
১৪. চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – পাতালপুরী
১৫. পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী
১৬. ষোড়শ পরিচ্ছেদ – দেওয়ানের বহির্বাটী
১৭. সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – পূজাবাটী
১৮. অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
১৯. ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – মুদির দোকান
২০. বিংশ পরিচ্ছেদ – দেওয়ানের বৈঠকখানা
২১. একবিংশ পরিচ্ছেদ – ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’
২২. দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী
২৩. ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – জুলিয়ার এজাহার
২৪. চতুৰ্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ – শিকার-ভ্রষ্ট শার্দ্দূল
২৫. পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – আত্মগ্লানি
২৬. ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ – ফৌজদারী-বালাখানা
২৭. সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – উপবনে
২৮. অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ – রাঘবের বাটী
২৯. ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ – রাঘবের উদ্যান
৩০. ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শ্বশুর ও জামাতা
৩১. একত্রিংশ পরিচ্ছেদ – পিঞ্জরে বিহঙ্গিনী
৩২. দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ – তদারক v
৩৩. ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – বিজয়া

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন