একবিংশ পরিচ্ছেদ – ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’

পাঁচকড়ি দে

একবিংশ পরিচ্ছেদ – ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’

গম্ভীর রজনী, চতুৰ্দ্দিক নিস্তব্ধ।

পুরীর বাহিরে তিনবার হরিধ্বনি হইল, রত্না উঠিয়া বসিল, মনে মনে বলিল, “অয়মেব সময়ঃ।” দেখিল, নিত্যানন্দ ঘুমাইতেছে, গড় গড় করিয়া তাহার নাক ডাকিতেছে, রত্না আপনার গাঁট্‌রিটি লইয়া গৃহের বাহিরে আসিয়া দ্বারে শিকল লাগাইয়া দিল; এবং সাবধানে নিঃশব্দপদসঞ্চারে তোসাখানার নিকটে আসিয়া দেখিল, দুইজন খানসামা অগাধ নিদ্রা যাইতেছে, সে ঘরেও শিকল লাগাইয়া দিল; পরে দেউড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল; তথায় একটি আলোক জ্বলিতেছে, ঢাল, তলবার, টাঙ্গী, বর্সা প্রভৃতি অস্ত্র সকল স্থানে স্থানে ঝুলিতেছে এবং দ্বারবান্ টিকারাম চিৎপাত হইয়া ভুঁড়ি ফুলাইয়া ঘুমাইতেছে; মুখ-নিঃসৃত বায়ুসঙ্ঘাতে তাহার শূকর- লোম- সদৃশ গুম্ফরাজি ক্ষণে ক্ষণে নৃত্য করিতেছে।

রত্না মনে মনে বলিল, “এ বেটাকে কি করিব, এ ভোজপুরী, জাগ্রত হইলে বড়ই গোলমাল করিবে; ইহাকে হত্যা করিলে আমি যে ফিকির করিয়াছি, তাহা বিফল হইবে–দেওয়ানকে দোষী প্রমাণ করিতে পারিব না, প্রত্যুত রাঘবকে বিপদগ্রস্ত হইতে হইবে। না, ইহাকে মারা হইবে না।”

তখন রত্না আপনার গাঁট্‌রি হইতে একগাছি সুদৃঢ় রজ্জু বাহির করিয়া টিকারামকে খাটিয়া সহ বান্ধিয়া ফেলিল। দ্বারবান্ চীৎকার করিয়া উঠিলে সে প্রাচীর গাত্র হইতে একখানি শাণিত তরবারী খুলিয়া তাহাকে ভয় প্রদর্শন করিল। দ্বারবান্জী নীরব হইয়া রহিল।

তখন রতন শর্ম্মা গাঁটরিটি কটিদেশে বাঁধিয়া লইয়া করস্থ তরবারী দ্বারবানের মুখের নিকটে সঞ্চালনপূর্ব্বক বলিল, “এসাহি রহনা, সম্‌ঝা।”

এই বলিয়া রতন শর্ম্মা সোপানশ্রেণী দ্বারা দ্রুতবেগে ছাদে উঠিয়া গেল; দেখিল, চন্দ্ৰমা অস্ত গিয়াছে, সুনিৰ্ম্মল নভস্তল হীরক-খচিত নীলাম্বরের ন্যায় শোভা পাইতেছে। সে অনাবৃত ছাদের উপর দিয়া চারিদিকে সাবধান দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে করিতে দেওয়ানের শয়ন-মন্দিরের দ্বারদেশে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং যন্ত্রসংযোগে একটি গবাক্ষের সন্ধিবন্ধনী চারিখানি ইষ্টক কৌশলে খুলিয়া ফেলিয়া জানালাটি বাহির করিয়া লইল। দেখিল, গৃহে আলোক জ্বলিতেছে এবং দেওয়ান ও তদীয় সহধৰ্ম্মিণী নিশ্চলে নিদ্রা যাইতেছে। ভাবিল, “বেশ সময়ে আসিয়াছি; কিন্তু সে বাক্সটি কোথায়? দেওয়ান বলিয়াছে, সে বাক্স সিন্দুকে তুলে নাই, অবশ্যই এই গৃহমধ্যে কোন স্থানে আছে।” এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে রতন শর্ম্মা ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে লাগিল, কিন্তু কোথায়ও তাহা দেখিতে পাইল না।

“তবে কি দেওয়ান মিথ্যা বলিয়াছে? না, তাহা কখনই হইতে পারে না, সে, যে প্রকার তেজস্বী ও সাহসী, কখনই বৃথা গৰ্ব্ব করিবে না,” এইপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে রতন শর্ম্মা পর্য্যঙ্কের পশ্চাদ্দিকে আসিয়া দেখিল, একটি কুলুঙ্গির উপরে সেই বাক্সটি রহিয়াছে।

রতন শৰ্ম্মা অভীষ্টসিদ্ধ করিয়া ব্যস্তভাবে যেমন নিষ্ক্রান্ত হইবে, পর্যঙ্কপদে তাহার পদ সংলগ্ন হওয়ায় সে অপহৃত দ্রব্যসহ গৃহতলে পড়িয়া গেল; সেই শব্দে দম্পতির নিদ্রা ভঙ্গ হইল। দেওয়ান “কেও কেও” বলিয়া লাফাইয়া উঠিলেন। বিনোদিনী কক্ষদ্বারে দস্যুর ভীষণ মূর্ত্তি দেখিয়া ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেন।

রতন শর্ম্মা তৎক্ষণাৎ উত্থিত হইয়া সন্ধিপথে আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আমার নাম রতন শর্ম্মা—প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিয়া চলিলাম, আশীর্ব্বাদ করি, তুমি চিরজীবী হও।”

গোবিন্দরাম আহত শার্দুলের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া তাহার প্রতি ধাবিত হইলেন। রত্না হুঙ্কার সহকারে লম্ফ প্রদানে ত্রিতলোপরি উঠিয়া দাঁড়াইল; সেখান হইতে বলিল, “দেওয়ান, তুমি এই রত্নরাজির নিমিত্ত দুঃখ করিও না, তুমি ধৰ্ম্মপথে থাকিয়া অক্ষয় ধনের অধিপতি হইবে, তুমি বিদ্বান্, বুদ্ধিমান ও উদ্যোগী, তুমি অতুল অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারিবে।”

দেওয়ান ভীম সর্দ্দারকে ডাকিলেন, টিকারামকে ডাকিলেন, কিন্তু কাহারই উত্তর পাইলেন না, তিনি ত্রিতলোপরি উঠিয়া গেলেন; দেখিলেন, রত্না আর সেখানে নাই। তখন দ্রুতপদে প্রাসাদশিখর হইতে অবতরণ করিয়া বহির্বাটীতে আসিয়া দেখিলেন, দ্বারবান্ খাটিয়াসহ আবদ্ধ ও সদর দরজা অবরুদ্ধ রহিয়াছে।

তিনি দ্বারোদঘাটনপূর্ব্বক রাজপথে উপস্থিত হইয়া ভীম সদারকে ডাকিতে ডাকিতে শুনিতে পাইলেন, কে যেন ক্ষীণস্বরে কি বলিতেছে। তিনি সেই স্বরানুসরণে পশ্চিমাভিমুখে কিয়দ্দূর যাইয়াই ভীমসদারকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরে ভীমে, এখানে অমন করে বসে রয়েছিস যে, তুই ছিলি কোথা? মদ খেয়ে বুঝি কোথা পড়েছিলি?”

ভীম। আজ্ঞা, আজকের রাত্রেই আমার মদ খাবার সময় কি না? আপনার বিপদের দিনেই আমি আমোদ করব না ত আর কবে করব? আপনার নিমক খেয়েছি, কিন্তু আপনার কাজ করতে পারলুম না, এই আমার বড় দুঃখ রইল। বেটারা আমাকে একেবারে মেরে ফেলে গেল না কেন?

দেও। তোকেও মেরেছে নাকি?

ভীম। বাবু, আমার ডান-পাটার দফা একেবারে সেরে দিয়ে গিয়েছে।

দেও। বেটারা বাড়ী ঢুকল কোন্ দিক দিয়া! তোকে যেমন বলেছিলাম—বাড়ীর চারিদিকে পাহারা দিয়েছিলি ত?

ভীম। বাবু, আমি বেশ বলতে পারি, রাত্রি একটা পর্য্যন্ত ইঁদুরটিও বাড়ীর ভিতর ঢুকতে পারে নি। তারপর বাবু আমার একটুকু কসুর হয়েছিল। আমি ভাবলেম, রাত্রি একটা হয়ে গেল, এখন পর্যন্তও যখন কোন সাড়া-শব্দ নাই, তখন আজ আর ডাকাতি হবে না, এই ভেবে আধ ঘণ্টার জন্য কেবল একবার ও পাড়ায় যাত্রা শুনতে গিয়াছিলাম, সেখান থেকে ফিরে যেই গোলাবাড়ীর ধার পর্যন্ত এসেছি, আর কে এক বেটা আপনার ঘরের ছাদ থেকে, রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল; আমি তৎক্ষণাৎ তাকে গিয়ে ধরলেম, সে-ও জোর করতে লাগল; আমিও তাকে তখন কায়দা করবার চেষ্টা করতে লাগলেম, এমন সময়ে, আর একরেটা পিছু থেকে এসে আমার পায়ে লাঠী মারল, আমি পড়ে গেলাম, তারা দুজনে উর্দ্ধশ্বাসে পালিয়ে গেল।

দেও। ভীম, তোর কিছুই কশুর হয় নাই। আমারই একটু সাবধানে থাকা উচিত ছিল। এখন বেশ বুঝতে পারছি, কাল যে বামুণ অতিথি হয়ে এসেছিল, সে-ই—রত্নাপাখী। যা হবার হ’য়ে গেছে। তোকে কি বেশী লেগেছে?

ভীম। আজ্ঞা, বড় না লাগলে, আমি এমন করে বসে থাকি না।

দেও। আচ্ছা, আমি টিকারামকে পাঠিয়ে দিই গিয়া, তোকে ধরে বাড়ী নিয়ে যাবে এখন। সে বেটাকে ত মড়ম্বা করে বেঁধে রেখে গেছে, বোধ হয়, সে বেটা ঘুমিয়ে পড়েছিল।

দেওয়ান বাড়ী আসিয়া, দ্বারবানের বন্ধন খুলিয়া, ভীমের কাছে পাঠাইয়া দিয়া দেখিলেন, সকল ঘরেরই দরজায় শিকল দেওয়া, শিকল খুলিয়া দিলে বাড়ীশুদ্ধ সমস্ত লোক একত্র হইয়া ‘হা হতোহস্মি’ করিতে লাগিল; এবং হলধর ঘোষ বলিলেন, “বাপু, আমার যে জন্য আশা, আইস, তাহা এই দণ্ডে করা যাউক, আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব করা কর্ত্তব্য নয়; চল, একটু ফরসা হলেই তোমায় আমায় কলিকাতায় বিশ্বনাথ ঘোষের কাছে যাই। তিনি অবশ্যই এই অত্যাচারের একটা প্রতীকার করিবেন। “

দেওয়ান। যে আজ্ঞা, তবে আপনি প্রস্তুত হউন। আমিও বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া আসি।

সকল অধ্যায়

১. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পাখীর বাগান
২. প্রথম পরিচ্ছেদ – গঙ্গা-হৃদয়ে
৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্ন্যাসীর আশ্রম
৫. পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ঘোষেদের বাটী
৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পরামর্শ
৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – দেউলপোতা
৮. অষ্টম পরিচ্ছেদ – রাঘব সেনের বাটী
৯. নবম পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী
১০. দশম পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর
১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গঙ্গাবক্ষে
১৩. ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – পূজাবাটী
১৪. চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – পাতালপুরী
১৫. পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী
১৬. ষোড়শ পরিচ্ছেদ – দেওয়ানের বহির্বাটী
১৭. সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – পূজাবাটী
১৮. অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
১৯. ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – মুদির দোকান
২০. বিংশ পরিচ্ছেদ – দেওয়ানের বৈঠকখানা
২১. একবিংশ পরিচ্ছেদ – ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’
২২. দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী
২৩. ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – জুলিয়ার এজাহার
২৪. চতুৰ্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ – শিকার-ভ্রষ্ট শার্দ্দূল
২৫. পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – আত্মগ্লানি
২৬. ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ – ফৌজদারী-বালাখানা
২৭. সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – উপবনে
২৮. অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ – রাঘবের বাটী
২৯. ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ – রাঘবের উদ্যান
৩০. ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শ্বশুর ও জামাতা
৩১. একত্রিংশ পরিচ্ছেদ – পিঞ্জরে বিহঙ্গিনী
৩২. দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ – তদারক v
৩৩. ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – বিজয়া

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন