মহাপ্লাবন – ৬১

কাজী আনোয়ার হোসেন

একষট্টি

সাত দিন পর।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বিশাল ভবনটাকে বাইরে থেকে দেখে স্বচ্ছ কাঁচের বাড়ি ভাবলেও ভুল হবে না। একটু আগে ওখানে হাজির হয়েছে রানা, সোহেল, আসিফ, তানিয়া, হিনা ও পুলিশ সুপারইন্টেণ্ডেণ্ট উবোন হিমুরা।

আধুনিক, রুচিশীল আসবাবপত্রে শোভিত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অতিথিদেরকে বসাল সুন্দরী মেইডরা। চলে গেল ঘর ছেড়ে।

একমিনিট পেরোবার আগেই আবারও খুলে গেল দরজা, ভেতরে ঢুকলেন জাপানি প্রাইম মিনিস্টার। সবার উদ্দেশে বাউ করলেন তিনি।

তাঁকে সম্মান দেখাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাউ করল সবাই।

আগে সবাইকে বসতে ইশারা করলেন প্রধানমন্ত্রী। বসার পর নিজ চেয়ারে বসে হাতের দু’কনুই রাখলেন কাঁচ ঢাকা টেবিলে। নরম সুরে বললেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ, অনুরোধে সাড়া দিয়ে আজ এসেছেন আপনারা। মিস্টার রানা, মিস্টার আহমেদ, হিনা বা সুপারইণ্টেণ্ডেণ্টকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ দিচ্ছি। সেদিন আপনারা না থাকলে বিদায় নিতাম পৃথিবী ছেড়ে।’ একটু থেমে বললেন, ‘মিস্টার রেজা এবং তাঁর স্ত্রীর কারণে মস্তবড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে এ বিশ্ব। আমরা জাপানের সবাই আপনাদের কাছে ঋণী।’

চুপ করে আছে অতিথিরা। লিউ ফু-চুং-এর কাছ থেকে জরুরি কিছু তথ্য পেয়েছে রানা। তবে ওরা কেউ জানে না আজ কেন ডাকা হয়েছে ওদেরকে।

‘মিস্টার রানা,’ বললেন প্রাইম মিনিস্টার। ‘ঠিক আপনার নির্দেশিত জায়গাতেই আমরা পেয়েছি জাতীয় সম্পদ সেসব তলোয়ার। সেজন্যে আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। … অন্যান্য বিষয়ে আপনাদের কৌতূহল থাকার কথা। তাই বলছি, লো হুয়াঙের তৈরি রোবট ব্যবহার করেই চিন ও জাপানের প্রকৌশলীরা বন্ধ করেছেন সাগরতলের সব ফাটল। আমরা এখন নিশ্চিত, মানব-সভ্যতা সাগরের নিচে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই।’

‘ধন্যবাদ, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার,’ বলল সোহেল। ‘শুনে খুশি হলাম।’

‘আরও কিছু বিষয়ে আলাপ হয়েছিল ফোনে আপনার সঙ্গে, বলল রানা। ‘সে বিষয়ে কিছু বলবেন, স্যর?’

মৃদু মাথা দোলালেন জাপানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটা। ‘আপনার কথা শোনার পর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। একে একে বলছি।’ উবোন হিমুরার দিকে চেয়ে হাসলেন তিনি। উঠে মোটা খাম বাড়িয়ে দিলেন পুলিশ অফিসারের দিকে। ‘খুলুন।’

খাম নিয়ে সাবধানে খুললেন হিমুরা। ভেতর থেকে বের করলেন কাগজ। পড়তে শুরু করেছেন। দু’মিনিট পর মুখ তুলে একবার প্রাইম মিনিস্টার আরেকবার রানাকে দেখলেন তিনি। দুই চোখ ভরে গেছে অশ্রুতে।

‘মিস্টার রানার কথায় নিয়েছি জরুরি পদক্ষেপ,’ বললেন প্রাইম মিনিস্টার। ‘একজন অফিসার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পঙ্গু হলে কেন তাঁকে চাকরি থেকে অবসর দিতে হবে? কেবিনেটের সবার সঙ্গে আলাপের পর ঠিক হলো, দেশের জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন এমন মানুষগুলোকে পঙ্গু আখ্যা দিয়ে তাঁদের জীবনটা নষ্ট করে দেব না আমরা। হিমুরা আপনি পড়েছেন নতুন নিয়োগপত্র। এরপর কী করবেন আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে আমি চাই, যোগ দেবেন নাগাসাকির পুলিশ কমিশনার হিসেবে। গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন বলে আপনাকে দেয়া হয়েছে একইসময়ে কয়েকটি পদোন্নতি। এ সবই আপনার প্রাপ্য ছিল।’

রানার দিকে চাইলেন হিমুরা। টপটপ করে গালে পড়ল অশ্রু। ভাঙা গলায় বললেন, ‘মিস্টার রানা, আপন ভাইও এত করত না আমার জন্যে। দুটো ছেলে-মেয়ে আমার। মানুষ করতে হবে। ভেবেছিলাম শহরের কোনও গলিতে ছোট একটা দোকান নিয়ে বসব। তবে আপনি যা করলেন আমার জন্যে, কখনও শোধ দিতে পারব না, স্যর…’ প্রচণ্ড আবেগে মুখ থেকে কথা হারিয়ে গেছে মানুষটার।

‘বসে পড়ুন, কমিশনার,’ তাঁকে বসতে ইশারা করলেন প্রাইম মিনিস্টার। উবোন হিমুরা বসার পর বললেন, ‘আরও একজন আছে, যার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তার কথাও বলেছেন মিস্টার রানা। ভেবে দেখলাম, আইন সামান্য বদলে নিলে ক্ষতি কী?’

আরেকটা খাম ড্রয়ার থেকে নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন টেবিলের ওপর দিয়ে। ‘হিনা, এটা তোমার জন্যে।’

‘আমার জন্যে?’ অবাক হয়েছে মেয়েটা।

‘খুলে দেখো কী আছে।’

খাম ছিঁড়ে কাগজ নিয়ে পড়ল হিনা। কপালে উঠল ওর দুই চোখ।

হাসলেন প্রাইম মিনিস্টার। ‘আপত্তি না থাকলে যোগ দাও পুলিশ অফিসারের পদে। তুমি চাইলে কাজ জুটিয়ে দেব কমিশনার হিমুরার অফিসেই। …কী, রাজি?’

একপলক প্রাইম মিনিস্টারকে দেখল হিনা, তারপর চেপে ধরল রানার হাত। ‘আপনি কি মানুষ, রানা, না দেবতা?’

‘জঘন্য লোক,’ মৃদু হাসল রানা। ‘এসব করার সাধ্য আমার নেই, সব করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী।’

‘তবে খুন হলে কিছুই করতে পারতাম না, তাই আবারও বলছি: আপনাদেরকে ধন্যবাদ,’ বললেন প্রধানমন্ত্রী।

রানা ও প্রাইম মিনিস্টারের উদ্দেশে বলল হিনা, ‘অফিসার হিমুরার দোকান করার উপায় ছিল, কিন্তু আমার সে টাকাও নেই।’ মাথা নাড়ল। ‘ভেবেছিলাম ফিরব ইয়াকুয়া দলে। বাকি জীবন পার করব ক্রীতদাসী হিসেবে। ভাবিনি হঠাৎ এভাবে খুলবে জীবনের পথ। আমি আপনাদের সবার কাছেই কৃতজ্ঞ। খুশি মনে কাজ করব হিমুরা স্যরের অফিসে।’

‘এবার অন্য বিষয়,’ বললেন প্রাইম মিনিস্টার, ‘মিস্টার রানা ও মিস্টার আহমেদ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের অফিসের নিয়ম অনুযায়ী তাঁরা কোনও পুরস্কার নিতে পারবেন না। কিন্তু এ আইন নেই আসিফ রেজা এবং তাঁর স্ত্রী তানিয়া রেজার অফিস নুমায়। তাই তাঁদের জন্যে জাপান থেকে দেয়া হচ্ছে বিশেষ সম্মাননা।’ আবারও চেয়ার ছেড়ে মখমলে মোড়া মাঝারি দুটো ফ্রেম আসিফ ও তানিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

চেয়ার ছেড়ে ও-দুটো নিল স্বামী-স্ত্রী।

‘নাগরিকত্ব সনদ,’ বললেন প্রধানমন্ত্রী, ‘এটা জাপানের কোটি মানুষের শ্রদ্ধা আপনাদের প্রতি।’ আবারও রানা ও সোহেলকে দেখলেন। ‘আমাদের কপাল এত ভাল নয় যে মিস্টার রানা ও মিস্টার আহমেদকে এ দেশের মানুষ বলে ধরে নেব। তবে জেনেছি, মানুষের বিপদে তাঁরা জীবন বাজি ধরতেও দ্বিধা করেন না। অনুরোধ করব, তাঁরা যেন ক’টা দিন বেড়িয়ে যান আমার বাড়ি থেকে।’

খুশি হয়ে রানার দিকে তাকাল সোহেল। আরও কিছু কাজ আছে ওর এ দেশে। হিনাকে কথা দিয়েছে, দু’জন মিলে মেরামত করবে পুরনো একটা গাড়ি।

‘আমার আপত্তি নেই,’ বলতে গিয়েও থেমে গেল রানা। মৃদু আওয়াজ তুলেছে পকেটে মোবাইল ফোন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে কল রিসিভ করল ও। ‘জী, স্যর।’

ফোন বিসিআই চিফের।

‘জরুরি কাজে ইমিডিয়েটলি ফিরছ সোহেল ও তুমি। নতুন করে অর্গানাইয করবে এ দেশের ড্রাগ লর্ডদের বিরুদ্ধে পুলিশ- বাহিনীকে।’ খুট করে কেটে গেল কল।

সোহেলের দিকে তাকাল রানা। ‘তোর ছুটি শেষ!’

‘আর তোর?’

‘আমারও!’

চেয়ে আছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী।

তাঁর দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল রানা। ‘পরের ফ্লাইটেই দেশে ফিরতে হচ্ছে। তবে কখনও এ দেশে এলে, আপনার সময় থাকলে দেখা করে যাব আমরা।’

‘বুঝলাম জরুরি কাজ,’ বললেন প্রাইম মিনিস্টার, ‘তবে আপনারা নিশ্চয়ই চান না আমি অর্ধেক খুন হই? তাই বলছি, লাঞ্চ করবেন আমাদের সঙ্গে। আপনাদের সবার সম্মানে নিজে রান্না করছেন আমার স্ত্রী।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা ও সোহেল। টুকটাক কথা শুরু হলো সবার ভেতর। একটু পর এল খাবারের ডাক।

‘চলুন, মহিলা খেপে যাওয়ার আগেই আপনাদেরকে নিয়ে যাই ডাইনিং রুমে,’ উঠে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। সবাইকে নিয়ে রওনা হয়ে ভাবলেন, সত্যিই সোনা দিয়ে তৈরি এদের অন্তর। বিশেষ করে ওই মাসুদ রানা! খুব ভাল হতো নির্ভর করার মত এমন কাউকে পাশে পেলে!

***

অধ্যায় ৬১ / ৬১

সকল অধ্যায়

১. মহাপ্লাবন – ১
২. মহাপ্লাবন – ২
৩. মহাপ্লাবন – ৩
৪. মহাপ্লাবন – ৪
৫. মহাপ্লাবন – ৫
৬. মহাপ্লাবন – ৬
৭. মহাপ্লাবন – ৭
৮. মহাপ্লাবন – ৮
৯. মহাপ্লাবন – ৯
১০. মহাপ্লাবন – ১০
১১. মহাপ্লাবন – ১১
১২. মহাপ্লাবন – ১২
১৩. মহাপ্লাবন – ১৩
১৪. মহাপ্লাবন – ১৪
১৫. মহাপ্লাবন – ১৫
১৬. মহাপ্লাবন – ১৬
১৭. মহাপ্লাবন – ১৭
১৮. মহাপ্লাবন – ১৮
১৯. মহাপ্লাবন – ১৯
২০. মহাপ্লাবন – ২০
২১. মহাপ্লাবন – ২১
২২. মহাপ্লাবন – ২২
২৩. মহাপ্লাবন – ২৩
২৪. মহাপ্লাবন – ২৪
২৫. মহাপ্লাবন – ২৫
২৬. মহাপ্লাবন – ২৬
২৭. মহাপ্লাবন – ২৭
২৮. মহাপ্লাবন – ২৮
২৯. মহাপ্লাবন – ২৯
৩০. মহাপ্লাবন – ৩০
৩১. মহাপ্লাবন – ৩১
৩২. মহাপ্লাবন – ৩২
৩৩. মহাপ্লাবন – ৩৩
৩৪. মহাপ্লাবন – ৩৪
৩৫. মহাপ্লাবন – ৩৫
৩৬. মহাপ্লাবন – ৩৬
৩৭. মহাপ্লাবন – ৩৭
৩৮. মহাপ্লাবন – ৩৮
৩৯. মহাপ্লাবন – ৩৯
৪০. মহাপ্লাবন – ৪০
৪১. মহাপ্লাবন – ৪১
৪২. মহাপ্লাবন – ৪২
৪৩. মহাপ্লাবন – ৪৩
৪৪. মহাপ্লাবন – ৪৪
৪৫. মহাপ্লাবন – ৪৫
৪৬. মহাপ্লাবন – ৪৬
৪৭. মহাপ্লাবন – ৪৭
৪৮. মহাপ্লাবন – ৪৮
৪৯. মহাপ্লাবন – ৪৯
৫০. মহাপ্লাবন – ৫০
৫১. মহাপ্লাবন – ৫১
৫২. মহাপ্লাবন – ৫২
৫৩. মহাপ্লাবন – ৫৩
৫৪. মহাপ্লাবন – ৫৪
৫৫. মহাপ্লাবন – ৫৫
৫৬. মহাপ্লাবন – ৫৬
৫৭. মহাপ্লাবন – ৫৭
৫৮. মহাপ্লাবন – ৫৮
৫৯. মহাপ্লাবন – ৫৯
৬০. মহাপ্লাবন – ৬০
৬১. মহাপ্লাবন – ৬১

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন