মৃত্যুঘণ্টা – ১৩

আনোয়ার হোসেন

তেরো

‘ভয়ে বুক কাঁপছিল, এত ওপর থেকে নদীতে পড়ে মরেই গেছ বুঝি,’ রানাকে বলল এলেনা।

‘আমি যমের অরুচি,’ হাসল রানা।

‘কিন্তু গেলে কেন ওদের পেছনে?’

‘তার আগে বলো, তুমি পিছু নিলে কেন?’

‘ভাবলাম তোমার না খারাপ কিছু… তাই…’ কাঁধ ঝাঁকাল এলেনা। ‘আমাদের আসলে দূর থেকে বোট দেখলেই চলত। পুলিশকে জানিয়ে দিলে ওরাই সব করত।’

‘ওরা ততক্ষণে পালিয়ে যেত,’ বলল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা দোলাল এলেনা।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে সম্মানের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ওদেরকে। তার আগে গ্রেফতার করে একঘণ্টা রেখেছিল প্রস্রাবের দুর্গন্ধ ভরা অন্ধকার এক সেলে। তারপর হাজির হলেন পুলিশের এক বড়কর্তা। নতুন করে রানা ও এলেনার পরিচয়  জেনে ফিরে গেলেন। তাঁর চেহারা দেখে মনে হয়েছে, ওদের কথা মোটেও বিশ্বাস করেননি তিনি

পেরিয়ে গেল বিশ মিনিট। আবারও ফিরলেন ভদ্রলোক। নতুন করে আবারও জ্বেলে দেয়া হলো সেলের বাতি। রানা ও এলেনা দেখল, সাদা মুলোর চওড়া দোকান খুলেছেন পুলিশের বড়কর্তা।

‘সরি, মিস্টার রানা, সরি, মিস রবার্টসন,’ দুঃখিত কণ্ঠে বললেন। ‘একটু দেরি হলো আপনাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে।’

‘নিশ্চিত ছিলাম যে আমি আসলে আমিই আছি,’ বলল বিরক্ত রানা।

‘কিন্তু আমরা তো আর জানতাম না,’ হাসলেন ভদ্রলোক। ‘যাক সেসব, প্রথমে যোগাযোগ করেছি ইন্টারপোলে। তারপর এনআরআই-এ। অবশ্য, মিস্টার রানা, আপনার ব্যাপারে আরও আগেই নিশ্চিত হয়েছি আমার বস মোসিউ আঁদ্রে মার্কসের কাছ থেকে। উনি আপনার অধীনে ইউএন-এর অ্যান্টি টেরোরিস্ট ইউনিটে কাজ করেছেন। বললেন, অন্তত তিনবার তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছেন আপনি নানান মিশনে। উনি দেশের বাইরে আছেন, নইলে এতক্ষণে নিজেই হাজির হতেন। ইন্টারপোল থেকেও নিয়েছি তথ্য। আর মিস রবার্টসনকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ এসেছে আমেরিকান এনআরআই থেকে। পুরনো কোনও বাজে রেকর্ড নেই তাঁর। তার ওপর আমাদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে: পুলিশের গাড়ির ক্ষতি করা, এক লোকের ভাড়া- দেয়া বোট ডুবিয়ে দেয়া, একজনের গাড়ি ও এক তরুণের মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও নষ্ট হওয়া… সবকিছুর সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেবে এনআরআই। কাজেই আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে আদালতে কোনও অভিযোগ তুলছি না।’

‘আমরা তা হলে চলে যেতে পারি?’ জানতে চাইল রানা।

‘পারেন,’ মাথা দোলালেন পুলিশ অফিসার। ‘কিন্তু তার আগে একটা অনুরোধ করব।’

‘কী ধরনের অনুরোধ? জানতে চাইল রানা।

ফ্রেঞ্চ পুলিশ অফিসার পকেট থেকে ছোট এক নোটবই নিয়ে নির্দিষ্ট পাতা বের করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ‘এই নোটবই আমার ছেলের। ওর বয়স আট। মা-র কাছ থেকে বাবার ঝুঁকিপূর্ণ সব কাজের কথা শুনে নোটবইয়ে সংক্ষেপে লিখে রাখে। আজই আমার কাছে এটা দিয়ে বলেছে, ‘বাবা, তোমার মত যাঁরা দুর্দান্ত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের অটোগ্রাফ এনে দেবে। আর যদি পারো, ছবিও।’ কপাল কাকে বলে ছেলের! আজই পেয়ে গেলাম আপনাকে। খুব খুশি হব আমার ছেলের জন্যে অটোগ্রাফ দিলে। ওকে শোনাব, কীভাবে বহু ওপর থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ভয়ঙ্কর এক অপরাধীকে তুলে এনেছেন আপনি। আমার ছেলের ইচ্ছে, এক দিন ওর বাবার মত পুলিশ অফিসার হবে। প্লিয, মিস্টার রানা!’

নোটবই নিয়ে অটোগ্রাফ দিল রানা। ছোট্ট খাতাটা ফেরত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আহত লোকটা মুখ খুলল?’

‘এখনও অজ্ঞান। তবে চেতনা ফিরলে জিজ্ঞাসাবাদ করব।’

‘সায়েন্টিস্ট আহসান মোবারক সম্পর্কে নতুন কিছু জানলেন আপনারা?’ জানতে চাইল রানা।

‘আসুন, আমার অফিসে বসে আলাপ করি,’ বললেন মোসিউ শোঁপা।

তাঁর সঙ্গে সেল থেকে বেরোল ওরা। প্রশস্ত এক অফিসঘরে ওদেরকে নিয়ে এলেন ভদ্রলোক। সবাই বসার পর ডান দিকের ড্রয়ার থেকে বের করলেন এক ফোল্ডার, খুলে বাড়িয়ে দিলেন রানার দিকে। ‘যা আছে, এখানেই।’

মাত্র তিন মিনিটে সব তথ্য পড়া হয়ে গেল রানার।

ওর পাশেই এলেনা, প্রথম ছবি দেখেই ভুরু কুঁচকে গেল ওর।

নির্বিকার চোখে বিজ্ঞানী মোবারকের উলঙ্গ, রক্তাক্ত, মৃতদেহ দেখছে রানা। মানুষটার হাত-পা বাঁধা। প্রচণ্ড নির্যাতন করেছে। চাক চাক রক্ত ত্বকে। ব্লো-টর্চের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে বুক ও পেটের মাংস।

চুপ করে আছে রানা। ফোল্ডার ফেরত দিল।

যে খুন করেছে, সে লাশ ফেলে যেতে পারত যে-কোনও জায়গায়, কিন্তু ইচ্ছে করেই এভাবে রেখে গেছে,’ বললেন শোঁপা।

‘একটা বার্তা দিয়েছে,’ বলল রানা।

মাথা দোলালেন পুলিশের বড়কর্তা।

‘এই বার্তা কার জন্যে?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘পুরো পৃথিবীর জন্যে,’ বললেন শোঁপা, ‘বুকে দেখেছেন পোড়া চিহ্ন? প্রায় দেখাই যায় না।’ আরেকটা ছবি নিয়ে রানার সামনে রাখলেন তিনি। এবারের ছবি ক্লোয-আপ। যেন গরুর মত করে ব্র্যাণ্ড করা হয়েছে মানুষটাকে। ‘জি, ই, এন, টু, ওয়ান ও সেভেন।’

‘এরা এগুলো দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে, জানেন আপনারা?’ ছবি দেখছে রানা।

‘জেনেছি। এসব তুলে দেয়া হয়েছে জেনেসিসের চ্যাপ্টার টু, ভার্স সেভেনটিন থেকে।’

আবারও অক্ষর ও নম্বর দেখল রানা। ওর কোনও কারণ নেই জেনেসিসের ভার্স মুখস্থ করার। কিন্তু ক্যাথোলিক পরিবারের মেয়ে এলেনার মনে পড়তে দেরি হলো না। নিচু স্বরে বলল ও, And ye shall not eat from the tree of knowledge of good and evil. For when you eat of it you shall certainly die.

ভীষণ চমকে গেছে এলেনা। রানাও চিন্তিত।

কর্মজীবনে নানান প্রাণীর জীবন নিয়ে কাজ করেছেন জেনেটিসিস্ট আহসান মোবারক, ভালর জন্যে চেয়েছিলেন নানানভাবে জিন বদলে দিতে। কিন্তু বাইবেলে পরিষ্কার করে স্রষ্টা বলেছেন: পৃথিবীর সমস্ত জীব বা তাদের জীবনের বিষয়ে সবকিছু গোপন করেছেন স্বয়ং তিনি।

মোবারকের বুকে যে বার্তা পুড়িয়ে লেখা হয়েছে, সেটা কি শুধু সতর্ক করে দেয়ার জন্যে? জঙ্গি কোনও দল কাজটা করেছে? তারা চায় না জিন নিয়ে গবেষণা হোক?

‘আমাদের ধারণা, এসব করেছে গোপন কোনও কাল্ট, জোর দিয়ে বললেন শোঁপা। ‘চার পুলিশকে খুন করার পর সায়েন্টিস্ট মোবারককে খুন করেছে এরাই। …আপনারা যদি এদের বিরুদ্ধে কিছু করেন, আমরা খুবই খুশি হব। দয়া করে যোগাযোগ রাখবেন। আমরাও তা-ই করব। কিছু জানলে উভয়পক্ষই উপকৃত হবে।’

‘বেশ,’ বলে উঠে দাঁড়াল রানা।

‘এবার সোজা ভাল কোনও হোটেলে, চেয়ার ছাড়ল এলেনা।

আপত্তি তুলল না রানা।

ওদের সম্মানে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেছেন পুলিশ অফিসার শোঁপা। ‘গুড লাক, মিস্টার রানা, মিস রবার্টসন।’

‘আপনিও ভাল থাকুন।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। বিকেল হয়ে গেছে, রাস্তার জ্যামে খালি কোনও ট্যাক্সি নেই। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে রানা ও এলেনা।

এইমাত্র একটু দূরে থামল একটা ট্যাক্সি। হাত তুলে ওটাকে ডাকল রানা। গাড়িটা পাশে থামতেই চেপে বসল ওরা দু’জন।

‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল,’ ড্রাইভারকে বলল এলেনা।

সকল অধ্যায়

১. মৃত্যুঘণ্টা – ১
২. মৃত্যুঘণ্টা – ২
৩. মৃত্যুঘণ্টা – ৩
৪. মৃত্যুঘণ্টা – ৪
৫. মৃত্যুঘণ্টা – ৫
৬. মৃত্যুঘণ্টা – ৬
৭. মৃত্যুঘণ্টা – ৭
৮. মৃত্যুঘণ্টা – ৮
৯. মৃত্যুঘণ্টা – ৯
১০. মৃত্যুঘণ্টা – ১০
১১. মৃত্যুঘণ্টা – ১১
১২. মৃত্যুঘণ্টা – ১২
১৩. মৃত্যুঘণ্টা – ১৩
১৪. মৃত্যুঘণ্টা – ১৪
১৫. মৃত্যুঘণ্টা – ১৫
১৬. মৃত্যুঘণ্টা – ১৬
১৭. মৃত্যুঘণ্টা – ১৭
১৮. মৃত্যুঘণ্টা – ১৮
১৯. মৃত্যুঘণ্টা – ১৯
২০. মৃত্যুঘণ্টা – ২০
২১. মৃত্যুঘণ্টা – ২১
২২. মৃত্যুঘণ্টা – ২২
২৩. মৃত্যুঘণ্টা – ২৩
২৪. মৃত্যুঘণ্টা – ২৪
২৫. মৃত্যুঘণ্টা – ২৫
২৬. মৃত্যুঘণ্টা – ২৬
২৭. মৃত্যুঘণ্টা – ২৭
২৮. মৃত্যুঘণ্টা – ২৮
২৯. মৃত্যুঘণ্টা – ২৯
৩০. মৃত্যুঘণ্টা – ৩০
৩১. মৃত্যুঘণ্টা – ৩১
৩২. মৃত্যুঘণ্টা – ৩২
৩৩. মৃত্যুঘণ্টা – ৩৩
৩৪. মৃত্যুঘণ্টা – ৩৪
৩৫. মৃত্যুঘণ্টা – ৩৫
৩৬. মৃত্যুঘণ্টা – ৩৬
৩৭. মৃত্যুঘণ্টা – ৩৭
৩৮. মৃত্যুঘণ্টা – ৩৮
৩৯. মৃত্যুঘণ্টা – ৩৯
৪০. মৃত্যুঘণ্টা – ৪০
৪১. মৃত্যুঘণ্টা – ৪১
৪২. মৃত্যুঘণ্টা – ৪২
৪৩. মৃত্যুঘণ্টা – ৪৩
৪৪. মৃত্যুঘণ্টা – ৪৪
৪৫. মৃত্যুঘণ্টা – ৪৫
৪৬. মৃত্যুঘণ্টা – ৪৬
৪৭. মৃত্যুঘণ্টা – ৪৭
৪৮. মৃত্যুঘণ্টা – ৪৮
৪৯. মৃত্যুঘণ্টা – ৪৯
৫০. মৃত্যুঘণ্টা – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন