৩৩. ডাক্তারের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট

হুমায়ূন আহমেদ

ডাক্তারের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট ভোর নটায়। আটটা থেকেই মতিয়ুর বলছে, কোনোরকম পাগলামী করবে না। যা জিজ্ঞেস করবে। জবাব দেবে। ফ্রিলি কথা বলবে। বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলবে না। সবচেয়ে বড় কথা পাগলামী করবে না।

মিলি করুণ স্বরে বলল, আমি পাগল মানুষ কিছু পাগলামী তো করবই। সেটা উনি চিকিৎসা করে ভাল করবেন। সেই জন্যেই এত দূর আসা।

মতিয়ুর গম্ভীর হয়ে গেল। মিলি বলল, জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে, কেমন বিদেশ বিদেশ ভাব।

এটা বিদেশ, বিদেশ বিদেশ ভাব থাকবে না? তোমার কী ধারণা এটা ঢাকা?

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা ঢাকা। আমি লরিতে গিয়ে ভাইয়ার নাম্বারে একটা টেলিফোন করে ফেললাম। রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। তখন রিসিপশনের মেয়েটা হিন্দিতে বলল, আপনি কোন নাম্বার চান?

মতিয়ুর বিরক্ত হয়ে বলল, কেন মিথ্যা কথা বলছি? তুমি ঘরেই ছিলে, কোথাও যাওনি। মিলি হেসে ফেলল।

হাসছ কেন?

মিথ্যা কথাটা কেমন করে ধরা পড়ে গেল তাই হাসছি। মজা লাগছে খুব।

মিলি সাজগোজ করতে লাগল। ফুলদানীতে হোটেল থেকে ফুল দিয়ে গেছে, সেই ফুল সে খোপায় গুজতে গুজতে বলল, সুন্দর হয়ে যাওয়া দরকার। নয়ত ডাক্তার ভাববেন বাংলাদেশের মেয়েগুলি দেখতে পচা। তাই না?

মতিয়ুর জবাব দিল না। রাগী চোখে তাকিয়ে রইল।

ডাক্তার দেবশৰ্মা বিশাল ব্যক্তি। বিশাল ব্যক্তিদের সাধারণত কোমল একটি মুখ থাকে। ইনার তাও নেই। প্রকাণ্ড একটা গোফের আড়ালে সব কোমলতা ঢাকা পড়েছে। চশমার কাঁচ এত মোটা যে চোখ দেখা যায় না। মিলি সহজভাবে বলল, কেমন আছেন ডাক্তার সাহেব?

ডাক্তার দেবমর্শ কোমল গলায় বললেন, ভাল আছি। ও আমাকে বলেছিল। আপনি বাঙালি কিন্তু আপনাকে দেখে আমার বিশ্বাস হয়নি। এখন কথা শুনে বিশ্বাস হচ্ছে।

চট করে কোন কিছু বিশ্বাস করা ঠিক না। অনেক বিদেশীরা চমৎকার বাংলা বলেন। তাছাড়া আমি নিজেও কিন্তু পুরোপুরি বাঙালি না। আমার মা ইউ পি-র মেয়ে।

মিলি হাসতে হাসতে বলল, আমি যা শুনি সব বিশ্বাস করে ফেলি। পাগল মানুষ তো। পাগল নাকি আপনি? হ্যাঁ। আমি এই জন্যই তো আপনার কাছে চিকিৎসার জন্যে এসেছি। আপনি আমাকে ভাল করে দিন

আপনি কবে থেকে পাগল হয়েছেন?

খুব ছোটবেলা থেকে। সময়টা বলুন। খুব ছোট, মানে কত ছোট? ক্লাস সিক্স থেকে।

বুঝলেন কী করে?

তা বলতে পারব না। আমরা দুভাই-বোনই ছিলাম পাগল। আমার বড় ভাইকে আপনি চিনবেন না। খুব নাম করা লেখক। আপনারা তো আর আমাদের লেখকদের বই পড়েন না, কাজেই তার নাম জানবেন না। আমাদের দেশে সবাই তাকে চেনে।

তাই নাকি?

জি আমাকে নিয়েও একটা বই লিখেছে নাম হল চৈত্রের দুপুর। এটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আপনার চোখে ঘা হয়ে যাবে।

ডাক্তার দেবীর্শমা হোসে ফেললেন। মিলি আহত স্বরে বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না তাই না?

হ্যাঁ করছি।

তা হলে হাসছেন কেন?

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সঙ্গে হাসির কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি এত সুন্দর করে কথা বলছেন যে শুনেই আমার হাসি আসছে। ভাল কথা চৈত্রের দুপুর। বইটি আমি পড়তে চাই। আপনার সম্পর্কে জানিবার জন্যে। চোখে ঘা করবার জন্যে নয়। চা দিতে বলি?

বলুন।

ডাক্তার চা দিতে বললেন। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। মিলির ভদ্রলোককে বেশ লাগল।

মিলি।

বলুন।

আপনার কী কী সমস্যা বলুন তো?

আমার তো কোনো সমস্যা নেই। আমার ভাইয়ের অনেক রকম সমস্যা।

বলুন তার সমস্যার কথাই বলুন।

ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমার ভাই এবং ভাবী আলাদা আলাদা থাকে।

ছাড়াছাড়ি কেন হল?

ভাইয়ের একটা দোষ হচ্ছে সে সব সময় সত্যি কথা বলবে। এই জন্যেই ছাড়াছাড়ি হয়েছে!

সত্যি কথা বলার এত সমস্যা তা তো জানতাম না।

সমস্যা তো হবেই। রানু ভাবী একদিন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তোমার অনেক উপন্যাসে মনিকার নাম আছে। মনিকার প্রতি তোমার কোন দুর্বলতা আছে? ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে বলল, আছে। অনেকখানি আছে। একজন মানুষের অনেকের প্রতিই দুর্বলতা থাকতে পারে তাতে কিছু যায় আসে না।

মনিকা কে?

মনিকা হচ্ছে একটি খুব বাজে ধরনের মেয়ে।

খুব সুন্দর বুঝি?

জানি না, আমার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি।

তাহলে কী করে বললেন, বাজে ধরনের মেয়ে?

মিলি হাসতে হাসতে বলল, আপনি ঠিক ভাইয়ার মত তর্ক করেন।

আপনার ভাই খুব তর্ক করতে পারে বুঝি?

খুব পারে। কেউ তাকে তর্কে হারাতে পারবে না।

ভাইকে খুব পছন্দ করেন?

হ্যাঁ।

খুব পছন্দ?

হ্যাঁ খুব।

সবচেয়ে অপছন্দ করেন। কাকে।

কাউকে না।

আপনার স্বামীর কোন ব্যাপারটা আপনার সবচেয়ে খারাপ লাগে? মিলি চুপ করে রইল। দেবশৰ্মা হাসতে হাসতে বললেন, প্রতিটি মানুষেরই কিছু কিছু খারাপ দিক আছে। আপনার স্বামীরও নিশ্চয়ই আছে। আছে না?

হ্যাঁ আছে।

সেই সম্পর্কে বলুন।

সেই সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। আমি কাউকে বলি না। আপনাকেও বলব না। আপনি ডাক্তার হন যাই হন।

ডাক্তার দেবশৰ্মা হাসিখুশি মেয়েটির গভীর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি মেয়েটির সমস্যাটি ঠিক ধরতে পারছেন না।

হোটেলে ফিরে মিলি অনেকক্ষণ। ঘুমুল। ঘুম ভাঙল বিকেলে। মতিয়ুর বেরুচ্ছে। মিলি বলল, আমি একা একা থাকিব?

হুঁ বিশ্রাম কর।

বিশ্রাম লাগবে না, আমিও যাব তোমার সাথে।

তোমার যেতে হবে না। তুমি থাক।

একা একা আমার ভয় লাগবে না?

ভয়ের কী আছে। চারদিক লোকজন।

মিলি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ লোক চলাচল দেখল। তারপর রুমে ফিরে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল রানুকে। চিঠি শেষ হবার পর বালিশে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কদল।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। সে নেমে গেল নিচে। লবি ফ্যাকা ফাকা। রিসিপশনে এখন একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলায় একটি মেয়ে থাকে। গুজরাটি মেয়ে। তার সঙ্গে বেশ খাতির হয়েছে মিলির। মেয়েটি মাথা নেড়ে নেড়ে সুন্দর গল্প করে। ইংরেজি কথাবার্তা। মিলি তার বেশির ভাগই বুঝতে পারে না। তবু খুব মাথা নাড়ে, যেন সব বুঝতে পারছে। ঐ মেয়েটি থাকলে বেশ হত। গল্প করা যেত। মিলি আবার উপরে উঠে এল। ঘর অন্ধকার। ঢুকতে ভয় লাগছে। সুইস টিপলেই বাতি জুলবে। কিন্তু বাতি জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। মিলি খাটে বসে রইল চুপচাপ। ঘর অন্ধকার থাকলেই তার বাচ্চাটির কথা মনে পড়ে। এখন যেমন মনে হচ্ছে। যেন সে খাটে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। দুবার সে ডাকল, মা মা বলে। তারপর উঠে বসল। একা একা খাট থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেল নিচে। চিৎকার করে সে কাঁদছে কিন্তু কেউ শুনতে পারছে না। কারণ সবাই এখন একতলার ঘরে বসে ভিসি আর দেখছে। ভিসিআরো খুব একটা দুমধাড়াক্কা ছবি হচ্ছে। সবাই ছবি দেখছে। কেউ তার কান্না শুনতে পাচ্ছে না।

মিলি ছটফট করতে লাগল। মাঝে মাঝে তার এমন কষ্ট হয়। ইচ্ছা করে কোটা খুলে ঘুমের ওষুধগুলি বের করতে। না, সে খাবে না। শুধু দেখবে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। বোতলটার দিকে তাকিয়ে থাকতেও কেন জানি ভাল লাগে। মিলি সুটকেস। খুলল। দরজার কাছে শব্দ হল। মতিয়ুর ফিরে এসেছে নাকি? মিলি উৎকৰ্ণ হয়ে রইল। না, মতিয়ুর না। মিলি বোতল বের করল। সব মিলিয়ে ছাপ্পানুটি ট্যাবলেট আছে। একটি বেশিও না কমও না। গুণে রাখা ট্যাবলেট। এখন সে আবার গুণবো। গুণতে গুণতে সে কাদবে। নিজের কথা ভেবে কাদবো। তার মেয়েটির কথা ভেবে কাঁদবে, রানু ভাবী এবং ভাইয়ের কথা ভেবে কাঁদবে। তারপর আবার বোতলটি লুকিয়ে রাখবে সুটকেসে।

মতিয়ুরের ফিরতে অনেক দেরি হল। সে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। অচেনা শহরে একা একা অনেকক্ষণ ঘুরতে হয়েছে। সে এসে দেখল মিলি দরজা খোলা রেখে ঘুমুচ্ছে? কী সব কাণ্ড মিলির। অচেনা অজানা একটা হোটেলে দরজা খোলা রেখে কেউ ঘুমায়? অন্য কিছু হোক না জিনিসপত্র তো নিয়ে যেতে পারত। একটা সুটকেস হাতে নিয়ে নেমে গেলে কে ধরতে পারত?

রাত এগারোটায মতিয়ুর প্রথম বুঝতে পারল মিলি এক গাদা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। মতিয়ুরের কিছু করার ছিল না। কারোরই কিছু করার ছিল না। তবু হোটেলের লোকজন প্রচুর ছোটাছুটি করল। হাসপাতালের ডাক্তাররা রাত তিনটা পর্যন্ত চেষ্টা করলেন। কিছুই কাজে লাগল না। রাত তিনটায় মিলি ঘোলা চোখে চারদিকে তাকাল। হাত বাড়িয়ে কাউকে খুঁজতে চেষ্টা করল। বিড়বিড় করে কী যেন বলল। কাকে সে খুঁজল, কী সে বলল তা কেউ জানল না। কোন দিন জানবেও না।

সকল অধ্যায়

১. ০১. আকাশে মেঘ করেছে
২. ০২. ওসমান সাহেব বাড়ি ফিরলেন
৩. ০৩. মিলির বয়স তেইশ
৪. ০৪. ওসমান সাহেবের বাবা ফয়সল সাহেব
৫. ০৫. শেষ রাতের দিকে
৬. ০৬. মিলি চুপি চুপি
৭. ০৭. ফয়সল সাহেব ডেনটিস্টের কাছে গিয়েছিলেন
৮. ০৮. টগরকে ভর্তি করা হয়েছে
৯. ০৯. হাতে একটা কমলালেবু
১০. ১০. মিলি সেজেগুজে বেরুচ্ছিল
১১. ১১. রাত এগারোটার সময় নবী এসে উপস্থিত
১২. ১২. ফয়সল সাহেব পিঠের নিচে
১৩. ১৩. রানুর বড় খালা সুরমা
১৪. ১৪. একটি চমৎকার দৃশ্য
১৫. ১৫. মিলি বাসায় ছিল না
১৬. ১৬. ঘুমের রুটিনে অদল-বদল হয়ে গেছে
১৭. ১৭. রানু আজ একটু সকাল সকাল
১৮. ১৮. মিলি বসে আছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে
১৯. ১৯. একটা দুঃস্বপ্ন
২০. ২০. মিলি একাই কাঁদছে
২১. ২১. রানু অবাক হয়ে বলল
২২. ২২. দিন কী খুব দ্রুত কাটে
২৩. ২৩. রানুরা নতুন বাসায় উঠে এসেছে
২৪. ২৪. মতিয়ুর অবাক হয়ে ওসমানের দিকে তাকিয়ে রইল
২৫. ২৫. অপলাকে রানুর বাসায়
২৬. ২৬. কুশল জানতে চেয়ে চিঠি
২৭. ২৭. মিলির চিঠি এসছে
২৮. ২৮. রানুর ইনসমনিয়ার মত হচ্ছে
২৯. ২৯. আকাশ মেঘলা ছিল
৩০. ৩০. অপলা পৌঁছল সন্ধ্যা মিলাবার পর
৩১. ৩১. অপলা ভেবে রেখেছিল
৩২. ৩২. ওসমান সাহেব জেগে উঠলেন
৩৩. ৩৩. ডাক্তারের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট
৩৪. ৩৪. প্রিয় রানু ভাবী
৩৫. ৩৫. হারিকেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন