ধাপ্পাবাজ ইত্যাদি

লীলা মজুমদার

ধাপ্পাবাজ ইত্যাদি

খুব কম বয়সে আমার বিয়ে হয়নি। এমএ পাশ করলাম, এক বছর শান্তিনিকেতনে, এক বছর কলকাতায় অধ্যাপনা করলাম। তারপর বিয়ে হয়ে যখন সংসার করতে লাগলাম, তখন দেখি কিছুই জানি না। সংসারের হালচালই বুঝি না। সবাইকে বিশ্বাস করি। ভবানীপুরে একটা দোতলার ফ্ল্যাটে থাকতাম। দুপুরে চাকরবাকররা নাওয়া-খাওয়া করতে চলে যেত। তখন আমি একা থাকতাম।

একদিন এক ফিটফাট বাবু এসে উপস্থিত। বলল, ‘বাড়িওয়ালা পাঠিয়েছেন। তাঁর সব ভাড়াটেদের পাখা আমরা সারিয়ে রং করে দিই।’

আমি বললাম, ‘আমাদের নিজেদের পাখা। ওসবের দরকার নেই।’

লোকটি বলল, ‘আহা, আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন না, মা, টাকাকড়ি দিতে হবে না। বাড়িওয়ালার সঙ্গে আমাদের কোম্পানির এইরকম ব্যবস্থা আছে, নিজেদের খরচায় পাখা খুলে নিয়ে গিয়ে, একেবারে নতুন বানিয়ে আবার টাঙিয়ে দিয়ে যাব। সাত দিন লাগবে।’

আমি বললাম, ‘আমাদের সব পাখা আনকোরা নতুন, কাজেই আপনাদের কষ্ট করতে হবে না। ধন্যবাদ।’ এই বলে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। বাড়িওয়ালা আমাদের আত্মীয়, তাঁকে ব্যাপারটা বলা হল, পাছে কিছু মনে করেন। তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন! ‘সে কী! আমি তো কারও সঙ্গে ও-রকম কোনও ব্যবস্থা করিনি! ভাগ্যিস পাখাগুলো দাওনি, দিলে আর ফিরে পেতে না।’

শুনে আমি হাঁ! লোকটাকে একটুও সন্দেহ করিনি। পুরনো পাখা হলে হয়তো দিয়েই ফেলতাম। বাড়ির মালিক বললেন, ‘খুব সাবধানে থেকো। আজকাল যা কাণ্ড হচ্ছে, কাউকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। এই তো সেদিন যোধপুর হাউসে মস্ত এক লরি নিয়ে এক ফিরিঙ্গি সায়েব, লম্বা একটা ফর্মা দেখিয়ে দারোয়ানকে বলল, ‘মালিকরা বড়দিনে কলকাতায় আসবেন। আমাদের আপিসে চিঠি দিয়েছেন সব পাখা খুলে সাফ করে তেল দিয়ে, নতুন রং দিয়ে আবার টাঙিয়ে দিতে হবে। এই দেখো মালিকের চিঠি আর এই যে আমাদের বড় সায়েবের সই দেওয়া রসিদ।’

দারোয়ান দেবনাগরি ছাড়া কিছু পড়তে পারে না। তার ওপর সায়েব আর লরি আর ইংরেজিতে সই দেওয়া কাগজ দেখে হকচকিয়ে ঘরদোর খুলে দিল। লরিতে সিঁড়ি, হাতিয়ার, মজুর সব ছিল। দেখতে দেখতে ৪২টি পাখা নামিয়ে লরিতে তুলে, সিঁড়ি ধরে থাকার জন্য দারোয়ানকে দু’টাকা বখশিস দিয়ে, দিব্যি সুন্দর চলে গেল।

দুপুরে এস্টেট ম্যানেজার এসে ব্যাপার দেখে চক্ষুস্থির! দারোয়ানকে ধমক-ধামক করে কোনও লাভ হল না। তাঁর নিজের ওখানে সকাল থেকে থাকার কথা। শেষ পর্যন্ত পুলিশে খবর দেওয়া হল। রসিদে লেখা— ৪২টি পাখা পেলাম, তারপর দুষ্পাঠ্য এক সই! বলাবাহুল্য কোনও ফল পাওয়া গেল না। মোট কথা, কাউকে দরজা খুলো না।’

এরপর কিছুদিন কেটে গেল, আমিও অনেকটা পোক্ত হয়ে উঠলাম। নির্দোষ কারিগর, মিস্ত্রি ইত্যাদিকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলাম। এমন সময় একদিন সন্ধেবেলায় আমাদের বেয়ারা হারাণ একজন আরমানি যুবককে নিয়ে এল। সাদা ইউনিফর্ম পরা ভারী ভদ্রগোছের চেহারা। সে এসেই বলল, ‘মাপ করবেন, কিন্তু আমরা খবর পেয়েছি আপনাদের বাড়িতে বেআইনি মদ চোলাই হয়। আমি আবগারি বিভাগ থেকে এসেছি, এই দেখুন আমার অর্ডার। আপনাদের বাড়ি ইন্সপেকট করব।’

আমি বেজায় আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বললাম, ‘বেশ তো, দেখুন খুঁজে যদি কিছু পান। আমি তো কিছু পাইনি।’ হারাণকে বললাম, ‘বাড়িঘর দেখিয়ে দে।’ হারাণ তাকে সঙ্গে করে খাবারঘর, রান্নাঘর, শোবার ঘর, স্নানের ঘর সব দেখাল। সমস্ত পরিষ্কার ফটফট করছে, কোথাও বেআইনি কিছু নেই।

তখন লোকটি বলল, ‘নীচে গুদোম নেই?’ বললাম, ‘আছেই তো। গ্যারাজ আছে, বাবুর্চির ঘর আছে, বেয়ারার ঘর আছে। দেখে আসুন গে।’ তার পণ্ডশ্রমের কথা ভেবে আমার বেজায় হাসি পাচ্ছিল। হারাণ তাকে সব খুঁটিয়ে দেখাল।

সত্যিই লোকটি ভারী ভদ্র। একটু পরে ফিরে এসে আমাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইল। বলল, ‘এইরকমই হয়। উড়ো খবর পেয়ে আমরা তল্লাশি করি, লোকে বিরক্ত হয়। আবার মাঝেমাঝে দুষ্কৃতকারীদের ধরেও ফেলি। কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম, এইরকম আমাদের ডিউটি। গুডনাইট।’

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আমার স্বামী চা খেতে বসলে, আমি ফলাও করে ওই গল্প করছি, হারাণ চা দিচ্ছে। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ভাগ্যিস আগে থাকতে খবর পেয়ে হাঁড়াগুলোকে পাশের গলির পোড়া বাড়িতে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল! নইলে তো হয়েই গেছিল!!’

শুনে আমার চক্ষুস্থির! ‘বলিস কী রে! কীসের হাঁড়া?’ হারাণের জিভের জড়তা ছিল। আস্তে আস্তে বলল, ‘ওই যে বাবুর্চির আর আমার মদ চোলাইয়ের বাসনপত্রগুলো।’

বেজায় রেগে গেলাম আমরা। হারাণকে পই পই করে বলে দিলাম, ‘খবরদার এমন কাজ করবি না। চাকরি যাবে, জেলে যাবি, সর্বনাশ হবে। আর ওই বাবুর্চিটার সঙ্গ ছাড়।’

এর পর বাবুর্চি আর হারাণ দুজনেই চাকরি ছেড়ে দিল। পোস্টাপিসে হারাণের নাকি একশো টাকা জমেছে, তাই দিয়ে ওরা ব্যাবসা করবে। কীসের ব্যাবসা জিজ্ঞেস করিনি। মদের নিশ্চয়।

এর চল্লিশ বছর বাদে ঝুরঝুরে বুড়ো শরীর নিয়ে হারাণ একদিন দেখা করে বলে গেল, ‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন, মা, ওতে সত্যিই সর্বনাশ হয়!’

সকল অধ্যায়

১. মেয়ে-চাকরে
২. ভ্‌-ভূত
৩. ইউরোপিয়ান্‌স্ ওন্‌লি
৪. ধাপ্পাবাজ ইত্যাদি
৫. শান্তিনিকেতন ১৯৩১
৬. বোলপুরের রেল
৭. ডাক্তার
৮. লেখকদের খোশগল্প
৯. ছেলে মানুষ কর
১০. পটোদিদি
১১. গিরীশদা
১২. খাওয়া-দাওয়া
১৩. নেশাখোর
১৪. পাড়াপড়শি
১৫. চোর
১৬. দজ্জাল মেয়ে
১৭. মাছ-ধরা
১৮. কুকুর
১৯. সাপ
২০. হুদিনি ইত্যাদি
২১. ভালবাসা
২২. পূর্ণদার মাছ
২৩. দাদামশাই ও স্বেন হেদিন
২৪. ওষুধ
২৫. স্বামীরা
২৬. কলকাতার রাস্তায়
২৭. বাঘের গল্প
২৮. ইন্দ্রজাল
২৯. বিচিত্র গল্প
৩০. জানোয়ার পোষা
৩১. সরল মানুষদের ঘোরপ্যাঁচ
৩২. ঠকিয়ে খাওয়া
৩৩. গরিবের ঘোড়া-রোগ
৩৪. জাঁ এরবের
৩৫. বুটু ও পটোদিদি
৩৬. বাঘ ও বিজয়মেসো
৩৭. রসের গল্প
৩৮. রেলগাড়িতে
৩৯. কালো সায়েব
৪০. বেড়ালের কথা
৪১. গিন্নিদের প্রসঙ্গে
৪২. জ্যাঠাইমার অর্থনীতি
৪৩. বইপাড়া
৪৪. দিলীপ
৪৫. মালিকানা
৪৬. কুসংস্কার
৪৭. মেয়েদের কথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন