দাদামশাই ও স্বেন হেদিন

লীলা মজুমদার

দাদামশাই ও স্বেন হেদিন

ভ্রমণকাহিনির কথাই ধরা যাক। সত্যি কথা, অথচ ভূতের গল্পের মতো লোম খাড়া করে দেয়। কেউ কেউ বানিয়ে কিংবা বাড়িয়ে লেখেন, কিন্তু তার চেয়েও রোমাঞ্চকর যে ভ্রমণকাহিনি একেবারে আনকোরা বাস্তব। আমাদের বন্ধু শ্রীউমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যেমন হিমালয় ভ্রমণ লেখেন, শ্রীমতী সবিতা ঘোষ যেমন বিদেশ ভ্রমণ লেখেন। সেকালেও এইরকম খাঁটি ভ্রমণকারীদের আত্মকথা পত্রিকাতে, বইতে বেরোত। তাঁদের একজন স্বেন হেদিন।

সুইডেনে বাড়ি, ছোটবেলা থেকে মধ্য ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ভ্রমণের শখ। তখন পর্যন্ত যে সমস্ত অজ্ঞাত নির্জন দেশ হিমালয়ের উত্তরে গাঢাকা দিয়ে থাকত, সেই সব জায়গায়, অনুমতি নিয়ে কিংবা বিনা অনুমতিতে, প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তাকলামাকান, তিব্বত, মানস সরোবর, কৈলাস পর্বত যাবার অনুমতি পাওয়া লালমুখো সাহেবের পক্ষে বড় শক্ত ছিল। তবু যেতেন। বারেবারে যেতেন। ফিরে এসে বই লিখতেন, ছবিটবি দিয়ে। সেকালে ক্যামেরা অত সহজলভ্য ছিল না, তাই নিজের হাতে চমৎকার ছবি এঁকে নিতেন। বইতে সেই ছবিও থাকত।

ভারী রসিক ছিলেন। রসবোধ না থাকলে কেউ অজ্ঞাত বিপজ্জনক কষ্টকর পথে পা দিয়ে আনন্দ পায়? খরচপত্র ছিল। সরকারি সাহায্য জোগাড় করতেন। মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে, অনেক সময় বোগদাদে আস্তানা গাড়তেন। হারুণ-অল-রশিদের কথিত রাজধানী বোগদাদ। ইউরোপের লোক সেই জায়গাটাকেই সুদূরের সীমান্ত বলে মনে করে। আর তাঁর যাত্রা শুরু হত সেখান থেকে। একেকবার ভারবাহী ঘোড়া, খচ্চর, মজুর, গাইড, দোভাষী, রসদ সংগ্রহ করতেই এক বছরের ওপর কেটে যেত। স্থানীয় ভাষা টাকা চলনসই গোছের শিখে নিতেন। আমীর-ওমরাহ থেকে ফকির, মুশাফিরদের সকলের সঙ্গে চেনা হয়ে যেত। দেশ থেকে বেশি সঙ্গীসাথী আনতেন না, কারণ রওনা হবার আগেই তাদের দেশের জন্য মন-কেমন করতে শুরু করত।

একবার বোগদাদে ওইরকম অনেক দিন ধরে তোড়জোড় চলছে। এমন সময় এক মুশাফির এসে কিছু সাহায্য চাইল। তাকে বিদায় করবার জন্য যৎসামান্য দেওয়া হল। তাতে সে মোটেই খুশি হল না। উলটে বলল, ‘কী! আমি পৃথিবীর যে কোনও ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্য থেকে লাইনের পর লাইন মুখস্থ বলতে পারি আর আমাকে কিনা এই সামান্য বিদায় দেওয়া…!’

একথা শুনে স্বেন হেদিনের ভারী মজা লাগল। তিনি বললেন, ‘তাই নাকি? আচ্ছা বলো তো দেখি, আমার দেশের শ্রেষ্ঠ কাব্য থেকে দশ লাইন।’ বলবামাত্র লোকটা নিখুঁত উচ্চারণে গড়গড় করে সুইডেনের বিখ্যাত প্রাচীন কাব্য থেকে দশ-বারো লাইন আউড়ে গেল। স্বেন হেদিনের গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। তিনি তাকে আরও অনেকগুলো টাকা দিয়ে ফেললেন।

তখন লোকটা বলল, ‘নাঃ! আপনাকে বেশিক্ষণ এরকম ধাঁধার মধ্যে ফেলে রাখা কর্তব্য হবে না।’ এই বলে এক টানে চুল দাড়ি গোঁফ খুলে ফেলে দিল। ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল স্বেন হেদিনের পুরনো বন্ধু, সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের এশীয় ভাষার বিখ্যাত অধ্যাপক! মাঝে মাঝে এইরকম মজা হত বলেই, স্বেন হেদিন ওই রকম অমানুষিক কষ্ট সইবার মনের জোর পেতেন।

যে সময়ে স্বেন হেদিন মানস সরোবর দেখতে গেছিলেন, আমার দাদামশাই, রামানন্দস্বামীও তার কাছাকাছি সময়ে কৈলাস পর্বত, মানস সরোবরে গেছিলেন। তফাত ছিল এই যে সাহেব গেছিলেন জ্ঞান আহরণ করতে, দাদামশাই গেছিলেন তীর্থ করতে। অবিশ্যি ভ্রমণের নেশা দুজনারই সমান ছিল।

দাদামশাই সন্ন্যাসী মানুষ, ষাটের ওপর বয়স। দিব্যি সুন্দর পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে সমস্ত ব্যবস্থা করে নিয়ে, দেরাদুন থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হয়ে গেলেন। সঙ্গে রসদ নেননি। সন্ন্যাসীরা কখনও ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে পথ চলেন না। পথের দরকার পথ থেকেই জুটে যায়।

দাদামশাই নিয়েছিলেন একটা কম্বল, একটা কাঠের বাটি, একটা মোটা লাঠি। দেরাদুন থেকে যোগী মঠ, সেখান থেকে কৈলাসের রাস্তা। ১৩০৫ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে রওনা। দুজন সেবক সঙ্গে গেল। একজনের ওই অঞ্চলেই বাড়ি। তিব্বতী ভাষা ভাল জানত। ওই পথে ওইরকম একজন সঙ্গে না থাকলে চলে না।

সেই বরফ-জমা অঞ্চলে পায়ে হেঁটে পথ চলা বড়ই কষ্টকর। থেকে থেকেই গুহাগহ্বর। অনেক সময়ই তার কাছে একটা গরম জলের উৎস। যেন ভগবানই তীর্থযাত্রীদের জন্যে ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

সেকালে দু’জাতের লোক তিব্বত যেত, ব্যাবসাদাররা আর তীর্থযাত্রীরা। সবাই গুহায় রাত কাটাত, গরম জলের উৎসে গা ধুত। জাতের বালাই কি অমন জায়গায় টেকে?

পথে গন্ধমাদন পর্বত দেখেছিলেন, ম্যাপে নিশ্চয় তার অন্য নাম। পাহাড়ে নানা রকম ওষুধের গাছ আছে। রাতে দাদামশাই পাহাড়ে আলো জ্বলতে দেখেছিলেন। ওখানে নাকি কেউ থাকে না। কীসের আলো কে জানে।

নিতি গিরিপথের কাছেই হোতি গিরিপথ। তাদেরও অন্য নাম আছে। সেই পথ দিয়ে গেছিলেন। নিতি হল গিয়ে ইংরেজশাসিত ভারত থেকে স্বাধীন তিব্বত দেশের মধ্যিখানের প্রবেশপথ।

এইখানে একটু গোলমাল দেখা দিল। এর আগে অবধি সাধু-সন্ন্যাসীরা ওপথে গেলে কেউ বাধা দিত না। তবে সাহেবদের ঢুকতে দেওয়া হত না। এদিকে লাসা অঞ্চলের মানচিত্র করবার জন্যে মাপজোক করতে লোক পাঠানো দরকার। শেষ পর্যন্ত এদেশি লোকদের সাধু সাজিয়ে লাসা পাঠানো হয়েছিল। সেকথা জানাজানি হতে কতক্ষণ!

লাসার শাসনকর্তারা মহা রেগেমেগে নিয়ম করলেন, তিব্বতে গেলে সাধু-সন্ন্যাসীদেরও জামিন রেখে যেতে হবে। ওখানে মরগাঁও বলে একটা গ্রাম ছিল, সেখানে ১০ দিন বাস করতে হত। সুখের বিষয়, এ-সমস্ত অসুবিধাও আপনা থেকে দূর হয়ে গেল। মরগাঁওয়ের প্রধান দাদামশায়ের ভক্ত হয়ে পড়ল এবং সব রকম বন্দোবস্ত করে দিল।

হোতি গিরিপথ ১৫০০০ ফুট উঁচু আর বড় দুর্গম। সেই পথে পার হওয়া গেল। ওপারে পৌঁছে প্রধান নিজেই জামিন হল। সে এক ব্যাপার। আড়াই সেরি এক পাথরকে সমান দু’টুকরো করা হল— কী উপায়ে তা জানি না। তারপর টুকরো দুটোকে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে সিলমোহর করে লিখে দিতে হল যে এই সাধু ইংরেজের ছদ্মবেশী চর কিংবা কম্পাসওয়ালা নন। তিব্বতে গিয়ে ধরা পড়ে যদি প্রমাণ হয় উনি ছদ্মবেশী চর, তা হলে কেদার সিং জামিন হয়েছে, অতএব তাকে ওই আধখানা পাথরের সমান ওজনের সোনা জরিমানা দিতে হবে। এমনকী ওখানকার রাজা ইচ্ছা করলে ওর প্রাণদণ্ডও দিতে পারেন।

বলাবাহুল্য দাদামশায়ের সে ভয় ছিল না। পাছে চর বলে স্থানীয় লোকরা সন্দেহ করে, সাধুরা তাই জুতো, ছাতা, বা ব্যাগ জাতীয় জিনিস সঙ্গে নিতেন না। দাদামশাই অনেক শারীরিক কষ্ট সয়ে আর মানসিক আনন্দ পেয়ে, কৈলাস, মানস সরোবর, নানা গুম্ফা, রক্ষিত তিব্বতী হরফে লেখা প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথির সংগ্রহ আর বহু পবিত্র জিনিস দেখে নিরাপদে অন্য গিরিপথ দিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর জন্যে কেদার সিংকে কোনও বিপদে পড়তে হয়নি।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল যে ওই বিদেশ-বিভুঁইয়ের ভিন্ন ভাষাভাষী গ্রামের লোকরা সঙ্গে করে ফলমূল, দুধ, মাখন, মিষ্টান্ন নিয়ে দলে দলে সাধু দেখতে আসত। তাঁদের শীতের রাত কাটাবার জন্য ছাউনি কিংবা গোয়ালঘর ছেড়ে দিত। তবু নিশ্চয় শীতে কষ্ট পেতেন, খালি পা, কম্বল ছাড়া গরম কাপড় নেই— কিন্তু সেটুকু তো হবেই।

যৎসামান্য খরচে, স্বেন হেদিনের যাত্রার প্রস্তুতিতে যত সময় লাগত তার সিকির সিকির চেয়েও কম সময়ের মধ্যে তোড়জোড় করে, লাঠি কমণ্ডলু কাঠের বাটি আর দুজন সঙ্গী সম্বল নিয়ে, দাদামশাই মানস সরোবর আর কৈলাস পাহাড় দেখে এসেছিলেন, আজ থেকে আশি বছর আগে।

সকল অধ্যায়

১. মেয়ে-চাকরে
২. ভ্‌-ভূত
৩. ইউরোপিয়ান্‌স্ ওন্‌লি
৪. ধাপ্পাবাজ ইত্যাদি
৫. শান্তিনিকেতন ১৯৩১
৬. বোলপুরের রেল
৭. ডাক্তার
৮. লেখকদের খোশগল্প
৯. ছেলে মানুষ কর
১০. পটোদিদি
১১. গিরীশদা
১২. খাওয়া-দাওয়া
১৩. নেশাখোর
১৪. পাড়াপড়শি
১৫. চোর
১৬. দজ্জাল মেয়ে
১৭. মাছ-ধরা
১৮. কুকুর
১৯. সাপ
২০. হুদিনি ইত্যাদি
২১. ভালবাসা
২২. পূর্ণদার মাছ
২৩. দাদামশাই ও স্বেন হেদিন
২৪. ওষুধ
২৫. স্বামীরা
২৬. কলকাতার রাস্তায়
২৭. বাঘের গল্প
২৮. ইন্দ্রজাল
২৯. বিচিত্র গল্প
৩০. জানোয়ার পোষা
৩১. সরল মানুষদের ঘোরপ্যাঁচ
৩২. ঠকিয়ে খাওয়া
৩৩. গরিবের ঘোড়া-রোগ
৩৪. জাঁ এরবের
৩৫. বুটু ও পটোদিদি
৩৬. বাঘ ও বিজয়মেসো
৩৭. রসের গল্প
৩৮. রেলগাড়িতে
৩৯. কালো সায়েব
৪০. বেড়ালের কথা
৪১. গিন্নিদের প্রসঙ্গে
৪২. জ্যাঠাইমার অর্থনীতি
৪৩. বইপাড়া
৪৪. দিলীপ
৪৫. মালিকানা
৪৬. কুসংস্কার
৪৭. মেয়েদের কথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন