ফ্লোরেঞ্জ জিগফেল্ড : ইতিহাসের যে-কোনো ব্যক্তির চেয়ে তিনি অধিক সংখ্যক

ডেল কার্নেগি

ফ্লোরেঞ্জ জিগফেল্ড : ইতিহাসের যে-কোনো ব্যক্তির চেয়ে তিনি অধিক সংখ্যক

ইতিহাসের যে-কোনো জীবিত লোকের চেয়ে ফ্লোরেঞ্জ জিগফেল্ড সর্বাধিক সুন্দরী মেয়ের টেলিফোন নম্বর জানতেন। তার ব্লু বুক অব বিউটিতে হাজারো মোহময়ী ও আকর্ষণীয়া সুন্দরীর নাম ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর লেখা ছিল।

জিগফেল্ডকে ‘আমেরিকান তরুণীদের গৌরব বর্ধনকারী’ বলে অভিহিত করা হলে তিনি গর্ববোধ করতেন। এমন একটি অতি সাধারণ তরুণী যার দিকে কেউ একবারের বেশি দুবার তাকায় না, তেমনি একটা মেয়েকেও তিনি মঞ্চের উপর একেবারে বদলে দিয়ে একটি রহস্যময়ী মনোমুগ্ধকারী চোখ ঝলসানো সুন্দরী নারীতে পরিণত করে দিতে পারতেন। দৈহিক গড়ন আর মনোরম ভঙ্গি ছিল জিগফেল্ডের মঞ্চে প্রবেশের পাসপোর্ট। কীভাবে একজনকে মোহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হয় জিগফেল্ড তা ভালো করে জানতেন।

তিনি ছিলেন প্রাচ্যের যে-কোনো রাজার মতোই রাজকীয়। এশিয়া ও ইউরোপের সমস্ত বাজার তন্ন তন্ন করে দামি ও সবচেয়ে সুন্দর পোশাক কেনার জন্য উদার হস্তে লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করেছেন। তাছাড়া তিনি মনে করতেন, শরীরের চামড়ার সাথে সুন্দর পোশাকের স্পর্শ না পেলে কোনো মেয়েই নিজেকে প্রকৃত সুন্দরী ভাবতে পারে না। এক রাখালের জন্য একবার তার মনোমতো টুপি খুঁজতে গিয়ে তিনি পুরো তিনমাস নিজের Show Boat-এর প্রযোজনা বন্ধ রেখেছিলেন। আরেকবার তার একটা প্রযোজনায় ২৫,০০,০০০ ডলার ব্যয় করেও মাত্র একবার প্রদর্শন করে সেটা বন্ধ করে দেন। তার মনে হল প্রযোজনটি তার গৌরবময় ঐতিহ্যের জন্য যোগ্যতর হয় নি। তার প্রতিটি কাজ হত প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ। তিনি তাঁর নিকটস্থ লোকের কাছেও টেলিগ্রাম পাঠাতেন। তাঁর কর্মচারীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার জন্য প্রায় প্রতিদিন ভোর ছটায় বিছানা ছাড়তেন। জিগফেল্ড দশ-বারো ডলার বাঁচাবার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিকল্পনা করতেন, আবার পরদিনই চোখের পলক না ফেলেই ওয়েল স্ট্রিটে একলাখ ডলার খরচ করে আসতে পারতেন। একবার এডউইন নামক এক ভদ্রলোকের কাছে থেকে জিগফেল্ড ৫০০০ ডলার ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের অপর প্রান্তে যাবার জন্য একখানি প্রাইভেট ট্রেন ভাড়া করে ওই টাকা উড়িয়ে দিলেন।

নিজের সৌন্দর্যবোধ এবং অদ্ভুত বিবেচনা শক্তি দ্বারা রমণীগণকে অনুভব করতে পারতেন যে তারা সুন্দরী। তার কোনো অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী রজনীতে তিনি তার নায়িকাদলের প্রতিটি মেয়েই তার কাছ থেকে এক বাক্স করে ফুলের তোড়া উপহার পেত। প্রত্যেক মহিলা, এমনকি বৃদ্ধারাও তার কাছে সহানুভুতিপূর্ণ ব্যবহার পেত। তিনি তার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত তারকাঁদের সপ্তায় ৫০০০ ডলার বেতন দিতেন, মৌসুমের শেষে দেখা যেত তাদের কারো ব্যাংকে জিগফেল্ডের চেয়েও বেশি টাকা জমেছে। জিগফেল্ড পঁচিশ বছর বয়সে দুরন্ত কর্কশ শক্তিধর স্যান্ডোর ম্যানেজার হিসেবে ভাগ্যাদেবীর কৃপালাভ করেছিলেন! এর দু’বছর পরে একেবারে দেউলিয়া অবস্থায় দেখা গেল লন্ডনে তখন তার হাতে একটা শিলিংও ছিল না। মন্টিকার্লোতে গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতে বাজী ধরলেন তিনি–কিন্তু চাকা ঘুরতে ঘুরতে গায়ের জামাটা হারালেন। তবে কপর্দকহীন হওয়াটা এই মহান ব্যবস্থাপকের কাছে কোনো চিন্তার বিষয় ছিল না। তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল নিজের বুদ্ধি-বিবেক ও আচার-আচরণের জাদু দিয়ে দুঃখ-দৈন্য দূর করে সাফল্যের তুঙ্গে আরোহণ করতে পারতেন।

আমেরিকার চতুর প্রয়োজকরা এনা হেল্ডকে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রচুর অর্থ প্রদানের লোভ দেখাচ্ছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত মাত্র সাতাশ বছর বয়স্কপ্রায় অপরিচিত ও কপর্দকহীন জিগফেল্ডই একেবারে এনার পোশাক ঘরে উপস্থিত হলেন, তাঁকে মুগ্ধ করলেন এবং তাকে চুক্তিপত্রে সই করালেন আর তরতরিয়ে উঠে এলেন খ্যাতি ও মর্যাদার উচ্চশিখরে। এনা হেল্ড আমেরিকায় ঝড় তুললেন। তাঁর খ্যাতির ফলশ্রুতিতে তার নামে সুগন্ধিদ্রব্য, পাউডার, ককটেল, টুপি, ঘোড়া, কুকুর, সিগারেট ইত্যাদির নামকরণ করা হল। অবশেষে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার চরম শিখরে আরোহণ করে এনা পরিণয়বদ্ধ হলেন জিগফেল্ডের সঙ্গে।

জিগফেল্ড কোনো ব্যাপারে চিন্তা করে মনস্থির করতে অপছন্দ করতেন। তার টেবিলে সবসময় এক কৌটা জ্যৈষ্ঠমধু রাখতেন। এ সম্পর্কে এক বন্ধুর প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, ‘ওগুলো কালো, কাজেই কোন রঙটা আমার পছন্দ তা মনস্থির করতে আমাকে ভাবতে হয় না। চব্বিশ বছর ধরে কোলাহলময় নিউইয়র্কে ফ্লোরেঞ্জের প্রদর্শনীগুলো ছিল একেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার উদ্বোধনী রজনীতে রাস্তায় রাস্তায়

গাদাগাদি হয়ে যেত, পর্দার পেছনে স্টেজে গোলমাল হয়ে যেত, স্টেজ কর্মীদের মধ্যে একটা ছোটাছুটি শুরু হত, সবার মধ্যে একটা কাজ আর তাড়াহুড়োর প্রতিযোগিতা লেগে যেত–কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তিটি সবসময় শান্ত-সুবোধ, ধীরস্থির ও শান্ত সমাহিত।

রজনীর বিশিষ্ট দর্শকবৃন্দ শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জমকালো সান্ধ্যপোশাক এবং সাদা টাই পরে আসত কিন্তু জিগফেল্ড নিজে পরতেন একটা সাদাসিধে ধূসর রঙের ব্যবসায়ী পোশাক। ওই অনুষ্ঠানে নিজেকে তিনি একটা আসনে উপবেশন করার বিলাসটুকুন ভোগ করতে দিতেন না। ব্যালকনিতে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুরো অনুষ্ঠানটা পর্যবেক্ষণ করতেন।

১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিট ভেঙে পড়ার সময় এই মহান ব্যক্তিত্বটির কর্মজীবনে নাটক শেষের বিরতির আলো জ্বলে উঠে যবনিকাপাত হল। ১৯৩২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় জিগফেল্ড শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি যখন ভুল বকাবকি শুরু করেন, মনে হচ্ছিল তখন তিনি কল্পনায় একটা নাটক পরিচালনা করছিলেন। তাঁর মঞ্চ ছিল তখন হাসপাতলের এক শুভ্র কক্ষ, মঞ্চে তখন তার একজন চাকর ছাড়া দ্বিতীয় কেউ ছিল না। জিগফেল্ড বিছানায় উঠে বসে অদৃশ্য অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকে ডিরেকসন দিচ্ছিলেন। তিনি চীৎকার করে বলছিলেন—’পর্দা উঠাও, দ্রুতলয়ে সঙ্গীত দাও, সমস্ত আলো জ্বেলে দাও। শেষ দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত হও।’

মৃত্যুর শেষমুহূর্তে তিনি বলছিলেন, ‘চমৎকার! দৃশ্যটা… সত্যি…চমৎকার… অপূর্ব।

সকল অধ্যায়

১. জন ডি. রকফেলার : যার ধন সম্পদ এখনো বেড়ে চলেছে
২. এন্ড্রু কার্নেগি : অন্যদেরকেও ধনী করে তুলতেন
৩. আর জোলসন : দারিদ্র্যকে যিনি জয় করেছিলেন
৪. উইলিয়াম রেভলফ্‌ হার্স্ট : যার মাসিক আয় দশ লক্ষ ডলার
৫. ফ্লোরেঞ্জ জিগফেল্ড : ইতিহাসের যে-কোনো ব্যক্তির চেয়ে তিনি অধিক সংখ্যক
৬. লিও টলস্টয় : জীবনবাদী লেখক
৭. সমারসেট মম্ : একজন বিশ্বখ্যাত লেখকের নেপথ্য কথন
৮. লর্ড বায়রন : মানুষের মাথার খুলিতে করে মদ পান করতেন
৯. মার্টিন জনসন : ভ্রমণের জন্যে রাঁধুনি হয়েছিলেন
১০. লায়ানল ব্যারিমোর : নিজের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পান নি
১১. হেলেন কিলার : যাকে নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল
১২. হাওয়ার্ড থার্সটন : একজন বিখ্যাত জাদুকর
১৩. এনরিকো কারুজো : মূল্যবান কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন
১৪. ওয়েন্ডেল পরিবার : নিউইয়র্কের সবচেয়ে অদ্ভুত ধনী পরিবার
১৫. হেটি গ্রিন : তার আয় ছিল ঘণ্টায় তিন শ ডলার অথচ
১৬. ইভানজিলিন বুদ : একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুখী মহিলা
১৭. লরেন্স টিবেট : প্রত্যাখান তাকে অনেকদূর নিয়ে গেছে
১৮. ক্লেরান্স ডেবরা : একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী
১৯. চার্লস ডিকেন্স : বিস্ময়কর ও জনপ্রিয় লেখক
২০. ডায়মন্ড জিম ব্রেডি : একজনের জন্য এক মিলিয়ন ডলার দিতে চেয়েছিলেন
২১. উইলিয়াম শেক্সপিয়ার : ইংরেজি সাহিত্যের কিংবদন্তি
২২. সিনক্লেয়ার লুইস : তিনি নোবেল বিজয়ী হলেন
২৩. ক্লাইভ বিটি : সার্কাসশিল্পী
২৪. মেয়ো ভ্রাতৃযুগল : আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসক
২৫. শিক সেল : একটি বইয়ের জনপ্রিয় লেখক
২৬. বেজিল জেহারফ : লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাধিপ্রস্তর হল তাঁর স্মৃতিসৌধ
২৭. থিয়োডর রুজভেল্ট : বুকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও বক্তৃতা থামান নি
২৮. বিলি সানডে : একজন জনপ্রিয় ধর্মপ্রচারক
২৯. জ্যাক লন্ডন : যাঁর আয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আয়ের দ্বিগুণ
৩০. উড্রো উইলসন : বিশ্বশান্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন
৩১. জে. পি. মর্গান : একজন বিশিষ্ট ধনকুবের, যিনি ছিলেন অখ্যাত ও রহস্যময়
৩২. ক্যাপটেন রবার্ট ফ্যালকন স্কট : দক্ষিণ মেরুতে ভ্রমণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি
৩৩. ফ্রান্সিস ইয়েটস ব্রাউন : যিনি তার জীবনে অনেকগুলো জীবনযাপন করেছেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন