নাথুরাম গডসের বয়ান

আমি নাথুরাম গডসে বলছি

(জেলের মধ্যে রাতের পর রাত জেগে নাথুরাম গডসে এই বয়ান তৈরী করেছিলেন এবং প্রায় ৯৩ পৃষ্ঠার এই বয়ান পড়তে তাঁর সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ ঘন্টা। এই বয়ানকে তৎকালীন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এক রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেব আখ্যাত করেছিলেন। বক্তব্য শুরু করার আগে নাথুরাম উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলন, তার বক্তব্য পুরোপুরি প্রকাশিত হোক বা না হোক কখনই যেন তা বিকৃতভাবে ছাপা না হয়।) বয়ানটি হচ্ছে :

এক ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আমি হিন্দুধর্ম, হিন্দু ইতিহাস এবং হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমি সামগ্রিকভাবে হিন্দু ধর্মের জন্য গর্ববোধ করি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মুক্ত চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হই। কোনও কুসংস্কারকেই আমি মান্যতা দিতাম না এবং এই উদ্দেশ্যেই আমি অস্পৃশ্যতা এবং জাতপাত প্রথা রোধ করার সংগ্রামে নেমে পড়ি। আমি প্রকাশ্যেই জাতপাত প্রথা বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। আমি মনে করতাম হিন্দুদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ থাকা উচিত নয় এবং প্রত্যেক হিন্দুরই থাকা উচিত সমানাধিকার এবং তা সামাজিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে তো বটেই। আমি বিশেষ পড়াশোনা করতে পারিনি কিন্তু বই পড়াতে ছিলো আমার প্রবল আগ্রহ। আমি দাদাভাই নৌরজী, স্বামী বিবেকানন্দ, গোপালকৃষ্ণ গোখলে এবং বালগঙ্গাধর তিলকের বই পড়েছি। এছাড়া আমি অধ্যয়ন করেছি শুধুমাত্র ভারতবর্ষের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসই নয়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এমনকি আমেরিকা ও রাশিয়ার ইতিহাসও। আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদকেও। তবে আমি বিশেষভাবে জানতে চেয়েছি বীর সাভারকার এবং গান্ধী কি লিখেছেন এবং কি বলেছেন সে সম্পর্কে।

১৯২৩-৩০ সাল থেকে যখন কংগ্রেস দল প্রথম ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিল আমি তখন শুধুমাত্র ছাত্র হলেও একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে এই অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। আর খবরের কাগজে এং অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে যা যা সংবাদ প্রকাশিত হতো তার সবগুলিই আমি গোগ্রাসে গিলতাম। এই প্রক্রিয়ায় থেকে এই আন্দোলনের প্রতি আমি এতটাই উৎসুক হয়ে পড়েছিলাম যে আমি ঠিকই করে ফেললাম যে ইংরেজ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবেই আমি আমার জীবন কাটিয়ে দেবো। এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের বিষয়টিও আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিলো আর এই বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে আমি ক্রমশ বুঝতে পারলাম যে গান্ধীর নীতি ও কর্মসূচী ভীষণ ভাবেই মুসলিমপন্থী। তখন থেকেই আমার মনে হতে লাগল যে তাহলে এবার হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুত্বের জন্য আমার কিছু করা উচিত। আবার গান্ধী যখন ‘কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’কে মেনে নিলেন তখন থেকেই আমি হিন্দু মহাসভার দিকে ঝুঁকলাম এবং তখন আমার মনে হলো যে এই হিন্দু মহাসভাই হলো হিন্দুদের একমাত্র সংগঠন যারা হিন্দু জাতির স্বার্থে লড়বে এবং প্রয়োজনে প্রাণ দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না।

১৯৩২ সালে ডক্টর হেডগেওয়ার যখন নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করলেন তখন বুঝতে পারলাম যে এটা আমার কাছে মস্ত একটা সুযোগের মতো তাই কালবিলম্ব না করে আমি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘে যোগ দিলাম। আমাকে এই সংগঠনের একজন প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হলো। এরপর আমি অবশ্য যোগ দিই হিন্দু মহাসভা দলে। তখন এই দলের সদ্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বীর সাভারকার। ১৯৩৮ সালে আমি অংশগ্রহণ করলাম হায়দারবাদ সত্যগ্রহে’ এই সত্যগ্রহে অংশগ্রহণ করে আমি কারাবাস করি এবং জেলের মধ্যে ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত গাওয়ার অপরাধে নিজামের লেঠেল বাহিনী আমাকে বেত্রাঘাতও করে।

হায়দারবাদ থেকে ফিরে এসে আমি পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লাম। এবার আমার লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়সেবক সংঘকে আরও কট্টর ও আন্দোলনমুখী করে গড়ে তোলা। কিন্তু আমি ক্রমশ বুঝতে পারলাম যে তা সম্ভব নয়। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি এবার নতুন দল গড়ে তুলবো। হিন্দু রাষ্ট্র দলই হলো সেই নতুন দল যার পত্তন আমি করলাম পুণার মত শহরে। আমাদের দলের দাবী ছিলো – আমরা যেন সবক্ষেত্রেই হিন্দু ধর্ম যাতে আরও শক্তিশালী হতে পারে সে ব্যাপারটিকে নিশ্চিত করতে পারি। আমি দিকে দিকে বিপুলভাবে সাড়া পেতে লাগলাম। আমার দল গড়ে তুলতে লাগল নতুন নতুন ক্লাব। শরীরচর্চার সঙ্গে সঙ্গে আগ্নেয় অস্ত্র শিক্ষার ব্যবস্থাও আমরা করলাম। তারপর আমরা নজর দিলাম প্রচারের দিকে। আমার এক পুরোনো বন্ধু ছিল নারায়ণ আপ্তে তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা মারাঠী ভাষায় নতুন এক দৈনিক সংবাদপত্র বার করলাম এবং আমিই হলাম তার সম্পাদক। কিন্তু সরকার এই পত্রিকাকে বেশিদিন চলতে দিলো না। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে না দিয়ে আবার নতুন এক দৈনিক পত্রিকা বার করলাম। পত্রিকাটির নাম দিলাম ‘হিন্দু-রাষ্ট্র’। এটিরও সম্পাদক হলাম আমি আর এই পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলেন আমার বন্ধু ও সহযোদ্ধা নারায়ণ আপ্তে। এটিও অবশ্য দৈনিক পত্রিকা হিসেবেই প্রকাশিত হতে লাগলো।

.

নাথুরাম গডসে বিচারসভায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে। তার বক্তব্যের পরিধি ছিলো প্রায় ৫০টি প্যারাগ্রাফের এবং যা বিভক্ত ছিলো পাঁচটি অনুচ্ছেদে। বক্তব্যের মাঝখানে অবশ্য বিচারকেরা তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন যে – এটা বিচারসভা, কোনও বক্তৃতামঞ্চ নয়। নাথুরামের বক্তব্যের প্রথম অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল — অভিযোগের উত্তরে :

মাহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করার পর আমার পালিয়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছাই ছিলো না। পালিয়ে যাওয়ার কথা আমি কখনও ভাবিনি। আমি নিজের উপর গুলি ছোড়ার কোনও চিন্তাকেও আমল দিইনি। আমার শুধুমাত্র একটাই ইচ্ছা ছিলো যে আমি যেন আমার চিন্তাকে বিচারসভার মাধ্যমে সারা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি।

আমি হিন্দুরাষ্ট্রে দল গঠন করার পরেই বুঝতে পারলাম যে আমাদের নতুন কর্মসূচী গ্রহণ করা দরকার এবং এই উদ্দেশ্যেই আমি গোপন সংগঠন গড়ার কথা ভেবেছিলাম। তাই প্রথম প্রথম গান্ধীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী কিন্তু শাস্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আয়োজন করতে শুরু করেছিলাম। আর বিক্ষোভ প্রদর্শন চলতো গান্ধীর তথাকথিত যেসব প্রার্থনা সভাগুলো হতো তার সামনেই। বলা বাহুল্য গান্ধী সেইসব প্রার্থনা সভাগুলোকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে তার সব ক্ষোভকে উগরে দিতেন।

.

নাথুরামের বক্তব্যের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিলো গান্ধী নীতির মূল্যায়ণ এই অনুচ্ছেদটিও দুটি ভাগে বিভক্ত ছিলো। প্রথম ভাগটি এই হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপটের যে ঘটনাবলী তাকে ভুল ধরা, যা নাথুরামের ভাষায় “পুরোপুরি এবং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক।”

মধ্যভারতের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখতে পাওয়া যাবে যে ভারতবর্ষ প্রকৃত অর্থে কোনও দিনই হিন্দুদের বাসস্থান ছিল না। মুসলমানরা ধারাবাহিকভাবেই এই দেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছিলো সেই দশের শতক থেকেই এবং এই দেশের অধিকাংশ ভূখন্ডেই তাদের মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো।

যদিও মারাঠা শক্তির উত্থান, রাজপুতদের বিদ্রোহ এবং শিখদের সংগ্রাম এই মুসলিম শাসনকে বারবার আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে তুলেছিলো।

শিবাজী, রাণাপ্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিং মুসলিম আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দ্বারা হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু সমাজের পুনরুত্থান ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। আমাদের দেশের উপর যে মুসলিম আগ্রাসন ঘটেছিলো তাঁরা একে রুখে দিয়েছিলেন। তারা এককথায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে দখলদার মুক্ত করেছিলেন। উল্টোদিকে প্রায় ৩০ বছর ধরে দেশের অবিশংবাদী নেতা হওয়া সত্ত্বেও গান্ধীর আমলেই কিন্তু ঘটেছিলো বেশি করে মন্দিরের উপর আক্রমণ, জোর করে ধর্মান্তরকরণ এবং আরো বেশী করে মুসলিমদের দ্বারা নারীদের উপর অত্যাচার এবং যার পরিণতি ঘটেছিল দেশের এক তৃতীয়াংশ ভূমি হারানোর মধ্য দিয়ে। সুতরাং শিবাজী, রাণাপ্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিংকে বিপথগামী দেশপ্রেমিক আখ্যা দিয়ে গান্ধী নিজের চরিত্র এবং উদ্দেশ্যকেই বেশি করে উম্মোচিত করে দিয়েছেন। তুলনা করলে দেখতে পাওয়া যাবে যে তাদের দেশপ্রেমের তুলনায় গান্ধী ছিলেন নিতান্তই ক্ষুদ্রকায় এক ব্যক্তি। ভারতবর্ষের মানুষেরা যে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছে তা একমাত্র গান্ধীর কৃতকর্মেরই ফলেই।

যুদ্ধ এবং কূটকৌশলে উন্নত হওয়ার ফলেই ইংরেজরা একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো। যদিও এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের বীজ তখনও ছিলো। কিন্তু এক সম্প্রদায়ের প্রতি অন্য সম্প্রদায় এতটা অসহিষ্ণু আগে কখনও ছিলো না। কারণ ইংরেজরাই ছিলো তখন উভয়েরই শত্রু। একমাত্র গান্ধীর নীতির জন্যেই শেষ পর্যন্ত মুসলমানেরা আলাদা রাজ্যের দাবী জানাতে শুরু করে। গান্ধীর জন্যেই এই দেশভাগ।

.

এইবার নাথুরাম তার বক্তব্য অনুসারে গান্ধীর রাজনৈতিক কর্মাবলীর ব্যাখ্যা শুরু করছেন। এতে তিনি টেনে আনলেন ১৯১৪ সাল থেকে গান্ধীর ভারতীয় রাজনীতিতে তার ভূমিকা নেই।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী ছিলেন ভারতীয়দের অবিচ্ছেদ্য এক কান্ডারী। ভারতে পদার্পণ করে তাই গান্ধী লাভ করেছিলেন ভারতীয়দের অগাধ আস্থা। এদেশের সব সম্প্রদায়ই তাঁকে নেতা বলে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে ভারতবর্ষ কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়। হোমরুল আন্দোলন, স্বাশাসিত সরকার এবং এমনকি তখন স্বাধীনতাই ছিলো ভারতীয় রাজনীতির এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য যার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা একেবারেই মেলে না। ভারতবর্ষের এই জটিল পরিস্থিতিতে আবার যুক্ত হয়ে পড়েছিল আরও কয়েকটি বিষয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সম্প্রদায় ভিত্তিক ভোটদান, পৃথক নির্বাচক মন্ডলী ইত্যাদি যা বৃটিশ তৈরী করেছিলো নিজেদের স্বার্থে অর্থাৎ এক কথায় বৃটিশরা সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটিকে নিজেদের মতো করেই দেখেছিলো। কিন্তু গান্ধী এর তাৎপর্য কখনই বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি ভারতবর্ষকে অখন্ড দৃষ্টিতে দেখার ফলে বিভক্ত ভারতের সমস্যাগুলোকে কখনই অনুধাবন করতে পারেননি।

১৯১৯ সাল থেকেই আমি লক্ষ্য করতে লাগলাম যে মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের জন্য গান্ধী তাদের একটার পর একটা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। পরিশেষে তো তিনি তাদের সব কিছুর পিছনেই দাঁড়িয়েছেন। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মিথ্যে দোহাই দিয়ে তিনি খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের মাধ্যমে আলাদা নির্বাচকমন্ডলী যখন গঠন করা হলো এবং যার মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়ের পৃথক রাজনৈতিক সত্তাকে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে বৃটিশরা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে ভাঙনের পথে নিয়ে যেতে সফল হলো তখনও কিন্তু গান্ধী নির্বিকারভাবে সব কিছু মেনে নিলেন। গান্ধী এমনকি সিন্ধু প্রদেশকেও আলাদা করার প্রস্তাবে সায় দিলেন। এই প্রক্রিয়াতেই গঠিত হলো নতুন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। এই সময়েই মুসলমানদের একটার পর একটা দাবী মেনে নিয়ে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন তিনি পাবেন। প্রখর বাস্তববাদী জিন্না, যিনি ছিলেন তখন মুসলিম লিগের একছত্র অধিপতি। সব সময় তার দাবীর সংখ্যা বাড়িয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু এতেও গান্ধীর মতিগতির কোনও পরিবর্তন নেই। শেষে ১৯৪০ সালে দু’জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জিন্না হাজির হলেন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবী নিয়ে। জিন্না কিন্তু বৃটেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টার কোনও ব্যাঘাত ঘটালেন না এবং এর দ্বারা তিনি বৃটেনের সহানুভূতি আদায় করে নিতে পারলেন। বৃটেন জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বকে সমর্থন জানালো। উল্টোদিকে যুদ্ধ শেষ হলে গান্ধীর কংগ্রেস ‘যে কোন মূল্যেই শান্তি’ এবং যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় বসা’ মনোভাবের ফলে জিন্নার নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। এর পরিণতিতে জিন্না দেশের এক তৃতীয়াংশ ভূমি পেয়ে গেলেন এবং এতে শুধু একটা একনায়কতন্ত্র দেশের জন্মই হলো শুধু তাই নয় দেশের ২০লক্ষ মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেলো। আমি যখন দেখতে পেলাম যে এত রক্তপাত এবং ধ্বংসের পরেও গান্ধী সেই একই তোষণের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন তখন আমার দেহ ও মন ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো এবং আমার সহ্যের সব সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম যে গান্ধী সেই সেই জিনিসই করতে চাইছেন যা বৃটিশরা পছন্দ করে। ভারত ভাগ করার বৃটেনের ষড়যন্ত্রকে গান্ধী পুরোপুরি ভাবেই মদত দিয়েছেন।

.

এই অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশে নাথুরাম গান্ধী হত্যার সপক্ষে তার মত ব্যাক্ত করেছেন।

প্রায় ৩২ বছর ধরে গান্ধীর মুসলিম তোষণের রাজনীতি চালিয়েও এবং সেই পথ থেকে ক্ষান্ত না হয়ে পরিশেষে গান্ধী যখন মুসলমানদের পক্ষ অবলম্বন করে অনশনে বসলেন তখন আমি আর স্থির এবং স্বাভাবিক থাকতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম যে গান্ধীর জীবনের চরম ছেদ ঘটানো দেশের স্বার্থেই একান্ত প্রয়োজন।

এবারে আমি আমার বক্তব্যের সমর্থনে গান্ধীর মুসলিম তোষণ নীতির বিষয়গুলির উল্লেখ করি।

১। খিলাফত আন্দোলন

২। মোপলা বিদ্রোহ

৩। আফগানিস্থানের আমীরের অনুপ্রবেশ

৪। আলাদা সিন্ধু প্রদেশ গঠন

৫। কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড

৬। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং

৭। সর্বপরি দেশভাগ

আমি এটাও এবার ভালভাবেই বুঝতে পারলাম যে গান্ধী সেটাই করতে চান যা মুসলমানেরা পছন্দ করে। একটার পর একটা পরাজয়ের পরেও গান্ধী কিন্তু কখনই তার মত অনুযায়ী তথাকথিত হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পথ থেকে সরে আসেননি। বাজীকরের মতো এই হিন্দু মুসলমান ‘ঐক্যের নেশায় তিনি আরও বুঁদ হয়ে থেকেছেন। এই বিষয়ে তার লক্ষ্য ছিলো জিন্নার সমর্থন আদায় করে দেশের একমাত্র নেতা বনে যাওয়া। কিন্তু মুসলিম লিগ এবং জিন্না গান্ধীর এই নীতিকে কোনও আমলই দেননি। ১৯২৯ সালের কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনের পর থেকেই তারা কংগ্রেস থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতার দাবী জানায়।

এরপর তো গান্ধীর মুসলমানদের প্রতি কোনও দুর্বলতা দেখানো উচিত ছিলো না কিন্তু তবুও তিনি মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার কাছে নতি স্বীকার করেন।

এরপরে আমি যেটা উল্লেখ করতে চাই তা হলো বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ডকে ডেকে আনা এবং এর ফলেই কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড ঘোষিত হয়ে যায় আর এই অ্যাওয়ার্ড ঘোষিত হবার ফলেই সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচন এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক ভোটদানের বিষয়টি আইনসিদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৯ সালে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগও ছিলো কংগ্রেস দলের এক মারাত্মক ভুল নীতির পরিচায়ক।

কিন্তু মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভা কংগ্রেসের পথে না হেঁটে মুসলিম স্বার্থকেই রক্ষা করেছিলো। গান্ধীর এই উচ্চাকাঙ্খা ছিলো যে তিনি কি হিন্দু, কি মুসলমান সকলেরই নেতা হবেন কিন্তু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে কংগ্রেস শুধু দেশের বা হিন্দুদের ক্ষতিই করলো না, ক্ষতি করলো গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদেরও। মহাত্মার কর্মনীতির জন্যেই হিন্দুদের মৌলিক অধিকার, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সব ক্ষেত্রেই ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিলো।

এবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গে আসি। আসি ‘ক্রীপস্ মিশন’ প্রসঙ্গেও। দুটি ক্ষেত্রেই তার ভূমিকা ছিলো নেতিবাচক। যে ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক তিনি নিজেই দিয়েছিলেন সেই ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে তিনি হঠাৎ স্থগিত ঘোষণা করে দিলেন শুধু তাই নয় তিনি নিজেই বললেন যে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এটা উল্লেখ করার বিষয় যে দেশের মানুষ কিন্তু তাঁরই ডাকে সাড়া দিয় ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ বলে হিংসাত্মক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ভাষার প্রশ্নেও গান্ধীর মুসলমানদের প্রতি দূর্বলতা নিয়ে। মুসলমানদের সন্তুষ্টিকরণের স্বার্থেই হিন্দী ভাষার পরিবর্তে গান্ধী হিন্দুস্থানী ভাষার রূপায়ণ চেয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে হিন্দুস্থানী ভাষাতে বাদশা রাম’ বা ‘বেগম সীতা’র উল্লেখ আছে। কিন্তু এই শব্দের অনুসরণে গান্ধী তো মিষ্টার জিন্নাকে শ্রীযুক্ত জিন্না বা মৌলানা আজাদকে পন্ডিত আজাদ বলার সাহস দেখাতে পারেননি। শুধুমাত্র হিন্দুদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েই গান্ধী সব সময় মুসলিম তোষণ চালিয়ে গিয়েছেন।

.

নাথুরামের বক্তব্যের এই অনুচ্ছেদের তৃতীয় অংশের শিরোনাম ছিলো ‘গান্ধী এবং স্বাধীনতা’ এই বিষয়টি নিয়ে বিচার পর্বে নাথুরাম ‘১৯১৪ সাল থেকে একমাত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন গান্ধী’ এই ধারণাকে নাস্যাৎ করে দিয়েছেন। এই বক্তব্যও তিনি খন্ডন করেছেন যে গান্ধীর নেতৃত্বেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছে। সেই অর্থে নাথুরামের বক্তব্য হলো গান্ধীকে কখনই Father of the Nation বা জাতির পিতা বলা যায় না।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন সব সময়েই জাগরুক থেকেছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে ১৮১৮ সাল পর্যন্ত মারাঠারা এবং ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত শিখেরা স্বাধীনতা আন্দোলনের মশাল প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছিলো। এর প্রায় ৯ বছর পরে অর্থাৎ ১৮৫৭ সালে সারা দেশ সশস্ত্র বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সাদা মানুষের শাসনের বিরুদ্ধে। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস দলের জন্ম হলো ভারতে বৃটিশ আধিপত্যকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে। এর পরিণতিতে স্বাধীনতার আকাঙ্খা আরও তীব্র হলে প্রথম প্রথম সাংবিধানকে ব্যবহার করেই স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। পরে অবশ্য তা হিংসাত্মক সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিলো। এই সময়ে ঘটেছিলো ক্ষুদিরামের বোমা ছোড়ার ঘটনা এবং এটা ঘটে ১৯০৬ সালে। সুতরাং এদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন কখনই থেমে থাকেনি। ফিনিক্স পাখির মতো এই আন্দোলনের আঁচ বরাবরই উপচে পড়েছে। উপরন্তু দেখা গেছে যে গান্ধী এই আন্দোলনে যুক্ত হবার পর থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি থমকে গিয়েছে। সংবিধানগত সংগ্রাম যেটা কংগ্রেসের মধ্যপন্থীরা শুরু করেছিলো ১৮৯২ সালে এবং ১৯০৯ সালের মর্লে-মিনটো সংস্কার, ১৯১৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার ইত্যাদি বিষয়গুলো স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সংবিধানগত সংগ্রামের বিশেষ একটা উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক ছিলো। গান্ধী আইন পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলেও মহান নেতারা যেমন লোকমান্য তিলক, এন সি কেলকার, সি আর দাশ, বীটলভাই প্যাটেল এবং পন্ডিত মোহন মালব্য প্রমুখেরা সংবিধানগত লড়াই থেকে ক্ষান্ত হন নি। এবার আমি উল্লেখ করতে চাই স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বিপ্লবীদের নাম। তার মধ্যে রয়েছেন সেই সব বিপ্লবীরা যেমন শ্যামজী কৃষ্ণভার্মা, লালা হরদয়াল, রাসবিহারী বসু, অরবিন্দ ঘোষ, ক্ষুদিরাম বসু, উল্লাসকর দত্ত, মদনলাল ধিংগড়া, ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেও এবং চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ। আমি উল্লেখ করবো গদর পার্টির কথা এবং সেই ‘কোমাগাতা মারু’র ঘটনাও। একথা অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে ১৯০৯ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে তার প্রত্যেকটির পিছনেই ছিলো এইসব বিপ্লবীদের ভূমিকা। এইসব কথাকে অস্বীকার করে যারা বলতে চান যে একমাত্র গান্ধীই ভারতের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তারা ইতিহাসকে বিকৃত করছেন মাত্র।

এরপর আমি উল্লেখ করতে চাই গান্ধীর সেই সব দূর্ভাগ্যজনক পরাজয়গুলিকে। এর মধ্যে রয়েছে গান্ধীর তথাকথিত অহিংস নীতি, ভারতছাড়ো আন্দোলন ইত্যাদি। অন্যদিকে দেখুন সুভাষচন্দ্রের ভূমিকাকে। এই মহান বীর শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামীই ছিলেন না বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিলেন। আবার কংগ্রেস সভাপতির লড়াইয়ে গান্ধীর ভূমিকাটাও দেখুন, গান্ধী তখন নাকি কংগ্রেসের এক আনার সদস্যও ছিলেন না কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুকে অন্যায়ভাবে পরাজিত করতে গান্ধী কি কোনও ভূমিকাই পালন করেন নি? তিনি কি সুভাষের বিরুদ্ধে সীতারামাইয়াকে মদত দেননি? নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি বলতে চাই যে তাঁর মতো বিপ্লবীর তুলনা এদেশে নেই। একাগ্র মানসিকতা নিয়ে লড়াই করে তিনি দেশের সম্মানের আসনের একেবারে শীর্ষস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন।

এই বিষয়ে আমি উল্লেখ করবো সেই সুভাষ বোসের ঐতিহাসিক অন্তর্ধানের কথাও। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াব্যাপী ভারতীয় জাতীয় সেনা (আই.এন.এ) গঠনের কথাও গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা উচিত। নেতাজী সুভাষ বসু এর পরেও থেমে না থেকে গঠন করেছিলেন এক অস্থায়ী সরকারও। এই অস্থায়ী সরকারের দ্বারাই সুভাষ বসু বৃটিশ ভারত আক্রমণ করেছিলেন যার ফলেই শেষ পর্যন্ত বৃটিশ শক্তি ভারত থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়। আমার ধারণা এবং এটা আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি যে নেতাজী সুভাষ বসু যদি সত্যি সত্যি ভারতে প্রবেশ করতে পারতেন, জীবিত ও বিজয়ী হিসেবে, তাহলে সারা ভারতবর্ষের মানুষ তাঁকেই নেতা হিসেবে বরণ করে নিতেন এবং সম্মানের আসনে বসাতেন। কিন্তু গান্ধীর ভাগ্য এতই ভাল ছিলো যে ১৯২০ সালেই লোকমান্য তিলক মারা গেলেন এবং গান্ধী ভারতবর্ষের নেতা হয়ে গেলেন। সুভাষচন্দ্র বেঁচে থাকলে গান্ধীকে বিপর্যস্ত ও পরাজিত হতে হতো কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু হলো বিদেশের মাটিতে। এর ফলে কংগ্রেস দলের পক্ষে সুবিধে হয়ে গেলো সুভাষ অনুরাগী কোটি কোটি ভারতবাসীর আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের মন জয় করা। আই.এন.এর কিছু অফিসারদের ও কংগ্রেস নিজের দলে টেনে নিলো এবং এমনকি ১৯৪৬ সালের সেই বিখ্যাত বিচারে তারা আই.এন.এন-এ অফিসারদের পক্ষে ও দাঁড়িয়ে গেলেন। কংগ্রেস নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জয় হিন্দ’ শ্লোগানটিকেও তাদের নিজের করে নিলো আর তার উপর ভর করেই কংগ্রেস দল ১৯৪৫-৪৬ এর নির্বাচনে বাজীমাত করলো। তারাও রাতারাতি ‘সুভাষপন্থী’ হয়ে গেলেন।

.

এরপর নাথুরাম উল্লেখ করলেন যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীর ভূমিকা নিতান্তই নগণ্য মাত্র। নাথুরামের দৃষ্টিতে গান্ধীকে বড়জোর একজন দেশপ্রেমিক বলা যেতে পারে।

দেশভাগ নিয়ে আরো একটা কথা আমার বলার আছে। প্রায় ২০ লক্ষ প্রাণ এবং ৩০ হাজার হিন্দু নারীর ধর্মান্তরকরণের মধ্যে দিয়ে যে দেশভাগ হলো এবং দেশভাগের প্রাক্কালে বাংলার যে মুখ্যমন্ত্রীর এতে ন্যক্কার জনক ভূমিকা (কলকাতা দাঙ্গা ইত্যাদি) ছিল গান্ধী কিন্তু সেই মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীকে আড়াল করতে ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ ভাগের পরিণতিতে যে কোটি কোটি হিন্দু অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পড়েছিল গান্ধী সেই বিষয়ে কোনও সহানুভূতি প্রকাশ করেননি।

যাইহোক গান্ধীর এই যে দেশপ্রেমিক আচরণ তা কিন্তু তার দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছিল। আমার মতে সুভাষচন্দ্র বসুই হলেন ভারতবর্ষের প্রধান বীর এবং শহীদ। তিনি মানুষের বিপ্লবী মানসিকতাকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু গান্ধী এবং তার সাগরেদরা সুভাষ বসুর এই মানসিকতাকে ধ্বংস করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন।

.

এরপর নাথুরাম পড়েছিলেন তার বক্তব্যের অনুচ্ছেদের চতুর্থ অংশটি এবং এর শিরোনাম ছিল- ‘আদর্শ সম্পর্কে হতাশা”।

দেশভাগের ফলে হিন্দু মুসলমান ঐক্যের সম্ভাবনা চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে গেলো। তার মুসলিমপ্রীতির জন্য জিন্নার পাকিস্তান পাওয়া সম্ভব হলো। গান্ধীর অন্তরাত্মা, বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এবং সর্বপরি তার অহিংসার তত্ত্ব সবই ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লো। তথাকথিত যে ঐক্যের ধারণা গন্ধী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন জিন্নার শক্ত চোয়ালের কাছে তা পরাস্ত হলো। ফলে গন্ধীর উচিত ছিলো হয় তার নীতির পরিবর্তন ঘটানো অথবা তার এই নিদারুণ পরাজয়কে স্বীকার করে নিয়ে জিন্না ও মুসলিম বিরোধী ঐক্যের যারাই দিশারী তাদের সঙ্গে যৌথসংগ্রাম গড়ে তোলা। কিন্তু গান্ধী এই বিষয়টি নিয়েও সততা দেখাতে পারেননি। তিনি দেশ এবং জাতির স্বার্থেও তার একগুঁয়ে মনোভাব পরিত্যাগ করতে পারেননি।

১৯২০ সাল থেকেই তো জিন্না ঘোষণা করে চলেছিলেন যে মুসলিম লিগ শুধুমাত্র মুসলমানদের পক্ষেই দাঁড়াবে। তাহলে তো এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কংগ্রেসকে হিন্দুদের পক্ষ অবলম্বন করাই উচিত। এটা যদি একান্তই অসম্ভব হতো তাহলে অন্তত হিন্দু স্বার্থের পক্ষ নিয়ে যারা আন্দোলন করছে তাদেরই সমর্থন করা গান্ধীর উচিত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভার আন্দোলনকে কংগ্রেসের অন্তত নৈতিক সমর্থন জানানো উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কংগ্রেস মুসলিম লিগের সব দাবিকেই মেনে নিলেও জাতীয় ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভা যে নীতি নিয়ে চলছিল তার প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিমূলক আচরণ করতে পারেনি। উপরন্তু কংগ্রেস দল হিন্দু মহাসভাকে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেই তার নিন্দা করেছে।

এই ভগ্ন ভারতবর্ষের জন্যেই কি শত শত বীর আত্মাহুতি দিয়েছে? হিন্দুরা যখন পূর্ব পাঞ্জাব বিহার, এবং দিল্লিতে মুসলিমদের উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছিল, যা পাকিস্তানের হিন্দুদের উপর মুসলমানদের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া স্বরূপই বলা যেতে পাবে – গান্ধী কিন্তু হিন্দুদের এই ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে নিন্দা করেছিলেন। গান্ধী কেন তখন পাকিস্তানের মুসলমানদের হিন্দুদের উপর অত্যাচার না করার পরামর্শ দেননি।

কাশ্মীর নিয়েও গান্ধী যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তাও বিশেষ নিন্দাসূচক একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একদিকে গান্ধী অহিংসার কথা বলেছিলেন কিন্তু কাশ্মীরে কি তিনি তার অহিংসনীতির প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন? কেন গান্ধীর এই দ্বিচারিতা?

আসলে আমার মনে হয় কাশ্মীর যুদ্ধ চালানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ আব্দুল্লাকে কাশ্মীরের মসনদে বসানো। কাশ্মীরে রাজনৈতিক ক্ষমতা মুসলমানদের হাতে যাচ্ছে এই চিন্তা থেকেই অনুপ্রবেশকারীদের হটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে গান্ধী সমর্থন করেছিলেন। একদিকে কাশ্মীরে মরণাপন্ন ঘটনা ঘটছে অন্যদিকে কিছু মুসলমানের বিপন্নতার কারণে গান্ধী দিল্লিতে অনশনে বসছেন। এ কেমন অহিংস নীতি?

কাশ্মীরে সৈন্য পাঠাতে নেহরুর সিদ্ধান্তকে গান্ধী তো পুরোপুরি সমর্থন করেছেন। গান্ধীর তো উচিত ছিলো সৈন্য পাঠানোর পরিবর্তে সেখানে অহিংস সত্যাগ্রহীদের পাঠানো। কাশ্মীরে রাইফেল পাঠানোর পরিবর্তে গান্ধীর কি সেখানে চরকা পাঠানো উচিত ছিল না? তাহলেই তো বোঝা যেত যে গান্ধীর অহিংসার তত্ত্ব কতটা মজবুত।

আমি এটা কখনই ভাবতে পারছি না যে বিংশ শতাব্দীতেও এই রকম একজন কপট মানুষ ভারতের মত একটা বিশাল দেশের নেতা হয়ে বসতে পারেন।

যে দিন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে গান্ধীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেব সেদিনই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে এর ফলে আমি কিন্তু আমার সব কিছু হারিয়ে ফেলবো। আমি কখনই কোনও দিন টাকাওয়ালা লোক ছিলাম না। কিন্তু যে সমাজে আমি বাস করি অর্থাৎ সেই মধ্যবিত্ত সমাজে আমার একটা সম্মান ছিল ব্যবহারিক সামাজিক জীবনে আমার যে ভূমিকা ছিল তাতে মানুষেরা আমাকে সম্মানের চোখে দেখতো। আমি একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ ছিলাম এবং স্বাস্থ্যই ছিল আমার একমাত্র সম্পদ। দেহগত কোনও অপূর্ণতা আমার ছিল না। কোনও কিছুতেই আমি আসক্ত ছিলাম না। স্বভাবপ্রকৃতির দিক থেকেও আমার মধ্যে কোনও রকম উগ্রতা ছিল না। যারা আমাকে জানতো তারা আমার শান্ত প্রকৃতির জন্য প্রশংসা করতো। আমি এটাও পরিস্কার করে জানাতে চাই যে আমি কিন্তু কখনওই কংগ্রেসের শত্রু নই। আবার এটাও কিন্তু আমি উল্লেখ করতে চাই যে আমার এবং গান্ধীর মধ্যে কিন্তু কোন রকম ব্যক্তিগত শত্রুতা অথবা বৈরিতা কখনই ছিল না। যারা এটা বলেন যে পাকিস্তানকে সমর্থন করার পেছনে গান্ধীর কোনও সৎ উদ্দেশ্য ছিল তাদের উদ্দেশ্যে আমি যেটা বলতে চাই তা হল আমি চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার শুধু পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে যে অবর্ণনীয় কষ্টের ইতিহাস রয়েছে তাকেই বিবেচনা করেছিলাম। আমি একটি কথা বারবার ঘোষণা করছি যে পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে শুধু একজনকেই জবাবদিহি করতে হবে এবং শুধু একজনই পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য সম্পূর্ণ দায়ী এবং তিনি হলেন গান্ধী এবং গান্ধী। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে বহু মানুষকেই প্রতারিত করা হয়েছে। এই রাষ্ট্র গঠন নিয়ে পাঞ্জাব, বাংলা, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধু প্রদেশের কোনও মানুষেরই মতামত গ্রাহ্য করা হয়নি।

তাই এইসব ঘটনায় আমি নিদারুণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। এমনকি পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও আমি যদি দেখতাম যে এই গান্ধীবাদী সরকার পাকিস্তানে বসবাসকারি আতঙ্কগ্রস্ত এবং অত্যাচারিত হিন্দুদের পেছনে দাঁড়িয়েছে তাহলেও আমি আমার নিজের মনকে সংযত করতে সক্ষম হতাম। গান্ধী এবং তার অনুগামীরা কিন্তু পাকিস্তানের হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বার বার আবেদন জানিয়েছিলেন যে তারা যেন কখনওই পাকিস্তান পরিত্যাগ না করেন। কিন্তু এর ফলে তো মুসলমানেরা আরও সুবিধে পেয়ে গেল হিন্দুদের উপর অত্যাচার করার যেটা পাকিস্তানের হিন্দুরা কখনওই বুঝতে পারেনি। এর পরিণতিতে ঘটলো নানা হত্যাকান্ডের ঘটনা। এইসব ঘটনার কথা মনে হলেই আমার মনের অঙ্গনে যেন আগুন ঝরতে থাকে। তবুও আমি বলতে চাই যে এই ঘটনা (গান্ধী হত্যা) যদি না ঘটত তাহলে তা আমার পক্ষে ভালই হতো। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এর ফলে আর আমার হাতের মধ্যে থাকলো না। তাই আমি মনে করলাম এই মানুষের কখনোই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটতে দেওয়া যায় না, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে তার ভুলের মাসুল তাকে প্রাণ দিয়েই ঢুকোতে হয়েছে। আমি প্রার্থনা করি যে ঈশ্বর তাঁকে ক্ষমা করুন তাঁর সৃষ্ট এই পবিত্র ভূমিকে কলুষিত করার অপরাধ থেকে।

.

ফাঁসির তিনদিন আগে নাথুরাম তার পিতা মাতার উদ্দেশ্যে যে শেষ চিঠি লিখেছিলেন তা নিম্নরূপ :

বিচার সভায় আমি আমার লেখা বিবৃতিটি পড়তে সময় নিয়েছিলাম প্রায় পাঁচ ঘন্টা। প্রথম এক ঘন্টার পর আমার একটি পায়ে সামান্য যন্ত্রণার কারণে আমি আমার দেহের ভারসাম্য কিছুটা হারিয়ে পেরেছিলাম। আসলে আমাকে তো অনেকদিন এভাবে একনাগাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। তাই হয়তো এমনভাবে ভারসাম্য হারানো।

যাইহোক এর পরের চারঘন্টা আমার বিবৃতি পড়তে আর কোনও অসুবিধে হয়নি। অবশ্যই পাঁচঘন্টার মধ্যে প্রায় ১৫-২০ মিনিট আমি বসেই বিবৃতিটি পড়েছিলাম। যেখানে বিচার সভাটি বসেছিল অর্থাৎ সেই কোর্ট ঘরে প্রবেশ নিয়ে বেশ কড়াকড়ি ছিল। কিন্তু যেদিন যেদিন আমার বিচারপর্ব অনুষ্ঠিত হত সেই দিনগুলোতে ভিড় হত খুব বেশি। শুধু তাই নয় সেই দিনগুলোতে অনেক গণ্য মান্য ব্যাক্তিদের সঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশ কিছু উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারীও। এছাড়া অবশ্য বেশকিছু বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ তো ছিলেনই। কোর্ট রুমে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা আমার বক্তব্যে এমনই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে দীর্ঘ ৫ ঘন্টা তাঁরা নড়াচড়া করতে পারেননি। শুধু তাই নয় আমার বক্তব্য যখন শেষ হল তখন তাঁরা আদালতের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমার কাছে এসে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। ইতি মধ্যেই কেউ কেউ জেনে ফেলেছিলেন যে আমার কফির প্রতি বিশেষ আকর্ষণের কথা। তাই তাঁরা বিশেষভাবে উৎকৃষ্ট কফি তৈরি করে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। আমার বক্তব্য বেশ উচ্চ মানের ছিল যদিও এই সময়টা ছিল খুবই প্রতিকূল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন