প্রথম ভাগ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও সমকালীন কলকাতা

অভিজিৎ পাল

প্রথম ভাগ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও সমকালীন কলকাতা

কথামুখ : উনিশ শতকের সমাজ

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে মূলত ইংরেজ শাসিত ঔপনিবেশিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্পর্শে ভারতীয় জনমানসে দ্রুত একের পর এক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থায় দাঁড়িয়ে অখণ্ড বঙ্গমানসে ও বঙ্গসমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণাগুলি কোনোটি আংশিক, কোনোটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হতে শুরু করে। সমাজে বহুকাল ধরে চলে আসা মধ্যযুগীয় শ্রেণিকৌলীন্য, বর্ণকৌলীন্য ও অর্থহীন কিছু ধর্মীয় অন্ধ-সংস্কারের মূলে এই সময় কুঠারাঘাত করে পাশ্চাত্য সভ্যতার বস্তুবাদ, যুক্তিবাদ, শিক্ষা, বিজ্ঞানচর্চা, নারীমুক্তির ধারণা, মানবতাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সহ আরও কিছু নবাগত বিষয়। বঙ্গের এই পরিবর্তমান সময়পর্বেই অবস্থান করছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। তিনি একাধারে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সমস্ত শুভ দিকগুলির বাহক এবং একই সঙ্গে উনিশ শতকের একজন নবজাগ্রত ব্যক্তিত্ব। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা না থাকায় তাঁর চেতনাবিশ্ব শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জটিলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজনিষ্ঠ প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রসারতা পেয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের পঞ্চাশ বছরের জীবনপর্বে তাঁর কৈশোর পর্যন্ত (১৮৩৬-১৮৫৩) জীবন কেটেছে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামাঞ্চলে এবং তাঁর কৈশোর উত্তীর্ণ জীবনপর্ব (১৮৫৩-১৮৮৬) কেটেছে মূলত দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে (তাঁর কায়িক জীবনের শেষ দুটি বছর কাটে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর ও কাশীপুর অঞ্চলে)। কলকাতায় বসবাস করলেও সারাজীবন কামারপুকুরের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ও যাতায়াত বজায় ছিল। বিশিষ্ট শ্রীরামকৃষ্ণ-গবেষক স্বামী প্রভানন্দ ‘একটি হিসাবের খাতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রত্যেক কর্মচারীর বছরে একমাস ছুটি প্রাপ্য থাকতো। শ্রীরামকৃষ্ণ এই ছুটি গ্রহণ করে কামারপুকুর যেতেন। তাছাড়াও বেশ কিছুবার তিনি অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে দীর্ঘ সময় কামারপুকুরে গিয়ে থেকেছেন। অর্থাৎ, উনিশ শতকের গ্রামসমাজ ও নাগরিকসমাজ উভয়ের সঙ্গেই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটেছিল। ‘কথামৃত’র পরিসরে মাস্টার মশাই শ্রীম মূলত শ্রীরামকৃষ্ণের নগরজীবনের প্রামাণিক বয়ান লিপিবদ্ধ করেছেন। এরই মাঝে মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত বেশ কিছু পূর্বকথার প্রসঙ্গে ‘কথামৃত’-এ দেখা গেছে তৎকালীন গ্রামসমাজের কথা, তথা টুকরো কিছু জীবন্ত ছবি। শ্রীরামকৃষ্ণের বহুবিধ কথার সূত্রেই ‘কথামৃত’র সমকালীন গ্রাম ও শহর উভয় সমাজের কিছু প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ছবি উঠে আসে, যাকে নির্দ্বিধায় তৎকালীন বঙ্গসমাজের বস্তুনিষ্ঠ প্রামাণিক দলিল বলা যায়।

সমাজপ্রেক্ষিত : গ্রাম ও শহর

• গ্রাম :

উনিশ শতকের প্রথমার্ধের গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে অষ্টাদশ শতকের গ্রামীণ সংস্কৃতির খুব বেশি পার্থক্য তখনও তৈরি হয়নি। ঔপনিবেশিক ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক শাসন-ব্যবস্থার কারণে ধীরে ধীরে গ্রামীণ সংস্কৃতির সমৃদ্ধ স্বনির্ভর অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর উৎপাদনশীল অর্থনীতি ক্ষয় পেতে শুরু করে। গ্রামবাংলার কৃষিজীবনের পাশাপাশি সমৃদ্ধ ছিল বস্ত্রশিল্প। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অতিরিক্ত শুল্কের কারণে ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত বস্ত্রশিল্প অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি বিদেশি রেশমের কাপড়ের প্রসারের পরে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী তাঁতবস্ত্রশিল্প বিনাশের সম্মুখীন হতে শুরু হওয়ার পর অখণ্ড বাংলাদেশের গ্রামের এই সমৃদ্ধ অর্থকরী পেশাটি ক্রমশ নষ্ট হয়ে যায়। গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে অর্থের আকাঙ্ক্ষায় ধীরে ধীরে গ্রামের একশ্রেণির মানুষ শহরমুখী হতে শুরু করে। পেশাগত কারণে ক্রমাগত গ্রামীণ সাধারণ মানুষের দল শহরে এলেও পুরোপুরি শহরে স্থায়ী বসবাসের বাসনা তাদের তখনও তৈরি হয়নি। তাদের চাকরিভিত্তিক পেশা শহরে থাকলেও জীবনের শিকড় গাঁথা ছিল গ্রামের মাটিতে। গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশেষত বৃদ্ধ ও মহিলাদের কলকাতা আগমনের অন্যতম আকর্ষণবিন্দু ছিল জলব্রহ্ম ভাগরথী গঙ্গাদর্শন ও ভারতের অন্যতম সতীপীঠ কালীঘাট কালিকা দেবীদর্শন। গ্রামীণ বিদ্যাচর্চা তখনও মূলত পাঠশালা ও টোলেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিদ্যাচর্চার বিষয় ছিল মূলত সংস্কৃত ও বাংলাভাষা। গণিতচর্চার অন্যতম উপাদান ছিল বাংলার প্রাচীন শুভঙ্করী ধাঁধা। গ্রামীণ বিদ্যাশিক্ষায় তখনও বিজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষাশিক্ষা প্রবেশ করেনি। পাশ্চাত্যের আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষার বিদ্যাচর্চার জন্য মানুষ শহরমুখী হতেন। বিদ্যাচর্চায় মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি তখনও ঐতিহ্যবাহী পুথির চর্চা বজায় ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণও ছেলেবেলায় কয়েকটি পুথি নকল (কপি) করেছিলেন এমন প্রামাণিক তথ্যও পাওয়া যায়। নকল করা সেই পুথিগুলির শেষে পুষ্পিকা অংশে শ্রীরামকৃষ্ণের নামের উল্লেখও রয়েছে—’গদাধর চট্টোপাধ্যায়’। তৎকালীন গ্রামীণ সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল কথকতা, মঙ্গলকাব্যের গান, যাত্রা ও পালাগান, কীর্তন, নগর সংকীর্তন, গাজন, মেলা, গ্রামের বিত্তবান জমিদারের গৃহের বিবিধ উৎসব, বিশিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের তর্কসভা। প্রাচীন কামারপুকুর অঞ্চলে রাঢ়বঙ্গের সর্বাধিক জনপ্রিয় মঙ্গলকাব্যের লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজার বিশেষ প্রচলন ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের পৈতৃক বাড়িতেও রঘুবীর শিলার পাশাপাশি শীতলা দেবীর নিত্য সেবা-পূজার ব্যবস্থা ছিল। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থের ‘পূর্বকথা ও বাল্যজীবন’ অংশে গ্রন্থকার স্বামী সারদানন্দ তৎকালীন কৃষিনির্ভর কামারপুকুর গ্রামাঞ্চলের সমৃদ্ধি ও স্বনির্ভরতার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। জমিদারী প্রথা গ্রামে তখন যথেষ্ট দৃঢ় ছিল। জমিদারের হাতেই মূলত পল্লীগ্রামের সার্বিক শাসনের দায়িত্ব বজায় ছিল। গ্রামীণ পল্লীসমাজে জাতিভেদ ও বর্ণকৌলীন্য যেমন বজায় ছিল তেমনই হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের স্থিতিশীল শান্ত সহাবস্থান সেই সময়ের গ্রামবাংলার আরেকটি সুস্থ ছবি। সত্যপীরের মতো কয়েকজন লৌকিক দেবতার সুবাদে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের নৈকট্যও বেড়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণও শিশু বয়সে মায়ের সঙ্গে কামারপুকুর থেকে সরাটি মায়াপুরে যাওয়ার পথে সত্যপীরের থানে (পীঠস্থানে) গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি’ গ্রন্থে অক্ষয়কুমার সেন লিখছেন:

 পথ সন্নিকটে এক পীরের আস্থান।
 সুশীতল বৃক্ষতল মনোরম স্থান।।
 সন্ধান পাইয়া মায়ে কন ধীরে ধীরে।
 দেহ দেহ দেহ গো মা নামাইয়া মোরে।।
 বৃক্ষমূলে অধিষ্ঠিত যথা সত্যপীর।
 পড়ে কত হাতি ঘোড়া বানান মাটির।।
 তাড়াতাড়ি ছুটিয়া গেলেন গদাধর।
 কি জানি কি ভাবে ভরে তাঁহার অন্তর।।

এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সন্মানের পেশা ছিল যজমানী। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, গোপ, তাঁতি, কৃষক, কামার, কুমোর, জেলে, ডোম প্রভৃতি জাতি ও পেশার মানুষের নিজস্ব পরিমণ্ডল ছিল। গ্রামের মধ্যেই তাদের পেশাগত প্রাথমিক নিশ্চয়তা থাকার কারণে শহরের জীবনযাত্রার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিশেষ ছিল না বলা চলে। গ্রামীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র ছিল সাপ্তাহিক হাট। বছরের বিভিন্ন সময়ে উৎসাবাদিতে মেলার আয়োজন করা হতো। তবে উনিশ শতকের শেষোর্ধে অতিরিক্ত শহরমুখী জীবনযাত্রার উৎসাহে গ্রামীণ ছোট ছোট অর্থকরী পেশাগুলি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে শুরু করেছিল। সবকিছু মিলিয়ে উনিশ শতকের গ্রামবাংলার সংস্কৃতির মধ্যে যেন অত্যাধুনিক চাকচিক্যময় শহুরে জীবনের ঠিক বিপরীতে আধুনিক জীবনযাপনের প্রয়াসহীন সহজতা লক্ষ্য করা যায়।

• শহর :

‘কথামৃত’র মূল পটভূমিতে রয়েছে তৎকালীন নগর কলকাতা। কলকাতা সেই সময় সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যনগরী। উনিশ শতকের শহর কলকাতায় মূলত অর্থকৌলীন্যের উপর ভিত্তি করে জন্ম হয়েছিল বাবু-সম্প্রদায়ের। এই শ্রেণির মানুষেরা ইংরেজ শাসকদের প্রতিপত্তি ও প্রসারতা তৈরি করারক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। ষড়যন্ত্র, কপটতা, শঠতা, তোষামোদ ও স্তাবকতা করে এই শ্রেণির মানুষেরা বিদেশি শাসকদের পাশাপাশি শহর কলকাতার বুকে বিশেষ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে অপরিমিত ভোগবাদ তাদের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। বাঁধনহীন জৈব ভোগাকাঙ্ক্ষা, অপরিমিত মদ্যপান, বাড়িতে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও পতিতা- বিলাস প্রভৃতিকে এরা গর্বসূচক সন্মান হিসেবে দেখেছিল। এর পাশাপাশি শাসকের ইংরেজি ভাষাশিক্ষা জন্ম দিতে শুরু করে চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এই পেশায় অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার পাশাপাশি চাকরিজীবনের থেকে অবসরপ্রাপ্ত অবস্থায় পেনশনের সুবিধা ছিল। ‘কথামৃত’র বেশ কিছু প্রসঙ্গে পেনশনের কথাও উঠে এসেছে। এই চাকরিজীবীরা শহর-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবহমান গ্রামীণ কায়িক পরিশ্রমের পেশাকে মনে করতে শুরু করেছিল নিম্নপেশা এবং আকাঙ্ক্ষা করেছিল উচ্চবিত্ত বাবুশ্রেণিতে পরিণত হওয়ার। বলাবাহুল্য, সমাজের সব মধ্যবিত্ত এইরকম ভাবনায় ডুবে ছিল এমন নয়, অবশ্যই এই ভাবনার ব্যতিক্রমও ছিল। পাশ্চাত্যের শিক্ষা, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বিজ্ঞানচর্চার প্রসার, যুক্তিবাদ প্রভৃতি যেমন জনমানসে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তেমনই ভারতীয় সংস্কৃতির অন্ধকারময় দিকগুলিকেই শুধুমাত্র বিচার করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি শিক্ষিত জনতা অন্ধভাবে প্রলুব্ধ হয়েছিল। কলকাতা শহরে এই পর্বে শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, ব্রাউটন ইনস্টিটিউশন, জেনারেল অ্যাসেম্বলি (বর্তমান নাম স্কটিশ চার্চ কলেজ), ভিক্টোরিয়া কলেজ, হিন্দু কলেজ (বর্তমান নাম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়), সংস্কৃত কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারতীয় সংগ্রহশালা, জাতীয় গ্রন্থাগারও এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। এইসব কেন্দ্রে চিরায়ত ভারতীয় সাহিত্য ও শাস্ত্রগুলি পাশ্চাত্য সাহিত্যের পাশাপাশি আকাদেমিক চর্চা শুরু হয়েছিল। এই পর্বেই গড়ে উঠেছিল বরানগর ওয়ার্কিং ম্যান্স ইনস্টিটিউট, কম্পট্রোলার জেনারেল অফিসের মতো বাণিজ্যিক সংস্থা। ‘কথামৃত’র পরিসরে এর মধ্যে অধিকাংশ সংস্থারই নামের উল্লেখ রয়েছে। বিজ্ঞানের উন্নতির হাত ধরে ভারতীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ কবিরাজি চিকিৎসার পাশাপাশি প্রচলন ঘটেছিল হোমিওপ্যাথি এবং অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার। কলকাতার রাজপথে রাতের চেহারা বদলে দিতে শুরু করেছিল গ্যাসের উজ্জ্বল আলো। শহর কলকাতার মধ্যবিত্তের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল যাত্রা ও থিয়েটার। প্রথম দিকে যাত্রা বা থিয়েটারে পুরুষ অভিনেতারাই নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন, ধীরে ধীরে নারীচরিত্রে নারীরা অভিনয় করতে শুরু করেন। তবে তুলনামূলকভাবে যাত্রাশিল্পের অনেক আগে থিয়েটারশিল্পে নারী অভিনেত্রীরা সম্পূর্ণ পেশাগতভাবেযুক্ত হয়েছিলেন। ‘কথামৃত’র ১৮৮৪-র ২৪ মে’র ঘটনায় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির মন্দিরপ্রাঙ্গণের নাটমন্দিরে ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালা অভিনয় প্রসঙ্গে জনৈক পুরুষ অভিনেতার নারীচরিত্রে অভিনয়ের উল্লেখ রয়েছে, আবার কিছুদিন পরেই কাছাকাছি সময়ে কলকাতার স্টার থিয়েটারে গিরিশচন্দ্রের থিয়েটার দলে অভিনেত্রীরা অভিনয় করছেন তারও উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও ‘কথামৃত’-এ কলকাতার বিনোদন হিসেবে দেখা যায় গড়ের মাঠে সার্কাস দেখা এবং চিড়িয়াখানায় পশু-পাখি দেখার কথা। উনিশ শতকে কলকাতার বিভিন্ন ছাপাখানার কল্যাণে মুদ্রিত বই সহজলভ্য হয়ে উঠতে শুরু করে এবং এই সময়ের আরও দুটি নতুন উপকরণ ছিল সংবাদপত্র ও সাহিত্যপত্রিকা। এই শেষ দুটি উপকরণের সূত্রে তৈরি হতে শুরু করেছিল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও সারস্বত সমাজ। ‘কথামৃত’র পরিসরে তৎকালীন বুদ্ধিজীবী ও সারস্বত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের কথোপকথন নথিবদ্ধ রয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাতেও গ্রামসুলভ সহজতা ম্লান হয়ে বাহ্যিক চাকচিক্য হয়ে উঠতে শুরু করেছিল অকথিত নাগরিক সভ্যতার স্বাভাবিক নিয়ম। ‘কথামৃত’-এ দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের আগে নিজের পোশাক নিয়ে ইতস্তত করছেন। ‘কথামৃত’র বর্ণনায় রয়েছে:

ঠাকুর গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন। মাস্টার পথ দেখাইয়া বাটীর মধ্যে লইয়া যাইতেছেন। উঠানে ফুলগাছ, তাহার মধ্য দিয়া আসিতে আসিতে ঠাকুর বালকের ন্যায় বোতামে হাত দিয়া মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন,”জামার বোতাম খোলা রয়েছে,—এতে কিছু দোষ হবে না?” গায়ে একটি লংক্লথের জামা, পরনে লালপেড়ে কাপড়, তাহার আঁচলটি কাঁধে ফেলা। পায়ে বার্নিশ করা চটি জুতা। মাস্টার বলিলেন,”আপনি ওর জন্য ভাববেন না, আপনার কিছুতে দোষ হবে না; আপনার বোতাম দেবার দরকার নাই।” বালককে বুঝাইলে যেমন নিশ্চিন্ত হয়, ঠাকুরও তেমনি নিশ্চিন্ত হইলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের এই সংকোচের কারণ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই সময়ে কলকাতার একজন গণ্যমান্য সারস্বত ব্যক্তিত্বদের একজন। আবার তিনি পেশাগত দিক থেকেও যথেষ্ট উচ্চ-পদাধিকারী। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আগে কখনও সাক্ষাৎ না থাকায় শ্রীরামকৃষ্ণ নাগরিক প্রসাধন সম্পর্কে এতটা বেশিই সচেতন। তৎকালীন কলকাতার কিছু অংশে গ্রামের মতোই জমিদারি প্রথা চালু ছিল। সমাজে আইনের হাত ধরে সতীদাহের মতো কুপ্রথা বন্ধ হলেও বিধবা বিবাহের প্রচলন তখনও মেনে নিতে পারেনি এই শহর। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। গ্রামের মতোই বাংলার নবজাগরণের পীঠস্থান হিসাবে চিহ্নিত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও তখনও বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়নি। তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় নারীশিক্ষা অনেকটাই সাফল্যের মুখ দেখেছিল। শ্রীরামকৃষ্ণও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তাঁর স্ত্রী শ্রীসারদা দেবীকে যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে বিদ্যাচর্চা করিয়েছিলেন বলে জানা যায়। অবশ্য শ্রীসারদা দেবীর বিদ্যানুরাগ শিশুবয়স থেকেই বজায় ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে এবং শ্যামপুকুরে বসবাসের সময়ও তিনি বিদ্যাচর্চা করেছিলেন বলে জানা যায়। কলকাতা শহরে বড়বাজার অঞ্চল সেই সময় ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তবে বড়বাজারের ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ছিলেন অবাঙালি।

নবজাগরণের গঠনভূমি ও ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন

প্রাচীন ভারত শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে একদা সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিল। ভারতের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তার স্মারক। কিন্তু বারবার একের পর এক বহির্শত্রুর হিংসাত্মক আক্রমণ এবং ধ্বংসমুখী জয়সূচনার মধ্যে দিয়ে ভারতভূমি তার প্রাচীন গৌরব হারিয়ে ফেলেছিল। বিবিধ রাজনৈতিক কূটকৌশল ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার জন্য ক্রমাগত ভারতীয় বৈদিক সনাতন ধর্ম কুসংস্কারগ্রস্ত হতে শুরু করে। বংশানুক্রমিক চতুর্বর্ণে বিভাজিত সমাজব্যবস্থা ও হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক ভেদাভেদ সাধারণ মানুষকে পরস্পরের থেকে দূরে সরাতে সক্ষম হয়েছিল। বিবিধ স্বার্থে এই পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহ দিয়েছিল বিদেশি শাসক ও আমাদের দেশের একদল ধর্মব্যবসায়ী সুবিধাবাদী রক্ষণশীল গোঁড়া সমাজপতিরা। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ধর্মের নামে রাজনীতি, ব্যাভিচার ও পুরোহিত শ্রেণির দ্বারা প্রচারিত ধর্মীয়বিধানগুলি সাধারণ মানুষকে জড় করে তুলেছিল। পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) পর বঙ্গদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রমশ ক্ষয়ীষ্ণু মুসলমান শাসনের অবসান ঘটে। শুরু হয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের কালপর্ব। এর কিছুকাল পরে লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস, লর্ড ওয়েলেসলির শাসন এবং লর্ড বেন্টিং ও লর্ড ডালহৌসির সমাজ-সংস্কার ও শিক্ষা সংক্রান্ত কয়েকটি কোম্পানির আইনে ভারত তথা বঙ্গের চিরায়ত চিন্তা-চেতনায় সজোরে ধাক্কা লাগে। অনেক দোলাচল ও জটিল অবস্থার পর ভারতে ১৮৩৫ নাগাদ পাশ্চাত্য ভাষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। ইংরেজ শাসকের পক্ষ থেকে ডালহৌসি সাহেবের আমলে প্রতিটি ব্রিটিশ প্রদেশে শিক্ষাবিভাগ গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। সেই সূত্রে কলকাতায় গড়ে ওঠে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭)। এই প্রচেষ্টাগুলি ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে বাস্তবিকই ইতিবাচক হয়ে দেখা দিয়েছিল। শাসকের এই হিতৈষী পদক্ষেপগুলি উনিশ শতকের বাঙালির পুনরায় স্বমহিমায় জাগরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক জীবন মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে লিখছেন:

প্রকৃতপক্ষে, পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে মধ্যযুগীয় ভারতীয় ধ্যানধারণা, অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের স্থলে দেখা দিল মানুষের বিচারশক্তি, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞাননিষ্ঠ চেতনা—শুরু হল আধুনিকতার পাদপীঠে চিরাচরিত শাস্ত্রীয় বিধি ও নীতিশাস্ত্রের এক যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞাননিষ্ঠ মূল্যায়ন। ভারত-ইতিহাসে এই ঘটনা ‘নবজাগরণ’ বা ‘রেনেসাঁস’ নামে পরিচিত।

বাস্তবিকই আধুনিক শিক্ষার আলো পেয়ে ভারতভূমি নতুন করে ভাবতে শিখছিল। তবে বাংলার নবজাগরণের দুটি স্পষ্ট দিক ছিল। প্রথমটি, নবাগত পাশ্চাত্য-শিক্ষা, বিজ্ঞান, জ্ঞানচর্চা, সভ্যতা-সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা; এবং দ্বিতীয়টি, ভারতীয় চিরায়ত প্রাচ্যবিদ্যা ও সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কার। অন্যান্যদেরমতো এই দুটি দিককেই স্বীকার করে শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় একে ব্যাখ্যা করছেন:

বঙ্গীয় রেনেসাঁসের মূল এজেন্ডা ছিল দুটি—আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিগ্রহণ ও প্রাচীন প্রাচ্য বিদ্যার পুনরুদ্ধার। গোটা উনিশ শতক জুড়ে বাঙালি বিব্রত ছিল আতিথ্য ও গার্হস্থ্যের সেই মহানাটকীয় বয়নকর্মে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রবল হয়ে উঠেছিল পশ্চিমীয়ানা। দ্বিতীয়ার্ধে ফুঁসে ওঠে অভিমানিনী প্রাচ্য।

ধর্ম ও দেশাচারের গতানুগতিকতায় জড়ভারগ্রস্থ জীবনকে উদ্ধার করার নবপ্রকল্পে প্রথমত পাশ্চাত্যের যুক্তিনির্ভর মানবতাবাদী শস্ত্রগুলিকেই ব্যবহার করা হয়েছিল।

পাশ্চাত্যের যুক্তিনির্ভর আলোর স্পর্শ পেয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির অন্ধকারময় দিকটি বাস্তবিকই প্রকট হয়েছিল। কিন্তু শুধু অন্ধকারময় দিকটিকেই বারবার আঙুল দিয়ে দেখানোর ফলে আলোকিত দিকগুলি অজ্ঞাতসারে অন্তরালে চলে গিয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির এই মোহাঞ্জন কাটতে শুরু করে ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়ের মূলত কলকাতায় বসবাসের সময়পর্ব থেকে (১৮১৫-১৮৩০)। নব্যশিক্ষিত যুবসমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণে ডুবে যেতে শুরু করে। পাশ্চাত্যেরশিক্ষাব্রতী মিশনারী ধর্মযাজকেরা বুদ্ধিমত্তারসঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার পাশাপাশি ভারতীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের ধর্ম-বীজ গেঁথে দেওয়া শুরু করেছিলেন। হ্যাঁ, অবশ্য স্বীকার্য তাদের মধ্যেও বেশ কিছু ভালো ও আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন। তরুণ নরেন্দ্রনাথ দত্তকে শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ধান প্রথম যিনি দিয়েছিলেন, সেই ইংরেজি সাহিত্যের মুক্তমনা অধ্যাপক উইলিয়াম হেস্টি, তিনিও কিন্তু একজন ইংরেজ ছিলেন। পাশ্চাত্যের বিচারহীন অন্ধ অনুকরণ হতে দেখে সচেতন হয়ে ওঠেন কিছু সচেতন বাঙালি চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। আর বাস্তবিকই সেদিনের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। ফলস্বরূপ ভারত তথা বঙ্গের চিরায়ত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে পুনরায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটির পর একটি সমাজ-সংস্কার এবং ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে উনিশ শতকের বঙ্গসমাজে।

• ব্রাহ্মসমাজ:

উনিশ শতকের বাংলায় সংস্কার আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাগ্রে ধ্বনিত হওয়া একটি নাম ব্রাহ্মসমাজ। ১৮২৮-এ রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত এই আন্দোলন হিন্দুদের আচারসর্বস্ব ধর্মযাপনের বিরোধিতা করে তাদের অন্ধকারময় কুসংস্কারের ভাবনাগুলির উপর প্রথম আলো তুলে ধরে। রক্ষণশীল ও আচারপ্রিয় পরিবারের সন্তান হয়েও রামমোহন ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর বিশ্লেষণী মুক্তচিন্তা নব্যশিক্ষিতদের খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার প্রবণতাকে রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজে তিনি হিন্দু ধর্মের বাহ্যিক আচার ও মূর্তিপূজাকে বাদ দিয়ে নাস্তিকতার প্লাবন থেকেও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আধুনিক চেতনার আলোয় রামমোহন রায় বুঝতে পেরেছিলেন তৎকালের সেই ক্ষয়ীষ্ণু মুহূর্তে যখন নব্যশিক্ষিত যুবসমাজের একাংশ হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে কিছু ভ্রান্তিকে অনুভব করে খ্রিস্টান ধর্মের মোহের ভ্রান্তিতে ক্রমাগত ডুবতে শুরু করেছে এবং তাদের সূত্র ধরে আধুনিক সভ্যতার মোড়কে সমাজে নতুন অভিযাত্রার শুরু হয়েছে তখন এই বিদেশি চকচকে ভ্রান্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রাচীন হিন্দু ধর্মের আচারসর্বস্বতা বাদ দেওয়ার আশু প্রয়োজন। রামমোহন ব্রাহ্মসমাজে সেই প্রচেষ্টায় সাফল্য পেয়েছিলেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজে হিন্দুদের অজস্র সাকার দেবতার উপাসনার পরিবর্তে প্রাচীন উপনিষদ কথিত প্রমত্তা সগুণ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার পুনরায় প্রচলন করলেন। মনে হয়, খুব সম্ভবত আধুনিক চিন্তায় তিনি হিন্দুদের সাকার উপাসনার যুক্তিবাদী কোনো সদুত্তর পাননি, বরং এতে তিনি শুধুমাত্র বাহ্যিক পৌত্তলিকতা অনুভব করেছিলেন। এর বাইরেও ব্রাহ্মসমাজের এই নিরাকার একেশ্বরবাদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদ ও খ্রিস্টান ধর্মের একেশ্বরবাদের ধারণার সঙ্গে বহুলাংশে সামঞ্জস্য ছিল। রামমোহন রায় প্রচারিত এই একেশ্বরবাদ সম্পূর্ণত উনিশ শতকের সংযোজন ভাবলে আংশিক ভুল হবে। উপনিষদের পাশাপাশি ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’য় কৃষ্ণ সম্পর্কিত একেশ্বরচেতনা রয়েছে। ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’র বিভূতিযোগ অধ্যায়ে (দশম অধ্যায়) শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন:

যচ্চাপি সর্বভূতানাং বীজং তদহমর্জুন।

ন তদস্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভুতং চরাচরম্।।

অর্থাৎ, হে অর্জুন, যা সর্বভূতে বীজস্বরূপ তাও আমি। এখানে স্থাবর বা জঙ্গম এমন কোনো কিছু নেই যা আমাকে ছাড়া সত্তাবান হতে পারে। সর্বভূতেই সেই এক আমি! ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র প্রাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যেমন একেশ্বরবাদ ধ্বনিত হয়েছিল, তেমনই ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’তেও প্রায় একই রকম একেশ্বরবাদের কথা ছিল। ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’তে রয়েছে দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া রণাঙ্গনে অসুরকে বলছেন:

একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।

পশ্যৈতা দুষ্ট মষ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।১০

অর্থাৎ, অদ্বিতীয় একা আমিই এই জগতে বিরাজিতা। একমাত্র আমি ছাড়া আর কেই বা আছে এই জগতে! হে দুষ্ট, ব্রহ্মাণীপ্রমুখ দেবীরা আমারই অভিন্না বিভূতিবিশেষ। এই দেখ, তারা সকলেই আমার মধ্যেই বিলীন হচ্ছেন। এরপর চণ্ডীতে দেবীর সেই অদ্বিতীয় সত্তার আরও কিছু কথা রয়েছে। এখানে বাহ্যিক পার্থক্য শুধু এইটুকুই যে, উপনিষদের একেশ্বরবাদ পরমব্রহ্মকে ঘিরে এবং ‘শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা’র একেশ্বরবাদ শ্রীকৃষ্ণকে এবং ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র একেশ্বরবাদ দেবী মহামায়া আদ্যাশক্তিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল। ব্রাহ্মরা এই প্রাচীন বহুকে একেশ্বরবাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, শুধু তাঁদের আঙ্গিকটি ছিল উনিশ শতকীয়। যুগোপযোগী রূপান্তরের জন্য সেই সময় বাঙালির জীবনচর্চায় ব্রাহ্মসমাজের এই নিরাকার ভাবনাটি অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। তৎকালীন সমাজে যারা সম্পূর্ণভাবে সাকার উপাসনা সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে সক্ষম তাদের জন্য ব্রাহ্মসমাজের দরজা ছিল উন্মুক্ত। সমাজে প্রচলিত অনমনীয় ও কঠোর গোঁড়ামি বলতে সাধারণ অর্থে যা বোঝায় ব্রাহ্মসমাজে তা বাহ্যিকত ছিল না। জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-বিত্ত-সমাজ নির্বিশেষে মানুষের সমানাধিকার তৈরি হয়েছিল ব্রাহ্মসমাজের পরিমণ্ডলে। তবে সাকারচেতনা বাঙালি সমাজে যে এতকাল ধরে বয়ে আসছিল, তার বিপরীতে এই নতুন সময়ের নিরাকার ভাবনা গ্রহণ করতে অনেকেই অক্ষম হয়েছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবে ব্রাহ্মসমাজের মতগুলি কখনও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে উঠতে পারেনি। শুধুমাত্র ধর্মচর্চার মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ তাঁদের সংস্কার ভাবনাকে সীমাবদ্ধ রাখেনি, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, বাল্যবিবাহ, কুলীনের বহুবিবাহ যেমন তাঁরা রোধ করার চেষ্টা করেছিল; তেমনই নারীর বাধ্যতামূলক চিরবৈধব্যের হাত থেকে রক্ষা করতে বিধবাবিবাহে তাঁরা উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। নারীশিক্ষার প্রসারেও ব্রাহ্মসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের সময়েই ব্রাহ্মসমাজ বাঙালির জনচেতনায় বিপুল সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। রামমোহনের পর আদি ব্রাহ্মসমাজে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের মধ্যে মতাদর্শ সহ বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে পারস্পরিক বিরোধ তৈরি হলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষমতাবলে আচার্যের পদ থেকে কেশবচন্দ্র সেনকে বহিষ্কার করেন। ১৮৬৬ নাগাদ আদি ব্রাহ্মসমাজের একাংশ ভেঙে জন্ম নেয় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। এখানে মন্দির-মসজিদ-গির্জার একটি সমন্বয়ের ভাব তৈরি হয়েছিল। এর কিছু সময় পরে ১৮৭৮-এ ব্রাহ্মসমাজের ভেতর ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে তাঁর কয়েকজন তরুণ অনুগামীদের গুরুতর বিরোধ তৈরি হলে শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ কেশবচন্দ্র সেনের সাহচর্য ত্যাগ করে গড়ে তোলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। কেশবচন্দ্র সেনের সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভাবনা, বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে দাঁড়ানো, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা পদ্ধতির পাশাপাশি অফুরন্ত ভক্তিবাদ ও অবতারবাদের প্রতি আস্থা সহ আরো কিছু অব্রাহ্মোচিত আচরণ প্রভৃতির জন্য ব্রাহ্মসমাজে আবার দ্বন্দ্ব তৈরি হলে কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা গড়ে তোলেন নববিধান সমাজ। ব্রাহ্মসমাজের আদিপর্বে উগ্র সাকার বিরোধিতা ছিল না। কিন্তু ক্রমশ সেই বিরোধিতা বাড়তে থাকে। ব্রাহ্ম ও অব্রাহ্মেও তীব্র ভেদাভেদ তৈরি হতে শুরু করে। নিরাকার সাধনায় বিশ্বাসীর পক্ষে সাকারকে মান্যতা দেওয়া যেন অস্বীকৃত হয়ে ওঠে। ‘কথামৃত’র পাতায় শ্রীম’র সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের দ্বিতীয় দর্শনের দিনের দৃশ্যে তা চিত্রিত রয়েছে তাঁদের কথোপকথনে। সেখানে রয়েছে:

শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, তোমার ‘সাকারে’ বিশ্বাস, না ‘নিরাকারে’?

মাস্টার (অবাক্ হইয়া স্বগত)—সাকারে বিশ্বাস থাকলে কি নিরাকারে বিশ্বাস হয়? ঈশ্বর নিরাকার, এ-বিশ্বাস থাকিলে ঈশ্বর সাকার এ-বিশ্বাস কি হইতে পারে? বিরুদ্ধ অবস্থা দুটাই কি সত্য হইতে পারে? সাদা জিনিস—দুধ, কি আবার কালো হতে পারে?

মাস্টার—আজ্ঞা, নিরাকার—আমার এইটি ভাল লাগে।

শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বেশ। একটাতে বিশ্বাস থাকলেই হল। নিরাকারে বিশ্বাস, তাতো ভালই। তবে এ-বুদ্ধি করো না যে, এইটি কেবল সত্য আর সব মিথ্যা। এইটি জেনো যে, নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য। তোমার যেটি বিশ্বাস, সেইটিই ধরে থাকবে।

মাস্টার দুইই সত্য এই কথা বারবার শুনিয়া অবাক্ হইয়া রহিলেন। এ-কথা তো তাঁহার পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে নাই।১১

মাস্টার মশাই শ্রীম’র ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত ছিল। তাই প্রথম দিকে তাঁর মধ্যেও এই রকম প্রচলিত নিরাকার ও সাকারের দ্বন্দ্ব বজায় ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের বক্তব্যটি এখানে অবশ্য নতুন। দুটিই সত্য! বাংলাদেশের চিরায়ত ঐতিহ্যবাহী সাকারভাবনা ব্রাহ্মসমাজের কাছে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য হওয়ার কারণে হিন্দুদের সনাতনপন্থীদের সঙ্গে ব্রাহ্মমতের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ফলে আংশিক হলেও ব্রাহ্মদের হিন্দুসমাজের পরিচিত গণ্ডির বাইরে রাখারও প্রচেষ্টা হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজও প্রথাগত রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত হয়ে আরেকটি নতুন রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেছিল। তাঁদের মধ্যে সাকারবাদীদের সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে পর্যন্ত সমালোচনা তৈরি হতে শুরু করেছিল। ‘কথামৃত’র মধ্যে দেখা যায় ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের পদে বিরাজমান বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে উৎকট সমালোচনা তৈরি হয়েছে, সেই সংবাদ জানতে পেরে শ্রীরামকৃষ্ণ বিজয়কে ইতিবাচক সান্ত্বনা দিচ্ছেন:

বিজয় তখনও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত, ওই ব্রাহ্মসমাজে একজন বেতনভোগী আচার্য। আজকাল তিনি ব্রাহ্মসমাজের সব নিয়ম মানিয়া চলিতে পারিতেছেন না। সাকারবাদীদের সঙ্গেও মিশিতেছেন। এই সকল লইয়া সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কর্তৃপক্ষীয়দের সঙ্গে তাঁহার মনান্তর হইতেছে। সমাজের ব্রাহ্মভক্তদের অনেকেই তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। ঠাকুর হঠাৎ বিজয়কে লক্ষ্য করিয়া আবার বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়ের প্রতি সহাস্যে)—তুমি সাকারবাদীদের সঙ্গে মেশো বলে তোমার নাকি বড় নিন্দা হয়েছে? যে ভগবানের ভক্ত তার কূটস্থ বুদ্ধি হওয়া চাই। যেমন কামারশালের নাই। হাতুড়ির ঘা অনবরত পড়ছে, তবু নির্বিকার। অসৎ লোকে তোমাকে কত কি বলবে, নিন্দা করবে! তুমি যদি আন্তরিক ভগবানকে চাও, তুমি সব সহ্য করবে। দুষ্টলোকের মধ্যে থেকে কি আর ঈশ্বরচিন্তা হয় না? দেখ না, ঋষিরা বনের মধ্যে ঈশ্বরকে চিন্তা করতো। চারিদিকে বাঘ, ভাল্লুক, নানা হিংস্র জন্তু। অসৎ লোকের, বাঘ ভাল্লুকের স্বভাব; তেড়ে এসে অনিষ্ট করবে।১২

‘কথামৃত’র পরিসরের অনেকগুলি চরিত্রই দেখা যায় প্রাথমিকভাবে তাঁরা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে এখানে মাস্টার মশাই শ্রীম ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। অনেক জটিলতা ও দ্বন্দ্ব থাকলেও পরধর্ম গ্রহণের হাত থেকে নব্যশিক্ষিত তরুণদের রক্ষা করতে বাস্তবিকই ব্রাহ্মসমাজ সেই সময় যথেষ্ট উপযোগী হয়েছিল, একথা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

• আর্যসমাজ:

১৮৭৫-এ বেদ-অভিজ্ঞ বাগ্মী পণ্ডিত স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সুতার্কিক অভিজাত সন্ন্যাসী ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর চিন্তা-চেতনা ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের সঙ্গে মিলতে না পারার ফলে তিনি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেননি। পাশ্চাত্যের ইংরেজি শিক্ষায় ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে ওঠা ভারতকে তিনি বৈদিক শাস্ত্রের শুভ চেতনাকে স্পর্শ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে ধর্মচর্চার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত ধর্মযাপনকে তিনি ত্যাগ করার পক্ষপাতি ছিলেন না, তবে প্রয়োজন মতো মার্জনা তিনি চেয়েছিলেন। সমাজে প্রচলিত মূর্তিপূজা, জাতিভেদ, বাল্যবিবাহ প্রথার তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। এরই সঙ্গে নারীশিক্ষা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, বিধবাবিবাহ, সমুদ্রপথে বিদেশযাত্রার পক্ষে তিনি নিজের সুচিন্তিত মত জানিয়েছিলেন। এই কারণে তাঁর অনুগামীরাও এই সব বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহিত হয়েছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের অনেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচিত ছিলেন, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁদের মতো পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু প্রাচ্যের ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য তৈরি হয়েছিল। পূর্বে যে সব মানুষ হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অন্যধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের আবার হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন দয়ানন্দ। বলাবাহুল্য তার ফল খুব একটা ইতিবাচক হয়নি। কাশীতে একটি শাস্ত্রীয় সম্মেলনে অসাধারণ জয়লাভের পর সারা দেশে তাঁর খ্যাতি দ্রুত প্রসারিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর কলকাতার সিঁথিতে ঠাকুরদের বাগানে ‘কাপ্তেন’ বিশ্বনাথ উপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে স্বামী দয়ানন্দকে দর্শন করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দয়ানন্দ সরস্বতী পরস্পরের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। ‘কথামৃত’-এ রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের সম্পর্কে শুভ ধারণা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী সকলকে জানিয়েছিলেন, শ্রীম সেই প্রসঙ্গে লিখছেন:

দয়ানন্দ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে যখন দর্শন করেন ও তাঁহার সমাধি অবস্থা দেখিলেন, তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমরা এত বেদ-বেদান্ত কেবল পড়েছি, কিন্তু এই মহাপুরুষে তাহার ফল দেখিতেছি; এঁকে দেখে প্রমাণ হল যে পণ্ডিতেরা কেবল শাস্ত্র মন্থন করে ঘোলটা খান, এরূপ মহাপুরুষেরা মাখনটা সমস্ত খান।১৩

বিদেশি শাসক ও সংস্কৃতির প্রতি একটা কালাপাহাড়ি ভাবনা আর্যসমাজে ছিল। বিদেশি ইংরেজদের বিরুদ্ধে উত্তর ভারতের হিন্দু সমাজকে শক্তিশালী করে তুলতে আর্যসমাজকে ভারতের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনগুলির বাইরে বলা যায় না। স্বামী দয়ানন্দের ভাবধারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অল্প হলেও বাঙালির জনচেতনায় সাড়া ফেলতে পেরেছিল।

• থিয়োসফি আন্দোলন:

ব্রাহ্মসমাজ ও আর্যসমাজের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকে যখন পাশ্চাত্যের উগ্র জড়বাদ কিছুটা হলেও প্রতিহত হয়েছে, তখন বিদেশাগত থিয়োসফি চিন্তাধারা ধীরে ধীরে ভারতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। রহস্যবাদ, যুক্তিবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক ভাবচেতনার অনবদ্য সংমিশ্রণে অলৌকিক ভাবনা পুষ্ট হয়ে ১৮৭৫-এ নিউইয়র্কে থিয়োজফি চেতনা ব্যাপ্তি লাভ করে। সোয়েডেনবার্গ, একহার্ট, জ্যাকব বোম্বে, ব্যাডার সহ আরও অনেক বিদেশি পণ্ডিত এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৬ নাগাদ মাদ্রাজে মার্কিন অধিবাসী কর্নেল ওলকট ও মাদাম ব্লাভাটস্কি গড়ে তোলেন থিয়োসফিক্যাল সোসাইটি। বিখ্যাত থিয়োসফিস্ট শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত এই সোসাইটির প্রসারের কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাশ্চাত্যের এই আন্দোলনটির বহিরঙ্গে প্রাচ্যভাবের ছোঁয়া ছিল বলে পাশ্চাত্যের পাশাপাশি প্রাচ্যের বহু মানুষ এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছিলেন। ‘কথামৃত’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ থিয়োসফি সম্পর্কে সামান্য দু-একটি কথা বলেছেন মাত্র। তিনি ভক্তিবাদী দৃষ্টিতে মন্তব্য করেছেন,”ভক্তিই একমাত্র সার—ঈশ্বরে ভক্তি! তারা কি ভক্তি খোঁজে? তাহলে ভালো।”১৪ শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাচ্যের অলৌকিক ক্ষমতা ও সিদ্ধাইয়ের বিপরীতে তাঁর নিজের মত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ভক্তিকেই চিরকাল কাঙ্ক্ষিত ভেবেছেন। চিরকাল তিনি সিদ্ধাইকে কাঙ্ক্ষিত ভাবতে চাননি। সেই সূত্রে ধরে অনুমান করা যায় থিয়োসফি থেকে যে অলৌকিক ক্ষমতা জন্মায় বলে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, তার পক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের মত না থাকাই খুব স্বাভাবিক। উনিশ শতকের মতো বিজ্ঞানপুষ্ট সময়ে শহরের শিক্ষিত মহলে এই আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে স্বামী নির্বেদানন্দ লিখছেন:

সম্পূর্ণ বিদেশাগত এবং বহু ভাবের বিচিত্র সংমিশ্রণে গঠিত হলেও এর প্রভাব ভারতবাসীদের ওপর যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। একদল শিক্ষিত ভারতবাসী দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক ভাষা ও অলৌকিকত্বের সঙ্গে নিজ ধর্মবিশ্বাস জড়িয়ে রাখতে চাইতেন।… তাঁরা দেখলেন, থিওসফি তাঁদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কৃত্রিম ঠাটটুকু রক্ষা করে বুদ্ধিজ আনন্দ দিতে পারবে, আবার সেই সঙ্গে রহস্য-প্রিয়তার স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষার খোরাকও জোগাতে পারবে।১৫

বুদ্ধিজ আনন্দ দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় আধুনিক ও যুগোপযোগী রসদ পাশ্চাত্যজাত এই আন্দোলনের ভেতর যথেষ্ট পরিমাণে মজুত ছিল। তাছাড়া স্বধর্মে স্থিত থেকেও পাশ্চাত্যের এই থিয়োসফি ভাবধারা গ্রহণেও কোনো বাহ্যিক বাধা ছিল না। ফলে বঙ্গদেশে এই ভাবধারার পরিসরও সহজেই বাড়তে পেরেছিল।

• বাউল ও সহজিয়া সম্প্রদায়:

সমসাময়িক ধর্মসংস্কারের পথে সম্ভবত লোকায়ত বাউলদের প্রভাব এসে লেগেছিল নগর কলকাতায়। শ্রীরামকৃষ্ণের সমসাময়িক বাংলাদেশের একজন বাউল ব্যক্তিত্ব লালন সাঁই। বাউলদের লোকায়ত মানবতাবাদ, জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা, মানুষের ভেতর ঈশ্বরকে (মানুষ রতন) অনুভবের ভাবনা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই সমান গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ‘কথামৃত’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ বাউলদের গান গেয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁদের আধ্যাত্মিক চেতনাকে। শক্তির ও ব্রহ্মের ধারণার সঙ্গে বাউলদের লোকায়ত ভাবনাকে মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন তিনি। ‘কথামৃত’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন:

শাক্তমতের সিদ্ধদের বলে কৌশলে। বেদান্তমতে বলে পরমহংস। বাউল বৈষ্ণবদের মতে বলে সাঁই। ‘সাঁইয়ের পর আর নাই!’

বাউল সিদ্ধ হলে সাঁই হয়। তখন সব অভেদ। অর্ধেক মালা গোহাড়, অর্ধেক মালা তুলসীর। ‘হিন্দুর নীর—মুসলমানের পীর’।

সাঁইয়েরা বলে—আলেখ! আলেখ! বেদমতে বলে ব্রহ্ম; ওরা বলে আলেখ। জীবদের বলে—’আলেখে আসে আলেখে যায়’; অর্থাৎ জীবাত্মা অব্যক্ত থেকে এসে তাইতে লয় হয়!১৬

সহজিয়া সম্প্রদায়গুলির মধ্যে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রভাব অনেকটাই পড়েছিল নগর কলকাতায়। কর্তাভজাদের পুরুষ-নারীর মিলিত সাধনার নামে ব্যভিচারের দৃষ্টান্ত হিসেবে কামারপুকুরের ভগবতী (ভগি) তেলীকে শ্রীরামকৃষ্ণ দেখেছিলেন। তিনি কর্তাভজাদের সাধনার স্তরভেদ সম্পর্কে জ্ঞাত হলেও সাধনপথের সঙ্গে রতিযোগকে ভালো চোখে দেখেননি। বরং সাবধান করেছেন তাঁর অনুগামীদের। এছাড়াও হঠযোগের অধিকারীদের পার্থিব দেহের সুখের জন্যে শরীরের প্রতি অতিরিক্ত যত্ন ও আয়ুবৃদ্ধির বহুবিধ চেষ্টাকে তিনি মন থেকে সমর্থন করেননি, সমর্থন না করলেও কোনোভাবেই তিনি ঘৃণা করেননি। এখানেও শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্য ভাবনার স্পর্শ পাওয়া যায়।

• ইয়ংবেঙ্গল দল:

হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি ডিরোজিও-র অনুগামী ছাত্ররা হিন্দু সম্প্রদায়ের যাবতীয় ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রকাশ্য পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করে ভারতীয় সংস্কৃতির আধুনিক সংস্কারের নামে অজ্ঞাতেই নৈতিক স্থলনে পর্যবসিত হয়েছিলেন। মদ্যপান ও খ্রিস্টান ধর্মের মোহ তাদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা গিয়েছিল। এই নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, রাধানাথ সিকদার, লালবিহারী দে, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। এই ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী বা ডিরোজিয়ানদের বিরোধিতায় সমবেত হয়েছিল তৎকালীন বঙ্গের বহু মানুষ। ডিরোজিও-র উপরেও সেই অভিঘাত এসে লেগেছিল। অধ্যাপক সুকুমার সেন হিন্দু কলেজের সম্পর্কে একটি তথ্য দিয়েছেন:

ডিরোজিও কবি ছিলেন, দেশপ্রিয় ছিলেন, (এদেশে বসবাসকারী পর্তুগীজ সন্তান বলিয়া) ডিরোজিও নিজেকে ভারতবাসী বলিয়া মনে করিতেন, সর্বোপরি স্বাধীনচিত্ত ভাবুক ছিলেন। ছাত্রদের উপর ডিরোজিওর ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন চিত্ততার প্রবল প্রভাব দেখিয়া ছাত্রদের অভিভাবকেরা শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। পাদ্রিরাও তাঁর প্রতি বিরূপ হইলেন। শাসনকর্তৃপক্ষও অসন্তুষ্ট হইলেন।১৭

ডিরোজিও-র মৃত্যুর পর এই ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী অনেকাংশে বিপথে চালিত হয়। অনেকেই তাঁদের উগ্র জীবনচর্চার ভ্রান্তিকে অনুভব করেন। অনেকেই নিজেদের পূর্ব-সংস্কারে ফিরেও আসেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে ইয়ংবেঙ্গল সুলভ জীবনযাপনের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন।১৮

• সনাতনপন্থী:

বঙ্গদেশে যখন একের পর এক নতুন সংস্কারবাদী আন্দোলন চলছে, তখনও সাধারণ মানুষের চেতনার সিংহভাগ জুড়ে অবস্থান করছিল সনাতনপন্থী হিন্দু পণ্ডিতদের প্রভাব। নব্যশিক্ষিতদের সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আধুনিক চিন্তাধারাকে তাঁরা নিজেদের ধর্তব্যের মধ্যেই ভাবতে চাননি। বরং প্রথম পর্বে উপেক্ষাই করেছেন। চিরায়ত প্রথাগত প্রাচ্যের সাধারণ মানুষের অগাধ সমর্থন পেয়ে বাংলার উনিশ শতকেও ব্রাহ্মণ্যবাদী এই প্রথাগুলি গর্বোন্নত ভাব নিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছিল। সনাতনপন্থীরা মূর্তিপূজা, ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার, জাতিভেদ, আচার সর্বস্বতা, অস্পৃশ্যতা, নারীর বাধ্যতামূলক চিরবৈধব্য, কৌলীণ্যপ্রথার পক্ষে এবং পাশ্চাত্যের বিদ্যাচর্চা, সমুদ্রযাত্রা ও প্রায় সব রকম নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিশেষত সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলি ভিত্তিভূমি ছিল যেমন শহর কলকাতা, তেমনই সনাতনপন্থীদের এই চেতনা মূলত গ্রাম বাংলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। শহর কলকাতাও তখনও এর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হতে পারেনি। ধর্মীয় গোঁড়ামি সহ আরও যেসব ভ্রান্তি এই প্রাচীনপন্থী ধর্মভাবনার বহিরঙ্গে ছিল, তাকে সংশোধনের কোনোরূপ তাগিদ তাঁরা অনুভব করেননি। বহুকাল থেকে চলে আসা কিছু ভ্রান্ত রীতিনীতিকেও তাঁরা ধর্মযাপনের অঙ্গ ভেবে ভুল করেছিল। বিশেষত বলা যায়, নব্য সংস্কারবাদীদের থেকে কোনো রকম আংশিক সংস্কারচেতনাও তাঁরা গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী দেখাননি। স্বামী নির্বেদানন্দ এই সনাতনপন্থী গোষ্ঠীদের মনোভাব সম্পর্কে লিখছেন:

ভুলই হোক, আর ঠিকই হোক, সনাতনপন্থীরা হিন্দুয়ানিকে সমগ্রভাবে গ্রহণ করে তার সঙ্গে হয় বেঁচে থাকতে, নয় বিনষ্ট হতে দৃঢ়সংকল্প হয়েছিলেন; সংস্কারকদের কাছ থেকে কোনরূপ আংশিক হিন্দুয়ানি গ্রহণ করতে চাননি তাঁরা। সংস্কারকেরা প্রাচীনপন্থী জনসাধারণের এই মনোভাবকে উৎকট ও বেশ বিপজ্জনক বলেই ধরে নিয়েছিলেন।১৯

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অনুভব করা যায়, বাস্তবিকই সেই পর্যায়ে সমাজ ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ধর্মের সংস্কারের আশু প্রয়োজন ছিল। ধর্ম একটি সৌভ্রাতৃত্বের পবিত্র বন্ধন তৈরি করে, মানুষকে মানুষের কাছে আনে, মানুষের থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে না। অথচ সনাতনপন্থীদের এই জাতীয় উৎকট রক্ষণশীল মনোভাব ভবিষ্যতের কাছে বিপজ্জনক হয়ে ওঠাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ধর্মের প্রতি মানুষের ভালোবাসার পরিবর্তে অমূলক ভীতি এবং উৎকট কিছু সংস্কারবদ্ধ হয়ে থাকার মধ্যে শুভ চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। তাছাড়া সনাতনপন্থীদের মধ্যেও পারস্পরিক বিবাদ বজায় ছিল। বিশেষত বৈষ্ণব ও শাক্তদের মধ্যে বিবাদ ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রত্যেকেই মনে করতেন তাঁদের পথই একমাত্র অনুসরণীয়। অন্যপথে কোনো সারবত্তা নেই। এই ধরণের ধারণা ধর্মীয় গোঁড়ামির পাশাপাশি উৎকট অবাঞ্ছিত তর্ক ও বিবাদের সূচনা করত। অন্যের মতকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার একটি দুর্বুদ্ধি তাঁদের মধ্যে বিশেষ সজাগ থাকত। ‘কথামৃত’র মধ্যেও তাঁর কিছু বাস্তবিক ছবি ধরা রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এই জটিল সামাজিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষভাব সম্পর্কে সংশয়ের অবসান ঘটাতে চাইছেন; ‘কথামৃত’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করেছেন:

“এইরকম বৈষ্ণব শাক্তদের ভিতর রেষারেষি। বৈষ্ণব বলে, আমার কেশব,—শাক্ত বলে, আমার ভগবতী, একমাত্র উদ্ধারকর্তা।

“আমি বৈষ্ণবচরণকে সেজোবাবুর কাছে নিয়ে গিছলাম। বৈষ্ণব চরণ বৈরাগী খুব পণ্ডিত কিন্তু গোঁড়া বৈষ্ণব। এদিকে সেজোবাবু ভগবতীর ভক্ত। বেশ কথা হচ্ছিল, বৈষ্ণবচরণ বলে ফেললে, মুক্তি দেবার একমাত্র কর্তা কেশব। বলতেই সেজোবাবুর মুখ লাল হয়ে গেল। বলেছিল, ‘শালা আমার!’ (সকলের হাস্য) শাক্ত কিনা। বলবে না? আমি আবার বৈষ্ণবচরণের গা টিপি।

“যত লোক দেখি, ধর্ম ধর্ম করে—এ ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে, ও ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে।২০

সনাতনপন্থীদের অতিরিক্তই মুক্তমনের অভাব এবং অযথা পারস্পরিক বিবাদ, অন্ধ কু-সংস্কার সঙ্গে নিয়ে চলা সেদিনের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আলোর স্পর্শ লাগা শিক্ষিত নব্যযুবদের কাছে শেষ পর্যন্ত বিরক্তি উৎপাদন করেছিল। ধর্মীয় পরিমণ্ডলের এই দোষগুলির কারণে তাঁরা চিরায়ত হিন্দুধর্মের প্রতি আস্থা ও উৎসাহ হারাতে শুরু করেছিল। এই জটিলতর প্রেক্ষাপটেই উনিশ শতকের বঙ্গসমাজে শ্রীরামকৃষ্ণের উঠে আসা। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও সনাতনপন্থী, তবে তিনি রক্ষণশীল গোঁড়ামির সম্পূর্ণ বিপরীতে উদারচেতা ও মুক্তমনা। সনাতনপন্থাকে অবলম্বন করে ভারতীয় সনাতন ধর্মের প্রকৃত অর্থ সন্ধান করেছেন তিনি। বলা যেতে পারে, এই পন্থার অতীতের গৌরবময় ইতিহাসকে তিনি উনিশ শতকে আবার প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সনাতন ধর্মের প্রথাগত চিন্তার বাইরে গিয়ে নতুন করে ভেবেছিলেন। কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে সনাতনপন্থার সার সত্যের সন্ধানে তিনি নিজের জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সবকটি ধর্মপথে তিনি স্বয়ং অভিজ্ঞতা অর্জন করে বাঙালি কাছে নজির স্থাপন করলেন ধর্ম মানে বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং সৌভ্রাতৃত্বের একটি সূত্র। তাঁর জীবনযাত্রা ও ধর্মচিন্তা যেন প্রাচীনপন্থী ও নব্যপন্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঘটে চলা পারস্পরিক বিবাদের একটি সুস্থ সমাধানের নজির স্থাপন করতে পারলো। বলা যেতে পারে উনিশ শতকের আধুনিক বঙ্গসমাজে শ্রীরামকৃষ্ণের এই নতুনতর ভাবনাবিশ্ব ছিল যথার্থই যুগোপযোগী। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা বা শিক্ষাপদ্ধতির আলোকে বেড়ে না ওঠা মুক্তমনা শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে এই যে অবলীলায় অসাধ্যসাধন ঘটে গেল, তাকে সমগ্র উনিশ শতকের নবজাগরণের সমাজ ও ধর্মযাপনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিস্ময় ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে!

উনিশ শতকের শিক্ষা ও যুক্তিবাদ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে লর্ড বেন্টিং ও লর্ড ডালহৌসির সমাজ ও শিক্ষা সংক্রান্ত কয়েকটি আইনে বাঙালির আবহমান সংস্কারে আঘাত হেনেছিল। ১৮১৩-এর ‘চার্টার অ্যাক্ট’ ভারতের আকাদেমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য কোম্পানি বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ধার্য করে। কিন্তু শিক্ষাদানের পদ্ধতিটি প্রাচ্য না পাশ্চাত্যের অনুগামী হবে, তা নিয়ে প্রাচ্যপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে মতান্তর চলে। অবশেষে লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনামলে কোম্পানির শিক্ষাসচিব লর্ড মেকেল ভারতের পাশ্চাত্যভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। ১৮৩৩-এ শিক্ষাখাতে ব্যয়ের জন্য পূর্বের এক লক্ষ টাকার পরিবর্তে দশ লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়। সেই সূত্রে তৈরি হয় ‘কলকাতা মেডিকেল কলেজ'(১৮৩৫)। অবশ্য ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘হিন্দু কলেজ’ (১৮১৭), সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪)। লর্ড ডালহৌসির আমলে ইংরেজ শাসিত প্রতিটি প্রদেশে শিক্ষা বিভাগ গড়ে ওঠে। যার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৮৫৭-এ মূলত পাশ্চাত্যের শিক্ষাপদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের তিনটি প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়— কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। পাশ্চাত্যের শিক্ষার প্রভাবে নব্যশিক্ষিত যুবসমাজে অচিরেই প্রভাব ফেলল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, নিরীশ্বরবাদ, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, লোকহিতবাদ, ঐহিকতা, প্রত্যক্ষ ধ্রুববাদ, স্বদেশপ্রেম, নারীমুক্তির মতো বিষয়। এছাড়াও সিগমুন্ড ফ্রয়েড, চার্লস ডারউইন, কার্ল মার্কস, জন স্টুয়ার্ট মিল, ডেভিড হিউম সহ আরও বেশ কয়েকজনের তত্ত্ব ও ভাবনার প্রভাব আমাদের মানস চালচিত্রে ধীরে ধীরে দাগ ফেলতে শুরু করে। এই দৃষ্টিকোণ বা মতবাদগুলির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এসে পড়েছিল উনিশ শতকের বঙ্গসমাজে, সাহিত্যে এবং ধর্মভাবনায়। বিদেশি শাসকদের এই লোকহিতকর শুভ প্রয়াস এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির চিরায়ত প্রাচ্যবিদ্যা, চিন্তাচেতনা ও ঐতিহ্যকে চাপা দিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে চাকচিক্যময় উন্নত ও আধুনিক সভ্যতার মোড়কে উপস্থাপিত করে ভারতীয়দের অভিরুচি ও চিন্তা-চেতনাকে আমূল পরিবর্তন করে ইংরেজ সুলভ করে তোলার কূট-চেষ্টার অভিঘাত নব্যশিক্ষিতদের মনে ভারতীয় সংস্কৃতির সম্পর্কে সংশয়ের আকর গড়ে তুলল। স্বামী নির্বেদানন্দ এই জটিল পরিস্থিতি সম্পর্কে বলছেন:

নতুন শাসন-ব্যবস্থার ফলে দেশে যে শিক্ষা-পদ্ধতি প্রবর্তিত হল, তার ঝোঁক ছিল এমন সব মানুষ গ’ড়ে তোলার দিকে, জাতিতে ভারতীয় হলেও যাদের রুচি ও চিন্তাধারা হবে ঠিক ইংরেজদের মতোই। সে শিক্ষার প্রভাবে ভারতের অন্তর্জীবন ভেঙে যাবার গতিবেগ হয়ে উঠল দ্রুততর। এই বিজাতীয় শিক্ষার মাধ্যমে তরুণের দল সংস্কৃতি সম্বন্ধে অদ্ভুত সব ধারণা অর্জন করতে লাগল; যেমন: সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, ভারতে তার কিছুই নেই; তার সমগ্র অতীত ব্যয়িত হয়েছে শুধু কতকগুলো অলীক আদর্শের নির্বোধোচিত অন্বেষণে; সত্যি যদি ভারত বেঁচে থাকতে চায়, তাহলে নিজেকে পুরোপুরি ইওরোপীয় সভ্যতার ছাঁচে ঢেলে গড়তে হবে। বলা বাহুল্য, এই সব যাদুমন্ত্রের মোহিনী শক্তিতে ভারতবাসীর আত্মবিশ্বাস ঝিমিয়ে পড়ল।

সাংস্কৃতিক সম্মোহনের প্রচণ্ড প্রভাবে ভারতবাসীরা যখন এভাবে অভিভূত হয়ে পড়েছে, তখন নবপ্রবর্তিত শিক্ষাপদ্ধতির অনুগামী কতকগুলি অশুভ প্রভাব এসে নিজস্ব আদর্শ থেকে বিচ্যুত করে তাদের বিপথগামী করার জন্য প্রচণ্ডভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠল।

ইংরেজী সাহিত্যের মাধ্যমে দেশের ওপর দিয়ে নাস্তিকতার প্লাবন বয়ে গেল।… শূন্যবাদী চিন্তাও হিন্দুবিশ্বাসের দুর্গ আক্রমণ করল। শত শত মনীষী তখনই আত্মসমর্পণ করে প্রকাশ্যভাবেই বশ্যতা স্বীকার করলেন জড়াত্মক বস্তুবাদের কাছে, আর শুরু করলেন নাস্তিক্যবাদী জীবনধারায় গর্ববোধ ও উল্লাস প্রকাশ করতে।…

এ আঘাত হয়েও যাঁরা রয়ে গেলেন আরো একটা বিধ্বংসী শক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হল তাঁদের। ভারতে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন আর খৃষ্টধর্ম-প্রচার একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেল, খৃষ্টান মিশনারীরা প্রায়ই এ-দুটি কাজ একসঙ্গে করতেন। শিক্ষক হিসাবে তাঁদের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত; কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, প্রচারক হিসাবে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল খুব সঙ্কীর্ণ।২১

স্বামী নির্বেদানন্দের এই বিশ্লেষণ যে খুব বেশি বিতর্কিত তা বলা যাবে না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনের পাতায় পাতায় এই নব্য বাঙালি-ইংরেজদের জীবনযাত্রার খণ্ডচিত্র ধরা আছে। মধুসূদন দত্ত সজ্ঞাতে এই নব্য বাঙালি-ইংরেজদের ব্যঙ্গে জর্জরিত করেছেন। যুবক বয়সে মধুসূদনও খ্রিস্টধর্মের মোহে অলীক খ্যাতির প্রত্যাশায় স্বধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। হয়তো অপরিণত বয়সে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজের জীবনে এই বিভ্রান্তির প্রত্যক্ষত শিকার হয়েছিলেন বলেই ভ্রান্তি কাটার পর ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র মতো একটি তৎকালীন সমাজসত্য লিখতে পেরেছিলেন।

প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক, মিশনারীদের প্রচারিত চিন্তা, চেতনা, আদর্শ, মতামতগুলিকে তৎকালীন বঙ্গের নব্যশিক্ষিতরা যথার্থ বিচার শক্তি থাকা সত্ত্বেও ঠিক কেন মেনে নিয়েছিলেন! এর উত্তরে স্বীকার করতেই হয় যে, ভারতের বিশেষত বঙ্গের ধর্মচেতনা বেশ কিছু কারণে জৈবিক দৃষ্টিতে কলুষিত হয়েছিল। সমসাময়িক নাগরিক চেতনা গূঢ় রহস্যময় তন্ত্রের বামাচার, বৈষ্ণবীয় রাগানুগা ভাবরসের সাধনা, বাউলদের নারীসঙ্গের গূঢ় সাধনার ভাবনা, কর্তাভজা সম্প্রদায় সহ আরও কিছু সহজিয়া গোষ্ঠীর নারী-পুরুষের মিলিত সাধনা প্রভৃতিকে সংস্কৃত সমাজ খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি। এর মধ্যে যেমন বেশ কিছু শুদ্ধ ধর্মচিন্তা ছিল, তেমনই ব্যাভিচারের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। এর পাশাপাশি প্রতিটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চেতনার কারণে উগ্র পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা, বিরোধ ও একে অন্যকে ভ্রষ্টপথ করে দেওয়ার ঘৃণ্য কূটকৌশল ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে নব্যশিক্ষিতদের মনে অনেকাংশে অনীহা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ‘কথামৃত’-এ নিজের চেনা জগতের এই রকম একটি বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করছেন শ্রীরামকৃষ্ণ:

ও-দেশে ভগি তেলী কর্তাভজার দলের। ওই মেয়েমানুষ নিয়ে সাধন। একটি পুরুষ না হলে মেয়েমানুষের সাধন-ভজন হবে না। সেই পুরুষটিকে বলে ‘রাগকৃষ্ণ’। তিনবার জিজ্ঞাসা করে, কৃষ্ণ পেয়েছিস? সে মেয়েমানুষটা তিনবার বলে, পেয়েছি।

ভগি (ভগবতী) শূদ্র, তেলী। সকলে গিয়ে তার পায়ের ধুলো নিয়ে নমস্কার করত, তখন জমিদারের বড় রাগ হল। আমি তাকে দেখেছি। জমিদার একটা দুষ্ট লোক পাঠিয়ে দেয়—তার পাল্লায় পড়ে তার আবার পেটে ছেলে হয়।২২

ভারতীয় প্রাচ্য-ধর্মের যে প্রাণশক্তি ও সদর্থকচেতনা এতকাল ধরে বিভিন্ন কারণে বঙ্গমানসে তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তাকে নবজাগ্রত বাঙালির কাছে নিজের জীবনের সঙ্গে যুগোপযোগীভাবে মিশিয়ে আলোকিত করে তোলার উদাহরণ সেদিনের নগর কলকাতায় ছিল না বললেই চলে। উনিশ শতকের এক-একটি নতুন ধর্মসংস্কারক গোষ্ঠীর ভেতরকার কলহে তাঁদের সমবেত প্রয়াসগুলি ভেঙে যাওয়া বাঙালির ধর্মভাবনাকে আরও বিভ্রান্তির মধ্যে নিয়ে ফেলে। সেই পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা, বাহ্যিক বিরোধ ও অপূর্ণতা মোচন করতে পেরেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই কারণে শহুরে শিক্ষিতমণ্ডলী ‘কথামৃত’র পরিসরে এসেছে।

উনিশ শতকে পাশ্চাত্যের শিক্ষার আলোয় যখন কলকাতা নগরী ভাসতে শুরু করেছে তখন বঙ্গদেশের গ্রামসমাজের চিত্রটি রয়ে গিয়েছিল বিগত শতকের মতো। গ্রামীণ শিক্ষা পাঠশালা ও টোলের মধ্যেই তখনও মূলত সীমাবদ্ধ। নিজগ্রামে ছেলেবেলায় পুথিবিদ্যার চর্চা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণও। বঙ্গসমাজে প্রচলিত একটি ভ্রান্তি রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ নিরক্ষর ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘কথামৃত’-এ বহুবার নিজেকে ‘মূর্খ’ বা ‘মূর্খোত্তম’ বলেছেন। কথাটি ঠিক নয়, তিনি প্রগাঢ় বিষয় থেকে একথা বলেছেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় আকাদেমিক শিক্ষিত ছিলেন না, একথা সত্য; কিন্তু কামারপুকুরে থাকাকালে তিনি তুলোট কাগজে ৩৯ পাতার পুথি শঙ্কর কবিচন্দ্রের ভণিতায় ‘হরিশ্চন্দ্রের পালা’, কৃত্তিবাস ও কবিচন্দ্র দুটি বিভ্রান্তিযুক্ত ভণিতায় ৩১ পাতার পুথি ‘মহিরাবণের পালা’, দ্বিজ বাঞ্ছারামের ভণিতাযুক্ত ‘যোগাদ্যার পালা’ পুথি, মাত্র ১৩ পাতার তেরিজাপাতাতে লেখা ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র পুথি নকল (কপি) করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘রামকৃষ্ণায়ণ’ নামে আরও একটি পুথি নকল করেছিলেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে ‘যোগাদ্যার পালা’ ও ‘রামকৃষ্ণায়ণ’ পুথির নকলগুলি পাওয়া না গেলেও অন্য পুথিগুলি পাওয়া যায়। পুথিতে কবিনামের ভণিতার পাশাপাশি পুষ্পিকা অংশে শ্রীরামকৃষ্ণের নামের উল্লেখ রয়েছে ‘গদাধর চট্টোপাধ্যায়’।২৩ গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থায় পাশ্চাত্যের ছাপ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সেভাবে দেখা যায়নি। শ্রীরামকৃষ্ণ বড় দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় বসবাসের সময় ঝামাপুকুর অঞ্চলে টোল খুলেছিলেন। তবে সেই টোল দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারেনি। দাদা রামকুমার তরুণ শ্রীরামকৃষ্ণকে পড়ানোর অনেক চেষ্টাও করেছিলেন, তবে শ্রীরামকৃষ্ণ এই ধরণের পুথিগত বিদ্যাচর্চায় রাজি হননি। শ্রীরামকৃষ্ণের জেদের কাছে তাঁর দাদা হার স্বীকার করেছিলেন। টোলের মতো এই ধরণের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতায় ক্রমাগত ক্ষয়ীষ্ণু হয়ে আসছিল। অনুমান করা যায়, শাসকের ভাষাশিক্ষা পেশাজীবনে ফলপ্রসূ হবে জেনে অভিভাবকেরাও পাশ্চাত্য শিক্ষাপদ্ধতি ও ইংরেজি ভাষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ফলে গ্রামীণ শিক্ষাপদ্ধতিতেও তার ছাপ পড়াই ছিল খুব স্বাভাবিক। উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ব্যক্তিত্বদের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার বিদ্যা-শিক্ষাজীবন গ্রামীণ শিক্ষাপদ্ধতিতেই সীমিত। পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে তিনি আসেননি। অথচ বাংলার নবজাগরণের যুগে শ্রীরামকৃষ্ণের চিন্তা, চেতনা, মননের যে অবদান, তাকে বাদ দিয়ে অখণ্ড বাংলাদেশের যুগচেতনা যেন বাস্তবিকই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পাশ্চাত্যের শিক্ষা নবজাগরণের যুগে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল একথা যেমন সত্য, সেই পরিবর্তনের যুগে মানুষ আত্মচেতনায় নিজে থেকেও নবজাগ্রত হতে পেরেছিল শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে তাকালে বোঝা যায় একথাও তেমনই সত্য।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও উনিশ শতকের কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী

উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ভারতের বুকে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। ‘কথামৃত’ পরিসরে যে সব প্রখ্যাত মানুষ এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন—পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, আচার্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ডেপুটি অধরলাল সেন, সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, মাস্টার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। বিভিন্ন বিশিষ্টজনের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎকারগুলিতে পরমার্থ প্রসঙ্গই রয়েছে আলোচনার ধৃ-কেন্দ্র।

• ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১):

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ৫ আগস্ট, ১৮৮২। মাস্টার মশাই শ্রীম প্রদত্ত তথ্যানুসারে শ্রীরামকৃষ্ণ বাল্যবয়স থেকে বিদ্যাসাগরের নাম ও দয়াধর্মের কথা শুনেছিলেন। শ্রীম’র সঙ্গে পেশাসূত্রে বিদ্যাসাগরের বিশেষ পরিচয় ছিল। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা শ্রীরামকৃষ্ণই প্রথম প্রকাশ করেন এবং বিদ্যাসাগর সেই সংবাদ শুনে ও শ্রীরামকৃষ্ণের বাহ্যিক ‘পরমহংস’ সুলভ চিহ্ন নেই জেনে নিজেও শ্রীম’কে সাক্ষাতের ইচ্ছা জানান। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রাচ্য সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্রজ্ঞান থাকলেও তিনি প্রচলিত ঈশ্বরধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সাকার বা নিরাকার কোনোদিকে ইচ্ছা তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল না। বরং নাস্তিক হিসাবেই তাঁর বেশি খ্যাতি ছিল। বাস্তববাদী ঈশ্বরচন্দ্র কর্মকেই জীবনের ব্রত বলে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই লোকহিতকর কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেকের কাছে বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। এই বঞ্চনা সম্ভবত বিদ্যাসাগরের মতো জ্ঞানী মানুষকেও বেশ আহত করেছিল। শাস্ত্রজ্ঞ বিদ্যাসাগরের গীতার নিষ্কাম কর্মের ধারণা থাকা সত্ত্বেও প্রিয়জন ও পরিজনদের বিরোধিতা, বঞ্চনা তাঁর কঠোর চিত্তকেও ব্যাকুল করেছিল। শেষজীবনে যেন অনেকটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে নাগরিকজীবনের বাইরে গিয়ে বসবাস করেছিলেন। বাহ্যিকভাবে বিদ্যাসাগর ‘নাস্তিক’ চিহ্নিত হলেও ‘কথামৃত’র একটি দৃশ্যে দেখা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরকে খুব আন্তরিক ও সরলভাবে জিজ্ঞাসা করছেন:

তাঁকে কি বিচার করে জানা যায়? তাঁর দাস হয়ে, তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁকে ডাক।

(বিদ্যাসাগরের প্রতি সহাস্যে)—”আচ্ছা, তোমার কি ভাব?”

বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন,”আচ্ছা সে কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব। (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য)—তাঁকে পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করে জানা যায় না।২৪

তাঁদের দুজনের এই ‘একলা-একলা’ বলাটা ভবিষ্যতে আর হয়ে ওঠেনি। তাঁদের আর দেখাও হয়নি অনেক কারণে। বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে প্রায়শই অনেক লোক নানা ধরনের কাজ নিয়ে আসে যায়। কিন্তু শুধুমাত্র নিষ্কাম দর্শনসুখের জন্য দেখা করতে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, তা সম্ভবত ঈশ্বরচন্দ্রকেও অবাক ও অভিভূত করেছিল। এমনকি ফেরার পথে বিদ্যাসাগর স্বেচ্ছায় গাড়িভাড়া দিতে চাইলে পর্যন্ত তিনি গ্রহণ করেননি। বিদ্যাসাগর অল্প সময়ের আলাপকালেই শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে অগাধ তৃপ্তি পেয়েছিলেন। নইলে বিদায়ের দৃশ্যে পুনর্মিলনের প্রতিশ্রুতি সহ তাঁকে এত আন্তরিকভাবে প্রীতি-প্রণাম করতে দেখা যেত না। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক কথোপকথনে বেদান্ত, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টা দ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ, নিষ্কাম কর্মবাদ সহ আরও অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছিল। সম্ভবত উভয়েই তৃপ্তি পেয়েছিলেন। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে লিখছেন:

এই সাক্ষাৎকারের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীকেই আলোকিত করেছে। একদিকে য়ুরোপীয় সংস্কার, অপরদিকে ভারতীয় সংস্কার—এই দুই ভাবধারার দ্বন্দ্ব গত শতাব্দীতে সমগ্র বাঙালির মনোভূমিকে উৎকণ্ঠিত করেছিল। একদিকে জ্ঞানবিজ্ঞান, সমাজসংস্কার, জনসেবা, শিক্ষাপ্রচার, আর একদিকে ঈশ্বর সন্ধান। একদিকে পার্থিব ব্যাপার, আর একদিকে অপার্থিব ব্যাপারের ইঙ্গিত।… শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎকারের ও আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর চিত্তসঙ্কট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে…২৫

বিদ্যাসাগর ও শ্রীরামকৃষ্ণ উভয়েই পরস্পরের জীবনচেতনা, ভাবাদর্শ ও সান্নিধ্যে যথেষ্ট তৃপ্তি পেয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ ‘কথামৃত’র বহু জায়গায় বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করেছেন।শুধু কথা দিয়েও বিদ্যাসাগরের দেখা করতে না আসা নিয়ে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণের সত্যরক্ষার প্রতি একটি তীব্র ঝোঁক কাজ করত। উনিশ শতকের আধুনিক মানুষের চিত্তসঙ্কটের যেন এক মূর্তিমান বিগ্রহ হিসাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘কথামৃত’-এ উপস্থিত। তিনি যেন কতগুলি নিটোল যুক্তির কর্কশতায় তিক্ত হয়ে থাকা মানবজীবনের ব্যক্তিপ্রতীক।

• বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪):

‘কথামৃত’-এ বিদ্যাসাগরের পর উনিশ শতকের সারস্বত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে যাঁর নাম বিশেষ উল্লেখ্য তিনি নিঃসন্দেহে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮৪-এর ৬ ডিসেম্বর শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম গুণী অনুরাগী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধরলাল সেনের কলকাতার বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ডেপুটি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম আলাপ হয়। অধরলাল নিজে বিশেষ উদ্যোগী হয়ে তাঁর ইংরেজি শিক্ষিত সহকর্মী ডেপুটি বন্ধুদের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ আলাপ করাতে চেয়েছিলেন। এই আলাপের হেতু সম্পর্কে অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন:

তাঁর (শ্রীরামকৃষ্ণের) মহিমা দেখাবার জন্য অধরলাল তাঁর কয়েকজন ডেপুটি বন্ধুকেও আমন্ত্রণ করেছেন। বোধ হয় একালের ইংরেজি শিক্ষায় বর্ধিত সহকর্মী বন্ধুদের দেখাতে চেয়েছিলেন, প্রত্যক্ষের বাইরেও আর একটা জগৎ আছে, ইংরেজি বিদ্যার বাইরেও আর একটি জগৎ আছে, যার আবির্ভাব ঘটে যুক্তিতর্ক-বিচার-বিশ্লেষণ থেকে নয়, চৈতন্যের গভীরতা থেকে তার উপলব্ধি আসে। তাঁর নিয়ন্ত্রিত বন্ধুদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রও ছিলেন। তখনই বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যিক হিসেবে দেশ-বিশ্রুত হয়েছেন। তাঁরা এসেছিলেন ঠাকুরকে পরীক্ষা করতে।২৬

পণ্ডিত বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম পরিচয়ে রসরাজ শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,”বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভাবে বাঁকা গো!”২৭ বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণের কথাটির ভেতরকার অর্থ ধরতে না পেরে উত্তর দিয়েছিলেন লৌকিক দৃষ্টিতে—”আর মহাশয়! জুতোর চোটে! (সকলের হাস্য) সাহেবের জুতোর চোটে বাঁকা।”২৮ আসলে শ্রীরাধার অনুরাগে শ্রীকৃষ্ণের বঙ্কিমবেশ ধারণের কথা বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আর বঙ্কিমচন্দ্র নিজের কর্মজীবনের বহুবার অযোগ্য অথচ শ্বেতাঙ্গ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে অপমানিত হওয়ার যন্ত্রণার প্রকাশ করেছিলেন হাস্যরসের প্রলেপ মাখিয়ে। ‘কৃষ্ণচরিত্র’ রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে শ্রীকৃষ্ণের বঙ্কিমভাব ব্যাখ্যাও করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এখানে উল্লেখ্য, বঙ্কিমচন্দ্র রাধাহীন কৃষ্ণে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁদের ভদ্রাসনে একক কৃষ্ণের নিত্যসেবা হত। বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণের কোনো পরকিয়া নায়িকাকে মান্যতা দিতেও চাননি। লক্ষ্যনীয় এই পর্বে বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণের সামনেই নিজের ডেপুটিত্ব বজায় রেখে ইংরেজিতে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালাচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যে ইংরেজি ভাষা বোঝেন না তার পরিচয় ‘কথামৃত’-এ বহুবার রয়েছে। এসবের পরে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বলার শৈলীতে মুগ্ধ হয়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে আত্মমত প্রচারে উৎসাহ দিলেও শ্রীরামকৃষ্ণ সেই বিষয়ে নিজের অসম্মতি জানান। প্রসঙ্গান্তরে মানব জীবনের লক্ষ্য নিয়ে কথা ওঠে, ‘কথামৃত’ থেকে সেই দৃশ্যটি দেখা যেতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রশ্ন করছেন:

(বঙ্কিমের প্রতি)—”আচ্ছা, আপনি কি বল, মানুষের কর্তব্য কি?”

বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে)—আজ্ঞা, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া)—এঃ! তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া! তুমি যা রাতদিন কর, তাই তোমার মুখে বেরুচ্ছে। লোকে যা খায়, তার ঢেকুর উঠে। মূলো খেলে মূলোর ঢেকুর উঠে। ডাব খেলে ডাবের ঢেকুর উঠে। কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর রাতদিন রয়েছো আর ওই কথাই মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে! কেবল বিষয়চিন্তা করলে পাটোয়ারি স্বভাব হয়, মানুষ কপট হয়। ঈশ্বরচিন্তা করলে সরল হয়, ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হলে ও-কথা কেউ বলবে না।২৯

শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রের কথার স্থূলরসে বিরক্ত হয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র জীবনকে এত স্থূলভাবে দেখেন না, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে তাঁর মননশীল তাত্ত্বিক প্রবন্ধাদিতে। সম্ভবত আধুনিক আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির ব্রাহ্মণ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে বারবার যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলেন। ডেপুটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্ভবত ভাবতে পারেননি শ্রীরামকৃষ্ণের মতো একজন সামান্য ব্রাহ্মণ পূজারী তাঁর সামনে এতটা তীব্র গর্জনে তাঁকেই ভর্ৎসনা করতে পারেন! এক্ষেত্রে ডেপুটি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন ছিল তা খুব বেশি স্পষ্ট নয়। কিন্তু সেই দিনের বৈঠকে অসাধারণ কীর্তন ও ঈশ্বরপ্রেমে আকণ্ঠ মাতোয়ারা শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখবার পর বঙ্কিমচন্দ্র যেন বদলে গেলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাবেগ সম্ভবত তাঁকেও শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল। এর পরের দৃশ্যে বঙ্কিমচন্দ্র তাই এত প্রগাঢ় আত্মমগ্ন, নিজের ভেতরে তাঁর যেন কি একটা ঘটে চলেছে। হয়তো সেই কারণেই বিদায়ের প্রাক্কালে তাঁর আভিজাত্য বাহক চাদরটি পর্যন্ত তিনি ঘরের ভেতরে ভুল করে ফেলে চলে আসলেন। কি যেন একটি গভীর ভাবনা তখন তাঁর গহন মনে চলছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের বিদায়লগ্নে বঙ্কিমচন্দ্র নিজে থেকেই বলছেন:

মহাশয়, যত আহাম্মক আমাকে ঠাওরেছেন তত নয়। একটি প্রার্থনা আছে—অনুগ্রহ করে কুটিরে একবার পায়ের ধুলা—৩০

এই আবার সাক্ষাতের ইচ্ছা থেকে বোঝা যাচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্র পুথিগত বিদ্যাহীন এক নিখাদ আনন্দপুরুষকে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে অনুভব করেছিলেন। কিন্তু উভয়ের ইচ্ছা থাকলেও এরপর আর কখনও বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি।

• কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪):

শ্রীরামকৃষ্ণ ও কেশবচন্দ্র সেনের মধ্যকার সম্পর্কটি রহস্যঘন। উভয়ের সেই নিগূঢ় রহস্য নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক লেখালেখি হলেও একসময় শ্রীরামকৃষ্ণ ও কেশবচন্দ্র কে কার গুরু এবং কে কার শিষ্য এই নিয়ে উভয়পন্থীর মধ্যে স্বমত প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলেছিল। এই বিবাদের কোনো পক্ষ গ্রহণ না করে আমাদের মনে হয় তাঁদের উভয়ের মধ্যে একটি সমপ্রাণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ‘কথামৃত’র বহু জায়গায় দেখা গেছে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন যেমন শ্রীরামকৃষ্ণের অমোঘ টানে দক্ষিণেশ্বর কালীতীর্থে গিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন, তেমনই শ্রীরামকৃষ্ণও সানন্দে উপস্থিত হচ্ছেন কেশবচন্দ্র সেনের কাছে। ১৮৭৫-এর ১৫ মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়। এই প্রথম দিন থেকেই দুজনের মধ্যে একটি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব তৈরি হয়েছিল। ১৮৭৫-এর ২৮ মার্চ তারিখে The Indian Mirror পত্রিকায় ও ১৪ মে তারিখে ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের সম্পর্কে সংবাদাদি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’-এ প্রকাশিত লেখাটি দীর্ঘ।৩১ এই সংবাদের লেখক ছিলেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন। ১৮৭৫ থেকেই কেশবচন্দ্র সেন শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে The Indian Mirror, ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’, ‘সুলভ সমাচার’, The New Dispensation, ‘ধর্মপ্রচারক’ সহ নানা পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবনা ও কথা প্রচার করতে থাকেন। ১৮৭৮-এ ‘পরমহংসের উক্তি’ নামে একটি পাতলা বইও কেশবচন্দ্র প্রকাশ করেছিলেন।৩২ ‘কথামৃত’ প্রকাশের অনেক আগেই শ্রীরামকৃষ্ণের কথা এভাবে গ্রন্থরূপ পেয়েছিল। কঠোর হিন্দুসংস্কার বিরোধী যে কেশবচন্দ্র সেনকে ব্রাহ্মসমাজের আদিপর্বে দেখা যায় এবং নববিধান সমাজের সময়ে যে কেশবচন্দ্রকে দেখা যায়, উভয়ের মধ্যে ধর্মবিষয়ক চিন্তা-চেতনার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বিস্তর। অনুমান করা যায়, আদর্শ ধর্মযাপনের মূর্ত প্রতীক পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণের দীর্ঘ সাহচর্যে এসে তাঁর ভক্তিবাদী মনোভাব কেশবচন্দ্র সেনের উপর ক্রিয়াশীল হয়েছিল। কেশবচন্দ্র পারিবারিক সূত্রে পাওয়া যে বৈষ্ণবীয় ভাবরস ও চেতনা ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে এসে কঠোরভাবে নিজের মধ্যে এতকাল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তা ক্রমাগত আলগা হতে শুরু করে। ‘কথামৃত’-এ ২ এপ্রিল, ১৮৮২-র ঘটনার মাঝে ১৮৭৯-এর ২৯ অক্টোবরের একটি পূর্বকথা লিখছেন শ্রীম:

উপাসনার পর ঠাকুর বলিতেছেন, তোমরা বল “ব্রহ্ম আত্মা ভগবান” “ব্রহ্ম মায়া জীব জগৎ” “ভগবত ভক্ত ভগবান”। কেশবাদি ব্রাহ্মভক্তগণ সেই চন্দ্রালোকে ভাগীরথীতীরে সমস্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে ওই সকল মন্ত্র ভক্তিভরে উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আবার যখন বলিলেন, বল “গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব”। তখন কেশব আনন্দে হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, মহাশয়, এখন অতদূর নয়; “গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব” আমরা যদি বলি লোকে বলিবে ‘গোঁড়া’! শ্রীরামকৃষ্ণও হাসিতে লাগিলেন ও বলিলেন, বেশ তোমরা (ব্রাহ্মরা) যতদূর পার তাহাই বল।৩৩

আমাদের মতে, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস কেউই কারও থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেননি, করার প্রয়োজনও হয়নি। ‘কথামৃত’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং কেশবচন্দ্রের আধ্যাত্মিক চেতনাকে বহুবার প্রশংসিত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যকার যে সুমিষ্ট সহৃদয়সংবেদী সম্পর্ক তা একান্তই তাঁদের নিজস্ব। জটিল দৃষ্টিতে সেই অনিন্দ্যসুন্দর সম্পর্কের গতানুগতিক বিশ্লেষণ না করাই শ্রেয় বোধ হয়।

• বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী (১৮৪১-১৮৯৯):

মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তথা চৈতন্য পার্ষদ অদ্বৈত আচার্য গোস্বামীর বংশধর আচার্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রথম যৌবনে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে প্রবল আস্থাবান হয়ে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের পারিবারিক বৈষ্ণবীয় ভাবধারা তিনি ত্যাগ করেছিলেন। এরপর তিনি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। উনিশ শতকের এই পর্বে নব্যশিক্ষিতদের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার বিশেষ ঝোঁক ছিল। তরুণ বিজয়কৃষ্ণও ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু করেন ও কিছুদিনের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজে তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের বিশেষ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। নিজ নিষ্ঠায় তিনি ধীরে ধীরে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও প্রচারকের উচ্চপদও পেয়েছিলেন। কেশবচন্দ্রের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের বিবাদ তৈরি হলে কেশবচন্দ্র ও বিজয়ের মধ্যেও সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই বিরোধ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে তাঁদের কোনোভাবে সাক্ষাৎ হয়ে গেলেও সৌজন্যমূলক বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ থাকত। অথচ ‘কথামৃত’র শ্রীরামকৃষ্ণ দেব এমন এক ‘বাহাদুরী কাঠ’ যেখানে কেশবচন্দ্র ও বিজয়কৃষ্ণ উভয়ে একসঙ্গে বিনাদ্বিধায় সচ্চিদানন্দ সাগরে ভাসতে পেরেছিলেন। ১৮৮২ থেকে বিজয়কৃষ্ণ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখন ব্রাহ্মসমাজের উচ্চপদস্থ একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ব্রাহ্মসমাজে থাকাকালে সাকারবাদীদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য বিজয়কৃষ্ণ তীব্রতর সমালোচনার মুখে পড়েন। এই সমালোচনা তাঁকে মনে মনে অনেকখানি বিদ্ধ করেছিল। বিজয়কৃষ্ণ প্রসঙ্গে ‘কথামৃত’র ১৮৮৪-এর ১৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় রয়েছে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও রাধিকা গোস্বামী কথা বলছেন:

“তাকে পাওয়াই ভার। আজ ঢাকায় ডাক, কাল আর এক জায়গায় ডাক। সর্বদাই ব্যস্ত।

“তাদের সমাজে (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে) বড় গোল উঠেছে।”

গোস্বামী—আজ্ঞা, কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ—তাকে বলেছে, ‘তুমি সাকারবাদীদের সঙ্গে মেশো! —তুমি পৌত্তলিক।’৩৪

এখানে দুটি কথা উঠে এসেছে। প্রথমটি ব্রাহ্মসমাজ মূলত নব্যশিক্ষিতদের সংগঠন হলেও ধর্মচর্চার মুক্তচিন্তা তাদের সকলের মধ্যে ছিল না। নিরাকার মানলে সাকার মানা যাবে না এমন একটি অদৃশ্য অকথিত গোঁড়ামি ব্রাহ্মসমাজেও অজ্ঞাতসারে তৈরি হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ব্রাহ্মমতে বিশ্বাসী হলে অন্যমতের সঙ্গে মেলামেশায় কূট সমালোচনা তৈরি হত। ভক্তিবাদী শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্য কেশবচন্দ্রের মতো আধ্যাত্মিক আনন্দ পেয়েছিলেন বিজয়কৃষ্ণ। জ্ঞানবাদী বিজয় তাই জীবনের শেষ পর্বে ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় পুনরায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ও রাধিকা গোস্বামীর প্রাগুক্ত কথোপকথনে রয়েছে ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণ চৈতন্যদেবের মূর্তির সামনে ভাবস্থ হয়েছিলেন। শেষ বয়সে তাঁর অদ্বৈতরক্তে মিশে থাকা ভক্তিবাদী চেতনা বিজয়কৃষ্ণ যে বৈষ্ণবীয় ভাবরসের সাধনা দিয়ে নিজের ধর্মজীবন শুরু করেছিলেন পুনশ্চ সেখানেই তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

• শশধর তর্কচূড়ামণি (১৮৫০-১৯২৮):

১৮৮৪-এর ২৫ জুন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির প্রথম সাক্ষাৎ হয়। পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি নিজের মত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চিরকাল যথেষ্ট সজাগ ও সচেতন ছিলেন। প্রবলভাবে তাঁর কঠোর-আচরণীয় হিন্দুচেতনা সাধারণ মানুষকে তাঁর দিকে অচিরেই আকর্ষণ করেছিল। শুষ্ক জ্ঞানমার্গের পথিক শশধর সম্ভবত শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্য এসে ভক্তিরসের যথার্থ আনন্দ অনুভব করেছিলেন। সমসময়ে এই পণ্ডিতকে ঘিরে নেতিবাচক অভিযোগ কম ছিল না। তবে ‘কথামৃত’র চারটি সাক্ষাতের তৃতীয় ও শেষ দিনে শশধর তর্কচূড়ামণির চেতনার পরির্বতনের চিত্র এঁকেছেন শ্রীম। তবে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে পণ্ডিত শশধর চিরকাল ভালো ধারণা রাখেননি। প্রাজ্ঞ অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই আচরণের দুটি সম্ভাব্য কারণ নির্দেশ করেছেন। প্রথমটি, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের সকলের সঙ্গেই যথেষ্ট সুসম্পর্ক বজায় ছিল। অথচ পণ্ডিত শশধর ছিলেন কঠোর ব্রাহ্মবিরোধী। দ্বিতীয়, শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে পণ্ডিত শশধর নিজের আধ্যাত্মিক দীনতা প্রকাশ করেছিলেন শ্রীম’র ‘কথামৃত’র সূত্রে এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার ফলে তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি অনেকাংশে প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলেন।৩৫ শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর তাঁর সম্পর্কে শশধর কিছু বিরূপ মন্তব্য লিখতে শুরু করেন এবং যথার্থ প্রমাণের অভাবে যখন নিজেই নিজের ফাঁদের শিকার হন, তখন পুরোপুরি চুপ করে যেতে বাধ্য হন।৩৬  আমাদের মতে, পণ্ডিত শশধর শ্রীরামকৃষ্ণের তীব্র সমালোচনা করে নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই প্রয়াস সফল হতে পারেনি।

• ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪):

পেশাসূত্রেই শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের যোগাযোগ শুরু হয়। সমগ্র ‘কথামৃত’ পরিসরে ডাক্তার সরকারের চরিত্রটি সবচেয়ে অদ্ভুত। দীর্ঘদিন শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ কয়েক বছরে যখন গিরিশাদি অনুগামীরা তাঁকে ঈশ্বরাবতার বলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন, তখন একই পরিবেশে থেকেও তাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। গলার কঠিন অসুখের সময় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতে করতে তাই রঙ্গ করে রসময় শ্রীরামকৃষ্ণকে একদিন বলেছিলেন:

যে অসুখ তোমার হয়েছে, লোকেদের সঙ্গে কথা কওয়া হবে না। তবে আমি যখন আসবে, কেবল আমার সঙ্গে কথা কইবে।” (সকলের হাস্য)৩৭

ডাক্তারের আচার-আচরণ, কথাবার্তায় বাস্তববাদী চিন্তার স্পষ্ট ছাপ ছিল। ডাক্তার সরকার শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব ও ভাবাবস্থা দেখে অবাক হয়েছিলেন এবং তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবসমাধি ও কাঞ্চনস্পর্শ করতে না পারার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই বস্তুবাদী ডাক্তারও কিছুদিন পর ক্রমশ নিজের প্র্যাকটিস ফেলে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসে সাত-আট ঘণ্টা থাকতে শুরু করেন। এই দীর্ঘ সময় শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে তিনি এসে থাকতেন যত না বেশি আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল পাওয়ার জন্য, তার চেয়েও বেশি মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে একজন আদ্যোপান্ত ভালো মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলেন বলে। ডাক্তার সরকার সেকথা স্বীকারও করেছিলেন,”As man I have the greatest regard for him.”৩৮ আপাতদৃষ্টিতে ডাক্তার সরকারকে নাস্তিক মনে হলেও তিনি যে তথাকথিত ‘নাস্তিক’ নন, সবার সামনে নিজের ধর্মভাবপ্রকাশে অনিচ্ছুক ডাক্তার শ্যামপুকুর বাটীতে একদিন সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ, মাস্টার, গিরিশচন্দ্র, নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের একান্তে বলেছিলেন সেই উপলব্ধির কথা:

ডাক্তার—ও-সব নিজের নিজের ভাব চাপতে হয়। প্রকাশ করা ভাল নয়। আমার ভাব কেউ বুঝলে না। My best friends (যারা আমার পরম বন্ধু) আমায় কঠোর নির্দয় মনে করে। এই তোমরা হয়তো আমায় জুতো মেরে তাড়াবে!

শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)— সেকি!—এরা তোমায় কত ভালবাসে! তুমি আসবে বলে বাসকসজ্জা করে জেগে থাকে।

গিরিশ—Every one has the greatest respect for you. (সকলেই আপনাকে যৎপরোনাস্তি শ্রদ্ধা করে।)

ডাক্তার—আমার ছেলে—আমার স্ত্রী পর্যন্ত—আমায় মনে করে hard-hearted (স্নেহমমতা শূন্য), —কেননা, আমার দোষ এই যে, আমি ভাব কারু কাছে প্রকাশ করি না।

গিরিশ—তবে মহাশয়! আপনার মনের কবাট খোলা তো ভাল—at least out of pity for your friends (বন্ধুদের প্রতি অন্ততঃ কৃপা করে)—এই মনে করে যে, তারা আপনাকে বুঝতে পারছে না।

ডাক্তার—বলব কি হে! তোমাদের চেয়েও আমার feelings worked-up হয়(অর্থাৎ আমার ভাব হয়)। (নরেন্দ্রের প্রতি) I shed tears in solitude (আমি একলা একলা বসে কাঁদি।)৩৯

এই অংশে ডাক্তার সরকারের ধর্মচিন্তার অবয়বটি স্পষ্ট হয়। তাঁর কথা দিয়ে তাঁর হৃদয়ের ছবিটি স্পষ্ট দেখা যায়। তবু ডাক্তার সরকারের বাহ্যিক কাঠিন্য অনুসরণ করে বলা চলে ‘কথামৃত’ পরিসরের মধ্যে ডাক্তার সরকারই প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে শুধুমাত্র ঐশ্বরীয় আবেশে পরিমাপ না করে তাঁকে ‘as a greatest human’ বা বলা যায় মানবতার চূড়ান্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চেয়েছিলেন।

অধ্যাপক সুমিত সরকার আধ্যাত্মিক চেতনায় অবিচ্ছিন্নভাবে আকণ্ঠ ডুবে থাকা শ্রীরামকৃষ্ণের সমসাময়িক বিশিষ্টজনের সান্নিধ্যে আসা সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের ‘ভদ্রলোক সংগ্রাহক’ চেহারা দেখেছেন। তিনি লিখেছেন:

শোনা যায়, তিনি কোনো সময় তাঁর জন্মস্থান কামারপুকুরে এলে তাঁকে দেখতে গ্রামের লোকের ভিড় জমলে তিনি বিরক্ত হতেন। অথচ কথামৃত ও রামকৃষ্ণের বিভিন্ন জীবন-বৃত্তান্তে বারবার দেখা যায়, রামকৃষ্ণ কীভাবে হামেশাই ভদ্রলোক ভক্ত সংগ্রহ করতে আগ বাড়িয়ে উদ্যোগী হয়েছেন। সামাজিক ধাপ বেয়ে ওপরে ওঠার একটা ‘স্বাভাবিক’ পদ্ধতি হিসেবেই এটাকে দেখা যেতে পারে।৪০

বলাবাহুল্য অধ্যাপক সরকার যে চেতনায় বিশ্বাসী সেখানে আধ্যাত্মিকতা শুধুমাত্র আফিমবৎ স্বাদু উপভোগ্য বলেই চিহ্নিত। আর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন সম্পূর্ণত আধ্যাত্মিক চেতনায় ভরপুর। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অনেকেই এই প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিহীন গ্রামীণ মানুষটিকে গ্রহণ করতে চাননি। তাঁর নতুন চেতনা ও গণধর্মের প্রতি তখনও কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজের সবাই সচেতন ছিলেন না। খোদ কলকাতায় যদি এই অবস্থা হয়, তবে হুগলি জেলার আপাত অনুন্নত সাধারণ একটি গ্রামে শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বাংশে গ্রহণ করার মতো আবহ ছিল কি, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ কাঙালের সঙ্গে অন্ন খাওয়া, মুসলমান গুরু ওয়াজেদ আলি খানের (প্রচলিত নাম গোবিন্দ রায়) কাছে ইসলামীমতে সাধনা করে দক্ষিণেশ্বরের নিকটবর্তী মোল্লাপাড়ার মসজিদে যাওয়া, অন্তরের নিষ্ঠা-ভক্তি-বিশ্বাস নিয়ে আজান দেওয়া সবই করেছিলেন। উনিশ শতকের গ্রামসমাজে এই বিষয়গুলি সেই সময় এতটাও সহজে মিটে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সুমিত সরকারের মন্তব্যকে মেনে নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে তাকালে মনে হয় তিনি সম্ভবত গ্রামের সমাজপতিদের হাত থেকে গ্রামস্থ পরিজনদের রক্ষা করতে ‘বিরক্তি’ প্রকাশ করে থাকতে পারেন। অবশ্য অধ্যাপক সরকার নিজেই এই বিষয়ে সংশয়দীর্ণ। তিনি নিজেই তার বক্তব্যে ‘শোনা যায়’ জাতীয় অনুমানবাচক বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন, যা তথ্যটির সত্যতা নিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রশ্ন তুলতে পারে। উনিশ শতকের শহুরে ‘ভদ্রলোক’ বলতে যদি সুমিত সরকার শুধুমাত্র আকাদেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও বিত্তবান শ্রেণিকে বুঝিয়ে থাকেন তবে বলা আবশ্যক হয়ে ওঠে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ-অন্তরঙ্গ লাটু (পরে স্বামী অদ্ভুতানন্দ, যিনি ছিলেন বিহারের এক সামান্য কৃষকের সন্তান), রামকৃষ্ণের বিদুর দুর্গাচরণ নাগ, অঘোরমণি দেবী সহ আরও কয়েকজন মহিলা থেকে দক্ষিণেশ্বরের জমাদার রসিক মেথর সহ আরও অনেকে শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। অন্যদিকে রয়েছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, যাঁকে তৎকালীন সমাজ ‘ভদ্রলোক’ বলার আগে ‘শহুরে আধুনিক সভ্যরা’ বেশ কয়েকবার ভাবতেন। সেই গিরিশচন্দ্র ঘোষ ‘কথামৃত’-এ একাধিকবার নিজেই স্বীকার করেছিলেন তাঁর জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের অবদান কতখানি। এভাবে সামাজিক ধাপ বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য গুরু বা আচার্য হয়ে ওঠার জন্য উনিশ শতকের সমাজ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য যথেষ্ট অনুকূল ছিল। কিন্তু তাঁর অবচেতনেও এই ধরণের কোনো জটিল কূট ও গুপ্ত লালসা ছিল না, ‘কথামৃত’র সূত্রে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে। তাছাড়া যে ভোগবাদী চেতনা থেকে এইভাবে সামাজিক ধাপ বেয়ে ওপরে ওঠার কথা ভাবা যায় সেই জটিল চেতনা শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল না, তা ‘কথামৃত’র বিভিন্ন পরিচ্ছেদ থেকেই স্পষ্ট হয়।

‘কথামৃত’ থেকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মথুরানাথ বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ সমকালের আরও কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ ঘটেছিল বলে জানা গেলেও ‘কথামৃত’র পরিসরে সেই সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বর্ণনা না থাকায় তাঁদের এই আলোচনার পরিসরে আনা হয়নি। এই পরিচ্ছেদে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ডেপুটি অধরলাল সেন, সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, মাস্টার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণ-বলয়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে আলোচনা থেকে বিরত থাকা হয়েছে। এই বুদ্ধিজীবীদের ‘কথামৃত’র সময়পর্বের পরবর্তী জীবনের একটি বড় অংশ মূলত শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে তাঁরা জীবনের আচার্যের পদে বসিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ধারা ওচিন্তা-চেতনা তাঁদের জীবনচর্চা এবং আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে আনন্দময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তিবাদ ও আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ

অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশে ধর্মীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল নদিয়াবাসীর হৃদয়ের রাজাধিরাজ শ্রীচৈতন্যের সমকাল থেকেই। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ও শ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভুর হাত ধরেই বাঙালি কৃষ্ণায়েৎ বৈষ্ণব সমাজে ধর্মযাপনে সর্বসাধারণের সমান অধিকারের আবহ তৈরি হতে পেরেছিল। সেই প্রবাহ ব্যাপ্তিও পেয়েছিল পরবর্তী সময়ে। পাশাপাশি বাংলাদেশের তান্ত্রিকসমাজেও শ্রেণি ও সম্প্রদায়গত ঔদার্য বজায় ছিল। তান্ত্রিক চক্রাসনে উন্নত শুদ্ধ দেহলক্ষণযুক্ত সমাজের যে কোনো স্তরের মানুষ অধিকার পেতেন। তাছাড়া বাংলার সহজিয়া সম্প্রদায়গুলির মধ্যে জাতিভেদ, বর্ণভেদ এমনকি লিঙ্গভেদ সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছিল। উনিশ শতকে ব্রাহ্মসমাজও ধর্মচর্চায় এই ধরণের বাহ্যিক ভেদাভেদ মুছতে চেয়েছিল। এই একই সময়পর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের নবজাগ্রত সত্তা জেগে উঠেছিল পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্লাবনে নয়, বরং প্রাচ্যের সভ্যতা-সংস্কৃতির শান্ত ঝর্ণার জলে। শ্রীরামকৃষ্ণের চেতনায় ‘আপামরে কোল দেওয়া’ চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ কাজ করেছিল। চৈতন্য মহাপ্রভুর মতোই তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ দিয়ে নয়, বরং হৃদয়জ আবেগ দিয়ে তিনি ধর্মপথকে সর্বজনীন মিলনক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছিলেন। উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে শ্রীরামকৃষ্ণের যে ভক্তিবাদী চেতনা তাকে আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ বলা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মচর্চার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সভামঞ্চে না বসেও বলতে পেরেছিলেন,”ভক্ত একটি পৃথক জাতি। সকলে এক জাতীয়।”৪১ শুধু তাই নয়, শ্রীরামকৃষ্ণ এই বিষয়ে খুব স্পষ্ট করে তাঁর চিন্তাকে ব্যক্ত করেছেন। ‘কথামৃত’-এ রয়েছে:

জাতিভেদ সম্বন্ধে কথা পড়িল। ঠাকুর বলিলেন,”এক উপায়ে জাতিভেদ উঠে যেতে পারে। সে উপায়—ভক্তি। ভক্তের জাতি নাই। ভক্তি হলেই দেহ, মন, আত্মা—সব শুদ্ধ হয়। গৌর, নিতাই হরিনাম দিতে লাগলেন, আর আচণ্ডালে কোল দিলেন। ভক্তি থাকলে চণ্ডাল, চণ্ডাল নয়। অস্পৃশ্য জাতি ভক্তি থাকলে শুদ্ধ, পবিত্র হয়।”৪২

‘কথামৃত’ পরিসরে শ্রীরামকৃষ্ণ ‘ভক্ত’ ও ‘ভক্তি’—এই দুটি শব্দ বিভিন্ন প্রসঙ্গে বারবার উচ্চারণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তিবাদকে ভিত্তি করেই তাঁর গণধর্মের স্বরূপ সন্ধান করতে শিখিয়েছিলেন অনুগামীদের। এতদিন হিন্দুদের পুরোহিত, মুসলমানদের ইমাম, খ্রিস্টানদের পাদ্রীরা বলে এসেছেন তাদের ধর্ম আচরণ না করলে নরকবাসী হতে হবে, পাপী হতে হবে। উনিশ শতকের যুগমানসে শ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের বার্তা ছিল অন্য। তিনি নিজের দীর্ঘ সাধনজীবনে অনুভব করতে পেরেছিলেন প্রতিটি ধর্মপথই সত্য, প্রতিটি ধর্মপথই শেষ পর্যন্ত এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যায়। এই যে গণধর্মের কথা শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন তার একটি আদিরূপ রয়েছে মহাভারতের ভীষ্মপর্বে ও গীতায়। শ্রীরামকৃষ্ণ শাস্ত্রের সারটুকু আয়ত্তে এনেছিলেন। ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’র ‘জ্ঞানযোগ’ নামক চতুর্থ অধ্যায়ের ১১তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্বয়ং বলেছেন:

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।

বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ॥৪৩

অর্থাৎ, যিনি যে প্রকারে আমার উপাসনা করেন, আমি তাঁকে সেই ফলদান করে অনুগ্রহ করি। হে পার্থ, বর্ণাশ্রমাদি ধর্মনিষ্ঠ মানুষেরা সকল প্রকারেই আমার পথই অনুসরণ করেন। ‘কথামৃত’-এ শ্রীরামকৃষ্ণ যেন গীতার এই বার্তারই নব্যরূপ এই শ্লোকের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে যুগোপযোগী রূপ দিয়ে বলছেন:

আন্তরিক হলে সব ধর্মের ভিতর দিয়াই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। বৈষ্ণবরাও ঈশ্বরকে পাবে, বেদান্তবাদীরাও পাবে, ব্রহ্মজ্ঞানীরাও পাবে; আবার মুসলমান, খ্রীষ্টান, এরাও পাবে। আন্তরিক হলে সবাই পাবে। …আমার ধর্মই ঠিক, আর সকলের মিথ্যা। এ-বুদ্ধি খারাপ। ঈশ্বরের কাছে নানা পথ দিয়ে পৌঁছানো যায়। ৪৪

শুধু মুখে বলা নয় নিজের জীবনে তিনি তা প্রয়োগও করে দেখালেন। শ্রীম লিখছেন, সুবর্ণ বণিক অধরলাল সেনের বাড়িতে প্রাথমিকভাবে অনেকেই ইচ্ছুক ছিলেন না, কিন্তু যখন তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে অধরের অন্নগ্রহণ করতে দেখেছিলেন তখন তাঁদের দ্বিধা কেটে যায়।৪৫ শ্রীরামকৃষ্ণের দ্বাররক্ষক ও কাঙালের অন্ন খাওয়ার প্রসঙ্গও ‘কথামৃত’-এ রয়েছে। তাঁর কাছে মানুষের মাত্র দুটি শ্রেণি—সৎ ও অসৎ। ধর্ম, বিত্ত বা অন্যকিছু নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের এই যে নতুন যুগোপযোগী চেতনা তাকে দ্বিধাহীন হয়ে আধ্যাত্মিক নবজাগরণের প্রারম্ভচেতনা বলা যেতে পারে। ‘কথামৃত’র অনুসরণে শ্রীরামকৃষ্ণকে যদি দেখা যায়, তবে স্পষ্ট চোখে পড়ে প্রাচীনপন্থী ধর্মচর্চাকারীরা তাঁর মধ্যে পেয়েছিলেন ধর্মের চিরায়ত প্রচলিত ঈশ্বরধারণার বিপুল তথা চূড়ান্ত নির্যাস এবং আধুনিক পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চায় শিক্ষিতরা তার মধ্যে পেয়েছিলেন মুক্তমনের গ্রহণযোগ্যতা। এই আপাত বিরোধী দুই বিপরীত ধারার অসাধারণ মিশ্রণটি তাঁর মধ্যে যে উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে ঘটা সম্ভব হয়েছিল, তা বঙ্গসমাজের ক্ষেত্রে ছিল বাস্তবিকই জরুরি। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখছেন:

বস্তুতঃ গোটা উনিশ শতক ধরেই বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও ধর্মীয় চিন্তা শিক্ষিত বাঙালির মনে নানা বিচিত্র ভাবের তরঙ্গ তুলেছিল। য়ুরোপে যাকে ‘রেনেসাঁস’ বলে, বাংলায় বলি নবজাগরণ তার প্রত্যক্ষ পরিচয় মিলবে এই শতকের ধর্মীয় আন্দোলন লক্ষ্য করলে। সেই সমস্ত পরস্পর-বিবাদমান ধর্মচিন্তা শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী ও উপদেশে সমন্বয় লাভ করল। সাকার, না নিরাকার, নিষ্কাম, না সকাম, গার্হস্থ্য, না সন্ন্যাস—সব প্রশ্নের উত্তর মিলল শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশে। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর যে নবজাগরণ বাঙালি চেতনায় প্রত্যক্ষ করা যায়, ধর্মসাধনা তাকে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই রেনেসাঁসের প্রভাব হিউম্যানিজম্‌কে ছাড়িয়ে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল। যার মধ্যে দেশ ও কাল, সমাজ ও ব্যক্তি, ধর্মাচার ও লোকহিতৈষণা একসঙ্গে মিলেমিশে গেছে, তাকে ধর্মীয় নবজাগরণ বললে অত্যুক্তি হবে না।৪৬

বাস্তবিকই ‘কথামৃত’ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণের উদারনৈতিক গণধর্মের পদ্ধতিটি অনন্য। সমস্ত বিপরীত ভাবধারার অসাধারণ স্বাদু মিশ্রণ! তিনি কালাপাহাড়ি ছন্দে ধর্মকে ভেঙে তার নবনির্মাণ করতে চাননি, সব ধর্মের শুভ নির্যাসটুকু সংগ্রহ করে তাকে সব রকমের ভেদাভেদহীন বিশ্বজনীন রূপ দিয়েছেন। এই কারণেই একুশ শতকেও বিশ্বচেতনায় শ্রীরামকৃষ্ণ এত বেশিমাত্রায় গ্রহণযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ : চিন্তার মৌলিকতা

শ্রীরামকৃষ্ণের যে সমকাল তার একদিকে ছিল উগ্র রক্ষণশীল সনাতনী প্রথা ও অন্যদিকে নবযুগের স্পর্শ পাওয়া মুক্তমননের ভাব-চিন্তাচেতনার উত্তাল স্রোত। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রত্যক্ষত সনাতন ধর্মের বাহক হয়েও প্রথাগত রক্ষণশীলতা, যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস, অর্থহীন কুসংস্কার, সমস্ত প্রকারের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে এবং একই সঙ্গে নব্যাগত পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতার প্রভাবান্বিত উগ্র কালাপাহাড়ি মনোভাবকে সমানভাবে বিরোধিতা করেছেন। এই উভয়দিকেই শ্রীরামকৃষ্ণের কোনো রকমের অন্ধ সমর্থন বা অন্ধ বিরোধিতার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। তিনি পৃথিবীর সমস্ত ইতিবাচক চেতনার পক্ষে নিজের অবস্থান পেশ করেছেন। ‘কথামৃত’ থেকে স্পষ্টতই অনুভব করা যায় সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, ধর্ম, নীতি, সমাজবিধি, লোকাচার, দৈনন্দিন জীবনচর্চা প্রভৃতি সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের একটি নিজস্ব মৌলিক চেতনা তৈরি হয়েছিল। তাঁর সংস্কারমুখী ইতিবাচক ও ন্যায়সম্মত ভাবনাগুলি কখনই আনুষ্ঠানিক সভা বা সমিতিতে নির্দিষ্ট উচ্চাসনে বসে বলা মৌখিক প্রতিবাদ নয়। তাঁর প্রত্যেকটি বক্তব্যের প্রধান প্রথম প্রায়গিক উদাহরণ স্বয়ং তিনি নিজেই! শ্রীরামকৃষ্ণের এই মৌলিকতা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতার কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। ‘কথামৃত’ই তাঁর চিন্তাচেতনার সবচেয়ে বেশি সাক্ষ্য বহন করে। তিনি সবার সামনে বৈঠকে বসে যা বলেছেন তা তিনি নিজের জীবনচর্চায় হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন, তিনি যা বলেননি তিনি তা করেননি। বলা যেতে পারে, তাঁর বক্তব্যের সত্যতা ও প্রায়োগিকতা আধুনিক সমাজের বাস্তবজীবনে কতদূর সম্ভব তিনি যেন নিজেকে দিয়ে প্রথমে তা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন এবং তারপর নিজের ভাবনাটি অপরের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁকে ঘিরেও যেন প্রথাগত অন্ধ সমর্থক তৈরি না হয়ে যায়, সেই জন্যও শ্রীরামকৃষ্ণ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি চেষ্টা করেছেন তাঁর অনুগামীদের চক্ষু ও কর্ণের বিবাদ বারবার মিটিয়ে দিতে। এক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের যুক্তিবাদী মন সম্পর্কে সিস্টার নিবেদিতা একটি তথ্য পেশ করেছেন:

…তাঁহাদের (শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরাগীদের) মধ্যে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামে একজন বলেন—”কোন কিছু পরীক্ষা না করে আমরা বিশ্বাস করি না, ঠাকুর আমাদের ঐরকমভাবে শিক্ষা দিয়েছেন।”৪৭

বিশ্বাসের পক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থান, অন্ধ-বিশ্বাসের পক্ষে নয়। ‘কথামৃত’-এ দেখা গেছে ডাক্তার সরকারও শ্রীরামকৃষ্ণকে একাধিকবার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে যাচাই করে দেখেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বা তাঁর অনুগামীরা এই বিষয়ে কোনো বিরোধিতা করে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেননি। ‘কথামৃত’-এ রয়েছে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষার আলোয় ধৌত ও প্রাচ্যের দর্শনশাস্ত্র-অভিজ্ঞ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও কমবেশি একই চেষ্টা করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের চেতনার বিশ্বটি এতটাই স্বচ্ছ যে, তিনি পাশ্চাত্যের সভ্যতার জ্ঞানচর্চার বৌদ্ধিক শুভ দিককে সানন্দে স্বাগত জানাতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের দর্শনাদিই সত্য এবং ভারতীয় চিরন্তনী শিক্ষা-সংস্কৃতির সবটাই খারাপ, এমন শুষ্ক জ্ঞানচর্চার ধারণাকে তিনি প্রত্যক্ষত বিরোধিতা করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুস্থ স্বাভাবিক মেলবন্ধন আধুনিক মানবসভ্যতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি জরুরি। সব সভ্যতার মধ্যেই কিছু না কিছু ইতিবাচক বিষয় রয়েছে, সেই সারবস্তুটিকে গ্রহণ করা দরকার। ‘কথামৃত’-এ রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার নব-আবিষ্কার অণুবীক্ষণ যন্ত্র দেখবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এই অপরিমেয় মুক্তমন প্রথাগত শিক্ষার ছোঁয়া না পাওয়া একজন মানুষের পক্ষে যে সত্যিই সম্ভব হয়েছিল, একে উনিশ শতকের অন্যতম এক বিস্ময় ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! এমন মুক্তমনা না হলে উনিশ শতকের অখণ্ড বাংলাদেশের বুকে বহুর মধ্যে ঐক্যের বার্তাটি দেওয়া বাস্তবিকই অসম্ভব ছিল।

প্রাচ্যচেতনায় সমৃদ্ধ শ্রীরামকৃষ্ণ দেব সম্ভবত নদীয়ার হৃদিরাজ চৈতন্যদেবের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন মানবতাবাদ ও সাম্যবাদ শব্দ দুটি ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে কতদূর ব্যাপ্তি পেতে পারে। ‘কথামৃত’-এ বারবার বিভিন্ন প্রসঙ্গে শ্রীচৈতন্যের তিনি প্রশংসা করেছেন, বিশেষ করে জাতিভেদের মতো জটিল বিষয়ে। পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের জটিল থেকে জটিলতর থিয়োরি (তত্ত্ব) না পড়েও ভারতীয় চিন্তাচেতনায় তিনি সেই ভাবনার ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখাতে পেরেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বহুবার বহু অন্ধকারমগ্ন প্রথাকে নিজে হাতে ভেঙে দেখিয়ে দিয়েছেন সেই সব কুসংস্কারের অসারত্ব। তাত্ত্বিক জটিলতার বাইরে মানুষকে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের যে মৌলিকতা, তা উনিশ শতকের অনেক বিশিষ্টজনের মধ্যেও ছিল না একথা হলফ করে বলা যায়। অন্যের তাত্ত্বিক জটিলতার মধ্যে দিয়ে নিজের স্বাধীন চিন্তাকে গতি না দিয়ে তিনি নিজের মতো করে ভাবার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই তাঁর চেতনার জগৎ এত বেশি জীবনমুখী। প্রকৃতপক্ষে মানুষ নিজের জীবন দিয়ে যা চর্চা করে তা মানুষের সারাজীবনের অক্ষয় সম্পদ হয়ে থাকে, শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও তাঁর কোনো রকম অন্যথা হয়নি। তিনি নিজের সুদীর্ঘ ১২ বছরের আধ্যাত্মিক সাধনজীবন থেকে এই উপলব্ধিতে এসে পৌঁছেছিলেন। এখানে তো কোনো মিথ্যাচার নেই। তিনি নিজে বহুপথে চলেছেন বলেই তিনি সানন্দে ঘোষণা করতে পেরেছেন মূর্তিপূজা বা নিরাকার ধারণা কোনোটিই মিথ্যে নয়। প্রতিটি মানুষের ভাবনার জগৎ পৃথক, যার যেমন পথ ভালো লাগে সেই পথে সঠিকভাবে হাঁটতে পারলেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। পথ ভিন্ন ভিন্ন হলেও গন্তব্য একটাই! লক্ষ্যনীয়, শ্রীরামকৃষ্ণের কোনো পথের প্রতিই কোনো বিদ্বেষ মনোভাব নেই। তাঁর কাছে ধর্ম ও ঈশ্বরের ধারণায় কোনো রকম কোনো বাহ্যিক বা মূলগত ভেদাভেদই নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের সম্পর্কে একটি প্রচলিত বিশেষণ ব্যবহার করা হয় তিনি সব ধর্মের সমন্বয়সাধক। ভেবে দেখার মতো বিষয় তাঁর মধ্যে সত্যিই কি কোনো রকমের ভেদাভেদ ছিল? যদি ভেদাভেদ না থাকে তবে সমন্বয় কি উপায়ে সম্ভব! শ্রীরামকৃষ্ণ একটি ধর্ম থেকে অন্য ধর্মকে পৃথক কখনই ভাবেননি। আমরা যারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রতিটি ধর্মকে পৃথক পৃথক ভাবি, তারাই এই ধরণের মহাসমন্বয়ের কথা ভাবি। শ্রীরামকৃষ্ণ এই ধরণের বাহ্যিক ভেদাভেদের অনেক ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁর চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন। লৌকিক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাবনাকে আমরা সমন্বয় বলে চেনার চেষ্টা করি শুধুমাত্র! নিজের আধ্যাত্মিক জীবনচর্চায় তিনি সব পথ দিয়েই যে অখণ্ড ‘অদ্বৈত’ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শুধু কেন এই বর্তমান সময়ে একুশ শতকেও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

ধর্ম মানেই যে মানবতার ক্ষয়সাধক নয়—এই দৃষ্টান্ত পেশ করতে শ্রীরামকৃষ্ণ উনিশ শতকের বঙ্গমানসে সম্ভবত সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। ধর্ম মানে মানববন্ধনের মিলনক্ষেত্র, তা বিচ্ছিন্নতার কারণ কেন হবে—তিনি যেন এই প্রশ্নের উত্তরে দৃষ্টান্তস্বরূপ নিজের জীবনকে উদাহরণ করে রেখে দিয়েছেন ভারতীয় সভ্যতার কাছে। হয়তো এই কারণেই ‘কথামৃত’র শ্রীরামকৃষ্ণ এত বেশি মাত্রায় সর্বজনীন হতে পেরেছিলেন। বর্তমান সময়েও ধর্ম সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের এই মৌলিকতা চিরন্তনী ও প্রাসঙ্গিক ভাবনায় স্নাত। যে উগ্রতা, বিচ্ছিন্নতা, মানবধর্মের হত্যার মধ্য দিয়ে একুশ শতকের গোটা বিশ্ব কমবেশি জর্জরিত, সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের ও তাঁর ধর্মভাবনা ঠিক কতটা প্রায়োগিক তা সহজেই অনুমেয়। শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু ভাঙতে আসেননি, তিনি গড়তে এসেছিলেন, কুসংস্কারে ফাটল ধরা জীবনচেতনাকে সযত্নে সংস্কার করতে এসেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মভাবনা তাই গণধর্মের জন্মভূমি। এই ধর্ম মানবতার ধর্ম, মানুষকে মানুষের কাছে আনার ধর্ম। শ্রীরামকৃষ্ণের নিরুপম চেতনার জগতের স্বাদ নিতে হলে ভেদধর্মটি শুধু ভেঙে নিতে হয়। ভারতীয় মানবতার ধর্মের মধ্যে যে সব ইতিবাচক দিকগুলি আগে থেকেই ছিল এবং সময়ের অভিঘাতে যার ওপর ধুলোর পুরু আস্তরণ জমেছিল উনিশ শতকে শ্রীরামকৃষ্ণ তাকেই নিজের জীবন দিয়ে শোধন করে পুনরায় জাগ্রত করে দিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গণধর্মে এটি অন্যতম মৌলিক বিষয়। এ এক এমন মানবধর্ম যেখানে সবাই আসবে এবং সবাই সমান মর্যাদা পাবে। এই কারণেই ‘কথামৃত’-এ দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিরাকারবাদী থেকে সাকারবাদী, জ্ঞানবাদী থেকে ভক্তিবাদী, এমনকি আস্তিকদের পাশাপাশি নাস্তিকতায় বিশ্বাসী মানুষও বারবার গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তথা এখনও বিশ্বমানবতার প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণকে সারা বিশ্ব গ্রহণ করে চলার পিছনে এটিও একটি অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে সমসাময়িক মুক্তমনা ব্রাহ্মসমাজ যেভাবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে একাধিকবার ভেঙে গেছে, আর্যসমাজের প্রভাব ম্লান হয়ে গেছে, ইয়ংবেঙ্গল দলের মতো কালাপাহাড়ি দল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মৌলিকতার জন্যই তাঁর প্রভাব পরবর্তী সময়ে রয়েছে গেছে অক্ষুণ্ণ। ‘কথামৃত’-এ দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ কোনো কোনো বিশেষ পন্থার অন্ধকারময় দিকটিকে চিহ্নিত করলেও কোনো মতবাদকে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য বলেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই ‘রঙিন রঙের গামলা’৪৮ যেখানে যার যেমন রঙ পছন্দ তিনি সেভাবেই ‘কথামৃত’-এ তাঁকে অনুভব করতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘কথামৃত’-এ ঈশ্বরপ্রসঙ্গে একটি অনুপম বক্তব্য রেখেছেন:

ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লা, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে—একঘাটের লোক বলছে জল, আর-একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর-একঘাটের লোক বলছে পানি—হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি,—কিন্তু বস্তু এক। মত—পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ,—ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।৪৯

শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত এই কথাটিই উনিশ শতকের আধুনিক বঙ্গ সমাজের পক্ষে সবচেয়ে বেশি মানানসই। এই কথাটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত-মার্জিত মানুষের অনেকেই মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারেননি। অন্তরের গভীর দর্শন থেকেই এই বার্তাটি জন্ম নিতে পারে। স্বধর্মে স্থিত থেকেও পরধর্ম সহিষ্ণুতার যে চরম দৃষ্টান্ত, জীবনাদর্শ ও মৌলিক চিন্তাচেতনা শ্রীরামকৃষ্ণ উনিশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতিকে দিতে পেরেছিলেন, তা বর্তমান ভারত তথা বিশ্বের কাছে এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

উনিশ শতকে যখন ভোগবাদের অযুত হাতছানির ঢেউ বঙ্গমানসে এসে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে সেই সময়ে দাঁড়িয়েও শ্রীরামকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ! শুধু রীতি ও নিয়মনিষ্ঠ ধর্মযাপনের মধ্যে দিয়ে নয়, যে কোনো কাজ সঠিকভাবে লক্ষ্যে স্থির থেকে চর্চা করলেই ঈশ্বরলাভ হয়।৫০ যারা ঈশ্বরের ধারণা ও ঐশ্বরিক সত্তায় বিশ্বাস করেন না, তারা শ্রীরামকৃষ্ণের এই বার্তাকে মানবতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর বার্তা হিসেবে দেখতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ধর্ম বা ঈশ্বর পার্থিব মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো কষ্টকল্পিত ধারণা নয়। স্বামী বিবেকানন্দ যে প্র্যাকটিক্যাল বেদান্তের কথা বলেছিলেন তার মূল বীজটি শ্রীরামকৃষ্ণ-দর্শনেই রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’—শুধু দেবগৃহের দেবতার সেবা নয়, দেবতার এক-একটি টুকরো টুকরো রূপ মানুষের সেবা। এই আদর্শই পরবর্তী সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীরা ব্যাপক রূপে প্রকাশ করেছিলেন, যা এখনও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম আদর্শ। জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ সহ অন্যান্য মার্গ শ্রীরামকৃষ্ণের গণধর্মে এসে একত্রে মিশে গেছে। শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে ঘটেছে এই সমস্ত মার্গের ইতিবাচক দার্শনিক সমন্বয়। উনিশ শতকের বুকে তিনি সেই মোহনা যেখানে বহুপথের রসধারা একত্রে বিনাদ্বন্দ্বে সহাবস্থান পেয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশিয়ে নিয়েছেন মানবতাবাদকে। আগে মানুষ ও তার শুভচেতনা, তারপরে ধর্ম ও সামাজিক সংস্কার। তাঁর কাছে মানুষ শুধু মানুষ—নারী ও পুরুষের প্রাথমিক ভেদাভেদ পর্যন্ত সেখানে নেই। তাঁর মতে জাগতিক সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিরাজমান। এই কারণেই শ্রীরামকৃষ্ণের নারীচেতনা এত নতুন ধরণের। কলকাতায় যখন একাধিক স্ত্রীর পাশাপাশি পতিতাবিলাস শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পুরুষের গর্বের বিষয়। সেই সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ নারীকে ভোগের উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত না করে ঠিক তার বিপরীতে সভ্যতার সার্বিক শুভ শক্তির প্রতীক আদ্যাশক্তির অংশ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। নিজের স্ত্রীকেও সহযাত্রী হিসেবে মান্যতা দিতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। নারী সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণকে যে উচ্চ ধারণা বহন করতে দেখা যায়, তা কোনোভাবেই পাশ্চাত্যের নারীবাদী আন্দোলনের ফলশ্রুতি বলা যায় না। এই চেতনা তাঁর স্ব-অর্জিত দার্শনিক ফসল। পরবর্তী অধ্যায়ে তা আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

‘কথামৃত’র শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে সবটাই বিশ্বজনীন। তাঁর মধ্যে সবটাই ইতিবাচক। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনদর্শনের সার্বিক মৌলিকতাই একুশ শতকের পৃথিবীর সমস্ত সমাজের পক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণকে এখনও এতটা বেশি প্রায়োগিক ও গ্রহণযোগ্য করে রাখতে পেরেছে, ভবিষ্যতেও তার অন্যথা হবে না। বিশ্বমানবতার ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক সাধনা ও সমাজ উন্নয়নের ভাবনা এত বেশি প্রায়োগিক যে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার যুগেও মুক্তমনা শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব পার হয়ে চলা সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র :

১. দ্র. স্বামী প্রভানন্দ, “একটি হিসাবের খাতা”, ‘অমৃতরূপ শ্রীরামকৃষ্ণ’, দ্বিতীয় সংস্করণ- অষ্টম মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৪২২ বঙ্গাব্দ, পৃ. ২৬-২৭

২. দ্র. স্বামী প্রভানন্দ, “শ্রীরামকৃষ্ণের বিদ্যাচর্চা”, ‘উদ্বোধন’, ৭৭বর্ষ, ২য় সংখ্যা, পৃ: ৬৪-৭৫

৩. দ্র. স্বামী সারদানন্দ, ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ'(প্রথম ভাগ, পূর্বকথা ও বাল্যজীবন), দ্বাদশ সংস্করণ-এয়োবিংশতি পুনর্মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৪১৫ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৩-১৯

৪. অক্ষয়কুমার সেন, ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি’, পঞ্চম সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ, পৃ.১২

৫. শ্রীম, ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ (অখণ্ড), প্রথম সংস্করণ-৪১তম পুনর্মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৪২১বঙ্গাব্দ, পৃ.৪৫

৬. দ্র. ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা'(অখণ্ড), প্রথম সংস্করণ-চতুস্ত্রিংশৎ পুনর্মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৪১৫বঙ্গাব্দ, পৃ. ২২১-২২

৭. জীবন মুখোপাধ্যায়,”শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভারতীয় নবজাগরণ”, ‘বিশ্বচেতনায় শ্রীরামকৃষ্ণ’, (সম্পা.) স্বামী প্রমেয়ানন্দ, স্বামী চৈতন্যানন্দ ও অন্যান্য, প্রথম প্রকাশ-১৫তম পুনর্মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৪২২ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৫৩

৮. শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, “রেনেসাঁসের কলকাতা ও রামকৃষ্ণ”, ‘কোরক’, বিশেষ সংখ্যা, ১৭৫তম জন্মবর্ষে শ্রীরামকৃষ্ণ, শারদ, ১৪১৮ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৩২

৯.  শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: ১০/৩৯

১০. শ্রীশ্রীচণ্ডী: ১০/৫

১১. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৮

১২. তদেব, পৃ. ৫৭৮

১৩. তদেব, পৃ. ৬৮৮

১৪. তদেব, পৃ. ৬৩৯

১৫. স্বামী নির্বেদানন্দ, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ও আধ্যাত্মিক নবজাগরণ’, প্রথম সংস্করণ-৭ম পুনর্মুদ্রণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৪২০বঙ্গাব্দ, পৃ. ১২

১৬. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৫২২

১৭. সুকুমার সেন, ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ (তৃতীয় খণ্ড), প্রথম আনন্দ সংস্করণ-নবম মুদ্রণ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৪১৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ২৯

১৮. দ্র. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘উনিশ শতকের আলোকে শ্রীরামকৃষ্ণ’, প্রথম প্রকাশ, হাওড়া রামকৃষ্ণ সংঘ, হাওড়া, ১৯৮৪, পৃ. ২১-২৪

১৯. স্বামী নির্বেদানন্দ, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৬

২০. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ.৪২২

২১. স্বামী নির্বেদানন্দ, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ২-৩

২২. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ২৬৪

২৩. দ্র. স্বামী প্রভানন্দ,”শ্রীরামকৃষ্ণের বিদ্যাচর্চা”, ‘উদ্বোধন’, ৭৭বর্ষ, ২য় সংখ্যা, পৃ: ৬৪-৭৫

২৪. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৫৩

২৫. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৩৯-৪০

২৬. তদেব, পৃ. ৪৩

২৭. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১১১৬

২৮. প্রাগুক্ত

২৯. তদেব, পৃ. ১১১৮-১৯

৩০. তদেব, পৃ. ১১২৫

৩১. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (সম্পা.), ‘সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস’, দ্বিতীয় মুদ্রণ, জেনারেল প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩-৬

৩২. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৫৯

৩৩. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৪০

৩৪. তদেব, পৃ. ৫৫৩

৩৫. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৮৮

৩৬. তদেব, পৃ. ৯৫-৯৬

৩৭.  শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৯৩৭

৩৮. তদেব, পৃ. ৯৫০

৩৯. তদেব, পৃ. ৯৮০

৪০. সুমিত সরকার, ‘কলিযুগ, চাকরি, ভক্তি : রামকৃষ্ণ ও তাঁর সময়’, তৃতীয় মুদ্রণ, সেরিবান, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ১১

৪১. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১১২৭

৪২. তদেব, পৃ. ১০৭

৪৩. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: ৪/১১

৪৪. শ্রীম, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৫১

৪৫. তদেব, পৃ. ৫১৯

৪৬. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৩

৪৭. ভগিনী নিবেদিতা, ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি’, অনুবাদ-স্বামী মাধবানন্দ, তৃতীয় সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৬১, পৃ. ২১০

৪৮. দ্র. শ্রীম,পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ২৮৮

৪৯. তদেব, পৃ. ২৩৯

৫০. দ্র. তদেব, পৃ. ৪২৭

অধ্যায় ১ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন