২.২৬ মেয়েরা একে একে বিদায় নিল

আশাপূর্ণা দেবী

মেয়েরা একে একে বিদায় নিল।

পারুলের যাত্রাকালে বকুল আস্তে বলে, ভুল করিস না। সেজদি! চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাবি তুই?

পারুল ঈষৎ কঠিন হাসি হেসে বলে, চোরের সঙ্গে কাড়াকড়ি করে থালার দখলটা নেবার প্রবৃত্তিও নেই!

তা বলে তুই কবিতা লেখা ছেড়ে দিবি? অত ভাল লিখতিস?

বকিস না, পারুল হেসে ওঠে, শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর! ভারী তো লেখা! ছেড়ে দিলে পৃথিবীর ভারী লোকসান!

পৃথিবীর না হোক, তোর নিজের তো অনেক লোকসান।

পারুল অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, লবণ-সমুদ্রে বাড়তি একমুঠো নুন ফেললে কি ইতারবিশেষ হয় বল তো? জীবনটাই তো লোকসানের।

কিন্তু সেজদি, অমলবাবু তো—

 

আরে কী মুশকিল, তোদের অমলবাবুর নিন্দে করছি নাকি আমি? মহদাশয় ব্যক্তি, স্ত্রীর একটু আরাম-আয়েসের জন্য ভাড়ার ভেঙে খরচা করতে পারেন, শুধু প্রেমের কবিতা চলবে না।

বেশ তো, ভগবানের বিষয় নিয়ে লিখবি-

পারুল ওর মাথাটায় একটু আদরের নাড়া দিয়ে বলে, ভারী তো লেখা, তার জন্যে ভেবে ভেবে মুণ্ডুটা তোর গেল দেখছি! বিদ্বন-মুখুদের নিয়ে আবার অনেক জ্বালা রে! ঈশ্বরই যে মানুষের আদি-অনন্তকালের প্ৰেমাস্পদ, এ ওদের মগজে ঢোকে না। আবেগ আর ব্যাকুলতা, এ দেখলেই তার মধ্যে আঁশটে গন্ধ পায় ওরা। যাক গে মরুক গে, মাও তো জীবনভোর কত কি লিখলেন, তার পরিণাম তো নিজেই বললি!

যদিও মার ওই লেখা সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারণা ছিল না পারুলের, বরং মার তীব্রতা, মার আবেগ, মার সব বিষয়ে তাল ঠুকে প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ করা, এসবকে পারুল খুব অবজ্ঞার চোখেই দেখতো, জানতো মার লেখাও ওই পর্যায়ের, কাজেই মূল্যবোধ কিছু ছিল না তার সম্বন্ধে, তবু এখন একটু উল্লেখ করলো।

ব্যর্থতার তুলনা করতে করলো উল্লেখ।

বকুল চুপ করে থাকলো।

বকুলের হঠাৎ সেই এক লহমার জন্য দেখা আগুনের আভায় স্পষ্ট হয়ে ওঠা মুখটা মনে পডালো।

সে মুখ পরাজিত সৈনিকের না। অপরাজেয় কাঠিন্যের, আজ পর্যন্ত ঠিক করতে পারে নি বকুল।

তা হয়তো পরাজিতেরই।

হয়তো সুবর্ণ ওই দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেওয়ালের লেখা পড়ে না, লেখে সেখানে। অদৃশ্য কালিতে রাখে বঞ্চনা-জর্জর পীড়িত আত্মাদের ইতিহাস। না, শুধু তার নিজের কথা নয়, লক্ষ লক্ষ আত্মার কথা। পরবর্তীকাল পড়বে ওই লেখা।

কে জানে তখন আবার তার প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেবে। কিনা আর এক নতুন জাতি— উদ্ধত, অবিনয়ী, অসহিষ্ণু, অসন্তুষ্ট, আত্মকেন্দ্ৰিক।

দেওয়ালের লেখাও তো শেলেটের লেখার মত একবার লেখা হয়, একবার মোছা হয়। আজ হয়তো এক হৃতসর্বস্ব সৈনিক পরাজয়ের কথা লিখে রেখে যাচ্ছে, আগামী কাল–

কিন্তু সত্যিই কি তবে এবার যাচ্ছে সুবৰ্ণলতা? তা নইলে এত ভেঙে পড়েছে কেন? উঠতে যদি পারেও, উঠতে চায় না।

বিছানাতেই রাতদিন।

মেজেয় মাদুরের ওপর পাতা বিছানা, ঘরমোছা-ঝি জ্ঞানদা এসে বলে, একটু যে উঠতে হবে মা–

আগে আগে উঠছিল সুবর্ণ, আজকাল বলে, আর উঠতে পারি না বাপু, পাশ থেকে মুছে নিয়ে যাও।

আর মাঝে মাঝে বলে, দক্ষিণের ওই বারান্দাটায় একটা চিক টাঙিয়ে দিলে ওইখানেই শুতাম–

প্ৰবোধ শুনতে পেয়ে রাগ করে বলে, ওই খোলা বারান্দায় শোবে? এই নিত্যি জ্বর—

ঘুষঘুষে জ্বরে খোলা হাওয়া ভাল, সুবর্ণ একটু হেসে বলে, তাছাড়া দক্ষিণের বারান্দায় মরবার যে বড় সাধ আমার!

ওসব অলুক্ষণে কথা বোলো না মেজবৌ—, প্ৰবোধ গুম হয়ে যায়।

সুবৰ্ণ বলে, অলুক্ষ্মণে কি গো? এখন মরলে জয়জয়কার! যাক গে, মরছি না তো— মরবোও না। তবে রাত্তিরে কেসে মরি, তোমার ঘুম হয় না—

তা কথাটা মিথ্যে নয়।

ও দেওয়ালের একবারে ও প্রান্তে উঁচু  খাটে ঝালর দেওয়া বালিশ-তাকিয়ায় ঘেরা যে বিছানাটি বড় শুরুমুখ্যা ছিল, প্ৰবোধের সেখানে আর নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাচ্ছে না।

ওই কাসি।

কাসির শব্দ হলেই কেমন যেন ঘরে টিকতে পারে না প্ৰবোধ, দরজা খুলে বেরিয়ে দালানের চৌকিতে এসে বসে।

তবু প্ৰতিবাদ করে প্রবোধ, বাঃ, শুধু আমার ঘুমটাই বড় হলো? তুমিও তো কেসে কেসে—, কিন্তু প্ৰতিবাদের সুরাটা যেন দুর্বল শোনায়।

সুবৰ্ণ দেওয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, তা নিজেকে তো নিজের কাছ থেকে সরিয়ে নেবার উপায় নেই?

 

আজও আবার সেই কথাই ওঠে।

কারণ গতরাত্রে প্রবোধ প্রায় সারারাতই ভিতরন্দালানে কাটিয়েছে। তবু আজ যেই সুবর্ণ দক্ষিণের বারান্দায় চিক ফেলার কথা বলে, প্ৰবোধ পাড়া জানিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, এই বকুল, দাদাদের বল মুটে ডেকে আমার খাটখানা ওই ছোট ঘরে নিয়ে যাক! ওখানেই শোবো। আমি আজ থেকে। কাসির জন্যে নাকি ঘুমের ব্যাঘাত হয় আমার, তাই একটা রুগী যাবে খোলা বারান্দায় শুতে!

ঘরে দাঁড়িয়ে নয়, ঘর থেকে বেরিয়ে চেঁচায়।

সুবৰ্ণ যেন সেই চেঁচানিটার দিকেই একটা রহস্যময় ব্যঙ্গহাসির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

ব্যবস্থাটা করে দিল সুবল।

বাবার নয়, মার।

কোথা থেকে যেন খান্নতিনেক চিক আর ত্রিপল এনে বারান্দায় বুলিয়ে দিয়ে মার বিছানাটা তুলে নিয়ে গেল। সেখানে। নিঃশব্দে, সকলের অগোচরে।

বলেছিলও সুবর্ণ সকলের অগোচরে।

সুবৰ্ণ কি ভেবেছিল, হাতে মজুত এই বাক্সটার সীল আমি ভাঙবই? তাই বলেছিল সুবৰ্ণ, সুবল, কখনো তো কিছু অনুরোধ করি নি। বাবা, একটা অনুরোধ রাখবি? দক্ষিণের বারান্দায় মরবার বড় শখ হয়েছে। করে দিবি ব্যবস্থা?

সুবল উত্তর দেয় নি, বোঝা যায় নি করবে। কিনা, কিন্তু খানিক পরেই দেখা যায় বারান্দায় পর্দা ঘিরছে।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ একাল-সেকাল নিয়ে তর্ক
২. ১.০২ মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়
৩. ১.০৩ মুক্তকেশীর চার ছেলে
৪. ১.০৪ এসেছিল সুবৰ্ণ সেই চিলেকোঠার ঘরে
৫. ১.০৫ সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আর কেউ
৬. ১.০৬ তিনটে বছর গায়েব করেও
৭. ১.০৭ মুক্তকেশীর ছোট দুই ছেলে
৮. ১.০৮ কিন্তু জেদী মেয়ে সুবৰ্ণলতা
৯. ১.০৯ তীৰ্থ থেকে ফিরলেন মুক্তকেশী
১০. ১.১০ মুক্তকেশীর সংসারের অন্নজল
১১. ১.১১ তাসের আড্ডা রোজই বসে
১২. ১.১২ ডান হাতে টুকটুকে করে মাজা তামার ঘটি
১৩. ১.১৩ বাসনমাজ ঝি হরিদাসী
১৪. ১.১৪ মুটের মাথায় ফলের ঝোড়া
১৫. ১.১৫ সুবৰ্ণর লজ্জা নেই
১৬. ১.১৬ পড়ন্ত বেলার রোদ সরতে সরতে
১৭. ১.১৭ বড় গলায় আশ্বাস দিয়েছিল সুবোধ
১৮. ১.১৮ ঠাকুমার সঙ্গে নবদ্বীপে আসায়
১৯. ১.১৯ অন্য ভুবন
২০. ১.২০ চাঁপার ধারণা ভুল ছিল না
২১. ১.২১ স্বাধীনতা পরাধীনতা নিয়ে
২২. ১.২২ সুবৰ্ণলতা না সত্যবতীর মেয়ে
২৩. ১.২৩ মেয়ে-গাড়িতে শুধু বৌকেই তুলে দেয় না প্ৰবোধ
২৪. ১.২৪ সিঁড়িতে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়ালো প্ৰভাস
২৫. ১.২৫ কালো শুঁটকো পেটে-পীলে ছেলেটা
২৬. ১.২৬ ভাগ্নেদের মেয়ের বিয়ের পরামর্শ
২৭. ২.০১ তারপর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে
২৮. ২.০২ পারু বকুকে ইস্কুলে ভর্তি
২৯. ২.০৩ সুবৰ্ণলতাই বা এমন অনমনীয় কেন
৩০. ২.০৪ পালকি সত্যিই এবার উঠে যাচ্ছে
৩১. ২.০৫ আমি নিজেই যাব
৩২. ২.০৬ নবকুমার বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে আছেন
৩৩. ২.০৭ একই দিনে মা-বাপ হারালাম
৩৪. ২.০৮ ভাগ্নের বাড়ির খবর
৩৫. ২.০৯ অনেকগুলো বছর জেলের ভাত খেয়ে
৩৬. ২.১০ তা বদলাবে এ আর বিচিত্র কি
৩৭. ২.১১ তারপর সুবৰ্ণলতা
৩৮. ২.১২ সুবালা তার ভাঙা দাঁতের হাসি হেসে
৩৯. ২.১৩ ঝটপটানি কি আছে আর
৪০. ২.১৪ গিরি তাঁতিনী এসেছে
৪১. ২.১৫ বৃষোৎসর্গ
৪২. ২.১৬ বহুদিন পরে মামাশ্বশুর-বাড়িতে
৪৩. ২.১৭ কানায় কানায় পূর্ণ মন নিয়ে
৪৪. ২.১৮ বড় ইচ্ছে হচ্ছিল সুবর্ণর
৪৫. ২.১৯ সুবৰ্ণলতার স্মৃতির পৃষ্ঠায়
৪৬. ২.২০ সুবৰ্ণর অগাধ সমুদ্রের এক অঞ্জলি জল
৪৭. ২.২১ ঢেউটা আনলেন জয়াবতী
৪৮. ২.২২ অভিমানী পারুল
৪৯. ২.২৩ সুবর্ণর সেই কেদারবন্দরী যাবার
৫০. ২.২৪ চিরদিনের উল্টো-পাল্টা সুবৰ্ণতা
৫১. ২.২৫ চলছিল গিরির আনাগোনা
৫২. ২.২৬ মেয়েরা একে একে বিদায় নিল
৫৩. ২.২৭ কেদার-বদরি ফেরত
৫৪. ২.২৮ গঙ্গার জল কত বাড়লো
৫৫. ২.২৯ সুবৰ্ণ একদিন উঠে বসে
৫৬. ২.৩০ ওই ঘামটাই হলো শেষ উপসৰ্গ
৫৭. ২.৩১ নিস্তব্ধ হয়ে গেল বাড়ি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন