২.০৫ আমি নিজেই যাব

আশাপূর্ণা দেবী

আমি নিজেই যাব! এর চাইতে অসম্ভব কথা আর কি আছে?

সুবৰ্ণলতা পাগল তাই এমন একটা অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক কথা বলে বসেছিল। অস্বাভাবিক বৈকি। বিধবা বুড়ীরা কালীঘাট গঙ্গাঘাট করে বেড়ায়, সে আলাদা কথা। বলতে গেলে তারা বেওয়ারিশ। কমবয়েসী। বিধবারাও মাঝে মাঝে পথে বেরোবার ছাড়পত্র পায়, বুড়ীদের দলে মিশে যেতে পারলে।

পথে মানে অবশ্য তীর্থপথে।

অল্পবয়সে যারা সর্বস্ব হারিয়ে বসে আছে, সমাজের কাছে এটুকু কৃপা তারা পায়। অথবা সমাজের উপর এটুকু দাবি তারা রাখে। অবশ্য বুড়ীদের মধ্যে সপ্তরিখী বেষ্টিত অবস্থায় তাদের খিদমদগারী করতে করতেই যাওয়া।

তা হোক—তবু রাজরাস্তায় পা ফেলবার সৌভাগ্য!

কিন্তু সধবারা?

নৈব্য নৈব চ!

তারা তো আর বেওয়ারিশ নয় যে, যা খুশি করতে চাইলেই করতে পারে? তবে আর মেয়েতে পুরুযেতে তফাৎ কি? কাছাকোঁচা দিয়ে কাপড়ই বা পরবে না কেন তবে?

তবুও যদি সুবৰ্ণ বাইরে জগৎ থেকে নজীর এনে এনে দেখাতে চায়, যদি বলে, ওরা মেয়ে নয়? এই বাংলা দেশের মেয়ে? তারও উত্তর আছে।

যারা বেম্ম, যারা খ্ৰীষ্টান, যারা সনাতন ধর্মত্যাগী ইঙ্গবঙ্গ, যারা বাঙালী হয়েও সাহেব, তাদের ঘরের মেয়েরাই যা নয়। তাই করছে। তাদের মেয়েরাই ডাক্তার হচ্ছে, মাস্টার হচ্ছে, দেশসেবিকা হচ্ছে, সমাজ-সংস্কারিকা হচ্ছে, হাটহট করে রাস্তায় বেরোচ্ছে, পিরিলি করে শাড়ী পড়ছে, জুতোমোজা পরছে। ছেলেদের মতন খেলাঘরের ছাতা হাতে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

তাদের মত হতেও চাও তুমি? সেটাই আদর্শ?

গোরস্তঘরের মেয়েরা সবাই যদি চৌকাঠ ডিঙোতে চায়, তাহলে সমাজ বলে আর রইল কি?

লাখ লাখ মেয়ের মধ্যে দু-পাটা মেয়ে কি করছে, সেটাই দেখতে হবে? বাকি মেয়েরা কোথায় রয়েছে সেটা দেখে?

এই যে প্ৰবোধের ওপাড়ার বন্ধু শশীশেখরদের বাড়ি? সুবৰ্ণ জানে না। তাদের কথা?… এখনো তাদের বাড়ির বাড়ির মেয়েরা চন্দ্ৰ-সূৰ্য কেমন তা জানে না, ভাদ্রবৌরা কখনো ভাসুরের সামনে বেরোয় না। শশীশেখরের দাদা যখন বৈঠকখানার দিক থেকে অন্দরের দিকে আসেন বা তিনতলা থেকে একতলায় নামেন, ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে পদক্ষেপ করেন না? ছোট একটা পেতলের ঘন্টা থাকে না তার হাতে?

কেন?

না, পাছে ভদ্রবৌরা অনবহিত থাকে, পাছে অসতর্কতায় মুখ দেখা হয়ে যায়। তা ওরা না হয় একটু বেশী, কিন্তু প্ৰবোধের জানাশোনা আত্মীয় কুটুম্ব কাদের বাড়িতে সুবৰ্ণর ইচ্ছানুযায়ী বেহায়াপনা চালু আছে?

সকল বাড়িতেই ধোপানী, গয়লানী, মেছুনী, তাঁতিনী, নাপিতনী। সব বাড়িতেই শাকওয়ালী, ঘুটেওয়ালী, চুড়িওয়ালী। অথচ সুবর্ণ নিজের বাড়িতে দুম করে একটা জোয়ানমার্দ গোয়ালা ঠিক করে বসলো সেবার! যুক্তি কি? না দুধ ভাল দেবে! নিকুচি করেছে ভাল দুধের! পত্রপাঠ বিদায় দিয়েছে তাকে প্ৰবোধ। পরিমলবাবুদের নজীর মানে নি।

নজীর দেওয়াই একটা রোগ সুবর্ণর।

আর নিজের গণ্ডীর নজীর ছেড়ে গণ্ডীর বাইরের নজীরে নজর।

তর্ক উঠলেই গড় গড় করে আউড়ে যাবে–বিধুমুখী, চন্দ্ৰমুখী, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, সরোজিনী নাইড়ু, কামিনী রায়, জ্ঞানদাননন্দিনী, লেভী অবলা বসু, আরও গাদাগুচ্ছির। মানবে না যে ওরা তোমার মত হিন্দু বাঙালীঘরের মেয়ে নয়। ঘরে বসে বসে এত খবর রাখেই বা কি করে কে জানে? মাঝে মাঝে তো তাজ্জব হয়ে যায় প্ৰবোধ। এই তো তার ঘরের মধ্যেই তো আছে চিরটাদিন, অথচ বাইরের খবর প্রবোধের থেকে বেশী রাখে। পাড়া বেড়াতেও যায় না, পাঁচটা সখীসামন্তও আসে না, অথচ–

আশ্চর্য!

মেয়েমানুষের এত জানা, এত বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের খবর রাখা হচ্ছে অনার্থের মূল। ও থেকেই সন্তোষ নষ্ট, শান্তি নষ্ট, বাধ্যতা নষ্ট। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে দরকার কি বাপু? বিধাতাপুরুষ যখন গোঁফদাড়ি দিয়ে পাঠায় নি, তখন রাধোবাড়ো, খাওদাও, স্বামীপুত্ত্বরের সেবা কর, নিদেন না হয় হরিনাম কর কিংবা পরিচর্চা কর। চুকে গেল ল্যাঠা। তা নয় লম্বা লম্বা বুলি, বড় বড় আম্বা!

তবে সেদিন সুবর্ণ এত কথা বলে নি। এসব ওর মতবাদ। যা মনে পড়ে প্ৰবোধ একটা তর্কাতর্কির মুখোমুখি হবার ভয় করছিল!… কিন্তু তর্ক সুবৰ্ণ করে নি সেদিন, বেশী কথাও বলে নি, শুধু বলেছিল, আমি নিজেই যাব।

প্ৰবোধ ভুরু কেঁচকালো।

আবার সোজা করলো সে ভুরু।

তারপর বললো, সে তো আর সম্ভব কথা নয়। তোমার যখন এতই ব্যস্ততা, তখন আমাকেই যেতে হবে পৌঁছাতে।

না!

না? না মানে?

মানে নিজেই যাব, সেই কথাই হচ্ছে। ঠিকানা বলে দিলে গাড়োয়ান ঠিকই নিয়ে যেতে পারবে।

ঠিকানা? প্ৰবোধ একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হাসে, শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা আর জানলাম কবে? জন্মের মধ্যে কৰ্ম্ম, সেই তো একবার দরজা পর্যন্ত আমি আবার ঠিকানা বলবো—

সুবৰ্ণ উত্তাল অসহিষ্ণু চিত্তকে স্থির করে শান্তগলায় বলে, তোমায় বলে দিতে হবে না।

প্ৰবোধ সুবর্ণর স্থিরতাকে ভয় করে।

প্ৰবোধ ভারী আবহাওয়াকে ভয় করে।

তাই প্ৰবোধ আবহাওয়াকে হালকা করে ফেলবার চেষ্টায় ছ্যাবলাগোছের হাসি হেসে বলে, তবে বলবেটা কে? তুমি? সেই মান্ধাতার আমলের স্মৃতি উটুকে? মাথা খারাপ? সে কি এখনো মনে আছে তোমার? কি বলতে কি বলবে- কেত্ব কথা আমার খারাপ লাগছে। তোমায় গাড়ি ডেকে দিতেও হবে না, রাস্তায় বেরিয়ে আমি

হঠাৎ থেমে গোল সুবৰ্ণ, গলাটা কি শক্ৰতা সাধলো?

প্ৰবোধ বুঝলো একবার যখন ধরেছে, ঠেকানো যাবে না। বিশেষ করে পরিস্থিতিটা গোলমেলে। তাই আচ্ছা আচ্ছা হচ্ছে বলে বেরিয়ে পড়ে একখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে এনে সশব্দ সমারোহে বলে, পারু, দোরটা বন্ধ করে দিয়ে যা। ভাল করে দিবি, কেউ কড়া নাড়লে বারান্দা থেকে দেখে তবে–

সুবৰ্ণ একখানা ফর্সা শাড়ি পরে নেমে এসেছিল ততক্ষণে, সুবর্ণর চোখ লালচে, মুখ লালচে, তবু সুবৰ্ণ দৃঢ়গলায় বলে, অত কথা হচ্ছে কেন? বলছি তো আমি নিজেই যাব।

প্ৰবোধও অতএব দৃঢ় হয়, বললেই তো হল না? কলকাতার রাস্তা বলে কথা! তার ওপর মোছলমান গাড়োয়ান কোন পথে নিয়ে যেতে কোন পথে টেনে ছুটি দেবে—

সুবৰ্ণ সহসা ঘুরে দাঁড়ায়, সিঁড়ির দিকে এগোয়, বলে, ঠিক আছে যাব না।

আরে বাবা হলটা কি? বলছি তো নিয়ে যাচ্ছি-–

না না না।

সুবৰ্ণ সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়।

ধৌত্তারি নিকুচি করেছে—, প্ৰবোধ জেরবারের গলায় বলে, আমি শালা সবাতাতেই চোরাদারে ধরা পড়েছি। চুলোয় যাক, আমার কি?

তারপর গট গট করে বেরিয়ে গাড়োয়ানটার হাতে একটা আনি দিয়ে বলে, দরকার লাগবে না। বাবা, যা!

দোতলায় উঠে এসে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলা তুলে বলতে থাকে, বুঝলাম মন খারাপ, তবু সবেরই একটা সামঞ্জস্য থাকা দরকার। মা-বাপ তো তোমার জ্যান্তে মরা, এখন যে অসুখ বলে খবর পাঠিয়েছে সেটাই আশ্চর্য!

ঘরের মধ্যে থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না, দেখাও যায় না কোণের দিকে কোথায় বসে আছে।

নিজেরই তো ঘর, তবু কেন কে জানে। হঠাৎ ঢুকে পড়বারও সাহস হয় না। বাইরে থেকেই আরো কিছুক্ষণ স্বগতোক্তি করে আস্তে আস্তে নীচের তলায় নেমে গিয়ে বৈঠকখানা ঘরে বসে থাকে।

 

বাবা-

অনেকক্ষণ পরে বকুল এসে ঘরে ঢোকে।

যেন খুব একটা বিচলিত দেখায় তাকে।

বলে ওঠে, বাবা, মা কোথায়?

মা কোথায়!

এ আবার কেমন ভাষা!

প্ৰবোধ কাছা সামলাতে সামলাতে উঠে পড়ে, তার মানে?

বকুল শুকনো গলায় বলে, কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত হিমপ্রবাহ বয়ে যায়, তবু মেয়ের সামনে অবিচলিত ভাব দেখাতে চেষ্টা করে প্রবোধ, ছাতে উঠে বসে আছে বোধ হয়।

না। ছাতে দেখে এসেছি।

হ্যাঁ, সর্বত্রই দেখেছে ওরা।

ছাতে, স্নানের ঘরে, ঘুঁটে-কয়লার ঘরে, এমন কি ঝিয়ের বাসনামাজার গলিতে পর্যন্ত।

কোথাও নেই সুবৰ্ণলতা।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ একাল-সেকাল নিয়ে তর্ক
২. ১.০২ মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়
৩. ১.০৩ মুক্তকেশীর চার ছেলে
৪. ১.০৪ এসেছিল সুবৰ্ণ সেই চিলেকোঠার ঘরে
৫. ১.০৫ সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আর কেউ
৬. ১.০৬ তিনটে বছর গায়েব করেও
৭. ১.০৭ মুক্তকেশীর ছোট দুই ছেলে
৮. ১.০৮ কিন্তু জেদী মেয়ে সুবৰ্ণলতা
৯. ১.০৯ তীৰ্থ থেকে ফিরলেন মুক্তকেশী
১০. ১.১০ মুক্তকেশীর সংসারের অন্নজল
১১. ১.১১ তাসের আড্ডা রোজই বসে
১২. ১.১২ ডান হাতে টুকটুকে করে মাজা তামার ঘটি
১৩. ১.১৩ বাসনমাজ ঝি হরিদাসী
১৪. ১.১৪ মুটের মাথায় ফলের ঝোড়া
১৫. ১.১৫ সুবৰ্ণর লজ্জা নেই
১৬. ১.১৬ পড়ন্ত বেলার রোদ সরতে সরতে
১৭. ১.১৭ বড় গলায় আশ্বাস দিয়েছিল সুবোধ
১৮. ১.১৮ ঠাকুমার সঙ্গে নবদ্বীপে আসায়
১৯. ১.১৯ অন্য ভুবন
২০. ১.২০ চাঁপার ধারণা ভুল ছিল না
২১. ১.২১ স্বাধীনতা পরাধীনতা নিয়ে
২২. ১.২২ সুবৰ্ণলতা না সত্যবতীর মেয়ে
২৩. ১.২৩ মেয়ে-গাড়িতে শুধু বৌকেই তুলে দেয় না প্ৰবোধ
২৪. ১.২৪ সিঁড়িতে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়ালো প্ৰভাস
২৫. ১.২৫ কালো শুঁটকো পেটে-পীলে ছেলেটা
২৬. ১.২৬ ভাগ্নেদের মেয়ের বিয়ের পরামর্শ
২৭. ২.০১ তারপর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে
২৮. ২.০২ পারু বকুকে ইস্কুলে ভর্তি
২৯. ২.০৩ সুবৰ্ণলতাই বা এমন অনমনীয় কেন
৩০. ২.০৪ পালকি সত্যিই এবার উঠে যাচ্ছে
৩১. ২.০৫ আমি নিজেই যাব
৩২. ২.০৬ নবকুমার বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে আছেন
৩৩. ২.০৭ একই দিনে মা-বাপ হারালাম
৩৪. ২.০৮ ভাগ্নের বাড়ির খবর
৩৫. ২.০৯ অনেকগুলো বছর জেলের ভাত খেয়ে
৩৬. ২.১০ তা বদলাবে এ আর বিচিত্র কি
৩৭. ২.১১ তারপর সুবৰ্ণলতা
৩৮. ২.১২ সুবালা তার ভাঙা দাঁতের হাসি হেসে
৩৯. ২.১৩ ঝটপটানি কি আছে আর
৪০. ২.১৪ গিরি তাঁতিনী এসেছে
৪১. ২.১৫ বৃষোৎসর্গ
৪২. ২.১৬ বহুদিন পরে মামাশ্বশুর-বাড়িতে
৪৩. ২.১৭ কানায় কানায় পূর্ণ মন নিয়ে
৪৪. ২.১৮ বড় ইচ্ছে হচ্ছিল সুবর্ণর
৪৫. ২.১৯ সুবৰ্ণলতার স্মৃতির পৃষ্ঠায়
৪৬. ২.২০ সুবৰ্ণর অগাধ সমুদ্রের এক অঞ্জলি জল
৪৭. ২.২১ ঢেউটা আনলেন জয়াবতী
৪৮. ২.২২ অভিমানী পারুল
৪৯. ২.২৩ সুবর্ণর সেই কেদারবন্দরী যাবার
৫০. ২.২৪ চিরদিনের উল্টো-পাল্টা সুবৰ্ণতা
৫১. ২.২৫ চলছিল গিরির আনাগোনা
৫২. ২.২৬ মেয়েরা একে একে বিদায় নিল
৫৩. ২.২৭ কেদার-বদরি ফেরত
৫৪. ২.২৮ গঙ্গার জল কত বাড়লো
৫৫. ২.২৯ সুবৰ্ণ একদিন উঠে বসে
৫৬. ২.৩০ ওই ঘামটাই হলো শেষ উপসৰ্গ
৫৭. ২.৩১ নিস্তব্ধ হয়ে গেল বাড়ি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন