ওরে আমার কর্মহারা, ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওরে আমার কর্মহারা, ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া,
ওরে আমার মন রে, আমার মন।
জানি নে তুই কিসের লাগিকোন্‌ জগতে আছিস জাগি–
কোন্‌ সেকালের বিলুপ্ত ভুবন।
কোন্‌ পুরানো যুগের বাণী অর্থ যাহার নাহি জানি
তোমার মুখে উঠছে আজি ফুটে।
অনন্ত তোর প্রাচীন স্মৃতি কোন্‌ ভাষাতে গাঁথছে গীতি,
শুনে চক্ষে অশ্রুধারা ছুটে।
আজি সকল আকাশ জুড়ে যাচ্ছে তোমার পাখা উড়ে,
তোমার সাথে চলতে আমি নারি।
তুমি যাদের চিনি ব’লে টানছ বুকে, নিচ্ছ কোলে,
আমি তাদের চিনতে নাহি পারি।

আজকে নবীন চৈত্রমাসে পুরাতনের বাতাস আসে,
খুলে গেছে যুগান্তরের সেতু।
মিথ্যা আজি কাজের কথা, আজ জেগেছে যে-সব ব্যথা
এই জীবনে নাইকো তাহার হেতু।
গভীর চিত্তে গোপন শালা সেথা ঘুমায় যে রাজবালা
জানি নে সে কোন্‌ জনমের পাওয়া।
দেখে নিলেম ক্ষণেক তারে, যেমনি আজি মনের দ্বারে
যবনিকা উড়িয়ে দিল হাওয়া।
ফুলের গন্ধ চুপে চুপে আজি সোনার কাঠি-রূপে
ভাঙালো তার চিরযুগের ঘুম।
দেখছে লয়ে মুকুর করে আঁকা তাহার ললাট-‘পরে
কোন্‌ জনমের চন্দনকুঙ্কুম।

আজকে হৃদয় যাহা কহে মিথ্যা নহে, সত্য নহে,
কেবল তাহা অরূপ অপরূপ।
খুলে গেছে কেমন করে আজি অসম্ভবের ঘরে
মর্চে-পড়া পুরানো কুলুপ।
সেথায় মায়াদ্বীপের মাঝে নিমন্ত্রণের বীণা বাজে,
ফেনিয়ে ওঠে নীল সাগরের ঢেউ,
মর্মরিত-তমাল-ছায়ে ভিজে চিকুর শুকায় বায়ে–
তাদের চেনে, চেনে না বা কেউ।
শৈলতলে চরায় ধেনু, রাখালশিশু বাজায় বেণু,
চূড়ায় তারা সোনার মালা পরে।
সোনার তুলি দিয়ে লিখা চৈত্রমাসের মরীচিকা
কাঁদায় হিয়া অপূর্বধন-তরে।

গাছের পাতা যেমন কাঁপে দখিনবায়ে মধুর তাপে
তেমনি মম কাঁপছে সারা প্রাণ।
কাঁপছে দেহে কাঁপছে মনে হাওয়ার সাথে আলোর সনে,
মর্মরিয়া উঠছে কলতান।
কোন্‌ অতিথি এসেছে গো, কারেও আমি চিনি নে গো
মোর দ্বারে কে করছে আনাগোনা।
ছায়ায় আজি তরুর মূলে ঘাসের ‘পরে নদীর কূলে
ওগো তোরা শোনা আমায় শোনা–
দূর-আকাশের-ঘুম-পাড়ানি মৌমাছিদের-মন-হারানি
জুঁই-ফোটানো ঘাস-দোলানো গান,
জলের-গায়ে-পুলক-দেওয়া ফুলের-গন্ধ-কুড়িয়ে-নেওয়া
চোখের পাতে-ঘুম-বোলানো তান।

শুনাস নে গো ক্লান্ত বুকের বেদনা যত সুখের দুখের —
প্রেমের কথা– আশার নিরাশার।
শুনাও শুধু মৃদুমন্দ অর্থবিহীন কথার ছন্দ,
শুধু সুরের আকুল ঝংকার।
ধারাযন্ত্রে সিনান করি যত্নে তুমি এসো পরি
চাঁপাবরন লঘু বসনখানি।
ভালে আঁকো ফুলের রেখা চন্দনেরই পত্রলেখা,
কোলের ‘পরে সেতার লহো টানি।
দূর দিগন্তে মাঠের পারে সুনীল-ছায়া গাছের সারে
নয়নদুটি মগ্ন করি চাও।
ভিন্নদেশী কবির গাঁথা অজানা কোন্‌ ভাষার গাথা
গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া গাও।

হাজারিবাগ, ১২ চৈত্র, ১৩০৯

সকল অধ্যায়

১. অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে
২. অত চুপি চুপি কেন কথা কও
৩. আকাশ-সিন্ধু-মাঝে এক ঠাঁই
৪. আছি আমি বিন্দুরূপে, হে অন্তরযামী
৫. আজ মনে হয় সকলেরই মাঝে
৬. আজি হেরিতেছি আমি
৭. আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে
৮. আপনারে তুমি করিবে গোপন
৯. আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা
১০. আমার খোলা জানালাতে
১১. আমার মাঝারে যে আছে কে গো সে
১২. আমি চঞ্চল হে
১৩. আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে
১৪. আলো নাই, দিন শেষ হল, ওরে
১৫. আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায়
১৬. ওরে আমার কর্মহারা, ওরে আমার সৃষ্টিছাড়া
১৭. ওরে পদ্মা, ওরে মোর রাক্ষসী প্রেয়সী
১৮. কত দিবা কত বিভাবরী
১৯. কাল যবে সন্ধ্যাকালে বন্ধুসভাতলে
২০. কী কথা বলিব বলে
২১. কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে
২২. কেবল তব মুখের পানে চাহিয়া
২৩. ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে
২৪. চিরকাল একি লীলা গো
২৫. তুমি আছ হিমাচল ভারতের অনন্তসঞ্চিত
২৬. তোমার বীণায় কত তার আছে
২৭. তোমারে পাছে সহজে বুঝি
২৮. তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব
২৯. দিয়েছ প্রশ্রয় মোরে, করুণানিলয়
৩০. দুয়ারে তোমার ভিড় ক’রে যারা আছে
৩১. দেখো চেয়ে গিরির শিরে
৩২. ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে
৩৩. নব বৎসরে করিলাম পণ
৩৪. না জানি কারে দেখিয়াছি
৩৫. নানা গান গেয়ে ফিরি নানা লোকালয়
৩৬. পথের পথিক করেছ আমায়
৩৭. পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি
৩৮. বাহির হইতে দেখো না এমন করে
৩৯. বিরহবৎসর-পরে মিলনের বীণা
৪০. ভারতসমুদ্র তার বাষ্পোচ্ছ্বাস নিশ্বসে গগনে
৪১. ভারতের কোন্‌ বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি
৪২. ভোরের পাখি ডাকে কোথায়
৪৩. মন্ত্রেসে যে পূত রাখীররাঙা সুতো
৪৪. মোর কিছু ধন আছে সংসারে
৪৫. যদি ইচ্ছা কর তবে কটাক্ষে হে নারী
৪৬. রোগীর শিয়রে রাত্রে একা ছিনু জাগি
৪৭. শূন্য ছিল মন
৪৮. সব ঠাঁই মোর ঘর আছে
৪৯. সাঙ্গ হয়েছে রণ
৫০. সে তো সে দিনের কথা, বাক্যহীন যবে
৫১. সেদিন কি তুমি এসেছিলে ওগো
৫২. হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা
৫৩. হে জনসমুদ্র, আমি ভাবিতেছি মনে
৫৪. হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ
৫৫. হে পথিক, কোন্‌খানে চলেছ কাহার পানে
৫৬. হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি
৫৭. হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে
৫৮. হে রাজন তুমি আমারে
৫৯. হে হিমাদ্রি, দেবতাত্মা, শৈলে শৈলে আজিও তোমার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন