২৭. বাহান্নটা কার্ড

হুমায়ূন আহমেদ

বাহান্নটা কার্ড বাহান্ন রকম।

দর্শকরা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করবেন। তারপর ফিরিয়ে দেবেন। ম্যাজিশিয়ানকে। ম্যাজিশিয়ানের হাতে নয়, টেবিলে রাখা একটি চারকোণা বাক্সে। ম্যাজিশিয়ান দূর থেকে মন্ত্র পড়বেন। ম্যাজিক ওয়াণ্ড শূন্যে দোলাবেন, ওমনি বাহান্নটি তাস হয়ে যাবে বাহান্নটি সাহেব। খেলার আসল মজাটা হচ্ছে ম্যাজিশিয়ান এক বারও হাত দিয়ে তাস ছেবেন না। তিনি দাঁড়িয়ে থাকবেন। দূরে। কাজেই দর্শকরা এক বারও ভাববে না। এর মধ্যে হাতসাফাইয়ের কিছু আছে। অসাধারণ একটি খেলা, তবে পুরোপুরি যান্ত্রিক। ম্যাজিশিয়ানের করবার কিছু নেই। যা করবার স্প্রিং লাগানো কাঠের বাক্সটাই করবে। তাসের প্যাকেট রাখামাত্র তা চলে যাবে লুকানো একটি খোপে। উপরে উঠে আসবে আগে থেকে রাখা এক প্যাকেট তাস। তাসের বদলে অন্য কিছুও উঠে আসতে পারে। একটি ডিম উঠে আসতে পারে। ছোট্ট চড়ুইছোনা উঠে আসতে পারে। কিন্তু তা করা ঠিক হবে না। তাহলে দর্শকরা ভাববে কাঠের বাক্সেই কিছু একটা আছে। তখন তারা বাক্স পরীক্ষা করতে চাইবে। তাসের বদলে যদি তাস আসে তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। দর্শকরা ভাববে গণ্ডগোলটি তাসে। তারা ব্যস্ত থাকবে তাস পরীক্ষায়। ম্যাজিক হচ্ছে মনস্তত্ত্বের খেলা।

আনিস স্প্রিং-দেওয়া বাক্সটি নিজেই বানিয়েছে, কিন্তু ঠিকমতো কাজ করছে না। ডালা নেমে আসার সময় ঝাপ্ত করে শব্দ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সব সময় নামছেও না। স্প্রিংটি আরো শক্ত করে সেই ত্রুটি দূর করা যায়, কিন্তু তাতে ঝাপ্‌ শব্দ আরো বেড়ে যায়। এই মুহূর্তে সেই শব্দ-সমস্যার কোনো সমাধান মনে আসছে না।

শাহানা অনেকক্ষণ থেকেই ছাদে হাঁটছে। আনিসকে লক্ষ করছে। কিন্তু আনিস এক বারও তাকাচ্ছে না। কেউ এক জন যে ছাদে আছে, এই বোধাটুকুও সম্ভবত তার নেই। শাহানা দরজার প্লাশে এসে দাঁড়াল। হালকা গলায় ডাকল, আনিস ভাই।

আনিস অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার, অসময়ে?

অসময়ে মানে? আপনার এখানে কি পঞ্জিকা দেখে আসতে হবে?

না, তা হবে না। ভেতরে আসবে?

আসতে বললে হয়তো আসব। আগে বলুন।

আস। ভেতরে আস।

আপনি বাক্স হাতে নিয়ে কী করছেন? ধ্যান করছেন নাকি? অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছি। এক সারা দেখি বিড়বিড় করে কথা বলছেন। কার সঙ্গে কথা বলছেন? বাক্সটার সঙ্গে?

দাঁড়াও, তোমাকে ব্যাপারটা বলি! এই বাক্সটাকে বলে টু-ওয়ে বক্স। দুটো কম্পার্টমেন্ট আছে। একটা দেখা যায়, অন্যটা দেখা যায় না!

আনিস দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। স্প্রীংটা কীভাবে কাজ করে সেটা দেখাল। বর্তমানে কী সমস্যা হচ্ছে, সেটা বোঝাতে চেষ্টা করল। শাহানা গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছে। যেন সব কিছু পরিষ্কার বুঝতে পারছে! আনিস বলল, কত সহজ টেকনিকে কেমন চমৎকার একটা কৌশল, দেখলে?

হ্যাঁ, দেখলাম। আপনি কথা বলার সময় আমি একটা কথাও বলি নি, চুপ করে শুনেছি। এখন আমি কিছুক্ষণ কথা বলব, আপনি চুপ করে শুনবেন। আমার কথা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত মুখ খুলবেন না। হাঁ ই কিছুই বলবেন না।

আনিস অবাক হয়ে তাকাল। শাহানার চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখ রক্তলাভ। গলার স্বর গাঢ়। ব্যাপারটা কী!

আনিসভাই।

বল।

শুক্রবারে আমার বিয়ে, আপনি তো জানেন। আপনাকে কার্ড দেওয়া হয়েছে না?

হয়েছে।

এখন আপনি যদি মনে করেন। আপনার সাহস আছে, তাহলে আমি আপনার সঙ্গে অন্য কোথাও চলে যেতে পারি। কোর্টে কীভাবে নাকি বিয়ে করে। আমি তো কিছু জানি না, আপনিই ব্যবস্থা করবেন। আমার কাছে চারশ টাকা আছে।

আনিস হতভম্ব হয়ে গেল। কী বলছে শাহানা! সুস্থ মাথায় বলছে, না। অন্য কিছু?

আনিস ভাই, আমি একটা স্যুটকেস গুছিয়ে রেখেছি। আপনি আপনার দরকারী জিনিসগুলি গুছিয়ে নিন।

এসব তমি কী বলছ শাহানা!

আপনি কি চান না। আমি সারা জীবন আপনার সঙ্গে থাকি?

চাইলেই কি সব হয়? আমি তোমাকে নিয়ে যাব কোথায়? কী খাওয়াব তোমাকে?

শাহানা উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, আনিস ভাই, আমি যাচ্ছি।

শাহানা শোন, একটা কথা শোন!

শাহানা দাঁড়াল না। সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নেমে গেল। আনিস সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ঘরে বসে রইল। সন্ধ্যা মেলাবার পর নিচে নেমে এল। বারান্দায় নীল কী যেন করছে। আনিসকে দেখেই বলল, তোমার কি শরীর খারাপ নাকি আনিস?

জ্বি না।

চোখ মুখ বসে গিয়েছে।

মনটা ভালো নেই ভাবী। বারান্দায় কী করছেন?

কিছু করছি না। তুমি আমাকে দুটো মোমবাতি এনে দিতে পারবে? আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই।

আনিস মোমবাতি আনতে গেল। মোমবাতি এনে দেখল, ইলেকট্রিসিটি এসে গেছে। সমস্ত বাড়ি আলোয় আলোয় ঝলমল করছে। একটি রিকশায় করে কারা যেন এসেছে, সম্ভবত নীলু ভাবীয় মা। বিয়ে বাড়ির লোকজন আসতে শুরু করেছে। করাই তো উচিত। আনিস মন্থর পায়ে দোতলায় উঠে এল।

সকল অধ্যায়

১. ০১. নীলুর কেমন যেন লাগতে লাগল
২. ০২. বাবু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে
৩. ০৩. পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জির মধ্যে
৪. ০৪. শাহানার স্যার
৫. ০৫. রফিকের মনে ক্ষীণ আশা
৬. ০৬. কেনাকাটা করতে নীলু
৭. ০৭. বুধবারটা রফিকের জন্যে খুব লাকি
৮. ০৮. টুনির বয়স এখন ন মাস
৯. ০৯. এয়ারপোর্টে সাব্বিরকে রিসিভ
১০. ১০. মনোয়ারার গাল ফুলে
১১. ১১. কবির সাহেব
১২. ১২. দুপুরবেলা পিওন
১৩. ১৩. মনোয়ারা গম্ভীর মুখে বললেন
১৪. ১৪. রহমান সাহেব খেতে এসে দেখেন
১৫. ১৫. সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল
১৬. ১৬. একটা সই লাগবে
১৭. ১৭. শফিক অফিসে এসে শুনল
১৮. ১৮. বৈশাখ মাস
১৯. ১৯. নীলু খুব লজ্জিত
২০. ২০. দীর্ঘদিন পর উত্তেজনা
২১. ২১. তিন লাইনের একটা বিজ্ঞাপন
২২. ২২. শারমিনের গায়ে-হলুদ
২৩. ২৩. রফিক বিয়ে করেছে
২৪. ২৪. একটা অদ্ভুত কাণ্ড
২৫. ২৫. কবির মাস্টারের শরীর
২৬. ২৬. গায়ে হলুদের দিন-তারিখ
২৭. ২৭. বাহান্নটা কার্ড
২৮. ২৮. শাহানার বিয়ে হয়ে গেল
২৯. ২৯. বিয়ের প্রথম কিছুদিন
৩০. ৩০. টলম্যান শফিককে ডেকে পাঠিয়েছে
৩১. ৩১. প্রথম প্লেনে চড়া
৩২. ৩২. লম্বা একটা মানুষ
৩৩. ৩৩. বায়োডাটা দিয়ে চাকরির দরখাস্ত
৩৪. ৩৪. সাত দিন হাসপাতালে
৩৫. ৩৫. কবির মাস্টারের ঘুম
৩৬. ৩৬. আজ শাহানা এসেছে
৩৭. ৩৭. মাতাল অবস্থায়
৩৮. ৩৮. কবির মামা বাড়ি ফিরে এসেছেন
৩৯. ৩৯. কবির মাস্টারের মৃত্যু
৪০. ৪০. নীলু হা করে তাকিয়ে আছে
৪১. ৪১. নীলগঞ্জ থেকে বাবলুর একটা চিঠি
৪২. ৪২. আনিস গিয়েছিল দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে
৪৩. ৪৩. শারমিন বিকেলে বাগানে হাঁটছিল
৪৪. ৪৪. কল্যাণীয়াসু নীলু
৪৫. ৪৫. নিমের পাতা তিতা তিতা
৪৬. ৪৬. নীলুরা ঢাকায় পৌঁছাল
৪৭. ৪৭. ডাক্তার সাহেবের চেহারা
৪৮. ৪৮. কিছু কিছু গল্প আছে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন