মহাশ্বেতা দেবী
স্কুল থেকে ফিরছিলাম আমাদের বিখ্যাত কাকুর বিখ্যাত অটোয় চেপে। অটোটা দেখতে শুনতে তেমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তিনদিন পর পর সেই যে ধ্যানে বসবে, তার ধ্যান ভেঙে উঠতে অনেকদিন লেগে যাবে। সেই কদিন কাকু আসবে রিকশা নিয়ে। সেই রিকশায় দুজনের জায়গায় ছ’জন বসে কোনরকমে ঝুলতে ঝুলতে যেতে হবে স্কুল।
সেদিন অবশ্য অটো বাবাজির মন মেজাজ ভালোই ছিল। টানা চারদিন খারাপ না হয়ে কাজ করছে। অতএব আমরাও বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি। অটোর জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া ঢুকছে। কি সুখ ! দুজনকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। এবার আমার পালা। চেনা রাস্তা শুরু হয়ে গেছিল। সামনেই মোড়ের সেই লজেন্সের দোকান, তার বাঁ দিকেই গলি, গলিতে ডান দিকের সারির চতুর্থ বাড়িটাই আমাদের। একতলার বারান্দায় ঠাম্মা রোজ চেয়ারে বসে থাকে এই সময়টাতে।
লজেন্সের দোকানের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম। সামনে থরে থরে কৌটো, বয়াম। আর সেই সব কৌটো বয়াম ভর্তি না-জানি কতরকমের লজেন্স, চকোলেট, ললিপপ আরও কত কি! যেন এক গুপ্তধনের ভাণ্ডার। এই সব দোকান লুট না করে চোরেরা যে কেন গয়নার দোকানে যায়, বুঝি না।
অটোটা তখন ফুটপাথ ঘেঁষে চলছিল। চোখের সামনে থরে থরে সাজানো কতরকমের লজেন্সের মধ্যে তখনই প্রথম চোখে পড়ল জিনিসটা। প্রথম সারিতেই কৌটোটা সাজিয়ে রেখেছিল দোকানদার। বেশ বড় কৌটো, তার ভেতরে ভর্তি গোলাপি গোলাপি কি যেন। দূর থেকে খুব ভাল বোঝা গেল না। খুব কিনতে ইচ্ছে হচ্ছিল জিনিসগুলো। অমন সুন্দর গোলাপি রঙের লজেন্স আমি আগে দেখিনি কখনও । টিভির সমস্ত বিজ্ঞাপন মনে করবার চেষ্টা করলাম। ওইরকম কোন লজেন্স বা চকোলেটের বিজ্ঞাপন ছিল কিনা। না, সেরকম কিছু মনে পড়লও না।
বাড়ি এসে গিয়েছিল ততক্ষণে। যথারীতি ঠাম্মা বসে ছিল বারান্দায়, হাতে পাঁজি। সারাদিন কীসের যে এত দিনক্ষণ ঠিক করে তা ভগবানই জানে। আমাকে দেখতেই পাঁজি বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। এবার খেতে বসা হবে।
খাওয়াদাওয়ার পরে প্রথমে ঠাম্মা জেদ করাতে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম অল্প কিছুক্ষণ ঠাম্মার কাছে। তারপর ঠিক যখন ঠাম্মার নাকটা ফুরফুর করে ডাকতে লাগল আর পেটটা তার তালে তালে উঠতে-নামতে লাগল তখন বুঝলাম সময় হয়েছে। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে সেদিন সারাটা দুপুর টিভি দেখেই কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু টিভি দেখে বিশেষ কোন ফল হল না। ওইরকম গোলাপি লজেন্সের কোন বিজ্ঞাপনই নেই।
বিকেলবেলায় যখন টিভি দেখে দেখে চোখ টনটন করছে তখন মনে হল দোকানে গিয়ে খোঁজ করলেই তো হয়। আমার মোড়ের দোকান অবধি একা একা যাওয়ার পারমিশান আছে। অতএব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। আমি ওই দোকানের রোজকার খদ্দের । দোকানদার আমায় খুব ভালো করেই চেনে। রোজ ঠাম্মার দেওয়া এক টাকা নিয়ে গিয়ে লজেন্স কিনি আমি। সেদিন আমাকে দেখে আমার পছন্দ মতন চিউইংগামের কৌটো খুলতে শুরু করে দিয়েছিল দোকানদার। আমি দোকানের কাছে যেতে যেতে বেরও করে ফেলেছিল চিউইংগাম। জিজ্ঞেস করল, “এটাই নেবে তো?”
আমি খুব ভাল করেই জানতাম যে একটাকায় ওই সুন্দর দেখতে গোলাপি লজেন্সটা পাওয়া যাবে না অতএব এক টাকাটা বাড়িয়ে ধরলাম দোকানদারের সামনে। সে আমার হাত থেকে কয়েনটা নিয়ে ধরিয়ে দিল চিউইং গামটা। আমি সেটার খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরতে পুরতে সরে গেলাম একটু ডান দিকে। আমার সামনেই সেই গোলাপি লজেন্সে ভরা কাচের কৌটো। কাছ থেকে দেখতে আরও ভালো লাগছিল সেগুলোকে। আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম গোলাপি জিনিসগুলো আসলে লজেন্স নয়, তার থেকে বড় কিছু। গোলাপি রঙটা আসলে সেগুলোর বাইরের কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল ঠাম্মার কথা। ঠিক সময়ে না ফিরলে দুপুরে টিভি দেখার নালিশ করবে ঠিক মার কাছে, অতএব গোলাপি লজেন্সের চিন্তা সব দোকানে ফেলে রেখে বাড়ি ফিরতে হল আমায়।
পরদিন কিন্তু আমি ভালোভাবেই তৈরি হয়েছিলাম। স্কুল থেকে ফিরেই হাত-পা-মুখ ধুলাম, পরিস্কার করে খেলাম, দুপুরে ঘুমোলাম আর বিকেলে একটার বদলে দুখানা কলা খেলাম। দেখি এত সব করাতে ঠাম্মার মেজাজ বেশ ভাল। শুরু করলাম সাধাসাধি , যাতে আমার আজকের রেশন একটু বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে এক টাকার বদলে একটু বেশি করে টাকা-পয়সা দেওয়া হয় আমায়। ঠাম্মা এমনিতেই বেশ নরম ছিল আজ আমার ভাল ব্যবহারে খুশি, তাই বেশি সাধাসাধি করতে হল না আমাকে। ঠাম্মা তাঁর মানিব্যাগ থেকে বের করে দিল তিনটে এক টাকার কয়েন, মানে, আজ আমি এক টাকার বদলে পেলাম তিন টাকা। ভীষণ আনন্দ হল আমার। এক টাকায় পাওয়া না যাক সেই সুন্দর দেখতে গোলাপি লজেন্স, তিন টাকায় নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশে মেঘ। বেশ একটু থমথমে পরিবেশ। আমি যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি তখনি বৃষ্টির আগের সেই ভেজা ভেজা হাওয়া বইতে লাগল চারিদিকে। বেশ বুঝতে পারলাম আজ বৃষ্টি হবে। আমি দৌড় লাগালাম দোকানের দিকে। ফিরতে ফিরতে যদি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় তাহলে ঠাম্মা খুব একটা খুশি যে হবে না তা আমি ভালো করেই জানতাম। দৌড়তে লাগলাম জোরে জোরে। মোড়ের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে হাঁপিয়ে উঠলাম আমি। সামনেই লজেসের দোকান। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা কিনছে। আমি আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম।
বুক ঢিপ ঢিপ করছিল আমার। সেটা জোরে দৌড়নোর জন্য, না লজেসের চিন্তায়, সেটা বুঝলাম না। মনে হতে লাগল, লজেন্সটার দাম আসলে কত? যদি লজেন্সটার দাম তিন টাকার বেশি হয় তাহলে কী করব? দোকানদার যদি আমায় নিয়ে হাসে?
দোকানের কাছে যেতেই বুক ঢিপঢিপানিটা অনেক বেড়ে গেল। গোলাপি লজেন্সের কৌটোটা দেখা যাচ্ছিল। সত্যিই কি সুন্দর রঙটা , খুব খেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ভগবানের কাছে মনে মনে অনেকবার বললাম, হে ভগবান লজেন্সটার দাম যেন তিন টাকাই হয়। তিন টাকার বেশি যেন না হয়। আমি যেন লজেন্সটা কিনতে পারি। মনে মনে প্রার্থনা করতে করতে এগোতে লাগলাম দোকানের দিকে। গোলাপি লজেন্সের কৌটোটা আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। লজেন্সগুলোকে আরও স্পষ্ট করে দেখতে পারছিলাম আমি। আর বুক ঢিপঢিপানিটা বেড়েই চলেছিল। ভগবানের কাছে আরও বেশি বেশি প্রার্থনা করছিলাম, হে ভগবান লজেন্সটা যেন তিন টাকা দিয়েই কিনতে পারি।
দোকানদার আমাকে দেখে রোজকার মত হাসি হাসি মুখ করে চিউইং গামের কোটো খুলতে শুরু করেছিল। কাছে যেতে আবার আগের দিনের মতন জিজ্ঞেস করলো, ‘কি, এটাই নেবে তো?’
আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, ‘না, আজ আমায় ওইটা দাও।’ বলে আঙুল দিয়ে তাক করলাম ওই গোলাপী লজেসের কৌটোটার দিকে।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিল। বড় বড় দুয়েকটা ফোঁটা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল। দোকানদার একবার আমায় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, ‘ওইটা খাবে? কিন্তু ওটার দাম যে দশ টাকা। আছে তোমার কাছে?’ হঠাৎ করে বুক ঢিপঢিপানিটা কমে গেল। হতাশা ছেয়ে গেল আমার মনে। দ-শ-টা-কা! সে তো বাবা-মা আমায় কখনও ধরতেই দেয় না। দশ টাকা দাম লজেন্সটার! তাকিয়ে দেখলাম ফের কৌটোটার দিকে। হঠাৎ করে যেন কৌটোটা খুব উঁচু বলে মনে হল। খুব দুঃখ হচ্ছিল।
সেদিন বৃষ্টি মাথায় কোনরকমে তিনটে চিউইং গাম হাতের মুঠোয় করে দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। একদমই যে কাঁদিনি, সেটা বলব না। একদম ভিজে গেছিলাম বৃষ্টিতে। সেদিন রাতে বাবা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরল। হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “দেখ তো এটা কী? আমার এক বন্ধু দিল তোকে দেয়ার জন্য। আমি তো প্যাকেট খুলেই অবাক। গোলাপি গোলাপি ওটা কি? সেই লজেন্সটা না? ভীষণ আনন্দ হল। শেষ পর্যন্ত লজেন্সটা আমি পেয়েই গেলাম।
লজেন্সগুলো খেতে মোটেই ভালো লাগেনি আমার। অতিরিক্ত মিষ্টি, তাছাড়া খোলসের ভেতরের রঙটাও মোটেই তেমন কিছু সুন্দর নয়। আমার বেশ হতাশই লাগল, মনে হল, না খেলেই ভালো হত, মুখের স্বাদটাও খারাপ হয়ে গেল। লজেন্সগুলো তারপরে বেশ কয়েকদিন বলতে গেলে পড়েই ছিল। শেষ পর্যন্ত মা সেগুলো আমাদের কাজের মাসিকে তার বাচ্চাদের দেয়ার জন্য দিয়ে দিল।
মোড়ের দোকানের দোকানদার বেশ আশায় আশায় ছিল যে আমি ওই লজেন্সটা কিনতে আসব। পরের দিন আমায় দোকানের দিকে আসতে দেখে বেশ হাসি হাসি মুখেই খুলতে লাগল গোলাপি লজেন্সের কোটোটা। আমি গিয়ে তার দিকে এক টাকার কয়েনটা বাড়িয়ে ধরে বললাম, চিউইং গাম দাও না, একটা। দোকানদারের হাসিটা কেমন যেন মিলিয়ে গেল। সে গোলাপি লজেন্সের কোটো বন্ধ করে চিউইং গামের কৌটোটা খুলতে লাগল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন