অভিরামায়ণ – ১


বছর বিশ আগে একদিন সকালে,
আগরতলার কাছে ছোটো এক গাঁয়ে,
শক্ত শরীরটা তার জড়িয়ে কম্বলে,
অভিরাম হাঁটছিল জুতা ছাড়া পায়ে;
একলাই হাঁটছিল এক্কেবারে একা,
হাত পেট খালি তার মাথা ভরা ভাবনা,
ছাত্রদের হোস্টেলে কাজটা ছিল পাকা,
আজ কিন্তু বলে দিল কাজটা হবে না।
অভিরাম জানে না এখন কী করবে,
বাড়ি যে ফিরে যাবে বাড়ি কি আছে তার,
দু-মুঠো খেতে দিতে কাকে গিয়ে বলবে,
কে দেবে খেতে তাকে যার নেই রোজগার।
ভালোবাসা-টাসা গরিবদের থাকে না,
পেটে আগুন জ্বললে প্রেম হয় কান্না।

অভিরাম জানে না পরিচয় কী তার,
একটা মা যে ছিল আবছা আসে মনে
পাড়াপড়শি বলেছে নামটা বাবার,
জীবন কাটছে তার এখানে-সেখানে।
ডুকলী আসার আগে চড়িলামে ছিল,
তরণীপিসিদের বাড়িতেই থাকত,
তরণীপিসি তাকে স্কুলে পাঠিয়েছিল,
ইস্কুলে বসেই সে পড়া-লেখা করত।
কপাল এমন তার পিসি গেল মরে,
রামুদাদা বই-খাতা ছুড়ে দিল ফেলে,
অভিরাম শুতে পেল গোয়লের ঘরে,
দা-কুড়াল পেল সে বইয়ের বদলে।
ভগবান নিল যদি মা-বাবা ও পিসি,
রামু দিল দা-কুড়াল অভি তাতে খুশি।

জঙ্গলে লাকড়ি কাটা বাঁকে করে আনা,
চড়িলাম বাজারে লাকড়িগুলো বেচা,
নিত্যদিন একপথে করা আনাগোনা,
নিত্যদিন এক কাজ এক মেলামেশা।
অভিরাম ছিল ভালোই সেই সময়,
নিত্যকার রোজগার গোটা পাঁচ টাকা,
যদি কোনোদিন টাকা কিছু কম হয়,
রামুর বউয়ের তবে কথা বাঁকা বাঁকা।
পাঁচ টাকা রোজগারে দু-টাকা খায়,
দু-টাকায় গোয়ালে দিব্বি পায় শুতে,
এক টাকা বাকি থাকে যে দেখতে পায়,
সকাল-সন্ধ্যার গালি আসুক গুণতে।
অভি তো ছিল ভালো থালি গালি গোয়ালে,
বুদ্ধির দোষেই অভি কাজটা খোয়ালে।

‘বুদ্ধির দোষে’ বলাটা ভাই ঠিক হল?
অভিরামের তো অনেক কিছুই ছিল না,
মা-বাবা গাঁ-ঘর যা-কিছু তোমরা বলো,
অভিরামের আগে ছিল পরে ছিল না।
কিন্তু বুদ্ধিটা এই অভিরামের ঘটে,
গোড়া থেকেই দেননি ভুলো সৃষ্টিকর্তা,
খুব এক মারাত্মক ভুল নয় বটে,
আর এটা খুব নতুনও নয় বার্তা।
এমন ভুল তিনি হামেশাই করেন,
সংসারে বহু মাথাই ফল মাকাল,
ওই মাথারা বাপের নামে সব তরেণ,
তাদের বাক্যির তোড়ে সকলে নাকাল।
বাপ আর টাকা থাকলে বুদ্ধি অধিক,
থাকাটা জানবে বিপজ্জনক, বেঠিক।

কিন্তু অভিরামের সব ঘরে তো শূন্যি,
বুদ্ধির ঘরটা নেই, মাথাটা নিরেট,
সুতরাং তার সব কৃতকর্মের জন্যি,
বুদ্ধির কোনো দোষ নেই দায়ী পেট।
খেতে খেতে যদি সে কোনো একদিন
রামুর বউয়ের শাড়ি ধরে টান দিল,
আর একটু ভাত আমার পাতে দিন,
এই কথাটাই সে বলতে চেয়েছিল।
কিন্তু রামুর বউ অ্যাসা চীৎকার দিলে,
অর্ধবস্ত্র ভূমে আঁচল অভির হাতে,
দৌড়ে এসে পড়শিরা সব দেখলে,
কিল চড় বৃষ্টি হল অভির পিঠেতে।
ভাতের জন্য ধরলে আঁচল এই হয়,
অন্য কিছু হলে তো লোকে মশকরা কয়।

এতে অভির সাঙ্গ হল কান্ড চড়িলাম,
তবু তো রামু তখন ঘরে ছিল না রে,
থাকলে কি হত তা যদি জানতাম,
বলতাম না কিন্তু আমি ভাই যারে তারে,
রামু এসে বউকে যদি বেদম মেরে থাকে,
অভি ছুঁলেই দোষ বুধনা কেন আসে,
গালি যদি দিয়ে থাকে রামু বউ-র মাকে,
আমি এসে বলব না কথা সর্বনেশে।
রামুর বউয়ের কান্ডাকান্ড সকলে জানে,
কিন্তু তার ঠোঁট দু-খানা ক্ষুর হেন ধার,
বুধনার কথা সবে বলে কানে কানে,
রামুর হাতে খায় বেটি কত না মার।
তবে বউ সোয়ামির জুতা শাশুড়ি বলে,
অহরহ পায়ে থাকে কাদায় বগলে।

তবে এসব শুধু চড়িলামেই নয়,
এসব ঘটনা সর্বত্রই ঘটে থাকে,
এইসব ঘটে ভাই সকল সময়,
ভালো যখন লেগেই যায় যার যাকে,
বৃথা তখন নিয়ম নীতি রীতি যত;
বুধনা যদি আসেই রামুর বউ মতি,
হেসে-খেলে কয় কথা তার সাথে কত,
এসব কিন্তু সহ্য করে না তার পতি।
কেই বা করে কেই বা পারে বলুন তো,
রামু থেকে রামচন্দ্র সব এককাট্টা,
মতির বেলায় উদোম প্রহার যত্তো,
সীতা দেবীর ভাগ্যে জোটে অগ্নিপরীক্ষা।
সত্য হোক মিথ্যা হোক সন্দ যদি হল,
সব সমান তবে রামু রাম ওথেলো।

দেখুন কান্ডটা, আমার এমনি হয়,
বলছিলাম আমি অভিরামের কথা,
আপনারাও ভাবছেন কী কথা কয়,
কোথা গেল অভিরাম বলছে কী যা তা।
বলুন, তবে একটু ভেবে বলবেন,
আপনাদের একটা কথা বলবই,
সোজা পথে চলাটা সকলে জানবেন,
একেবারেই কাজটা তত সোজা নয়।
যারা বাজারে যেতে পথে লাইব্রেরি যায়,
রামায়ণ কিনতে গিয়ে কিনে লোলিটা,
তারাও জানবেন চালের ভাত খায়,
তারাও আমাদেরই বন্ধু মিত্র ভ্রাতা।
তবে হ্যাঁ গালি দিলে দুর্বলকেই দিন,
সবলে ক্ষমা করা সর্বার্থে সমীচীন।

যাকগে, পাড়ার লোকের ঠ্যাঙানি খেয়ে,
অভিরাম এসেছিল ওই ডুকলী গ্রামে,
কেমন করে সেকথা বলব কী দিয়ে,
তার আসার কথা কেই বা আজ জানে।
অভিরামের নিজেরই কিছু নেই মনে,
জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকায়,
বুদ্ধি নেই ঘটে যার সে কিই বা জানে,
অসহায় চোখ দুটো মাথাটা ঝাঁকায়।
রবির মা এসে তবু দুটো কথা বলে,
অভিরাম শোনে আর একটুকু হাসে,
রবির মার কথায় অভিরাম চলে,
রবির তো মা নয় অভিরামের মা সে।
খোদার সংসার গো চমৎকার আহা,
সবার জুটিয়ে দেয় যার চাই যাহা।
১০

এই যে রবির মা উনত্রিশে অনূঢ়া,
কবে কোন কৈশোরে রবি তারে দেখেছিল,
উথাল-পাথাল বুকে পাগলের পারা,
কবে কোন দুপুরে কী কথা বলেছিল।
মেয়ে যখন মাঠে যেত রবি পিছনে,
মেয়ে যখন ঘাটে রবি গাছতলায়,
মেয়ে যখন ঘুমায় রবি আনমনে,
ঘাটে বসে শাপলার ডগাটা চিবায়।
কিন্তু বৃন্দাবন তো ডুকলীতে হয় না,
গাঁয়ের বিবেক হঠাৎ উঠল জেগে,
রবিকে ধরে ডাকাল তো মেয়েটাকে মা,
সেইদিন রাত্তিরেই রবি গেল ভেগে।
‘গীতার মেয়ের নাম কী’ এই প্রশ্নটা,
যে করে সে নয়কো একেবারে বোকাটা।
১১

সেই থেকে সে ‘রবির মা,’ নাম হারিয়ে,
ডুকলী গাঁয়ের স্বনিযুক্ত সেবাদাসী,
ভন ভন ঘুরছেই দুটো পা চালিয়ে,
বক বকম কথা কিন্তু মুখেতে হাসি।
পোয়াতির বাচ্চা হবে ধাই তো আসেনি,
বিয়েবাড়ি বরের বাপ ঝগড়া করে,
মাঠে জমির জল এখনো তো নামেনি,
গাঁও প্রধান ব্যাটা এখনো যদি ফেরে।
সব খোঁজ রাখে রবির মা একা একা
সবাই ডাকে তারে সবার দরকারে,
কিন্তু না ডাকলেও ঘরে বসে থাকা,
লিখে তো দেননি বিধি রবির মায়েরে।
অপকারীর উপকার যে জনে করে,
তার নাম রবির মা, বলো নবকুমারে।
১২

রবির মা-ই অভিরামকে ঘাটে দেখে,
পড়ে আছে অচৈতন্য কাদা-জলে ভিজে,
মড়া না জ্যান্ত জিজ্ঞেস করবে সে কাকে,
বুকে কান দিয়ে পরখ করে সে নিজে।
ডাকাডাকি হাঁকাহাকি তার পরে কল্লো,
মাথা ধরে ঝাঁকাঝাঁকি অনেকক্ষণ করে,
হাত ধরে টেনেটুনে মড়াটারে তুল্লো,
কোনোমতে ধরে ধরে নিয়ে গেল ঘরে।
ডুকলির গুণীজনে ভালো চোখে দেখেনি,
কোনো কিছু কথা তবে বলেনিকো কেউ,
এমনিতে রবির মা একটা সর্দারনি,
হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবে তুমি যেই হউ।
ডুকলীর কর্তারা অন্যদেরই মতো,
নরমের যম তারা শক্তের তো ভক্ত।
১৩

সেই থেকে অভি রবির মায়ের প্রজা,
ওর ঘরেই থাকে খেতে দিলেই খায়,
সারাদিন কাজ তার চাকরিটা খোঁজা,
আর শোনা দিলে গালি রবির ওই মায়।
রোজই বেরোয় সকালে ফেরে সন্ধ্যায়,
রোজই মুখটা থাকে অভির শুকনো,
রোজই অভ্যর্থনা হয় কাংস্য গলায়,
রোজই একবুলি তার অতি পুরানো।
ধপ করে সামনে পড়ে একঘটি জল,
ঝনাৎ করে এসে পড়ে ভাত একথালা,
বাক্যবৃষ্টি হতে থাকে সাথে অনর্গল,
তার মধ্যেই বসে বসে পিন্ডিটা গেলা।
উটে যখন কাঁটা খায় রক্ত ঝরে মুখে,
চক্ষু তার মুদে আসে বেদনার সুখে।
১৪

রবির মা ছয়ত্রিশ অভির ছাব্বিশ,
রবির মা পৃথুলা অভিরাম মাঝারি,
স্ফীতোদরা মহিলা পুরুষটি মহিষ,
আবলুশ অভির গা চুলটা বাহারি।
রবির মায়ের মুখ চন্দ্র হেন নয়,
নাক চোখ তার কালে সুন্দরই ছিল,
তাম্বুল রাগ ওষ্ঠে অলক্ত রাগ হয়,
ফুলে ওঠা পেশিগুলি অভির নাচ্ছিল।
কিন্ত অভির চোখ দুটো নিরীহ স্থির,
অবোধ শিশুর মতো অসহায় দৃষ্টি,
আপন অক্ষমতায় নিজেই অস্থির,
প্রতিপদে ভাবে বুঝি হল অনাসৃষ্টি।
প্রকান্ড শরীর ও অসীম শক্তি নিয়ে,
ঐরাবত সতত থাকে অঙ্কুশ ভয়ে।
১৫

সেই থেকে অভিরাম ওখানেই আছে,
তবে রবির মাকে ‘রবির মা’ ডাকেনি,
সেই থেকে ওখানে ভাত ও গালি খাচ্ছে,
‘কামি’ হয়েছে ‘রবির মা’ কেমনে কী জানি।
ডুকলীর লোকেরা সহজেই মানেনি,
দুই-একজন মাথাচাড়া দিয়েছিল,
কিন্তু ঠেলাটা ঠিক সামলাতে পারেনি,
শ্যামলা তো কামিকে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘অভিরাম কে হয় গো রবির মা তোর’,
কামি বলেছিল ‘সব কি গো জানবার’?
জানলাম কিছু? দিলাম শান্তিকে গোর,
পেটের বাচ্চাটা তোর না তোর বাবার?
কচুর পাতা কঞ্চি দিয়ে বাচ্চারা কাটে,
কেয়া গাছের কাছে তারা যায় না মোটে।
১৬

শ্যামল ডুকলীর বড়দা সকলের,
বন্ধু তার তখনকার মন্ত্রীর ভাই,
সিক্স পর্যন্ত পড়েছে একত্রে বিমলের,
তার পর আলাদা পরিচয়ও নাই।
কিন্তু যেই সুরেশ হয়েই গেল মন্ত্রী,
রাতারাতি নেতা হল বিমল ভাই তার,
দিকে দিকে জুটে গেল কত ষড়যন্ত্রী,
শ্যামল বন্ধু তার এবে মনসবদার।
মা কথা শোনেনি চিহ্নে ভোট দেয়নি,
নতুন নেতা শ্যামল কেমনে তা সয়,
মাকে ধরে দিয়েছিল বেদম প্যাঁদানি,
অত বড়ো নেতা কি আর সকলে হয়।
সেই সময় ভাই বাপকে দিলে গালি,
অজপুত্র সকলে দিত রে হাততালি।
১৭

শ্যামলদের বাড়িতেই শান্তি থাকত,
তাদের বাড়িতেই গলায় দিল দড়ি,
অন্যের হলে পুলিশের হাত লাগত,
গলগলিয়ে বেরুত কড়ি কাঁড়ি কাঁড়ি।
কিন্তু শান্তি তো নেতার বাড়িতে মরেই,
এটা কি তেমন বড়ো একটা ঘটনা,
সেদিন শ্যামল ও বাবা ছিল না ঘরেই,
তাই হয়েছিল কিছু কানাকানি রটনা।
পরে রবির মা কামি ও ক-জনে মিলে,
শান্তিকে নামিয়ে আনে কড়িকাঠ থেকে,
তারাই রাখে ওকে নি:শঙ্ক ভূমিতলে,
সহগ ভ্রুণটা জঠরেই তার থাকে।
জীবনের নাটক সারাক্ষণ চলছে।
হাসিকান্না নাচাগানা কত কী বলছে।
১৮

তবুও শ্যামল তাকে সহজে ছাড়েনি,
গর্জিয়ে এসেছিল রবির মা-র ঘরে,
কিন্তু তাকে ভড়কাতে শ্যামল পারেনি,
তাকে ফিরিয়েছিল সে কঠিন উত্তরে।
‘দেখ রে শ্যামলবাবু তোর মা ভিক্ষা করে,
তুই চড়ে বেড়াস মন্ত্রীর সাদা গাড়ি,
বাপটা তোর সাদা জামা গায়ে পরে,
দালালি করে বেড়ায় যত বাড়ি বাড়ি।
আমরা তোকে কিছু কোনোদিন বলি না,
তোর বাপকে দেখলে মুখটা ফেরাই,
তোদের পথের কাঁটা হয়ে তো চলি না,
মাঁদার গাছে গা ঘসটাস কেন ভাই।’
সাপের হাসি বেদে বুঝে অন্য কেউ নয়,
বুনো ওলে বাঘা তেঁতুল একটুই লয়।
১৯ এসব অনেকদিন আগেকার কথা,
তখনও রবির মা বয়সে তরুণী,
তখনই রবির মা সোজা রাখে মাথা,
তখনও অভিরাম এখানে আসেনি।
তার পর হাওড়া দিয়ে কত জল গেল,
সুরেশের পার্টি তাদের গদি হারাল,
শ্যামলটা কিছুদিন আড়ালেতে ছিল,
তার পর স্বমর্যাদায় আবার দাঁড়াল।
এবার এক মন্ত্রী তার মেসোর ভাই,
অবশ্য দলটা তার একটু আলাদা,
কিন্তু ডুকলীতে তারও জায়গা চাই,
মেসোর ভাই তখন হয়ে গেল দাদা।
গণতন্ত্র মহাতন্ত্র সর্বতন্ত্র সার,
এ তন্ত্রের মন্ত্রে ভাই সব একাকার।

অধ্যায় ১ / ৬

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন