মন-আয়নায় ছবি

অর্পিতা সরকার

মন-আয়নায় ছবি

‘ওর বদলে যাওয়াটা নিশ্চয়ই তোমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না তন্ময়?’

ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তন্ময় বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কার চেঞ্জের কথা বলছ তুমি ঈশানী?’

ঈশানী বিরক্তির সুরে বলল, ‘তোমার মেয়ে ঝুমঝুমের কথা বলছি আমি৷’

তন্ময় হেসে বলল, ‘এটা তো কোয়াইট ন্যাচারাল, ঈশানী৷ ইউনিভার্সিটিতে গিয়েও যদি নিজের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন না আনতে পারে সেটা ওর ব্যর্থতা৷ আমার মেয়ে হয়ে ওর পার্সোনালিটি গ্রো করবে এই বয়েসে এটাই স্বাভাবিক৷’

ঈশানী চিন্তিত গলায় বলল, ‘আমিত্বের বাইরে একবার উঁকি দিয়ে দেখলে বুঝতে পারতে, ঝুমঝুমের সাজপোশাক থেকে শুরু করে কথা বলা, হাঁটার ধরনে অবধি একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়েছে৷ সেটা হয়েছে মাত্র পাঁচ মাসে৷ তুমি জানো, ওকে ঝুমঝুম বলে ডাকলে ও বিরক্ত হয়৷ ভ্রমর বলে ডাকতে বলে৷ এগুলো কেন হচ্ছে, বাবা হিসাবে খোঁজ নেওয়াটা তোমারও দায়িত্ব৷ তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ, আমিও একটা দায়িত্বশীল পোস্ট হোল্ড করি অফিসে৷ তাই সংসারের বিষয়টা শুধুই আমি সামলাব এটা ভাবাটা নিতান্ত স্বার্থপরের মতো ভাবনা হবে৷’

তন্ময় বলল, ‘এই তো ঈশানী, আমিত্বের দোরগোড়ায় তুমিও দাঁড়িয়ে আছ৷ শুধু আমাকে বেরিয়ে আসতে না বলে নিজেও একটু বেরিয়ে এসো৷ মেয়েটা আমার একার তো নয়৷ তুমি ওর মা, তাই অফিসের দায়িত্বপূর্ণ পদের সঙ্গে এই দায়িত্বটাও একটু সামলাও বরং৷’

আবারও ল্যাপটপে মনোনিবেশ করল তন্ময়৷ আগামীকাল ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে মিটিং আছে৷ আজকের রাতটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ওর কাছে৷ এখন মেয়ের চলাফেরার পরিবর্তন নিয়ে ভাবার সময় নেই৷ তা ছাড়া ঝুমঝুম বড়ো হয়েছে, জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক৷ ঈশানী যদি ভেবে থাকে, ঝুমঝুম আগের মতোই ওর হাতের মুঠোয় মধ্যে থাকবে সেটা ভুল ধারণা৷ মুঠো আলগা করতে শেখেনি ঈশানী৷ সবকিছুর ওপরে নিজের কন্ট্রোল রাখতে বরাবর পছন্দ করে ঈশানী৷ তন্ময় নিজের অফিস, প্রজেক্ট নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকায় সংসারের কন্ট্রোল অনায়াসে নিয়েছে ঈশানী৷ দায়িত্ব থেকে ছাড়া পেয়েছে বলেই হয়তো তন্ময়ও এ ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে স্বচ্ছন্দে ৷ কিন্তু ঝুমঝুমের যে এই অতিশাসন পছন্দ হবে না সেটা তন্ময় আগেই জানত৷ ঈশানীর একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে, প্রতিটা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত স্পেসে প্রবেশ করে নিজের মতামত দেওয়া৷ তন্ময় এই নিয়ে বহুবার বিরক্তি প্রকাশ করেছে৷ কিন্তু এটাই নাকি পরিবারের মানুষদের প্রতি ঈশানীর কনসার্ন৷

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই তন্ময় অনুভব করল, ঈশানী দ্রুতপায়ে ঝুমঝুমের ঘরের দিকে গেল৷

ঝড়ের পূর্বাভাস পেল তন্ময়৷ ঈশানীর জেরার মুখে পড়ে ঝুমঝুম যে এত রাতে চিৎকার করবে সেটাই স্বাভাবিক৷ মেয়ে বড়ো হচ্ছে, তার আচার-ব্যবহারে বদল আসবে এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে কেন যে ঈশানী সিনক্রিয়েট করতে চাইছে, কে জানে!

দরজাটা সামান্য ফাঁক করে দেখছে ঈশানী৷ ঝুমঝুম পড়ার টেবিলে বসে আছে৷ সামনে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে৷ কিন্তু ঝুমঝুমের মুখটা বইয়ের দিকে নেই৷ দেওয়ালের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে৷ ইদানীং মেয়েটা যেন বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে৷ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলে না৷ যদিও ঈশানী আর তন্ময় দুজনেই সার্ভিস করায় ঝুমঝুমকে বাবা-মা হিসাবে সময় কমই দিয়েছে ওরা৷ তবুও ডিনার টেবিলে বসে ঈশানী চেষ্টা করত ঝুমঝুমের সারাদিনের সবকিছু শুনে নেওয়ার৷ ঝুমঝুমও বকবক করে সব বলত৷ ইদানীং কোনোমতে ডিনার সেরে নিজের ঘরে চলে আসছে ও৷ মেয়ের এই অদ্ভুত বদলটা কেন যে তন্ময়ের চোখে পড়ল না, কে জানে! ঈশানী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে৷ অফিসের দায়িত্ব ওরও কিছু কম নেই৷ কিন্তু ও বাড়িটাকে অফিস বানিয়ে রাখেনি তন্ময়ের মতো৷ ঝুমঝুমকে ডেকে পরিষ্কার কথা বলবে ঈশানী? নাকি আর কদিন অবজার্ভ করবে? ঝুমঝুম যদি বলতে না চায় ওর জীবনের ওঠা-পড়ার গল্পটা, তখন মা হিসাবে ঠিক কী করণীয় ওর!

ঈশানী দেখল, ঝুমঝুমের দু-চোখ বেয়ে আপনা-আপনি জল গড়িয়ে পড়ছে৷ লাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, মেয়েটা একলা বসে কাঁদছে৷ অথচ মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই৷ কান্নাটাকে যেন উপভোগ করছে ও৷ ঠিক কী হল মেয়ের! এই মুহূর্তে মেয়ের ঘরে ঢুকে ওকে প্রশ্ন করার সাহস পেল না ঈশানী৷ নিজের মেয়েটাকে যেন ভীষণ রকমের অপরিচিত লাগছে ওর৷ ধ্যানস্থ কোনো সন্ন্যাসীর ধ্যান ভাঙিয়ে দিলে যেমন অঘটন ঘটবে, এই মুহূর্তে ঝুমঝুমকে ডেকে ফেললেও যেন তেমনই অনিষ্ট ঘটে যাবে৷ ত্রস্তপায়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল ঈশানী৷ ড্রয়িং হলে দেখল, তন্ময় একই রকমভাবে সংসার থেকে পালিয়ে বাঁচতে ল্যাপটপে মুখ গুঁজেছে৷ ঈশানীর পায়ের শব্দেও সেদিকে তাকাল না৷ এটা তন্ময়ের ইচ্ছাকৃত, সেটা ঈশানী জানে৷ এত বছরের বিবাহিত জীবনে এটুকু চেনে তন্ময়কে৷ অফিস আর বাড়ি ব্যালেন্স করতে না-পারা ফেলিয়োর একটা মানুষ৷

নিজের ঘরে ঢুকেই ঝুমঝুমের বেস্ট ফ্রেন্ড পারমিতাকে ফোন করল ঈশানী৷ রিং বাজছে অন্য প্রান্তে৷ তন্ময় ঠিক না ও ঠিক, জানতেই হবে ওকে৷ শুধুই মেয়ে বড়ো হয়েছে বলে এই পরিবর্তন নাকি অন্য কিছু৷ বন্ধুদের চোখে কি কিছু পড়েছে? নাকি ঈশানীর ভ্রান্ত চিন্তা!

পারমিতা রিসিভ করেই বলল, ‘হ্যাঁ আন্টি, বলো৷’

পারমিতা বহুবার এসেছে এ বাড়িতে৷ তাই ঈশানীর সঙ্গে সম্পর্কও বেশ সহজ সরল৷ ঈশানী ভণিতা না করেই বলল, ‘হ্যাঁ রে, অরিত্রীর মধ্যে তোরা কোনো চেঞ্জ দেখেছিস?’

পারমিতা চুপ করে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য৷ তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘গত দু-মাস আমার সঙ্গে সেভাবে কথা বলে না অরিত্রী৷ আমি অনেকবার কথা বলার ট্রাই করেছি, আন্টি৷ কিন্তু ও চুপ করে থাকে৷ আমায় বলেছে, চুপ করে থাকতে ওর নাকি ভালো লাগছে৷ একাকিত্বের একটা অদ্ভুত উন্মাদনা আছে, ও আপাতত সেটা অনুভব করতে চায়৷ তাই আমরা যেন ওকে কেউ বিরক্ত না করি৷ আমি ভেবেছিলাম, তোমায় কল করব৷ কিন্তু বাড়ির কোনো কারণে অরিত্রী আপসেট কি না সেটাও বুঝতে পারিনি, তাই তোমায় কল করিনি৷ আসলে কী জানো আন্টি, অরিত্রী আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷ অন্যরা থাকলেও বেস্ট ফ্রেন্ড তো বার বার হয় না৷ তাই আমিও খুব একা হয়ে গেছি৷ আগে হলে অরিত্রীকে বকে, রাগ করে মানিয়ে নিতাম৷ কিন্তু এখনকার অরিত্রীকে তো আমি চিনিই না৷ ওর কাছে আমার অভিমানের কোনো মূল্য নেই, আন্টি৷’ কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল পারমিতা, ‘ও তো উৎসবের সঙ্গেও ইদানীং মেশে না৷’

ঈশানী বলল, ‘উৎসবটা কে?’

পারমিতা একটু ঢোঁক গিলে বলল, ‘আন্টি তোমার সময় হবে, তাহলে চলো, আমরা একটা ক্যাফেতে বসে কথা বলি৷’

সময়! ব্যস্ত ঈশানীর সব থেকে দুর্মূল্য জিনিস সময়৷ কিন্তু আপাতত ঝুমঝুমের এই পরিবর্তনের কারণ জানতে সময় তো বের করতেই হবে ওকে৷

ঈশানী বলল, ‘আগামীকাল বিকেলে বসি, চল৷ আমি আসলে দেরি করতে চাইছি না, পারমিতা৷ মেয়েটা এমন অদ্ভুত বিহেভ কেন করছে, বুঝতে পারছি না৷’

পারমিতা এককথায় রাজি, ‘আন্টি, তাহলে আমরা কফি উইথ আড্ডাতে বসি? তোমার অফিসের কাছে হবে৷ আর আমারও ওখান থেকে পিয়ানো ক্লাস কাছে৷ কথা সেরে আমি ক্লাসে বেরিয়ে যাব৷’

ঈশানী বলল, ‘হ্যাঁ তা-ই আয়৷’

* * *

‘হ্যালো উৎসবদা? আমি পারমিতা বলছি৷ অরিত্রীর মা মানে ঈশানী আন্টি আমার সঙ্গে আগামীকাল বসতে চাইছে৷ তুমি কি আসবে? মানে অরিত্রীর এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণটা ঠিক কী সেটাই আমরা বুঝতে চাইছি৷’

উৎসব চ্যাটার্জি মৃদু হেসে বলল, ‘তুমি এখনও বেশ সরল রয়ে গিয়েছ, পারমিতা৷ তাই এই পরিবর্তনকে নিয়ে ভাবছ৷ আসলে অরিত্রী ওর জীবন থেকে আমাদের ছেঁটে দিতে চাইছে৷ তাই এমন একটা বিহেভ করছে যেন আমরা নিজেরাই সরে যাই ওর থেকে৷ আমরা বার বার প্রশ্ন করেছি, ও উত্তর দেয়নি৷ অপমানিত হয়ে সরে এসেছি৷ আমার দৃঢ় ধারণা, অরিত্রীর জীবনে অন্য কারো আগমন ঘটেছে৷ তাই ও পুরোনোদের বিদায় দিল নিঃশব্দে৷’

 পারমিতা বলল, ‘কিন্তু উৎসবদা, আন্টি বলছে, অরিত্রী নাকি বাড়িতেও এমনই আচরণ করছে৷ ওরাও কনফিউজড৷’

 উৎসব বলল, ‘পারমিতা, তোমরা ওর বন্ধু ছিলে৷ তাই এসব সমাধানে তোমরা যেতেই পারো৷ কিন্তু আমি ওর বন্ধু নই, আমি ওকে ভালোবাসি আজও৷ তাই ও যেভাবে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তারপর ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মানে নিজের সম্মানটুকুকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া৷ ভালোবাসার জন্য আমি তাতেও রাজি ছিলাম৷ কিন্তু অরিত্রী বলল, উৎসব, আমি ফিল করছি, আমাদের মধ্যে আর সেই সম্পর্কটা কোনোদিন গড়ে উঠবে না৷ তাই তুমি আমার জীবন থেকে সরে গেলেই খুশি হব৷ ওকে খুশি করতেই আমার সরে আসা৷’

পারমিতা দীর্ঘশ্বাসটা গোপন না করেই বলল, ‘তোমাদের সম্পর্কটা নিয়ে আমরা সবাই হিংসা করতাম৷ মনে হত মেড ফর ইচ আদার৷ কেন যে এমন করল অরিত্রী!’

 উৎসব হেসে বলল, ‘আর হিংসে করে লাভ নেই৷ তবে যদি কখনো অরিত্রী নিজে আমায় ডাকে, আমি নিশ্চয়ই যাব৷ কারণ ওকে ছাড়া আমার জীবনে অন্য কারো প্রবেশ হবে না বলেই মনে হয়৷’

পারমিতা বিষণ্ণস্বরে বলল, ‘রাখছি, উৎসবদা৷’

মনটা খারাপ লাগছে পারমিতার৷ সবকিছু মাত্র কয়েক মাসে কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল৷ অরিত্রীর সঙ্গে পারমিতার পরিচয়টা খানিকটা নাটকীয় ঢঙেই হয়েছিল৷ অরিত্রী ছিল বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের ছাত্রী৷ ক্লাস ফাইভ থেকে পড়েছে এই স্কুলেই৷ পারমিতা ভরতি হয়েছিল ইলেভেনে৷ নতুন স্কুলে মফসসল থেকে আসা মেয়েটাকে কেউই তেমন পাত্তা দিচ্ছিল না৷ সবাই দু-তিনজন করে বন্ধু নিয়ে দল বেঁধেই ছিল৷ শুধু শুধু নিজেদের দলে পারমিতাকে ঢোকাতে তারা নারাজ৷ প্রাইমারি স্কুলে চটজলদি বন্ধুত্ব হয়ে গেলেও উঁচু ক্লাসে সম্পূর্ণ অন্য স্কুলে এসে সেভাবে বন্ধুত্ব হয় না৷ পারমিতার নিজের পুরোনো স্কুলের কথা মনে পড়ছিল৷ কত বন্ধু ছিল ওর৷ কেন যে বাবা এই চন্দনপুরে এসে আচমকা ফ্ল্যাট কিনে বসল, কে জানে! ট্রান্সফারের চাকরির এই এক সমস্যা৷ আনমনা হয়ে ক্লাসের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল৷ নিজের মাঠে নিচু ক্লাসের মেয়েরা তখনও ঘোরাফেরা করছে৷ আজ প্রথম দিন স্কুলে৷ দশ মিনিটের মধ্যেই প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়বে৷ হঠাৎই কানের কাছে এসে কেউ একজন বলল, ‘এই স্কুলে নতুন বুঝি?’

পারমিতা দেখল, রীতিমতো সুন্দরী একটা মেয়ে ওর একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ নিজে সাধারণ দেখতে বলেই সুন্দরীদের প্রতি ওর একটা দুর্বলতা আছে৷ পারমিতার ধারণা, যাদের ঈশ্বর এত নিখুঁত করে গড়েন তাদের মধ্যে অহংকারটাও নিপুণভাবে প্রবেশ করিয়ে দেন৷ পারমিতার দেখা সব সুন্দরীই বেশ অহংকারী৷ এমনকী ওর ছোটোকাকিমা পর্যন্ত বেশ অহংকারী ছিল৷ ছোটোকাকিমা যখন সেজেগুজে কোথাও যেত, পারমিতা অপলক তাকিয়ে থাকত লুকিয়ে লুকিয়ে৷ কাকিমার হাঁটাচলার মধ্যেই একটা দম্ভ চোখে পড়ত৷ সেই কারণেই সুন্দরীদের প্রতি ওর আগ্রহ থাকলেও ও কখনো উপযাচক হয়ে সুন্দরীদের সঙ্গে কথা বলতে যায় না৷ অরিত্রী হেসে বলল, ‘তুমি নতুন ভরতি হয়েছ এই স্কুলে?’

পারমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ নতুন৷’

অরিত্রী ওর হাত ধরে টেনে বলল, ‘প্রেয়ারের আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ো না৷ রফিক স্যার দেখলে কপালে দুঃখ আছে৷ চলো প্রেয়ার লাইনে৷ বাই দ্য ওয়ে, আমি তোমাকে তুমি কেন বলছি? তোর নাম কী?’

পারমিতা হেসে বলছিল, ‘অবশ্যই তুই বলো৷’

অরিত্রী দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিল, ‘আমিও তোর শাশুড়ি নই৷ আমাকেও তুই বলবি পারমিতা৷ তোকে পারমিতাই বলছি৷ পারো বললেই আবার দেবদাস খুঁজতে হবে৷’

অরিত্রীর অমন স্বাভাবিক ব্যবহারে পারমিতাও খুব দ্রুত স্বাভাবিক হয়েছিল নতুন পরিবেশে গিয়ে৷ ক্লাসে ঢুকে বুঝেছিল, ক্লাসের অধিকাংশ মেয়েই অরিত্রীকে হিংসে করে৷ সেটা অরিত্রী ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল বা সুন্দরী বলে নয়, ওদের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থাও খুবই ভালো৷ মা, বাবা দুজনেই বড়ো সার্ভিস করে৷ এত গুণ থাকার পরেও যদি সতেরো বছরের যৌবনে পদার্পণ করা সহপাঠীরা ওকে হিংসে না করে তাহলে বুঝতে হবে, এতদিনের জানা সব অভিজ্ঞতা মিথ্যে৷ তবে মিথ্যে হয়েছিল বই কী, সুন্দরীমাত্রেই অহংকারী হয় এমন ধারণাটা ভেঙে দিচ্ছিল অরিত্রী একটু একটু করে৷ পারমিতাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘তুই অন্য স্কুল থেকে এসেছিস বলে আমায় হিংসা না করে বন্ধু হলি৷ জানিস, এখানে সবাই আমার সহপাঠী৷ কেউ বন্ধু নেই৷’

সেই থেকেই অরিত্রীর সবকিছুর ওপরেই পারমিতার একটা অদ্ভুত অধিকারবোধ জন্মে গিয়েছিল৷ অলিখিতভাবে একটা নিয়ম ছিল ওদের মধ্যে, ওরা দুজনের সব সিক্রেট শেয়ার করবে৷ চার বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের বিচ্ছেদে যে কষ্টটা হয়েছিল পারমিতার, সেটা নীলাদ্রির সঙ্গে ব্রেকআপেও হয়নি৷ পারমিতা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারে না, অরিত্রীর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা এভাবে শেষ হবে৷ চোখের সামনে সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটা কেমন যেন বদলে গেল৷ যে অরিত্রীর সবটুকু চেনে বলে গর্ব করত ও, সেই মেয়েটাই যেন ওর সব থেকে অপরিচিত হয়ে গেল৷ রাগ, অভিমান, কষ্ট সবকিছুকে ছাপিয়ে এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য৷ আন্টির ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই পারমিতা বুঝতে পারছে শুধু ওকে বা উৎসবদাকে সরিয়ে দেবার কারণে নয়, অন্য কারণে অরিত্রীর মধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে, যার কারণ ওর বাড়ির লোকও জানে না৷ পারমিতার কতবার মনে হয়েছে, ছুটে গিয়ে আগের মতো অরিত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলতে, ‘কেন এমন করছিস? কী হয়েছে তোর, আমাকেও বলবি না?’ কিন্তু অরিত্রীর ওই ভীষণ ঠান্ডা চাউনি আর শীতল ব্যবহার দেখে নিভে গেছে ওর সব উষ্ণতা৷ শুধু কষ্ট পেয়েছে৷ বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় নীল হয়েছে৷ বন্ধুরা বলেছে, ‘কী রে, অরিত্রী পাত্তা দেয় না তাই এসেছিস আমাদের কাছে?’

 বড্ড একলা হয়ে গেছে পারমিতা৷ তবুও চেষ্টা করেছে ডিপার্টমেন্টের সবার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে৷ কিন্তু অরিত্রীর সঙ্গে ওর যে বন্ডিং সেটা যেন আর কিছুতেই কারো সঙ্গেই গড়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ আন্টির ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই নিজেকে কেমন একটা অপরাধী মনে হচ্ছে পারমিতার৷ ওর বোধহয় আরেকটু খেয়াল রাখা উচিত ছিল৷ যখন প্রথম ওকে অরিত্রী বলেছিল, ‘পারমিতা, ঠাম্মা চলে যাওয়ার পর বড্ড একা লাগে রে বাড়িতে৷ মা, বাবা যেন দূরের নক্ষত্রের বাসিন্দা৷ নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত৷ আমার সবটুকু ঘিরে ছিল ঠাম্মা৷ ঠাম্মা চলে গেল, আমিও বড্ড নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম’—, তখনই পারমিতার উচিত ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে বলা, ‘আমি তো আছি তোর সঙ্গে৷’ বলা হয়নি৷ অরিত্রীর মনের কথাগুলো বুঝতে না-পারাটা ওর অক্ষমতা৷ ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ শব্দটার অপমান৷ অরিত্রী কিন্তু ঠিক বুঝেছিল ওকে, তাই তো ক্লাস টুয়েলভে যখন নীলাদ্রির সঙ্গে ওর ব্রেকআপ হয়ে যায় তখন দু-হাত দিয়ে ওকে আগলে রেখেছিল অরিত্রী৷ মুড অফ থাকার কারণে প্রায়ই পারমিতা খারাপ ব্যবহার করে ফেলত ওর সঙ্গে৷ কিন্তু অরিত্রী বুঝে নিত ওকে৷ নীলাদ্রি তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে৷ পারমিতা ক্লাস টুয়েলভে৷ আচমকা নীলাদ্রির ব্যবহার কেমন বদলে যেতে শুরু করল৷ ফোন করলে রিসিভ করে না৷ মিট করতে চাইলেও যেন ইচ্ছা নেই৷ পারমিতার কষ্ট হত৷ বুঝতে পারছিল ওদের সম্পর্কটা ভাঙনের মুখে৷ তবুও শেষ চেষ্টা করেছিল৷ নীলাদ্রিকে ডিরেক্ট জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি ঠিক কী চাও?’

নীলাদ্রি বলেছিল, ‘কী আবার চাইব? কলেজে আমার প্রচুর মেয়ে-বন্ধু আছে৷ তারা তো এভাবে জিজ্ঞাসা করে না কী চাই?’

কথাটা কানে লেগেছিল ওর৷ বন্ধু? পারমিতা নীলাদ্রির শুধুই বন্ধু? গত এক বছরে ওরা যে দুজন দুজনকে কয়েকশোবার ‘ভালোবাসি’ বলেছে সেগুলো শুধুই বন্ধুত্বের কারণে? পারমিতা বলেছিল, ‘তোমার কলেজের সব বন্ধুর সঙ্গে তুমি আমার তুলনা কোরো না৷ আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের নয়৷’

নীলাদ্রি বলেছিল, ‘এই মুহূর্তে অন্য কোনো সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে৷’

সূর্য-ডোবা বিকেলে ঝিলমিল পার্কের বেঞ্চে ওকে একা রেখে হনহন করে চলে গিয়েছিল নীলাদ্রি৷ একবারও পিছন ঘুরে তাকায়নি৷ পারমিতা ভেবেছিল, একবার অন্তত তাকাবে ওর দিকে, কিন্তু নীলাদ্রি চলে গিয়েছিল৷ সম্পর্কটা ঠিক কেন ভেঙেছিল, বুঝতে পারেনি ও৷ শুধু বুঝেছিল, ওর জীবনের অনেকটা খুশি কেউ যেন কেড়ে নিয়ে চলে গেল৷ ক্লাসে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকত৷ টিফিন টাইমেও মাঠে যেতে ইচ্ছে করত না৷ অরিত্রীকেও বলতে ইচ্ছে করেনি নীলাদ্রি তাকে কীভাবে অপমান করে চলে গিয়েছে৷ কিন্তু অরিত্রী বুঝেছিল, পারমিতা কষ্টে আছে৷ তাই আগলে রেখেছিল ওকে৷ ইচ্ছা করেই নীলাদ্রির কথা জিজ্ঞাসা করত না ওকে৷ এমনভাবে কথা বলত যেন নীলাদ্রি বলে কাউকে চিনতই না ওরা৷ অথচ ব্রেকআপের আগের দিনও অরিত্রী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পুজোয় কী রঙের স্কার্ট কিনবি? ওহ, তুই তো আবার নীল ছাড়া পোশাক কিনিস না৷ তোর নীলাদ্রির প্রিয় রং৷’

দুজনেই হেসেছিল৷ পড়াশোনার মাঝে নীলাদ্রিকে নিয়ে লেগপুল করত অরিত্রী৷ কিন্তু ঠিক যেদিন থেকে ওদের ব্রেকআপ হয়েছে সেদিন থেকে যেন ইচ্ছা করেই নীলাদ্রির নামটুকুও উচচারণ করেনি অরিত্রী৷ প্রায় দিন দশেক পরে পারমিতা অরিত্রীকে বলেছিল, ‘আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে, জানিস? কারণটা জানি না৷’

অরিত্রী বলেছিল, ‘কারণটা আমি জানি৷ খোঁজ নিয়ে দেখলাম নীলাদ্রি কলেজের একটা মেয়ের সঙ্গে এনগেজড৷ তাই পুরোনো সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গেল৷ কিন্তু পারমিতা, সামনেই আমাদের উচ্চমাধ্যমিক৷ তাই এসব ভাবার সময় নেই৷ তুই বরং ব্রেকআপের দুঃখকে বল, এগজামের পরে আসতে৷ তখন না হয় কেয়াদের ছাদে বসে আমরা দুজনে কাঁদব একটু৷ এখন এসব বাদ দে৷ তোর রেজাল্ট খারাপ হলে নীলাদ্রি ভাববে, দুঃখে তুই এতটাই কাতর হয়ে গেছিস যে রেজাল্ট খারাপ হল৷ তাই আপাতত দুঃখকে দূরে রাখ৷ আর শোন, কিছু মনে করিস না, নীলাদ্রির হেয়ার কাটিংটা আমার একেবারে পছন্দ ছিল না৷ তাই ও আপদ গেছে, ভালো হয়েছে৷’

পারমিতা কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেলেছিল ওর কথা বলার ধরন দেখে৷ অরিত্রী ফুঁ দিয়ে পারমিতার মন-খারাপির বাতাসটাকে সরিয়ে দিত ওর কাছ থেকে৷ পারমিতার মনে হত, নীলাদ্রি ওর প্রেমিক ছিল ঠিকই কিন্তু ওকে অনেকটা বেশি বোঝে অরিত্রী৷ সেই অরিত্রীর ক্রাইসিস টাইমে পারমিতা কিছুই করতে পারল না! শুধুই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল ওর কাছ থেকে! এটা ও একেবারেই ঠিক করেনি৷ অরিত্রী নীলাদ্রির প্রসঙ্গে বলেছিল, ‘পারমিতা, কেউ একজন কিছুটা সময় দিয়েছিল মাত্র৷ আমরা বোকা, ভালোবাসার কাঙাল৷ তাই সেটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছি৷ দুর্মূল্য সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছিলাম ওই ভালোবাসা নামক অনুভূতির সঙ্গে৷’

কিন্তু অরিত্রীর দেওয়া সময়টা শুধু যে সময় নয় সেটুকু বোকা হয়েও পারমিতা জানে৷ আর জানে বলেই ওই সম্পর্কটা ফিরে পেতে এতটা উৎসাহী ও৷

‘কী হল, ঘরে বসে আছিস কেন চুপচাপ? তোকে ডিনারে ডাকল বাবা তিনবার৷ চল, আমরা টেবিলে ওয়েট করছি৷’

মায়ের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে পারমিতা বলল, ‘মা, অরিত্রীর কোনো একটা সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম হয়েছে মনে হচ্ছে৷’

মা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘পারো প্লিজ৷ আর অরিত্রীর কথা উঠবে না ডিনার টেবিলে৷ অরিত্রীর আর তোর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবার পরে তোকে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমাদের যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিল৷ তাই ওই মেয়ের কী প্রবলেম হয়েছে জেনে আমাদের কোনো লাভ নেই৷ প্লিজ বাদ দাও অরিত্রীর প্রসঙ্গ৷’ পারমিতা সামলে নিল৷ মা-কে বলা যাবে না আন্টির সঙ্গে মিটের কথা৷ মা কিছুতেই যেতে দেবে না৷ আসলে এ বাড়ির লোকজন ওই একটা নাম এত শুনেছে পারমিতার মুখে যে অরিত্রী এ বাড়িতে সশরীরে উপস্থিত না থেকেও যেন থেকে গিয়েছিল৷ তারপর আচমকাই অরিত্রীর পরিবর্তনে বদলে গিয়েছিল পারমিতাও৷ তাই মা আর ওর নামটুকুও শুনতে চায় না৷

পারমিতার আচমকাই একটা কথা মনে পড়ে গেল, অরিত্রী যখন একলা হতে চাইছিল তখন বলেছিল, জানিস, ‘আমি শোভনাদেবীর স্কুলবেলার মতো হতে চাই৷ ঠিক ওরকম দেখতে৷ তাহলে একজন আমার স্বপ্নে আসে৷ তার জন্য সাধনা দরকার, একলা থাকার দরকার৷’

থমকে গেল পারমিতার ভাবনা, কেন অরিত্রী ওর মৃতা ঠাকুমার যৌবনবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে নিজেকে? তবে কি সত্যিই ওর কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিল?

‘হ্যালো, হ্যাঁ আমি অরিত্রী রায় বলছি৷ এটা বেনারসি নিকেতন তো? আমাকে আপনি ১৯৪৮ সালের বেনারসি বা তাঁত, জামদানি দেখাতে পারবেন? যদি পারেন তাহলে আমি বিকেলে আসছি৷ হ্যাঁ, আমি একটা আর্টিকলে পড়লাম, আপনারা প্রায় একশো বছর আগের শাড়ির ডিজাইন আবার ফিরিয়ে আনছেন৷’

দোকানের রিসেপশনিস্ট বলল, ‘হ্যাঁ ম্যাডাম, পাবেন৷ আমাদের থার্ড ফ্লোরে একটা সেকশন আছে পুরোনো ডিজাইনের শাড়ি বা জুয়েলারির৷ তবে গোল্ড নয়৷’

অরিত্রী আনন্দে নেচে উঠল৷ অবশেষে ও পেয়ে যাবে ওই সময়ের ডিজাইনের শাড়ি, সেমিজ৷ নিজের ঘরের বড়ো আয়নাটার দিকে অপলক তাকাল অরিত্রী৷ ধুর, ওকে দেখতে তো এখনও অরিত্রীর মতোই লাগছে৷ সাইড ফেস থেকেও ভ্রমরের মতো লাগছে না৷ চোখের কাজলটা আরেকটু মোটা করে টানল অরিত্রী৷ তবুও মুখটা যেন ভ্রমরের মতো লাগছে না৷ নিজের ঘরের বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল অরিত্রী৷ কদিনের পরিশ্রম বৃথা গেল মনে হচ্ছে৷ এটা ওর আগে ভাবা উচিত ছিল৷ ভ্রমরের মতো হাঁটাচলা, কথা বলার টেকনিক নকল করলে কী হবে, ওকে দেখতেই তো ভ্রমরের মতো নয়৷ সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় ওর মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠল৷ ও দেহে-মনে ভ্রমর হয়ে উঠতে চায়৷ মুছে যাক ওর অরিত্রীর সত্তা৷ ও হয়ে উঠুক ভ্রমর৷ শুভময়ের ভ্রমর৷ লজ্জা, একটা অদ্ভুত লজ্জা জড়িয়ে ধরছে ওকে৷ কেমন যেন ভাসা ভাসা মেঘের আড়ালে রাখতে ইচ্ছা করছে নিজেকে৷ সেই স্কুল লাইফে যখন প্রথম ও পাহাড় দেখেছিল তখনও ঠিক এমন শিরশির করেছিল অরিত্রীর গোটা শরীর৷ তখন বেশ ছোটো, তাই এই অনুভূতির ঠিক কী নাম সেটা জানা ছিল না ওর৷ তবে ওই বিশাল ধ্যানগম্ভীর পর্বতের সামনে দাঁড়িয়ে ও কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল৷ মনে হয়েছিল, এমন শান্ত গম্ভীরকে প্রশ্ন করাও পাপ৷ কিছুতেই যেন ধ্যান ভঙ্গ না হয় পর্বতের, তাই অরিত্রীর চেঁচিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করলেও ডাকেনি৷ ফিসফিস করে মায়ের কানে কানে বলেছিল, ‘পাহাড়ের ঘুম কখন ভাঙে?’

মা বলেছিল, ‘সন্ধেবেলা৷’

হয়তো কথার কথা, কিন্তু অরিত্রী অপেক্ষা করছিল সন্ধ্যা হবার জন্য৷ সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষাটা ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার মতো৷ প্রতিটা মুহূর্তের হিসাব রাখছিল ও৷ এক শিরশিরে অনুভূতি জেগেছিল শরীর জুড়ে৷ পাহাড়ের গায়ে একটা রিসর্টে ছিল ওরা৷ সারাদুপুর ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল পাহাড়ের দিকে৷ কখন পাহাড়ের ঘুম ভাঙবে সেই অপেক্ষায়৷ এতদিন পরে সেই দীর্ঘ অপেক্ষার কথা মনে পড়ছে ওর৷ কারণ অরিত্রী এখন নিজেকে একটু একটু করে ভ্রমর গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় আছে৷ শুধু ভ্রমর নয়, শুভময়ের ভ্রমর৷ ধৈর্য ধরে নিজেকে ভাঙছে আর গড়ছে নিঃশব্দে৷

তারপর সন্ধ্যা হতেই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আলো জ্বলে উঠছিল৷ যেন কোনো মেঘবালিকা ধীরপায়ে খুব সযত্নে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালছে৷ সব প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলেছিল তা নয়, একটা-দুটো করতে করতে গোটা মুসৌরি পাহাড় সেজেছিল আলোর মালায়৷ সেদিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মন ভরে গিয়েছিল অরিত্রীর৷ ভালো-লাগার কাঁপা অনুভূতিতে আপাদমস্তক ভিজেছিল ও৷ বুঝেছিল, পাহাড়ের ঘুম ভাঙলে এমন সুন্দর লাগে৷ কিন্তু সেই ঘুম ভাঙানোর জন্য বহু অপেক্ষার দরকার৷ আর চিৎকার-চেঁচামেচি পাহাড়ের একেবারে পছন্দ নয়৷ ওইজন্যই হয়তো প্রদীপের আলোয় আলোয় সেজে ওঠে পাহাড়৷ আলো চোখে পড়লে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে৷ মা-কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সারারাত আর ঘুমোবে না পাহাড়?’

মা আনমনে উত্তর দিয়েছিল, ‘না বোধহয়৷ অতন্দ্র প্রহরী হয়ে পাহারা দেবে পাহাড়ের রানিকে৷’ এইসব কত পুরোনো কথা! ভুলেই গিয়েছিল অরিত্রী৷ মনে পড়ল শুধু ওই একই অনুভূতি আবার নতুন করে পেল বলে৷ ভ্রমর হবার নেশায় নাকি শুভময়ের সঙ্গে সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষায় সেটা অবশ্য আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারেনি অরিত্রী৷

নিজের পার্সটা আরেকবার দেখে নিল৷ এটিএম কার্ডটা রয়েছে কি না৷ মান্থলি বেশ ভালো একটা অ্যামাউন্ট ওর বাবা এবং মা ওর অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেয়৷ কখনো দুজনের বেশ প্রতিযোগিতাও চলে৷ কে ঝুমঝুমকে বেশি ভালোবাসে তার কম্পিটিশন৷ সেই প্রতিযোগিতা শুধু দামি গিফট বা টাকাতেই সীমাবদ্ধ অবশ্য৷ ঘণ্টাখানেক সময় কারো ছিল না ঝুমঝুমকে দেওয়ার৷ দুজনেই অফিসের পরে নিজেদের গণ্ডিতে ঢুকে পড়ে৷ একমাত্র আদরের ঝুমঝুমের জন্য তাদের সময় কোথায়? তাই দাঁড়িপাল্লার একধারে সময় আর অন্যদিকে টাকা রেখে মাপামাপি করার পরে দুজনেই ভেবে দেখেছে, টাকাটাই তাদের বেশি আছে৷ তাই ওটাই হোক ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম৷ সেই কারণে অরিত্রীর অ্যাকাউন্টে দুজনের পর্যাপ্ত ভালোবাসার নিদর্শন সব সময়ই মজুত৷ একটা চোদ্দো-পনেরো হাজারের বেনারসি কিনতে ওকে কারো কাছেই হাত পাততে হবে না৷ পারমিতা বলত, ‘অরিত্রী, প্রপার গৌরী সেন কিন্তু তোর বাড়িতে৷ লাগলে টাকা, দেবে গৌরী সেন৷ তুই কী লাকি রে! আর আমার বাবাকে দেখ, কবে থেকে একটা ল্যাপটপ চাইছি, আজ নয় কাল করেই যাচ্ছে৷’

অরিত্রী অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, ‘লাকি শব্দটাও ভালোবাসার মতো আপেক্ষিক জানিস!’ পারমিতা বরাবরই বড্ড সরল৷ একটু বোধহয় অগভীর৷ তাই ওর মনটা পড়ে নেওয়া যেত খুব সহজেই৷ স্বচ্ছ নদীর মতো পারমিতা৷ কখন ওর মন-খারাপ, কখন ও খুশি সব ধরা পড়ত ওর চোখের তারায়৷ প্রাণচঞ্চল পারমিতার সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজের মধ্যেও অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করেছিল অরিত্রী৷ ও নিজেও কিছুটা পারমিতার মতো হয়ে যাচ্ছে৷ অতি সহজেই হাসছে, অল্পতেই কাঁদছে, ছোট্ট অনুভূতিগুলোও শেয়ার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছিল৷ কিন্তু ছোটো থেকে অরিত্রী এমন নয় মোটেই৷ একমাত্র স্কুলে গিয়ে ও হাসত, আর ঠাম্মার ঘরে ঢুকে গল্প করতে করতে হাসত৷ বাদবাকি সময় ও থাকত খুব গম্ভীর৷ এটার কারণ অবশ্য চূড়ান্ত অভিমান৷ ছোট্ট থেকে ব্যস্ত বাবা-মায়ের প্রতি অভিমান জমতে জমতে সেটা কঠিন প্রাচীরে পরিণত হয়েছিল৷ কেন কে জানে, ঐশ্বর্যের মধ্যে মানুষ হলেও বার বার অরিত্রীর মনে হত ও খুব অবহেলিত এ বাড়িতে৷ একমাত্র ঠাম্মা ছাড়া ওকে কেউ ভালোবাসে না৷ তাও তো ঠাম্মা বছরের ছয় মাস জেঠুর বাড়িতে থাকত আর ছয় মাস ওদের বাড়িতে৷ যখন ওদের বাড়িতে আসত তখন ওর আনন্দের সীমা থাকত না৷ কিন্তু বাবা-মা-কে দেখত, ঠাম্মাকে সেভাবে ওয়েলকাম করত না৷ কোনো কটুবাক্য শোনাত না ঠিকই, কিন্তু ঠাম্মার সঙ্গে সেই উষ্ণ সম্পর্ক যেন ছিল না এ বাড়ির কারো৷ ঠাম্মা একমাত্র আঁকড়ে ধরত ঝুমঝুমকে৷ ঠাম্মার অবশ্য ঝুমঝুম নামটা মোটে পছন্দ ছিল না৷ ঠাম্মা ওকে ভ্রমর বলে ডাকত৷ বলত, শুধু ভ্রমরের টানেই এ বাড়িতে ছুটে আসা৷ জেঠু একবার বলেছিল, ঝুমঝুমকে দেখতে ঠিক মায়ের মতো৷ ঠিক যেন মায়ের অল্প বয়েসের ছবি৷ বাবা একটু গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘দাদা, তোর চোখটাই খারাপ৷ ঝুমঝুমকে দেখতে পুরো আমার মতো৷ মায়ের মুখ পেলি কোথায়!’

ঠাম্মা বসে বসে হাসছিল বারান্দায়৷ হেসে বলেছিল, ‘আমার ভ্রমরকে ঠিক ভ্রমরের মতো দেখতে৷ আর কারো মত নয়৷’

ঝুমঝুমের খুব ভালো লাগত ভ্রমর নামটা৷ যদিও বাড়ি বা স্কুলে কেউ ডাকত না ওকে৷ একমাত্র ঠাম্মা ছাড়া ওই নামে ওকে কেউ ডাকত না৷ আগে অবশ্য এই নামটা নিয়ে অতটাও উৎসাহ ছিল না ওর৷ ইদানীং মনে হচ্ছে, ওর চারপাশে যারা আছে, সকলে ওকে এই নামেই ডাকুক৷ অরিত্রী জানে, উৎসবের সঙ্গে ওর সম্পর্কটার সুতোটা ভীষণ রকমের আলগা হতে শুরু করেছিল৷ না, উৎসবের দোষে নয়৷ দোষ অবশ্যই অরিত্রীর৷ শুভময়ের জায়গায় উৎসবকে ও কিছুতেই বসাতে পারছিল না৷ এতে উৎসবও কষ্ট, পাচ্ছিল, আর অরিত্রী নিজেও৷ প্রতিমুহূর্তের দ্বন্দ্বে মানসিক যন্ত্রণা বাড়ছিল বই কম ছিল না৷ তাই ও উৎসবকে বলেছিল, ‘ব্রেক চাই৷ নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চাই৷’

উৎসব অপলক তাকিয়ে বলেছিল, ‘প্যাকিং করার সময়ে তো আরেকটা হাত সঙ্গে থাকলে হেল্প হয়, অরিত্রী৷ তুমি গোছাও-না৷ আমিও পাশে থাকি৷’

অরিত্রী বুঝতে পারছিল, উৎসবের কষ্ট হচ্ছে৷ কষ্ট যে ওর হচ্ছিল না এমন নয়৷ কিন্তু ওকে যে ভ্রমর হতে হবে৷ শুভময়ের ভ্রমর৷ তাই অযথা উৎসবকে প্রতিক্ষণে যন্ত্রণা দিয়ে লাভ কী! উৎসবের বিহ্বল দৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই অরিত্রী বলেছিল, ‘আমি একা থাকতে চাই, উৎসব৷’

ও একটু থেমে বলেছিল, ‘কেউ এসেছে তোমার জীবনে?’

অরিত্রী আলগোছে বলেছিল, ‘না, কেউ আসেনি৷ আমি যেতে চাইছি অন্য একজনের জীবনে৷’

উৎসব আর দাঁড়ায়নি৷ ‘বেস্ট অফ লাক’ বলে হনহন করে হেঁটে গিয়ে নিজের বাইক স্টার্ট দিয়েছিল৷

অরিত্রীর অনেকটা কষ্ট হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু হল না৷ সম্পর্কটা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে যাবার পরেও হল না৷ তার কারণ হয়তো শুভময়৷ ভ্রমর হয়ে ওঠার একাগ্রতার মাঝে ও কাউকে চায় না৷ বিশেষ করে যারা ওকে ভীষণভাবে চেনে৷ যেমন পারমিতা, উৎসব বা গানের স্কুলের বন্ধু তমালিকা৷ তাই এদের তিনজনকে ও খুব সযত্নে সরিয়ে দিয়েছে নিজের থেকে দূরে৷ সম্পর্কের যেহেতু গভীরতা ছিল, তাই ওদের মনে অভিমান জমেছিল বেশি প্রশ্নের থেকে৷ অভিমানের কারণেই হয়তো পারমিতা এসে স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে বলেনি, ‘এটা হয় না, অরিত্রী৷ আমার কী দোষ হল যে, তুই একা আমাদের বন্ধুত্বটাকে ভেঙে দিচ্ছিস? বন্ধুত্বটা তো দুজনের৷ তুই আমার পারমিশন না নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারিস না৷’ এটা বলার অধিকার পারমিতার ছিল৷ কিন্তু ওর ঠোঁট দুটো অল্প কেঁপেছিল৷ অভিমানের পাহাড় নিয়ে সরে গিয়েছিল অরিত্রীর থেকে৷ সম্পর্কের গভীরতা বেশি বলেই অভিমান সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, আর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি অরিত্রীকে৷ তমালিকা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলেছিল, ‘কেন রে আরিত্রী? আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাইছিস কেন? বিকল্প পেলি বুঝি?’ অরিত্রী কিছু বলেনি, তমালিকা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল আস্তে আস্তে৷ আর তেমন কোনো বাধা ছিল না ভ্রমর হয়ে ওঠার দুর্গম পথের৷ এরাই ছিল ওর নিজের লোক৷ ওর বদলে যাওয়াটা নিয়ে যারা ব্যতিব্যস্ত করত ওকে৷ বাকি বাবা,মা কবেই সেভাবে তাকিয়ে দেখেছে ওকে! এখন আচমকা মায়ের নজর পড়েছে ওর ওপরে৷ তাই আজ অফিস থেকে ফিরে প্রায় বার তিনেক জিজ্ঞাসা করা হয়ে গেল, ‘তোর কী হয়েছে, ঝুমঝুম? হোয়াট হ্যাপেন্ড?’

ভ্রমর নিশ্চুপ, ভ্রমর শান্ত বহতা নদী৷ ভ্রমর কথায় কথায় তর্ক জোড়ে না৷ চোখের পলক ফেলে বুঝিয়ে দেয়, সে কী চাইছে৷ তাই মা-কে জোর গলায় বলা হল না, ‘তোমাদের কেয়ার ছাড়াই আমি বড়ো হয়েছি, মা৷ তাই এত বছর পরে আর না-ই বা খুঁজতে এলে আমার মন খারাপের কারণ!’ ঝুমঝুম হলে অবশ্যই বলত, অরিত্রীও হয়তো বলত, ‘পেরেন্টস জব করলেও তোমাদের মতো বিজি থাকে না৷’

পেরেন্টস’ মিটিং থেকে শুরু করে অরিত্রীর গানের ফাংশন কোনো জায়গাতেই উপস্থিত থাকতে পারেনি ওর বাবা, মা৷ কারণ তারা দুজনেই বড়ো চাকরি করে৷ ওদের দুজনের ভাষায় অবশ্য ওরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন৷ এই মুহূর্তে অরিত্রী কাউকে এন্ট্রি দিতে চায় না ওর জীবনে৷ ওর পালটে যাওয়ার চেষ্টা ব্যাহত হবে তাহলে৷ ওর ভ্রমর হয়ে ওঠায় দেরি হবে৷ শুভময়ের কাছে পৌঁছোতে দেরি হবে৷ তাই যারা ওকে খুব কাছ থেকে চেনে, যারা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে ওর অরিত্রী বা ঝুমঝুম সত্তাকে, তাদের থেকে ও এখন দূরে থাকতে চায়৷

মুশকিল হয়েছে ওর স্টেপকাট চুল নিয়ে৷ একে বড়ো করতে তো বছর ঘুরে যাবে৷ যদিও ওর চুল বাড়ে তাড়াতাড়ি৷ অথবা নিউ মার্কেট থেকে একটা অরিজিনাল চুলের বল খোঁপা ও জোগাড় করে নিতেই পারে কিন্তু শুভময়ের সামনে কোনো ছলচাতুরী নয়৷ ভ্রমরের সবটুকু জানুক শুভময়৷ পায়ের নখ থেকে মাথার চুল কোনো কিছুতে নকল করবে না ও৷ কিন্তু অরিত্রী জানে এই চুল বাড়তে কমপক্ষে মাস ছয়েক তো বটেই৷ অবশ্য মনেপ্রাণে শরীরে ভ্রমর হয়ে উঠতে এটুকু সময় ওর লাগবেই৷

লম্বা লিস্ট করতে লাগল অরিত্রী৷

খোঁপায় লাগানো কাঁটা থেকে শাড়ির ব্রোচ সব কিনতে হবে ওকে৷

আজ আবার প্রায় মাস পাঁচ-ছয় পরে পারমিতা কল করল, পারমিতার ফোন পাওয়ার পর থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে অফিসের কিউবে বসে আছে উৎসব৷ সামনে রোজদিনের মতো ল্যাপটপ খোলা৷ তাতে এখনও মিসেস কুলকার্নির ইন্টিরিয়র ডিজাইন৷ প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বেশ হাসিখুশি মুখ আর মনে পরিতৃপ্তি নিয়ে ফিরে গেছেন ‘সুসজ্জিত’-র অফিস থেকে৷ ‘সুসজ্জিত’ নামটা সম্ভবত মায়ের দেওয়া৷ ছোটোবেলায় এমনই একবার শুনেছিল উৎসব৷ ওর বাবা কথায় কথায় বলেছিল, ‘বেকার ছেলের হাত ধরার ক্ষমতা সকলের থাকে না৷ নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে আমার ওপরে ভরসা করেছিল তোর মা৷’ এই বাড়িটা আসলে উৎসবের ঠাকুরদার৷ পৈতৃক সূত্রে একটা তিনতলা বাড়িই পেয়েছিল বাবা গোলপার্কে৷ আর বিশেষ সম্পত্তি কিছুই পায়নি৷ কারণ অল্প বয়সে ঠাকুরদা মারা যাবার পরে, ঘরের জিনিস বেচেই ঠাকুমা সংসার চালিয়েছিল৷ পিসির বিয়ে দিয়েছিল৷ বাবা একটা চাকরি জোগাড় করেছিল৷ কিন্তু বসের মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে সে চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে গিয়েছিল৷ সেই বসের মেয়েটাই উৎসবের মা৷

কলেজে পড়াকালীন উৎসবকে অনেকেই বলত, ‘আর্কিটেক্ট নিয়ে কেন পড়লি তুই? সায়েন্সের কোনো একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে পারতিস!’ উচ্চমাধ্যমিকে পিয়োর সায়েন্স থাকার কারণে অনেকের মনেই প্রশ্নটা আসত৷ কিন্তু উৎসব তখন ভেবে নিয়েছে সুসজ্জিতই ওর ডেস্টিনেশন৷ বাবা-মায়ের স্বপ্নটাকে আরও বড়ো জায়াগায় নিয়ে যেতে হবে এটাই ছিল ওর সুপ্ত বাসনা৷ বাবা অবশ্য খুশিই হয়েছিল ছেলের এমন সিদ্ধান্তে৷ মা একটু গাইগুঁই করে বলেছিল, ‘কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়তে পারতিস বা জয়েন্টে বসতেও পারতিস৷’

উৎসব হেসে বলেছিল, ‘কোনো একদিন সুসজ্জিত কলকাতার বুকে এক নম্বরে দাঁড়িয়ে থাকবে মা৷’

ছোটো থেকে বারবার শুনে এসেছিল বাবা, মায়ের একসঙ্গে পথ চলার সূচনা হয়েছিল এই ব্যাবসা দিয়েই৷ কীভাবে এ ব্যাবসার কথা মাথায় এসেছিল সেটা নিয়েও বাবা গল্প করেছে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে৷

আজ সব পুরোনো স্মৃতি যেন একসঙ্গে ভিড় করে আসছে ওর দৃষ্টিপথে৷ মিসেস কুলকার্নি যখন বললেন, ‘আমি এই বাড়িটা আমার মেয়েকে গিফট করতে চাই, মিস্টার৷ আজীবন এই বাড়ির প্রতিটা আসবাব যেন ওকে ওর সিঙ্গেল মাদারের কথা মনে করিয়ে দেয়’, তখন আর প্রফেশনাল না হয়ে নিতান্ত মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট থেকে একটা ইন্টিরিয়রের ডিজাইন করেছিল উৎসব৷ যেখানে আধুনিকতা আর বনেদিয়ানার মিশেল থাকলেও বাড়িকে নিজের শান্তির আশ্রয় মনে হবে৷ ঘরোয়া অথচ সমস্ত আধুনিক সুবিধাযুক্ত বাড়ির ডিজাইনটা দেখে মিসেস কুলকার্নি বললেন, ‘এই নিয়ে চারজনের ডিজাইন রিজেক্ট করলাম, মিস্টার উৎসব৷ কিন্তু পাঁচ নম্বরে এসে আপনি আমাকে চমকে দিলেন৷ না, বলার কোনো জায়গাই রাখলেন না৷ বাজেট নিয়ে ভাববেন না, আপনি শুধু মন দিয়ে ইট-কাঠ-পাথরের বাড়িটাকে ঘর করে তুলুন প্লিজ৷’

মনটা আজ বেশ ফুরফুরে ছিল৷ বড়ো বড়ো কোম্পানির অফিসের ইন্টিরিয়র করেছে উৎসব৷ কিন্তু এতটা স্বাধীনতা মিসেস কুলকার্নিই দিলেন৷ পাশের কিউবে বসে বাবা মিসেস কুলকার্নির উচ্ছ্বাসটুকু দেখতে পাচ্ছিল৷ কথা বিশেষ শুনতে পায়নি৷ তাতেই বাবার খুশি আর গর্বমিশ্রিত মুখটা দেখে উৎসবের মনে হল, এটাই ও চেয়েছিল৷

আদিত্য মিত্র যখন বাবার এই পৈতৃক বাড়িটা পেয়েছিল, তখন তার হাতে ক্যাপিটাল বলতে কিছুই ছিল না৷ আদিত্য আর কল্পনা যখন প্রেম করত তখন তারা গল্প করত, নিজেদের ঘর কীভাবে সাজাবে৷ সেই নিয়ে প্রায়ই মতবিরোধও হত৷ ছোটোখাটো ঝগড়াও হত৷ কিন্তু ঘর সাজানোর গল্পের শেষ হত না৷ এভাবেই কবে যেন ওর মানসচক্ষে একটা বাড়ির ছবি এঁকেছিল, তার প্রতিটা ঘরের ফার্নিচার কেমন হবে সেসবও এঁকেছিল৷ দুর্দান্ত ছবি আঁকতে পারত কল্পনা৷ আদিত্যর পরিকল্পনাকে আঁকার খাতায় রূপ দিয়েছিল কল্পনা৷ সেই শুরু৷ বাড়ি এঁকে তার ঘরের ডিজাইন করতে শুরু করেছিল ওরা আপন খেয়ালে৷ অফিসের সামান্য এক কর্মচারীর প্রেমে পড়েছে একমাত্র মেয়ে—জানতে পেরেই উৎসবের দাদু আদিত্যকে কোনো কারণ ছাড়াই ছাঁটাই করে দিয়েছিলেন৷ ভেবেছিলেন, বেকার ছেলের আর সাহস হবে না৷ কিন্তু সাহস আদিত্যর বরাবরই বেশি৷ তাই বেকার হয়ে গিয়েও কল্পনার হাত ছাড়েনি৷ কল্পনা নিজেও জেদের বশেই বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে৷ তারপর বিয়ের পর ওরা বুঝেছিল, বাস্তব আর স্বপ্নে বড্ড ফারাক৷ সংসার চালাতে গেলে অর্থের প্রয়োজন৷ তখন পিতৃদত্ত বাড়িটার দুটো তলাকে অফিস বানিয়ে ফেলে কর্তা-গিন্নি৷ নিজেদের ঘরে পরদা, দামি ফার্নিচার না থাকলেও অন্যের বাড়ি সাজিয়ে দিতে লাগল রুচিশীলভাবে৷ তখনও ইন্টিরিয়রের বিষয়টা উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ কলকাতায় সেভাবে ইন্টিরিয়রের বিজনেস গজিয়ে ওঠেনি অলিগলিতে৷ সে সময় সুসিজ্জিত নিজের জায়গা করে নিয়েছিল ধীরে ধীরে৷ তারপর গোলপার্কে এই বাড়িটা শুধুই অফিস হল৷ কল্পনা আর আদিত্য নতুন ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেল৷ উৎসবের জন্ম হয়েছিল ওদের বিয়ের প্রায় বছর পাঁচেক পরে৷ বাবা নাকি বলেছিল, ‘এত অভাবের মধ্যে তাকে আনতে চাই না, কল্পনা৷’

উৎসব অবশ্য এসব কষ্টের দিন দেখেনি৷ জ্ঞান হয়ে থেকেই সে গাড়িতে চড়ছে৷ কলকাতা শহর বাদ দিয়েও দিল্লিতে আরেকটা নতুন আউটলেট খুলতে চলছে সুসজ্জিত৷ সাফল্যকে যখন প্রায় মুঠোবন্দি করে ফেলেছিল উৎসব, ঠিক তখনই অরিত্রী সরে গেল ওর জীবন থেকে৷ যাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিল, সে দমকা হাওয়ার মতো সরে গেল৷ নিজেকে অনেক কষ্টে বুঝিয়েছিল৷ কাজের মধ্যে সারাক্ষণ নিজেকে এনগেজড করে রাখত উৎসব৷ তবুও রাত্রে শুয়ে একবার করে অরিত্রীর হোয়াটসঅ্যাপটা চেক করতে ভোলেনি এই ছয় মাসে৷ এতদিনের অভ্যেস বলেই হয়তো৷ শুধু মনে হত, ওকে হয়তো মিস করবে অরিত্রী৷ হয়তো লিখে ফেলবে, ‘উৎসব, মিট করতে চাই৷’ কিন্তু অপেক্ষারা দীর্ঘ হতে হতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে গেছে তবুও মেসেজ আসেনি অরিত্রীর৷ উৎসবও একটু একটু করে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল অরিত্রীহীন জীবনে৷ তার মধ্যেই পারমিতার ফোনে মনের সব বন্ধ দরজা খুলে গেল এক নিমেষে৷ দরজাগুলো যে খুব কঠিনভাবে বন্ধ নেই সেটা বেশ বুঝতে পারছে উৎসব৷ তাই অরিত্রী কোনো সমস্যায় আছে শুনেই আবারও উতলা হল উৎসব৷ ঠিক কী হয়েছে অরিত্রীর? কেন ওর মা পারমিতার সঙ্গে বসে আলোচনা করতে চাইছে অরিত্রীকে নিয়ে? অরিত্রী তো বলত, বাবা-মা দুজনের কেউই ওর প্রতি যত্নবান নয়৷ তাহলে হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, ওর মা পারমিতার সঙ্গে আলোচনায় বসবে! ছেড়ে-আসা সম্পর্ক থেকে এখনও বেরোতে না-পারার ব্যর্থতায় নিজেরই নিজের ওপরে রাগ হল উৎসবের৷ এতটা দুর্বল কেন হয়ে পড়ে ও এই মেয়েটার নাম শুনলেই? কেন সব প্রতিরোধের বাঁধ ভেঙে অরিত্রী নামক মেয়েটার ফেলে-যাওয়া স্মৃতিগুলো ঘুরপাক খায় ওর চারিদিকে? পারমিতা ওকে ডাকছিল অরিত্রীর মায়ের সঙ্গে বসার জন্য৷ ঠিক কী পরিচয় দেবে ও নিজের? অরিত্রীর বন্ধু? না, এমন মিথ্যাচার ও করতে পারবে না৷ শুধু বন্ধু ও ছিল না কোনোদিন৷ একবার কি যাওয়া উচিত অরিত্রীর মায়ের সামনে? কী জানতে যাবে ও? আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ভাবনাগুলো৷ আবারও ঘুরেফিরে আসছে সেই প্রশ্নটা যার সম্মুখীন ও কিছুতেই হতে চাইছে না৷ অরিত্রীর সত্যিই কি কিছু হয়েছে?

দরজাটা একটু আশা নিয়েই খুলেছিল ঈশানী, সারাদিনের পরে ঝুমঝুম বাড়িতে ফিরল ভেবে অজান্তেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল ও৷ অফিস থেকে ফিরে অবধি এক কাপ চা-ও খাওয়া হয়নি ওর৷ ঝুমঝুমের পরিচিত সকলকে একের পর এক কল করে গেছে ঈশানী৷ মাথাটা ভার লাগছে বেশ৷ কোথায় গেল মেয়েটা এই চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি দেয়নি৷ যাক, মেয়েটা বাড়ি ফিরল ভেবেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল৷ দরজাটা খুলে আশাহত হল ঈশানী৷ তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে গেটে৷ মুখে যথারীতি সেই বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট৷ ঘণ্টা দুয়েক আগে বাড়ি ফিরতে হয়েছে বলেই কপালের ভাঁজে বিরক্তির চিহ্ন সুস্পষ্ট৷ সেটাকে লুকোনোর চেষ্টাও নেই অবশ্য তন্ময়ের আচরণে, বরং ও নির্লজ্জের মতো প্রকটভাবে বুঝিয়ে দেয় এ সংসারে টাকা ছাড়া ওর আর কিছুই দেবার নেই৷ ঈশানীকে দেখেই বিরক্ত গলায় বলল, ‘তোমার মেয়ে বাড়ি ফিরেছে?’

ঈশানী ক্লান্ত গলায় বলল, ‘না, ফেরেনি৷’

আজ আর বলতে ইচ্ছে করছিল না, মেয়েটা ওর একার নয়, দুজনেরই৷ ঝুম যখন জন্মেছিল তখনও তন্ময় মধ্যবিত্ত ছিল, তাই ঝুম ছিল ওর আদরের মেয়ে৷ তন্ময়ের কেরিয়ারে যত উন্নতি হয়েছে, ঝুম হয়ে গেছে ঈশানীর একার সন্তান৷ আর ঈশানী আদৌ তন্ময়ের মনের কোথাও এক টুকরো জমি নিয়ে আছে কি না আজ আর বুঝতেই পারে না৷ একই ছাদের নীচে বাস করেও মনের দূরত্ব বেড়ে গেছে কয়েক আলোকবর্ষ৷ তাই দুজনের বলা কথাগুলো দুজনের কাছেই বড়ো দুর্বোধ্য লাগে আজকাল৷ তন্ময় অফিস ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘থানা থেকে কখন ফিরলে? থানায় ঠিক কী বলল? আর ঝুমঝুমের বন্ধুবান্ধবরা কী বলছে?’

ঈশানী ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘ওর বন্ধুরা কেউ জানে না ও কোথায় গেছে৷ আর থানায় রিপোর্ট লেখাতে আমি এখনও যাইনি৷’

তন্ময় বিস্মিত গলায় বলল, ‘মানে প্রায় ঘণ্টা তিনেক সময় তুমি অযথা নষ্ট করলে তা-ই তো? এখনও রিপোর্ট লেখাওনি কেন? মেয়েটার তো কোনো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে না কী!’

ঈশানী বলল, ‘না, মানে থানা-পুলিশ করলে যদি ঝুম ফিরে এসে রাগারাগি করে! তাই আরেকটু ওয়েট করছিলাম৷’

তন্ময় বলল, ‘তাহলে আমায় কল করে টেনশন দিলে কেন? ইমপর্টেন্ট মিটিং ছেড়ে আমায় চলে আসতে হল৷ কারণটা হল, আমার প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে গেছে, আর তার মা সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে!’

ঈশানী বলল, ‘তোমাকে তো ফিরতে বলিনি, শুধু জানিয়েছিলাম, ঝুম ফেরেনি৷’

তন্ময় গোটাকয়েক ফোন করল৷ সম্ভবত ওর পরিচিত পুলিশ অফিসারদের৷ তারপর একটু চিন্তিত গলাতেই বলল, ‘তুমি কদিন আগেই বলছিলে না ঝুমঝুমের ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটেছে? সেটা কি তুমি খেয়াল করেছিলে? নাকি ওর কোনো ফ্রেন্ড বা টিচার বলেছে?’

ঈশানী বলল, ‘খেয়াল ঠিক করিনি, ঝুম নিজেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল ওর পরিবর্তনটা৷ হঠাৎই ঝুমঝুম বলে ডাকতে আমায় বিরক্ত গলায় বলল, বলেছি না ভ্রমর বলে ডাকতে৷ তখন আমি খেয়াল করলাম, ওর চুলের স্টাইল থেকে পোশাক সবকিছুর পরিবর্তন করেছে ও খুব সচেতনভাবে৷ সেই পাঁচের দশকের মতো সাজগোজ করে কলেজ যাচ্ছে৷ জানি, পুরোনো ফ্যাশন আবার মার্কেটে ইন করেছে৷ কিন্তু এটা ঠিক ট্রেন্ড মেনটেইন করে নয়৷’

তন্ময় বলল, ‘আমি কি ফ্যাশন নিয়ে জানতে চেয়েছি, ঈশানী? প্লিজ টেল মি, কবে নোটিশ করলে, ও বদলে যাচ্ছে?’

তন্ময় যে টেনশন করছে ঝুমকে নিয়ে সেটা ওর গলার স্বরেই স্পষ্ট৷ ঈশানী বলল, ‘ওর সাজপোশাক, কথাবার্তার ধরন দেখলেই বোঝা যাচ্ছে অদ্ভুত বদলটা৷ তারপর ওর বেস্ট ফ্রেন্ড পারমিতার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ওর পরিবর্তন শুরু হয়েছে অনেক আগেই, বাহ্যিকটুকু আমি ধরতে পেরেছি মাত্র৷ ও নাকি ওর পুরোনো সব বন্ধুর সঙ্গে ব্রেকআপ করে নিয়েছে৷ এখন একা থাকতে পছন্দ করে৷ এমনকী ওদের টিউশন ব্যাচ থেকে পিকনিকে গিয়েছিল, সেখানে একমাত্র অ্যাবসেন্ট ছিল ঝুম৷ ওর নাকি যাওয়ার মুড ছিল না৷’

তন্ময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাত তো এগারোটা বাজে৷ থানায় ডায়েরি করা উচিত কি? তাহলে চলো, ফর্ম্যালিটিগুলো অন্তত মিটিয়ে আসি৷’

‘রৌনক, আপনি যে বললেন, আপনি শুভময়কে চেনেন? কোথায় শুভময়?’ রৌনক আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে স্যার৷’

বিশাল হলঘরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে একটা আনকোরা ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের এক ভদ্রলোক৷ পরনে আদ্দির পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা৷ অরিত্রীর বুকের ভিতরের লাবডুব আওয়াজটা ও নিজেই শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট৷ শুভময় আর ওর মধ্যে এখন মাত্র চার-পাঁচ হাতের ব্যবধান৷ এভাবে যে শুভময়ের সঙ্গে দেখা হবে ওর, ও কখনো কল্পনা করতেই পারেনি৷ যার জন্য ও গত ছয় মাস ধরে নিজেকে তৈরি করছিল তিল তিল করে, সে আজ ওর সামনে৷ অথচ এখনও যে নিজেকে সম্পূর্ণ তৈরি করে ওঠা হয়নি অরিত্রীর৷ এখনও যে বাকি আছে পুরোপুরি ভ্রমর হয়ে ওঠার যাত্রাটা৷ তবুও আজ ও ফিরে যাবে না৷ শুভময়কে যখন ও খুঁজে পেয়েছে তখন একবার অন্তত মুখোমুখি হবেই ওর৷ একবার অন্তত বলে যাবে, ‘দেখো, চিনতে পারো তোমার ভ্রমরকে?’ ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে অরিত্রী, অবশ হয়ে যাচ্ছে ওর গোটা শরীর৷ অদ্ভুত এক শিরশিরে আবেশ যেন ওকে ঘিরে রেখেছে৷ চোখের সামনে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টিটা৷ একটা বড়ো হলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে যেন কত সময় লাগছে অরিত্রীর৷ ঠিক শুভময়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অরিত্রী৷ শুভময় তখনও ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে৷ তখনও পেনসিলের ছোঁয়ায় ক্যানভাসের সাদা চরিত্রে লাগেনি এতটুকু কলঙ্কের আঁচড়৷ অরিত্রী অস্ফুটে বলল, ‘শুভময়, আমি তোমার ভ্রমর৷’

পিছন ফিরে তাকাল শুভময়৷ চোখে একরাশ বিস্ময়৷ ঠোঁটের কোণে কৌতূহল৷ ভ্রূ-তে বেশ কিছু প্রশ্নচিহ্ন প্রকট৷

শুভময় বলল, ‘বলুন৷’

অরিত্রী আবারও আবেগতাড়িত গলায় বলল, ‘আমি তোমার ভ্রমর৷’

শুভময় সচকিত হয়ে বলল, ‘ভ্রমর? কে ভ্রমর? আমি তো কস্মিনকালেও আপনাকে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না৷ তা ছাড়া আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে৷ আমার স্ত্রী আছে পাশের ঘরেই৷ আপনি একটু দূরে দাঁড়ান প্লিজ৷ গুঞ্জন দেখলে অন্যরকম ভাববে৷’

অরিত্রী বলল, ‘আপনি আর্টিস্ট তো? আপনার আদি বাড়ি কালনা একশো আট শিব মন্দিরের পাশে ছিল তো? আপনি জীবনে শুধু ভ্রমরেরই ছবি এঁকেছেন তো?’

শুভময় অস্বস্তির গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে৷ আমার জন্ম কলকাতায়৷ ইন ফ্যাক্ট কালনা আমি কখনো যাইনি পর্যন্ত৷ শুনেছিলাম, কোনো এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকেন ওখানে৷ এ ছাড়া ওই শহরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ কোনোদিন নেই৷’

অরিত্রী কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনি ভ্রমরকে চিনতে পারছেন না? আপনার বেশির ভাগ ছবিই তো আমায় নিয়ে আঁকা৷’ শুভময়ের শীতল ব্যবহার বাধ্য করল অরিত্রীকে ‘তুমি’র আন্তরিক সম্বোধন ছেড়ে ‘আপনি’ বলাতে৷

শুভময় ঠান্ডা গলায় বলল, ‘না, আমি কোনো ভ্রমরের ছবি আঁকিনি৷ ইন ফ্যাক্ট মডেল ইউজ করে ছবিই আমি জীবনে খুব কম এঁকেছি৷ আমার বেশির ভাগ ছবি প্রকৃতিকেন্দ্রিক৷ অবশ্যই তার মধ্যে বিভিন্ন পেশার মানুষ আছেন, কিন্তু ভ্রমর নামের কেউ নেই৷’

অরিত্রী পিছন ঘুরে দেখল রৌনক নেই৷ ও বলেছিল, কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেরিয়েছে, তাই শুভময়ের ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েই ও চলে যাবে৷ অরিত্রীও ভেবেছিল, শুভময়কে পেয়ে গেলে ওর সঙ্গেই সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরবে৷ কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে, এর নাম শুভময় বা পেশায় চিত্রশিল্পী হলেও অরিত্রী যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এ সে নয়৷ ভ্রমর নামটা শোনার পর তার গলায় কোনো সংকোচ থাকবে না৷

কিন্তু এই শুভময় তো ভ্রমর নামটাই প্রথম শুনল মনে হচ্ছে৷ অরিত্রী বলল, ‘আচ্ছা, আপনার বাবার কি খাতা-পেনের দোকান ছিল?’

শুভময় ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না ম্যাডাম, আমার বাবা সরকারি চাকুরিজীবী৷ স্কুলশিক্ষক ছিলেন৷ বছর দুয়েক আগেই রিটায়ার করেছেন৷’ অরিত্রী ঠিক যতটা উত্তেজনা নিয়ে এই ঘরে প্রবেশ করেছিল, তার চারগুণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে এল ওই ঘর থেকে৷ নামে শুভময় আর পেশায় চিত্রশিল্পী হলেই সকলে ভ্রমরের শুভময় হতে পারে না৷ অনেকটা জ্বলার পরে প্রদীপ নিভিয়ে দিলে যেমন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ বেরোয় তেমনি অরিত্রীর ভিতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে৷ সারাদিনের উত্তেজনা এখন নিভে গিয়ে বড্ড ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত৷ উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছে ও৷ ঠিক যেন দিগভ্রষ্ট কোনো পাখি৷ কোথায় ফিরতে হবে, কিছুই বুঝতে পারছে না৷ ওর যে একটা ঘর আছে সেটাও যেন ভুলে গেছে ও৷ হঠাৎই খেয়াল হতে মোবাইলের দিকে তাকাল, কখন যে চার্জ শেষ হয়ে ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বুঝতেও পারেনি ও৷

‘আপনার হোটেল এসে গেছে৷ আপনি অরণ্য রিসর্টে স্টে করেছেন তো? আরে মিস্টার উৎসব, আমি আপনাকে বলছি৷’

পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে বেশ হাঁপাচ্ছিল দুজনেই৷ সুভদ্রার ডাকে চমক ভাঙল উৎসবের৷ নিজস্ব ভাবনার রাজ্য থেকে আচমকা বেরিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এই তো আমার আস্তানা৷ বাই সুভদ্রা৷’

সুভদ্রা আলতো স্বরে বলল, ‘অরিত্রী কোথায় গেছে? না মানে আপনাকে বড্ড টেন্সড লাগছে৷ যদি ইচ্ছে হয়, শেয়ার করতে পারেন৷ আমাদের সাইকোলজিতে বলে, শেয়ার করলে বাড়তি দুশ্চিন্তা কমে যায়৷ এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখা আছে৷ যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথাকে আপনি নিজের মধ্যে রেখে দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার মস্তিষ্ক জানান দেবে এ কাজের দায়িত্ব শুধুই আপনার৷ পৃথিবীর কোনো মানুষ এ কথা জানে না৷ তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে বা মাথায় চাপ বাড়বে৷ ঠিক যখনই আপনি কথাটা শেয়ার করবেন তখনই আপনার মস্তিষ্ক বলবে, এ দায় শুধু আপনার নয়৷ আরেকজন যেহেতু জানল, সে-ও কিছু বুদ্ধি দেবে, তখন দেখবেন, একটু হলেও চাপমুক্ত লাগবে৷ কখনো ট্রাই করে দেখতে পারেন৷ এনিওয়ে, আজ চলি৷ ফোন নম্বর রইল, যদি কল না করেন তাহলেও অভদ্র ভাবব না৷’

উৎসব ভূমিকা না করেই বলল, ‘অরিত্রী আজ বাড়ি ফেরেনি৷ কোথায় গেছে, কেউ জানে না৷ ওর মা ঈশানী আন্টি আমাদের রিলেশনের কথা জানতেন না৷ তিনি হঠাৎ আজ আমায় কল করে অরিত্রীর কথা জানতে চাইলেন৷ আসলে ও অন্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা৷ বন্ধুদের সঙ্গে নাইট পার্টিতে যাওয়া, আউটিং এসব করত না৷ ওই কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কোচিং, ওর গানের ক্লাসের বাইরে ওকে সেভাবে কোথাও যেতে দেখেনি৷ মানে সন্ধে সাতটার পরে ও কখনো বাড়ির বাইরে থাকেনি৷ আজ নাকি দুপুরেই ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ক্লাস থাকা সত্ত্বেও৷ অরিত্রী এরকম কখনো করে না৷’

সুভদ্রা একটু ভেবে বলল, ‘আপনি একবার কল করে দেখতে পারতেন৷ ওর মা যেহেতু আপনার কাছে খোঁজ নিলেন তাই আপনার একটা কল করা উচিত ছিল৷’

ফোনটা বের করে দুবার নাড়াচাড়া করে অন্যমনস্কভাবে উৎসব বলল, ‘না থাক৷ ও দূরত্ব চেয়েছিল, আমি বিনা প্রশ্নে সেটা দিয়েছি ওকে৷ আর বিরক্ত না-করাই শ্রেয়৷ আসলে অরিত্রী বড্ড জেদি মেয়ে৷ ভীষণ শান্ত, অত্যন্ত ভদ্র মেয়ে, কিন্তু অসম্ভব জেদ৷ ও যদি ভেবে নেয়, আজ রাতে বাড়ি ফিরবে না, তাহলে কলকাতা পুলিশের সাধ্য নেই ওকে বাড়িতে ফেরায়৷ তাই এই অবস্থায় আমি ফোন করে সুযোগ নিতে চাইছি এমন ভাবানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই৷ এনিওয়ে, ঠান্ডা বাড়ছে, আপনি আসুন৷’

সুভদ্রা বলল, ‘একটা কথা বলি, আপনার ব্রেকআপ হয়েছে শুধুমাত্র ইগো থেকে৷’

বেশ জোরেই হেসে উঠল উৎসব৷ সন্ধের নিস্তব্ধ পাহাড় হয়তো এমন আচমকা শব্দের জন্য প্রস্তুত ছিল না৷ তাই হাসির আওয়াজটা কান্নার মতো শোনাল যেন৷ সুভদ্রা বুঝল, উৎসব স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, এর বেশি আর কিছু বলবে না ও নিজের সর্ম্পকে৷ কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে হয়তো এর থেকে বেশি আপন হওয়ার চেষ্টা করাও বাতুলতামাত্র৷ তাই সুভদ্রা নিজের কটেজের দিকে এগোতে লাগল৷ খুব ইচ্ছে করছিল একবার পিছন ফিরে দেখতে, উৎসব ওর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কি না৷ কিন্তু তারপরেই মনে হল, যদি না থাকে তাহলে কি আজকের সন্ধেটা অর্থহীন হয়ে যাবে? মস্তিষ্ককে এত ভাবার সুযোগ দিল না মন৷ পিছন ঘুরে দেখল, ওর দিকেই স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উৎসব৷

কিন্তু অন্য কিছু ভাবছে ও৷ অদ্ভুত একটা একাকিত্বের বেড়াজালে নিজেকে ঘিরে রেখেছে ছেলেটা৷ কিছুতেই যেন সেই বলয় থেকে নিজেকে বের করবে না এমনিই সিদ্ধান্ত নিয়েছে উৎসব৷ সুভদ্রা হাত নাড়ল৷ কোনো উত্তর নেই উৎসবের৷ অথচ এদিকেই তাকিয়ে আছে ও৷ সুভদ্রা জানে না উৎসব ওকে আর কল করবে কি না৷ জানে না পাহাড়ি পথের বাঁকে মিলিয়ে যাবে কি না ওদের পরিচয়সূত্রটুকু৷ তবুও আবার দেখা হবে উৎসবের সঙ্গে এই আশা নিয়েই নিজের কটেজে ঢুকল সুভদ্রা৷ ঠান্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়েছে মানালিতে৷ পাহাড়ে এই এক মুশকিল, সন্ধে মানে মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা৷ এখানে সকাল যেমন হয় পাখি-ডাকা ভোরে, তেমনই অন্ধকার নামলে বড়ো চুপচাপ হয়ে যায় চারিদিক৷ আজীবন তিলোত্তমার ব্যস্ততা-দেখা চোখ দুটোর একটু অস্বস্তি হয় বই কী৷ ফায়ারপ্লেসের আগুনে হাত সেঁকতে সেঁকতে সুভদ্রা ভাবছিল, উৎসব কলকাতা ছেড়ে এখানে এসেছে অরিত্রীকে ভুলবে বলে, অথচ ওর ভাবনায় সব সময় অরিত্রীর বাস৷ সুভদ্রার হঠাৎই খেয়াল হল, ও একজন অতি স্বল্পপরিচিত মানুষকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাবছে৷ ঠিক সেই সময় দরজায় নক করল কেউ৷ সুভদ্রা দরজাটা খুলতেই একটা অল্পবয়সি ছেলে ঢুকল চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে৷ সুভদ্রা আসার সময় রিসেপশনে জানিয়ে এসেছিল, রুমে যেন চা আর চিকেন পকোড়া পাঠিয়ে দেয়৷ ছেলেটার গায়ের রং অসম্ভব ফরসা, সাধারণত বাঙালি ছেলেরা এতটা ফরসা হয় না৷ টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম সূত্রে না পড়েও ছেলেটাকে একনজরে সুদর্শন বলা চলে৷ মাথায় একমাথা ঘন চুল, টিকালো নাক, টানা চোখ, একটু লম্বাটে মুখ৷ ঠিক যেন গ্রিক ভাস্কর্য৷

হিন্দিতেই কথা বলল সুভদ্রা৷ ছেলেটাও হিন্দিতেই উত্তর দিল৷ কিন্তু ওর হিন্দি শুনেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেটার মাতৃভাষা হিন্দি নয়৷ সুভদ্রা আগ্রহের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার মাতৃভাষা কী?’

ছেলেটি হঠাৎই খুশি হয়ে গিয়ে বলল, ‘আমি বাঙালি, দিদি৷’ বছর উনিশের ছেলেটার চোখ দুটো স্বপ্ন-জড়ানো৷ একটু ভাবুক বোধহয়৷ সুভদ্রা বলল, ‘বাড়ি কোথায় তোমার? নাম কী?’

ছেলেটা বেশ গল্প করার ভঙ্গিমায় গলায় আন্তরিকতা মিশিয়ে বলল, ‘আমি মেদিনীপুরের ছেলে, দিদি৷ আমার জন্ম ওখানেই৷ আমার বাবা ওখানের বয়েজ স্কুলের হেডমাস্টার৷ আমার মা সংগীতের শিক্ষিকা৷ আমি ওদের একমাত্র সন্তান৷ আমার নাম সহজ রায়৷’

চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থমকে গেল সুভদ্রা৷ জিজ্ঞাসা করল, ‘ওঁরা বেঁচে আছেন তো?’

ছেলেটা নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ আছেন৷ আমি হয়তো মরে গিয়েছি ওঁদের কাছে৷ অবাধ্য সন্তানের পরিচয় লোকসমাজে দেওয়ার থেকে তাকে মৃত ঘোষণা করা অনেক সম্মানের৷’

সুভদ্রা বলল, ‘বাবা-মায়ের ওপর এত রাগ কেন? কী করেছেন ওঁরা? বাই দ্য ওয়ে, তোমাকে দেখতে অনেকটা টম ক্রুজের মতো৷ তুমি কথাও বলো বেশ নায়কোচিত৷ তোমার চেহারা, হাঁটাচলার মধ্যে একটা ফিলমি ব্যাপার আছে৷’

উৎসাহিত হয়ে সহজ বলল, ‘দিদি, আপনার সত্যি মনে হয়, আমার মধ্যে হিরো হবার গুণ আছে?’

সুভদ্রা মুচকি হেসে বলল, ‘গুণ কী বলছ, আমি তো তোমায় প্রথম দেখে হিরোই মনে করেছিলাম৷ তবে তোমার যা গায়ের রং তাতে বলিউড নয়, হলিউডের হিরো হলেও অবাক হব না আমি৷’

সুভদ্রা ততক্ষণে বুঝে গেছে, সহজ কেন বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে হোটেলে ওয়েটারের কাজ করছে৷ উৎসবের কেসটা ও বুঝতে হয়তো ভুল করেছিল একটু, কিন্তু সহজের কেসটাতে ও সেন্ট পারসেন্ট রাইট৷ সহজ অবস্থাপন্ন বাড়ির একমাত্র সন্তান৷ হিরো হতে চেয়েছিল বাড়ির অমতে৷ তাই রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়েছে ছেলে৷

বেশি প্রশ্ন করলে আবার সন্দেহ হতে পারে ভেবেই সুভদ্রা বলল, ‘এখানে সাইট সিয়িং কী কী করব সহজ? জানো?’

সহজ এই মুহূর্তে প্রসঙ্গ বদলাতে নারাজ৷ সে তার হিরো হবার স্বপ্ন নিয়েই কথা বুনতে চায়৷ কিন্তু সুভদ্রা জানে, এদের বেশি প্রশ্ন করলে এরা আর তার ধারেকাছে ঘেঁষে না৷ এরা নিজেদের স্বপ্নের জগতে ভেসে বেড়াতে পছন্দ করে৷ বাস্তবের রুক্ষতা একেবারেই অপছন্দ এদের৷ এটাও এক ধরনের মানসিক রোগ৷ নিজের যোগ্যতার থেকে স্বপ্নকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া৷ নিজের ক্ষমতা যাচাই না করেই এমন কিছুর পিছনে ধাওয়া করেছে এরা যেটা হয়তো বাস্তবে অসম্ভব৷ সহজ বলল, ‘এই হোটেলে কাজ করে বেশ কিছু টাকা জমিয়ে নিয়ে মুম্বই যাব৷ আসলে প্রথমেই তো বক্স অফিস হিট মুভি দিতে পারব না৷ টাকাও হয়তো বেশি দেবে না আমায়৷ তখন মুম্বইয়ের খরচ চালানোর জন্যই টাকা জমাতে হবে কিছু৷ আর তা ছাড়া প্রতিটা হিরোর বায়োগ্রাফি পড়লেও আপনি বুঝতে পারবেন, প্রত্যেকে প্রথম জীবনে হয় হোটেল বয়, নয় চায়ের দোকানে, নয় স্টুডিয়ো বয়ের কাজ করেছে৷ ইন্টারভিউয়েও ওরা বলে ওদের স্ট্রাগলের কথা৷ আসলে দিদি, রিয়েল হিরোর লাইফে স্ট্রাগল থাকবে না,—এটা হয় না৷

সুভদ্রা বুঝল বিষয়টা ভীষণ সেন্সিটিভ, কারণ ছেলেটার বয়েস মাত্র উনিশ৷ এই বয়েসেই যেকোনো ভুল করতে পারে অবলীলায়৷ সুভদ্রা হাসিমুখে বলল, ‘এটা অবশ্য ঠিক৷ স্ট্রাগলের গল্প না থাকলে কেউ হিরো হতে পারে না৷ কিন্তু কলকাতায় এত হোটেল থাকতে তুমি এখানে কেন এলে?’

সহজ আরও সহজ করে উত্তর দিয়ে বলল, ‘আসলে উচ্চমাধ্যমিক এগজামের পরে এখানেই বেড়াতে এসেছিলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে৷ তখন পরিচয় হয়েছিল আমার বয়সি একজন ওয়েটারের সঙ্গে৷ তার ফোন নম্বরও নিয়ে গিয়েছিলাম৷ তারপর যখন বাড়ি থেকে হিরো হতে দেবে না, পড়াশোনাই করতে হবে বলে জেদ ধরল তখন আমি সোজা চলে এলাম এখানে৷ তাও ছয় মাস আছি এখানে৷ আর বছরখানেক পরে মুম্বই৷ তারপর দিদি আমায় পরদায় দেখবেন৷’ সহজের মুখে অনাবিল হাসি৷

সুভদ্রা ভাবছিল, ঠিক কীভাবে সহজকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ওর বাড়িতে৷

শ্মশানের ধারে চুপ করে একটা বেদিতে বসে আছে অরিত্রী৷ শ্মশান শুভময়ের একটা প্রিয় জায়গা৷ ও প্রায়ই একলা এসে বসে থাকত শ্মশানে৷ দাউদাউ করে জ্বলত চিতা৷ সেই চিতার ছবিও এঁকে রেখেছে শুভময়৷ আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্মীভূত হয় মানুষের আজীবন অর্জিত অহংকার৷ সুখ, দুঃখ, আনন্দের অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে পুড়ে যেত৷ এভাবেই কি পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে ভ্রমর আর শুভময়ের ভালোবাসা? চুপচাপ বসে আছে অরিত্রী৷ বাড়ি ফিরতে ভালো লাগছে না ওর৷ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ও জ্বলন্ত চিতার দিকে৷ ক্লান্ত অবসন্ন পা দুটো ওকে নিয়ে যাচ্ছে গঙ্গার ঘাটের দিকে৷

পাহাড়ের এই এক রহস্য, নিজেকে রহস্যময়ী করে রেখে পর্যটককে বিভ্রান্ত করেই যেন আনন্দে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীনচেতার৷ সন্ধের পাহাড় যেমন সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতছানি দিচ্ছিল, ঠিক যেন অভিসারিকার বেশে বাসবদত্তা৷ ভোরের পাহাড় আবার ধ্যানগম্ভীর, পার্থিব জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহ কোনো এক সন্ন্যাসিনী যেন তপস্যায় বসেছেন৷ নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীনা৷ কোনো লোভাতুর আহ্বানেই যেন ভাঙবে না তাঁর কঠিন তপস্যা৷ সুভদ্রা আনমনে ভাবছিল, উৎসব যদি ফোন না করে তাহলে আর উপযাচক হয়ে ফোন করবে না ও৷ এটুকু আত্মসম্মান থাকা উচিত নিজের৷ পাহাড়ের দিকেই একমনে তাকিয়ে ছিল সুভদ্রা৷ কতদিন পরে কলকাতার ব্যস্ততা ছেড়ে নিজেকে একলা করে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পেল সুভদ্রা৷ সাইকোলজি নিয়ে পড়াশানা করে নিজেকেই যদি চিনতে না পারে তাহলে তো নিজের কাছেই হেরে যাওয়া৷ যদিও এই মুহূর্তে সুভদ্রা নিজেকে চিনতে অপারগ৷ কে জানে, গতকাল সন্ধের পর থেকে নিজের মধ্যে একটা অচেনা অস্থিরতার আভাস পাচ্ছে৷ প্রথমে তো মনে করেছিল, নিশ্চুপ জায়গায় একলা থাকায় একাকিত্বের অনুভূতিরা ঘিরে ধরতে চাইছে৷ কিন্তু তারপর বুঝতে পেরেছে, এ অনুভূতিটা হারিয়ে ফেলার ভয়েই হচ্ছে৷ অথবা আরেকটু যদি নিষ্ঠুরভাবে কাটাছেঁড়া করা যায় তাহলে বলতে হয় একজন স্বল্পপরিচিতকে হারানোর ভয়৷

যাকে গতকাল সন্ধে অবধি সুভদ্রা চিনতও না৷

নিজেকেই কি আদৌ ও চেনে ভালো করে? যদি চিনত তাহলে উৎসবকে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বন্ধু ভেবে নিতে পারত না বোধহয়৷ নিজের ওপরেই কেমন একটা বিরক্ত লাগছিল ওর৷ না, নিজে কোনোভাবেই যোগাযোগ করবে না উৎসবের সঙ্গে৷ দেখা যাক-না, সুভদ্রার বন্ধুত্ব আদৌ প্রয়োজন আছে কি না উৎসবের৷ এ তাগিদ যদি একতরফা হয় তাহলে আজকেই এর ইতি টানবে ও৷ দরজায় নক করল কেউ৷ সুভদ্রা দরজা খুলেই দেখল, সহজ দাঁড়িয়ে আছে৷ মুখে অনাবিল হাসি৷ চোখে একরাশ স্বপ্নের আঁকিবুকি, ‘দিদি, একজন আপনার খোঁজে এসেছেন৷ রিসেপশনে ওয়েট করছেন৷’

সুভদ্রা একটু অবাকই হল৷ মানালিতে ওর খোঁজে কারো আসার কথা নয়৷ তাও আবার বিনা ফোনে৷

সহজ উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘নাম বলল উৎসব৷’

সুভদ্রা হেসে বলল, ‘যাক, বন্ধুত্বের পরীক্ষায় পাস করে গেলাম তাহলে৷’

সহজ বলল, ‘দিদি, ডাকব ওঁকে?’

সুভদ্রা ঘাড় নাড়তেই সহজ ছুটল৷ সুভদ্রাকে সহজের বেশ পছন্দ হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে৷ কারণ সুভদ্রা ওর হিরো হওয়ার নেশাকে পাগলামি বলেনি৷ তাই সুভদ্রার সব দিক খেয়াল রাখতে সহজ বদ্ধপরিকর৷

নিজের এলোমেলো চুলগুলো আলগা হাতে ঠিক করে নিতে গিয়েও করল না সুভদ্রা৷ মুখ-চোখের ঘুম-মাখা আলস্যটুকুকেও প্রসাধনের প্রলেপে ঢাকতে ব্যস্ত হল না সুভদ্রা৷ মনকে আর কোনো প্রশ্রয় দিতে নারাজ ও৷

এ বন্ধুত্ব যেন কোনো প্রত্যাশার চাদরে মুড়ে না যায়৷

উৎসব ব্যস্ত হয়েই ঢুকল সুভদ্রার ঘরে৷ গলার স্বরে বেশ টেনশন কাজ করছে৷ সুভদ্রা সহজকে বলল, ‘দু-কাপ কফি পাঠাও, সঙ্গে ব্রেকফাস্ট৷’

উৎসব যেন একটু চঞ্চল৷ কিছু বলতে চায় কিন্তু পারছে না৷

সুভদ্রা বলল, ‘খোঁজ নিয়েছিলেন? ফিরেছে অরিত্রী?’

উৎসব যেন অপেক্ষায় ছিল সুভদ্রার এই প্রশ্নের৷ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘পারমিতাকে কল করেছিলাম৷ ও ভোরে জানাল, এখনও ফেরেনি৷ সারারাত গেল কোথায় মেয়েটা? ওর বাবা-মা থানায় ডায়েরি করেছে৷ বিভিন্ন হসপিটালেও নাকি খোঁজ নিয়েছে৷ এখনও কোনো খোঁজ নেই? কী হতে পারে, বলুন তো? কোনো দুর্ঘটনা নয় তো?’

সুভদ্রা বলল, ‘আমার মনে হয় এটা অভিমানের সময় নয়৷ প্রেমিকা, ব্রেকআপ এসব বাদ দিলেও তো আমরা মানুষ তা-ই না? তাই এই মুহূর্তে একজন পরিচিত হিসাবে অরিত্রীর খোঁজ নেওয়াটা কর্তব্য৷’

উৎসব অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘না না, আমি এখন এসব অভিমান নিয়ে ভাবছিই না৷ পারমিতা কল করেছিল ওর ফোনে৷ ফোন সুইচড অফ বলছে৷ ওর মা জানিয়েছে, ফেরেনি এখনও বাড়িতে৷’

সুভদ্রা বলল, ‘আর কোনো নম্বর জানা নেই আপনার?’

উৎসব যেন ভাবনার সমুদ্রে ডুব দিয়েছে৷ স্মৃতি হাতড়ে চলছে নাকি পুরোনো দিনগুলোতে অবগাহন করতে ভালোই লাগছে ওর৷ মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও তেমন কিছু বুঝতে পারল না সুভদ্রা৷ উৎসবের মুখে হালকা দুশ্চিন্তার ছাপ ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেল না সুভদ্রা৷ উৎসব ঠোঁটে হালকা হাসি নিয়ে বলল, ‘আরেকটা নম্বর আমি জানি ওর৷ ওই সিমটা আমিই দিয়েছিলাম ওকে৷ আসলে আমরা যখন রাতে ফোনে কথা বলতাম তখন নাকি অরিত্রীর মা মেয়ের ফোনে ফোন করে চেক করেছিলেন দু-দিন ফোনটা এনগেজড কি না৷ তাই আমিই ওকে এই সিম সমেত ফোনটা গিফট করেছিলাম৷ ওই পার্সোনাল নম্বরটা শুধু ও আর আমি জানতাম৷’

সুভদ্রার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ‘এত গুরুত্ব পেয়েও আপনাকে হারিয়ে ফেলল অরিত্রী? সত্যিই মেয়েটা বোকা!’ কিন্তু নিজেকে সংযত করে বলল, ‘তাহলে ওই নম্বরেই একটা কল করে দেখুন-না৷’

উৎসব বলল, ‘আমি যদি একটুও ওকে চিনে থাকি তাহলে নিশ্চিত সে নম্বর এখন আর চালু নেই৷ আমার সঙ্গে সঙ্গে সেই নম্বরকেও ও বিদায় দিয়েছে৷’

দীর্ঘশ্বাসটা আর গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করল না উৎসব৷ সুভদ্রার কানে এসে ধাক্কা দিল যন্ত্রণা-মেশানো দীর্ঘশ্বাসটা৷ সুভদ্রা বলল, ‘আমি একবার কল করে দেখব ওই নম্বরে? যদি অরিত্রী রিসিভ করে তাহলে না হয় কেটে দেব৷ আপনার নম্বর থেকে তো কল যাচ্ছে না, তাই সমস্যার কিছু নেই নিশ্চয়ই৷’

উৎসব একটু ভেবে বলল, ‘আপনার আমার ওপরে রাগ হচ্ছে না, সুভদ্রা? এত স্বল্পপরিচিত একজনের কাছে সকাল হতেই নিজের সমস্যা নিয়ে হাজির হওয়া মানুষকে অত্যন্ত স্বার্থপর মনে হচ্ছে না? যদি মনে হয়, নির্দ্বিধায় বলতে পারেন৷ নিজের এই স্বভাবের ওপরে লাগাম টানতে পারি কঠোর হাতে৷ তবে কেন জানি না মনে হল, আপনিই সঠিক মানুষ যার কাছে সবটা বলা যায় নিঃসংকোচে৷’

সুভদ্রা হেসে বলল, ‘মানালিতে এখনও তিন দিন আছি৷ সৌজন্য প্রকাশের সময় পাবেন অনেকটা৷ আপাতত নম্বরটা বলুন৷’

উৎসব নম্বরটা বলল৷ গত ছয় মাসে সে যে ভুলে যায়নি নম্বরটা, তা দেখে নিজেরই অবাক লাগছে৷ সাধারণত ফোন নম্বর একেবারেই মনে থাকে না ওর৷ মোবাইলে লোড থাকার ফলে মনে রাখতেও হয় না সেভাবে৷ তাই ধীরে ধীরে অভ্যেসটাও চলে গেছে৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে অরিত্রীর নম্বরটা মনে রয়ে গিয়েছিল৷ অব্যবহারেও ভুলে যায়নি বহু ব্যবহারের স্মৃতি৷ সুভদ্রা ইশারায় বলল, রিং হচ্ছে৷ স্পিকার করে দিল সুভদ্রা৷ গলাটা অরিত্রীর কি না চিনে নিতে হবে উৎসবকে৷ ফোনে রিং বাজছে৷ সুভদ্রার একটু টেনশন হচ্ছে৷ এ নম্বর নাকি ওরা দুজনে ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি জানত না৷ তবে রং নম্বর তো হতেই পারে৷ পুরো রিং বেজে থেমে গেল৷ উৎসবের দিকে হতাশার চোখে তাকাল সুভদ্রা৷ ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল সুভদ্রার৷ অরিত্রী কল ব্যাক করেছে৷ উৎসব হাত নেড়ে বলল, রিসিভ না করতে৷ তবুও সুভদ্রা অবাধ্য হয়েই ফোনটা রিসিভ করল৷ ওদিক থেকে একজন পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল, ‘কে আপনি?’

সুভদ্রা নরম গলায় বলল, ‘অরিত্রী আছে?’

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এই নামে কেউ নেই এখানে৷’

উৎসব বলল, ‘আমি জানতাম এই সিম, এই নম্বরকে ও আর বাঁচিয়ে রাখবে না৷ যেখানে আমিই মৃত, সেখানে তার স্মৃতি জীবিত থাকবে এ দুরাশা আমি করিনি৷’

সুভদ্রা বলল, ‘তাহলে এখন উপায়?’

একটু যেন কঠোর গলাতেই উৎসব বলল, ‘চলুন, আজ হিড়িম্বা টেম্পলস ঘুরে আসি৷ রেডি হয়ে নিন, আমি বাইরে ওয়েট করছি৷’

সুভদ্রা বুঝল, আর অরিত্রীর আলোচনা চাইছে না উৎসব৷ টেনশন হলেও অপমান চাইছে না৷ সুভদ্রা কাচের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, আকাশের রং আজ মেঘলা৷ একটু যেন মন-খারাপি সুর বাজছে আকাশের বুকে৷ অথবা সারারাত বৃষ্টি হয়ে একটু মলিন হয়েছে৷ এ সময় উগ্র রঙের পোশাক বড়ো বেমানান৷ চা-পাতা রঙের একটা পুলওভার গায়ে চাপিয়ে স্নিকার দুটো পায়ে গলাতে গলাতেই ভাবল, সহজের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে উৎসবের৷ ও যদি ছেলেটাকে বাড়ি ফেরানোর কোনো রাস্তা খুঁজে বের করতে পারে তাহলে মন্দ হয় না৷

উৎসব ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আকাশের না হয় মন-খারাপ, হয়তো পাহাড়েরও, কিন্তু আপনার মন-খারাপ কেন সেটা বলুন দেখি?’

সুভদ্রা বলল, ‘মন-খারাপ কেন হবে?’

উৎসব বাইরে পাহাড়ের বাঁকের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, ‘তাহলে ঠোঁটের সেই সবজান্তা হাসিটা মিসিং কেন? না মানে কে সুইসাইড করতে চাইছে, কার ব্রেকআপ হয়েছে, কে চাকরি খুঁজছে এসব বুঝে নিয়ে যে হাসিটা হাসেন সেটা নেই কেন?’

সুভদ্রা উৎসাহ পেয়ে বলল, ‘আসলে সহজের কেসটা নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় আছি৷ এত কম বয়েসে এমন ভাবনায় ডুবেছে ছেলেটা—কী করে যে ওকে বোঝাব, কে জানে!’

উৎসব বলল, ‘সহজ, সেটা আবার কে? আপনি তো মানালি এলেন মাত্র দু-দিন৷ এসেই সহজ-কঠিন সব জুটিয়ে ফেললেন কী করে বলুন তো? ট্যালেন্ট নিয়ে কোনো কথা হবে না কিন্তু৷ মানালি এসেই আমায় বাঁচালেন মৃত্যুমুখ থেকে৷ আবার কোন সহজকে কঠিন করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন৷’

সুভদ্রা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আপনি যেভাবে একা একা বিয়াসের ধারে বসে ছিলেন, তাতে ওটা সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয় কিন্তু৷ তবে এটা একবারে জেনুইন কেস৷ ছেলেটা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে, হিরো হবে বলে৷ এই হোটেলে ওয়েটারের কাজ করছে৷ বাবা মেদিনীপুরের একটা স্কুলের শিক্ষক, মা-ও গানের দিদিমণি৷ সহজ ওদের একমাত্র সন্তান৷ সে দীর্ঘদিন ধরে বাড়িছাড়া৷ ভাবতে পারছেন ওর বাবা-মায়ের অবস্থাটা? এখুনি আসবে ব্রেকফাস্ট নিয়ে আমার ঘরে৷ একটু কথা বললেই বুঝতে পারবেন, আবেগে ভাসছে ছেলেটা৷’

কথা বলতে বলতেই আনমনে উৎসব দুবার নিজের মোবাইল চেক করল৷ সম্ভবত অরিত্রীর কোনো খবর পাওয়ার আশায় উন্মুখ৷

সহজ আসতেই ইশারা করল সুভদ্রা৷ উৎসব সজাগ হয়ে বলল, ‘আসলে ফিলম ইন্ডাস্ট্রিটা এখন আর আগের মতো নেই, সুভদ্রা৷ এখন এখানে রীতিমতো অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা-করা ছেলে-মেয়েরা চান্স পাচ্ছে৷ আমাদের কলকাতাতেই তো অভিনয় শেখানো হয় বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনে৷ সেখানে সব নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রী ক্লাস নেন৷ ডান্স অ্যাকাডেমিও আছে৷ ফিলমের প্রয়োজনে ডান্সও শিখিয়ে নেয় ওরা৷ এখন আর না শিখে আচমকা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে লাভ নেই৷ ফ্লোর বয় করে রেখে দেবে৷ আমার এক বন্ধুর ভাই তো পুনেতে পড়াশানা করছে এই নিয়ে৷’

সহজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার কাছেই৷ হাতের ট্রে-তে ওদের ব্রেকফাস্ট৷

সুভদ্রা ওকে দেখেই বলল, ‘এসো এসো সহজ৷ এই তোমার কথাই বলছিলাম আমার বন্ধুকে৷ তুমি হিরো হতে চাও, অভিনয় করতে চাও—এগুলোই বলছিলাম৷’

সহজ দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘ডিগ্রি না থাকলে অভিনেতা হওয়া যায় না, স্যার?’

উৎসব বলল, ‘আরে তোমার যা বয়েস তাতে সময় তো প্রচুর পাবে৷ বছর দুয়েকের গোটা দুই কোর্স করে নিলেই তো মিটে যাবে৷ নিজেকে একটু তৈরি করে নেওয়া আর কি৷ বাদবাকি ঈশ্বরের আশীর্বাদে চেহারাটা তো হিরোর মতোই৷’

সহজের কপালে একটা ছোট্ট ভাঁজ পড়ল৷ সুভদ্রা নিশ্চিন্ত হল ওটা দেখে৷ যাক, ভাবানো গেছে অন্তত ওকে৷ সহজ বলল, ‘কিন্তু তাহলে তো বাড়ি ফিরতে হবে আমায়?’

বাড়ি ফেরার কথা ভাবলেই অরিত্রীর গলার কাছটা বিতৃষ্ণায় তেতো হয়ে ওঠে৷ সেই বাবা-মায়ের ইগো৷ সেই মায়ের ওকে নিয়ে অযথা আদিখ্যেতা৷ এগুলো দেখে দেখে ও জাস্ট বিরক্ত হয়ে গেছে৷ ইদানীং বাড়ি মানে ওর কাছে ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচার একটা আস্তানামাত্র৷ যতদিন পর্যন্ত ঠাম্মি ছিল ততদিন পর্যন্ত বাড়িটাকে তবুও আপন মনে হত৷

পিছন থেকে কেউ একজন চিৎকার করছে, ‘আরে আরে, গঙ্গায় জোয়ার আছে৷ নামছেন কেন ওদিকে? আরে ম্যাডাম, আপনাকে বলছি৷ সারারাত তো আপনি শ্মশানে কাটিয়েছেন বোধহয়৷’

অরিত্রী পিছন ঘুরে দেখল, একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ওর দিকেই এগিয়ে আসছে৷ এই হয়েছে আরেক মুশকিল৷ মানুষের প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করা৷ অচেনা কোনো মহিলাকে দেখলেই এদের উপকার করার নেশা চেপে বসে৷ অরিত্রী ওর কথায় কান না দিয়েই গঙ্গার দিকে এগিয়ে গেল৷ ভোরের আলো এখনও ঠিকমতো ফোটেনি৷ রাতেও একবার গঙ্গায় নামার চেষ্টা করেছিল ও৷ কিন্তু কয়েক পা এগোতেই দুজন ভদ্রলোক ওকে নিষেধ করেছিল৷ তাই নামা থেকে বিরত থেকেছে৷ এখন শ্মশানটা সারারাতের ক্লান্তি মেখে, পোড়া-পোড়া গন্ধের মধ্যেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছে৷ এখুনি হয়তো ‘বলো হরি, হরিবোল’ বলে কেউ এসে ভেঙে দেবে এই সামান্য নিস্তব্ধতাটুকুও৷ এই ঝুম-ধরে-থাকা পরিবেশে অরিত্রী একেবারেই নতুন৷ চারিদিকে শুধুই হারানোর রিক্ততা৷

বাতাসে দীর্ঘশ্বাস৷ আচ্ছা, শুভময় কেন এসে বসে থাকত এমন জায়গায়? শুধুই ছবি আঁকবে বলে? নাকি ভ্রমরকে হারানোর কষ্টের থেকেও বড়ো কষ্টকে চাক্ষুষ করবে বলে? শুভময় শ্মশান থেকে কখনো স্নান না করে বাড়ি ফিরত না৷ বাড়ি ফিরে শিবের মূর্তির সামনে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকত শুভময়৷ শিব যে ওর ইষ্টদেবতা—এমন নয়৷ শুভময় হচ্ছে ঘোর নাস্তিক৷ কলেজ লাইফ থেকে কমিউনিস্ট হওয়ার ফলেই হয়তো নাস্তিক৷ তবুও শিবকে বড্ড ভাল লাগত শুভময়ের৷ ও বলত, শিব একটা শক্তির নাম৷ শুধু গড়া নয়, ভেঙে তছনছ করে দিতেও পারে৷ ওর রংতুলির সঙ্গে মিল আছে৷

তুলি যেমন সাদা ক্যানভাসে ঘর গড়তে পারে, পাততে পারে সাজানো সংসার৷ তেমনি অভিমানী তুলি আবার ধ্বংস করে দিতে পারে সাজানো ক্যানভাসের রঙিন সংসারকে৷ হয়নো কালো রঙের পোঁচ টেনে নষ্ট করে দিল মাসখানেকের পরিশ্রম৷ শিবও যেন এমনিই, নিজের ইচ্ছের মালিক৷ শক্তিশালী, খামখেয়ালি বলেই শিবকে এত পছন্দ শুভময়ের৷ গঙ্গার সিঁড়িতে পা রাখতেই ভদ্রলোক প্রায় ছুটে এসে দাঁড়াল ঘাটের কাছে, ‘আরে করেন কী ম্যাডাম? গঙ্গায় স্রোতের টান আছে৷ নামলে বিপদ৷ দেখুন, আমি আপনাকে চিনি না ঠিকই, কিন্তু এত মৃত্যু দেখার পরে আবারও মৃত্যু হতে দেখব এতটাও ইনসেন্সিটিভ নই আর কি!’

অরিত্রী অন্যমনস্কের গলায় বলল, ‘আপনি কেন এখানে এসেছেন? কেউ মারা গেছেন কি আপনার?’

ভদ্রলোক আদিগন্ত গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার স্ত্রী-র জন্য আসি৷ ওকে হারিয়েছি মাত্র বছরখানেক আগেই৷ কিডনির প্রবলেম ছিল৷ সঙ্গে খুব পজেসিভ৷ ওর মনে হত ও মারা গেলে আমি আবার বিয়ে করব, ওকে ভুলে যাব৷ তাই অফিস থেকে ফিরে, মেয়ের দেখাশোনা করে, এখানে এসে একবার করে ঘুরে যাই৷ যাতে ও না ভাবে, আমি ওকে ভুলে গেছি৷ এখানেই ওকে শেষ দেখেছিলাম কি না৷ গতকাল ওর জন্মদিন ছিল৷ তাই রাত বারোটায় এসেছিলাম উইশ করতে৷ তখন থেকেই দেখলাম, আপনি চুপ করে ঘাটের ধারে বসে আছেন৷ বাড়ির কারো কিছু হয়েছে?’

ভদ্রলোকের কথা শুনে অরিত্রীর খারাপ লাগছিল৷ মুখই নাকি মনের আয়না, কিন্তু সব সময় মানুষের মুখ দেখে বোঝা সম্ভব নয় তার মনের অলিগলিতে কতটা অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে৷ ভদ্রলোকের মুখে ভোরের আলো এসে পড়েছে৷ না-ঘুমোনো চোখ দুটোতে অনেকটা ক্লান্তি জমে আছে৷ অরিত্রী জানত না শ্মশানেও জীবন্ত স্মৃতিরা ঘুরপাক খায়৷ ও ভাবত মৃত্যুই বুঝি শেষ কথা৷ অরিত্রী বলল, ‘আমি স্নান করতে নামছি৷’

ভদ্রলোক বললেন, ‘অভ্যেস নেই তো আপনার তাই স্রোতের টান সামলাতে পারবেন না হয়তো৷ এমনি মাথায় জল দিয়ে উঠে আসুন বরং৷ কিছু মনে করবেন না, স্কুলজীবনে বড্ড দামাল ছিলাম৷ বন্ধুরা গঙ্গায় সাঁতারও কেটেছি৷ তখনই আমাদের এক বন্ধুকে এই জোয়ারই টেনে নিয়েছিল৷ আমরা তিনজন চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি৷ তখন আমরা ক্লাস নাইন৷ গঙ্গা যেমন পবিত্র তেমনই ভয়ংকর৷ তারপর থেকে আর নামিনি গঙ্গায়৷ আচ্ছা ম্যাডাম, আমি চলি৷’

অরিত্রী ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করল না৷ থাক, আচমকা পরিচয়ের রেশ টেনে লাভ নেই৷ এভাবেই শেষ হওয়া ভালো৷ ভদ্রলোক চলে গেল৷ অরিত্রীও বাধ্য মেয়ের মতো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মাথায় জলের ছিটে নিয়ে উঠে এল৷ দমবন্ধ লাগছে ওর৷ আবারও কানে ভেসে আসছে হিমশীতল মৃত্যুর ডাক৷

তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বড়োরাস্তায় উঠল ও৷

ফোন সুইচড অফ হয়ে গেছে কখন যেন৷ উবের বুক করার উপায় নেই৷ একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে বাড়ির ঠিকানা বলল৷ বাড়িতে ঢোকার পরে বাবা-মা যে নাটকটা করবে সেটা ওর অজানা নয়৷ তবুও যেন আজ মনটা বিদ্রোহ করে উঠল৷ নিজের খেয়ালের মালিক হতে ইচ্ছে হল ওর৷ নিজের ইচ্ছাকে প্রায়রিটি দিতে মন চাইল৷ ফ্ল্যাটের দরজা খোলা৷ ড্রয়িং রুমে বাবা-মা ছাড়াও পাশের ফ্ল্যাটের জেঠু বসে আছেন৷ জেঠুর ছেলে প্রশাসনে আছে৷ ওই কারণেই হয়তো মা ডেকেছে জেঠুকে৷ ওকে দেখেই মা ছুটে এল৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সারারাত ঘুমোয়নি৷ কিন্তু কেন কে জানে, আজ আর মা-বাবার এই নির্ঘুম চেহারাটা দেখে ওর কষ্ট হচ্ছে না৷ বরং ছোটোবেলায় ওর যেদিন একা একা ঘুম আসত না, সেদিন ও চাইত, বাবা অথবা মা কেউ একজন ওর পাশে এসে শুয়ে থাকুক৷ কিন্তু তখন ওদের কাজ ছিল৷ ফাইল বা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকত ওরা৷ কেউ যেন কাউকে এক ইঞ্চি ছাড়তে রাজি ছিল না৷ দুজনকেই কেরিয়ারের টপে উঠতে হবে এটাই ছিল দুজনের প্রতিযোগিতা৷ ও যে একা একা বড়ো হচ্ছিল সেটা বোধহয় কেউই খেয়াল করেনি৷ তখনকার অন্ধকার দীর্ঘ রাতগুলোতে ঘুমহীন চোখে ভয় পেত ও৷ আজ না হয় একটা রাত ফিরিয়ে দিল ওদের৷ আজ না হয় একটু ভয়, অল্প আতঙ্ক ফিরিয়ে দিল ওদের, তাতেও তো পড়ে থাকে অনেকগুলো দিন-রাত-বছরের হিসেব৷

মা এসে উদবিগ্ন গলায় বলল, ‘কী রে, কোথায় ছিলিস রাতে? ফোনের সুইচড অফ কেন তোর? কোনো বিপদ হয়েছিল নাকি?’

মজা লাগছে অরিত্রীর৷ সকলের চিন্তাগ্রস্ত মুখটা দেখতে৷ ভালো মেয়ে, শান্ত মেয়ে, বাধ্য মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে ও জাস্ট ক্লান্ত হয়ে গেছে৷ আজ একদিন অবাধ্য হয়ে মন্দ লাগছে না৷ বাবার ভ্রূ-র মাঝে সেই বিরক্তিসুলভ চিহ্নটা আর নতুন লাগে না ওর৷ বাবার ডেইলি রুটিন যদি কোনো কারণে এক ফোঁটাও ঘেঁটে যায় তাহলে এই বিরক্তির চিহ্নটা স্পষ্ট হয়৷ ছোটোবেলায় বাবার কপালে এই ভাঁজ দেখলে নিজের ভুল খুঁজে যেত অরিত্রী৷ মনে ভাবত, ওরই কোনো দোষে হয়তো বাবা এমন গম্ভীর হয়ে আছে৷ তারপর বুঝেছিল, বাবার রুটিনের পরিবর্তন যার কারণে হয় তার ওপরে বাবা রেগে থাকে৷ অরিত্রী চেষ্টা করত, কোনো কারণেই যেন বাবা ওর ওপরে রেগে না থাকে৷ কিন্তু একদিন মাঝরাতে ওর জ্বর এসেছিল৷ ডাক্তারকাকুকে ডেকে আনতে হয়েছিল, সেদিনও বাবার ভ্রূ-র ভাঁজে ওই বিরক্তিচিহ্ন দেখেছিল ও৷ আজ অবশ্য এই পরিচিত চিহ্নটা দেখে মোটেই উদগ্রীব নয় ও৷

মা-কে খুব ক্যাজুয়ালি বলল, ‘একটু কাজ ছিল৷’

বাবা আর সময় নষ্ট না করে বলল, ‘ফোন করে জানিয়ে দাওনি কেন? অযথা আমাদের হ্যারাস করার কোনো কারণ আছে কি?’

অরিত্রী হেসে বলল, ‘আমার জন্য তোমরা চিন্তিত হয়েছ এটা একেবারেই আনকোরা নতুন ঘটনা আমার কাছে৷ জানা ছিল না৷ ভবিষ্যতে রাতে বাইরে থাকলে কল করে দেব৷’

 মা কিছু বলতে যাচ্ছিল, মা-কে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরিত্রী বলল, ‘আমি স্নান করতে ঢুকছি৷’

জেঠুর সামনে মেয়ের এমন উদ্ধত ব্যবহারে দুজনেই যে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে, সেটা পিছন ঘুরে যেতে যেতেও ফিল করল অরিত্রী৷ শাওয়ারের ঠান্ডা জল গায়ে পড়তেই গতকালের সমস্ত দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ আচ্ছা, ওটা সত্যিই শুভময় নয় তো? কোনো কারণে হয়তো স্বীকার করতে চাইল না৷ শুভময়ের অল্প বয়েসের ছবিটার সঙ্গে মেলাতে হবে একবার৷ শুভময় কি ওকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকতে চায়? কিন্তু কেন শুভময় অস্বীকার করতে চাইছে তার ভ্রমরকে?

‘এই শুভময়টা কে, তুমি কিছু জানো, পারমিতা? মানে ঝুমঝুম কি তোমায় কিছু বলেছে এ ব্যাপারে?’

পারমিতা ক্যাপুচিনোতে হালকা করে চুমুক দিয়ে বলল, ‘না আন্টি’৷ আসলে আমি ওকে আনমনে ডায়েরিতে লিখতে দেখেছি— শুভময়৷ স্কুল-কলেজ বা ইউনিভার্সিটির কেউ নয়৷ তাহলে আমি জানতে পারতাম৷ উৎসবদাও বলল, ওকেও নাকি এই নামটাই বলেছে অরিত্রী৷ শুভময়কে ফিরে পেতে ও সব ছাড়তে পারে৷’

ঈশানী অধৈর্যের গলায় বলল, ‘আমাদের কোনো রিলেটিভদের মধ্যেও নয়৷ কে এই শুভময়? উৎসব ছেলেটাকেও আমি চিনতাম না, কিন্তু ছেলেটার সঙ্গে একটু কথা বলেই বুঝলাম, বেশ ভালো ছেলে৷ বিশেষ করে আবেগকে কন্ট্রোলে রাখতে পারে৷ অরিত্রী ওর সঙ্গে যা করেছে, তারপরে উৎসব আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেই পারত৷ কিন্তু ওর পারিবারিক শিক্ষা যে ভালো সেটা ওর সামান্য কয়েকটা কথাতেই বুঝতে পারলাম৷ হঠাৎ কী হল ঝুমঝুমের? উৎসবের সঙ্গে ব্রেকআপের কারণটা ঠিক কী, তুমি কি জানো?’

পারমিতা বলল, ‘আন্টি, ঠাম্মা মারা যাবার মাস দুয়েক পর থেকেই ওর মধ্যে একটু একটু পরিবর্তন লক্ষ করছিলাম৷ প্রথমে তো ও আপসেট ছিল খুবই৷ ও ঠাম্মার আদরের ছিল, তাই ভেবেছিলাম বিষয়টা ন্যাচারাল৷ কিন্তু ও যখন ঠাম্মার অল্প বয়েসে পরা শাড়িগুলো পরে ওরকম সেজে ইউনিভার্সিটিতে আসতে শুরু করল তখন অবাক হলাম৷ অমন স্টাইল কনসার্নড মেয়ের এহেন পরিবর্তনটা আমাদের অনেকেরই চোখে লেগেছে৷ যেহেতু আমি ওর বেস্টি তাই অনেকেই আমায় জিজ্ঞাসা করেছে৷ আমিও অরিত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হঠাৎ এমন পুরোনো দিনের নায়িকার মতো সাজগোজ কেন রে? ও হেসে বলেছিল, একটা পুরোনো মানুষের খোঁজ পেয়েছি৷ বলতে পারিস, প্রেমিক পুরুষের খোঁজ পেয়েছি৷ প্রেম কত পবিত্র হয়, তোর ধারণা আছে পারো? নেই তা-ই না? কারণ এখনও অবধি আমরা যে ক-টা প্রেম দেখেছি সেটা দু-তরফে দেখেছি৷ কিন্তু কোনোদিনই তারা এক হবে না জেনেও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সেভাবে দেখিনি, তা-ই না?

‘আমি বলেছিলাম, উৎসবদা তোকে সত্যিই খুব ভালোবাসে৷ অরিত্রী হেসে বলেছিল, বললাম না এ প্রেম সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই৷ এ প্রেমিকের কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল না, শুধুই অর্ঘ্য সাজিয়ে নিবেদনের আগ্রহ ছিল৷

‘সত্যি বলতে কী আন্টি, এত দার্শনিক ভাবনাচিন্তা ওর মধ্যে আমি আগে দেখিনি৷ হ্যাঁ, ওর পার্সোনিলিটি আর পাঁচটা মেয়ের থেকে একটু আলাদা ঠিকই, কিন্তু এতটা গম্ভীর ওকে স্কুল থেকে কলেজ কখনো দেখিনি৷ তারপর তো বেশ বুঝতে পারছিলাম, ও আমায় ইগনোর করছে৷ ওই দায়সারা কথা বলছে৷ তাও আমি উপযাচক হয়ে কথা বললে উত্তর দিচ্ছে৷ একটা যেন ঘোরের মধ্যে আছে৷

‘একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেই দিল, ও এ জীবনের অনেক কিছুই বর্জন করতে চায়৷ তার মধ্যে উৎসবদা আর আমিও পড়ি৷ আপনিই বলুন আন্টি, এরপর কোনো আত্মসম্মানী মানুষ অরিত্রীর সঙ্গে কথা বলবে? তাই আমিও সরে গিয়েছিলাম৷ ওই জাস্ট হাই, হ্যালো ছাড়া কথা হয়নি বিশেষ৷ ও নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে৷ ওর আড়ালে ওকে নিয়ে যে ক্লাসসুদ্ধু ছেলে-মেয়ে হাসে সেদিকে ওর নজর নেই৷ সেই পাতা-কাটা চুল, সেই ব্রোচ-লাগানো শাড়ি পরেই আসছে৷ তারপর শুনলাম, উৎসবদাকেও নাকি বলেছে, ওর দূরত্ব দরকার৷ এই সম্পর্কে ও নাকি হাঁপিয়ে উঠেছে৷ উৎসবদা প্রশ্ন করায় বিরক্তি প্রকাশ করেছে৷’

ঈশানী চিন্তিত গলায় বলল, ‘আমাদের সম্পর্কে কখনো বলেনি কিছু? দেখো পারমিতা, তুমি তো জানো, চাকরির কারণে আমি আর ওর বাবা দুজনেই ওকে সময় দিতে পারিনি তেমন৷ এটা হয়তো ওর একটা ক্ষোভের জায়গা৷ আমি ভাবছিলাম, এই কারণে ব্যবহারের পরিবর্তন হচ্ছে কি না? সবটাই আন্দাজে বোঝার চেষ্টা করছি আর কী! কারণ ঝুম তো একটা কথারও উত্তর দিল না৷ কাল রাত থেকে এতবার জিজ্ঞাসার পর আলগোছে বলল, কাল রাতে নাকি ও শ্মশানে কাটিয়েছে৷ কী ভয়ংকর! হঠাৎ শ্মশানে কেন গেল সেটাই তো বুঝলাম না৷’

পারমিতা উদাস গলায় বলল, ‘বড্ড মিস করি ওকে আমি, আন্টি৷ কিন্তু ও এমনভাবে মুখের ওপরে দরজাটা বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে যে কিছু করতেও পারি না৷ উৎসবদাও খুব আপসেট ছিল৷ এখন আস্তে আস্তে কাজে ফিরছে৷ কেন যে নিজের জীবনটা নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলছে ও, কে জানে! এই শুভময়ের বাড়ি কোথায় কেউ জানে না৷’

ঈশানী ঠান্ডা-হয়ে-যাওয়া কফিতে চুমুক দিয়ে ঠোঁটে বিরক্তির ভঙ্গিমা ফুটিয়ে বলল, ‘এ হে, ঠান্ডা হয়ে গেছে৷’

 কাপটা টেবিলে নামিয়ে ঈশানী বলল, ‘আসলে কী জানো পারমিতা, আমার দৃঢ় ধারণা, ঝুমঝুম কোনো এজেড ছেলের ট্র্যাপে পড়েছে৷ ওর যে টাকার অভাব নেই সেটা সে ছেলে বুঝে গেছে৷ তাই যারা ওর শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের প্রথমে সরিয়ে দিল ঝুমের জীবন থেকে৷ যেমন তুমি, উৎসব৷ আমরা তো ছেড়েই দাও, টুসি, যে ওকে ছোটো থেকে গান শেখাত, যার সঙ্গে ও বন্ধুর মতো মিশত, তাকেও নাকি বলেছে, সকলের থেকেই একটু দূরত্ব মেইনটেইন করছে ও৷ ঠিক কী কারণে এই দূরত্বের দরকার হচ্ছে ওর এটাই তো অদ্ভুত রহস্য৷’

পারমিতা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘অঙ্কিতাকে নাকি সেদিন অরিত্রী বলেছে, ওকে যেন ভ্রমর বলে ডাকে ও৷ ওকে তো বোধহয় এ নামে একমাত্র ওর ঠাকুমাই ডাকতেন৷ হঠাৎ এই নাম নিয়ে এত অবসেশন কেন সেটাও তো বোঝা যাচ্ছে না, আন্টি৷’

ঈশানী বলল, ‘হ্যাঁ জানি, ও আমাকেও ওই ভ্রমর নামেই ডাকতে বলেছে৷ আচ্ছা পারমিতা, এই উৎসব ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলে হয় না, কে এই শুভময়?’

পারমিতা বলল, ‘উৎসবদা জানে না৷ তবে আমি অনেক খুঁজে বের করেছি ছেলেটা একজন শিল্পী৷’

ঈশানী বলল, ‘হ্যাঁ, ছবি আঁকে৷ ঝুমঝুমের ঘরে বেশ কিছু আঁকার ছবি পেয়েছি৷ বেশির ভাগই একটা বিশাল মন্দির চত্বর, তার মধ্যে দিয়ে একটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে৷’

ঈশানী হঠাৎই চুপ করে গিয়ে ক্যাফের জানালার দিকে দৃষ্টি স্থির করল৷ পারমিতা সেদিকে তাকিয়ে দেখল, ফুটপাতে বেশ কিছু কাগজ হাতে অরিত্রী হকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে৷

ঈশানী আর পারমিতা বিল মিটিয়ে চোখে অনন্ত কৌতূহল নিয়ে অরিত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ ওর কোনো হুঁশ নেই৷ ঈশানী দেখল মেয়ের হাতের কাগজগুলো আসলে কবিতার কাগজ৷ অরিত্রী পথচলতি মানুষের মধ্যে সেগুলো বিতরণ করতে ব্যস্ত৷ না, টাকা নিচ্ছে না৷ হকার নয়, লিফলেট বিলি করছে৷ পারমিতা দেখল, জেরক্স পেপারে কবিতা ছাপা৷ নীচে লেখা—ভ্রমরের শুভময়৷ তার মানে এগুলো শুভময়ের লেখা কবিতা৷ অরিত্রী সকলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় কাকুতিমিনতি করে বলছে, ‘একবার পড়ে দেখবেন প্লিজ, এ কবিতায় কবি তার প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলেছে, তার যন্ত্রণার কথা লেখা হয়েছে কবিতার মাধ্যমে৷’

 বিনা পয়সায় বলে অনেকে নিচ্ছে৷ সুন্দরী মহিলা বিলি করছে বলে অনেকে নিচ্ছে, আবার অনেকে তাড়ায় আছে, তাই বেশি কথা বাড়াতে চায় না বলে নিচ্ছে৷

ঈশানী মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ কী অদ্ভুত আকুতি ওর চোখ দুটোতে৷ এই কবিতার কাগজ লোকের হাতে না পৌঁছোলে যেন অনেক কিছুই অধরা রয়ে যাবে৷ ঈশানী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ পায়ে যেন এক ফোঁটা জোরও অবশিষ্ট নেই৷ এ কোন ঝুমঝুমকে দেখছে ঈশানী? যে মেয়েটা বাড়ির গাড়ি ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না, চিকেন স্টু লাঞ্চে না পেলে যে ‘আর কিছু খাব না’ বলে দেয়৷ ডাইনিং-এর এসি কোনো কারণে একদিন খারাপ হলে যে খাবারের থালা নিয়ে নিজের ঘরের এসি-তে বসে খায়, সেই মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গরম, ধুলো উপেক্ষা করে শুভময়ের কবিতার কাগজ বিলি করছে! নিজের মেয়েটাকে এত অপরিচিত এর আগে কখনো লাগেনি ঈশানীর৷ ঝুমঝুম গম্ভীর ছিল অন্যদের থেকে বেশি৷ একটু ইন্ট্রোভার্টও৷ কিন্তু নিজের পছন্দ-অপছন্দ চিরকালই সোচচারে বুঝিয়ে দিয়েছে৷ এমন পাগলামি কেন করছে ওই শুভময় নামক অচেনা ছেলেটার জন্য? কদিন চেনে ও তাকে?

পারমিতা নিজের ইগো ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে গিয়ে হাত পাতল৷ অরিত্রী একটা কবিতার কাগজ ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘পড়ে দেখবেন৷ এটা আমার শুভময়ের লেখা কবিতা৷’

পারমিতাকে ভালো করে লক্ষই করেনি অরিত্রী৷ পারমিতা বলল, ‘এগুলো তুই বিলোচ্ছিস কেন রে? শুভময় তোকে দায়িত্ব দিয়েছে বুঝি?’

অরিত্রী হেসে বলল, ‘তুই না চিরটা কাল বড্ড বোকা রয়ে গেলি৷ শুভময় যে কবিতা লেখে এটাই তো লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল৷ ও হচ্ছে শিল্পী৷ নিজের খেয়ালে আঁকে, নিজের খেয়ালে কবিতা লেখে, ও মোটেই প্রচার চায় না৷ কিন্তু ওর জীবনসঙ্গিনী হিসাবে আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে না কী? আমি চাই-এ কবিতা মানুষের ভাবনাকে তীব্রভাবে ঝাঁকুনি দিক৷ মানুষের মননে, চিন্তনে ওই কবিতার লাইন ঘুরুক৷ আমি তো দুজন প্রকাশকের সঙ্গেও কথা বলেছি৷ এগুলো বই আকারে প্রকাশ করব বলে৷’

পারমিতা কাগজটা উলটে-পালটে বলল, ‘নিজের ফোন নম্বর কেন দিয়েছিস এই কাগজে?’

 অরিত্রী হেসে বলল, ‘এই মানুষগুলো ফোন করে আমায় পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে৷ শুভময়ের কবিতা লোকজনের মধ্যে কতটা আলোড়ন তুলল, জানতে হবে না আমায়?’

পারমিতা অপলক তাকিয়ে আছে ওর সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েটার দিকে৷ এই মেয়েটাই স্কুল লাইফ থেকে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড? যে নিজের ফোন নম্বর বন্ধুদের সঙ্গেও শেয়ার করতে চাইত না৷ বলত, ব্যক্তিগত সবকিছুকে পণ্য করার দরকার আছে কি?

সে আজকে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের ফোন নম্বর বিলি করছে? এবারে তো শুভময় ছেলেটাকে দেখতেই হচ্ছে পারমিতার৷ একটা মানুষকে আমূল বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে ছেলেটা৷

পিছন ফিরে দেখল, আন্টি ওকে ইশারা করছে৷ পারমিতা কাছে যেতেই বলল, ‘একটা কবিতার কাগজ আমায় দাও৷ এই শুভময়কে খুঁজে বের করতেই হবে৷ না হলে আমার ঝুমঝুম বদলে যাচ্ছে৷ দেখি, একবার একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷ মেয়েটা অদ্ভুত একটা মোহের মধ্যে আছে৷’

পারমিতা বলল, ‘আন্টি, ওকে ডাকলে কি আমাদের সঙ্গে গাড়িতে যাবে?’

ঈশানী ক্লান্ত গলায় বলল, ‘উহুঁ, গাড়ি এখন ওর কাছে বিলাসিতা৷ ও নিজেকে ভাঙছে, নিজেকে পরিবর্তন করতে চাইছে, রাস্তায় হাঁটতে চাইছে৷’

পারমিতা আর ঈশানী বাকি রাস্তাটা চুপ করেই কাটিয়ে দিল৷ অরিত্রীকে এইভাবে দেখে দুজনেরই আর কোনো কথা নেই৷

‘হ্যালো উৎসবদা, আমি আর আন্টি কাল বসেছিলাম অরিত্রীকে নিয়ে আলোচনায়৷ আন্টিও শুভময় বলে কাউকে চেনে না৷ তবে ওই শুভময় ছবি আঁকে আর কবিতাও লেখে৷ তোমায় একটা কবিতা হোয়াটসঅ্যাপ করেছি, দেখো৷ অরিত্রী রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই কবিতা লিফলেট আকারে বিলি করছিল৷ কিন্তু এই শুভময়কে কেউই চেনে না৷ আন্টি আজ ওর ঘর খুঁজে একটা সাদা-কালো ছবি আবিষ্কার করেছে, ছবিটা তোমায় পাঠালাম৷’

সুভদ্রা তাকিয়ে আছে উৎসবের দিকে৷ এ কদিনে সুভদ্রার সামনে অন্তত বার দশেক বলেছে উৎসব অরিত্রী সম্পর্কে লেস ইন্টারেস্টেড৷ কারণ অপমান ভুলে যাওয়া ওর স্বভাব নয়৷ অথচ অরিত্রী সম্পর্কিত ফোন এলেই গলার স্বর বদলে যায় উৎসবের৷ কিছুতেই গলার উদবিগ্ন ভাবটা কাটিয়ে উঠে নিস্পৃহ হতে পারে না৷

সুভদ্রা আছে বলেই পারমিতাকে বলল, ‘ওর জীবন যেভাবে ইচ্ছে কাটাক৷’ যদিও ওই অরিত্রীকে কল্পনা করতেই ওর কষ্ট হচ্ছে৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে উপযাচক হয়ে পথচলতি লোকজনকে কবিতার কাগজ বিলোচ্ছে? উৎসবের সঙ্গে অপেক্ষা করার সময় কখনো কালেভদ্রে পাঁচ মিনিট দেরি হলে অরিত্রী রেগে যেত৷ ওর নাকি পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে থাকতে একেবারেই ভালো লাগে না৷ এটাই জানত উৎসব এতদিন৷ কে এই শুভময়? কার জন্য নিজেকে এভাবে বদলাতে হচ্ছে অরিত্রীকে?

হোয়াটসঅ্যাপটা খুলতেই একটা কবিতার পাতার ছবি এল৷ নীচে একটা সাদা কালো ছবি৷ ছেলেটার চেহারাটা ভীষণ আকর্ষণীয়৷ কিন্তু স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে উত্তম-সৌমিত্রের আমলের৷ বড্ড সেকেলে টাইপ জুলপি থেকে চুলের স্টাইল৷ ওহ, এইজন্যই অরিত্রী নিজেকে পরিবর্তন করতে বদ্ধপরিকর৷ নিজের স্মার্ট লুক ভেঙেচুরে আগেকার সাজপোশাক পরে, হেয়ারস্টাইল পালটে বদলাতে চাইছে নিজেকে৷ না হলে এই শুভময়ের পাশে ওকে বড়ো বেমানান লাগবে৷

এবারে আসল কারণটা বুঝতে পারল উৎসব৷ কিন্তু হঠাৎ এই ছেলেটিকে পছন্দ হওয়ার কারণ কী? ভালো ছবি আঁকে আর ভালো কবিতা লেখে বলে?

সুভদ্রা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সহজ উৎসবের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওহ, এ তো রাঙাদাদুর ছবি৷ আপনারা চেনেন?’

সহজের কথায় চমকে উঠেছে উৎসব৷ এটা অরিত্রীর বয়ফ্রেন্ড৷ একে সহজ চিনবে কী করে?

সুভদ্রা বলল, ‘কার ছবি, উৎসব?’

উৎসব ফোনটা সুভদ্রার সামনে ধরে বলল, ‘অরিত্রীর বয়ফ্রেন্ড৷ এর জন্যই আমাদের ব্রেকআপ হয়েছে৷ এর জন্য অরিত্রী নিজের সবকিছু বদলাতে রাজি৷ এমনকী রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই শুভময়ের কবিতার কাগজ বিলি করছে যাতে শুভময়ের কবিতা সকলের কাছে পৌঁছে যায়৷

‘এই অরিত্রীকে আমি চিনতাম না৷ ও যে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়ে ভালোবাসতে জানে এটাও আমি বুঝিনি কখনো৷ বার বার মনে হয়েছে, আমাদের সম্পর্কটাতে আমিই বেশি এফোর্ট দিই৷ আর এফোর্ট দিই বলেই হয়তো রয়ে গিয়েছিল এতদিন৷ অরিত্রীর দিক থেকে তেমন উষ্ণতা কখনো অনুভব করিনি৷ মনে হত, আমি না থাকলেও ওর জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটবে না৷ কিন্তু ইদানীং পারমিতার কাছে শুনে বা শেষের দিকে ওকে খেয়াল করে বুঝতাম, এই সম্পর্কটাতে ও গভীরভাবে নিমজ্জিত হতে চাইছে৷’

একটানে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণের জন্য থামল উৎসব৷ দেখল, সুভদ্রা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে৷ ফোনটা হাতে ফেরত দিয়ে সুভদ্রা বলল, ‘শুনুন, এটা আপনার প্রেমিকার বয়ফ্রেন্ড হতে পারে না৷ ছবিটার যা বয়েস তাতে লোকটির বয়েস অন্তত সত্তরের ওপরে৷ আপনার সঙ্গে ব্রেকআপ করবে বলে এই ছবি দেখিয়ে মিথ্যে বলেছে৷ এখন ডিজিটাল যুগ৷ রিলের ব্যবহার উঠে গেছে প্রায় বছর দশেক আগেই৷ ছবিটা স্টুডিয়োতে তোলা৷ আমার বাবা-মায়ের বিয়ের সময় কালার ছবি আছে, মশাই৷ তার মানে বছর পঁয়ত্রিশ আগেই লোকজন কালার ছবি তুলত৷ স্টুডিয়োতে এখন সব ডি. এস. এল. আর.৷ তার আগে থেকেই ডিজিটাল ক্যামেরা এসে গিয়েছিল৷ প্রেমিকাকে নিশ্চয়ই নিজের দাদুর ছবি দেবে না? এ ছবি একজন বছর আটাশের বা ত্রিশের ছেলের হতে পারে না, উৎসব৷ তা ছাড়া ছেলেটার জামার স্টাইল দেখলেই বোঝা যায় এর জন্ম ১৯৫০ সালের আশপাশে৷ এটা অরিত্রীর বয়ফ্রেন্ড হতে পারে না৷’

সহজ হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আরে ধুর, এটা হল রাঙাদাদু৷ এটা কারো বয়ফ্রেন্ড নয়৷ বয়েস তিয়াত্তর বছর৷ কলেজের প্রফেসর ছিল, রিটায়ার করেছে বহুদিন৷ আর্ট কলেজের প্রফেসর৷’

সুভদ্রা বলল, ‘তুই ঠিক চিনিস?’

সহজ হেসে বলল, ‘আরে বাঁ কানের লতিতে একটা জড়ুল আছে, দেখো দিদিমণি৷’

উৎসব ভালো করে লক্ষ করল৷ যদিও ছবিটা একটু অস্পষ্ট, কিন্তু তবুও কানের লতিটা কালচে রয়েছে৷

সুভদ্রা সহজকে বসিয়ে বলল, ‘এই রাঙাদাদুর বাড়ি কোথায়, সহজ?’

উৎসব কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিল, সুভদ্রা ইশারায় চুপ করতে বলল৷

সহজ জমিয়ে বসে পড়ল৷ গল্প করতে একটু বেশিই ইন্টারেস্ট ছেলেটার৷ সেটা আগেও লক্ষ করেছে সুভদ্রা৷ তাই গল্পের ঢঙেই বলল, ‘বলো সহজ, এঁকে তুমি চিনলে কী করে?’

সহজ বলল, ‘ও মা, চিনব না কেন? ইনি তো আমার মায়ের কাকা হন৷ কালনায় বাড়ি৷ মা-কে খুব ভালো বাসেন৷ দু-একবার এসেছেন আমাদের মেদিনীপুরের বাড়িতে৷ ওঁর ছেলে অনির্বাণদা তো খুব ভালো স্পোর্টসম্যান ছিল৷ তারপর একটা পা বাইক অ্যাক্সিডেন্টে নষ্ট হয়ে গেল৷ এখন আর কিছু করে না তেমন৷’

 সুভদ্রা বলল, ‘দাদুর ছেলে মামা না হয়ে দাদা কেন, সহজ?’

সহজ বলল, ‘আসলে দাদু বিয়ে করেননি তো৷ তাই নিজের ছেলে-মেয়ে নেই৷ এই অ্যাক্সিডেন্টটা নাকি ঘটেছিল দাদুর জন্যই৷ দাদুকে বাঁচাতে গিয়েই নাকি অনির্বাণদার পা-টা গিয়েছিল৷ অনির্বাণদা অনাথ৷ তাই দাদুর কাছেই রয়ে গেছে৷ আসলে বয়েসটা কম তো তাই মামা বলি না৷ তা ছাড়া প্রথমে এমনিই থাকত, কয়েক বছর পরে দাদু বলল, অনিই আমার ছেলে৷’

উৎসব বলল, ‘এখন তোমার এই দাদু কোথায় আছেন? কী করেন?’

সহজ বলল, ‘আমার সঙ্গে যখন লাস্ট দেখা হয়েছিল তখন দাদু বাড়িতে একটা আঁকার স্কুল খুলেছিল, দেখেছিলাম৷ খুব সুন্দর আঁকে দাদু৷ আবার ভালো কবিতাও লেখে৷’

উৎসব বলল, ‘ফোন নম্বর আছে?’

সহজ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘মায়ের কাছে আছে৷ আমার কাছে নেই৷’

সুভদ্রা বলল, ‘এই দাদুর কোনো নিজের ছেলে নেই, তা-ই তো? বিয়ে কেন করেননি ভদ্রলোক?’

সহজ বলল, ‘তা তো জানি না৷ এসব মা জানে৷’

উৎসব অরিত্রীর ছবি বের করে সহজের সামনে রেখে বলল, ‘দেখেছ কখনো?’

সহজ একটু ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ দেখেছি৷ এর নাম ভ্রমর৷ দাদুর মডেল৷ এর বহু ছবি এঁকে রেখেছে দাদু নিজের স্টুডিয়োতে৷ তবে চুলের কাটিংটা আলাদা ছিল৷ আর শাড়ি পরে ছিল৷ কিন্তু মুখের কাটিং এরকমই ছিল৷ অনেকগুলো ছবি ছিল ঘরে৷ সবের নীচে স্টাইল করে লেখা ছিল—ভ্রমর৷’

সুভদ্রা বলল, ‘তুমি তোমার মায়ের ফোন নম্বরটা একবার দাও তো সহজ৷’

সহজ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা কি আমার ঠিকানা জানিয়ে দেবে মা-কে? আমি কিন্তু হিরো হতে চাই৷’

সুভদ্রা হেসে বলল, ‘আরে না না, আমরা কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাব না৷ শুধু এই শুভময়ের ফোন নম্বরটা চেয়ে নেব৷’

সহজ অবিশ্বাসী চোখে বলল, ‘সত্যি বলছ তো?’

উৎসব বলল, ‘তোমায় মিথ্যে বলে লাভ? তা ছাড়া আমি তোমায় এমনিও বুঝিয়েছি, ফিলমের ওপরে কোর্স করানো হচ্ছে কলকাতায়৷ অভিনয় শেখানো হয় দক্ষ অভিনেতা দ্বারা৷ এগুলো শিখতে গেলে এমনিও তোমায় ফিরতে হবে বাড়ি৷ না হলে এই হোটেল বয়ের কাজ করে করে হিরো-হিরো লুকটাও চলে যাবে৷ এখন আর ওই আগের মতো নেই অভিনয়জগৎ৷ অনেক স্টার কিড রয়েছে এ জগতে৷ তাই বাইরে থেকে অভিনয় না জেনে গেলে অডিশনেই বাদ চলে যাবে তুমি, সহজ৷’

সহজ আচমকা উৎসবের হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘তাহলে স্যার, আমি আপনাদের রাঙাদাদুর কাছে নিয়ে যাব, কিন্তু আপনাদেরও আমার বাবাকে রাজি করাতে হবে আমায় যাতে অ্যাক্টিং শেখার স্কুলে ভরতি করে দেয়৷’

সুভদ্রা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে৷ তা-ই হবে, সহজ৷ আমি রাজি করাব তোমার বাবাকে৷’

সহজ ছুটল ম্যানজারকে বলতে, ও বাড়ি ফিরবে৷ উৎসব বলল, ‘যাক, আপনার একটা প্রচেষ্টা সফল হল মানালিতে এসে৷’

সুভদ্রা বলল, ‘যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা বলতে চাই৷’

উৎসব হেসে বলল, ‘আরে, আপনি আমার প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাই আমি আজীবন ঋণী থাকব৷’

সুভদ্রা বলল, ‘বার বার লজ্জা দেবেন না প্লিজ৷’

উৎসব বলল, ‘মজার ছলে বললেও বিশ্বাস করুন, আমি রেসপেক্ট করি আপনাকে শুধু আপনার এই গুণটার জন্যই৷ যে মানুষ অন্যের কথা ভেবে একটা পা-ও বাড়ায়, আমি তাকে সম্মান করি৷ তাই সংকোচ না করে নির্দ্বিধায় বলুন৷’

সুভদ্রা বলল, ‘আমি অরিত্রীকে একবার দেখতে চাই৷ একটু কথা বলতে চাই৷ কেন জানি না মনে হচ্ছে, মেয়েটার কোনো সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম হচ্ছে৷ এত বয়স্ক একজন মানুষকে ও ঠিক কেন জীবনসঙ্গী করতে চাইছে এটাই জানার ইচ্ছে৷’

উৎসব অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না সুভদ্রা, আমি অরিত্রীর সম্মুখীন হব না কোনোদিনই৷ কারণ অপমান জিনিসটা ছোটো থেকেই বড্ড অপছন্দের আমার৷ তাও যদি সেটা হয় অকারণে৷ তাই যদি অরিত্রী নিজে কোনোদিন ক্ষমা চেয়ে আমায় ডাকে, সেদিন হয়তো গিয়ে দাঁড়াবো ওর পাশে, কিন্তু অযাচিতভাবে আর নয়৷ আপনাকে ওর এক বন্ধুর নম্বর দিয়ে দেব৷ যোগাযোগ করে দেখা করে নেবেন৷’

সুভদ্রা বলল, ‘আমি জানি, আপনার ইগো হার্ট হয়েছে৷ কিন্তু ও একটা সাইকোলজিক্যাল প্রবলেমে ভুগছে, উৎসব৷ আমার অন্তত সেটাই মনে হচ্ছে৷’

উৎসব বলল, ‘হতে পারে৷ আবার না-ও হতে পারে৷ একটা পুরোনো ছবি দেখে আর সহজের কথাতে আমি সবটাকে এত সহজভাবে ভাবতে পারছি না৷ তবে হ্যাঁ, সহজের সঙ্গে আমিও যাব শুভময়কে দেখতে৷ বলতে পারেন কৌতূহল৷ কার জন্য অরিত্রী এত পাগল হয়ে গেল সেটা জানতে হবে তো?’

সুভদ্রা বলল, ‘তাহলে সহজ আমাদের পথপ্রদর্শক হোক৷ দেখি কে সেই শুভময়৷’

‘হ্যালো আন্টি, আমি পারমিতা বলছি৷ অরিত্রীকে নার্সিং হোমে ভরতি করা হয়েছে৷ আচমকাই একটা বাইক এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়৷ বাইকের পিছনের ছেলেটার হাতে একটা লাঠি ছিল, সেটা দিয়ে অরিত্রীর মাথার পিছনে মারার চেষ্টাও করা হয়েছিল৷ আপনি শিগগির আসুন৷’

ফোনটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল ঈশানী৷ অরিত্রীকে মারার চেষ্টা কে করবে?

‘অ্যাক্সিডেন্ট! ঝুমঝুমের? কখন হল? কীভাবে হল ঈশানী? বাইকের সঙ্গে? কার বাইক?’

তন্ময়ের একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তরে ঈশানী নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘আমি এত কিছু জানি না৷ পারমিতার ফোন পেলাম এইমাত্র৷ ইউনিভার্সিটির সামনেই নাকি ঘটেছে৷ ওরা দেখেই ভরতি করেছে নার্সিং হোমে৷ আমি বেরোচ্ছি অফিস থেকে৷ তুমি এসো৷ ও গ্রিনল্যান্ডে ভরতি আছে৷’

ঈশানী ফোনটা কেটে দিল৷ তন্ময় টিমের দুজন জুনিয়রকে ডেকে আজকের মিটিংগুলো সামলে নিতে বলে বেরিয়ে এল অফিস থেকে৷ বিকেল পাঁচটায় কবে লাস্ট অফিস থেকে বেরিয়েছে, আজ আর ওর মনে নেই৷

বেশ কিছুদিন ধরেই ঈশানী বলছিল, ঝুমঝুমের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে৷ তন্ময় ভেবেছিল বয়সের পরিবর্তন৷ ঈশানী নিজের ছাড়া কারো স্বাধীনতা সহ্য করতে পারে না, তাই হয়তো মেয়ের এই পরিবর্তন পছন্দ করতে পারছিল না৷ কিন্তু দিন তিনেক আগে সারারাত বাইরে কাটিয়ে পরদিন সকালে ফেরা মেয়েটাকে একটু অচেনাই লাগছিল তন্ময়ের৷ আসলে অরিত্রীকে নিয়ে কোনোদিনই বাবা-মা হিসাবে ভাবতে হয়নি ওদের৷ ছোটো থেকেই অত্যন্ত বাধ্য মেয়ে ছিল৷ স্কুল থেকে কখনো কমপ্লেইন্ট আসেনি৷ দারুণ রেজাল্ট করেছে মেয়েটা৷ নিজেকে নিজেই সামলেছে ছোটো থেকেই৷ তাই এই অচেনা ঝুমকে দেখে সত্যিই সেদিন চমকে উঠেছিল তন্ময়৷ একই বাড়িতে থাকলেও কাজের চাপে সেভাবে লক্ষ করা হয়নি অনেকদিন মেয়েটার দিকে৷ ঈশানী বোধহয় ঠিকই বলে, দিন দিন ও যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে৷ নিজের মেয়েটার সঙ্গেও কতদিন কথা বলা হয়নি সেভাবে৷ কেন এমন আচরণ করছে মেয়েটা, জিজ্ঞাসাও করা হয়নি৷ ছোটোবেলায় রক্তে খুব ভয় ছিল ঝুমের৷ মশা মেরে ফেললে সেই রক্ত দেখেও কেঁদে ফেলত মেয়ে৷ একবার তন্ময়ের আঙুল কেটে গিয়ে অনেকটা রক্ত পড়েছিল মেঝেতে৷ ঝুম ঘরে লুকিয়েছিল ভয়ে৷ ছোট্ট ঝুম কিছুতেই ঘুমোতে চাইত না যতক্ষণ না তন্ময় বাড়ি ফিরত৷ ঈশানী রেগে বলত, বাপ-সোহাগি মেয়ে৷ তখন তন্ময়ের এত মাইনে ছিল না, এত দামি গাড়ি ছিল না, কিন্তু মেয়েটার ফ্রকগুলো ছোটো হচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারত৷ ঈশানী প্রথম প্রথম যথেষ্ট চেষ্টা করত ওদের বাড়ির মধ্যে অফিসের জটিলতা না ঢোকাতে, কিন্তু তন্ময় তখন কেরিয়ার, উন্নতি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে নারাজ ছিল৷ তারপরেই ঈশানী ওদের সম্পর্কটাতে এফর্ট দেওয়া একেবারেই ছেড়ে দিল৷ নিজেও তন্ময়ের মতোই কেরিয়ার নিয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠল, তখনই ওদের সম্পর্কের মাঝে একটা শীতল প্রাচীর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল৷

ঝুমঝুম তখন স্কুলে৷ ভাগ্যিস সেই সময় তন্ময়ের মা এসে ঝুমের দায়িত্ব নিত কিছুটা৷ তাই মেয়েটা একাকিত্বে ভোগেনি৷ মা মারা যেতেই নাকি ঝুমের এই পরিবর্তন—এটাই ঈশানীর ধারণা৷ কে জানে, আজ কতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে মেয়েটার? বেঁচে আছে তো?

এসি গাড়িতেও ঘামতে লাগল তন্ময়৷ আরেকটু আগে নজর দেওয়া দরকার ছিল ওদের৷ ঈশানী বারকয়েক বলার চেষ্টা করেছে তখনও তন্ময় ওকে অপমানই করেছে৷ গাড়ির উইন্ডোতে তাকিয়েও চোখ সরিয়ে নিল তন্ময়৷ নিজেকেই যেন আজ অপরিচিত লাগছে ওর৷

গাড়ি পার্ক করিয়ে নার্সিং হোমের দিকে ছুটল ও৷ ঈশানীকে কল করেও পেল না, হয়তো ফোন সাইলেন্ট রেখেছে নার্সিং হোমে আছে বলে৷

ওকে দেখেই উঠে এল ঈশানী আর ঝুমের দুজন বান্ধবী আর একজন সম্ভবত ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হবেন৷ ঈশানী কিছু বলার আগেই তন্ময় বলে ফেলল, ‘ঝুমঝুম বেঁচে আছে তো?’

ঈশানী ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এ কেমন প্রশ্ন?’

তন্ময় ভাঙা গলায় বলল, ‘ভয় পেয়েছিলাম খুব৷’

ঈশানী বলল, ‘কেউ একজন ঝুমকে মারতে চাইছে৷’

তন্ময় চমকে উঠে বলল, ‘কে? কেন?’

ঈশানী বলল, ‘পারমিতা আর রত্নাশ্রী ওর পিছনেই বেরিয়েছিল, রাস্তায় ওঠার মুখেই বাইকটা সজোরে ধাক্কা দেয় ঝুমঝুমকে৷ ও পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা লাঠি দিয়েও নাকি মাথায় আঘাত করা হয় ওকে৷ যে বাইক চালাচ্ছিল আর যে বাইকের পিছনে বসে ছিল, দুজনের মুখেই হেলমেট ছিল তাই কেউ দেখতেও পায়নি৷ জ্ঞান ফিরেছে, জানাল ডক্টর৷ আর দশ মিনিট পরে দুজন করে দেখতে দেবে৷’

তন্ময় ঈশানীকে বলল, ‘আমাদের কোনো শত্রু? নাকি ওর এক্স-বয়ফ্রেন্ড—সেদিন যার কথা বলছিলে?’

ঈশানী বলল, ‘কিন্তু উৎসব তো মানালিতে এখন৷’

তন্ময় বলল, ‘সে লোক লাগিয়ে মারতে কতক্ষণ? দেখো, এ ছাড়া তো আমার আর কারো কথা মাথাতেই আসছে না৷’

 ওদের কথার মাঝেই রত্নাশ্রী আর পারমিতা এগিয়ে এসে ঝুমঝুমের ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আন্টি, অরিত্রীর ব্যাগ৷’

ঈশানী আর তন্ময় দুজনে ঝুমের প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলছিল৷ উনি বলছিলেন, ‘আগামীকাল সিসিটিভি ফুটেজ বের করে থানায় ডায়েরি করব৷ কারণ স্টুডেন্ট এবং টিচারদের সেফটি দেখতে হবে৷’

দুটো ভিজিটিং কার্ডে দুজনে ঢুকেছে ঝুমের ঘরে৷ ঈশানী তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন কোনো প্রশ্ন করবে না ওকে৷’

 তন্ময় মেয়ের হাতটা আলতো করে ধরে বলল, ‘ঠিক হয়ে যাবি৷’

ঝুমঝুমের চোখে একটা অবিশ্বাসী চাউনি৷ খুব ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ওরা কারা ছিল? জানতে পারলে কিছু?’

ঈশানী বলল, ‘আমরা খুঁজতে শুরু করেছি, খুঁজে পেয়ে যাব৷ তুই সুস্থ হয়ে উঠলেই আমরা তিনজনে বেড়াতে যাব৷’ কথাটা বলেই তন্ময়ের দিকে তাকাল৷

তন্ময় বলল, ‘ঝুমের প্রিয় পাহাড়ে যাব৷’

 ঝুমঝুম এসব যে শুনছে না সেটা ওর মুখের অভিব্যক্তিই বুঝিয়ে দিচ্ছে৷ ও যেন ভাবনার সাগরে ভেসে চলেছে৷ পার্থিব সবকিছু বড়ো অকিঞ্চন ওর কাছে৷ এমনকী মাথা ফাটার যন্ত্রণাও তুচ্ছ ওর কাছে৷ তন্ময়ের অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে ঝুমের দিকে তাকিয়ে৷ মেয়েটা কবে এতটা বড়ো হয়ে গেল, টেরই পেল না৷ শুধু দেখল একটা বাচচা মেয়ে কোনো বায়না ছাড়া, কোনো দুষ্টুমি ছাড়া আচমকাই বেশ বড়ো হয়ে গেল৷ এতটা বড়ো হয়ে গেল যে বাবা-মা হয়েও ওরা টের পেল না৷ ঝুম খুব ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমার ব্যাগটা পেয়েছ? ওতে শুভময়ের লেখা কবিতাগুলো আছে৷ যত্ন করে রেখো৷’

ঈশানী বলল, ‘তুই বাড়ি ফিরে এলে একদিন শুভময়কে বাড়িতে ডাক৷ আমরা আলাপ করি৷’

তন্ময় বলল, ‘হ্যাঁ, তোর মা বলছিল সে নাকি শিল্পী মানুষ৷ আলাপ করাবি না আমাদের সঙ্গে?’

ঝুমঝুম অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আগে আমি ওকে খুঁজে পাই, তারপর তো আলাপ করাব৷ আমিই তো খুঁজছি৷’

ঈশানী আর তন্ময় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, ‘বেশ, তুই বাড়ি চল, তারপর আমরা সবাই মিলে ওকে খুঁজব৷ তোর বাবার বন্ধু সব্যসাচী আঙ্কলকে বললেও উনি শুভময়ের ঠিকানা জোগাড় করে দেবেন৷ উনি তো কলকাতা পুলিশে আছেন৷’

তন্ময় বলল, ‘হ্যাঁ, তুই শুভময়ের একটা ছবি দিস, আমি দেখছি৷’

 ঈশানী লক্ষ করল, ঝুমের চোখে একটা শান্ত চাহনি৷ বাবা ওর ব্যাপারে অ্যাটেনশন দিচ্ছে এটাতেই বোধহয় ঠোঁটে ক্লান্ত হাসি ফুটেছে মেয়েটার৷ নার্সিং হোমে এসে অবধি তন্ময়ের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখছে ঈশানী৷ এ যেন সেই কলেজজীবনের ভীষণ কেয়ারিং মানুষটা৷ ভিজিটিং আওয়ার শেষ৷

তন্ময় বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘চলো, ডক্টরের সঙ্গে কথা বলে যাই৷ কবে রিলিজ করবে সেটাও তো জানতে হবে৷’ একদিকে ঝুমঝুমের এমন বিপদ, দুশ্চিন্তার মধ্যেও ঈশানীর একটাই পাওয়া—তন্ময় ঝুমকে নিয়ে ভাবছে৷

ঈশানী বলল, ‘তুমি কিছু বুঝলে?’

তন্ময় বলল, ‘সম্ভবত সোশ্যাল মিডিয়ায় না দেখেই প্রেম৷ ঝুম খুঁজে বেড়াচ্ছে শুভময়কে৷ আদৌ নামটুকু সত্যি বলেছে কি না সেটাই তো বুঝতে পারছি না৷ তবে খুব সম্ভবত বাজে কোনো ছেলের পাল্লায় পড়েছে ঝুমঝুম৷ ঈশানী, ঝুম আজ থেকে আমাদের ফার্স্ট প্রায়রিটি এটা মাথায় রেখে এগোতে হবে৷’

ঈশানী বলল, ‘আমি পারমিশন না নিয়েই ওর ঘরটা দেখেছিলাম৷ বহু পুরোনো ডায়েরি, কিছু ভাঁজ-করা ছবি রয়েছে৷ আর ঝুমের আলমারিতে কিছু পুরোনো স্টাইলের বেনারসি, জুয়েলারি পেলাম৷ এমনকী ফলস হেয়ার অবধি৷ এসব নিয়ে মেয়েটা করে কী?’

ডক্টর জানালেন, একটা সিটি স্ক্যান করে নিয়ে পরশু ছেড়ে দেবেন৷ আগামীকাল একটু অবজার্ভেশনে রাখতে চান৷

গাড়িতে উঠেই ঈশানী ঝুমের ব্যাগটা ঢেলে ফেলল সিটে৷ বেশ কিছু জেরক্স পেপার৷ ওর ফোন৷ বইপত্র ছাড়াও একটা দোমড়ানো কাগজের টুকরো৷ কাগজটা খুলতেই গোটা তিনেক লাইন৷ বেশ গোটা গোটা লেখা৷

‘শুভময়ের থেকে দূরে থাকুন৷ ওকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না৷ শুভময়ের সঙ্গে যেদিন দেখা করবেন সেদিন আপনার জীবনের শেষ দিন হবে৷’

ঈশানী বলল, ‘কে এই শুভময়?’

তন্ময় বলল, ‘কোনো ম্যারেড ম্যান নয় তো?

কিন্তু ঝুমঝুম যে ওকে খুঁজছে সেটা অন্যরা জানল কী করে? কবিতার পাতাগুলো খোলো তো দেখি৷

প্রতিটা পাতায় ঝুমের ফোন নম্বর দেওয়া আছে৷ এর থেকে কি কোনোভাবে কেউ ট্র্যাক করেছে ঝুমকে? নাকি যারা করেছে তারা ঝুমকে চেনে? চলো, থানায় একটা ডায়েরি করে আসি৷’

ঈশানী বলল, ‘কিন্তু কার নামে?’

তন্ময় বিরক্তির গলায় বলল, ‘ওই উৎসবের নামে৷ এটা তো পরিষ্কার, ওই ছেলেটাই লোক দিয়ে এসব করিয়েছে৷ শোনো, ঝুমঝুমের বাবা-মায়ের অর্থের পরিমাণটা তো কিছু কম নয়৷ তাই ঝুমঝুম অন্যত্র প্রেম করছে এটা মেনে নেওয়া ওই উৎসবের পক্ষে সমস্যা৷ শুভময় ঢোকায় ওই ছেলেটা সব থেকে বেশি অসুবিধা৷’

ঈশানী বলল, ‘কিন্তু উৎসব এখন মানালিতে৷ আমার সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে৷ ছেলেটা বেশ ভদ্র মনে হল৷’

তন্ময় হেসে বলল, ‘ফোনে কথা বলে তুমি বুঝে গেলে ভদ্র ছেলে? কলকাতা শহরে এই প্রেমের নামে কত কিছু রোজ হচ্ছে, ধারণা আছে তোমার? দেখো বিষয়টা খুব ক্লিয়ার৷ শুভময়ের জন্যই উৎসবের সঙ্গে রিলেশনশিপ ভেঙেছে ঝুম৷ কে এই শুভময়, কেউ জানে না৷ উৎসবও না৷ এই অবস্থায় ঝুমকে যদি শুভময়ের খোঁজ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে এই উৎসব আবারও এন্ট্রি নেবে ঝুমের লাইফে৷ আমার দৃঢ় ধারণা, এর পিছনে এই ছেলেটার হাত আছে৷’

 ঈশানী বলল, ‘তোমার কথায় যুক্তি আছে৷ পারমিতা সেদিন বলছিল, ওদের নাকি প্রায় তিন-চার বছরের রিলেশন ছিল৷ আচ্ছা, ঝুম কোনোদিন আমাদের কিছু বলেনি কেন এই উৎসবের ব্যাপারে?’

তন্ময় গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমরাও শুনতে চাইনি৷ ও আমাদের ভরসা করেনি৷ মা হয়তো জানত৷ ঠাম্মার সঙ্গে তো সব কথা বলত ঝুম৷’

ঈশানী বলল, ‘আমার চিন্তা হচ্ছে, যদি সত্যিই এটা উৎসব করে থাকে তাহলে তো ও আবার অ্যাটাক করবে৷ ও তো ঝুমের রেগুলারের রুটিন জানে, তন্ময়৷ আর শুভময়কে কোথায় খুঁজে পাব বলো তো? তা ছাড়া এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় হওয়া সম্পর্ক ভরসাযোগ্যও তো নয়৷ না হলে এর ঠিকানা জোগাড় করতে এত পরিশ্রম কেন করতে হচ্ছে ঝুমকে? ছেলেটা মিট অবধি করেনি নাকি ঝুমের সঙ্গে? প্রেমটা হল কী করে? ঝুমঝুম এত বোকা বুদ্ধির, আমি এখনও ভাবতেই পারছি না, তন্ময়৷’

তন্ময় হেসে বলল, ‘তোমারই মেয়ে তো৷ আবেগেই তো ভাসবে৷ মনে আছে, যখন তোমার বাড়ি থেকে বলেছিল, ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব না, তখন তুমি বলেছিলে, চলো, পালাই৷ জানতেও চাওনি আমার বাড়িঘর আছে কি না?’

 ঈশানী হেসে বলল, ‘হয়তো বয়েসটাই এমন আবেগে ভাসার৷’

‘ডায়েরিটা লিখুন৷ উৎসব মিত্র, কেয়ার অফ আদিত্য মিত্র৷’

 সবটা থানায় বলে ডায়েরি করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হল তন্ময়দের৷ এসেই ঝুমের ঘরে ঢুকল তন্ময়৷ তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজে চলেছে৷

ঈশানী দেখল, হাতে কিছু কাগজ নিয়ে ছুটে ওর মা যে ঘরে থাকত সেই ঘরে ঢুকল তন্ময়৷ ঈশানীর ক্লান্ত লাগছে৷ ডিনার করে শুতে হবে৷ আর পারছে না৷ বয়েস হচ্ছে সেটা শরীর এখন থেকেই জানান দিচ্ছে যেন৷

‘বললে না তো সুভদ্রা, আমায় দেখে তোমার ঠিক কী মনে হচ্ছে? লুজার? দেবদাসমার্কা প্রেমিক? অরিত্রী ছেড়ে চলে যাবার পরে তার প্রেমিককে খুঁজতে চলেছি? বলো-না সুভদ্রা, কী মনে হচ্ছে আমায় দেখে?’

‘আর তো মাত্র ঘণ্টাখানেক৷ তারপরেই তো আমার ট্রেন৷ তুমি তো তাও কাল অবধি থাকছ মানালিতে৷ এইটুকু সময় অরিত্রীর কথা থাক-না৷ সহজ তো নিয়ে যাবে বলল শুভময়ের কাছে৷ তখনই না হয় আমরা দেখব তাকে৷ আপাতত বলো তো, এই কদিন কি আমি একটু বেশিই বিরক্ত করলাম তোমাকে?’

বিয়াসের ধারে চুপ করে বসে আছে সুভদ্রা আর উৎসব৷ উৎসবকে দিয়ে নিজের বেশ কয়েকটা ছবি তোলানোর পরে কর্মহীন হয়ে পড়েছে সুভদ্রা৷ কথাও যে খুব বলতে পারছে এমন নয়৷ অদ্ভুত এক অনুভূতি ঘিরে ধরে আছে ওকে৷ মানালিতে এসেছিল একলা সময় কাটানোর জন্য৷ এসেই উৎসবের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল৷ খোলা মনের উৎসব কখন যে ওকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে, বুঝতেও পারেনি৷ উৎসব অরিত্রীকে আজও ভালোবাসে বুঝেও কেন যে সুভদ্রার অবাধ্য মন ওর দিকেই ছুটে চলেছে, কে জানে৷ ঠিক যেন বিয়াসের স্রোত৷ পাথরে ধাক্কা খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হবে জেনেও ক্রমাগত ছুটে গিয়ে চলেছে প্রস্তরখণ্ডের দিকেই৷ সুভদ্রার অবাধ্য মনের অলিন্দের দ্বারে কড়া পাহারা বসিয়েও শেষরক্ষা হল না, সেই ঘরে মানালির ঠান্ডা বাতাস চুপি চুপি প্রবেশ করেই ছাড়ল৷ তবুও সুভদ্রা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই যেন উৎসব বুঝতে না পারে যে ও দুর্বল হয়েছে৷ উৎসব বলল, ‘না না সুভদ্রা, বলো, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আমি কি বোকা? আমি কি পাগল? যে মেয়েটা মুখের ওপরে বলে চলে গেল, তার ব্রেক চাই, আর তার কথাই আমি ভেবে চলেছি অনবরত৷ তোমাদের সাইকোলজি এটাকে কী বলে?’

সুভদ্রা বলল, ‘জোর করে ভোলা যায় না, উৎসব৷ তুমি পুজোর সমস্ত উপাচার সাজিয়ে, ফুলের মালা গেঁথে, চন্দন বেটে, ধূপ জ্বালিয়ে বসে বলছ, আমি তো পুজো করতে চাই না, তাহলে মন মানবে কেন? ধূপ, ধুনো, ফুল-চন্দনের গন্ধে এমনিই তোমার হাত পৌঁছোবে ঈশ্বরের চরণে৷ তাই অরিত্রীকে ভুলতে এসে যদি বার বার ওরই খবর নিতে ব্যস্ত থাকো তাহলে চেষ্টা করা বৃথা৷’

উৎসব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘চেষ্টা তো করছি, সুভদ্রা৷

সুভদ্রা অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘উহুঁ, চেষ্টা করার তো দরকার নেই৷ গাছে ফুল আছে, দোকানে ধূপ আছে৷ তুমি যদি একত্রে কিনে না আনো তাহলে তো পুজোয় বসার কথাই মনে পড়বে না৷ একটা একটা মুহূর্তকে একত্র করে ভুলতে চেষ্টা করে লাভ নেই, উৎসব৷ মুহূর্তগুলোকে ছড়িয়ে যেতে দাও এলোমেলো৷ এতটাই এলোমেলো ছড়িয়ে যেতে দাও যাতে ওদের কুড়িয়ে আনতে গেলেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়৷ অতটা পরিশ্রম করতে মন চাইবে না, তাই হারিয়ে যাবে স্মৃতির ভিড়ে৷’

উৎসব হঠাৎই সুভদ্রার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘চলে যাবে আজ? যদি আজ আমি কিছু করে বসি, বাধা দেবে কে?’

সুভদ্রা বলল, ‘যার গোটা মন জুড়ে অরিত্রী রাজত্ব করছে সে আর যা-ই করুক সুইসাইড করবে না৷ কারণ বলা তো যায় না, কখন অরিত্রী নিজের সব ভুল বুঝে ফিরে আসে!’

 উৎসব বলল, ‘কিন্তু এমন নির্ভেজাল বন্ধুত্ব? যেটা মানালির নির্জনতায় তৈরি হল সেটা কি তিলোত্তমার জটিলতায় থাকবে?’

সুভদ্রা দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে বলল, ‘যদি এটাকে বন্ধুত্ব মনে করো তাহলে তো রাখার দায়িত্ব দুজনেরই৷ যে বন্ধুত্ব জনসমক্ষে বিচলিত হয়ে পড়ে, পরিচয়হীনতায় ভোগে সে বন্ধুত্বকে আগে মজবুত করতে হবে, উৎসব৷’

উৎসব বলল, ‘আজ তোমাকে বড্ড অপরিচিত লাগছে, সুভদ্রা৷ গত পাঁচ দিনের তুমির সঙ্গে আজকের তুমির বড়ো অমিল৷’

সুভদ্রা বলল, ‘পাহাড়ি রাস্তায় রহস্য আছে বলেই না বার বার ছুটে আসি সেখানে৷ অরিত্রীর মধ্যে গোপনীয়তা ছিল বলেই না ভুলতে পারছ না৷’

সুভদ্রার বলা হল না, ‘অরিত্রীকে ভোলার ছলে মনে রাখার চেষ্টা করাটাও ভালোবাসা, উৎসব৷’ বলা হল না, ‘অরিত্রী ফিরে এলে এই বন্ধুত্ব কি আর খুব দরকার হবে তোমার? একাকিত্ব কাটানোর সঙ্গী আর প্রেমিকার মধ্যে সূক্ষ্ম নয়, বেশ বড়ো পার্থক্য আছে৷’

না-বলা কথাগুলো মনে রেখেই বলল, ‘আপাতত শুভময় সন্ধানে যাচ্ছি আমরা সহজকে নিয়ে৷ আর সহজকে ওর বাড়িতে ফিরিয়ে দিতেও হবে৷ তারপর না হয় কোলাহলমুখরিত কলকাতায় আমাদের বন্ধুত্ব স্থায়ী হবে কি না তা নিয়ে ভাবা যাবে৷’

উৎসব বলল, ‘এড়িয়ে যেতে চাইছ? সময় চাও? বন্ধুত্বের পরীক্ষায় জিতি কি না পরখ করে নিতে চাও? বেশ রাজি৷’

উৎসবের কথা শেষ হবার আগেই পারমিতা ফোন করল৷ রিসিভ করতেই বেশ ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘তুমি কোথায়, উৎসবদা? কলকাতায় ফিরবে কবে? তোমার নামে কেস করেছে অরিত্রীর বাবা৷ আমাকেও থানায় ডেকেছিল৷ তোমার বাড়ির প্রপার অ্যাড্রেস জিজ্ঞাসা করল৷’

উৎসব চমকে উঠে বলল, ‘কেস করেছে? কিন্তু কেন? আমি কী করলাম ওদের?’

পারমিতা অরিত্রীর অ্যাক্সিডেন্ট থেকে ভরতি সব বলার পরে বলল, ‘ওর বাবার ধারণা, এটা তোমার কাজ৷’

উৎসব বলল, ‘ধারণা? ধারণার বশে ওরা আমাকে দোষী সাজাতে চাইছে? অরিত্রী নিজে কী বলছে? তারও কি ধারণা, আমিই লোক দিয়ে ওকে মারতে পাঠিয়েছিলাম? আমি আগামীকাল ফিরব৷ দেখি, কী হয়?’

সুভদ্রার চোখে কৌতূহল৷

উৎসব বলল, ‘অরিত্রীর বাবার ধারণা, তার মেয়ের অ্যাক্সিডেন্টের পিছনে আমি দায়ী৷ বাইকচালক আমার লোক ছিল৷’

সুভদ্রা বলল, ‘তোমার স্ট্রং অ্যালিবাই আছে৷ তুমি কলকাতায় ছিলেই না৷ আমি সাক্ষী দেব৷ তা ছাড়া তোমার ফ্লাইটের টিকিট, হোটেল বুকিং সব আছে৷ চিন্তা কোরো না৷’

উৎসব বলল, ‘অরিত্রী আমার জীবনটাকে অভিশপ্ত করে দিতে চাইছে কেন? আমি তো সরে এসেছি ওর কাছ থেকে৷ তারপরেও কেন এত রাগ?’

সুভদ্রা বলল, ‘নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেও শুভময়কে দরকার, উৎসব৷ তুমি কাল ফিরেই একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলে রেখো৷ আমি সহজকে নিয়ে চললাম৷ ওকে আপাতত আমাদের বাড়িতেই রাখব৷ শুভময়ের সঙ্গে দেখা করে তারপর সহজকে নিয়ে যাব ওদের বাড়ি৷’

শুভময় নিজের ঘর থেকে সাধারণত বেরোয় কম৷ আজকাল আর আঁকতেও ভালো লাগে না৷ হাত কাঁপে, ছবিও কেঁপে যায়৷ কবিতা লেখা তো ছেড়েই দিয়েছিল ভ্রমর চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই৷ শখ বলতে এখন একটাই আছে—স্মৃতির পাতায় আলপনা কাটা৷ এই এখন যেমন লম্বা বারান্দায় পায়চারি করতে করতে মনে পড়ে যাচ্ছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের সরস্বতীপুজোর দিন৷ হাঁটিপুরে শুভময়ের মামাবাড়ি৷ ছোটো থেকেই বড়োমামার মেয়ে অপালা আর শুভময়ের ভাব বেশি ছিল সব ভাইবোনের মধ্যে৷ অপালা শুভদা বলতে পাগল৷ শুভদা যা করবে তাতেই সে সঙ্গ দিত৷ যদিও শুভময়ের থেকে অপালা প্রায় বছর চারেকের ছোটোই ছিল৷ সেবারও সরস্বতীপুজোর আগে হাঁটিপুরে গিয়েছিল শুভময়৷ অপালা তখন দশম শ্রেণির যুবতি৷ কিন্তু বড়ো হলে কী হবে, দাদার কাছে আবদার তার কমেনি৷ আর্ট কলেজের মেধাবী ছাত্র শুভময়কে বগলদাবা করে নিজের স্কুলে নিয়ে গিয়ে বলছিল, ‘এবারে স্কুলের পুজোর দায়িত্বে আছি আমরা পাঁচ বান্ধবী৷ তোকে মাঠ জুড়ে দুর্দান্ত আলপনা এঁকে দিতে হবে৷ আর আমাদের সরস্বতীকে সাজিয়েও দিতে হবে৷’

শুভময় জানত, বোনের আবদারের কাছে ওর কোনো অজুহাত চলবে না৷ তাই পুজোর আগের দিন বিকালবেলা স্কুলের বেদিতে আলপনা আঁকতে হাজির হয়েছিল৷ আনমনে আঁকছিল শুভময়, অপালা কোথায় চলে গিয়েছিল, কে জানে৷ ঠিক তখনই একটি মেয়ে এসে ওর সামনে চায়ের কাপ আর বিস্কুট রেখে বলেছিল, ‘গলা ভিজিয়ে নিন৷ আমি কখনো আর্টিস্টকে সামনে থেকে দেখিনি, এই প্রথম কোনো চিত্রশিল্পীকে এত কাছ থেকে দেখছি৷ শিল্পীদের আঙুলগুলো নাকি সাধারণদের থেকে একটু আলাদা হয়? তা-ই?’

খুব চা-পিপাসা পেয়েছিল শুভময়ের৷ মনে হয়েছিল সাদা শান্তিপুরি তাঁতের ডুরে শাড়ি-পরা মেয়েটা বুঝি সাক্ষাৎ দেবী৷ কেমন গরম চা এনে হাজির করেছিল ওর সামনে মনের কথা বুঝে৷ নিজের হাত দুটো ওর সামনে তুলে বলেছিল, ‘কই, আলাদা কিছু নয় তো?’

মেয়েটা বলেছিল, ‘আমায় আঁকবেন?’

একটু হকচকিয়ে শুভময় বলেছিল, ‘ক্যানভাসে?’

মেয়েটা বলেছিল, ‘হ্যাঁ৷ আমি অপালার বন্ধু৷ আমি জানি, আপনি ওকেও এঁকে দিয়েছিলেন খাতায়৷’

মেয়েটার উজ্জ্বল কালো চোখ দুটোতে দৃষ্টি থমকে গিয়েছিল একুশের শুভময়ের৷ ও না বললেই যেন গভীর কালো চোখ দুটো জুড়ে বৃষ্টি নামবে৷ অদ্ভুত মায়া-জড়ানো দৃষ্টিটা৷ কিন্তু ঠোঁটের কোণে সরল হাসির আনাগোনা৷ ঘাড় নেড়ে শুভময় বলেছিল, ‘আঁকব৷’

মেয়েটা বলেছিল, ‘তাহলে আগামীকাল চলে যাব অপালার সঙ্গে আপনাদের বাড়িতে৷’

আরও ঘণ্টাখানেক পরে মেয়েটা এসে বলেছিল, ‘খিদে পায়নি আপনার? চলুন, কিছু খেয়ে নেবেন৷ আমাদের এখানে বিশেজেঠুর ঘুগনি বিখ্যাত৷ সঙ্গে ফোলা ফোলা মুড়ি৷’

শুভময় বলেছিল, ‘আরেকটু বাকি আছে৷ শেষ করেই একেবারে যাব৷ অপালা কোথায়? ওকে দেখছি না?’

‘ও তো ঠাকুর আনতে গেছে৷ আপনার সব দায়িত্ব দিয়ে গেছে আমার ওপরে৷ আমি যত্ন না করলে এসে আমায় মারবে৷ বলবে, কেন আমার দাদার যত্ন হয়নি?’

শুভময় হেসে বলেছিল, ‘তাহলে আরেক কাপ চা দিয়ে যত্ন করা হোক৷’ হরিণীর গতিতে ছুটেছিল মেয়েটা৷ শুভময় মনে মনে বলেছিল, মেয়েটার নাম ভ্রমর হওয়া উচিত৷ সেইদিন থেকে ওর আসল নাম ভুলে ভ্রমর বলেই ডাকত ওকে৷ ভ্রমরেরও বিশেষ পছন্দের ছিল নামটা৷ শুভময় এঁকেছিল ভ্রমরকে৷ একবার নয়, বহুবার৷ একবার ভ্রমরের অনুরোধে, তারপর শুধুই নিজের মনের অবাধ্য ইচ্ছায়৷ কোনো মেয়েলি অবয়ব আঁকার চেষ্টা করলেই পজেসিভ ভ্রমর যেন ওর রং-তুলি জুড়ে রাজত্ব করতে শুরু করত৷ কিছুতেই আঁকতে দিত না অন্য কোনো নারীর ছবি৷

সেই কত যুগ হয়ে গেল ভ্রমরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তবুও হিংসুটের মতো ওর গোটা মন জুড়ে যেন আজও ভ্রমরেরই সাম্রাজ্য৷

বারান্দায় পড়ে-থাকা কাগজটা তুলে নিয়ে চশমার সামনে ধরতেই চমকে উঠল শুভময়৷ এ তো ওর লেখা কবিতা৷ ভ্রমরের জন্য৷ ভ্রমরকেই দিয়েছিল কবিতার ডায়েরিটা৷ শুভময়ের কাছেও ছিল না আর কোনো কপি৷ ভ্রমরের সঙ্গেই চলে গিয়েছিল ওর কবিতারা৷ তাহলে এ কবিতার ঝকঝকে পাতাটা এ বাড়িতে এল কোথা থেকে? ‘ভ্রমরকে শুভময়’ লেখাটাও তো জ্বলজ্বল করছে৷ নিজের সইয়ের ‘S’ টা এভাবেই আজও বেঁকিয়ে লেখে শুভময়৷ পাতার নীচে লেখা অরিত্রী, ব্র্যাকেটে ভ্রমর৷ তার পাশে ফোন নম্বর রয়েছে৷ তবে কি কাউকে দিয়ে ওর কাছে এ কবিতা পাঠিয়েছে ভ্রমর? ফোন নম্বরে ফোন করলে কি ভ্রমর ফোন ধরবে?

কাঁপা হাতে ফোন নম্বরটা প্রেস করতেই একটি নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘ভ্রমর স্পিকিং৷ কে বলছেন?’

শুভময়ের গলা কাঁপছে৷ তবুও সামলে নিয়ে বলল, ‘ভ্রমর, আমি শুভময়৷ তোমার শুভময়৷’

অরিত্রী প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘শুভময়, তুমি কোথায় এখন? আমি আসছি, আগামীকালই আমি কালনায় আসছি৷’

‘সুভদ্রা, তোমার মনে হচ্ছে না আমরা একটা অলীক বিষয়ের পিছনে ধাওয়া করে কালনা এলাম? আমার তো এখন মনে হচ্ছে, ওই শুভময়ের বাড়িতে গিয়ে করব কী? মানে তাকে অরিত্রীর ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করব, আপনি এই মহিলাকে চেনেন কি না? যদি ভদ্রলোক বলেন, কে আপনারা? কেন আপনাদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেব? তখন তোমার উত্তর রেডি আছে তো?’

সুভদ্রা বলল, ‘মানালি গিয়ে এবার আমার দুটো উপকার হল৷ প্রথমত, সহজকে ওর বাড়িতে ফিরিয়ে দিলাম৷ সহজ এখন ফিলম ইন্ডাস্ট্রির খুঁটিনাটি নিয়ে পড়াশোনা করবে, ওর বাবা কালকে কথা দিল আমাদের৷ তা-ই না?’

কথার গতিপথ বদলে যাওয়ায় থই খুঁজে না পেয়ে উৎসব বলল, ‘হ্যাঁ৷ ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা ছেলেকে ফিরে পেয়ে যেন জীবন ফিরে পেলেন৷ এটা তুমি একটা ভালো কাজ করলে৷’

 সুভদ্রা বলল, ‘আমার একার কাজ নয়, তোমারও সাহায্য ছিল৷ নয়তো সহজকে বুঝিয়ে বাড়ি ফেরানো কঠিন হত৷ আসলে অভিভাবকরা সন্তানের আলাদা প্যাশন দেখলেই কেমন অদ্ভুতভাবে রিঅ্যাক্ট করেন৷ অভিনেতা হতে চায় সেটা মেনে নিতে কষ্ট৷ সেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের ঘেরাটোপে বন্দি থাকে৷ আলাদা কিছু নিয়ে কেরিয়ার গড়তে চাইলেই তাদের ভ্রূতে ভাঁজ পড়ে৷ কত সহজ এমন হারিয়ে যায়, বলো তো?’

উৎসব বলল, ‘আর মানালির দ্বিতীয় লাভ?’

সুভদ্রা বলল, ‘সহজকে পেলাম বলেই না অরিত্রীর শুভময়ের খোঁজ পেলাম আমরা৷ মেয়েটা যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে এতদিন ধরে৷ সহজের মায়ের কাছে শুনে যা বুঝলাম ভদ্রলোকের বয়েস কিন্তু সত্তরের ওপরে, অবিবাহিত৷ প্রফেসর ছিলেন, রিটায়ার করেছেন৷ একজনকে দত্তক নিয়েছেন৷ অত্যন্ত ভালোমানুষ৷ কিন্তু এত ভালোমানুষ হঠাৎ তেইশ বছরের মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে কেন ফেললেন? উদ্দেশ্য কী? সহজের মা আঁকা বা কবিতা দেখে একবাক্যে বললেন, এটা তাঁর কাকা শুভময়ের আঁকা৷ তাহলে অরিত্রী যে আঁকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেগুলো এই শুভময়েরই৷ ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য কী?’

উৎসব বলল, ‘জানো সুভদ্রা, কাল সহজের মায়ের কথা শোনার পর থেকেই একটা কথা আমার মাথায় ঘুরছে৷ ওই শুভময় যে ছেলেটিকে দত্তক নিয়েছে সে বাবার ছবি আর লেখা নিয়ে অরিত্রীর সঙ্গে এসব করছে না তো? কী যেন নাম বলল ছেলেটার?’

 সুভদ্রা বলল, ‘অনির্বাণ৷ আমার তো প্ল্যান ছিল, সহজকে নিয়ে আগে ওর রাঙাদাদুর বাড়ি যাব, তারপর ওর মেদিনীপুরের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসব৷ সহজ রাজিও হয়েছিল৷ তারপর প্ল্যান চেঞ্জ করলাম৷ তোমার নামে অরিত্রীর বাবা এরকম একটা অ্যালিগেশন দিয়ে দিল যে আর নতুন ঝামেলায় জড়াতে চাইলাম না৷ শেষে হয়তো সহজকে নিয়ে ঘোরার অপরাধে পুলিশ আমাদের ধরত৷ কারণ সহজ বলছিল, ওর বাবা নাকি কাগজে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনও দিয়েছিল ওর ছবি দিয়ে৷ কলকাতার রাস্তায় আবার ছেলে চুরির দায়ে পড়ব বলেই ওকে ফিরিয়ে দিয়ে ওর মায়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আসাই মনস্থির করলাম৷’

উৎসব বলল, ‘সহজের মা তো আসতে চাইল তোমার সঙ্গে, ওঁকে নিয়ে আসতে রাজি হলে না কেন?’

সুভদ্রা বলল, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ সহজের মা ওঁর ভাইঝি৷ তাঁর সামনে এমন একটা বিষয় উনি কি আদৌ উত্থাপন করতে চাইবেন? তাই কাটিয়ে দিলাম৷ উৎসব, পারমিতা কী বলল? অরিত্রীকে নার্সিং হোম থেকে রিলিজ করেছে?’

 উৎসব বলল, ‘হ্যাঁ, করেছে গত পরশু৷ ও নাকি বাড়ি ফিরে বলেছে, ওর এই দুর্ঘটনায় আমি জড়িত নই৷ আমি যখন থানায় গেলাম, বড়োবাবু বললেন, অরিত্রী বয়ান দিয়েছে, আপনি একটা সই করে আপাতত যান৷ পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকলে আসবেন৷’

সুভদ্রা বলল, ‘আমি যে তোমায় বলেছিলাম ফ্লাইটের টিকিট, হোটেল চেক ইন-চেক আউটের প্রমাণ নিয়ে জমা দিতে, দিয়েছিলে?’

উৎসব বলল, ‘হ্যাঁ, দিয়ে এসেছি৷ ওরা দেখল না৷ অরিত্রীর বয়ানের ভিত্তিতে আমায় অ্যারেস্ট করল না বোধহয়৷ জানো সুভদ্রা, এই প্রথম আমার বাবা-মা দুজনেই বলল, মেয়েটার থেকে দূরে থাক৷ আসলে ওরা যে থানা-পুলিশ করতে পারে, আমার ধারণার বাইরে ছিল৷’

সুভদ্রা বলল, ‘কিন্তু অরিত্রী তো বয়ানে তোমাকে নির্দোষ বলে গেছে৷’

উৎসব হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, এতদিনের ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে, বলতে পারো৷ না হলে প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুনের দায়ে জেলের ঘানি টানটুকুই যা বাকি ছিল৷ বাকি সবরকম অপমান ও করেই দিয়েছে আমায়৷ ওর বাবার ধারণা, ওদের সম্পত্তির জন্যই আমি চাইছি না অরিত্রী আমায় ছেড়ে যাক৷ মানে বুঝতে পারছ, ভদ্রলোক ভাবছেন, অরিত্রী এখন শুভময়ের প্রেমে পড়েছে তাতে আমি রেগে আছি, কারণ অরিত্রীদের সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবে তাই৷ সত্যি বলতে কী, অরিত্রীর বাবা-মা দুজনেই সার্ভিস করেন৷ এইটুকু ছাড়া বিশেষ কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না ওদের পরিবারের খুঁটিনাটি জানার৷ কারণ আমি জানি আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ওদের থেকে খারাপ নয়৷ শুধু আমার বাবার সঙ্গে ওর বাবার একটা বেসিক পার্থক্য আছে৷ আমার বাবা কোনোদিন ভাবেননি, অরিত্রী আমাদের ঐশ্বর্য দেখে আমার সঙ্গে মিশেছিল৷ আসলে অহংকারটা ওদের পরিবারের একটা ঐতিহ্য৷ অবশ্য অরিত্রীর মধ্যে আলাদা অহংকার কখনো দেখিনি৷ দেখলাম যখন ব্রেকআপ করতে চাইল৷ মনে হল, এতদিন সম্পর্কে থেকে ও আমায় বিশাল দয়া করেছে৷’

 সুভদ্রা বলল, ‘বাদ দাও৷ শুভময়কে আমাদের দরকার উৎসব৷ না হলে অরিত্রীর এই প্রাক্তন আর বর্তমানের রহস্যের সমাধান হবে না৷ ওর ওপরে কিছু হলেই ওদের পরিবার তোমায় দায়ী করবে৷ তাই শুভময়কে আমাদের সামনে আনতে হবে, উৎসব৷ মেঘনাদের মতো আড়ালে বসে উনি অরিত্রীকে পরিচালনা করবেন আর বিপদ হলেই দায়ী তুমি হবে এটা কোনো কাজের কথা নয়৷’

উৎসব গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেই বলল, ‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু তাতে তোমার এত উতলা হবার কী আছে, সুভদ্রা? কারণ এবারে মানালি গিয়ে যে দুটো লাভ হল তোমার তার মধ্যে তো আমার সঙ্গে বন্ধুত্বটা কোনো স্থান পায়নি৷ তাহলে আমাকে নিয়ে এতটা ভাবিত হওয়ার কোনো কারণ আছে কি?’

সুভদ্রা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গুগল ম্যাপ অনুযায়ী আমরা আর মাত্র আধ ঘণ্টায় ওঁর বাড়ি পৌঁছোব৷ তাই শুভময়কে ঠিক কীভাবে ফেস করবে সেটাই ভাবি বরং আমরা৷’

উৎসব বলল, ‘তোমার প্রিয় সিঙ্গারের নাম বলো৷’

সুভদ্রা দেখল, উৎসব গাড়ির স্পিকারে গান চালাবে বলেই এমন প্রশ্নের অবতারণা করছে৷ সুভদ্রা হেসে বলল, ‘নিজের পছন্দের তো সব সময় শুনি, তুমি তোমার পছন্দের শোনাও৷’

‘তন্ময়, তুমি দু-দিন ধরে ঝুমঝুমের ঘরদোর ঘেঁটে চলেছ— এটা যদি মেয়েটা জানে, বিপদে পড়ে যাবে কিন্তু৷ তোমার মেয়ে আবার প্রাইভেসি নিয়ে ভীষণ আপোশহীন৷ তার ব্যক্তিগত জিনিসে আমরা হাত দিয়েছি জানলে হয়তো নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরেই আবার বেরিয়ে যাবে৷ ছেড়ে দাও, আর খুঁজে লাভ নেই৷’

তন্ময় গম্ভীরভাবে বলল, ‘ঈশানী, এই শুভময় লোকটা যথেষ্ট বয়স্ক লোক৷ কোনো ইয়াং ছেলে নয়৷ জাস্ট ঝুমকে ফাঁদে ফেলেছে৷ ছবি, চিঠি যা পেলাম টুকরো টুকরো সেগুলো এখনকার ছেলেরা লিখবে না৷ অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের লোকজনের ভাষা৷ মানে স্টাইলটা বলছি৷ শুভময়ের ছবি দেখে মনে হল আমার বাবার আমলের লোক৷ বিলিভ মি, ঝুমঝুম কোনো ধুরন্ধর লোকের পাল্লায় পড়েছে৷ কীভাবে এর সঙ্গে পরিচয় হল সেটাই আমার কাছে ধোঁয়াশা৷ লোকটা দুর্দান্ত ছবি আঁকে সেটা পরিষ্কার৷ ঝুম তোমাকে বলেছে, আজ ও নার্সিং হোম থেকে সোজা কালনা যাবে? ওই শুভময়ের অ্যাড্রেস পেয়ে গেছে ও৷ ইন ফ্যাক্ট শুভময় ওকে কল করেছিল৷’

ঈশানী একটু চমকে উঠে বলল, ‘আজ যাবে? তোমায় কখন জানাল? আমি তো জানি না৷’

তন্ময় বলল, ‘আমিও জানতাম না, তবে আমায় বলল, পাপা, সূর্যদাকে একটু দিয়ো তো কাল৷ সূর্যদা গাড়িটা ভালো চালায়, আর মফসসলের সব রাস্তা চেনে৷ তখন আমি জানতে চাইলাম, সে তুই আমার গাড়ি নিয়ে যা, সূর্য চালিয়ে নিয়ে যাবে৷ কিন্তু যাবি কোথায়? কলকাতার বাইরে? তাতে উত্তেজিত হয়ে বলল, নার্সিং হোম থেকে ফার্স্ট আওয়ারে আমায় রিলিজ করে দেবে৷ তুমি সূর্যদাকে বলে রেখো৷ এখান থেকেই সোজা কালনা যাব আমি৷ শুভময়ের বর্তমান অ্যাড্রেস পেয়ে গেছি, ও কাল কল করেছিল৷’

ঈশানী বলল, ‘মেয়েটাকে একা ছাড়া তো ঠিক হবে না গো৷ এক কাজ করো, আমরাও যাই, চলো৷ তন্ময় বলল, সেটাই ভাবছি৷ আমার সেকেন্ড হাফে একটা ইম্পরটেন্ট মিটিং আছে৷ ওটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি৷ একা তো ছাড়া যাবেই না৷ দুর্বল শরীর, তার ওপরে ওই ফ্রড লোক৷’

 ঈশানীর ভ্রূ-তে গভীর ভাঁজ পড়েছে৷ বলল, ‘আচ্ছা, লোকটাকে না দেখেই ঝুম এমন পাগলামি কেন করছে? সব কেমন গোলমেলে লাগছে৷’

তন্ময় বলল, ‘হিসেব কিছুতেই মিলছে না, ঈশানী৷ শুভময় ঝুমঝুমকে ভ্রমর সম্বোধনে কবিতা লিখেছে কেন? এ নামে তো ওকে শুধুই মা ডাকত৷’

 ঈশানী বলল, ‘ঝুমই বা কেন নিজের বাকি সব নাম বাদ দিয়ে ওই ভ্রমরের পিছনেই পড়ে আছে সেটাও তো বুঝতে পারছি না৷’

তন্ময় বলল, ‘আপাতত ঝুমের সঙ্গে ওই শুভময়ের বাড়ি যাওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা দেখছি না৷ কারণ থানা-পুলিশ তো তোমার মেয়ে করতে দেবে না৷ উৎসব সম্পর্কে পুলিশ ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এলে ও পরিষ্কার জানিয়েছে উৎসব নির্দোষ, আমারই নাকি টেনশনে ভুল হয়ে গেছে৷ বুঝতে পারছ, চাইলে উৎসব আমার নামে ডিফামেশন কেস করতে পারে!’

ঈশানী বলল, ‘তোমাকে তো আমিও বারণ করেছিলাম৷ উৎসব ছেলেটা ভালো৷ অযথা ওকে আর এর মধ্যে জড়িয়ো না৷ এনিওয়ে, জিডি-টা তুলে নিয়েছ?’

তন্ময় মৃদু ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ৷ সূর্য ওকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাক, আমরা তোমার গাড়িতে কালনা যাব ওকে ফলো করে৷ কারণ আমি জানি, ঝুম ওর গাড়িতে আমাদের অ্যালাও করবে না৷’

ঈশানী বলল, ‘আমি অফিসে আগেই এমার্জেন্সি লিভের ব্যবস্থা করে রেখেছি৷ তুমি মিটিংটা পিছোনোর ব্যবস্থা করো৷’

তন্ময় যে একটা জটিল অঙ্ক করতে ব্যস্ত এটা ওর কপালের ভাঁজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ তবুও এই বিপদে তন্ময় যে ওর পাশে আছে এটাই শান্তি৷ না হলে ঝুমের এই জেদের কাছে কীভাবে যে ঈশানী দাঁড়াত কে জানে! মেয়েটা এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন করছে, কে জানে৷ ভাবনার মাঝেই ঈশানীর ফোনটা বেজে উঠল৷ ঝুমঝুম কল করছে৷ তন্ময় ফোনটা স্পিকারে দিতে বলল৷ বেশ উত্তেজিত গলায় ঝুমঝুম বলল, ‘মা, আমার ওয়ার্ডরোবের দ্বিতীয় তাকে একটা প্যাকেট আছে দেখো তো, বেনারসি প্যালেসের৷ ওই প্যাকেটটা কাল নার্সিং হোমে আনবে একবার৷ আমি ওগুলো পরে শুভময়ের কাছে যেতে চাই৷ ভুলে যেয়ো না৷’ ফোনটা কেটে দিল ঝুম৷

তন্ময়ের চোখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর৷ ঝুমের আলমারি খুলে প্যাকেটটা বের করল ঈশানী৷ ভিতরে একটা রেশম সিল্কের কলকা পাড়ের পুরোনো ডিজাইনের শাড়ি, পিস কেটে ম্যাচিং ব্লাউজ৷ সেটাও আগের ডিজাইনের৷ সঙ্গে মুক্তোর মালা আর কানের দুল৷ হাতে একটা হাঙরমুখো বালা৷ গোটা প্যাকেটের জিনিসগুলোই যেন পঞ্চাশের জামানার৷

বহুদিন পরে আবারও রং-তুলি হাতে নিয়েছে শুভময়৷ ইদানীং বড্ড হাত কাঁপে৷ নিজের আঁকা নিজেরই তেমন পছন্দ হয় না আজকাল৷ মনে হয়, খুঁত রয়ে যাচ্ছে অনেক৷ সরলরেখাগুলো যেন চক্রান্ত করেই বেঁকে যাচ্ছে ক্যানভাসে৷ এলোমেলো রেখা দিয়ে আঁকা ছবি শুভময়ের নিজেরই সব থেকে অপছন্দের ৷ হয়তো অনেকেই ওর ছবির খুঁতগুলো খুঁটিয়ে দেখলেও ধরতে পারবে না৷ কিন্তু শুভময়ের চোখে সব পরিষ্কার৷ তাই রং-তুলির আকর্ষণ থেকে ইদানীং নিজেকে দূরেই রাখে ও৷ কিন্তু গতকাল ভ্রমরের গলাটা শোনার পর থেকেই বার বার সাদা ক্যানভাসটা ওকে টানছে৷ আজ ভ্রমর কালনা আসবে বলছে৷ যতবার ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে ততবার একটা করে ছবি ওকে উপহার দিতে হয়েছে শুভময়কে৷ না হলেই মহারানির মনে হত, ওকে কম ভালোবাসছে শুভময়৷ চোখটা বন্ধ করে নিল শুভময়৷ হাঁটিপুরের দুর্গাষ্টমীর সকাল৷ সকলে অঞ্জলি দেবে বলে উপস্থিত হয়েছে মুখার্জিদের পুজো দালানে৷ ভ্রমর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল শুভময় নেই৷ অপালা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘দাদাভাইকে খুঁজছিস?’

লজ্জা পেয়ে ভ্রমর বলেছিল, ‘তুই যে বললি, কাল রাতে এসেছে, চণ্ডীমণ্ডপে আসেনি?’

অপালা গম্ভীর গলা করে বলেছিল, ‘আসবে কী করে? সে যে কার্ল মার্কসের ভক্ত৷ তাই নাস্তিক৷ দুর্গা ঠাকুর তার কাছে মাটির পুতুল৷ তাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে৷’

 ভ্রমর ছুটে বাইরে এসে বলেছিল, ‘তুমি যাবে না, শুভময়? তাহলে আমিও দেব না অঞ্জলি৷’

শুভময় একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিল, ‘বিশ্বাস যার যার নিজের নিজের৷ তুমি দুর্গাকে দেবী মানো বলেই না শুদ্ধবস্ত্রে, উপবাস করে এসেছ, যাও, অঞ্জলি দিয়ে এসো, আমি অপেক্ষা করছি৷’

 ভ্রমর একচুলও নড়েনি৷ শুভময় বুঝেছিল, ওকে না নিয়ে সে যাবে না৷ বাধ্য হয়ে মণ্ডপে এসেছিল৷ অপলক তাকিয়ে দেখেছিল মৃন্ময়ী দুর্গা আর চিন্ময়ী ভ্রমরকে৷ লাল জরির পাড়, ক্রিম রঙের একটা রেশম সিল্কের বেনারসি পরে, কানে দুটো মুক্তোর বিন্দু, গলায় একছড়া মুক্তোর মালায় অপরূপা৷ ভিজে চুলের গোছাটা কোমরের শাড়িটাকে ভেজাতে ব্যস্ত৷ একমনে অঞ্জলির মন্ত্র উচচারণ করছিল ভ্রমর৷ ওর নিষ্পাপ আবদার রাখতেই সেদিন পুরোহিতের বলা মন্ত্র উচচারণ করেছিল শুভময় নিজের বিশ্বাসের ঘরে ফাঁকি দিয়ে৷

ধীরে ধীরে কাঁপা হাতেই ক্যানভাসে ফুটে উঠল সেই অষ্টমীর সকালের ভ্রমরের ছবিটা৷ ওই শাড়িটা পরে শুভময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আদুরে গলায় বলেছিল, ‘আমায় তোমার মডেল করতে পারো আজ৷’

 শুভময় ওর হাতটা নিজের হাতে রেখে বলেছিল, ‘এ ছবি মনোমন্দিরে খোদাই হয়ে গেছে৷ এঁকে দেব’খন, দেখো মিলিয়ে৷’

এঁকেছিল ভ্রমরকে, ভ্রমর হেসে বলেছিল, ‘মুক্তোর মালার লকেটের ডিজাইনটা যে আমার নিজেরই মনে নেই ভালো করে৷ তুমি এত নিখুঁতভাবে দেখলে কখন?’

শুভময় চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘সবাই যখন ঠাকুর দেখছিল তখন৷’

আজও চোখের সামনে সে দৃশ্য জীবন্ত৷ ক্যানভাসে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও, এ ছবিতে যেন খুঁত না থাকে৷ লাল পাড়টা দিয়ে ভ্রমরের যৌবন ঢাকতে ব্যস্ত হল শুভময়৷ কোমরের কাছটা পাতলা পাতলা কুঁচি আঁকছিল ও, ঠিক তখনই অনির্বাণ দরজা খুলে ঢুকে বলল, ‘দুজন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে৷ কী বলব? দেখা করবে?’

শুভময় বলল, ‘তোর কী হয়েছে রে? দিনকয়েক ধরে দেখছি, চোখ দুটো লাল, ঠিক করে খাচ্ছিস না৷ শরীর ঠিক আছে?’

অনির্বাণ একটু থেমে বলল, ‘ওদের কী বলব, বাবাই? ডাকব? নাকি বলব, তুমি দেখা করবে না?’

শুভময় বলল, ‘আজকাল তো মানুষজন আসেই কম৷ কষ্ট করে যারা মনে রেখে এসেছে তাদের পাঠিয়েই দে৷ কিন্তু তুই বললি না তো তোর কী হয়েছে?’

 ক্রাচটা দুবার মাটিতে অকারণে ঠুকে বলল, ‘সব অন্যায় মানুষ স্বেচ্ছায় করে না জানো, কিছু অন্যায় মানুষ নিজেকে রক্ষা করতেও করে৷ তবুও তাকে অন্যায়ের দলেই ফেলা হয়৷’

শুভময় বলল, ‘কী হেঁয়ালি করছিস? মন-খারাপ করছে? বর্ডারে ফিরতে ইচ্ছে করছে নাকি?’

অনির্বাণ বলল, ‘ইচ্ছে করলেই কি ফিরতে পারব? তাই আর ওসব ভাবি না৷ তাহলে ওদের পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’

অনির্বাণের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল শুভময়৷ আর কেউ না জানুক, শুভময় জানে, ওর এই জীবনটার ওপরে সম্পূর্ণ অধিকার আছে অনির্বাণের৷ কারণ ও না থাকলে সেদিন কিছুতেই বাঁচত না শুভময়৷ বৃষ্টি-ভেজা কলকাতার রাস্তায় একঝলক দেখেছিল ভ্রমরকে৷ গাড়ির জানালায় আনমনে ভেজা শহর দেখছিল ভ্রমর৷ মুহূর্তের দেখা৷ তাও ভ্রমর ওকে দেখেনি৷ বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে উঠেছিল৷ দীর্ঘ বছর পরে ভ্রমরকে দেখে৷ আনমনেই রাস্তা পেরোতে যাচ্ছিল শুভময়৷ সামনেই একটা লরির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল৷ নিশ্চিত মৃত্যু দাঁড়িয়েছিল ওর সম্মুখে৷ হঠাৎই একটা হ্যাঁচকা টানে রাস্তার ধারে টেনে নিয়ে গিয়েছিল কেউ ওর শরীরটাকে৷ কিন্তু একটা বাইক এসে অনির্বাণের পায়ে সজোরে ধাক্কা দিয়েছিল৷ বর্ডার ফোর্সের তরতাজা অনির্বাণের একটা পা চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল৷ বাবা-মা-হারা অনির্বাণের দায়িত্ব সেদিন থেকেই শুভময় নিজে নিয়েছিল৷ অনির্বাণকে দত্তক নিয়েছিল৷ সেই থেকেই অনির্বাণ এখানে আছে৷ পা-টা কমজোরি ঠিকই, কিন্তু মনে আর গায়ে জোর কিছু কম নেই৷ এ বাড়ির যাবতীয় কাজ একা হাতে সামলে আসছে অনির্বাণ৷ শুভময়কে যত্নের কোনো ত্রুটি করেনি কোনোদিন৷ একাকিত্বের জীবনে অনির্বাণই একমাত্র সম্বল শুভময়ের৷ তাই ওর মন খারাপ বা শরীর খারাপ হলে শুভময় উতলা হয়ে ওঠে৷ অনির্বাণের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা শুভময়ের নেই৷ ছেলেটার ছোটো থেকে শখ ছিল, বর্ডার ফোর্স জয়েন করবে৷ করেওছিল একুশ বছর বয়সে৷ কিন্তু শুভময়ের জন্য ছেলেটার স্বপ্নটা অর্ধেক পথ হেঁটে থমকে গেল৷

‘বাবা, এই যে এঁরা এসেছেন কলকাতা থেকে৷’ অনির্বাণ দুটো অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে৷

ছেলে-মেয়ে দুটোকে আগে দেখেছে বলে তো মনে পড়ল না শুভময়ের৷

‘ডক্টর, আমায় রিলিজ কখন করবেন?’ অরিত্রীর গলায় অস্থিরতার সুর৷ অধৈর্য লাগছে ওর৷ এখনও মনের মতো করে সাজগোজ বাকি, শুভময়ের সঙ্গে দেখা হবার মুহূর্তের জন্য এতদিনের অপেক্ষা ছিল ওর৷ ঠিক ওই ছবিটার মতো সাজবে বলেই সব কিনে রেখেছিল৷ কম ঘুরতে হয়নি ঠিক ওইরকম শাড়ি আর জুয়েলারি খুঁজতে৷ ঠিক এই সময়েই কিনা ওর এমন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে বসল৷ বিরক্ত হয়েই অরিত্রী ওকে চেকআপ করতে-আসা ডক্টরকে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবু, আমায় আজ ছাড়ছেন তো? আমি কিন্তু আজ কিছুতেই নার্সিং হোমে থাকব না৷’

 বয়স্ক ডক্টর হেসে বললেন, ‘বেশ বেশ, আজ ছুটিই দেব৷’

 চেকআপের পর ডক্টর শান্ত গলায় বললেন, ‘এত কম বয়েস, এখন এত চিন্তা কীসের? খাবে আর ঘুমাবে৷ ঘুমের সমস্যা হচ্ছে? টেনশন করো নাকি?’

অরিত্রী কিছু বলার আগেই ঈশানী আর তন্ময় ঢুকে বলল, ‘তোকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন৷’

 অরিত্রীর চোখে-মুখে উত্তেজনা আর লজ্জার মাখামাখি দৃষ্টি এড়াল না ঈশানীর৷ তন্ময়ও হয়তো মেয়ের এমন উচ্ছলতা অনেকদিন দেখেনি৷ ঈশানী বলল, ‘চল ঝুম, বাড়ি চল৷’

 অরিত্রী অবাক হয়ে বলল, ‘বাড়ি যাব মানে? সূর্যদা কোথায়, বাবা? আমি ওকে নিয়ে সোজা কালনা যাব? তোমায় যে বলেছিলাম, আমার আলমারি থেকে ওই ব্যাগটা আনতে, আনোনি?’

ঈশানী বলল, ‘সে তো এনেছি৷ কিন্তু নার্সিং হোমে তুই সাজবি?’

ঝুমঝুম হেসে বলল, ‘মোটেই না৷ সযতনে পার্লারে আমি কথা বলে রেখেছি৷ ওরা সব রেডি করে দেবে৷’

ঈশানী অসহায়ভাবে তন্ময়ের দিকে তাকাল৷ তন্ময় স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, সূর্য তো বাইরেই ওয়েট করছে৷ ওকে বলে দিয়েছি তোকে সাবধানে নিয়ে যেতে৷ কিন্তু ঝুম, আমার একটা রিকোয়েস্ট তোকে রাখতে হবে৷’

ঝুমঝুম কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আবার কী? প্লিজ আজ আমি যাব৷’

তন্ময় বলল, ‘তুই তো না শুনেই বলছিস৷ আমার ইচ্ছে শুভময়ের সঙ্গে পরিচয় করার৷ মানে আমার মামণি কার জন্য এত পাগল হল সেটা স্বচক্ষে দেখতে চাই৷ নিয়ে যাবি আমাদের?’

অরিত্রী লাজুক চোখে হেসে বলল, ‘তোমরা সত্যি যাবে?’

ঈশানী মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তুই ভালো থাকলে আমরাও খুশি৷ চল, কোন পার্লারে যাবি বললি সেখানে চল৷ ডক্টর বেশ কিছু ওষুধ দিয়েছেন, ওগুলো নিয়ম করে খেতে হবে কিন্তু৷ অবহেলা করলে চলবে না৷’

অরিত্রী আজ বাধ্য মেয়ে৷ অকারণেই যেন হেসে উঠতে চাইছে ওর ঠোঁট দুটো৷ চোখের কোনায় খুশির ঝলক৷ তন্ময় ফিসফিস করে ঈশানীকে বলল, ‘কোনো রিঅ্যাক্ট করবে না৷ জাস্ট দেখে যেতে হবে আমাদের৷ তারপর প্রয়োজন বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আপাতত শুভময়কে খুঁজে বের করাটা ভীষণ জরুরি৷’

উৎসব ফিসফিস করে বলল, ‘এ তো সত্তরের বৃদ্ধ, সুভদ্রা৷ আমাদের মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছে৷’

সুভদ্রা বলল, ‘দাঁড়াও, বুঝে নিতে দাও৷ আপনি ভ্রমর নামের কাউকে চেনেন, স্যার?’

শুভময় ঘাড় নেড়ে বলল, ‘কেন বলুন তো? আপনাদের কি ভ্রমর পাঠিয়েছে আমার কাছে? কে আপনারা? ভ্রমর এখন কেমন আছে?’

সুভদ্রা একটু বেশিই ভদ্রতা করছে শুভময় নামক লোকটির সঙ্গে৷ লোকটা একটা ফ্রড লোক৷ নিজের পুরোনো ছবি দেখিয়ে আর কবিতা-আঁকা পাঠিয়ে অল্পবয়সি মেয়ের সঙ্গে ফোনে সেক্স চ্যাট করে বেড়ায় হয়তো৷ না হলে এই তিয়াত্তর বছরের লোকটার প্রতি আকৃষ্ট হল কী করে অরিত্রী? লোকটার মরার বয়েস হয়ে গেছে, একটা ধেড়ে লোককে দত্তক নিয়েছে, তারপরেও এসব স্বভাব যায়নি৷ এমন কিছু কিছু বুড়ো লোক থাকে৷ সময়ে বিয়ে করেনি, এখন বাচচা মেয়েদের গায়ে হাত বুলিয়ে আশীর্বাদের নামে নিজের সুপ্ত কামনা চরিতার্থ করার ইচ্ছে৷ একটা পারভার্টের সঙ্গে সুভদ্রা এত নরম গলায় কথা কেন বলছে সেটাই বুঝতে পারছে না উৎসব!

সুভদ্রা বলল, ‘শুভময়বাবু, ভ্রমর আপনার প্রেমে পাগল সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন৷ এই বয়সে আর বিয়ে তো করবেন না, তাহলে মেয়েটাকে এভাবে মানসিক অত্যাচার করার কারণটা যদি বলেন?’

শুভময় হেসে বললেন, ‘আপনারা ভ্রমরের কে হন তা না বললে তো এত ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না৷ আপনারা যে ভ্রমরকে দেওয়া কবিতার ডায়েরিটা চুরি করেননি বা ওকে এঁকে-দেওয়া ছবিগুলো চুরি করে এনে এসব প্রশ্ন করছেন না তার গ্যারান্টি কে দেবে? আমার আর ভ্রমরের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি ছিল৷ আমরা জীবনেও অন্য কারো কাছে নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুলব না৷ এত বছর পরে আপনারা আচমকা এসে ভ্রমর আর আমার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নোত্তরের পসরা সাজিয়ে বসবেন আর আমি গোপন-করে-রাখা সমস্ত কথা বিনা দ্বিধায় বলে দেব এটা তো হয় না৷ তাই আগে নিজেদের পরিচয় দিন৷’

উৎসব বলল, ‘আপনি যে বেশ ভালোই হিপনোটাইজ করতে পারেন সেটা আপনার ঘোরানো কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে৷ আপনার জন্য মেয়েটা আজ হাসপাতালে৷ অথচ আপনি বসে বসে নিশ্চিন্তে সাদা ক্যানভাস ভরাচ্ছেন রঙে রঙে৷’

অনির্বাণ সম্ভবত বাইরে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে শুনছিল ওদের কথা৷ হঠাৎই বেশ বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনারা বাবার ওপরে হম্বিতম্বি না দেখিয়ে গিয়ে সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করুন যে কীসের আশায় এই বয়সের একজন মানুষের সঙ্গে সে সম্পর্ক রাখতে চাইছে? বাবা চোখ বুজলেই সম্পত্তির অধিকারী হবে বলে? এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গেছে কলেজে প্রফেসরি করে আর ছবির এগজিবিশনে গিয়ে বাবার সম্পত্তির পরিমাণটা বেশ শাঁসালো, তাই কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না৷ বাবার কবিতা বিলি করে করে বাবার খোঁজ চলছে৷ আপনারা যদি মেয়েটির রিলেটিভ হন তাহলে ওকে গিয়ে বলবেন সাবধানে থাকতে৷ না হলে এমন রোড অ্যাক্সিডেন্ট কিন্তু বার বার হবে৷’

উৎসব আঁতকে উঠে বলল, ‘তার মানে আপনিই মারতে চেয়েছিলেন ওকে?’

সুভদ্রা বলল, ‘সম্পত্তির ভাগীদার আসছে ভেবেই তার মানে এই আক্রমণ৷’

অনির্বাণ দরজায় একটা সজোরে ঘুসি মেরে বলল, ‘আমার আর আমার বাবার মধ্যে যদি কেউ ঢুকতে চায় তাকে প্রাণে মেরে দেব৷ এতদিন দেশের শত্রুদের মেরেছি, এবারে নিজের শত্রুকে মারব৷’

শুভময় বিস্মিত হয়ে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি ভ্রমরের অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছ? ছি ছি অনির্বাণ, তুমি এতটা নীচে কী করে নামতে পারো? শোনো, তোমাদের সকলকে একটা কথা বলছি, আমার ভ্রমর এসব পার্থিব সম্পত্তির অনেক ওপরে বাস করে৷ তার মনে এসব সামান্য পার্থিব জিনিস রেখাপাত করে না৷ সে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিল আমার জন্য৷ যা জানো না, সেগুলো নিয়ে তোমরা এসব নোংরা আলোচনা বন্ধ করো৷ অনির্বাণ, ভ্রমরকে তুমি আদৌ চেনো না, তাই হয়তো সম্পত্তির ভাগীদার জুটবে, ভাবছ৷’

সুভদ্রা বলল, ‘বুঝতে পারছেন, একটা মেয়ের জীবনকে আপনি কতটা বিপদগ্রস্ত করে তুলেছেন? আপনার ছেলে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে মারতে ছুটছে৷ মেয়েটার অপরাধ একটাই, সে না বুঝে আপনাকে ভালোবেসেছে৷’

 শুভময় উদাস হেসে বললেন, ‘ভালো শুধু সে একাই বাসেনি৷ যাক গে, এ নিয়ে আমি আপনাদের কোনো কৈফিয়ত দেব না৷ আপনারা আসতে পারেন৷’

উৎসব ফিসফিস করে বলল, ‘সুভদ্রা, পারমিতা মেসেজ করেছে৷ বলছে, অরিত্রীকে আজ ছেড়ে দিল নার্সিং হোম থেকে৷ ও নাকি কালনা আসছে৷’

 সুভদ্রা বলল, ‘তুমি যে বললে, অরিত্রীকে আগেই ছেড়ে দিয়েছিল, ও পুলিশে বয়ানও তো দিয়েছে৷’

 উৎসব বলল, ‘জানি না৷ তাহলে কি পুলিশ ওর বয়ান নিতে নার্সিং হোমই গিয়েছিল? নাকি ওর বাবা আগের নার্সিং হোম থেকে বার করে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছিল বেটার ট্রিটমেন্টের জন্য? দেখো সুভদ্রা, সব খবরটাই তো আমি ভায়া পাচ্ছি৷ তাই কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে কে জানে! মোট কথা, পারমিতা জানাল, অরিত্রী আসছে এখানে৷’

সুভদ্রা বলল, ‘তার মানে অরিত্রী শুভময়ের খোঁজ জানে৷’

উৎসব একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘আমাদের দেখা হয়ে গেছে শুভময়কে৷ এবারে চলো৷ আমি চাই না অরিত্রী এসে এখানে আমায় দেখুক৷ হয়তো ভাববে, ওর ভালোবাসা আমি কেড়ে নিতে এসেছি৷ বলা যায় না, মেয়েকে মারার অভিযোগে বাবা থানায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল, এবারে শুভময়কে কুবুদ্ধি দেবার অভিযোগে মেয়ে জিডি করল আমার নামে৷ আমি যথেষ্ট পুরস্কার পেয়ে গিয়েছি, সুভদ্রা৷ ভালোবাসার জন্য আর পুরস্কারের প্রয়োজন নেই আমার৷ প্লিজ এখান থেকে চলো৷’

সুভদ্রা বলল, ‘বিশ্বাস করো, কিছু তো একটা গোলযোগ আছেই৷ আমার মন বলছে, কোনো একটা হিসেবে গোলমাল হচ্ছে৷’

 উৎসব বলল, ‘তুমি তো মন নিয়ে কাজ করতে চাও, গোয়েন্দা তো তুমি নও৷ এখানে কোনো মনের কারবার নেই, সুভদ্রা৷ একজন ক্রিমিনাল রয়েছে পাশের ঘরেই, যে তার বাবার সম্পত্তির ভাগীদার আসছে ভেবে রীতিমতো খুন করতে গিয়েছিল অরিত্রীকে৷ ওই দেখো শুভময়ের টেবিলের পাশে অরিত্রীর ফোন নম্বর লেখা কাগজটা পড়ে আছে৷ এটাই অরিত্রী রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিলি করছিল৷ ওটাই কোনোভাবে অনির্বাণের হাতে পড়েছিল৷ তখনই ও অরিত্রীকে দেখে থাকবে৷ বাকিটা ফলো করে বের করেছে, ও কোথায় পড়ে৷ নিজের বাবার কবিতা আর সাইন চিনেই মারতে গিয়েছিল ওকে৷’

 সুভদ্রা বলল, ‘রাইট৷ তারপর ও তো নিজের সন্তানও নয়৷ দত্তক নিয়েছে, বলছিল সহজ৷’

উৎসব ফিসফিস করে বলল, ‘ওই দেখো, অরিত্রীকে আঁকছে শুভময়৷’

সুভদ্রা বলল, ‘ছবির মেয়েটার সঙ্গে অরিত্রীর মুখের মিল আছে ঠিকই, কিন্তু কিছু একটা পার্থক্য লাগছে৷’

উৎসব বলল, ‘এ লোক বড়ো খেলোয়াড়৷ কিছু একটা প্ল্যান করেই এগোচ্ছে৷ সেটা ওই তন্ময়বাবু আর ঈশানীদেবীকেই বুঝতে দাও৷ অর্থের অহংকারে চিরকালই অন্ধ এই মানুষ দুটো৷ অরিত্রী বলত, ওদের ড্রয়িং রুমে নাকি টাকার গল্প হয় সর্বক্ষণ৷ ওটাই নাকি ওদের এন্টারটেইনমেন্ট৷ তন্ময়বাবু তো থানায় বয়ান দিয়েছিলেন, অরিত্রীর টাকার লোভেই নাকি আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম৷ এখন অরিত্রীর অন্যত্র সম্পর্ক হতে ব্রেকআপ হয়ে যাওয়ায় আমি নাকি ওকে রাগের মাথায় মারতে গিয়েছিলাম৷ এখন নতুন রিটায়ার্ড প্রফেসর জামাই নিয়ে কী করবে সেটা ওরাই ঠিক করুক সুভদ্রা৷ চলো৷ আমি অরিত্রীর মুখোমুখি হতেই চাই না৷’

কথা শেষ হবার আগেই উৎসব দেখল, অরিত্রী ঢুকছে গেট দিয়ে৷ সুভদ্রাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে পিলারের পিছনে আড়াল করল নিজেদের৷ শুভময়ের কোনো খেয়াল নেই৷ সে তার ভ্রমরের চোখ আঁকতে ব্যস্ত৷ পিলারের পিছন থেকে উঁকি দিয়ে উৎসব তার তিন বছরের পরিচিত অরিত্রীকে দেখল৷ এ যেন অন্য কোনো মেয়ে৷ এ মেয়েকে চেনে না উৎসব৷ পুরোনো ডিজাইনের মসলিনের শাড়ি, ম্যাচিং লম্বাহাতা ব্লাউজ৷ চুলে পফ করে খোঁপা-বাঁধা৷ গলায় মুক্তোর হার৷ সব মিলিয়ে কেমন যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নায়িকা মনে হচ্ছে৷ গোটা সাজটার মধ্যে একটা সাবেকি ঢং৷ হাঁটার মধ্যেও সেই চঞ্চলতা নেই৷ উৎসবের সঙ্গে যখন বাইরে বেরোত তখন এক-পা হেঁটেই বলত, ‘চলো, বাড়ি ফিরি৷’ অদ্ভুত এক চঞ্চলতা কাজ করত আপাত শান্ত মেয়েটার মধ্যে৷ উৎসব বার বার জিজ্ঞাসা করত, ‘অরিত্রী, তুমি কি খুশি নও এ সম্পর্কে?’ অরিত্রী ওর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলত, ‘তোমায় পেয়ে কেউ খুশি না হলে তাকে খুশি করার দায়িত্ব তোমার নয়, উৎসব৷ কারণ এত যত্ন নেওয়া, এভাবে সব বিষয়ে প্রশ্রয় দেওয়া জীবনসঙ্গীকে পেয়ে যদি কেউ খুশি না হয় তার খুশি হবার অধিকারই নেই৷’ উৎসবের তবুও বার বার মনে হত অরিত্রী যেন কিছু খুঁজছে যেটা ওর মধ্যে হয়তো ছিল না৷ তাই তো আরেকজনের খোঁজে নেমেছিল৷ সুভদ্রা কানের কাছে এসে বলল, ‘ছবির থেকেও ঢের সুন্দরী তোমার প্রেমিকা, উৎসব৷’ উৎসব হেসে বলল, ‘প্রাক্তন৷ আমাদের চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু ইচ্ছে করছে, শুভময়ের সঙ্গে অরিত্রীর প্রথম দর্শনের দৃশ্যটুকু দেখেই যাই৷ মেয়েটা কম তো খোঁজেনি শুভময়কে৷’

সুভদ্রা হেসে বলল, ‘এটা হয়তো তুমি অভিমান থেকে ব্যঙ্গ করে বলছ, কিন্তু আমি বলছি উৎসব, কিছু একটা সমস্যা আছেই৷’

উৎসব বলল, ‘ওই যে উনি অরিত্রীর বাবা আর পাশের মহিলা মা৷’

সুভদ্রা বলল, ‘অরিত্রী কিন্তু এদের মতো দেখতে হয়নি৷ ঠিক যেন অল্প বয়সের শর্মিলা ঠাকুর৷ সাজটাও ওরকমই সেজেছে অবশ্য৷ কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে মুখের মিল নেই৷’

 উৎসব বলল, ‘ওই যে ডানদিকে তাকাও৷ অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে লুকিয়ে৷ ওর পালিত বাবার সম্পত্তি অন্য কারো কাছে যেতে দেবে না৷ জানেই না অরিত্রীরা শুভময়বাবুকে বার দুয়েক কেনা-বেচা করার ক্ষমতা রাখে৷ বিষয়টা যে সম্পত্তিঘটিত নয় সেটুকু ঢুকছে না লোকটার মাথায়৷’

সুভদ্রা ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলল উৎসবকে৷

অরিত্রী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ক্যানভাসের সামনে৷

ক্যানভাসে আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুভময়, তুমি আমার ছবি এঁকেছ কিন্তু ঠোঁটের নীচে এ তিল তো আমার নেই৷’

তন্ময় বলল, ‘ঈশানী, এ ছবিটা আমার মায়ের অল্প বয়সের ছবি৷ এ ছবি ঝুমের নয়৷ মায়ের অ্যালবামে সাদা-কালো এমন কয়েকটা ছবি আমি দেখেছিলাম৷’

 ঈশানী বলল, ‘আসলে ঝুমের সঙ্গে তোমার মায়ের মুখের অসম্ভব মিল৷ নাক, চোখ, ঠোঁটের গড়ন সব এক৷ তাই তোমার মা মনে হচ্ছে৷ সাইড থেকে দেখো, এ ঝুমঝুমেরই ছবি৷’

 তন্ময় বলল, ‘ভালো করে দেখো, ঠোঁটের নীচে তিল আছে ঝুমের? মায়ের ছিল৷ তুমি মা-কে যখন দেখেছ তখন মায়ের বয়েস প্রায় বিয়াল্লিশমতো৷ এ ছবি মায়ের স্কুলবেলার৷ তাই তোমার চোখে মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷’

ঈশানী বলল, ‘তারপর কিডনির সমস্যার জন্য মায়ের মুখটা ফুলেও গিয়েছিল অনেক৷ আমার বিয়ের পর থেকেই তো নানা রোগে ভুগতেন৷ কিন্তু তন্ময়, এই ধরনের ছবিই তো বেশ কয়েকটা পেয়েছিলাম ঝুমের আলমারিতে৷ ছবির নীচে লেখা ছিল— ভ্রমর৷ মায়ের হলে তো শোভনা লেখা উচিত ছিল৷’

তন্ময় বলল, ‘ওই দেখো, শুভময়বাবু কী বলছেন, শোনো৷’

শুভময় অপলক তাকিয়ে আছে অরিত্রীর দিকে৷ ঠোঁটটা কাঁপছে ওঁর৷ ভারী চশমার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে নোনতা জলের ধারা৷

অরিত্রী জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার ওপরে আমার ভারী অভিমান হয়েছে৷ স্বপ্নে তোমার বাস ছিল বহুদিন ধরে৷ তোমায় খুঁজেছি পাগলের মতো৷ কেন নিজেকে এভাবে লুকিয়ে রেখেছিলে?’

শুভময় কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমিই তো বলেছিলে, আর কোনোদিন যেন তোমার সামনে না আসি৷ আমার মুখ দেখলে সংসার এলোমেলো হতে পারে তোমার৷’

কথাটা বলেই সংবিৎ ফিরে পেলেন যেন ভদ্রলোক৷ হঠাৎই যেন স্বপ্নভঙ্গ হল শুভময়ের৷ চশমার ঝাপসা-হয়ে-যাওয়া কাচটা ভালো করে মুছে বেশ কয়েক পলক তাকিয়ে থাকলেন অরিত্রীর দিকে৷ চমক ভাঙা গলায় বললেন, ‘কে আপনি? অবিকল আমার ভ্রমরের মতো দেখতে? আমার ভ্রমরও স্কুলবেলায় আপনার মতোই দেখতে ছিল৷ তাই আমি ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম৷ আপনার সঙ্গেই কি গতকাল কথা হয়েছিল আমার?’

 অরিত্রী ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল, ‘শুভময়, কোনো ভুল হচ্ছে না৷ আমিই তোমার ভ্রমর৷ হাঁটিপুরের ভ্রমর৷ সরস্বতীপুজোর দিন, দুর্গা অষ্টমীর দিন, দোলের দিনের সেসব স্মৃতি কি তোমায় মনে করিয়ে দিতে হবে, শুভ?’

উৎসব ফিসফিস করে বলল, ‘সুভদ্রা, মেয়েটার মাথাটা কি গেল নাকি? দাদুর বয়সি লোককে শুভ বলে নাম ধরে ডাকছে?’

 সুভদ্রা বলল, ‘চুপ৷ আমায় শুনতে দাও৷ আমার মনে হচ্ছে, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম৷’

অরিত্রী বলল, ‘এসব কী কথা, শুভ? আমি তো তোমার হাত ধরে সেদিন বিয়ের মণ্ডপ ছাড়তে প্রস্তুত ছিলাম৷ তুমিই এলে না সীমানা নদীর ধারে৷ শেষে চিঠি পাঠালে৷ লিখলে—বাউন্ডুলে একজনের সঙ্গে নিজের জীবনের সুতোটা বেঁধো না ভ্রমর৷ আমি এখনও নিজে প্রতিষ্ঠিত নই, তোমাকে এ ভবঘুরে জীবনে নিয়ে যাই কী করে? সুখী হও ভ্রমর৷ আমিও রাগের মাথায় লিখলাম, ওই মুখ আর দেখিয়ো না আমায়৷ তুমি এখনও সেই কথা ধরে বসে আছ?’

ঈশানী তন্ময়ের কানে কানে বলল, ‘এসব কী বলছে ঝুম? কার বিয়ের মণ্ডপ? কীসের বিয়ে?’

তন্ময় বলল, ‘এ কোন ঝুম? আমার কেমন ভয় করছে, ঈশানী৷ ঝুমের কি কোনো মেন্টাল প্রবলেম হল?’

শুভময় অবাক হয়ে বলল, ‘আমার চিঠির প্রতিটা শব্দ আপনি ঠিক বলছেন৷ কে আপনি? আমার ভ্রমরের বয়েস এখন প্রায় সাতষট্টি হবে৷ আপনার বয়েস কত আর? হয়তো একুশ বা বাইশ৷ আপনি আমার আর ভ্রমরের কথোপকথন জানলেন কী করে? কে হন আপনি ভ্রমরের?’

ঝুমঝুম হেসে বলল, ‘এ তোমার ভারী অন্যায়, শুভ৷ আগে তো আমি রাগ করতাম, তুমি আমায় কবিতা লিখে মান ভাঙাতে৷ এখন আমি কবিতা লিখি কী করে? তুমি তো জানো, না আমি ভালো ছবি আঁকতে পারি, না কবিতা লিখতে! আমি শুধুই অভিমান করতে পারি, শুভ৷ প্লিজ আর রাগ করে থেকো না৷ দেখো, চিনতে পারছ এই মুক্তোর মালাটাকে? যেটা আমি রাগ করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম হাঁটিপুরের গাজনের মেলায়৷ তুমি আসতে দেরি করেছিলে বলে? তারপর প্রতিটা মুক্তো খুঁজে সে মালাকে তুমিই তো নিখুঁতভাবে গেঁথে দিয়েছিলে আমায়৷’

শুভময় বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কে আপনি? এসব কথা কে বলল আপনাকে?’

অরিত্রী আদুরে গলায় বলল, ‘আমি তোমার ভ্রমর৷ যে নামটা আমি সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম সংগোপনে৷’

 ঘরের এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে হঠাৎই বেশ উচ্চস্বরে হেসে উঠল অরিত্রী৷ দেওয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এই যে মশাই নাস্তিক, কমিউনিস্ট দেওয়ালে রামকৃষ্ণদেবের ছবি কেন? কবে থেকে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শুরু করলে? আগে তো প্রসাদ দিতে গেলে বলতে, ফল বলো, প্রসাদ নয়৷’

শুভময় এতক্ষণে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, আরও দুজন স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে আছে খোলা দরজার সামনে৷ অরিত্রী বলল, ‘ওহ পরিচয় করিয়ে দিতেই তো ভুলে গেছি৷ এঁরা হলেন আমার বাবা আর মা৷ আলাপটা সেরে রাখো৷ যা ভিতু তুমি৷ আগে তো চারবার চেষ্টা করেও বাবার মুখোমুখি হতে পারোনি৷ এবার বাবা নিজেই এসেছে৷ আলাপ করো শুভ৷’

শুভময় বললেন, ‘আমি আলাদাভাবে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই৷’

তন্ময় বলল, ‘আপনি এখানেই বলুন-না৷ আপনার সঙ্গে ঝুমঝুমের পরিচয় কীভাবে হয়েছিল— ফেসবুকে?’

শুভময় ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘দেখুন, আমি আপনার মেয়েকে চিনি না৷ সত্যি বলতে কী, কখনো দেখিনি৷ দু-দিন আগে আমার ঘরের সামনে একটা মোচড়ানো কাগজ পড়ে ছিল৷ কাগজটা তুলে দেখলাম আমার লেখা কবিতার প্রিন্ট কপি৷ নীচে আমার সাইন করা৷ কিন্তু এ কবিতা আমার এখনকার লেখাই নয়৷ এ লিখেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়তে৷ পাতার সাইডে একটা ফোন নম্বর ছিল৷ সেটাতে ফোন করতেই একটি মহিলা বলে উঠল, ভ্রমর বলছি৷ আমি ভেবেছিলাম, আমার ভ্রমর হয়তো কোনোভাবে কাউকে দিয়ে এ কবিতার পাতাটা পাঠাতে চেয়েছে আমার কাছে৷ নিজের ফোন নম্বর লিখে দিয়েছে, যাতে আমি যোগাযোগ করি৷ আমি বলেছিলাম, শুভময় বলছি৷ তখন সে বলেছিল, তোমার বর্তমান ঠিকানা দাও, আমি আসছি৷

‘আজকে তার আসার কথাও ছিল৷ এখন আপনার মেয়ে এসে দাবি করছে সে-ই ভ্রমর৷ আমি মানলাম, ওর গলার স্বর বা চেহারার সঙ্গে ভ্রমরের অনেকটা মিল আছে, কিন্তু এ আমার ভ্রমর নয়৷ কারণ তার বয়েস অনেক হয়েছে৷ সে আমার যৌবনের প্রেম৷ বলতে পারেন একমাত্র প্রেম৷ আজ আমি অবিবাহিত তার জন্যই৷ জীবনে আর কাউকে তার স্থানে বসাতে পারব না বলেই সে চেষ্টা করিনি৷ তা ছাড়া ভ্রমর বিয়ে করে ঘোর সংসারী হয়েছিল৷ তার দুই সন্তানও হয়েছিল৷ এ অবধি আমি তার খবর জানতাম৷ তারপর আর জানা হয়নি৷ কিন্তু আপনার মেয়ে কীভাবে আমাদের গোপন কথা জানল সেটাই বিস্ময়!’

তন্ময় বলল, ‘আপনার ভ্রমরের ভালোনাম কি শোভনা ছিল? প্রফুল্লচন্দ্র স্কুলের ছাত্রী ছিল?’

শুভময় আচমকাই উত্তেজিত হয়ে তন্ময়ের হাত দুটো ধরে বললেন, ‘হ্যাঁ৷ আপনি তাকে চেনেন? কেমন আছে সে?’

তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘না, তিনি আর ইহজগতে নেই৷ উনি আমার মা ছিলেন৷ হাঁটিপুরে আমার মামাবাড়ি ছিল৷ পরে বড়োমামা ত্রিবেণি চলে এসেছিল বলে হাঁটিপুরে আর যাওয়া হয়নি৷ মা তার নাতনির নাম দিয়েছিল ভ্রমর৷ এই যে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে৷’

শুভময় তন্ময়কে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি ভ্রমরের ছেলে? তুমি যে আমার বড়ো কাছের মানুষ৷ কিন্তু ভ্রমরের নাতনি এসব কী বলছে, বাবা? আমি তো তাকে চিনি না৷’

 ঈশানী এগিয়ে এসে বলল, ‘মেসোমশাই, আমার শাশুড়ি মা রোজ রাতে ডায়রি লিখতেন৷ উনি মারা যাবার পরে সে ডায়েরিটা কেউ পাইনি আমরা৷ গতকাল সেটা আবিষ্কার করলাম ঝুমঝুমের ব্যাগ থেকে৷ সম্ভবত ও ঠাকুমার ডায়েরি পড়েই আপনাদের কথা জেনেছে৷ তা ছাড়া মায়ের সঙ্গে ওর অসম্ভব ভালো বন্ডিং ছিল৷ মা ওকে সব গল্প বলত৷ আপনার কবিতার খাতা, আপনার আঁকা সব ছবি রয়েছে ঝুমের আলমারিতে৷ তা ছাড়া আপনার পুরোনো কিছু কম বয়েসের ছবিও দেখেছি আমি৷ আপনার দেওয়া ভ্রমর নামটাই মা তার নাতনিকে ডাকত৷ ঠাকুমা মারা যাবার পরে ঝুমের অদ্ভুত পরিবর্তন হচ্ছিল৷ বেশি কথা বলত না৷ কাউকে সহ্য করতে পারছিল না৷ হঠাৎই শুভময়ের সঙ্গে দেখা করবে বলে পাগল হয়ে উঠেছিল৷ এখন বুঝতে পারছি, ও ওর ঠাকুমার এসব জিনিস পড়েই আপনাকে মনে মনে কল্পনা করেছিল৷’

শুভময় ইতস্তত করে বলল, ‘ভ্রমর চলে গেল, যাবার আগে একবার দেখা করেও গেল না৷ এত তার অভিমান! তখনও যে চাকরি পাইনি আমি৷ বাড়ির মেজোছেলে, বড়দার বিয়ে হয়নি তখনও, কী করে নিজের বিয়ের কথা বলতাম৷ কিছুতেই বুঝল না ভ্রমর৷ একরাশ অভিমান আজীবন বয়ে বেড়াল৷ আমাকেও অপরাধের ভাগীদার করে চলে গেল৷’

অরিত্রী ঘুরে ঘুরে শুভময়ের ঘর দেখতে ব্যস্ত৷ এসব কথা শোনায় ওর কোনো ইন্টারেস্ট নেই৷

উৎসব বলল, ‘সুভদ্রা, অরিত্রী কি নিজেকে শোভনাদেবী ভাবছে নাকি?’

সুভদ্রা বলল, ‘হ্যাঁ৷ ও নিজের ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে নিজেকে শোভনাদেবীর জায়গায় বসিয়ে কল্পনা করছে৷ তাই বুঝতেই পারছে না ওর বয়েস বাইশ আর শুভময়ের তিয়াত্তর৷ ও ঠাকুমার স্কুলবেলা, কলেজবেলা পড়েছে ডায়েরিতে, তখন শুভময় তরুণ৷ সেইভাবেই কল্পনা করছে নিজেদের৷ উৎসব, অরিত্রী কিন্তু সিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্ট৷ ও কল্পনার জগতে বাস করছে৷ অবাস্তব ফ্যান্টাসির জগতে রয়েছে ও৷ ওর মেন্টাল ট্রিটমেন্ট দরকার৷’

 উৎসব বলল, ‘ওর ঠাকুমা মারা যাবার পরে কেমন ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল যেন৷ তখন থেকেই শুরু হয়েছে এই সমস্যাটা৷’

 সুভদ্রা বলল, ‘হ্যাঁ, একাকিত্ব কারণ হতেই পারে৷ একেকজনের একেকরকম সিমটম দেখা যায় এ রোগে৷’

অরিত্রী হঠাৎই বলল, ‘মা, পাপা, তোমরা এখন এসো৷ আমি আজ থেকে শুভময়ের সঙ্গেই থাকব৷’

শুভময়ের চোখে ভয়৷ কাঁপা গলায় বললেন, ‘কিন্তু দিদিভাই, আমি যে বয়স্ক মানুষ৷ আজ আছি, কাল নেই৷ এখানে তুমি থাকবে কী করে?’

অরিত্রী হেসে বলল, ‘ধুর, আর তোমার ইয়ারকি ভালো লাগছে না, শুভ৷ তুমি আমার থেকে মাত্র বছর পাঁচেকের বড়ো হবে৷ এমন বুড়ো-বুড়ো কথা বলবে না তো৷ বলো আমাদের বেডরুমটা কোথায়? আমি চেঞ্জ করব৷’

 শুভময় অসহায়ের মতো তাকালেন ঈশানীর দিকে৷ ঈশানী বলল, ‘এভাবে থাকাও যায় না, ঝুম৷ আজকে বাড়ি চলো৷ ব্যাগপত্র গুছিয়ে, ব্যবস্থা করে আসতে হবেই৷’

ঈশানী অরিত্রীর হাত ধরে টানতেই এক ঝাঁকুনি দিল অরিত্রী৷ ঈশানী পড়তে পড়তে কোনোক্রমে বাঁচল৷ তন্ময় কিছু একটা বলতে যেতেই হাতে একটা জলের বোতল তুলে ওর দিকে টার্গেট করে ঝুমঝুম বলল, ‘পাপা, আমি তোমাদের ব্যস্ত জগতে কোনোদিন ঢুকিনি৷ প্লিজ, এবারে যদি শুভময়ের থেকে আমায় আলাদা করার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷’

এ অরিত্রীকে উৎসব চেনে না৷ সফিস্টিকেটেড মেয়ে, এমন মারমুখী অ্যাগ্রেসিভ তো দেখেনি কোনোদিন৷ একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এরকম করা যায়! কেন অরিত্রী কোনোদিন উৎসবকে এভাবে ভালোবাসল না? নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়েই উৎসব দেখল, অনির্বাণ বেশ গলাবাজি করছে, ‘মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি? এ শহরে আমাদের একটা সম্মান আছে৷ হঠাৎ এক অল্পবয়সি মেয়ে এসে বাবাকে প্রেমিক বলে দাবি করছে, এ বাড়িতে থাকবে বলে আবদার করছে— এগুলো তো মেনে নেওয়া যায় না৷’

 তন্ময় বলল, ‘দেখুন, বুঝতেই তো পারছেন, ওর একটু মেন্টাল প্রবলেম হচ্ছে, আমরাও চাইছি ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে৷’

 অনির্বাণ বিরক্ত গলায় বলল, ‘তা পাগল মেয়েকে ডাক্তার দেখান৷ এভাবে লোকের বাড়িতে এনে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন কেন?’

শুভময় স্থির গলায় বললেন, ‘অনির্বাণ, তুমি ঘরে যাও৷ এরা ভ্রমরের নিজের লোক, আমারও আপনজন৷ এদের সঙ্গে এ ভাষায় কথা বলবে না৷’

অনির্বাণ দুমদাম পা ফেলে নিজের ঘরে চলে গেল৷

উৎসব ফিসফিস করে বলল, ‘সুভদ্রা চলো৷ অরিত্রী এই সময় আমায় দেখলে আরও রাগ করবে হয়তো৷ তা ছাড়া ওর বাবা-মায়েরও সম্মুখীন হতে চাইছি না আমি, প্লিজ৷’

 অরিত্রী মারমুখী রূপ ছেড়ে কাঁদতে শুরু করেছে৷ আকুল-করা সে কান্না৷ হৃদয় নিংড়ে যেন বেরিয়ে আসছে নোনতা জলের ধারারা৷

ঈশানী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আজ চলো, আমরা আবার আসব৷’

ঝুম কান্না-ভেজা গলায় বলল, ‘কেন মা, আমি তো শরীরে-মনে শুধুই শুভময়ের? কেন আমি ওর কাছে থাকতে পারব না? সমাজের ভয়ে? ঠিক আছে, তোমরা আজই আমার আর শুভর বিয়ে দিয়ে দাও৷ তাহলে তো সমাজ কিছু বলবে না৷’

 তন্ময় বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ঝুম, তুই কি পাগল হলি? একজন তিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধকে বিয়ে করবি বলে কাঁদছিস? ভালো করে দেখ বাস্তবটাকে৷ শুভময়বাবুর বয়েসটা দেখ৷ তা ছাড়া উনি তোকে ভালো’…

তন্ময়ের কথা শেষ হবার আগেই উৎসবের পাশ থেকে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল সুভদ্রা৷ তন্ময়ের কথার রেশ ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, ওরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসে সেটা আমাদের হাঁটিপুরের সবাই জানত৷ অরিত্রী চলো, আমরা হাঁটিপুরের সীমানা নদীর ধারে যাই৷ শুভময় ওখানেই অপেক্ষা করবে তোমার জন্য৷ এই ইট-কাঠ-পাথরের বাড়িতে তোমাদের মিলন হোক এ বোধহয় হাঁটিপুরের গাছগুলোও চাইছে না৷’

 সুভদ্রার এসব কথা শুনে অরিত্রীর কান্না থেমেছে৷ ভেজা চোখেই বলল, ‘ওহ, এবার বুঝলাম৷ শুভ আমার সঙ্গে ওখানে দেখা করতে চাইছে? বেশ তবে তা-ই চলো৷ আমার স্কুলটাও ঘুরে আসব একবার৷’

 সুভদ্রা ইশারায় ঈশানী আর তন্ময়কে চুপ করতে বলল৷ অরিত্রীর হাত ধরে ওকে নিয়ে গেল গাড়ি অবধি৷ ঈশানী বলল, ‘আপনার পরিচয়টা? ঠিক চিনতে পারলাম না৷’

 সুভদ্রা বলল, ‘আমি অরিত্রীর বন্ধু৷ আসলে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছি৷ এসব কেস দেখেছি৷ ও সিজোফ্রেনিয়া পেশেন্ট৷ বকেঝকে লাভ নেই৷ ও বাস্তব থেকে অনেক দূরে, নিজের বানানো কল্পনার জগতে বাস করছে৷ সেখানে ও শোভনাদেবীর স্কুলবেলার জীবন কাটাচ্ছে৷ তাই ওকে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে৷ আর আপনাদের যত্ন খুব প্রয়োজন৷ আপাতত বাড়ি নিয়ে যান৷ ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন৷’

তন্ময় সুভদ্রাকে থ্যাঙ্কস জানিয়ে গাড়িতে উঠল৷

অরিত্রীর গলা শোনা যাচ্ছে, ‘সূর্যদা, সোজা হাঁটিপুর চলো৷’

শুভময় সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন৷ ওঁর আপাতত একটু নিস্তব্ধতা প্রয়োজন৷ কত বছর ধরে সযত্নে লুকিয়ে-রাখা অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে দিয়ে গেল মেয়েটা৷ সেই চিঠি, সেই রাত সব মনে করিয়ে দিয়ে গেল৷ ভ্রমর আর নেই এ পৃথিবীতে—এটা শোনার পর থেকেই কেমন যেন অবসন্ন লাগছে শরীরটা৷ খুব আশা ছিল, একদিন অভিমান কমবে, সেদিন নিশ্চয়ই খোঁজ করবে শুভময়ের৷ একবার হয়তো শেষ দেখা হবে এই আশায় দিন গুনত শুভময়৷ আজ শেষ আশাটুকুও নীরবে শেষ হল৷ আর ভ্রমরের নাতনির কণ্ঠস্বর, কথা বলার ভঙ্গিমা সবই যেন সেই আঠারোর ভ্রমর৷

 শুভময়ের সব সংযম যেন ভেঙে দিয়ে গেল মেয়েটার স্পর্শ৷ এতদিনের জমিয়ে-রাখা যন্ত্রণার প্রকোষ্ঠটা আজ ছটফট করে তালা ভাঙতে চাইছে৷

আবারও ক্যানভাসে মন দেওয়ার চেষ্টা করল শুভময়৷ ঠোঁটের নীচের তিলটাকে আরেকটু স্পষ্ট করল তুলির ছোঁয়ায়৷

উৎসব স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়েই বলল, ‘তুমি হঠাৎ বেরোতে গেলে কেন? অরিত্রীর মায়ের প্রচুর প্রশ্ন, তোমার ফোন নম্বর নিলেন তো ভদ্রমহিলা, দেখো, অযথা প্রশ্ন করবেন৷’

সুভদ্রা বলল, ‘তোমার বোধহয় এখন থাকা উচিত ওদের পাশে৷ আসলে মেয়েটা অসুস্থ তো৷’

উৎসব বলল, ‘না সুভদ্রা, উচিত নয়৷ কলকাতা শহরে অনেক ডাক্তার আছেন, না হলে ওঁরা মেয়েকে নিয়ে রাতারাতি বিদেশ যেতে পারেন৷ কিন্তু আমি জেলে থাকলে কাউকে পাশে পাব না৷ তাই প্লিজ, অরিত্রীর প্রসঙ্গটা থাক৷ আমি চাই, ও সুস্থ হয়ে উঠুক৷ মনের মতো জীবনসঙ্গী পাক৷ কিন্তু আমি ওদের মেয়েকে সম্পত্তির লোভে ভালোবাসিনি কোনোদিনই, এটুকু বোঝানোর জন্যই ওদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকবে না আমার৷ তুমি রাখলে রাখতে পারো সুভদ্রা, কিন্তু প্লিজ আমায় এ অনুরোধ করো না৷’

সুভদ্রা বলল, ‘বেশ করব না৷’

উৎসব চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল৷ সুভদ্রাও তাকিয়ে আছে জানালার দিকে৷ শুধু গাড়ির যান্ত্রিক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ উৎসব হঠাৎ বলল, ‘তাহলে মিস সুভদ্রা, মানালি গিয়ে দুটো কাজ হল, বলো? এক, সহজকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া৷ দুই, অরিত্রীর আসল সমস্যা জানা৷’

সুভদ্রা আলতো করে উৎসবের হাতের ওপরে হাতটা রেখে বলল, ‘তিন, সারাজীবনের জন্য একজন ভালো বন্ধুকে পাওয়া৷’

 উৎসব বলল, ‘অরিত্রী আমায় কোনোদিন মন থেকে ভালোবাসেনি, সুভদ্রা৷ আমি ওর মনের রাজ্যে প্রবেশ করতেই পারিনি কোনোদিন৷ খুব ইচ্ছে করে, কারো মনে আমার একচ্ছত্র অধিকার থাকুক৷’

সুভদ্রা হেসে বলল, ‘পড়ে আছে শূন্য সিংহাসন, পারো তো নিজের অভিষেক করিয়ে নাও৷’

উৎসব হেসে বলল, ‘আপ্রাণ চেষ্টা করব৷’

ওদের গাড়িটা ছুটছে মনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে৷ মন-আয়নায় ফুটে উঠছে রংবেরঙের ছবি৷

সমাপ্ত

অধ্যায় ১ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন