কলকাতা : প্রতিষ্ঠার পটভূমিকা

অতুল সুর

কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠা ও সেই শহরকে কেন্দ্র করে পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পত্তন, এই দুই ঘটনার মূলে ছিল দুই যুদ্ধ। এই দুই যুদ্ধের মধ্যে, পলাশীর যুদ্ধ সুপরিচিত। অপর যুদ্ধ হচ্ছে হিজলির যুদ্ধ। যাঁরা কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে লেখাপড়া করেন বা টুকিটাকি লেখেন, তাঁরা কোনদিনই হিজলির যুদ্ধের গুরুত্ব সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করেন নি। অথচ হিজলির যুদ্ধে ইংরেজরা যদি পরাজিত হত, তাহলে ইংরেজদের পক্ষে কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হত না বা তার ৬৭ বছর পরে পলাশীর যুদ্ধও ঘটত না। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপন করা তো দূরের কথা! 

কি ঘটনাচক্রে হিজলির যুদ্ধ হয়েছিল, তা এখানে বলা দরকার। বাণিজ্য করবার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা প্রথম বাঙলা দেশে আসে ১৬৪০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। দিল্লীর বাদশাহকে উপঢৌকন, আর বাঙলার নাববকে ইনাম দিয়ে ইংরেজরা নিজেদের বাণিজ্যের অনেক সুযোগ সুবিধা সংগ্রহ করে। কিন্তু ইনাম পেয়ে পেয়ে বাঙলার নবাবের লোভ ক্রমশ বেড়ে যায়। তার ফলে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ ঘটে। ইংরেজরা পাটনার কুঠি থেকে জোব চার্ণককে কাশিমবাজারের কুঠিতে ডেকে পাঠায়। ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ চার্ণকের বিরুদ্ধে দেশীয় ব্যবসাদাররা এক মামলা দায়ের করে। হুগলির কাজি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ৪৩,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবার রায় দেয়। চার্ণক এই টাকা দিতে অস্বীকার করে। নবাবের সৈন্য তখন কাশিমবাজার অবরোধ করে। চার্ণক কৌশল অবলম্বন করে, কাশিমবাজার থেকে পালিয়ে একেবারে হুগলিতে এসে হাজির হয়। চার্ণক দেখে যে ইংরেজদের যদি বাঙলায় কায়েমী ব্যবসা-বাণিজ্য স্থাপন করতে হয়, তাহলে তাদের মাত্র ব্যবসায়ীর তুলাদণ্ড হাতে নিয়ে থাকলে চলবে না। তাদের অসি ধারণ করতে হবে। চার্ণক বুঝে নেয় যে ক্রমাগত উৎকোচ প্রদান ও তোষামোদ দ্বারা মোগলকে বাধ্য রাখা অসম্ভব। মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। এই সময় গভর্ণর হেজেস ও বিলাতের ডিরেকটরদের কাছে লিখে পাঠান যে মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণাই সমীচীন এবং আত্মরক্ষার জন্য স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন। 

শীঘ্রই ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের যুদ্ধ লাগে। দুপক্ষেরই সৈন্যসামন্ত ও নৌবহর হুগলিতে এসে হাজির হয়। ইংরেজরা নবাবপক্ষকে পরাজিত করে হুগলি তছনছ করে দেয়। হগলির শাসক আবদুল গনি ছদ্মবেশে জলপথে হুগলি থেকে পালিয়ে যায়। তারপর ওলন্দাজদের মধ্যস্থতায় গনি ইংরেজদের কাছে এক সন্ধির প্রস্তাব করে পাঠায়। চার্ণকও তাই চাইছিলেন। কেননা, তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে এরকমভাবে ঝগড়া করে, হুগলিতে ইংরেজদের পক্ষে আর বেশীদিন ব্যবসা করা সম্ভবপর হবে না। তিনি ইংরেজদের ব্যবসার সুবিধার জন্য অন্যত্র একটি শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। 

১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তারিখে চার্ণক বেরিয়ে পড়েন, ইংরেজদের জন্য এক শক্তিকেন্দ্র স্থাপনের জায়গা খুঁজতে। ভাগীরথী ধরে নেমে এসে তিনি সুতানটি গ্রামে পৌঁছান। এটাকেই তিনি ইংরেজদের শক্তিকেন্দ্র স্থাপনের উপযুক্ত স্থান বলে মনে করেন ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসেই চার্ণক তাঁর প্রতিভু ওয়াটস্ ও বরামলকে (বনমালীকে?) ঢাকায় পাঠিয়ে দেন, নবাব শায়েস্তা খানের কাছে এক আরজি-পত্র পেশ করার জন্য। ওই আরজি-পত্রে বারো দফা প্রার্থনা ছিল। তার মধ্যে দু-দফা ছিল কলকাতায় এক দুর্গ ও একটা টাকশাল নির্মাণ। ১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারী তারিখে শায়েস্তা খান চার্ণককে জানান যে তিনি তাঁর আরজি অনুমোদন করেছেন ও ওটা বাদশাহের কাছে সই-সাবুদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আসলে শায়েস্তা খান কিছুই করেন নি। তিনি যুদ্ধ করে ইংরেজদের বাঙলা থেকে তাড়িয়ে দেবার মতলব ভাঁজছিলেন মাত্র। চার্ণকও বুঝে নিয়েছিলেন যে যুদ্ধ ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় পন্থা নেই। ১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে ইংরেজদের সঙ্গে মোগলদের যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধটা প্রথম লাগে বালেশ্বরে এবং পরে হিজলিতে। চার্ণক বাদশাহী নিমক মহল পুড়িয়ে দেয়, মোগলদের থানা দুর্গ অধিকার করে, এবং হিজলির যুদ্ধ পরিচালনা করবার জন্য সেখানে যায়। 

ইতিমধ্যে বালেশ্বর ধ্বংস করে, ইংরেজরা হিজলি দখল করে নিয়েছিল। বাদশাহ ঔরঙ্গজেব তখন হায়দারাবাদের যুদ্ধে লিপ্ত। তাঁর কাছে যখন এসব দুঃসংবাদ গিয়ে পৌঁছায় তখন তিনি বুঝতেই পারলেন না, হুগলি, বালেশ্বর, হিজলি প্রভৃতি জায়গা কোথায়! একখানা মানচিত্র এনে তাঁকে জায়গাগুলো দেখানো হল। সেনাপতি মালিক কাসিমকে তিনি আদেশ দিলেন, সৈন্যসামন্ত নিয়ে গিয়ে বেয়াদব বিদেশীদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দেবার। এদিকে বাঙলার নবাব শায়েস্তা খানও সেনাপতি আবদাস সামাদের অধীনে হিজলিতে সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দিলেন। চার্ণক শীঘ্রই এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন। হিজলীর প্রাকৃতিক পরিবেশটা ছিল খুবই খারাপ। কাউকালি নদী, কুঞ্জপুরের খাল ও রসুলপুরের নদী দ্বারা বেষ্টিত হয়ে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরস্থ এই জায়গাটা একটা দ্বীপবিশেষ ছিল। দ্বীপটি জলাভূমিতে পরিপূর্ণ ও অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। তারপর সামনেই এসে গেল গ্রীষ্ম। চার্ণকের সঙ্গে যে সাড়ে চারশত সৈন্য ছিল, তারা ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে একে একে মারা যেতে লাগল। সৈন্যসংখ্যা একশতেরও নিচে গিয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে ‘বোফর্ট’ ও ‘রচেষ্টার’ নামে যে দুখানা জাহাজ ছিল, তার মধ্যে ‘বোফর্ট- এর তলদেশে ছিদ্র দেখা দিল। তাঁর সঙ্গের লোকজন মরতে মরতে এমনভাবে হ্রাস পেল যে জাহাজ চালাবারই লোক রইল না। ঠিক এই বিপর্যয়ের মধ্যেই আবদাস সামাদ বারো হাজার সৈন্য, বহু পরিমাণ গোলা-বারুদ ও কামানসহ রসুলপুর নদীর অপর পারে এসে হাজির হল। 

চার্ণক হিজলি দ্বীপের যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল, সেটা পাকাবাড়ি বটে, কিন্তু অত্যন্ত নড়বড়ে। বাড়িটা ছিল একটা আমবাগানের মধ্যে। তার চতুর্দিকে ছিল কাঁচাবাড়ি। সেদিন যদি ভাগ্যদেবী ইংরেজদের প্রতি সুপ্রসন্ন না হতেন, তা হলে আবদাস সামাদের কামানের এক গোলাতেই বাড়িটা ভূমিসাৎ হয়ে যেত, এবং সঙ্গে সঙ্গে ধুলিসাৎ হত ইংরেজদের কলকাতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নবিলাস। 

চার্ণক যখন এরকমভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে মুষড়ে পড়েছেন, ঠিক সেই সময় (১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে) হিজলিতে এসে উপস্থিত হল ক্যাপটেন ডেনহামের অধীনে ইওরোপ থেকে সদ্য আগত ৭০ জন তাজা সৈনিক। এই সময় চার্ণকের মাথায় খেলে গেল এক কৌশলের বুদ্ধি। ওই ৭০ জন সৈনিককে তিনি আদেশ দিলেন তারা যেন সামরিক বাদ্য বাজিয়ে ও সমরোপকরণ নিয়ে নদীর ধার থেকে ইংরেজদের ওই আশ্রয়স্থলে আসে, এবং আবার আমবাগানের আড়াল দিয়ে নদীর ধারে ফিরে যায়, এবং পুনরায় উক্তরূপে মার্চ করে আশ্রয়স্থলে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলল এই মহড়া। আবদাস সামাদ গেল ঘাবড়ে। ভাবল ইংরেজদের প্রচুর সৈন্যসামন্ত ও সমরোপকরণ এসেছে। সুতরাং এ যুদ্ধে লিপ্ত হলে পরাজয় সুনিশ্চিত। সন্ধির প্রস্তাব করে পাঠাল। চার্ণক সঙ্গে সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এই সন্ধিপত্রই ইংরেজদের মাথায় পরিয়ে দিল কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠার শিরোপা। ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট তারিখে কলকাতা প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইংরেজদের সঙ্গে মোগলদের আর যুদ্ধ হয়নি। 

হিজলির যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়েছিল স্রেফ কৌশলবুদ্ধির সাহায্যে, আর পলাশীর যুদ্ধে নিছক চক্রান্ত দ্বারা। 

অধ্যায় ১ / ৫৪

সকল অধ্যায়

১. কলকাতা : প্রতিষ্ঠার পটভূমিকা
২. কলকাতার জন্মদিন কবে?
৩. চৌরঙ্গীর জঙ্গলের রানী
৪. পেরিন সাহেবের বাগান
৫. কলকাতার আদিরূপ
৬. কি করে মহানগরী হ’ল?
৭. শিয়ালদহের যুদ্ধ
৮. কলকাতার বেগম
৯. কলকাতার বাবু কালচার
১০. আঠারো শতকের সাহেব বিবি গোলাম
১১. গরমকালের কলকাতা
১২. কলকাতায় সতীদাহ
১৩. কলকাতার নববর্ষ
১৪. সেকালের রথ ও স্নানযাত্রা
১৫. সেকালের জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব
১৬. পুরানো কলকাতার দুর্গাপূজা
১৭. দুর্গা প্রতিমা ও কুমারটুলি
১৮. কলকাতার রাস
১৯. সেকালের দোল
২০. সেকালের শিবরাত্রি
২১. বর্ষশেষ ও গাজন
২২. কালী কলকাত্তেওয়ালী
২৩. কলকাতার শিবমন্দির
২৪. সে আর এক কলকাতার
২৫. স্ত্রী শিক্ষা ও গঙ্গাবাঈ
২৬. বাবু সমাজের বাজির লড়াই
২৭. কলকাতার ঠাকুর রামকৃষ্ণ
২৮. কলকাতার আড্ডা ও মেয়ে মজলিস
২৯. সেকালের সাকার্স
৩০. কলকাতার থিয়েটার
৩১. কলকাতার সিনেমা
৩২. সেকালের বড়দিন
৩৩. কলকাতার মসজিদ গির্জা ও অন্যান্য ধর্মস্থান
৩৪. কলকাতার বাজার হাট
৩৫. কলকাতার হাসপাতাল ও চিকিৎসালয়
৩৬. কোর্ট কাছারি ও আইনবিদ
৩৭. কলকাতার ব্যবসা
৩৮. কলকাতার ফেরিওয়ালা
৩৯. কলকাতায় জুয়ার ঢেউ
৪০. কলকাতার শেয়ার বাজার
৪১. নিউ মার্কেটের ইতিহাস
৪২. কলকাতার মিষ্টির দোকান
৪৩. কলকাতার গঙ্গার ঘাট
৪৪. কলকাতার পতিতাপল্লীর পদাবলী
৪৫. কলকাতার রাস্তার নামাবলী
৪৬. পাঁচপল্লীর পাঁচালী
৪৭. কলকাতার ফুসফুস
৪৮. আগুন বোমা মন্বন্তর
৪৯. কলকাতার প্রথম ব্রহ্মহত্যা
৫০. রামমোহনের বাড়ী নীলামে
৫১. কলকাতার হুজুগ ও হল্লা
৫২. খেলার হুজুগ
৫৩. বিপর্যস্ত কলকাতা
৫৪. কলকাতার কি বিকল্প আছে?

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন