কলকাতার ফুসফুস

অতুল সুর

বিশাল ময়দানটা (১৮১০ বিঘা) ছাড়া, কলকাতায় আছে কমসে কম ২০০টা পার্ক। সেগুলো যে মাত্র বড় রাস্তার ধারেই আছে, তা নয়। গলিঘুঁজির ভেতরও। তাছাড়া, কলকাতায় মেয়েদেরও দুটো পার্ক আছে। একটা উত্তরে, আর একটা দক্ষিণে। 

কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল এলোমেলোভাবে। প্রথম দিকে ছিল তার অবিন্যস্ত রূপ। বড় রাস্তার ধারে এক সারি বাড়ির পেছনে তৈরি হয়েছিল আর এক সারি বাড়ি। দু সারি বাড়ির মাঝখানে সৃষ্ট হয়েছিল এক একটা করে সুর গলি। এরকমভাবে সারির পর সারি তৈরি হয়েছিল বাড়ি, আর সেগুলোর সঙ্গে গজিয়ে উঠেছিল অসংখ্য গলিঘুঁজি। 

গলিঘুঁজির বাড়িগুলো সব ছিল অসূর্যম্পশ্যা। সেখানে সূর্যের আলো ও বাতাস ক্বচিৎ কদাচিৎ ঢুকত। ইংরেজ শাসকরা এটা লক্ষ্য করেছিল। চিন্তা করেছিল, এ-সব বাড়ির বাসিন্দাদের শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের জন্য চাই ফুসফুস। তাই তারা তৈরি করেছিল পার্কগুলো। এ-গুলোই হচ্ছে কলকাতার ফুসফুস। 

কলকাতার পার্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্ক হচ্ছে ইডেন গার্ডেন। এর আয়তন হচ্ছে ১৩৩ বিঘা। বাকিগুলো অনেক কম মাপের। পার্ক সার্কাসের মাঠের আয়তন হচ্ছে ৬৫ বিঘা, দেশবন্ধু পার্কের ৪৫ বিঘা, আর্মড পুলিশ ফুটবল গ্রাউণ্ডের ৫০ বিঘা, যতীন্দ্রমোহন পার্কের ২০ বিঘা। জিমখানা পার্ক ও দেশপ্রিয় পার্কের আয়তনও তাই। উডবার্ন পার্কের আয়তন হচ্ছে ১৮ বিঘা, মার্কাস স্কোয়ারের ১১ বিঘা, রবীন্দ্র কাননের ১০ বিঘা। ওয়াটগঞ্জ পার্কেরও দশ বিঘা। আর রডন স্কোয়ারের ৯ বিঘা ১৭ কাঠা। কলকাতার বাকি পার্কগুলো সবই -এর চেয়ে কম মাপের। 

সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পার্ক আছে করপোরেশনের তিন নম্বর, ডিস্ট্রিকটে, ৫৭টা। তারপর চার নম্বর ডিস্ট্রিকটে ৪১টা, এক নম্বর ডিস্ট্রিকটে ৩৭ টা দু’নম্বরে ২৯টা, আর কাশীপুরে ১২টা। 

ইংরেজ চেয়েছিল কলকাতার ঘিঞ্জি অঞ্চলের বাসিন্দারা এই সব পার্কে এসে সকাল- বিকেলে হাওয়া খাবে। ইংরেজ আমলে ছেলে-বুড়ো সকলে করতও তাই। কিন্তু এখন সবই পাল্টে গেছে। লোকের দৈনন্দিন জীবন এমন উৎকটভাবে সমস্যাবহুল হয়ে উঠেছে যে লোক নিজ বাড়িতেই হাঁপ ছাড়বার সময়পায় না, পার্কে গিয়ে হাওয়া খাওয়া তো দূরের কথা! তা-হলেও ছুটিছাটার দিনে লোক পার্কে গিয়ে আরাম পায়। 

তবু আজকাল অনেক পার্কে হাওয়া খাবার উপায় নেই। অবহেলা ও পৌরসভার কুকর্মের জন্য বড় বড় পার্কগুলোতে হাওয়া আর ঢুকতে পায় না। পার্কের রেলিংয়ে দোকান ঘর বসিয়ে সেগুলোতে হাওয়া ঢোকবার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গোলদীঘি ও দেশপ্রিয় পার্ক তার দৃষ্টান্ত। আরেক রকমভাবেও পৌরসভা পার্কগুলোতে হাওয়া ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। ইংরেজ আমলে বিলাতি লোহা দিয়ে তৈরি রেলিংগুলো অপসারণ করে, তার জায়গায় পাঁচিল গেঁথে দেওয়া হয়েছে। সে রেলিংগুলো গেল কোথায়? কেউ জানে না। আজাদ হিন্দ বাগ বা হেদুয়া তার এক দৃষ্টান্ত। 

ইংরেজরা আরও চেয়েছিল যে বড় রাস্তার ধারের পার্কগুলো রাস্তার শোভাবর্ধন করবে। কিন্তু ইটের পাঁচিল গেঁথে ও দোকানঘর বসিয়ে শহরের সে শোভা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, হেদুয়া, গোলদীঘি ও অনুরূপ পার্কের পুকুরের হাওয়া আশপাশের বাড়িগুলোতে ঠাণ্ডা হাওয়া দিত, তা-ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হয়তো বাবুরা বলবেন যে রেলিং চুরি-যাবার ভয়ে তাঁরা এ-রকম করেছেন। কিন্তু এ-রকম যুক্তি বাবুদের গৌরব বর্ধন করে না, বাবুদের প্রশাসনিক অক্ষমতারহি পরিচয় দেয়। কেননা, ইংরেজ আমলে তো এরকম চুরি হত না। 

অনেক পার্কের মাঝে পুষ্করিণী পার্কের শোভা বর্ধন করত। কিন্তু আজ সেসব পুষ্করিণীতে পানা পড়ছে। অন্ততঃ রডন স্কোয়ার সম্বন্ধে আমরা সেই কথাই শুনছি। এর জন্য দায়ী কে? পানা, না বাবুদের অকর্মণ্যতা? ইংরেজ আমলে এরূপ ঘটলে যাদের হাতে পুষ্করিণী পরিষ্করণ ও সংরক্ষণের ভার ন্যস্ত থাকত, তাদের পিঠে ঘোড়ার চাবুক মেরে তাদের সক্রিয় করে তুলতো। 

পার্কগুলোর পুষ্করিণীতে পানা পড়ছে। তার জন্য সেখানে ব্যবসায়িক সংস্থা বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে, এটা মেয়েলি যুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কোন বিবেকবান পুরুষের উক্তি নয়। রডন স্কোয়ার ব্যবসায়িক সংস্থা হবে কি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হবে, সেটা আসল সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হচ্ছে, ইংরেজ আমলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে পার্কগুলো সৃষ্ট হয়েছিল, সে উদ্দেশ্য কতটা সিদ্ধ হচ্ছে, সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করারা জন্য পার্কগুলোর যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে সেগুলোকে তাদের বর্তমান দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করা। পানা পড়ছে বলে পার্কের পুষ্করিণীগুলোকে বুজিয়ে দিতে হবে, এর চেয়ে বড় মূঢ়তা আর কিছু হতে পারে না। যে শহরে জলের অভাবে দমকলবাহিনী যথাসময়ে আগুন নেভাতে পারে না সে শহরের জলাশয়গুলো বুজিয়ে দেবার মত গর্হিত অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। বরং আগুন নেভাবার জন্য যেসব পার্কে জমি আছে সেখানে নতুন পুকুর কাটানো বা যেখানে জমি নেই সেখানে মাটির তলায় জলাশয় বা রিজারভয়ার নির্মাণ করাই আশু প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। 

সকল অধ্যায়

১. কলকাতা : প্রতিষ্ঠার পটভূমিকা
২. কলকাতার জন্মদিন কবে?
৩. চৌরঙ্গীর জঙ্গলের রানী
৪. পেরিন সাহেবের বাগান
৫. কলকাতার আদিরূপ
৬. কি করে মহানগরী হ’ল?
৭. শিয়ালদহের যুদ্ধ
৮. কলকাতার বেগম
৯. কলকাতার বাবু কালচার
১০. আঠারো শতকের সাহেব বিবি গোলাম
১১. গরমকালের কলকাতা
১২. কলকাতায় সতীদাহ
১৩. কলকাতার নববর্ষ
১৪. সেকালের রথ ও স্নানযাত্রা
১৫. সেকালের জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব
১৬. পুরানো কলকাতার দুর্গাপূজা
১৭. দুর্গা প্রতিমা ও কুমারটুলি
১৮. কলকাতার রাস
১৯. সেকালের দোল
২০. সেকালের শিবরাত্রি
২১. বর্ষশেষ ও গাজন
২২. কালী কলকাত্তেওয়ালী
২৩. কলকাতার শিবমন্দির
২৪. সে আর এক কলকাতার
২৫. স্ত্রী শিক্ষা ও গঙ্গাবাঈ
২৬. বাবু সমাজের বাজির লড়াই
২৭. কলকাতার ঠাকুর রামকৃষ্ণ
২৮. কলকাতার আড্ডা ও মেয়ে মজলিস
২৯. সেকালের সাকার্স
৩০. কলকাতার থিয়েটার
৩১. কলকাতার সিনেমা
৩২. সেকালের বড়দিন
৩৩. কলকাতার মসজিদ গির্জা ও অন্যান্য ধর্মস্থান
৩৪. কলকাতার বাজার হাট
৩৫. কলকাতার হাসপাতাল ও চিকিৎসালয়
৩৬. কোর্ট কাছারি ও আইনবিদ
৩৭. কলকাতার ব্যবসা
৩৮. কলকাতার ফেরিওয়ালা
৩৯. কলকাতায় জুয়ার ঢেউ
৪০. কলকাতার শেয়ার বাজার
৪১. নিউ মার্কেটের ইতিহাস
৪২. কলকাতার মিষ্টির দোকান
৪৩. কলকাতার গঙ্গার ঘাট
৪৪. কলকাতার পতিতাপল্লীর পদাবলী
৪৫. কলকাতার রাস্তার নামাবলী
৪৬. পাঁচপল্লীর পাঁচালী
৪৭. কলকাতার ফুসফুস
৪৮. আগুন বোমা মন্বন্তর
৪৯. কলকাতার প্রথম ব্রহ্মহত্যা
৫০. রামমোহনের বাড়ী নীলামে
৫১. কলকাতার হুজুগ ও হল্লা
৫২. খেলার হুজুগ
৫৩. বিপর্যস্ত কলকাতা
৫৪. কলকাতার কি বিকল্প আছে?

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন