উঁচুমহল

বুদ্ধদেব গুহ

উঁচুমহল

 

ম্বের নারিমান পয়েন্ট-এ দূর থেকে যে, বাইশ-তলা হালকা-ছাইরঙা বহুতল বাড়িটি দেখা যায় তার একতলার এন্ট্রান্সে ঝকঝকে পেতলের প্লেটে লেখা আছে এম. বি ইন্টারন্যাশনাল ইনক; তার নীচে বারোটা লিমিটেড কোম্পানির নাম।

এম. বি. ইন্টারন্যাশনাল ইনক আমেরিকাতে ইনকর্পোরেটেড নয়। আমেরিকার লিমিটেড কোম্পানিগুলির শেষে থাকে ‘ইনক’, যেমন সুইডিশ কোম্পানির আগে থাকে ‘আকটিবোলাগেট’ অথবা সুইস কোম্পানির আগে থাকে ‘সোসাইটে’।

চা, কফি, টিভি, মিউজিকাল ইনসট্রুমেন্টস, ইলেকট্রিক ফারনেস, কটন ও পলিয়েস্টার ফেব্রিকস, ফার্মাসিউটিকালস গুডস তা ছাড়াও বহুজিনিস নিয়ে ব্যাবসা করে এই অতিকায় কোম্পানিগোষ্ঠী। অথচ মূলমালিক ওই এম. বি. ইন্টারন্যাশনাল ইনক। সেটি একটি হোল্ডিং কোম্পানি। আসল মালিক মনীষা বসু। অবশ্য আরও দু-জন ডামি ডিরেক্টর আছেন। তাঁরা মনীষার-ই বেনামদার।

বম্বেতে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-হেমন্ত ইত্যাদি কোনো ঋতুর বালাই নেই। বম্বের লোকেরা বলেন, মাত্র তিনটিই ঋতু এখানে। হট, হটার এবং হটেস্ট।

এখন হট। জুলাই মাস।

কাঁটায় কাঁটায় সকাল ঠিক সাড়ে ন-টায় একটি আকাশি-নীল রঙা বি. এম.ডাব্লু গাড়ি এসে মেইন গেট-এর সামনে দাঁড়াল।

মনীষা নিজেই চালাচ্ছিল। পেছনে ধবধবে টেরিলিনের উর্দি আর টুপি পরা ড্রাইভার। চারজন ডোরমেন দৌড়ে এসে দরজা খুলল। মনীষা নামল। হালকা ফেডেড-জিনস এবং ওপরে হালকা-হলুদ একটি সিল্কের জ্যাকেট পরে। বুক-পকেট থেকে কালোর মধ্যে সাদা ফুল-তোলা একটি কলম উঁকি দিচ্ছে। মঁ-ব্লা মাস্টারপিস।

মনীষার বাবার কাছ থেকে চেয়ে-নেওয়া এই কলমটি। বাবার মাত্র এই একটি সম্পত্তিই মনীষা চেয়ে নিয়েছিল, বাবা যখন বেঁচেছিলেন। দুই বোন দুই ভাই বাবার অন্যসব কিছুই পেয়েছে। মনীষা কিছুই নেয়নি। ও জানে যে, সব-ই নিয়েছে। বাবার গুণ বলতে যা কিছু ছিল সেইসবের উত্তরাধিকারিণী। জাগতিক সম্পত্তি আর দোষ অন্যরা কাড়াকাড়ি করে নিয়েছে। অবশ্য ও শুধুই যে, গুণ পেয়েছে এমনও নয়। দোষ মনীষা যে, একেবারেই পায়নি তা বলা যায় না। মনীষা নিজেই শুধু জানে সেই দোষের কথা। সেই দোষ হচ্ছে ‘জেদ’। দোষও বটে গুণও বটে। কিন্তু সেজন্যে ও কিছুমাত্র বিব্রত বা লজ্জিত নয়। অমন দোষ এমন মেয়েকেই মানায়।

কার্পেট-মোড়া লবি পেরিয়ে এসে লিফট-এর সামনে দাঁড়াল মনীষা। এটি প্রাইভেট লিফট। সোজা উঠে গেছে। চেয়ারপার্সন-এর সেক্রেটারিয়েট পেরিয়ে তবে তাকে ঢুকতে হয় নিজের অফিসে। পার্সোনাল সেক্রেটারি, ইকনমিক সেক্রেটারি, ডেভালাপমেন্ট সেক্রেটারি, রিসার্চ সেক্রেটারি, পাবলিক রিলেশনস সেক্রেটারি এবং প্রাইভেট সেক্রেটারি। তাদের প্রত্যেকের-ই আছে আবার ছোট্ট একটি করে নিজস্ব দপ্তর।

হালকা গোলাপিরঙা কার্পেট এবং ফিকে নীল-রঙা অ্যাক্রিলিক পেইন্টে মোড়া দেওয়াল। মনীষার নিজস্ব সেক্রেটারিয়েটের টেলেক্স, ইলেকট্রনিক টাইপ-রাইটার, পার্সোনাল কম্পিউটার সব সার সার সাজানো। এফেক্টিভ এয়ার-কণ্ডিশানিং। অনভ্যস্তদের ঠাণ্ডা লাগে।

মনীষা প্রত্যেকের ‘গুড মর্নিং’-এর উত্তরে হাসিমুখে ‘মর্নিং টু ইউ অল’ বলেই, নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল।

নিজের ঘরের চারদিকের দেওয়াল বিলিতি, ওয়ালপেপারে মোড়া। ঢুকলে, মনে হয়, কোনো গভীর জঙ্গলেই কেউ ঢুকে পড়ল বুঝি। একধারে ঘন সবুজ পাইনের বন। অন্যদিকে হেমন্তর বার্চ ও চেস্টনাট, হলদেটে-লালের বাহার ফল। গাঢ় সবুজ কার্পেট নীচে। শেডেড-ল্যাম্প।

চেয়ারপার্সনের ঘরে মস্ত একটি টেবিল। কাচ-ঢাকা। টেবিলের ওপরে একটুকরো কাগজও নেই। মনীষার কোনো বিশেষ চেয়ার নেই। সেই গোল-টেবিলের যেদিকে যখন খুশি সে বসে। অন্য একটি চেয়ার অবশ্য আছে, জানলার পাশে। জন কেনেডির মতো। একটি রকিং-চেয়ার। যখন-ই কিছু ভাবতে হয় তখন সেই চেয়ারে বসেই দোলে মনীষা। না-দুললে ওর ভাবনা খোলে না। টেবিলের ওপরে মাস্টার ইন্টারকম। ছ-টি টেলিফোন ছ-রঙা।

মনীষার কোম্পানিগুলিতে মেয়েরাই সমস্ত উঁচু পোস্টে আছে। ছেলেরা মুখ্যত কেরানি, মিনিয়ালস, বেয়ারা, ড্রাইভারস। যেসব মহিলারা ‘উইমেনস লিব’ ‘উইমেনস লিব’ করে চেঁচান তাদের মনীষা করুণা করে। উইমেন আর অলরেডি লিবারেটেড। ‘উইমেনস লিব’ কথাটার মধ্যেই একটা হীনম্মন্যতার গন্ধ আছে। মনীষা সেই কারণেই এই কথাটা অথবা এই কথার প্রবক্তাদের ভালো চোখে দেখে না।

ইন্টারকম তুলে ও পার্সোনাল সেক্রেটারিকে বলল, স্যুসি, হোয়াট আর দ্যা স্পেশ্যাল প্রবলেমস অফ দ্যা ডে?

—ওনলি ওয়ান ম্যাম।

—কী?

—মিস্টার অতীশ সরকার।

—হুজ হি?

—আমাদের সবচেয়ে বড়ো কম্পিটিটর। ইলেকট্রনিক্স-এ। অন্যান্য ক্ষেত্রেও। কলকাতার কলিনসনস-এর, ব্যাঙ্গালোরের ‘ইণ্ডিয়া ল্যাম্প’-এর এক্সপ্যানসন তো মি. সরকার-ই এম. আর. টি পি-তে লাগিয়ে স্টল করে দিয়েছেন। এখন লেগেছেন আমাদের পেছনে। আজকেই বারোটাতে আপনার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

—আজকে? বারোটায়? মাই গুডনেস। আমাকে আগে জানাওনি কেন?

—আপনি তো প্যারিস থেকে গত সপ্তাহতে ফিরেই দিল্লি, ম্যাড্রাস এবং কলকাতায় চলে গেলেন। কাল আপনার ফ্লাইট ডিলেইড ছিল তো তিনঘণ্টা। তবুও আমি এয়ারপোর্টে দু-ঘণ্টা অপেক্ষা করে তারপর বাড়ি ফিরে যাই। রাত এগারোটায়। ড্রাইভার মকবুল আপনাকে কি আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্টের লিস্ট দেয়নি?

—ওঃ আই সি। না স্যুসি। মকবুল দিয়েছিল বটে। বাট আই ও’জ ভেরি ভেরি টায়ার্ড! দেখার সুযোগ পাইনি। বাট ইন এনি কেস আই কান্ট মিট দ্যাট মি. সরকার টুডে। ইউ হ্যাভ টু ক্যানসেল দ্যাট অ্যাপয়েন্টমেন্ট?

—কী বলব ওঁকে?

—দ্যাটস ইয়োর বিজনেস স্যুসি। ডোন্ট আস্ক মি সিলি কোয়েশ্চেনস।

—হি ইজ আ বিগ শট।

—আই কেয়ার আ স্ট্র। এম. বি. ইন্টারন্যাশনাল ইনক ইজ নো স্মল অর্গানাইজেশন ইদার।

স্যুসির সঙ্গে কথা শেষ করেই প্রাইভেট সেক্রেটারি কুমুদিনীকে ডাকল মনীষা।

মর্নিং ম্যাম।

মর্নিং! কুমুদিনী। আমার ঘরে এক্ষুনি এসো একবার।

কুমুদিনী সারাভাই-এর কেরিয়ারের ব্যাপারটা খুব-ই গোলমেলে। স্কটল্যাণ্ড-ইয়ার্ড-এ সে কিছুদিন চাকরি করেছিল। তারপর একটি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাত নিজেই বম্বেতে। এদিকে ইংরেজিতে কবিতা লেখে। ভালো সেতার বাজায়। ইকেবানাতে ওসাকার স্কুলের ডিপ্লোমা হোল্ডার। দেখতেও অতিসুন্দরী। বিয়ে করেছে একজন ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টকে। হি ইজ ভেরি হাই আপ ইন দ্যা টাটাজ। একটিই মেয়ে ওদের। তিন বছর বয়স।

—ইয়েস ম্যাম। হোয়াটস দ্যা অ্যাসাইনমেন্ট?

ঘরে ঢুকে কুমুদিনী জিজ্ঞেস করল!

মনীষা ‘মঁ-ব্লাঁ’ কলমটি দিয়ে ঠোঁটে আলতো করে আঘাত করতে করতে বলল, ওয়েল। এতদিনে তোমাকে একটি ইন্টারেস্টিং কাজের ভার দিতে পেরে আমি খুব খুশি। তুমি স্যুসির সঙ্গে দেখা করো। মিস্টার অতীশ সরকার অফ ‘সরকার অ্যামুলগ্যামেটস’। ‘আই অ্যাম টোল্ড দ্যাট হি ইজ বিগ গাই। আই ওয়ান্ট টু ফাইণ্ড আউট হাউ বিগ হি রিয়্যালি ইজ। তার সম্বন্ধে আমি সমস্ত ইনফরমেশান চাই। যতটুকু আমি জানি, তা হচ্ছে যে, সে ব্যাচেলর। কিন্তু প্লে-বয় নয়। ইউ নো, ওয়ান অফ দ্যাট টাইপ হু আর ম্যারেড টু মানি। আ রিয়্যাল ব্লকহেড অফ দ্যাট সর্ট।’

—কী কী ইনফরমেশান চাই আপনার ম্যাম?

—সব। তার গ্রূপের সব কোম্পানির ব্যালান্সশিট। এ বছরের বাজেটেড ফিগারও। দিল্লি, বম্বে এবং কলকাতার স্টক এক্সচেঞ্জে তার কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামের ওঠা-নামার গ্রাফস। যদি সম্ভব হয়। তার কোথায় কোথায় ইন্টারেস্ট আছে?—ভারতবর্ষে এবং বাইরেও মাইনর হোল্ডিং থাকলেও আমার জানা চাই। কোনো ফ্লি-পোর্টে কোম্পানি ফ্লোট করছে কি না! বছরে সুইটজারল্যাণ্ডে কতবার যায়? এটসেট্রা। ইউ নো হোয়াট আই মিন! এবং অফ অল থিংগস, মানুষটার দুর্বলতা কী কী! রেস খেলে? মেয়েঘটিত দোষ আছে? মদ খায়? গান শুনতে ভালোবাসে? বই পড়ে? মাছ ধরে?

—দুর্বলতা আমি যতদূর জানি, নেই। আমার স্বামী ওঁকে নানা পার্টিতে মিট করেছেন। ওঁর কাছেই শুনেছি। মি. সরকার ইজ আ মেল শভিনিস্ট পিগ।

—তাই-ই? মাই ফুট!

বলেই তাড়াতাড়ি বলল, সরি। আই ডিডনট ওয়ান্ট টু হার্ট ইয়োর হাজব্যাণ্ড। আই ডোন্ট বিলিভ ইট। ‘পুরুষ’ মানুষ মাত্রই দুর্বল। ফাইণ্ড আউট দ্যা এরিয়াজ অফ হিজ উইকনেসেস। গেট গোল্ড অফ দি অ্যাকিলিসেস হিল কুমুদিনী।

মনীষা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।

একটু চুপ করে থেকে বলল, ওয়েল! যদি এই অতীশ সরকার অন্যরকমও হয় দ্যাটস ওলসো ফাইন। দ্যাট স্যুটস মি ফাইন। শুয়োর-পোড়া গন্ধ আমার দারুণ লাগে। বারবিকিউ! হা:! আ মেল শভিনিস্ট পিগ।

একটু ভেবে মনীষা বলল, তোমার স্বামীকে বলো যে, কালকেই দ্যাট মিনস ফ্রাইডে-ইভনিং তাজমহল হোটেলে মি. সরকারকে ইনভাইট করতে। ফর চাইনিজ ফুড। হার্বার বারে ইউ ওল হ্যাভ ইয়োর ককটেইলস। তারপর যখন গোল্ডেন ড্রাগন-এ খেতে ঢুকবে তখন আই উইল জাস্ট ওয়াক ইন ক্যাজুয়ালি। এলোন। তখন-ই আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে তোমরা। আমি তোমাদের টেবিলে জয়েন করব। তারপর লিভ দ্য রেস্ট টু মি। ইতিমধ্যে অন্য ইনফরমেশানগুলোওজোগাড় করার চেষ্টা করো। গেট ইন টাচ উইথ হিজ ট্রাস্টেড মেন। টাকার বাণ্ডিল ছুড়ে দাও। এভরিবডি হ্যাজ আ প্রাইস কুমুদিনী। ইণ্ডিয়াও ছোটো ছোটো আফ্রিকান বা ইস্ট-এশিয়ান দেশগুলোর-ইমতো হয়ে গেছে। ইউ ক্যান হ্যাভ এনিবডিজ লয়্যালটি। ইটস জাস্ট আ ম্যাটার অফ প্রাইস। গভীর লজ্জার, এটা দেশের পক্ষে। কিন্তু গভীর আনন্দের আমাদের পক্ষে। নইলে এমন ব্যাবসা করা যেত না। যাই-ই হোক কী করবে না করবে তা তোমার-ই ব্যাপার। কিন্তু করতে হবে। আই ওয়ান্ট দিজ ইনফরমেশান বাউট হিম; ভেরি ভেরি ব্যাডলি।

—ওক্কে ম্যাম।

—বেস্ট অফ লাক কুমুদিনী। সময় নেই সময় নষ্ট করবার।

কুমুদিনী চলে গেলে, মনীষা তার ফিনানসিয়াল সেক্রেটারির লাইন তুলল।

—নমিতা ভাট।

—গুড মর্নিং ম্যাম।

—এনি প্রবলেম নমিতা?

—না। আজকে কোম্পানি ফিফথ-এর নতুন অ্যাকাউন্টেন্টের ইন্টারভিউ আছে। ফিনানসিয়াল অ্যাডভাইজার এবং চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট চান যে, আপনি থাকুন সেই সময়ে। ইটস আ কিই-পোস্ট।

—হোয়াট? সেরগিল ওয়ান্টস মি টু বি প্রেজেন্ট? হাউ ডেয়ারস শি টেল হার টু টক টু মি বাউট ন্যাউ। আই উইল স্যাক হার।

কটাং করে ফোন নামিয়ে রাখল বিরক্ত মনীষা।

লাল আলোটা দু-বার ‘ব্লিপ-ব্লিপ’ করে নিভে গেল ইন্টারকম-এর।

প্রীতম সিরগিল দিল্লির মেয়ে। ওর বাবা দিল্লিতে ইনকামট্যাক্সের কমিশনার ছিলেন। প্রীতম নিজে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। কস্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি এবং ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট। কম্পিউটারের ট্রেনিং আছে ওর। সেরগিল-ই পুরো গ্রূপের নাম্বার ওয়ান ওর ডিভিশনে। অ্যাকাউন্টস, ট্যাক্সেশান, ব্যাঙ্ক ম্যানেজমেন্ট সব-ই ওর ওপরে।

ইন্টারকম পি-পি করল! প্রীতম লাইনে এসেছে।

বলল, গুড মর্নিং ম্যাম।

—মর্নিং প্রীতম। ডু ইউ ওয়ান্ট আ স্যাক? তুমি কি চাও যে, তোমার চাকরিটা চলে যাক?

প্রীতম তুতলে উঠল।

বলল, নো ম্যাম। বাট হোয়াই?

—তুমি কোন সাহসে বলো যে, ফিফথ-কোম্পানির নতুন অ্যাকাউন্টেন্টের ইন্টারভিউ আমি নিজে নেব? তোমাদের মতো যোগ্যজনের ওপর তো ইন্টারভিউ নেওয়ার ভার দেওয়াই আছে। ফাইনাল সিলেকশানটাও তোমরা বলতে পারবে না?

—পারব, কিন্তু....

—কোনো কিন্তু নেই এরমধ্যে। এম বি ইন্টারন্যাশানালের চেয়ারপার্সনের আরও অনেক ইম্পর্টান্ট কাজ আছে। আমিই যদি ইন্টারভিউ নেব তবে তোমাদের রাখবার দরকার কী আমার? তুমি একমিনিট আমার ঘরে এসো।

প্রীতম দু-মিনিটের মধ্যে এল ঘরে।

মনীষা বলল, ইন্টারভিউ বোর্ডে আমি থাকব না। কিন্তু ফাইনাল সিলেকশানে তিনজনকে সিলেক্ট করে নিয়ে সেপারেটলি জিজ্ঞেস করবে যে, ফিফথ-কোম্পানি থেকে আমার মাসে দশ লাখ টাকা দু-নম্বর চাই। কী করে বের করবে না করবে দ্যাট ইজ হার হেডেক। তাকে যা আমরা মাইনে এবং পার্কস দেব প্লাস ক্যাশ প্যাকেট তাতে আমরা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইলেও সে থাকবে এখানে। এদেশের মানুষের গায়ের চামড়া গন্ডারের মতো হয়ে গেছে। চল্লিশ বছরে যথেষ্টই পুরু হয়ে গেছে তা। যারা চরকা কাটত, খদ্দর পরত, প্লেইন লিভিং ও হাই থিংকিং-এ বিশ্বাস করত সেইসব আত্মত্যাগী আদর্শবানদের বংশধরেরা সব গন্ডার হয়ে গেছে। শুনে নাও কান খুলে। ইটস আ ডিল। প্রত্যেক মাসের তিন তারিখের মধ্যে দশলাখ টাকা, এক-শো টাকার নোটে আমি আমার টেবলে চাই। গ্লাডিঅলা ফুল-ভরা বাস্কেটের নীচে টাকাটা পাঠাবে। কেউ যেন বুঝতে না পারে। আমি জানব, তুমি জানবে আর ফিফথ কোম্পানির সেই নতুন অ্যাকাউন্টেন্ট জানবে। পুরুষদের ইন্টারভিউ নিতে পারো কিন্তু ফাইনাল সিলেকশন করতে হবে তিনজন মেয়ের মধ্যে থেকেই। যাও।

প্রীতম চলে যাচ্ছিল। ওকে ডেকে বলল ইউ নো, এই টাকাও ব্যাবসায়েই দরকার। আমি বাড়ি নিয়ে যাব না। অন মানি। বিভিন্ন পার্টির ফাণ্ডে ডোনেশন দিতে হয়। দিল্লিতে কোনো লাইসেন্স বা পারমিট পেতে গেলেও খরচ করতে হয়। আমরা, বিজনেস পার্সনরা কোনো রিস্ক নিতে পারি না। প্রত্যেক ঘোড়াকেই ব্যাক করতে হয়। তো সে পার্টির নেতা যতবড়ো রাসকেল-ই হোক-না-কেন! মোস্ট স্টুপিড জনগণ, ইমোশানের বশে কখন যে, কাকে ভোট দেবে কে জানে? যাও। উই হ্যাভ নো চয়েস। উই হ্যাভ টু রাইড উইথ দ্যা টাইড।

প্রীতম-এর মতো কোয়ালিফায়েড, ভালো ফ্যামিলির মেয়েকে মনীষা যে, এমন করে বলে তাতে মাঝে মাঝে প্রীতম-এর মনে হয় যে, চাকরি ছেড়ে দেয়। এসব দু-নম্বরি তিন নম্বরি মামলাতে ওর থাকতেও ইচ্ছে করে না। কিন্তু যে টাকা ও পার্কস এবং যে ক্যাশ-প্যাকেট মনীষার কাছ থেকে ও নিজেও পায় তা দেওয়ার ক্ষমতা বা উপায় টাটা বা ডি. সি এম. বা ধিরুভাই আম্বানীরও নেই বোধ হয়। এই ইনফ্লেশানের বাজারে, যারজন্যে এই রাজনৈতিক নেতাদের লোভ-ই দায়ী। প্রীতম-এর চোখের সামনেই সমস্ত দেশটাই অসৎ হয়ে গেল। যার-ই কোনো উপায় আছে, তার পক্ষেই সৎ থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। কোনো মানুষ-ই চায় না যে, সে খারাপ হয়ে যাক। কিন্তু এই ইনফ্লেশান এবং এই আশ্চর্য রাজনীতিই প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, পেশাদার মানুষদেরও জোর করে ঠেলে দিয়েছে এই ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে। দিল্লিতে গ্রীষ্মকালে যে, ধুলোর ঝড় ওঠে, সেইরকম চোখ-জ্বালা করা আঁধির মধ্যে।

প্রীতম-এর যদিও নিজের সংসার নেই। এখনও বিয়েই করেনি ও। দিল্লির মহারানিবাগে একটি বাড়ি আছে। বাবার-ই বানিয়ে যাওয়া। এখন মা একাই থাকেন। সেই বাড়ির একতলা ভাড়া দিলেও কম আয় হয় না। ভারতের রাজধানী দিল্লির ব্যাপার-স্যাপার-ই আলাদা। এই গরিবগুরবোদের দেশের কোনো ব্যাপারের সঙ্গেই এর সাযুজ্য নেই। কিন্তু টাকা বড়োই খারাপ জিনিস। একবার এতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সব-ই গেল। মদ ছাড়া যায়, সিগারেট ছাড়া যায়, টাকার আর ক্ষমতার লোভ কিছুতেই ছাড়া যায় না।

এয়ার-কণ্ডিশানড ফ্ল্যাট, এয়ার-কণ্ডিশানড গাড়ি, বছরে একটা করে হলিডে, এনিহোয়্যার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। প্রীতম-এর নিজের কথা ছেড়ে দিলেও তার মা পড়ে গেছেন পুরোপুরি এই ফাঁদে। খরচ বাড়ানো সোজা, কমানো বড়ো কঠিন। মায়ের মুক্তির সম্ভাবনা নেই। হয়তো ওর নিজেরও নেই। প্রীতম-এর বাবা সাধু-প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না তা প্রীতম জানে। সাধু হলে ওই চাকরি করে মহারানিবাগে লনঅলা বাড়ি করা যেত না।

ভাবছিল প্রীতম, মা আসলে বাবা থাকতেই নষ্ট হয়ে যান। অবশ্য প্রীতম যে, জীবনে ওয়েল-সেটলড হয়েছে তাও তার বাবার-ই জন্যে। বাবাকে ক্রিটিসাইজ করে না তাই। অথবা অন্যভাবে বললে বলতে হয়; মা-ই হয়তো বাবাকে নষ্ট করে দেন। আসলে, মেয়েরাই বেশিরভাগ পুরুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে, সে স্ত্রী-ই হন কী প্রেমিকা বা রক্ষিতা। তাঁদের স্বামীদের আয় আর তাঁদের চাহিদার মধ্যে কোনোই সাযুজ্য থাকে না প্রায়-ই। ঘটনা যাই-ই ঘটুক এখন মনীষা যদি প্রীতমকে লাথিও মারে মনীষার পায়ের ইটালিতে তৈরি ‘গুচ্চি’র অ্যাঙ্কল বুট দিয়ে, তাহলেও চাকরি ছাড়ার উপায় তার আর নেই। এ জীবনের মতো ফেঁসে গেছে প্রীতম। বড়ো বড়ো বিজনেস টাইকুইন্সরা এমনি করেই টাকা দিয়ে বেঁধে রাখেন তাদের চারধারের মানুষদের। এ বাঁধন দেখা যায় না। কিন্তু অক্টোপাসের বাঁধনের মতোই তা। কিছুদিনের মধ্যেই ‘বিবেক’ বাঁধা পড়ে।

প্রীতম চলে গেলে রকিং চেয়ারটাতে এসে বসল মনীষা। মনীষা ভালো করেই জানে যে, সে তার অফিসারদের যেমন করে রেখেছে তাতে, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের উলঙ্গ হয়ে তার ঘরের কার্পেটে হামাগুড়ি দিতে বললেও তারা তাই-ই দেবে। স্বাধীনতাউত্তর এই ভারতবর্ষে এখন শক্তির আর ক্ষমতার মূলউৎস হচ্ছে দু-টি। এক, টাকা। দুই, রাজনৈতিক ক্ষমতা। মেধা এখন আর কোনো শক্তিই নয় এদেশে। ইন্টেলেকচুয়াল পাওয়ারের কোনো দাম নেই আর। ফাঁকা আওয়াজ হয়ে গেছে। কৃষ্টি, সংস্কৃতিরও কোনোই দাম নেই। বড়োলোকেরা কদর করলে তবেই সেসবের দাম। সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা সবকিছুই নির্ভরশীল, এঁদের দয়ায়, যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ-ই এসবের প্রকৃত মূল্যায়ন করার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও রাখেন না।

কিন্তু মনীষা রাখে।

মনীষা জানে যে, তার প্রতিযোগীরা সকলেই মনীষা নয়। এইজন্যে মাঝে মাঝে সে বড়ো বিমর্ষ বোধ করে। সব ব্যাবসাতেই প্রতিযোগীদের স্তরে নিজেকে নামিয়ে আনতে হয় টিকে থাকতে গেলে। এই নামিয়ে আনার কারণে ক্লান্তিবোধও করে। গভীর ক্লান্তি।

টাকা আর রাজনৈতিক ভ্রূকুটি দিয়ে দেশের প্রায় সমস্ত মেধাবী ও গুণী মানুষদের ইঁদুর বানিয়ে রেখেছে মনীষা এবং তার প্রতিযোগীরা। তাই-ই যেসব মেধাবী মানুষ এখনও মেরুদন্ড টান করে দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখতেন তাঁরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। যাঁরা যেতে পারেননি তাঁরা হয় ছোটোখাটো সংস্থাতে অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন। আর পেনশন চালু রাখার জন্যে কোনোরকমে চাকরি বজায় রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় কোনোক্রমে দিনাতিপাত করছেন। মেরুদন্ড তাঁদেরও নেই। কলমের জোর নেই, সাহস তাঁরা দেখাতে পারেন না। কোনোরকমে ফাইল সামলে চাকরিজীবন শেষ করে সসম্মানে রিটায়ার করার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকেন। সেখানেও তাঁদের মেধায় মরচে পড়তে সময় লাগে না বেশি। ধার ভোঁতা হয়ে যায়। অবশ্য ব্যতিক্রম আছে বলেই দেশ এখনও থেমে যায়নি।

মনীষা এই ব্যবস্থাতে আদৌ খুশি নয়। কিন্তু ও নিরুপায়। তার জন্মের আগে থেকেই দেশ যেভাবে চলেছে তাতে ওর নিজের কোনোই চয়েস ছিল না। স্বাধীনতার বয়স হল প্রায় চল্লিশ। তার বয়স তিরিশ। বাবার ছোট্ট একটি কোম্পানিতে সে এসে যোগ দিয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এপাশ করে। ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। কলকাতার মডার্ন হাই স্কুলে পড়েছিল। আরও বেশি পড়াশুনা সে করেনি কারণ অল্পবয়সেই ও শিখেছিল হাঁসের বাচ্চা যেমন ডিম থেকে বেরিয়েই সাঁতার কাটে, ব্যবসায়ীর ছেলে-মেয়েকেও তেমনি স্কুল-কলেজের বেড়া ডিঙোনো মাত্রই ব্যাবসায়ে ঢুকে পড়তে হয়। ব্যাবসাতে হাতেকলমে যা শেখার, বিবেক ঘষে ফেলার নিষ্ঠুরতায় অভ্যস্ত হওয়ায়, প্রতিযোগীকে জয় করার অদম্য উদ্যম, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, প্রতিযোগীর লোক ভাগিয়ে আনা, তার কারখানার ইউনিয়ন লিডারকে পয়সা দিয়ে তার কারখানা স্ট্রাইক করিয়ে দেওয়া, এসব-ই হাতেকলমে শিখতে হয়। বই পড়ে এসব শেখা যায় না। বইয়ে খুব কম কথাই লেখা থাকে। ভালো ব্যাবসাদার হতে পারলে অনেক পন্ডিত ও বিদ্বানদের-ই নিজের চাকর করে রাখা যায়।

এদেশীয় বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে জুতোও পালিশ করানো যায় কারণ মেরুদন্ডে একেবারেই ঘুণ ধরে গেছে এই জাতের। জুতো-পালিশ করানো যায় এইজন্যেই যে, এক জাহাজ মেধা ও বিদ্যা, সংস্কৃতি আর আত্মাভিমান জড়ো করেও একমুঠো সাহসের সমান হয় না নিক্তি। সবাই বিকিয়ে দিয়েছে নিজেদের। একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, একটা ফ্ল্যাট, একটা গাড়ির জন্যে।

ব্যাবসা করতে গেলে সাহস লাগে, আর অন্য সবকিছুর চেয়েও বেশি। আর লাগে, সেন্স অফ টাইমিং, একধরনের ষষ্ঠবোধ, যা একজন ব্যবসায়ীকে অন্যদের তুলনায় অনেক আগেই তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। তার কর্মচারীরা বিদ্যায়-বুদ্ধিতে তার চেয়ে অনেক-ই বড়ো কিন্তু তার দুঃসাহস আছে। একটার-পর-একটা ঝুঁকি নিয়ে, এদের প্রত্যেককে মাসের এক তারিখে তাদের প্রাপ্য নিশ্চিতভাবে হাতে তুলে দেওয়ার পরও অর্গানাইজেশনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে সকলে পারে না। এই ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, এই দুঃসাহসের-ই আর এক নাম ‘এন্টারপ্রেনারশিপ’।

মনীষা, তার দেশের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের চেয়েও বেশি ক্লিষ্ট থাকে দেশের মানুষের এই চারিত্রিক অবক্ষয়ের কথা ভেবে। অনেক ফ্লাই-ওভার, ব্রিজ, রাস্তা, পাতাল রেল, হোটেল, স্টেডিয়াম হল দেশে, কিন্তু মানুষেরা সব লিলিপুটিয়ান হয়ে গেছে। মানুষরা অমানুষ হয়ে গেছে। চেহারায় লম্বা-চওড়া হলে কী হয়? এরা সব মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গধারী জীব।

পার্সোনাল ফোনটা বাজল। ডাইরেক্ট লাইন।

মনীষা উঠে গিয়ে ধরল বিরক্তির সঙ্গে—

—হাই!

ওপাশ থেকে দীপ বলল।

—কী খবর?

নিরুত্তাপ গলায় বলল মনীষা।

—কাল কী করছ রাতে?

—ভাবছি। এখনও ঠিক করিনি। সি-রক-এর রিভলভিং রেস্তরাঁতে চাইনিজ খেতে যাব ভাবছি।

ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলল।

—একা?

—আমি তো একাই। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যালোন।

—একা থাকতে চাও, তাই-ই একা!

কথা ঘুরিয়ে মনীষা বলল, সুমিত্রার কী খবর?

—ভালো।

কথা এড়িয়ে গেল দীপ।

মনীষা ভাবছিল, আশ্চর্য দাম্পত্য-সম্পর্ক ওদের। দীপ আর সুমিত্রার। এই মুহূর্তে হয়তো সুমিত্রাও তার কাফফ-প্যারেডের অফিসের ঘর থেকে সুরেশ নেভাটিয়া অথবা বিল্টু সুব্রামণিয়মকে ফোন করছে। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা নামেই আছে। একসঙ্গে কোনো পার্টিতে গেলে হানি-হানি করে দু-জনে দু-জনকে। অথচ পুরো ব্যাপারটা জোলো।

দীপ ছেলেটা আসলে একটা ইডিয়ট। ওর ধারণা ও খুব হ্যাণ্ডসাম। হয়তো ও হ্যাণ্ডসামও কারও কারও চোখে। কিন্তু মনীষার মনে হয়, টাইয়ের বা টেরিকটের কাপড়ের অথবা সুইমিং কস্টিউমের বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে ওকে মানালেও মানাতে পারে। ও কী করে মনীষার কাছে আসার স্বপ্ন দেখে, মনীষা ভেবেই পায় না। সেইজন্যেই মনে হয় ছেলেটা ইডিয়ট। মনীষা বোস অনেক হয় না; একজন-ই হয়েছে। যে-পুরুষের কাছে সে হারতে রাজি না থাকে, যার মধ্যে নিজের চেয়েও ভালো বা বেশিকিছু না দেখতে পায়, সে-পুরুষ মনীষার জন্যে নয়। এবং সেকারণেই লক্ষ পুরুষের লোভী চোখ তার ওপর থাকা সত্ত্বেও সে আজ অবধি একজনেরও কাছাকাছি আসেনি মনের। এমনকী শরীরেরও। শরীর তো মনের থেকে অনেক-ই কম দামি, তবুও শারীরিকভাবেও আসেনি দেশে বিদেশে কারও সঙ্গেই।

তার ফার্স্ট-কাজিন পবিত্রর বন্ধু জয় একদিন কলকাতার বাড়ির ছাদে চকিতে চুমু খেয়েছিল তাকে। তখন ও বি. এ. পড়ে। সেন্ট জেভিয়ার্স-এ পড়ত জয়। যে কর্মটি জয় করেছিল তাকে চুমুও বলে না। আচমকা চিনেপটকা ফাটার-ই মতো অতর্কিত, মোস্ট আন রোমান্টিক ঘটনা একটা।

কলকাতায় গতবছর একটি চাকরির জন্যে দেখা করেছিল জয় মনীষার সঙ্গে। পুরুষগুলো সত্যিই আত্মসম্মানজ্ঞানহীন। জয় বিয়েও করেছে। স্ত্রী দক্ষিণ কলকাতার একটি সম্ভ্রান্ত স্কুলে পড়ায়। এক ছেলে এক মেয়ে। ‘ফর ওল্ড টাইমস সেক’ বহুবছর আগে কোনো একদিন চিনেপটকার মতো হঠাৎ একটি চুমু খেয়েছিল যে, সেই দাবিতেই বোধ হয় চাকরি চাইতে এসেছিল। মনীষার একটি কোম্পানির কলকাতার ব্রাঞ্চে হাজার তিনেক টাকা মাইনের একটা চাকরি তৎক্ষণাৎ দিয়েও দিয়েছিল সেলস ডিপার্টমেন্টে। প্রকৃত সেল্ফ-রেসপেক্ট নেই এদিকে ফালতু সেন্স অফ রেসপেক্ট আছে। বলেছিল, অনুনয় করে, মাইনেটা যেন স্ত্রীর চেয়ে বেশি হয়, একটাকা হলেও বেশি হয়। এই কথা বলে, স্ত্রীর লাস্ট-ড্রন স্যালারির সার্টিফিকেটও দেখিয়েছিল।

হাসি পেয়েছিল মনীষার। ভবিষ্যতে মনে হয় বাঙালি মেয়েরাই স্বামীদের খাইয়ে-পরিয়ে রাখবে। বি. এস. সিটা অবশ্য পাশ করেছিল জয়। তাও কম্পার্টমেন্টালে। চেহারাটা অনেকটা সৌমিত্র চ্যাটার্জীর মতোই। বাঙালি মেয়েরা ওরকম চেহারা বোধ হয় খুব-ই পছন্দ করে। একসময় যেমন উত্তমকুমার ক্রেইজ ছিল।

একটি জবরদস্তি চুমুর, তাও অন্যপক্ষের জবরদস্তিতে খাওয়া; দাম একটু বেশিই পড়ে গেল। ওয়েল। হোক গিয়ে। ‘ফর ওল্ড টাইমস সেক।’

বাঙালি ছেলেরা কেন যে, এত মিনমিনে হয়ে গেল। চোর ডাকাত, ঠগ, জোচ্চোর পর্যন্তও একটা ভালো বেরোয় না ওদের মধ্যে থেকে। ভেরি স্যাড। ভেবেছিল মনীষা। আগে বাঙালিরা ভালো কেরানি হত, চাকুরে, মেধাবী অধ্যাপক, ফরেন সার্ভিস, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস, রেভিনিউ সার্ভিসের অফিসার! আজকাল তাও হয় না। কোথায় যে, তলিয়ে যাচ্ছে জাতটা! ভাবলেও কষ্ট লাগে। অথচ সেই জাতের নিজেদের এই অধঃপতন নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। এখনও সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স, হামবড়াই, ‘আম্মো কিছু কম নই’। ভাবলে হাসি পায়।

ওপাশ থেকে দীপ কী যেন বলছিল। ন্যাগিং চ্যাপ। আ পেইন ইন দ্যা নেক। বাঁ-হাত দিয়ে টেলিফোনের বোতামটা টিপে নিজেই রিসিভার নামিয়ে রাখল।

সুমিত্রা মনীষার সঙ্গে মডার্ন হাই স্কুলে পড়ত। বম্বেতেই সেটল করেছিলেন ওর বাবা। সুমিত্রার স্বামী হিসেবেই দীপের সঙ্গে প্রথম আলাপ। এইজন্যেই সুমিত্রাকে মনীষা ওর ডাইরেক্ট আনলিস্টেড টেলিফোন নাম্বারটা দিয়েছিল। দীপকে যে, কেন বিয়ে করল ও ভেবে পায়নি মনীষা। ওকে কী করে একেবারে ফেলে দেবে তাও বুঝতে পারে না মনীষা। সুমিত্রা সত্যিই ওর বান্ধবী। অনেক-ইমিল আছে দু-জনের। তবে ইদানীং চারিত্রিক দিক দিয়ে একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। হয়তো স্বামীর কাছ থেকে যা পায় না তা অন্যের কাছ থেকে নিয়ে পুষিয়ে নিতে চায় নিজের শূন্যতা।

দীপের বাবার অনেক সম্পত্তি ছিল কলকাতায়। এলাহাবাদে এবং দিল্লিতেও। বেচারাম বাবু! একটা করে সম্পত্তি বেচে আর মৌজ করে দীপু দু-নম্বরের টাকায়। চাকরি যেটা করে, সেটা লোকদেখানো। হাজার খানেকও মাইনে পায় কি না সন্দেহ। ছেলেটার কোনো সেন্স অফ প্রোপোরশন নেই। নইলে, মনীষার দিকে হাত বাড়ায়? সিলি! সেন্স অফ প্রোপোরশন অবশ্য খুব কম পুরুষের মধ্যেই দেখেছে ও। পুরুষদের অপমান করে, ছোটো করে, চাকরি খেয়ে, ব্যাবসা ডুবিয়ে খুব-ই আনন্দ পায় মনীষা। অনেক বছরের অত্যাচারের শোধ তোলে ও একা হাতে। যতটুকু পারে। মনীষাও হেরে যেতে পারে, যার কাছে তেমন পুরুষের দেখা মেলেনি আজ অবধি। হয়তো বাকি জীবনেও মিলবে না। ওর ব্যাবসাকেই ওর স্বামী করে নিতে হবে।

ইন্টারকম তুলে নিয়ে আবার ডাকল স্যুসিকে।

—ইয়েস, ম্যাম।

—মি. সরকারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দিয়েছ?

—নো ম্যাম। তাকে পাচ্ছিই না।

—পাচ্ছি না মানে কী? কনটাক্ট হিজ সেক্রেটারি অ্যাণ্ড লিভ দ্যা মেসেজ।

—তাও কী আর করিনি! সঙ্গে সঙ্গেই করেছি। কিন্তু....

—কিন্তু কী? এতে আবার কিন্তু কীসের?

—সেক্রেটারি বলছে যে, তিনি গল্ফ খেলতে গেছেন।

—হোয়াট? মি. সরকার মাস্ট বি অ্যান এক্সট্রা-অর্ডিনারি গুড ম্যানেজার। ইটস অ্যাডমিরিবেল দো। অ্যাপয়েন্টমেন্ট কি ওঁর সেক্রেটারি ক্যানসেল করে দিয়েছে? তা নইলে কীরকম দায়িত্ববান মানুষ তিনি? এদিকে বলছ বিগ শট!

—নো; ম্যাম নট অ্যাট অল। সে বলল, আমার বস অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা জানেন। আই অ্যাম শিয়োর দ্যাট হি উইল বি দেয়ার ইন টাইম। ইফ হি কান্ট গো, হিজ ডেড-বডি উইল গো। আই কান্ট রিচ হিম ন্যাউ। ইটস ট্যু লেট! সরি।

—হোয়াট?

মনীষা বলল। হিজ ডেডবডি উইল কাম?

—ইয়েস ম্যাম। মি. সরকারের সেক্রেটারি তো তাই-ই বললেন। মি. সরকার নাকি তাই-ই বলেন সকলকে। এপর্যন্ত জ্যান্ত অবস্থাতেই যদিও গেছেন সব জায়গায়।

বলেই, হাসল একটু।

মনীষা বিরক্ত গলায় বলল, এটা কি হাসির ব্যাপার হল? তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? ওঁর সেক্রেটারি গল্ফ ক্লাবেও ফোন করে ক্যানসেল করতে পারলেন না? তাঁকে ধরার দায়িত্ব কি আমার?

—চেষ্টা করেছিলেন তাও। গল্ফক্লাবের অফিস থেকে নাকি বলেছে, হি মাস্ট বি ইন অর অ্যারাউণ্ড দ্যা নাইনথ-হোল ন্যাউ। হি রিফিউজেজ টু কাম টু রিসিভ হিজ কল। ইন ফ্যাক্ট হি হেইটস টু বি ডিস্টার্বড ইন হিজ গেম। দ্যাটস হিজ স্ট্যাণ্ডিং ইনস্ট্রাকশন।

—সিলি ওল্ড ফুল। বুড়োবয়সে এই রোদে গল্ফ খেলে মারা যাবে। পাগল নাকি? বয়স কত মি. সরকারের? এনি আইডিয়া স্যুসি? ওভার সেভেন্টি?

—জানি না তা ম্যাম। তবে কম করে ষাট-টাট তো হবেই। এতবড়ো ইণ্ডাস্ট্রিয়াল-এম্পায়ার গড়ে তুলেছেন যখন।

মনীষা হাসল।

বলল তোমার থিয়োরি ঠিক হলে তো আমার বয়স পঁচাত্তর হওয়া উচিত ছিল।

স্যুসি বলল, ইউ আর অ্যান এক্সেপশান ম্যাম। দেয়ারস ওনলি ওয়ান মনীষা বোস ইন ইণ্ডিয়া।

—স্টপ ইট স্যুসি। আই নো হোয়াট আই অ্যাম।

ফোনটা নামিয়ে রেখে মনীষা ভাবছিল, মোসাহেবি, ফ্ল্যাটারি জিনিসটা এমন-ই যে, যে-কেউই করুক; তা পছন্দ হয় না। আবার কেউ তেমন করে করলে খুব ভালোও লাগে। যদি কেউ তেমন করে করতে জানে। যেকোনো জিনিস-ই একটা ‘আর্ট’। আর্টের লেভেলে জীবনকে তুলতে পারে ক-জন? এইরকম ‘কাঁচা গ্যাস’, তাও নিজের কর্মচারীদের কাছ থেকে; খেতে ভালো লাগে না।

মনীষার খাস বেয়ারা বাদেকার এসে টেলেক্স ম্যাসেজের ট্রে আর চিঠিগুলো দিয়ে গেল। এইসব টেলেক্স রেসপেকটিভ ডিপার্টমেন্ট এবং কোম্পানির নাম্বার ওয়ানরা দেখেছেন। শুধু যেগুলো মনীষার দেখা একান্তই দরকার সেগুলোই পাঠিয়েছেন ওঁরা। যে-এগজিকিউটিভ তাকে বেশি বদার করেন, বেশিবার সাহায্য চান, বেশি প্রবলেম নিয়ে আসেন, তাঁর সি. সি. আর.-এ ‘ইনকমপিটেন্ট’ লেখে মনীষা। তবে এই অতীশ সরকার বুড়োটার কাছে, একটা জিনিস নিশ্চয়ই শেখার আছে। ‘ম্যানেজমেন্ট’। এত বড়োগ্রূপের নাম্বার ওয়ান হয়ে যে-মানুষ বেলা পৌনে বারোটা অবধি গল্ফ খেলার সময় পায়, সে-মানুষটা সময়কে কবজা নিশ্চয়ই করতে পেরেছে। মনে মনে একটু ভয়ও করতে লাগল ওর। এমন কেয়ার-ফ্রি অ্যাডভার্সরিকে ও জীবনে ফেস করেনি। ভয় হতে লাগল একথা ভেবে যে, হেরে যাবে না তো? সরকার নিশ্চয়ই ধূর্তচূড়ামণি। এমন সেল্ফকনফিডেন্ট নাম্বার-ওয়ান বিদেশেও কম-ই দেখেছে। গল্ফ খেলছে! তাও, শনিবার বা রবিবার নয়। সপ্তাহের মধ্যে উইকডেইজ-এ। গল্ফ খেলছে। ফানি! ভেরি ফানি ইনডিড!

টেলেক্স মেসেজগুলো দেখে, ড্রয়ার থেকে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ ছোটো ছোটো প্যাড বের করে যে-ডিপার্টমেন্টাল হেডকে যা ইনস্ট্রাকশান দেওয়ার দিয়ে ট্রেটা ফেরত পাঠিয়ে দিল ও বাদেকারের হাতে স্যুসির কাছে। স্যুসিই এবার যা করার তা করবে।

ঘড়িতে দেখল পৌনে বারোটা। কেমন যেন নার্ভাস লাগতে লাগল মনীষার। এমন কখনো হয় না। হয়নি আগে। যে-মানুষ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলে তার ডেড-বডিও অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে আসে, তাকে মিট করার আগে একটু উত্তেজনা হওয়ার-ই কথা! তার ওপর সে নাকি বোয়ালমাছ। মনীষার কফি প্ল্যানটেশানের, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স ইণ্ডাস্ট্রিজের ইন্টারেস্ট সব-ই গিলে খাওয়ার মতলব আছে নাকি মানুষটার। এমন বাঙালি ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টও দেশে যে, আছে তা জানা ছিল না ওর। সরকার পদবি কি বাঙালি ছাড়া অন্য রাজ্যের লোকেরও হয়? কে জানে?

বাথরুমে গেল মনীষা। হালকা পিঙ্ক-মার্বেল মোড়া বাথরুম। পিঙ্ক বিদে। পিঙ্ক বেসিন। ইনসেট করা বাথ-টাব। কমোড। দেওয়ালে হোয়াট-নট। পাশে হালকা-নীল ড্রেসিংরুম। কয়েক প্রস্থ জামাকাপড়, প্যান্টি, ব্রা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে কসমেটিক্স। মেয়েদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস।

জানলা দিয়ে একবার সমুদ্রের দিকে তাকাল। দুপুরের সমুদ্রে নিশ্চয়ই এখন নোনা গন্ধ। এয়ার কণ্ডিশানড বাথরুম থেকে গন্ধ পাওয়া যায় না। শব্দও নয়। গন্ধ-শব্দ-হীন দৃশ্য শুধু। সি-গাল ওড়াওড়ি করছে। জলের ওপরে। জলের মধ্যে রোদের ভাপ। এয়ার কণ্ডিশানড ঘরে বসে বাইরের অসহ্য রোদকে দেখতে ভালো লাগে। হাওয়াতে সমুদ্রের উপর ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে।

আয়নাতে তাকাল একবার মনীষা। ওকে ফিলম স্টারের মতো সুন্দরী কেউই বলবে না। কিন্তু যাদের সৌন্দর্য চেনার চোখ আছে তারা এক নজরেই চিনবে তাকে। লম্বাটে মুখ। লালচে-ফর্সা। চুল টান টান হয়ে পড়ে আছে পিঠে। নেমে গেছে হাঁটু অবধি। চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা। গোল। হংকং থেকে নিয়ে এসেছিল গতবার। গালে দু-টি কালো আর তিনটি লাল তিল। ওকে দেখলে হার্ভার্ড কী কেম্ব্রিজের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানো আপনভোলা, ইংরেজি কী ফিলসফির ছাত্রী বলে মনে হলেও হতে পারে। কিন্তু এতবড়ো বিজনেস ম্যাগনেট বলে মনে হওয়ার কোনো-ই উপায় নেই।

সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। ড্রেসিংরুম থেকে ফোনটা তুলে মনীষা বলল স্যুসিকে, মি. সরকার নিশ্চয়ই দেরি করবেন। এলে, তোমার গেস্টরুমে বসিয়ে কফি খাইও। তারপর আমার ঘরে এনো। আই অ্যাম ফিলিং আ লিটল ডিজি।

স্যুসি উদবিগ্ন গলায় বলল, ডক্টর ওয়াংখেড়কে কি ডাকব ম্যাম? ডিসপিরিন পাঠিয়ে দেব? আছে আমার কাছে।

—না না। কিচ্ছু দরকার নেই।

মনীষা আবার আয়নাতে তাকাল। তার সুন্দর চোখ দু-টি, আনত দিঘল বড়ো-বড়ো আইল্যাশ। মাঝে মাঝে নিজের চোখ দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায় মনীষা। ওর তিরিশ বছরের নারীশরীরের মধ্যে বিজনেস ও ইণ্ডাস্ট্রিয়াল টাকুন হওয়া সত্ত্বেও যে, একজন নারী বাস করে, যে বড়ো নরম আসলে; অথচ বাইরের কাঠিন্যর মুখোশ যার সত্তার অন্তরতমে কেটে বসে গেছে সেই মেয়েটির মুখ-ই আয়নাতে ভেসে এল হঠাৎ। মুখোশটাই জীবন হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। আর কিছুদিন এমনি চললে মুখটি বোধ হয় হারিয়েই যাবে। ইউনাইটেড স্টেটস-এর সেনেটর কোহেনের একটি উক্তি মনে পড়ে গেল ওর। ‘হোয়েন ইউ স্টেপ ইনট্যু দ্য ওয়ার্ল্ড অফ মিররস, ইট ইজ ভেরি হার্ড ট্যু ডিটারমাইন রিয়ালিটি ফ্রম রিফ্লেকশান।’’

চোখ বন্ধ করে ফেলল মনীষা। তারপর বাড়াবাড়ি জিনস ও জ্যাকেট খুলে ফেলে সিল্কের শায়া বের করে ভোপালের ‘মৃগনয়নী’ থেকে কিনে আনা হসসা সিল্কের মেরুন আর কালো স্ট্রাইপের শাড়ি পরল একটা। পনি-টেইল খুলে চুলটা ছড়িয়ে দিল পিঠময়। ম্যাচ করা ব্লাউজ পরল। নাভিতে, বগলতলিতে এবং শরীরের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘শ্যানেল নাম্বার ফাইভ’ স্প্রে করে দিল একটু। মুখে হালকা করে পাউডার বুলোল। আইব্রো পেনসিল দিয়ে ভ্রূ ঠিক করল। ঠোঁটে হালকা-মেরুন লিপস্টিক বুলোল ‘ক্রিশ্চিয়ান-ডায়র’-এর। চোখে, লক্ষ্ণৌ থেকে আনানো সুর্মা। তারপর আয়না যখন বলল যে, ভালো দেখাচ্ছে, মেয়েলি দেখাচ্ছে; তখন নিজের ঘরে ফিরে চেয়ারে বসল।

কেন জানে না, এই অদেখা রাঘব-বোয়াল বুড়োটা ওকে বড়ো আন-নার্ভড করে দিয়েছে। মনটা বড়োই উচাটন হয়েছে। এমন হয় না কখনো। এরকম ডেয়ার-ডেভিল কেয়ার ফ্রি প্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলা করেনি সে।

ঘড়িতে তখন বারোটা বাজতে দুই। ইলেকট্রনিক ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক বারোটাতে তক্ষুনি ইন্টারকম তুলে স্যুসিকে ডাকল।

ওপাশ থেকে স্যুসি বলল, হি ইজ অলরেডি হিয়ার ম্যাম। জাস্ট ওয়াকিং ইনট্যু মাই রুম। শ্যাল আই লেট হিম ইন? অর শ্যাল আই কিপ হিম ওয়েটিং ইন মাই রুম?

—না, না। তোমার ওখানে বসবার দরকার নেই। আমি রেডি হয়ে গেছি। তুমি নিজেই নিয়ে এসো।

বলেই, বলল না না, তোমার আসার দরকার নেই। বেশি ইম্পর্ট্যান্স দেওয়া হবে। বাদেকরকে দিয়েই পাঠাও।

পাছে স্যুসি তার বেশ-পরিবর্তন দেখে কিছু ভাবে, তাই-ই...।

মেয়েরা বড়ো ছোটো-মনের ও সন্দিগ্ধ হয়। নিজে মেয়ে বলেই একথা হাড়ে-হাড়ে জানে ও।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখার আগে ফিসফিস করে বলল, হাউ ওল্ড ইজ দ্যা ওল্ড হ্যাগ? দ্যাই গাই? স্যুসি?

স্যুসি ইন্টারকম-এই যেন গলে গেল আইসক্রিমের মতো। বলল, ওঃ ম্যাম। হি ইজ আ রিয়্যাল গাই! হি হার্ডলি উড বি থার্টি। সো ইয়াং। বিয়ারস আ গোটি বেয়ার্ড। আ রিয়্যাল গ্রূভি গাই! অ্যাণ্ড নাউ হি গোজ। হি ইজ টেরিফিক।

এই প্রথম মনীষার তার অর্গানাইজেশনের টপ-লেভেলে সব-ই মেয়ে এবং অনেক অবিবাহিত মেয়ে রাখাটাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে হল।

বাদেকর দরজায় দু-বার টোকা মারতেই মনীষা নিজে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বলল, ওঃ কাম ইন মি. সরকার। প্লিজ বি সিটেড।

মি. অতীশ সরকার হাত বাড়িয়ে নীচু হয়ে বো করে মনীষার হাতটা নিল। মনীষা! কী বিপদেই যে পড়ল! কেন যে, স্যুসি অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করেছিল কে জানে? মনীষার হাতে হাত দিয়ে আলতো করে চুমু খেলেন। বললেন ইটস সো নাইটস ট্যু হ্যাভ মেট ইউ।

—প্লেজার ইজ মাইন।

মনীষা বলল।

কেন জানে না মি. সরকারের মুখে ও পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাতে পারল না। মানুষটার চোখের দৃষ্টিটা এমন, যেন মনে হয় মনের গভীরতম প্রদেশে সে-চাউনি পৌঁছে যায়। তার কাছ থেকে কোনো গোপন তথ্য এমনকী নিজেকেও আড়াল করে রাখা কঠিন।

মনীষা বলল। হোয়াট উড ইউ লাইক ট্যু হ্যাভ মি. সরকার? ইউ ও্যর প্লেয়িং গল্ফ ইন দ্যা সান আই অ্যাম টোল্ড। ইউ মাস্ট বি ভেরি থার্স্টি। আরনট ইউ?

উত্তরে মি. অতীশ সরকার পরিষ্কার বাংলায় বললেন, আপনি কি বাঙালি? আমি ভেবেছিলাম আপনি সাউথ ইণ্ডিয়ান হবেন! ভাসু। অনেক বাসুই কিন্তু বাসু লেখেন। ভেরি স্ট্রেঞ্জ ইনডিড। এত কমবয়সি একজন বাঙালি মেয়েই যে, ‘এম. বি.’ ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ভাবতে পারিনি। মাই হার্টিয়েস্ট কনগ্রাচুলেশনস।

—হ্যাঁ। কী করে বুঝলেন যে, আমি বাঙালি? দেখেই?

মনীষা চোখ নামিয়ে বলল।

—হ্যাঁ। চেহারা দেখেই। বাঙালি মেয়ের সৌন্দর্য কি অন্য কাউকে মানায়, না অন্য কেউ পেতে পারে? এমন সুন্দরী বাঙালি মেয়ে আমি কিন্তু দেখিনি।

বলেই, মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, আই মিন এভরি ওয়ার্ড অফ ইট। চুল, চোখ, আইল্যাশ, হাঁটার ধরন, মানে...

—ওয়েল, এনাফ ইজ এনাফ। এবার থামুন। ইউ আর হিয়ার টু ডিসকাস বিজনেস। আরনট উই?

মনে মনে কিন্তু রাঙিয়ে গেল মনীষা। কিন্তু পরক্ষণেই ভয়ে ঘামতে লাগল। সাংঘাতিক লোক এ। মনীষার ব্যাবসা আর ইন্ড্রাস্ট্রি যদি কেউ ডোবায় তো এই লোকটিই একমাত্র পারে ডোবাতে। এই বোয়ালমাছেই খাবে তাকে। ডেঞ্জারাস।

মনীষা নিজেকে বলল, সাবধান মনীষা। সাবধান। ডোন্ট বি ক্যারেড অ্যাওয়ে বাই হিজ চার্ম। হি হ্যাজ মেনি অ্যা থিংগস আণ্ডার হিজ স্লিভস। বাঙালিকেই তার সব চেয়ে বেশি অবিশ্বাস। বাঙালি হচ্ছে সাউথ-আমেরিকার নদীর ‘পিরানহা’ মাছের-ই জাত। তারা নিজেরাই নিজেদের খেয়ে বেঁচে থাকে। কাঁকড়ার জাত। একজন ওপরে উঠলে অন্যরা তার পা কামড়ে টেনে নামায় নীচে। বাঙালির ইকুয়ালাইজেশান পলিসি বড়ো বিচিত্র।

আপনি লাঞ্চ কোথায় খান? কাজের কোনো কথাতেই না গিয়ে হঠাৎ-ই প্রশ্ন করলেন মি. সরকার মনীষাকে এলোমেলো করে দিয়ে।

—কোনো ঠিক নেই। কখনো ক্লাবে যাই, কখনো ‘তাজ’-এ। বা ‘ওবেরয় টাওয়ার্স’-এ। এখানেও আনিয়ে নিই কখনো-কখনো। লাঞ্চ ইজ নট ইম্পর্ট্যান্ট অন আ ওয়ার্কিং-ডে।

—আমার একটা ‘কাম্পারি’ খেতে ইচ্ছে করছে খুব-ই। উইথ সোডা অ্যাণ্ড প্লেন্টি অফ আইস। চলুন, লেটস গো আউট ফর লাঞ্চ। ওখানেই বিজনেস ডিসকাস করে নেব। ফর আ চেঞ্জ। শত্রুরা একসঙ্গে লাঞ্চ খেতে খেতে তাদের বিজনেস ডিসকাস করে তো!

—আপনাকে আমি শত্রু মনে করি কে বলল, আপনাকে?

—মিত্রও যে মনে করেন না তা আমি জানি।

—তারপর-ই বলল কোথায় পাবেন ‘কাম্পারি’? আজ তো ড্রাইডে বম্বেতে!

—আমার ঘরে যাব। আমি ‘তাজ’-এই উঠি। বার বার। ‘ওল্ড উইং’-এ। ঘরে তো দেবেই রুম সার্ভিসে ফোন করলে! আপনার কি আপত্তি আছে আমার হোটেলের ঘরে যেতে?

মনীষার মস্তিষ্ক বলল, সাংঘাতিক ডিজাইনিং চ্যাপ। তাকে ধনে-প্রাণে মারবে এই লোক। রাজি হোয়ো না কিছুতেই। অপরিচিত মানুষ হয়ে একজন অল্পবয়সি মহিলাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবের মধ্যেই প্ল্যান আছে। অথচ প্রস্তাবটিকে অশালীন বলে মনে হল না।

মুখে বলল, হোটেলে না গেলেই কি নয়? ‘কাম্পারি’ খেতেই হবে আপনার? আমার অফিসের সেলারে জিন ছিল কিন্তু। ভোদকা ছিল স্কচ ছিল অনেকরকম। ‘রয়্যাল স্যালুটও’।

—থ্যাঙ্ক ইউ। কাম্পারি-ই খেতে হবে। আমার যখন যা-ইচ্ছে করে আমার তক্ষুনিই চাই। এখন-ই। রমাপদ চৌধুরীর একটি উপন্যাস আছে-না এই নামে। আমাদের জেনারেশনের মানসিকতা উনি নির্ভুলভাবে ধরতে পেরেছিলেন। আমরা হচ্ছি ‘রাইট ন্যাউ’-এ বিশ্বাসী প্রজন্মর মানুষ। কী বলেন আপনি? সাবস্টিটিউটে আমি বিশ্বাস করি না। কোনো সেকেণ্ড বেস্ট-এর সঙ্গে আমার কমপ্রোমাইজ নেই। না ব্যাবসায়ে; না জীবনে।

—মি. সরকার....

বাঘিনির মতো প্রতাপশালিনী মনীষা গলা খাঁকরে অবশেষে খ্যাঁকশিয়ালির মতো গলায় কী যেন বলতে গেল।

—মি. সরকার নয়। অতীশ। আমিও আপনাকে মনীষা বলেই ডাকব। আমার মনে হয় আমরা কনটেমপোরারি। আপনি কোন বছরের স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট? কোথা থেকে?

—নাইনটিন সেভেনটি টু। কলকাতায়। মডার্ন হাই। স্কুল-লিভিং নয়। হায়ার সেকেণ্ডারি।

—আমি সেভেনটি। সেন্ট-জেভিয়ার্স স্কুল থেকে। মডার্ন হাই যখন, তখন স্মিতাকে চিনতেন? ও-ও সেভেনটি টুর ব্যাচ।

—স্মিতা? চ্যাটার্জি?

—দ্যাটস রাইট। ও আমার ফার্স্ট-কাজিন। আমার পিসি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন বামুনের ছেলেকে। চ্যাটার্জি। ইনফ্যাক্ট আমাদের ফ্যামিলিতে সকলের-ই লাভ-ম্যারেজ।

—আপনার?

কথাটা জিজ্ঞেস করবে না ভেবেও করে ফেলল মনীষা। হেয়ার-ট্রিগারে আঙুল লাগা গুলির মতোই বেরিয়ে গেল প্রশ্নটা। আর ফেরানো যাবে না। লজ্জায় মরে গেল প্রশ্নটা করেই। মোস্ট ইরেলিভেন্ট প্রশ্ন।

অতীশ একটু চুপ করে থাকল। তাকিয়ে রইল মনীষার চোখের দিকে অনেকক্ষণ। তারপর বলল, বিয়ে করার সময় এখনও পাইনি। তবে, আমার ইচ্ছে সম্বন্ধ করেই বিয়ে করব। বেশ নতুন-নতুন গন্ধ থাকবে বউ-এর গায়ে। টক টক; মিষ্টি-মিষ্টি। কে জানে কেমন?

মনীষা হেসে ফেলল। মি. সরকারের ছেলেমানুষি কথার ধরনে।

কথাবার্তা শুনে মনে হয় মানুষটা একেবারেই ছেলেমানুষ। এতবড়ো ব্যাবসা করে, কে বলবে তা! এমন করে সদ্য-পরিচিতা মহিলা অ্যাডভারসারির সঙ্গে কথা বলে কেউ? একেবারে আনকনভেনশনাল, আনপ্রেডিকটেবল মানুষ।

—চলুন, তাহলে আর দেরি কেন? খিদেও পেয়ে গেছে।

—আপনি কি ডিসকাস করবেন? আমার কোনো সেক্রেটারিকে কি সঙ্গে নেব?

মনীষা বলল।

—নট অ্যাট অল। উই উইল বি এবল টু টেক কেয়ার অফ আওয়ারসেলভস।

প্রাইভেট-লিফট দিয়ে নেমে পথে আসতেই মনীষার সোফার তার আকাশিনীল ‘বি. এম. ডাব্লু.’ গাড়িটি নিয়ে এল।

—আঃ। আ লাভলি কার। কনভার্টিবল কি? হুড খোলা যায়?

—হ্যাঁ। সুইচ টিপলেই!

মনীষা বলল।

—ওক্কে, যদি আমাদের বিজেনস-মিটিংটা ঝগড়া না হয়ে যায় তবে একদিন মুনলাইট ড্রাইভে যাব আপনার সঙ্গে এই গাড়িতে।

ওরা কথা বলতে বলতেই অতীশ সরকারের সাদা মার্সিডিস চালিয়ে নিয়ে এল পার্কিংলট থেকে তার গোর্খা-ড্রাইভার।

বা:। মনীষা বলল। আমারও একটা আছে। তবে ফিকে হলুদ রঙের। থাকবেই। আফটার অল, মনীষা বাসু ইজ দ্যা চেয়ারপার্সন অফ ‘এম. বি. ইনক’।

বলেই, বলল, আপনি আমার গাড়িতেই আসুন। আমার ড্রাইভারকে আপনার ড্রাইভার নিয়ে আসুক ‘তাজ’-এ। ব্যাটা ‘বি. এম. ডাব্লু’তে চড়েনি কোনোদিন। মনীষা বসুর দৌলতে চড়ে নিক একটু।

মনীষা হাসল।

বলল, আহা! মার্সিডিস যেন ফেলনা গাড়ি।

—মনীষা বসু যে-গাড়িতে চড়ে তার তুলনায় সব-ই ফেলনা, খেলনা।

মনীষার মধ্যে ভীষণ খুশির, ভীষণ ভয়ের, গা ছমছম একধরনের অনুভূতি হতে লাগল। এই মানুষটা সাংঘাতিক। ব্যাবসাসংক্রান্ত ফেভারের কথা তো ছেড়েই দিল, ব্যক্তিগত কিছু চেয়ে বসলেও ও হয়তো ‘না’ বলতে পারবে না। কিছু কিছু পুরুষ থাকে, মেয়েদের পক্ষে যাকে ‘না’ বলা ভারি মুশকিল। এদের-ই বোধ হয় ‘ইরেজিস্টিবল’ বলে।

খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল অতীশ। পাশে বসে ভাবছিল ও। বেশ গান বেজে উঠল: ‘ডিড আই স্যে আই লাভ ইউ? ডিড আই স্যে আই কেয়ার?’

—রাইট! মাই ক্রেজ!

অতীশ বলল।

—সো ইজ মাইন।

মনীষা বলল।

—কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়? ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না, ভালোবাসায় ভোলাবো আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলবো না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাবো।’ ভালো লাগে না?

—নিশ্চয়ই!

—অজয় চক্রবর্তী? ‘তোমারি গাহি জয়’? রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রণয় কুসুম বনে বিচ্ছেদ ভুজঙ্গ রয়েছে সজনি।’

—ইস আপনার সঙ্গে আমার রুচির খুব-ই মিল দেখছি।

মনীষা উচ্ছল হয়ে বলল।

ওকে নিভিয়ে দিয়ে অতীশ বলল, দ্যাটস ইমম্যাটেরিয়াল, ব্যাবসার পলিসিতে মিল থাকাটাই বড়োকথা।

বলেই, ক্যাসেট-প্লেয়ারটা বন্ধ করে দিল।

মনীষা একবার দেখল অতীশের দিকে। তারপর গম্ভীর হয়ে গেল। আর পাত্তা দেবে না লোকটাকে। নিজেকে বেশি চালাক মনে করে। ওভারস্মার্ট একটা।

‘তাজ’-এর লাউঞ্জের সামনে পৌঁছোতেই উর্দিপরা শিখ গেটম্যান ওকে বিরাট সেলাম ঠুকল। চাবি গাড়িতে লাগিয়েই নেমে গেল অতীশ। তারপর ডানদিকে ঘুরে গিয়ে লেফট-হ্যাণ্ড ড্রাইভ মার্সিডিস-এর দরজা খুলে নামাল মনীষাকে। তারপর এসকর্ট করে নিয়ে গিয়ে রিসেপশনে চাবি চাইল।

ওল্ড-উইং-এর লিফট অবধি হেঁটে গিয়ে লিফটের বোতাম টিপল। সুইমিং পুল-এর দিক থেকে অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে ফেডেড জিনস ও হালকা বেগুনি টি-শার্ট পরে প্রায় দৌড়ে এসে অতীশকে বলল, হাই! ডার্লিং!

—হাই! হাউ ইজ লাইফ রিতা? মিট মনীষা বাসু।

রিতা বলল, ‘হাই’। মনীষাকে।

তারপর-ই বলল, হাই আর ইউ প্লেসড দিস ইভনিং অতীশ?

বাইরে বৃষ্টি নেমেছিল। সেদিকে দেখিয়ে, অতীশ পাঞ্জাবিতে বলল ‘কিন্না আচ্ছা মওসুম হেগা। আই প্রেফার টু বি টোটালি ডিসপ্লেসড দিস ইভনিং।’

বলেই বলল, ওয়ার্ক! ওয়ার্ক! অ্যাণ্ড ওয়ার্ক। নো রেসপাইট রিতা।

—ওক্কে!

বলে, একটু অপমানিত মুখে রিতা রিসেপশনের দিকে হেঁটে গেল।

অতীশ বলল, ইচ্ছে করেই আপনার পরিচয় দিলাম না। আরও জেলাস হত। দিল্লির গল্ফ-ক্লাবে আলাপ। ওরা শিখ। খুশয়ন্ত সিংদের সঙ্গে কীরকম আত্মীয়তাও আছে। প্রপার্টি-ওনার্স, বিজনেস-টাইকুন।

লিফট-এ উঠতে উঠতে বলল, দিল্লি গল্ফক্লাবে ভদকা-বেসড হোয়াইট-লেডি খেয়েছেন কখনো? দারুণ করে।

না:। মনীষা বলল।

তারপর বলল, শীতকালে গেলে কখনো-কখনো ওখানে রোদে বসে লাঞ্চ খাই!

—ফাইন। নেক্সট টাইম আই উইল বি উইথ ইউ।

মনীষা কিছু বলল না।

ওর হাঁটু কাঁপছিল। ভালোলাগা কাকে বলে ও জানত। ‘ফলিং ইন লাভ হেড ওভার হিলস’ কথাটা শিশুকাল থেকেই শুনে এসেছে। কিন্তু ভেবেছিল, ওটা কথার-ই কথা। ‘অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড’-এ অ্যালিসদের জীবনে কখনো অমন ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারত। রোমিয়ো-জুলিয়েট পড়েছিল। লায়লা-মজনুর গল্প শুনেছিল! ইম্ফলে একটি প্রোপোজড ইণ্ডাস্ট্রির প্রোজেক্ট-রিপোর্ট নিয়ে স্টাডি করতে যখন মণিপুরে গেছিল তখন থৈবী খাম্বার প্রেমের গল্পর কথাও শুনেছিল কিন্তু তার জীবনে, কোনো শিক্ষিতা, আধুনিক, প্রচন্ড প্রভাব প্রতিপত্তিশালী মেয়ের জীবনেও এমন দুর্ঘটনা যে, ঘটতে পারে তা আজ বেলা পৌনে বারোটার সময়ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না। কিন্তু এখন...

অতীশ বলল, কী ভাবছেন?

—না:।

—কিছু তো ভাবছেন। মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের মস্তিষ্ক একমাত্র যোগাসন, গল্ফ, টেনিস অথবা স্কোয়াশ খেলার সময়-ই শুধু অন্য ভাবনা মুক্ত থাকে। নইলে না ভেবে তার উপায়-ই নেই। কিছু একটা ভাবছেন নিশ্ছয়ই।

মনীষার অসহায় লাগতে লাগল। কান্না পেয়ে গেল ওর। মা-বাবার কথা মনে পড়ে গেল। তাঁরা থাকলে দৌড়ে গিয়ে বলত, বাঁচাও আমাকে তোমরা, এই সুন্দর ইরেজিস্টেবল পুরুষ মানুষটার হাত থেকে।

—সো! হিয়ার উই আর!

বলেই, লিফট থেকে নেমে মনীষাকে এসকর্ট করে নিয়ে বাঁ-দিকের করিডরে পড়েই ডানদিকের সবচেয়ে বড়ো স্যুইটের দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।

—হাউ বাউট উ্য! মে আই ফিক্স ইউ আ ড্রিঙ্ক?

—‘ব্লাডি মেরি’। প্লিজ! জাস্ট ওয়ান।

ঘোরের মধ্যে বলল, মনীষা।

—তা কি হয়? একটা খেলে গৃহস্থর অকল্যাণ হবে। সে রসগোল্লাই হোক কী ব্লাডি-মেরি।

—বসুন! এ কী! দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

স্যুইটের সিটিং-রুমের সোফায় ধপাস করে বসে পড়ল মনীষা। এত আনস্মার্ট লাগেনি নিজেকে কখনোই।

অতীশ ঘরের ফ্রিজ খুলে দেখল। নিজের মনে বলল, টোম্যাটো—জ্যুস? ইয়েস! ভদকা? ইয়েস! লেমন স্লাইসেস? ইয়েস।

তারপরেই বলল, না:। রুম সার্ভিসেই বলে দিই। ভালো করে বানিয়ে দেবে ওরা। একসঙ্গে দুটো লার্জ বলে দিই? নইলে আমাদের ডিসকাশন-এর সময় আবার উঠে অর্ডার করতে হবে।

মনীষা কিছু বলতে পারল না।

উঠে বলল, মে আই ইউজ ইয়োর টয়লেট প্লিজ?

—শিয়োর। প্লিজ যান। ফিল অ্যাট হোম। বাঙালির ঘরে এসে এমন কিন্তু কিন্তু করছেন কেন?

মনীষা বেডরুমে গিয়ে টয়লেটে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে লক করে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিজেই আঁতকে উঠল। সমস্ত মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। গায়ে, মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। ঠোঁট-দু-টি শুকিয়ে গেছে। ভীষণ পিপাসা। মুখ ধুল ঠাণ্ডাজল দিয়ে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নতুন করে মেক-আপ করল ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে। ওডিকোলোন লাগাল। হাত কাঁপছিল ওর। তারপর অনেকক্ষণ পর বেরোল বাথরুম থেকে।

রুম-সার্ভিসের বেয়ারা দু-টি বড়ো ইটালিয়ান কাম্পারি, দু-টি সোডা, আইস-ব্যাকেট এবং দু-টি বড়ো ‘ব্লাডি-ম্যারি’ রেখে দিল এনে মধ্যের কাচের টেবিলে। বিলটা সই করে কুড়ি টাকার একটি নোট দিল অতীশ বেয়ারাকে। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। বলে, সে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলল, হাউ বাউট লাঞ্চ স্যার?

—প্লিজ ব্রিং আ মেনু-কার্ড ফ্রম ‘গোল্ডেন ড্রাগন’। উই উইল প্লেস দ্যা অর্ডার ফর চাইনিজ ফুড।

বলেই, ‘ব্লাডি-ম্যারি’র গ্লাস তুলে দিয়ে মনীষার হাতে, নিজের কাম্পারির মধ্যে সোডা ও আইস কিউব ফেলে, স্টারার দিয়ে নারিয়ে গ্লাসটি উপরে তুলে বলল: ট্যু দা ফার্স্ট মিটিং অফ মনীষা অ্যাণ্ড অতীশ। চিয়ার্স!

মনীষা বলল, চিয়ার্স! অস্ফুটে। ওর যে অফিসে কাজ আছে। দু-টি ‘ব্লাডি-ম্যারি’ খেয়ে তারপর ‘গোল্ডেন-ড্রাগন’-এর এলাহি লাঞ্চ খেয়ে ফিরতে ফিরতে তো চারটে বেজে যাবে। সত্যিই সর্বনাশ হল ওর।

মনীষা নিজেকে শক্ত করে বলল, আপনি নিশ্চয়ই আমাদের নীলগিরির কফি প্ল্যানটেশানের কথা জিজ্ঞেস করবেন?

—কফি—প্ল্যানটেশান? ওঃ। নো:। শুধু তাই নয় আরও অনেক ব্যাপার ছিল ডিসকাশনের। কিন্তুলেটস কল ইট আ ডে। আজকে কোনো কাজের কথা নয়। ‘দু-জনে মুখোমুখি সমান দুখে দুখী বাহিরে বারি ঝরে ঝরঝর’।

মনীষার সেই অবশ ভাবটা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। একজন পুরুষের জন্যে, সে যত বড়ো ডন জোয়ান-ই হোক-না-কেন, তার তিল তিল করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য সে নষ্ট করতে পারে না। ‘এম. বি.’ ইন্টারন্যাশনালের মান্থলি স্যালারি আর ‘ওয়েজেস’-এর বিল-ই দু-কোটি টাকা। তার সুস্থ, সবল ও অনভিভূত থাকার ওপরে নির্ভর করছে অগণ্য পরিবারের শুভাশুভ। নতুন কম্পিউটার আর টি ভি প্রোজেক্টের জন্যে ব্যাঙ্কের কাছে দশ কোটি টাকা লোনও নিয়েছে। আশা করছে তিন বছরের মধ্যে ব্রেক-ইভিন করবে। তারপর প্রফিট আসতে শুরু করবে। ব্রেক-ইভিন পয়েন্ট পেরিয়ে গেলেই ইণ্ডাস্ট্রিজ-এ প্রফিট আসতে শুরু করে বানের তোড়ের মতো। বাঙালি ইণ্ডাস্ট্রি মাইণ্ডেড নয়, রিস্ক নিতে পারে না, ধৈর্য ধরতে পারে না বলেই তার ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হওয়া হয়ে ওঠে না। অতীশ সরকার প্রায় তাকে ঘায়েল করে এনেছিল। আর একটু হলেই মনীষার ভেতরের চিরন্তন নারী-সত্তা আর ব্যবসায়ী-সত্তাকে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। যাক সামলে নিয়েছে মনীষা। মানুষটা তার পৌরুষের চমক আর মনোহারিত্ব দিয়ে তাকে হারিয়ে দিয়ে তার গ্রূপ অফ কোম্পানিজকে করায়ত্ত করবে ভেবেছিল এইরকম প্রেমের অভিনয় মনীষা আগেও অনেকবার দেখেছে। তবে কখনোই সে, এমন দুর্বল হয়ে পড়েনি। ‘ব্লাডিম্যারির’ গ্লাসে একটি বড়ো চুমুক দিয়ে মনীষা বলল, ‘না, কেন? আমাদের তো বিজনেস ডিসকাস করতেই এখানে আসা!’

অতীশ যেন মনীষার চোখের ভাষা পড়তে পারল মুহূর্তের মধ্যে। একটু অন্যমনস্ক দেখাল তাকে।

কাম্পারির গ্লাসে সেও বড়ো একটি চুমুক দিয়ে বলল, আই অ্যাম সরি। আমি হয়তো অনেক কিছু ইম্যাজিন করতে শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার ও আপনার জীবনে বিজনেস ছাড়াও অন্য অনেক কিছুই আছে। সুস্থ সাধারণ অন্য অনেক নারী-পুরুষের-ই মতো। আমি এই ব্যাবসা করে করে নিজেকে তো প্রায় নষ্টই করে ফেলেছি। এখন দেখছি, আপনিও ব্যতিক্রম নন।

ব্যতিক্রমের কোনো ব্যাপার নেই। ‘বিজনেস ইজ বিজনেস’ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল মনীষা।

তারপর অতীশের দিকে চেয়ে বলল, আপনি কেন আজকের মিটিং চেয়েছিলেন, তা জানালে খুশি হব।

অতীশের মুখ দেখে মনে হল ও ব্যথিত হয়েছে। প্রথমে, তাই-ই মনে হল। পরক্ষণেই বুঝল মনীষা যে, অতীশ একজন পাকা অভিনেতা। ঘাঘু পুরুষ। রিতার সঙ্গে রাত কাটাবে আর আমাকে এমন-ই ভাব দেখাচ্ছে যেন আমাকে দেখে একেবারে ওভারহোয়েলমড। চালাকি করার জায়গা পায় না।

মনে মনে বলল মনীষা, নিজেকে।

নড়বড়ে হয়ে যাওয়া নিজেকে পেপ-আপ করার জন্যে গ্লাসে একটা বড়ো চুমুক দিল।

এমন সময় ফোনটা বাজল।

—দ্যাটস রাইট।

অতীশ বলল, রিসিভার তুলে। স্মার্টলি। তারপর-ই বলল, ও। নিশ্চয়ই চিনতে পারছি। মি. সারাভাই। কেমন আছেন?

মনীষা বুঝল, কুমুদিনী ইতিমধ্যেই কাজে নেমে পড়েছে। দ্যাটস ফাইন। অতীশ বলল, মে বি, হোয়েন আই কাম নেক্সট টাইম। আই অ্যাম লিভিং টুমরো ফর ব্যাঙ্গালোর। ডাহা মিথ্যুক! রিতাকে বলল কলকাতা আর কুমুদিনীর স্বামীকে বলছে ব্যাঙ্গালোর।

—কবে আবার আসব? ও। আমার সেক্রেটারির নাম্বারটা রেখে দিন। ওকে সপ্তাহখানেক পরেই ফোন করে জেনে নেবেন। বোঝেন তো! নিজের হোয়্যারাবাউটস নিজেই জানি না।

ফোনটা রেখে দিতেই আবার বেজে উঠল।

—ইয়েস। বিয়ান্দকাব হোয়াট ইজ ইট? আই টোল্ড ইউ টাইম অ্যাণ্ড এগেইন নট টু ডিস্টার্ব মি ডিউরিং লাঞ্চ আওয়ার। কী ব্যাপার? ‘জে’ ক্লাসের টিকিট নেই? ঠিক আছে। টেল ইয়োর ড্যাম ট্রাভেল-এজেন্টস টু গেট মি অ্যান ইকনমি ক্লাস টিকিট। আমার কাল সকালে দিল্লি যেতেই হবে। ‘ফিকি’র-এগজিকিউটিভ কমিটির মিটিং আছে। তুমি আবার আমাকে চারটেতে কনটাক্ট করো। না, না, অফিসে। যখন যাব। অফিসেই ফিরে যাব আমি।

ফোনটা নামিয়েই ‘তাজ’-এর অপারেটরকে ফোন করে বলল অতীশ, তিনটে অবধি কোনো ইনকামিং কল যেন তাকে না দেওয়া হয়। তাই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি ডিস্টার্বড। মনীষা বলল, মে আই ইউজ ইয়োর ফোন?

দু-দিকে দু-হাত ছুড়ে দিয়ে অতীশ বলল, হোয়াই নট। বাই ওল মিনস।

মনীষা তার নিজের অফিসে ফোন করে স্যুসিকে বলল, যে, সে ‘তাজ’-এ আছে চারটের সময় ফিরবে। সাড়ে চারটেতে প্রত্যেক গ্রূপ-এর ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোলারদের মিটিং ফিক্স করে ওঁদের বলে দাও।

ওপাশ থেকে স্যুসি বলল, গ্রূপ ওয়ানের মিসেস রতনঝংকার যে, আজ বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা যাচ্ছেন।

—টেল হার ট্যু পোস্টপোন হার ট্রিপ। ট্রাভেল এজেন্টকে বলে দাও। আই হ্যাভ ইম্পর্ট্যান্ট ম্যাটারস টু ডিসকাস উইথ ইচ অফ দেম। আর শোনো আমাকে এখানে আর ডিস্টার্ব কোরো না।

ফোনটা রেখেই অতীশকে বলল, কই? ‘গোল্ডেন-ড্রাগন’-এর মেনু তো নিয়ে এল না। কখন লাঞ্চ অর্ডার করবেন? কখন ফিরব?

—ওঃ। আই অ্যাম সরি!

বলেই, অতীশ আবার রুম-সার্ভিসে ফোন করল। করে, বলে দিল তারপর নিজের গ্লাসটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল মনীষার সামনে। বলল, আপনি যখন এত কিন অন ডিসকাসিং বিজনেস তখন দয়া করে দিন দশেক বাদে আপনার অফিসেই আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবেন। আপনার সেক্রেটারিকে বলবেন যেন, আমার সেক্রেটারিকে জানিয়ে দেয়। আমিও বলে যাব আমার সেক্রেটারিকে।

—আমি পরশু একবার লানডান-এ যাব তারপর ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে ফিরব। যদি এক-দু-দিন দেরি হয় তবে অসুবিধে হবে না নিশ্চয়ই।

মনীষা বলল।

—না, না। আপনার সুবিধেমতোই দেবেন। তা ছাড়া আমি রবিবারে সিংগাপুরে যাচ্ছি। সেখান থেকে তাইপে। তারপর ব্যাংকক হয়ে ফিরব। আপনার অসুবিধে না করেই দেবেন।

—দেন, লেটস গেট ব্যাক টু প্রিলিমিনারি থিংগস।

মনীষা বলল, হ্যাঁ। এবার আপনি ডাই-হার্ড প্রফেশনালের-ই মতো কথা বলছেন।

অতীশ পরক্ষণেই বলল, কিছু মনে যদি না করেন তো আজ থাক। আমার বিজনেসম্যানের মুখোশটা আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরমুহূর্তেই খসে গেছে। সেটা না পরে, বিজনেস আমার দ্বারা হবে না। হয় না। কথা দিচ্ছি যে, এর পরের মিটিং-এ শুধুই বিজনেস-ই আলোচনা করব। যদি আপনাকে আমার ঘরে ডেকে নিয়ে আসাতে এবং হঠাৎ এমন ইনফরম্যাল আনবিজনেসম্যান লাইক ব্যবহার করায়, আপনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। অনেস্টলি, আই অ্যাম রিপেনট্যান্ট। আপনি আমাকে কী ভাবছেন জানি না, তবে যা ভাবছেন আমি তা নই।

মনীষা নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, এতে ভাবাভাবির কী আছে?

মনে মনে বলল, আপনি যা, তাই-ই ভেবেছি। ঠিক-ই ভেবেছি। তবে আপনি নিজেকে খুব চালাক মনে করেন। আমিও কিছু হাবাগোবা নই। তবে প্রায় নিজের সর্বনাশ-ই করে ফেলেছিলাম আর কী! ‘এম. বি.’ ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপার্সন নিজেকে একজন মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ের মতো এত সহজে প্রেমে পড়ার লাক্সারি অ্যাফোর্ড করতে দিতে পারে না। ছি: কী করতে বসেছিলাম আমি!

চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বম্বের বর্ষাকালটা আমার দারুণ লাগে। নইলে অন্য সময় বিচ্ছিরি। নেহাত পেটের দায়েই বার বার আসতে হয়। নইলে আমার হেড-কোয়াটার্স ব্যাঙ্গালোর, দ্যা গার্ডেন-সিটি অফ ইণ্ডিয়া! আমার সবচেয়ে ফেভারিট। ওখানেই সেটল করব ঠিক করেছি। যখন করব। জানি না কবে সেই সুদিন হবে। অতীশ বলল।

মনীষা পরিবেশটাকে যেমন গুরুগম্ভীর করে তুলেছিল, তা থেকে একটু সরে এসে বলল, বেশি বয়সে ওখানে না থাকাই ভালো। বাত হয়। গাউট। আর্থরাইটিস হয়।

—বেশি বয়স অবধি কি বাঁচব? যা হেকটিক লাইফ লিড করি! আমার ইচ্ছে, আমি পঁয়তাল্লিশেই রিটায়ার করে হয় ব্যাঙ্গালোরে আঙুরের চাষ করব, নয় কুন্নুরে আমার ছোট্ট কফি-প্ল্যানটেশনেই কাটাব আর যে-ক-বছর বাঁচি!

—এত তাড়াতাড়ি মরার ইচ্ছে কেন?

—না:। মানুষের জীবনের দৈর্ঘ্যই তো তার বেঁচে থাকার একমাত্র পরিমাপ নয়। জীবনের ভলিউম, জীবনের মাস, অ্যাচিভমেন্টস-ই একজন মানুষের জীবনের ওয়েইং-স্কেল। তা বিচার করেই সবকিছু। যে-ক-বছর বাঁচি, ঘূর্ণিঝড়ের মতোই বাঁচব, যেমন বাঁচছি কুড়ি বছর থেকে। ইনফ্যাক্ট বাবার মৃত্যুর পর থেকেই। ভেবেছিলাম, ঘূর্ণি-ঝড়ে পড়া ঝরাপাতার মতো উড়ে-বেড়ানোর জীবনে ছেদ টানবার একটা সুযোগ আসবে। অ্যাটলিস্ট অ্যাট সাম পয়েন্ট অব টাইম। ভেবেছিলাম! অনেকবার-ই হাতের কাছে এসেও সে-সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। হয়তো বহুবার আরও যাবে। কিছুই করার নেই। জীবন এইরকম-ই।

শেষের দিকে অতীশের গলাটা যেন সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেল।

রুম-সার্ভিসের বেয়ারা ‘গোল্ডেন-ড্রাগন’-এর মেনু নিয়ে এল।

অতীশ বলল, ইয়া! থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। তারপর মনীষাকে বলল, কী স্যুপ খাবেন? আপনি?

—শাক ফিন।

—ফাইন। আমিও তাই। আর? আর কী খাবেন?

—হাক্কা-নুডলস। আর মিক্সড ফ্রায়েড-রাইস। উইথ ব্যাম্বু-শুটস। দ্যাট শুটস মি ফাইন কিন্তু একটাই বলুন। এরা কোয়ানটিটিতে বড্ডই বেশি দেয়।

ঠিক! তা বলে কোয়ালিটি ডিসপেন্স করে নয়। ‘তাজ’ ইজ ‘তাজ’।

তারপর বলল, আমি সারাসকাল গল্ফ খেলেছি। দারুণ খিদে পেয়েছে। দুটো করেই বলি। যতটুকু পারবেন খাবেন। লিচু আর আইসক্রিম বলি? ডেসার্ট হিসেবে?

—আমি বড্ডই ওয়েট পুট-অন করেছি।

মনীষা বলল।

মেনু থেকে চোখ সরিয়ে অতীশ পূর্ণদৃষ্টিতে চাইল মনীষার দিকে। বলল, আই ডোন্ট থিঙ্ক সো। ইউ আর জাস্ট রাইট ফর ইয়োর হাইট। এভরিথিং ইন দ্যা রাইটেস্ট প্রোপোরশন অ্যাট দ্যা রাইট প্লেসেস।

মনীষা ব্লাশ করল। অসভ্য পুরুষ! পুরুষ মাত্রই অসভ্য।

অতীশ বলল, ভালো করে খাবেন। নইলে এতবড়ো দায়িত্ব সামলাবেন কী করে? রোজ সওনা নেবেন আর সাঁতার কাটবেন।

—রোজ সওনা নিয়ে আর সাঁতার কেটেই তো এই। আমার বাড়িতেই আছে।

—ফাইন। যদি কোনোদিন দয়া করে বাড়িতে ডাকেন ভবিষ্যতে, তাহলে আমারও সওনা নেওয়ার আর সাঁতার কাটার সৌভাগ্য হবে! পালি হিলে? তাই-না? নাম্বারটা লেখা আছে। রেডিলি মনে করতে পারছি না।

—তা জানি। সব খোঁজ নিয়েই তো আপনি এসেছেন।

—কোয়াইট রাইট। সব খোঁজ না নিয়ে আমি মনীষা বসুর কাছে আসিনি। তবে দেখলাম যে, আমি ভুল। সব খোঁজ নেওয়া সত্ত্বেও যা-খুঁজতে এসেছিলাম তা পেলাম না। তা ছাড়া জানার অনেক কিছুই বাকি ছিল।

বলেই দু-কাঁধ শ্রাগ করে বলল, ওয়েল! কান্ট বি হেল্পড!

তবে যে বললেন, আপনি ভেবেছিলেন ‘ভাসু’ আমি। বাসু শুনে চমকে গেছিলেন যেন, এমন-ইভাব দেখালেন আমার অফিসে!

ওটা আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্যে। সে-মুহূর্তেও আমি ‘সরকার অ্যামাল-গামেটস’-এর নাম্বার-ওয়ান ছিলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই অতীশ সরকার হয়ে গেছিলাম। জাস্ট অতীশ সরকার। ইন মাই ইণ্ডিভিজুয়াল, প্রাইভেট; কনফিডেন্সিয়াল ক্যাপাসিটি। যে, নিছক-ই একজন তিরিশ বছরের ক্লান্ত একা পুরুষ।

অন্যমনস্ক দেখাল অতীশকে। কিছুক্ষণ চুপ করে অন্যদিকে চেয়ে রইল।

তারপর মনীষার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, মনীষা বসুকেও আমি নিছক একজন নারী হিসেবেই এখানে ডেকে এনেছিলাম। ইন হার ইণ্ডিভিজুয়াল ক্যাপাসিটি। তাঁর বিত্ত, সম্পদ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি বাদ দিয়েই—শুধুমাত্র তাঁর নরম ব্যক্তিত্ব আর সৌন্দর্য নিয়েই তিনি আসবেন ভেবেছিলাম। ভুল হয়েছিল। ভুলের জন্যে ক্ষমাও চেয়েছি!

বলেই, মুখ নীচু করে ফেলল অতীশ।

এই লোকটাকে বুঝতে পারছে না মনীষা। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে, লোকটা যা বলছে তা সত্যি। সিনসিয়ারলিই বলছে। মনে হচ্ছে, হি মিনস এভরি ওয়ার্ড অফ ইট। পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে, লোকটি একটি ঠগ। চিট। স্যুইণ্ডলার। প্রফেশনাল লেডি-কিলার। তার চেহারা আর ব্যক্তিত্বর চমক দিয়েই সে ‘এম. বি.’ ইন্টারন্যাশনালকে কবজা করে নিয়ে তারপর-ই মনীষা বাসুকে ছুড়ে ফেলে দেবে।

কুমুদিনী বলছিল, অতীশ সরকার ‘এম. বি.’ ইন্টারন্যাশনাল ইনক-এর হোল্ডিং-এর অনেক কোম্পানির-ই শেয়ার কর্নার করতে আরম্ভ করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। বম্বে-কলকাতা-দিল্লি কোনো জায়গার স্টক-ব্রোকাররাই সন্দেহ প্রকাশ করেননি। এই আপাত-স্থিরতার পেছনে যে, অতীশ সরকার-ই, সে-খবরও মনীষার বিভিন্ন ম্যানেজারেরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ-এজেন্সির মাধ্যমেই জানতে পেরেছে। ব্যাপারটা খুব-ই বুদ্ধিমানের মতো করছে। আলাদা করে ছোটো ছোটো শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে দেখা করে ওর এজেন্টরা ফ্যাবুলাস প্রাইস অফার করছে। এক-একটা লট কিনেই চুপ মেরে যাচ্ছে। আবার কিছুদিন পরে এগোচ্ছে।

অতীশ বলল, কাল দিল্লিতে পৌঁছিয়েই একটি কবিতার কথা মনে পড়বে আমার।

—কার কবিতা? শঙ্খ ঘোষ, না শক্তি, সুনীলের?

—না। ওঁদের কবিতার খুব-ই ভক্ত ছিলাম একসময় যদিও। এখন সময় পাই না। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ-ই মনে আছে কিছু কিছু। মনে আছে বলেই মনে পড়ে। মনে না থাকলে আজ আর নতুন করে পড়ার সময় থাকত না।

—কোন কবিতা?

সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে শুধোল মনীষা। বিস্মিত হল অতীশের কাব্যপ্রীতি দেখে! এরকম ভার্সেটাইল ব্যাবসাদার আগে মিট করেনি কখনো। বাঙালি ব্যাবসাদার তো নয়ই!

—আপনি কিন্তু খাচ্ছেন না। আমি আরও দুটো ‘কাম্পারি’ খাব। আপনি আমাকে কাম্পানি দেবেন না?

‘আমি ড্রাঙ্ক হয়ে অফিসে যেতে চাই না।

‘চারটে ‘ব্লাডি-ম্যারি’ খেলেই এতবড়ো গ্রূপের চেয়ারম্যান যদি ড্রাঙ্ক হয়ে যায় তবে তার কোম্পানি বিক্রি করে দেওয়াই ভালো।

‘কখনো বেচলেও আপনাকে বেচব না।

মনীষা বলল।

‘আমি কিনলে-না সে প্রশ্ন উঠবে? কেন মিছিমিছি ঝগড়া করছেন? ঝগড়া করতে হলে করবেন পরের দিন। আজ ভাব। শুধু ভাব।

বলেই, রুম-সার্ভিসে অর্ডার করল আরও ড্রিঙ্কস-এর।

মনীষা ভাবল, সর্বনাশ! আরও ‘ব্লাডি ম্যারি’।

বলল, আপনি কি আমাকে রেপ-টেপ করবার মতলব করছেন নাকি? কী মতলব বলুন তো!

এবারে হেসেই বলল মনীষা।

—আপনার কি মনে হয় অতীশ সরকারেরও কোনো মেয়েকে রেপ করার প্রয়োজন ঘটে। উলটে সারাক্ষণ নিজেকেই বাঁচিয়ে রাখতে হয়, উইথ গ্রেট ডিফিকাল্টি; ফ্রম বিইং রেপড বাই লেডিজ।

মনীষা বলল, আপনার নিজের সম্বন্ধে ধারণাটা বড্ড বেশি উঁচু।

—একটুও নয়। কথাটা আপনার বেলাও কি প্রযোজ্য নয়? মানে, আপনাকেও কি সারাক্ষণ ভদ্রলোকদের হাত থেকে বাঁচতে হয় না? হাজার-রকমের ন্যুইসেন্স-এর হাত থেকে? ফর ইনস্টান্স, আপনার সেই বান্ধবীর স্বামী, আহা: নামটা মনে করতে পারছি না। আপনার স্কুলের বান্ধবীর স্বামী...

চমকে উঠল মনীষা। কী সাংঘাতিক লোক! ওকে ইনসাইড-আউট করে জেনে তবেই এসেছে ওর কাছে। লোকটা ওর সম্বন্ধে জানে না এমন কিছুই নেই। এমনকী পার্সোনাল লাইফ সম্বন্ধেও।

কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ না করে বলল, সে তো আমি মেয়ে বলে। আমি একা কেন? সব মেয়েকেই ওইরকমভাবেই এখনও বাঁচতে হয়। পুরুষরা তো জানোয়ার-ই! ইন মেজোরিটি!

—তা ঠিক! লস্ট-কেসে কখনো আর্গু করি না আমি। কিন্তু সুন্দরীরা কিন্তু জানোয়ারদের-ই বেশি পছন্দ করেন। জানি না কেন! নইলে ‘বিউটি অ্যাণ্ড দ্যা বিস্ট’ কথাটা আসতই না। যাকগে, কবিতাটা বলি।

কবিতাটির নাম ‘নষ্ট-স্বপ্ন’। আপনি জানেন?

—আমার কোনো স্বপ্নই নষ্ট হয়নি। না:। জানি না।

মনীষা বলল।

—যদি না হয়ে থাকে তো আপনি লাকি! তবে এটা বোধ হয় বাজে কথা। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল—এম্পায়ার গড়ার স্বপ্ন ছাড়াও একজন পুরুষ অথবা নারীর অন্য অনেক-ই স্বপ্ন থাকে। যেসব স্বপ্নের রং ফিকে বেগুনি। অথবা লেমান-ইয়ালো। সেইসব স্বপ্ন, সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যেকটি স্বপ্নই। কোনো কোনো মহিলা যেমন কনসিভ করতে পারেন কিন্তু প্রতিবারেই তাঁদের ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়, সেইসব স্বপ্নও তেমন-ই। হাউ আনফরচুনেট! নষ্ট হওয়ার জন্যেই স্বপ্ন। স্বপ্ন-মাত্রই নষ্ট হয়। জহরলাল নেহরুর ভারত-গড়ার স্বপ্নর মতো। হোয়াট আ ট্র্যাজেডি!

বলেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে লাগল অতীশ উদাত্ত সুললিত গলায়, সুন্দর কাটা কাটা ডিকশানে। তার বাংলা আবৃত্তি শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল মনীষার যে, এই যুবক-ই ‘সরকার অ্যামালগ্যামেটস’-এর কর্ণধার।

কালকে রাতে মেঘের গরজনেরিমিঝিমি বাদল-বরিষণেভাবতেছিলেম একা একা—স্বপ্ন যদি যায় রে দেখাআসে যেন তাহার মূর্তি ধ’রেবাদলা রাতে আধেক ঘুমঘোরে।।মাঠে মাঠে বাতাস ফিরে মাতি।বৃথা স্বপ্নে কাটল সারারাতি।হায় রে, সত্য কঠিন ভারী,ইচ্ছামত গড়তে নারি—স্বপ্ন সেও চলে আপন মতে।আমি চলি আমার শূন্যপথে।কালকে ছিল এমন ঘন রাত,আকুল ধারে এমন বারিপাত—মিথ্যা যদি মধুররূপেআসত কাছে চুপে চুপেতাহা হলে কাহার হত ক্ষতি!স্বপ্ন যদি ধরত সে মুরতি!’

—বা:।

মনীষা বলল। চমৎকার। চমৎকার আবৃত্তি করেন তো আপনি!

—হ্যাঁ। যে নিজে লিখতে না পারে, নিজের মনের কথা অন্যকে বোঝাতে না পারে; তার অন্যর কবিতা আবৃত্তি করা ছাড়া উপায়-ই বা কী?

—‘ক্ষণিকা’র? না?

—বা:। ঠিক ধরেছেন তো! অনেকেই বলতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ তো অবসলিট-ই হয়ে গেছেন তরুণদের কাছে। তারজন্যে কিছু মডার্ন কবি-সাহিত্যিকও দায়ী। যাঁরা নিজেরাই ভালো করে না পড়ে রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করে দিয়েছেন।

—বাড়াবাড়ি রকমের অডাসিটি! আপনার কী মত জানি না। তেমন বিকল্প না থাকলে বাতিল করাটা স্পর্ধার ব্যাপার। শূন্য-স্পর্ধা। এবার আমিও তাহলে আপনাকে একটু শোনাই। ‘ক্ষণিকা’ থেকেই।

—বা:। ওয়াণ্ডারফুল। এরা ড্রিঙ্কস দিতে এতদেরি করছে কেন? কী হল কী ‘তাজমহল’ হোটেলের?

বলেই, রুম সার্ভিস; টেলিফোন ডায়ালের ছ-নম্বর ঘোরাল। ওপাশ থেকে উত্তর আসার আগেই বেয়ারা এসে কলিং-বেল বাজাল। ফোন নামিয়ে রেখে, বিল সই করে, টিপস দিয়ে, মনীষার ড্রিঙ্কস নিজে হাতে বানিয়ে দিয়ে মনীষাকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ব্লাডি ম্যারি’টা শেষ করে নতুনটাতে চুমুক দিয়েই শুরু করুন। গায়ে জোর না করলে দুরূহ কর্ম করা যায় নাকি?

—আমি কিন্তু একটুখানি বলব। শুনে, আপনার বলতে হবে কোন কবিতা।

—পরীক্ষা হোক। আমি জানতাম, আপনি ভালো রবীন্দ্রসংগীত আর অতুলপ্রসাদের গান গাইতে পারেন। আবৃত্তিও করতে পারেন জানতাম না। না!

আবারও চমকাল মনীষা।

—আপনি যে তার-ই সঙ্গে ‘জেনেসিস’ গ্রূপের ‘ফিল, কলিনস’-এর নাম করবেন সেটা জানাও অভাবনীয় ছিল।

অতীশের কথা কেটে দিয়ে মনীষা বলল, একে আবৃত্তি বলে না।

পুনরাবৃত্তিই বলা ভালো। বলেই, গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, বেশ ছুটি করিয়ে দিলেন কিন্তু আপনি আজ। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন ক্লাস-কাটে, কলকাতার চাকুরেরা যেমন মিথ্যে কথা বলে অফিস-কাটেন, তেমন-ই আর কী! এমন রোজ রোজ হলে দু-জনের ব্যাবসাই উঠে যাবে। দেখতে হবে না আর।

—যাক। যাক। উঠেই যাক। সঙ্গে যন্ত্রণাটারও শেষ হবে। এই দৌড়ে-বেড়ানোর নাম কি জীবন? যতটুকু হয়েছে তাতেই কেটে যাবে বাকি জীবন। ‘আরও’ ‘‘আরও’ করার তো শেষ নেই!

অতীশ বলল।

—এবার শুনুন। আমি কিন্তু অলরেডি ‘হাই’ হয়ে গেছি। আপনার স্বপ্ন-প্রসঙ্গেই মনে এল কবিতাটি। তাই...

—কিছু হতে হলে ‘হাই’ হওয়াই ভালো। ‘লো’ হতে যাবেন কোন দুঃখে? বলুন এবার।

অতীশ বলল।

কপাল যদি আবার ফিরে যায়প্রভাব কালে হঠাৎ জাগরণে, শূন্য-নদী আবার যদি ভরেশরৎমেঘে ত্বরিত বরিষণে,বন্ধু ফিরে বন্দী করে বুকে,সন্ধি করে অন্ধ অরিদল,অরুণ ঠোঁটে তরুণ ফোটে হাসি,কাজল-চোখে করুণ আঁখিজল,তখন খাতা পোড়াও, খ্যাপা-কবি,দিলের সাথে দিল লাগাও দিল।বাহুর সাথে বাঁধো মৃণাল বাহুচোখের সাথে চোখে মিলাও মিল’।।

—স্পেলনডিড। কবিতার নাম ‘যথাসময়’। পাশ?

মনীষা মুখ না তুলেই বলল, পাশ।

এমন কবিতা ওর মনেই বা পড়ল কেন? আর মনে পড়লে বলতেই বা গেল কেন ছাই!

নিজের অবিমৃষ্যকারিতায় হতভম্ব হয়ে ভাবল মনীষা।

 

দুই

 

মনীষার অফিসে নিজের সাদা-মার্সিডিস চালিয়ে ওকে পৌঁছে যখন দিয়ে গেল অতীশ তখন চারটে বেজে দশ! কী লজ্জা! এমন কখনো হয়নি আগে।

—সি ইউ এগেন। এরপরের মিটিং-এ যদিও শুধুই বিজনেস ডিসকাসড হবে, নেভারদিলেস আই ওয়ান্ট দ্যাট মিটিং টু বি আ ক্লোজ-ডোরড ওয়ান। আমারও কোনো এইডস থাকবে না আপনারও না। অ্যাণ্ড রিমেম্বার। ক্লোজ-সার্কিট টি-ভি ক্যামেরাও যেন না চালানো থাকে আপনার ঘরে। ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ আলোচনা করতে যাব আমি আপনার ‘ক্রেমলিন’-এ। আই নো অল বাউট ইয়োর অর্গানাইজেশন। অ্যাণ্ড বাউট দ্যা চেয়ারপার্সন অ্যাজ ওয়েল।

একটু থেমে, হেসে বলল, দশ-বারো দিন সময় দিয়ে গেলাম। দেশবিদেশের সব ডিটেকটিভ-এজেন্সি লাগিয়ে আপনাকে আমার অর্গানাইজেশান এবং আমার সম্বন্ধে জানবার পূর্ণসুযোগও দিয়ে গেলাম। ন্যাউ, মেক হে! হোয়াইল দ্যা সান শাইনস।

আবার বলল, সি ইউ।

বলেই, মনীষার ডান হাতের পাতাটি নিজের ঠোঁটের কাছে তুলে আলতো চুমু খেল অতীশ। মনীষার শরীরের মধ্যে প্রথম কৈশোর থেকে জমিয়ে রাখা যা-কিছুই সবচেয়ে দামি বলে জানত, যা কিছুকে কাঠিন্যর ফয়েল দিয়ে মুড়ে রেখেছিল, সব-ই যেন হঠাৎ ফ্রিজ থেকে বের-করা আইসক্রিমের মতোই গলে গেল। ওর বাহ্যিক ব্যক্তিত্বর হিমবাহ হঠাৎ-ই যেন কোনো দৈব দুর্বিপাকে কোনো উষ্ণ সাগরে এসে পড়ে অতিদ্রুত জীবনের নোনা জলে মিশে যেতে লাগল! ভীষণ ইনসিকিয়োর ফিল করতে লাগল ও। আবার দারুণ সিকিয়োরড-ও। কী সর্বনাশ যে, ঘটে গেল ওর জীবনে।

সাড়ে-চারটেতে মিটিং ডেকেছিল। মিসেস রতনঝংকার তাঁর কলকাতার ট্রিপ ক্যানসেলও করেছেন। স্যুসি বলল, শি ইজ আ লিটল আপসেট। শি ক্যুড হ্যাভ অ্যাটেনণ্ডেড আ ফ্রেণ্ডস বার্থ-ডে পার্টি। হার পি-এ টোল্ড মি।

—টেল হার টু গেট লস্ট।

মনীষা বলল। পনেরো-শো টাকাও জলে গেল। এই লাস্ট-মিনিট ক্যানসেলেশনে। ওসব কোনো ব্যাপার-ই নয় এতবড়ো কোম্পানিতে। কোনো বড়ো কোম্পানিতেই নয়। প্রাইভেট সেক্টরে এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মিটিং ক্যানসেল করাটাও কোনো ব্যাপার নয়। আফটার অল, সমস্ত বড়ো অর্গানাইজেশানের নাম্বার ওয়ানদের-ই কতগুলো প্রেরোগেটিভস থাকেই। সেইসব প্রেরোগেটিভস সংবিধান মান্য-করা নির্বাক, অভুক্ত জনগণের বাধ্যতামূলকভাবে নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া ‘প্রেরোগেটিভস’ নয়। এই প্রেরোগেটিভস-মনীষা অথবা অতীশ নিজে অর্জন করেছে। নিজে হয়তো পুরো করেনি মনীষা, কিন্তু তার পরিবারের অর্থ, তার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, দিল্লিতে তার ‘পুল’ এইসব-ইতাকে কিছু স্বাধিকার দিয়েছে। মাঝে মাঝে; সবসময় নয়, এই স্বাধিকার প্রয়োগ করে আহ্লাদিত বোধ করে ও। যেমন আজকের মিটিংটা ক্যানসেল করে বোধ করল। সকলের-ই মাঝে মাঝে জানা উচিত নতুন করে যে, মনীষার সুবিধে-অসুবিধে বা ক্বচিৎ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছাতে তার-ই নিয়োজিত এগজিকিউটিভসদের অনেককেই দশ-পনেরো কুড়ি হাজার মাস-মাইনের মানুষদেরও উঠতে-বসতে হয়। প্রাইভেট সেক্টরে বড়োচাকরির যেমন সুখ অনেক, অসুখও কম নয়। পাবলিক সেক্টরের বড়ো চাকরিওয়ালারা তার সব খোঁজ হয়তো রাখেন না। ক্বচিৎ এই ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে, ও নিজের ক্ষমতাকে এবং নিজেকেও পুনরাবিষ্কার করে। ইউনাইটেড নেশানস-এর সিকিয়োরিটি কাউন্সিলের মিটিং-এ রাশিয়া বা ইউনাইটেড স্টেটস যেমন করে। নিজের পুনরধিষ্ঠান এবং স্বাধিকারের সীমা সম্বন্ধে বারংবার সচেতন হওয়ার-ই অন্য নাম তো বেঁচে থাকা।

ইন্টারকম তুলে মনীষা বলল, স্যুসি। আই অ্যাম গোয়িং হোম। শ্যাল বি হিয়ার অ্যাট নাইনও ক্লক শার্প টুমরো। বাই। গো থ্রু দ্যা টেলেক্সস অ্যাণ্ড ড্যু দ্যা নিডফুল। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি অ্যাট দ্যা রেসিডেন্স।

স্যুসি ঘড়ির দিকে চেয়ে অবাক হল। হেডকোয়ার্টাস থেকে কোনোদিনও পাঁচটার এক মিনিটও আগে অফিস ছেড়ে যান না ম্যাডাম। কোনো বিজনেস কম্পিটিটরের সঙ্গে সাড়ে বারোটায় লাঞ্চে বেরিয়ে চারটে বাজিয়েও ফেরেন না। এই প্রথম! কী হল ম্যাডামের কে জানে; অতীশ সরকারের কথা মনে পড়ল স্যুসির। ওর মুখে এক স্মিতহাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বলল, আফটার অল, ম্যাডামও ওর-ই মতো একটি মেয়েই! অতীশ সরকারকে দেখে এবং তার সঙ্গে কথা বলে যেকোনো মেয়ের-ই শরীর-মন রিকি-ঝিকি করে উঠবে। তা ম্যাডামের আর বিশেষ দোষ কী? ওর বয়ফ্রেণ্ড চেরিয়ান জর্জকে একটা ফোন করল। আজ ও-ও একটু তাড়াতাড়ি বেরোবে।

 

তিন

 

মনীষার বিশ্বাস হচ্ছিল না গতকালের কোনো কথাই। ও যে, কী করে এমনভাবে প্রতিপক্ষর কাছের মানুষ হয়ে গেল, তা ভেবে লজ্জা করছিল ওর। ‘ব্লাডি-ম্যারি’র সঙ্গে কিছু মিশিয়ে-টিশিয়ে দিয়ে তাকে দ্রব করে দেয়নি তো অতীশ?

যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। অফিসের প্রত্যেককে মনীষা বলে দিল যে, ও লানডান ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে ফিরলেই ‘সরকার অ্যামালগ্যামেটস’-এর ওপরে পুরো রিপোর্ট চায়। বম্বে, কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর, ম্যাড্রাস এবং দিল্লির আলাদা আলাদা ডিটেকটিভ এজেন্সিকে ভার দেওয়ার কথা বলল। তা ছাড়া কুমুদিনী নিজে যা করার করবে। সিঙ্গাপুরে ওদের কন-ম্যানকে ফোন করে বলে দিতে বলল, সরকারদের সিঙ্গাপুরের কোম্পানি সম্বন্ধেও সব খোঁজ খবর নিতে। এও বলে দিল যে, প্রত্যেক ডিটেকটিভ এজেন্সির কাছ থেকে লিখিত কনফারমেশন নেবে, যাদের এই বিশেষ কাজ দেওয়া হয়েছে এবং হবে যে, সরকার অ্যামালগ্যামেটস তাদের মক্কেল নয়।

‘লুফৎহানসা’র ফ্লাইট। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট-এ নেমে লানডান-এর ফ্লাইট নিল। ‘হিথ্রো’ এয়ারপোর্টে যখন প্লেনটা ল্যাণ্ড করল তার আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সি গাল একটি। টারম্যাকের পাশের ঘাসে। লানডানে এলেই খুব ভালো লাগে ওর। মা-বাবার সঙ্গে প্রথম এসেছিল যখন ওর বারো বছর বয়স। লানডান ইজ লানডান। ওল্ড ইজ গোল্ড। কিলবি, ওর লানডানের ম্যানেজার নিতে এসেছিল। কিলবিকেও বলে দিল ওই ব্যাপারে।

লানডানের কাজ সেরে যেদিন ফ্র্যাঙ্কফুর্ট-এ পৌঁছোল সেদিন শনিবার। ছুটির দিন। ইচ্ছে করেই বেলা এগারোটার ফ্লাইট নিয়েছিল।

ফ্র্যাঙ্কফুর্ট-এ কাজেই আসুক আর বেড়াতেই আসুক দিলীপদার বাড়িতেই ওঠে। দিলীপ রায়চৌধুরী। দিলীপদা আর নীলিমা বউদি অফেনবাখ-এ থাকেন। মার্কেটিং স্ফিয়ারে পশ্চিম জার্মানির একজন কেউকেটা দিলীপদা। বাঙালির গর্ব। ওয়েস্ট জার্মানির ‘হুজ হু’-তে নাম ছাপা হয়। কুইন এলিজাবেথ যে-মডেলের গাড়ি চড়েন ‘মার্সিডিজ’, সেই মডেলের গাড়ি চড়েন দিলীপদাও। ওদের একমাত্র মেয়ে রাজকুমারীও রাজকুমারীর-ই মতো দেখতে। চেহারায় তো অতিসুন্দরীই তার চেয়ে বড়োকথা ওর ‘ডিম্যেনুর’। রাজকুমারীদের-ই মতো। জার্মানটা তো জার্মানদের মতোই বলে, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজিও সেরকম-ই বলে। অথচ বাঙালি সংস্কৃতিও পুরোপুরি বাঁচিয়ে রেখেছে। ওর পড়াশুনা শেষ হলে, দিলীপদার সঙ্গে একটা ভেঞ্চার করে রাজকুমারীকে এখানে তার ‘হেড’ করে দেবে ইচ্ছে আছে মনীষার। তার আগে বোম্বেতে নিয়ে এসে মাস ছয়েক ওর সঙ্গে রাখবে। হাতেকলমে কাজ দেখাবার জন্যে। দিলীপদাও তাঁর অফিসে মাসদুয়েক রেখে শেখাতে পারেন।

রিজার্ভ-ব্যাঙ্ক যদি আর একটু লিবারাল হত তবে ব্যাবসা, বিদেশে কেমন করে করতে হয় দেখিয়ে দিত মনীষা।

অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরও তেমন দোষ নেই। চারধারে চোরেদের এত ভিড় যে, সবাইকেই চোর ভাবেন তারা। অবশ্য মনীষার কোনো প্রবলেম হয় না। হবেও না যতদিন অমিতাভ কাকা ডেপুটি গভর্নর। এই সময়টাতে দিল্লিতে অনেক-ই বড়ো বড়ো পদে দেখা যাচ্ছে বাঙালিদের অনেকদিন পর। বলতে হবে ভেরি প্লেজেন্ট কোইনসিডেণ্ড। বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সেস-এর চেয়ারম্যান এখন জে জে দত্ত সাহেব। রেভিন্যু সেক্রেটারি বন্দ্যোপাধ্যায় সাহেব। বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেসের মেম্বার ইনভেস্টিগেশন এস কে রায় সাহেব। চেয়ারম্যান টিক্কু সাহেবের ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে যাওয়ার একটা গুজব শুনছে। যদি চলে যান, পেলে কী আর অমন লুক্রেটিভ প্রেস্টিজাস পোস্ট ছেড়ে দেবেন? যদি চলেই যান তবে হয়তো রায়সাহেব-ই চেয়ারম্যান হবেন সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সেস-এর। রায়সাহেব নিজে অবশ্য কখনোই এমন সম্ভাবনার কথা স্বীকার করেন না। বলেন কারা যে, গুজব রটাচ্ছে, জানি না। গুজবও হতে পারে। গুজব, এই গুজবের-ই দেশ ভারতবর্ষ!

অবশ্য টিক্কু সাহেবও মানুষ চমৎকার। রায়সাহেবদের-ই ব্যাচ-মেট। নারায়ণ সাহেব যখন চেয়ারম্যান ছিলেন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মনীষাকে ওরা সকলেই চেনেন এবং অতটুকু মেয়ে এতবড়ো ব্যাবসা একা হাতে এফিসিয়েন্টলি চালাচ্ছে দেখে, ওকে সবসময়ই সাহায্য করেন ওঁরা প্রত্যেকেই। যখন যতটুকু দরকার পড়ে। মেয়ের-ই মতো দেখেন সকলে।

ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করার পর মনীষা দেখল, ওকে নিতে এসেছেন দিলীপদাই। কিন্তু রায়চৌধুরী নন, দিলীপ চ্যাটার্জি। খুব-ই মজার মানুষ। দিলটাও অন্য দিলীপদার-ই মতো বড়ো। ওঁর স্ত্রী জয়া। বিজয়ওয়াড়ার মেয়ে। এখানের হাসপাতালে আছেন। খুব-ই ভালোমনের মেয়ে। আর ওঁদের একমাত্র ছেলে, দশ বছরের বাপির মতো হ্যাণ্ডসাম ছেলে মনীষা জীবনেও দেখেনি। মনীষা ঠাট্টা করে বলে যে, বাপি একা হাতেই নাতসি-জার্মানির সর্বনাশ করে দেবে বড়ো হয়ে। জার্মান মেয়েদের এতবড়ো ‘কিলার’ আর হবে না কখনো। বাপি জার্মান ছাড়া অন্য ভাষা তেমন বলতে পারে না। ইংরেজি অবশ্য বলে। সেইটাই বড়ো হলে গুণ হয়ে দাঁড়াবে। ও একাই জার্মানির মহিলাকুলে কৃষ্ণ হয়ে শ্বেতাঙ্গিনিদের নাকানি-চোবানি খাওয়াবে। মনীষার বিশ্বাস। খুব-ই সপ্রতিভ ছেলে।

গাড়িতে উঠেই দিলীপদা বললেন, রায়চৌধুরী একটু বার্লিনে গেছে কাজে। তাই আমরাই নিতে এলাম। রাতে ভূপাল রায় আর মিসেস রায় পীযূষ বিশ্বাসের বাড়ি আসবেন। তোমাকে শুঁটকি মাছ খাবার নেমন্তন্ন করেছেন পীযূষবাবু। মনীষা হাসল, কৃতজ্ঞতায়; ভালোলাগায়। এঁদের কাছে কত কীই যে পায়, পেয়েছে; বদলে কিছুমাত্রই করতে পারে না। বড়োজোর কখনো এয়ারপোর্ট গাড়ি পাঠানো। বা কানেকটিং ফ্লাইটের দেরি থাকলে বাড়িতে বা হোটেলে ডিনার খাওয়ানো। তাও দু-তিনবছরে একবার।

একটি ভারী চিঠি দিলেন দিলীপদা। বললেন, রায়চৌধুরীর বাড়িতে সিঙ্গাপুর থেকে কে পাঠিয়েছে তোমাকে ‘স্কাইপ্যাক’ ক্যুরিয়ার-সার্ভিসে।

মনীষা খামটা নিয়ে দেখল, লেখা আছে : ফ্রম : এস অ্যামালগ্যামেটস।

বুক ঢিপ-ঢিপ করতে লাগল মনীষার।

জয়া বউদি বললেন, কী হল তোমার? শরীর খারাপ?

—না।

একটু পরে বলল, দিলীপদা। এবারে কিন্তু আমি ফ্রাঙ্কফুর্টে হোটেলেই উঠব। বুকিং করা আছে। আমার অনেকগুলো বিজনেস-মিটিং আছে। অফেনবাখ বা তোমাদের ওখান থেকে আসা-যাওয়া করতে অসুবিধে হবে।

—আহা! অফেনবাখ অথবা আমাদের বাড়ি যেন ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে কতই দূর?

হেসে বলল, জয়া।

—না। তা ছাড়া দিলীপদাও তো নেই।

—বা: নীলিমা আর রাজকুমারী তো আছে। ওদের কাছেই তো নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। তা ছাড়া ওরা না থাকলেও আমার বাড়িতে কি থাকতে পারবে না দু-দিন?

—থাকতে পারতাম সকলের কাছেই। কিন্তু মিটিং চলবে দেরি করে। হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলেই ডিনার অ্যারেঞ্জ করেছেন ওঁরা।

দিলীপ বলল, ঠিক আছে। তোমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি। রাতে আমরা সকলে এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

—শুঁটকি মাছটা কাল রাতেই কোরো। পীযূষদা আর ভূপালদাকে বোলো। বউদিদেরও। রেলিশ করে খাব কাজ-টাজ শেষ করে। সকাল দশটাতে ফ্লাইট। পরশু। অসুবিধে হবে না কোনো।

ওক্কে! দিলীপদা বলল। তুমি যেমন বলবে। কাজ করতেই তো আসা। কাজে বাগড়া দেবই বা কেন আমরা! অবুঝ তো নই!

তারপর বলল, আমার আর দিলীপের তো প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল জার্মানিতে! এখানের লোকেদের মুখে শিখেছিলাম: ‘ওয়ার্ক কামস ফাস্ট ইন আ ম্যানস লাইফ।’ এখন দেখছি শুধু ম্যানস নয়, ইন আ উওম্যানস লাইফ অ্যাজ ওয়েল।

জয়া বলল, বলো ইন আ পার্সনস লাইফ।

—দ্যাটস রাইট। গত তিরিশ বছরে শুধু জার্মানিই নয়, আমাদের দেশও অনেক বদলে গেছে। নইলে এতটুকু মেয়ে সারাপৃথিবীময় ঘুরে ব্যাবসা করছে। তাও আবার বাঙালি মেয়ে। আমাদের সময় তো ভাবাই যেত না।

জয়া বউদি দিলীপদার এবং অন্য সকলের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলেন। জার্মান অবশ্য বলেন জার্মানদের মতোই। জার্মান হাসপাতালে কাজ।

মনীষা বলল জয়াকে, রাগ করলে না তো তোমরা বউদি?

—তোমাকে তো আর নতুন দেখছি না আমরা। এত সহজেই রাগ করব?

হোটেলে নেমে আঙুল দিয়ে নামটা দেখিয়ে আগামীকাল সকালে ফোন করতে বলল ওদের।

ফ্র্যাঙ্কফুর্ট-এর সবচেয়ে ভালো হোটেল। নাম্বার বের করে নেওয়া কোনো প্রবলেম নয় কারও পক্ষেই। গাড়ি থেকে ব্যাগটাকে দিলীপদা নামিয়ে দিয়ে যখন চলে গেল তখন ভাবল ও। কিন্তু মুশকিল হল হোটেলে নামবার পর।

কোনো ঘর নেই বলল রিসেপশন থেকে।

—সরি, একটিও নয়।

—ঘর থাকার কথাও নয়।

বম্বের তাজ বা ওবেরয় টাওয়ার্স, দিল্লির হায়াত রিজেন্সি বা মৌরীয়া শেরাটনে বা তাজ-এ গিয়েও উইদাউট রিজার্ভেশনে ঘর পাওয়া মুশকিল। আসলে তো ওর বুকিং ছিলও না। অতীশের চিঠিটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ও ডিসিশান নিয়ে মিথ্যে কথাটা বলেছিল। ওর হাত-পা আবারও ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কারও বাড়িতে থাকলে কিছুটা সামাজিকতা তো করতে হয়-ই! ও এখন একেবারেই একা থাকতে চায়। অতীশ কী লিখেছে তা পড়তে চায়। ধারে-কাছে আর কাউকেই এখন ও চায় না। কাউকেই নয়। কী করে ও দিলীপদার, মানে যেখানে ওঠবার কথা ছিল ওর, তার ঠিকানা জানল? রীতিমতো আন-নার্ভিং ব্যাপার।

হোটেলের লবি থেকে ওর কাস্টমারের বড়োসাহেবকে ফোন করে বলল, অন্য জায়গায় থাকার কথা ছিল কিন্তু ও ডিসিশন চেঞ্জ করছে; ইনি কি একটা ঘর...।

কার্ল রিমেনস্নাইডার বলল, এম এস বাসু। আপনি রিসেপশানে আবার ফিরে যেতে যেতেই আপনার ঘর ওই হোটেলেই আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

এবারে রিসেপশানে ফিরে যেতেই একেবারে ‘ভি আই পি’ ট্রিটমেন্ট।

মনীষা ভাবল, না:। রিমেনস্নাইডারের হোল্ড আছে।

তারপর হেসে রিসেপশানের মেয়েটিকে বলল, তাহলে এই যে, আমাকে বললেন ঘর নেই।

—ঘর সত্যিই নেই। ইটস দ্যা বেস্ট স্যুইট উই হ্যাভ। আই ডিডনট টেল আ লাই!

—স্যুইট?

—ইয়েস ম্যাম। স্যুইট, অ্যাণ্ড দ্যা বেস্ট স্যুইট ইন দ্যা বেস্ট হোটেল ইন ফ্রাঙ্কফুর্ট!

অ্যামেরিকান আর্মির বেস থাকাতে ফ্রাঙ্কফুর্টের অনেকেই ইংরেজি শিখে নিয়েছে। হোটেলে তো ইংরেজি জানেই সকলে। তবে ‘জার্মান’ জাতের রকমটাই একটু আলাদা বলেই যেন কী ইস্ট আর কী ওয়েস্ট জার্মানি সব জায়গাতেই জার্মানরা এক হতে চাইছে! হাবে-ভাবে বোঝা যায়। দুই জার্মানিকে এক হতে দিতে রাশিয়া বা আমেরিকা কেউই চায় না। বিরাট স্যুইট। ভারতীয় টাকা দিয়ে ডয়েশ মার্ককে গুণ করতেই দেখা গেল যে, স্যুইটের ভাড়া দিনে আট হাজার টাকা! মনীষা ভয় পেয়ে বেডরুমে না ঢুকেই সিটিং রুম থেকে রিসেপশানে ফোন করল।

—কোনো গোলমাল হল না তো!

তারা বলল, কোথাওই ভুল হয়নি। ইউ আর মিস্টার রিমেনস্নাইডারস গেস্ট।

মনীষা পড়ল বিপদে। সারাবছরে এই কাস্টমারের সঙ্গে ‘এম বি’ ইন্টারন্যাশনাল এমনকিছু বিরাট ব্যাবসা করে না অথবা করবার আশু সম্ভাবনাও নেই। খাতিরটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের মনে হল। তখনও বেডরুমে না ঢুকেও নি:সন্দেহ হওয়ার জন্যে রিমেনস্নাইডারকে ফোন করল আবার।

কার্ল বলল, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাকে অটো হেফফনার ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন যে, ইউ শুড বি লুকড আফটার লাইক আ প্রিন্সেস। ইটস অ্যান অর্ডার। ইউ নো! হিজ উইশ ইজ আ কম্যাণ্ড টু মি।

কে হেফফনার? আমি তো চিনি না। মনীষা আরও বিপদে পড়ে বলল অসহায়ের মতো।

তারপর বলল, প্লে-বয় ম্যাগাজিনের হিউ হেফফনার না তো?

—তুমি অটোকে না চিনতে পারো। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির সকলেই তাকে চেনে। এত বড়োলোক পশ্চিম-জার্মানিতে কম-ই আছেন।

—কিন্তু আমার তো এই হোটেলে ওঠার-ই কথা ছিল না।

তখনও সন্দিগ্ধ গলায় বলল মনীষা।

—তা আমি জানি। দিলীপ রায়চৌধুরীর অফেনবাখ-এর বাড়িতে তোমার জন্যে হলুদ গোলাপের বোকে এবং ওয়াইন-এর বাস্কেট পৌঁছে গেছে তোমার ফ্লাইট ল্যাণ্ড করার সঙ্গে সঙ্গেই। তুমি আমাকে ফোন করবার পরও আমি যদি তোমার জন্যে এমন ব্যবহার না করি, তাহলে আমার সঙ্গেই ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যাবে। বছরে কত বিলিয়ন মার্ক-এর ব্যাবসা করি, হেফফনারের সঙ্গে তা তুমি জানো না, এম এস বাসু। আমি তোমার ব্যাপারে কোনো ঝুঁকিই নিতে পারি না। আই কানট অ্যাফোর্ড টু। এবারে আমি কিছুই করছি না। হেফফনার-এর অতিথি তুমি। কার ইনস্ট্রাকশানে হেফফনার তোমাকে প্রিন্সেস-এর ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে তা অবশ্য আমি বলতে পারব না।

মহাবিপদেই পড়ল মনীষা। এদিকে স্নান করতে ইচ্ছে করছে খুব। কিছুই করতে পারছে না। অতীশের চিঠিটা পর্যন্ত খুলতে পারছে না।

নীলিমা বউদিকে ফোন করল একটা। বউদি বললেন, আরে। ফুলে-ফলে আমার ফ্ল্যাট ভরে গেল, ওয়াইন এসেছে এক ঝুড়ি। তুই কোন জার্মান বিজনেস ম্যাগনেট-এর সঙ্গে প্রেমে পড়লি রে? ফ্রাঙ্কফুর্টের সবচেয়ে এক্সপেনসিভ ফ্লোরিস্ট-এর দোকান থেকে ফুল এসেছে। রেয়ারেস্ট ওয়াইনস। তোর দাদা থাকলে এখানে সব নিজেই নিয়ে নিত। বলত, ওয়াইনের কদর ইউরোপের লোকেরাই করতে পারে। তোর ওপরে এসব ওয়েস্ট!

—তা সব-ই দাদার জন্যেই রেখে দাও। দুই দিলীপদাকে ভাগ করে দিয়ো।

—তা না হয় হবে।

—কিন্তু পাঠালটা কে?

—সে কী? তুই নিজেই জানিস না?

—না। এ তো রহস্য-কাহিনির মতো শোনাচ্ছে। তুমি কার্ডটা খোলো তো।

—সে কী রে! তোকে কে পাঠিয়েছে ভালোবেসে। আমি খুলে পড়ব? প্রিন্স-ট্রিন্স হলে যদি আমিই এই বয়সে নতুন করে প্রেমে পড়ে যাই? তোর দাদার কী হবে?

—ছাড়ো তো দাদার কথা! প্রেমের আবার কোনো বিশেষ বয়স আছে নাকি? কলার খোসায় পা পড়ার মতো! পড়লে হড়কাতে হবেই।

মনীষা বলল আর উপায় কী বলো বউদি? তোমার এখানে আসতে অথবা আমারও যেতে তো পনেরো-কুড়ি মিনিট লেগে যাবেই এই পিক আওয়ারে! কে পাঠাল তাই যদি না জানা যায়!

—ধর। দেখি, খুলি। আরে! এ কী কান্ডরে! এ কোন প্রিন্স-চার্মিং লেখা আছে উইথ লাভ! অ্যাটিশ?

—কিন্তু সে পাপিষ্ঠের নামটা তো বলবে?

বুকটা ধক করে উঠল মনীষার। মুখে যতই সপ্রতিভতা ঝরাক না কেন!

বউদি বলল, অ্যাটিশ! সে কে রে। জার্মান নাম বলে মনে হচ্ছে। রাশ্যানও হতে পারে। মনীষা বলল, অ্যাটিশ। তাই বলো বউদি। বুঝেছি! সেই বদমাশটা। হতচ্ছাড়া।

—কে? কে রে মনীষা?

—ওই একটা জার্মান প্লে-বয়, না-না জার্মান ঠিক নয়। অস্ট্রিয়ান প্রিন্স টিরল-এ বাড়ি। লানডানে মিট করেছিলাম। বিলিয়নিয়র! অনেক ব্যাবসাও আছে। আমি আজ-ই পালাব এখান থেকে। বলে ফেলেই ভাবল, সর্বনাশ হল। পালিয়ে এসেই আবারও পালানোর কথা?

—সে কী রে? তাহলে এখানে চলে আয়। পুলিশকে ইনফর্ম করব?

—না, না। আর একটু দেখি। তোমাদের জানাব। দরকার হলেই জানাব।

 

টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই রিমেনস্নাইডার আবার ফোন করে বলল, আর ইউ কম্ফর্টেবল? আমাকে হেফফনার এক্ষুনি ফোন করে বলল যে, আমার সঙ্গে তোমার মিটিং-এর দরকার নেই। মানে, তুমি যে-জন্যে এখানে এসেছিলে। তোমরা গত ছ-মাসে যা এক্সপোর্ট করেছিলে তার দশগুণ বেশি মাল আগামী ছ-মাসে কোরো। সেম এফ. ও. বি. প্রাইসে। তোমার সঙ্গে আমার মিটিং শেষ হল। ও আর একটা কথা ইন্সপেকশান কিন্তু জিনিভায় সার্ভেল্যান্সকে দিয়ে করতে হবে। এস. জি. এস. জিনিভা। ওদের সঙ্গে ইণ্ডিয়ার যে-কোম্পানির এগ্রিমেন্ট আছে, সেই কোম্পানি করলেও হবে। রাখলাম। রিল্যাক্স ম্যাম। পরশু সকালে ঠিক সময়ে গাড়ি যাবে তোমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছোতে। টেক ইয়োর ওন টাইম অ্যাণ্ড এনজয়। তোমার গাড়ি হোটেলে পৌঁছেও গেছে। রিসেপশানে বললেই হবে। চব্বিশ ঘণ্টা একটি ‘সোফার ড্রিভন’ মার্সিডিস হোটেলের পার্কিং লনে থাকবে তোমার জন্যে! গুটেন-মর্গেন ম্যাম। তিনজন সোফার শিফট-ডিউটিতে থাকবে।

বলেই, রিমেনস্নাইডার লাইন ছেড়ে দিল।

ও ধপাস করে বসে পড়ল সোফাতে সারাদিন স্কুল করা নীচু ক্লাসের আলুথালু ছাত্রীর মতো। ওর বুদ্ধি যত, সব-ই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। বুদ্ধি ওর কিছু কম নেই বলেই জানত। কিন্তু জড়ো করতে সময় লাগবে!

মনীষা ভাবল, এবার সবচেয়ে আগে যা করা দরকার তা হচ্ছে অতীশের চিঠিটা পড়া। এই চক্রান্তর কারণটা কী —তা জানতে হবে। ভাগ্যিস নীলিমা বউদি ‘অতীশ’ নামটা বুঝতে পারেনি। জার্মানিতে পরিচিত বাঙালিদের একে অন্যে সকলেই চেনে। ওই ফুলের দোকান থেকে ফুল কিনে আর প্রচন্ড এক্সপেনসিভ রেয়ারেস্ট-ওয়াইনস দিয়ে ডালি সাজিয়ে দেওয়ার মতো বাঙালির সংখ্যা ওখানে বেশি নেইও। তাই বেচারি নীলিমা বউদি ভেবেছে মনীষার কোনো জার্মান বিজনেস কানেকশান হবে হয়তো। কিংবা কোনো কোম্পানির নাম!

ভুলে যাওয়ার আগে আর একবার ফোন করার কথা ভাবল, নীলিমা বউদিকে ওগুলো ওকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে। তারপর-ই ভাবল, অতটুকু বুদ্ধি ওঁর আছে। তা ছাড়া ওঁরও সোফার-ড্রিভন গাড়িও যখন আছে।

এবার আর সময় নষ্ট নয়। স্যুটকেসটা খুলে পায়জামা আর টপটা বের করে বেডরুমে ঢুকে সব জামাকাপড় খুলে বাথরুমে গেল মনীষা অতীশের চিঠিটা নিয়ে। যাওয়ার সময় নিজের মুখোশটাকেও খুলে ফেলে একেবারে নিরাবরণ হয়ে গেল। গরম ও ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে ক্রিস্টালের ট্রান্সপারেন্ট বাথটাবের দু-টি কল খুলে পেপার-কাটারের অভাবে হাত দিয়েই চিঠিটা খুলে বাথটাবে শুয়ে পড়ল।

যদিও সিংগাপুরের হোটেল থেকে অনিয়ন-স্কিন পেপারে লিখেছে অতীশ তবুও রীতিমতো ভারী চিঠি।

কী চমৎকার বাংলা হাতের লেখা। ভাবা যায় না! মুগ্ধ হল মনীষা। কয়েক লাইন পড়তেই বুঝল, হাতের লেখা; যাঁরা সাইন বোর্ড লেখেন তাঁদেরও চমৎকার হয়। কিন্তু হাতের লেখা আর লেখার হাতের এমন মণিকাঞ্চন যোগ বড়ো একটা হয় না।

ব্যাংকক

‘‘মনীষা,

ক্যুরিয়ার-সার্ভিসে পাঠানো এই চিঠি, আমার অনুমান, তোমাকে যাঁরা এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসবেন (দিলীপ রায়চৌধুরী অথবা দিলীপ চ্যাটার্জি) নিশ্চয়ই ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টেই তোমার জন্যে নিয়ে আসবেন! এবং তুমি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে আমি ওঁদের ঠিকানা কী করে জানলাম তা ভেবে।

কী করে জানলাম, তা নাই-ই বা জানলে। তবে বুঝতে নিশ্চয়ই পারছ যে, তোমার চেয়ে আমার অর্গানাইজেশান অনেক এফিসিয়েন্ট। লানডান-এ তুমি কোন হোটেলে ছিলে তাও আমি জানতাম। কিন্তু ফোন করিনি ইচ্ছে করেই। ফোন করলে সকালবেলার এই প্রেজেন্ট অথবা আনপ্লেজেন্ট সারপ্রাইজ তোমাকে দিতে পারতাম না।’’

—এই অবধি পড়েই মনীষা ভাবল অতীশ বড়োই ফাস্ট-ওয়ার্কার। আর ‘তুমি’ সম্বোধন করে লেখার অধিকার সে কী করে পেল কে জানে!

‘‘তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, মানুষটার সাহস তো কম নয়! ‘তুমি’ সম্বোধন করেছে!’’

অস্বীকার করব না যে, আমি দুঃসাহসী। আর যাই হোক সাহসের অভাব নিয়ে সারাপৃথিবীতে এতবড়ো ব্যাবসা চালানো যায় না। সাহস তোমারও আছে, স্বীকার করি। নইলে ভারতবর্ষের মতো জায়গাতে একজন মেয়ে হয়ে তুমিও এতবড়ো ব্যাবসায়িক সাম্রাজ্য চালাতে পারতে না। আমাদের দেশে মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়েও বয়সে তিরিশের নীচে থেকেও হাঙর-কুমির অধ্যুষিত পরিবেশে এতবড়ো ব্যাবসা তুমি বাঁচিয়ে রাখতে পারত না। আমিও হাঙর।

আমার এক বন্ধু প্রায়-ই বলে যে, কলকাতার বি. বি. ডি. বাগে যতরকম এবং যতসংখ্যক মাংসাশী হিংস্র শ্বাপদ আছে, তা ভারতবর্ষের কোনো জঙ্গলেও নেই। কথাটা শুধু আমাদের দেশের বড়ো বড়ো শহরের ব্যাবসা-কেন্দ্রগুলি সম্বন্ধে নয়, পৃথিবীর প্রত্যেকটি বড়ো ব্যাবসাকেন্দ্রিক শহরগুলি সম্বন্ধেই প্রযোজ্য।

আমিও অনেক-ই হিংস্র জন্তুর মধ্যে একজন। প্রতিযোগীকে ঘাড় কামড়ে রক্ত চুষে খেয়ে চিরদিন-ই আমি এক গভীর আনন্দ পেয়েছি। প্রতিযোগীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে নভোস্থল থেকে সমুদ্রের গভীরতম প্রদেশে যেতেও আমার কখনো দ্বিধা হয়নি।

কিন্তু আমি একাই নই। তুমিও আমার-ই মতো। আমি বড়ো হাঙর।

তুমি আমার চেয়ে একটু ছোটো। আমার মতো মানসিকতা তোমারও। নইলে বেঁচে থাকতেই পারতে না, এই নির্মম প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে। তুমি যে, বহাল-তবিয়তে বেঁচে আছ এবং তোমার ব্যাবসা ক্রমশ-ই বড়ো করে তুলছ তাতে একথাই প্রমাণ হয় যে, তুমিও ভ্যাম্পায়ারের মতো প্রতিযোগীর রক্ত খেতে ভালোবাসো।

আমরা হয় বাঘ নয় হাঙর। কিন্তু আমি এই ক্রমাগত যুদ্ধের খেলায় মেতে থেকে যুদ্ধের দামামার শব্দে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বোধ হয় ভুলেই যেতে বসেছিলাম যে, হাঙর কিংবা বাঘেরাও তাদের প্রজাতির জন্য কারও সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রাপ্তবয়স্ক হলে মিলিত হয়। হাঙর অথবা বাঘও তার নিজের প্রজাতির অন্য লিঙ্গর কারও সঙ্গে সহবাস করে। সংসার পাতে অল্পদিনের জন্য। ঘাড় কামড়ে ধরে মিলনের সময়। তখন সে-কামড় প্রাণহরণের জন্যে নয় মিলনের আনন্দকে তীব্রতর করার জন্যেই।

মনীষা, অতীশ সরকার এতদিন ভাবত যে, সে তার ব্যাবসাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার জীবনে প্রেম বা বিবাহর মতো মূর্খামি অথবা বিলাসিতার সময় কখনোই হবে না। কিন্তু তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই আমি নিজেকে নিয়ে বড়োই মুশকিলে পড়েছি। ব্যাবসা আমার মাথায় উঠেছে। সমস্তক্ষণ শুধু তোমার কথাই ভাবছি। হঠাৎ-ই যেন বুঝতে পারছি যে, জীবনে ব্যাবসাই সব নয়, টাকা, সম্পত্তি, মান, যশ ক্ষমতাই শেষকথা নয়। প্রত্যেকের-ই ফুরোয় একসময়। এই ফুরিয়ে যাওয়া দুঃখের নয়। নদী যখন সাগরে গিয়ে মেশে তখন-ই তার যাত্রা সার্থক হয়, পরিপূর্ণ; পরিপ্লুত হয় সে। আমার পথ চলা এ জীবনের মতো সাঙ্গ করার সময় এখনও হয়নি। তবে যতিচিহ্নর সময় হয়েছে। তোমার সঙ্গে মিলিত না হতে পারলে, তোমাকে নিয়ে ঘর না বাঁধতে পারলে আমার এই গন্তব্যহীন চলাকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিতে হবে।

মানুষ হিসেবে, আমার কারও কাছে হারবার সময় এসেছে। বুঝতে পারছি যে, জীবনে কোনো কোনো হার অনেক-ই বড়ো বড়ো জিত-এর চেয়েও অনেক-ই বেশি দামি। এবং এই হার স্বীকারের প্রকৃত মূল্য যারা না বোঝে, জীবনের পথে কোনো ছায়াচ্ছন্ন রম্য বাঁকে এসে নিজেকে যে, পথশ্রান্ত পথিক বলে না মনে করে, না বোঝে যে, কারও কোলে মাথা দিয়ে ক্ষণিক বিশ্রামের অবকাশ পেয়েছে, সব ক্লান্তি অপনোদনের, তার যেমন করেই হোক করা উচিত, তবে বলতে হবে যে, সে বড়োই অভাগা।

তেমন কোনো মানুষের খোঁজ সে যখন পায়, যে তার মনের মানুষ। তার মনুষ্যত্ব বোধ হয় তখন-ই সম্পূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়। আমার মনে হচ্ছে, তোমাকে দেখার পর থেকেই আমিও আমার জীবনের পথে তেমন-ই কোনো বাঁকে এসে পৌঁছেছি।

আমার এই পথ অন্ধগলি যাতে না হয়ে ওঠে, অন্য কারও হাতে হাত রেখে এই চলাকে যাতে আরও দুর্বার অর্থময় ও সুস্থির গন্তব্য চলা না-করে তুলতে পারি তাহলে সারাজীবন-ই শুধু পথের ধুলাতেই ধূলিধূসরিত হব। কোনো এক বন্ধনহীন প্রাপ্তিতে যদি পথের সাথিকে বাঁধতেই না পারি তাহলে এই চলা এবং গতি সম্পূর্ণই নিরর্থক হয়ে উঠবে।

আমি জানি, যতটুকু তোমাকে জেনেছি তাতে; যে-তুমি আমার হাতে তোমার হাত যে, রাখবেই তার কোনো স্থিরতা নেই। বেশিরভাগ মেয়েকেই বুঝতে আমার আধঘণ্টাও লাগেনি। মিথ্যে বলব না, দেশে এবং বিদেশে বহুজাতীয় নারীর সঙ্গে আমি সহবাস করেছি। ব্যাবসার কারণে ছাড়া, ব্যক্তিজীবনে আমি কখনো কারও সঙ্গেই মিথ্যাচার করিনি। আমি যা, তা তোমাকে জানাতে চাই কিছুই না-ঢেকে। এই বহু-জাতিক শব্দটিতে ‘জাত’ কেবল চামড়ার রঙেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেক-ই রকম মানসিক স্তরের নারীর কথাও আমি বলছি। কিন্তু কখনো এমন অঘটন ঘটেনি যে, কাউকে প্রথম দর্শনেই জীবন-সঙ্গিনী করতে ইচ্ছে জেগেছে। কারও হাতে ঠোঁট-ছোঁওয়াতেই আমার স্কোয়াশ-খেলা ঋজু পাইনের মতো শরীরকে ‘উইপিং-উইলোর’ মতো নুয়ে পড়া মনে হয়েছে। অথচ নুয়ে-পড়ার মধ্যেও যে, এত গভীর আনন্দ তা সেদিনের আগে কখনো জানিনি।

তুমি হয়তো ভাববে যে, আমি কী লজ্জাহীন, অভিমানহীন অথবা আত্মসম্মানজ্ঞানহীন! তা হয়তো ভাববে। কিন্তু আমার চরিত্রে শিশুকাল থেকে দু-টি দোষ কখনোই ছিল না। এক ‘ভয়’। অন্যটি ‘দ্বিধা’। যখন আমি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, তখন আমার বাবা আমাকে একদিন ওঁর ঘরে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এক জীবনে অগণ্য মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে, পরিচয় হবে; কাছাকাছি আসবি তাদের। কোনো পুরুষের মতো পুরুষের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন মনে হবে যে, ঘর বাঁধার মতো কারও মুখোমুখি এসেছিস তখন তাকে জানাতে দ্বিধা করবি না যে, তুই তাকে চাস। হাঁটু গেড়ে তার পায়ের কাছে বসে বলবি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ কাউকে ভালোবাসার কথা বলার মধ্যে নিজেকে ছোটো করার কোনো ব্যাপার নেই। ঈশ্বর আর প্রেমিকের কাছে নতজানু হলে মানুষের সম্মান-ই বাড়ে। আত্মা শুদ্ধিকর যা, তা করতে কখনো দেরি করিস না। ভয়ও পাস না।

কোনো নারীর কাছে নতজানু হয়ে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলার পর সেই নারী দু-টির মধ্যে একটি জিনিস-ই করতে পারে। তার বেশি ঘটনীয় আর কিছুই নেই। হয় সে তোকে তার মৃণালভুজে টেনে নেবে, নয় সে তোর বুকে পদাঘাত করবে।

বলেছিলেন, ‘জীবনে সততার কোনো বিকল্প নেই। অন্তত কিছু কিছু ব্যাপারে। ব্যাবসা করতে নেমে সবসময় সততা নিয়ে চলে না। প্রতিযোগী শঠ হলে তার সঙ্গে শঠের মতোই ব্যবহার করবি। ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’। তার সঙ্গে ভালোমানুষি করা মানে ‘মৃত্যু’। হেরে-যাওয়া। কিন্তু প্রেমের বেলায় তোর প্রাণের পরমনৈবেদ্য কোনো নারীর কোমল হাতে সততার সঙ্গে তুলে দিবি। গ্রহণ করলে তো তুই ধন্যই হলি। গ্রহণ না করলেও ছোটো হয়ে গেলি এমন ভাবিস না। সৎ-প্রেম নিবেদন করলে আত্মাই উজ্জ্বলতা পায়।’

মনীষা, আমিও বিশ্বাস করি যে, দুঃখ না পেলে মানুষ পূর্ণতা পায় না। দুঃখ পেলে পাব। দুঃখের বা মিথ্যে অহমিকাভরা অভিমানে ঘা লাগবার ভয় যে-করে তার দ্বারা আর যাই-ই হোক শুদ্ধ প্রেম কখনোই হয় না।

‘মনের মানুষ’ কারও জীবনেই বার বার মুখোমুখি আসে না। এলে, তাকে চিনতে ভুল করাটা বোধ হয় পরমমূর্খতা। তার জন্যেই প্রতীক্ষা করেছিলাম।

আমার মনে হয় যে-মানুষ নিজে যে-মানসিক স্তরের তার কখনো অযোগ্য কাউকে বিকল্প করা অনুচিত। এই স্তর বলতে— আমি অর্থনৈতিক, জাতিগত, সামাজিক-পরিচয়গত স্তরের কথা বলছি না। আশাকরি তুমি বুঝবে মানসিক স্তর বলতে আমি কী বোঝাতে চাইছি। ভিন্ন স্তরের মানসিকতার একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে-সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখনো-কখনো; সে-প্রেম, প্রেম নয়। হঠকারিতা, করুণা, দয়া, বা অনুকম্পাই মাত্র। এইসব অনুভূতি নির্ভর প্রেম আসলে ‘মোহ’। মোহর বিভিন্ন স্তর। তার আয়ু অত্যন্ত স্বল্প। স্বল্প বলেই আমাদের দেশে পর্যন্ত ডিভোর্সের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে।

বাবা এও বলেছিলেন যে, ‘‘আমি জাত মানি না, দেশ মানি না, শুধু ‘মানুষ’ মানি। তুই আমার একমাত্র সন্তান। তোর সুখ-ই আমার সুখ। তুই যাকে হাতে ধরে তোর বলে আনবি আমি তাকেই বরণ করে নেব। তার সঙ্গে আমি শোবও না, সংসারও করব না। আমার মতামত এই ব্যাপারে ইমম্যাটেরিয়াল।’‘

জানো মনীষা। বাবা চলে গেছেন আজ দশ বছর হল।

আমারও বয়স পঁয়ত্রিশ হল। দেখায় হয়তো কম।

তোমাকে সেদিন অফিসে নামিয়ে দিয়ে আমি আবার হোটেলেই ফিরে গেছিলাম। অফিসে আর যাওয়া হয়নি সেদিন। ব্রিফ-কেস-এ বাবার একটি ছবি থাকে সবসময়। বাবার ছবিটিকে বের করে মাথায় ঠেকিয়েছিলাম। জানি না তুমি আমার হবে কি না। হলে, আমার বাবার মতো খুশি আর কেউই হতেন না তোমাকে দেখে। তুমি নিজস্ব অধিকারেই রাজকুমারী। কিন্তু তোমায় রাজরানিও হতে হবে।

আমি ঈশ্বর মানি, এই সুপার-কম্পিউটারের যুগে। এবং নিজের কারখানায় কম্পিউটার তৈরি করার পরও। ঈশ্বরের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। বিজ্ঞান-ই ঈশ্বরবোধ আমার মধ্যে গভীর করেছে। এই বোধ সকলের মধ্যে প্রত্যাশার নয়। ‘ভগবান-টগবান মানি না’ বলাটা হয়তো অতি-সপ্রতিভতার লক্ষণ। কিন্তু ঈশ্বর আর চলিতার্থের ভগবান সমার্থক নয়। আশাকরি তুমি বুঝবে-কী আমি বলতে চাইছি। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার মনে হয়েছে ঈশ্বরের এই ইচ্ছে যে, আমি তোমার সঙ্গে মিলিত হই। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে।

ছাত্রাবস্থায় এডগার অ্যালান পো আমার অন্যতম প্রিয় লেখক ছিলেন। ওঁর সম্বন্ধে পরে, একটি লেখা পড়ে অনেককিছু জেনেছিলাম। যা জেনেছিলাম তার সাক্ষ্য দেয় তাঁর লেখা। এডগার অ্যালান পো-র কাছে Art meant only beauty and true beauty always contained an element of strangeness or vagueness। ওঁর সমসাময়িক আমেরিকান লেখকদের থেকে তিনি অনেক-ই অন্যরকম ছিলেন। বোদলেয়রের মতো বড়োকবিও বলেছিলেন, ‘He is a saint’! আজও পোকে ফরাসীয়রাই বেশি সম্মান করেন আমেরিকানদের চেয়ে। তুমি হয়তো জান। হয়তো সাহিত্য ‘কী’ এবং ‘কেন’ তা ফ্রেঞ্চরা অনেকের চেয়েই ভালো বোঝেন বলেই।

তোমাকে প্রথম দিন দেখেই, বাদল দিনের মেঘের মতো তোমার মুখের মধ্যে রোদ আর ছায়া খেলতে দেখেই, তোমার ব্যবহারের ও আমার প্রতি মনোভাবের অতিদ্রুত পরিবর্তন ও পুনঃপরিবর্তন দেখে আমার পো-র লেখার কথা মনে হয়েছিল। তুমিও আমার চোখে ‘Concept of strangeness and vagueness’ এবং সেইজন্যেই সৌন্দর্যর সংজ্ঞা। তুমি আমার ‘কাব্য’।

ইবসেনের পরে নরওয়েজিয়ান লেখকদের মধ্যে ন্যুট হামসুন সবেচেয়ে বেশি বিখ্যাত। তুমি আমার চেয়ে ভালো জানবে। ওঁর সম্বন্ধে যেমন বলা হয়, ‘He had a superb contempt for everything that was not of aesthetic value in his own eyes।’

আমারও দৃষ্টিভঙ্গি হুবহু ন্যুট-হামস্যুনের-ই মতো। তবে তফাত এই যে, আমার আখরগুলি সোনা হয়ে উঠবে না কখনো। ন্যুট হামস্যুন সম্বন্ধে বলা হত ‘Words were gold in his hands’! তবে আখরগুলি নয়, আমি নিজেই হয়তো সোনা হয়ে যেতে পারি যদি তুমি আমাকে একটিবার ভালোবেসে ছুঁয়ে দাও।

—ভালো থেকো

ইতি তোমাকে বউ করতে চাওয়া

অতীশ।’’

 

চার

 

বাথ-টাব-এর জল মনীষার সমস্ত শরীরকে উষ্ণতায় জড়িয়ে নিয়েছিল। মনীষা দু-টি চোখ-ই বুজে ফেলল। তারপর বাথটাবে উঠে বসে চিঠিটা বেসিনের পাশে রাখল। তারপর আবারও জলের গভীরে ডুবিয়ে দিল সমস্ত শরীরকে। শুধু মাথাটি জেগে রইল। শরীরে গভীর ঘুম। স্বপ্নভরা ঘুমের ফেনাতে শরীর পিছল হয়ে গেল। ডুবে গেল সমস্ত শরীর। শুধু মাথাটি জেগে থাকল।

একটি ছোটো হাঙর সাঁতরে আসছে দূরের নীল সাগর থেকে। দূর সমুদ্রর নোনা সন্ধে, সি-গালের বিধুর তীক্ষ্ণ ডাকে ওর নাক ও কান ভরে গেল। দু-টি চোখ ভরে এল জলে।

স্বপ্নর মধ্যেই টয়লেটের টেলিফোনটি বেজে উঠল। ঘণ্টা বাজল। পাগলা-ঘণ্টি বাজল মস্তিষ্কর মধ্যে। জলভেজা, রক্তাভ নগ্ন শরীরের ডান হাতটি বাড়িয়ে ফোন ধরবার জন্যে বাথ-টাব ছেড়ে এক ঝটকায় উঠতে যেতেই জল চলকে পড়ল টয়লেটের মেঝেতে।

—ছি:।

মনীষা বকল নিজেকেই।

এবং হয়তো অতীশকেও।

টেলিফোনটা বেজেই যাচ্ছিল।

মেঘলা দুপুরের কামাতুর কবুতরের মতো।

অধ্যায় ১ / ৫

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন