পরিযায়ী

বুদ্ধদেব গুহ

পরিযায়ী

 

শিকা! ঐশিকা! ঐশিকা!

নামটা নিজের মনেই বার বার উচ্চারণ করেছিল।

ভারি আশ্চর্য নাম যা হোক। তাকে লেখা কাকির চিঠির কথা যেদিন প্রথম জানল কর্বুর, তখন থেকেই একটা চাপা উত্তেজনায় ভুগছে ও। ব্যানার্জিসাহেবরা সকলে থাকবেন যদিও ঠাকুরানি পাহাড়ের ওপরের গেস্টহাউসে, তবু সেদিন থেকেই ‘গৈরিকা’ বা ‘ঐশিকা’ নাম দু-টিকে ব্রাহ্মণ না হয়েও যে, মনে মনে গায়ত্রী অথবা পেতনি তাড়ানো মন্ত্রর মতোই কেন জপছে, তা ঠিক বলতে পারবে না। কিন্তু জপছে। ‘ঐশিকা’! কী আশ্চর্য নাম রে বাবা। কোনোদিনও অমন নাম শোনেনি।

তার নিজের নামটা নিয়েও অবশ্য অনেকেই তাকে ঠাট্টা করে এসেছে সেই স্কুলের দিন থেকেই। বাঙালি সহপাঠীরা কেউ কেউ বলেছে, ‘কর্পূর’। অবাঙালিরা বলেছে ‘গড়বুর’, অর্থাৎ ‘গড়বর-এর ছোটোভাই’ গোছের ব্যাপার আর কী!

আসলে এখানে বাংলা ভাষা ভালো করে জানা মানুষের বড়োই অভাব। তাই ‘কর্বুর’ শব্দটার মানে যে, বহুরঙা একটি ব্যাপার তা জানেই না কেউ। শিশুকাল থেকেই চরিত্রে সে নাকি ‘চিত্রবিচিত্র’ তাই ঠাকুরদার-ই ইচ্ছেতে স্কুলে ভরতি করানোর সময়ে বাবা তার নাম রাখেন ‘কর্বুর’।

ওড়িশা-বিহারের সীমান্তবর্তী এই লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ আকরের নীল-লাল নদী বওয়া এলাকাতে শুদ্ধ বাংলার চর্চা কম মানুষেই করেন। শুদ্ধ বাংলার চর্চা অবশ্য আজকাল কলকাতার সাহেব-হয়ে-যাওয়া ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া-করা বাঙালিরাও করেন না। ‘বাঙালিয়ানা’ বলতে এখানে একমাত্র আনন্দবাজার রাখা। যদিও আনন্দবাজার নিজেই আর এখন তেমন বাঙালি নেই।

তবে ওরা প্রবাসী হলেও সেনদের ‘টাটিঝারিয়া’ বাংলোতে বাংলার চর্চা এখনও আছে খুব-ই। নানা দৈনিকপত্র ছাড়াও নানা লিটল-ম্যাগাজিনও নিয়মিত আসে।

এখন দাদু বা ঠাকুমা কেউই আর জীবিত নেই কিন্তু তাঁদের মতামত সেন-বাড়িতে এখনও সমান মান্য এবং সম্মানের।

ব্যাবসাতে ইতিমধ্যেই খুব-ই সুনাম হয়েছে কর্বুরের। ছেলেমানুষ হওয়া সত্ত্বেও। দাদু গত হয়েছেন ছ-বছর হল। উত্তরাধিকারসূত্রে বাবা দাদুর ইজিচেয়ারটা পেয়েছেন। কর্বুর পেয়েছে দাদুর ‘মঁ ব্লাঁ’ মাস্টারপিস পেনটি। হেড অফ দ্য ফ্যামিলি হিসেবে বাবা ওই ইজিচেয়ারে বসেই সকালে হেঁটে এসে তিন কাপ চা খেয়ে, প্রায় বেলা দশটা অবধি ডাঁই করা খবরের কাগজ ও পত্র-পত্রিকা পড়েন। সকালে চা আর দু-টি ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কিট ছাড়া বাবা আর কিছুই খান না। ব্রেকফাস্টও খান না। কর্বুরের মনে হয় খবর খেয়েই বাবার পেট ভরে যায়।

কাকু, দাদুর জীবদ্দশাতেই দাদুর চোখের মণি জিপগাড়িটাকে চেয়ে নিয়েছিল। গারাজ ভরতি নতুন নতুন গাড়ি থাকা সত্ত্বেও আমেরিকান ডিসপোজাল থেকে কেনা, একেবারেই লজঝড়ে হয়ে যাওয়া জিপটার প্রতি দাদুর যে কী, অসীম মমতা ছিল তা যাঁরা তাঁকে চিনতেন তাঁরাই জানতেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিল দাদুর পার্সোনাল ড্রাইভার। সিরাজুদ্দিন। দাদুর উইলে তিনি লিখে গিয়েছেন যে, সিরাজ যতদিন বাঁচবে ততদিন-ই সে মাইনে পাবে। কাজ করতে ইচ্ছে করলে কাজে আসবে, ইচ্ছে না করলে বা শরীরে না কুলোলে আসবে না। জিপটা নিয়েছিলেন যখন দাদু, তখন-ই প্রথম ম্যাঙ্গানিজ মাইনটা নেন ধুতরাতে। জিপটা আজও যে কী করে চলে, সেটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। স্টিয়ারিংটা পুরো তিন-পাক ফলস।

জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে খুব-ই ভালোবাসতেন দাদু। যতদিন শিকার আইনি ছিল, উনিশশো বাহাত্তর অবধি, ততদিন অবধি পারমিট নিয়ে শিকারও করেছেন। ওদের বড়োবিলের বাড়ির বাইরের বারান্দা আর বিরাট বসবার ঘর দেখলে এখনও বাঘ, ভাল্লুক, বাইসন-এর মাউন্ট-করা মাথা, হাতির পা-এর মোড়া, নানারকম হরিণের চামড়াতে প্রায়-মিউজিয়ম বলেই মনে হয় নবাগন্তুক মানুষের কাছে।

কাকুও বাবার-ই মতো এঞ্জিনিয়ার। তবে মাইনিং এঞ্জিনিয়ার নন। যা কিছুই চলে না, তার সবকিছুকেই চালু রাখাটা প্রফেশনাল চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছে কাকু। এখন কাকু, কাকি আর তাঁদের একমাত্র সন্তান সাত বছরের কিরিকে নিয়ে জামশেদপুরের নীলডিতে থাকেন। ব্যানার্জিসাহেব-ইহচ্ছেন কাকুর বস। যদিও কর্বুরদের পরিবারে তৈলমর্দনটা উচ্চশ্রেণির আর্ট হিসেবে পরিবারের কোনো সদস্যই গ্রহণ করেননি, তবু খাতিরদারি তো একটু করতে হয়-ই, যখন ওঁরা আসছেন-ই।

কাকুর একটা সাদা-রং ফিয়াট সিয়েনা আছে। জিপটা কাকু শুধু এখানে এলেই ব্যবহার করে। নইলে, বিশ্রামেই থাকে অন্যসময়ে। তবে এবারে যেহেতু তাঁর বড়োসাহেব আসছেন, কর্বুরকে চিঠিতে জানিয়েছেন কাকু, জিপটাকে পঞ্চমীর দিনের মধ্যে ‘চলেবল’ কণ্ডিশনে আনতে। যদিও বড়োবিলে ‘বড়োজামদার’ বার্ড কোম্পানি ও মিত্র এস. কে. কোম্পানির নতুন আর্মাডা ও মারুতি জিপসি থাকবে বড়োসাহেবের চড়ার জন্যে, তবুও তাঁর জঙ্গল-পাগল মেয়েরা সারাণ্ডাতে যখন যাবে তখন ওই হুডখোলা, সামনের কাচ বনেটের ওপরে শুইয়ে দেওয়া পুরুষালি জিপ-এ চড়ে ‘রিয়্যাল-রাফিং’ করে তারা আনন্দ পাবে। তারা নাকি ইতিমধ্যেই কাকুর মুখে জিপ-এর গল্প শুনে রীতিমতো উত্তেজিত। কাকুর তাই ইচ্ছে যে, জিপটিতে কর্বুর যেন সন্ধিপুজো করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। এবং তারপর জ্যান্ত দেবীরা এলে, গজ-এ বা নৌকোতে করে তাঁদের না নিয়ে গিয়ে, যেন ওই জিপে করেই নিয়ে যায় অকুস্থলে।

গৈরিকা বড়ো, ঐশিকা ছোটো। তবে পিঠোপিঠি। ব্যানার্জিসাহেবের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, যখন মেয়েদের বয়েস ছিল খুব-ই কম। বহুদিন বিদেশে থাকা ক্ষৌণিশ ব্যানার্জি নিজে নাকি যেমন সুদর্শন তাঁর স্ত্রীও নাকি তেমন-ই সুন্দরী ছিলেন। মেয়েদুটিও তাই ডানাকাটা পরি হয়েছে। উনি দুই মেয়েকে, বলতে গেলে ‘সিংগল প্যারেন্ট’-এর মতো মানুষ করে তুলেছেন। মেয়েদের জন্যে জীবনের অনেক সহজ সুখ, অনেক সস্তা আনন্দ বর্জন করেছেন। নিজেকে অনেকভাবে বঞ্চিত করেছেন। তবে উনি নাকি বলেন, মেয়েদের কাছাকাছি থাকতে পেরে তিনি যে, আনন্দ পেয়েছেন সেই আনন্দ তাঁকে অন্য কোনো কিছুই দিতে পারত না। এতদিন বাবা হয়েও উনি এতবছর মেয়েদের মা হওয়ার আনন্দকে জেনেছিলেন, এখন মেয়েরা দূরে চলে যাবে বলে মেয়েদের ‘বিদাইয়ার’ কষ্টটাও যেন মায়ের-ই মতো বুঝতে আরম্ভ করেছেন।

‘কিরি’ নামটি কাকুই দিয়েছে। দাদু দেননি। ‘হো’ ভাষাতে ‘কিরি’ মানে পোকা। ‘কিরিবুরু’ মানে পোকাদের জঙ্গল। যেমন ‘মেঘাতিবুরু’ মানে জমাট বাঁধা মেঘেদের মতো জঙ্গল। তা যাই হোক, কাকু, বুরু থেকে কিরি কেটে নিয়ে ছেলের নাম দিয়েছে কিরি।

ভদ্রলোকের মতো একটা নাম তো দিতে পারত ছোটকা। কোথায় কিশা আর কর্বুর আর কোথায় কিরি। ‘ওর চেয়ে হারাকিরি দিলেই তো হত।’

দাদু বলেছিলেন।

দাদু তখন প্রচন্ডরকম বেঁচে। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধিও দাদু প্রচন্ডরকম জীবিত ছিলেন।

কাকু দুঃখ পেয়েছিল ছেলের নাম সম্বন্ধে দাদুর প্রতিক্রিয়ার কথা শুনে। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি।

কর্বুরদের পরিবার দৃঢ়বদ্ধ, ঘন-সন্নিবিষ্ট, মেঘাতিবুরুর-ই মতো। তথাকথিত আধুনিকতার কোনোরকম বারফাট্টাই তাদের নিরন্ধ্র পারিবারিক বেষ্টনীকে টলাতে পারবে না মনে হয় আরও অনেকদিন। এখন পরের প্রজন্মের বউ-জামাইরা এসে যদি এতদিনের ঐতিহ্যকে নষ্ট করে দেয় তো, সে অন্য কথা। সেইজন্যেই জামাই ও বউ নির্বাচনে এই পরিবার অত্যন্ত সাবধানি।

দিদি কিশার বিয়েতে সকলেই খুব খুশি। অত্যন্ত শিক্ষিত, উদার, বনেদি অথচ সর্বার্থে আধুনিক পরিবারেই বিয়ে হয়েছে কিশার। জামাই বিলাবল এবং তাদের পরিবারের প্রত্যেককেই এ-পরিবারের সকলের-ই খুব পছন্দ।

 

দুই

 

প্রতিবছর-ই পুজোর পরে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন বড়োবিল-বড়োজামদার বাঙালিরা মিলে। এবারে কথা ছিল ‘মহড়া’ নাটকটি মঞ্চস্থ করবেন। নাটক হিসেবে যদিও সেটি লেখা নয়। ওই নামের একটি উপন্যাসের-ই নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করছেন ওঁরা। তবে মূলউপন্যাসের মধ্যেই নাটকটি প্রায় নাটকের ফর্মেই আছে। উপন্যাসে এমন আছে যে, ‘মান্ডুর রূপমতী’ নাটকটি মঞ্চস্থ করা গেল না, কারণ, যে-ছেলেটির নায়কের ভূমিকাতে অভিনয় করার কথা, তার মা নাটক শুরু হওয়ার আধঘণ্টা আগে হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলেন।

ঔপন্যাসিক আসলে ওই নাটকের মাধ্যমে বলতে চেয়েছিলেন যে, আমাদের প্রত্যেকের জীবন-ই অনেকগুলি মহড়ার-ই সমষ্টিমাত্র। আসলে আমাদের জীবনে খুব কম মহড়াই অবশেষে সফল হয়, নাটকরূপে মঞ্চস্থ হতে পারে। এই আমাদের জীবনের ট্র্যাজেডি। ‘মহড়া’ উপন্যাসটি কলকাতা থেকে কিনে এনেছিল নাট্যামোদী একজন। দে’জ পাবলিশিং বা সাহিত্যম-এর বই। সঠিক মনে নেই। ওদের প্রত্যেককেই জটাদা একটি করে জেরক্স-করা স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়েছেন।

সকলের পীড়াপীড়িতে এবারে কর্বুর রাজিও হয়ে গিয়েছিল নায়কের ভূমিকাতে অভিনয় করতে। কারণ, উপন্যাসটির বক্তব্য ও উপস্থাপনা তার মনে খুব-ই ধরেছিল। তক্ষ রায়ের ভূমিকাতে স্থানীয়দের মধ্যে বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং অভিনেতা জটা রায় অভিনয় করবেন ঠিক হয়েছে। উনি নাটকটি পরিচালনাও করবেন এবারে। অন্যান্যবারের সামাজিক সব নাটক পচাদা পরিচালনা করেন।

যেদিন মহড়া প্রথম শুরু হল ঠিক সেদিন-ই কাকির চিঠি এসেছিল ঐশিকা অ্যাণ্ড কোম্পানির আগমন-বার্তা জানিয়ে। কর্বুর বলেছিল জটা রায়কে, ‘জটাদা, আমাকে বাদ দিতে হবে’। তাতে পুজো কমিটির প্রত্যেকেই বেঁকে বসেছিল। আলাদা আলাদা ডেপুটেশন গিয়েছিল বাবার এবং মায়ের কাছে পুরুষ এবং মহিলাদের। তারপর তাঁদের-ই সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে বাবার ব্যক্তিগত চিঠি নিয়ে ফটকা গেল বড়োবিল থেকে ভোরের বাসে টাটাতে। কাকুর উত্তরও নিয়ে এল সন্ধের বাসে। দাবি মঞ্জুর হয়েছে। কাকু নাকি বলেছে যে, ব্যানার্জিসাহেব ও তার মেয়েরা নাকি খুব খুশিই হয়েছেন। সারাণ্ডার পাঁচদিন থেকে একটি দিন কমিয়ে সন্ধেবেলা পুজোমন্ডপে ‘মহড়া’ নাটকটি দেখে পরদিন ভোরেই জঙ্গলে যাবেন ওঁরা কর্বুরের সঙ্গে। এইরকম-ই ঠিক আছে।

অভিনয় কখনো করেনি কর্বুর। কী জীবনে, কী মঞ্চে। অভিনয় করা যে, এত কঠিন সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাও ছিল না। নবাব বাজবাহাদুরের চরিত্রে অভিনয় করছে সে। আর রূপমতীর ভূমিকাতে অভিনয় করছে বড়োজামদার একজন এঞ্জিনিয়ারের রূপবতী গুণবতী কন্যা শিখী।

মহড়া আরম্ভ হয়ে গেছে গতকাল থেকেই। এই মহড়ার-ই জন্যে বড়োবিলেই রাতে থাকতে হচ্ছে কর্বুরের। ভোর পাঁচটাতে উঠে ভোগতা মুণ্ডার বানিয়ে দেওয়া এককাপ চা খেয়ে ষাট কিমি জঙ্গলে এবড়ো-খেবড়ো পথে গাড়ি চালিয়ে খাদানে যায়। বিকেলে পৌনে চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ে খাদান থেকে। বাড়ি ফিরে চানটান করে সাতটাতে যায় মহড়াতে। ফিরতে ফিরতে এগারোটা সাড়ে এগারোটা। মা, না খেয়ে বসে থাকেন। ও মহড়া থেকে ফিরলে, মা-ছেলেতে গল্প করতে করতে বসে একসঙ্গে খান।

মাঝে মাঝে ব্যানার্জিসাহেবের মেয়ে গৈরিকা-ঐশিকার কথা ওঠান মা। মাঝে মাঝেই বড়োজামদার শিখীর কথাও ওঠে। শিখীর বাবা নিজে গাড়ি করে শিখীকে নিয়ে যেতে আসেন। আসবার সময়ে বড়োজামদার গোয়েলসাহেবের ছেলের গাড়ি করেই আসে শিখী। রাজ গোয়েলও অভিনয় করছে সেনাপতি একরাম খাঁ-এর ভূমিকাতে। গোয়েলসাহেব সেইল-এর বড়ো ঠিকাদার। চারপুরুষ বিহারে থেকে থেকে এবং বাঙালি অফিসারদের খিদমদগারি করে করে ওরা ‘ব্যাংলো বিহারি’ হয়ে গেছে। হিন্দি বলে বিহারিদের মতন। বাংলাও বলে বাঙালিদের-ই মতন।

কর্বুর ঠিক বুঝতে পারে না যে, ওর মা, ইদানীং অদেখা ঐশিকা আর শিখীর কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনেন কেন। বুঝতে যে, একেবারেই পারে না তা নয়। একটু একটু পারে। কিন্তু ভাব দেখায় যে, পারে না। আজকাল সে তো অভিনয় করতে একটু একটু শিখছেই। তবে ওর মা একটা কথা ছেলেবেলাতে প্রায়-ই বলতেন ওকে, উলটোপালটা কথা বললে, ‘কবু, তুই আমাকে পেটে ধরেছিস না, আমি তোকে পেটে ধরেছি? আমি তোকে যতখানি বুঝি, তুই কি আমাকে তার ছিটেফোঁটাও বুঝতে পারবি কোনোদিনও?’

কেন জানে না, আজকাল আর বলেন না, মা ওই বাক্যটি। ছেলে-মায়ের মধ্যেও ধীরে ধীরে ছেলের বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ব্যবধান গড়ে ওঠেই। ছেলের বিয়ে হলে হয়তো সেই ব্যবধান আরও বাড়ে। অনেক কিছু কর্বুর যেমন জানে, আবার অনেক কিছু জানেও না।

আজ রাতে ফিরে স্ক্রিপটা নিয়ে বসল আবার ও। নাটক করতে গিয়ে, নতুন করে বুঝতে পারছে যে, এই কম্পিউটার-এর যুগেও স্মৃতিশক্তিকে একেবারে নস্যাৎ করাটা ঠিক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তির খুব প্রয়োজন আছে।

নাটকটার মধ্যে বেশ গভীরতা আছে। ডায়ালগ-এর মধ্যে দিয়ে নায়ক-নায়িকা যা বলছেন একে অন্যকে, সেই কথোপকথন একটা অন্য মাত্রা পাচ্ছে। তাদের যা বক্তব্য, তা যেন শুধুমাত্র নাটকের অন্য এক চরিত্রর জন্যই নয়, যেসব দর্শকের গভীরতা আছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সেইসব চরিত্রের মধ্যে নিজেদের-ই দেখতে পাবেন হয়তো। আইডেন্টিফায়েড হবেন।

আজ বার বার-ই ভুল করছিল কর্বুর তার পাঠ বলতে গিয়ে। শিখী মুখ টিপে হেসেছিল একবার।

জটাদা বলেছিলেন, কর্বুর, ভুলে যেয়ো না, তুমিই আমার নায়ক। তুমি ঝোলালে পুরো নাটকটাই ঝুলে যাবে।

শিখী বলেছিল, কর্বুরদা, কো-অ্যাক্টরের ওপরে অন্যের অভিনয়ের মান নির্ভর করে। তোমার অভিনয়টা যদি ভালো হয় তবে আমার অভিনয় আপসেই ভালো হবে। এবং vice versa.

জটাদা বলেছিলেন, পার্ট মুখস্থ করাটা প্রাইমারি ব্যাপার, তারপরে অভিনয়ের অন্য সবদিক। পার্ট-ই যদি মুখস্থ না করো কর্বুরসাহেব, তবে আমরা যে, ডুবে যাব।

লজ্জা পেয়েছিল খুব-ই কর্বুর। সেই কারণেই স্ক্রিপটা নিয়ে বসা। ও ঠিক করেছে, কাল রিহার্সালের সময়ে টেপ করে নেবে পুরোটা, তারপর খাদান-এ যেতে আসতে গাড়িতে ক্যাসেটটা বার বার বাজিয়ে ভুল-ত্রুটি শুধরে নেবে। মুখস্থও করে নেবে নিজের পার্ট। ধরা-ছাড়াও ভালো করে লক্ষ্য করবে।

আজ-ই কিছুটা অংশ অন্তত নিজেই পড়ে, অন্যদের পার্টসুদ্ধু টেপ করে নেবে ঠিক করল। যেখানে যেখানে ভুল হচ্ছে বারে বার। কাজটা এগিয়ে থাকবে অন্তত কিছুটা।

শ্যামলের বেগুন-ভাতে ভাই আর মানিকের চিচিঙ্গার মতো দেখতে মেয়েলি গলার দাদা প্রম্পটার। দু-দিকের উইংস-এর আড়াল থেকে দু-জনে প্রম্পট করছে। একজনের গলা ফেন-ভাতের মতো ভ্যাতভ্যাতে, কিন্তু ভারী। অন্যজনের গলা আবার এমন-ই চিঁচি করে যে, রিহার্সাল যেখানে হয়, সেই প্রাচীন দুর্গাবাড়ির কার্নিশে-বসা পায়রাগুলো পর্যন্ত ভয় পেয়ে ডানা ধড়ফড়িয়ে উড়ে যায়।

জটাদা সিগারেটটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বি রেডি’! অল ক্যারেকটারস। প্রথম দৃশ্য। তৃতীয় অঙ্ক। স্টেজ-এ নবাব বাজবাহাদুর এবং রূপমতী। লোকেশান: মান্ডুর দুর্গর পশ্চিমপ্রান্তের ‘রূপমতী মেহাল’। রেডি? নাউ স্টার্ট।

হাতঘড়িটা, পাঞ্জাবির আস্তিনটা একবার তুলে একঝলক দেখে নিয়েই বলেছিলেন জটাদা।

কল্পনাতে দেখা মান্ডুর দুর্গের পশ্চিমপ্রান্তর রূপমতী মেহাল-এর এক সকালবেলা। যেন চোখে দেখতে পাচ্ছিল কর্বুর। নর্মদার দিকে চেয়ে-থাকা, স্নান-করে ওঠা সুকেশা, সুগন্ধি গায়িকা, ‘রূপমতী মেহাল’-এর চাঁদোয়ার নীচে বসে আছেন।

রূপমতী বললেন—সুলতান। কিছুদিন থেকেই আপনাকে বড়ো ছটফট করতে দেখছি। আমার গান কি আর ভালো লাগে না আপনার?

বাজবাহাদুর—সে জন্যে নয়, সে জন্যে নয়। গানও যেদিন ভালো লাগবে না রূপমতী, বিশেষ করে তোমার গান, সেদিন বাঁচা আর মরাতে তফাত থাকবে কি কোনো?

রূপমতী—তবে? সুলতান সবসময়ে কোন চিন্তা আপনাকে এমন অন্যমনস্ক করে রাখে আজকাল?

এমন সময়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা যাবে। অশ্বারোহীদের আসবার আওয়াজ। দূর থেকে। রূপমতী-মেহালের দিকে।

বাজবাহাদুর ওইদিকে চেয়ে হঠাৎ-ই কথা থামিয়ে দেবেন। রূপমতী ওই দূরাগত অশ্বারোহীদের দিকে যেন, চেয়ে থাকবেন কিছুক্ষণ। এখনও দূরে আছে অনেক-ই। সুলতানের ডাকহরকরা, ভালো করে লক্ষ্য করে, যেন তাদের ধ্বজা দেখেই বুঝলেন। বুঝেই, অন্যমনস্ক হয়ে যাবেন রূপমতী।

রূপমতী-মেহালের নীচে অমলতাস গাছেরা ফুলের স্তবকে স্তবকে ভরে গেছে। সামান্য প্রভাতি হাওয়ায় একটু একটু দুলছে সেই স্তবকগুলি।

রূপমতী—কী সুন্দর। না? জাঁহাপনা?

বাজবাহাদুর—কী?

রূপমতী—এই ফুলগুলি। এই সকাল, নিমারের আদিগন্ত এই উপত্যকা, দূরের নর্মদাদেবী, পুণ্যতোয়া, উত্তরবাহিনী। অথচ আপনার সময়ই নেই এসব দেখবার। এমনকী গানও শোনবার।

একজন অশ্বারোহী দুড়দাড় করে সরু সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এল। অন্যরা দাঁড়িয়ে রইল। কুর্নিশ করল সবাই বাজবাহাদুরকে। হ্রেষারব এবং অস্থির ঘোড়াদের পা ঠোকার আওয়াজে মন্থর প্রভাতি হাওয়া অবিন্যস্ত হয়ে উঠল। অশ্বারোহী এসে পাকানো এবং হলুদ রেশমি সুতোয় বাঁধা বার্তা তুলে দিল সুলতানের হাতে, মাথা ঝুঁকিয়ে। বলল—

হোশাঙ্গাবাদ থেকে সেনাপতি লড্ডন খাঁ পাঠিয়েছেন।

বাজবাহাদুর বার্তাটি খুলে পড়লেন। ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হল তাঁর। বললেন, সেনাপতি একরাম খাঁকে দেখা করতে বলো আমার সঙ্গে বড়া মসজিদে। এক্ষুনি। আমি যাচ্ছি।

(অশ্বারোহী চলে গেল আবারও দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে।)

রূপমতী—কী খবর সুলতান? খারাপ কিছু?

বাজবাহাদুর—খবর খুব-ই খারাপ। দিল্লি থেকে মোগল সম্রাট আকবর, সেনাপতি আধম খাঁকে পাঠিয়েছে মাঁলোয়া দখল করার জন্যে। তাঁর বিরাট বাহিনী এগিয়ে আসছে ক্রমশই। লড্ডন খাঁ খবর পাঠিয়েছেন হোশাঙ্গাবাদ থেকে যে, সারাংগপুরে আধম খাঁকে রুখতে না পারলে মান্ডু বাঁচানো যাবে না কোনোক্রমেই। তাকে তো ‘ধার’ পেরিয়ে মান্ডুতে উঠে আসতে দেওয়া যায় না।

একটু চুপ করে থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, হেস্তনেস্ত যা হবার তা ধার-এর সমতলেই হোক। আমার মান্ডু আর আমার রূপমতীর গায়ে যেন আঁচড়টিও না লাগে।

রূপমতী—সর্বনাশ! বড়োই খারাপ খবর এ সুলতান। আধম খাঁর বাহিনী যে বিরাট। সম্রাট আকবর তো ছেলেখেলা করার জন্যে সেনাবাহিনী পাঠান না। আপনি যদি হেরে যান তাহলে কী হবে আমার?

বাজবাহাদুর—হারার কথা বোলো না আমাকে রূপমতী। বোলো না, হারার কথা। বোলো না।

যা বলতে চাইছিলাম তা থেকে অনেক-ই সরে এলাম আমি রূপমতী। যেমন, জীবনে যা করতে চেয়েছিলাম, তা থেকেও। সময় হাতে বেশি নেই। আমাকে বলতে দাও। আমি চেয়েছিলাম এমন-ই এক সুলতান হতে, এই সুন্দর মান্ডুর ব্যতিক্রমী সুলতান, যিনি কোনো রাজ্য জয় করবেন না কোনো অন্য রাজার। জয় করবেন সংগীত-জগতের সমস্ত রাজ্য, জাগির জানবেন সেই আশ্চর্য জগতের ঝংকৃত অলিগলিকে, আবিষ্কার করবেন নারী ও পুরুষের প্রেমকে নতুনতর, শান্ত স্নিগ্ধ আলোয়। কী বলো তুমি? এও কি এক ধরনের রাজত্ব নয়? সাম্রাজ্য নয়? এই সাম্রাজ্যের গভীরে যাওয়ার চেষ্টাও কি রাজকার্য নয়? ‘রাজকার্য’ মানে কি শুধুই মৃত্যুদন্ড? কারাগার? যুদ্ধ? রক্তপাত? নারী ও শিশুর ক্রন্দন?

রূপমতী—আপনি কি যুদ্ধে আপনার নিজের সহোদরকে হত্যা করেননি নবাব?

বাজবাহাদুর—আঃ। যুদ্ধ আমি করেছিলাম, সে তো প্রাথমিক যুদ্ধই, ক্ষমতাতে আসীন হওয়ার-ইযুদ্ধ সে। যা নইলে, আমি সুলতান হতাম না মাঁলোয়ার, মান্ডুর।

রূপমতী—(হেসে) সুলতানদের জীবনে ‘প্রাথমিক’ যুদ্ধ বলে কোনো কথা নেই। যুদ্ধই তাঁদের জীবনের বড়োসঙ্গী।

আজ কী সুন্দর দেখাচ্ছে সবকিছু। না, জাঁহাপনা? আপনাকেও। চারদিকের এই প্রভাতি প্রকৃতিকে। আঃ। কত ফুল। কত পাখি চারদিকে? জৌনপুরিতে গান ধরব একটা? এই গম্ভীর রাগ এইমুহূর্তে আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ধরি? সুলতান?

বাজবাহাদুর—না। আমি মসজিদে যাব। সেনাপতি একরাম খাঁ অপেক্ষা করছেন সেখানে আমার জন্যে। চলি আমি, রূপমতী। সন্ধেবেলায় জেহাজ-মেহালে বরং দেখা হবে। আজ গভীর রাতে মালকোষ শুনব তোমার গলায়। জানি না, আর কতদিন শুনতে পাব তোমার গান! এ পৃথিবীতে গান, প্রেম সব-ই সুকৃতির জিনিস, উপচে-পড়া ধন এসব। ক-জনে এর কদর জানে বলো?

 

রিহার্সাল দিয়ে বাড়ি ফিরতেই মা বললেন, নে ধর, তোর কাকির চিঠিটা পড়। আজ-ই এল। পড়ে আমাকে ফেরত দিস।

কর্বুর একটু অবাক হল। ওঁরা যে, আসবেন তা তো কাকি অনেক আগেই জানিয়েছে মাকে। আবার এ চিঠি পড়ার কী দরকার।

নীলডি

জামশেদপুর

১০।৯।১০

শ্রদ্ধাভাজনীয়াসু দিদি,

অনেকদিন আপনার চিঠি পাই না। বড়োবিল-এর বাড়ির ফোন কি ঠিক হবে না? যে-পরিমাণ খোঁড়াখুঁড়ি টেলিফোন ডিপার্টমেন্ট করে চলেছে গত দু-মাস হল তাতে জায়গামতো খুঁড়লে, যেমন সুবর্ণরেখায় বা স্যেশেলস আইল্যাণ্ডস-এ, সাত রাজার বা সাত জলদস্যুর গুপ্তধনের সন্ধানও তারা পেতে পারত। কবুকে বলুন যে, ওদের ধমক-ধামক দিক। নইলে অন্তত বক্তৃতাই দিক। আমাদের দেশে তো এখন বক্তৃতা দিয়েই জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা পর্যন্ত হচ্ছে। আর কবুর বক্তৃতাতেও যদি তাড়াতাড়ি গর্তগুলো না বোজায়, তবে কবুকে বলুন আজকের দিনের সব যুক্তির বড়োযুক্তি, সব বাগ্মিতার, ‘নোটের বাণ্ডিল’ ছুড়ে মারতে।

কুরুবকের বড়োসাহেব তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে যে-যাবেন শুধু সে কথাই আগে জানিয়েছি আপনাকে। এবারে একটু বিস্তার করে বলি। এতদিন কিরির পরীক্ষা নিয়ে খুব-ই ব্যস্ত ছিলাম। বড়ো করে লেখার অবকাশ ছিল না। কুরুবকের বস ব্যানার্জিসাহেবের সঙ্গে আপনি ও দাদা যখন এখানে এসেছিলেন তখন আলাপিতও হয়েছেন। তিনি তাঁর দুই কন্যা গৈরিকা ও ঐশিকাকে নিয়ে পুজোর সময়ে সারাণ্ডার জঙ্গল দেখতে যাবেন। আমাদের কর্বুরবাবু তো সারাণ্ডার পোকা। বড়োবিল-এ ওঁরা ঠাকুরানি পাহাড়ের ওপরে ‘বার্ড’ কোম্পানির অতিথিশালাতেই থাকবেন। আমি আর আপনার দেওর কর্বুর কথা ওঁদের এতই বলছি ও বলেছি যে, বলতে গেলে ওঁরা মিস্টার কর্বুর সেন-এর ভরসাতেই আহ্লাদ করে সারাণ্ডা দেখতে যাচ্ছেন। আপনারা তো ব্যানার্জিসাহেবকেই দেখেছেন শুধু, মেয়েদের দেখেননি। তাই এই বিস্তার।

সেনসাহেবের মেয়েরা কেউই টাটানগরে থাকে না। গৈরিকা আহমেদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইনস থেকে পাশ করেছে সবে। তার বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের পর দু-জনে মিলে মাস দুই পরে স্টেটস-এ চলে যাবে। ঐশিকা দিল্লির ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’ ইউনিভার্সিটি থেকে ‘মাসকম’ করে এসেছে। একটি বিদেশি টিভি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছে। শুনতে পাচ্ছি যে, চাকরিটি হয়ে যাবে। হয়ে গেলে, হয়তো দিল্লি অথবা মুম্বাইতে পোস্টিং হবে। তাই ব্যানার্জিসাহেব মেয়েরা চলে যাওয়ার আগে ক-টা দিন সব কাজকর্ম ছেড়ে তাদের সঙ্গে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে চান।

আর কী লিখব। আশাকরি দাদার ব্লাডসুগার আর বাড়েনি। আপনার হাঁটুর ব্যথা কি কমল?

কিরি ভালো আছে। পড়াশুনোতে একেবারেই মন নেই। কবু পড়াশোনাতে এত ভালো হওয়া সত্ত্বেও ওকে পারিবারিক স্বার্থে ব্যাবসাতে ঢুকতে হল। এখন মনে হয়, ওকে, ও যা পড়তে চায়, তাই পড়তে দিয়ে কিরিকেই সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া ভালো ছিল। এই ব্যাবসা এমনকিছু কঠিন নয় যে, কবুর মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলে এতে আনন্দ পাবে। তবে কিরির বড়ো হতে যে, অনেক-ই দেরি।

দিদি! আপনাকে এইবারে চুপি চুপি আসল কথাটা বলি। গৈরিকার বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে। আমার ও আপনার দেওরের খুব-ই ইচ্ছে যে, ঐশিকার মতো একটি সর্বগুণসম্পন্না মিষ্টি মেয়ে আমাদের পরিবারের বউ হয়ে আসুক। ওরা সকলে মিলে যে, বড়োবিল-এ যাচ্ছে তাতে আমরা খুব-ই উত্তেজিত। আপনি ও দাদা ওদের সকলের সঙ্গে ভালো করে মিশতে পারবেন। কবুও বেশ ক-দিন কাছ থেকে ঐশিকাকে দেখতে পারবে। ঐশিকা এবং তার পরিবারও আপনাদের সকলকে কাছ থেকে দেখার প্রচুর সুযোগ পাবে। কুরুবককে, উনি তো বটেই, মেয়েরাও খুব-ই পছন্দ করে।

আপনাকে কী বলব দিদি। পুজোর এখনও দেড়-দুমাস দেরি আছে কিন্তু এখন থেকেই আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে রয়েছি। যদি আমার এই আশা পূর্ণ হয় তাহলে আনন্দ রাখার আর জায়গা থাকবে না। আমার একটুও সন্দেহ নেই যে, আপনার ও দাদার ঐশিকাকে ভীষণ-ই ভালো লাগবে। অমন বউ এলে আমাদের পরিবারের মুখোজ্জ্বল হবে। কবুও খুব সুখী হবে। সম্ভবত।

ভালো থাকবেন। ফোনটা ঠিক হলেই আমাকে একটা ফোন করবেন। তারপর যেমন আগে করতাম, একরাতে আমি, আর একরাতে আপনি অবশ্যই কথা বলব। কিরিরও তার জ্যাঠা-জেঠিমার আর কবুদাদার গলা দিনান্তে একবার শুনতে না পেলে ঘুম আসে না।

একটা কথা বলে এই চিঠি শেষ করছি। চুপি চুপি বলি যে, ঐশিকাকে আপনাদের কিরিবাবুর খুব-ই পছন্দ। ও-ই প্রথম আমার মাথাতে কথাটা ঢোকায়। গতশনিবার গৈরিকার জন্মদিনে ও-ও গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে ব্যানার্জিসাহেবের বাংলোতে। খাওয়া-দাওয়া, গানবাজনার পর অনেক রাতে ফিরে শুতে যাওয়ার আগে আমরা বসার ঘরে বসে যখন টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল দেখছিলাম তখন, হঠাৎ ও এসে বলে গেল, ‘মা! কবুদাদার সঙ্গে ঐশিকা দিদির বিয়ে দিয়ে দাও না। দারুণ হবে। ভাবি হো তো এইসি।’

সেই রাত থেকে আমরা কিরির কথাটিই ভাবছি। বার বার।

আহা! সত্যিই যদি কিরির মুখের কথাটা ফলে তবে আর আমার আনন্দ রাখার জায়গা থাকবে না।

আমরা গাড়িতে মহাষষ্ঠীর দিন গিয়ে পৌঁছোব।

ইতি

স্নেহধন্যা পদ্মা

রুক্মিণী সেন

টাটিঝারিয়া, চড়ুই চড়াই

বড়োবিল, ওড়িশা

 

চিঠিটা বার দু-তিন পড়ল কর্বুর। ওর মনের মধ্যে কিছু উত্তেজনা, কিছু ভয়, কিছু আশা, ভালোলাগা ঝিলিক মেরে গেল। কর্বুর ভাবছিল, একা এলেই তো পারতেন। মা বা কাকি বা দিদি হলে অন্য কথা ছিল। একে অনাত্মীয়া, তার ওপরে তরুণীদের ঠিক ‘হ্যাণ্ডল’ করতে জানে না কর্বুর। এয়ারপোর্টের কনভেয়ার বেল্ট-এ কার্ডবোর্ডের বাক্স আসে না? লেখা থাকে, ‘Fragile! Handle with care’. মেয়েদের তেমন-ই কাচের বাসন বলেই মনে হয় কর্বুরের। ভেঙে গেলেই, হাতে-পায়ে কাচ ফুটে গিয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটতে পারে।

চিঠি প্রসঙ্গে কর্বুর ভাবছিল, আজকাল ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল-এর দৌলতে পৃথিবী এখন রীতিমতো দৌলতাবাদ হয়ে গেছে। চিঠি লেখে খুব কম মানুষ-ই। অথচ চিঠির কোনো বিকল্প সতিই কি কিছু আছে? বড়ো বড়ো মনীষীরা তাঁদের মন-খোলা চিঠির মধ্যে দিয়ে, তাঁদের দীর্ঘ এবং ব্যতিক্রমী ইচ্ছাপত্রর মধ্যে দিয়ে পরবর্তী সময়ের মানুষদের যতখানি দীক্ষিত ও শিক্ষিত করে গেছেন তা কি ফোন ফ্যাক্স বা ই-মেইল কোনোদিন করতে পারবে?

ইনফরমেশন-ই সব নয়। স্মৃতিই মানুষের একমাত্র গুণ নয়। গুণ তো নয়ই বরং কর্বুরের মনে হয়, স্মৃতি এক ধরনের দোষ-ই। স্মৃতি যার অত্যন্তই প্রখর তার কল্পনাশক্তিই নষ্ট হয়ে যায়, তার বিচার-বুদ্ধি-শ্রুতি নষ্ট হয়ে যায়, তার মনুষ্যত্বও অবশেষে বিঘ্নিত হয়। Robot মানুষের বিকল্প হতে পারে অনেক ব্যাপারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে-মানুষকে ‘পূর্ণ-মানুষ’ আখ্যা দিয়েছিলেন, সে-মানুষ-ই সব মানুষের আদর্শ বলে গণ্য হওয়া উচিত। সেই ‘পূর্ণ-মানুষ’ কোনোদিনও Robot হয়ে উঠতে পারে না। পারবে না। কর্বুরের মনে হয়, মানুষ নিজের মধ্যে অহমিকা এবং অন্ধত্বর কারণে বিজ্ঞানের দাস হয়ে ওঠাতে মনুষ্যত্বের যে-ক্ষতি হচ্ছে, তা পরে তারা বুঝতে পারবে। কিন্তু যখন পারবে, তখন খুব-ই দেরি হয়ে যাবে। মানুষ পরম মূর্খ বলেই নিজের সঙ্গেই প্রতিযোগিতাতে নেমেছে আজ। কিন্তু এসব কথা বললে অন্যে কর্বুরকে পাগল ভাববে, পাগল বলবে।

ফ্যাক্স বা ই-মেইল এবং ইন্টারনেট থাকুক, শুধুমাত্র বাণিজ্যের জন্যে, শিল্পের জন্যে, আধুনিক ‘সফল’ মানুষের টাকা, আরও টাকা আয়ের জন্যে, তার ব্যাবসার, পেশার, শিল্পের সাম্রাজ্যর সীমা আরও বিস্তৃত করার জন্যে। কিন্তু ব্যক্তি-মানুষের সম্পর্কে চিঠি যদি আর না থাকে, আধুনিক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের সম্পর্ক অচিরেই ব্যাবসার ও শিল্পের অংশীদার, খরিদ্দার অথবা প্রতিযোগীর-ই হয়ে উঠবে। স্বার্থহীন কোনো সম্পর্ক, প্রেম বা সহমর্মিতার, সমবেদনার কোনো সম্পর্ক আর বোধ হয় থাকবে না, এই কেজো-পৃথিবীতে। সে বড়ো দুর্দৈব হবে।

ঐশিকাদের ট্যুরের একটি ‘আইটিনিরারি’ দিয়ে মা বলেছিলেন কর্বুরকে, সারাণ্ডার প্ল্যানিং ওঁরা তোর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

—সারাণ্ডাতে ক-দিন?

—তিনরাত চারদিন।

—একগাদা মেয়ে-ফেয়ে নিয়ে কেউ জঙ্গলে যায়?

—কেন? মেয়েরা কি মানুষ নয়? তুই এত নারীবিদ্বেষী কবে থেকে হলি?

—হলাম আবার কী? ছিলাম-ই তো চিরদিন।

—তাই? বোঝা তো যায়নি।

কাকির চিঠিটা মা বার বার-ই পড়ছিলেন আর বলছিলেন, সত্যি! খুব ভালো চিঠি লেখে রে পদ্মা। মনে হয়, যেন সামনে বসে কথা বলছে।

কর্বুর খাবার টেবিলে মাকে ফেরত দিল চিঠিটা।

—পড়লি ভালো করে?

—হুঁ।

—কী বলিস?

—আশ্চর্য তো তুমি। চিনি না জানি না, কে বা কারা আসছেন। তা আসছেন আসুন না। এতে বলাবলির কী আছে? সত্যি। তোমরা এমন করো না!

রুক্মিণী একটু নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন।

 

তিন

 

কর্বুর ওর নতুন সাদা ইণ্ডিকাটা নিয়ে ঠাকুরানি পাহাড়ে গিয়েছিল। গেস্ট হাউসটা পাহাড়ের ওপরে। সবচেয়ে ভালো ঘর দুটোই বুক করে রেখেছিল ও আগে থেকেই। গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকারের সঙ্গেও কথাবার্তা বলে এল। তিনি বললেন, কোম্পানির হেড অফিস থেকেও ফোন এসেছিল। ব্যানার্জিসাহেবের দেখভাল ভালো না হলে আমার চাকরিই চলে যাবে।

আজ মহালয়া। পুজো তো এসেই গেল। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ লেগেছে। শিউলি গাছের নীচে কমলা-বোঁটা সাদা-ফুলের অবিন্যস্ত আলপনা পড়েছে। বড়োজামদা আর বড়োবিলের মাঝামাঝি অনেকখানি জায়গা নিয়ে গর্জন সেন-এর অর্থাৎ কর্বুরের দাদুর বানানো একতলা বিরাট বাংলোটির মধ্যে গাছগাছালি, জগিং অথবা হাঁটার পথ, লিলিপুল, তাতে জাপানিজ গার্ডেন—শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণের ‘লিলিপুল’-এর মতো, সব-ই আছে। বাংলোর ভেতরে, কিন্তু অন্যপ্রান্তে একটি বড়ো গেস্ট-কটেজ আছে তাতে দু-টি শোয়ার ঘর এবং মাঝে ডাইনিং-কাম-লিভিং রুম, সামনে পুবমুখী চওড়া বারান্দা। অ্যাটাচড বাথ। তাতে গিজার, কমোড তো আছেই এবং বিদেও আছে, মেয়েদের সুবিধের জন্যে।

কর্বুর ভাবছিল, ওঁরা এসে এইখানে থাকলে দেখাশোনা করার সুবিধে হত। কাকু নাকি বলেওছিলেন ব্যানার্জিসাহেবকে কিন্তু উনি নাকি ‘গা’ করেননি। কেন করেননি, কে জানে। হয়তো ভেবেছিলেন, অধঃস্তন অফিসারদের কাছে ব্যক্তিগত ঋণ হয়ে যাবে, নয়তো ভেবেছিলেন, সেখানে থাকাটা তাঁর নিজের এবং তাঁর নানা আরামে অভ্যস্ত মেয়েদের পক্ষে যথেষ্ট আরামদায়ক হবে না হয়তো।

যাই হোক, ওঁদের যা খুশি তাই করুন। কর্বুরের কিছু করার নেই এ ব্যাপারে।

বাংলো থেকে বেরিয়ে, যে-পথটি অনেক দূরের প্রধান সড়কে পড়েছে সেই লাল মাটির ঢেউ-খেলানো পথটাকে, বর্ষার জল পেয়ে চড়চড় করে বেড়ে-ওঠা কচিকলাপাতা-রঙা শালের চারাগাছ, সবুজ-রঙা ঝাঁটিজঙ্গল এসে যেন, দু-পাশ থেকে গলা টিপে ধরেছে। দু-পাশের বড়োগাছের ডালপালা আর ফুলপাতা মাথার ওপরে সবুজ-রঙা চাঁদোয়ার সৃষ্টি করেছে। তাতে দিনের বেলাতে সোনা-রঙা রোদের ঝালর ঝোলে। এবং হাওয়ায় দোলে। শরতের রোদ তখন বুটি-কাটা গালচে পাতে, সোনা-সবুজ রঙা, সেই পথে। আর চাঁদনি রাতে সেই চাঁদোয়ার-ই হাজারও ঝরোকা খুলে যায়। সেই চাঁদোয়ার রং তখন হয়ে যায় রুপোলি। আর তা দিয়ে রূপসি রুপোচুর আলো চুঁইয়ে পড়ে বরখার মতো।

ওদের বাংলোর বাগানের মধ্যে শারদীয়া গাছগাছালির মিশ্রগন্ধের মধ্যে বারোমাস্যা চাঁপা আর ম্যাগনোলিয়া গ্রাণ্ডিফ্লোরার গন্ধ থম মেরে থাকে। আমলকীর ডালেদের থেকে পাতা ঝরতে থাকে। জলপাই গাছের গাঢ় সবুজ পাতাগুলোতে তখন জেল্লা লাগে। দাদুর শখ করে লাগানো রাবার গাছগুলোর পাতাগুলো কালচে-সবুজ দেখায়। রাবার গাছে অনেক জল লাগে। তাদের জন্যই আজ থেকে ষাট বছর আগে দাদু ইংল্যাণ্ড থেকে Sprinkler আমদানি করেছিলেন। তবে গ্রীষ্মকালে বাগানের অনেক জায়গাতেই Sprinkler ব্যবহার করা হয়। এই শরতে প্রত্যেকটি গাছ এক বিশেষ সুগন্ধে সুগন্ধি হয়। বর্ষণক্ষান্ত প্রকৃতি পাখিদের গলার জুয়ারি খুলে দিয়ে ঠোঁটে মধু ঢেলে দেয়।

দাদুর খুব-ই গোলাপের শখ ছিল। বাবা আর কাকুর সিজন-ফ্লাওয়ার আর গোলাপের চেয়ে পছন্দ বেশি স্বয়ম্ভর নানা দিশি-বিদেশি গাছের। ওদের বাগানে কদম থেকে রাধাচূড়া, আতা থেকে চালতা কোনো গাছের-ই অভাব নেই। মস্তবড়ো বটল-ব্রাশ থেকে আফ্রিকান টিউলিপ, আকাশমণি থেকে অগ্নিশিখা, অমলতাস থেকে বাসন্তী সব গাছ-ই আছে। প্রায় দশ বিঘা জায়গা নিয়ে বাংলোটা। দাদু গর্জন সেন বাংলোর নাম রেখেছিলেন ‘টাটিঝারিয়া’।

গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের বগোদর থেকে হাজারিবাগ শহরে যেতে পথে পড়ে ‘টাটিঝারিয়া’। দাদুর খুব প্রিয় জায়গা ছিল ওই টাটিঝারিয়া। মস্তবড়ো একটা রয়্যাল টাইগারও মারেন দাদু সেখানে এক শীতের সকালে। টাটিঝারিয়ার বাংলোতেই দশদিন। সেই জায়গার নামেই বাংলোর নাম দেন। নামটি বড়োই কাব্যিক।

কর্বুর, বলতে গেলে এই বাংলোর হাতার মধ্যেই বড়ো হয়েছে। এখনও যখন খাদানে না থাকে, তখন এই বাড়ির মধ্যেই সময় কাটে কর্বুরের। বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা যাকে বলে, তা কখনোই ছিল না। নিজের চেয়ে উৎকৃষ্ট মানুষের সংস্পর্শ ওর ভালো লাগে। নইলে উৎকৃষ্ট মানুষদের সঙ্গে সময় কাটায় লাইব্রেরিতে, গান শুনে। অবসর সময়ে বাগানের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। এই বাগান-ই শিশুকাল থেকে ওর মধ্যে প্রকৃতির প্রতি এক গভীর ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছে। ছুটি-ছাটা পেলেই ও সারাণ্ডার বনে বনেও ঘুরে বেড়ায়। বলতে গেলে, এই-ই প্রধান শখ ওর। শখ বলা ঠিক হবে না। বলতে হয় নেশা।

টালির ছাদ-দেওয়া চারদিক খোলা একটি তিনকোনা ঘর বানিয়েছে বাগানের এক নিরিবিলি কোণে। সিমেন্টের গোল টেবিল ও বেঞ্চ আছে তার নীচে। সেখানে বসেই গান শোনে কর্বুর। কখনো ছবি আঁকে। ডায়েরি লেখে। কখনো কিছু লেখালেখিও করে। তবে নিজেই লেখে, নিজেই পড়ে। ও একা থেকেই আনন্দ পায় খুব। তার লেখা কবিতা বা গদ্য বা তার গাওয়া গান গাছেরা শোনে, ফুলেরা শোনে আর শোনে পাখিরা।

এতেই খুশি কর্বুর। খাদানে ওকে যেমন সব জাগতিক কাজ করতে হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীত জগতে বাস করে, ও যখন খাদানে থাকে না। ওর কোনোরকম সুখের জন্যে অন্য কারওকেই প্রয়োজন যে, পড়ে না একথাটা জেনে ও এক ধরনের শ্লাঘা বোধ করে। সেই শ্লাঘাকে ও ন্যায্য বলেই মনে করে। অন্তর্মুখী বলে ও নিজেকে নিয়ে গর্বিত এই সহজ বর্হিমুখিতার দিনে। তবে সেই গর্ব প্রচ্ছন্ন থাকে ওর নিজের-ই মধ্যে। বাইরে তার কোনোই প্রকাশ নেই। কেজোজগতে ওর যে, ব্যক্তিত্ব সেই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ওর অবসরের জগতের ব্যক্তিত্বের কোনোই মিল নেই। ঈশ্বরের কাছে তাই ও প্রার্থনা করে, সুখের-ই মতো, ওর দুখের দিনেও যেন ওর অন্য কারওকেই প্রয়োজন না হয়। ঈশ্বরের দেওয়া হাজারও সুখের ভার যদি সে বইতে পেরে থাকে এতগুলো বছর অনায়াসে কোনো জ্যোতিষীনির্দেশিত কোনো মাদুলি বা আংটি না পরেই, তাহলে সে তাঁর দেওয়া দুখের ভারও সইতে পারবে।

তার কাকি পদ্মা তার-ই সমবয়েসি। কাকু চাকুরিতে জয়েন করে টাটাতে থাকলেও কাকি এখানেই থাকতেন। উইক এণ্ডে কাকু আসতেন গাড়ি চালিয়ে। ‘সুন্দরী’ বলতে যা বোঝায় চলিতার্থে, কাকি তা ঠিক নয়। কিন্তু তার মনটি ভারি সুন্দর। তার শরীরের বাঁধুনিটিও। চোখ চিবুকও কাটা কাটা। কিন্তু নাকটি একটু চাপা। সেই খুঁতের ক্ষতিপূরণ করে দিয়েছেন ঈশ্বর তার চোখ দু-টিতে। কাকির চোখের দিকে চাইলে চোখ ফেরানো যায় না। যেদিন কাকি চোখে কাজল দিত সেদিন আড়কাঠি হয়ে যেত চোখ দু-টি। কর্বুরের দু-টি চোখকে সেই চোখ-জোড়া কোনো অদৃশ্য আঠাতে জুড়ে দিত। খড়কে-ডুরে তাঁতের শাড়িতে অথবা কটকি শাড়িতে অথবা কখনো-কখনো প্যাস্টেল শেড-এর বেগমবাহারে বা মধ্যপ্রদেশের হোসসা সিল্কে এই বাগানে প্রজাপতির মতো মনে হত কাকিকে।

পদ্মা যখন এই বাড়িতে প্রথম আসে তখন কর্বুরের বয়স বাইশ আর পদ্মার বয়স পঁচিশ। পঁচিশ বছরের বিবাহিত নারী অভিজ্ঞতাতে বাইশ বছরের কলেজ-ছাত্র কর্বুরের চেয়ে অনেক-ই এগিয়ে ছিল। ‘পদ্মা কাকিমা’ না বলে কর্বুর তাকে কিছুদিন পর থেকেই ডাকত শুধুই কাকি বলে। তাতে কারর-ই আপত্তি ছিল না। একমাত্র পদ্মার ছাড়া। পদ্মা বলত, ‘কাকি’ মানে তো মেয়ে কাক। আমি কি এতই কুৎসিত?

বলতে গেলে, প্রোষিতভর্তিকা, নি:সন্তান অল্পবয়েসি পদ্মার একমাত্র সঙ্গী ছিল কর্বুর। ও বড়ো হয়ে ওঠার পরে কাকির সান্নিধ্য ওর শরীরের মধ্যে নানারকম উদবেগ জাগাত। এক অস্বস্তিকর ভালো লাগাতে বিবশ হয়ে পড়ত কর্বুর। তাই, ওর মতো করে ভালো যেমন বাসত কাকিকে, তেমন এক ধরনের ভয়ও জাগত বুকের মধ্যে। কাকির মধ্যে এমন কিছু ছিল যে, অঙ্গুলিলেহনে সে প্রায় সমবয়েসি কর্বুরকে তার দাস করে তুলতে পারত। কাকির কোনো অনুরোধ, কোনোরকম আজ্ঞাই তাকে মুখে বলতে হত না। তার চোখের ভাষাই যথেষ্ট ছিল, সেইসব ভয়ংকর অথচ শালীন খেলার দিনে। কাকি তখন ভীষণ-ই একা। কিরি তখনও আসেনি। একটা সময়ে কাকি, কাকুর ওপরে সব ভরসা ত্যাগ করেছিল। অথচ দোষটা পরোক্ষে দেওয়া হত কাকিকেই সেকথা বুঝতে পারত কর্বুর। কাকি ছিল তার একমাত্র খেলার সাথি, তার কবিতা ও গানের একমাত্র শ্রোতা। তার নির্জনতার একমাত্র সাথি। কাকি জামশেদপুরে চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে মন বসে না কর্বুরের। খাদানেই থাকে অধিকাংশ সময়ে। যখন পারে তখন সারাণ্ডার কোনো বাংলোতে চলে যায়।

মা-বাবা অখুশি হন কিন্তু তাঁদের ‘মুডি’ ছেলেকে কিছু বলেন না মুখে।

বিয়ের পাঁচ বছর পরে কলকাতার ডাক্তার ঘনশ্যাম কুন্ডুর হাতযশে পদ্মা কনসিভ করে। ছ-বছরের মাথাতে কিরি জন্মায়। এই ছ-বছরে পদ্মা ও কর্বুর দু-জনেই অনেক বড়োও বুঝি হয়েছে নিজেদের যার যার মতো করে। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বুঝির মধ্যেও কিছু অবুঝপনা তো থাকেই। সেই অবুঝপনাকে গলা টিপে যারাই মারতে জানে, মারতে পারে, তারাই শুধু জানে তাদের কষ্টের কথা। কর্বুর ও পদ্মা জেনেছিল, তাদের নিজের নিজের মতো করে সেই কষ্টকে। ঘি আর আগুন কাছাকাছি থাকলে এবং বিশেষ করে প্রকৃতির মধ্যে থাকলে, যেকোনো মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে যেতেই পারে। বাইরের নয়, ভেতরের সেই আগুনকে নিবোনোর জন্য কষ্ট যেমন আছে, এক গভীর ব্যথাজাত আনন্দও আছে। সেই কষ্ট ও আনন্দের কথা, সেই কষ্ট ও আনন্দ, যারা জীবনে কখনো পেয়েছে, শুধু তারাই জানে।

 

চার

 

গতকাল দশেরা গেছে। আজ ‘মান্ডুর রূপমতী’ মঞ্চস্থ হবে। ব্যানার্জিসাহেবেরা সকলে এসে গেছেন দুপুরে। রাতে সকলেই নাটক দেখতেও আসবেন। কাকিও রয়ে গেছে নাটক দেখার জন্য।

কর্বুরের বাবা বলেছিলেন, ব্যানার্জিসাহেবরা যখন আসবেন আমি আর তোর মা-ই যাব ওঁদের রিসিভ করতে। আর পদ্মা তো যাবেই বলেছে। তুই যা করছিস তাই ভালো করে কর। জীবনে এই প্রথম নাটক করছিস, সকলে যেন দেখে ধন্য ধন্য করে। জীবনে যা-কিছুই করবি, কোনো কিছুই খারাপ করে করিস না। এমন জেদে করবি যে, জীবনের কোনোক্ষেত্রেই যেন, তোকে কেউ হারাতে না পারে। ‘এক নম্বর’ হওয়ার সাধনাই পৌরুষের সাধনা।

মা বলেছিলেন, কেন? সাধনা কি শুধু পুরুষদের-ই একচেটে নাকি? ‘পুরুষ-এর’ নয়, ‘মানুষ-এর’ বলো।

ঠিক-ই বলেছ তুমি। দিনকাল পালটে গেছে। আমরা এখনও এই পৃথিবীকে পুরুষ-প্রধান পুরুষশাসিত বলেই মনে করি। সেটা ভুল।

কর্বুর আর পদ্মা টাটিঝারিয়ার বাইরের গেট-এ দাঁড়িয়ে কাকুকে ‘টা-টা’ করে দিয়ে ফিরে আসছিল। কাকি আর কিরি নাটক দেখে তারপর-ই যাবে। সিরাজ চাচা পৌঁছে দিয়ে আসবে।

কাকি বলল, তোমাকে কিন্তু সত্যিই নবাবের মতোই দেখাবে। স্টেজ রিহার্সালেই যা দেখাচ্ছিল।

নবাবের পোশাক পরলেই তো নবাব হওয়া যায়। বাহাদুরির কী?

কর্বুর বলল।

—ঠিক তা নয়। পোশাক, কারওকে নবাবের ভড়ংটুকুই দিতে পারে মাত্র, ‘নবাবি’ আছে তোমার চেহারায়, চলাফেরায়, গলার স্বরে, চোখের দৃষ্টিতে।

—আমাকে ফিউড্যাল বলছ?

তারপর-ই বলল, বড়োজামদার শিখীকে কীরকম দেখাবে?

—ওর মধ্যে ‘আভিজাত্য’ বলে কোনো ব্যাপার-ই নেই। তোমার পাশে ওকে বাঁদির মতো দেখাবে। ঝুটো হিরে-মুক্তো পরলেই কি আর বাঁদি রানি হয়ে যায়?

—আমার তো বেশ লাগে শিখীকে। স্মার্ট, বুদ্ধিমতী, ব্যক্তিত্বময়ী, হাসিখুশি।

—হুঁ। ঐশিকাকে তো দ্যাখোনি। তাই শিখীর প্রশংসা করছ। তুমি একটি ভ্যাবাগঙ্গারাম। ক-জন মেয়ে তুমি দেখেছ জীবনে?

—তা সত্যি। সেই শরীর-মন জাগার পর থেকে প্রথম যৌবনে মা ছাড়া, ‘মেয়ে’ বলতে তো, শুধু তোমাকেই দেখেছি। তুমি আসার আগেই তো দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তুমি এমন করেই আমার সমস্তখানি মন জুড়ে ছিলে যে, অন্য কারওকে দেখবার বা জানবার সুযোগ যে, পাইনি তাই শুধু নয়, দেখবার বা জানবার কোনো তাগিদও হয়তো বোধ করিনি।

—দোষটা তাহলে আমার-ই বলছ?

—দোষের কথা তো বলিনি কাকি। এ তো তোমার গুণ-ই। ‘চারুলতার’ মতো তুমিও যে, আমার সখী ছিলে। জীবনের যা-কিছু সুন্দর দিক, সব তো আমি তোমার মধ্যেই দেখেছি। তোমার কাছ থেকেই শিখেছি, মানে তোমার-ই সান্নিধ্যে। আমার কিন্তু মনে হয় যে, তোমাকে কাছে পেয়েছিলাম দীর্ঘ ছ-বছর, কিরি আসার আগে পর্যন্ত, তাই অন্য কোনো মেয়েকেই আমার এ-জীবনে আর ভালো লাগবে না। মেয়েদের কেমন যে, হওয়া উচিত তার-ই ‘রোল-মডেল’ হয়ে উঠেছ তুমি আমার কাছে।

—লাগবে, লাগবে। ঐশিকাকে ভালো লাগবেই। কতকিছু স্বপ্ন দেখেছি আমি। হয়তো দাদা আর দিদিও দেখছেন। তোমার কাকু তো তার নিজের বয়েসটা একটু কম হলে ঐশিকাকে নিজেই বিয়ে করে ফেলতেন, ভাব দেখলে এমন-ই মনে হয়।

—ভালোই বলেছ। আগেকার দিনে স্ত্রী গত হওয়া অনেক বাবা ছেলেদের জন্যে পাত্রী দেখতে গিয়ে মেয়ে তেমন পছন্দ হলে যেমন নিজেরাই বিয়ে করে ফেলতেন তেমন-ই আর কী!

ওরা লতাপাতা ডালপালার চাঁদোয়ার নীচে নীচে পাখির ডাক, ফুলের গন্ধ, শরতের রোদের গন্ধের মধ্যে বুঁদ হয়ে সবুজাভ-সোনালি পথ বেয়ে বাংলোর দিকে ফিরে আসছিল গেট থেকে। ‘টাটিঝারিয়ার’ গেট থেকে বাংলোটি প্রায় আড়াইশো মিটার মতো।

কর্বুর বলল, আচ্ছা কাকি, আমার সুখ নিয়ে তুমি এত ভাবো কেন বলো তো?

কর্বুরের মুখের দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে রক্তিম মুখে পদ্মা বলল, ভাবব না? আমি যে, তোমার মায়ের-ই মতন কবু, আমি যে, তোমার কাকিমা।

—তা তো বটেই। সম্পর্কেই ওই কাকিমা। আমার চেয়ে কী এমন বড়ো। তোমার সঙ্গে তো আমার বিয়েও হতে পারত তুমি আমার কাকিমা না হলে।

আরও অনেক কথাই মনে এসেছিল কর্বুরের, সেসব বলল না। গান, সাহিত্য এইসবের সাঁকো পেরিয়ে নারীর মধ্যে যে, চিরকালীন রহস্য জমা রয়েছে অনন্তকাল ধরে তার-ই হদিশ পেয়েছিল কর্বুর পদ্মার মাধ্যমে।

—সেকথা অবান্তর। ঘটনা হচ্ছে এই যে, আমি তোমার কাকিমা। তোমার গুরুজন। মনে নেই? দিদি বিয়ের পর প্রথম বছর বিজয়ার দিনে আর নববর্ষে তোমাকে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করিয়েছিলেন। তারপরে অবশ্য আমিই দিইনি তোমাকে প্রণাম করতে।

—প্রণামের কতরকম হয়, কাকি। পা ছুঁলেও অনেক সময়ে প্রণাম হয়ে ওঠে না, আবার কারওকে চুমু খেলেও তো তা প্রণাম-ই হয়ে ওঠে।

পদ্মা চুপ করে রইল।

—বলল, জানি। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো চুমুরও ছিল না, প্রণামেরও নয়।

তারপর বলল, বলো কবু, ছ-ছটা ভারি বিপজ্জনক বছর আমরা কাটিয়ে গেছি এখানে—কিরি আসার আগে অবধি। তাই না?

—তাই। আমরা দু-জনেই যে, ভ সভ্য, সম্ভ্রান্ত পরিবারের তার প্রমাণ কিন্তু আমরা দিয়েছি।

—তা দিয়েছি। কিন্তু সেই অলিখিত সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্যে, কষ্টও তো কম পাইনি দু-জনেই আমরা। বলো তুমি?

পদ্মা বলল।

চমকে উঠে কবু বলল,

—তা ঠিক! তবে মাঝে মাঝে কী মনে হয় জান?

—কী?

—সেই কষ্টটাই হয়তো আনন্দ ছিল।

একটু চুপ করে থেকে পদ্মা বলল, ঠিক তাই। জীবনে যা-কিছুই গভীর আনন্দের তার বেশির ভাগ সম্ভবত কষ্টই। কষ্টটাই যে, আনন্দ তা বুঝতে অনেক-ই সময় লাগে। ত্যাগ বা বঞ্চনার মধ্যে দিয়ে যে, গভীর এক ‘শুচিস্নিগ্ধ’ আনন্দ আসে তা সম্ভবত সহজ এবং সাধারণ শারীরিকপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে আসে না কোনোদিন-ই।

—কী জানি! জানি না। তবে আমার একটা ভয় হয় কাকি যে, যদি কখনো বিয়ে করি, কোনো মেয়েকেই আমি তোমার আসনে বসাতে পারব না।

—একী অলক্ষুণে কথা। ছি:, ওরকম বলতে নেই। দিদি এবং দাদা আর তোমার কাকু একথা শুনতে পেলে কী ভাববেন বলো তো আমাকে? তা ছাড়া, আমি তো তোমাকে দুখি করতে চাইনি কোনোদিন-ই, সুখী করতেই চেয়েছিলাম। ওরকম করে বোলো না। আমার পক্ষে নিজেকে ক্ষমা করা সম্ভব হবে না তাহলে কোনোদিনও। তা ছাড়া, বিয়ে করলেই জানবে যে, নারী-পুরুষের সম্পর্কে শুধু মন-ই নয়, শরীরটাও অনেকখানি। দাম্পত্যর সঙ্গে নিছক মনের প্রেমে তফাত আছে অনেক-ই। তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। You have to live life to know life. সব জিনিস বই পড়ে বা উপদেশ পেয়েই শেখা যায় না।

বাংলোতে পৌঁছে ওরা দু-জনে বারান্দাতে এসে বসল। কর্বুরের বাবা এবং মা, কাকু আর কিরি রওনা হয়ে যাওয়ার পরেই বিজয়া সারতে বেরিয়ে গেছেন। একটি নতুন ফিয়াট উনো এসেছে, বাসন্তী-রঙা। বাবার ওই গাড়িটা খুব পছন্দ। নিজেই চালিয়ে গেছেন। বাবার ড্রাইভার বানোয়ারি আজ আসবে না। দশেরার দিন রাতে প্রচুর সিদ্ধি খেয়েছে আর ঢোল বাজিয়ে নেচেছে। আজ নেশা কাটতে সময় লাগবে। যদি আসেও হয়তো সন্ধের দিকে আসবে।

পদ্মা বলল, দশটা বাজে। তুমি যাও স্নান করে নিয়ে বিশ্রাম করো। আমি কিচেনে যাচ্ছি। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে একটা ঘুম লাগাও। তারপর গরম জলে স্নান করে বেরোবে। ক-টাতে পৌঁছাতে হবে?

—চারটেতে। মেক-আপ-এ যে, অনেক-ই সময় নেবে।

—তা তো নেবেই। নবাব হওয়া কি সোজা কথা! যাওয়ার আগে গরম জলে দুটো ডিসপিরিন ফেলে গার্গল কোরো আর আমার কাছ থেকে কাবাব-চিনির রুপোর কৌটোটা নিয়ে যেয়ো। গালে ক-টি ফেলে রাখবে, দেখবে, গলা বাঘের মতো বলছে।

—কত বড়োকৌটো?

—ছোটোকৌটো। নস্যির কৌটো। বেঁটে কাকার ছিল। ওপরটাতে ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিক লাগানো। ভেতরটা দেখা যায়। আমার একটা পেতলের কৌটো ছিল। বেঁটে কাকা সেটা নস্যির জন্যে নিয়ে তাঁর রুপোর কৌটোটা কাবাব-চিনি রাখার জন্যে দিয়ে দেন। তোমার নবাবি জোব্বার পকেটে থাকবে। স্টেজেও তুমি জোব্বা থেকে বের করে খেতে পারবে। কৌটোটা আমি Silvo দিয়ে পালিশ করে দিচ্ছি। এসব জিনিস তো নবাবদের-ই মানায়।

—সে হবেখন।

—তুমি যাও। বিশ্রাম করো। আমি ওদিকে যাই।

উঠে দাঁড়িয়েই, পদ্মা বলল, কাল ভোরে কখন বেরোবে জঙ্গলে?

—ব্রেকফাস্ট করে বেরোব। ওঁদের বলেছি, সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকতে।

—প্রথমে কোথায় যাবে?

—কুমডি।

—ইশ। যেখানে আমরা বাংলোর পাশে হাতি দেখেছিলাম?

—হ্যাঁ।

—আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করছে। তোমার সঙ্গে জঙ্গলে যাওয়ার মজাই আলাদা। কত গাছ চেন তুমি, কত পাখি, কত ফুল।

—চল-না তুমি।

—তা হয় না।

—কেন?

—আমরা সকলেই চাই তুমি আর ঐশিকা দু-জনে দু-জনকে কাছ থেকে জানো।

—তাহলে কাবাবমে হাড্ডি করে গৈরিকাকেও সঙ্গে দিচ্ছ কেন?

হেসে উঠল পদ্মা।

তারপর বলল, রিলিফ-এর জন্যে। একটানা একসঙ্গে থাকলে রোমিওরও, জুলিয়েটকে খারাপ লাগতে পারত।

—তাই? আর ঐশিকার বাবা?

—ব্যানার্জিসাহেবও দারুণ কম্পানি। কোনোরকম হ্যাঙ-আপস নেই ভদ্রলোকের। তাঁর স্ত্রী সত্যিই ভাগ্যবতী ছিলেন।

—তাই নাকি? তবে লোকে যে বলে, যার স্ত্রী মরে, সেই ভাগ্যবান।

—তারা সব বাজে লোক।

—চল-না তুমিও। খুব মজা হবে। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। আমার নার্ভাস লাগছে।

—নার্ভাস হওয়ার পাত্রই তো তুমি। বাজে কথা বোলো না।

—চলো চলো।

—জান-না। কিরিটা একা থাকবে। স্কুলও তো খুলে যাবে কাল থেকে। তোমাদের রওনা করিয়ে দিয়ে আমিও চলে যাব টাটা। ছানা-পোনা যতদিন ছিল না, দিন অন্যরকম ছিল।

বলেই বলল, না:। আর গল্প নয়। এবার আমি যাচ্ছি। আজ বারোটার মধ্যে খেয়ে নেবে। আজ মুন্না দেবী কী রাঁধছে গিয়ে দেখি।

 

পাঁচ

 

ব্যানার্জিসাহেবের ওপেল অ্যাস্ট্রা, ছাই-রঙা। ড্রাইভারের নাম বিহারি। জিপটা চালাবে কর্বুর-ই নিজে। সঙ্গে রহমতকে নিয়েছে। বিচিত্রবীর্য লোক। একাধারে ড্রাইভার, ক্লিনার, বাবুর্চি এবং বডি-গার্ড। ওড়িয়া আর হিন্দি দুইয়েতেই সমান দখল। তা ছাড়া ব্যক্তিত্বও আছে। জঙ্গলের মধ্যের বনবাংলার চৌকিদারেরা আর আজকাল আগের মতো নেই। তাদের দিয়ে ঠিকমতো কাজ করিয়ে নেওয়া বাহাদুরির কাজ। রহমত ভালো নার্সও। একবার মনোহরপুরে শিকারে গিয়ে জ্বরে, বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল কর্বুর। রহমত শুধু সেবাই করেনি, বহাল তবিয়তে বড়োবিলে ফিরিয়েও নিয়ে এসেছিল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, কর্বুরকে, তুমিও এ গাড়িতেই এসো। জিপ তোমার ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে আসুক। এখন তো জিপের দরকার নেই। আপত্তি আছে?

—তা নেই।

কর্বুর বলল, আমি সামনে বসি?

না। ব্যানার্জিসাহেব বললেন, পাইপের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে।

তারপর বললেন, আমি মোটা মানুষ, সামনেই কম্ফর্টেবল ফিল করি। তুমি ওদের সঙ্গে পেছনেই বোসো-না বরং।

—বেশ।

গৈরিকা বলল, আপনাকে স্যাণ্ডউইচ করি?

—মানে?

—মানে, আমরা দু-জনে দু-দিকে বসি জানলার পাশে। দেখতে দেখতে যেতে পারব তা হলে। আপত্তি আছে?

কর্বুর মনে মনে বলল, এমন আলগা ভদ্রতার মানে কী? বাবা আর মেয়েতে যা নিজেদের ইচ্ছে তা তো করছেন-ই। মাঝে মাঝে একটা করে ‘আপত্তি আছে?’ প্রশ্ন করার কী দরকার?

শুধু বলল, যেমন আপনাদের খুশি।

পদ্মা এবং কর্বুরের মা-বাবাও এসেছিলেন, ওদের সকলকে সি-অফ করতে ঠাকুরানি পাহাড়ের ওপরে।

রহমত-এর জিপে মুরগির ঝুড়ি, আনাজের বস্তা, চাল, ডাল, তেল, নুন, লঙ্কা এবং যাবতীয় মশলা। একটি পাঁচ-ছ কেজির পাঁঠা। সাদা-রঙা। চা, কফি, বিস্কিট, চিজ ‘Knor’-এর স্যুপ প্যাকেট, নুডলস ইত্যাদি জিপের পেছনে বোঝাই করা।

কর্বুর বলল, আমি বরং গাড়িটা চালাই। আপনাদের ড্রাইভার আমাদের ড্রাইভারের সঙ্গে আসুক। ওকেও একা আসতে হবে না, আর এ-গাড়িতেও ওরা দু-জনে পেছনে হাত-পা ছড়িয়ে যেতে পারবেন।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেটা মন্দ হবে না।

পেছন থেকে ঐশিকা বলে উঠল, গাড়ির পেছনের সিটটা তো বিছানা নয়, যে হাত-পা ছড়িয়ে যেতেই হবে। তবে আপনার যদি আমাদের সঙ্গে পেছনে বসতে আপত্তি থাকে, সে-কথা বললেই তো হয়।

এবারে কর্বুরেরও মনে হল যে, কিছু বলা দরকার। বড়োই খলবল করছে দু-বোন। পায়ের নীচে ঘাস গজাতে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

শৈশবে মাতৃহীন মেয়েদের যত ভালো করে ব্যানার্জিসাহেব মানুষ করেছেন বলে শুনেছিল কর্বুর ওর কাকির কাছে, আসলে তেমন ভালো করে মানুষ হয়তো করতে পারেননি উনি। মেয়ে দু-টি বেশ অভব্য আছে। এবং প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই সপ্রতিভ। আদরে আদরে একেবারেই গোবর হয়েছে।

কর্বুর হেসে বলল, আমি এই পাড়াগাঁ বড়োবিল-এ থাকি বলেই ভাববেন না যে, মেয়েদের সঙ্গে মিশতে কোনোরকম আড়ষ্টতা আছে আমার। আপনারা যা ভাবছেন, তা ভুল।

বলতে বলতেই জিপের দিকে গিয়ে রহমতচাচাকে যা বলার বলে, ওঁদের ড্রাইভার বিহারিকে জিপের সামনের সিট-এ বসিয়ে দিয়ে, নিজে এসে ওপেল-এর ড্রাইভিং সিট-এ বসল।

বসেই, এঞ্জিন স্টার্ট করল।

ঐশিকা বলল, আড়ষ্টতা যে নেই, তা তো কাল নাটক করার সময়েই দেখলাম।

কর্বুর বলল, নাটক তো জীবন নয়। দুটো আলাদা ব্যাপার।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সফিস্টিকেটেড গাড়ি, চালাতে অসুবিধে হবে না তো তোমার?

কর্বুর অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি সামনে গড়িয়ে দিয়ে বলল, চালাই তো। আমাদের আছে একটা। সাদা রঙের।

—ওপেল অ্যাস্ট্রা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন দাদুর একটা ওপেল ‘ক্যাপিটান’-ও ছিল। ওপেল অ্যাস্ট্রার চেয়ে অনেক-ই বড়ো। লেফট হ্যাণ্ড ড্রাইভ। আমি ওতেই গাড়ি চালানো শিখেছিলাম এই রহমতচাচার-ই কাছে।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, আই সি।

হয়তো ভাবছিলেন, কুরুবক সেন যেমন, নরম-সরল-বিনয়ী-ভদ্র তার ভাইপো কর্বুর ঠিক সেরকম নয়।

—তোমার বাবা মা কাকিমা তো দেখলাম একটা টাটা সাফারিতে এসেছিলেন। আরও গাড়ি আছে নাকি তোমাদের?

—একটা ‘ইণ্ডিকা’ আছে আমার। গতসপ্তাহেই পেয়েছি। কাকার তো ফিয়া সিয়েনা আছে। নিশ্চয়ই জামশেদপুরে দেখেছেন। মারুতি এস্টিম-এ রহমতচাচা মায়ের ও কাকিমার ডিউটি করে, দিদিরও, যখন আসে দিদি। তা ছাড়া বাজার-দোকান করার জন্যে একটা মারুতি ভ্যানও আছে। পেছনের সিটটা খুলে ফেলা হয়েছে। বাজার বইবার সুবিধার জন্যে। তা ছাড়া একটা ফিয়াট-উনোও নিয়েছেন বাবা।

—বা:। আগেকার দিনের রাজারাজড়াদের ঘোড়ার শখ ছিল একসময়ে, তোমাদের দেখছি গাড়ির শখ।

—তা জিপটার কথা বললেন না? ওটা বুঝি ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না?

গৈরিকা বলল।

—ওটাকে কি ঠিক গাড়ি বলা চলে?

—তবে ওটা কী?

ঐশিকা বলল, পেছন থেকে।

—ওটা পক্ষীরাজ।

কর্বুর বলল।

সকলে হেসে উঠলেন একইসঙ্গে।

গাড়ির মধ্যের আবহাওয়ার গুমোটটা এয়ারকণ্ডিশনার চালানো থাকা সত্ত্বেও ঠিক কাটছিল না এতক্ষণ। এবার মনে হল যেন কাটতে শুরু হল।

হঠাৎ ঐশিকা বলল, কাল রাতে আপনাকে কিন্তু সত্যিই নবাব-নবাব-ই দেখাচ্ছিল। নাটকে।

—তাই? থ্যাঙ্ক ইউ। নাটকের নবাব।

তারপর বলল, মেক-আপম্যানের বাহাদুরি আর ভাড়া-করা পোশাকের দৌলতে অনেক বান্দাও সহজেই চেহারাতে নবাব বনতে পারে, কিন্তু ডিমেন্যুরেও নবাব বনা বোধ হয় অতসহজ নয়।

—আপনার চেহারা এবং ডিমেন্যুর দুইয়েতেই নবাব-নবাব লাগছিল।

এবারে গৈরিকা বলল।

কর্বুর আবারও বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

তারপর বলল, আমি তো নবাব-ই। অন্যরকমের নবাব।

—কোথাকার নবাব?

—সারাণ্ডার জঙ্গলের নবাব। কারও-কোয়েল-কয়নার উপত্যকার এই Land of seven hundred hills-এর নবাব আমি। শালমহুয়ার জঙ্গলের নবাব।

—কোয়েল নদীর নাম তো শুনেছি কিন্তু কারো বা কয়নার নাম তো শুনিনি। ওইসব নামেও নদী আছে বুঝি? জানতাম না তো!

—এই বিপুলা পৃথিবীর কতটুকুই বা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব? আমি এখানে থাকি বলেই হয়তো জানি।

—তা কেন? ডিসকভারি চ্যানেল বা ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেল দেখলে তো, ঘরে বসে অনেক-ই জানা যায়। বিপুলা পৃথিবীর সর্বত্রই যে, নিজের পায়ে হেঁটে ঘুরতেই হবে তার কী মানে?

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

—তা হতে পারে। কিন্তু নিজের পায়ে না ঘুরলে আবার কোনো জায়গাই তেমন করে দেখাও হয় না। যাকে বলে, ‘To have a feel of the place.’ সেই অনুভূতিটা হয় না আদৌ টিভি দেখে—।

সেটা অবশ্য ঠিক-ই।

ব্যানার্জিসাহেব কর্বুরের কথায় সায় দিলেন।

মেয়েদের কেমন লাগছে তা বলতে পারবেন না, ব্যানার্জিসাহেব গতরাতে বাজবাহাদুরের চরিত্রে কর্বুরের অভিনয় দেখে এবং আজ এইটুকু সময়ের মধ্যেই তাকে যতটুকু দেখেছেন তাতেই ছেলেটিকে ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে ওঁর। নিজের ছেলেবেলার কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে যেন। নো ডাউট, দিস ইয়াং ম্যান ইজ কোয়াইট আ Guy! আসলে, নিজেকে মানুষ যত ভালোবাসে তত তো আর কারওকেই বাসতে পারে না। কারও সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেলেই তাকে ভালো লেগে যায়।

মনে মনে বললেন, উনি।

গৈরিকা বলল, ‘মহড়া’ নাটকটির কিন্তু বেশ ডেপথ আছে। নাটকের মধ্যেও নাটক ছিল একটা। থিমটা খুব-ই প্র্যাকটিকাল।

—কোয়াইট আনইউজুয়ালও।

ঐশিকা বলল।

—সত্যিই তো আমাদের সকলের জীবন-ই এক-একটি মহড়া। ক-জনের জীবনে জীবনের নাটক শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়? রিহার্সালই তো সার। আইডিয়াটা সত্যি খুব-ই অরিজিন্যাল। সন্দেহ নেই।

—ওই ভদ্রমহিলা কে?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

—কোন ভদ্রমহিলা?

—যিনি রূপমতীর ভূমিকাতে অভিনয় করলেন? গানও তো বেশ ভালোই গান মহিলা দেখলাম।

—দেখলাম কী? শুনলাম বল।

গৈরিকা বলল।

—ওই হল।

—মহিলা ঠিক নন। বয়সে আপনাদের-ই মতো হবে শিখী। ওর নাম শিখী রায়। ক্ল্যাসিকাল গান শেখে বড়োজামদার হেরম্ববাবুর কাছে। হেরম্ব চ্যাটার্জি। আগ্রা ঘরানার গাইয়ে। বিজয় কিচলু রবি কিচলুদের গুরুভাই। কুমারপ্রসাদ মুখার্জিরও।

—কই? হেরম্ব চাটুজ্যের নাম তো কখনো শুনিনি। গানও শুনিনি কখনো।

—শোনবার তো কোনো কারণ নেই। হেরম্ব জ্যাঠারা তো ‘they also ran’-এর দলেই পড়েন। বাণিজ্যিক সাফল্যের মুকুট তো তাঁদের মাথায় ওঠেনি। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতাতেও থাকেন না। তাই তাঁদের আপনারা চিনবেন কী করে!

—তা ছাড়া এসব প্রাগৈতিহাসিক গানও শোনেন নাকি আপনারা? আপনারা তো সম্ভবত নচিকেতা, সুমন, লোপামুদ্রাদের আধুনিক গান-ই শোনেন বাংলা গান আদৌ শুনলে। ইণ্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিক তো এখন কাকুর এই জিপগাড়ির-ই মতো অ্যান্টিক ব্যাপার হয়ে গেছে।

—আপনি বড়োবেশি Surmise করে নেন মশায়। আপনি একটু বেশি ওভার কনফিডেন্টও। আধুনিকতার ওপর আপনার রাগ আছে মনে হয়।

—আধুনিকতার ওপরে রাগ নেই। যে মানুষ আধুনিক নন তিনি অশিক্ষিত। তবে আধুনিকতা আর ছদ্ম-আধুনিকতার মধ্যে তফাত তো আছেই। থাকবেও চিরদিন।

—আপনি বুঝি ইণ্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল গানের খুব ভক্ত? ওয়েল। ‘বাহার’ আর ‘বসন্ত’ এই দুই রাগের মধ্যে তফাত কী তা বলতে পারবেন?

—আজ্ঞে না। আমি জলবসন্ত আর আসল বসন্তর মধ্যের ফারাকটা জানি।

তারপর বলল, ওইসব গান শুনলেও আপনারা কোনো কোটিপতির বাড়িতে বা রবীন্দ্রসদনে বা কলামন্দিরে বা সংগীত রিসার্চ আকাদেমিতে শোনেন। হেরম্ব চাটুজ্যেদের খোঁজ আপনারা রাখেন না। কোনোদিন রাখবেনও না। ক্ল্যাসিকাল ইণ্ডিয়ান মিউজিক আপনাদের কাছে জামদানি শাল, জড়োয়ার গয়না, এম. এফ. হুসেইনের ছবির-ই মতো, নিছক-ই Status Symbol.

গৈরিকা বলল, আপনি তো মহা ঝগড়ুটে লোক মশায়। আমার মা একটা কথা বলতেন, ‘বাতাসের গলায় দড়ি দিয়ে ঝগড়া করা।’ আপনাকে দেখে মায়ের সেই কথাটা মনে পড়ছে।

হেরম্ববাবু প্রসঙ্গে আপনি আগ্রা ঘরানার কথা বলছিলেন না?

আপনি আবার এসব ঘরানা-টরানার কথাও জানেন নাকি?

খুব বেশি ঘরানা তো নেই। তা ছাড়া কুমারপ্রসাদ মুখার্জির ‘কুদরত রঙ্গি-বিরঙ্গি’ বইটি কেউ পড়ে ফেললেই তো মোটামুটি জেনে ফেলতে পারেন।

তারপর বলল গৈরিকা, সেটি আবার কী বই?

—সেটি ভারতীয় মার্গ সংগীত এবং গাইয়েদের নিয়ে লেখা একটি অসাধারণ বই। না পড়ে থাকলে, অবশ্যই পড়বেন। ‘আনন্দ’ পাবলিশার্স-এর বই। তা ছাড়া, রসবোধ কাকে বলে তা বুঝতে পারবেন বইটি পড়ে।

—কোন কুমারপ্রসাদ? ধূর্জটিপ্রসাদের একমাত্র পুত্র যিনি?

ব্যানার্জিসাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

—হ্যাঁ।

—আরে তাকে তো আমি চিনতাম। কোল-ইণ্ডিয়াতে ছিলেন না?

—ছিলেন-ই তো। আমার বাবাও সেই সুবাদে চেনেন।

—পড়তে হবে তো।

তারপর কর্বুর বলল, অমিয়নাথ সান্যালের ‘স্মৃতির অতলে’ বইটি পড়েছেন?

—না তো।

—ইউ হ্যাভ মিসড সামথিং ইন ইয়োর লাইফ। ‘জিজ্ঞাসা’র বই, মানে প্রকাশক। অবশ্যই পড়বেন সে বইটিও।

—আজকাল বেশি জানার তো প্রয়োজন নেই। বইয়ের ব্লার্ব, সিডি বা এল.পি-তে গায়ক-গায়িকার যে পরিচিতি থাকে, সেই পরিচিতিটুকু পড়ে নিলেই তো পন্ডিতি করা যায়। ঠেকাচ্ছেটা কে? আসল পন্ডিতেরা আমাদের মতো এইরকম নকল পন্ডিতদের দাপটে লজ্জাতে আজকাল ঘরেই থাকেন কুলুপ এঁটে। ইকনমিস্ট গ্রেশাম সাহেবের সেই Maxim এখন জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অর্থনীতিতেই নয়।

—কী? মানে কোন Maxim?

—‘Bad money drives away good money.’

—যা বলেছ ভাই। কার-রে-ক্ট।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

পরক্ষণেই ভাবলেন, কর্বুর যদি ভবিষ্যতে তাঁর জামাই হয়, তাহলেও কি তাকে ‘ভাই’ বলেই সম্বোধন করবেন? সত্যি। নিজেকে নিয়ে চলে না। যদি...

তারপরই বললেন কর্বুরকে, তোমার কি কোনো ডাকনাম নেই বাবা? ‘কর্বুর’, ‘কর্বুর’ করে বার বার ডাকতে যে, আমার ডেঞ্চার খুলে যাচ্ছে।

কর্বুর হেসে বলল, বাড়িতে সকলে আমাকে কবু বলেই ডাকেন।

—দ্যাটস মাচ বেটার।

—‘কর্বুর’ মানে কী? কোনো দিশি শব্দ?

গৈরিকা জিজ্ঞেস করল।

—শব্দটা বাংলাই। কিন্তু শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বাঙালিরা তো আজকাল বাংলা জানাটাকে লজ্জাকর ব্যাপার বলেই মনে করেন। তাঁরা অনেক শব্দর-ই বাংলা জানেন না অথচ ইংরেজি অথবা ফ্রেঞ্চ প্রতিশব্দ জানেন।

—আপনি বাপির-ই মতো বড়োজ্ঞান দেন মশায়! মানেটা বলুন-ই না। তা ছাড়া বাপি ঝগড়ুটে নন, আপনি একনম্বর ঝগড়ুটে।

ঐশিকা বলল।

—‘কর্বুর’ মানে বহুবর্ণ। মানে বুঝলেন? মাল্টি-কালারড। চিত্র-বিচিত্র।

—বাবা! নামটা কে রেখেছিলেন আপনার? খুব-ই থটফুল মানুষ তো উনি।

—আমার দাদু। হি ওয়াজ আ গ্রেট ম্যান।

এদের খুনশুটির হাত থেকে বাঁচার জন্যে ব্যানার্জিসাহেব বললেন, কবু, আমরা প্রথমে কোথায় যাচ্ছি?

—কুমডিতে। আজকে সারাদিন কুমডিতেই থাকব। রাতেও। তারপর কাল ব্রেকফাস্ট করে থলকোবাদে যাব। তারপর...

—তারপরের কথা আগে বলবেন না প্লিজ। আমরা একটু সাসপেন্স-য়েই থাকতে ভালোবাসি।

—সেটা মন্দ বলিসনি। আমি প্রথমবার যখন States-এ যাই তখন পথে দেড়শো মাইল সামনে বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না, ট্রাফিক জ্যাম আছে কি নেই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কি হয়নি, সব-ই টিভি স্ক্রিন-এ ফুটে উঠতে দেখে বড়ো বিরক্তি ধরেছিল। আমাদের দেশে যখন গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে আমরা পুরোনো দিনের গাড়িতে বেরোতাম, তখন ভূমিকম্প হবে না বন্যা, বজ্রপাত না শিলাবৃষ্টি, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্রই না জেনে মহানন্দে যেতাম। অজ্ঞতারও এক বিশেষ আনন্দ আছে। বেশি জানলে সেই নির্মল আনন্দ মাটি হয়।

ঐশিকা বলল, এই ইন্টারনেট ই-মেইল-এর যুগে ‘সাসপেন্স’ জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। সবাই সবজান্তা। কারোর-ই অজানা কিছুই নেই। ভবিষ্যৎ-এ কুয়াশা নেই, ঝকঝকে রোদ্দুর। জীবনে কোনো রহস্য নেই। না, আমরা কিন্তু একটু প্রাচীনপন্থী। একটু কম জেনেই আমরা খুশি থাকি।

—বেশ। এ তো আনন্দের-ই কথা।

কর্বুর বলল।

—আপনার নাটকটা কিন্তু আমাকে রীতিমতো হন্ট করছে।

ঐশিকা বলল।

—হন্ট করাটা তো ভালো নয়। ‘Haunt’ শব্দের মানেটা তো বিশেষ সুবিধের নয়। ভেবেছিলাম, বাংলাটা ভালো করে শেখেননি, তাই কথায় কথায় ইংরেজি ফুটোচ্ছেন। যখন ইংরেজি শিখেছেন তখন ইংরেজিটাও তো ভালো করে শেখেননি মনে হচ্ছে।

একটু অপ্রতিভ না হয়ে ঐশিকা বলল, ভুলটা ধরেছেন আপনি ঠিক-ই। অনেক শব্দ ব্যবহার করতে করতে আমরা তার আসল মানেটাই ভুলে যাই। রাইট ইউ আর!

কর্বুর অবাক হল একটু। যাকে বলে প্লেজেন্টলি সারপ্রাইজড। ঝগড়া লাগার বা অপমানিত হওয়ার যখন যথেষ্টই কারণ ছিল তখন নিজের ভুল একবাক্যে স্বীকার করে নিল ঐশিকা। এটা একটা মস্ত গুণ বলতে হবে।

—তক্ষ রায়ের চরিত্রটা, মানে গতরাতের নাটকে, কিন্তু অসাধারণ। বিশেষ করে তাঁর Introspection, যেখানে উনি স্বগতোক্তি করছেন, বলছেন, ‘‘রূপমতীর বয়স হবে না কোনোদিন-ই।তক্ষ একদিন বৃদ্ধ হবে,। লোলচর্ম, গলিত, নখদন্ত কিন্তু রূপমতী রয়ে যাবেন তেমন-ই রূপমতী। তেমন-ই রইবে তাঁর গর্বিত গজগমনের পদক্ষেপ, তাঁর ব্রীড়াভঙ্গি। তাঁর গানের গলা। বয়স ছুঁতে পারবে না তাঁর কিছুকেই।’’

গৈরিকা বলল।

—ক্লাসিক হয়ে যাবেন রূপমতী, চিরকালিনী হয়ে থাকবেন, ন্যুট হামসুন-এর উপন্যাসে ‘গ্রোথ অফ দ্যা সয়েল’-এর মতো, বিভূতিবাবুর ‘আরণ্যক’-এর মতো।

ঐশিকা বলল।

—বাবা:। আপনি ‘আরণ্যক’ও পড়েছেন নাকি? বিভূতিভূষণের কী ভাগ্য!

—ইয়েস স্যার।

—সারাণ্ডা বিভূতিভূষণের খুব প্রিয় জায়গা ছিল। বিশেষ করে মনোহরপুর।

—আমরা যাব না?

—যাওয়ার কথা তো আছে। তা বিভূতিভূষণের আর কোনো বই পড়েছেন?

—আর একটা পড়েছিলাম। একটি ভারি মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস, নাম ‘দুই বাড়ি’।

বলেই বলল, আপনি পড়েছেন?

—না তো।

—ওইসব বই স্কুলে থাকতেই পড়েছিলাম। তারপর পড়াশুনোর যা চাপ পড়ল, বাংলার চর্চা আর রাখতে পারলাম কই?

—রাখা উচিত ছিল। কর্বুর বলল।

—জ্ঞান দেবেন না তো মশাই। আমরা মেয়েরা রান্নাঘরে গলদঘর্ম হয়ে সারাদিন আপনাদের জন্যে রান্না করব, দুপুরে যখন আপনারা ‘আপিস’-এ গিয়ে রাজা-উজির মারবেন, দরজাতে লাল আলো জ্বেলে আড্ডা মারবেন আর আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারি বলবেন, ‘হি ইজ ইন আ কনফারেন্স’ তখন আমরা শরৎবাবুর উপন্যাস পড়ব বিছানাতে শুয়ে, বাংলা গান শুনব, উত্তমকুমারের ছবি দেখব টিভিতে, বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখব, আর আপনাদের গুরুজনেরা, ‘সাহেব’ আপনাদের জন্যে পাত্রী দেখতে এসে বেশ বাঙালিআনাতে সম্পৃক্ত ‘মিষ্টি’ মেয়ে পছন্দ করে যাবেন। না, চিরদিন-ই তো তা হতে পারে না। এখন আমরাই ‘আপিস’ করব, উপার্জন করব, বাইরের জগৎ সামলাব আর পুরুষেরাই আলু-পোস্ত আর তেল-কই রান্না করে রাখবে আমাদের জন্যে। দুপুরে সুনীল গাঙ্গুলি, দিব্যেন্দু পালিত অথবা শংকরের বাংলা উপন্যাস পড়বে। আমরা ভীষণ-ই টায়ার্ড হয়ে বাড়ি ফেরার আগে ঘরে এয়ারকণ্ডিশনার চালিয়ে রাখবে, স্নানঘরে গিজার চালিয়ে রাখবে, বাড়ি পৌঁছোলে সেজেগুজে পারফিউম মেখে, আমাদের হাসি মুখে চা করে দেবে, নাইটি গোছ করে রাখবে বাথরুমে। এক্কেবারে সুইটি-পাই নেকুপুষুমুনু আদর্শ স্বামী হবে সব। ঘোরতর বাঙালি। ফুলেল তেল মাখবে মাথায় আমাদের জন্যে।

গৈরিকা বলল, ঠিক বলেছিস তুই। ওয়াক্সিং করবে, হেয়ার রিমুভার ইউজ করবে।

ঐশিকা বলল, দিন পালটাচ্ছে স্যার। বহুহাজার বছরের অব্যেস-টব্যেস সব পালটাতে হবে এবার পুরুষদের। স্বামী এবং স্ত্রী ভূমিকার অদলবদল হবে।

গৈরিকা বলল, ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?’

—যারা না শুনতে পায় তারা বদ্ধ কালা। কালের রথের চাকাতে চাপা পড়ে মরা ছাড়া তাদের গতি নেই।

ঐশিকা বলল।

কর্বুর বলল, আমার তো মনে হয়, আর দশ-পনেরো বছরের মধ্যে বিয়ে ব্যাপারটাই অ্যাজ অ্যান ইনস্টিটিউশান আর থাকবেই না, সচ্ছল, উচ্চশিক্ষিত সমাজে। আপনারা মিছেই আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখছেন। আমরা পুরুষেরা, আপনাদের, আমাদের অমনভাবে হিউমিলিয়েট করার সুযোগ-ই দেব না আর সম্ভবত।

—কেন একথা বলছ তুমি কবু? বিয়ে উঠে যাবে কেন? সেটা মন্দ হবে না?

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

—বলছি স্যার...।

—স্যার-স্যার আবার কী...

—না, আপনি কাকুর বস।

—বস তো কাকুর অফিসে। তা ছাড়া আমি তো তোমার বস নই। বরং তুমি আমার বস এখন। তোমার গার্জিয়ানশিপেই তো জঙ্গলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে আমার ডাকনামেই ডেকো। ‘ঘোঁৎলা’ বলেই।

—না। সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। বাধো-বাধোও ঠেকবে। আমি বরং আপনাকে ব্যানার্জিসাহেব বলেই ডাকব।

—ব্যানার্জিকাকুও বলতে পারো।

—ব্যানার্জিসাহেব-ই ভালো।

—তো এখন বলো, কেন তোমার এরকম মনে হয়?

—আমার একার মনে হয় না। এও কালের-ই যাত্রার ধ্বনি। অদৃষ্টের লিখন। ‘ভবিতব্যং ভবেতব্য’। মানুষ বড়োই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে, বড়োই আত্মকেন্দ্রিক। তার স্বাতন্ত্র্যবোধ এমন-ই এক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত সচ্ছল সমাজে, মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জোয়ার আসার পরে, পুরুষ ও নারীর রুচি এতই বেশি সূক্ষ্ম অথবা স্থূল হয়ে যাচ্ছে, যদিও ভিন্ন ভিন্ন রকম, তাতে এক ছাদের নীচে দু-জন মানুষের বাস করাই মুশকিল হবে। এই ‘প্রগতি’র গতি রোধ করা না গেলে একটা সময় আসবেই যখন মানুষে আর live together-ও করবে না। মেলামেশা হবে, শারীরিক সম্পর্কও থাকবে। কিন্তু স্ত্রী ও পুরুষে থাকবে আলাদা আলাদা ছাদের নীচে।

গাড়ির মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, গম্ভীর গলায়, তোমার তাই মনে হয়?

—আজ্ঞে।

—বাপি, তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে, ‘শেষের সে দিন ভয়ংকর’ ভেবে তুমি মুষড়ে পড়ছ। তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার মেয়েরা তোমার না-থাকা ছেলেদের চেয়েও অনেক ভালো করে দেখবে তোমাকে। তা ছাড়া তুমি তো আমাদের বাবা-ই শুধু নও, তুমি যে আমাদের মা-ও।

—এরজন্যে কি মেয়েদের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই দায়ী বলে আপনি মনে করেন স্যার?

ঐশিকা ফৌজদারি আদালতের উকিলের মতো প্রশ্ন করল কর্বুরকে।

—না, তা নয়। দায়ী আমি কোনোপক্ষকেই করছি না। দায়ী যদি কারওকে করতে হয় তবে এই সময়কেই করতে হয়। আমরা আগের প্রজন্মের তুলনাতে অনেক-ই বেশি অধৈর্য হয়ে গেছি। যা-কিছুই পাওয়ার, তা আমরা এখুনি চাই। Right now! কোনো কিছুর জন্যেই অপেক্ষা করার সময় নেই আমাদের। জীবনের সবক্ষেত্র থেকেই ‘ধৈর্য’ ব্যাপারটা উবে যাচ্ছে। Most Volatile of all Qualities.

—বাপিদের সময়ে জীবন এত তো টেনশান-এরও ছিল না। দাম্পত্যজীবন শুরুও হত অনেক তাড়াতাড়ি। পুরুষ রোজগার করত, বাইরেটা সামলাত, আর মেয়েরা আনন্দে সংসার করত, ছেলে-মেয়ে মানুষ করত। পুরুষ ও নারীর ভূমিকাটা কমপ্লিমেনটারি ছিল। আজকের মতো এমন কমপিটিটিভ ছিল না। বাইরেও প্রতিযোগিতা, ঘরের মধ্যেও প্রতিযোগিতা। সবসময়েই এখন দুজনে-ই দু-জনের প্রতিযোগী। হারতে কেউই রাজি নয়। ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ মানসিকতা ছিল না। মানিয়ে নেওয়াটা ছেলেবেলা থেকেই মায়েরা শেখাতেন মেয়েদের। মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে কোনোরকম হীনম্মন্যতাও ছিল না। এখন তেমন আর হয় না, তাই সুখী হওয়াটাই ভারি কঠিন হয়ে গেছে।

ঐশিকা বলল, দুঃখ দুঃখ গলায়।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, ‘সুখ’ যে কী, সুখ যে কাকে বলে, তা তো ভুলেই গেছিস তোরা। হয়তো কখনো জানতেও চাসনি। এখন মানুষের জীবনে আরাম আর সুখ এক হয়ে গেছে। সিনোমিনাস। ছেলেবেলায় বাট্রাণ্ড রাসেল-এর বই পড়েছিলাম, তাতে উনি লিখেছিলেন, ‘উই ড্যু নট স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্স, উই স্ট্রাগল টু আউটশাইন আওয়ার নেবারস।’ আরও চাই আরও আরও। প্রতিবেশীর যা আছে, তার চেয়ে আমার বেশি চাই। তোমাদের চারখানা গাড়ি আছে তো আমার সুখী হওয়ার জন্যে অন্তত পাঁচখানা গাড়ি চাই-ই-চাই। মানুষের পয়েন্ট অফ ভিউই সব গোলমাল হয়ে গেছে। সবকিছু জড়িয়ে মড়িয়ে hotch potch হয়ে গেছে।

একটু চুপ করে থেকে বললেন, রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা ছিল না? একটা? ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।’

—ঠিক।

কর্বুর বলল।

তারপর বলল, এই ইউনাইটেড স্টেটস দেশটাই জীবনের সমস্তক্ষেত্রে সারাপৃথিবীর পরিবেশটাকেই দূষিত করে দিল। এইডস-এর চেয়েও মারাত্মক এই রোগ। শব্দ-দূষণ, বায়ু-দূষণ এসব এই মানসিকতার দূষণের সঙ্গে তুলনীয়ই নয়। মানুষ যদি নিজেকেই নষ্ট করে ফেলে তাহলে তার টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি, নির্মল পরিবেশ দিয়ে হবেটা কী?

ঠিক-ই বলেছ তুমি কবু।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

তারপর দুই মেয়েকে একটু ভর্ৎসনার সুরেই বললেন, অনেক তত্ত্বকথা হয়েছে। এবারে একটু চুপ করে দু-পাশের দৃশ্য দেখো।

পথের পাশের গাছগুলো দেখিয়ে গৈরিকা কর্বুরকে জিজ্ঞেস করল, এই গাছগুলো কি সব-ই শাল?

—অধিকাংশই। সারাণ্ডার শালবন তো বিখ্যাত।

—সাহেবরা কি সত্যিই পাহাড়গুলো এক এক করে গুনেছিল যে, সারাণ্ডাকে বলা হয় ‘ল্যাণ্ড অফ সেভেন হান্ড্রেড হিলস’?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

—শুনেছি তো তাই।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, ‘গোঁজামিল’ ব্যাপারটা তো ওদের চরিত্রানুগ ছিল না। ওদের অনেক গুণও ছিল কিন্তু আমরা দোষগুলোকেই বড়ো করে দেখেছিলাম। ওরা চলে যাওয়ার পরে এখন ওদের গুণগুলো দীপ্তি পাচ্ছে।

—তা হবে। আমরা তো আর সেই প্রজন্মের সাহেবদের দেখিনি।

ঐশিকা বলল।

 

ছয়

 

কুমডি বাংলোটা ছোটো। বনবাংলোর তুলনাতে একটু চাপা। কিন্তু সুন্দর। তবে বনবাংলোর যা সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ, চওড়া বারান্দা তা এই বাংলোতে নেই। কেন নেই, তা জানে না কর্বুর।

বাংলোর সামনে থেকেই পথ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীতে। সেই নদীর ওপর বাঁধ বাঁধা হয়েছে একটা। ছেলেবেলাতে যখন আসত তখন বাঁধ ছিল না। ওই পথ-ই চলে গেছে থলকোবাদ।

কুমডিতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। ভালো-মন্দ খেতে খেতে আরও দেরি। শুধু বনভ্রমীই তো নন ওঁরা, বনভ্রমণ কাম চড়ুইভাতি করতেই এসেছেন। এঁদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলে লাভ নেই যে, বনভ্রমণ আর বনভোজন এক নয়। বললে, ভাববেন ‘জ্ঞান দিচ্ছে’। এমনিতে তো ‘জ্ঞানদাতা’ উপাধি পেয়েই গেছে।

খাওয়া-দাওয়ার পরে ব্যানার্জিসাহেব শুয়েছেন। তিনটি ভদকা খেয়েছিলেন গন্ধরাজ লেবু দিয়ে। তারপর সুগন্ধি ভাত, বেগুনভাজা, ভাজা মুগের ডাল, নারকোল-কুচি দেওয়া, পাহাড়ি নদীর পাড়হেন মাছ ভাজা মুচমুচে, বড়োবিল থেকে আনা কচি-পাঁঠার মাংস, ‘হাতুহাতুর’ দোকানের রাবড়ি।

ঘুম, কর্বুরেরও পেয়েছিল। কারণ, খেতে বসে দুই কন্যা তো শুধু গন্ধ শুঁকেই উঠে গেলেন, ফিগার-কনশাস এমন-ই। জমিয়ে খেলেন ব্যানার্জিসাহেব আর কর্বুর-ই। তা ছাড়া গতরাতের নাটকের পর আলাপ-আলোচনাতে এবং বাড়ি ফিরেও খাবার টেবিলে বসে বাবা, মা আর কাকির সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতে অনেক-ই দেরি হয়েছিল।

কাল সারারাত যেন এক ঘোরের মধ্যে ছিল। রূপমতী-রূপী শিখীর প্রসাধিত আলো-পড়া মুখটি রাতে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। সে কাল একটা পারফিউম মেখেছিল তার নাম নাকি ‘রেড ডোর’। ‘রেড ডোর’-এর সুগন্ধে ম ম করছিল শিখী। প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই অনেকজন মেয়ে থাকে বোধ হয়। এক এক সময়ে এক এক জন বাইরে আসে। সেই বিভিন্নরূপী বিভিন্ন সত্তার কোন জনের হাতে যেকোনো পুরুষ কখন অনবধানে বধ হবে তা একমাত্র বিধাতাই জানেন। পুরুষমাত্রের-ই যা দুর্বলতা, তাই নারীমাত্ররই বল। একটু দেখা, একটু ছোঁয়া, একটু বিলোল চাউনি, একটু হাসি, একটু অভিমান দিয়ে যেকোনো নারী অবহেলে যেকোনো পুরুষকে বধ করতে পারে। এ বিধাতার-ই চক্রান্ত। পুরুষকে ভঙ্গুর করে তিনিই গড়েছেন। আসলে Fragile মেয়েরা নয়, পুরুষেরাই।

শিখীকে কাকির কেন অত অপছন্দ বোঝে না কর্বুর। কর্বুরের তো খারাপ লাগে না মেয়েটিকে। তা ছাড়া তাদের শিকড়ও এ অঞ্চলে পোঁতা। এই প্রাকৃতিক পরিবেশে লোহা আকরের নীল আর ম্যাঙ্গানিজ আকরের লালের গুঁড়ো এবং নদীর বুকের সোনার গুঁড়ো নিয়ে খেলা করেছে ছেলেবেলাতে। শাল, মহুয়ার ছায়াতে ঘুরেছে। ‘সারহুল’ উৎসবে হো-মুণ্ডাদের সঙ্গে নেচেছে। ছোট্ট কিন্তু নিরুপদ্রব শান্ত এক জগতে নির্মোকের মধ্যে মানুষ হয়েছে। দিল্লি আহমেদাবাদে পড়তে যায়নি। বড়ো চাকরিও করবে না। ঘরোয়া বউ হবে। স্বাবলম্বনের নেশাতে মেতে অজানিতে উদ্ধত হয়ে উঠবে না। সে হয়তো খুশি হবে পরনির্ভরতাতেই। তার স্বামীর স্ত্রী, ‘হাউসওয়াইফ’ বলে পরিচয় দিতে সে, লজ্জিত হবে না। কর্বুরের সন্তানের মা হবে। কর্বুরের পছন্দসই রান্না করবে ছুটির দিনে। কর্বুরও তার হাউসওয়াইফ স্ত্রীর সবরকম সুখবিধান করবে। দু-জনে একসঙ্গে কবিতা পড়বে, রবীন্দ্রসংগীত গাইবে, আলুচাট এবং ঘুগনি খাবে। দু-জনেই দু-জনের ওপর প্রচন্ড নির্ভরশীল হবে। নির্ভরতা তো শুধু আর্থিক-ই হয় না, কত ব্যাপারেই মানুষ পরনির্ভর হয়।

আগেকার দিনে স্বামীরা রোজগার করত আর স্ত্রীরা ঘর সামলাত। দু-জনের সুস্থ ও খুশি দাম্পত্যজীবন, অবসর, হাসিগল্পের সময়, ছেলেমেয়েদের নিজের পছন্দমতো মানুষ করে তোলাতেই তাদের সব আনন্দ-আহ্লাদ ছিল। সন্তানদের মানুষ করার শিক্ষা নিয়েই ভাবতেন তাঁরা, তাদের নিছক টাকা রোজগারের মেশিন করে তোলাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। অর্থ আর সুখ যে সমার্থক নয়, এইসব কথা আজকালকার কম ছেলেমেয়ে এবং তাদের মা-বাবারাই বোঝেন। কর্বুরের মনে হয়, বিয়ের পরে সুখী আমাদের হতেই হবে, দু-জনের দু-জনকে মেনে নিতেই হবে, To burn the bridges behind অ্যাটিটিউড নিয়েই দম্পতিকে এগোতে হবে বিয়েকে সফল করার জন্যে। তাহলেই কথায় কথায় ছাড়াছাড়ি—বিচ্ছেদ হবে না। বিধাতা আর কোন মানুষকে সর্বগুণসম্পন্ন করে গড়েছেন? একজনের মধ্যে অন্যজন যা চায় তার সব সে কখনোই পাবে না, এটা মেনে নিয়েই অস্বস্তিটুকুকে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু গৈরিকা ঐশিকারা এতই উচ্চশিক্ষিত এবং উপার্জনক্ষম, তাদের কি অত ধৈর্য থাকবে মানিয়ে নেওয়ার? ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চললে সম্পর্কটা চিরদিন-ই প্রতিযোগিতার-ই থাকবে, পরিপূরক হয়ে ওঠা হবে না কখনোই একে অন্যের একজীবনে।

গৈরিকা শুয়েছে বাবার পাশে। বাবাকে ছেড়ে কিছুদিন পরেই চলে যাবে বলেই হয়তো বাবার একটু বেশি কাছে থাকতে চায় সে। কে যে কী করে, কেন করে, তা তো সে নিজে ছাড়া অন্য কেউই বোঝে না।

কর্বুর, বাংলোর গেট থেকে একটু দূরে মহুয়াগাছের নীচে একটা ইজিচেয়ার চৌকিদারকে দিয়ে আনিয়ে নিয়ে তাতে বসে আছে। তার কোলে রামচন্দ্র গুহর লেখা Savaging The Civilized বইটি খোলা আছে। ভেরিয়ার অ্যালউইনের ওপরে লেখা বই। শিখীই বইটি দিয়েছে কর্বুকে। মহড়া চলাকালীন।

এ ক-দিন, মানে, যতদিন মহড়া চলেছিল ‘মহড়া’ নাটকের, ততদিন যেন একটা নেশার মধ্যেই ছিল ও। নাটক মঞ্চস্থ হয়ে যাওয়ার পরে দুর্গাবাড়ির মন্ডপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সব-ই কেমন ফাঁকা-ফাঁকা। গোরু চরবে বাইরে, দুর্গাবাড়ির ভেতরে চড়ুইদের সভা, মাঝে মাঝে দাঁড়কাক অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের মতো এসে চড়ুইদের তাড়া দিয়ে যাবে। তেমন-ই হচ্ছে আজ নিশ্চয়ই।

চোখদুটো খোলা বইয়ের পাতাতে নিবদ্ধ ছিল কিন্তু বইয়ের পাতা সে দেখছিল না। দেখছিল, একটি কাঠবেড়োলি শরতের দুপুরের নরম রোদে কোথা থেকে কী একটা ফল নিয়ে এসে তাকে কবজা করার চেষ্টা করছে। রোদ আর ছায়ার ঝিলিমিলি চলছে নদীর জলে, ঘাসে পাতায়। বর্ষার পরে জল পেয়ে মহুয়াগাছের শাখাতে-উপশাখাতে পাতাগুলো সতেজ সবুজ হয়েছে। চোখ বইয়ের ওপরে পড়ছিল মাঝে মাঝে কিন্তু মন তার ঘাসফড়িং-এর মতো সেই আলোছায়ার শতরঞ্জির ওপরে এক্কা-দোক্কা খেলছিল। একা-একা।

হঠাৎ-ই চমকে উঠল, ‘কী করছেন?’ শুনে।

দেখল, ঐশিকা।

কখন যে গেট খুলে এতটা হেঁটে এসেছে, শব্দ পায়নি। শীত বা গ্রীষ্ম হলে শুকনো পাতার মচমচানি শুনতে পেত।

ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে উঠল কর্বুর।

বলল, বসুন।

ঐশিকা হাসল।

রহস্যময়ী হাসি।

সেই প্রথমবার ভালো করে লক্ষ করল কর্বুর ঐশিকাকে। খাবার টেবিলে ও পাশে বসেছিল। যে পাশে থাকে, তাকে ঠিকমতো দেখা যায় না। খাওয়ার টেবিলে অথবা জীবনেও। একে অন্যের মুখোমুখি হতে হয়। এই সত্যটা হঠাৎ হৃদয়ংগম করল ও।

—কী বই এটা?

—Savaging The Civilized.

—কার লেখা?

—রামচন্দ্র গুহ।

প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে ঐশিকা বলল, আপনি খাবেন?

—কী?

—হজমি।

—না।

—একটা না হয় আমার অনুরোধে খেলেন-ই।

—দিন। আপনারা দু-বোন দুপুরে খেলেন তো না, যেন শুঁকলেন। ওই খাবার হজম করার জন্যেই হজমি খেতে হচ্ছে?

—হজম করার জন্যে নয়।

—তবে খাচ্ছেন কেন?

—অব্যেশ।

ইচ্ছে করে ‘স’-কে ‘শ’র মতো উচ্চারণ করল।

ঐশিকা বলল, ইজিচেয়ারে না বসেই।

বলল, আপনি না বসলে, এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আমায় চলেই যেতে হয়। নাটক করে করে নাটুকে হয়ে গেছেন।

তারপর-ই বলল, আচ্ছা আমি না হয় ইজিচেয়ারের হাতলটার ওপরেই বসছি। যা লম্বা হাতল। ভেঙে যাবে না তো?

—ভাঙবে না। তবে হাতল না বলে পাতোল বলাই ভালো। সাহেবরা শিকার করে এসে ক্লান্ত হয়ে এই হাতলটা লম্বা করে দিয়ে পা তুলে দিয়ে আরাম করত।

—পা তুলে দিলে আরাম হয় বুঝি?

—হয় না? ব্লাড সার্কুলেশন রিভার্সড হয় তো। আরাম হতেই হবে। যেদিন থেকে হাঁটতে শিখি আমরা সেদিন থেকেই তো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ক্রমাগত রক্তকে টানছে নীচের দিকে। পা তুলে থাকলে হৃদয় আরাম পায়।

জিভ দিয়ে হজমিটাকে মুখের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে ঐশিকা হঠাৎ ‘টাক’ করে জিভ দিয়ে একটা শব্দ করল। আশ্চর্য! কাঠবেড়ালিটা এতক্ষণ ওদের কথাতে ভয় পায়নি একটুও। ওই ‘টাক’ শব্দতেই ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে গিয়ে একটা আমলকী গাছে উঠে গেল।

—কী সুন্দর! না?

ঐশিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল।

ঐশিকা একটু পরে বলল, সত্যি। আপনি কত জানেন। এমন জ্ঞানী পুরুষমানুষ আগে কখনো দেখিনি। এতদিন ভাবতাম, আমার বাপিই একমাত্র জ্ঞানী।

—আপনার বাপি কি পুরুষমানুষ নন?

—বাপি পুরুষমানুষ ছিলেন নিশ্চয়ই আমার মায়ের কাছে। আমার কাছে তিনি শুধুই বাপি। উভলিঙ্গ। বাবাও বটে মাও বটে।

তারপর বইটা তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই দেখতে পেল যে, শিখী দিয়েছে বইটা কর্বুরকে।

—শিখী কে?

—মান্ডুর রূপমতীর ভূমিকাতে যে মেয়েটি অভিনয় করেছিল। বললাম না আসার সময়ে!

—ওঃ। শি ইজ ভেরি গুড। দেখতেও যেমন সুন্দরী অভিনয়ও তেমন-ই ভালো করেন।

—আমার তো ধারণা মেয়েমাত্রই ভালো অভিনেত্রী।

—তাই?

—হুঁ।

—কেন মনে হয়?

—মনে হয়।

—বোকা বোকা হল কথাটা। আপনার মতো বুদ্ধিমানের মুখে মানাল না।

—আমি বুদ্ধিমান সেকথা আপনাকে কে বলল?

—বলেছেন অনেকেই।

—কে বলুন না?

—তাদের মধ্যে একজন পদ্মাদি।

—কাকির মতটা মত বলে ধর্তব্য নয়।

—আমি অন্যের মতে সায় দিই না কখনো। নিজের মতেই চলি।

—তাহলে বলছেন কেন?

—বলছি, নিজের মতটাও তাই বলছে বলে।

—কেন?

—আপনার মুখ-ই বলে যে, আপনি বুদ্ধিমান, আপনার চোখ, আপনার কথাবার্তা। কী পুরুষের কী নারীর, বুদ্ধির প্রসাধনের মতো কোনো প্রসাধন-ই আর নেই। বুদ্ধিই আপনার মুখটিকে প্রসাধিত করেছে।

—আপনারও।

—তাই? ভাগ্যিস বললেন।

—আপনি তো দেখছি খুব ওভার-কনফিডেন্ট নিজের সম্বন্ধে।

—নিজেদের ওপর কনফিডেন্স-এর অভাবেই তো মেয়েরা এত হাজার বছর ধরে আপনাদের তাঁবেদারি সয়েছে, এখনও সইছে ইসলামিক সব রাষ্ট্রে, তাই কনফিডেন্সটা মেয়েদের পক্ষে অত্যন্তই জরুরি।

ঐশিকা একবার ইজিচেয়ারের ডান হাতলে আর একবার বাম হাতলে বসছিল।

—আপনি তো ভারি চঞ্চল। মনে হয় কিণ্ডার-গার্টেনের ছাত্রী।

—তাই? ভালোই তো। যতদিন ছোটো থাকা যায়। বড়ো আর বুড়োর মধ্যে বিশেষ তফাত আছে কি? আজ যে বড়ো, কাল সে বুড়ো।

উত্তর না দিয়ে তাকিয়েছিল কর্বুর ঐশিকার দিকে।

বাঙালির তুলনায় বেশ লম্বা সে। একটা সাদা-কালো ডুরে তাঁতের শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউজ। শ্যাম্পু করা প্রায় হাঁটুসমান চুল মেলে দিয়েছে পিঠের পরে। কালো টিপ পরেছে একটা। অ্যানোডাইজ করা লোহার একটা মটর মালা গলাতে। ওইরকম-ই বড়ো বড়ো দানার বালা বাঁ-হাতে। ডান হাতে কালো ব্যাণ্ডের সাদা ডায়ালের হাতঘড়ি। দারুণ একটা খুশবু উড়ছে। তা ঐশিকার চুল থেকে, না মুখ থেকে, না কানের লতি থেকে, না স্তনসন্ধি থেকে বুঝতে পারছে না কর্বুর। কিন্তু খুশবুটা উড়ছে বিলক্ষণ।

শিখীর পারফিউমের কথা মনে হল কর্বুরের। Red door। কিন্তু এই গন্ধটা আরও অনেক গাঢ়, প্রায় ঐন্দ্রজালিক।

—কী পারফিউম মাখেন আপনি?

—আমি ভারতীয় নারী। আতর মাখি। জীবনে বিদেশি পারফিউম মাখিনি।

—সত্যি?

—এটা আতরের গন্ধ? কী নাম এই আতরের?

—ভালো লেগেছে আপনার?

—হুঁ।

—এর নাম ‘ফিরদৌস’। ভালো লাগলেই ভালো। পৃথিবীর সব গন্ধই তো পরপ্রত্যাশী।

—অনেকরকম হয় বুঝি আতর?

—নিশ্চয়ই। এক এক ঋতুতে এক এক আতর মাখতে হয়। তবে নিজের নিজের রুচি মতোই মাখতে হয়। যেমন আপ রুচিসে খানা, পর রুচিসে পিনা তেমন-ই প্রেমিক বা প্রেমিকা যে, গন্ধ ভালোবাসে সেই সুগন্ধিতে সুরভিত হওয়াই রেওয়াজ।

—যখন প্রেমিক বা প্রেমিকার মন জানা থাকে না?

হেসে ফেলে ঐশিকা বলল, তখন আপ রুচিসে। যেমন, আমি মেখেছি।

কর্বুর লক্ষ করল যে হাসলে, ঐশিকাকে আরও অনেক বেশি সুন্দরী লাগে।

—কী কী আতর হয়?

জিজ্ঞেস করল কর্বুর।

—কতরকম। গরমে ‘থসস’, ‘হিম্বা’, ‘গুলাব’, শীতে ‘অম্বর’, ‘মুশক’, বসন্তে ‘রাত-কি রানি’, ‘জুঁই’ আরও কতরকম আছে।

—কেনেন কোত্থেকে?

—আতরওয়ালা আসে জৌনপুর থেকে বছরে একবার। দিল্লি, মুম্বাই, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, ভোপাল, হায়দরাবাদ, ইলাহাবাদ নানা জায়গাতেই পাওয়া যায়। যে শহরেই একটি করে চাঁদনি-চওক আছে সেই শহরেই জানবেন আতরের দোকানও আছে অনেক। এটা তো মুসলমানি সংস্কৃতি। আসলে খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা, শিল্প-টিল্প, সুরভি-টুরভির চর্চা মুসলমানেরাই হিন্দুদের চেয়ে অনেক-ই বেশি করেছে। রাজা-মহারাজাদের চেয়ে নবাব-বাদশাদের দাপট তো প্রবলতর ছিল দিল্লির দরবারে।

বলেই বলল, বা:। দারুণ লিখেছে তো আপনার শিখী?

—কী?

অবাক হয়ে বলল কর্বুর।

কর্বুরদা, ‘কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে’—শিখী।

—কই? তাই লিখেছে বুঝি? দেখি।

অবাক এবং একটু লজ্জিত হয়ে বলল কর্বুর।

দেখুন।

বলে, বইটা এগিয়ে দিল কর্বুরের দিকে।

তারপরেই বলল, বেচারি শিল্পী। যাকে এমন ট্যানজেন্ট-এ প্রেম নিবেদন করল সেই জানল না। হতভাগিনী আর কাকে বলে।

কর্বুর রেগে গেল।

বলল, প্রেম নিবেদন করবে কেন? নিশ্চয়ই কারও কবিতা কোট করেছে।

তা তো নিশ্চয়ই। নিজমুখে যে কথা বলতে সংকোচ হয় সেকথা পরের গাওয়া গান বা লেখা কবিতা দিয়েই বলে এসেছে চিরদিন-ই মানুষ একে অন্যকে। তবে কবিতা নয়, ওটি একটি গান। এবং অবশ্যই প্রেমের গান। আপনিই তো বললেন...

তারপর একটু থেমে ভেবে বলল, আপনিই বললেন কি? না, পদ্মাদি? যে শিখী আগ্রা ঘরানার হেরম্ব চ্যাটার্জির কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখে।

বলেই বলল, কিন্তু ওই গানটি তো উচ্চাঙ্গ সংগীত নয়।

—তবে? নিম্নাঙ্গ-সংগীত?

কর্বুর বলল।

খুব জোরে হেসে উঠল ঐশিকা। ওর উচ্চকিত হাসি শুনে কাঠবেড়ালিটা আমলকী গাছ থেকে নেমে এসে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে একটা কেলাউন্দার ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।

—এইজন্যেই বিজ্ঞজনেরা বলেন যে, কখনো রেগে উঠতে নেই। তবে যাই হোক, রাগের মাথায় বলে ফেলা আপনার কথাটা এবারে চালু করে দেব। নিম্নাঙ্গ সংগীত। দারুণ।

ঐশিকা বলল।

তারপর বলল, ওই গানটা শোনায়নি আপনাকে শিখী কখনো?

না তো।

—শুনবেন? আমি জানি। শিখীর তরফে আপনাকে শোনাতে পারি যদিও শিখী জানতে পারলে রাগ করবে হয়তো।

—কেন? রাগ করবে কেন?

—বা, তার তূণের তির আমার.....

—আপনি বড়োই ফেনিয়ে তোলেন।

বিরক্তির গলাতে বলল কর্বুর।

—কী করব। নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ তুলতে হলে কিছু তো একটা করতে হয়ই।

কর্বুর বুঝতে পারছিল যে, ভেতরে ভেতরে সে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঐশিকা সত্যিই সুন্দরী। এতখানি সুন্দরী যে, তা আশ্চর্য! আগে একটুও বুঝতে পারেনি। তা ছাড়া সুন্দরীই শুধু নয়, প্রচন্ড রসবোধসম্পন্ন এবং রীতিমতো বুদ্ধিমতীও। দুষ্টুও আছে বেশ। কর্বুরের কলেজের বন্ধু বিনোদানন্দন পান্ডে মেয়েদের মধ্যে যে, গুণটিকে ‘নামকিন’ বলত সেই গুণটিও তার মধ্যে যেন অধিক পরিমাণেই বিদ্যমান। সত্যি কথা বলতে কী, ঐশিকা যে কেন কাকিকে এমন করে বশ করেছে এখন তা বুঝতে পারছে একটু একটু। এতদিন বেশি মেয়েদের সঙ্গে মেশেনি যে কর্বুর, তা ঠিক-ই, মেয়েদের সম্বন্ধে তেমন কোনো বিশেষ আকর্ষণ বা ঔৎসুক্যও ছিল না। কাকিই ছিল তার ধারণা, মেয়েদের সম্বন্ধে। ঐশিকা যেন প্রথম বর্ষার ঝরনার বান-এর মতো সেইসব ধ্যান-ধারণা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের নীচের মাটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভাবনার কথা, এ পর্যন্ত অন্য কারওকেই দেখে বা কারও সঙ্গেই মিশে এমন শারীরিক আকর্ষণ বোধ করেনি আগে। ভেতরে ভেতরে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে, নিজের সম্বন্ধে বেশ উচ্চধারণাসম্পন্ন কর্বুর সেন।

কর্বুর চুপ করেই ছিল।

শরতের দুপুর। প্রকৃতির মধ্যে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, বুনোহাঁস যেমন অবলীলায় নদীর বালি ছেড়ে জলে নামে এতটুকু ঢেউ না তুলে, তেমন করে। একটা কপারস্মিথ পাখি ডাকছে নদীর এপার থেকে। স্যাকরার মতো ঠুকঠাক করছে। আর ওপার থেকে তার দোসর সাড়া দিচ্ছে। আর একটু বেলা পড়ে এলেই র‌্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো তাদের ধাতবগলার তীক্ষ্ণডাক ডাকতে শুরু করবে। দিনশেষে নদীর ওপরে চমকে চমকে ডেকে বেড়াবে ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ।

সেইসময়ে হঠাৎ-ই একঝাঁক বুনোহাঁস নদীর বাঁধের জলে উড়ে এসে বসল।

—ওগুলো কী পাখি?

ঐশিকা শুধোল।

—জলের পাখি। বুনোহাঁস।

—নাম কী?

—কটন টিল।

—কোথায় ছিল?

—কে জানে?

—প্রতিবছর শরতের গোড়া থেকেই ওরা পৃথিবীর সব শীতার্ত দেশ থেকে উড়ে আসতে আরম্ভ করে আমাদের দেশে।

—কেন আসে?

—একটু উষ্ণতার জন্যে।

—তাই? হাঁসেরাও মানুষদের-ই মতো তাহলে।

—ওই নামের একটি উপন্যাস আছে। পড়েছেন কি? ম্যাকলাস্কিগঞ্জের পটভূমিতে লেখা। আমার খুব প্রিয় উপন্যাস।

কর্বুর সামনে বসে থাকা ঐশিকার চোখে চেয়ে বলল।

—তাই? কিন্তু পড়িনি।

—তারপর-ই কথা ঘুরিয়ে ঐশিকা বলল, স্যার বইটা পড়ে ফেলুন।

—স্যার কেন? আমি কি মাস্টারমশাই?

—না সেজন্যে নয়। আমি যে, টিভি কোম্পানিতে জয়েন করছি একমাস বাদে, সেখানকার নিয়ম রপ্ত করছি। আমার মালকিন বলে দিয়েছেন, যাকেই ইন্টারভিউ করতে যাবে তিনি গোরু-ছাগল হোন কী প্রচন্ড প্রতিভাধর, সকলকেই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করবে। অথবা ‘ম্যাডাম’। আর সবসময়েই পুরুষদের একটা বিশেষ দূরত্বে রাখার চেষ্টা করবে। পুরুষেরা হনুমানের জাত। দড়ি ঢিলে দিলেই ঘাড়ে এসে উঠবে। বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিকেরা। খুব সাবধানে হ্যাণ্ডল করবে তাদের।

—তার সঙ্গে আমার কী?

—না। বললাম-ই তো, ‘স্যার’ বলাটা প্র্যাকটিস করছি আর কী।

তারপর বলল, ওই হাঁসেরা কোন কোন দেশ থেকে আসে?

—কত দেশ। সাইবেরিয়া, রাশিয়া, বেলো-রাশিয়া, নর্ডিক-কান্ট্রিজ। প্রতিবছর-ই আসে আবার গরম পড়বার আগে আগেই ফিরে যায়। সব পরিযায়ী পাখি এরা।

—‘পরিযায়ী’ মানে কী?

—মানে?

—মানে কী?

—ও। ইংরেজি প্রতিশব্দ না বললে তো আজকালকার উচ্চশিক্ষিত বাঙালিরা মানে বোঝেন না অনেক বাংলা শব্দের-ই। কী বিপদের কথা।

—ওঃ। আপনি বাপিকেও হার মানাবেন দেখছি সার্মোনাইজিং-এ।

কর্বুর বলল, মাইগ্রেটরি। Migratory। বানান করে বলল তারপরে।

—কী কী হাঁস আসে?

—বললাম না, কত হাঁস। গার্গনি, পিনটেইল, ম্যালার্ড, পোচার্ড, পিংক-হেডেড পোচার্ড, গিজ, শোভেলার, বাহমিনি ডাকস, যাকে সংস্কৃতে বলে ‘চক্রবাক’ আর বাংলাতে ‘চখাচখি’ আরও কত পাখি।

—আপনি পাখি সম্বন্ধে যত জানেন গোরু-ছাগলদের সম্বন্ধেও কি ততই জানেন?

কর্বুর সাবধান হয়ে গেল।

—বলল, হঠাৎ এই প্রশ্ন?

—না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। পরক্ষণেই বলল, কিন্তু এখানে জল কোথায়?

—এই সাতশো পাহাড়ের দেশে আকাল তো আছেই, এইসব জলের পাখি, জলা জায়গাতেই আসে, নানা হ্রদ-এ, ঝিলে-বিলে-বাদায়। ডাঙার পাখিও আছে অনেক, পরিযায়ী, মানে ‘মাইগ্রেটরি’। সারাণ্ডায় কোয়েল, কারও, কয়না ছাড়া নদী নেই। আর সেও সব পাহাড়ি নদী। জলের পাখি এখানে বেশি আসবে কেন?

—উষ্ণ হয়ে গেলেই তারা আবার ফিরে যায়?

—হ্যাঁ তাই। শুধু পাখিই কেন। মানুষও তো একটু উষ্ণতার জন্যেই ঘুরে মরে সারাজীবন।

—তা ঠিক। কিন্তু আমি আবার এমন মানুষও দেখেছি, বিশেষ করে পুরুষমানুষ, তারা তপ্ত খোলাতে হর্স-চেস্টনাট-এর বীজের মতো ভাজা হওয়ার পরও তাদের শীত কাটে না।

কর্বুর ঐশিকার দেওয়া বাম্পারটা খেলবে ঠিক করল। বলল, প্রয়োজনের তুলনাতে এবং বয়েসের তুলনাতে আপনার অভিজ্ঞতা একটু বেশি হয়ে গেছে। আপনার সারল্য চলে গেছে। আপনি টোটালি কনফিউজড হয়ে গেছেন। ব্যানার্জিসাহেব আপনাকে আদরে একেবারে গোবর করেছেন।

—অসার অথবা অসাড় যারা, তাদের তো ফুল-ফোটাবার জন্যে গোবরের সার-ই লাগে। কি? লাগে না?

কর্বুর চুপ করে থাকল।

—কী জ্যাঠামশায়ের মতো হাতল ইজিচেয়ারে বসে আছেন আপনি। চলুন-না নদীর দিকে একটু বেড়িয়ে আসি। চৌকিদার তো বলছিল, অন্ধকার হলেই গেট থেকে বেরোনো মানা।

—রাতে, জিপে করে বেরোব আপনাদের নিয়ে। সঙ্গে স্পটলাইট নিয়ে এসেছি। অনেক কিছু জানোয়ার দেখতে পাবেন।

—তাই? কিন্তু সে তো রাতে। আর্টিফিশিয়াল আলোতে। দিনের বেলায় দেখার মতো আনন্দ তো হবে না।

—তা হবে না। কিন্তু আপনি যতই সুন্দরী হোন না কেন, জানোয়ারদের তো আপনার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আপনাকে দেখতে বা দেখা দিতে তারা আড়াল ছেড়ে বেরোবে কি? তা ছাড়া এইসব অঞ্চলে হাতি অনেক। এবং ভাল্লুকও। এরা আনপ্রেডিকটেবল। প্রতিবছর-ই অনেক মানুষ মারা যায় এখানে তো বটেই, কিরিবুরু, গুয়া, মেঘাতিবুরু, নোয়ামুন্ডির খাদান এলাকার আশেপাশে।

—ধ্যুৎ। আপনি একটি রিয়্যাল জ্যাঠামশাই। ভয়েই মরলেন। আমি একাই যাচ্ছি।

—এখানে চুপ করে বসুন। বনের মধ্যে কতরকম শব্দ, গন্ধ, শুনুন, অনুভব করুন। জানেন কি? দেখা দুরকম হয়। এক, নিজে দৌড়ে বেরিয়ে দেখা আর দুই...।

বাংলোর গেট থেকে গৈরিকা চেঁচিয়ে বলল—ওই। তুই ওখানে। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আচ্ছা মানুষ তো তুই।

—তুইও আয় না দিদি।

গলা তুলে বলল, ঐশিকা।

তারপর বলল, তারপর?

—তারপর কী?

—ওই যে বলছিলেন, দুরকম দেখার কথা। দ্বিতীয়রকম দেখার কথা তো বললেন না।

—ও হ্যাঁ।

—নিজে বসে থেকেই যা কিছু দেখার, শোনার, গন্ধ নেওয়ার, সেসবকেই ধীরে ধীরে নিজের কাছে উঠে আসতে দিতে হয়, শীতের রাতে কুয়াশা যেমন নীচের খাদ থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে তেমনি করেই প্রকৃতিও তার সব রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ নিয়ে আলতো পায়ে এসে আপনার কাছে ধরা দেবে, নি:শর্তে।

ঐশিকা হাততালি দিয়ে উঠল।

চমকে উঠল কর্বুর।

গৈরিকা কিছুটা এগিয়ে এসেছিল, বলল, কী হল?

—কী হল না, তাই বল। আরে ইনি তো পোয়েট। যা একখানা বর্ণনা দিলেন না। দ্বিতীয়রকম দেখার।

—কী বলছিস কী?

গৈরিকা আরও এগিয়ে এসে কর্বুরকে বলল, ‘হাই’।

—হাই!

বলল, কর্বুর।

—বাবা: আপনিও দেখি আমেরিকান হয়ে গেলেন। দিদি না হয় আমেরিকা যাবে বলে যাকে তাকে ‘হাই! হাই’! বলে প্র্যাকটিস করছে।

—চাকরি করবেন বলে আপনিও যেমন যাকে তাকে ‘স্যার’ বলে যাচ্ছেন।

কর্বুর বলল।

ঐশিকা হেসে বলল, আহা। উপায় কী আছে? ভালো চাকরি। দারুণ স্যালারি দেয়। চাকরিটা রাখতে হবে তো। তাই ‘স্যার’ বলা প্র্যাকটিস করছি। দোষ হয়েছে কি?

—‘কীরে! তুই এখনও আপনি-আজ্ঞে করে যাচ্ছিস?’ ব্যাপার তো ভালো মনে হচ্ছে না।

—কী করা যাবে। উনি যে স্যার।

ঐশিকা বলল।

কর্বুর বলল, দূরে রাখাই ভালো ‘আপনি আজ্ঞে’ করে। পুরুষমাত্রই তো হনুমানের জাত।

—ওকথা তুই ওঁকেও বলেছিস।

—কথাটা আমার নয়, আমার মালকিনের।

—সত্যি, ওই, তুই ইনকরিজিবল। তুই এসেই, ওঁর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিস?

খুব-ই ঝগড়াটি বুঝি উনি?

কর্বুর, গৈরিকার দিকে চেয়ে বলল।

—সে আর বলতে। সেই ছেলেবেলা থেকেই।

—মেয়েবেলা বল দিদি।

—ওই হল।

—লক্ষণসমূহ দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়েবেলা শেষ হয়নি এখনও।

কর্বুর বলল।

ঐশিকা বলল, এখন-ই শেষ হবে কী? সারাজীবন ধরে চলবে আমার মেয়েবেলা। আমি কোনোদিন বুড়ি হব না।

বলেই, গৈরিকাকে বলল, দিদি, তুই আমাকে বলছিস। আমার কী দোষ বল? আমি ওঁকে এদিক ওদিক খুঁজে দেখি, আমাদের ছায়া পাছে মাড়াতে হয়, তাই উনি বাংলো থেকে এতদূরে এই পেল্লায় গাছের নীচে হাতল-দেওয়া ইজিচেয়ারে বসে কোলের ওপরে একটা বই রেখে উদাস হয়ে চেয়ে আছেন দূরে। ছবিটা ভালো লাগল। নানারকম পাখি ডাকছে। কাঠবিড়ালি দৌড়াদৌড়ি করছে, সুগন্ধ থমথম করছে চারদিকে, তারইমধ্যে স্যার এত উদাস কেন তাই দেখতে এসে কারণটা আবিষ্কার করলাম।

—কী কারণ?

গৈরিকা একইসঙ্গে ঐশিকা আর কর্বুরের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল।

—কারণটি ওই বইয়ের মধ্যে আছে। শিখী, ওরফে মান্ডুর রূপমতী স্যারকে লিখেছেন:

কর্বুরদা, ‘কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে।’

—তাতে তোর কী হয়েছে?

দিদিগিরি ফলিয়ে গৈরিকা দেড় বছরের ছোটোবোনকে বলল।

—আমার কিছুই হয়নি। কিন্তু হতে তো পারত।

—এমন হেঁয়ালি কথা আমার ভালো লাগে না। আপনার লাগে?

উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই বলল, কর্বুর কারও নাম হয়? বলব বলছিস? আমিও স্যার?

—বলছিই তো।

—যদি বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেন।

—দেন তো দেবেন। যদির কথা নদীতে ফ্যাল। আমি তাহলে স্যারের মনের অবস্থাটা বর্ণনা করার জন্যে রবে ঠাকরের একটা গান-ই গেয়ে ফেলি।

—রবে ঠাকরেটা আবার কী ব্যাপার?

—মহারাষ্ট্রের বাল ঠাকরে আর আমাদের রবে ঠাকরে। দুই জাতের আইডেন্টিফিকিশেন মার্ক। বলেই, গান ধরে দিল ঐশিকা—

‘হেলাফেলা সারাবেলা একী খেলা আপন সনে।

এই বাতাসে ফুলের বাসে-মুখখানি কার পড়ে মনে।।

আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি কে জানে গো কাহার হাসি।

দুটি ফোঁটা নয়নসলিল রেখে যায় এই নয়নকোণে।।

কোন ছায়াতে কোন উদাসী দূরে বাজায় অলস বাঁশি,

মনে হয় কার মনের বেদন ভেসে বেড়ায় বাঁশির গানে।

সারাদিন গাঁথি গান কারে চাহে, গাহে প্রাণে—

তরুতলে ছায়ার মতন বসে আছি ফুলবনে।।

গান শেষ হলে তিনজনেই অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল।’

গান, যদি তেমন ভালো গাওয়া হয়, তবে তার অভিঘাত চুমুর মতন বা থাপ্পড়ের মতনও হতে পারে। শ্রোতাকে তা স্তব্ধ করে দেয় একেবারে।

নিস্তব্ধতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে কী একটা পাখি পাগলের মতো ডেকে উঠল। পেছনের জঙ্গল থেকে।

দুই কন্যাই চমকে উঠল সেই ডাকে।

—কী পাখি ওটা?

—হুপী।

কর্বুর বলল।

—বা: বা:। ভয় পেয়ে গেছিলাম।

গৈরিকা বলল।

—সত্যি। আপনি কত কী জানেন স্যার। আপনাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।

ঐশিকা বলল।

—আমিও তাই। একইসঙ্গে এত রূপ। আপনার গান শুনতে শুনতে ভাবছিলাম যে, যে মেয়ে এত ভালো, মানে এইরকম ভাবের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে, সে এমন ইংরেজি-নবিশ হয় কী করে! ‘পরিযায়ীর’ মানে, যাকে Migratory বলে বোঝাতে হয়।

—হয়। হয়। আসলে জানতে পারেন না। একজন মানুষের মধ্যে অনেকজন মানুষ থাকে। আপনি পৃথু ঘোষকে চেনেন না?

—বাবা:। আপনি আবার ‘মাধুকরী’ও পড়েছেন দেখছি। বাংলা সাহিত্যও পড়েন?

—হ্যাঁ স্যার। পৃথু ঘোষ বলেনি কি ওয়াল্ট হুইটম্যানকে উদ্ধৃত করে?

—কী?

Do I contradict myself?

Very well then...I contradict myself

I am large...I contain multitudes.

 

সাত

 

রাতে ওরা খেতে বসেছিল।

পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে হুড-খোলা জিপে, সামনে উইণ্ডস্ক্রিনের কাচ বনেটের ওপরে নামিয়ে দিয়ে গেলে এপ্রিল মাসেও শীত লাগে। আর এখন তো অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ। জঙ্গলে তো বটেই এমন উদলা-উদোম জিপেও তো ওরা অভ্যস্ত নয়। তাই হাড়-মজ্জার মধ্যেও শীত ঢুকে গেছে। হি-হি করছে ওরা শীতে। মনে হচ্ছে, ব্যানার্জিসাহেবের কন্যাদের রাফিংয়ের শখ বোধ হয় একরাতেই উবে যাবে। তবে কর্বুর তৈরি হয়েই গিয়েছিল। ব্যানার্জিসাহেবকেও সকন্যা তৈরি হয়েই আসতে বলেছিল কাকুর মাধ্যমে। তবুও তাঁরা একটি করে হালকা শাল নিয়ে এসেছেন শুধু। তার-ই অর্ধেক মাথায় জড়িয়ে আর বাকি অর্ধেক ঊর্ধ্বাঙ্গে পাক মেরে তাঁরা কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচিয়েছেন।

নয়নতারা মেয়েদের পাছে সর্দি লাগে, তাই ফিরে এসেই গরম জলে একটি করে ভিএসওপি কনিয়াক গিলিয়ে দিয়েছেন তাদের। নিজেও পাতিয়ালা পেগ ঢেলে খেয়েছেন। জবরদস্ত পুরুষমানুষ।

মদ খেলেই কেউ জবরদস্ত পুরুষমানুষ হন না। তবে কিছু কিছু পুরুষ আছেন যাঁরা অন্যের ওপরে কোনো জবরদস্তি করেন না বলেই সহজেই বোঝা যায় যে, তাঁরা জবরদস্ত। ব্যানার্জিসাহেব নিজে কোনোই গরম জামা নিয়ে আসেননি। গলায় একটি সিল্কের স্কার্ফ। ফেডেড জিনসের টপ এবং ট্রাউজার তাঁর পরনে ছিল। মাথার আধখানাই টাক তাই মাথার ওপরে সাদা রঙা টুপি ছিল। তাও গলফ-খেলার টুপি—। গরম টুপি নয়। জিপে ওঠার আগে অবশ্য একটি ডাবল স্কচ মেরে গিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি, হুইস্কি-সোডা পেটে আছে শীতে করবে কী?’’ ‘জন হেইগ-ই’ ওঁর প্রিয় স্কচ। থাকবেন তিনরাত কিন্তু পাছে অতিথ-বিতিথ আসে এবং কর্বুর বেশি খায়, তাই অ্যাজ আ মিজার অফ অ্যাবাডান্ট প্রিকশান, আধ কেস অর্থাৎ ছ-বোতল হুইস্কিই নিয়ে এসেছেন।

কর্বুর ওসব খায় না শুনে তিনি হতাশ হয়েছেন। বলেছেন, তুমি কী গো ছেলে! ইফ উই ডোন্ট ড্রিঙ্ক দেন হোয়াটস দ্যা পয়েন্ট ইন লিভিং?

কর্বুর হেসে বলেছিল, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আই হ্যাভ আ লট অফ আদার রিজনস ফর লিভিং।

—দ্যাটস ভেরি গুড। তুমি অপছন্দ করো না তো, যাঁরা খান তাঁদের?

—বারে:, তা কেন করব? যে যাঁর নিজস্ব মতে চলবেন।

উনি বলেছিলেন, ফাইন। তুমি তো দেখছি সিগারেটও খাও না। কোনো নেশা নেই? বুড়োবয়সে তো তুমি রক্ষিতা রাখবে দেখছি। যৌবনের বেশি-ভালোরা প্রৌঢ়ত্বে এসে বেশি-খারাপ হয়।

—কী হচ্ছে বাপি। তুমি ওঁর লোকাল গার্ডিয়ান, না উনি তোমার সমবয়েসি? তোমাকে নিয়ে সত্যিই চলে না। তুমি সত্যিই ইনকরিজিবল।

—সরি সরি। আই অ্যাপলোজাইজ। তুমি কিছু মনে করলে না তো ভায়া?

—না, না।

হেসে বলল কর্বুর।

ভাবল, পোটেনশিয়াল জামাইকে কেউ ‘ভাই’ বলে এমন শোনেনি কখনো আগে।

তখনও কন্যারা ভীষণ-ই উত্তেজিত ছিল। তাদের বাবাও কম নন। রহমত চাচা আর চৌকিদার মিলে রান্না করেছে। ওরা সকলে খাবার টেবিলে এসে বসল খাবার ঘরে। মুচমুচে করে আটা ও ময়দা মেশানো পরোটা, ঝাল-ঝাল আলুর তরকারি, মেটে-চচ্চড়ি, মধ্যে টিনের আনারস দেওয়া, শুখা-শুখা বেগুন ভাজা এবং শেষে ফুটপুডিং।

মেনুটা অবশ্য কর্বুর-ই ঠিক করেছে। বাজারও করিয়েছিল। ওই-ই মেয়েদের জন্যে পেপসির বোতল এনেছে বড়ো বড়ো।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, পাঁঠার মাংস তো অনেক-ই আছে। কাল আমি দুপুরে তোমাদের হাঙ্গারিয়ান গুলাশ রেঁধে খাওয়াব।

—বেশ।

ঐশিকার শীত যেন তখনও কাটেনি। ওকে শীতে কষ্ট পেতে দেখে কর্বুরের শরীরে এক ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। কোনো যুবতী শীতে কষ্ট পাচ্ছে আর কোনো যুবক তা দেখেও তাকে উষ্ণ করে তোলার চেষ্টা করছে না, এই অবস্থাটা সেই পুরুষের পক্ষে বড়োই কষ্টকর। ওর ইচ্ছে করছিল ঐশিকাকে বুকের মধ্যে খুব জোরে জড়িয়ে ধরে, খুব করে চুমু খেয়ে দিয়ে তার দু-হাতের পাতা নিজের দু-হাতের পাতা দিয়ে ঘষে-ঘষে তাকে উষ্ণ করে তোলে। এমন যে, কখনো হতে পারে, তা আগে জানেনি কখনো। কর্বুর তার জাগতিকার্থে অসামাজিক, অতিপরিশীলিত, সুরুচিসম্পন্ন, বিদগ্ধ সত্তাকে নিয়ে অত্যন্তই গর্বিত ছিল এতগুলো বছর। কাকির ঘনিষ্ঠ সঙ্গ, তাদের ‘টাটিঝারিয়ার’ নির্জন পরিবেশে মাঝে মাঝে শরীরের মধ্যে একরকম ছটফটানি যে, বোধ করেনি তা নয়, গরমের দুপুরে ধুলোবালির মধ্যে পুরুষ চড়াইয়ের ছটফটানির মতো, কিন্তু সেই আর্তি এমন তীব্র কোনোদিন-ই ছিল না।

পরিবেশ-ই কি এজন্যে দায়ী? হয়তো তাই। এই শারদরাতের শিশিরভেজা পাহাড়বেষ্টিত বনে, ঝিঁঝিদের একটানা ‘ঝিঁ-ঝিঁ’ শব্দের মধ্যে বন থেকে ওঠা এক নিবাত নিষ্কম্প নিষিদ্ধ মিশ্রগন্ধের প্রতিবেশে ওরও শরীর বলে যে, একটি যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার আছে, যে ব্যাপারটিকে সে আবাল্য, অজানিতে অনবধানে বয়ে বেড়িয়েছে তার মঞ্জরিত সুগন্ধি মনের-ই সঙ্গে, সে কথা আজ এই ভরা-যৌবনের আতরগন্ধী শীতার্ত দূতীকে দেখে সে যেন হঠাৎ করেই বুঝতে পেরেছে। এবং পেরে অপ্রতিভ এবং লজ্জিতও হয়েছে।

পৃথু ঘোষ হয়তো ঠিক বলেছিল, একজন মানুষের মধ্যে অনেক-ই মানুষ থাকে। তার ভেতরের কোন মানুষটি যে, কখন কোন পরিবেশে এবং প্রতিবেশে হঠাৎ তার মগ্নসত্তার বাইরে বেরিয়ে এসে অন্য মানুষটিকে হকচকিয়ে দেয়, তা পূর্বমুহূর্তেও জানা থাকে না। মানুষ হয়ে জন্মানো এক মস্ত ব্যাপার। সব মানুষ-ই কি তাদের মনের মধ্যে এবং শরীরের মধ্যেরও এইসব মনুষ্যজনোচিত ক্রিয়া-বিক্রিয়া, ঘাত-প্রতিঘাত, ভয় ও বিস্ময়কে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারে? নাকি, জানোয়ারের-ই মতো ভক্ষণ-শয়ন-রমণের বৃত্তর মধ্যে জীবন কাটিয়েই চলে যায়, ‘মানুষ’ হয়ে জন্মাবার ও বেঁচে থাকার আশ্চর্য সব পরস্পর-বিরোধী অনুভূতির শরিক না হয়েই?

কে জানে! সব প্রশ্নের উত্তর তো কর্বুরের কাছে নেই। সব প্রশ্নের উত্তর যার জানা আছে, সেই রবীন্দ্রনাথ বা ঐশিকার ভাষায়, ‘রবে ঠাকরের’ গান অটো-রিভার্স কম্প্যাক্ট ডিস্কের-ই মতো কে যেন বাজিয়ে দিল তার বুকের মধ্যে। ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না, ফুরাবে না/সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা/কত জনম মরণেতে তোমার এই চরণেতে/আপনাকে যে দেব তবু বাড়বে দেনা/আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।’

তখনও ওরা খাবার টেবিলেই বসে। চৌকিদার এসে তার বহুদিনের পরিচিত কর্বুরকে বলল, কবু দাদা, আপনারা যখন ঘুমিয়ে থাকবেন তখন যদি সেই হাতিটা আসে বাংলোর পাশে, তখন ঘুম ভাঙিয়ে দেব কি?

—আমার ঘুম ভাঙিয়ো না। তবে মেমসাহেবকে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ো। হাতি তো দেখতে পাননি ওঁরা। রাতের বেলা না দেখতে পেয়ে ভালোই হয়েছে। রাতে তাই হাতি এসে এঁদের দেখা দিয়ে গেলেই আমাদের মান থাকবে।

—দেখি দাদা। কালও তো এসেছিল। ব্যাটা রোজ এককাঁদি করে কলা বা অন্য যা কিছু পায় সাবড়ে দিয়ে যায় শুঁড়ে করে। নিতান্ত কলা-হারাম না হলে আজকেও এসে আমাদের ইজ্জত তো বাঁচানো উচিত।

ব্যানার্জিসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কথাটা কী বলল চৌকিদার?

—কলা-হারাম।

কর্বুর বলল।

ওরা সকলে হেসে উঠলেন।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেন্স অফ হিউমার আছে।

—আচ্ছা ওই যে কাঠ-কয়লার আগুনের মতো লালচোখো পাখিগুলো জিপের চাকার-ই নীচে পড়ে, ‘গেল গেল’ করতে করতেও জিপ তাদের চাপা দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পথ থেকে প্রায় জিপের বনেট ফুঁড়ে সোজা উঠে ডান বা বাঁ-পাশের দুদিকে উড়ে যাচ্ছিল সেই কিম্ভূতুড়ে পাখিগুলোরনাম কী? ভারি সুন্দর লাগে কিন্তু ওদের লাল চোখগুলো।

গৈরিকা প্রশ্ন করল।

—হ্যাঁ তা লাগে। ওদের নাম ‘নাইটজার’। যদি বড়ো বাঘের সঙ্গে আমাদের দেখা হত তবে দেখতেন চোখ কতখানি ভূতুড়ে হতে পারে। অনেক-ই বড়ো বড়ো চোখ, তবে ঠিক নাইটজারের চোখের মতোই লাল। আর যখন মাথা ঘোরায় বাঘ, সেই আলো যেন কোনো অদৃশ্য পুরুষ এসে অন্ধকার দিয়ে মুছিয়ে দেন। নিভিয়ে দেন না কিন্তু। মুছিয়ে দেন। নিজের চোখে না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না।

—যে প্রকান্ড সাপটা আস্তে আস্তে পথ পেরোচ্ছিল তার তো কোনো ফণা ছিল না। ওটা কী সাপ?

ঐশিকা বলল।

তারপর বলল, মুখে যে কলুপ এঁটে থাকার অর্ডার দিয়েছিলেন, তাই তখন তো কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

—সব সাপের তো ফণা থাকে না। যাদের থাকে, তারাও মানুষদের মধ্যে যাঁরা পন্ডিত, তাঁদের পান্ডিত্যের ফণার মতো সবসময়েই তো ফণা উঁচিয়ে থাকে না! তবে যে সাপটিকে আজ আমরা দেখলাম তাদের ফণা থাকেই না। সাপটা পাইথন। বাংলায় যার নাম ‘অজগর’।

—‘অ-য় অজগর আসছে তেড়ে।’ সেই অজগর?

গৈরিকা বলল।

—হ্যাঁ।

—একটা পাখি যে, ডাকল হার্ট-ফেইল করিয়ে দিয়ে ‘দুরগুম-দুরগুম-দুরগুম’ শব্দ করে নদীর ধারের ঘন বনের মধ্যে থেকে, সেটা কী হে?

—সেটা তো পেঁচা।

—পেঁচা? পেঁচা হতেই পারে না।

ঐশিকা বলল।

তারপর বলল, পেঁচার ডাক তো আমাদের জামশেদপুরের নীলডিতেও শুনতে পাওয়া যায়। যায় না বাপি?

—তা যায়।

—পেঁচা ডাকে ‘কিঁচি-কিঁচি-কিঁচর-কিঁচি—কিঁচর’। ঘুরে ঘুরে উড়ে ঝগড়া করে। আমাদের ওখানে কখনো-কখনো লক্ষ্মীপেঁচাও আসে। দুধসাদা। যাঁদের বাড়ি আসে, তাঁরা খুব খুশি হন। না?

কর্বুর বলল, তা ঠিক। কিন্তু যে, পেঁচার ডাক শুনলেন আজ বনের গভীর থেকে সে অলক্ষ্মী পেঁচা। ওইসব শহর-গ্রামের পেঁচাদের চেয়ে অনেক-ই বড়ো হয় দেখতে তারা। ওই পেঁচার নাম-ই‘কাল-পেঁচা’। গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিশুতি রাতে তারা যখন ডাকে তখন শুধু আপনাদের বুক কেন, অনেক সাহসীর বুক-ই দুরদুর করে ওঠে।

—আমরা কি ভীরু?

—সাহস আর ভয় ব্যাপারটা আপেক্ষিক।

ঐশিকা বলল, ‘বুরু’ মানে কী? সব নামের পেছনেই দেখছি একটা করে ‘বুরু’ যোগ হয়।

কর্বুর হেসে বলল, ‘বুরু’ মানে পাহাড়। কেউ কেউ আবার বলেন জঙ্গল। আমি ঠিক বলতে পারব না। কাকু যেমন কিরিবুরু থেকে ‘বুরু’ বাদ দিয়েই শুধুই ‘কিরি’ নাম রেখেছে ছেলের। গুয়াতে যে লোহার খাদান আছে ওগুলো স্টিল অথরিটি অফ ইণ্ডিয়া হওয়ার আগে সব ইণ্ডিয়ান আয়রন অ্যাণ্ড স্টিলের-ই, মানে ‘ইসফোর’ ছিল। স্যার বীরেন মুখার্জির বাবা স্যার রাজেন মুখার্জির পত্তন করা। লোহা, ম্যাঙ্গানিজ এসব-ই সারফেস-মাইনস। অথবা ‘ওপেন-কাস্ট’ও বলে। কয়লা তামা বা অভ্রর খাদানের মতো মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তা তুলে আনতে হয় না। ধরুন ‘বনম’ মানে উই ঢিপি। যে পাহাড়ে অনেক উইঢিপি তার নাম বনম-বুরু। ‘হঞ্জর’ মানে হচ্ছে কুঁজ। যে পাহাড়ের ওপরে কুঁজের মতো একটি পাথর ঝুলে আছে তার নাম হয়ে গেল হঞ্জর-বুরু। যে পাহাড়ে বনদেবতা বা মারাং থাকেন তার নাম মারাংবুরু। আমগাছকে ‘মুণ্ডা’ ভাষায় বলে ‘উলম’। যে পাহাড়ে অনেক উইঢিপি আর আমগাছও আছে তার নাম ‘বনম-উলি-বুরু’। বঙ্গসন্তানেরা সন্ধি করে তার নাম করে দিয়েছিলেন হয়তো বনমালিবুরু। এইসব ব্যাপার আর কী!

—এই সারাণ্ডার বনে বুঝি অনেকরকম আকর, মানে মিনারাল ওরস পাওয়া যায়?

গৈরিকা শুধোল।

—হ্যাঁ যায় তো। বিহারের সিংভূম খুব-ই বড়োলোক এ বাবদে। এইসব পাহাড়ের মৃত্তিকা-ত্বকে প্রচুর লাল-নীল-হলুদ-রঙা গুঁড়োর মতো আয়রন অক্সাইড আছে। আকরিক লোহাও আছে। গুয়া, নোয়ামুন্ডি, বাদামপাহাড় এইসব অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে লোহার আকর আর আয়রন অক্সাইড। ম্যাঙ্গানিজ আছে জামদা থেকে রাউরকেল্লার পথে কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে জঙ্গলের বুক ফুঁড়ে চলে গেলে, ভুতরা মাইনস-এ। আছে, আমাদের ধুতরা মাইনস-এ। তা ছাড়াও আরও অনেক খাদান আছে। ভুতরা মাইনস, ওড়িশা ম্যাঙ্গানিজ কোম্পানির খাদান। সেখানে কুড়ারি নদী বয়ে গেছে ছায়াচ্ছন্ন গিরিখাতের মাঝে মাঝে।

—‘মহলশুখার চিঠি’ বলে একটি বই পড়েছিলাম, তাতে মহলশুখা আর ভুতরা মাইনসের কথা আছে।

ঐশিকা বলল।

—প্রকাশক কে?

—আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

তারপর বলল, এদিকের নদী-নালাতে সোনাও পাওয়া যায়। মেয়েরা পাহাড়ের বুকে কোনো কোনো নির্জন জায়গায়, যেখানে নদী বয়ে যায় নিভৃতে, সেখানে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সোনার চিকচিকে গুঁড়ো ছেঁকে তোলে।

—কেন? সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে কেন?

—নিশ্চয়ই কোনো প্রথা আছে আদিবাসীদের। শুধু মেয়েরাই সেই সোনার গুঁড়ো ছেঁকে তোলে। পুরুষদের সেখানে যাওয়া মানা।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, জায়গাটা জানো নাকি? চলো, ভায়া, তুমি-আমি চলে যাই।

ঐশিকা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, বাবা! বিহেভ ইয়োরসেলফ।

—এদিকে ‘মুণ্ডা’, ‘হো’ ছাড়া আর কোনো উপজাতি আছে?

—কোলেরাও আছে। বীরহোড়। কোলেরা গুয়ার কাছে একটি পাহাড়ের কোলে থাকে, তাই তাকে বলে ‘কোল-টুংরি’। লোহা খাদানের লাল-হলুদ মাটি এনে ওরা মাটির ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ফুল, পাতা, নানা পশুপাখি, মেয়ে-মরদের সুন্দর সুন্দর সব ছবি আঁকে।

—সত্যি। আমাদের এই ট্রাইবাল-আর্টের কোনো তুলনা নেই।

গৈরিকা বলল।

—লোহা, সোনা, ম্যাঙ্গানিজ ছাড়াও আছে সিসে, তামা, রুপো। এখানের নদীর মতো সুন্দর বহু-বর্ণা নদীও পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। দেখাব আপনাদের। দেখে গাইতে ইচ্ছে করবে, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।’

একদিক দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘন বনের মধ্যে দিয়ে ছিপছিপে লাল নদী এসে অন্যদিক থেকে আসা নীল নদীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কোথাও বা হলুদ নদী মিলেছে সবুজ নদীর সঙ্গে। সে দৃশ্য দেখার মতো।

তারপর ও বলল, বড়োবিলে বড়োজামদাতে নানা ইনস্পেকশন কোম্পানির অফিস আছে। যেমন মিত্র. এস. কে. প্রাইভেট লিমিটেড, ব্রিগস কোম্পানি ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরা ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন ধাতুর আকর পরীক্ষা করে করে কোন আকরে কত শতাংশ আছে সেই ধাতু এবং তাদের অন্য গুণাগুণ কী, এইসব-ই যাচাই করে সার্টিফিকেট দেন। ওই সার্টিফিকেটকে মেনেই রপ্তানি ও আমদানিকারকরা ব্যাবসা করেন।

একসময়ে ওদের খাওয়া শেষ হল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, এই জঙ্গলে এমন পুডিং, ভাবা যায় না।

গৈরিকা বলল, সত্যি। কিন্তু এবারে কি শয়নে পদ্মনাভ?

—বাংলোর পাশে ভিউপয়েন্টে গরমের রাত হলে গিয়ে বসতে পারতাম।

—তার চেয়ে কাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে জঙ্গলে কিছুদূর হেঁটে বেড়ালে খুব ভালো লাগবে।

ঐশিকা বলল।

—শরৎকালের সৌন্দর্য যে কী তা গ্রামের সৌন্দর্য যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন, কিন্তু এই জঙ্গলের সৌন্দর্য একেবারেই অন্যরকম। অন্ধকার রাতের রূপও কিন্তু অন্যরকম। তা পুরুষের রূপ। আর চাঁদনি রাতের রূপ, নারীর রূপ।

—বাবা: তুমি তো দেখছি কবি হে কবু।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

—আমরা তার প্রমাণ আগেই পেয়েছি।

ঐশিকা বলল।

কবু বলল, একটা কাজ করলে মন্দ হয় না।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, কী?

—কাল ভোরে উঠে, এককাপ করে চা খেয়ে ‘টোয়েবু’ ফলস-এ যাওয়া যেতে পারে। সঙ্গে করে গ্যাসের ছোটোউনুন আর ব্রেকফাস্টের রসদ ওখানে নিয়ে গেলে ওখানে বসেই ব্রেকফাস্টও খাওয়া যেতে পারে। তারপর বাংলোতে ফিরে অথবা না-ফিরেও থলকোবাদ যাওয়া যেতে পারে। থলকোবাদ, টোয়েবু থেকে কাছেই।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেটা মন্দ হয় না।

তারপর বললেন, তোমরা তিনজনে যাও সকালে। ট্রান্সপোর্ট তো দুটি আছেই। আমি তোমাদের জন্যে সব বন্দোবস্ত করে মালপত্র নিয়ে গিয়ে পৌঁছোব সেখানে। কী যেন নাম বললে ফলসটার? গোয়েবু?

—না টোয়েবু।

—হ্যাঁ। হ্যাঁ। টোয়েবু। জিনিসপত্রও সব গুছিয়ে নেব। চান-টানও সেরে নেব। যাতে ওখান থেকেই থলকোবাদ চলে যেতে পারি। তোমরা না হয় থলকোবাদে গিয়েই চান কোরো।

—কেন?

—এনজয় ইয়োরসেলভস।

—আমরা টোয়েবুতেও তো চান করতে পারি।

গৈরিকা বলল।

—তাও পারো। অ্যাজ ইউ লাইক ইট।

—ঠিক আছে। এ কি অফিস যাওয়া! যা মনে হবে, মানে সকালে উঠে যা করতে ভালো লাগবে তাই-ই করা যাবে। ছুটিতে এসেও এত আগে থাকতে সব ঠিক-ঠাক, এমন টাইট স্কেডিউল আমার ভালো লাগে না।

গৈরিকা বলল।

কর্বুর লক্ষ করল যে, Schedule-এর আমেরিকান উচ্চারণ করল গৈরিকা, স্কেডিউল। এই আমেরিকানরাই এতদিনের পৃথিবীব্যাপী ঐতিহ্যমন্ডিত ইংরেজি ভাষাটিকে কী বিকৃতই না করে দিল। যাঁদের ঐতিহ্য থাকে না, অতীত থাকে না, নিজস্ব ভাষা থাকে না, তারাই গাজোয়ারি করে নিজেদের ঐতিহ্য তৈরি করতে চায়।

চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠতে ঐশিকা বলল, আমার গা এখনও ছমছম করছে। রাতের জঙ্গলের মধ্যেই মনে হয় কত জীবজন্তু সব বুঝি গা-ঠাকা দিয়ে বসে রইল। দেখা হল না।

কর্বুর বলল, তাই-তো হয়। যতটুকু অদেখা থাকে, যতটুকু অন্ধকার, ততটুকু রহস্যে মোড়া থাকে। সেখানে কী আছে? তা জানার জন্যে মন আনচান করে। যেটুকু সহজে দেখা যায়, বা যা আলোকিত, তা তো সহজে দেখাই যায়।

—ঠিক তাই।

কর্বুর বলল।

—তাহলে গুডনাইট।

—গুডনাইট তো বটে কিন্তু আমাদের খুব-ই খারাপ লাগবে।

কর্বুর বলল, কেন?

—না। আপনি এই বসার ঘরের সোফাতে, আর আমরা ঘরে।

—সোফাতে কেন? পা-তোলা চেয়ারে আরামে ঘুমোব কম্বল মুড়ি দিয়ে। আপনাদের পাহারাও দেওয়া হবে। আমি তো দারোয়ানি করতেই এসেছি।

যদি কোনো জানোয়ার বা সরীসৃপ অথবা চোর আসে তারাও সবাই ওই ড্রইংরুম দিয়েই ঢুকবে বলছেন!

ঐশিকার কথাতে সবাই হেসে উঠলেন একসঙ্গে।

—ঘুমোবই যে, তার-ই বা কী মানে আছে? আমি তো জেগেও থাকতে পারি! আপনারাও জেগে থাকলে পারতেন। রাতের জঙ্গল থেকে কতরকম আওয়াজ ভেসে আসবে। শুনতেন বসে বসে। চোখ যখন দেখতে পায় না তখন কান-ই চোখ হয়ে যায়। আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়, কোন জানোয়ার, কত দূরে, কী করছে বা সে কী দেখে ডাকছে?

গৈরিকা বলল, থাক। আমার ঘুম পাচ্ছে। জঙ্গলের সব-ই একদিনে শিখে ফেলতে গেলে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। হজম হবে না। আমি চললাম শুতে। আপনাকে বালিশ দিয়েছে কি?

—আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান। কোনো চিন্তা নেই।

কর্বুর বলল।

যেতে যেতে ফিরে দাঁড়িয়ে ঐশিকা বলল, আপনি কীরকম লোক যে, অন্য কারও সঙ্গে শুতে পারেন না? বাপির সঙ্গেও পারবেন না? তাহলে বিয়ে যখন করবেন তখন কী করবেন?

—আলাদা ঘরে শোব। বিয়ে করলেই যে, এক-ই বিছানাতে এক মশারির তলাতে অন্যজনকে জাপটে-সাপটে প্রতিরাতে শুতেই হবে তার কী মানে আছে, জানি না আমি। আমি তো আমাদের ধুতরা খাদানের কাছে একটি জঙ্গলময় টিলা দেখেছি। তাতে মনোরম দুটি ছোটো সেলফ-কনটেইনড কটেজ বানাব। একটাতে আমি থাকব, অন্যটাতে বউ। মধ্যে একটা চাঁপা-রঙা টাইলের পথ থাকবে যোগসূত্র হিসেবে। তার দু-পাশে থাকবে পারিজাত আর স্থলপদ্মর গাছ। মিয়া-বিবির আলাদা আলাদা বাবুর্চি থাকবে। আলাদা খাস বেয়ারা। এবং আয়া। একদিন আমার বাড়ি বউকে নেমন্তন্ন করব, আর একদিন সে করবে আমাকে নিমন্ত্রণ।

—আপনার ঘরে আতরদানি থাকবে তো?

—কোনো যবন-কন্যাকে বিয়ে করলে, তাও থাকবে।

—সেটি তো হবে না। যবন-কন্যাকে বিয়ে করতে হলে তো আপনাকেও যবন হতে হবে। ধর্মান্তরিত না হলে তো বিয়ে হবে না। আপনার নাম হয়তো কর্বুর সেন থেকে হয়ে যাবে জনাব মুর্গমসল্লম খাঁ।

কর্বুর হেসে বলল, এটা যা বলেছেন! পৃথিবীতে আর কোনো ধর্মই বোধ হয় এমন জবরদস্তি করে না অন্যের ওপরে।

—সেইজন্যেই আপনার ওই লাইনে না-যাওয়াটাই সেফ হবে।

—তা ঠিক। নিজের মা-বাবার ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে। দেশে স্বধর্মের মেয়ের কি অভাব পড়েছে?

—সেকথা ঠিক। দেশে সবকিছুর আকাল থাকলেও অনূঢ়া কন্যাদের গোনা-গুনতি নেই। কী সম্মান-ই না দিলেন আমাদের। আমরা যেন গোরু-ছাগল। ভাবছেন তাই?

তারপর বলল, আপনি স্যার তাহলে আপনার সেই না-বাগানো বউদের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে জেগে থাকুন, আমরা ঘুমোই গিয়ে। ‘কলা-হারাম’ হাতিটা যদি আসে, আপনি সঙ্গে না থাকলে কিন্তু আমরা সাহস করে দেখতে যেতে পারব না।

—আমিই কি আপনাদের সাহস?

—হ্যাঁ স্যার। তবে শুধুমাত্র কোনো কোনো ব্যাপারে।

ঐশিকা বলল।

বলেই, দুষ্টুমি-ভরা হাসি হেসে, ঘরে গিয়ে দুয়ার দিল। কর্বুরের মনে হল, ও যেন কর্বুরের মুখের ওপর-ই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। না-বন্ধ করলে, কর্বুর কি ওদের ঘরে যেত?

ভারি অসম্মানজনক ব্যাপার-স্যাপার!

কর্বুর ভাবল যে, সে অনবধানেই বড়ো তাড়াতাড়ি একটু বেশি মাখো-মাখো হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা ডেঞ্জারাস। যদিও সব মেয়েই ডেঞ্জারাস। আরও প্রশ্রয় দিলেই মাথায় চড়ে বসবে। মা-কাকি-কাকুর পছন্দ হলেই যে, কর্বুরের ঐশিকাকে বিয়ে করতেই হবে তার কী মানে আছে! ঐশিকাও মনে হয়, তার সুন্দর তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে টোকা মেরে আজ অবধি অনেক ছেলেকেই টাকা-কেন্নোর মতো ছুড়ে ছুড়ে ফেলেছে। কর্বুর নিজের ছোট্ট জগতেই সুখী ছিল। তার পক্ষে বড়োজামদার শিখীই ভালো। ঘরোয়া মেয়ে। ঐশিকা তাকে পছন্দ করলেও তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে সারাজীবন। তেমন অবস্থার কথা ভাবলেও আতঙ্ক হয়। অমন বোকামি কর্বুর করবেই না।

‘কলা-হারাম’ হাতিটা আসেনি কাল রাতে।

পুবের আকাশ ফর্সা হতেই রহমত চাচার কাছ থেকে চেয়ে দু-কাপ চা খেয়ে হাত-মুখ ধুয়ে কর্বুর বেরিয়ে পড়ল। সাহেব আর মিসি-বাবারা নিশ্চয়ই দেরি করে উঠবেন। ওঠামাত্র যাতে গরম জল পান হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে এবং গরম চা-ও পান তার বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করেই ও বেরোল দূরবিনটা গলায় ঝুলিয়ে। একসময়ে প্রায় প্রতিসপ্তাহেই আসত সারাণ্ডাতে। আজকাল কাজে-কর্মে এমনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে যে, সময়ই পায় না। তার ওপর পুজোর দু-মাস আগে থেকে তো নাটকের মহড়া নিয়েই ছিল এ বছরে।

‘মহড়া’ উপন্যাসটির লেখক হয়তো ঠিক-ই বলেছেন। আমাদের অধিকাংশ মানুষের জীবনটাই এক-একটা মহড়াই। মহড়া দিতে দিতেই জীবন শেষ। জীবনের নাটক খুব কম মানুষ-ই মঞ্চস্থ করতে পারেন। এই দুর্বুদ্ধিজীবীতে গিস-গিস করা দিনে, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী তক্ষ রায়ের চরিত্রটা এঁকেছেন লেখক অসাধারণ। কুদর্শন তক্ষ রায়ের প্রেমে পড়ে গেছে কর্বুর।

মহড়া দিতে দিতেই শিখীকে কাছ থেকে জেনেছে কর্বুর। ভারি ভালো মেয়ে। নরম, লাজুক, ভালো গান গায় এবং দারুণ ভুনিখিচুড়ি আর কড়াইশুঁটির চপ রান্না করতে পারে। একেবারে তার চলে যাওয়া ঠাকুমার-ই মতো। জামশেদপুরের ঐশিকার সঙ্গে বড়োজামদার শিখীর অবশ্য তুলনাই চলে না। ঐশিকার ক্লাস অন্য। ও জন্মেছেই কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সি.ই. ও অ্যাণ্ড এম. ডি.-র স্ত্রী হওয়ার জন্যে। বড়োবিল-এর ‘টাটিঝারিয়া’ আর ধুতরা খাদানের পাহাড়ের কটেজে ও আঁটবে না। ওর পটভূমির সঙ্গে শিখীর পটভূমির অনেক-ই তফাত আছে। ভবিষ্যতের তো আছেই। বিয়ের জন্য মা-বাবা-কাকু-কাকি অনবরত জোর দিচ্ছেন। নানা সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা বলছেন। তবে এ ব্যাপারে বলতে হয়, ওঁদের আক্কেলের অভাব আছে। কী করে ওঁরা ভাবতে পারলেন যে, ঐশিকার মতো মেয়ের এই বড়োবিল-এর খাদান-মালিক কর্বুরকে ভালো লাগবে। কর্বুর কোনো দিক দিয়েই ওর যোগ্য নয়।

যদিও বিয়ের বয়েস তার হয়েছে কিন্তু বিয়ে করলেই তো স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল সব। এলিজিবল, সচ্ছল ব্যাচেলার হিসেবে যেখানেই যায় সেখানেই যে, একটা আলাদা খাতির! সেসব আর থাকবে না। তার বাজারদরের জন্যেই নয়, কার না ভালো লাগে সমাজে তার চাহিদা যেন অব্যাহত থাকে তা দেখতে। বিয়ে-টিয়ে নিয়ে বিশেষ ভাবেওনি। নানা ভাবনা নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাবা-মা তাঁদের ছেলের ঘরের নাতি দেখতে অহেতুক উৎসুক হলেই যে, তাকে বিয়ে করতে হবে এক্ষুনি এবং জনক হতেই হবে এ কেমন কথা! আসলে সব মানুষ-ই স্বার্থপর। সন্তানেরা যেমন, তেমন অনেকক্ষেত্রে বাবা-মায়েরাও। নিজেদের ইচ্ছাপূরণের কথাই ভাবেন শুধু তাঁরা। অন্যের কথা ভাবেন না আদৌ।

কিছুটা গিয়েই ও আবার ফিরল। ভাবল, বাঁধের দিকে গিয়ে দেখে, কাল শেষদুপুরে যে, ‘কটন-টিল’-এর ঝাঁকটা এখানে নামল এসে, সংখ্যায় তারা কত?

কুমেডি বাংলোটা পেরিয়ে গেল। সেখানে ঘুম-ভাঙা কারওকেই দেখল না। ভালোই হল, ভাবল ও। তাও একা থাকা যাবে কিছুক্ষণ। জঙ্গলে এসে একা না থাকতে পারলে আসার কোনো মানেই হয় না।

বাঁধের পাশে পৌঁছে আশ্চর্য হল কর্বুর। একটি হাঁসও নেই। তারা হয়তো সকালের আলো-ফোটার আগেই চলে গেছে, নাকি কাল-ই বিকেলে গেছে, কে জানে! চারদিক শিশিরে ভিজে আছে। কোথাওই বসার জায়গা নেই। বাঁধের ওপারের জঙ্গল থেকে নানা পাখির মিশ্রস্বর ভেসে আসছে। এমন সময়ে ধনেশ ডাকল একটা। কুমডির আশপাশে আগে ধনেশ দেখেনি কখনো। ও ঝুলিয়ে-রাখা দূরবিনটা তুলে নিয়ে সেদিকে খুঁজতে লাগল পাখিটাকে। ধনেশ উঁচু গাছের ওপরের দিকের ডালে বসে থাকতে ভালোবাসে। চুপ করে থাকা ওদের কুষ্ঠিতে নেই। সব সময়েই ‘হ্যাঁক হুঁক্ক হুঁক্ক’ করছে। নাক্সভোমিকা গাছে বসতে ভালোবাসে ওরা। ওই গাছের ফলও খেতে ভালোবাসে। ওড়িশাতে ওই গাছগুলোকে বলে ‘কুচিলা’। আর কুচিলা খায় বলেই ওদের নাম সেখানে ‘কুচিলা খাঁই’।

দূরবিনটা নামাতে যাবে এমন সময়ে কে যেন পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে চাইল। মুখে বলল, পাখি রইল বাঁ-দিকে আর স্যার দেখছেন ডানদিকে।

—তাই?

কর্বুর খুশি ঐশিকাকে দেখে।

—বলল, কখন ওঠা হল রাজকুমারীর?

—কী যে বলেন স্যার। আমি হলাম বাঁদি। রাজকুমার কেন যে, না বলে কয়ে বেরিয়ে এলেন তা বুঝলাম না। আপনি না আমাদের লোকাল গার্জেন!

—ঐশিকা ব্যানার্জির লোকাল গার্জেনি করি এতবড়ো ধৃষ্টতা কি আমার হতে পারে!

—কী পাখি ওটা? বিচ্ছিরি ডাক কিন্তু যাই-ই বলুন।

—ওদের বাংলা নাম বড়োকি ধনেশ। ইংরেজিতে বলে, দ্যা গ্রেটার ইণ্ডিয়ান হর্ন বিল। ওড়িয়া নাম, ‘কুচিলা খাঁই’।

—ছোটোও হয় বুঝি?

—হয় বই কী। সেগুলো অনেক-ই ছোটো হয়। ওড়িশাতে সেগুলোকে বলে ‘ভালিয়া-খাঁই’।

—কেন?

—‘ভালিয়া’ বলে একরকমের ফল হয়। ওরা সেই ফল খেতে ভালোবাসে বলে।

—তাহলে কি বাপিকে আমরা গুলাশ খাঁই বলে ডাকতে পারি।

—‘গুলাশ’ মানে?

—আরে বাপি কাল বলল না, আজ মটন দিয়ে হাঙ্গারিয়ান গুলাশ রান্না করবে থলকোবাদে গিয়ে।

কর্বুর হেসে ফেলল।

বলল, ব্যানার্জিসাহেব খুব খাদ্যরসিক আছেন। তাই না?

—শুধুই খাদ্যরসিক কেন, পানীয়-রসিক, জীবন-রসিক। আমার বাপি একজন এপিকিউরিয়ান। বাট হি ইজ আ গ্রেট গাই। আই অ্যাডোর হিম!

বলেই বলল, পাখিগুলোকে কাছ থেকে দেখব বলে এলাম, আর তারা গেল কোথায়? আমাকে বোধ হয় পছন্দ হয়নি। কখন গেল? আমাকে আসতে দেখেই!

আমিও তো ওদের দেখতেই এসেছিলাম। এসে দেখছি, চলে গেছে। কোনো বড়োজলাতে গিয়ে বসেছে হয়তো।

—মাইগ্রেটরি।

স্বগতোক্তি করল ঐশিকা।

তারপর-ই বলল, বাংলাটা যেন কী বলেছিলেন?

—পরিযায়ী।

—রাইট। ‘পরিযান’ থেকে পরিযায়ী?

—আমি কি অত জানি! আমি তো ধানবাদের মাইনিং এঞ্জিনিয়ার। পাথর চিনি, আকর চিনি। আটারলি বেরসিক।

—তাই নাকি? কে বলে? আপনি আটারলি-বাটারলি-রসিক।

তারপর আবারও নিজের মনেই বলল, পরিযায়ী। পরিযায়ী। পরিযায়ী।

পরক্ষণেই হঠাৎ চমকে উঠে বলল, ওটা কী পাখি ডাকল? মেটালিক সাউণ্ড। মেটালিক-এর বাংলা কী?

—মেটাল হচ্ছে ধাতু। মেটালিক হচ্ছে ধাতব।

—সত্যি! আই শুড বি অ্যাশেমড অফ মাইসেলফ।

বলেই বলল, আপনি আমাকে বাংলা পড়াবেন?

‘বাংলা পড়ানো’ শব্দ দুটি ধানবাদ মাইনিং স্কুলের গোপেন সামন্ত অন্য অর্থে ব্যবহার করত। কর্বুরের হাসি পেয়ে গেল। ঐশিকার মুখে শব্দ দুটি শুনে। কিন্তু হাসল না।

বলল, ওই পাখিটার নাম র‌্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো। ফিঙে জাতীয় পাখি।

—পাখিটা যে গাছে বসে আছে সেটা কী গাছ?

—গামহার।

—বা:, সুন্দর নাম তো।

—পাশের গাছটা কী গাছ?

—ওটা বিড়ো। বাংলাতে বলে পিয়াশাল।

—আর ওগুলো।

—ওগুলো সব শাল। সারাণ্ডা তো শালের জন্যেই বিখ্যাত।

—কোথায় একটু বসা যায় বলুন তো। সব জায়গাই তো এখনও ভিজে।

—নাই বা বসলেন।

—ওই ঝোপগুলো কীসের ঝোপ? কমলা কমলা ছোটো ছোটো ফুল ফুটেছে। বিচ্ছিরি গন্ধ কিন্তু ঝাড়গুলোতে এবং ফুলগুলোতেও।

—হ্যাঁ, তা ঠিক। ওগুলোর নাম Lantana, হিন্দিতে বলে ‘পুটুস’। গাড়োয়াল পাহাড়ে এদের-ই বলে ‘লালটায়েন’। জিম করবেট এবং অন্যান্য সাহেবদের মুখে Lantana শুনে থাকবে স্থানীয় মানুষরা, তার-ই অপভ্রংশ ‘লালটায়েন’।

—ফুলের বা গাছের-ই মতো পাখির নামও কি প্রদেশ ভেদে আলাদা আলাদা হয়ে যায়?

—যাবে না? আমাদের এই ভারতবর্ষ কত বড়ো দেশ। কত ভাষাভাষী, কত রাজ্য, কিন্তু সব মিলিয়ে আমরা এক-ই। এই বিরাটত্ব এবং মিলন-ই তো ‘ভারতীয়ত্ব’। —‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’

—আবার সাতসকালে জ্ঞান দিতে শুরু করলেন স্যার? বাপি তো আছেই। তার ওপরে আপনি। কিন্তু আপনার যা বয়েস তাতে তো আপনার অজ্ঞানাবস্থাই থাকা উচিত এখনও। এত জ্ঞান, আসে কোত্থেকে বলুন তো স্যার?

—জ্ঞান কি আর হেলিকপ্টার থেকে পড়ে ম্যাডাম? জ্ঞান পড়াশুনো এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে অর্জন করতে হয়। অনেক-ই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

—আপনার মধ্যে যতখানি জায়গা আছে তা জ্ঞানে ভরতি হয়ে গেলে কী হবে? আপনি কি বেলুনের মতো ফেটে যাবেন? না, কলসির জলের মতো সে জ্ঞান উপচে পড়ে যাবে। না, পথে-প্রান্তরে পড়ে নষ্ট হবে?

—জানি না। কালকে যে গানটা শোনাবেন বললেন, সেটা শোনান না।

—কোনটা?

—ওই যে Savaging The Civilized বইটির মধ্যে যে, গানটি লেখা ছিল সেটা।

—ছি:। আপনি তো ভারি নিষ্ঠুর। একজন ভালোবেসে একটা গানের কলি লিখে প্রেম নিবেদন করল, আর সেই গান আপনি অন্যের মুখে শুনতে চাইছেন? তার মুখেই শুনবেন। গান তো রূপমতী চমৎকার গায়। এবার থেকে শিখীকে ‘রূপমতী’ বলেই ডাকবেন।

—সে আমি বুঝব।

সামান্য বিরক্তির গলাতে বলল, কর্বুর।

—না তো কি আমি বুঝব? আপনার পাঁঠা আপনি ল্যাজে কাটবেন না মাথায়, তাতে আমার কী?

—বড়োবাজে কথা বলেন আপনি। বেচারি আপনার কী ক্ষতি করেছে যে, তার পেছনে লেগেছেন?

—ওমা! আমি ক্ষতি করতে যাব কেন? আমি তো তার অ্যাডমায়রার হয়ে গেছি, যেমনি হয়েছি আপনারও।

—এত অ্যাডমিরেশানের বন্যা কেন?

—কী করব স্যার। অব্যেশ।

আবার ‘স’-কে ইচ্ছে করে ‘শ’ বলল ঐশিকা।

—আপনার বাপি আদরে আদরে আপনাকে এক্কেবারে গোবর করেছেন।

—আমাকে গোবর করেছেন। জানি তো! এককথা আর কতবার বলবেন স্যার। তার চেয়ে এইটা শুনুন। ভৈরবীতে বাঁধা।

একটু চুপ করে থেকে বলল, নিধুবাবুর নাম শুনেছেন? না শুনে থাকলে, রূপমতীকে জিজ্ঞেস করবেন, বলে দেবে। সে অবশ্যই শুনেছে। আপনাকে দেওয়া বইটিতে ‘কী করে কলঙ্কে যদি’ গানটা লিখেছেন যিনি। তাঁর-ই লেখা গান।

—আমি জানি।

—কী জানেন?

—নিধুবাবুর নাম। রামনিধি গুপ্ত তো!

—সত্যি! আপনাকে যতই দেখছি স্যার ততই অবাক হচ্ছি।

—কেন?

সামান্য বিরক্তির গলাতে বলল, কর্বুর।

—আপনি কী যে জানেন না! মানে কোন বিষয়ে আপনার জ্ঞান নেই? আপনি তো সব্যসাচী।

—তার মানে? আমি সবজান্তা বলছেন?

—‘সবজান্তা’ শব্দটা প্রশংসাসূচক নয়। বরং বলা যাক আপনি সর্বজ্ঞ।

—গানটা গাইবেন কি?

—গাইছি।

বলেই, ঐশিকা ধরে দিল: ‘প্রণয় পরম রত্ন, যত্ন করে রেখো তারে/বিচ্ছেদ তস্করে আসি, যেন কোনও রূপে নাহি হরে/অনেক প্রতিবাদী তার হারালে আর পাওয়া ভার/কখন যে সে হয় কার, কে বা বলিতে পারে/প্রণয় পরম রত্ন, যত্ন করে রেখো তারে।’

অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল কর্বুর। নিধুবাবুর এটি একটি বিখ্যাত গান। ভৈরবীতে বাঁধা। শরতের সকালবেলার রোদ, শিশিরভেজা সুগন্ধি গাছপালার গন্ধের মধ্যে কারও নদীর পাশে দাঁড়িয়ে গাওয়া সেই ভৈরবীর সুর যেন, এই বনভূমির সকালের সব রন্ধ্র ভরে দিল।

এই গানটি কর্বুর শিখীর গলাতেও শুনেছিল। কিন্তু শিখীর গলা ঐশিকার গলার সঙ্গে আদৌ তুলনীয় নয়। ঐশিকার গলা তো নয়, যেন কোকিল কথা বলছে। সুরে একেবারে ভরপুর। কলকাতার আনন্দবাজারের প. ব.-র ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘‘সুরঋদ্ধ’’। তার ওপরে গানের ভাব, গানের বাণীর প্রতিটি শব্দ যেন প্রাণ পেল ঐশিকার গায়কির-ই জন্যে।

কর্বুরকে চুপ করে থাকতে দেখে ঐশিকা বলল, নিজে থেকেই জোর করে গান শোনালাম স্যার, ভদ্রতা করেও তো মানুষে কিছু একটা বলে বানিয়ে বানিয়েও। তাও বললেন না। আচ্ছা, বিয়ে করতে আসা জামাইকে দেখে, সে যতই হতকুচ্ছিৎ হোক না কেন, অথবা কারও গান শুনে, সে গায়িকা যতই খারাপ গান করুক না কেন, আজ অবধি কেউই কি কখনো খারাপ বলেছে? আপনি কী নিষ্ঠুর মানুষ স্যার!

তুমি তো গান গাইলেই পারতে।

কর্বুর, ঐশিকার ছদ্ম-বিনয় ছেঁটে দিয়ে বিস্ময়াভিভূত গলায় বলল।

—‘তুমি’ বলে ফেলেই লজ্জিত হল কর্বুর। বলল, সরি, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। তবে গুণপনাতে বড়ো হলেও বয়সে তো আমার চেয়ে ছোটোই আপনি!

চোখ বড়ো বড়ো করে ভর্ৎসনার স্বরে ঐশিকা বলল, খুব-ই অন্যায় হয়েছে। গুণপনাতে গুরুজনকে ‘তুমি’ বলে কেউ কখনো? তা ছাড়া, আমার বয়স কত তা আপনি জানলেন কী করে!

তারপর-ই বলল, আচ্ছা স্যার! আপনি এতক্ষণ ‘আপনি’ চালিয়ে গেলেন কী করে? অসীম আপনার ক্ষমতা। ঐশী ক্ষমতা। আপনি ইচ্ছে করলে লাল্লুপ্রসাদ যাদব হতে পারতেন। আমার তো দমবন্ধ হয়ে আসছিল প্রথম থেকেই। আপনি সত্যিই প্রি-হিস্টরিক।

—এসব কথা থাক। তুমি এমন গান গাও, তো গানকেই প্রফেশন কেন করলে না?

—কোনো কিছুকেই ‘প্রফেশন’ করা কি অত সোজা আজকাল স্যার? দলে না ভিড়তে পারলে, গোরু-ছাগলের মতো যূথবদ্ধ হয়ে গায়ে-গা ঘষতে না পারলে, আজকাল কিছুই হয় না। প্রকৃত গুণীরা এখন তাঁদের অভিমান নিয়ে বাড়িতেই বসে থাকেন আর ভূশন্ডীর মাঠের ভূত-পেতনিরা চারধারে হুলা-হুলা, হনু-হনু নৃত্য করে বেড়ায়। দলে-বলে যারা আছে, তারাই আজকাল ‘সব পেয়েছির দেশে’র বাসিন্দা। রসে-বশে দিন কাটায়।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ক্ল্যাসিকাল গানের কথা হয়তো আলাদা। অন্য অধিকাংশ গানের-ই এখন ‘জনগণায়ন’ হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক শিল্পী সংঘর মাধ্যমেই আপনাকে পা ফেলতে হবে, নইলেই পদস্খলন। নিজেকে অত নীচে টেনে নামাতে রুচিতে বাধে। তেমন শিক্ষাও তো পাইনি। তাই অনেকরকম কষ্ট করেও, বাপিকে একা ফেলে রেখেও দু-বোনে বাইরে বাইরে পড়াশুনো করেছি। আজকাল স্বাবলম্বী না হলে তো চলে না। আমার মনে হয়, মহারাজকে বিয়ে করলেও সে মেয়ের স্বাবলম্বী হয়েই করা উচিত। ভালোবাসাটা, আদরটা, উপরি পাওনা। কিন্তু নিজের খাওয়া-পরাটার বন্দোবস্ত, নিজের স্বেচ্ছার্জিত রোজগারেই করা উচিত। মানে, তেমন প্রয়োজনে যেন করা যায়, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া উচিত।

—‘গৃহবধূ’ হয়ে থাকা বলছ কোনো শিক্ষিত মেয়ের পক্ষেই আজকাল সম্ভব নয়?

—সম্ভব নয় কেন? আমার বা আমার দিদির চেয়েও অনেক বেশি শিক্ষিত লক্ষ লক্ষ মেয়ে কি গৃহবধূ হয়ে নেই? অবশ্যই আছে। এবং তারা সুখেই আছে। হয়তো অনেক সম্মানেও আছে। কিন্তু আমরা বড়ো ভয় পাই। আপনারা পুরুষেরা যে, অনেক বছর আমাদের খেলনার মতো ব্যবহার করেছেন। পরাশ্রয়ী স্বর্ণলতাকে আঁকশি বাড়ালেই পেড়ে ফেলা যায়। সে নিজে তো গাছ নয়, লতা নয়, তার নিজের তো কোনো শিকড় নেই। নিরাপত্তার বোধটা বড়োবেশি বিঘ্নিত হয় তাতে। সেটা কোনো দম্পতির সুস্থ দাম্পত্যর পক্ষেও প্রার্থনার নয়।

—বা:। তুমি তো বাংলাটাও ভালো ভালো শব্দ দিয়ে গেঁথে বলতে পারো।

—পারি না কিছুই। তবে পারা উচিত ছিল। আমাদের বাপি, আমাদের যা শেখাতে চেয়েছিল তার পাঁচ ভাগও শেখা হয়নি আমাদের। বাপিই শিশুকাল থেকে শিখিয়েছিল যে, যাই করো না কেন জীবনে, একনম্বর হওয়ার সাধনা করো। দু-নম্বর হয়ে বাঁচা আর না-বাঁচাতে কোনো তফাত নেই। বাপি বলত, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’।

—আশ্চর্য। আমার বাবাও ঠিক এই কথাই বলেন।

এমন সময়ে গৈরিকা আর ব্যানার্জিসাহেবকেও আসতে দেখা গেল। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে শুয়েছিলেন উনি। তার-ই ওপরে ফেডেড জিনসের টপটা চাপিয়ে নিয়েছেন। আধ-টেকো মাথাতে টুপি। ভদ্রলোক একেবারে ওরিজিনাল মানুষ। কোনো বাহ্যিক ভড়ং নেই, যদিও থাকলে মানিয়ে যেতে পারত। গৈরিকার গায়ে হালকা খয়েরি রঙা শাল। ওঁরা নীচে নামলেন না। কিছুটা এসেই দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন ব্যানার্জিসাহেব, ওগো কবু? গোয়েবু ফলস-এ যাওয়ার কী হল?

ঐশিকা বলল, ‘গোয়েবু’ না বাপি ‘টোয়েবু।’

—সেটা মন্দ বলিসনি।

গৈরিকা গলা তুলে দূর থেকেই বলল, কী রে ওই। তোর শীত-টিত করছে না? শালটাও নিয়ে এলি না!

ঐশিকা ফিসফিস করে বলল, কর্বুরকে, আপনাকে কী অপমান। এরকম উষ্ণ পুরুষের কাছে থাকলে কি কোনো মেয়ের শীত লাগা উচিত? আপনিই বলুন?

—আমাকে বা আপনি করে বলা কেন?

গৈরিকা আবার চেঁচিয়ে বলল, আপনার কলা-খেকো হাতি তো আপনাকে ডিসওবলাইজ করল মশাই। উঠে আসুন। হাতি তো দেখাতে পারলেন না কিন্তু প্রোগ্রাম তো ঠিক করতে হবে।

—তাই তো দেখছি। চেঁচিয়ে বলল কর্বুর।

ওঁরা বেশ দূরেই ছিলেন।

ভালো শুনতে না পেয়ে কর্বুর বলল, মানে?

—মানে, ডিসওবলাইজ করল।

—কে?

—কে আবার?

—হাতি।

ঐশিকাকে বলল, চলো। যাওয়া যাক।

—দিদিটা সারাজীবন আমার সঙ্গে শত্রুতা করে গেল।

—কেন একথা বলছ?

—বলব না? আমরা যে, একটু একা গল্প করছি তা সহ্য হল না।

ঐশিকার মুখে ওই বাক্যটি শুনে এক অনাবিল আনন্দে কর্বুরের মন ভরে গেল। প্রাপ্তিটার রকম না জেনেই খুশিতে ডগমগ হল।

—তোমাকে আমি ‘ওই’ বলেই ডাকব, গৈরিকার মতন-ই।

—‘ওই যা:’-ও বলতে পারতেন।

ঐশিকার রসবোধে নতুন করে নিশ্চিন্ত হল কর্বুর।

ওপরে উঠতেই ব্যানার্জিসাহেব বললেন, ব্রেকফাস্টে কী খাবে ভাই কবু? আমি ভাবছি, অরেঞ্জ জ্যুস। তারপর কষে প্যাঁজ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে ডাবল-ডিম-এর ওমলেট, সঙ্গে বেকন ভাজা, উইথ মাস্টার্ড। নিয়ে এসেছি তো আমরা সঙ্গে করে। ঠাণ্ডাতে খারাপ হবে না। রুটিও তো তুমি এনেছ। তবে আর কী! ক্রিসপ টোস্ট, উইথ অরেঞ্জ মার্মালেড। আর কিছু কি তুমি সাজেস্ট করছ? বড়োজামদার দোকানের কড়াপাকের সন্দেশও আছে। এতেই চলে যাবে? কী বলছ তুমি?

—বাপি, আমরা কি এখানে খেতেই এসেছি?

—সেটা মন্দ বলিসনি। তবে খেতেও তো এসেছি এবং খাওয়াতেও। ছেলেটাকে তোরা তো দেখাশোনাই করছিস না। তা আমার তো কিছু করতে হয়।

—ছেলেটা কি কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্র বাপি?

গৈরিকা বলল।

সকলে জোরে একসঙ্গে হেসে উঠল সেই কথায়। সকালের শিশিরভেজা বনপথে আর শরতের জঙ্গলে সেই হাসির অনুরণন উঠল। কতকগুলো ‘ব্যাবলার’ উচ্চকিত হাসিতে ভয় পেয়ে ‘ছি:। ছি:। ছি:’। করতে করতে দল বেঁধে উড়ে চলে গেল। ডানদিক থেকে বাঁ-দিকের জঙ্গলে।

ঐশিকা বলল, কর্বুরকে। আচ্ছা, পাখিগুলো কি ব্রাহ্ম?

কর্বুর অবাক হয়ে বলল কেন?

—না। আমরা দাঁত দেখিয়ে মুখ হাঁ করে হেসেছি বলে হয়তো বিরক্তিতে ‘ছি: ছি:’ করতে করতে চলে গেল।

গৈরিকা বলল, ভালো হচ্ছে না কিন্তু ওই।

—ওই যা:।

বলল, ঐশিকা।

তারপর গৈরিকাকে শুনিয়েই বলল, মিস্টার ব্রহ্মকৃপা দাস ব্রাহ্ম।

—তিনি কে?

—দিদির হবু স্বামী। হবুই বা বলি কেন, বলি গবু। রেজিস্ট্রি তো হয়েই গেছে।

ওরা দুজনে হেঁটে পথে উঠে ব্যানার্জিসাহেবের সঙ্গে বাংলোতে পৌঁছোল। গৈরিকা এল পেছন পেছন। ঐশিকার ওপরে একটু বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হল। সম্ভবত আনন্দের আতিশয্যে ঐশিকা একটু বাড়াবাড়িও করে ফেলেছিল। পরে দু-বোনে বুঝে নেবেখন।

ভাবল, কর্বুর।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, খাওয়া, ক-দিন জঙ্গল দেখা সব-ই মিলিয়ে-মিশিয়ে করতে হবে তো! প্রত্যেক ক্রিয়া-কর্মকে ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্টে বদ্ধ করে রাখলে কী করে হবে! এটার সঙ্গে ওটা, ওটার সঙ্গে সেটা, তবে না মজা!

বলেই বললেন, তুমি কী বলো ভায়া কবু?

—একদম-ই ঠিক বলেছেন আপনি!

—দেখেছিস! দ্যাখ তোরা। তোরা তোদের বাড়াবাড়িতে আনন্দটাকেও কর্তব্য করে তুলিস। এইখানেই আমার আপত্তি। ‘নিয়মানুবর্তিতা’ খুব বড়োগুণ। কিন্তু আমেরিকান প্যাকেজ ট্যুর বেড়োতে-আসা ট্যুওরিস্টরা যেমন ‘বেড়ানো’ কাকে বলে তার কিছুমাত্রই জানে না, তোরাও তা জানিস না। আরে নিয়ম ভাঙাটাই তো হচ্ছে ছুটির মূলমন্ত্র। এই সরল সত্যটা বোঝে ক-জনে?

—বা:। ভারি চমৎকার করে বললেন কিন্তু আপনি। আমার মনের কথাটি বলেছেন। ডায়েরিতে লিখে রাখব!

 

আট

 

ওরা চানটান সেরে ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়েছিল কুমডি থেকে। টোয়েবু ফলস থলকোবাদ থেকে পাঁচ কিমি। আর থলকোবাদ কুমডি থেকে চল্লিশ কিমি। থলকোবাদ থেকে সিমলিপালেও যাওয়া যায়। হাটগামারিয়া তেতাল্লিশ কিমি থলকোবাদ থেকে।

ওরা মানে, ওরাই। রহমত এবং বিহারি জিপটা নিয়ে সোজা চলে যাবে থলকোবাদে। গিয়ে রান্নাবান্নার বন্দোবস্ত করবে।

থলকোবাদ বাংলোতে কুমডির চেয়েও বেশি অরণ্যপ্রেমী আসেন কারণ থলকোবাদের টাওয়ারটি ভালো। বাংলোটিও পাহাড়চুড়োয়। তবে বন্যপ্রাণী দেখতে হলে সবচেয়ে সুবিধে প্রখর গ্রীষ্মে আসা। কষ্ট খুব-ই হয় তখন। অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে কিন্তু তখন পর্ণমোচী বনের অধিকাংশ পাতা ঝরে যাওয়ায় নজর চলে বহুদূর অবধি। আর বন্যপ্রাণীরা যেখানে জল থাকে তার আশপাশেই থাকে তখন। জলপান করার জন্যে যেমন, তেমন গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্যে জলে গা-ডুবিয়ে থাকার জন্যেও। বর্ষার পর থেকে জঙ্গলের মধ্যে অনেক জায়গাতেই প্রায় জল থাকে, তাই প্রাণীরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।

সাড়ে এগারোটা বাজে, এমন সময়ে ওরা গিয়ে পৌঁছোল।

—এই আপনার টোয়েবু ফলস?

গৈরিকা বলল, ফলস-এর সামনে দাঁড়িয়ে।

—কেন? পছন্দ হল না।

—না:। ফলস দিলেন।

গৈরিকা হেসে বলল।

—এই দেখার জন্যে না এলেও হত। তার চেয়ে বনের মধ্যে কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে আপনার জ্ঞান অথবা গান শোনা যেত। তাতে আমাদের জ্ঞান বাড়ত। প্রাণ স্নিগ্ধ হত।

গৈরিকা বলল, সত্যি! আপনার গান তো শোনাই হল না। শোনান এক্ষুনি।

—লাঞ্চ-এর আগে হাতে অনেক-ই সময় আছে। এখন কবু যা দেখাতে নিয়ে এল তোদের আদর করে, তাই দেখ। গান বরং পরে শুনিস।

বলেই বললেন, যাই বলো কবু, ভদকা খাওয়ার এমন জায়গা আর হয় না। ওই—যা তো মা, গাড়ি থেকে ভদকার আর জলের বোতলটা নিয়ে আয়।

আমিই এনে দিচ্ছি। কবু বলল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেটা মন্দ নয়।

—ফার্স্ট ক্লাস। তোমার মতো যদি জামাই থাকত একটা আমার। সব দুঃখহরণ করতে পারত।

কবু ওঁর ভদকা আর জলের বোতল এবং গ্লাস নিয়ে এল। বিহারি সব-ই বেতের বাক্সে প্যাক করে দিয়েছে।

—বা-ব্বা! ব্রহ্মকৃপা পেয়েছ, তাতেও তোমার দুঃখহরণ হচ্ছে না!

ঐশিকা বলল, রাগ দেখিয়ে।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, শুধু ব্রহ্মকৃপাতে কি আমার মতো পাপী তরবে রে মা। যিশুখ্রিস্ট, মা কালী সকলের কৃপাই আমার দরকার। তাই তো এখন মা কালীর সেবায় লাগব।

—মানে?

—মানে ভদকা খাব।

—পৃথিবীর কোন কোন জলপ্রপাত দেখেছ তুমি কবু? স্টেটস আর কানাডার সীমান্তে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখেছ?

কর্বুর বলল, আমি কখনো দেশের বাইরেই যাইনি। একবার শুধু বাংলাদেশে গেছিলাম। যদিও বাংলাদেশকে বিদেশ বলা যায় অবশ্য। আমার নিজের দেশ-ই এতবড়ো ও এত সুন্দর যে, আগে স্বদেশ-ই ভালো করে দেখি। তারপরে বিদেশে যাব।

—এটা তুমি ঠিক বললে না, হরিশরণ।

—কী বলছ বাবা কাকে? উনি তো কর্বুর।

—ইয়েস। ইয়েস। ভুল হয়ে গেছে। ‘স্মিরনফ’ ভদকাটা বড্ড কড়া! শ্বশুরের নামও ভুলিয়ে দেয়। সরি, হরিশরণ, আই মিন কর্বুর। তারপর বললেন, ট্রাভেলিং ইজ এডুকেশন। নিজের দেশকে ভালোবাসতে হলে, নিজের দেশের কীভাবে উপকার করা যায়, তা জানতে হলে বিদেশ অবশ্যই দেখা দরকার। না দেখলে, তুলনা করবে কী করে। বিদেশ না দেখলে নিজের দেশকেই পৃথিবী বলে ভুল করাও অসম্ভব নয়। সেইজন্যেই প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষের পক্ষেই বিদেশ দেখাটা খুব জরুরি।

—যাব কখনো। সময় হয়নি। তাগিদও হয়নি।

—যেয়ো এখন। তাড়া কীসের? অঢেল সময় পড়ে আছে। তুমি তো ছেলেমানুষ!

—হ্যাঁ। কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্র।

ঐশিকা বলল এবার।

কর্বুর তাকাল খুনশুটি করা ঐশিকার দিকে। মুখে কিছুই বলল না।

ঝরনার ঝরঝরানি শব্দ, হাওয়া-লাগা, গাছপালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে এসে পড়া শরতের সোনালি রোদের ঝিলিমিলির মধ্যে পনিটেইল করা ঐশিকাকে দারুণ দেখাচ্ছিল। কারও চুলের মধ্যে এতখানি যৌনতা থাকতে পারে তা আগে কখনো জানেনি কর্বুর। তার ওপর আতরের গন্ধ। ঝরনার স্রোতে ঝরাপাতা হয়ে খুশিতে ভেসে যেতে ইচ্ছে করছিল ওর।

গৈরিকা বলল, কুমডি দেখলাম, তারপর থলকোবাদে যাব। আর কোন কোন বনবাংলো আছে সারাণ্ডাতে?

এমন সময় ঐশিকা আঙুল দিয়ে একটি ঝোপের দিকে দেখিয়ে কর্বুরকে বলল, ওগুলো কী ফুল স্যার?

—কোনগুলো? ওগুলো তো...

—না, না। ওগুলো নয়, বাঁ-দিকে, আরও বাঁ-দিকে দেখুন। আমার আঙুল দেখুন।

আজকে ঐশিকা মরচে-রঙা জিনস পরেছে, গায়ে মরচে-রঙা শাল। মরচে-রঙা স্পোর্টস গেঞ্জির ওপরে। চুলটাকে পনি-টেইল করেছে। ভাগ্যিস আজও চুল ছেড়ে দেয়নি। কাল সারারাত কর্বুর ঐশিকার চুলের মধ্যে, চুলের গন্ধে হাবুডুবু খেয়েছে। ঘুমোতে পারেনি একটুও।

আর গৈরিকা হালকা নীলরঙা শাড়ি পরেছে, নীল-রঙা শাল। দু-বোনের মধ্যে ঐশিকাই বেশি সুন্দরী। দু-জন সুস্নাতা যুবতীর শরীরের সাবানের, পারফিউমের আর আতরের গন্ধে ঝরঝরিয়ে পড়া জলের পাশের প্রজাতির আর কাচপোকা-ওড়া এই উজ্জ্বল সকাল সুগন্ধে যেন উদবেল হয়ে উঠেছে।

কর্বুর বলল, ওঃ। ওই ফুলগুলো! ওগুলোর নাম ‘হেল’।

—ওঃ হেল।

গৈরিকা বলল, কপট বিরক্তি ঝরিয়ে।

—এখানে কি হেভেনও আছে নাকি?

—না। হেভেন নেই। শুধুই হেল।

তারপর বলল, নামটা বোধ হয় মিথ্যে নয়, কারণ ওই গাছের ফল বেটে পাহাড়ি নদীতে আদিবাসীরা যখন দেয়, তখন নদীর সব মাছ মরে গিয়ে ভেসে ওঠে। তখন তাদের ধরতে ভারি সুবিধে হয় আদিবাসীদের। এই ফলগুলো বিষ। খেলে, মানুষও মরে যেতে পারে।

—বিষক্রিয়ায় যে মাছ মরে, তা খেয়ে মানুষের কিছু হয় না?

—না, হয় না। কেন হয় না, বলতে পারব না।

—আমি তোমার পাশের এই পাথরে একটু বসি হরিহরণ? পাইপটা একটু জম্পেশ করে ধরাই। আমার তো বেশ দারুণ লাগছে জায়গাটা। এই জলপ্রপাত, এই রোদ, এই মিষ্টি শীত, এই রাশান ভদকা, আর তুমি এই হরিশরণ। দারুণ। আমি কিন্তু তোমাকে হরিশরণ বলেই ডাকব।

তারপর মেয়েদের দিকে চেয়ে বললেন, তোদের বুঝি ভালো লাগছে না?

—‘পুষ্পবনে পুষ্প নাহিরে, পুষ্প আছে অন্তরে।’

কর্বুর বলল।

—দেখেছ বাপি। যত ফুল সব উনি তোমার মধ্যে খুঁজে পেলেন।

গৈরিকা বলল।

—তা কী করা যাবে! ও নিজে গুণী তাই অন্য গুণীকে সহজে চিনল। তোদের মতো তো নয়। তা বলুন না বন-বাংলোর নামগুলো এবারে।

গৈরিকা আবার বলল।

—বলছি। তার আগে বলব, এর পরের বার এলে গুয়াতে ক-দিন থেকে যাবেন। কিরিবুরু থেকে নীচের সারাণ্ডা ভারি সুন্দর দেখায়। কিরিবুরুও সুন্দর জায়গা। সেখানে এবং মেঘাতিবুরুতে তো ভালো আরামপ্রদ গেস্ট হাউসও আছে। থলকোবাদের কাছ থেকে কারও নদী গিয়ে কোয়েলে মিশেছে। তবে এই কোয়েলে আর পালামৌর কোয়েলে অনেক তফাত। পালামৌর কোয়েল অনেক-ইবেশি সুন্দর।

—গেস্ট হাউস কাদের?

—‘বোকারো’ স্টিল-এর। গেস্ট হাউসের কাছেই ভিউ পয়েন্ট আছে। সেখানে থেকে ইচ্ছে করলে সারাণ্ডার সাতশো পাহাড়কে আলাদা করে গোনা যায়, যদি কারও ধৈর্য থাকে।

—আরও বনবাংলোর কথা বলুন। কোথায় কোথায় আছে?

সারাণ্ডা ফরেস্ট ডিভিশনে তিনটি রেঞ্জ আছে। কিরিবুরু, কয়না আর সামটা রেঞ্জ। এই কিরিবুরু রেঞ্জ-এর অধীনে পড়ে কুমডি, বরাইবুরু আর করমপদা। কয়না রেঞ্জ-এর অধীনে পড়ে পোঙ্গা, ছোটোনাগরা, অনুকুয়া, সালাই আর মনোহরপুর। এই মনোহরপুর ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় জায়গা। বনবিভাগের একজন আমলার সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনিই তাঁকে সারাণ্ডার অনেক জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেন।

—বিভূতিভূষণ তো সাধারণ মানুষ ছিলেন না আমাদের মতো যে, ওমলেট উইথ বেকন মাস্টার্ড দিয়ে খাওয়ার জন্যেই জঙ্গলে আসতেন। তিনি ছিলেন সাধক।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

—তা ঠিক।

কর্বুর বলল।

—এই গাছটি কী গাছ ভায়া?

—কোন গাছ?

—আরে আমি যার নীচে শিলাসনে বসে ভদকা খাচ্ছি আর পাইপ ফিল করছি।

—ও। এটা তো কদম গাছ।

ঐশিকা বলল, হোয়াট আ পিটি, বাপি! যদি বা জীবনের অনেক পথ হেঁটে কদমতলে এসে পৌঁছালে তাও রাধার বদলে কর্বুর সেন।

সকলেই ঐশিকার কথাতে একসঙ্গে হেসে উঠলেন। সেই হাসির দমকে ঝরনার জল যেন আরও জোর পেয়ে এগিয়ে গেল।

—অন্য বাংলোগুলোর কথা তো বললেন না? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ওঠাতে সব কিছু গোলমাল হয়ে গেল।

—হ্যাঁ। বলছি। সামটা রেঞ্জ-এর অধীনে আছে সেরাইকেলা, তিরিলপোসি, আর থলকোবাদ। থলকোবাদে তো আমরা যাচ্ছিই।

—এই ‘রেঞ্জ’ ব্যাপারটা কী বলুন তো স্যার?

ঐশিকা বলল।

—বনবিভাগের হায়ারার্কি জানলে পরে, বুঝতে সুবিধে হবে। সবচেয়ে ওপরে বনমন্ত্রী, বনমন্ত্রীর পরে ফরেস্ট সেক্রেটারি, তাঁর নীচে প্রিন্সিপাল চিফ কনসার্ভেটর অফ ফরেস্টস, সংক্ষেপে পি.সি.এফ. এবং তাঁর অধীনে আবার চিফ কনসার্ভেটর। সি.এফ. তাঁর অধীনে আবার একাধিক কনসার্ভেটর।

—একাধিক কেন?

—মানে, নানা বিভাগের একজন করে চিফ। ওয়াইল্ড লাইফ, সিলিভি কালচার, ফরেস্টস, গেম-পার্ক, প্ল্যানিং ইত্যাদি ইত্যাদি। তা ছাড়া অঞ্চল হিসেবেও আছে। যেমন, নর্থ বিহার, সাউথ বিহার ইত্যাদি ইত্যাদি। এক একজন চিফ কনাসার্ভেটর-এর অধীনে থাকেন একাধিক কনসার্ভেটর। একজন কনসার্ভেটরের অধীনে থাকেন কয়েকজন ডি.এফ.ও. অর্থাৎ ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার। আবার এক একজন ডি.এফ.ও.-র অধীনে থাকেন কয়েকজন রেঞ্জার, এক-একটি রেঞ্জ-এর দায়িত্বে।

—আর রেঞ্জারের নীচে কেউ থাকেন না?

—থাকেন বই কী! রেঞ্জারের নীচে ফরেস্টার। একাধিক-ই থাকেন। তাঁদের নীচে ফরেস্ট গার্ড।

—বাবা। এ দেখি বন্যপ্রাণীর চেয়েও সংখ্যাতে আমলা বেশি।

গৈরিকা বলল।

—হ্যাঁ। সেইরকম-ই ব্যাপার।

হেসে বলল, কর্বুর।

—এখানে একরকমের ফুলে ফোটে তাদের নাম ‘হুঁতিতি’।

—কী বললেন? তাই? অদ্ভুত নাম তো!

—হ্যাঁ। শুধু নামেই নয়, চরিত্রেও অদ্ভুত। আট বছর বাদে ফোটে। পৃথিবীর খুব কম প্রাণী অথবা উদ্ভিদের গর্ভাবস্থা এতদীর্ঘ। যদি বা থেকেও থাকে, তবে তা আমার অজানা। আমি আর কতটুকুই বা জানি।

—বাবা:। গলা তো শুকিয়ে গেল আপনার। কফি খাবেন নাকি? এনেছি তো ফ্লাস্কে করে।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, দে-দে। এনেছিস তো দিচ্ছিস না কেন?

—আপনার টোব্যাকোর গন্ধটা ভারি সুন্দর।

কর্বুর বলল, ব্যানার্জিসাহেবকে।

—‘গোল্ডব্লক’। ইংলিশ টোব্যাকো। আমার বন্ধু রনাল্ড রায়ান পাঠায় কানাডা থেকে, এর তার হাতে, নিয়মিত। ভেরি সুইট এবং সুইট স্মেলিং টোব্যাকো।

—ইচ্ছে আছে থলকোবাদে আজকের দিনটা আর রাতটা থেকে আপনাদের নিয়ে সালাই যাব। একটি নির্জন মালভূমির একেবারে ওপরে দু-কামরা আর একটি আউট হাউসের বাংলো। মালভূমিতে রাতে জিপ নিয়ে ঘুরলে, আশা করি অনেক জানোয়ার দেখাতে পারব।

—তা তো পারবে। এখন লাঞ্চের মেনুটা কী তা বলো তো দেখি।

—পৌঁছোতে তো দেরি হবে। তাই বলছি পাতলা করে মুসুর ডালের খিচুড়ির সঙ্গে কড়কড়ে করে আলুভাজা আর বেগুনি।

—বা:। ফার্স্ট ক্লাস। ভদকার সঙ্গে যা জমবে না।

—কী কী জানোয়ার দেখতে পাব আমরা?

ঐশিকা শুধোল।

—হাতি তো এখানে যত্রতত্রই দেখা যায়। কাল রাতে হাতিটা এল না কেন জানি না। তবে একটা হাতিতে ইন্টারেস্টেড নই। একটা হাতি মানেই ঝামেলার ব্যাপার। লেপার্ড ওয়াইল্ড ডগস বা ভারতীয় ঢোল দেখা যায়।

—কুকুরের নাম ঢোল?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

—তাদের দলের সর্দারের কী নাম?

এবারে গৈরিকা জিজ্ঞেস করল।

—ঢোলগোবিন্দ।

কর্বুর বলল।

তারপর বলল, হ্যাঁ। বুনো-কুকুরের-ই নাম। লাল লাল দেখতে। দলে থাকে। দিশি কুকুরের চেয়ে বড়ো হয়। আবার অ্যালশেসিয়ানদের চেয়ে ছোটো হয়। এরা পনেরো মিনিটের মধ্যে বড়ো শম্বরকে শেষ করে কঙ্কালটি রেখে যাবে। এরা যে জঙ্গলে ঢোকে, সেই জঙ্গল থেকে বাঘও ভয়ে পালায়।

—তাই?

—হ্যাঁ।

—আর মানুষদের?

—ভরসার কথা এই যে, আজ অবধি মানুষদের কখনো আক্রমণ করেনি। যেদিন মানুষের ভয় এদের ভেঙে যাবে, সেদিন থেকে বনচারী মানুষের-ই বড়ো বিপদ।

তারপর বলল, এত অল্প সময়ের জন্যে এলে কি বন দেখা যায়? কুমডির কাছেই বীরহোড়দের একটি বস্তি আছে। সেখানে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল আপনাদের। এখনও আদিম আছে তারা। চাষবাস করে না। বনের ফলমূল কান্দা-গেঠি খেয়ে থাকে। মহুয়ার ফুল, ফল, শালেরও। উইপোকাকে ওরা বলে ‘বানর-ডুমরি’, ওদের ভাষাতে। উইপোকা খায় ওরা, মহুল-ফুলও, ভাল্লুকের সঙ্গে লড়াই করে। ভাল্লুকেরও তো ওসব খুব-ই প্রিয় খাদ্য। মহুয়ার মদকে ওরা বলে ‘আরকি’। আর হাঁড়িয়া বা পচাইকে বলে ‘ভিয়েন’।

—শুনেছি, মহুয়া ‘ডক্টরড’ করে খেলে দারুণ হয়। তবে তোমার সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করে লাভ কী? কুরুবককে বলব ভাইপো দেখে এলাম বটে তোমার। সেই সেযুগে ছিল যুধিষ্ঠির আর এযুগে কর্বুর। মাঝে ধু-ধু সমুদ্দুর। যদি বা কিছু থাকতেও পারত কর্বুর তা কর্পূর করে হাওয়া করে দিয়েছে।

—‘হাওয়া-করা’ আবার কী কথা বাপি?

গৈরিকা বলল।

—আরে, আমি মিস্ত্রি মানুষ। আমি ওইরকমভাবেই কথা বলি। আমি কি আর তোদের মতো সংস্কৃতিসম্পন্ন?

—কর্বুরও তো মিস্ত্রিই। এঞ্জিনিয়ার যদি মিস্ত্রি হন।

গৈরিকা বলল।

—কর্বুরের সঙ্গে আমার তুলনা। সে তো লাখে এক। এমন একটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সে যে মোদের কর্বুর গো, কবুবাবু তুমি।

কর্বুর হেসে ফেলল।

—আচ্ছা, সালাই কতদূর? থলকোবাদ থেকে?

ঐশিকা প্রশ্ন করল এবারে।

—চল্লিশ কিমি মতো হবে। তবে জঙ্গলের পথ তো। সময় লাগে যেতে।

তাহলে...বলেই, ভদকার গ্লাস ‘বটমস-আপ’ করলেন।

ব্যানার্জিসাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনল কর্বুর একমুহূর্ত। তারপর-ই স্বগতোক্তি করল, একটা মোটরসাইকেল আসছে।

—ডাকাত-টাকাত নয় তো?

গৈরিকা বলল উদবিগ্ন গলায়।

রেজিস্ট্রিটা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর বাঁচার শখটা হঠাৎ-ই তীব্র হয়েছে যেন। বুঝতে পারে গৈরিকা। আর নিজে যখন বোঝে, তখন অন্যেরাও বোঝে নিশ্চয়ই।

ঐশিকা বলল, তাতে কী হয়েছে? আমাদের লোকাল গার্জিয়ানের কোমরে যন্ত্রও আছে।

—কী করে জানলে তুমি?

জিজ্ঞেস করল কর্বুর, ঐশিকাকে।

‘তুমি’ শুনে ব্যানার্জিসাহেব খুশি হলেন এবং খুশি যে, হয়েছেন তা দেখবার জন্যে পূরিত গ্লাসটাতে বড়োচুমুক লাগালেন একটা।

—তুমি যখন ড্রাইভিং-সিট থেকে নামছিলে তখন দেখে নিয়েছি।

সেকথার উত্তর না দিয়ে কর্বুর বলল, তাই? তোমার চোখ তো খুব ভালো।

—সে বিষয়ে কি আপনার কোনো সন্দেহ আছে?

আমার নিজের গাড়িতে ড্রাইভিং সিট-এর পাশে দরজার সঙ্গেই লাগানো হোলস্টার আছে। সেখানেই পিস্তলটা থাকে, যখন-ই গাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করি। তবে আজকালকার ডাকাতরা তো পিস্তল ব্যবহার করে না, তারা তো চাইনিজ এ. কে. ফর্টিসেভেন, ইজরায়েলি উজি, রাশিয়ান কালানিশভ অটোম্যাটিক ওয়েপনস ব্যবহার করে।

দেখতে দেখতে ‘ভটভট’ শব্দটা জোর হতে লাগল।

কর্বুর স্বগতোক্তি করল, সাইলেন্সরটা ফাটা আছে, তাই আওয়াজ এতজোর হচ্ছে।

নিস্তব্ধ শারদসকালের গভীর বনের মধ্যে সেই ফাটা-সাইলেন্সার লাগানো মোটর-সাইকেলের শব্দ চতুর্দিকে ঝরনার মতো অনুরণিত হচ্ছিল।

তারপর-ই কর্বুর উঠে দাঁড়াল। আবারও স্বগতোক্তি করল, ফটকা নয়তো!

—ফটকা?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

—সে কীরকম ডাকাত যে, নাম তার ফটকা?

গৈরিকা বলল, তা ছাড়া আমাদের কাছে আছেটা কী যে, ডাকাতি করতে আসবে?

—ওরা ক-জন আছে তা তো জানি না। আপনারা দুই বোনেই তো যথেষ্ট। আর কীসের দরকার তাদের!

বলেই বলল, ডাকাতের নাম ফটকা নয়। ভালো মানুষের নামও ফচকা নয়। আমাদের বড়োবিলের অফিসের এরাণ্ড বয়ের নাম হচ্ছে ফটকা। সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। তার মোটর-সাইকেলের সাইলেন্সরটা দশমীর দিন-ই ফেটেছে যে, তা আমি জানি। সেইজন্যই ভাবলাম...

দেখতে দেখতে শব্দটা কাছে এসে গেল এবং দেখা গেল একজন গাঁট্টা-গোট্টা বাঁটুল চালাচ্ছে মোটর-সাইকেল আর আর একজন রোগা-প্যাংলা লম্বা পেছনে বসে। তার হাতে একটা তেল-পাকানো মোটা লাঠি।

—নমস্তে ছোটোবাবু।

চালক বলল, বাইকটা লাগাতে লাগাতে।

—ক্যারে ফটকা। বাত ক্যা?

উদবিগ্ন গলাতে পাথর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কর্বুর।

—ফ্যাক্স আয়া। বড়োবাবু বলিন কি আভভি লেতে যা না।

—কাঁহাসে আয়া? কলকাত্তাসে?

—নেহি বাবু। টাট্টাসে।

বলে, সে পকেট থেকে ফ্যাক্স মেসেজটা বের করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগল।

টোটালি আনকনসার্নড ব্যানার্জিসাহেব ফটকার সঙ্গীকে বললেন, লাঠি কাহে লেতে আয়া?

সে কাঁচুমাচু মুখ করে ওড়িয়াতে বলল, হাতি মারিবাকু পাঁই।

—বলে কী এ ছোকরা! লাঠি দিয়ে হাতি মারবে কী?

—রাস্তামে মিলাথা হুজৌর। এহি লাঠি দিখকেই তো ডরকে-মারে ভাগা জোর সে।

ফটকা বলল।

—মিলা থা? হাথ্বি? কাঁহা মিলা থা?

—কুমডি বাংলো কি বগলহিমে।

কর্বুর ফটকার সঙ্গীর দিকে চেয়ে বলল, উও হ্যায় কৌন?

—জামদা সে উসকো উঠাকে লায়া হ্যায় বাবু। পান-দুকানি কি ভাতিজা। জঙ্গলমে এবেলা আনেমে ডর লাগল থু।

—ক্যা নাম হ্যায় তুমহারা?

—নমস্কার আইগাঁ। ম নাম্ব ক্রপাসিন্ধু।

—তম ঘর কউটি?

—পানপোষ আইগাঁ।

ফটকার হাত থেকে ফ্যাক্সটা নিয়েই পড়ল কর্বুর মনে মনে। ব্যানার্জিসাহেবের নামেই ফ্যাক্স। জামশেদপুর থেকে তাঁর সেক্রেটারি এম. এস. মানসুখানি পাঠিয়েছে। ‘ইয়োর ফাদার-ইন-ল এক্সপায়ার্ড লাস্ট নাইট। প্লিজ প্রসিড টু ক্যালকাটা। বডি বিইং কেপ্ট ইন মর্চুরারি। উইল বি ক্রিমেটেড ওনলি আফটার ইয়োর অ্যারাইভাল। সলিসিটর্স ওলসো ডেজায়ার্স সো। হ্যাড ওলসো স্পোকন ট্যু মিস্টার কে. সেন।’

তারপরে পি. এস.—প্লিজ টেক ইয়োর ডটার্স অ্যালাউড কনডোলেন্সেস—মীনা।

—কী ব্যাপার?

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

কর্বুরের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে উনি বললেন, নির্ঘাত সে বুড়ো টেঁসেছে। সারাটাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে গেল মানুষটা। দেড় বছর পর চারটে দিনের জন্য এসেছি...! সত্যি!

গৈরিকা আর ঐশিকা একসঙ্গে বলে উঠল, কে? দাদু?

মনে তো হচ্ছে, তাই। কর্বুর ফ্যাক্স মেসেজটা ওঁকে দিল।

উনি ফ্যাক্সটা জোরে জোরে পড়লেন।

তারপর বললেন কর্বুরকে, তুমি তোমার ফটকাকে বলো যে, আমাকে এক ঝটকাতে থলকোবাদে পৌঁছে দেবে মোটর-সাইকেলের পেছনে বসিয়ে। তুমি, বুড়োর অগাধ সম্পত্তি যারা পাবে, তাদের কলকাতাতে পাঠাবার বন্দোবস্ত করো।

—বুঝলাম না। আপনি যাবেন না?

কর্বুর বলল।

—নো। নেভার। যে শ্বশুর জীবনে জামাইকে জামাই-ষষ্ঠী পর্যন্ত খাওয়ালেন না একদিন, তাঁর মৃত্যু তো আমার কাছে আনন্দের ঘটনা। আমি থলকোবাদেই যাব। আই উইল ড্রাউন মাই সরো দেয়ার। বুলকু চাটুজ্যের মুখে তোমরা গিয়ে আগুন দাও গে যাও। আমার স্ত্রী-ই চলে গেছেন কবে। তার আবার ফাদার-ইন-ল। ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার ছিল হে কবু। চক্ষুচর্মহীন।

ঐশিকা বলল, কী হচ্ছে বাবা! এঁরা কি বুঝবেন যে, এটা তোমার ঠাট্টা!

—ঠাট্টা! তোমরাও ঠাট্টা ভাবলে নাকি?

তারপর বললেন, কর্বুর আমার পুত্রসম। কিছুই মনে করবে না। আর, ফটকা আর কৃপাসিন্ধু তো বাংলাই বোঝে না। ভারি বয়ে গেল। তোরা কোটি কোটি টাকা পাবি। তোরা যা।

তারপর বললেন,

—ওরে ওই, কী বুঝলি?

—কী?

তোর দিদির বর ব্রহ্মকৃপার কপালটা তো দারুণ রে। এ তো জ্যাকপট পাওয়ার কপাল। বিয়ের রেজিস্ট্রি হল কী সঙ্গে সঙ্গে অমর বুড়ো পটল তুলল! আমার তো ভয় ছিল আরও বছর বিশেক চালিয়ে যাবে স্ট্রেইট-ব্যাটে ব্লক করে করে।

তারপর বললেন, এই যে বাবা কর্বুর। একটা ফ্যাক্স মেসেজ লিখে দিচ্ছি, আমার জামাই বাবাজীবন ব্রহ্মকৃপাকে কনগ্রাচুলেট করে। পাঠাবার বন্দোবস্ত অবশ্যই কোরো।

 

নয়

 

আগামীকাল লক্ষ্মীপুজো। আজ-ই সকালে কর্বুরের কাকু কুরুবক, কাকি এবং কিরি পৌঁছেছে। বাগানের মধ্যে ঠাকুরদালান। দুর্গাপুজোর আগে থাকতেই ঝকঝক তকতক হয়েছে। পেতল তামার সব জিনিস পালিশ করার জন্যে বাইরে থেকে এনে লোক লাগানো হয়েছে। বারান্দার কার্নিশে লাগানো আংটা থেকে ঝোলানো রট-আয়রনের ফ্রেম থেকে অর্কিড ও সিজন ফ্লাওয়ার ঝোলানো হয়েছে। পিদিমদানিতে রেড়ির তেল আর সলতে পড়েছে। শ্যাণ্ডেলিয়ার-এর সব ক-টি বালব পরীক্ষা করে দেখে, খারাপ বালব বদল করা হয়েছে।

বাড়িতে দুর্গাপুজোই হয় না। অন্য সব পুজোই হয়, যথা—লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো হয় খাদানে খুব জাঁকজমক করে।

কালকে বড়োবিল বড়োজামদা থেকে অনেকেই আসবেন। জামশেদপুর থেকেও কাকার ঘনিষ্ঠরা আসবেন অনেকে। তাঁরা গেস্টকটেজ-এ থাকবেন। এবারে পুজো অক্টোবরের মাঝামাঝি পড়েছিল। তাই গরম একেবারেই নেই। এবারে লক্ষ্মীপুজো রবিবারে পড়েছে তাই আজ শনিবার বলে কাকুরা সকালেই এসে পড়তে পেরেছে, অন্যান্য বছর লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন রাতে আসে।

শিখীও এসেছে বড়োজামদা থেকে। জটাদা, পচাদা, গোয়েল সবাই আসবে কাল। লক্ষ্মীপুজোর ভোগ হয় ‘টাটিঝারিয়াতে’ ভুনিখিচুড়ি, বাদাম, কিশমিশ, কড়াইশুঁটি দেওয়া, আর কড়াইশুঁটির চপ। আলু ও বেগুন ভাজা। যাঁরা ভাত খান না রাতে, তাঁদের জন্যে লুচি এবং ধোকা এবং ছানার তরকারি। মিষ্টি দু-তিনরকম তো থাকেই।

আজকের মতো কাজকর্ম সব সামলে নিয়েছেন মা-কাকিমারা কাজের লোকজনের সাহায্যে। প্রসাদের জোগাড় করতে হবে সকাল থেকে। বড়োবিলের বড়োজামদার অনেকে আসবেন, মেয়েরা। অপাদিও আসবেন। আজও এসেছেন অপাদি। সর্বগুণসম্পন্না মহিলা। স্বামীহারা হয়েছেন গতবছর। মা-কাকিমার বন্ধু বিশেষ। এখন ওরা কর্বুরের লাইব্রেরি-ঘরের সামনের বারান্দাতে বসে আছে। মা, বাবা, কাকু, কাকি, অপাদি, শিখী, কবু। কিরি, ফটকার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছে বাংলোর সামনের দিকে লনে, আলো জ্বেলে। এদিকের আলো সব নিভোনো। কাল কোজাগরি পূর্ণিমা। শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদের আলোতে চরাচর ভেসে যাচ্ছে। আকাশময় তারারা উজ্জ্বল হয়েছে। এ বছর খুব বৃষ্টি হওয়াতে শরতের রূপ অনবদ্য হয়েছে। বাগান থেকে নানা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে মা, কাকিমা, অপাদি ও শিখীর মাখা সুগন্ধ। মা-কাকিমার পাউডার বা সাবান বা পারফিউমের গন্ধ চেনে কর্বুর। চেনে না অনাত্মীয়াদের সুগন্ধ। যেমন গৈরিকা, ঐশিকা, শিখী বা অপাদির। মেয়েরা চান করে উঠে পাটভাঙা শাড়ি পরলে তাঁদের কাছে গেলেই ভালো লাগায় মরে যায় কর্বুর সেই ছেলেবেলা থেকেই।

চাঁদের আলোতে দেখলে চেনা মানুষকেও অচেনা মনে হয়। যেমন অন্ধকারেও হয়। অসুন্দরকেও চাঁদের আলোতে সুন্দর বলে মনে হয়, অগায়ককে গায়ক বলে। মন্টিকাকা, করুণাজ্যাঠাও এসেছেন জেঠিমা ও কাকিমাদের নিয়ে।

বাবা বললেন, একটা গান শোনা তো কবু। অনেকদিন তোর গান শুনি না।

মা বললেন, কবু তো গাইবেই কিন্তু অপাকে তো পাওয়া যায় না। অপার গান-ই আগে শুনি। সেই লক্ষ্মীবন্দনার গানটা শোনাও তো অপা।

অপাদির অন্য দশজন মহিলার মতো গানের ব্যাপারে কোনো ন্যাকামি নেই। বলামাত্রই গান করেন উনি। অপাদি ধরে দিলেন, ‘এসো সোনার বরণ রানি গো, এসো শঙ্খকমল করে/এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, থাকো মা লক্ষ্মী ঘরে।’

বড়োভালো গানটি। গান শেষ হতে না হতেই কোথা থেকে একটি লক্ষ্মীপেঁচা এসে বসল তো বসল বড়ো স্থলপদ্ম গাছটার-ই ওপর। একটা চাপা গুঞ্জন উঠল সমবেত পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে। কিছুক্ষণ থেকে, পেঁচাটা উড়ে গেল।

করুণাজ্যাঠা বললেন, কত ষড়যন্ত্র করে আমার বাড়ির বাগানে একবারও একে আনতে পারলাম না আর দেখ গপা-আর কুরু তোদের বাগানেই সে উড়ে এল। দেবতারাও যদি ‘তেলা মাথাতে তেল দেন’ তাহলে আমরা যাই কোথায়? আরও ধনাগম হবে অচিরে। অতিউত্তম।

সকলেই হেসে উঠলেন।

কবু চুপ করে রইল। কাকি একবার চাইল কবুর দিকে, অন্যদিকে চেয়ে থেকেও বুঝতে পারল কবু।

করুণাজেঠিমা বললেন, শিখী, তুই একটা নিধুবাবুর গান শোনা।

—গলাটা আজ ভালো নেই।

বলল, শিখী।

মা বললেন, জানি তো। তবু গা, দিদি বলছেন।

শিখী ধরল, ‘কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে/আমি যাতনা বাঁধা সদা সে পড়িল সেই ফাঁসে।’

কবু গান শুনতে শুনতে কুমডিতে চলে গেল মনে মনে। ঐশিকাকে দেখতে পেল কল্পনাতে তার সামনে বসে ওই গানটিই গাইছে। তফাতটা তখন-ই বুঝেছিল। তবে তফাতটা যে, এতখানি সে এখন বুঝল। ঐশিকার ক্লাস-ই আলাদা। সামাজিক, পারিবারিক পটভূমি তো একজন মানুষের জীবনে অনেকখানি। তা সকলে স্বীকার করুন আর নাই করুন। তারপরে যাকে বলে Schooling, তার ওপরেও অনেকখানি নির্ভর করে। ঐশিকা গানও গায় শিখীর চেয়ে অনেক-ই ভালো। তা ছাড়া, যে-কথাটা সে কারওকেই বলতে পারেনি কিন্তু নিজে একদিন অনুক্ষণ অনুভব করেছে তা হল, ঐশিকার কাছে গেলেই ও যেমন শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করেছে, তেমন মহড়া দিতে দিতে শিখীর এত কাছে গতদেড়মাস ধরে থেকেও করেনি। ঠিক এইরকম শারীরিক অনুভূতি ওর জীবনে অন্য কোনো নারীর সম্বন্ধেই হয়নি।

গান শেষ হলে, সকলে নানা কথা বলছিলেন। কর্বুরের কানে কিছুই যাচ্ছিল না। ওর দু-চোখের সামনে ঐশিকার খোলা চুলের সুগন্ধি মেঘ, ওর কানে তার বুদ্ধিদীপ্ত সরস কথোপকথন, ওর নাকে সেই ফিরদৌস আতরের গন্ধ।

বুলকু চাটুজ্যে অর্থাৎ ঐশিকাদের দাদু, মায়ের বাবা কী করতেন জানে না কর্বুর। সত্যিই তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি এক এক নাতনির জন্যে রেখে গেছেন কি না তাও জানে না, জানতে চায়ও না। তবে ঐশিকা গৈরিকার বাবা ব্যানার্জিসাহেব একজন গ্রেট লোক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কথায় কথায় তাঁর ‘সেটা মন্দ হয় না’ বাক্যবন্ধটি ভোলবার নয়। মানুষটা, ছুটিতে এসে নিজেকে কী করে আনওয়াইণ্ড করতে হয়, তা জানেন। আর মেয়েরা যদি রসবোধ পেয়ে থাকে, তো বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে।

চলে যাওয়ার পর ওদের আর কোনো খবর পায়নি। কারওকে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করেছে। ও তো খাদান থেকে ফিরেছে মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। কাকু-কাকির সঙ্গে কথা হওয়ার তেমন সুযোগও হয়নি।

করুণা হঠাৎ বললেন, আরে বুলকু চাটুজ্যে চলে গেল। জানো গপা?

বাবা বললেন, কে বুলকু চাটুজ্যে?

আরে বি কে চ্যাটার্জি। কলিয়ারি কিং ছিলেন। তা ছাড়া, মস্ত বড়ো স্টিভেডর। কত শত কোটি টাকার মালিক তা ঈশ্বর-ই জানেন। কিন্তু সকালে তার নাম করলেই হাঁড়ি ফাটে এমন-ই বদনাম ছিল তার।

বাবা হয়তো চিনতেন।

কবুর বাবা বললেন।

গর্জন কাকা তো অবশ্যই চিনতেন। মিত্র এস কে’র এস কে মিত্র, কোডারমার, ক্রিশ্চান মাইকা কোম্পানির রামকুমার আগরওয়ালা আর তার ভাইয়েরাও ভালো করে চিনতেন। তবে, মানুষটা অনেস্ট ওয়েতে পয়সা করেছিল। করলে কী হয়, ওয়ান-পাইস-ফাদার-মাদার। সারাজীবন সবাইকে টাইট করে দিতে দিতে কখন যে, প্যাঁচ-ই কেটে যায় তা তো বোঝা যায় না। তাকে টাইট দিয়েছিল তার একমাত্র মেয়ের জামাই।

তারপরেই কী মনে পড়তে বললেন, কুরুবক কোথায়? তুমি চেন না? শোনোনি বুলকু চাটুজ্যের কথা?

—না তো!

কর্বুর সব শুনেও চুপ করেছিল।

জেঠু বললেন, টাটাতে তোমার যে বস গো, সেই তো বুলকু চ্যাটার্জির জামাই।

—ব্যানার্জিসাহেব! না, না, তাঁর স্ত্রী তো কবেই চলে গেছেন!

—হ্যাঁ। সে তো জানিই। মেয়ে দুটিকেও হিরের টুকরো করে তুলেছে, বুলকু চাটুজ্যের কোনোরকম কথাই না শুনে। সে চেয়েছিল দুই সুন্দরী নাতনির জন্যে দুটি ঘরজামাই নিয়ে আসে। দুটিকেই আঠারো-উনিশেই বিয়ে দিতে চেয়েছিল। যা রেখে যাবেন তা তো চারপুরুষ বসে খেলেও পাঁচপুরুষের জন্যেও থাকবে কিছু। কিন্তু ঘোঁৎলা বাঁড়ুজ্যে অন্য চরিত্রের মানুষ। সে তার শ্বশুরমশাইয়ের কোনো প্রভাব-ই মেয়েদের ওপরে পড়তে দেয়নি। তবে যাওয়া-আসা ছিল। বুড়োর চোখের মণি ছিল ওই দুই নাতনি। নাতনিরাও দাদুকে ভালোই বাসত কিন্তু তাদের আপব্রিঙ্গিং নিজে হাতে করেছে। ঘোঁৎলা বাড়ুজ্যের মতো চরিত্র আমি বেশি দেখিনি।

কর্বুর জিজ্ঞেস করল ক্ষৌণিশ ব্যানার্জির ডাকনাম বুঝি ঘোঁৎলা?

—তা নইলে আর বলচি কার কথা। ডাঁটিয়াল।

—তাঁর প্রয়োজন-ই বা কী? তাঁর ‘টেক হোম পে’ কত জানেন করুণাদা? রুসি মোদীর সঙ্গে বনত না। সে চলে যাওয়াতে এখন ব্যানার্জিসাহেবকে আটকাবার কেউই নেই। তাঁর পয়সাই কে খায় তার ঠিক নেই! মেয়ে দুটিও তো হাইলি কোয়ালিফায়েড। তারাও বাবার পয়সার প্রত্যাশা করে না।

—তোমাদের কোনোই ধারণা নেই কুরু, বুলকু চ্যাটার্জি কী পরিমাণ ধনী।

মন্টিকাকা প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললেন, ব্যাপারটা জমেছে ভালোই। লক্ষ্মীপুজোর রাতে লক্ষ্মীপেঁচা আর ধন-দৌলতের আলোচনাই তো সঠিক বিষয় আলোচনার। এদিকে চা-ও তো এসে গেল। কবুর গান কি আজ শোনা হবে না?

মন্টিকাকার একটি কন্যা আছে, নিবেদিতা, সে মোটেই সুবিধের নয়। সুবিধের নয় মানে—চেহারা, ছবি ভালোই কিন্তু একেবারে পুলিশ সার্জেন্ট। কর্বুরের ওপরে মন্টিকাকার যে নজর আছে, তা সে অনেকদিন-ই আঁচ করেছে। তবে সুখের বিষয় এই যে, মা মন্টিকাকিমাকে একেবারে পছন্দ করেন না। সেইটিই কর্বুরের রক্ষাকবচ।

কর্বুর বলল, আজ সকাল থেকেই আমার গলাতে ভীষণ ব্যথা। তা ছাড়া ইণ্ডিকার এ.সি.-টাএত এফেক্টিভ, আগে বুঝতে পারিনি, গলা একেবারে ধরে গেছে। ধরে রয়েছে।

—তাহলে আর কী? চা খেয়ে আমরা একে একে উঠি। কালকে বাড়ির পুজো সেরে এখানে আসব খিচুড়ি খেতে।

—নিশ্চয়ই আসবেন।

কর্বুরের মা বললেন, শর্বাণী আর মেয়েকেও নিয়ে আসবেন।

—নিশ্চয়ই আনব।

মন্টিকাকা বললেন।

একে একে সবাই-ই উঠলেন। কর্বুরও উঠে সকলকে ‘টাটিঝারিয়ার’ গেট অবধি পৌঁছে দিল। কর্বুরের বাবা ছেলেবেলা থেকেই শিখিয়েছেন এটি। উনি বলতেন, কেউ কারও বাড়িতে খেতে আসেন না। একটু আদর-যত্ন, আসুন-বসুন, একটু আপ্যায়নের জন্যেই আসেন। প্রত্যেককে বাইরের গেট অবধি পৌঁছে দেবে।

কর্বুর শিখীকে বলল, তুমি যাবে কীসে? কাকাবাবু নিতে আসবেন?

—না। আমি অটোতে চলে যাব।

—রাতের বেলা অটোতে যাবে কী? চলো আমিই ছেড়ে দিয়ে আসছি।

পাশে দাঁড়ানো কাকি বলল, তোমার সঙ্গে আমার দরকার আছে কবু। তোমার কাকাকে বলো, নয়তো একজন ড্রাইভারকে বলো-না। সবাই তো গুলতানি করছে সারভেন্টস কোয়ার্টারে।

এমন সময়ে একটা লাল-রঙা মারুতি এসে দাঁড়াল গেট-এ।

কর্বুর বলল, আরে রহমত খাঁ। তোমার হাতে বাজবাহাদুরের রূপমতীকে এই রাতের বেলা ছেড়ে দেওয়া কি নিরাপদ হবে? আকাশে এমন চাঁদ, বাতাসে এমন গন্ধ।

—সেইজন্যেই তো হবে কবু দাদা।

গোয়েল বলল।

—তব ঠিক হ্যায়। সামহালকে লে যানা রূপমতীকো।

—বিলকুল। আপ বে-ফিক্কর রহিয়ে।

—আচ্ছা শিখী, আবার এসো। তোমার দেওয়া বইটা পড়েছি। খুব ভালো বই। আর আজ তো গানটি শুনলাম-ই। কী আর বলব! ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোটো করব না।

—চলি কবুদা। একদিন সময় করে এসো-না আমাদের বাড়িতে। গানবাজনা হবে।

শিখী বলল।

—আমাকেও বলবে তো?

গোয়েল বলল।

—তোমাকে না বললে আমি যাবই না।

কর্বুর বলল।

শিখী কিছু না বলে, কর্বুরের খুলে দেওয়া দরজা দিয়ে সামনের বাঁ-দিকের সিট-এ গিয়ে বসল।

—চলে দাদা।

—হ্যাঁ। সামহালকে যা না।

সবাই চলে যাওয়ার পরে কর্বুর আর তার কাকি ফিরে আসছিল। ভারি ভালো লাগছে এখন। সেই চন্দ্রাতপের নীচে এখন চাঁদের আলো আর ছায়ার সাদা-কালো বুটি-কাটা গালচে পাতা। একটি পিউ কাঁহা বাংলোর পেছনে চন্দ্রালোকিত প্রান্তরে পাগলের মতো ডাকতে ডাকতে চলে গেল।

কর্বুর জিজ্ঞেস করল, ওদের দাদুর কাজ কি হয়ে গেছে?

—হ্যাঁ কবেই তো হয়ে গেছে।

—ফিরে এসেছে ওরা জামশেদপুরে?

—হ্যাঁ। ফিরে, ঐশিকা তো চলেও গেছে দিল্লিতে। সত্যি! ওদের দাদু আর মরার সময় পেলেন না!

—দিল্লিতে কোনো টিভি কোম্পানিতে জয়েন করতে। ছ-মাস ট্রেনিং-এ থাকবে তারপর ভারতবর্ষের কোনো বড়োশহরে পোস্টিং হবে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। ভারতবর্ষের বাইরেও পাঠাতে পারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল কবুর। লক্ষ করল পদ্মা।

—আর গৈরিকা? সে কবে যাচ্ছে স্টেটস-এ?

—ঠিক জানি না। সম্ভবত সামনের মাসে।

—ওঁরা কী বললেন?

—কী সম্বন্ধে?

—আমার খিদমদগারিতে সন্তুষ্ট তো! কাকার মানহানি হয়নি তো?

—বাবা:। মানহানি কী? কাকার প্রমোশন-ই হয়ে যাবে হয়তো। ব্যানার্জিসাহেব তো তোমার প্রশংসাতে পঞ্চমুখ। বারে বারে বলছেন ‘জেম অফ আ বয়’, গৈরিকাও যে কত প্রশংসা করল।

—আর অন্যজন?

—তাঁর মন ঠিক বুঝতে পারলাম না। তিনি তাঁর বাবার কথা আর দিদির কথা শুনে গেলেন। তোমার সম্বন্ধে অবশ্য বলেছেন শুধুমাত্র একটিই বাক্য।

—সেটা কী?

বলেছেন, ‘আ ভেরি নাইস পার্সন’।

—লিখে দিতে বললে না কেন কাকি? ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতাম সার্টিফিকেটটি।

একটু রাগ-রাগ গলাতে বলল কর্বুর?

বাংলোর কাছে যখন পৌঁছেছে প্রায় ওরা, তখন বুকের ভেতর থেকে একটি খাম বার করে কাকি বলল, তিনি দিল্লি যাওয়ার আগে এই চিঠিটা দিয়ে গেছেন তোমাকে দিতে।

—খাম জুড়ে সেলোটেপ লাগিয়ে তার ওপরে আবার সই করেছেন যাতে কেউ খুলে না পড়তে পারে।

—কে খুলে পড়ত?

—আমিই পড়তে পারতাম। যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর। আমিই আলাপ করালাম, এখন আমিই পর হয়ে গেলাম।

—চিঠিটা তুমিই রাখো। তুমি পড়ে, আমাকে দেবে মনে করলে দিয়ো।

—কী লিখেছে আগে দেখো। চিঠিটা তো বড়ো নয়। প্রেমপত্র হলে বড়ো হত। তবে আতর মাখা হাত বুলিয়েছে খামের ওপরে। আঃ কী সুন্দর গন্ধ। এত পাতলা চিঠি। মনে হয় ভদ্রতার চিঠিই হবে। ওদের ভদ্রতার তো কোনো তুলনা নেই।

—হ্যাঁ।

—বিশেষ করে ব্যানার্জিসাহেবের। হি ইজ আ ফাস্ট রেট জেন্টলম্যান। কলকাতা থেকেই লিখেছিলেন আমাকে।

আমি যাই। স্নান করব কাকি।

কর্বুর বলল।

শোনো, খেতে আসতে দেরি কোরো না। কাল খুব সকালে উঠতে হবে আমার আর দিদির। অনেক-ই কাজ। পুজোর দিন।

তারপর বলল, দরজা বন্ধ করে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তারপর চিঠিটা খুলে বিছানাতে শুয়ে পোড়ো। ইশ। ঐশিকাটা একটা থার্ডক্লাস মেয়ে। আর একটু বড়োচিঠি লিখতে পারল না।

কর্বুর বারান্দাতে উঠে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে মনে মনে বলল, চিঠির ওজন আর চিঠির ভার তো কথা নয়। কী লিখেছে সে, দেখাই যাবে।

ঘরে গিয়ে চিঠিটাকে লেখার টেবিলের ওপরে রেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে সে বাথরুমে গেল।

অনেক অনেকদিন পরে ঈষদুষ্ণ জলে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে স্নান করতে করতে, সাবান মাখতে মাখতে সে গুনগুনিয়ে গান গাইতে লাগল—‘কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে।’ তারপর আয়নার সামনে নিরাবরণ নিজেকে ভালো করে দেখল বহুদিন পর। নিজেকে দেখে ওর নিজেকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করল। মুখটা আয়নাতে অচেনা মনে হল। কে যেন উত্তেজনা মেশা লজ্জার আবির মাখিয়ে দিয়েছে তার মুখে। এ মুখকে সে আগে জানেনি। এ এক প্রেমিকের মুখ।

পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে, চুল আঁচড়ে, ব্রাইলক্রিম মেখে, ওডিকোলন গালে ঘাড়ে বুকে লাগিয়ে সত্যি সত্যিই বিছানাতে এসে শুয়ে, বুকের নীচে বালিশ দিয়ে চিঠিটা খুলল। হালকা নীল-রঙা প্যাডে বাঁ-দিকের ওপরে ইংরেজিতে ছাপা Oishika Banerjee... ঠিকানা নেই, ফোন নাম্বার নেই। তবে ডানদিকে তারিখ আছে, আর স্থান আছে। নীলডি, জামশেদপুর, বিহার।

স্যার

আমি ভালো চিঠি লিখতে পারি না। বাংলাতে তো পারিই না, যদিও সেটা গর্বের কথা নয়।

এইটুকু বলার জন্যেই এই চিঠি যে, কবু, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। সত্যি কথা বলতে কী, এত ভালো, এর আগে, আর কারওকেই লাগেনি।

পরিযায়ী পাখির-ই মতো হয়তো একবছর পরে আবার উড়ে যাব তোমার কাছে। আমার বাঁ-পায়ের মধ্যমাতে একটা রুপোর চুটকি পরিয়ে দেওয়া তোমার উচিত ছিল। অনেক পাখির মধ্যে আমাকে যদি তখন চিনতে না পারো।

তোমার সঙ্গে আমার অনেক-ই কথা ছিল। দাদু চলে গিয়েই সব গুবলেট হয়ে গেল। আর বাপি আর একজন ডিসটার্বিং এলিমেন্ট। অথচ বাপিই যে, আমাদের সব।

আমার দিল্লির ঠিকানা, ফোন নাম্বার, ফ্যাক্স নাম্বার সব দিলাম। আমার চিঠিটা যে, পেয়েছ সেটুকুই শুধু জানাবে Fax করে। তারপরে চিঠি লিখবে। চিঠির আজও কোনো বিকল্প নেই স্যার। এই ফ্যাক্স আর ই-মেইল-এর দিনেও।

যদি আসতে পারো, তো কবে আসবে, কোথায় উঠবে তা রেসিডেন্স-এ ফোন করে জানাবে। আমাকে রোজ-ই সকাল আটটার মধ্যে করলে পাবে।

তোমার সঙ্গে এতকথা আছে যে, তা ফোনে বা একটামাত্র চিঠিতে বলা যাবে না। অথচ কথা ক-টি খুব-ই জরুরি। বেশিদিন অপেক্ষা করা যাবে না।

আমার সঙ্গে তোমারও যদি কোনো কথা না থাকে, তাহলে এসো না।

আসছ কী আসছ না, জানিয়ো। দেওয়ালির সময়ে এলে সময় দিতে পারব। ছুটি থাকবে দু-দিন। এলে খুশি হব।

ভালো থেকো।

Take care!

Regards–

ইতি—পরিযায়ী, ওই যা:।

শ্রীকর্বুর সেন

টাটিঝারিয়া, চড়ুই-চড়াই,

বড়োবিল, ওড়িশা

 

দশ

 

রাতে খাবার টেবিলে ওরা সকলে খেতে বসেছিল। গর্জনবাবু ওরফে গপা, কর্বুরের বাবা, খেয়ে নিয়েছেন আগেই। মা আর কাকু পাশাপাশি বসেছেন। কর্বুর আর কাকি, অন্যদিকে পাশাপাশি।

ডালের বাটিটা নিজের দিকে টেনে কবু বলল, মা, আজ দিল্লি থেকে একটা জরুরি ফ্যাক্স এসেছে। আমাকে কালীপুজোর আগে একবার দিল্লি যেতে হবে। বুঝেছ?

—ওমা! তাই?

—হ্যাঁ।

—কী কাজে যাবি?

কুরুবক জিজ্ঞেস করল।

—এক্সপোর্ট প্রোমোশান কাউন্সিল-এর এম.ডি. ডেকেছেন। আমাদের কোম্পানিই হয়তো অ্যাওয়ার্ডটা পেতে পারে এবারে। গুজব শুনছিলাম। ঠিক নেই অবশ্য।

—বা:। তাই নাকি? সব-ই ভালো খবর। এবারে লক্ষ্মীপুজো তো একেবারে জমে গেল দেখছি।

পদ্মা কর্বুরের মুখের দিকে চাইল একবার। তারপর কর্বুরকে সার্ভিংস্পুন দিয়ে ডাল ঢেলে দিতে দিতে বলল, খবর যখন শুভ, তখন দেরি না করাই ভালো। শুভস্য শীঘ্রম।

বলেই, টেবিলের নীচে বাঁ-হাতটা নামিয়ে কর্বুরের ঊরুতে খুবজোর চিমটি কাটল একটা পদ্মা।

—উঃ।

বলে উঠল কর্বুর।

মা বললেন, কী হল?

—লঙ্কা! লঙ্কা।

বলল, কর্বুর।

—সত্যি! এতবার বলি এদের, ডালে শুকনো লঙ্কা না দিতে কথা কি শুনবে এরা! মিষ্টি কিছু খা একটা। সন্দেশ খাবি?

—সন্দেশের চেয়েও মিষ্টি তোমার কাছে কিছুই কি নেই দিদি?

—কী যে হেঁয়ালি হেঁয়ালি কথা বলিস তুই আজকাল পদ্মা, বুঝি না কিছুই।

—বুঝবে দিদি, বুঝবে। আমি সব-ই বুঝিয়ে দেব।

কুরুবক চকিতে একবার পদ্মার মুখে তাকাল।

এক নি:শব্দ হাসিতে তার মুখ ভরে উঠল।

কর্বুরের কাকি পদ্মা বলল, অ্যাওয়ার্ডটা কোম্পানি পেলে তো ভালোই। আমাদের কবুও একটা অ্যাওয়ার্ড পাবে, ইনডিভিজুয়াল পারফরমেন্সের জন্যে।

কবুর মা বললেন, তাই নাকি? ওঁকে বলব তো কথাটা কাল ভোরেই।

কবু কথা না বলে, মুখ নামিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেতে লাগল, এমনইভাবে, যেন জীবনে মুগের ডাল খায়নি কখনোই।

 

 

[এই উপন্যাসের সব চরিত্রই কাল্পনিক। উপন্যাসে উল্লিখিত কোনো চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কোনো চরিত্রর কোনো মিল পরিলক্ষিত হলে তা সম্পূর্ণই দুর্ঘটনাপ্রসূত বলেই জানতে হবে।]

—লেখক

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন