স্ট্রেঞ্জার – ৯

কাজী আনোয়ার হোসেন

নয়

লিযের পিছু নিয়ে স্যালোনে এসে আর্মচেয়ারে বসল রানা। নিচু ভলিউমে বেহালার সিডি চালিয়ে দিল লিয। দুটো গ্লাসে কালো রাম ঢালতে যাচ্ছিল লিয, চট করে মনে পড়ে যাওয়ায় রানা বাধা দিল। ‘আমার কাছে এক বোতল ভাল উইস্কি আছে। উপহার দিয়েছিল একজন। এক দৌড়ে নিয়ে আসছি ওপর থেকে।’

চেয়ার ছেড়ে চিলেকোঠার দিকে চলল রানা। দশ মিনিট পর ফিরল পনেরো বছরের পুরনো গ্লেনমোরেঞ্জির বোতল হাতে। ওটা দেখে সাইডবোর্ড থেকে ক্রিস্টালের দুটো গ্লাস নিয়ে এল লিয। মুখোমুখি দুই চেয়ারে বসল ওরা।

নিজের অতীত স্মৃতিচারণ করতে করতে দুনিয়ার সেরা মদে চুমুক দিল লিয। মুরগির ছোট্ট খামারে জীবনের প্রথম দশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে বাবা-মার সঙ্গে। জায়গাটা ছিল গৃহযুদ্ধের এলাকা। আত্মসমর্পণের আগে ওখানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে জেনারেল লি। ওদিকের জমিতে এখনও পাওয়া যায় মাস্কেটের পুরনো বুলেট।

‘মুরগি বিক্রি করে যা আসত, তার চেয়ে বেশি রোজগার করত বাবা মাছ ধরে,’ আনমনে বলল লিয।

খামারের ব্যাপারে অদক্ষ ছিল ওর বাবা। শেষে সব বিক্রি করে হাজির হলো চিটিমাচা শহরে। ছোট একটা চাকরি নিল পরিবারের মুখে খাবার জোগাতে। খুব কঠিন ছিল ওদের জীবনটা।

সতেরো বছর বয়সে বড় শহরের টানে বাড়ি ছাড়ল লিয। ভালবাসল নিজের চেয়ে আঠারো বছরেরও বেশি বয়সের মার্ক ডওসনকে। ওই শহরে সে ছিল প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ দাঁতের ডাক্তার। বিয়ে করল ওরা। তবে বাচ্চা নিল না লোকটা। বহু বছর পর লিয জানল, শহরের নানান জায়গায় ওর স্বামীর রয়েছে ছয়জন রক্ষিতা। তাদের পেটে হয়েছে তার ঔরসে আট ছেলেমেয়ে। এসব যখন জানল লিয, ওর বয়স প্রায় চল্লিশ। মাথায় ভেঙে পড়ল আকাশ। বুঝল কেন বাচ্চা নিতে রাজি হয়নি মার্ক ডওসন। তার এই চরম বিশ্বাসঘাতকতা মানতে পারল না লিয। ঠিক করল, তালাক দেবে তাকে।

‘আসলে জীবনের কঠিন এই পথে সবাই কিছু না কিছু গোপন করে,’ বলল লিয। ‘মনটা ভেঙে গিয়েছিল আমার।’

‘আমি দুঃখিত, বিড়বিড় করে বলল রানা। রেগে গেছে মার্ক ডওসনের ওপর।

আবারও গ্লাসে সোনালি গ্লেনমোরেঞ্জি ঢেলে নিল ওরা। গ্লাসে চুমুক দিয়ে তিক্ত হাসল লিয। ‘তোমার জীবনেও অনেক গোপন কিছু আছে, তাই না, রানা?’

সরাসরি প্রশ্ন শুনে আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা। ‘জেনেবুঝে কখনও কাউকে ঠকাতে যাইনি।’

‘আমার একটা গোপন কথা আছে, বলল লিয। ‘ওটা বহু বছর আগের। ছোটবেলায় মা বলেছিল। তবে বলে দিয়েছিল, কাউকে যেন না বলি। নইলে এ এলাকার অনেকেই ঘৃণা করবে আমাকে।’

‘ঘৃণা করবে? কেন?’

‘ওটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে গৃহযুদ্ধের ইতিহাস, কাঁধ ঝাঁকাল লিয। ‘আমাদের এই দক্ষিণে সবসময় ইতিহাস নিয়ে চর্চা চলে।’

‘তুমি কি তোমার গোপন তথ্য আমার সঙ্গে শেয়ার করতে চাও?’ জানতে চাইল রানা। ‘বলে ফেললে পরে হয়তো খারাপ লাগবে।’

মৃদু হাসল লিয। ‘ঠিকই বলেছ, না বলাই বোধহয় ভাল। তুমি আবার রাগ করলে না তো?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে চাই না।’

‘তা হলে বরং প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলি, বলল লিয। ‘নিজের ব্যাপারে কিছুই বলোনি। … এবার কি বলবে কী ধরনের পেশায় আছ?’

‘আমি ইউএস হেল্‌থ্ ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর, গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ‘রেস্টুরেন্টগুলো ভাল খাবার দিচ্ছে কি না, সেটা ঘুরে ঘুরে দেখছি।’

‘না, ঠাট্টা নয়, রানা।’

‘মানুষকে নিরাপদ রাখার কাজে নিয়োজিত।’

‘পুলিশ?’

‘না, তা নই।’

‘তা হলে ডিটেকটিভ? নাকি উকিল?’

‘না, উকিল নই। পেটে অত প্যাঁচ নেই। কাজ করি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে।’

‘বিয়েটিয়ে করোনি?’

‘বিয়ে তো করতে চাইল না কেউ।’

‘এত ভাল ছেলে, বিয়ে করবে না বললেই হলো?’ মাথা নাড়ল লিয। ‘তুমি নিজেই বোধহয় বিয়ে করতে চাওনি। অবশ্য, বয়সও তো বেশি হয়নি। পঁচিশ কি ছাব্বিশ? অনেক সময় পড়ে আছে। … বাড়িতে কারা আছেন?’

‘সেই ছোটবেলায় মারা গেছেন বাবা-মা,’ বলল রানা। ‘ভাই-বোনও নেই।’

‘তাতে কী, স্রষ্টা তো আছেন,’ বলল লিখ। ‘দেখভাল করছেন। পৃথিবীতে শেষ দিনটা পর্যন্ত তিনিই তো সাহায্য করেন আমাদের সবাইকে। তুমিও সবার বাইরে নও। তোমাকে কখনও ত্যাগ করেননি ঈশ্বর। নইলে বহু আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হতো।’

চুপ করে থাকল রানা।

ওর গ্লাসে আবারও উইস্কি ঢেলে দিল লিয।

চুপচাপ কিছুক্ষণ ড্রিঙ্ক করল ওরা।

টুকটাক কথার মাঝ দিয়ে পেরিয়ে গেল আরও দু’ঘণ্টা। তারপর রানা খেয়াল করল, প্রায় শেষ করে এনেছে ওরা উইস্কির বোতল।

নরম সুরে বলল লিয, ‘জায়গাটা ভাল লাগলে থেকে যাও আরও কিছু দিন। রুম ভাড়া দিতে হবে না। খাবারও ফ্রি।’

‘পরে কখনও এলে নিশ্চয়ই তোমার গেস্টহাউসে উঠব,’ কথা দিল রানা। হোয়াইট ওয়াইন ও স্কচ উইস্কি মিলে কড়া নেশা হয়েছে ওর। চেয়ার ছেড়ে হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে টলতে টলতে তৃতীয়তলার চিলেকোঠায় উঠল রানা। বিছানায় শুয়ে দেখল, সবই দেখছে দুটো করে। কেমন ঝাপসা। কোন্‌টা যে আসল আর কোনটা নকল, কে জানে!

খেয়াল থাকল না পোশাক পাল্টায়নি। পায়ে এখনও বুট। ঘুমিয়ে পড়তেই পৌঁছল অদ্ভুত ঘন-ঘোরের ভেতর।

বহুক্ষণ পর চটকা ভাঙল ওর।

আনমনে ভাবল, জগৎ ভরে গেছে নানান বিদঘুটে আওয়াজে।

কেন যেন সতর্ক করছে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।

ঘোরের ভেতর শুনল একটা চিলচিৎকার।

ওটা এসেছে নিচতলা থেকে।

কয়েক মুহূর্ত পর এল কাঁচ ভাঙার আওয়াজ।

মেঝেতে পড়ল ভারী কী যেন।

খানিকটা সচেতন হয়ে উঠল রানা।

আবারও আর্তচিৎকার ছাড়ল কেউ।

ভীষণ ভয় পেয়েছে কোনও মহিলা!

উইস্কির নেশার শেষ রেশটা কেটে গেল রানার।

তখনই প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরে উঠে থেমে গেল নারীকণ্ঠ! হঠাৎ কাউকে জবাই করলে এমন আওয়াজ হয়!

লাফিয়ে বিছানা ছাড়ল রানা। ঝড়ের বেগে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে তীরবেগে নামতে লাগল। ভাল করেই বুঝেছে, মারাত্মক কোনও বিপদে পড়েছে লিয বাউয়ার!

সকল অধ্যায়

১. স্ট্রেঞ্জার – ১
২. স্ট্রেঞ্জার – ২
৩. স্ট্রেঞ্জার – ৩
৪. স্ট্রেঞ্জার – ৪
৫. স্ট্রেঞ্জার – ৫
৬. স্ট্রেঞ্জার – ৬
৭. স্ট্রেঞ্জার – ৭
৮. স্ট্রেঞ্জার – ৮
৯. স্ট্রেঞ্জার – ৯
১০. স্ট্রেঞ্জার – ১০
১১. স্ট্রেঞ্জার – ১১
১২. স্ট্রেঞ্জার – ১২
১৩. স্ট্রেঞ্জার – ১৩
১৪. স্ট্রেঞ্জার – ১৪
১৫. স্ট্রেঞ্জার – ১৫
১৬. স্ট্রেঞ্জার – ১৬
১৭. স্ট্রেঞ্জার – ১৭
১৮. স্ট্রেঞ্জার – ১৮
১৯. স্ট্রেঞ্জার – ১৯
২০. স্ট্রেঞ্জার – ২০
২১. স্ট্রেঞ্জার – ২১
২২. স্ট্রেঞ্জার – ২২
২৩. স্ট্রেঞ্জার – ২৩
২৪. স্ট্রেঞ্জার – ২৪
২৫. স্ট্রেঞ্জার – ২৫
২৬. স্ট্রেঞ্জার – ২৬
২৭. স্ট্রেঞ্জার – ২৭
২৮. স্ট্রেঞ্জার – ২৮
২৯. স্ট্রেঞ্জার – ২৯
৩০. স্ট্রেঞ্জার – ৩০
৩১. স্ট্রেঞ্জার – ৩১
৩২. স্ট্রেঞ্জার – ৩২
৩৩. স্ট্রেঞ্জার – ৩৩
৩৪. স্ট্রেঞ্জার – ৩৪
৩৫. স্ট্রেঞ্জার – ৩৫
৩৬. স্ট্রেঞ্জার – ৩৬
৩৭. স্ট্রেঞ্জার – ৩৭
৩৮. স্ট্রেঞ্জার – ৩৮
৩৯. স্ট্রেঞ্জার – ৩৯
৪০. স্ট্রেঞ্জার – ৪০
৪১. স্ট্রেঞ্জার – ৪১
৪২. স্ট্রেঞ্জার – ৪২
৪৩. স্ট্রেঞ্জার – ৪৩
৪৪. স্ট্রেঞ্জার – ৪৪
৪৫. স্ট্রেঞ্জার – ৪৫
৪৬. স্ট্রেঞ্জার – ৪৬
৪৭. স্ট্রেঞ্জার – ৪৭
৪৮. স্ট্রেঞ্জার – ৪৮
৪৯. স্ট্রেঞ্জার – ৪৯
৫০. স্ট্রেঞ্জার – ৫০
৫১. স্ট্রেঞ্জার – ৫১
৫২. স্ট্রেঞ্জার – ৫২
৫৩. স্ট্রেঞ্জার – ৫৩
৫৪. স্ট্রেঞ্জার – ৫৪
৫৫. স্ট্রেঞ্জার – ৫৫
৫৬. স্ট্রেঞ্জার – ৫৬
৫৭. স্ট্রেঞ্জার – ৫৭
৫৮. স্ট্রেঞ্জার – ৫৮
৫৯. স্ট্রেঞ্জার – ৫৯
৬০. স্ট্রেঞ্জার – ৬০
৬১. স্ট্রেঞ্জার – ৬১
৬২. স্ট্রেঞ্জার – ৬২
৬৩. স্ট্রেঞ্জার – ৬৩

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন