১৪. ভারতের অতীত ও ভবিষ্যৎ

ভগিনী নিবেদিতা

চর্তুদশ পরিচ্ছেদ
ভারতের অ
তীত ও ভবিষ্যৎ

গুরুর সহিত যদি ভূ-প্রদক্ষিণও করা যায়, তবে উহাই তীর্থযাত্রায় পরিণত হয়। একদিন লোহিতসাগরে সন্ধ্যার কিছু পরে একটি ব্যক্তিগত সমস্যা লইয়া আমি স্বামীজীর নিকট উপস্থিত হই। প্রশ্নটি ছিল, অপরকে সাহায্য করিবার প্রকৃত পন্থা কি। বস্তুতঃ এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর তিনি শাস্ত্রোক্তি অবলম্বন ব্যতীত স্বয়ং কদাচিৎ দিতেন। এইরূপ উত্তরের জন্য পরে আমরা কতই না কৃতজ্ঞ বোধ করিয়াছি! তাহার ব্যক্তিগত মত আমরা জানিতে চাহিতাম। কিন্তু কোন শাস্ত্রবাক্যের ব্যাখ্যাসহযোগে ঐ মত প্রকাশ করায় আমাদের মনে উহা দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হইয়া যাইত, এবং অসহিষ্ণু প্রশ্নকর্তার অভিপ্রায় মতো তৎক্ষণাৎ কোন একটা উত্তর দিলে যেরূপ হইত, তাহা অপেক্ষা অধিক দিন ধরিয়া আমরা ঐ বিষয়ে চিন্তা ও আলোচনা কবিতে পারিতাম।

ঐরূপ একদিন, কোন ব্রত লইয়া যাহারা সিদ্ধিলাভ না করিতে পারে, তাহাদের কী গতি হয়, এই বিষয়ে প্রশ্ন করিলে তিনি কয়েকটি সুন্দর সংস্কৃতশ্লোক উদ্ধৃত করিয়া উত্তর দেন। তাঁহার সেই অপূর্ব কণ্ঠস্বর এখনও আমার কানে বাজিতেছে।

অর্জুনের প্রশ্নটি আবৃত্তি করিলেনঃ

“অতিঃ শ্ৰদ্ধয়োপেতে যোগাচ্চলিতমানসঃ।
অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি ॥
কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্চিন্নাভ্রমিব নশ্যতি।
অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্ৰহ্মণঃ পথি।।”
–গীতা, ৬/৩৭-৩৮

 —অর্থাৎ হে কৃষ্ণ, যে সকল ব্যক্তি শ্রদ্ধার সহিত কোন যোগ অভ্যাস করিতে আরম্ভ করিয়া উহাতে সিদ্ধিলাভ করিতে না পারিলে তাহাদের কি গতি হয়? হে মহাবাহো, ব্ৰহ্মমার্গে অবস্থান না করিতে পারিয়া তাহারা কি উভয় কূল হারাইয়া বায়ুতাড়িত মেঘের ন্যায় খণ্ড খণ্ড হইয়া বিনাশপ্রাপ্ত হয়?

পরক্ষণেই তিনি শ্রীকৃষ্ণের নির্ভীক ও সগর্ব উত্তর আবৃত্তি করিলেনঃ

“পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে।
ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদুর্গতিং তাত গচ্ছতি ॥”
—গীতা, ৬/৪০

–হে পার্থ, ইহলোকে বা পরলোকে তাহাদের কদাপি বিনাশ নাই। হে তাত, যে ব্যক্তি কোন কল্যাণকর কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে, তাহার কোন কালে দুর্গতি হয় না।

তারপর তিনি এমন এক প্রসঙ্গে উপনীত হইলেন, যাহা আমি জীবনে কখনও ভুলিব না। প্রথমে তিনি বুঝাইয়া দিলেন, শরীর, মন ও বাক্যের সম্পূর্ণ সংযম ব্যতীত যাহা কিছু কাজ, সব ইন্দ্রিয়সেবা মাত্র। অতঃপর বলিলেন, সিদ্ধিলাভে ব্যর্থ সাধক কখন কখনও রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হইয়া জন্মগ্রহণ করে, এবং যে বাসনার ফলে তাহার পতন ঘটিয়াছিল, ঐ জন্মে উহাই চরিতার্থ করে। তিনি আরও বলিলেন, “অনেক সময়, পূর্বজন্মের সাধু-জীবনের স্মৃতি এই সব রাজাদের মনের মধ্যে বারংবার উদয় হয়। পূর্বজন্মের এইরূপ একটা অস্পষ্ট স্মৃতি বর্তমান থাকা মহত্ত্বের লক্ষণ বলিয়া গণ্য হয়। আকবরের ঐরূপ স্মৃতি ছিল। তাহার মনে হইত, পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন ব্রহ্মচারী, কোন কারণে ব্রত পালনে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি আরও অনুকূল অবস্থার মধ্যে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিবেন এবং সেইবার তিনি সিদ্ধিলাভ করিবেন। ইহার পর স্বামীজী নিজের ব্যক্তিগত ঘটনা কিছু কিছু বলিলেন। কদাচিৎ তিনি ঐরূপ বলিতেন। পূর্বজন্মের স্মৃতিপ্রসঙ্গে তিনি যেন অন্যমনে ক্ষণকালের জন্য নিজ অতীত জীবনের আবরণ উন্মোচন করিয়া ফেলিলেন। সহসা আমার দিকে ফিরিয়া আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি যাই ভাব . কেন, আমারও এরকম একটা স্মৃতি আছে। যখন আমি মাত্র দু-বছরের, আমাদের সহিসের সঙ্গে ছাইমাখা, কৌপীনপরা বৈরাগী সেজে খেলা করতাম। আর যদি কোন সাধু ভিক্ষা করতে আসত, তাহলে বাড়ির লোকে আমাকে ওপরতলায় দরজা বন্ধ করে রাখত, পাছে আমি তাকে অনেক কিছু দিয়ে ফেলি। আমি মনে প্রাণে অনুভব করতাম, আমিও ঐ রকম সাধু ছিলাম, কোন অপরাধবশতঃ শিবের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়েছি। অবশ্য আমার বাড়ির লোকেরা ঐ ভাবটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল, কারণ আমি যখন দুষ্টুমি করতাম, তারা বলত, “হায়! হায়! এত জপতপ করবার পর শেষে শিব কিনা কোন পুণ্যাত্মাকে না পাঠিয়ে এই ভূতটাকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অথবা আমি খুব দুরন্তপনা করলে তারা ‘শিব! শিব!’ বলতে বলতে আমার মাথার উপর এক বালতি জল ঢেলে দিত। আর আমিও তৎক্ষণাৎ শান্ত হয়ে যেতাম—এর অন্যথা কখনো হতো না। এখনো পর্যন্ত আমার মনে যখন কোন দুষ্টুবুদ্ধি জাগে, ঐ কথা মনে পড়ে যায়, আর অমনি আমি শান্ত হয়ে যাই। মনে মনে বলি, ‘না, না, এবার আর নয়’!”

যাহা হউক বর্তমান ক্ষেত্রেও স্বামীজী তাহার প্রথামত গীতার মত উদ্ধৃত করিলেন, আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিলেন,”তিন রকমের দান আছে—তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক। তামসিক দান—যা ঝোকের মাথায় করা হয়—সব সময়ে তা ভ্রমপূর্ণ। দাতা নিজের দান করবার ঝোক ছাড়া আর কিছু চিন্তা করেন না। নামযশের জন্য যে দান—তাকে বলা হয় রাজসিক দান। আর সাত্ত্বিক দান—যা দেশ কাল ও পাত্র বিচার করে দেওয়া হয়। তারপর যে ঘটনা হইতে আমার প্রশ্নটির উৎপত্তি তাহার উল্লেখ করিয়া বলিলেন, “আমার মনে হয়, তোমার দানটা তামসিক ধরনের হয়েছে। সাত্ত্বিক দানের কথা ভাবতে গেলে আমার মনে দিন দিন এক মহানুভবা পাশ্চাত্য রমণীর কথাই দৃঢ়ভাবে উদয় হচ্ছে; দেখেছি, তারই দানে কোন আড়ম্বর নেই, দেশ কাল ও পাত্রের যথেষ্ট বিচার আছে এবং কোন ভ্ৰম-প্রমাদ নেই! আমার নিজের কথা বলতে গেলে, আমি ক্রমাগত শিক্ষা করছি যে, দানেরও একটা নির্দিষ্ট মাত্রা থাকা চাই, নতুবা ওতে বিপরীত ফল হয়।”

তাহার কণ্ঠস্বর ক্রমে মৃদুতর হইয়া অবশেষে নীরবতায় ডুবিয়া গেল, এবং আমরা নক্ষত্রালোকে উদ্ভাসিত সমুদ্রের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলাম। তারপর তিনি পুনরায় আরম্ভ করিলেন, “বয়স যত বাড়ছে, ততই দেখছি যে, ছোটছোট কাজের মধ্যেই আমি মহত্ত্বের বিকাশ দেখতে চাই। কোন মহৎ ব্যক্তির সম্পর্কে আমার জানতে ইচ্ছা করে তিনি কি আহার করেন, কি পরেন, চাকরবাকরদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলেন—এই সব। আমি দেখতে চাই, সার ফিলিপ সিডনীর মতো ছোটখাট কাজে মহত্ত্বের নিদর্শন। মৃত্যুকালেও পরের তৃষ্ণানিবারণের কথা যাদের মনে আসে—তাদের মতো লোক অতি বিরল।

“কিন্তু উচ্চপদে অধিষ্ঠিত যে-কোন লোক মহতের ন্যায় আচরণ করতে পারে। রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোয় অতি বড় ভীরুও সাহসী হয়ে ওঠে—জগৎসুদ্ধ লোক যে তার দিকে তাকিয়ে আছে! তখন কার না হৃদয় নেচে উঠবে? কার না শিরায় রক্তস্রোত দ্রুততর বইবে, যতক্ষণ না সে তার শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ দেখাতে পারছে।

“দিন দিন আমার কাছে নগণ্য কীটের মতো নীরব অবিচলিতভাবে মুহূর্তের পর মুহূর্ত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবিশ্রান্ত কর্তব্য কর্ম করে যাওয়াই প্রকৃত মহত্ত্ব বলে বোধ হয়।”

স্বামীজীর অপূর্ব কথাবার্তার স্মৃতি বিজড়িত থাকায় মানচিত্রের কত নূতন স্থানই না আমার দৃষ্টিতে নূতন সৌন্দর্য লাভ করিয়াছে। ইটালীর উপকূল অতিক্রম করিবার সময় আমরা বিভিন্ন খ্রীস্টীয় ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছি। বনিফেসিও প্রণালীর মধ্য দিয়া যাইবার সময় কর্সিকা দ্বীপের দক্ষিণ উপকূল আমাদের দৃষ্টিগোচর হইলে সম্রমের সহিত স্বামীজী মৃদুতরকণ্ঠে ‘সেই সংগ্রামদেবতার জন্মভূমি’ সম্পর্কে বলিতে লাগিলেন, এবং ক্রমশঃ ফরাসী দেশের অবতারণা করিয়া রোবসপিয়রের ক্ষমতা সম্পর্কে অথবা ‘তুমিও নেপোলিয়ন!’ এই কথা দ্বারা ভিকটর হিউগো তৃতীয় নেপোলিয়নের প্রতি যে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন, সে সম্বন্ধে বর্ণনা দিতে লাগিলেন।

জিব্রাল্টার প্রণালীর মধ্য দিয়া যাইবার সময় আমি প্রাতঃকালে ডেকের উপর আসিতেই, তিনি সাগ্রহে বলিলেন, “তুমি তাদের দেখেছ কি? তাদের দেখেছ কি? ওখানে জাহাজ থেকে তারা নামছে, আর ‘দীন্‌!’ ‘দীন্‌!’ শব্দে গগন বিদীর্ণ করছে।” অতঃপর আধ ঘণ্টা ধরিয়া মুরদিগের বারংবার স্পেন আক্রমণের জ্বলন্ত বর্ণনা দ্বারা তিনি আমাকে অভিভূত করিয়া দিলেন। আবার হয়তো কোন রবিবারের সন্ধ্যায় তিনি বহুক্ষণ ধরিয়া বুদ্ধদেবের গল্প করিলেন। বুদ্ধ-জীবনের সাধারণ ইতিহাস বর্ণিত নীরস ঘটনাগুলিতে তিনি যেন নূতন প্রাণ সঞ্চার করিতেন। মহাভিনিষ্ক্রমণ ব্যাপারটি ভগবান বুদ্ধের নিকট যেরূপ বোধ হইয়াছিল, স্বামীজী ঠিক সেইভাবেই উহার বর্ণনা দিতেন।

কিন্তু তাহার সকল কথাবার্তাই মনোরঙ্ক অথবা শিক্ষাসংক্রান্ত ছিল না। প্রায়ই তিনি জ্বলন্ত উৎসাহের সহিত নিজের জীবনের মহান উদ্দেশ্য বর্ণনা করিতেন। ঐ সকল সময়ে আমি পূর্ণ মনোযোগের সহিত অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিতাম। তাহার শ্রীমুখ-নিঃসৃত প্রত্যেকটি বাক্য সংগ্রহ করিয়া রাখিবার ঐকান্তিক আগ্রহ আমার ছিল। কারণ আমি জানিতাম, ভবিষ্যতে অসংখ্য ভক্ত ও জিজ্ঞাসু জন্মগ্রহণ করিবেন, যাহারা স্বামীজীর স্বপ্নগুলি বাস্তবে পরিণত করিবেন, এবং তাহাদের ও স্বামীজীর মধ্যে আমি কেবল বার্তাবাহী যন্ত্র বা সেতুস্বরূপ।

যখন আমরা এডেনের নিকটবর্তী হইয়াছি, সেই সময়ে এইরূপ একটি সুযোগ উপস্থিত হইল। সেদিন প্রাতঃকালে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করি, ভারতের কল্যাণের জন্য তাহার যে সব পরিকল্পনা, এবং অপরে যে সব উপায় নির্দেশ করে, এই উভয়ের মধ্যে মোটামুটি পার্থক্য কোন্ কোন্ বিষয়ে বলিয়া তিনি মনে করেন? এ বিষয়ে তাহার যথার্থ মনোভাব জানা অসম্ভব বলিয়াই বোধ হইল। বরং তিনি অন্য মতাবলম্বী নেতাদের কাহারও কাহারও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং কার্যপ্রণালীর প্রশংসাই করিলেন। আমারও মনে হইল, ঐ প্রশ্নটি চুকিয়া গেল। হঠাৎ সন্ধ্যার সময় তিনি নিজেই ঐ বিষয়ের পুনরবতারণা করিলেন।

তিনি বলিলেন, “যারা তাদের নিজের নিজের কুসংস্কারগুলো আমার দেশবাসীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমি কখনো একমত নই। মিশরদেশের পুরাতত্ত্ব-আলোচনায় রত ব্যক্তিগণের যেমন ঐদেশের প্রতি একটা স্বার্থজড়িত অনুরাগ থাকে, তেমনি ভারতের প্রতিও কারও কারও এমন অনুরাগ থাকতে পারে যা সম্পূর্ণ স্বার্থজড়িত। এরকম অনুরাগলাভ শক্ত নয়। লোকের এরকম আকাঙক্ষা হতে পারে যে, এদের পড়া বইগুলিতে, চর্চায় এবং কল্পনার রাজ্যে ভারতের যে চিত্র তার মনের মধ্যে রয়েছে, অতীতযুগের সেই ভারতকেই সে আবার প্রত্যক্ষ করে। আমার ইচ্ছা, প্রাচীন ভারতের সগুণগুলিই আবার জেগে উঠুক এবং তার সঙ্গে যুক্ত হোক বর্তমান যুগের যা কিছু শক্তিশালী গুণ; কেবল এই মিশ্রণব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে হওয়া চাই! নূতন ভারতকে গড়ে উঠতে হবে ভিতর থেকে, কোন বাইরের শক্তির সাহায্যে নয়।

“সেজন্য, আমি শুধু উপনিষদ প্রচার করি। লক্ষ্য করে দেখলে বুঝতে পারবে, উপনিষদ্ ব্যতীত অন্য কিছু থেকে আমি কখনো প্রমাণরূপে উদ্ধৃত করিনি। আবার উপনিষদের মধ্যেও কেবল সেই ভাবটি—যা শক্তির প্রকাশক। বেদ-বেদান্তের সার ঐ একটি শব্দে নিহিত। বুদ্ধ অপ্রতিরোধ বা অহিংসা প্রচার করেছিলেন। কিন্তু আমার মতে ঐ একই শিক্ষা উপনিষদের বীর্য শব্দের দ্বারা আরও অধিক দেওয়া যায়। কারণ, অহিংসার পেছনে মারাত্মক দুর্বলতা থেকে যায়। দুর্বলতা থেকেই আসে প্রতিরোধের ভাব। গায়ে একবিন্দু সাগরজল লাগলে, আমি তার থেকে ভয়ে পালিয়ে যাই না, বা তাকে শাস্তি দেবার কথাও মনে আসে না। আমার কাছে ওটা গ্রাহ্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু একটা মশার কাছে ঐ একবিন্দু জলই বিপজ্জনক। আমি চাই, যে কোন আঘাতের ক্ষেত্রেই, তাকে যেন তুচ্ছ করতে পারি। শক্তি ও নির্ভীকতা! আমার নিজের আদর্শ সেই অদ্ভুত সাধু, সিপাহী বিদ্রোহের সময় যাকে তারা মেরে ফেলেছিল–এবং যিনি মর্মান্তিকভাবে ছুরিকাবিদ্ধ হয়েই কেবল মৌন ভঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘হ, তুমিও তিনি—তত্ত্বমসি!’

“জিজ্ঞেস করতে পার, এই প্রাচীন-আধুনিক সময়ের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের স্থান কোথায়?

“তিনিই এই কার্যসাধনের প্রণালীস্বরূপ—সেই অদ্ভুত, অহংজ্ঞানরহিত পন্থা! তিনি নিজেকে জানতেন না। ইংলণ্ড বা ইংরেজদের সম্বন্ধে তার এইটুকু মাত্র জ্ঞান ছিল যে, তারা এক অদ্ভুত প্রকৃতির লোক—দূরে সমুদ্রের ওপারে বাস করে। কিন্তু তিনি সেই অসাধারণ জীবন যাপন করে গেছেন—আমি তার ব্যাখ্যাকার মাত্র। তার মুখে কারও সম্পর্কে কদাপি নিন্দা ছিল না। একবার আমাদের দেশের বীভৎস আচার-বিশিষ্ট কোন সম্প্রদায়কে আমি তীব্র সমালোচনা করি। তিন ঘণ্টা ধরে আমি কঠোরভাবে তার উদ্দেশ্যে বকে যাচ্ছি, তিনিও নীরবে শুনে যাচ্ছেন। আমার সব কথা শেষ হবার পর তিনি শুধু বললেন, “দেখ, সব বাড়িতেই মেথর ঢুকবার জন্য পিছন দিকে একটা দরজা থাকে। এও সেইরকম আর কি!

“এতদিন ধরে আমাদের (ভারতের) দেশের ধর্মের মহাদোষ ছিল এই যে, সে মাত্র দুটি কথা জানতত্যাগ ও মুক্তি। এ জগতে কি কেবল মুক্তিই দরকার? গৃহীদের জন্য কিছুই চাই না?

“কিন্তু আমি এই সব লোকদেরই বিশেষ করে সাহায্য করতে চাই। সব আত্মাই স্বরূপতঃ এক নয় কি? সকলেরই গম্যস্থান কি এক নয়?

“শিক্ষার মধ্য দিয়ে জাতির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করতে হবে—এইটিই উপায়?”

সেই সময়ে মনে হইয়াছিল, এবং পরেও যত ভাবিয়াছি, ততই অধিকতররূপে আমার মনে হইয়াছে যে, আচার্যের নিকট হইতে এই একটি মাত্র কথা শুনিবার জন্যও সমস্ত সমুদ্রপথ অতিক্রম করা সার্থক।

সকল অধ্যায়

১. ০১. লণ্ডনে, ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দে
২. ০২. লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ–১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে
৩. ০৩. বিভিন্ন আদর্শের সংঘর্ষ
৪. ০৪. স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘ
৫. ০৫. উত্তরভারত-ভ্রমণ
৬. ০৬. জীবের চৈতন্যদাতা
৭. ০৭. তত্ত্বালোকের ঝলক
৮. ০৮. অমরনাথ
৯. ০৯. ক্ষীরভবানী
১০. ১০. কলিকাতা ও স্ত্রীভক্ত-পরিবার
১১. ১১. শক্তিপূজা ও স্বামীজী
১২. ১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১৩. ১৩. মহাপুরুষদর্শন-প্রসঙ্গে
১৪. ১৪. ভারতের অতীত ও ভবিষ্যৎ
১৫. ১৫. হিন্দুধর্ম
১৬. ১৬. পাশ্চাত্যদেশে স্বামীজীর সহিত কয়েকদিন
১৭. ১৭. স্বামীজী-প্রচারিত মতসমূহের সমষ্টিভাবে আলোচনা
১৮. ১৮. স্বামীজী বুদ্ধকে কি চক্ষে দেখিতেন
১৯. ১৯. ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী
২০. ২০. নারীজাতি ও জনসাধারণ
২১. ২১. পাশ্চাত্য সেবাব্রতীকে শিক্ষাদান-প্রণালী
২২. ২২. সন্ন্যাস ও গার্হস্থ্য
২৩. ২৩. তথাকথিত অলৌকিক দর্শনাদির সহিত আচার্যদেবের সম্বন্ধ
২৪. ২৪. মৃত্যু সম্বন্ধে স্বামীজীর শিক্ষা
২৫. ২৫. সমাধি
২৬. ২৬. স্বামীজীর মহাসমাধি
২৭. ২৭. উপসংহার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন