দীনেশচন্দ্র সেন
দেওয়ান ভাবনা
চন্দ্রাবতী প্রণীত
( ১ )
ছয়না বচ্ছরের[১] সুনাইগো ইরামতী[২] জ্বলে।
হাসিয়া খেলিয়া উঠে সুনাইগো আপন মায়ের কোলে॥
সাতনা বচ্ছরের সুনাইগো মুখে মধুর হাসি।
মায়ের কোলে উঠে সুনাইগো পুন্নিমার[৩] শশী॥
আটনা বছরের সুনাইগো ঝাইরা[৪] বান্ধে চুল।
মুখেতে ফুট্যাছে সুনাইর গো শতেক পদদ্মফুল॥
নয়না বচ্ছরের সুনাইগো নবীন কিশোরী।
গিরের[৫] পরদীম্[৬] সুনাই সুনাইগো আঙ্গিনা পশরি[৭]॥
দশনা বচ্ছরের সুনাইগো দশে শূন্য পড়ে।
বিধাতা হইল বাদীগো পড়ল বিষম ফেরে॥
শুন শুন পূর্ব্বকথাগো দুঃখের বিবরণ।
দশ বচ্ছর কালেগো বাপের অকাল মরণ॥
বাপ নাই ভাই সুনাইগো একেলা জননী।
কর্ম্মদোষে হইলা সুনাইগো জনম দুঃখিনী॥
পারাত[৮] নাই পরতিবাসীরে[৯] একলা থাকে ঘরে।
অভাগী মায়ের দুঃখুগো জল্যা পুড়্যা মরে॥
বিরক্ষ[১০] মইরা[১১] গেলে যেমুন[১২] গো ঝুইরা[১৩] পড়ে লতা।
লতা যদি শুক্যা[১৪] গেলগো ঝরে পুষ্প পাতা॥
অভাগী মায়ের দুষ্কু[১৫] গো সুনাই অন্তরে বুঝিল।
চক্ষের জলেতে সুনাইরগো বুক ভিজ্যা গেল॥
অঙ্গেতে বসন নাইগো সুনাইর দুষ্কের নাই সীমা।
দীঘলাটী[১৬] আছে সুনাইরগো মায়ের ভাই মামা॥
কারে লইয়া থাকবাম মাওগো একলা শূন্য ঘরে।
তাহেত[১৭] সুন্দর কন্যাগো ভাব্যা চিন্তা মরে॥
দশ বচ্ছর গিয়া সুনাইগো এগরতে পড়ে।
কন্যার যৈবন[১৮] দেখ্যাগো ভাব্যা চিন্তা মরে॥
এতেক সুন্দর কন্যাগো তাহেত যুবতী।
কেবা বিয়া দিব কন্যারগো কেবা করে গতি[১৯]॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া মায়েগো কোন কাম করে।
আশ্রয় মাগিতে গেলগো ভাইয়ের গোচরে॥১—৩০
( ২ )
গেরাম[২০] ভাড়ুক ঠাকুরগো যজমানি বাউন[২১]।
এইখানে[২২] কইবাম আমিগো তাহার বিবারণ॥
ঘরে নাই পুত্র কন্যাগো কেবল সুনাইর মামী।
ভাটুক ঠাকুরের বেবসা[২৩] গো কেবল যজমানি॥
সন্ধ্যাবেলা সুনাইর মাওগো শুনাইরে লইয়া।
আপন ভাইয়ের বাড়ীত দাখিল হইল গিয়া॥
“শুন শুন পরাণের ভাইওরে[২৪] কি কইবাম তোমারে।
দৈবের দুর্গতি আমারগো কপালের ফেরে॥
কে দেয় সুনাইর বিয়াগো কন্যা হইল বড়।
ভাব্যা চিন্ত্যা আইলাম দাদাগো এইযে তোমার ঘর॥”
পুত্র কন্যা নাই ঠাকুরগো একলা মদন[২৫]।
সুনাইরে পাইয়া হইলগো সানন্দিত মন॥
মামার বাড়ীত থাকে সুনাইরে মায়ের সঙ্গেতে।
ভাইয়ে বইনে যুক্তি করেগো সুনাইর বিয়া দিতে॥
পরম সুন্দরী সুনাইগো দীঘর মাথার চুল।
মুখেতে ফুট্যাছে সুনাইরগো শতেক চম্পার ফুল॥
মামায়ত দিয়াছে কিন্যারে পাছা[২৬] নীলাম্বরী।
জল ভরিতে যায় সুনাইগো কাঙ্কেতে[২৭] গাগরী॥
নদীর পারে কেওয়া বনরে ফুটল কেওয়া ফুল।
তার গন্ধে উইরা করে ভমরারা[২৮] রুল[২৯]॥
কাঙ্কেতে গাগরী সুনাইরগো পৈরনে[৩০] নীলাম্বরী।
পন্থেতে মানুষ চাইয়া থাকেগো সুনাইরে না[৩১] হেরি॥
অঙ্গের লাবণি সুনাইরগো বাইয়া পড়ে ভূমে।[৩২]
বার বছরের কন্যাগো পইড়াছে যৈবনে॥
আষাঢ়মাসে দীঘলা পান্সীরে নয়া জলে ভাসে।
সেহি মত সোনাইর যৈবন খেলায় বাতাসে॥
কোথাতনে[৩৩] আইছে কন্যাগো পরম সুন্দরী।
পাড়ায় লোকে কানাকানিগো সোনাইরে না হেরি॥
কাজল মেঘে সাজল[৩৪] হাসিরে বিজুলীর ঝলা।
আন্ধাইর ঘরে থাকলে সোনাইগো আন্ধাইর ঘর উজালা১—৩০
(৩)
গাঁথ গাঁথ সুন্দর কন্যালো মালতীর মালা।
ঝইরা পড়ছে সোনার বকুল গো ঐনা গাছের তলা॥
তোমার বিয়ার ঘটক আইছে লো কালুকা বিহানে[৩৫]।
কেমন করে দিব বিয়াগো ভাবে মনে মনে॥
বর্মা[৩৬] যে লেখ্যাছে[৩৭] কলমরে[৩৮] কপালে তোমার।
ভাবিয়া চিন্তিয়া মার দেখে অন্ধকার॥
এইতনা ঘটক ফির্যা গেলগো পছন্দ না হয়।
চাদের সমান কন্যাগো বর যে কালা[৩৯] হয়॥
এই ঘটক ফির্যা গেলরে আর ঘটক আইল।
সোনাইর বিয়া দিতে মায়ের গো মন না উঠিল॥
যেমন সুন্দর কইন্যা গো তেমন না আইল বর।
তার মধ্যে থাকব জামাইর বারবাংলার ঘর॥
সোনার কার্ত্তিক অইব জামাই গো যেমন চান্দের ছটা।
কুলে শীলে বংশে ভালা গো জমিদারের বেটা॥
যতেক সম্বন্ধ আইন গো সোনাইর মায়ে নাই সে বাসে[৪০]।
এহি মতে আইল ঘটক পরতি মাসে মাসে॥১—১৬
( 8 )
ইকরের করমর[৪১] মাকড়ের রে আঁশ।
এইনা বির্ক্ষে সোনার ফুল গো কুটে বারমাস॥
বার মাসের বার ফুলরে ফুট্যা থাকে ডালে।
এই পন্থে আইসে নাগর পরতি[৪২] সন্ধ্যাকালে॥
হাতেতে খাগরের[৪৩] শর জুলুঙ্গা[৪৪] লইয়া।
পালা ঢুপি[৪৫] সঙ্গে নাগর আইসে পন্থ দিয়া॥
দেখিতে সোনার নাগর গো চান্দের সমান।
সুবর্ণ কার্ত্তিক যেমন গো হাতে ধনুরবান॥
ওইনা পন্থ দিয়া নাগর গো আনাগোনা করে।
সোনাইরে দেখিল নাগর আইনা গাঙ্গের ধারে॥
গাঙ্গের পারে কেওয়া পুষ্প গন্ধেতে হাইল[৪৬]।
মাধবের সঙ্গে সোনাইর গো পরথম দেখা হইল॥
“কোথায় থাকে সুন্দর নাগররে কোথায় বাড়ীঘর।
মনের কথা কই বা কারে কে দেয় উত্তর॥
চারি চক্ষু এক অইলরে পরাণ কাইড়া[৪৭] লইল।
কোন্ দৈবে মনের মানুষরে[৪৮] আন্যা দেখাইল।
কোন্ বা দেশে থাকে ভমরারে কোন্ বাগানে বৈসে।
কোন্ বা ফুলের মধু খাইতেরে ভমরা উইড়া আইসে॥
উইড়া উইড়া আইসে ভমররে ফির্যা ফির্যা যায়।
কোন্ বা ফুলের মধুর আশায়রে ঘুরিয়া বেড়ায়॥
ধরতাম যদি পারতাম[৪৯] ভমরারে রাইতের নিশাকালে[৫০]।
কেশেতে বান্ধিয়া তোমায় রাখতাম খোপার ফুলে॥
খাইতে দিতাম ফুলের মধু বইতে[৫১] দিতাম পিড়ি।
শুইতে দিতাম শীতল পাটী সঙ্গে যাইতাম উড়ি॥
পক্ষী হইলে সোনার বন্ধুরে রাখিতাম পিঞ্জরে।
পুষ্প হইলে প্রাণের বন্ধুরে খোঁপায় রাখতাম তোরে॥
কাজল হইলে রাখতাম বন্ধুরে নয়ান[৫২] ভরিয়া।
তোমার সঙ্গে যাইতাম বন্ধুরে দেশান্তরী[৫৩] হইয়া॥”
“কি কর সুন্দর কন্যাগো একেলা নিরালা।
কার লাগিয়া গাথ কন্যা আইজের[৫৪] পুষ্পমালা॥
কালি[৫৫] দিছলাম[৫৬] পত্রলো ঐ না[৫৭] পদ্মের পাতে।
কোন্ জনে লেখ্যাছে পত্রলে। কিৰা লেখা তাতে॥”
পত্র পাইয়া কন্যাগো পড়ে সাবধানে।
মাধবে লেখ্যাছে পত্রগো পড়ে মনে মনে॥
একবার দুইবার তিনবার পড়ে।
পত্র না পড়িতে কন্যারগো দুই আঁখি ঝরে॥
পরথমে লেখ্যাছে পত্রেগো মাধব সুন্দর।
“দেখ্যাছি সুন্দরী কন্যা ঘরে একেশ্বর[৫৮]॥
গাঙ্গের পারে হিজল গাছ লো চিড়ল চিড়ল[৫৯] পাতা।
জলের ঘাটে যাইও কন্যাগো কইবাম মনের কথা॥
গাঙ্গের পারে আছে কন্যা কেওয়া পুষ্পের বন।
নিরাল। বসিয়া করবাম গো প্রেম আলাপন॥
তোমার লাগিয়া কন্যা হইলাম যে পাগলা।
তুমি আমার মুখের মধু গলার পুষ্পমালা॥
বাপের আছে ধন-দৌলত কন্যাগো লাখের জমিদারী[৬০]।
তোমারে দিয়াম[৬১] কন্যাগো অগ্নিপাটের শাড়ী॥
বাড়ীর আগে ফুলবাগিচা লাল আর নীলা[৬২]।
ফুল তুইল্যা দিবাম কন্যাগো তুমি গাঁইথ্যো[৬৩] মালা॥
বাড়ীর পাছে বান্ধা[৬৪] ঘাট আছে পুষ্করিণী।
তুমি কন্যা জলে যাইতেগো সঙ্গে যাইবাম আমি॥
ভরিতে না পার কন্যা ভইরা দিবাম কোলে।
তোমারে লইয়া কন্যা সাঁতার দিবাম জলে॥
বাহুতে পরাইয়া দিবাম বাজুবন্ধ তার[৬৫]।
হীরামতি দিয়া দিবাম তোমার গলার হার॥
বাপের বাড়ীতে আছেগো জলটুঙ্গীর ঘর[৬৬]।
সেই ঘরে বসিয়া তুমি করিবা পশর॥
বাড়ীর মধ্যে আছে কন্যা কামটঙ্গীর[৬৭] বাসা।
রাইতের নিশি তথায় বসি খেলাইবাম পাশা॥
গলায় গাঁথিয়া দিবাম জোনাকীর মালা।
বাসরে শিখাইবাম কন্যা তোমায় রতিকলা॥
বাগানের বাছা ফুলে বান্ধ্যা দিবাম চুল।
টোনা[৬৮] ভর্যা তুইল্যা আনবাম মালতীর ফুল॥
মন দিবাম দৌলত দ্বিাম আর দিবাম পরাণ।
খুসী মনে করলো কন্যা মোরে যৌবন দান॥”
উত্তর
“শুনরে পরাণের বন্ধু শুন দিয়া মন।
বিয়া নাই সে হইল মোর পরথম যৈবন॥
মা ও মাতুল মোর আছে তারা ঘরে।
ৰাছিয়া নিছিয়া বিয়া দিব ভালা বরে॥
ফুল হইয়া ফুটিতাম বন্ধুরে যদি কেওয়াবনে।
নিতি নিতি হইত বন্ধু দেখা তোমার সনে॥
তুমি যদি হইতেরে বন্ধু আসমানের চান[৬৯]।
রাত্র নিশা চাইয়া থাকতাম খুলিয়া নয়ান॥
তুমি যদি হইতেরে বন্ধু ঐ সে নদীর পানি।
তোমারে চাহিয়া দিতাম তাপিত পরাণি॥
একেত অবলা নারী ঘরে বন্দী রই।
দারুণ দুঃখের জ্বালা কেমনে রইয়া[৭০] সই॥
যেদিন দেখ্যাছি তোমায় ঐ না জলের ঘাটে।
সেই দিন হইতে পাগলা মন ফিরে বাটে ঘাটে॥
মায়েরে না কইতে পারি আপন মনের কথা।
অবলা যে নারী আমি মনে রইল ব্যথা॥
কইও কইও সল্লার কাছে তোমার মনের কথা।
কতদিনে পূরব আশা যাইব দারুণ ব্যথা॥
কতদিনে তোমার সঙ্গে হইব মিলন।
দূরের পানে[৭১] চাইয়া কন্যা লিখিল লিখন॥”
চন্দন ফুলের[৭২] মালা তার পত্রখানি।
দুতীর অঞ্চলে বান্ধ্যা কন্যা দিল যে মেলানি[৭৩]॥
পত্র না লইয়া সল্লা হইল বিদায়।
পরথম যৈবন লইয়া কন্যা করে হায় হায়॥১-৮৮
( 8 )
দারুণ দুর্জন্যা[৭৪] বাঘরারে কোন্ কাম করে।
খবর কইল গিয়া ভাবনার গোচরে॥
বইয়া আছে দেওয়ান ভাবনা বারবাংলার ঘরে।
এমন সময় বাঘরা গিয়া জানাইল তারে॥
“পরগণা মহালে আছে পরম সুন্দরী।
তাটুক বামুনের কন্যা যেমন হুর[৭৫] পরী॥
বার বচ্ছরের কন্যা তেরতে উতরে[৭৬]।
এমন সুন্দর কন্যা নাই কার ঘরে॥
বিয়। না হইয়াছে কন্যার বিয়ার বাকি আছে।
তুমি যদি কর সাদি আন্যা দিবাম পাছে[৭৭]॥”
কথা শুন্যা দেওয়ান ভাবনা কোন্ কাম করিল।
বাঘরারে মাপিয়া কাঠায় যত ধন দিল॥
“শুন শুন ভাটুক ঠাকুর কই যে তোমারে।
এক যে সুন্দরী কন্যা আছে তোমার ঘরে॥
জল বাইছেতে দেওয়ান ভাবনা দেখ্যাছে তাহারে।
সেই দিন হইতে দেওয়ান ভাবনা পাগল হইয়া ঘুরে॥
তার কাছে তোমার কন্যা যদি দেওগো সাদী।
ঘরের যত নিকার বিবি সকল হইবে বাঁদী॥
বাড়ীর আগে দিয়া দিব চৌকোণ পুষ্কণী[৭৮]।
সানেতে বান্ধিয়া দিব ঘাটের সিঁড়ি খানি॥
বাউন্ন[৭৯] পুরা জমি দিব লেখ্যা লাখেরাজ।
দেওয়ানের কথায় তুমি কর এই কাজ॥”
একেত ভাটুক ঠাকুর যজমান্যা বামুন।
সেইত আবার পাইল জমির লোভন[৮০]॥
সম্মতি জানাইল ভাটুক দুর্জন্যা বাঘরায়।
জাতি মাইরা[৮১] বিয়া দিব মনেতে গুছায়॥
মায়ে না জানিল কথা না জানে কন্যায়।
কানাকানি হানাহানি শব্দে শুনা যায়[৮২]॥১-২৮
( ৫ )
“শুন শুন সল্লা দুতী কহিরে তোমারে।
পত্র লইয়া যাও তুমি বন্ধুর গোচরে॥
আজি সন্ধ্যাকালে দুতী মোরে লইয়া যায়।
সন্ধ্যার তারা নিব্যা[৮৩] গেলে না দেখি উপায়॥
দুর্জন দুষ্মন মামা দুষমনি করিয়া।
দেওয়ান ভাবনার কাছে মোরে দিবে আজি বিয়া॥
এই কথা বাহিয়া আইস বন্ধুর গোচরে।
সন্ধ্যাবেলা এথা হইতে লইয়া যায় মোরে॥”
পত্র লইয়া দুতী তরিত[৮৪] করিল গমন।
মাধবের নগরে গিয়া দিল দরশন॥
পত্রেতে সকল কথা মাধবরে কহিয়া।
আর বার ফিবে দূতী কিবা পত্র লইয়া॥
“কালি যে দেখ্যাছি আমি অতি দুঃস্বপন।
জলের ঘাটে যাইতে দূতী নাহি চলে মন॥
বাঁও[৮৫] আঁখি ঝরে মোর তরাসে কাঁপে বুক।
আজি কেন ঘন ঘন শুকাইছে মুখ॥
খাল্যা[৮৬] কলসী কাখে তুলিতে না পারি।
কিব। জানি হইল মোরে কহ শীঘ্র করি॥
যাইতে জলের ঘাটে নাহি চলে পাও।
শুকনা ডালেতে বস্যা কাগায়[৮৭] করে রাও[৮৮]॥
জলের ঘাটে যাইতে মোরে করিছে বারণ।
হাঁচি টিক্টিকি আর যত অলক্ষণ॥
জলে না যাইবাম আমি থাকি মায়ের কাছে।
কি জানি কপালে মোর কত দুঃখু আছে॥”
“শুন শুন দূতী আরে শুন কই তোমারে।
জলের ঘাটে না গেলে ন। পাইবাম প্রাণ-বন্ধুরে॥
কি জানি পরাণের বন্ধু যাইব[৮৯] চলিয়া।
আর না পরাণের বন্ধু আসিব[৯০] ফিরিয়া॥”
এই না ভাবিয়া কন্যা যা থাকে কপালে।
খাল্যা কলসী কন্যা তুলিল কাঁকালে[৯১]॥
আগে যায় সল্লা দূতী পাছেতে সোনাই।
দৈবের নিবন্ধ কথা সভারে জানাই॥
বান্ধা আছে পানসী নাও কেওয়া বনের ধারে।
সোনাইরে ধরিয়া লইল দেওয়ান ভাবনার চরে॥
“কইও কইও কইও দূতী কইও মায়ের আগে।
আমারে যে লইয়া যায় দেওয়ান ভাবনার চরে॥
(ভাবনায় লইয়া যায়রে।)
‘কইও কইও কইও দূতী কইও মামীর আগে।
আমার কাঁখের কলসী পইড়া (রৈলা) অইনা নদীর ঘাটে॥
(ভাবনায় লইয়া যায়রে॥)
“কইও কইও কইও দুতী দুষ্মন মামার ঠায়।
বাউন্ন পুরা জমি লইয়া মুখে বস্যা খায়॥
কইও কইও কইও দুতী প্রাণ-বন্ধুর আগে।
বন্ধুরে জানাইও সুনাইরে খাইছে ভাবনা-বাঘে॥
সাক্ষী হইয়ো চান্দ-সূরুয দিবস-রজনী।
বন্ধুর লাগাল পাইলে কইয়ো দুখের কাহিনী॥।
উইড়া যাওরে বনের পংখী নজর বহু দূরে।
বন্দেরে[৯২] কহিয়ো সুনাই লইয়া গেছে চোরে॥
গাঙ্গের পারের হিজল গাছ শুন আমার কথা।
প্রাণ-বন্ধুরে লাগাল পাইলে কইও যত কথা॥
দেওয়ান ভাবনা, ১৮৪ পৃঃ
গাঙ্গের পারে কেওরা ফুল ফুট্যা রইছে ডালে।
দুষ্কের কথা কইও মোর বন্ধুর লাগাল পাইলে॥
সাক্ষী হইয়ো নদী নালা আর পশুপংখী।
আভাগী[৯৩] সুনাইরে দিল কাল বিধাতা ফাঁকি॥
সত্যযুগের বায়ু সাক্ষী আরত সাক্ষী নাই।
বন্ধুর আগে কইও তোমার মইরাছে সুনাই।
কি করিলাম দুষ্কের কপাল কেন বা আইলাম জলে।
সেই কারণে যজ্ঞের ঘির্ত[৯৪] খাইল চণ্ডালে॥
আগে যদি জানতাম দুষ্কুরে এই ছিল কপালে।
কাঙ্খের কলসী গলাত[৯৫] বান্ধ্যা ডুব্যা মরতাম জলে॥”
(ভাবনায় লইয়া যায়রে।)
“আসিব বলিয়া বন্ধু না আসিল কেরে[৯৬]।
না জানি পরাণের বন্ধু পড়িল কি ফেরে॥
না আইল না আইল বন্ধু ক্ষতি নাই সে তাতে।
না জানি বিপদে বন্ধু পড়িল কি পথে॥
বিষম নদীর ঢেউরে অলছতলছ[৯৭] পানি।
কি জানি পন্থেতে বন্ধুর ডুবছে নাও[৯৮] খানি॥
উইড়া যাওরে বনের পাংখী খবর দিও তারে।
তোমার সুনাই লইয়া যায় দেওয়ান ভাবনার ঘরে॥
(ভাবনায় লইয়া যায়রে।)
সুন্দর দেখিয়া ভাবনায় লইয়া যায়রে।
লইয়া যায় লইয়া যায় লইয়া যায়রে॥”
“কেবা যাওরে নদী দিয়া বাইয়া পানসী নাও।
কার ঘরের যুবতী নারী ধইরা লইয়া যাও॥
কিসের লাগ্যা কান্দ কন্যা পানসীতে বসিয়া।”
নৌকা হইতে মাধব তারে কয় ডাক দিয়া॥
মাধবের ডাক যখন সুনাই শুনিল।
ডাক ছারিয়া[৯৯] কন্যা তখন কান্দিতে লাগিল॥
জলের উপর হইল রণ নিশির আমলে[১০০]।
কোথা রইল দাড়ী মাঝি পইরা মরে জলে॥১-৭৬
(৬)
কিসের বাদ্য বাজে আজি নগরে নগরে।
আইল আনন্দে গেরাম খানি তোলপাড় করে॥
তুল্যা আন বনের ফুল আঞ্চল ভরিয়া।
মাধবের সাথে আইজ সুনাইর বিয়া॥
পুরবাসী নারী দেয় মঙ্গল জুকার[১০১]।
বাসর সাজাইতে কেউ গাঁথে পুষ্পহার॥
জল ভরে পুরনারী নদীর ঘাটে গিয়া।
সুনাইর সঙ্গে হইল আইজ মাধবের বিয়া॥১-৮
(৭)
“কি কর মাধব তুমি গিরেতে বসিয়া।
তোমার বাপে দেওয়ান ভাবনায় নিয়াছে বান্ধিয়া॥”
এই কথা শুনিয়া মাধব কোন কাম করে।
ভাওল্যা[১০২] সাজাইয়া গেল দেওয়ান ভাবনার ঘরে॥
একেলা ঘরেতে সুনাই কেবল সঙ্গে দাসী।
এইখানে, শুনিরো সুনাইর বারমাসী॥
আষাঢ় মাসেতে নদীর কুলে কুলে পানি।
বাপেরে আনিতে মাধব সাজায় পানসীখানি॥
একেলা ঘরেতে রইল সুনাই যুবতী।
সুনাই কান্দিয়া কয় শুন সল্লা দুতী॥
আষাঢ় মাস গেল দূতী এইনা আশার আশে।
কোথায় গিয়া পরাণের বন্ধু রইলা বৈদেশে[১০৩]॥
শায়ন[১০৪] মাসেতে দুতী পূজিলা মনসা।
সেইতে না পুরিলগো আমার মনের আশা॥
ভাদ্র মাসেতে দূতী গাছে পাকন[১০৫] তাল।
ভাবিয়া চিন্তিয়া দূতীরে (সুনাইর) গেল যৈবন কাল॥
আশ্বিন মাসেতে দূতী দুর্গাপূজা দেশে।
না আইলা প্রাণের বন্ধু দূর্গামায় পূজিতে॥
কার্ত্তিক মাসেতে দূতী শুকায় নদীর পানি।
আসিবে পরাণের বন্ধু মনে অনুমানি॥
আইলনারে পরাণের বন্ধু কার্ত্তিক মাস যায়।
বাইরে কান্দে দাস দাসী ঘরে কান্দে মায়॥
আঘন[১০৬] মাসেতে দূতী শীতের কুয়াসা।
পরাণ-বন্ধু বৈদেশে রইল না মিটিল আশা॥
পৌষ মাসে পোষা আন্ধি[১০৭] অঙ্গকাপে শীতে।
একেলা শর্য্যায় শুইয়া বন্ধু বৈদেশেতে॥
পৌষ গেল মাঘরে গেল ফাল্গুন আইল।
বসন্তে যৌবন-জ্বালা দ্বিগুণ বাড়িল॥
কি বুঝিবা আরে দূতী কাল বসন্তের জ্বালা।
যার ঘরেতে নাই সে পতি যৈবতী[১০৮] একেলা॥
চৈত[১০৯] মাসেতে দূতী বহিছে চৈতালী[১১০]।
দেশে না আসিন বন্ধু হইলাম পাগলী॥
চৈত মাস যায় দূতী বচ্ছর হইল শেষ।
একদিন না বান্ধিলাম আভাগীর চিকণ কেশ॥
একদিন বাগিচায় ফুল না লইলাম তুলিয়া।
মধুর যৈবন গত হইল ভাবিয়া চিন্তিয়া॥
গায়েতে পড়িল – – -যৈবন হইল কালি।
কোন কুঞ্জে বিরাজ করে আমার বনমালী॥
জ্যেষ্ঠ মাসেতে দূতী গাছে পাকনা আম।
কপাল বাইয়া পড়ে কন্যার জ্যৈষ্ঠমাস্যা[১১১] ঘাম॥
তালের পাতা লইয়া বাতাস করে যত দাসী।
বাতাসে কি শীতল হয় মন যার উদাসী॥
(৯)
সুনাইর শ্বশুর দেশে আইল ফিরিয়া।
বধুর কাছে কয় কথা কান্দিয়া কান্দিয়া॥
“তুমিত প্রাণের বন্ধু কহি যে তোমারে।
এক পুত্র আছিল মোর বংশের দুয়ারে॥
সেও পুত্র হারা হইলাম কপালের দোষে।
তোমার লাগ্যা দেওয়ান ভাবনা মোরে অপবশে॥
আমারে বান্ধিয়া নিন ভাবনার সহরে।
মাধবে পাইয়া দেওয়ান ছাইরা দিল মোরে॥
শুন বধূ তুমি যদি কিরপা[১১২] নাইসে কর।
অকালেতে পুত্র আমার যাইব যমের ঘর॥
দুরন্ত দুর্জন ভাবনা পরতিজ্ঞা[১১৩] যে করে।
তোমারে পাইলে ছাইরা দিব মাধবেরে॥
বংশের নিদান পুত্র এক বিনে নাই।
তোমারে ছাড়িয়া যদি পরাণের পুত্র পাই॥”
এই কথা শুনিয়া সুনাইর চউখে[১১৪] আইসে পানি।
আউল[১১৫] কেশ বান্ধ্যা কন্যা মুছে চউখের পানি॥
ভাওয়ালিয়া সাজাইতে কইল আপন শ্বশুরে।
পতি উদ্ধারিতে কন্যা যায় ভাবনার সরে[১১৬]॥
সঙ্গে লইল জড়ের[১১৭] লাড়ু কটরায় ভরিয়া।
দেওয়ান ভাবনার সরে কন্যা দাখিল হইল গিয়া॥
খবর পাইয়া দেওয়ান ভাবনা কোন্ কাম করে।
সুনাইরে দেখিতে আইল ভাওল্যা উপরে॥
সুনাইরে দেখিয়া ভাবনা হইল অজ্ঞান।
দেখিতে যৈবতী কন্যা পূর্ণিমার চান॥
“শুন শুন দেওয়ান ভাবনা কহি যে তোমারে।
প্রাণের বন্ধু বন্দী কইরা রাখছ তোমার ঘরে॥
আমি যে আইছিগো দেওয়ান এই যে তোমার ঘরে।
এই কথা না জানাইও প্রাণের বন্ধুরে॥
শুন শুন দেওয়ান ভাবনা আমার মাথার কিরা[১১৮]।
না কয় যেন আমার কথা যতেক খবইরা[১১৯]॥
আমার বন্ধুরে আগে করিবা খালাস।
তবে সে মিটাইবাম আমি তোমার মনের আশ॥”
বন্দী খানায় বন্দী মাধব বুকেতে পাথর।
হাতে পায়ে আছে তার লোহার শিকল॥
যেই ভাওয়ালিয়া লইয়া সুনাই আসিল।
সেই ভাওয়ালিয়ায় দেওয়ান মাধবেরে দিল॥
মুক্তি পাইয়া মাধব আরে যায় নিজ দেশে।
সুনাইর কি হইল দশা শুন অবশেষে॥
নিশি রাইত মেঘে আন্ধা[১২০] আসমানে নাই তারা।
বারবাংলার ঘরে সুনাই চৌদিকে পাহাড়া॥
মায়ের পায়ে করে সুনাই কোটি নমস্কার।
উদ্দিশে[১২১] বিদায় মাগে করি হাহাকার॥
তার পরে স্মরিল কন্যা মাধবের মুখ।
আন্ধাইরে পাইল কন্যা মনে বড় সুখ॥
সোয়ামির[১২২] পদে জানায় শতেক ভকতি।
তার পরে স্মরে কন্যা দুর্গা ভগবতী॥
আসমান কালা জমীনরে কালা কাল নিশা[১২৩] যামিনী।
বিষের কটরা খুলে কন্যা জনম দুঃখিনী॥
শিশুকালে বাপ মইল[১২৪] এতেক নাইরে মনে।
সেইত দুঃখের কথা আইজ পড়িল মনে॥
নিশি রাইতে দেওয়ান ভাবনা আইন বাংলা ঘরে।
আইসা দেখে পইড়া সুনাই পালঙ্ক উপরে॥
বিষেতে অবশ অঙ্গ বদন হইল কালা।
অঙ্গেতে হইয়াছে কন্যার গরলের জ্বালা॥
না দেখল অভাগী মাওরে আপন বন্ধুজনে।
কোথায় রইল প্রাণের বন্ধু আইজ এই নিদানে॥
কোথায় রইল শাউরী[১২৫] কোথায় সল্লা দূতী।
নিদান কালে কাছে নাইসে রইল প্রাণের পতি॥
দুর্জন দুষমন ভাবনার আশা না পুরিল।
প্রাণ-বন্ধুরে বাঁচাইতে সুনাই পরাণে মরিল॥১-৬০
.
টীকা
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন