দ্য হাউস – ১

কেইগো হিগাশিনো

প্ৰথম পৰ্ব

বাসায় অচেনা এক নম্বর থেকে ফোন এলো একদিন। আর সেখান থেকেই সবকিছুর শুরু।

কণ্ঠস্বরটা শোনামাত্র চিনতে পারলাম। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও পারব। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল সাথে সাথে। তা সত্ত্বেও যতটা সম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে বলছেন?’ আসলে ওকে হয়তো বোঝাতে চাইছিলাম কিছুটা হলেও আত্মসম্মানবোধ অবশিষ্ট আছে আমার ভেতরে। পরক্ষণেই মনে মনে গালি দিলাম নিজেকে। আহাম্মকের মতন কথাটা না বললেও হতো।

“ইয়ে, মিসেস নাকানো বলছি।”

ডাকনামটা বলেনি, বিয়ের পরের নামটা বলেছে কেবল। হয়তো ওর মনেও আমার মতন একই কথাই ঘুরছিল।

“মিসেস নাকানো?” না চেনার ভান অব্যাহত রাখলাম।

“ওহ, সরি। কুরাহাশি। সায়াকা কুরাহাশি বলছি।”

“তুমি!” না চেনার ভান অব্যাহত রাখলাম। “সেদিনের জন্য ধন্যবাদ।”

কিছু বললো না ও। হয়তো বলার মতন কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। অবাক হলাম না ব্যাপারটায়। এভাবে হঠাৎ ধন্যবাদ জানানোটা বোকামি বৈ কিছু নয়। রিসিভার হাতে হেসে উঠলাম নিচু স্বরে।

“যদিও আমাদের কথা হয়নি।”

“ঠিক বলেছ,” সায়াকার কণ্ঠস্বরে স্বস্তির আভা।

“বন্ধুদের সাথে কথা বলতেই তো ব্যস্ত ছিলে। আমার দিকে ভালো করে তাকালেও না।”

“তুমিই তো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলে।”

“না তো।”

“ওহ, আচ্ছা।”

“সত্যি বলছি।”

“হুম।”

পাশের টেবিলে রাখা মেকানিক্যাল পেন্সিলটা তুলে মাথায় চাপ দিয়ে নিব বের করলাম। নীরবতাটুকু অস্বস্তিকর ঠেকছে কানে।

“আজ হঠাৎ ফোন দিলে যে? কোনো কারণ আছে? নাকি এমনি?”

“এমনি হবে কেন?”

ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। আওয়াজটা একদম মৃদু, কিন্তু এটা বুঝতে পারছি যে কোনো কারণে অস্থির হয়ে আছে।

“একটা বিষয়ে তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাচ্ছিলাম,” অবশেষে বললো। “সময় হবে কি?”

অবাক না হয়ে পারলাম না। ও যে দেখা করার কথা বলতে পারে, তা মাথাতেও আসেনি। দেখা করতে চাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। পেন্সিলের নিবের দিকে নিবন্ধিত আমার দৃষ্টি।

“ফোনে আসলে এই ব্যাপারে আলোচনা করতে চাইছি না,” লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে ও।

এতদিন পর কেন নিজে যেচে পড়ে দেখা করার আমন্ত্রন দিচ্ছে, তা নিয়ে না ভেবে পারলাম না। ওর বিবাহিত জীবন নিয়ে কিছু বলবে নাকি? নাহ, ও সেরকম মেয়ে নয়।

“বিষয়টার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে?”

“না,” পরিষ্কার কণ্ঠে বলে সায়াকা। “এটা আমার ব্যক্তিগত একটা সমস্যা। কিন্তু আমি চাই তুমি আমার গল্পটা শোনো। এরপর একটা উপকার চাইব তোমার কাছে। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, যার সাথে আলাপ করতে পারব এই ব্যাপারে।”

আমার জবাব কি হতে পারে, সেটা আঁচ করে আগেভাগেই কথাটা বলে দিল ও।

কৌতূহল হচ্ছে আমার, অস্বীকার করবো না। কিন্তু নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার স্বামী জানে এই ব্যাপারে?”

“ও নেই এখন।”

“নেই মানে?”

“অ্যামেরিকা গিয়েছে অফিসের কাজে।”

“আচ্ছা।”

আঙুল দিয়ে ঠেলে মেকানিক্যাল পেন্সিলটার নিব ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম।

“কিন্তু তুমি উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে বোসো না। ও দেশে থাকলে যেভাবে সবকিছু ঘটতো, সেভাবেই হবে।”

তৎক্ষণাৎ কিছু বললাম না আমি। আসলে কিছু বুঝছি না। ওর গলার স্বরে এটা স্পষ্ট যে বিষয়টা গুরুতর কিছু। তাই আমাকে আরো সতর্ক হতে হবে।

“একটু ভাবতে হবে আমাকে,” বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম একবার। “এমন নিশ্চয়ই আরো অনেকেই আছে, যাদের সাথে কথা বলতে পারবে তুমি। আমার সাথে তোমাকে দেখা গেলে বিপদে পড়তে পারো, তো জানো?” এটা

“জানি। তা সত্ত্বেও তোমাকে ফোন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“কিন্তু-”

“প্লিজ,” সায়াকার কণ্ঠে কাতরতাটুকু টের পাচ্ছি। মনের পর্দায় দেখলাম ওর চোখ লাল, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। লম্বা শ্বাস টেনে ফোন রেখে দেয়ার আগে বললাম, “কালকে বিকেলে সময় দিতে পারব।”

“ধন্যবাদ।”

* * *

হাইস্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষ অবধি ছয় বছরের সম্পর্ক ছিল আমার আর সায়াকার। তবে সেই তুলনায় সম্পর্কটা যে খুব গভীর ছিল, বলা যাবে না। অনেক যুগলের ক্ষেত্রেই কিছু মুহূর্ত থাকে, যা স্মৃতির পটে রয়ে যায় অমলিন। কিন্তু আমরা যেন একদিন হুট করেই বুঝতে পারি যে দেখতে দেখতে ছয় বছর পেরিয়ে গেছে প্রেমের।

সম্পর্কের ইতি টেনেছিল ও-ই।

“আমাকে মাফ করে দিও। অন্য একজনকে ভালোবাসি আমি।”

কোনো প্রকার ভণিতা ছিল না আমাদের মধ্যে। কিছুদিন দূরে থেকে আবারও চেষ্টা করা, এসব নাটক সহ্য হতো না আমার। তাই এরকমটাই কথা দিয়েছিলাম একে-অপরকে; কখনো যদি মনে হয় সম্পর্কটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না, সরাসরি বলবো। তাই ওর কথাটা শুনে আমিও জোরাজুরি করিনি।

“ঠিক আছে,” এটুকুই বলেছিলাম কেবল।

পুরোটা সময় মাথা নিচু করে রেখেছিল ও।

কিছুদিন আগে আমাদের হাইস্কুলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয় শিনজুকুতে। ওর সাথে দেখা হবে, এই কথাটা মাথায় আসেনি বললে মিথ্যে বলা হবে।

অনুষ্ঠানের দিন বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় মাঝেমাঝেই ওর দিকে নজর চলে যাচ্ছিল। ও যে আসবে, ঠিক প্রমাণিত হয়েছিল আমার এই ধারণাটা। মনের মধ্যে সুপ্ত একটা আশাও ছিল যে হয়তো দেখা হবে ওর সাথে। আমাদের সম্পর্কের সময় একদম ছিপছিপে গড়নের ছিল ও। কিন্তু এখন শরীরের এখানে-সেখানে নজর আটকে যাওয়ার মতন বাঁক। হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়ায় সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে তখন সেই চুপচাপ মেয়েটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার।

বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে সায়াকা, তাই ওকে ওভাবে দেখে স্বস্তিই পেয়েছিলাম। অর্থাৎ, খুব একটা বদলায়নি। ওকে অন্য কোনো রূপে চিন্তা করতে পারি না আমি। অনুষ্ঠানেও সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিল সায়াকা। কে এখন কেমন আছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করছিল নিশ্চয়ই।

একবার মনে হলো আমার দিকে তাকিয়ে আছে সায়াকা। সেই মুহূর্তে আমিও যদি তাকাতাম, তাহলে কথা হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু ওকে যেন খেয়ালই করিনি, এমন চেহারা বানিয়ে রাখলাম পুরোটা সময়।

কিছুক্ষণ পর সবাই একে একে বলা শুরু করলো এখন কোথায় আছে, কী করছে। সায়াকার পালা এলে হুইস্কির গ্লাসটার দিকে চোখ নামিয়ে নিলাম। কথায় কথায় ও জানালো- চার বছর আগে বিয়ে করেছে, বর্তমানে গৃহিনী। ওর স্বামী একটা আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। বছরের লম্বা একটা সময় কাজের খাতিরে বাইরে থাকতে হয়। একদমই গড়পড়তা জীবন যাকে বলে। কখনো ভাবিনি ওকে এমন কিছু বলতে শুনবো।

করে। “বাচ্চা-কাচ্চা কয়জন?” আমাদের প্রাক্তন ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ জিজ্ঞেস

স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন। বরফ গলে পাতলা হয়ে গেছে আমার হুইস্কি। সেটাতেই চুমুক দিলাম একবার।

“এক মেয়ে।”

“কত বছর?”

“তিনে পা দিবে কিছুদিন পর।”

“তোমার মতনই আদুরে নিশ্চয়ই।”

সাথে সাথে কিছু বলে না সায়াকা। কিছুক্ষণের নীরবতার পর আগের তুলনায় ক্ষীণস্বরে বলে, “অনেক।”

এবারে চোখ তুলে তাকাই ওর দিকে। গলায় কষ্টের অস্তিত্বটুকু আর কেউ টের না পেলেও আমি পেয়েছি। তবে এরপর আর কিছু বললো না ও। অন্য একজন কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে।

রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল সায়াকা। কেন যেন মনে হলো চেহারাটা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সেই সময় আমার দিকে তাকালো ও। যেন টের পেয়েছে আমার দৃষ্টি ওর দিকে। প্রথমবারের মতন চোখাচোখি হয় আমাদের।

সাথে সাথে মাথা নামিয়ে নিই। শেষ পর্যন্ত ওদিন আর কোনো কথা হয় না। বাসায় ফিরে গলার টাই ঢিলা করতে করতে নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কেন গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানটায়? পরমুহূর্তেই মনে হয় ওর সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।

এর সপ্তাহখানেক পর ফোনটা পাই।

* * *

শিনজুকুর সিটি হোটেলের ক্যাফেতে দেখা করবো বলে ঠিক করেছি আমরা। পাঁচটা বাজার দশ মিনিট আগে ওখানে পৌঁছে গেলে ওয়েট্রেস একটা টেবিলে নিয়ে যায়। সায়াকা তখনও আসেনি। ছোট ক্যাফেটায় নজর বুলিয়ে মনে মনে হাসি একবার। কী আশা করেছিলাম? ও আগে এসে বসে থাকবে? আমি যার জন্যে অপেক্ষা করছি সে ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নয়, বরং একজন সেলস এক্সিকিউটিভের স্ত্রী।

মনে মনে নিজেকে বললাম, খুব বেশি কিছু আশা করে বসে থেকো না। মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনবে কেবল। ও বলেছে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করার মত কেবল তুমিই আছ।

আমার মনের মধ্যে আরেকটা অংশ বলছে, “ওর কথাগুলো শুনে উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসছে তোমার। সায়াকা বলেছে, তোমাকে এমন কিছু বলতে চায় যা নিজের স্বামীকেও বলতে পারবে না। তোমার মনের মধ্যে এখনও আশা যে অন্য একজনকে বিয়ে করার পরেও তোমাকেই ভালোবাসে, সায়াকা। নিজেকে সামলাও! এসব দিবাস্বপ্ন তোমার নিজের কষ্টের কারণ হবে।”

এসব আকাশকুসুম কল্পনার ইচ্ছে নেই আমার, কিন্তু…

পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে এলো সায়াকা। আমাকে দেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, দেখে মনে হচ্ছে যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। একটু পর ধীর পায়ে এগোতে শুরু করলো টেবিলের দিকে। একটা সবুজাভ টপস, সাদা ব্লাউজ আর লম্বা স্কার্ট পরনে। পঞ্চাশের দশকে এই ধরনের স্কার্ট আধুনিক বলে গণ্য হতো নিশ্চয়ই। চুল যেভাবে কাটা, তা ভীষণ মানিয়ে গেছে ওর সাথে। গৃহিনী পত্রিকার মডেল হতে পারত অনায়াসে।

“ভেবেছিলাম আমি আগে এসে পড়বো,” টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো। গালে লালচে আভা।

“কাজ একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে আমার,” বলি আমি। “দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো?”

মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে আমার উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসে এক কাপ দুধ চা অর্ডার দিল ও। এই অভ্যাসটা আগের মতই আছে।

“কাছেই থাক নাকি তুমি?” মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সায়াকা।

“না, খুব একটা কাছে না। দু’বার বদলাতে হয় ট্রেন।”

ও। “তাহলে এখানে দেখা করার কথা বললে যে?” চারপাশে নজর বুলায়

“তোমার যেন অসুবিধা না হয়, সেজন্যে বলেছি। তুমি তো বোধহয় তোদোরোকিতে থাকো।”

আমার কথা শুনে বিস্ময় ফুটল সায়াকার চেহারায়। আসলে পুনর্মিলনীর দিন ওর বলা ঠিকানাটা ভুলিনি। সায়াকা নিজেও বুঝতে পারল সেটা। কিছুটা স্বাভাবিক হলো আগের তুলনায়।

“ভেবেছিলাম আমার কোনো কথাই ঠিকঠাক শোনোনি সেদিন।” “তুমিও নিশ্চয়ই আমার কথা শোনোনি।”

“শুনব না কেন? সবকিছু ভালোই চলছে তোমার তাহলে।” ওয়েটার ওর দুধ চা দিয়ে গেল এই সময়। দুই হাতে কাপটা ধরে চোখ বন্ধ করে চুমুক দিল ও একবার।

“তোমাকে আমার ফোন নম্বর কে দিয়েছিল?”

“কুদো।”

“সেটাই ভেবেছিলাম।”

আমাদের রিইউনিয়নের সব বন্দোবস্তও কুদোই করেছিল। আগে থেকেই এসব কাজে পারদর্শী সে। তাছাড়া আমার আর সায়াকার মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, এটাও কুদো জানত। এতদিন পর আমার ফোন নম্বর চাইতে দেখে কী কী যে ভেবছে, কে জানে! সায়াকার মনেও নিশ্চয়ই এই চিন্তা একবার হলেও এসেছে। খুব সম্ভবত সেজন্যেই ওকে এরকম গম্ভীর দেখাচ্ছে এখন।

পকেট থেকে নিজের একটা বিজনেস কার্ড বের করে ওর দিকে ঠেলে দিলাম।

“তুমি তাহলে নারিমাতে থাকো,” একবার চোখ বুলিয়ে বললো ও। “ইউনিভার্সিটির কাছে থাকলেই সুবিধা। আমি যেখানে থাকি, সেখানকার স্টেশন থেকে একটু পরপরই তোশিমায় যাওয়ার ট্রেন ছাড়ে।”

“সাইন্স ফ্যাকাল্টি, ফিজিক্স… আগের মতই।”

“পার্থক্য বলতে এখন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট আমি।”

“আর কিছুদিনের মধ্যে তো অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হয়ে যাবে, তাই না?” “সেটার দেরি আছে।”

কার্ডটার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সায়াকা। এরপর একবার ঠোঁট ভিজিয়ে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো।

“আর কোনো কার্ড আছে নাকি তোমার?”

“আরেকটা কার্ড? না তো, কেন?”

“মানে, তুমি তো এখনও টুকটাক লেখালেখি করো বোধহয়? রিইউনিয়নে এরকমটা বলাবলি করছিল কেউ একজন।”

“ওহ,” মাথা ঝাঁকিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে আসা কফিতে চুমুক দিলাম একবার। “ওটা ওরকম কিছু না।”

“একটা বিজ্ঞান পত্রিকার জন্যে কলাম তো লেখ?”

“ছোটখাটো একটা সাময়িকী। প্রতি সংখ্যাতে যে লিখি, সেটাও না।” কথাটা যে কেবল বিনয়ের খাতিরে বলেছি, তা নয়। বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে সমাজ’ এই শিরোনামে লেখাগুলো প্রকাশিত হয়। সম্পাদক উপযুক্ত কোনো বিষয় খুঁজে পেলে আমাকে জানায়। বর্তমানে আলোচিত কোনো বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা করি। প্রাথমিকভাবে আমার উর্ধ্বতন এক প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করেছিল সাময়িকীর সম্পাদক। তার বন্ধু লোকটা। কিন্তু এসব ‘ছাইপাশ’ লিখে মূল্যবান সময় নষ্ট করবে প্রফেসর? প্রশ্নই আসে না। তাই আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রতিবেদনটার কথা এখনো মনে আছে। ‘বেজবলে যেভাবে খেলোয়াড় বাছাই করা হয়’। এরপর আমার আরো সাতটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

“পত্রিকাটার নাম শুনেছিলাম। লাইব্রেরিতে গিয়ে অবশ্য সবগুলো পাইনি। তিনটা পড়েছি এখন পর্যন্ত।”

“তাই নাকি?” বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলি। “পড়ে নিশ্চয়ই হাসি পেয়েছে তোমার, তাই না?” সায়াকা সাহিত্যের ছাত্রী, এজন্যেই কথাটা বললাম। মাথা ঝাঁকায় ও।

“নাহ, মজা পেয়েছি পড়ে। বিষয়গুলোও দারুণ ছিল।”

“আচ্ছা। এই প্রথম কোনো পাঠকের কাছ থেকে সরাসরি প্রশংসা শুনলাম।”

ওর চোখে চোখ রাখার আগে আরেকবার চুমুক দিলাম কফির কাপে।

“আমাকে কি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলে?”

এবারে লম্বা একটা শ্বাস নিল ও, যেন নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। এরপর ব্যাগ থেকে বাদামি রঙের একটা খাম বের করে আনল। খামটা ওলটাতেই ভেতর থেকে শব্দ করে একটা চাবি পড়লো টেবিলের উপরে। সাথে একটা কাগজ। চাবিটা পেতলের, নিচের দিকে সিংহের মাথার নকশা। কাগজে কিছু কথা লেখা।

মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম।

“এগুলো কী?”

“আমার বাবার রেখে যাওয়া জিনিস,” ধীরে ধীরে শব্দগুলো উচ্চারণ করলো ও।

“মারা গেছেন উনি?”

“এক বছর আগে। হার্ট অ্যাটাক।”

“ওহ।”

খুব একটা যে কষ্ট পেলাম কথাটা শুনে, তা নয়। ভদ্রলোকের সাথে কখনো দেখা হয়নি আমার।

চাবিটা হাতে নিলাম। বেশ ভারী। এবারে খেয়াল করলাম কাগজটায় ম্যাপের মতন নকশা আঁকা। নিচে ডানদিকে ছোট করে একটা ট্রেন স্টেশনের নাম লেখা।

মাতসুবারাকোয়েকি, মাতসুবারা লেক স্টেশন। আমার যদি ভুল না হয় তাহলে জায়গাটা নাগানোতে। কোমোরো থেকে খুব একটা দূরে নয়।

“কী হয়েছে বলো তো।”

“আমি চাই এই ম্যাপে যে জায়গাটা দেখানো হয়েছে, সেখানে তুমি আমার সাথে আসো।”

“আমি? তোমার সাথে? কিন্তু কেন?” বিস্মিত স্বরে চোখ বড় করে বললাম।

হাত বাড়িয়ে চাবিটা নিল ও। আমার আঙুলে ওর আঙুলের পরিচিত স্পর্শ টের পেলাম অনেক দিন পর। একই রকম আছে ওগুলো। সরু, ফ্যাকাসে।

“আসলে, বাবার জীবদ্দশায় করে যাওয়া কিছু কাজ এখনো ভাবায় আমাকে,” শান্তস্বরে বললো সায়াকা। “মাছ ধরতে ভালোবাসত সে। ছুটির দিনে সুযোগ পেলে একা একাই বেরিয়ে পড়তো। কিন্তু কখনো কখনো কিছু বিষয় অদ্ভুত লাগত আমার। এই যেমন মাছ ধরার আগের দিন কোনো প্রস্তুতি না নেয়া, মাছের খাবার না বানানো। এমনকি বর্শি, ছিপ ঠিক আছে কিনা, তা-ও দেখত না। ফিরে আসত খালি হাতে। সাথে থাকত না কোনো মাছ। শুধু এটাই নয়, বাসায় ফেরার পর ছিপ পরিষ্কারও করতো না। কিন্তু বাবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষ। তার একদমই নোংরা সহ্য হতো না।”

“তাহলে কি তোমার ধারণা, মাছ ধরার নাম করে অন্য কোথাও যেত সে?”

“সেটাই তো একমাত্র যুক্তিযুক্ত সম্ভাবনা, তাই না?”

“এটা কি প্রায়ই ঘটতো?”

“এই ধরো দুই তিন মাসে একবার। অবশ্য আমি যখন স্কুলে বা অন্য কাজে বাইরে থাকতাম, তখন বাবা বাড়ি থেকে বের হলে আমার জানার কোনো উপায় ছিল না।”

“কখনো কিছু জিজ্ঞেস করোনি?”

“করেছিলাম। বাবা, তুমি কি আসলেও মাছ ধরতে যাও?’ জবাবে কোনো প্রকার তর্ক করেনি আমার সাথে। ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল ‘ছিপ নিয়ে সেই জন্যেই তো বের হই।’ আমি নিশ্চিত ছিলাম, মিথ্যে বলছে সে। কিন্তু তখন ভেবেছিলাম কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে বাবা। তার বাসাতেই যায় নিশ্চয়ই। ততদিনে মা মারা যাওয়ার কয়েক বছর হয়ে গেছে। সুতরাং, সে যদি অন্য কারো সাথে আসলেও সম্পর্কে জড়ায়, তাহলে সেটা অস্বাভাবিক কিছু হবে না।”

“এরকম ভাবনা মাথায় আসাই স্বাভাবিক,” টেবিলে কনুই রেখে বললাম।

“হ্যাঁ, মা’র কথা ভেবে মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এটাও আশা করছিলাম, বাবা হয়তো আমার সাথে ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিবে।” ক্ষণিকের জন্যে হাসি ফুটলো তার মুখে। এরপর আবার গম্ভীর হয়ে গেল। “কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ যোগাযোগ করেনি আমার সাথে। সুতরাং, আমার অনুমান ভুল ছিল, এই বিষয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। এরপর দেখতে দেখতে এক বছর কেটে যায়। তখনও আমি উত্তর পাইনি যে কোথায় যেত বাবা। কিন্তু কিছুদিন আগে এই চাবি আর ম্যাপটার খোঁজ পাই। মাছ ধরতে যাওয়ার সময় বাবা যে ব্যাগটা নিয়ে যেত, সেটার ভেতরেই ছিল।”

ম্যাপটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুললাম। চোখাচোখি হয়ে গেল ওর সাথে।

“তাহলে তোমার ধারণা উনি ম্যাপে নির্দেশিত এই জায়গাটায় যেতেন?” মাথা নেড়ে সায় দেয় সায়াকা।

“আর তুমি ওখানে গিয়ে নিজের চোখে সবকিছু দেখে আসতে চাও?” আবারো মাথা নাড়ে ও।

কাপটা হাতে তুলে নিতে গিয়ে মনে হলো ভেতরে কিছু নেই। মাঝপথেই থেমে গেলাম।

“সেক্ষেত্রে তুমি একাই তো যেতে পারো। আমাকে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার?”

“আমি কখনো ওদিকে যাইনি আগে। তাছাড়া একা একা এতদূর যেতে ভালোও লাগবে না।”

“তাহলে অন্য কাউকে বলো।”

“আর কেউ নেই তো অমন। তুমি বাদে আমার এমন কোনো বন্ধু নেই যাকে ওখানে যেতে বলবো আমার সাথে।”

চোখ নামিয়ে নিল সায়াকা। দুই হাত মাথার পেছনে নিয়ে চেয়ারে দুলতে লাগলো সামনে পেছনে। বাচ্চাদের মতন এই কাজটা মাঝেমাঝে আগেও করতো ও।

“আমি আসলে বুঝতে পারছি না,” বলি ওকে। “এত বেশি চিন্তার তো কিছু নেই। ওখানে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে তোমার বাবা কী গোপন করেছেন এতদিন। তাছাড়া এটা এমন কিছু নয় যে এখনই জানতে হবে। তোমার হাজবেন্ড ফিরলে তার সাথেও যেতে পারবে। ধরো কোনো ছুটির দিনে গেলে। তোমাদের মেয়েও গেল সাথে। তিনজন একসাথে ঘোরাও হবে, আবার…”

মাঝপথেই থেমে গেলাম। হঠাৎ মুখ তুলে তাকিয়েছে ও। চোখমুখ একদম শক্ত। বিভ্রান্ত ভর করলো আমার মনে। “কোনো সমস্যা?”

এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছে কান্না চাপার চেষ্টা করছে বুঝি। হঠাৎ এরকম আচরণের কারণ কী?

চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। নিজেকে একটু সামলে নিক ও। এরপর হয়তো নিজেই বলবে।

তবে এটা নিশ্চিত যে-কোনো সমস্যা আছে। নতুবা এত লোক থাকতে আমার সাথে যোগাযোগ করতো না। হাজার হলেও আমি ওর প্রাক্তন প্রেমিক। স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের মধ্যে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। প্রাক্তন প্রেমিকা হঠাৎ এভাবে যোগাযোগ করলে অজান্তেই মনের কোণে আশার আলো জ্বলে ওঠে। হয়তো সে আবারো আমাদের সম্পর্কটা ঠিক করতে চায়।

কিছুক্ষণ পর মাথা তোলে ও। চোখ ঠিক লাল নয়। কিছু একটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কোনো একটা দৃশ্য মনোযোগ কেড়েছে খুব সম্ভবত। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম সেদিকে। কম বয়সি এক জুটি প্রবেশ করেছে ক্যাফেতে। ছোটখাটো মেয়েটার পরনে খাটো স্কার্ট আর ঢিলেঢালা একটা টিশার্ট। ছেলেটা সেই তুলনায় বেশ লম্বা। একটা জিন্স আর পোলো শার্ট পরনে। রোদেপোড়া চেহারা দু’জনেরই।

তাদের দিকে তাকিয়েই সায়াকা বললো। “তুমিও আগে এরকমই ছিলে।”

ছাত্রাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটিক্স দলে ছিলাম আমি। একশো মিটার দৌড় আর হাই জাম্পে অংশ নিতাম।

এবারে আমার দিকে তাকালো সায়াকা।

“মনে আছে তখনকার কথা?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”

“আমারও,” একবার আমার বুকের দিকে তাকিয়ে আবারো আমার মুখের দিকে তাকালো ও। “ইউনিভার্সিটির দিনগুলো?”

“অনেক কিছুই ভুলে গেছি। আবার কিছু কিছু বিষয় খুব ভালো মনে আছে।”

“আর প্রাইমারি স্কুলের কথা?”

“সেটা তো অনেক দিন আগের ব্যাপার। ভুলে যাওয়াটাই কি স্বাভাবিক না? তখনকার বন্ধুদের চেহারা মনে করতে পারি না আর।”

“কিন্তু কোনো স্মৃতি আছে? এই যেমন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা শিক্ষা সফর?”

“ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা খুব ভালোমতই মনে আছে। কখনোই কোনো কিছুতে প্রথম হতে পারিনি।”

“তাই নাকি?” সায়াকার কণ্ঠে বিস্ময়, মুখে হাসির আভা। “আর এর আগে?”

“আগে বলতে?”

“প্রাইমারি স্কুলে পড়ার আগের কথা বলছি। তখনকার কথা কিছু মনে আছে?”

“কী বোঝাতে চাইছ, বলো তো?” জবাবে বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে বলি আমি।

“যা জিজ্ঞেস করলাম, সেটার উত্তর দাও।”

“আবছা মনে আছে। যাদের সাথে খেলতাম, মা-বাবার বকুনি, কেমন খেলনা ছিল—এসব।”

“তাহলে তখনকার স্মৃতি আছে তোমার। যে বাসায় থাকতে, যাদের সংস্পর্শে ছিলে- তাদের মনে আছে?”

“থাকবে না কেন?” হেসে বলি। “হঠাৎ এসব জিজ্ঞেস করছো যে?” আবারো দ্বিধার ছাপ ফুটলো ওর চেহারায়। যেন কথাটা বলবে কিনা ভাবছে।

“আমার নেই।”

“তোমার নেই মানে?”

“কোনো স্মৃতি নেই,” দ্রুত একবার শ্বাস টেনে বলে ও। “যে বাসায় থাকতাম, যাদের সাথে থাকতাম, কোনো বিশেষ খেলনার স্মৃতি— এসব কিছুই মনে নেই আমার। সেসব স্মৃতির খোঁজেই আবার যেতে চাই।”

“ছোটবেলার স্মৃতি বলতে কেবল প্রাইমারি স্কুলের কিছু বিষয় মনে আছে আমার। বিশেষ করে নবীনবরণ অনুষ্ঠান। মা’র হাত ধরে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম। দুই পাশে ছিল সারি সারি চেরি গাছ। তুষারপাতের মতন পাপড়ি ঝরে পড়ছিল…”

কিছুক্ষণের জন্যে যেন হারিয়ে গেল ও। “কিন্তু এর আগের কোনো কিছু মনে নেই একদমই। কিচ্ছু না।” প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় সায়াকা।

আমি এখনও পুরোপুরি ধরতে পারছি না, ও কী বোঝাতে চাইছে। কিছুক্ষণ পর মুখ খুললাম, “তাতে কী? এটা কোনো গুরুতর ব্যাপার না। অনেকেই নিজেদের অতীত ভুলে যায়। এতে আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।”

“কেউ কিন্তু একেবারে কিছু ভুলে যায় না। ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিকে হয়ে আসতে পারে। আমার ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটলে, এত চিন্তা হতো না।” “কেন, তোমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ওরকম না?”

“না। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়েও বিষয়টা ভাবাত আমাকে। নিজেকে প্রশ্ন করতাম কেন আমার আগের কোনো স্মৃতি নেই। বড় হয়ে একদম ছোটবেলার কথা ভুলে যেতেই পারি, সেটা নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু স্কুলে থাকতে তো তেমনটা হবার কথা নয়।”

“তা ঠিক-”

“বিষয়টা এতই অদ্ভুত যে আমার বাবাকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমার প্রশ্ন ছিল কেন কিন্ডারগার্টেনের কোনো স্মৃতি মনে নেই। তখন বাবা বলে, ছোটবেলার স্মৃতি ভুলে যেতেই পারি। কিন্তু তার জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারিনি আমার বন্ধুদের কারো মধ্যে এরকম সমস্যা ছিল না। এসব চিন্তা মাথায় এলেই অস্বস্তিতে ভুগতাম। তা সত্ত্বেও বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগোতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতাম, জানো? বড্ড একা মনে হতো নিজেকে। ভয় লাগতো,” বুকে হাত রেখে লম্বা একটা শ্বাস নিল ও।

“তোমার কি আসলেই কিছু মনে নেই?”

“একদমই না। স্মৃতির পাতাগুলো খালি, সাদা কাগজের মতন,” চেহারায় বেদনার ছাপ স্পষ্ট সায়াকার। “তোমার যেমন কিছু কিছু বিষয় মনে আছে, আমার তা-ও নেই।”

“তোমাদের বাড়িতে কোনো ছবির অ্যালবাম ছিল না? সেখানে নিশ্চয়ই ছোটবেলার ছবি আছে? অন্তত যেদিন প্রথমে স্কুলে গেলে, সেদিনকার অনুষ্ঠানের ছবি তো থাকার কথা। সেগুলো দেখলে কিছু মনে পড়ে না?”

“বাবা-মা আমার অনেক ছবি তুলতো। দুই অ্যালবাম ভর্তি ছবি আছে। কিন্তু আমি একদম ছোট, এরকম কোনো ছবি নেই। প্রথম অ্যালবামটার প্রথম পাতার ছবিটা প্রাইমারি স্কুলের নবীন বরণের দিন তোলা।” “অসম্ভব।”

“এটাই সত্যি। তুমি চাইলে আমি দেখাতে পারি। বাসাতেই আছে।” “আর আংকেল-আন্টি তোমাকে প্রাইমারি স্কুলের আগের সময়কার কোনো গল্প বলেনি?”

“হুম,” একদিকে মাথা কাত করে ও। “নববর্ষের অনুষ্ঠানের কিছু গল্প বলেছে। একটা গল্প আমার মনে আছে। পাঁচ বছর বয়সে আমাকে নাকি একবার হারিয়ে ফেলেছিল। দু’জনেই ভয় পেয়ে যায় ভীষণ। সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। কিন্তু আমি নাকি আলমারিতে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

“এই গল্পগুলোর কোনো অর্থই নেই তোমার কাছে?”

“আমার মনে হতো যেন অন্য কারো গল্প শুনছি,” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সায়াকা। “আর সত্যি বলতে বাবা-মা’কে দেখে মনে হতো না খুব একটা আগ্রহ আছে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাপের। মুখ বেজার হয়ে থাকতো তাদের। যেন অপ্রীতিকর সব ঘটনার স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।”

“অপ্রীতিকর ঘটনা—”

কথাটা কেন বললো ও, কে জানে! একদম ছোটবেলার কোনো স্মৃতি নেই ওর, এই বিষয়টা অদ্ভুত। কিন্তু এর চেয়েও অদ্ভুত ওর বাবা-মা’র কাছে তখনকার কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকাটা। বাবা-মায়েরা শুধুমাত্র এই কাজটা করার জন্যে হলেও ক্যামেরা কেনে।

“আগে তো কখনো এই ব্যাপারে কিছু বলোনি তুমি আমাকে।”

“তোমার সাথে আমার যখন পরিচয়, ততদিনে বিষয়টার সাথে আপস করে নিয়েছিলাম। বলা যায় হাল ছেড়ে দেই একটা পর্যায়ে। কিন্তু শৈশবের কোনো স্মৃতি নেই, এই ব্যাপারটা সবসময় খোঁচাত আমাকে। আমাদের সম্পর্কটা যখন প্রণয়ে গড়ায়, তখনও ভুলিনি। “

নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে। আঙুলগুলো একসাথে করে টেবিলের উপর রাখলাম, আবার সরিয়ে নিলাম। ওর কথাগুলো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।

“তোমার বোধহয় ধারণা, এমন কিছু একটা ঘটেছিল যেটায় তুমি শৈশবের সমস্ত স্মৃতি হারিয়েছ, তাই না?” ভাবনাগুলো গুছিয়ে আনার চেষ্টা করলাম।

মাথা নেড়ে সায় দিল ও।

“আর এখানে গিয়ে দেখতে চাও, কোনো সূত্র পাওয়া যায় কিনা?” টেবিলে রাখা ম্যাপটার দিকে ইঙ্গিত করলাম।

“আসলে একটা বিষয় মনে আছে আমার।”

“কী?”

“এই চাবিটা,” বলে সিংহের মাথা নকশার চাবিটা হাতে নেয় ও। “আগে কোথাও দেখেছিলাম একবার। কিন্তু প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হবার পরে নয়, আগে। যদি ওখানে গিয়ে জানতে পারি এটা কিসের চাবি, তাহলে হয়তো কিছু মনে পড়তে পারে।”

আবারো বুকের ওপরে হাত ভাজ করে রাখলাম। চেয়ারে হেলান দিয়ে শব্দ করে শ্বাস ছাড়লাম একবার।

“আমি আসলে বুঝতে পারছি না। বিষয়টা কি আসলেও এতটা জরুরি? এটা জানি যে দীর্ঘ সময় ধরে তোমাকে ভোগাচ্ছে চিন্তাটা। কিন্তু এতদিনে তো তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই না? তাছাড়া শৈশবের স্মৃতি আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে হয় না। তোমার ভাগ্যে যা আছে, ভবিষ্যতে সেটাই হবে।”

চোখ বন্ধ করে নিল সায়াকা। রাগ চাপার চেষ্টা করছে খুব সম্ভবত। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো।

“কিন্তু স্মৃতিগুলো আমার দরকার।”

“কেন?”

“কিছুদিন আগে খেয়াল করেছি খুব জরুরি কিছু বিষয় মনে নেই আমার, যেগুলো থাকা উচিত ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এমন কিছু খুঁজে পাইনি, যা সেই স্মৃতিগুলো আবার মনে পড়ার ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে।”

“জরুরি কিছু বিষয় মনে নেই?”

“না,” দৃঢ় কণ্ঠে বলে ও। “এটা কেবলমাত্র আমার পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব। তোমাকে বলে বোঝাতে পারছি না বোধহয়।”

জবাবে সায়াকা এমন কিছু বলতে পারে, তা মাথায় আসেনি আমার। এতক্ষণের সমস্ত প্রতিরোধ গুড়িয়ে গেল এক নিমেষে।

“আরেকটু খুলে বলো আমাকে। কেন তোমার এমনটা মনে হচ্ছে যে জরুরি কিছু বিষয় ভুলে গেছ?”

“এখানে সেই ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না,” মাথা ঝাঁকায় সায়াকা।

“তাহলে কোথায় বলবে?”

“যদি আমার সাথে ওখানে যাও, সবকিছু জানাবো,” বলে ম্যাপে হাত রাখে সায়াকা। “যদি আমরা এখানে যাই, আর আমার শৈশবের স্মৃতি যদি ফিরে আসে, তাহলে তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারব নিশ্চয়ই। এজন্যে চাইছি তুমি আমার সাথে যাবে।”

মাথা চুলকালাম আমি। “কেমন যেন অবিশ্বাস্য ঠেকছে সবকিছু।”

“মাফ চাইছি সেজন্য। জানি, আমার কথা কতটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব না,” আবারো মাথা নামিয়ে নিল ও।

ওর মানসিক অবস্থা যে ভালো না, তা আচরণেই স্পষ্ট। যে-কোনো মূল্যে স্মৃতিগুলো ফিরে পেতে চাইছে। ওকে সাহায্য করার ইচ্ছেও আছে আমার। কিন্তু ঠিক কী কারণে সাহায্য করছি, তা না জানলে বিষয়টা ঘোলাটেই থেকে যাবে শেষ পর্যন্ত।

“আমার পক্ষে তোমার সাথে যাওয়া সম্ভব না,” বলি। “এই কাজের জন্যে আমি সঠিক লোক নই আসলে। অন্য কেউ নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবে তোমাকে।”

“এতক্ষণ আমার কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর, এটা তোমার জবাব?” “তুমি সবকিছু বলোনি। তাছাড়া তোমার এরকম ভেঙ্গে পড়ার পেছনে মূল কারণ কী, সেটাও জানি না। আমি সাথে না গেলেই ভালো হবে বোধহয়।”

কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না সায়াকা। বোধহয় অনুরোধ করতে করতে ক্লান্ত। কিংবা, বুঝতে পেরেছে যে অনুরোধেও কোনো কাজ হবে না। হাত বাড়িয়ে কাপটা তুলে নিল ও, কিন্তু অনেক আগেই খালি হয়ে গেছে ওটা।

কেউই কিছু বললাম না লম্বা একটা সময়। আশপাশের কোলাহল আগের মতই আছে। কিছুক্ষণ আগে ক্যাফেতে আসা সেই জুটির দিকে তাকালাম। দু’জনের মুখেই দরাজ হাসি 1

“বেশ,” কিছুক্ষণ পর মুখ খোলে সায়াকা। “ভুল ভেবেছিলাম বোধহয়। তোমার নিজের একটা জীবন আছে। প্রাক্তন প্রেমিকার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার সময় হবে না এটাই স্বাভাবিক।

“তুমি যদি বিপদে পড়ো, তাহলে অবশ্যই আমাকে পাশে পাবে। কিন্তু এভাবে না।”

“ধন্যবাদ। কিন্তু অন্য কোনোভাবে তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয় না,” সায়াকার মুখে মলিন হাসি।

চাবি আর ম্যাপটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো আবারো। ও উঠে দাঁড়ালে বিলের কাগজটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়ালাম। একই সময়ে সায়াকাও হাত বাড়ানোয় কাগজটা নিয়ে এক প্রকার টানাটানি শুরু হয়ে গেল।

“আমি বিল দিব,” বললাম।

মাথা ঝাঁকায় সায়াকা। “নাহ, আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।”

“তো কী হয়েছে?”

বিলটা ধরে তখনও নিজের দিকে টানছিলাম, এসময় ওর বাম হাতের কব্জির দিকে নজর গেল। ঘড়ির বেল্টের সমান্তরালে দুটো লাল দাগ। ছেড়ে দিলাম বিলটা। কী বলবো বুঝতে পারছি না।

সায়াকা সম্ভবত টের পেয়েছে আমার নজর কোন দিকে। বিল সমেত হাতটা দ্রুত পেছনে নিয়ে গেল।

“আমি দিচ্ছি বিল।”

বাম হাতটা দৃষ্টির আড়ালে রেখেই ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে ছুটে গেল ও।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। কব্জির ওই লাল দাগগুলোর কথা ভুলতেই পারছি না। চমকে গেছি বললেও কম হয়ে যায়।

সায়াকা ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। বকুনির ভয়ে বাচ্চাদের যেমন চেহারা হয়, ওকেও সেরকমই দেখাচ্ছে এখন।

“যোগাযোগ করার জন্যে ধন্যবাদ,” বলি আমি।

জবাবে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো ও, ঠিক শুনতে পেলাম না। হোটেল থেকে বের হওয়ার দরজার দিকে পা বাড়ালাম। আমার পেছন পেছন এলো সায়াকা। আন্ডারপাসের দিকে পা বাড়াতে যাব, এসময় থেমে গেল ও।

“আমি ট্যাক্সিতে ফিরব।”

“ঠিক আছে।”

এরপরেও লম্বা একটা সময় বিদায় না জানিয়ে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলাম দু’জন। স্যুট-টাই পরিহিত তিনজন লোক পাশ কাটিয়ে গেল আমাদের।

এক পা এগোলাম ওর দিকে।

“তোমার হাজবেন্ডের কানে তো যাবে, তাই না?”

“কী?”

“তুমি যদি হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাও, সে তো জানবে?”

“ওহ,” টান টান হয়ে থাকা দড়ির গিট খুলে যাওয়ার মতন শান্তি ফুটলো ওর চেহারায়। “সেদিকে খেয়াল রেখেই যা করার করতে হবে। তাছাড়া ওর আসতে এখনো প্রায় ছয় মাস।”

“ওহ আচ্ছা।”

মাথার ভেতরে নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আসলে এখনো দ্বিধায় ভুগছি।

এসময় সায়াকা মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে।

“আসবে তুমি আমার সাথে?”

“আগামী শনিবার সময় হবে তোমার?” ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সায়াকা।

“হ্যাঁ, হবে।”

“তাহলে আমাকে শুক্রবার সন্ধ্যায় ফোন দিও একবার। কীভাবে সবকিছু করবো, সেই ব্যাপারে আলাপ করা যাবে।”

“ঠিক আছে,” চোখ পিটপিট করছে ও। “ধন্যবাদ।”

ওর বাম হাতের কব্জির দিকে তাকালাম আবারো। কিন্তু আমার নজর কোনদিকে সেটা টের পাওয়ার সাথে সাথে ডান হাতের তালু দিয়ে ঢেকে ফেলল জায়গাটা। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

“তুমিও ট্যাক্সিতেই চলো নাহয়? আমি নামিয়ে দিচ্ছি তোমাকে?” আগের তুলনায় কিছুটা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ও।

“না, ধন্যবাদ।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

ওকে ওখানে রেখে উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তা পার হয়ে ওর দিকে ফিরে দেখি এখনো আমাকেই দেখছে। হাত নেড়ে বিদায় জানালাম এবারে।

নিঃসঙ্গ একটা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে নীল আকাশে। বোঝাই যাচ্ছে বেশ গরম পড়বে আজ। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে। মাথাটা বেশ ভারী ভারী ঠেকছে। গত রাতে অতিরিক্ত ব্র্যান্ডি খাওয়ার ফল। ঘুম একদমই হয়নি। পরদিন কী হবে, সেই চিন্তাই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল পুরোটা সময়।

ঘড়িতে এখন সকাল সাতটা। আমার হিসেবে রীতিমতো ভোর। শেষ কবে এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিলাম ভুলে গেছি। কিছুক্ষণ হালকা ব্যায়াম করে সময় নিয়ে শেভ করলাম। দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে বের হয়ে দেখি কেবল বিশ মিনিট গেছে। আটটা নাগাদ বের হয়ে যাব বিধায় আর নাস্তা করলাম না।

খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। টিভিতে খবর দেখলাম কিছুক্ষণ। আটটা বাজার অপেক্ষায় আছি শেষ কয়েক মিনিট মনে হলো যেন একেকটা ঘণ্টা।

কিশিতানি বুলভার্দ পেরিয়ে ডানে একটা পার্শ্বরাস্তায় ঢুকিয়ে দিলাম গাড়ি। এদিক দিয়ে পশ্চিমে কিছুদূর এগোলেই কোশু। শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় অনেকেই ঘুরতে বেরিয়েছে। পর্যটকবাহী অনেকগুলো গাড়ি চোখে পড়লো।

আরো কিছুক্ষণ সামনে এগোনোর পর বাম দিকে রয়্যাল হোস্টের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো। পার্কিং লটে গাড়ি রেখে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করলাম। জানালার পাশে একটা টেবিলে বসে আছে সায়াকা।

“সরি, তোমাকে বসিয়ে রেখেছি এতক্ষণ,” ওর সামনে রাখা খালি চায়ের কাপটা দেখে বললাম।

“আরে, সরি কেন বলছো, আমিই বেশি আগে চলে এসেছি,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলে সায়াকা। “ভেবেছিলাম ভিড় থাকবে রাস্তায়।”

গতকাল সন্ধ্যায় ফোনে আলাপ করে ঠিক করেছিলাম ও একটা ট্যাক্সিতে করে এখানে চলে আসবে সকালে। যাওয়ার পথে আমি ওকে উঠিয়ে নিয়ে যাব।

এক কাপ কফি আর স্যান্ডউইচের অর্ডার দিলাম। সায়াকা এক স্কুপ আইসক্রিম দিয়ে যেতে বললো।

“আজকে আবহাওয়া বেশ ভালো দেখছি,” আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলাম।

“ভালোই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু আবহাওয়া রিপোর্ট মোতাবেক সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামতে পারে।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ, নাগানোর আবহাওয়া অধিদপ্তরে ফোন দিয়েছিলাম।”

“তুমি দেখি সবকিছুই আগে থেকে ভেবে রেখেছ।”

মনে মনে নিজেকে শুধালাম, আবহাওয়া যে-কোনো সময় বদলে যেতে পারে। আড়চোখে সায়াকাকে দেখছি। ওর লুই ভ্যুইতোঁ ব্যাগটা ফুলে আছে বেশ। আজকে গিয়ে আবার আজকেই ফিরে আসার কথা আমাদের। একদিনের জন্যে এতকিছু নেয়ার দরকার আছে কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করাটা মানায় না, তাই মুখ বন্ধই রাখলাম। ওর ব্যাগের পাশেই বড় একটা কাগজের ব্যাগ। এটার ভেতরেই বোধহয় ছবির অ্যালবামগুলো। আগের দিন বলেছিল, সাথে করে নিয়ে আসবে।

একজন ওয়েট্রেস এসে আমাদের অর্ডার করা খাবারগুলো টেবিলে রেখে গেল। সায়াকা আইসক্রিম খেতে খেতে, কফি আর স্যান্ডউইচ শেষ করে ফেললাম। এখনও সেই আগের মতন চামচ থেকে একটু একটু করে আইসক্রিম চেটে খাচ্ছে ও, এই অভ্যাসটা বদলায়নি।

ওর বাম হাতের কব্জির দিকে তাকালাম আড়চোখে। আজকের ঘড়িটা ভিন্ন। আগের দিনের চেয়ে বেশ মোটা। ক্ষতচিহ্নগুলো দেখা যাচ্ছে না সেই কারণে। সেই উদ্দেশ্যেই পরেছে নিশ্চয়ই।

নাস্তা পর্ব শেষ হলে বেরিয়ে পড়লাম দু’জনে। কোশুর মূল সড়ক ধরে আরো পশ্চিমে যেতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শোফু ইন্টারচেঞ্জে পৌঁছে গেলাম।

“একটা গানের সিডি নিয়ে এসেছি, বাজাব ওটা?” সায়াকার চোখে লাজুক দৃষ্টি। আমার গাড়ির সিডি প্লেয়ারটা বেশ ভাল।

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু কার গান?” মনে মনে আশা করছি ইউমিঙের গান ছাড়বে না। একবার পুরো একটা অ্যালবাম শুনিয়েছিল। কান দিয়ে রক্ত পড়া বাকি ছিল কেবল।

স্পিকারে কুইনের গান বেজে উঠল একটু পর। তবে কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম এটা ফ্রেডি মারকারির কণ্ঠ নয়, অন্য কেউ গাইছে। সায়াকা জানালো এই আর্টিস্টের নাম জর্জ মাইকেল।

“আর কী শোনো তুমি?”

“বন জোভি শোনা হয় মাঝে মাঝে,” জবাব দেয় ও।

আগে এই ধরনের গান খুব বেশি শুনতো না সায়াকা। পছন্দ বদলেছে তাহলে। দীর্ঘ একটা সময় ধরে যোগাযোগ নেই আমাদের মধ্যে, এই সত্যটা আরো একবার টের পেলাম।

খুব বেশি ট্রাফিক জ্যাম নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সুতামা ইন্টারচেঞ্জে। কিন্তু টোল বুথ অবধি পৌঁছতে বেশ সময় লেগে গেল। কিয়োসাতোর উদ্দেশ্যে চলেছে অনেক গাড়ি। বেশিরভাগই নানান বয়সি জুটি। বাইরে থেকে দেখলে আমাদেরও নিশ্চয়ই সেরকমই মনে হচ্ছে। ছুটির দিনে ঘুরতে বেরিয়েছি। ছাত্রাবস্থায় আসলেও একবার আমরা কিয়োসাতো তে গিয়েছিলাম। ছবির বইগুলোতে যেরকম গেস্টহাউজ দেখা যায়, ওরকম একটা গেস্টহাউজে ছিলাম সেবার। পার্শ্ববর্তী একটা ফরাসি রেস্তোরাঁর স্বাদহীন খাবারগুলোর কথাও মনে আছে।

পাশে বসা সায়াকা হেসে উঠল এসময়। অন্যান্য গাড়িগুলোর সাথে উত্তরে চলেছি আমরা। আগের এই ওয়ান ফোর্টি ওয়ান ন্যাশনাল লাইনের নাম বদলে এখন রাখা হয়েছে কিয়োসাতো লাইন। দু’পাশে জিংকগো গাছের সারি।

“কী হলো, হাসছ কেন?”

“এই রাস্তা দিয়ে এর আগেও একসাথে গিয়েছিলাম আমরা, মনে আছে? একটা সুন্দর গেস্টহাউজে ছিলাম।”

“হ্যাঁ।”

আমিও যে একই কথাই ভাবছিলাম, তা আর বললাম না।

“জায়গাটা দেখার সাথে সাথে আরেকটু হলে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেছিলে। তোমার নাকি এরকম লাভ হোটেলগুলো*  একদম অপছন্দ।”

[*প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী ও পুরুষের অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর জন্য সমগ্র জাপানে অসংখ্য হোটেল আছে যেগুলো লাভ হোটেল নামে পরিচিত। হোটেলগুলো সাধারনত ঘণ্টা হিসাবে বিল নিয়ে থাকে। ৩ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ভাড়া নেয়া যায়।]

“আসলেও অপছন্দ,” হেসে বলি।

“শেষ পর্যন্ত অবশ্য থাকতে রাজি হয়েছিলে। কিন্তু পরদিন কিয়োসাতোতে গিয়ে স্যুভনির দোকানগুলো দেখে তোমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল!”

“উফ! জঘন্য!”

“বারবার আমাকে খোঁচাচ্ছিলে যেন তখনই ফিরে যাই। ঠিকমতো কেনাকাটাও করতে পারিনি। “

“আসলে ওখান গিয়ে কেমন যেন লজ্জা লাগছিল।”

“অভিজ্ঞতাটা সুখকর ছিল না আসলেও।”

দু’জনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম এবারে। ভাবলাম একবার বলি কেনাকাটার জন্যে কিয়োসাতো’তে থামা যেতে পারে, কিন্তু গিলে ফেললাম কথাগুলো। অ্যাকসেলেরেটরে চেপে বসলো পা।

কিছুক্ষণের মধ্যে সারি সারি রঙচঙে সব ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ চোখে পড়লো। জায়গাটা এখনও আগের মতনই আছে।

আরেকটু সামনে এগোনোর পর বাম দিকে একটা রাস্তা চলে যেতে দেখলাম। সেদিকে গেলেই কিয়োসাতো। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে গাড়ি সোজা চালিয়ে এসে পড়লাম।

“তোমার বাবা কি সবসময় গাড়িতে করেই যেত?”

“হ্যাঁ, বাবা ট্যাক্সি চালাত।”

ভুলে গেছিলাম এটা। হাইস্কুলে থাকতে ও বলেছিল আমাকে।

“আংকেল যদি শীতকালেও এখানে আসেন, তাহলে চাকায় চেইন ব্যবহার করতে হতো নিশ্চয়ই।”

“তুমি বলাতে খেয়াল হলো, বাবা সবসময় ট্রাঙ্কে চেইন রেখে দিত তখন ভাবতাম তুষারঝড়ে আটকা পড়ার পূর্বসতর্কতা হিসেবে এমনটা করতো সে।”

“প্রায়ই এখানে আসতে হতো বোধহয়, তাই কাছেই রাখত চেইনগুলো।”

“হ্যাঁ,” সায় দিল ও।

গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে টানা গাড়ি চালালাম আরো বেশ কিছুক্ষণ। কোমি লাইন লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে আসার পর দু’পাশে বাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেল আগের তুলনায়। প্রাইমারি স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে।

উমিনোকুচি পার করে এলাম। এর দশ মিনিট পরে মাতসুবারা লেক লেখা একটা সাইন চোখে পড়লো। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর স্টেশনের সাইনবোর্ড দেখলাম ডান দিকে। ম্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী সেদিকে ঢুকে পড়লাম। একদম ছোট্ট একটা স্টেশন। দেখে মনে হবে কারো বাড়ি বুঝি। ঢোকার পথে উপরে কাঠের প্যানেলে আদিকালের নকশায় মাতসুবারাকয়েকি লেখা। নামফলকের চারপাশের পেরেকগুলোয় জং ধরে গেছে। অন্ধকার ওয়েটিং রুমটা আমি ছাত্রাবস্থায় যে ভাড়া করা ঘরটায় থাকতাম, সেটার চেয়েও ছোট। একপাশের তাকে পুরোনো ‘শোনেন জাম্প’ আর ‘শোজো ফ্রেন্ড’ ম্যাগাজিন রাখা কম বয়সি ছেলেমেয়েদের জন্যে। ট্রেনের শিডিউল একপাশের দেয়ালে টাঙ্গানো, হাতে লেখা হয়েছে সেগুলো। প্রতি নব্বই মিনিটে একটা করে ট্রেন আসে। কিছুক্ষণ আগেই একটা গেছে। প্লাটফর্মে কেউ নেই। নির্জন চেকপয়েন্টটা পার হয়ে সেখানে গেলাম আমরা। একটাই লাইন সামনে। সুনসান, নিস্তরঙ্গ পরিবেশ।

“আমাকে ম্যাপটা একটু দেখাবে?” সায়াকাকে বললাম। ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো ও।

ম্যাপে দেখানো হয়েছে কীভাবে মাতসুবারা লেক স্টেশন থেকে গন্তব্যে যেতে হবে। গন্তব্য বোঝানোর জন্যে ম্যাপের বাম দিকে ওপরে একটা কালো ডট ব্যবহার করেছেন সায়াকার বাবা। দেখে মনে হচ্ছে একটা লম্বা আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে অনেকটা দূর। রাস্তার দুই পাশে ‘তিনটা পাইন গাছ’ বা ‘বড় গাছের গুড়ি- এরকম বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া। আমাদের গন্তব্যের কাছে লেখা ‘সিংহ’। এখন অবধি জানি না এই কথাটা দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে, কিন্তু সায়াকার কাছে সিংহের মাথার নকশার একটা চাবি আছে। সুতরাং বলা যায়, আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি।

“ওখানে গিয়েই দেখতে হবে সবকিছু,” বলি।

“হ্যাঁ,” প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলে সায়াকা।

স্টেশন থেকে মূল সড়কে ফিরে এলাম আমরা। কিয়োসাতোকে পেছনে ফেলে ম্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী ডান দিকের রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলাম গাড়ি। এখন চারপাশে খাড়া সব পাহাড়।

কিছুদূর যাওয়ার পর একটা চৌরাস্তার মোড়ে পৌছুলাম। এখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে ইনাগো হট স্প্রিং শহরে। আমরা মাতসুবারার দিকে এগোলাম।

খানিক পরেই ডান দিকে হ্রদটা চোখে পড়লো প্রথমবারের মতন। ছোট বড় অসংখ্য হোটেল লেকের পাশে। বেশিরভাগ পার্কিং লটই খালি। উইকেন্ড হওয়া সত্ত্বেও ভিড়-বাট্টা তেমন একটা নেই।

তবে যতই সামনে এগোলাম বাড়ির সংখ্যা কমতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বন দেখতে পেলাম আমাদের সামনে। সেই বনের প্রবেশ পথের ঠিক পাশে তিনটা পাইন গাছ। ম্যাপে তাহলে ঠিকঠাক নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে। গাড়ি নিয়ে বনে ঢুকে পড়লাম।

ম্যাপ মোতাবেক এবারে বড় একটা গাছের গুড়ি দেখতে পাওয়ার কথা, যার পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। কিন্তু সেরকম কিছু চোখে পড়লো না। বেশ কয়েকবার তীক্ষ্ণ মোড় নিল পথটা। এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ করেই ভালো রাস্তায় উঠে পড়লো গাড়ি। এখান থেকে চারপাশে চলে গেছে অনেকগুলো পথ। সেরকমই একটা পথে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলাম। পশ্চিমা নকশার বেশ কয়েকটা বাড়ি এবং কাঠের কেবিন চোখে পড়লো। বনের সাথে একদম মিশে আছে ওগুলো। এখানে নিশ্চয়ই বসতি স্থাপনের আজ চলছে।

“ম্যাপের কালো ডটটা দিয়ে বোধহয় এরকমই একটা বাড়ির কথা বলা হয়েছে,” সায়াকা বলে।

“খুব সম্ভবত,” বললাম। “কিন্তু আমাদের গাছের গুড়িটা খুঁজে বের করতে হবে।”

“ওটা বোধহয় এদিকে নয়। এখানকার পথগুলোর নাম আছে কিন্তু, ওই সাইনবোর্ডটায় দেখো। বাবা কোনো নাম লেখেনি ম্যাপে।”

“তা ঠিক,” বলে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললাম।

এবারে উল্টো পথে চলছে গাড়ি। বেশ কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়লো, বেশিরভাগই খালি।

বাড়িগুলো ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে এসেছি, এমন সময় সায়াকা চিৎকার করে উঠলো, “ওই তো!”

গাড়ি থামিয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম। রাস্তার পাশে একটা চৌকো পাথর। কয়েক হাতের মতন লম্বা। পাথরটার তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, তবে গাছের গুড়ি বলেও সহজে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। ওটার ঠিক পাশ দিয়েই একটা ছোট রাস্তা চলে গেছে। কিন্তু এত সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো সহজ হবে বলে মনে হয় না।

“হ্যাঁ, ওদিকেই যেতে হবে খুব সম্ভবত,” বলে খানাখন্দে ভরা রাস্তার মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলাম। চাকাগুলো শব্দ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিছুটা পথ যাওয়ার পর ডানদিকে পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউজের মতন দেখতে একটা দালান চোখে পড়লো।

সামনে এগোতে থাকলাম। রাস্তার দুইপাশে আগাছায় ভর্তি। সেগুলোর মধ্যে দিয়েই যেতে হচ্ছে।

আরেকটু যাওয়ার পর রাস্তাটা ভাগ হয়ে গেল দুই দিকে। ম্যাপেও এমনটাই দেখানো হয়েছে। গাড়ি থামিয়ে চারপাশে তাকালাম। এবারে শেষ নির্দেশনা চিহ্নটা খুঁজে বের করার পালা।

ডানদিকে ছোট একটা সাইনবোর্ড। কিছু লেখা নেই সেখানে। সাদা রঙ দিয়ে কী যেন একটা আঁকা হয়েছে। জায়গায় জায়গায় রঙ উঠে যাওয়ায় বুঝতে কিছু কষ্ট হলেও এটা স্পষ্ট যে একটা সিংহ আঁকা হয়েছিল সেখানে। আর কথা না বাড়িয়ে সেদিকে ঘুরিয়ে দিলাম গাড়ি। সায়াকাও কিছু বলছে না।

দশ মিটারের মতন যাওয়ার পরে একটা ধূসর বাড়ি চোখে পড়লো আমাদের বাম দিকে। চারপাশে এমনভাবে ঝোপঝাড় আর আগাছা গজিয়েছে যে দূর থেকে কেবল দ্বিতীয় তলাটা দেখা যাচ্ছে।

ওখানেই গাড়ি পার্ক করলাম। রাস্তা শেষ। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে তাকালাম বাড়িটার দিকে।

বাড়িটা এখন ধূসর দেখালেও আগে যে সাদা রঙ করা হয়েছিল, তা বোঝা যাচ্ছে। ঢালু ছাদের দু’পাশে দু’টো ত্রিভুজাকৃতির স্কাই-লাইট। আর ভাইলাইট দু’টোর মাঝে একটা ছোট চৌকো চিমনি।

কোনো বেড়া চোখে পড়লো না। তবে ইটের পিলারের মাঝে গেটটা বহাল তবিয়তেই আছে। সেখান থেকে একটা সিমেন্টে বাঁধানো পথ চলে গেছে সামনের পোর্চের দিকে।

গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে এগোলাম আমরা। পর্দা থাকার কারণে জানালা দিয়ে ভেতরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। নিচতলার সবগুলো জানালাই বন্ধ।

বাড়িটার বাম দিকটা তুলনামুলক চওড়া। আসলে সামনে পোর্চের কারণে অমন দেখাচ্ছে। পোর্চের নিচে বাড়ির দেয়ালগুলোর মতন ধূসর একটা দরজা। আর সেটার বাম দিকে কিছুটা অংশ সামনে বেরিয়ে আছে। দরজার উপরে এবং চারপাশে নজর বুলালাম। কোনো নামফলক চোখে পড়লো না।

“দেখে তো মনে হচ্ছে না কেউ থাকে,” আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো সায়াকা। “এরকম বাড়িকে ভিলা বলে বোধহয়।”

“হ্যাঁ।”

কলিংবেল গোছের কিছু চোখে পড়লো না। অগত্যা আঙুল দিয়ে দরজায় খটখট করলাম তিনবার। এরকম নির্জন পরিবেশে ভোঁতা শব্দটা আমার নিজেরই কানে লাগলো। দরজার যেখানটায় ছুঁয়েছি, সেখানে ধুলোর মধ্যে দাগ বসে গেছে।

যেরকমটা অনুমান করেছিলাম, ভেতর থেকে কোনো জবাব পাওয়া গেল না। একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমি আর সায়াকা। কাঁধ ঝাঁকালাম এর উদ্দেশ্যে। “চাবি দিয়ে চেষ্টা করে দেখবে নাকি?”

“তাই করি।”

ব্যাগ থেকে চাবি বের করে আমার হাতে দিল ও।

দরজার হাতল বাম দিকে। আর লকটা তার ঠিক নিচে। চাবিটা লকে ঢুকাতে গিয়েও থেমে গেলাম।

“নাহ, এটা না।”

“কী সমস্যা?”

“লকটা অন্যরকম। এটা এই লকের চাবি না।”

তবু চেষ্টা করলাম। চাবিটা লকের তুলনায় বেশ বড়।

“এত কষ্ট করে এতদূর এলাম, কিন্তু এখন এই চাবি কাজ করবে না!” হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে সায়াকা। “এই ম্যাপের সাথে তাহলে চাবির কোনো সম্পর্ক নেই?”

“সেটা এখনই বলা যাবে না।”

ওখান থেকে সরে বাড়িটার পেছন দিকে চলে এলাম আমরা। এদিকটায় বন একদম কাছে। ঘন গাছগুলোর ডালপালা বাড়ির ছাদ অবধি পৌঁছে গেছে।

সামনের দিকের দরজার ঠিক উল্টোপাশে এদিকে একটা ধাতব প্যানেল চোখে পড়লো। দেখতে অনেকটা দরজার মতন। একপাশে কবজাও আছে। অর্থাৎ, খোলা যায় এটা।

“এটা কি স্টোরেজ রুম নাকি?” সায়াকা পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো।

“হয়তো। কিন্তু কীভাবে যে খুলবো।”

কোনো হাতল চোখে পড়োলো না প্রথমে। কিন্তু যেখানে হাতল থাকার কথা সেখানে হাতের মুঠোর আকৃতির একটা পিতলের ফলক। আর এই ফলকটা সিংহের মাথার নকশার।

“এটা আবার কী?”

ফলকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সায়াকা। ওটা ধরে একপাশে টান দিতেই নড়ে উঠলো। মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এলো ওর।

এবারে আমি সামনে এগোলাম। ফলকটা ধরে ধাক্কা দিলাম একপাশে। দীর্ঘদিন কেউ ছোয়নি বিধায় আটকে গেল প্রথমে। তবে একটু চাপ প্রয়োগ করতেই শব্দ করে সরে গেল। এবারে একটা লক দেখা যাচ্ছে সেখানে। আরো একবার চোখাচোখি হলো আমাদের।

ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হলেও চেহারায় সেটা বুঝতে দিচ্ছি না। সায়াকার বাবার দেয়া সিংহের মাথা নকশার চাবিটা লকে প্রবেশ করালাম। এবারে সুন্দর মত ঢুকে গেল। ধীরে ধীরে মোচড় দিলাম একবার। কোনো শব্দ হলো না, তবে টের পেলাম ভেতরে কিছু একটা সরে গেছে।

চাবি ধরে টান দিলাম, কিন্তু খুলে এলো না। লকের ভেতরেই আটকে আছে। তবে দরজাটা ক্যাঁচক্যাঁচ করে খুলে গেল। ভেতরে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে বেইজমেন্টে। নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

চাবিটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে লক থেকে বের করে নিল সায়াকা। ওদিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “বাবার কাছে বেইজমেন্টে যাওয়ার চাবি কেন?”

“সেটাই জানার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ল ও।

“ঠিক আছে।”

“ভেতরে চলো তাহলে?”

“অনুমতি না নিয়েই?”

“অনুমতি নেয়ার মত কাউকে দেখছ?” কৌতুকের সুরে বললাম।

মাথা ঝাঁকিয়ে আমার কথা মেনে নিল ও।

“চলো।”

“দাঁড়াও।”

আমার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে রইলো কিছুক্ষণ। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো কিছুক্ষণের মধ্যে।

“সরি, আমার না ভয় লাগছে।”

“আমি একা গিয়ে দেখে আসব?”

“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলে সায়াকা। “আমিও যাব তোমার সাথে। সমস্যাটা তো আমার। আমিই জবাব খুঁজতে এসেছি এখানে।”

গাড়ি থেকে টর্চ নিয়ে এলাম। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পা রাখলাম সিঁড়িতে। ভেতরে বেশ ভালোই ঠাণ্ডা। ভ্যাপসা একটা গন্ধ এসে লাগলো নাকে। দীর্ঘদিন কোনো জায়গা বন্ধ থাকলে এরকম গন্ধ হয়। সেই সাথে ধুলো তো আছেই।

সিঁড়ির গোড়ায় অর্ধেকটা তাতামি ম্যাট পাতার মতন জায়গা2। একপাশে লোহার তৈরি দরজা। হাতলটা দেখতে ইংরজি ‘এল’ এর মতন। সামনের দিকে টর্চ ধরে হাতল ধরে চাপ দিলাম। ক্লিক করে শব্দ হলো একটা। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা।

ভেতরে ছোট একটা রুম। চারপাশে সিমেন্টের দেয়াল। সিলিং ভর্তি ঝুল। ছাতা পড়ে কালো হয়ে গেছে দেয়ালগুলো। কাঠের ভাঙা টুকরো আর ইট পড়ে আছে এখানে-সেখানে। হয়তো বাড়িটা তৈরির পর বেঁচে গেছিল এগুলো। দু’টো বিশ লিটারের কেরোসিনের ক্যানও চোখে পড়লো। হাত দিয়ে তুলে দেখলাম। একটা খালি, আরেকটায় এখনো কিছুটা রয়ে গেছে।

বাতি জ্বালানোর জন্যে সুইচ খুঁজতে গিয়ে টের পেলাম দেয়ালে কোনো সুইচবোর্ড নেই। সিলিং থেকে ঝুলছে না কোনো বাল্ব। সকেটেরও বালাই নেই।

“এই বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই সাথে করে টর্চ নিয়ে আসে,” বললাম।

বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে ঘাড় একদিকে কাত করলো সায়াকা।

বেইজমেন্টের ভেতরের দিকে অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রেমে বসানো একটা স্লাইডিং ডোর। সেটার পেছনে আরেকটা ছোট রুম। রুমের এক প্রান্ত থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। বাড়ির ভেতর থেকে বেইজমেন্টে আসার জন্যে এই সিঁড়িটা ব্যবহৃত হতো নিশ্চয়ই। লম্বা সময় কেউ ব্যবহার করেনি, এটা নিশ্চিত। প্রতিটা ধাপে অন্তত ইঞ্চিখানেক ধুলোর প্রলেপ।

“কেউ আছেন?”

আমার কথা প্রতিধ্বনিত হলো সিঁড়ির ওপরে খোলা জায়গাটায়। কিন্তু কোনো জবাব এলো না।

“এটাই ভেবেছিলাম। কেউ নেই এখানে। খালি। চলো উপরে গিয়ে দেখি কী অবস্থা।”

সিঁড়িতে মাঝ বরাবর কার্পেট পাতা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জুতো খুলেই পা দিতাম হয়তো। কিন্তু এখন গায়ে মাখলাম না ব্যাপারটা।

“জুতো পরেই উঠবো?” দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে সায়াকা।

“তুমি চাইলে খুলতে পারো। পরে মোজা কালো হয়ে গেলে আমার দোষ নেই।”

আরো কিছুক্ষণ দোটানায় ভোগার পর আমার মতন স্নিকার্স না খুলেই সিঁড়িতে পা দিল ও।

উপরে একটা ছোট করিডর। কিছুদূর এগিয়ে দুই ভাগ হয়ে গেছে ওটা। শেষের ঠিক আগে দুই পাশে দু’টো কাঠের দরজা। আর দেয়ালে অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের একটা জানালা। পর্দা টাঙ্গানো বিধায় বেশ অন্ধকার। সিঁড়িটা দোতলায় উঠে গেছে।

পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিলাম। রোদ ঢোকার জো নেই, তবে কিছুটা আলোকিত হলো ভেতরটা। দেয়ালে সবুজের উপর ফুলেল নকশার সুন্দর ওয়ালপেপারটা দেখতে পাচ্ছি আমরা। জানালার ঠিক উল্টো দিকের দেয়ালে ঝুলছে গোল বাধাই করা ফ্রেম। ভেতরে ফলমূলের ছবি।

বাম পাশের দরজার হাতল ধরে টান দিলাম আস্তে করে। মুখের ঠিক সামনে ঝুল থাকায় দেখতে পাচ্ছি না কিছু। একটু পিছিয়ে হাত দিয়ে ঝুলগুলো সরালাম। সরু একটা রুম, মাঝে সাদা প্যান। পশ্চিমা নকশার টয়লেটটা চিনতে অসুবিধে হলো না।

মুখে অস্বস্তির হাসি ফুটিয়ে সায়াকার দিকে তাকালাম। “প্রথম দরজা খুলেই টয়লেট।”

“প্রতি বাসাতেই টয়লেট আছে,” আগের তুলনায় শান্ত দেখাচ্ছে ওকে।

পাশেই একটা সিঙ্ক দেখতে পেয়ে কলটা ঘুরালাম। কিন্তু নল দিয়ে পানি বেরুলো না।

“টয়লেটগুলো কাজ করছে বলে মনে হয় না।”

কপালে ভাঁজ পড়লো সায়াকার।

টয়লেটের দরজা বন্ধ করে এবারে অন্য দরজাটার দিকে হাত বাড়ালাম। হাতলে মোচড় দিয়ে এক দিকে ঘোরাতেই মৃদু শব্দ করে খুলে গেল। শিরশিরে বাতাসের অস্তিত্ব টের পেলাম গালে। মনে হচ্ছে যেন দীর্ঘ দিন পর বাতাস ঢোকার সুযোগ পেল।

হলরুমে প্রবেশ করলাম আমরা। ডানদিকে বাড়ির প্রবেশপথ। উল্টো দিকে আরেকটা দরজা, যার উপরের অংশে নকশাদার কাঁচ চোখে পড়লো। বাম পাশের দেয়ালের সামনে চারকোনা একটা টেবিলে দুই হাতলওয়ালা একটা পাত্র রাখা। উল্টোদিকে আরো একটা দরজা চোখে পড়লো। সেটার সামনেও একই রকম একটা টেবিল আর পাত্র সাজিয়ে রেখেছে বাড়ির মালিক।

“ভেতরে আসার দরজাটা খুলে দাও। তাহলে যাওয়া-আসা সহজ হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা।”

কার্পেটটা ডিঙ্গিয়ে গেল সায়াকা, ধুলোয় ওটার এমন অবস্থা যে আসল নকশার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। যেখানে জুতো রাখতে হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে দরজার হাতলের দিকে হাত বাড়াল ও। প্রবেশপথের পাশের ও কেবিনেটটা খুলে ভেতরে উঁকি দিলাম এসময়। কেবল দুই জোড়া স্নিকার্স, এক জোড়া ছেলেদের কালো চামড়ার জুতা আর এক জোড়া মেয়েদের চামড়ার জুতো চোখে পড়লো। এত বড় একটা বাড়িতে মাত্র চার জোড়া জুতো দেখে একটু অদ্ভুতই লাগলো। আদৌ যদি এই বাড়িতে কেউ থাকে আর কি!

“একটু এদিকে আসবে-?” ডাক দিল সায়াকা।

“কোনো সমস্যা? চাবি কাজ করছে না?”

“না, লক তো খুলছে,” বলে চাবিতে মোচড় দিল ও, ক্লিক শব্দটা শুনতে পেলাম আমিও। “কিন্তু দরজা খুলছে না।”

“হ্যাঁ? তাই নাকি?” বলে দরজার চারপাশে টর্চের আলো দিয়ে দেখতেই মুখ থেকে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এলো আমার। “আরে, এটা কী!” দরজার চার কোনায় পুরু কাঠের টুকরা আর স্ক্রু দিয়ে আটকানো। খুলবে কী করে?”

“দরজা এভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে কেন?”

“বুঝতে পারছি না,” বলে কোমরে হাত দিয়ে কাঠের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একদম শক্ত করে আটকানো হয়েছে, খোলা সহজ হবে না। “কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। এই বাড়িতে ঢোকার একমাত্র মাধ্যম ওই বেইজমেন্টের দরজা, যেটা দিয়ে আমরা ঢুকেছি। সিংহের মাথার নকশার চাবিটা সেজন্যেই দেয়া হয়েছিল।

“এত ঝামেলার দরকার কী ছিল?”

“হয়তো অযাচিত কেউ যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এভাবে তো সাধারণ কোনো পরিবার থাকতে পারে না কোথাও।”

বুকে হাত ভাঁজ করে কিছুক্ষণ ভাবলাম, কিন্তু কোনো যুক্তি মাথায় এলো না। এরকম বিহ্বল অবস্থাতেই জুতো রাখার কেবিনেটটার উপরে ঝোলানো ছবিটার দিকে চোখ চলে গেল আপনাআপনি। সেখানে একটা ঘাটে কয়েকটা ইয়ট বাঁধা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এসময় হঠাৎই কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে লাগল মনে, কিন্তু কারণটা বুঝতে পারছি না।

“অন্য রুমগুলো দেখবে না?” সায়াকার কথায় চিন্তার বাঁধন ছিড়ে গেল। “হ্যাঁ, চলো দেখি।”

জুতো না খুলেই আবারো আগের হলরুমে ফিরে এলাম আমরা। কাঁচের দরজাটায় মৃদু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

এটাই খুব সম্ভবত লিভিং রুম। সিলিং বেশ উঁচু কারণ ঘরটা দোতলার সাথে যুক্ত। মাঝখানে একটা কফি টেবিল আর সোফা। একপাশে বড় একটা পিয়ানো দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে আর ডানদিকে কোনায় ফায়ারপ্লেস। এই ফায়ারপ্লেসের চিমনিই খুব সম্ভবত একদম ছাদ অবধি পৌঁছে গেছে।

দরজার পাশের দেয়ালে তিনটা সুইচ। কিন্তু ওগুলো চাপাচাপি করেও কোনো লাভ হলো না। এমন যদি হয় দীর্ঘদিন ব্যবহার হবে না দেখে সার্কিট ব্রেকার খুলে রাখা হয়েছে, তাহলে সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু পানির লাইনের মতন এখানে যদি বিদ্যুৎ-এর সংযোগও না থাকে, সেক্ষেত্রে ঝামেলা হয়ে যাবে।

মেঝেতে টর্চের আলো ফেলে সামনে এগোলাম। গোটা জায়গাটা জুড়ে পশমি কার্পেটে পাতা। ঠাণ্ডার সময় ভালোই কাজে দেয় নিশ্চয়ই। বারবার মনে হচ্ছে কেউ বুঝি ঘাপটি মেরে আছে ছায়াতে।

“একটু বেশিই অন্ধকার, ভয় করছে আমার,” আমার হাত ধরে বলে সায়াকা।

“তাহলে জানালা খুলে দেই।”

বড় স্লাইডিং প্যানেলের জানালা দু’টো আগেই খেয়াল করেছি আমি জানালার ধরন দেখে ধারণা করলাম এই দিকটা দক্ষিণ। খুলে দিয়ে পর্দাগুলো সরালাম। ভেবেছিলাম আলোয় ভরে উঠবে গোটা ঘর। কিন্তু খুব একটা উজ্জ্বল হলো না ভেতরটা। আকাশে কখন যে এত মেঘ জমেছে, টের পাইনি। এসময় মনে পড়লো আসার আগে সায়াকা বলেছিল, রাতে বৃষ্টি হতে পারে।

তবে এখন আর টর্চ জ্বালিয়ে রাখার দরকার পড়ছে না। আবারো রুমটা দেখলাম একবার। টেবিল থেকে শুরু করে পিয়ানো, সবকিছুতে ধুলো। পিয়ানোর উপরে একটা ফ্রেঞ্চ ডল রাখা। পরনে লাল জামা-কাপড় ওটার। চুলগুলো লম্বা। বড় বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুতুলটার চুল আর ছোট্ট কাঁধজোড়াও ধুলোয় ঢাকা। সাদাটে দেখাছে ওগুলো।

আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে কেবল দু’জোড়া পায়ের ছাপ চোখে পড়লো গোটা ঘর জুড়ে। অর্থাৎ, লম্বা একটা সময় ধরে এখানে আমরা বাদে আর কেউ আসেনি।

দরজার উপরে একটা ঘড়ি, যেখানে সময় দেখাচ্ছে এগারোটা দশ। ব্যাটারির আয়ু নিশ্চয়ই অনেক আগেই ফুরিয়েছে ওটার। আমার ঘড়ি অনুযায়ী এখন সময় একটা পাঁচ।

পিয়ানোটার দিকে এগিয়ে গেল সায়াকা। উপরে স্ট্যান্ডে রাখা স্বরলিপির কাগজটা দেখলো কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে। ওখানেও প্রচুর ধুলো।

“বেয়ারের প্র্যাকটিস শিট।”

আমার এটুকু জানা আছে যে নতুন যারা পিয়ানো শেখে, তারা বেয়ারের স্বরলিপি অনুসরণ করে।

“অর্থাৎ, এখানে যে পরিবার থাকতো, তাদের কেউ পিয়ানো শিখছে। নাকি ‘শিখত’ বলবো?”

গম্ভীর মুখে পাতাগুলো উল্টে চলেছে সায়াকা। যে পাতাটা খোলা, সেটা বাদে বাকি পাতাগুলো একদম নতুনের মতন সাদা। তবে কোনার দিকগুলো হলদে হয়ে গেছে।

“কী অদ্ভুত একটা বাড়ি!” বলি আমি। “লম্বা একটা সময় ধরে কেউ আসেনি এখানে, কিন্তু কারো ছুটি কাটানোর ঠিকানা বলেও মনে হচ্ছে না এখন।”

সায়াকা কিছু বললো না, এখনো স্বরলিপির দিকে তাকিয়ে আছে ও। “কোনো সমস্যা?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

জবাব দিল না সায়াকা। চুপ থেকেই কপালে হাত রাখল, যেন মাথাব্যথা করছে।

আর কথা বাড়ালাম না। ওকে এভাবে দেখে চিন্তা হচ্ছে। এখানে আসাটা কি আসলেও উচিত হয়েছে আমাদের?

একটু পরে স্বরলিপিটা নামিয়ে রাখল ও। দেখে মনে হচ্ছে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

“সায়াকা-”

“সরি,” অন্য দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলে ও। “ভেবেছিলাম কিছু একটা মনে পড়বে বুঝি। ভুল ভেবেছি আসলে। তোমাকে ভয় পাইয়ে দিলাম বোধহয়।”

“ব্যাপার না। এখনো অনেক সময় আছে আমাদের হাতে।”

“তা আছে। কিন্তু তোমার কি মনে হয়, এই পোড়োবাড়িতে আদৌ কোনো সূত্র আছে? থাকলেও কি খুঁজে পাব আমরা? তোমাকে এত দূর টেনে এনেছি, জানি এসব বলা উচিত হচ্ছে না, কিন্তু…”

“আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। জানতাম সহজ হবে না কাজটা,” বলে ওর মাথার দিকে ইঙ্গিত করলাম। “আমরা যে তালা খোলার চেষ্টা করছি, সেটা তো প্রায় বিশ বছর ধরে বন্ধ।”

কপালে হাত রেখে মৃদু হাসলো সায়াকা। “আশা করি মরচে ধরে যায়নি।”

আনমনা দৃষ্টিতে তাকালাম পিয়ানোর দিকে। কিন্তু পুতুলটার সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্র চমকে উঠলাম ভেতর থেকে।

দরজা খুলে পাশের ঘরটায় প্রবেশ করলাম আমরা। সামনে এক মিটার দৈর্ঘ্যের ছোট একটা করিডোর পার হয়েই ডাইনিং রুম। করিডোরের অপর প্রান্তে গোল একটা টেবিল। চারজন বসে অনায়াসে খেতে পারবে ওটায়। টেবিলের মাঝে একটা ছোট্ট টব। সবুজ গাছটা যে কৃত্রিম তা বলে দিতে হবে না।

দেয়াল ঘেঁষে ইংরেজি এল আকৃতির একটা কিচেন কাউন্টার। সিঙ্কে দু’টো কাপ আর দু’টো পিরিচ চোখে পড়লো। দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছে, সময় হুট করেই স্থির হয়ে গেছে বুঝি।

সিঙ্কের পাশে একটা পুরোনো আমলের দুই দরজার রেফ্রিজারেটর, এরপর একটা কাবার্ড। ভেতরের তাকে বেশ কয়েকটা ছোট বড় প্লেট, গ্লাস, কাপ আর বাটি সাজিয়ে রাখা। ড্রয়ারগুলোও খুলে ভেতরে উকি দিলাম আমি। ছুরি এবং কাটাচামচ পাশাপাশি সাজানো। মৃদু আলোয় চকচক করে উঠলো ওগুলো।

টেবিল থেকে একটু দূরে একটা ম্যাগাজিন র‍্যাকে বেশ কয়েকটা ম্যাগাজিন রাখা। ওপর থেকে একটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টালাম। ভেতরে নানারকম মডেলের রেল ইঞ্জিনের ছবি। বেশিরভাগই বাষ্পচালিত ইঞ্জিন। তারিখ দেখে নিশ্চিত হলাম, বিশ বছরের পুরোনো পত্রিকাটা।

“এত পুরোনো পত্রিকা এখানে কী করছে!” বললাম। বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে একদিকে মাথা কাত করলো সায়াকা।

একদম শেষ পাতায় উল্টে ছোট করে পেন্সিল দিয়ে লেখা ৫০০ ইয়েন। এবারে আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।

“নিশ্চয়ই পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা। রেল ইঞ্জিন নিয়ে আগ্রহী কেউ থাকে নিশ্চয়ই এখানে,” বলে পত্রিকাটা রেখে দিলাম র‍্যাকে। “তবুও কেমন যেন অদ্ভুত।”

“কী?”

“ডাইনিং রুমে এরকম পত্রিকা থাকবে কেন?”

জবাবে বলার মতন কিছু খুঁজে পেলাম না প্রথমে। “ইচ্ছে হয়েছে, রেখেছে,” একটু পর বললাম।

সায়াকা কথা বাড়ালো না।

রান্নাঘরের উল্টোদিকে একটা স্লাইডিং দরজা। ভেতরে ছয় তাতামি ম্যাটের জাপানিজ নকশার একটা ঘর। একপাশের দেয়ালে একটা কুলুঙ্গি। দেয়ালে ঝোলানো স্কুলটায় ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং। তবে সেটা মূল্যবান কিছু কিনা, তা বলতে পারব না। ঘরের মাঝে একটা ছোট কফি টেবিল।

তাতামি ম্যাটের ওপরে জুতো পায়ে হাঁটার অভ্যাস নেই বিধায় ওগুলো স্লাইডিং দরজার সামনে খুলে রাখলাম। ম্যাটগুলো বেশ ঠাণ্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে। তবে ছাতা পড়েনি।

প্রথমেই জানালাগুলো খুলে দিলাম আমরা। এখন আর একতলায় টর্চ জ্বালানোর দরকার নেই।

নিচু টেবিলটায় টেবিলক্লথের উপরে একটা সিগারেটের কেস আর ধাতব অ্যাশট্রে রাখা। কেসটা খুলে দেখলাম ভেতরে এখনো দশটা সিগারেট রয়ে গেছে। ব্র্যান্ডের নাম মাইন।

“মাইন সিগারেট এখনো পাওয়া যায় নাকি?”

একটা বের করে নাকের কাছে নিয়ে শুকলাম। তামাকের কোনো গন্ধই আর অবশিষ্ট নেই।

“এদিকে এসো একটু,” সায়াকা রান্নাঘর থেকে বললো এসময়।

“কী হয়েছে?”

রুমটা থেকে বেরিয়ে আবারো জুতো পরে নিলাম।

“এটা দেখো,” বলে লিভিংরুমে যাওয়ার দরজাটার উপরে একটা সাধারণ দর্শন আটকোনা ঘড়ির দিকে ইঙ্গিত করলো ও। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লো না আমার।

“ঘড়িটায় কোনো সমস্যা?”

“একটু অদ্ভুত না ব্যাপারটা?” বললো সায়াকা। “লিভিং রুমের ঘড়িটার মতন এটাতেও সময় দেখাচ্ছে এগারোটা দশ।”

দরজা খুলে লিভিং রুমে উঁকি দিয়ে ওখানকার ঘড়িটা দেখলাম আরেকবার। সায়াকা ঠিকই বলেছে।

“এমনটা আগে দেখেছ কখনো? দু’টো ঘড়ি একদম ঠিক একই সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব।”

“একদম অসম্ভব না। তবে মিনিটের কাটাগুলোর অবস্থানও যেহেতু মিলে গেছে, তাই এর সম্ভাবনা সাতশ বিশবারে একবার।” বারোকে ষাট দিয়ে গুণ করে বললাম কথটা। “তবে কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে কাজটা করেছে ধরে নেয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত।”

“এই সময়ের কি কোনো বিশেষত্ব আছে?”

“সেটাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে যদি আসলেই কেউ থেকে থাকে, তাহলে দু’টো ঘড়িরই স্বাভাবিক সময় দেখানোর কথা।”

দু’টো ঘড়িই ব্যাটারি চালিত। এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় আগের বাসিন্দাদের কেউ নিশ্চয়ই ব্যাটারি খুলে নিয়ে গেছে। এরপর পেছনের নব ঘুরিয়ে ঘড়ির সময় এগারোটা দশ করেছে খুব সম্ভবত…

কিন্তু বিষয়টা নিয়ে ভাবলে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। কেন, সেটা বলতে পারব না। কিছু একটা বুঝতে পারছি না, এজন্যেই বোধহয় এই অস্থিরতা। “বাদ দাও। দোতলায় যাই চলো,” সায়াকাকে বললাম। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিল ও।

লিভিং রুম থেকে করিডোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে সিঁড়ির কাছে ফিরে এলাম। এবারে সিঁড়ির পাশে পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন বক্সটা চোখে পড়লো। বিদ্যুৎ ফিরে পাব, এই আশায় সার্কিট ব্রেকারের হাতলটা উঠিয়ে দিলাম উপরে, কিন্তু কিছুই ঘটলো না। বিদ্যুতের চিহ্নমাত্র নেই।

“ধুর,” লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলি। “ইচ্ছে করেই এভাবে ফেলে রেখে গেছে বাড়িটা।”

“ফিরে আসার আর কোনো ইচ্ছে নেই হয়তো।”

“আমারও সেটাই ধারণা। কোনো পানির সরবরাহও নেই।”

টর্চ জ্বালিয়ে উপরতলায় উঠে গেলাম। বামদিকে একটা দরজা আর ডানে সরু একটা করিডোর। সমুদ্রের তলদেশের মতন নিস্তব্ধ চারপাশ।

বাম দিকের দরজাটা খুললাম প্রথমে। ভেবেছিলাম ভেতরে হয়তো ঘুটঘুটে অন্ধকার হবে। কিন্তু কোত্থেকে যেন আলো আসছে। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম উৎস। ঠিক উল্টোদিকেই একটা জানালা। লিভিং রুমটা দেখা যায় এখান থেকে। জানালার ঠিক নিচেই গোল দেয়াল ঘড়িটা।

প্রায় পাঁচটা তাতামি ম্যাট সমান চওড়া ভেতরটা। জানালার সামনে বিছানা আর বইয়ের তাকের মাঝে একটা পড়ার টেবিল। বিছানায় নীল সবুজ চেকের চাদর পাতা। শ্বাস টানতেই দীর্ঘদিনের বদ্ধ বাতাস ঢুকে গেল ফুসফুসে। কেমন ছাতা পড়া গন্ধ।

“দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চার রুম,” বিছানার দৈর্ঘ্য দেখে আন্দাজ করলাম।

“হ্যাঁ, ছেলে বাচ্চা,” সায়াকা বলে।

“ছেলে? এটা কেন মনে হলো?”

“দেখ,” টেবিলের পাশে ঝোলানো একটা ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করলো ও। “কালো ব্যাগ ছেলেরাই ব্যবহার করে সাধারণত।”

“তা ঠিক,” মাথা নেড়ে সায় দিলাম আমি। “আর যেহেতু স্কুলব্যাগ আছে, সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি বাসাটা শুধু ছুটি কাটানোর কাজে ব্যবহৃত হতো না। লোকে থাকত।”

“এরপর হঠাৎ অন্য কোথাও চলে গেছে?”

“আপাতত তো সেরকমই মনে হচ্ছে।”

রুমটায় যে একটা ছেলে বাচ্চা থাকতো, তার অনেক আলামত পেলাম আমরা। বিছানার নিচে বেজবল গ্লোভস, টেবিলে নরম প্লাস্টিকের ডায়নোসর। গ্লোভসটায় ধুলোর আস্তর, খুব বেশি ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

বইয়ের তাকটায় রেল ইঞ্জিন নিয়ে অনেকগুলো পত্রিকা রাখা। নিচতলায় আমরা যে পত্রিকাটা দেখেছি, সেটা এখান থেকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিশ্চয়ই। এসব পত্রিকা বাদেও অনেকগুলো এনসাইক্লোপিডিয়াও চোখে পড়লো। গুণে দেখলাম আমি, মোট চব্বিশ খণ্ড। এছাড়াও বিশটার মতন বাচ্চাদের গল্পের বই। সবগুলোই ক্লাসিক, হার্ডকভার। বাকিগুলো প্রাইমারি স্কুলের ষষ্ঠ বর্ষের পাঠ্যবই, ছবির বই আর ফটো অ্যালবাম। একটাও মাঙ্গা চোখে পড়লো না।

“ছেলেটা নিশ্চয়ই সিক্সথ গ্রেডে পড়তো। তাকের বইগুলো দেখে মনে হচ্ছে ছাত্রও ভালো ছিল।”

“হ্যাঁ, ভালো ছাত্রই হবে,” টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বলে সায়াকা।

একটা খোলা বই আর খাতা দেখা যাচ্ছে সেখানে। খাতার উপরে চোখা পেন্সিল আর রাবার। পাশেই প্লাস্টিকের পেন্সিল বক্স।

“পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিল।”

“আর সেই ব্যস্ততার মধ্যেই হঠাৎ করে চলে যেতে হয়েছে। আর কখনো ফিরে আসেনি?”

“জানি না। সেটাই তো মনে হচ্ছে।’

নিচের এঁটো কফির কাপগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সময় যেন হঠাৎ‍ থমকে গেছে বাসাটার ভেতরে।

“কেমন অদ্ভুত না ব্যাপারটা?” সায়াকাকে দেখে মনে হচ্ছে একটু ভয় পাচ্ছে বেচারা। “বাড়ি ছেড়ে যায় অনেকেই, কিন্তু এভাবে হুট করে কাজের মাঝখানে…”

“হয়তো এমন কিছু ঘটেছে যে জন্যে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। সাথে করে কিছু নিতেও পারেনি। “

“তাড়াহুড়ো করে বের হলেও কি স্কুলের ব্যাগ আর বইপত্র সাথে নেয়া যায় না? আবার ধরো মাঝে মাঝে নানা কারণে বাচ্চাদের কিছুদিন স্কুল কামাই দিতে হয়। সেক্ষেত্রে কিন্তু বাবা-মায়েরা সবকিছু ঠিকই সাথে নেয়, যেন পড়াশোনায় কোনো ক্ষতি না হয়। অনেক সময় ব্যাংক বা লোন ক্রেডিট কোম্পানিগুলোকে পাওনা টাকা দেয়ার সময় হলে পালিয়ে যায় অনেকে। আমার এক বন্ধু চাকরি করে একটা ক্রেডিট কোম্পানিতে। ওর কাছ থেকে শুনেছি।”

“হ্যাঁ, এটাও কিন্তু হতে পারে।”

চেয়ারটা সরিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুললাম। ভেতরে পড়াশোনার নানান জিনিসপত্র। কম্পাস, চাদা, ত্রিভুজ। অন্য দু’টো ড্রয়ারে নতুন খাতা আর রঙ করার সরঞ্জাম।

টেবিলে খুলে রাখা পাঠ্যবইটা দেখতে লাগল সায়াকা। গণিত বই প্রচ্ছদের নানারকম জ্যামিতিক নকশা।

“আরে!” প্রচ্ছদের পেছন ভাগটা দেখে আচমকা বলে উঠলো সায়াকা। প্রকাশের তারিখ লেখা আছে ওখানটায়। আমাকে দেখাল ও।

কেন অবাক হয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হলো না। বইটা তেইশ বছরের পুরোনো।

চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। জানালার ফ্রেমটা প্রতিফলিত হচ্ছে ওর চোখে।

“অসম্ভব,” বলি আমি। “এই বাড়িটা যদি আসলেও তেইশ বছরের পরিত্যক্ত হয়ে থাকে, তাহলে আরো খারাপ হবার কথা অবস্থা। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে খুব হলে দুই কি তিন বছর ধরে খালি পড়ে আছে।”

“কিন্তু এই ঘরে যে থাকতো সে তেইশ বছর আগে চলে গেছে এখান থেকে।”

“শুধু একটা বইয়ের প্রকাশকাল দেখে সেটা নিশ্চিত হয়ে বলা সম্ভব নয়।”

বইটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উল্টেপাল্টে দেখে খাতার দিকে হাত বাড়ালাম। পেন্সিলটা সরিয়ে রাখলাম এক পাশে। ওটা যেখানে ছিল সেখানে কোনো ধুলো নেই।

খোলা পাতাটায় পেন্সিলে লেখা ‘ওখানে যদি শুধু হরিণ থাকে, তাহলে পায়ের সংখ্যা হবে ২৬*৪=১০৪। কিন্তু জুতোর সংখ্যা যেহেতু ৮৪ টা, তাহলে বাড়তি জুতো ১০৪-৮৪=২০ টা। তাহলে বানরের সংখ্যা ২০:২=১০ টা।” সেই নামকরা বক আর কচ্ছপের সমস্যা। কিন্তু এখানে মুরগি আর খরগোশের জায়গায় বানর আর হরিণ ব্যবহার করা হয়েছে।

আগের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে বুঝলাম সবগুলো সমস্যারই ঠিক ঠিক সমাধান করা হয়েছে। হাতের লেখা খুব সুন্দর না হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

কোনো বানান ভুলও নেই। এই রুমে যে বাচ্চাটা থাকতো, আসলেও লক্ষ্মী ছিল সে।

সব শেষে খাতার কভারের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।

গণিত, ষষ্ঠ গ্রেড, শাখা ১. ইউসুকে মিকুরিয়া।

সায়াকার দিকে তাকিয়ে দেখি সে-ও নামটাই দেখছে মনোযোগ দিয়ে।

“এই নামটা মনে আছে তোমার?” জিজ্ঞেস করি।

“মিকুরিয়া ইউসুকে,” বানান করে পড়ে ও। এরপর চোখ মুদে কিছুক্ষণের জন্যে, যেন মনে করার চেষ্টা করছে।

“শুনেছ নাকি নাম-”

“একটু চুপ করবে? সরি, এভাবে বলছি,” বলে সায়াকা। মুখ বন্ধ করে ফেললাম আমি

দুই কি তিন মিনিট পর লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায় ও।

“নাহ, এখনও মনে পড়ছে না।”

“পরিচিত মনে হচ্ছে কি?”

“হ্যাঁ। কিন্তু ভুলও হতে পারে। অন্য নামের সাথে গুলিয়ে ফেলছি বোধহয়,” ভ্রু কুঁচকে দুই হাতে কপাল চেপে ধরলো সায়াকা।

“তোমার বাবাকে কখনো নামটা বলতে শুনেছ?”

“হ্যাঁ, হয়তো। কিন্তু… পরিষ্কার মনে পড়ছে না,” অস্থির ভঙ্গিতে চুলে একবার হাত বুলায় ও।

“বাদ দাও,” ওর কাঁধে হাত রাখলাম। “অন্তত এখন আমরা এটা জানি, মিকুরিয়া পরিবার বসবাস করতো এখানে। অন্য ঘরগুলো দেখি চলো।”

“আচ্ছা।”

খাতা আর বইটা ওখানেই রেখে বেরিয়ে এলাম আমরা।

করিডোর ধরে সামনে এগোলে শেষ মাথায় একটা দরজা। সেখানেও একই রকম ভ্যাপসা গন্ধ। জানালা বন্ধ থাকলেও পুরোপুরি অন্ধকার নয় ভেতরে। কারণ একতলার জানালাগুলোর মতন এই তলায় জানালার বাইরেও কোনো শাটার নেই। শুধু পাতলা পর্দা চোখে পড়লো। টর্চের আলোয় চোখ বুলাতে লাগলাম রুমটার ভেতরে। প্রথমেই নজরে এলো দেয়ালে ঝোলানো একটা স্যুট। আবছা আলোয় মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমার পাশে সায়াকারও একই অবস্থা।

একটা রকিং চেয়ার আছে ঘরটায়। দেয়ালের সামনে দু’টো বিছানা পাশাপাশি রাখা। জানালার কাছেই একটা ধুলোমাখা টেলিস্কোপ। দেয়ালের দাগগুলো দেখে অস্বস্তি হচ্ছে। সময়ের সাথে যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে ভেতরের সবকিছু, এমনটাই মনে হলো আমার। যে বাসায় বাচ্চা একটা ছেলে থাকে, তার বাবা-মা থাকে, সেখানটা এরকম নিষ্প্রাণ হবার কথা না।

“দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটার বাবা-মা’র ঘর,” সায়াকা বললো পেছন থেকে।

“তাহলে তিনজনের একটা পরিবার।” ভেতরে ঢুকে পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিলাম। ধুলো উড়িয়ে আর্দ্র বাতাস ঢুকে পড়লো ভেতরে।

রকিং চেয়ারটার কাছে এসে ওটার উপর থেকে কিছু একটা উঠালো সায়াকা। দেখে মনে হচ্ছে পুরোনো ন্যাকড়া, কিন্তু আদতে তা নয়। একটা সুতো বেরিয়ে আছে ওটা থেকে। মেঝেতে পড়ে থাকা উলের বলের মধ্যে গিয়ে মিলেছে সুতোটা। ধূসর-নীল দেখাচ্ছে এখন, কিন্তু আসল রঙ বোধহয় নীলই ছিল।

“কেউ কি স্কার্ফ বুনছিল নাকি?”

“না, আমার মনে হচ্ছে এটা একটা সোয়েটার,” সায়াকা আমাকে দেখিয়ে বলে। “এই জায়গাটা গোল, দেখো। নেক লাইনের মতন।”

“অনেক ছোট।”

“বাচ্চাদের জন্যে, বোঝাই যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলার ছেলের জন্যে বানাচ্ছিল।”

“ইউসুকে?”

“তাই হবে হয়তো,” সাবধানে জিনিসটা আবারো চেয়ারের উপর নামিয়ে রাখলো সায়াকা। “এটা বোনার মাঝেই কি চলে যেতে হয়েছিল ইউসুকের মা’কে?”

“হয়তো।”

সায়াকার হাতের ছোঁয়ায় দুলতে লাগল চেয়ারটা। এই বাড়িটায় ঢোকার পর থেকে এই প্রথম কিছু দুলতে দেখলাম।

আবারও নজর বুলালাম চারপাশে। একটা বুকশেলফ আছে ভেতরে, কিন্তু খুব বেশি বই নেই ওটায়। ছেলের তুলনায় বাবা-মা’র পড়ার অভ্যাস তেমন ছিল না বোধহয়, ভাবি আমি। সামনে এগিয়ে বইয়ের নামগুলো দেখে অবাকই হলাম কিছুটা। জাপানের সংবিধানের বইয়ের পাশাপাশি আইনের বইও আছে বেশ কয়েকটা। বাড়ির কর্তা তাহলে আইনজীবি? সেক্ষেত্রে বইয়ের সংখ্যা বেশি কম হয়ে গেল।

“কেমন যেন সবকিছু,” বলি আমি। “কিছু চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছে এখানে মানুষ থাকতো এক সময়। কিন্তু জরুরি কী যেন একটা নেই; বলে বোঝাতে পারছি না বোধহয়। কোনো একটা ঘাপলা আছে।”

“আমারও এরকমই মনে হচ্ছে,” বলে সামনে দেয়াল ঘেঁষে রাখা ছোট টেবিলটার দিকে গেল সায়াকা। দু’টো বুকেন্ডের মাঝে ঠেস দিয়ে পেশাগত কিছু বই রাখা। সেগুলোতে হাত না দিয়ে প্রথম ড্রয়ার খুলে ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে আনলো সায়াকা।

“কী ওটা?”

“চশমা।” একটা রুপালি ফ্রেমের চশমা আমাকে দেখালো ও। কাঁচগুলো দেখে ভ্রু কুঁচকে গেছে ওর।

“দেখে মনে হচ্ছে রিডিং গ্লাস।”

“হ্যাঁ?”

সামনে এগিয়ে চশমাটা হাতে নিলাম। আসলেও একদিকে বাঁকানো কাঁচগুলো। কনভেক্স লেন্স বলে একে। সাধারণত বয়স্ক মানুষেরা ব্যবহার করে এই ধরনের চশমা। অবশ্য এমনটাও খুবই সম্ভব যে ইউসুকের বাবা বা মা’র কারো হয়তো চোখে সমস্যা ছিল। কিংবা ইউসুকে হয়তো কোনো বয়স্ক দম্পতির একমাত্র সন্তান, একটু দেরি করে বাচ্চা নিয়েছে যারা।

“কোনো তথ্য জানা যাবে, এমন কিছু নেই?” ড্রয়ারটা দেখিয়ে বললাম।

“এটা আছে…” ভেতর থেকে গোল একটা জিনিস বের করে আনলো সায়াকা। একপাশ থেকে চেইন ঝুলছে।

দেখামাত্র চিনতে পারলাম আমি।

“আরে, এটা তো একটা পকেট ওয়াচ। এখন আর দেখাই যায় না এই জিনিস।”

“একটা ঢাকনা আছে উপরে। কীভাবে খোলে… ওহ এভাবে।” পাশের ধাতব বোতমটায় চাপ দিতেই ক্লিক শব্দ করে খুলে গেল ঢাকনাটা। হালকা ধুলো উড়তে লাগলো চারপাশে। একদিকে মুখ সরিয়ে নিল সায়াকা। কিন্তু ঘড়ির ডায়ালটার দিকে তাকাতেই জমে গেল। চোখের পলকও পড়ছে না।

“কী হলো?” জিজ্ঞেস করি।

জবাবে ধীরে ধীরে ঘড়ির ডায়ালটা আমার দিকে ঘোরায় ও। সাদা ডায়ালে সংখ্যাগুলো রোমান হরফে লেখা। ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের কাটা তিনটা থেমে আছে।

বন্ধ অবস্থায় ঘড়িটায় সময় দেখাচ্ছে এগারোটা দশ।

ক্যাফেটার বাইরে বড় একটা পাইন গাছ। নাহলে মাতসুবারা হ্রদের সুন্দর একটা দৃশ্য দেখা যেত ভেতর থেকে। গাছের ফাঁক দিয়ে একটু পর পর রাজহাঁসের আদলে তৈরি প্যাডেল নৌকা ভেসে যেতে দেখছি। সপ্তাহান্ত তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা কমই বলা যায়। তবে সেটা অফ সিজনের কারণে নাকি আজকের খারাপ আবহাওয়ার কারণে, তা বলতে পারব না। অথবা এমনটাও হতে পারে, এটাই এখানকার স্বাভাবিক চিত্র। কাউন্টারের পেছনে যে ভদ্রমহিলা বসে আছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে না খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ভেতরে দশজন বসা যায়। এই মুহূর্তে আমরা বাদে অল্পবয়সি এক জুটি আর ছোট একটা পরিবার আছে কেবল।

দুপুরের খাবারের সময় হয়ে যাওয়ায় রেস্তোরাঁর খোঁজে বাড়িটা থেকে বের হই আমরা। একটা সময় নিজেদের এই হ্রদের পাড়ে আবিষ্কার করি।

“যা বলছিলাম…” তোনকাতসু কারি রাইস শেষ করে কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে বললাম। “বাড়িটার ব্যাপারে এখন অবধি কী কী জেনেছি আমরা?”

“ইউসুকে মিকুরিয়া আর তার পরিবার থাকতো ওখানে। এরপর একদিন হুট করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় পুরো পরিবার। আপাতত এটুকুই জেনেছি আমরা,” ওর সামনের শ্রিম্প রিজোটোর তিনভাগের এক ভাগও খাওয়া হয়নি। দুধ চা’টা তাও আধকাপ খেয়েছে।

“না, আরো কিছু তথ্য আছে আমাদের কাছে। এক, তোমার বাবার কাছে বাড়িটার বেইজমেন্টে ঢোকার চাবি ছিল। দুই, এই পরিবারের কাছে এগারোটা দশ মিনিটের কোনো গুরুত্ব আছে।”

“আর ইউসুকের মা ভালো উল বুনতেন। ওর বাবার কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধা হতো আর পেশায় খুব সম্ভবত আইনজীবি ছিলেন।”

“ঠিক বলেছ,” মাথা নেড়ে বলি আমি। “আবার এমনটাও হতে পারে যে ওর বাবা সেলাই করতেন আর মা আইনজীবি ছিলেন।”

লম্বা শ্বাস ছেড়ে কাঁধ ঝাঁকায় সায়াকা। “কেমন যেন জট পাকানো সব। এই বাসায় বাবা নিশ্চয়ই আসত প্রায় প্রায়ই। কিন্তু কী করতো এসে?”

“আর বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে না যে কেবল ছুটি কাটানোর জন্যে আসত কেউ।”

ক্যাফের মাঝবয়সি মালিক নিজেই এলো আমাদের এঁটো প্লেট নিয়ে যাওয়ার জন্যে। সেই সুযোগে গ্লাসে পানিও ঢেলে দিল সে। তার পরনে একটা জিন্স আর পোলো শার্ট। কিন্তু চোখের ত্রিভুজাকৃতির চশমাটা দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস সে। “আপনি কি এদিকেই কোথাও থাকেন?

“হঠাৎই জিজ্ঞেস করলাম।

“আমি? হ্যাঁ,” কাউন্টার টেবিলটা মুছতে মুছতে বললো সে।

তাকে বাড়িটার ব্যাপারে বলে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু জানে কিনা। কিন্তু তার হাবভাব দেখে মনে হলো এরকম একটা বাড়ি যে আছে, সেটাই জানে না।

“ওটা কি হাউজিং এস্টেটটার ওখানে?” জিজ্ঞেস করলো সে।

“না, তার চেয়ে একটু সামনে। বাম দিকের যে চিকন রাস্তাটা চলে গেছে, সেটার শেষ মাথায়।”

মাথা নিচু করে আবার কাউন্টারের পেছনে চলে গেল সে। রান্নাঘরের দরজা খুলে আমার প্রশ্নটারই পুনরাবৃত্তি করলো ভেতরের কারো উদ্দেশ্যে।

একটু পরেই ছোট করে ছাটা চুলের একজন লোক বেরিয়ে এলো। কাপড়ের ওপর একটা অ্যাপ্রন চাপিয়েছে সে। নিশ্চয়ই এই ক্যাফের বাবুর্চি।

“সাদা বাড়িটার কথা বলছেন? একদিকে চিমনি যে?” আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।

“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বলি। “কিছু জানেন বাড়িটার ব্যাপারে?”

“তেমন কিছু না। শুধু এটুকু জানি যে ওদিকে ওরকম একটা বাড়ি আছে।”

“ওটার মালিক কে, তা জানেন?”

“না, এই বিষয়ে কোনো ধারণা নেই,” মাথা ঝাঁকায় সে। “বন্ধুদের সাথে আলাপের সময় মাঝে মাঝে বাড়িটা নিয়ে কথা ওঠে। ওরকম একটা বাড়িতে কেমন পরিবার থাকতে পারে, এসব আলোচনা আর কি। লম্বা সময় ধরেই বাড়িটা দেখছি আমরা, কিন্তু কাউকে থাকতে দেখিনি। নানারকম গুজবও শুনেছি। কেউ কেউ বলে ওখানে একটা পরিবার থাকতো, এরপর কোনো এক অসুখে সবাই একসাথে মারা যায়। অন্যেরা বলে কোনো বড়লোক ট্যাক্স থেকে বাঁচার জন্যে বাড়িটা বানিয়ে ফেলে রেখেছে। কিন্তু এসব গুজব একটাও সত্য নয়।”

“কতদিন আগে বানানো হয়েছে বাড়িটা?”

“কত দিন আগে…” বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রাখে সে। “অন্তত গত দশ বছরে যে বানানো হয়নি, এই বিষয়ে নিশ্চিত আমি। আরো আগে হবে। তবে বিশ বছরের বেশি পুরোনো বলে মনে হয় না।”

“তাহলে আপনি বলছেন ওখানে কখনো কাউকে থাকতে দেখেননি?”

“না। এটাই তো অদ্ভুত ঠেকে আমার কাছে। অবশ্য, এই এলাকায় এরকম অনেক বাড়ি আছে। যেমন, ওখান থেকে একটু সামনে এগোলেই একটা পরিত্যক্ত নার্সিং হোম দেখতে পাবেন। যে কোম্পানি চালাত ওটা, তারা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় ওভাবেই পড়ে আছে। শুধু বাড়িই নয়, সুইমিং পুল আর টেনিস কোর্টও লম্বা সময় ধরে পড়ে থাকতে দেখবেন।”

ক্যাফে মালিকের দিকে তাকিয়ে একবার হাসল লোকটা, এরপর আমাদের দিকে ফিরে জানতে চাইল, “বাড়িটার ব্যাপারে আগ্রহী কেন আপনারা?”

“বাড়িটার ব্যাপারে না। আসলে আমরা এই এলাকায় একটা ভূতাত্ত্বিক জরিপ করতে চাই। বাড়িটার মালিকের সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো।”

“ভূতাত্ত্বিক জরিপ?”

“আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই।”

মানিব্যাগ থেকে কার্ড বের করে দেখালাম তাকে। ওখানে লেখা ‘ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিক্স, ফ্যাকাল্টি অব সাইন্স’। তবে সে কিছু সন্দেহ করলো বলে মনে হয় না।

“সেক্ষেত্রে আপনি নির্দ্বিধায় কাজ করতে পারেন। কেউ কিছু বলবে না।”

“আচ্ছা। তাহলে সেটাই করবো।”

“হ্যাঁ। আচ্ছা, আচ্ছা,” এই কথাটা মাথা নেড়ে কয়েকবার বললো লোকটা।

জিজ্ঞেস করার মতন আর কোনো প্রশ্ন নেই। কফিও শেষ। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে বিল দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক সেই মুহূর্তের লোকটার কিছু একটা মনে পড়ে গেল খুব সম্ভবত। বললো “ওহ হ্যাঁ, একবার ওখানে নাকি এক লোককে দেখেছিল আমার পরিচিত একজন।”

“তাই? কবে?”

“চার কি পাঁচ বছর আগে। তখন একটা সুশি রেস্তোরাঁয় চাকরি করতাম আমি। ডেলিভারি ম্যান ভুল দিকে মোড় নিয়ে ওখানে চলে গেছিল। তখনই বাসার সামনে একজনকে দেখতে পায়।”

“কেমন লোক, বলতে পারবেন?”

“খুব সম্ভবত বয়স্ক কেউ।”

“বয়স্ক কেউ? আচ্ছা। কিন্তু বাড়ির সামনে দেখা গেছে বলেই যে সে বাড়ির মালিক, তা তো নয় নিশ্চয়ই?”

“বলা যায় না। কিন্তু সেই ডেলিভারি ম্যান বলেছিল লোকটাকে ঝাড়ু দিতে দেখেছে।”

“উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল?”

“হ্যাঁ, একটা ঝাড়ু হাতে।”

এই সময়ে সায়াকা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “আপনার পরিচিত এই ভদ্রলোকের সাথে কি দেখা করা যাবে?”

ওর গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে বোধহয় ভড়কে গেল লোকটা। “ও আর কি এসব ছোটখাটো চাকরি করতো তখন। এখন আর এখানে থাকে না।”

“আচ্ছা…” বলে আমার দিকে তাকায় সায়াকা। ওর মাথায় কী ঘুরছে, তা বুঝতে সমস্যা হলো না।

ক্যাফে মালিক আর লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিল পরিশোধ করে দিলাম।

“নিশ্চয়ই আমার বাবাকেই দেখেছে,” ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ফিরে আসা মাত্র বললো সায়াকা।

“আমারও সেটাই মনে হয়। আরেকটা রহস্যের সমাধান হলো।”

“কী রহস্য?”

“বাড়িটার ওরকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার রহস্য। হ্যাঁ, আমরা অনেক ধুলো দেখেছি ভেতরে, কিন্তু আসলেও যদি তেইশ বছর ধরে খালি পড়ে থাকতো, তাহলে অবস্থা আরও খারাপ হবার কথা।”

“তুমি তাহলে বলতে চাইছ বাড়িটা পরিষ্কার করার জন্যেই নিয়মিত এখানে আসত বাবা?”

“হয়তো অন্য কোনো কাজও ছিল তার। সেই সুযোগে সব পরিষ্কার করতেন।”

কয়েকবার চোখ পিটপিট করলো সায়াকা।

“বাবার সাথে ওই পরিবারের কী সম্পর্ক থাকতে পারে তা মাথায় খেলছে না।”

“কোনো-না-কোনো যোগাযোগ তো আছেই,” বলি আমি। “সেজন্যেই পরিষ্কার করলেও কোনো কিছু বদলাননি তিনি। এমনকি খাতা-বইও বন্ধ করেননি কিন্তু! বাড়ির বাসিন্দারা যেভাবে রেখে গিয়েছিল, সবকিছু সেভাবেই আছে।”

“বাবার সাথে বাড়িটা আর ওই পরিবারের কী সম্পর্ক থাকতে পারে, সেই ব্যাপারে সূত্র খোঁজা উচিত আমাদের।”

“আগে চলো তুমি যে অ্যালবামগুলো নিয়ে এসেছ, সেগুলো দেখি,” বলে গাড়ি চালু করলাম। “হয়তো সেখানে পুরোনো কোনো ছবিতে দেখা যাবে বাড়িটা।”

* * *

ধূসর বাড়িটার সামনে ফিরে এলাম আমরা। আবারও বেইজমেন্ট দিয়ে প্রবেশ করলাম ভেতরে। কেরোসিনের ক্যানগুলোর কাছে একটা মোমবাতি আর ম্যাচ চোখে পড়লো আমার। এগুলো নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।

সূর্য ডুবতে এখনও কিছু সময় বাকি, ভারি মেঘের কারণে অন্ধকার হয়ে আছে আকাশ। খোলা জানালা দিয়ে যথেষ্ট আলো আসছে না ভেতরে। মোমবাতি ব্যবহারের আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে।

আমার গাড়ির ট্রাঙ্কে প্লাস্টিকের একটা শিট ছিল। সেটা নিয়ে এসে সোফার উপরে বিছিয়ে বসলাম। খুব আরামদায়ক কোনো ব্যবস্থা না, ধুলোমাখা সোফায় বসার চেয়ে ভালো অন্তত। টিস্যু পেপার দিয়ে কফি টেবিল থেকে ধুলো পরিষ্কার করে সেটার উপরে ছবির অ্যালবাম রাখলাম।

মোট দু’টো অ্যালবাম। প্রথমটার মলাটে একটা হাতে আঁকা পশুর ছবি আর দ্বিতীয়টায় একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সায়াকা বলেছিল, প্রথম পাতার ছবিটা ওর স্কুলের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের দিন তোলা। সাদা শার্ট আর গাঢ় নীল রঙের শর্ট স্কার্ট পরে আছে, কাঁধে লাল ভুল ব্যাগ। এমনভাবে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে যেন প্রচণ্ড রোদ।

পাশে যে মহিলা সায়াকার হাত ধরে আছে, সে খুব সম্ভবত ওর মা। ছিপছিপে গড়ন, পরনে বিজনেস স্যুট। সায়াকার কাছে শুনেছিলাম প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন সময়েই মা’কে হারিয়েছে। হয়তো ছবিটা তোলার সময়েও অসুস্থ ছিল সে। মেয়ের নবীনবরণ অনুষ্ঠানেও তার মুখে কোনো হাসি নেই। তবে বিউটি পার্লারে গিয়ে করানো চুলের স্টাইলটা বলছে যে অনুষ্ঠানটায় আগ্রহ নিয়েই গিয়েছিল।

“ছোটবেলায় খুব একটা হাসতাম না আমি,” সায়াকা বলে।

“হাসতে না? কেন?”

“জানি না। দেখ, আমার একটা ছবিতেও হাসির কোনো চিহ্ন নেই।”

পাতাগুলো উল্টে চললাম। কোথাও ছোট্ট নায়াকা জাতীয় উদ্যানে দাঁড়িয়ে আছে, তো কোনটায় অ্যামিউজমেন্ট পার্কে রোলার কোস্টারের সামনে। বড় বড় আদুরে চোখগুলোর কারণে নিশ্চয়ই অন্য বাচ্চাদের থেকে সহজেই আলাদা করা যেত ওকে।

তবে ও ঠিকই বলেছে, কোনো ছবিতেই হাসছে না। বরং প্রতিটা ছবিতে এর চোখে শঙ্কা। যেন সম্পূর্ণ অচেনা এক জগতে একা ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

“তুমি তোমার ছোটবেলার ব্যাপারে আমাকে কখনোই খুব বেশি কিছু বলোনি,” মাথা তুলে বললাম ওকে। “সেজন্যেই ছয় বছরের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তোমার শৈশব সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।”

“এই বিষয়ে আমাদের কোনো আলাপই হয়নি। তুমিও তো তোমার শৈশবের ব্যাপারে কিছু বলোনি।”

“যেন আমাদের মধ্যে অলিখিত একটা চুক্তি হয়েছিল যে অতীতের ব্যাপারে কিছু বলবো না।”

“ভবিষ্যতের ব্যাপারেও না,” এবারে কিছুটা শীতল শোনালো সায়াকার কন্ঠস্বর।

প্রায় জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিলাম, সেই কারণেই অন্য কাউকে বেছে নিয়েছে কিনা; যার ভবিষ্যত সুপরিকল্পিত। কিন্তু কথাগুলো গিলে ফেললাম।

ছবির অ্যালবামটার দিকে মনোযোগ দিলাম আবারও। কিন্তু আমরা যে বাড়িটা খুঁজছি, সেটার কোনো খবরই নেই। আমার পাশে বসে সায়াকা অন্য অ্যালবামটা দেখছে।

কিন্তু বাড়িটার একটা ছবিও পাওয়া গেল না। এমনকি আশপাশের এলাকার কোনো ছবিও নেই।

“তোমার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হবার আগের সময়ে ফিরে গেলেই কেবল এই পরিবারের সাথে তোমার বাবার সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু জানা যাবে হয়তো।”

“আর আমার।”

“হ্যাঁ।”

আরো একবার শুরু থেকে অ্যালবামগুলো দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। তৃতীয় পাতায় দেখা মিলল সায়াকার বাবার। একটা কলার খোলা হাফ-হাতা শার্ট তার পরনে, মাথায় ড্রাইভিং হ্যাটটা একদিকে বাঁকানো। বাবা-মেয়ে একটা গেটের সামনে দাঁড়ানো, সম্ভবত সায়াকার মা তুলেছিল ছবিটা গেটটা খুব পরিচিত ঠেকল আমার কাছে। ওগিকুবোতে, ওদের বাসার গেট এটা। ডেট শেষে প্রায়ই ওকে বাসায় পৌঁছে দিতাম, তখন দেখেছি। তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কেবল বাড়িটা একটু নতুন ঠেকছে, এই যা। না, নিজেকেই বললাম। একটা পার্থক্য আছে।

“পাইন গাছটা নেই।”

“হ্যাঁ?”

“বড় পাইন গাছটা, মনে নেই? দরজার পাশেই তো ছিল ওটা। আমার ভালো মতন মনে আছে।”

ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওপরে নিচে মাথা নাড়ল সায়াকা। ওরও মনে পড়েছে নিশ্চয়ই।

“গাছটা আমি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হবার পর লাগানো হয়েছিল তাহলে। পরের দিকের ছবিগুলোতে আছে নিশ্চয়ই। “

কয়েক পাতা ওল্টানোর পর আসলেও চোখ পড়লো গাছটা। সেই বছরেরই শীতকালে তোলা একটা ছবিতে চোখে পড়লো। তাহলে দাঁড়াচ্ছে যে গ্রীষ্মে বা হেমন্তে বোনা হয়েছিল ওটা।

“পাইন গাছই কেন লাগালেন ওনারা, এটা ভাবছি।”

“জানি না,” সায়াকা বিভ্রান্ত স্বরে বলে।

“তোমার পরিবার তো ওগিকুবোতে অনেক আগে থেকেই থাকত, তাই না?”

প্রশ্নটা শুনে এক দিকে ঘাড় কাত করলো সায়াকা, কিন্তু কিছু বললো না।

“ঠিক বলিনি?” জিজ্ঞেস করলাম।

“মনে হয় না,” সায়াকার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে ও নিজেও নিশ্চিত নয় এই ব্যাপারে।

“তোমরা অন্য কোথাও থেকে এসেছিলে এখানে?”

“সেরকমই শুনেছিলাম। আগে আমরা ইয়োকোহামাতে থাকতাম।”

“কবে এসেছ ওগিকুবোতে?

“তা ঠিক বলতে পারব না। আমি একদম ছোট থাকতে বোধহয়।”

“কিন্তু,” ছবিটায় টোকা দিয়ে বললাম, “এমনটাও হতে পারে যে এখানে সেই বছর ক্লাস শুরু হবার আগে এসেছ। নতুন বাসায় এসে অনেকেই কিন্তু গাছ লাগায়।”

বিস্ময় ফুটলো সায়াকার দৃষ্টিতে। “এভাবে তো ভেবে দেখিনি।”

“তোমরা যদি সেই সময়ে বাসা বদলিয়ে থাকো, তাহলে নিশ্চয়ই

সেটা নাগরিক সনদে উল্লেখ করা আছে।”

“হ্যাঁ, আসলেও লেখা ছিল। কিন্তু আমি কখনো মনোযোগ দিয়ে তারিখটা দেখিনি। জরুরি মনে হয়নি কখনো।”

মাথা নাড়লাম আমি, এমনটাই স্বাভাবিক।

“হয়তো তোমরা আগে যেখানে থাকতে, সেখানে কিছু ঘটেছিল।”

“যে কারণে আমি সবকিছু ভুলে গেছি? “

“হ্যাঁ।”

ভ্রু কুঁচকে চিন্তায় ডুবে গেল সায়াকা। চেহারায় অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ।

“ইয়োকোহামায় কোথায় থাকতে, এটা জানো?”

“মিদোরি ডিসট্রিক্টে, কিন্তু সেটা না-ও হতে পারে।”

“আংকেল-আন্টি কি ওখানকার ব্যাপারে কোনো আলাপ করেছিল। তোমার সাথে?”

“না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ও। “কী একটা অবস্থা। কিছুই জানি না আমি। এখনও যে বেঁচে আছি, এটাই তো অনেক।”

“আরে এটা এমন কোনো ব্যাপার না। আমি নিজেও আমার পরিবারের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানি না। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমাকে আমার দাদা-দাদির নাম জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না।”

“আমিও না। তাদের কখনো দেখিনি আমি।”

“আমার দাদি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া অবধি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার নাম জানার কখনো আগ্রহ হয়নি আসলে। দাদি বললেই সে জবাব দিত।”

খুব একটা হাসির কিছু বলিনি, তবু হাসল সায়াকা।

“তোমার অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই?”

“মনে হয় না। বিয়েতে আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটা ছবি তোলার কথা বলেছিল ফটোগ্রাফার। কিন্তু কাউকে খুঁজে না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে ছবি তুলি।”

“হুম।”

আবারও অ্যালবামটার দিকে তাকালাম। সায়াকাকে বিয়ের পোশাকে কল্পনা করলাম। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বুকের ভেতরে। আমার হঠাৎ এভাবে চুপ হয়ে যাওয়া খেয়াল করল ও। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। জোর করে মুখে হাসি টেনে মাথা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বিয়েটা কি চার্চে হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“সেটাই ভেবেছিলাম। বিয়ের পোশাকে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর লাগছিল তোমাকে।”

“খুব একটা না,” মৃদু হাসে সায়াকা।

“তোমার পরিবারের কেউ যে যায়নি, এটা দেখে অবাক হয়নি তোমার শ্বশুড়-শাশুড়ি?”

“নাহ। আমার যে কেউ নেই, সেজন্যে বরং খুশি হয়েছিল। থাকলে রীতি-রেওয়াজ মেনে অনেক কিছু করতে হতো তাদের জন্যে।”

“ওহ আচ্ছা,” বললাম। এমনটাই হবার কথা। দ্বিতীয় অ্যালবামটা তুলে নিলাম এবার। এই অ্যালবামের প্রথম ছবিটা নববর্ষের দিন তোলা। সায়াকা একটা শিনতো মন্দিরের বড় গেটের সামনে কিমোনো পরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশের ভদ্রমহিলাকে এই প্রথম দেখলাম। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। পরনে ধূসর কিমোনো।

“এটা কে?” ছবিটা দেখিয়ে বললাম।

“ওহ, ইনি,” হাসি ফুটলো সায়াকার মুখে। “আগে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। শুনেছি এক সময় বাবার খুব উপকার করেছিলেন।”

“আর এখন?”

“মারা গেছেন। যতদূর মনে পড়ে…” মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবে সায়াকা, এরপর বলে, “আমি তখন ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষে। তার শেষকৃত্যেও গিয়েছিলাম।”

অ্যালবামের পাতাগুলো উল্টে চললাম। আরো বেশ কয়েকটা ছবিতে দেখা মিলল ভদ্রমহিলার।

“উনার নাম কী?”

এবারে মাথা ঝাঁকাল সায়াকা। “সত্যি বলতে, তার নাম কখনোই জানা হয়নি আমার। অনেকটা তুমি আর তোমার দাদির মতন। উনাকেও আমি ‘দাদি’-ই বলতাম।”

“দাদি।”

সবগুলো ছবিতে ভদ্রমহিলার পরনে দামি সব কিমোনো। ধূসর চুলগুলো সুন্দর করে বাঁধা। যতদূর মনে হচ্ছে, দূরে কোথাও থেকে সায়াকাদের বাড়িতে আসতেন তিনি।

“তোমার এই দাদি থাকতেন কোথায়?”

“জানি না…”

“শেষকৃত্যে গিয়েছিলে বললে না? কোথায় হয়েছিল সেটা?”

“বাবা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছিল। আমি জানি না কোথায়,” গোমড়া মুখে বলে সায়াকা। “সরি।”

“আরে, সরি বলছো কেন,” হেসে বলি। অ্যালবামের পাতা উল্টে চললাম। শেষ ছবিটায় সায়াকা একটা ইউনিফর্ম পরে বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিডল স্কুলে পড়তো নিশ্চয়ই তখন। “ইউনিফর্মটায় তো সুন্দর লাগছে তোমাকে,” হালকা স্বরে বলে অ্যালবামটা বন্ধ করে দিলাম।

“এটা কি হতে পারে যে…” সায়াকা বলে, “আমার এই দাদিই হয়তো এই বাড়িটায় থাকত? বাবা যেহেতু সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্যে এতদূর গাড়ি চালিয়ে আসত, তাহলে বলা যায় ঘনিষ্ঠ কেউই ছিল সে। অন্য কারো কথা মাথায় আসছে না আমার।”

“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে সায় দিলাম। “তোমার কথায় যুক্তি আছে।”

“হয়তো এখানে এমন কিছু পাওয়া যাবে, যেটা দেখে আমরা নিশ্চিত হতে পারব এই ব্যাপারে।”

“চলো, দোতলায় গিয়ে খুঁজি।”

* * *

দোতলার বড় ঘরটা থেকে আমাদের তল্লাশি শুরু করলাম। সায়াকার আন্দাজ যদি ঠিক হয়, তাহলে ছবির বয়স্ক ভদ্রমহিলা ইউসুকের মা। তিনিই হয়তো রকিং চেয়ারে বসে সোয়েটার বুনছিলেন। তেইশ বছর আগে ইউসুকে যদি প্রাইমারি স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায় মা এবং ছেলের বয়সের পার্থক্য অনেক। সায়াকা এখানে যে রিডিং গ্লাসটা খুঁজে পেয়েছি. সেটাও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।

রিডিং গ্লাস এবং পকেট ওয়াচটা যে ছোট টেবিলটায় পাওয়া গেছে, সেটা আবারও দেখল সায়াকা। টেবিলের উপরে কলম, আতশ কাঁচ এবং অন্যান্য কিছু জিনিস পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা।

দেয়ালে ঝোলানো স্যুটটার দিকে এগোলাম আমি। ধুলোয় সাদা দেখাচ্ছে এখন, এখানে সেখানে খেয়ে ফেলেছে মথ, কিন্তু আগে নিশ্চয়ই চমৎকার গাঢ় খয়েরি রঙের ছিল। স্যুটের ভেতরের পকেটের ঠিক নিচে এন্থয়ডারি করে চাইনিজ ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে ‘মিকুরিয়া’ লেখা।

ছোট আলমারিটা খুললাম আমি। ভেতরে একই রকম পুরোনো আরো দু’টো স্যুট আর মাঝবয়সি মহিলাদের সাধারণ একটা ড্রেস। এই স্যুটগুলোর ভেতরের পকেটে কোনো নাম উল্লেখ করা নেই।

আলমারির নিচের দিকে একটা ড্রয়ার; খুললাম সেটা। একটা বাইবেল চোখে পড়লো। দ্রুত পাতা উল্টে গেলাম বাইবেলটার। ভেতরে সরু দু’টো কাগজ গুঁজে রাখা হয়েছে এক জায়গায়। কাগজ দু’টো থেকে কালি উঠে গেছে। কোনমতে একটা কাগজে চিড়িয়াখানা’, ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ আর অন্যটায় ‘শিশু’ লেখাগুলো বুঝতে পারলাম। বাবা ছেলে গিয়েছিল নিশ্চয়ই।

আলমারির পাশে একটা ছোট স্টোরেজ রুম। পুরো রুমের তুলনায় একদমই জায়গা কম ভেতরে। আধ তাতামি ম্যাটের সমান হবে। ভেতরে অনেকগুলো বাক্স আর কাগজের ব্যাগ। একটা একটা করে নেড়েচেড়ে দেখলাম। সবগুলোই খালি।

বাক্স আর কাগজের ব্যাগগুলো সরানোর পর একদম নিচে একটা জিনিস চোখে পড়লো। একটা সবুজ রঙের ছোট ধাতব বাক্স। তুলে আনার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু আমার ধারণার চাইতেও ভারী ওটা। সায়াকা’কে ডেকে দেখালাম।

“খোলার চেষ্টা করেছ?” জানতে চাইল ও।

হাতল ধরে টান দিলাম। এক ইঞ্চিও নড়লো না ঢাকনাটা।

“লক করা।” সাধারণ কম্বিনেশন লক। কিন্তু এতও সাধারণ না যে আন্দাজে সংখ্যা ঘুরিয়ে খোলা যাবে। “চাড় মেরে খুলতে হবে। গাড়িতে যে যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলো দিয়ে হবে কিনা জানি না।”

“কোনো কোড লাগবে?”

“হ্যাঁ। আংকেল কি তোমাকে এরকম কিছু বলে গেছেন?”

“না।”

“সেটাই ভেবেছিলাম,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম। কী করে বাক্সটা খোলা যায়, সেটাই ভাবছি।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে দেয়ালে ঝোলানো স্যুটটায় হাত বুলাচ্ছে সায়াকা। “অনেক পুরোনো,” বিড়বিড় করে বলে ও। এরপর হঠাৎই মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ করে ওঠে। “আহ!”

ওর দিকে তাকালাম। “কোনো সমস্যা?”

“এখানে কিছু একটা আছে,” বলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করে আনলো ও। একটা কালো রঙের মানিব্যাগ। ভেতরে বেশ কিছু নোটও আছে। দুইটা দশ হাজার ইয়েনের নোট, রাজকুমার সোতুকুর ছবি ওগুলোতে। বাকিগুলো ইতো হিরোবুমির ছবি সমেত এক হাজার ইয়েনের তিনটা নোট।

“অনেক পুরোনো নোট,” বলি।

“এখনকার নোটগুলো কবে থেকে চালু করা হয়েছে যেন?”

“তাও বারো-তেরো বছর।”

“তাহলে এই মানিব্যাগটা এরপর আর ব্যবহৃত হয়নি।”

“মনে হয় না।”

“আর কী আছে?” বলে আরেকটা পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে আনলো সায়াকা। একটু পর বুঝতে পারলাম, কাগজ নয় আসলে সাদা-কালো একটা ছবি ওটা। কিছুক্ষণ ছবিটা দেখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সায়াকা।

পাঁচ বছর বয়সি বাচ্চা একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ওখানে। হাতে বালি লেগে আছে, খেলছিল খুব সম্ভবত। জুলুজুলু চোখে সরাসরি লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ চালাক চতুর।

“এটাই ইউসুকে?” সায়াকা বলে।

“তাই তো মনে হচ্ছে। তুমি চেনো বাচ্চাটাকে?”

“নাহ। কিন্তু…” ছবিটা আবারও হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল ও। “মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি।”

“এমনটাও হতে পারে যে হয়তো ছোটবেলায় দেখা হয়নি, কিন্তু বড় হওয়ার পর কোথাও দেখা হয়েছে তোমাদের। এই ছেলেটার মতন দেখা যায় এরকম কারো সাথে পরিচয় আছে তোমার এখন?”

আরো কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখল সায়াকা। এরপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “মনে পড়ছে না।”

“ওহ। দেখো তো কোনো কয়েন আছে কিনা মানিব্যাগটায়?”

“কয়েন? না, নেই তো মনে হয়। কেন?”

“কয়েনে সাধারণত কবে তৈরি করা হয়েছে, সেটা লেখা থাকে। সেখান থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারতাম ইউসুকের পরিবার এখানে ঠিক কোনো সময়টায় ছিল,” বলে আলমারির অন্য কাপড়গুলোর পকেট হাতড়ে দেখলাম। কোনো মানিব্যাগ বা পার্স নেই এখানে।

প্যান্টগুলো বের করে আমার নিজের কোমরের সাথে তুলনা করে দেখলাম। ভদ্রলোক বেশ রোগা ছিলেন আমার চেয়ে।

“ইউসুকের ঘরে কয়েন থাকতে পারে,” সায়াকা বলে।

“হ্যাঁ। চলো তাহলে এখন ওই ঘরটায় দেখি।”

উল্টোদিকে ইউসুকের ঘরটায় চলে এলাম আমরা।

“খুব বেশি এদিক ওদিক করো না কিছু। হয়তো বিশেষ কোনো কারণে এভাবে রাখা হয়েছে সব জিনিস, যেন মনে হয় সময় থমকে গেছে,” ভেতরে পা দিয়ে সায়াকাকে বললাম।

“আচ্ছা,” ছোট করে জবাব দেয় ও।

ছেলেটার পড়ার টেবিল আর বুকশেলফের উপরে দেখলাম টাকা জমানোর ব্যাংক আছে কিনা, কিন্তু পেলাম না কিছুই।

“ওরকম কিছু থেকে থাকলে সাথে করে নিয়ে গেছে।”

“তাহলে স্যুটের পকেটে থাকা মানিব্যাগটা রয়ে গেল কী করে?”

“ওটা নিতে ভুলে গেছে হয়তো।”

“আসলেই?” বুকশেলফের বইগুলোয় হাত বুলাচ্ছে সায়াকা। “যাওয়ার সময় শুধু টাকা নিয়ে গেল? বই আর পত্রিকাগুলো রেখে গেল এভাবে?”

“হয়তো পছন্দের বইগুলো নিয়ে গেছে, সেটা জানার তো কোনো উপায় নেই আমাদের।”

সায়াকা’কে দেখে মনে হচ্ছে না আমার যুক্তিটা পছন্দ হয়েছে। বাচ্চাদের একটা গল্পের বই তুলে নিল ও। ‘ভিখারী রাজপুত্র’।

“বইটার প্রকাশকাল তেইশ বছর আগের,” আমাকে সালটা দেখিয়ে বলে ও। “ওর পড়ার বইগুলোর মতনই।”

“অন্য বইগুলো?” আরো দুই তিনটা বই বের করে দেখলাম। সবগুলোই প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত। পত্রিকাগুলোর প্রকাশকাল আরো আগের। কোনোটাই তেইশ বছরের কম নয়।

“এখন তো পরিষ্কার, নাকি? পরিবারটা তেইশ বছর আগে রাতারাতি কোথাও চলে যায়।”

“কিন্তু রান্নাঘরে আমরা যে পত্রিকাগুলো পেয়েছি, সেগুলো কিন্তু বিশ বছর আগের, তার উপরে সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়ের দোকান থেকে কেনা। তাহলে সেগুলো কি পরে কেউ এখানে রেখে গেছে?”

“কিন্তু…” বুড়ো আঙুল কামড়ে ধরলো সায়াকা।

বুকশেলফ থেকে যে বইগুলো বের করেছে সায়াকা, সেগুলো জায়গামত রাখতে রাখতে মাথায় ভাবনাগুলো গোছানোর চেষ্টা করলাম আমি। সায়াকার কথা যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ, মিকুরিয়া পরিবার যদি তেইশ বছর আগে অন্য কোথাও চলে যায়, তাহলে রান্নাঘরের পত্রিকাগুলো অন্য কেউ নিয়ে এসেছে। আর সেটা সায়াকার বাবা হবার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু এটা কেন করবে সে?

শেষ বইটা রাখার সময় একটা সাদা রঙের নামহীন ডায়রি চোখে পড়লো আমার। পেছনের দিকে রাখার কারণে আগে চোখে পড়েনি।

বের করে আনলাম। দেখে সাধারণ কোনো ডায়রি মনে হচ্ছে না। স্পাইন বা প্রচ্ছদ, কোথাও-ই কিছু লেখা নেই। বিভ্রান্ত মনে বইটা খুলতেই একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে।

প্রথম পাতায় লেখা-

‘৫ই মে। বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া।

আজকে থেকে ডায়রি লেখা শুরু করলাম।’

দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো বাচ্চার হাতের লেখা। অঙ্ক খাতার লেখাগুলোর সাথে বেশ মিল।

অধ্যায় ১ / ৫

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন