আই. পি. সি. ৩৭৫ – ৫

মহাশ্বেতা দেবী

পাঁচ

ছাড়া পেয়েই বাড়ি আসেনি বকু। টাউনেও আসেনি। জেল থেকে বেরিয়ে অবনীবাবুর যোগাযোগেই শেলটার পেয়েছিল কলকাতার কাছাকাছি। অবনীবাবু বলেছিল, নতুন টাউনশিপ হচ্ছে এখন, এখন জমি ডেভেলপ করো আর বাড়ি বানাও। ঢুকিয়ে দিলাম বীরু পাঠকের আপিসে। খাটবে খাবে। কারু কিছু বলার নেই।

এ কথা মিলনই সরমাকে বলে গেল।

—টাউনে আসবে না সে?

—এলে আসবে।

—তাকে দেখেছিস তুই?

—না মা। তবে বাবুল দেখেছে, আমার ক্লাসে পড়ত যে বাবুল? দাদা না কি অন্য মানুষ হয়ে গেছে। বাবুলকে চা খাইয়েছে। বলেছে, কুসঙ্গে পড়েছিলাম, মাকে মুখ দেখাতে লজ্জা করে। পায়ে দাঁড়াই, তখন আসব।

—আমি তো চিঠিও লিখেছিলাম দু’বার। জবাব দেয়নি।

—পায়নি হয় তো।

—বাইরেই থাকুক, ভাল পথে চলুক। এ টাউনে তো…

—না মা, আজকাল কে কী মনে রাখছে বলো। মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা মানুষের, কেউ আর ভাবে না কিছু।

—যাক, ”মা” শব্দটা মনে আছে ওর;

—বাবুল তো তাই বলল।

—তুই হঠাৎ এলি যে?

—কাজে ফরাক্কা গিয়েছিলাম, তোমাকে দেখে গেলাম। কাল যাব।

—ওরা ভাল আছে?

—ভাল থাকে কোথায়? লিলির মা’র জ্বর হয়েছিল, লিলি সেখানেই। ওঁরা লিলির খুব ভরসা করেন তো! ওকেও ছুটতে হয়।

—সে তো হবেই!

—অতসী আসে না?

—মাঝে মাঝে; তারও তো কাজ!

—রেবতী মাসি বেশ এখানে রেখে তোমার ঘাড়ে মেয়ে মানুষ করে নিল যা হক।

—কী বলছিস?

—রেবতী মাসি তো পসয়াঅলা মানুষ! যথেষ্ট আছে ওর। বাবুলের মেসোই তো ওর জমিজমা বেচার ব্যবস্থা করে দেয়।

—আছে, বেচছে।

—এ বাড়ির দামও অনেক এখন।

—শুনে কী হবে মিলন? আমি বেচে দেব? যাব কোথায়? আমাকে এখানেই থাকতে হবে।

—লিলি আর আমি আলোচনা করি তো…

—আমি বেঁচে থাকতে ও বাড়ি ছেড়ে যাব কোথায়? এখানেই যে ভাবে পারি…

মন বলছিল, বকু যদি ভাল হয়ে কোনদিন ফিরে আসে, বাড়িটা না থাকলে সে দাঁড়াবে কোথায়?

মন বলছিল, মুখ বলতে পারছিল না।

—দাদা খুব অন্য রকম হয়ে গেছে। বাবুল বলল, কী সব আংটি কবচ পরেছে।

সরমা শ্রান্ত গলায় বলেছিলেন, তাকে তো বহুকাল দেখি না, তোকেও কমই দেখি। যে যেখানে থাকো, ভাল থাকো।

—রত্ন ধারণা করলে ভাল হয় মা!

—সেইজন্যে পলা পরেছিস?

—হ্যাঁ, খুব কাজ দিচ্ছে।

এও বোধহয় পরিবর্তিত সময়ের লক্ষণ। তাই হবে। টাউনেও তো এখন গ্রহরত্ন বিচার ইত্যাদির জোর হাওয়া। যারই পয়সা আছে সেই কলকাতা ছুটছে। টাউনেও জ্যোতিষীরা পসার জমিয়েছে। কী হয় রত্ন ধারণ করলে? সরমা আর সুধন্য যদি তা করতেন। কী এড়ানো যেত? বকুর অধঃপতন? সুধন্যর মৃত্যু? মিলনের এমন আলাদা হয়ে যাওয়া?

সরমা জানেন না, সরমা জানেন না।

শুধু জানেন তাঁকে থাকতে হবে নির্বাসনে। একবার অতসীকে বলেছিলেন, পারলে টাউনের বাড়ি বেচে তোর মায়ের বাড়ির কাছে বাড়ি করে নিতাম।

—পারতেন না।

—কী সুন্দর বাড়ি। কী শান্তি!

—টাউনের কাছের গ্রাম। টাউনের চেয়ে খারাপ মাসিমা। অশান্তি, দলাদলি, হিংসা, মারদাঙ্গা, কী নাই? আর, সারা জীবন টাউনে থাইকা, অহনে …. হয় না মাসিমা। অল্প বয়সে পারা যায়, বেশি বয়সে…. আমিই পারি না। কত অকথা কুকথা। এই বলে, বিয়া দাও মাইয়ার। আবার বলে, অতসী তো সেখানে বিয়া করছে। আমাগো লুকায়। মা আছিল না, নিধিরাম মায়ের পাকা তেতুল গাছটা কাইটা বেইচা দিল?

—সত্যি, শান্তি কোথাও নেই।

—মায়ে ভাবে গুরুপাড়ায় শান্তি পাইব, সেখানেও অহনে হিংসাহিংসি। অহন তো কাম শিখাইছে, ওহানে ডিউটি দেই। যখন স্বাধীনে চাকরি করুম, জানি মায়ে যাইব না। তয় আপনাকে নিয়া যামু। বারি দাদারে দিয়া চইলা যিবেন।

সরমা কি সে আশাও রাখেননি মনের সঙ্গোপনে? বকু বা মিলনের তো তাঁকে দরকার নেই। তাঁর আর অতসীর পরস্পরকে দরকার।

আর দেখো আজ সন্ধ্যায় কী শুনলেন?

রাত কি কাটবে না?

রাত যেন অন্ধকার হচ্ছে ক্রমে।

জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া।

মেঘ জমছে আকাশে। তারা ঢেকে গেছে, বুঝি প্রলয় নামবে।

নামুক, ঝড়ঝঞ্ঝা, মহাপ্রলয়। সরমা কালকের সকাল দেখতে চান না।

.

ছাড়া পাবার দেড় বছর বাদে বকু টাউনে ফেরে। এসে মার সামনে দাঁড়িয়েছিল।

বলেছিল, বসব একটু?

সরমা ঘাড় হেলিয়ে ছিলেন।

—মিথ্যে কখনও টেকে না মা।

সরমা অনেক চেষ্টায় বললেন, ও সব কথা থাক বকু। কী হবে বলে?

বকু কী নিখুঁতভাবে অনুশোচনা দগ্ধ সন্তানের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল, সরমার মনও কেঁপে উঠেছিল বারবার। কীভাবে সত্য—অর্ধসত্য ও মিথ্যা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলেছিল।

হ্যাঁ, সে সময়ে ও একেবারে বয়ে নিয়েছিল। পাপের পথের নিদারুণ মোহ ওকে বেঁধে ফেলেছিল।

—বাড়িতে ভাল লাগত না মা? দামি জামাকাপড় পরব, নোট ওড়াব, মস্তানি করব, না করলে অবনীবাবু বা পুলিশ ফেলে দেবে আমাকে।

—কেন, কেন বকু? আমরা কি খারাপ থাকছিলাম? সামান্য, খেয়ে পরেও তো মাথা তুলে বাঁচা যায়!

—আমি তো তা চাইনি।

—এখন … এখন কী হবে?

বকু তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখছিল।

—প্রায়শ্চিত্ত।

—তুমি করবে?

বকুর চোখ স্থির, যেন ছায়াঢাকা। চোখ দেখে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে না। গলার স্বরও সম্পূর্ণ অন্য রকম। কথা বলছিল ও গলায় প্রলম্বিত কবচে আঙুল রেখে।

—বাবার মৃত্যুর কারণও তো আমি।

সরমা নিরুত্তর।

—অনেক কথাই মনে হয়, বলার লোক পাই না।

—সঙ্গে কোন ব্যাগ সুটকেশ নেই?

—লালবাবুর গ্যারেজে রেখে এসেছি।

—কাজ করছো কোথাও? এখন…. যদি বুঝে শুনে চলো…

—তোমার সঙ্গে জড়াব না ভাবছি। ওদিকে দুটো ঘর তুলে নেব, বাথরুম থাকবে। নিজের মত আসব, যাব। তোমার আপত্তি আছে?

—সে তো অনেক টাকার ধাক্কা।

বকু ঈষৎ হেসে বলল, টাকা আমার, তোমার মতামতটা দরকার। বাড়ি তোমার।

—করে নিতে পারলে করে নাও।

—ওপরেও রান্নাঘর বাথরুম করে দিতে পারি। একটা বড় ঘর। বাবা তো শেষ করে যেতে পারেনি… ওপরে থেকে একতলা ভাড়াও দিতে পারো। মিলন তো বউ নিয়ে এখানে থাকবে না।

—না, আমি যতদিন আছি, যেমন রেখে গেছেন, তেমনই থাকুক বাড়ি। আমার পরে…

—সেই ভাল। আমি উঠি মা।

—বাড়িতে থাকবে না?

—না… এখনি নয়…অনুমতি করলে আসব যাব… ঘর তুলে নিলে থাকব…

—কোথায় আছো বকু?

—গ্যারেজে। মানে… পিছনের ঘরে। একটা অফিসও করব ওদিকে….

—কিসের?

—ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। পয়সা এখন মাটিতে।

—তোমার অফিস?

—পাঠক কোম্পানির। ওর ব্যবসা ছড়াচ্ছে এখন। নর্থ বেঙ্গলে চা বাগান, কলকাতায় হাউসিং, দুর্গাপুরে হাউসিং, সে অনেক ব্যাপার। চলি এখন।

—এসো বকু। ভাল থাকো, ভাল কাজ করো, আমি চিঠি লিখলে জবাব দাওনি… তুমি ভাল থাকো তেমন প্রার্থনাই করে যাচ্ছি। তোমাকে ভাল দেখলে আমি শান্তিতে মরব।

—মিলন টাকা দেয়?

—মাসে মাসে পাঠায়।

—ওর ক্ষমতাই বা কী, পাঠাবেই বা কত।

বকুর গলায় তাচ্ছিল্য পরিষ্কার। তারপরই ও সম্পূর্ণ অন্য গলায় বলল, টাকা লাগবে? রেখে যাব টাকা?

—না বকু। টাকা লাগবে না।

আজ মনে হয়, ভাগ্যে টাকা নেননি। টাকা নিলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন না।

বকুর বাইরের ব্যবহার কিছুকাল অন্তত খুবই ভদ্র, নম্র, অনুতপ্ত ছিল। শুধু তাঁর কাছেই নয়, টাউনের কাছেও। যারা ওকে আগে দেখেছে, তারাও বলত, আগের মতো অসভ্য চোয়াড়ে নেই ও।

সরমা শুনে যেতেন। অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে চাইতেন, বিশ্বাস আসত না।

বকু তার মনের মতো ঘর তুলে নিয়েছিল, যদিও সে ঘরে ও কমই এসেছে পরে। এখন তো বহুদিন আসে না। রেবতী বলে গেল, শোধরাইছে, ঘর তোলছে, এবারে সংসারি হইয়া বসুক।

সরমা কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু পোড়খাওয়া, বহুদর্শী রেবতীও তো ভুলে গিয়েছিল। একবার ও ডাক্তার দেখাতে এল। কেবল অক্ষিদে, নয় অজীর্ণ, কিছুই ভাল লাগে না মুখে। বলে গেল, দাদায় অষুধ দিল খানিক, লইলাম, খামু না।

—কেন রেবতী!

—আর দিদি! বাঁচবার ইচ্ছাই চইলা যাইত্যাছে। মন কয়, রেবতী লো! দ্যাহ ফালাইয়া মুক্ত হ’! আর বাচুম ক্যান? অতসীর বান্ধা কাম, পাকা চাকরি ওখানেই হইব। অর নামেই সগলই লেখ্যা দিছি। কাম করলাম অনেক, অহন আর মন চলে না।

—তাহলেও ওষুধ খেও।

—রাখেন ছিরা কথা। শোনেন, আপনের বড় পোলারে যে দেখলাম। হ’ দিদি, সাচাই কই। লোকজন নিয়া কুলডাঙা, মদনখালি বিবির হাট ঘুরতেছিল। জমি খুঁজে। তা আমার বারি আইল, গড় হইয়া পন্নাম করল। কইল, মায়ের লিগ্যা আপনে কত করছেন তা জানি। মুখ দেইখ্যা কে বলব…

—তোমার বিশ্বাস হয় ও শুধরে গেছে?

—কথা তো ভালই কয়। আর শোনেন। ভালর পর মন্দ, মন্দের পর ভাল, ঠাকুরের পিথিবিতে এই তো চলে। আমারেই দেখেন।

সরমা নিরুত্তর।

—এমন ঘর বানাইল, থাকে না?

—না। মাঝে মাঝে আসে।

এই রেবতীর সঙ্গে ওঁর শেষ দেখা। তারপরেই তো অতসী একদিন এসে আছড়ে পড়ল।

—মা মইরা গেল মাসিমা! আমার কপাল! আমি সময়ে খবরও পাই নাই। পায়রাডাঙা গিছিলাম আরেক নার্সের বিয়া দেখতে, অরা মায়ের কিনা জমিতে তার গতি করছে, আমি দেখতেও পাইলাম না।

অতসী সারাদিন, সারা রাত কেঁদেছিল মায়ের জন্যে। সরমা ওকে ধরে বসেছিলেন। তারপর, অতসী চোখ মুছে উঠে বসেছিল।

—আজ যামু মাসিমা।

—কোথায় যাবি?

—কুলডাঙা যামু, গুরুপারা এক রাত থাকুম, তারপর উকিলবাড়ি হইয়া হাসপাতাল ফিরুম।

—আমি সঙ্গে যাব?

অতসী সবেগে মাথা নেড়েছিল। বলেছিল, যা কান্দা ছিল, আপনের কাছে কাইন্দা লইছি। আর কান্দুম না।

—একলা যাবি মা?

—না, জবা সিসটারের কাকা আছে, তারে লইয়া যামু। তিনি মায়ের গুরুভাই।

—কাজকর্মও আছে মায়ের…

—মায়ের গুরু থানে অরাই বলল। ওইখানেই শান্তি পাইত, ওইখানেই দিন দেইখা কাম কইরা দিমু। কাঙ্গালী ভোজনের কথা বলত মা, ওখানেই….

সরমা মাথা নেড়েছিলেন।

—তোকে নিয়ে থাকলেই শান্তি পেত মা। তুই বলে এত চিন্তা ছিল!

—থাকে তো নাই। বলত, আমারে দোষ দিস না মা। আমার কত জন্মের পাপ আছিল, এ জন্মে জেল খাটলাম। তরে কাছে রাখি নাই, আমার কপাল দেইখা। যারে ধইরা বাচতে গিছি, সেই চইলা যায়। তর বাপ, আমার জ্যাঠা, দেখ! অসীমা দিদি যে এত ভালবাসত, সেও তীর্থে গিয়া মইরা গেল। তরে কাছে রাখলে তরই খারাপ হইত। তাতেই… দোষ নিস না মা!

এরকমই জটিল ছিল রেবতীর মন?

—আয় তবে। যাতে শান্তি পাস…

—শান্তি পাই আপনের কাছে আইলে। সে তো আমার আপনার কপালে নাই! তয়, নিধিরামের বিষদাঁত আমি ভাঙব। ওই বারি আর লগের জমি অরে লইতে দিব না।

নিধিরাম নয়, বকু ছিল পিছনে। সরমা তা জানতেন না।

তখনও জানেননি, বোঝা উচিত ছিল। বোঝেননি বলেই না আজ সরমা রাত জাগছেন এমন করে। এ বিছানায় অতসী অনেকদিন শোয় না। তবু হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন পাশের খালি জায়গায়। মিলন ঘুমোচ্ছে ওপরে। টাউনে আর কে জেগে আছে সরমার মতো?

অসীমা গেল, রেবতী গেল, সরমা এমন করে বেঁচে থাকবেন কেন? অতসী কি আছে, না নেই? কেন মনে হচ্ছে অতসী এখানে আছে এখানেই?

.

সব কাজ সেরে বিজয়িনীর মতো ফিরেছিল অতসী।

—আপনে একলা? রাতটুকু থাকুম?

—নিশ্চয় অতসী।

—দাদা তো আসেই না, তাই না?

—এলেও চলে যায়। থাকে না।

—গেরেজের পিছনে ভাল ঘরে থাকে। আপিসও করছে, খুব জমি কিনতেয়াছে।

—আমাকে কিছু বলে না। ওখানে সব ভালভাবে হয়ে গেল!

—হ। টাকা তুইলা নিছিলাম। কাঙ্গালী ভোজন…. আমিও একটু জল দিলাম মায়েরে। শ্মশান মনে হয় না মাসিমা, এমন সুন্দর জায়গা। গাছ লাগাইছে, মড়া রাইখা বসব, তার চালা তুলছে। পুরোত ভাল। মন দিয়া মন্ত্র পরায়। দেখেন! জীবনে আমার কাছে কিছু লইল না। মইরা তবে অন্নজল নিল! মারে যেহানে দিছে, সেহানে পাচিল ঘেইরা মায়ের নামে ফলক দিব।

—কোন বিঘ্ন হয়নি তো?

—বিঘ্ন মনে করলে বিঘ্ন।

অতসী নিশ্বাস ফেলল।

—সুবইলার বউ বইলা গেল, জমি—বাড়ি রাখতে পারবা না তুমি। গ্রামেই ঢুকতে পারবা না। অহন সবাই না কি বলত্যাছে, মায়ে জল্লাদ আছিল, মাইয়া দুশ্চরিত্র। নার্সিং করে, না হাতি, নামে নার্স, কামে পাচজনের লগে লটরঘটর করে।

—ছি ছি ছি!

—এ তো বউয়ের কাকা নিধিরামের রটনা। আমি ঘরের খাট চৌকি সর্বস্ব বিলাইয়া দিছি মাসিমা। ঘর তালা দিয়া আইছি, চাবি দিছি নিধিরামের শত্রু বঙ্কিমরে। বলছি, তগো ক্লাবে টাকা দিমু। তরা গাছের ফল খা, ঘরটা দেখ, রাতে জানি মানুষ থাকে।

—বেচে দিলেই হত না?

—ইশ! অমুন মাগনা কি না! পাচটা গ্রামে মুনুষ জমি বেচছে, অহন হাহাকার কান্দে। নিধিরাম দালালি খাইয়া কোঠাবাড়ি তুলছে। আমি অগো বিষদাত ভাইঙা দিমু।

ভুজঙ্গ উকিলও অতসীকে শুনিয়েছিলেন যে, জমি বা বাড়ি রাখতে লোকবল চাই।

অতসী শোনেনি।

—উকিলবাবু কয় অহন জমি বাপের নয়, দাপের। তোমার লোকবল নাই, বেইচা দাও। তা মাসিমা, আমার মায়েও জিদ্দি আছিল, আমিও তার মাইয়া। সে জীবন দিয়া রাইখা গেল, আমি বেইচা দিমু?

—রেবতীও তো তাই বলেছিল।

—না মাসিমা! আমি মায়ের নাম জাগাইয়া করুম কিছু। ওই গ্রামে মা শত লাঞ্ছনা সইয়া মাতা তুইলা থাকছে। তার সম্মান এট্টা…. টাকা দিয়া কী করুম? আমিও তো ধরেন হাজার টাকা পাইব এবার। অবশ্য দুই শৎ টাকা মিশনরে দান করুম মাসে মাসে। অরা ত ভাল কাম করে।

—মায়ের নামে ওখানেই বেড করে দে।

—না, কুলডাঙায় করুম।

জেদ, অল্প বয়সের জেদ। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার জেদ।

—ঠিক আছে, খাবি চল!

কী যোগাযোগ। সেই সন্ধ্যাতেই বকু এসেছিল। ”মা’! বলে ডেকে ও ঢুকল আর অতসীকে দেখেই কত সহজে বলল, রেবতী মাসির মেয়ে অতসী না? মুখ দেখেই চিনেছি।

সরমা নির্বাক দর্শক।

অতসী কিন্তু খুব সহজে বলল, আপনে বকুদা না? এক্কেরে বাপের মুখ পাইছেন। দারান, গর করি।

মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করেছিল অতসী। বলেছিল, আমি আপনের এক আবাইগা বোন গো দাদা।

—অভাগী কিসে? মায়ের সম্পত্তি পেয়েছো! নিজে কাজ করছো!

—তাতে কী হয় দাদা? মা কবে হইতে গুরুপারার মঠে নাম লিখাইছে, মাসিমা না থাকলে আমি ত দারাইতাম না। আমার কে আছে দাদা?

—না না, ভেবো না। বিপদ হলেই চলে এসো। তোমার মা…. আগে জমিজমা বেচেছে জলের দরে। তুমি যেন তা কোরো না।

—আমি বেচুম না।

—নিধিরাম তোমাদের কে হয় না? লোকটা খুব বাজে স্বভাবের। যাকে অসহায় পাচ্ছে, তার জমি কম দামে কিনে নিচ্ছে। লোকটার কোন কৃতজ্ঞতা নেই। এ কথা বলায় অতসী নিমেষে গলে যায়।

—সেই তো পিছনে লাগছে।

—বেচলে আমায় বোলো। ওদিকে নিউ অনন্তপুর টাউনশিপ হবে। পার্ক, বাজার, সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বদলে যাবে চেহারা।

—আমি বেচুম না দাদা!

—দাদা কেন, ‘বকুদা’ বলো।

—বোন বইলা একটু দেখবেন বকুদা!

—নিশ্চয় দেখব। আচ্ছা, চলি আমি। মা! কাল কলকাতা যাব। কিছু আনব না কি?

—না বকু… দরকার নেই কিছু।

—জানতাম, এই কথাই বলবে।

একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বকু চলে গেল। বলল, দরজা খোলা রাখো কেন? যে কেউ ঢুকতে পারে?

ও চলে গেলে অতসী বলল, এই মানুষের নামে এত কথা? আমি ত ভালই দেখলাম মাসিমা। আপনে বা কিছু নেন না কেন?

—অভ্যেস চলে গেছে অসী। থাক… খাবি আয়।

তিনি আর অতসী একসঙ্গে বসে খাওয়া, গল্প করা, সেও তো সেদিনই শেষবারের মতো। যদিও তা জানতেন না সরমা।

আজ মনে হয়, বকু যখন থেকে আতঙ্ক হয়ে উঠল, তখন থেকেই তাঁর কারাদণ্ড শুরু। শহরে থেকেও মুখ লুকিয়ে চলতেন, কারও সঙ্গে মিশতেন না। বকুকে জন্ম দিয়েছেন, সেই অপরাধে কারাবাস।

বকু যতদিন জেলে ছিল, সেই সময়টুকুই যেন জামিনে খালাস ছিলেন।

বকু ফিরে এসেছে, আবার তাঁর কারাবাস শুরু। পার্থ আসে না, অসীমা নেই, রেবতী চলে গেল, প্রসূতিসদনে যান, মুখ বুজে কাজ করে চলে আসেন। এ জীবন কতদিন, কতদিন সইতে হবে?

মিলন কবে দূরে সরে গেছে। অতসী, অতসী যেন এক টুকরো আকাশ। অন্ধকার কারাকক্ষের একমাত্র জানলা দিয়ে ওকে দেখতে পান। মুক্তি পায় মন। অতসী ওর বুভুক্ষু, স্নেহকাতর মনে এক পশলা বৃষ্টি, একটি স্নিগ্ধ প্রলেপ।

—কী ভাবেন মাসীমা?

—কিছু না মা, তুই খা।

—মায়ে বুঝে নাই, দাদা তো সেই মানুষ নাই। তাতেই থাকতে মানা করছিল।

—তুই খা।

—আপনের বিশ্বাস হয় না?

—বিশ্বাস… করতে ভয় পাই।

অতসী বিশ্বাস উজ্জ্বল চোখে বলেছিল, কুলডাঙ্গায় বঙ্কিমের কাকা কত পাপ করছে, মদ খাইত, প্রথম বউরে মাইরাই ফেলে। অহন তার কী পরিবর্তন! কী শান্ত মানুষ! পরে বিয়া করছে, সংসারি হইছে, আগের পক্ষের মাইয়ারে ভাল বিয়া দিছে। মাইনষের বিপদে আপদে গিয়া দারায়। মাইনষে মন্দ হয়, আবার ভালও হয়। রত্নাকরের কথা তো আপনেই বলতেন।

—বুঝছি, ভাল হক, সে তো আমিও চাই। তবে অতসী… এখন বিশ্বাস আসে না। আমার অবস্থা…

—আমি বুঝি। ওঠেন, ছোট পোলা আসে না?

—কমই আসে।

—দ্যাখবেন, আপনের মতো মায়েরে যারা বুঝল না, একদিন তারা আইসা পায়ে পরবে।

অতসী এইভাবে ভাবত। দুঃখের পর সুখ আসে। দুঃখিনী মায়ের মহিমা একদিন বোঝে হৃদয়হীন সন্তান! কেমন করে সে এসব বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রেখেছিল?

.

* * *

.

অতসী আর থাকতে আসেনি বেশ কিছুদিন। তবে আসতে যেতে দেখা করেছে। একবার বকুর সঙ্গে দেখাও হয়েছে।

বকু ইদানীং মায়ের কাছে আসছিল। বলতে শুরু করেছিল, অতসীকে সরমা বলুন জেদ ছাড়তে। কুলডাঙ্গায় জমি কিনছে বকুর আপিস। বেচে দেওয়া বুদ্ধির কাজ হবে।

—এত জমি দিয়ে কী করবে তোমরা?

—এখন ফেলে রাখব! পরে দেখা যাবে।

—ওর অনেক স্বপ্ন আছে। ও রাজি হবে না।

—তুমি বললেও না?

—প্রথমত আমি বলতে যাব না। আগে বলেছি, রাজি হয়নি। তারপর ও জেদি মেয়ে।

—ও! জেদ!

—খুব জেদি। মায়ের মতো।

—তা হলে বলতে হবে না। তবে মা! কেউ যদি জবরদখল করে বসে, ওঠাতে পারবে না।

জবরদখলই বা করবে কেন? তুমি তো অতসীর সঙ্গে কথা বলবে।

—জবরদখল যারা করে, তারা কি ভাল লোক?

—জবরদখল হবে? ওর মায়ের এত কষ্টের সম্পত্তি?

—এখন তো…. জবরদখলের ভয় দেখিয়ে বেচতেও বাধ্য করছে।

—কুলডাঙাতেও?

—কলকাতার আশপাশেও হচ্ছে। ওকে বেচতেই বলো।

—ও অন্য জাতের মেয়ে বকু। ভীষণ জেদ ওর।

—বুঝিয়ে বলো। জমির কাজে যারা নেমেছে, টাকা—থানা—আদালত—এল. আর. আপিস, সব তাদের হাতে।

—সরমা কেন বোঝেন নি, বকু তার নিজের কথাই বলছে? এ টাউনে সবই বকুর হাতে চলে গেছে, তা কেন বোঝেন নি?

দুরাশা, দুরাশা ছিল মনে যে বকু সৎপথে যাবার চেষ্টা করছে। বকু যা বলছে তা অতসীর ভালর জন্যই।

—বুঝিয়ে বলো, তোমার কথা তো মানে।

—সব কথা মানে, কিন্তু জমি বাড়ি বেচতে বললে শোনে না।

—বুঝতে চায় না।

—নদীর ও ধারটাই ডেভলপ করছে… করবে। এ টাউনের তো ভবিষ্যৎ নেই।

সরমার অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই অন্য কথা বললেন।

—বাড়ি করেছো, থাকো না কেন?

—থাকব… থাকব…. তোমার সম্পত্তির দামও বাড়িয়ে দিলাম বাড়ি করে। তোমারই তো জমি বাড়ি।

—আমার দরকার নেই সম্পত্তিতে।

—এগুলোই তো ভুল মা। টাকার মর্মই বোঝো না। এখন কি আর আদ্যিকেলে আইডিয়া নিয়ে চলে?

—চিরকাল জেনেছি, ভদ্রভাবে কোনও মতে ধারকর্জ না করে জীবন কাটালে সেই যথেষ্ট।

বকু ভুরু কুঁচকে পাঁচিলের গায়ে শ্যাওলার ছোপে কিছু পড়তে চেষ্টা করেছিল চোখ ওর সুদূরে! ও আস্তে অন্যমনস্ক গলায় বলল, বাবা তাই বলত! সে রকম জীবনই কাটিয়ে গেল, একটা নো—বডি হয়ে।

সরমা কঠিন গলায় বললেন, বাবার নামও কোরো না।

রকুর গলা একই রকম। বিস্মিতও বটে, বাবার মৃত্যুর কারণও আমি হলাম। তাই তুমি আমাকে দেখলে পাথর হয়ে যাও। আশ্চর্য। ছেলে কী করছে তাই নিয়ে হার্ট অ্যাটাক!

সম্পূর্ণ অন্য নগ্ন, বর্বর গলায় বলল! তোমাদের সব ধারণা ভুল! আজ ভিখিরির মতো বাঁচা যায় না। কবুতরের কলিজা নিয়ে বাঁচা যায় না।

—তুমি… সিংহের মতো বাঁচো।

বকু মাথা ঝাঁকাল। বলল, বাবার জন্যে আমাকে তুমি কাঠগড়ায় তুলে রেখেছো। এত নির্মম হওয়া ঠিক নয় মা! এত অভিমানী হওয়াও ঠিক নয়। আমি অমানুষ, মিলন বা মানুষ কিসে? সেও তো নিজেরটুকু নিয়ে ঘর গোছাচ্ছে। কিন্তু মা! আমি চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি। এত বিচার কোরো না মা একটু নরম হও। কেন টাকা চাইছি? যাতে তুমি ভাল থাকো, খুব ভাল থাকো, চাকরি ছেড়ে দিতে পারো…

এরকম ভাবাবেগপূর্ণ বাক্য অসমাপ্ত রেখেই বকু চলে গিয়েছিল।

সরমা মাথা নেড়েছিলেন।

কেন বাড়িতে থাকে না?

কেন গ্যারেজের পিছনে থাকে?

কেন অবনীবাবু আর বীরু পাঠক ওকে খাতির করে?

কোথা থেকে ও জমি কেনার টাকা পাচ্ছে?

কিসের পিছনে দৌড়াচ্ছে ও?

কেন ও টাউনে ফিরে এল?

অবনীবাবু আর বীরু পাঠক না কি বলে, বকুকে টাউন থেকে মিথ্যা দুর্নাম নিয়ে বেরোতে হয়েছিল। তাই নিজের নামকে প্রতিষ্ঠা করবে এখানেই, সেই জেদেই ও ফিরে এসেছে।

সরমা জানেন, ”মিথ্যা দুর্নাম” নয়। বকু মিতাকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছিল। কীভাবে ও ছাড়া পেল তা সরমা জানেন না। সরমা জানেন, ক্ষমতা থাকলে তিনি সব ফেলে রেখে চলে যেতেন।

ভীষণ চূড়ান্ত রকম একা তিনি।

অতসী, শেষ অবধি তোর কাছেই চলে যাব।

সুধন্যের স্মৃতির প্রতি বিশ্বস্ততাও তো বিশাল বন্ধন।

মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু আসে না কেন?

মরতেও ইচ্ছে করে না। এ বাড়ি বাড়ি নয়। সুধন্যের বড় কষ্টের, বড় যত্নের ও ত্যাগের স্মৃতি। তিনি রেখেছেন, ছেলেদের কাছে এর মূল্য শুধু টাকার অঙ্কে।

অতসী, তুই তাড়াতাড়ি দাঁড়া। আমি দেখে যাই। কবে বকু তার মুখোশ ফেলে দেবে, সেদিন কী হবে?

.

মুখোশ পরে চলতে বকুর খুব কষ্ট হচ্ছিল। একদিন মুখোশ খুলে গেল, পর্দা উড়ে গেল, বকু ছিন্নভিন্ন করে দিল তাঁর এত কষ্টে ও ত্যাগে অর্জিত ক্ষণিকের শান্তি।

বকু মাঝে মঝে বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিল। ওর নিজের অংশেই থাকত মার সঙ্গে কথাবার্তা বলত, একটু বসত।

সেই উদ্যোগ নিয়ে পুরো বাড়ি খুচরো মেরামত, ঘরে চুনকাম, বাইরে রং দরজা জানলায় রং করাল। রান্নাঘরে গ্যাস এনে দিল, পাঁচিল ফেলে শক্ত মজবুত পাঁচিল তুলল।

সবাই প্রশংসা করল, কিন্তু সরমা একটু হেসে চুপ করে গেলেন। বকুকে বলেন, অনেক খরচ হল।

—হক। বাড়ি রাখতে গেলে খরচ করতে হয়। মিলন তো চার পয়সা দেবে না।

—গ্রিল লাগালে, আবার নেট?

—নিরাপদ থাকবে, একা থাকো।

রামের মা এখন কাজ করে না, ও এনে দিয়েছে মীরাকে। প্রসূতিসদনে রামের বউয়ের যমজ ছেলে হয়েছে, সরমা বলে কয়ে খরচ কম করে দিয়েছিলেন। সরমা একদা পার্থকে বলে রামকে ব্যাঙ্ক লোন পাইয়ে দেন, ফলে রাম নিজের রিকশা কিনে নেয়। ইত্যকার কারণে রামের মা খুবই কৃতজ্ঞ। মাঝে মাঝে আসে খোঁজ নিতে। সে বলল, অহন বারি হাসতেছে। এবারে বউ আনেন, দুঃখ তো অনেক করলেন।

—দুঃখ কিসের? খাটা তো ভাল।

—এবারে আরাম করেন। বউ আনেন। সরমার চোখে পর্দা পড়ল ঝপ করে! বললেন, এখন কি বিয়ে দেয় কেউ? ছেলেরা বিয়ে করে।

—হ, আমার রাম যেমুন সীতা আনছে। আমি বউ আনলে উচকপালি মাইয়া আনতাম না। মন্দ কপাল হয় ঢিপকপালি মাইয়ার।

সরমা বুঝলেন, সবাই সব ভুলে গেছে। কার বিয়ে দেবেন? বকুর? বকু ক’বছর আগে কী করেছিল? হয় ভুলে গেছে, নয় সেদিনের স্মৃতি চাপা পড়েছে মনে। বর্তমানে মানুষ আর ভাবে না, বিচার করে না। চাল—তেল—কেরোসিন—লোডশেডিং—ছেলেমেয়ের স্কুলে ভর্তি—মানুষ বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত।

ব্যস্ত নিরাপত্তার জন্যেও। রোজগার বেড়েছে শিক্ষক শিক্ষিকারও। জমি কিংবা বাড়ি করব, গ্যাস চাই, ফ্রিজ চাই, এর জন্যও ধাবিত মানুষ। ঐহিক নিরাপত্তার জন্য চাই সেফগার্ড। তাই এত ধর্মগুরু ও জ্যোতিষী ও তন্ত্রমন্ত্রের জন্য রেস চলছে। টাউন সেদিনের মতো প্রতিবাদী, মানবিক ও নৈতিক নেই। একা সরমার মনে শুধু নিরন্তর রক্ত ঝরে ফোঁটা—ফোঁটা। আবার তো তিনি বোবা, কার সঙ্গে কথা বলবেন? আকাশে বৃষ্টি ছিল, বিকেলে ঘনিয়েছিল আঁধার।

বকু ভিজতে ভিজতে এল।

—আজ থেকে যেতে হবে মা! ফরাক্কা যাওয়া হল না, আজ টাউনে ফিরব না। ভোরে চলে যাব।

এদিকটা এখন ‘টাউন’ নয়, নদীতে খেয়া চলত বলে ”ঘাটপাড়া” নাম ছিল, সে নামই ফিরে এসেছে।

—এদিকে একটা খাওয়ার মতো হোটেল নেই।

—বিষ্টিতে হোটেলে যাবে কে?

—তাহলে খিচুড়ি করবে মা?

—তাই করি।

একদা সুদূর অতীতে, বালক বকু বলত, আজ খিচুড়ি করবে মা? বড় বড় আলু দিয়ে?

—আমি জামাকাপড় বদলে আসি।

বকু গেল জামাকাপড় বদলাতে, অতসী ধাক্কা দিল দরজায়।

—দরজা খোলেন মাসিমা। জলে ভিজত্যাছি?

—দরজা খুলতে বৃষ্টিস্নাত অতসী ঢুকল।

—কী বা অ্যাকসিডেন্ট হইছে, বাস বন্ধ। কুলডাঙা হইতে ফিরতে কী বিপদ তাই বলেন? অথচ জরুরী কাম, কাল যাইতেই হইব। যাক, আইয়া পরলাম।

—যা যা, চাবি নিয়ে যা। জামাকাপড় ছাড়। তোর একটা জামা, সায়া সবই তো আছে। আমার কাপড়ই পর।

কালো জামা, সাদা পাতলা থান কাপড়ে অতসীকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। এক পিঠ ভেজা চুল। খুব অন্যরকম।

—আজ খিচুরির দিন।

—তাই করছি। বকুও খেতে চাইল।

—বকুদা আইছে? দারান আমি রানধি।

বকু পিছন থেকে বলল, রাঁধতে পারো?

—সব পারি। আর অহন তো বারি নূতন কইরা দিছেন, গ্যাসে রানতে আরাম কত!

বকু বারান্দায় গিয়ে মোড়ায় বসল কাগজ নিয়ে। সরমা বাংলা কাগজ একটা রাখেন। অনেককালের অভ্যাস।

খাওয়া দাওয়া সহজ ভাবেই হল। বকু তৃপ্তি করে খেল। বলল, বেশ হয়েছে।

—মাসিমার মতো হয় না।

—তা কী করে হবে? মার মতো কে রাঁধবে? কত কম ঘি—তেলে রাঁধত!

আমার মা কোজাগরী পুজোর দিন যে নিরামিষ তরকারি রাঁধত!

—পূজা হইত বারিতে?

—হত বই কি। মা খাবার করত কত রকম। বাবা তো দোকানের খাবার খেত না।

—মনে আছে আপনের?

—সব মনে আছে। জেলে বসে সে সব কথাই ভাবতাম।

—অহন ও সব ভুইলা যান। মাসিমা কষ্ট পাইছে খুব….

—বাড়ি নতুন করে ফেললাম, মায়ের জন্যেই তো। দাঁড়াও, রান্নাঘরে কল এনে দেব।

সরমার মনে হচ্ছিল, এত স্বাভাবিক কথাবার্তা, বকু কি সত্যিই বদলে যাচ্ছে?

খাওয়া হয়ে গেল। অতসী, সরমা আর বকু বসে কথা বললেন। তারপর অতসী বলল, বিছানা কইরা ফেলি মাসিমা। কাল ভোরে বারাইতে হইব।

—যা। আমি রান্নাঘর বন্ধ করে আসছি। তোর ভিজে কাপড় পাশের ঘরে মেলে দে।

—বারি জানি হাসতেয়াছে।

—বকু সব করল।

—শুনছি সব। খুব পছন্দ হইছে আমার। যাই, কাপর মেইলা দেই। নাইলন ত পরতে পারি না যে নিমেষে শুকাইব। সুতির কাপড়…

কাপড় মেলতে গেল অতসী! বকু চলে গেল নিজের ঘরে। রান্নাঘর বন্ধ করে সরমা শোবার ঘরে ঢুকলেন, বিছানা ঝাড়ার ঝাঁটা খুঁজছেন। হঠাৎ অতসীর গলায় চাপা আর্তনাদ শুনলেন।

—না বকুদা না। ছারেন আমারে! না..

সরমা দৌড়ে ঢুকেছিলেন ও ঘরে। বকুকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন।

—বেরোও, বেরোও তুমি! বেরো আমার বাড়ি থেকে, বেরো!

—আমি ওর সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম মা!

—বেরো, বেরো তুই; আমার বাড়িতে আমার অতসীকে….

বকু মুখোশ ফেলে দিয়েছিল। হিংস্র, কুটিল, ভয়াল ও ধূর্ত ওর মুখচোখ।

—টাকা ফেলে দাও চলে যাচ্ছি।

—কিসের টাকা?

—বাড়ির মধ্যে বাড়ি…. এ বাড়ি মেরামত … মনে ছিল না?

—বেরো তুই। টাকা খরচ আমি করেছি?

বুক বাজিয়ে বকু বলেছিল, আমি করেছি। ইনভেসটমেন্ট। সে টাকা জলে যাবে?

সরমা ওকে প্রবল ধাক্কায় বাইরে বের করে দেয়। বকু নিজের ঘরে চলে যায়।

অতসীকে জাপটে ধরে ঘরে নিয়ে আসেন। বলেন, ভয় কী মা! আমি আছি।

অতসী মাথা হেলায়। ও তখনও বিমূঢ়।

—এখানে পা দিস না আর প্রসূতিসদনে দেখা করিস।

অতসী! ও অমানুষ, আক্রোশ পুষে রাখবে।

—বুঝেছি।

—এখন বুঝছিস, কেন আমি ওকে বিশ্বাস পাইনি?

—আপনারে যদি….

—না… আমাকে মেরে শাস্তি দেবে না….আমার উপর ওর আক্রোশ …. দগ্ধে দগ্ধে মারবে…। এ বাড়ির লোভই কি ওর নেই?

দুজনে দুজনকে জড়িয়ে শুয়েছিলেন। সারা রাত, সারা রাত, নিদ্রাহীন। কারাকক্ষে একটা জানলা ছিল। এক টুকরো আকাশ। বকু সে জানলা বন্ধ করে দিচ্ছে।

—প্রসূতিসদনে চিঠি লিখিস।

—হ। আপনে… এ কথা… কারেও …

—তাই বলি? কলঙ্ক তো মেয়েদেরই হয়।

ভোরবেলা সরমা বাড়ি বন্ধ করে অতসীর সঙ্গে বাস অবধি গিয়েছিলেন। বাসস্টান্ডে চা খেয়েছিলেন দুজনে।

হঠাৎ অতসী বলল, ক্যান মাইয়াদেরই হয় মাসিমা?

—কী হয় মা?

—কলঙ্ক? শুধু মাইয়াগো হয়?

—তাই তো দেখি!

হয়নি। মিতার বেলা হয়নি। টাউন ক্ষেপে গিয়েছিল। বকুকে হাতে পেলে মেরে ফেলত।

—আমিও তো দেখি। কত মাইয়ার ইজ্জত লইতেয়াছে কত পুরুষ। একজনারে চারজন… হাসপাতালে তো আনেই। ধরাই পরে না অনাচারগুলা… ধরলেও আদালত ছাইরা দেয়… মাইয়াদের কলঙ্ক হয়… বিয়া হয় না… শুধু… মাইয়ারা।

—কী বলব মা।

—দাদা ডাকলাম…. সম্মান করলাম… বুঝি নাই মাসিমা। তয় অহন হইতে আর ক্যাও আমার গায়ে হাত দিতে পারব না, আপনে দেখবেন!

—হ্যাঁ অতসী। বিশ্বাস করি।

—আপনে পারবেন না থাকতে। আমি কোয়াটার পাই, আপনারে মাথায় কইরা লইয়া যামু।

—আমিও সেই দিনের পথ চেয়ে থাকব।

—মা আর কী সইছে? আপনে… বাসে উঠি মাসিমা।

শক্ত মেয়ে অতসী। নাক টেনে মুখচোখ মুছে নিল।

সরমা ফিরে এলেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন