শ্বেত পাথরের থালা – ১৭

বাণী বসু

অধ্যায় ১৭

অমলেন্দু ঘোষাল অভিমন্যুর থেকে কিছু ছোট। দুজনেই বোধহয় এক স্কুলের ছাত্র, সেই হিসেবে একটা অতিরিক্ত টান, সৌহার্দ্য ছিল। বন্দনাকে দেখবামাত্র সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন। লাঞ্চ আওয়ারের পর। অফিসে এখন বেশ খানিকটা শিথিলতা। অনেকেই সিটে নেই। ঘোষালের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে বন্দনা ঘামছে। ঘোষাল অভিমন্যুকে অফিসের বাইরে দাদা বলত, বন্দনাকে বউদি। সামাজিক, মেলামেশা অবশ্য ছিল না। কিন্তু যতবার অফিসের উৎসবে, পার্টিতে এসেছে অমলেন্দু ঘোষাল তাকে বিশেষ খাতির করেছে। ককটেল পার্টির গোলমেলে আবহাওয়ায় তাকে সহজ হতে সাহায্য করেছে। আজ সেই মানুষটির কাছে সে প্রার্থী। প্রথমে সে কাকাকেই পাঠাতে চেয়েছিল। তিনি আগে এসে অবস্থাটা বুঝে যান। কিন্তু কাকার শরীরটা ভালো নেই। বুকে চাপ। মাথা ঘুরছে। ডাক্তার বলছেন ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু বিশ্রাম দরকার। কাকা তা সত্ত্বেও আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুব কষ্ট হবে। তাছাড়াও ডাক্তারের বারণ। এ দিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়ে গেছে। তাকে আসতেই হয়েছে।

অমলেন্দু বললেন—‘আপনার তরফ থেকে টেলিফোন পেয়ে আমি খানিকটা অবাকই হয়ে গেছি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ তো আপনি একেবারেই ছিন্ন করে ফেললেন।’

বন্দনা টেবিলের মাৰ্বল রঙের টপটার দিকে তাকিয়ে বলল—‘আসলে মিঃ ঘোষাল আমি তো এখন ও বাড়িতে নেই।’

—‘ও বাড়িতে নেই? মানে অভিদার বাড়িতে? নেই?’ সামান্য বিস্ময় প্রকাশ করেই নিজেকে সামলে নিলেন ঘোষাল। অযথা কৌতূহল প্রকাশ করবার লোক তিনি নন। তাছাড়া এতে বিস্ময়েরই বা আছে কি?

বন্দনা বলল—‘ছেলেকে নিয়ে কাকার কাছে আছি। আমি ভাবছিলাম এখানে যদি একটা চাকরি পাওয়া যায়।’

ঘোষাল চমকে বললেন—‘চাকরি? আপনি?’ বন্দনা মুখ নিচু করে আছে। মনে মনে দ্রুত ভেবে নিলেন ঘোষাল মিসেস ভট্টাচার্য আর শ্বশুরবাড়িতে থাকেন না। ছেলেকে নিজেই মানুষ করছেন। কাকা বয়স্ক। রিটায়ার্ড। আর্থিক অসুবিধে হওয়া বিচিত্র নয়। বললেন—‘আশ্চর্য! আপনি এতদিন কি করছিলেন? এতদিন আসেননি কেন? আপনাকে এখানে অ্যাবজর্ব করা আমাদের দায়। নৈতিক কর্তব্য। খুব আনন্দের সঙ্গে আমরা সে কর্তব্য পালন করব। আপনি এক কাজ করুন। আপনার সম্মানের উপযুক্ত কাজ তো চাই! পাঁচজনের সঙ্গে বসে কাজ করতেও আপনার অসুবিধে হবে। আপনি তাড়াতাড়ি একটা টাইপরাইটিং স্টেনোগ্রাফির কোর্স নিয়ে আসুন। আমার নিজস্ব অফিসেই আপনাকে আমি নিয়ে নেব। সেক্রেটারিয়াল কোর্স আমরাই পড়িয়ে নেব। আপনি তো আগে জয়েন করুন।’

দারুণ উৎসাহের সঙ্গে বাড়ি ফিরে বন্দনা দেখল সদর খোলা। এখনও রূপের ফেরার সময় হয়নি। তবু এটা নিশ্চয় ওরই কীর্তি। সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠতে উঠতে জুতোর শব্দ পেলো ওপরে। তাদের নিচের তলার ভাড়াটে অবনীশবাবু এবং একজন ডাক্তার নেমে আসছেন। বন্দনাকে দেখেই অবনীশবাবু বললেন—‘এই তো এসে গেছেন।’

—‘কি ব্যাপার?’ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে বন্দনা জিজ্ঞেস করল।

—‘ভয়ের কিছু নেই মা। —সোমনাথবাবুর শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল। একটু অজ্ঞান মতো হয়ে গিয়েছিলেন। ইনি ডক্টর সেন, আমি ডেকে আনলাম।’

—‘কি হয়েছে ডাক্তারবাবু?’

খুব চিন্তিত মুখে ডাক্তার বললেন—‘হয়েছে তো অনেকরকম। একটা ই· সি· জি· করিয়ে কোনও কার্ডিওলজিস্টকে কনসাল্ট করুন। তাড়াতাড়ি। আমি লিখে দিচ্ছি—ডক্টর চ্যাটার্জি খুব কাছেই বসেন। চলে যান।’

কাকার ঘরে ঢুকে বন্দনা দেখল চোখ বুজিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। কথা না বলে, খাটের পাশে বসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললেন। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বন্দনা মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে রাখল। ডাক্তার কথা বলতে বারণ করেছেন। কাকাকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে। জীবনে যত ঝড় এসেছে সোমনাথবাবুর স্বভাব হল সোজা দাঁড়িয়ে সেই ঝড়কে আটকানো। লম্বা লম্বা নমনীয় গাছের মতো তিনি ঝড়ের সঙ্গে নুয়ে পড়ে নিজেকে বাঁচাতে শেখেননি। প্রথম যখন শরীর খারাপ টের পেলেন, নিজের কাছে যথেষ্ট বই আছে। পড়ে শুনে, ব্যায়াম, হাঁটা, নিয়মমত খাওয়া নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি আরম্ভ করে দিলেন। ডাক্তারের কাছে ভুলেও গেলেন না। কিন্তু এই ঝড় এভাবে আটকানো তাঁর সাধ্যের বাইরে। বন্দনা যোগীন্দর অ্যান্ড যোগীন্দরে কাজে যোগ দেবার পাঁচ মাসের মাথায় সোমনাথবাবু মারা গেলেন। মায়োকার্ডিয়্যাক ইসকিমিয়া।

সকল অধ্যায়

১. শ্বেত পাথরের থালা – ১
২. শ্বেত পাথরের থালা – ২
৩. শ্বেত পাথরের থালা – ৩
৪. শ্বেত পাথরের থালা – ৪
৫. শ্বেত পাথরের থালা – ৫
৬. শ্বেত পাথরের থালা – ৬
৭. শ্বেত পাথরের থালা – ৭
৮. শ্বেত পাথরের থালা – ৮
৯. শ্বেত পাথরের থালা – ৯
১০. শ্বেত পাথরের থালা – ১০
১১. শ্বেত পাথরের থালা – ১১
১২. শ্বেত পাথরের থালা – ১২
১৩. শ্বেত পাথরের থালা – ১৩
১৪. শ্বেত পাথরের থালা – ১৪
১৫. শ্বেত পাথরের থালা – ১৫
১৬. শ্বেত পাথরের থালা – ১৬
১৭. শ্বেত পাথরের থালা – ১৭
১৮. শ্বেত পাথরের থালা – ১৮
১৯. শ্বেত পাথরের থালা – ১৯
২০. শ্বেত পাথরের থালা – ২০
২১. শ্বেত পাথরের থালা – ২১
২২. শ্বেত পাথরের থালা – ২২
২৩. শ্বেত পাথরের থালা – ২৩
২৪. শ্বেত পাথরের থালা – ২৪
২৫. শ্বেত পাথরের থালা – ২৫
২৬. শ্বেত পাথরের থালা – ২৬
২৭. শ্বেত পাথরের থালা – ২৭
২৮. শ্বেত পাথরের থালা – ২৮
২৯. শ্বেত পাথরের থালা – ২৯
৩০. শ্বেত পাথরের থালা – ৩০
৩১. শ্বেত পাথরের থালা – ৩১
৩২. শ্বেত পাথরের থালা – ৩২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন