অভিজিৎ রায়
০৮. বিশ্বাসের ভাইরাস
অনিষ্টকর কর্ম মানুষ কখনোই অতোটা অন্তপ্রাণভাবে ও সানন্দে করে না, যতোটা সে করে ধর্মীয় বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে করার সময়। –প্যাসকেল
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিশ্বজুড়েই আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং ‘সুইসাইড টেরোরিজম’-এর মাধ্যমে নির্বিচারে হত্যা এবং আতঙ্ক তৈরি ধর্মীয় উগ্রপন্থী দলগুলোর জন্য খুব জনপ্রিয় একটা পদ্ধতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আল কায়দার উনিশ জন সন্ত্রাসী চারটি যাত্রীবাহী বিমান দখল করে নেয়। তারপর বিমানগুলো কক্সা করে আমেরিকার বৃহৎ দুটি স্থাপনার ওপর ভয়াবহ হামলা চালায় তারা। নিউ ইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর (পেন্টাগন)– এ ওই হামলা চালানো হয়। প্রায় তিন হাজার মানুষ সেই হামলায় মৃত্যুবরণ করে। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা ছিল এটি। এই হামলার পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ থাকলেও এটি অনস্বীকার্য যে এর পেছনে সবচেয়ে বড় মদদ আসলে বিশ্বাস নির্ভর ধর্মীয় উগ্রতা।
একটা প্রশ্ন আমাদের বরাবরই উদ্বিগ্ন করে। কেন এইসব তরুণ সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিচ্ছে? কেন তারা হয়ে উঠছে আত্মঘাতী? কেন তারা ঘটনা তো একটা দুটো নয়, বিশ্বজুড়েই ঘটে চলেছে শত শত। বাংলাদেশেই কি আমরা কিছুদিন আগে বাংলা ভাইযের তাণ্ডব দেখি নি? ইসলামের নামে দেশের প্রতিটি জেলায় বোমাবাজি, কিংবা রমনা বটমূলে কিংবা সিনেমা হলগুলোর মতো ‘বে-শরিয়তী জায়গাগুলোর ওপর আগ্রাসন, চট্টগ্রাম আদালতে আত্মঘাতী বোমার তাণ্ডবে জগন্নাথ পাঁড়ের মৃত্যু, পত্রিকার পাতায় ঘাতকাহত হুমায়ুন আজাদ কিংবা ব্লগার থাবা বাবার রক্তাক্ত ছবি? ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামের একুশ বছরের এক বাংলাদেশী যুবক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়ে বিশ্বব্যাপী পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর হয়েছিলেন[২৯৪] এগুলোর ভিত্তি কী? ২০০৫ সালের পর শুধু মুম্বাইযেই সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে অন্তত দশটি, যেগুলোর সাথে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। এর আগে রামজন্মভূমিকে ইস্যু করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সন্ত্রাস, বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাটে দাঙ্গাও দেখেছি আমরা। এগুলোরই বা কারণ কী? এধরনের ঘটনা। ঘটলেই খুব জোরেশোরে একটি কারণকে সামনে নিয়ে আসা হয়: বিদ্যমান সামাজিক অনাচার। ২০০১ সালে সেপ্টেম্বর ১১-এর রক্তাক্ত ঘটনার পর পরই নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘আমেরিকা নিজেই এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র, যার কর্মকাণ্ডই নাইন-ইলেভেনকে নিজের ওপর টেনে এনেছে[২৯৫]। তবে সব বিশ্লেষকই যে চমস্কির ঢালাও মন্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন তা নয়। যেমন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস লিঙ্কন তার Holy Terrors, Thinking About Religion After September 11’ গ্রন্থে পরিষ্কার করেই বলেছেন[২৯৬]–
ধর্মের কারণেই আতা এবং তাদের অন্যান্য সহযোগীরা মনে করেছে এধরনের আক্রমণ শুধু নৈতিক নয়, সেইসাথে পবিত্র দায়িত্ব।
আতা নিজেও তার সুটকেসে কোরআন বহন করছিলেন। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত আতার কাছ থেকে পাওয়া তার শেষ নির্দেশাবলীগুলোও সেই সাক্ষ্যই দেয় যে, তারা পবিত্র আল্লাহ এবং ইসলামের প্রেরণাতেই এই জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন। সেই নির্দেশাবলীতে আতা খুব গুরুত্ব দিয়েই বলেছিলেন-কীভাবে আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করতে হবে, কীভাবে অস্ত্র তৈরি রাখতে হবে, কীভাবে নিজের দেহকে কোরআনের আয়াত দিয়ে আশীর্বাদধন্য করে নিতে হবে, কীভাবে ঘটনা ঘটানোর সময় সুরা পাঠ করে যেতে হবে, ইত্যাদি[২৯৭]।
‘পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রভাব সাধারণ মানুষদের কাছে ব্যাপক, এমনকি এই আধুনিক সমাজেও। সেজন্যই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর অমানবিক আয়াত কিংবা শ্লোকগুলো সন্ত্রাস এবং সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে। সহিংসতার সাথে যে ধর্মের বাণীর অনেক সময়ই সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকে তার ব্যাখ্যা জ্যাক নেলসন প্যালম্যের দিয়েছেন তার ইজ রিলিজিয়ন কিলিং আস?” গ্রন্থে [২৯৮]। তিনি বলেন–
Violence is widely embraced because it is embedded and sanctified in sacred texts and because its use seems logical in a violent world.
একই ধরনের কথা বলেছেন নতুন দিনের নাস্তিক স্যাম হ্যারিস তার নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার এন্ড অফ ফেইথ’ গ্রন্থে[২৯৯] তিনি তার বইয়ে দেখিয়েছেন অতিমাত্রায় মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নির্ভরতার কারণেই সন্ত্রাস আর জিহাদ এখনও করাল গ্রাসের মতো থাবা বসিয়ে আছে আমাদের সমাজে। তিনি মনে করেন আধুনিক সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরিখে মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নির্ভর ব্যবস্থা আজ অচল। এগুলো পরিত্যাগের সময় এসেছে আজ।
কিন্তু তারপরেও সামাজিক অনাচারের ব্যাপারটা থাকবেই। অনেক সময় সামাজিক অনাচার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়ন মিলেমিশে এমনই একাকার হয়ে যায় যে আলাদা করা মুশকিলই হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক যেমন হয়েছিল, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের মুম্বাইযে। সেইদিন প্রায় ১০জন জঙ্গি সবমিলিয়ে তাজ হোটেলসহ মুম্বাইযের ৫টা বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক আক্রমণ করে, গোলাগুলি করে নিমেষের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হামলায় দেড়শ জনেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল। ঘটনার পরপরই ডেকান মুজাহিদিন নামের একটি অজানা সন্ত্রাসী গ্রুপ ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ লস্কর-ই-তৈয়বার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়[৩০০]। এছাড়াও আলকায়দা, জয়সে মুহাম্মদ, ভারতীয় মুজাহিদিন এবং সর্বোপরি অন্যান্য পাকিস্তানি টেরর গ্রুপের জড়িত থাকার সম্ভাবনাও অনুমিত হয়েছে মিডিয়ায়। নিহত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পাঁচজন আমেরিকানসহ পনেরো জন বিদেশির মৃত্যুর ব্যাপারটা নিশ্চিত করা হয়েছিল। সিএনএন পুরো দুই-তিন দিন ধরে ভারতের ঘটনাবলী সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। ঘটনার ভয়াবহতা এতই বেশি ছিল যে, অনেকেই ঘটনাটিকে ভারতের ৯/১১ হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছিলেন। নাইন ইলেভেনের ঘটনার সময় যেমনটি হয়েছিল, ঠিক তেমনই এসময়েও বহু বিশেষজ্ঞ এর পেছনে কাশ্মীর সমস্যা, সামাজিক অনাচার, মুসলিমদের প্রতি ভারতের বৈমাত্রেয় মনোভাবসহ বহু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সন্ধানে তৎপর হলেও এর পেছনে বড় একটা কারণ যে ধর্মীয় ছিল তা সন্দেহাতীত। মূলত হোটেল তাজের সেই সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামের লেখাটির সূত্রপাত ঘটেছিল এবং এটি মুক্তমনা এবং সচলায়তন ব্লগে প্রকাশের পর বহু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, উন্মোচন করেছিল পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার দুয়ার[৩০১]। বইয়ের এই অধ্যায়টি সেই প্রবন্ধেরই আনুষঙ্গিক বিস্তৃতি।
বিশ্বাস নির্ভর সন্ত্রাসবাদ এত ব্যাপক আকারে মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কোনো নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্বিক কিংবা জৈববৈজ্ঞানিক কারণ আছে কিনা তা খুঁজে দেখাকে আমরা আসলেই এখন জরুরি মনে করি। বিবর্তনবাদ কি এ ব্যাপারে আমাদের কোনো পথ দেখাতে পারে? অনেক সামাজিক জীববিজ্ঞানীই কিন্তু মনে করেন পারে। আমরা আগের অধ্যায়ে বিবর্তনের মাধ্যমে নৈতিকতার উদ্ভব নিয়ে সামান্য আলোচনা করেছিলাম। এই অধ্যায়ে আমরা সেই একই প্রক্রিয়ায় করব বিশ্বাস নির্ভরতার অনুসন্ধান।
আমরা যতই নিজেদের যুক্তিবাদী কিংবা অবিশ্বাসী বলে দাবি করি না কেন, এটা তো অস্বীকার করার জো নেই-’বিশ্বাসের একটা প্রভাব সবসময়ই সমাজে বিদ্যমান ছিল। না হলে এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রাচীন ধর্মগুলো স্রেফ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে এভাবে টিকে থাকে কীভাবে? এখানেই হয়ত সামাজিক বিবর্তনবাদের তত্বগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এটা মনে করা ভুল হবে না যে, বিশ্বাস’ ব্যাপারটা মানবজাতির বেঁচে থাকার পেছনে হয়ত কোনো বাড়তি উপাদান যোগ করেছিল একটা সময়। মানুষ আদিমকাল থেকে বহু সংঘাত, মারামারি এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। একটা সময় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করাটা ছিল মানবজাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক। যে গোত্রে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারা গিয়েছিল যে যোদ্ধারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করে মারা গেলে পরলোকে গিযে পাবে অফুরন্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, হুর পরী উদ্ভিন্নযৌবনা চিরকুমারী অপ্সরা, (আর বেঁচে থাকলে তো আছেই সাহসী যোদ্ধার বিশাল সম্মান আর পুরস্কার)–তারা হয়ত অনেক সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ। করেছে এবং নিজেদের এই যুদ্ধংদেহী জিন’ পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে। আমাদের মুক্তমনা সাইটে রিচার্ড ডকিন্সের একটি চমৎকার প্রবন্ধ রাখা আছে ধর্মের উপযোগিতা নামে প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক ডকিন্স একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন[৩০২]।
ডকিন্সের লেখাটি থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা যাক। মানব সভ্যতাকে অনেকে শিশুদের মানসজগতের সাথে তুলনা করেন। শিশুদের বেঁচে থাকার প্রযোজনেই একটা সময় পর্যন্ত অভিভাবকদের সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলতে হয়-এ আমরা জানি। ধরা যাক একটা শিশু চুলায় হাত দিতে গেল, ওমনি তার মা বলে উঠল- ‘চুলায় হাত দেয় না, ওটা গরম!, ওটা গরম! শিশুটা সেটা শুনে আর হাত দিল না, বরং সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিল। মার কথা শুনতে হবে-এই বিশ্বাস পরম্পরায় আমরা বহন করি-নইলে যে আমরা টিকে থাকতে পারব না, পারতাম না। এখন কথা হচ্ছে-সেই। ভালো মা-ই যখন অসংখ্য ভালো উপদেশের পাশাপাশি আবার কিছু মন্দ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপদেশও দেয় ‘শনিবার ছাগল বলি না দিলে অমঙ্গল হবে’; কিংবা ‘রসগোল্লা থেযে অংক পরীক্ষা দিতে যেও না। গেলে গোল্লা পাবে’ জাতীয়-তখন শিশুর পক্ষে সম্ভব হয় না সেই মন্দ বিশ্বাসকে অন্য দশটা বিশ্বাস কিংবা ভালো উপদেশ থেকে আলাদা করার। সেই মন্দ বিশ্বাসও বংশপরম্পরায় সে বহন করতে থাকে অবলীলায়। সব বিশ্বাস খারাপ নয়, কিন্তু অসংখ্য মন্দ বিশ্বাস হয়ত অনেক সময় জন্ম দেয় বিশ্বাসের ভাইরাসের’। এগুলো একটা সময় প্রগতিকে থামাতে চায়, সভ্যতাকে ধ্বংস করে। উদাহরণ হিসেবে, ডাইনি পোড়ানো, সতীদাহ, বিধর্মী এবং কাফেরদের প্রতি ঘৃণা, মুরতাদ হত্যার কথা বলা যায়।
.
বিশ্বাসের ভাইরাস
‘বিশ্বাসের ভাইরাস ব্যাপারটা এই সুযোগে আর একটু পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। একটা মজার উদাহরণ দেই ড্যানিয়েল ডেনেটের সাম্প্রতিক ‘ব্রেকিং দ্য স্পেল বইটি থেকে[৩০৩]। আপনি নিশ্চয়ই ঘাসের ঝোপে কিংবা পাথরের উপরে কোনো পিঁপড়াকে দেখেছেন-সারাদিন ঘাসের নিচ থেকে ঘাসের গা বেয়ে কিংবা পাথরের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়, তারপর আবার ঝপ করে পড়ে যায় নিচে, তারপর আবারও গা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে-এই বেআক্কেল কলুর বলদের মতো পশুশ্রম করে পিপড়াটি কী এমন বাড়তি উপযোগিতা পাচ্ছে যে,এই অভ্যাসটা টিকে আছে? কোনো বাড়তি উপযোগিতা না পেলে সারাদিন সে এই অর্থহীন কাজ করে সময় এবং শক্তি ব্যয় করার তো কোনো মানে হয় না। আসলে সত্যি বলতে কী, এই কাজের মাধ্যমে পিঁপড়াটি বাড়তি কোনো উপযোগিতা তো পাচ্ছেই না, বরং ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। গবেষণায় দেখা গেছে পিঁপড়ার মগজে থাকা ল্যাংসেট ক্লক নামে এক ধরনের প্যারাসাইট এর জন্য দায়ী। এই প্যারাসাইট বংশবৃদ্ধি করতে পারে শুধু তখনই যখন কোনো গরু বা ছাগল একে ঘাসের সাথে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। ফলে প্যারাসাইটটা নিরাপদে সেই গরুর পেটে গিযে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই এখন জলের মতো পরিষ্কার-যাতে পিপড়াটা কোনোভাবে গরুর পেটে ঢুকতে পারে সেই দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঘাস বেয়ে তার ওঠানামা। আসলে ঘাস বেয়ে ওঠানামা পিঁপড়ার জন্য কোনো উপকার করছে না বরং ল্যাংসেট ফুক কাজ করছে এক ধরনের ভাইরাস হিসেবে-যার ফলে পিঁপড়া বুঝে বা না বুঝে, তার দ্বারা চালিত হচ্ছে।
ছবি। পেজ ৩৫৭
চিত্র : ল্যাংসেট ফুক নামের প্যারাসাইটের কারণে পিঁপড়ার মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন পিঁপড়া কেবল চোখ বন্ধ করে পাথরের গা বেয়ে ওঠানামা করে। ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও কি মানুষের জন্য একেকটি প্যারাসাইট?
এধরনের আরও কিছু উদাহরণ জীববিজ্ঞান থেকে হাজির করা যায়। নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম (বৈজ্ঞানিক নাম Spinochordodes tellinii) নামে এক ফিতাকৃমি সদৃশ প্যারাসাইট আছে যা ঘাসফড়িং-এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেললে ঘাসফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এর ফলে নেমাটোমর্ফ হ্যেরওয়ার্মের প্রজননে সুবিধা হয়। অর্থাৎ নিজের প্রজননগত সুবিধা পেতে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম বেচারা ঘাসফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে[৩০৪]। এছাড়া জলাতঙ্ক রোগের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। পাগলা কুকুর কামড়ালে আর উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু মস্তিষ্ক অধিকার করে ফেলে। ফলে আক্রান্ত মস্তিষ্কের আচরণও পাগলা কুকুরের মতোই হয়ে ওঠে। আক্রান্ত ব্যক্তি অপরকে কামড়াতেও যায়। অর্থাৎ ভাইরাসের সংক্রমণে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
আমাদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা প্রথাগত বিশ্বাসের ভাইরাসগুলোও কি আমাদের এভাবে আমাদের অজান্তেই বিপথে চালিত করে না? আমরা আমাদের বিশ্বাস রষ্কার জন্য প্রাণ দেই, বিধর্মীদের হত্যা করি, টুইন টাওয়ারের ওপর হামলে পড়ি, সতী নারীদের পুড়িয়ে আত্মতৃপ্তি পাই, বেগানা মেয়েদের পাথর মারি। মনোবিজ্ঞানী ড্যারেল রে US ‘The God Virus : How religion infects our lives and culture’ বইয়ে বলেন, জলাতঙ্কের জীবাণু দেহের ভেতরে ঢুকলে যেমন মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যায়, ঠিক তেমনই ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও মানুষের চিন্তাচেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তৈরি হয় ভাইরাস আক্রান্ত মননের। ড্যারেল রে তার বইয়ে বলেন[৩০৫]–
Virtually all religion rely upon early childhood indoctrination as the prime infection strategy… Biological virus strategies bear a remarkable resemblance to method of religious propagation. Religious conversion seems to affect personally. In the viral paradigm, the God virus infects and takes over critical thinking capacity of individual with respect to his or her own religion, much as rabies affects specific parts of the central nervous system.
নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম যেমনিভাবে ঘাসফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে, ঠিক তেমনই আমরা মনে করি ধর্মের বিভিন্ন বাণী এবং জিহাদি শিক্ষা মানবসমাজে অনেকসময়ই ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইটের মতো সংক্রমণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী করে তোলে। ফলে আক্রান্ত সন্ত্রাসী মনন বিমান নিয়ে আছড়ে পড়ে টুইন টাওয়ারের ওপর। নাইন ইলেভেনের বিমান হামলায় উনিশ জন ভাইরাস আক্রান্ত মনন ঈশ্বরের কাজ করছি এই প্যারাসাইটিক ধারণা মাথায় নিয়ে হত্যা করেছিল প্রায় তিন হাজার সাধারণ মানুষকে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অধ্যাপক ব্রুস লিংকন, তার বই ‘হলি টেররস : থিংকিং অ্যাবাউট রিলিজিয়ন আফটার সেপ্টেম্বর ইলেভেন’ বইয়ে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে বলেন, ‘ধর্মই মুহাম্মদ আতাসহ আঠারো জনকে প্ররোচিত করেছিল এই বলে যে, সংগঠিত বিশাল হত্যাযজ্ঞ শুধু তাদের কর্তব্য নয়, বরং স্বর্গ থেকে আগত পবিত্র দায়িত্ব[৩০৬]। হিন্দু মৌলবাদীরাও একসময় ভারতে রামজন্মভূমির অতিকথনের ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। এধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাস থেকে হাজির করা যাবে, ভাইরাস আক্রান্ত মনন কীভাবে কারণ হয়েছিল সভ্যতা ধ্বংসের।
ছবি। পেজ ৩৬০
চিত্র : বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামে এক প্যারাসাইটের সংক্রমণে ঘাসফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে (বামে), ঠিক একইভাবে বিশ্বাসের ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত আল কায়দার ১৯ জন সন্ত্রাসী যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল টুইন টাওয়ারের ওপর ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর (ডানে)। বিশ্বাসের ভাইরাসের বাস্তব উদাহরণ।
১১ই সেপ্টেম্বরের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার পরে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স ফ্রি এনকোয়েরি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘Design for a Faith-Based Missile নামে। তিনি সেই প্রবন্ধে আত্মঘাতী সন্ত্রাসীদের বিশ্বাস নির্ভর (ভাইরাসাক্রান্ত) মিসাইল হিসেবে অভিহিত করে লেখেন[৩০৭]–
There is no doubt that the afterlife-obsessed suicidal brain really is a weapon of immense power and danger. It is comparable to a smart missile, and its guidance system is in many respects superior to the most sophisticated electronic brain that money can buy. Yet to a cynical government, organization, or priesthood, it is very very cheap.
২০১০ সালে প্রকাশিত বই ‘সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’-এ দেখানো হয়েছে সমকামের প্রতি অহেতুক ঘৃণা-বিদ্বেষ তৈরিতেও ধর্মের বিশাল ভূমিকা আছে। প্রথম দিকের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ধর্মগুলো এত প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ছিল না বলে সমকামের প্রতি বিদ্বেষ এত তীব্রভাবে অনুভূত হয় নি। ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পর থেকেই পাদ্রি, পুরোহিত মোল্লারা ঢালাওভাবে সমকামিতাকে ‘ধর্মবিরুদ্ধ যৌনাচার’, ‘মহাপাপ’, ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিকৃতি’ প্রভৃতি হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করে এবং এর ধারাবাহিকতায় শুরু হয় পৃথিবী জুড়ে সমকামীদের ওপর লাগাতার নিগ্রহ এবং অত্যাচার[৩০৮]। এটাকে ভাইরাস আক্রান্ত মনন ছাড়া আর কী বলা যায়?
ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে আবারও ফিরে তাকাই। ইসলামি সন্ত্রাসবাদ লালন-পালনে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিশাল অবদান আছে, এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু তারপরেও কেবল আমেরিকার দিকে অঙ্গুলি তুলে ধর্মগ্রন্থগুলোকে কখনোই ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ বানানো যায় না। ধর্মগ্রন্থের যে অংশগুলোতে জিহাদের কথা আছে (২ : ২১৬, ২ : ১৫৪), উদ্ভিন্নযৌবনা হুরিদের কথা আছে (৫২ : ১৭-২০, ৪৪ : ৫১-৫৫, ৫৬ : ২২), ‘মুক্তা সদৃশ’ গেলমানদের কথা আছে (৫২ : ২৪, ৫৬ : ১৭, ৭৬ : ১৯) সেসমস্ত ‘পবিত্র বাণীগুলো ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে কিংবা বছরের পর বছর। সৌদি পেট্রোডলারে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা নামক আগাছার চাষ করে বিভিন্ন দেশে তরুণ সমাজের কিছু অংশের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাসের ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে। ফলে এই ভাইরাস-আক্রান্ত জিহাদিরা স্বর্গের ৭২টা হুর-পরীর আশায় নিজের বুকে বোমা বেঁধে আত্মাহুতি দিতেও আজ দ্বিধাবোধ করে না; ইহুদি, কাফের, নাসারাদের হত্যা করে ‘শহীদ’ হতে তারা কার্পণ্যবোধ করে না। ল্যাংসেট ফুক প্যারাসাইটের মতো তাদের মনও কেবল একটি বিশ্বাস দিয়ে চালিত অমুসলিম কাফেরদের হত্যা করে সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম করতে হবে, আর পরকালে পেতে হবে আল্লাহর কাছ থেকে উদ্ভিন্নযৌবনা আয়তলোচনা হুর পরীর লোভনীয় পুরস্কার। তারা ওই ভাইরাস আক্রান্ত পিঁপড়ার মতো হামলে পড়ছে কখনও টুইন টাওয়ারে, কখনও রমনার বটমূলে কিংবা তাজ হোটেলে।
কীভাবে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয়, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আধুনিক মিম তত্বকে। মিম নামের পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে, তার বিখ্যাত বই ‘দ্য সেলফিশ জিন’-এ[৩০৯]। আমরা তো জিন-এর কথা ইদানীং অহরহ শুনি। জিন হচ্ছে মিউটেশন, পুনর্বিন্যাস ও শারীরবৃত্তিক কাজের জন্য আমাদের ক্রোমোজোমের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য একক। সহজ কথায়, তিন জিনিসটা হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের অখণ্ড একক যা বংশগতিয় তথ্যকে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়। জিন যেমন আমাদের শারীরবৃত্তীয় তথ্য বংশ পরম্পরায় বহন করে, ঠিক তেমনই সাংস্কৃতিক তথ্য বংশপরম্পরায় বহন করে নিয়ে যায় ‘মিম। কাজেই ‘মিম’ হচ্ছে আমাদের ‘সাংস্কৃতিক তথ্যের একক’, যা ক্রমিক অনুকরণ বা প্রতিলিপির মাধ্যমে একজনের মন থেকে মনান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক যেভাবে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের একক জিন ছড়িয়ে পড়ে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে। যে ব্যক্তি মিমটি বহন করে তাদের মিমটির ‘হোস্ট’ বা বাহক বলা যায় ‘মিমপ্লেক্স’ হলো একসাথে বাহকের মনে অবস্থানকারী পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একদল ‘মিম। কোনো বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতি-নীতি, কোনো দেশীয় সাংস্কৃতিক বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ-এগুলো সবই মিমপ্লেক্সের উদাহরণ। সুজন ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে মিমপ্লেক্সের অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন। সুজান ব্ল্যাকমোর মনে করেন জিন এবং মিমের সুগ্রন্থিত সংশ্লেষই মানুষের আচার ব্যবহার, পরার্থতা, যুদ্ধংদেহী মনোভাব, রীতি-নীতি কিংবা কুসংস্কারের অস্তিত্বকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। মিম নিয়ে মুক্তমনা সাইটে দিগন্ত সরকার বাংলায় চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, সেটি রাখা আছে মুক্তমনায় প্রকাশিত ই-বই ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়’-এ[৩১০]। এই ই-বইটিতে দিগন্ত সরকার ধর্মের উৎস সন্ধানে নামের বাংলা প্রবন্ধটিতে মিমবিন্যাসের আলোকে ধর্মের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা মূলত ডকিন্স এবং সুজন ব্ল্যাকমোরের মিম নিয়ে আধুনিক চিন্তাধারারই অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশ[৩১১]। সম্প্রতি মুক্তমনা ব্লগে ব্লগার স্বাধীন একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন ‘জিন এবং মিম’ শিরোনামে। তিনিও তার প্রবন্ধের মাধ্যমে মিমের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন বাঙালি পাঠকদের জন্য। এছাড়া অন্য বাংলা ব্লগগুলোতেও সম্প্রতি মিম নিয়ে ভালো লেখা উঠে আসছে।
কোনো সাংস্কৃতিক উপাদান কিংবা কোনো বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস কীভাবে মিমের মাধ্যমে জনপুঞ্জে ছডিযে পড়ে? মানুষের মস্তিষ্ক এক্ষেত্রে আসলে কাজ করে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার যেভাবে কাজ করে অনেকটা সেরকমভাবে। আর মিমগুলো হচ্ছে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের মধ্যে ইন্সটল করা সফটওয়্যার যেন। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সফটওয়্যারগুলো ভালোমতো চলতে থাকে ততক্ষণ তা নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা থাকে না। কিন্তু কখনও কখনও কোনো কোনো সফটওয়্যার ভালো মানুষের (নাকি ‘ভালো মিমের’ বলা উচিত) ছদ্মবেশ নিয়ে ট্রোজান হর্স’ হয়ে ঢুকে পড়ে। এরাই আসলে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো। এরা সুচ হয়ে ঢোকে, আর শেষ পর্যন্ত যেন ফাল হয়ে বেরোয়। যতক্ষণে এই ভাইরাসগুলোকে শনাক্ত করে নির্মূল করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়-ততক্ষণে আমাদের হার্ডওয়্যারের দফারফা সারা। এই বিশ্বাসের ভাইরাসের বলি হয়ে প্রাণ হারায় শত সহস্র মানুষ-কখনও নাইন-ইলেভেনে, কথনোবা বাবরি মসজিদ ধ্বংসে, কখনোবা তাজ হোটেলে গোলাগুলিতে। Viruses of the Mind শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স দেখিয়েছেন কীভাবে কম্পিউটার ভাইরাসগুলোর মতোই আপাত মধুর ধর্মীয় শিক্ষাগুলো সমাজের জন্য ট্রোজান হর্স কিংবা ওয়ার্ম ভাইরাস হিসেবে কাজ করে তিলে তিলে এর কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। আরও বিস্তৃতভাবে জানবার জন্য পাঠকেরা পড়তে পারেন সাম্প্রতিক সময়ে রিচার্ড ব্রডির লেখা ‘ভাইরাস অফ মাইন্ড কিংবা ক্রেগ জেমসের লেখা ‘দ্য রিলিজিয়ন ভাইরাস’ নামের বইগুলো[৩১২]। এ বইগুলো থেকে বোঝা যায় ভাইরাস আক্রান্ত মস্তিষ্ক কী শান্তভাবে রোবটের মতো ধর্মের আচার আচরণগুলো নির্দ্বিধায় পালন করে যায় দিনের পর দিন, আর কখনো-সখনো বিধর্মী নিধনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে; একসময় দেখা দেয় আত্মঘাতী হামলা, জিহাদ কিংবা ক্রুসেডের মহামারী।
.
ভাইরাস আক্রান্ত মনন
ভাইরাস আক্রান্ত মন-মানসিকতার উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে ঢের। কিছু উদাহরণ তো দেওয়াই যায়। এই ধরনের ভাইরাস-আক্রান্ত মননের সাথে বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা এই বইয়ের দুজন লেখকেরই কম বেশি আছে। তার কিছু কিছু বর্ণনা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে (ধর্মীয় নৈতিকতা) রাখা হয়েছে। ব্লগ সাইটে বিতর্ক করতে গেলে ব্যাপারটা ভালো বোঝা যায়। আপনি যত ভালো যুক্তি দেন না কেন, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, নৃতত্ব এবং সমাজবিজ্ঞান থেকে যত আধুনিক এবং অথেনটিক গবেষণারই উল্লেখ করুন না কেন, তারা চির আরাধ্য ধর্মগ্রন্থকে মাথায় করে রাখবেন আর আপনার প্রতি গালি গালাজের বন্যা বইয়ে দেবেন। এই ধরনের অভিজ্ঞতা শুধু আমাদের নয়, ইন্টারনেটে যারা বিজ্ঞান, যুক্তিবাদিতা, সংশয়বাদিতা প্রভৃতি নিয়ে লেখালেখি করেন সেরকম অনেক লেখকেরই আছে।
এই ভদ্রলোকেরা হত ভাইরাস আক্রান্ত মননের খুব ছোট উদাহরণ। কিন্তু ভাইরাস আক্রান্ত মননের চরম উদাহরণগুলো হাজির করলে বোঝা যাবে কীভাবে এ ধরনের মানসিকতাগুলো সমাজকে পঙ্গু করে দেয়, কিংবা কীভাবে সমাজের প্রগতিকে থামিয়ে দেয়। এর অজস্র উদাহরণ পৃথিবী জুড়ে পাওয়া যাবে। কিছু প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, যখন কোনো নতুন প্রাসাদ কিংবা ইমারত তৈরি করা হতো, তার আগে সেই জায়গায় শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো-এই ধারণা থেকে যে, এটি প্রাসাদের ভিত্তি মজবুত করবে। অনেক আদিম সমাজেই বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুমারী উৎসর্গ করার বিধান ছিল; কেউ কেউ সদ্য জন্মলাভ করা শিশুদের হত্যা করত, এমনকি খেয়েও ফেলত। কোনো কোনো সংস্কৃতিতে কোনো বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে অন্য মহিলা এবং পুরুষদেরও তার সাথে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, যাতে তারা পরকালে গিযে পুরুষটির কাজে আসতে পারে। ফিজিতে ‘ভাকাতোকা’ নামে এক ধরনের বীভৎস। রীতি প্রচলিত ছিল যেখানে একজনের হাত-পা কেটে ফেলে তাকে দেখিয়ে দেখিযে সেই কর্তিত অঙ্গগুলো খাওয়া হতো। আফ্রিকার বহু জাতিতে হত্যার রীতি চালু আছে মৃত–পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য। এগুলো সবই মানুষ করেছে ধর্মীয় রীতি নীতিকে প্রাধান্য দিতে গিযে, অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিযে। এধরনের ধর্মীয় হত্যা’ সম্বন্ধে আরও বিস্তৃতভাবে জানার জন্য ডেভিড নিগেলের ‘Human Sacrifice : In History And Today’ বইটি পড়া যেতে পারে। এগুলো সবই সমাজে বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামক আগাছার চাষ ছাড়া আর কিছু নয়।
ইতিহাসের পরতে পরতে অজস্র উদাহরণ লুকিয়ে আছে কীভাবে বিশ্বাসের ভাইরাসগুলো আণবিক বোমার মতোই মারণাস্ত্র হিসেবে কাজ করে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ধর্মযুদ্ধগুলোই তো এর বাস্তব প্রমাণ। কিছু নমুনা দেখা যাক[৩১৪]—
বলা নিষ্প্রয়োজন, উপরের লিস্টটি কেবল বিগত কয়েক শতকের কতিপয় ধর্মীয় সহিংসতার আলোকচ্ছটা মাত্র, সিন্ধুর বুকে বিন্দুসম। ধর্মীয় সহিংসতার পুরো ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে গেলে তা নিঃসন্দেহে মহাভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে। অন্ধবিশ্বাস নামক ভাইরাসগুলো কীভাবে সন্ত্রাসবাদী তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়-তার কিছু উদাহরণ আমরা আগেই রেখেছি এই বইয়ের পূর্ববর্তী ‘ধর্মীয় নৈতিকতা’ অধ্যায়ে। সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম, ধর্মগ্রন্থের ভালো ভালো বাণীগুলো থেকে ভালোমানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা পায় কেউ, আবার সন্ত্রাসবাদীরা একই ধর্মগ্রন্থের ভায়োলেন্ট ভার্সগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পায় সন্ত্রাসী হওয়ার। সেজন্যই তো ধর্মগ্রন্থগুলো-একেকটি ট্রোজান হর্স-ছদ্মবেশী ভাইরাস! এজন্যই একই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে কেউ ইহুদি নাসারাদের সাথে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিন লাদেন’ হয়ে যায়, আবার কেউবা পরিণত হয় সুফি সাধকে। কী করে হলফ করে বলা যাবে যে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া নিচের ভাইরাসরূপী আয়াতগুলো সত্যিই জিহাদি সৈনিকদের সন্ত্রাসবাদে উৎসাহিত করছে না? পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ধৃত করা যাক–
তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে… (২ : ২২১৬)।
আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে থাকুন, আপনি নিজের সত্ত্বা ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের জিম্মাদার নন! আর আপনি মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করতে থাকুন (৪ : ৪৪)।
হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না; তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না (৫ : ৫১)।
যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (কোরআন ৩ : ৮৫)।
আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে। যায় (৮ : ৩৯)।
তোমরা যুদ্ধ করো আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তার রাসুল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিজিয়া প্রদান করে (৯ : ২৯)।
অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দান মারো, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত করো তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ করো, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ লও।…. যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, আল্লাহ কখনোই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না(৪৭ : ৪)।
অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অত: পর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও করো এবং যেখানে পাও হত্যা করো। তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং সাহায্যকারী বানিও না (৪ : ৪৯)।
আর তাদেরকে হত্যা করো যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে … (২: ১৯১)
আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই করো, যে পর্যন্ত না। ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। (২: ১৯৩)।
আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের ওপর আঘাত হানো এবং তাদেরকে কাটো জোড়ায় জোড়ায় (৮ : ১২)।
অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা করো যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দি করো এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁত পেতে বসে থাকো (৯ : ৫)।
যদি বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদের মর্মন্তুদ আজাব দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন (৯ : ৩৯) …ইত্যাদি।
অনেক ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীরা বলেন, কোরআন কখনও সন্ত্রাসবাদে কাউকে উৎসাহিত করে না, কাউকে আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্ররোচিত করে না, ইত্যাদি। এটা সত্যি সরাসরি হয়ত কোরআনে বুকে পেটে বোমা বেধে কারো উপরে হামলে পড়ার কথা নেই; কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, কোরআন খুললেই পাওয়া যায়-যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, আল্লাহ কখনোই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না (৪৭ : ৪), কোরআনে বলা হয়েছে আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনও মৃত মনে করো না (৩ : ১৬৯); কিংবা বলা। হয়েছে-যদি আল্লাহর পথে কেউ যুদ্ধ করে মারা যায় তবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত (৯ : ১১১)।
আর আল্লাহর পথে শহীদদের জন্য জান্নাতের পুরস্কার কেমন হবে? আল্লাহ কিন্তু এ ব্যাপারে খুব পরিষ্কার তথায় থাকবে আনতন্যনা রমণীগণ, কোনো জিন ও মানব পূর্বে যাদের ব্যবহার করে নি (৫৫ : ৫৬)। তাদের কাছে থাকবে নত, আয়তলোচনা তরুণীগণ, যেন তারা সুরক্ষিত ডিম (৩৭ : ৪৮-৪৯); সুশুভ্র (wine) যা পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু (৩৭ : ৪৬)।
আমি তাদেরকে আয়তলোচনা হুরদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দেব (৫২ : ২) …
তাবুতে অবস্থানকারিণী হুরগণ (৫৫ : ৭২); প্রবাল ও পদ্মরাগ সদৃশ রমণীগণ (৫৫ : ৫৮)।
উদ্যান, আঙ্গুর, পূর্ণযৌবনা তরুণী এবং পূর্ণ পানপাত্র (৭৮ : ৩৩-৩৪)।
তথায় থাকবে আনতনয়না হুরিগণ, আবরণে রক্ষিত মোতির ন্যায়, (৫৬ : ২২-২৩)।
আমি জান্নাতি রমণীগণকে বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর তাদেরকে করেছি চিরকুমারী (৫৬ : ৩৫ ৩)।
শুধু আয়তলোচনা চিরকুমারীদের লোভ দেখিযেই আল্লাহ ক্ষান্ত হন নি, ব্যবস্থা রেখেছেন গেলমানদেরও—
সুরক্ষিত মোতিসদৃশ কিশোররা তাদের খেদমতে ঘোরাফেরা করবে (৫২ : ২৪)। ইত্যাদি।
বেহেস্তে সুরা-সাকি-হুর-পরীর এমন অফুরন্ত ভাণ্ডারের গ্রাফিক বর্ণনা দেখে দেখে অনেকেরই শহীদ হতে মন চাইবে! বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানী সাতোসি কানাজাওয়া তো মনেই করেন ইসলামি সমাজে বহুগামিত্ব এবং পাশাপাশি মৃত্যুর পরে উদ্ভিন্নযৌবনা এবং চিরকুমারী হুরিদের অফুরন্ত ভাণ্ডারের নিশ্চয়তার কারণেই মুসলিমদের মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের এত আধিক্য চোখে পড়ে[৩১৫]।
কেবল ইসলামের জিহাদি সৈনিকেরাই ভাইরাস আক্রান্ত মননের উদাহরণ ভাবলে ভুল হবে। বিশ্বাসের ভাইরাস’ লেখাটি মুক্তমনায় প্রকাশের পর দিগন্ত সরকার ‘বিশ্বাসের ভাইরাস এবং আনুষঙ্গিক’ নামের একটি সম্পূরক প্রবন্ধে ভারতের আর. এস. এস পরিচালিত স্কুলগুলোর পাঠ্যসূচির নানা উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন কীভাবে ছেলেপিলেদের মধ্যে শৈশবেই ভাইরাসের বীজ বপন করা হয়[৩১৬]। বিদ্যাভারতী নামের এই স্কুল সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে-সংখ্যায় প্রায় ২০,০০০। প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী এতে পড়াশোনা করে-যাদের অধিকাংশই গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের। পড়াশোনা চলে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি। তিস্তা সেতালবাদের প্রবন্ধ In the Name of History Examples from Hindutva-inspired school textbooks in India থেকে[৩১৭] অসংখ্য দৃষ্টান্ত হাজির করে দিগন্ত দেখিয়েছেন কীভাবে সত্য মিথ্যের মিশেল দেওয়া ইতিহাস পড়িযে এদের মগজ ধোলাই করা হয়–
‘‘হোমার বাল্মীকির রামায়ণের একটা ভাবানুবাদ করেছিলেন-যার নাম ইলিয়াডা’ ‘প্লেটো ও হেরোডোটাসের মতে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ভারতীয় ভাবধারার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।
‘গরু আমাদের সকলের মাতৃস্থানীয়, গরুর শরীরে ভগবান বিরাজ করেন।
একই স্কুলের ভারতের ম্যাপে ভারতকে দেখানো হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, তিব্বত এমনকি মায়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে বলা হয় অশোকের অহিংস নীতির ফলে তার সেনাবাহিনী যুদ্ধে উৎসাহ হারিয়েছিল। আলেকজান্ডার নাকি পুরুর কাছে যুদ্ধে হেরে গিযে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন।
মধ্যযুগের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার উগ্ররূপ আর বেশি প্রকট। সমগ্র ইতিহাস শিক্ষায় মুসলিমদের বিদেশি শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছেঃ
‘ভারতে বিদেশি মুসলিম শাসন
‘ভারতে তলোয়ার ধরে ইসলামের প্রচার হয়েছিল। মুসলিমেরা এক হাতে কোরআন আরেক হাতে তরবারি নিয়েই এসেছিল এদেশে … আমরা তাদের পরে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আমাদের যে ভাইযেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।”
‘হিন্দুরা চরম অপমানের সাথে তুর্কি শাসন মেনে নিয়েছিল।
‘বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, পর্দাপ্রথাসহ আরও অনেক কুসংস্কার মুসলিম রাজত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিন্দুসমাজে স্থান করে নিয়েছে’
‘শিবাজী আর রানা প্রতাপ ছিলেন প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী। তারা মুসলিমদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্যই লড়াই করেছিলেন।’’
ভারতের স্কুলের পাঠ্য পুস্তকগুলোতে বিন কাশিম, ঘৌরী বা গজনীর মাহমুদ বা তৈমুর লং কীভাবে হিন্দুদের হত্যা করেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা হাজির করে বাচ্চাদের মাথায় অঙ্কুরেই ‘মুসলিম বিদ্বেষ প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। দেশ বিভাগের জন্য একতরফাভাবে মুসলিমদের দায়ী করে ইতিহাস লেখা হয়। আর. এস. এস-এর মতো সন্ত্রাসবাদী সাম্প্রদায়িক দলকে প্রকৃত স্বাধীনতাকামী একটি সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হয়। সব থেকে মজার কথা, মহাত্মা গান্ধী যে এই সংগঠনের একজনের হাতেই মারা গিয়েছিলেন, সেকথাও বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। সামগ্রিকভাবে, পাঠক্রম এমনভাবে সাজানো যাতে সবার মধ্যে ভাব সৃষ্টি হয় যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মুসলিম ও খ্রিস্টানদের হাতে অত্যাচারিত। তাদের ঘাড়ে দায়িত্ব বর্তায় তার প্রতিশোধ নেওয়ার।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর সেইদিন প্রায় ৫০ জন জঙ্গি মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসবাদের যে তুঘলকি কাণ্ড শুরু করেছিল সেদিন এই বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে আমরা মুক্তমনায় দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। বিশ্বাসের বাইরেও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যুসহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল বিস্তৃত পরিসরে উঠে এসেছিল কাশ্মীর প্রসঙ্গ, উঠে এসেছিল ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের নানা উদাহরণ। এটা ঠিক যে, কাশ্মীরী জনগণের ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাগাতার অত্যাচার, বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাটে সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের ওপর যে ধরনের অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে তা ভুলে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। মুসলিমরা ভারতের জনগণের প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ তারাই ভারতে সবচেয়ে নিপীড়িত, অত্যাচারিত এবং আর্থসামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী। এ সমস্ত অনেক কারণ মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করেছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু এটাও ঠিক, পৃথিবীতে সামাজিক অবিচার যেমন আছে, তেমন আছে সামাজিক অবিচারের নামে অন্ধবিশ্বাসের চাষ এবং তার প্রচার। ধর্মগ্রন্থের জিহাদি বাণীগুলো কিংবা সুচতুর উপায়ে বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে মগজ ধোলাইযের উদাহরণগুলো এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব জামান আমাদের সাইটে প্রবন্ধটি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে যা বলেছেন তা হয়ত অনেকের মনেই চিন্তার খোরাক জোগাবে। তিনি বলেন–
মানুষের কোনো কোনো স্বভাব যেমন উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় বিশেষ কোনো বংশাণুর পরিস্ফুটনের কারণে সৃষ্ট হয়, তেমনই মৌলবাদী সন্ত্রাসও ঘটতে পারে কোনো কোনো ধর্মীয় আদেশাবলীর উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় পরিস্ফুটিত হওয়ার কারণে। এই উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করতে পারে অনেক কারণ, যার মধ্যে সামাজিক অনাচার অবশ্যই অন্যতম। কিন্তু শুধু সামাজিক অনাচার থাকলেই যে মৌলবাদী সন্ত্রাস ঘটবে এটা নিশ্চিত না। বংশাণুর মতো একটা মূল কারণও থাকতে হবে (মৌলবাদী সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে যা হতে ধর্মগ্রন্থের কোনো কোনো শ্লোক, কিংবা জাতিবিদ্বেষী বিকৃত ইতিহাস চর্চা)। আর এই ধর্মীয় বংশাণু কেবল সামাজিক অনাচারেই পরিস্ফুটিত হয়-তাও হলফ করে বলা যাবে না। কোনো কোনো ধর্মের আদেশাবলী এতই শক্তিশালী যে বিভিন্ন পরিস্ফুটক পরিবেশ অতি সহজেই সৃষ্ট হয় আদেশাবলীর জোরালো তাগিদেই। আর ধর্মীয় মূল কারণ না থাকলে সামাজিক অনাচার অন্যরকম সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। আবার নাও দিতে পারে।
থাইল্যান্ডে অতি গরিব বৌদ্ধরা ভিক্ষা করবে কিন্তু কখনও হিংসায় লিপ্ত হবে না। অনেক গরিব লোক চরম দারিদ্রের মধ্যেও সততা বিসর্জন দেয় না। তিব্বতিদের ওপর অত্যাচার হয়েছে অনেক বেশি। কিন্তু তিব্বতের লোকেরা হিংসার আশ্রয় নিয়ে সন্ত্রাসবাদী হয় নি। কাজেই এটা কখনোই বলা যায় না যে সামাজিক অনাচারই ধর্মীয় সন্ত্রাসের মূল কারণ, বরং বলা যায় অনুঘটক মাত্রা।
.
বিশ্বাস এবং বুদ্ধিমত্তা
বহুদিন ধরেই এ ব্যাপারটা প্রচলিত যে, অবিশ্বাসীরা সাধারণত বিশ্বাসীদের চেয়ে অধিকতর বুদ্ধিদীপ্ত এবং স্মার্ট হয়ে থাকে। সম্প্রতি বিভিন্ন বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের চালানো জরিপে চাঞ্চল্যকর কিছু ফল এবং ব্যাখ্যা উঠে এসেছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী সাতোসি কানাজাওযার চালানো সাম্প্রতিক গবেষণা (Social Psychology Quarterly, Vol. 73, No. 1, 33–57) থেকে জানা গেছে নাস্তিক (Atheist) এবং উদারপন্থীরা (Liberal) সাধারণত ধার্মিক (Theist) এবং রক্ষণশীলদের (Conservative) চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে থাকে। সোশাল সাইকোলজি কোয়ার্টারলি জার্নালে ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘Why Liberals and Atheists Are More Intelligent শীর্ষক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ধার্মিক হিসেবে দাবিদার ব্যক্তিদের চেয়ে নাস্তিকদের আইকিউ গড়পড়তা অন্তত ৬ পয়েন্ট বেশি থাকে, আর রক্ষণশীল গ্রুপের চেয়ে উদারপন্থী বা প্রগতিশীল গ্রুপের আইকিউ বেশি থাকে অন্তত ১২ পয়েন্ট[৩১৮]।
ছবি। পেজ ৩৯০
চিত্র : ধার্মিকতার প্রকোপ যত বাড়ে পাল্লা দিয়ে কমে আইকিউ। যেমন চরম নাস্তিকদের গড়পড়তা আইকিউ পাওয়া গেছে ১০৩.০৯ আর চরম ধার্মিকদের আইকিউ ৯৭.১৪। কাজেই নাস্তিক হিসেবে দাবিদার ব্যক্তিদের চেয়ে আস্তিকদের আইকিউ গড়পড়তা অন্তত ৬ পয়েন্ট কম থাকে।
ছবি। পেজ ৩৯১
চিত্র : রক্ষণশীল গ্রুপের চেয়ে উদারপন্থী বা প্রগতিশীল গ্রুপের আইকিউ অন্তত ১২ পয়েন্ট বেশি থাকে।
ব্যাপারটি অধ্যাপক কানাজাও বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন তার প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এবং ব্লগে[৩১৯,৩২০]। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, বিশ্বাস ব্যাপারটা একসময় টিকে থাকার ক্ষেত্রে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল, সেজন্য যেকোনো সংস্কৃতিতেই ধর্ম এবং বিশ্বাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, এবং যেকোনো সমাজেই ধার্মিকদের সংখ্যাও নাস্তিকদের চেয়ে সাধারণত বেশি (যদিও নাস্তিকদের সংখ্যা আধুনিক বিশ্বে ক্রমবর্ধমান)। আর আদিম ট্রাইবগুলোতে খুঁজলে দেখা যাবে সেখানে জাদুটোনা থেকে শুরু করে নরবলি, কুমারী নিধনসহ হাজারো অপবিশ্বাসের সমাহার। সে দিক থেকে চিন্তা করলে নাস্তিকতা, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, লিবারেলিজম প্রভৃতি উপাদানগুলো বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপটে মানবসমাজের জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন (evolutionarily novel) এবং যাদের মস্তিষ্ক এই নতুন নতুন পরিবর্তনগুলো ধারণ করার জন্য বেশি নমনীয়, তারাই বুদ্ধিদীপ্ত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেজন্যই নাস্তিকেরা আস্তিকদের থেকে বেশি স্মার্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ‘সাভানা অনুকল্প অনুযায়ী এটা ঘটে বলে গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে। সেজন্যই একজন বিশ্বাসী সারা প্যালিন কিংবা উইচ’ খ্যাত ক্রিস্টিন ওডেনেলের চেয়ে বৌদ্ধিক মননে একজন রিচার্ড ডকিন্স কিংবা একজন বিল মার অনেক এগিয়ে থাকেন আজকের দুনিয়ায়। সদালাপী’দের চেয়ে যুক্তিতে, বুদ্ধিতে আর সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রগামী থাকেন ‘মুক্তমনারা। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ফলাফলটি এসেছে ইউসিএসডি এবং হার্ভার্ডের সাম্প্রতিক একটা যৌথ গবেষণা থেকে যেখানে ডোপামিন নির্ভর DRD, জিনটিকে চিহ্নিত করা গেছে বলে দাবি করা হয়েছে, এবং যার একটা বিশেষ ভ্যারিযান্ট উদারপন্থীদের মাঝে দেখা যায়[৩২১]। এ জিনটিকে বহুল প্রচারিতভাবে ‘অভিনবত্ব অনুসন্ধানী জিন (novelty seeking gene) হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। যাদের মধ্যে এ জিনটির অস্তিত্ব আছে, তার একটা বড় অংশ পরিণত বয়সে উদারপন্থী মতাদর্শের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে একটা মজার বিষয় মনে পড়ল। আমেরিকার প্রচণ্ড রক্ষণশীল ফক্স চ্যানেলের নিউজ হোস্ট শন হ্যানিটি আর বিল ও রাইলি প্রতিদিনই মার্কিন জনগণকে মনে করিয়ে দেন যে কীভাবে লিবারেল মিডি’ সবকিছু অধিকার করে মগজ ধোলাই করছে! কথাটা যে খুব বেশি মিথ্যা তা অবশ্য নয়। হলিউড সিনেমা থেকে শুরু করে (ফক্স বাদে) প্রায় প্রতিটি নিউজ চ্যানেলই মোটামুটি লিবারেলদের দখলে বলা যায়।
পাশাপাশি শো বিজনেস, ক্রিযেটিভ রাইটিং, অ্যাক্টিভিজম থেকে শুরু করে অ্যাকাডেমিয়াও মোটামুটি লিবারেলরাই রাজত্ব করছে। আসলে এর কারণ খুব সহজ। মিডিয়া লিবারেলদের হাতে চলে যাচ্ছে কারণ রক্ষণশীলদের চেয়ে তারা বেশি বুদ্ধিমান, চৌকস, বুদ্ধিদীপ্ত এবং অধিকতর বেশি উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। বাংলাদেশেও কবি সাহিত্যিকসহ যারা শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির সাথে জড়িত থাকেন তাদের মধ্যে উদারপন্থী লোকের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে, এবং তাদের মধ্যেই অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বেশি পাওয়া যায়।
ছবি। পেজ ৩৯৩
ছবি। পেজ ৩৯৪
চিত্র : একজন প্রথাগত বিশ্বাসীর চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকেন একজন সচেতন নাস্তিক বৌদ্ধিক মনন, যুক্তি, বাস্তবতা এবং স্মার্টনেসে।
অবিশ্বাসীরা শুধু স্মার্ট নয়, গবেষণায় দেখা গেছে নৈতিক দিক দিয়েও অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। নাস্তিক এবং প্রগতিশীল পরিবারে শিশু নির্যাতন কম হয়, তারা নারী নির্যাতন কম করে থাকে, তাদের পরিবারে বিবাহ বিচ্ছেদের হার কম, তারা একগামী সম্পর্কে আস্থাশীল থাকে, তারা পরিবেশ সচেতন থাকে ধার্মিকদের চেয়ে ঢের বেশি। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি সচেতনতাও বিশ্বাসীদের তুলনায় নাস্তিকদের মধ্যে অনেক বেশি দেখা যায়। এর কারণ, অবিশ্বাসীরা সাধারণত যুক্তি, মানবতা এবং বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলো বিবেচনা করেন, অন্ধবিশ্বাসের বলে নয়।
.
বিশ্বাস ও দারিদ্র্য
বিশ্বাস শুধু মানসিকভাবেই ব্যক্তিকে পঙ্গু এবং ভাইরাস আক্রান্ত করে ফেলে না, পাশাপাশি এর সার্বিক প্রভাব পড়ে একটি দেশের অর্থনীতিতেও। সাম্প্রতিক বহু গবেষণায়ই বেরিয়ে এসেছে যে দারিদ্রের সাথে ধর্মবিশ্বাসের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। সম্প্রতি প্রকাশিত (অগাস্ট, ২০১০) গ্যালোপ জরিপ থেকে দেখা গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে হতদরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেই ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব সর্বাধিক[৩২২]। আপনার বিশ্বাস প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলে কিনা, এর ভিত্তিতে ২০০৯ সালে যে জরিপ চালানো হয়, তাতে দেখা যায়। পৃথিবীর সর্বাধিক দারিদ্রকিষ্ট দেশগুলো থেকেই ‘হ্যাঁ বাচক উত্তর উঠে এসেছে। আর তালিকাতে প্রথমেই আছে বাংলাদেশের নাম।
Is religion an important part of your daily life?
Bangladesh —Yes –99%+
Niger ——– ,, –99%+
Yemen——– ,, –99%
Indonesia—– ,, –99%
Malawi——- ,, –99%
Sri Lanka——,, –99%
Somaliland region— ,, –98%
Djibouti —— ,, –98%
Mauritania— ,, –98%
Burundi —– ,, –98%
2009 GALLUP
গ্যালোপ জরিপ থেকে দেখা গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে হতদরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেই ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব সর্বাধিক।
সম্প্রতি উপরের এই গ্যালোপ জরিপের ওপর ভিত্তি করে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বিশ্লেষণমূলক একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে[৩২৩]। কলামিস্ট চার্লস ব্লো সম্পাদকীয়টিতে বলেন–
একশটি দেশের মধ্যে ২০০৯ সালে গ্যালোপ জরিপ। চালানো হয়েছে এবং দেখা গেছে দারিদ্রের সাথে ধর্মবিশ্বাসের একটি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। ধনী দেশগুলো কম ধর্মপ্রবণ আর দরিদ্র দেশগুলোতেই ধর্মান্মোদনা বেশি দৃশ্যমান।
নিউইয়র্ক টাইমসের উক্ত প্রবন্ধটিতে চমৎকার একটি গ্রাফও সংযুক্ত হয়েছে, যেটি নিজেই দারিদ্রের সাথে ধর্মবিশ্বাসের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট–
ছবি। পেজ ৩৯৭
চিত্র : গ্যালোপ জরিপের ওপর ভিত্তি করে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বিশ্লেষণমূলক একটি সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত।
উপরের গ্রাফের গড়পড়তা পয়েন্টগুলোর ট্রেন্ড বিশ্লেষণে আনা যেতে পারে। যদি কেউ কোনো দেশের ধর্মীয় প্রভাব এবং পার ক্যাপিটা গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্টের প্লট একটি বক্ররেখার মাধ্যমে তুলে ধরেন তবে রেখচিত্রটি দাঁড়াবে অনেকটা এরকম–
ছবি। পেজ ৩৯৮
চিত্র : দেশের ধর্মীয় প্রভাব বনাম পার ক্যাপিটা জিডিপির প্লট
এই গ্রাফটি নিয়ে আমরা মুক্তমনা ব্লগে অনেক আলোচনা করেছি। এটি অধ্যাপক ভিক্টর স্টেরের ‘নিউ এথিজম’ বইয়ে আছে। ইন্টারনেটেও অনেক সাইটে গ্রাফটি পাওয়া যাবে[৩২৪]।
গ্রাফটি লক্ষ্য করলেই পাঠকেরা দেখবেন যে, আমেরিকা এবং কুয়েতের মতো দুযেকটি দেশ ছাড়া বাকি সব কমবেশি দেশই এই গ্রাফের কোরিলেশন সমর্থন করে। আমেরিকা অন্যতম সচ্ছল দেশ (গড় জিডিপি $৪৬,০০০) হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের প্রভাব বেশি। ধনসম্পদে শীর্ষস্থানীয় দেশ হওয়া সত্বেও দেশটির ধর্মীয় প্রভাবের পরিমাপ দারিদ্রক্লিষ্ট মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা কিংবা চিলির সারিতে রয়ে গেছে। কেন এই ব্যতিক্রম তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একটি কারণ তো অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী চেতনার বিকাশ। একটি দেশ যখন ক্ষমতার শীর্ষে উঠে যায়, সামরিকভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠে, তখন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে প্রগতিশীল বৈশিষ্ট্যগুলো হারাতে থাকে। গ্রিক এবং রোমান সভ্যতার শেষদিকেও একই ব্যাপার ঘটেছিল। এর বাইরে, আরেকটি বড় কারণ, আমেরিকার পুঁজিবাদ ধর্ম জিনিসটাকেও আভ্যন্তরীণভাবে ব্যবসা’র পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। এখানে চার্চকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়, তা আসলে ধর্মীয় পরিবৃত্তির বাইরে গিযেও সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করে। সাধারণ বসন্ত উৎসব (ফল ফেস্টিভাল) থেকে শুরু করে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ক্লাসিক্যাল পিয়ানো বাজনার বেশিরভাগই এখানে চর্চাকেন্দ্রিক। এই ‘আমেরিকান অ্যানোমালি’ আর অস্বাভাবিক উপায়ে অর্জিত তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের কথা বাদ দিলে ধর্ম এবং দারিদ্র্যের একটা স্পষ্ট সম্পর্কই পাওয়া যায়। নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ এবং এ সংক্রান্ত প্রযুক্তির উত্থানের ফলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে তেলের দাম পড়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও এভাবে ব্যতিক্রম হিসেবে থাকবে না বলাই বাহুল্য।
এই দুই একটি অ্যানোমালি তথা ‘অস্বাভাবিকতা বাদ দিলে গ্রাফ থেকে ধর্ম এবং দারিদ্র্যের একটা স্পষ্ট সম্পর্কই পাওয়া যায়। গ্রাফ দেখলে যে কেউ বুঝবে যে দেশে ধর্মীয় প্রভাব যত বাড়ছে, সেইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দারিদ্র আর ধর্মীয় প্রভাব যেখানে কম মানুষের সচ্ছলতাও বেশি। ব্যাপার কী?
ব্যাপার তো সাদা চোখেই বোঝা যাওয়ার কথা। যে সমস্ত দেশ যত দারিদ্রক্লিষ্ট, সেসব দেশেই ধর্ম নিয়ে বেশি নাচানাচি হয়, আর শাসকেরাও সেসব দেশে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সেজন্যই দারিদ্রক্লিষ্ট দেশগুলোতে ধর্ম খুব বড় একটা নিয়ামক হয়ে কাজ করে সবসময়েই। কিংবা ব্যাপারটা উল্টোভাবেও দেখা যেতে পারে ধর্মকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া, কিংবা লম্ফঝম্ফ করা, কিংবা জাগতিক বিষয়আশয়ের চেয়ে ধর্মকে মাত্রাতিরিক্ত বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই সেসমস্ত দেশগুলো প্রযুক্তি, জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে এবং সর্বোপরি দরিদ্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার মোল্লাদের তোয়াজ করতে ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল। যে দেশ জাগতিক বিষয়ের চেয়ে ঠুনকো বিশ্বাস নিয়েই মত্ত থাকে, সে দেশ অর্থ-বৈভব জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে যাবে-এটা কি আশা করা যায়? ধর্মের রশি আমাদের পেছনে টেনে রেখেছে অনেকটাই। বিশ্বাসের ভাইরাসের এরচেয়ে বড় কুফল আর কী হতে পারে! তাই বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’ বলে কথিত বিশ্বাসীদের তোতা পাখির মতো আওড়ানো বহুল প্রচারিত উক্তিটিকে সামান্য বদলে দিয়ে আমরা বলতে পারি–
বিশ্বাসে মিলায় দারিদ্র্য, অবিশ্বাসে বহুদূর!
.
ভাইরাস প্রতিষেধক
তাহলে এই সন্ত্রাসের ভাইরাস প্রতিরোধ করা যায় কী করে? ভাইরাস যে প্রতিরোধ করতেই হবে-এ নিয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এ ভাইরাস প্রতিরোধ না করতে পারলে এ সভ্যতার ক্যান্সারে রূপ নিয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে। মুম্বাইয়ে ফিদাইন হানার পর পরই মুক্তমনায় লিখিত একটিপ্রবন্ধে ড. বিপ্লব পাল বলেছিলেন[৩২৫]–
রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ ইত্যাদির ধারণাগুলোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন হচ্ছে-তখন মধ্যযুগীয় ধর্মগুলোর আত্মিক উন্নতির কিছু বাণী ছাড়া আর কিছুই আমাদের দেওয়ার নেই। সেই আত্মিক উন্নতির নিদান ধর্ম ছাড়াও বিজ্ঞান থেকেই পাওয়া যায়-তবুও কেউ আত্মিক উন্নতির জন্য ধার্মিক হলে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু ধর্মপালন যখন তার হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়বোধকে উস্কে দিচ্ছে-সেটা খুব ভয়ংকর। ধর্ম থেকে সেই বিষটাকে আলাদা করতে না পারলে, এগুলো আমাদের সভ্যতার ক্যান্সার হয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে।
অর্থাৎ, এ ভাইরাসকে না থামিয়ে বাড়তে দিলে একসময় সারা দেহটাকেই সে গ্রাস করে ফেলবে। অধ্যায়ের প্রথম দিকে দেওয়া ল্যাংসেট ক্লক প্যারাসাইট আক্রান্ত পিঁপড়ার উদাহরণের মতো মানবজাতিও একসময় করে তুলবে নিজেদের আত্মঘাতী, মড়ক লেগে যাবে পুরো সমাজে। তাই কি আমরা চাই?
না, কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই তা চাইতে পারেন। তাহলে এই সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গড়ে তোলা দরকার অ্যান্টিবডি, সহজ কথায় তৈরি করা দরকার ভাইরাস প্রতিষেধকের। আর এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে আমার আপনার মতো বিবেকসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষেরাই। আমরা কিন্তু আসলেই মনে করি-এই অ্যান্টিবডি তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের মুক্তমনার মতো বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী সাইটগুলো; ভূমিকা রাখতে পারে বিশ্বাসের নিগড় থেকে বেরুনো মানবতাবাদী গ্রুপগুলো এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী ব্যক্তিবর্গ 26। দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার, দরকার খোলস ছেড়ে বেরুনোর মতো সৎ সাহসের, দরকার আমার-আপনার সকলের সামগ্রিক সদিচ্ছার। আপনার আমার এবং সকলের আলোকিত প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমরা একদিন সক্ষম হব সমস্ত বিশ্বাসনির্ভর ‘প্যারাসাইটিক’ ধ্যান ধারণাগুলোকে তাড়াতে, এগিযে যেতে সক্ষম হব বিশ্বাসের ভাইরাসমুক্ত নিরোগ সমাজের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
ড. ড্যারেল রে যে কথাগুলো বলে তার গড় ভাইরাস’ বইটি শেষ করেছেন[৩২৭],সে কথাগুলো উচ্চারণ করে আমরাও সমাপ্তি টানবো এই অধ্যায়টির–
ভাইরাসমুক্ত জীবনের আস্বাদন কোনো সুনির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, বরং একটি চলমান যাত্রাপথের নাম। আমরা সবাই এই ভাইরাস দিয়ে কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত এবং আমরা নিজেদের অজান্তেই বয়ে নিয়ে যাই অসুস্থ বিশ্বাস, মতামত কিংবা ধারণা। শিশু বয়সেই ধর্মীয় বিশ্বাসের পানপাত্র হাতে তুলে দিয়ে আমাদের অনেকের মাথাই আক্রান্ত করে ফেলা হয়েছে। আক্রান্ত মননকে প্রতিষেধক দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে ফেলাই হবে আমাদের যাত্রাপথের লক্ষ্য। আমরা যদি ঈশ্বর-ভাইরাসের কুফলগুলো সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন থাকতে পারি, তবেই আমরা ভাইরাসমুক্ত সমাজ প্রত্যাশা করতে পারি।
আমাদের ধারণা, নতুন দিনের নাস্তিকেরাই ভাইরাস মুক্ত সমাজ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। আর নতুন দিনের নাস্তিকদের ক্রমিক প্রচেষ্টার কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হবে পরের অধ্যায়ে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন